নাট্য সংগঠক ও শিক্ষক কুমার রায়

ড. বিশ্বজিৎ মণ্ডল

অধ্যাপক কুমার রায়

 বহুরূপীর বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে কুমার রায়ের সম্পর্ক শৈশব থেকে। এই দীর্ঘদিনের ভিজ্ঞতায় বাংলা থিয়েটারের আঙ্গিনায় মঞ্চ, পোষাক, সঙ্গীত পরিবেশনা প্রভৃতি সর্ব ক্ষেত্রে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তার কর্মের মধ্যে বৈচিত্রের স্বাদ পাওয়া যায়। এর প্রস্তুতিকাল খুব ছোটবেলা থেকে শুরু হয়েছিল। আধুনিকতার ছোঁয়া সর্বসময় সাধারণ স্রোতের উল্টোমুখে হাঁটে। প্রত্যেক যুগেই আধুনিকরা আসে এবং তারা সবসময় চলমান থাকে, এই চলমানতা পুরোনো কর্ম ঝেড়ে ফেলে নতুন কর্মের দিকে এগিয়ে যায়। কুমার ঠিক তারই একজন অগ্রদূত। তিনি কখনও পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইতেন না। একটা চিন্তার পেছনে তাঁর আর একটা চিন্তা কাজ করতো। মঞ্চ,পোষাক,অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে একাত্ম হওয়ার কথা ভাবতেন। সেই ভাবনা থেকেই বিভিন্ন মুহূর্তে নাটকীয় সংঘাত উঠে আসত। তাঁর চিন্তা,চেতনা সবসময় একটা নিজেস্ব মৌলিক কোনো আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা করতো। তাঁর কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাথমিক ব্যাপার ছিলো শিল্প স্বয়ং। মানুষের মধ্যে শিল্পবোধ জাগিয়ে তোলা দর্শকের রুচির দোরগোড়ায় সঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া নাটকের মূল উদ্দেশ্য। নাটক পরিচালনার মধ্যে বিপুল বৈচিত্র নিয়ে আসা, আধুনিক বুদ্ধিজীবি মননকে তুষ্ট করতে পারা, মানুষের মনে ভেসে ওঠা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সেগুলি সমালোচনামুক্ত করা ছিলো তাঁর লক্ষ্য। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পঁচিশ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে প্রায় উনিশটি নাটকে তিঁনি নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন। নাটক পরিচালনার প্রথম পট অর্থ্যাৎ নাটক নির্বাচন করা, নাটক পড়া ইত্যাদি এইসমস্ত কাজগুলি করার সময় কোনোরকম অসম্মতির উপর পরতে হয়নি। ফলে সেই কাজটি তিঁনি খুব অনায়াসে করে ফেলতে পারতেন। নাটক বাছাই করার ক্ষেত্রে দেখা যায় তার বৈচিত্রের সন্ধানই নানাধরণের নাটক করার ব্যাপারে তাঁর খুব উৎসাহ। একটি নাটক বাছাইয়ের পর অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্বস্তভাবে একটি চরিত্রকে দাঁড় করিয়ে দিতেন। এইভাবে তিঁনি বাংলানাট্যের প্রায় প্রতিটি বিভাগে তাঁর অবদান রেখে গেছেন। মানুষ হিসেবে তিঁনি ছিলেন অত্যন্ত পরিমিতি বোধ সম্পন্ন। কোনো চরিত্রের স্বাভাবিকতাকে তিঁনি নষ্ট হতে দেননি। কবি শঙ্খ ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন বই থেকে কিভাবে এক একটা সংলাপ সত্য হয়ে ওঠে মঞ্চে, বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের সংলাপ, তাঁর ভাষণের মধ্যে তৈরী হয়ে উঠতে থাকে একটি বাচিক অভিনয় ও তার নানা স্তর-স্তরান্তর। এ হল শিল্পচর্চায় কোনো একটা পরম কিছুকে ছুঁতে পাবার সম্ভাবনার কথা, সেটা যে অল্প সময়েই পাওয়া যায়,সেখানে পৌঁছতে যে নিরন্তর সাধনা লাগে এই বিষয়টি কুমার রায় নিজে যেমন অন্তস্থ করেছিলেন তেমনি তার সান্নিধ্যে আসা সমস্ত শিষ্য এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও এই চিন্তার বীজ বপন করতে তিঁনি সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। তাই তিঁনি প্রকৃত নাট্য শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ছেলেবেলা থেকে বাড়ির আঙ্গিনায় ছবি আঁকা, অভিনয় করার নেশা সবসময় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াতো। ওর মানসিক প্রস্তুতির জন্য বহুপথ অতিক্রম করতে হয়েছে। এর জন্য পরবর্তীকালে নাটকের ছেলে-মেয়েদের তিঁনি নানা বেড়াজাল টপকে সেই পথের দিশারী করে তুলতেন, তিঁনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন নাটকের প্রতিটি ডায়লগকে ভিসুয়ালাইজ করতে হবে, সেইদিক থেকে তাঁর ছিলো অসাধারণ ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার জন্য প্রতিটি সিনকে একটার পর একটা মঞ্চে দাঁড় করিয়েছেন। কুমার রায় ছিলেন নানা কাজের মানুষ। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে থিয়েটারকেও একটা কাজ হিসেবে ভাবতেন, এবং নাটকের ছেলেমেয়েদেরকেও সেই ভাবনায় ভাবিত করে তুলতেন। কুমার রায়-এর আর একটি পরিচয় রয়েছে, তিঁনি একজন বড় মাপের প্রশিক্ষক। একটা নাটককে কিভাবে মঞ্চায়ন করতে হয় অর্থ্যাৎ কিভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং একটা চরিত্রকে মঞ্চে দাঁড় করাতে হলে তাকে সেই চরিত্র সম্পর্কে কল্পনা করতে হবে। সেই কল্পনার মধ্যে যে নতুন কিছু আবিস্কৃত হবে সেই আবিস্কারকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করতে হবে। তারপর তার থেকে পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি বেড়িয়ে আসবে। যতক্ষণ না কোনো প্রতিচ্ছবি মানসলোকে ধরা পড়ছে ততক্ষণ কল্পনাশক্তি দিয়ে সেটা পরিপক্ক করে তুলতে হবে। এই যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নাট্যপরিচালক ও অভিনেতাদের জীবনে একটা অভিরূপ সৃষ্টি করেন এই কথাই তিঁনি ছাত্র-ছাত্রীদের সবসময় বোঝাতেন। কুমার রায় একজন স্বাধীন শিল্পী। থিয়েটারে সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ, তিঁনি একাধারে যেমন নাট্যপরিচালক, অভিনেতা, মঞ্চশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী তেমন অন্যদিকে তিঁনি একজন নাট্যসংগঠক। তাঁর অবিস্মরণীয় ও মৌলিক চিন্তা-ভাবনার জন্য তিঁনি নাট্যকর্মীদের কাছে শিক্ষক হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন।

তিঁনি সবসময় বাস্তবের আঙ্গিনার মঞ্চের কাঠামোকে বাঁধতেন, সেই বাস্তব হচ্ছে একজন শিল্পীর বাস্তবতা,  যারা মঞ্চের মধ্যে আবর্তন করতেন। এমনকী যারা নেপথ্য শিল্পী হিসেবে কাজ করতেন তাদের বোধ ও বোধির অভিনয়ের প্রতিটির অঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেটাকে আমরা বিশেষ করে থিয়েটার কর্মী ও দর্শক হিসেবে উপলব্ধি করতে পারি। আজও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই নিজের অজান্তে কুমার রায়ের মননশীলতাকে অনুকরণ করে চলেছে। নাট্যপরিচালক মেঘনাথ ভট্টাচার্য্য বলেছেন,“আমাদের সমস্ত নাট্যকর্মীদের শেখা উচিত কিভাবে জীবনকে, থিয়েটারকে দেখতে হয়, বিচার করতে হয়। কিভাবে নিজেকে আড়ালে রেখে সচেতনভাবে এক নতুন ধরণের নাট্যশিল্প গড়তে যৌথ উদ্যোগের সামিল হতে হয়, নেতৃত্ব দিতে হয় কতটা নীরবে, কতটা প্রচার বিমূখ হয়ে।” কুমার রায়কে শুধুমাত্র অভিনেতা বা নির্দেশক বললে তাঁর কাজের পরিধিটা ছোট হয়ে যায়। থিয়েটারের জগতে অনেক কর্মী আছেন যারা কুমার রায়ের ছাত্র-ছাত্রী, মঞ্চ পরিকল্পনা, পোষাক, নাটকের সংগীত ও বিভিন্ন বিষয়ে কুমার রায়ের সঙ্গে থেকে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। তাঁর প্রতিটি প্রযোজনা নবীন অভিনেতাদের কাছে শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠত।

নাট্যসংগঠক হিসেবেও কুমার রায়ের আর একটা গুণ হলো সংযম এবং সতর্কতা। তিঁনি দলের মধ্যে নেতাগিরিকে প্রশ্রয় দিতেন না। এই কারণে নাট্যজনেদের কাছে অনেক সম্মানে ভূষিত হতে পেরেছেন। যিনি পরিচালক হবেন বা নির্দেশক তার রীতিজ্ঞান সম্পন্ন এবং দক্ষ হওয়া চাই। এর সব গুণই ছিলো কুমার রায়ের মধ্যে, যার জন্য তিঁনি সব অভিনেতাদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। অভিনয়ের পেছনে মনন, নিষ্ঠা এবং পারদর্শিতা একসঙ্গে কাজ করতো। অভিনীত চরিত্রগুলির প্রত্যেকটাকে অভিনয়ের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেন। নানাদিক থেকে একটা বাধা আসা সত্যেও নিজেস্ব কলাকৌশলের দ্বারা অতিক্রম করতেন। তাই কুমার রায়কে একটি নতুন যুগের স্রষ্টা বলা যেতে পারে। বহুরূপী নাট্যদলের বহু প্রযোজনা তৈরী হয়েছে তাঁর হাত ধরে। নতুন ধারার থিয়েটার নিয়েই সারাজীবন তিঁনি ব্যস্ত থেকেছেন। দেশী-বিদেশী অনেক নাটক প্রযোজনা করেছেন। শুধুমাত্র যারা অভিনয় করেন তাদের নিয়ে ব্যস্ত না থেকে নাট্যের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করতেন। যেমন মঞ্চ, আলোক, পোষাক, রূপসজ্জা সব বিষয়ের দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। দলের কর্মীদের মধ্যে যে যেরকম কাজ পছন্দ করতো তাকে সেই ভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন। সেইসব কর্মীরা নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সুপ্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। নাট্যজগতের এই সম্মিলিত প্রয়াস বা তার সাংগঠনিক প্রতিভা ও দক্ষতা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভাবনার দিক উন্মোচিত করেছে। অধ্যাপক দেবাশিস রায়চৌধুরী বলেছেন-“রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে তাঁর জীবন ও জীবিকা এক হলেও তিঁনি যে এক সুশৃঙ্খল শিক্ষাব্রতী ছিলেন তার কারণ হলো বহুরূপীর মতো নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা, এত জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন যে ছাত্রদের দাবীতেই নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধে আমাদের নাট্যবিভাগে বেশ কিছু উন্নতমানের প্রযোজনা করেছেন। তাঁর কাছে নাট্যসাহিত্যের পাঠ নিলেও কোনো নাট্য প্রযোজনার সময় তিঁনি হতেন অভিনয় শিক্ষক তথা নাট্য নির্দেশক (নাট্য আকাশবাণী প্রবক্তা ১৪)।” 

কুমার রায় ছিলেন একজন প্রোথিতযশা শিক্ষক এবং একজন নাট্যসংগঠক। এ বিষয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন –  “শম্ভু মিত্রের উদ্যোগে যে বহুরূপী স্থাপিত হয়েছিল সেখানে অনেক নাট্যব্যক্তিত্য ছিলেন। তুলসী লাহিড়ী, গঙ্গাপদ,মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য এইরকম অনেক নাট্যব্যক্তিত্য, সেই বহুরূপীকে তিঁনি ধরে রেখেছেন। এখনও বহুরূপী নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ করছে। বহুরূপী নামের যে পত্রিকা সেটাকেও তিঁনি সচল রেখেছেন। অনেক নাটকের পত্রিকা শুরু হয় আবার বন্ধ হয়ে যায়। তাই বাংলায় যেরকমভাবে উল্লেখযোগ্য নাটকের পত্রিকা আর নেই, বহুরূপীই রয়ে গেছে এখনও। আমরা তো এখনও বাংলা নাটক সম্পর্কে চিন্তা করতে গেলে প্রথমে কুমার রায়ের কথা মনে পড়ে। গ্রুপ থিয়েটার যে পথ নির্দেশ করেছে বহুরূপী তার অগ্রগামী।” এই সাংগঠনিক ক্ষমতা নিয়ে বাংলা থিয়েটারের ভিতকে তিঁনি সুদৃঢ় করেছিলেন। তিঁনি শুধু থিয়েটারে নন্‌ সাহিত্য, চিত্রকলা , সঙ্গীত ইত্যাদি শিল্পের নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজও করেছিলেন। থিয়েটারের মতো একটি শিল্পরূপের জন্য জীবনপণ করা সামান্য কৃতিত্ব নয়। অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী তাঁর কাছে সংলাপ বলার ভঙ্গী, শব্দের উচ্চারণ, কণ্ঠস্বরের নিয়ন্ত্রণ, শরীরের ব্যবহার ইত্যাদি নানাবিষয়ের তালিম পেয়েছেন। থিয়েটারে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে চরিত্রাভিনয়ের নতুন বৈশিষ্ট সৃষ্টি করে সেগুলি মঞ্চায়নের মাধ্যমে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। তাঁর নাটকের বিচার বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা যখন ছাত্র-ছাত্রীরা  আলোচনা করতেন তখন মনে হত পূর্বের কোনো শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নানাভাবে বিস্তার করে দিচ্ছেন। তিঁনি সবসময় বলতেন কোনো তাত্ত্বিক বিষয় আলোচনা না করে জীবনকে সহজ ও সহানুভূতিশীল করে তুলতে হবে।

“গত ৬২ বছর বহুরূপী নাট্যপত্র প্রকাশ পাচ্ছে। প্রথম প্রকাশ ১৯৫০ সালে মে মাসে, প্রথম ৩৫ সংখ্যার সম্পাদক গঙ্গাপদ বসু(১৯৫০-র সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭০)। ২২শে মে ১৯৭১-এ গঙ্গাপদ বসুর প্রয়াণ ঘটে। ৩৬ থেকে ৪৯ সংখ্যা সম্পাদনা করল শম্ভু মিত্র। (১৯৭১ থেকে ১৯৭৮) তাঁর সহযোগী সম্পাদক চিত্তরঞ্জন ঘোষ। ৫১ সংখ্যা থেকে প্রধান সম্পাদক কুমার রায়। (১৯৭৯ জুন – ২০০৬) তাঁর সহযোগী সম্পাদক চিত্তরঞ্জন ঘোষ এবং প্রভাত কুমার দাস। ১৯৭৮-এ শম্ভু মিত্র বহুরূপী ছেড়ে চলে গেলেও তার নির্দেশিত পথ ও ভাবনা – আদর্শই দল ও নাট্যপত্র চলতে থাকে কুমার রায়ের যোগ্য নেতৃত্বে।”৪  এর থেকে অনুধাবন করা যায় শুধু নাটক পরিচালনা বা অভিনয় নয়। থিয়েটারের সামগ্রিক বিষয়ে তার দক্ষতা পারদর্শিতা ও নিষ্ঠা দিয়ে শম্ভু মিত্রের পরবর্তী বহুরূপীকে তিনি একটি মজবুত সংগঠনে পরিণত করায় যে কৌশল, যে কর্মদক্ষতা তা যথাযথভাবে পালন করেছেন বলে থিয়েটারের মানুষেরা আজও স্বীকার করেন। 

এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৌমিত্র বসু বলেছেন –“১৯৮০ সালে হঠাৎই মারা গেলেসভাপতি অনিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জায়গায় দলের সভাপতি হলেন কুমার রায়। খুবই টালমাটালের সময়ে তাঁকে দলের হাল ধরতে হয়েছে। একদিকে যেমন শম্ভু মিত্র ও শাঁওলী মিত্র ছেড়ে দিয়েছেন দল, তৃপ্তি মিত্রও কিছুটা নিষ্ক্রিয়, তার মধ্যে দল ছেড়ে দিলেন রমাপ্রসাদ বণিক এবং আরও তিনজন তরুণ, তৃপ্তি মিত্রও পদত্যাগ করলেন শেষ পর্যন্ত। রমাপ্রসাদরা তৈরী করলেন চেনামুখ নাট্যগোষ্ঠী; তৃপ্তি মিত্র হল সেই দলের সভানেত্রী। বলা বাহুল্য, প্রচুর গুজব এখন ছড়িয়ে যাচ্ছে বহুরূপীকে নিয়ে, সেই সময় শান্ত মনে শুধু প্রযোজনার কথা ভাববার অবকাশ ছিলোনা। মনে পড়ছে, সেই সময়েই একদিন রাত্রিবেলা দরজা ভেঙে চুরি হয়  বহুরূপীতে। পরেরদিন বিশাল মাপের এক তালা কিনে লাগানো হল দরজায়। বলাই গুপ্ত তারঁ অবিশ্বাস্য সরল গলায় বলেছিলেন – ‘বাব্বা, এ তো লক্‌আউটের তালা।’ হাসির কথা, কিন্তু শুকনো ঠোঁটে আমাদের হাসিও ফোটেনি অনেকের। তখন তো বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, বহুরূপী  শেষ হয়ে গেল এবার। এই সংকট এবং দলের আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে বার করে আনতে কুমার রায় নির্দেশক হিসেবে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা করে গেছেন। দলের সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন নায়ক হেসেবে, এবং এইভাবে দলকে আবার এক শক্ত ভিতের ওপড় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। শুধু আশি সালে নয়, পর পর বেশ কয়েক বছর ভাঙন যেন তাড়া করে ফিরছিলো তার দলকে। দল থেকে চলে গেলেন শান্তি দাস, কালিপ্রসাদ ঘোষ, অমর গাঙ্গুলি, দেবতোষ ঘোষ। এ তো কেবল  অভিনেতাদের চলে যাওয়াই নয়, যাঁদের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে চিনতেন, সেই সুবাদে পাশে থেকে পরামর্শ দিতে পারতেন, বুঝতে পারতেন অনেক না বলা ব্যকুলতা, আবেগ, তাঁদের অভাবে আরও বেশি বেশি করে একা হয়ে যাওয়া, তাঁদের জায়গায় নিশ্চই নতুন মানুষ আসেন, তৈরী হয় নতুন সম্পর্ক, কিন্তু পুরনোদের জায়গা কি আর নেওয়া সম্ভব? দীর্ঘ বহুরূপী জীবনে অনুমান করতে পারি, একা থেকে আরও একা হয়ে যেতে হয়েছে তার এই প্রধান স্থপতিকে।”৫ 

কুমার রায়ের যে গুণগুলো বাংলা রঙ্গমঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছিলো সেই গুণাবলীর মধ্যে বিশেষ এবং প্রধান গুণ সংগঠক হিসেবে নিজের জীবনাচরণকে তিঁনি কোনো বিতর্কের মধ্যে রাখতেন না। তাঁর স্বভাবের মধ্যেই ছিল অপরিমেয় সংযম এবং সতর্কতা। তিঁনি কখনওই থিয়েটার দলের মধ্যে কেউ একজন তারকা থাকবেন এটা তিঁনি বিশ্বাস করতেন না। তিঁনি বিশ্বাস করতেন দলে সকলের সমান অধিকার এবং মর্যাদা থাকবে, কমবয়সী হলেও সাংগঠনিক মর্যাদায় তিঁনি গুরুত্ব দিতেন। তিঁনি আচার-আচরণে কখনওই ভদ্রতা এবং সংযমের গণ্ডী না ছাড়িয়েও হো হো করে প্রাণ খুলে হাসতে পেরেছেন, স্নেহের সম্পর্ক তৈরী করতে পেরেছিলেন তাঁর ছাত্র-ছাত্রী সুলভ নাট্যকর্মীদের কাছে। কুমার রায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডঃ অশোক মিত্র তাঁর একটি লেখাতে বলেছেন – “আমার বার বার মনে হয়েছে যে বাংলা ও বাঙালীর সংস্কৃতির ও বাঙালী সৌজন্যের পরাকাষ্ঠা কুমার রায়ের মধ্যে দেখেছি। এই মানুষটির মধ্যে একধরণের মহত্ত্ব দেখেছি, যেটা বাঙালী মহত্ত্ব এবং যেটা সমাজের শতস্খালন সত্ত্বেও আমাদের বাঙালী হিসেবে গর্ব বোধ করতে সাহায্য করে।” 

তথ্যসূত্র

বিশেষ কুমার রায় সংখ্যা –

১। বহুরূপী পত্রিকা – ১১৪/অক্টোবর ২০১৪।

২। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমী পত্রিকা – কুমার রায়, মার্চ ২০০৬।

৩। ইলোরা পত্রিকা – ১১ বর্ষ, ২০০৬।

৪। ইলোরা পত্রিকা – ১১ বর্ষ, ২০০৬।

৫। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমী পত্রিকা – মার্চ ২০০৬।

৬। নাট্য মুহূর্ত – কুমার স্মারক বক্তৃতা – ২০১৩।                             

Features for Style Identification of Hindustani Musicians

Dr. Kaushik Banerjee, Dr. Anirban Patranabis, Dr. Ranjan Sengupta, Dr. Dipak Ghosh

Sir C V Raman Centre for Physics and Music, Jadavpur University, Kolkata 700032

Abstract

Identification of style of a musician is hard to recognize by an amateur listener, but to expert music listeners or to the musical ears just one or two strokes are enough to recognize. So, what are the physical causes behind this mystery? Our aim is to find out those causes and analyze in such a way that could satisfy the musical standpoints. Important elements from the physical perspective are steady states of notes and silence. Steady states of note recognize prominent presence of a note. Number of occurrence of a note in a signal articulates the importance of that note. Use of silence is also a style statement of a good musician and it varies from one musician to another. There are some unique musical ornaments like Meend which is exclusively use in Indian music. Measure of silence, steady states and meend are good parameters for style analysis.

Introduction

A music genre is a conventional category that identifies some pieces of music as belonging to a shared tradition or set of conventions. It is to be distinguished from musical form and musical style, although in practice these terms are sometimes used interchangeably. An artistic form of auditory communication incorporating instrumental or vocal tones in a structured and continuous manner is expressive style.

Ustads used to be very orthodox in general but there were few exceptional personalities like: Ustad Wazir khan, a descendent of Mian Tansen through daughter’s lineage (Senia Binkar Gharana) (B K Roy Chowdhury, 1974). He taught Ustad Allauddin Khan, founder of Senia Maihar Gharan and one of the legendary musicians of 20th century. Along with Wazir Khan, Allauddin Khan also learnt from about ten more gurus (teachers) (K Banerjee, 2007).

 As a result, he had a huge musical knowledge over different musical instruments and Gharanas. At the same time, he was much liberal in all respect of his contemporary musical legends. His authority and authenticity of knowledge over different musical instruments reflected on his disciples (Pt J Bhattacharjee, 1999).  Some of them were would be legends of the next century. We include two of them in our study; one is Pandit Ravi Shankar and the other is Pandit Nikhil Banerjee. Noticeably, both of them were Sitar player from Senia Maihar Gharana but their playing styles were different. 

    Sahabdad Khan, a great exponent of Sarengi and also played sitar and surbahar of 19th century. He used to stay at Etawah from which his Gharana has been known as Etawah Gharana. Sahabdad’s son Imdad khan was born in Etawah, later he went to Indore where he got talim from great binkar Ustad Bande Ali Khan (H K Roy Chowdhury, 1929). His rigorous practice and fast Gat-tora playing in sitar is still hearsay to the musicians. He was one of the greatest sitar and surbahar players of his time. His unique style of sitar and surbahar playing made him legend and since him Etawah Gharana is also known as Imdadkhani Gharana. He used to play Alap-jore and Jhala on surbahar followed by Gattora on sitar (S Bhattacharya, 1999).  This style was also maintained by his able son Ustad Inayet Khan (H K Roy Chowdhury, 1929).

 Among his two sons Vilayet Hussein Khan was elder. When he was born Inayet Khan was court musician of Gouripur of Mymensingh, East Bengal (now Bangladesh). Due to Inayet Khan’s premature death, Vilayet Khan’s musical talim was mostly from his uncle Wahid Khan and maternal grandfather Bande Hassan Khan (K Banerjee, 2007). He also acknowledged the influence of Ustad Ali Akbar Khan (K Banerjee, 2007). Hence, his style of playing was a little bit different. Though he used to play both surbahar and sitar but he started his career as a sitar player and as a representative of Etawah or Imdadkhani Gharana.

It is fact that changing political situation transforms the entire socio-economic condition, or better to say, total ambience of a country, and this was happened to Indian subcontinent during early to mid of 20th century. It was a Juncture to India in all respect. However, through the musical perspective, it was really a crucial period. Raja-maharajas lost their power, Zamindari system was also abolishing. Ultimately, musicians, especially great musical legends were in perplexed conditions. Once, they have to only satisfy the king and his courtiers who were mostly connoisseur of music. And in exchange of that, they used to get secured and luxurious life as per their excellence and family background. Now, they have to please the common people with a different musical sense. Like this ambiance and time, Ravi Shankar, Vilayet Khan and later Nikhil Banerjee started their musical career (K Banerjee, 2007) and within few years they have become the most famous sitar players and faces of India to the world. So, these are the cause to choose three legends music for our current experiment.

Thus, here style refers to individual identity, excellence, along with presence of all characteristics of Gharana which expressed through playing of same music (raga) on the same musical instrument. It was observed that, at the time of rendition all of them depending on few musical ornaments which convey their attitude best. For that reason, while one artist depending on meend, gamakas, other on deferent variation and fraction of laye (tempo), krintan, jamjama, and remaining artist on meend, fast tans etc.          

Previous works on style analysis are mostly on western music like: classification of Western music genres using melodic features computed from pitch contours (J.Salamon et al.2012). Jan LaRue (1981) attempted to classify audio signals according to their cultural styles by using characteristics like timbre, rhythm and musicology-based features. These research papers either classify western musical genre or are based on categorization of sound, melody, harmony, rhythm to recognize composers in conceptual patterns etc. In the domain of Hindustani music there are very few works have been reported. Datta A.K. et.al. (2017) have done some computational analysis for automatic recognition of raga. Vidwans A et.al (2012) have detected Indian classical vocal styles from melodic contours. Feature based computational approach for style identification in Hindustani music is scarce. Present study identifies the style and the similarity and differences in the music of three maestros.

Experiment

Three raga renderings in raga ‘Bhairavi’, ‘Darbari’ and ‘Kafi’ played in Sitar by renowned artists like Nikhil Banerjee, Ravi Shankar and Vilayat Khan was collected from different archives. Thus a database consists of nine signals each of one minute durations was formed. Each raga has some common phrases. All the signals were digitized at a sampling rate of 44100Hz (16 bits per sample) in mono channel. From each signal, detection of the tonic ‘Sa’ position, extraction of other notes (with pitch value) and pitch profile and other respective and essential procedures regarding this experiment were done as per our previous research works (Banerjee. K et. al. 2012, Datta A. K et al 2006, Datta A.K et al 2009).Following are the key features which identifies the style of playing of anartist’s: (a) frequency of uses of each notes – compared for all raga renderings for all notes used. This reflects the preferences of using touching notes and long notes. (b) Duration of notes – compared for all raga renderings for all notes used. In some rendering we found a very strong preference for a single note while in other an equal weightage was given to two or more notes. (c) Duration of silence – reflects the tempo and artist’s mood during the performance. (d) Total number of steady states and total duration of steady states and (e) Duration of transition between notes – unveiled the artist’s mood. In Indian classical music, transition between notes is one of the most important features of expertise and renowned artists’ love using transition notes. (Datta et al, 2017). Although timbre is an important characteristic in distinguishing sound signals we have emphasized on musicological perspectives only.

Results

Figure 1: Note duration in second for three ragas and for three artists

Steady states of note recognize prominent presence of a note. Number of occurrence of a note in a signal articulates the importance of that note. And in this way we can get Vadi, Sambadi, Anuvadiand Barjit notes. Specific notes associated with each stroke made on the main strings as well as the sympathetic and chikari strings were taken into consideration. From figure 1 it is observed that due to the presence of sympathetic and chikari string vibration, the note ‘sa’ is the most dominant note and this is one of the important sound characteristics of Indian plucked Musical Instruments with sympathetic strings like sitar. Although the phrases of the three ragas remain same, it is observed that the notes played by the three maestros are totally dissimilar from each other. Unlike western music there is no fixed rule of using notes in Hindustani music (HM) but fixed combinations of note exist for a given raga. In HM, other than Chalan (ascending-descending movement of notes in such a way which is specific for each raga) and Pakad (minimum combination of notes that exactly convey a particular raga), there is no fixed rule like western music. Artists played the notes of their own style keeping the phrasal pattern and mood of the raga constant. Thus artists improvise their performances with various combinations of notes.

Figure 2: Ratio of average silence duration to note duration

Silence is like colours of the canvas upon which music is painted. Proper utilisation of silence in HM is one of the key factors that affect the listener. Without silence the music would be mere noise to the listeners. In Hindusthani music, a good musician learns from his/her guru how to take intervals in making notes prominent (Vadi, Samvadi etc.) or in between Tan/Tora etc. Later, at the time of rendition, conscious practice goes in their subconscious mind and they do it very naturally. Amazingly, the use of silence is also a style statement of a good musician and it varies from one musician to another. So, measure of silence is a good parameter for style analysis. So the coherence of notes and silence is very important in HM. Therefore, the length of silence and the ratio of silence duration to the note duration are important features to identify the style of an artist. We have measured all the silence and note durations for all the signals. Then we measured the ratio of the average of silence and note durations and are shown in figure 2. The figure is self-explanatory and clearly distinguishes the style of the three artists. A low value of silence to note ratio indicates a less silence duration while larger silence to note ratio indicates longer silence duration. In all the three renderings of Ravi Shankar larger silence to note duration is found and hence silence zones are dominating in his renderings. Average note duration and number of notes played by Ravi Shankar is less than the other two artists.  He also played more short durational notes than long durational notes. In all the renderings of both Nikhil Banerjee and Vilayat Khan a smaller value of silence to note duration is found. A minute observation indicates a larger silence duration for Nikhil Banerjees’s renderings than compare to Vilayat Khan’s rendering. But a very little difference in average note duration is observed among the two artists. But again a minute observation indicates that Vilayat Khan played much more long durational notes than Nikhil Banerjee in all the three renderings. Hence we may conclude as that Ravi Shankar’s style includes longer silence duration but smaller note duration with more number of notes, while Vilayat Khan’s style includes smaller silence duration with long durational notes. In comparison with the two artists Nikhil Banerjee’s style is in between the two. So these two features are very important cue to distinguish style of musicians.

Figure 3: Scatter plot of total number of steady states

We also measure the steady states of the sound signals of the main strings only. We considered a note duration greater than 100 ms as a steady state. We have measured number of such steady states and also the total duration of steady states. Scatter plots of total number of such steady states are shown in figure 3 and a bar diagram of average duration of steady states for all the ragas is shown in figure 4. A lowest number of steady states are observed in the renderings of Nikhil Banerjee but his style of music includes very long durational steady state notes. In comparison with the other two artists he played least number of long durational notes but longest stead state duration. Although Vilayat Khan played long durational steady state notes, he played lesser number of steady state notes. Ravi Shankar’s style of music shows a highest number of steady state notes but average duration of steady states is smallest in comparison with the other two artists. Hence figure 3 and 4 clearly distinguish the style of three artists. In general, Ravi Shankar played frequent but shorter durational note while both Nikhil Banerjee and Vilayat Khan are comfortable with long durational note. It is also observed that the average steady state durations of raga Bhairavi is almost similar for all the three artists but for the other two ragas no such similarity is observed.

Figure 4: Average duration in millisecond of steady states for three ragas and for three maestros

Figure 5: Total meend (transition between notes) duration

Another important feature for style analysis is the transition between notes. Transition between two notes with a sliding tone is known as Meend in Indian classical music. It is an essential and integral part of Indian classical music that gives the essence of Indian classical music which is strictly prohibited in western music (Datta et. al, 2009). Pitch transition and note sequence are significant to the listeners in identifying the melodic similarity (Datta et. al, 2009). We had identified the transition area between notes used by the artist and measured the total transition time for the whole signal. Figure 5 shows the total transition time for all the nine signals. It is observed that Ravi Shankar played shorter meend in all the three ragas. But no such consistency is observed for the other two artists. Nikhil Banerjee played shorter meend in raga Bhairavi and Kafi but he played longer meend in raga Darbari. Vilayat Khan played longer meend in Bhairavi and Darbari but he played shorter meend in Kafi. Utilisation of gliding notes is different for individual artists. For the raga kafi all the three artists played the gliding notes almost with equal transition time. For raga Bhairavi Nikhil Banerjee and Ravi Shankar both played the gliding notes with equal transition time but Vilayat Khan used much longer transition time in the said raga. All the three artists played the meend differently in raga Darbari. So Ravi Shankar’s style of music can be identified illicitly by the parameter transition time between gliding notes. 

Conclusion

Due to the presence of sympathetic and chikari string vibration, the note ‘sa’ is the most dominant note and this is one of the important sound characteristics of Indian plucked Musical Instruments with sympathetic strings like sitar.

The length of silence is an important measure of style recognition. Also the ratio of silence duration to the note duration is important features to identify the style of an artist.

Each artist has different tendency of playing steady notes and steady state duration is unique for an artist.

Transition time between successive notes is different for different artists. Preferences of using number of notes during meend production are also unique for an artist.

This study helps the amateur learners to follow the styles of successful and famous artists.

References

Banerjee.K, Patranabis. A, Sengupta, R and Ghosh. D (2012), “Search for spectral cues of emotion in Hindustani music”, Proceedings of the National Symposium on Acoustics-2012 (NSA-2012), 5-7 December, KSR Institute for Engineering and Technology, KSR Kalvi Nagar, Tiruchengode – 637215, Tamilnadu.

Banerjee Kaushik (2007), “Bharatiya Sangeeter Bikash O Antarjatikikarane Ustad Allauddin Khan Ebong Tar Uttarsurider Aabodan (Bengali)”, Thesis paper (unpublished) Rabindra Bharati University, Kolkata.

Banerjee Kaushik (2017), Indian String Musical Instruments –Making &Makers, Parul Prokashani Pvt. Ltd., 1st edition, . ISBN 978-93-86186-61-4. KOLKATA, 2017

Datta A K, Sengupta R and Dey N (2009), ―’Objective Categorisation of Meends from Hindustani vocal performances’, J Acoust. Soc. India, Vol. 36, No. 2, pp. 92-95.

Datta A K, Sengupta R, Dey N and Mukherjee A K (2006). ―’A methodology of note extraction from the song signals’, Proc. Int. Symposium- Frontiers of Research on Speech and Music, U P Technical University, Lucknow, India.

Datta A K, Sengupta R, Dey N and Nag D (2006); “Experimental Analysis of shrutis from performances in Hindustani music”, Monograph published by ITC Sangeet Research Academy, Kolkata, ISBN 81-903818-0-6.

Datta A K, Sholanki S S, Sengupta R, Chakraborty S, Mahto K and Patranabis. A et. al. (2017), “Signal Analysis of Hindustani Classical Music” Pub- Springer, 2017, ISSN 1860-4862, ISBN 978-981-10-3958-1.

Ghosh Laxmi Narayan (1975), Geet – Baddyam:, Pub: Pratap Narayan Ghosh, 1st edition, Calcutta 1975.

Liu Y, Xiang Q, Wang Y and Cai L (2009), “Cultural Style Based Music Classification of Audio Signals,” Acoustics, Speech and Signal Processing, IEEE International Conference on Acoustics, Speech and Signal Processing.

Miner Allyn (1997), Sitar and Sarod in the 18th and 19th Centuries, published by – Motilal Banarsidass Publishers PVT. LTD, First Edition 1997, Delhi.

Pandit Ravi Shankar (1999), Rag-Anurag, edited by Shankarlal Bhattacharya, Ananda publishers, 1st edition, 3rd print, Calcutta (1999). 

Pandit Bhattacharjee Jotin (1999), Ustad Allauddin Khan O Aamra (vol- II), Pub- Amit Bhattacharjee, 1st edition, January 1999, Calcutta.

Roy Chowdhury Harendra Kishore (1929), The Musicians of India (illustrated) Part-1(reprint), Kuntalin Press (1929), Calcutta.

Roy Choudhury Bimala Kanta (1974), Bharatiya Sangeet Kosa, Calcutta, Kalika press.

Salamon J, Rocha B and Gomez E (2012): “Musical Genre Classification using Melody Features extracted from polyphonic music signals”, IEEE International Conference on Acoustics, Speech and Signal Processing.

Vidwans A, Ganguli K K and Rao P (2012), Classification Of Indian Classical Vocal Styles From Melodic Contours, Proc. of 2nd CompMusic Workshop, Istanbul, Turkey, 12-13, July.

ফিরে দেখা : কলকাতায় সরোদ চর্চা

পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 সরোদ যন্ত্রের সৃষ্টিতে ভারতে আসা আফগানকে ব্যবসায়ীদের উত্তরসূরীদের বিরাট অবদান আছে। সেই সব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে থাকত রবাব নামে একটি বাদ্যযন্ত্র।  এটি একটি লোক বাদ্যযন্ত্র। যা তারা লোক সংগীতের সঙ্গে বাজাতেন। রপ্তানির সুবাদে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তাদের অনায়াসে যাতায়াত ছিল। দরবারী সঙ্গীত অর্থাৎ ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি তাঁরা ক্রমশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তাদের অনেকেই পাঞ্জাবে ও উত্তরপ্রদেশের শাজাহানপুর বুলন্দশহর, বেরেলী, মোরাদাবাদ, নাজিবাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন।  ক্রমশ তারা ভারতের বৃহৎ সংগীত পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য ভারতে প্রাচীনকাল থেকে রবাব এর মতো একটি বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ছিল। যেটি রুদ্রবীণা নামে পরিচিত ছিল। মোগল দরবারে সংগীতরত্ন মিয়া তানসেন এই যন্ত্রটি বাজাতেন। তখন থেকে রুদ্রবীণা বাদ্যযন্ত্রটিকে ধ্রুপদী বীনা বা তানসেনী রবাব বলা হত। তবে এই বাদ্য যন্ত্রটির গঠন ও বাজাবার পদ্ধতি আফগানি রবাব থেকে একেবারেই আলাদা।

Arabian Rabab
Rebab of Uzbekistan

 ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে তানসেন বংশের জাফর খাঁ,  সুর সৃঙ্গার যন্ত্রের উদ্ভাবন করেন। ধ্রুপদী রবাবের কাঠের প্লেটের বদলে ধাতুর প্লেট, চামড়ার জায়গায় কাঠের তবলী ও তাঁতের তারের জায়গায় লোহা, পিতল বা তামার তার লাগিয়ে এই যন্ত্রটি তৈরি হয়। ফলে এই নতুন যন্ত্রটির ধ্বনি বা মীড় দীর্ঘস্থায়ী হয়।

নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ যখন ব্রিটিশদের কাছে হেরে কলকাতায় নির্বাসিত হলেন, তখন শিল্প ও কলা রসিক নবাব সঙ্গে করে নিয়ে এলেন অনেক বাইজি, বাদক, গায়ক ও কত্থক নাচিয়ে ইত্যাদিদের। ওয়াজেদ আলীর সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন তারমধ্যে নিয়ামতুল্লা খাঁর নাম প্রধান, কারণ তাঁর একটা বিরাট গুনগ্রাহীর দল গড়ে ওঠে, যারা ছিলেন ব্যবসায়ী এবং সেই অর্থে জমিদার নয়। বলাহয় নিয়ামতউল্লা খাঁই প্রথম হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের উচ্চমানের যন্ত্রসংগীত শিল্পী। তাঁর দুই পুত্র কেরামত উল্লা খঁ  ও কৌকব খাঁ। কৌকব খাঁ, কুকব খাঁ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন বাঙালি ধনী সংগীত-সৌখিন মহলে। 

নিয়ামতুল্লা খান ও আশাদুল্লা খান

 বেঙ্গল ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন এদেরকে রানী ভিক্টোরিয়ার করনেশন অ্যানিভার্সারিতে লন্ডনে বাজাতে পাঠান। ঝকমকে পোশাক ও দ্রুতলয়ের গৎ তোড়া বাজিয়ে সাহেব দর্শকদের মন জয় করে নেন। পরবর্তীকালে এঁরা বেশ কিছু রেকর্ড করেন যা সেই সময় বাঙালির ঘরে ঘরে নিয়মিত বাজত। 

আমীর আলি খান

এই ঘরানার দ্রুত গত গুলি ছিল খুব আকর্ষণীয়। তানসেন বংশের নানা বন্দিশকে এরা নিজেদের মত করে গড়ে সাজিয়ে নেন। কলকাতায় যারা এদের কাছে শিখে পরের প্রজন্মে তার প্রচার শিষ্যদের মাধ্যমে করেন তারা হলেন কালী পাল, ধীরেন বসু, শ্যাম গাঙ্গুলি প্রমুখ। এই বংশের আর এক গুনী শিষ্য ওমর খাঁ কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করতেন এবং এর পুত্র ইরফান খানের কাছে ভালো ভালো বন্দিশ শোনা যেত। 

বাবা আলাউদ্দিন

A rectangular wooden frame fitted on both sides with goat skin forms the resonator of this instrument. The single steel string is tunable with a wooden peg mounted on the long neck. It is played with a bow. Body is approximately 11″ w x 20″ t; over all length is approximately 34.5″. The term Rabab is found in ninth and tenth century texts,and is the oldest known Arabic word for a bowed instrument Capable of a range of dynamic accents. This instrument is the essential melody instrument of the nomadic Bedouins; customarily played by the sha’ir, or poet-singer, to accompany heroic and love songs. A rabab player rests the instrument vertically on his or her knee and draws the bow across the string in a similar fashion to a cello player. Never handle the hair of the bow with your hands. Oils from your skin will be absorbed by the bow hairs and leave permanent slick spots on the hair. The bow hair, whether it is made of real horsehair or synthetic fibers, will be slick. In order to grab the strings it will need to be coated with rosin. Rosin is sold seperatley.

রাজশাহীর জমিদার ললিত মোহন মৈত্রেয় ভগবান দাস পাখোয়াজজীর শিষ্য ছিলেন। পাখোয়াজ রেওয়াজ করার জন্য শাহজাহানপুর থেকে সরোদিয়া মহাম্মদ আবদুল্লা খাঁ ও তাঁর দত্তক পুত্র আমির খাঁ কে রাজশাহীতে নিয়ে আসেন বাঁধা মাইনের চাকরিতে। এঁদের বাজনা শুনে আকৃষ্ট হয়ে নাতি রাধিকা মোহন আমির খানের কাছে নিয়মিত তালিম নিতে শুরু করেন।  হাফিজ আলী খাঁ সাহেবের কাকা মুরাদ আলি খাঁ ছিলেন আব্দুল্লা ও আমির খানের গুরু। ইনি ওই ঘরানার বিভিন্ন রকম গতের খাজানা ছিলেন। কোন কারনে বাড়ির উপর রাগ করে বাড়ির বাইরের লোকজনদের শেখাতে আরম্ভ করেন, যা তখনকার দিনে খুব বিরল ছিল। পরবর্তীকালে আমি আমীর খাঁ যখন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন তখন সেই সব গৎ বাঙালি ছাত্র রাধিকা মোহন মৈত্র, বাণীকন্ঠ মুখোপাধ্যায়, তিমির বরণ ভট্টাচার্য্য এদের মধ্যে পৌঁছে গেলো যা এখনো এদের  শিষ্য-প্রশিষ্যদের মধ্যে শোনা যায়। রাধিকামোহন, যিনি পরবর্তীকালে  সেনী বীনকার দবীর খাঁর কাছে শেখেন। রাগদারীর শুদ্ধতার খাতিরে ওইসব বহুমূল্য গদ সম্পাদনা করে তাঁর ছাত্রদের শিখেছেন। যা তাঁ দুই সুযোগ্য শিষ্য বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সমরেন্দ্র সিকদার এর শিষ্যদের মাধ্যমে এখনো শোনা যায়।

নিয়ামতুল্লাহ ঘরানার আধিপত্য ভেঙে নিজের সাম্রাজ্য স্থাপন করেন হাফিজ আলী খাঁ তার গান গাওয়া সরোদ বাজিয়ে। যদিও তিনি সুদূর গোয়ালিয়রে থাকতেন কিন্তু মাঝে মধ্যেই কলকাতায় বাজাতে আসতেন। অসাধারণ বাজনা শুনে বড় একটা উদগ্র সমর্থকের দল গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে জলুবাবু, লোহাপট্টির বেচাচন্দ্র, গৌরীপুর হাউজ রাইচাঁদ বড়াল ও দুর্লভ চন্দ্র ভট্টাচার্যের নাম  উল্লেখযোগ্য।  পরবর্তীকালে আমজাদ আলী খানের বাজনার প্রভাব বাঙালির ওপর পড়ে। এনার বাজনায় সেতারের মতন পরিচ্ছন্ন তান বাঙালি সরোদ বাদকদের আকৃষ্ট করে।

ধীরেন বসু
রাধিকা মোহন মৈত্র
আলি আকবর খান
তিমির বরণ

বাবা আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গীতের শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার নুলো গোপাল ও হাবু দত্তের কাছে।  একজনের কাছে ধ্রুপদ-খেয়াল গান আর অন্যজনের কাছে পাশ্চাত্য রীতিতে বেহালার শিক্ষা। এছাড়া উনি নন্দবাবুর কাছে মৃদঙ্গ,  হাজারী ওস্তাদের কাছে সানাই, লোবো সাহেবের কাছে বেহালা ও আহমেদ আলীর কাছে সরোদ শেখেন রামপুরের উজির খাঁ সাহেবের কাছে শেখার আগে। কলকাতায় বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছাড়া বিশেষ কাউকে শেখাননি। সবাইকে বলতেন মাইহারে, যেখানে তিনি রাজসভা বাদক ছিলেন সেখানে গিয়ে শিখতে। কলকাতার দুই বিখ্যাত বাঙালি সরোদ বাদক, তিমির বরণ ও শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায় দুজনেই মাইহারে গিয়ে শিক্ষা লাভ করেন। 

পঞ্চাশের দশক থেকে যখন বাবা আলাউদ্দিনের সুযোগ্য পুত্র আলী আকবর খাঁ ও ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর খাঁ কলকাতায় বসবাস শুরু করলেন তখন থেকেই সেই অর্থে কলকাতায় মাইহার ঘরানার সরোদ বাদন এর প্রচলন শুরু হল। উন্নত ও সুন্দর বাজনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্টিত আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিকএ শিখতে যান।  এভাবেই মাইহার বাজের প্রভাব কলকাতা শহরের যন্ত্রসংগীতে পড়ে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

তাঁরা ক্রমশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তাদের অনেকেই পাঞ্জাবে ও উত্তরপ্রদেশের শাজাহানপুর বুলন্দশহর, বেরেলী, মোরাদাবাদ, নাজিবাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন।  ক্রমশ তারা ভারতের বৃহৎ সংগীত পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য ভারতে প্রাচীনকাল থেকে রবাব এর মতো একটি বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ছিল। যেটি রুদ্রবীণা নামে পরিচিত ছিল। মোগল দরবারে সংগীতরত্ন মিয়া তানসেন এই যন্ত্রটি বাজাতেন। তখন থেকে রুদ্রবীণা বাদ্যযন্ত্রটিকে ধ্রুপদী বীনা বা তানসেনী রবাব বলা হত। তবে এই বাদ্য যন্ত্রটির গঠন ও বাজাবার পদ্ধতি আফগানি রবাব থেকে একেবারেই আলাদা।

 ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে তানসেন বংশের জাফর খাঁ,  সুর সৃঙ্গার যন্ত্রের উদ্ভাবন করেন। ধ্রুপদী রবাবের কাঠের প্লেটের বদলে ধাতুর প্লেট, চামড়ার জায়গায় কাঠের তবলী ও তাঁতের তারের জায়গায় লোহা, পিতল বা তামার তার লাগিয়ে এই যন্ত্রটি তৈরি হয়। ফলে এই নতুন যন্ত্রটির ধ্বনি বা মীড় দীর্ঘস্থায়ী হয়।

নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ যখন ব্রিটিশদের কাছে হেরে কলকাতায় নির্বাসিত হলেন, তখন শিল্প ও কলা রসিক নবাব সঙ্গে করে নিয়ে এলেন অনেক বাইজি, বাদক, গায়ক ও কত্থক নাচিয়ে ইত্যাদিদের। ওয়াজেদ আলীর সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন তারমধ্যে নিয়ামতুল্লা খাঁর নাম প্রধান, কারণ তাঁর একটা বিরাট গুনগ্রাহীর দল গড়ে ওঠে, যারা ছিলেন ব্যবসায়ী এবং সেই অর্থে জমিদার নয়। বলাহয় নিয়ামতউল্লা খাঁই প্রথম হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের উচ্চমানের যন্ত্রসংগীত শিল্পী। তাঁর দুই পুত্র কেরামত উল্লা খঁ  ও কৌকব খাঁ। কৌকব খাঁ, কুকব খাঁ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন বাঙালি ধনী সংগীত-সৌখিন মহলে। 

 বেঙ্গল ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন এদেরকে রানী ভিক্টোরিয়ার করনেশন অ্যানিভার্সারিতে লন্ডনে বাজাতে পাঠান। ঝকমকে পোশাক ও দ্রুতলয়ের গৎ তোড়া বাজিয়ে সাহেব দর্শকদের মন জয় করে নেন। পরবর্তীকালে এঁরা বেশ কিছু রেকর্ড করেন যা সেই সময় বাঙালির ঘরে ঘরে নিয়মিত বাজত। 

এই ঘরানার দ্রুত গত গুলি ছিল খুব আকর্ষণীয়। তানসেন বংশের নানা বন্দিশকে এরা নিজেদের মত করে গড়ে সাজিয়ে নেন। কলকাতায় যারা এদের কাছে শিখে পরের প্রজন্মে তার প্রচার শিষ্যদের মাধ্যমে করেন তারা হলেন কালী পাল, ধীরেন বসু, শ্যাম গাঙ্গুলি প্রমুখ। এই বংশের আর এক গুনী শিষ্য ওমর খাঁ কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করতেন এবং এর পুত্র ইরফান খানের কাছে ভালো ভালো বন্দিশ শোনা যেত। 

রাজশাহীর জমিদার ললিত মোহন মৈত্রেয় ভগবান দাস পাখোয়াজজীর শিষ্য ছিলেন। পাখোয়াজ রেওয়াজ করার জন্য শাহজাহানপুর থেকে সরোদিয়া মহাম্মদ আবদুল্লা খাঁ ও তাঁর দত্তক পুত্র আমির খাঁ কে রাজশাহীতে নিয়ে আসেন বাঁধা মাইনের চাকরিতে। এঁদের বাজনা শুনে আকৃষ্ট হয়ে নাতি রাধিকা মোহন আমির খানের কাছে নিয়মিত তালিম নিতে শুরু করেন।  হাফিজ আলী খাঁ সাহেবের কাকা মুরাদ আলি খাঁ ছিলেন আব্দুল্লা ও আমির খানের গুরু। ইনি ওই ঘরানার বিভিন্ন রকম গতের খাজানা ছিলেন। কোন কারনে বাড়ির উপর রাগ করে বাড়ির বাইরের লোকজনদের শেখাতে আরম্ভ করেন, যা তখনকার দিনে খুব বিরল ছিল। পরবর্তীকালে আমি আমীর খাঁ যখন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন তখন সেই সব গৎ বাঙালি ছাত্র রাধিকা মোহন মৈত্র, বাণীকন্ঠ মুখোপাধ্যায়, তিমির বরণ ভট্টাচার্য্য এদের মধ্যে পৌঁছে গেলো যা এখনো এদের  শিষ্য-প্রশিষ্যদের মধ্যে শোনা যায়। রাধিকামোহন, যিনি পরবর্তীকালে  সেনী বীনকার দবীর খাঁর কাছে শেখেন। রাগদারীর শুদ্ধতার খাতিরে ওইসব বহুমূল্য গদ সম্পাদনা করে তাঁর ছাত্রদের শিখেছেন। যা তাঁ দুই সুযোগ্য শিষ্য বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সমরেন্দ্র সিকদার এর শিষ্যদের মাধ্যমে এখনো শোনা যায়।

নিয়ামতুল্লাহ ঘরানার আধিপত্য ভেঙে নিজের সাম্রাজ্য স্থাপন করেন হাফিজ আলী খাঁ তার গান গাওয়া সরোদ বাজিয়ে। যদিও তিনি সুদূর গোয়ালিয়রে থাকতেন কিন্তু মাঝে মধ্যেই কলকাতায় বাজাতে আসতেন। অসাধারণ বাজনা শুনে বড় একটা উদগ্র সমর্থকের দল গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে জলুবাবু, লোহাপট্টির বেচাচন্দ্র, গৌরীপুর হাউজ রাইচাঁদ বড়াল ও দুর্লভ চন্দ্র ভট্টাচার্যের নাম  উল্লেখযোগ্য।  পরবর্তীকালে আমজাদ আলী খানের বাজনার প্রভাব বাঙালির ওপর পড়ে। এনার বাজনায় সেতারের মতন পরিচ্ছন্ন তান বাঙালি সরোদ বাদকদের আকৃষ্ট করে।

বাবা আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গীতের শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার নুলো গোপাল ও হাবু দত্তের কাছে।  একজনের কাছে ধ্রুপদ-খেয়াল গান আর অন্যজনের কাছে পাশ্চাত্য রীতিতে বেহালার শিক্ষা। এছাড়া উনি নন্দবাবুর কাছে মৃদঙ্গ,  হাজারী ওস্তাদের কাছে সানাই, লোবো সাহেবের কাছে বেহালা ও আহমেদ আলীর কাছে সরোদ শেখেন রামপুরের উজির খাঁ সাহেবের কাছে শেখার আগে। কলকাতায় বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছাড়া বিশেষ কাউকে শেখাননি। সবাইকে বলতেন মাইহারে, যেখানে তিনি রাজসভা বাদক ছিলেন সেখানে গিয়ে শিখতে। কলকাতার দুই বিখ্যাত বাঙালি সরোদ বাদক, তিমির বরণ ও শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায় দুজনেই মাইহারে গিয়ে শিক্ষা লাভ করেন। 

পঞ্চাশের দশক থেকে যখন বাবা আলাউদ্দিনের সুযোগ্য পুত্র আলী আকবর খাঁ ও ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর খাঁ কলকাতায় বসবাস শুরু করলেন তখন থেকেই সেই অর্থে কলকাতায় মাইহার ঘরানার সরোদ বাদন এর প্রচলন শুরু হল। উন্নত ও সুন্দর বাজনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্টিত আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিকএ শিখতে যান।  এভাবেই মাইহার বাজের প্রভাব কলকাতা শহরের যন্ত্রসংগীতে পড়ে।

সূত্রনির্দেশ

নাগরিক কথা, সেপ্টেম্বর, ২০১৭

The Divine Connection of BharatNatyam & Yoga

Yoga Mudra
NrityaChuramani Rahul Dev Mondal ( Assistant Professor , Rabindra Bharati University , Department Of Dance )

In the Hindu tradition, gods and goddesses dance as a way of expressing the dynamic energy of life. The image of Nataraja represents the god of gods, Shiva, as the Lord of the Dance, choreographing the eternal dance of the universe as well as more earthly forms such as Indian classical dance (which is said to have originated from his teachings). In Hindu mythology Shiva is also Yogiraj, the consummate yogi, who is said to have created more than 840,000 asanas, among them the hatha yoga poses we do today. While a cultural outsider may not relate to these mythic dimensions in a literal way, dancers in India revere the divine origins of their dances, which were revealed to the sage Bharata and transcribed by him into the classic text on dance drama, the Natya Shastra (circa 200 c.e.). What many practitioners of yoga do not know is that one of the central texts of yoga, Patanjali’sYoga Sutra, written around the same time, was also inspired by an encounter with Nataraja.

 My Body as Temple, Dance As Offering

The first movement I learned from my BharatNatyam master dance teacher, was Bhumi Pranam. Just as Surya Namaskar (Sun Salutation) honors the sun, this movement honors (the translation of pranam is “to bow before or make an offering to”) bhumi, the Earth. Bhumi Pranam is done before and after every practice and every performance. With hands together in Anjali Mudra, I was taught to bring my hands above my crown, to my forehead (Ajna Chakra), the center of my heart, and then, with a deep opening through the hips, to touch the earth. Bhumi Pranam expresses the essence of dance as a sacred offering that recalls B. K. S. Iyengar’s famous saying, “The body is my temple and asanas are my prayers.”

In this case, dance is the offering; indeed, in classical forms such as Bharatha Natayam , the dance actually originated in temple complexes, where 108 karanas were sculpted into the walls of temple entryways. These detailed reliefs reflect the traditional prominence of temple dancers known as devadasis (“servants of God”), who are thought to have incorporated some elements of yoga practice into their art.

There are only a few living devadasis left, and Bharata Natyam is usually done in a way that emphasizes entertainment (while still demonstrating a depth of devotion rarely seen on the stage). The text of Natya Shastra unites the various forms of Indian classical dance by means of a ritual performance format that is still followed (with some variations among different styles). Many forms begin with an invocation to the Divine, or pushpanjali (“offering through flowers”), to root the dance in sacred expression. A pure dance section called nritta follows, showing with great skill the movement vocabulary of the form and the union of the dancer with tala (rhythm). The heart of a dance performance involves abhinaya, a combination of dance and mime in which a dancer or dancers will embody characters of a sacred story cycle by expressing the lyrics and rhythm of accompanying songs through body language, hand mudras, and facial gestures. The songs are based on mythic stories such as the Shiva Purana, Gita Govinda, or Srimad Bhagavatam.

YOGA MUDRA

The Balance of the Sun and Moon

While there are many philosophical and practical connections between yoga and dance, the principle of unifying opposites is essential to both systems. Practitioners of hatha yoga are often told that the word “hatha” represents the figurative joining of the sun (ha) and the moon (tha), respectively masculine and feminine energies. On a practical level, this often translates as the balance of differing qualities within a pose: strength and flexibility, inner relaxation and focus. Within Indian classical dance forms, this balance of the masculine and feminine is understood as the balance of tandava and lasya. Tandava is associated with strong, vigorous movements and is considered to be the vibrant dance of the virile Shiva. Its complement, lasya, the dance of Shiva’s consort Parvati, embodies graceful, fluid movements. Dances are often classified as being tandava or lasya in the same way that certain asanas or Pranayamas are classified as heat-generating or cooling. In BharataNatyam , tandava and lasya become embodied within the structure of the karanas, with tandava being the lower body and lasya the upper body. Tandava is the strong stamping of the feet, like Shiva, and lasya is the fluidity in the torso and the grace of the hand movement or mudras.

In Kuchipudi dance, a solo dancer can embody the two qualities in the form of Shiva Ardhanarishvara whose visage is half male (Shiva) and half female (Parvati). In costume, the dancer will dress differently on the two sides of the body and will perform the characters of both parts by showing one side or the other.

From Alignment to Mastery

Another area where dance and hatha yoga meet is in the actual sadhana (practice), where there are many parallels between the two arts in both the technique and spirit (bhava) of the dance. The tradition is passed from guru to shishya (student) in a live transmission; the teacher gives the proper adjustments and guides the students into the inner arts of the practice. All of Indian classical dance refers back to the Natya Shastra text for an elaborate classification of the form. If you thought the technique of asana was detailed, you should peruse the Natya Shastra: It not only describes all the movements of the major limbs (angas)—the head, chest, sides, hips, hands, and feet—but also offers a detailed description of the actions of the minor limbs (upangas)—including intricate movements of the eyebrows, eyeballs, eyelids, chin, and even the nose—to create specific moods and effects. As in hatha yoga, one begins with the basics of body mechanics and gradually moves toward the subtler aspects of the art.

The karanas, dance counterparts of asanas, are linked into a sequence known as angaharas. The dance forms emphasize staying grounded, relating all of the movements with gravity to the earth, then reaching to the heavens. The emphasis on stilling the mind through concentration on the inner and outer bodies, moving the practitioner toward an experience of freedom, also parallels the inner processes of yoga. When I was first learning the basic steps of BharatNatyam , it took all of my concentration to keep a strong and consistent rhythm with my feet while tilting my head and eyes in opposition to my torso. I felt very mechanical and awkward, just like many beginning students of yoga. Only through repetition and focus on precision did I start to feel a flow of grace, or lasya. Watching the more experienced dancers practice and perform gave me a deep respect for the mastery that is the eventual fruit of so much sadhana.

Studying BharatNatyam  gave me enough patience with my Ashtanga Yoga practice to allow me both to embrace technique and to let go. Both processes can lead to a state of embodied communion. Ultimately, yoga is about connecting to the Big Dance, which one can experience either abstractly, through the lens of spiritual culture, or more intimately, as did physicist Fritz of Capra. In his book The Tao of Physics, he describes the experience he had while he was sitting on the beach and watching the waves, observing the interdependent choreography of life: “I ‘saw’ cascades of energy coming down . . . in which particles were created and destroyed. I ‘saw’ the atoms of the elements and those of my body participating in this cosmic dance of energy. I felt its rhythm and ‘heard’ its sound and at that moment I knew that this was the Dance of Shiva.”

References:

  1. Kothari Sunil – BharatNatyam – Indian Classical Dance Art, Marg
  2. Sastri Gourinath – Abhinaya Darpan
  3. Das Nilmoni – Byam O Sastho – Iron Man Publishing House
  4. Vivekananda Swami – Patanjali Yoga Sutra – Vijay Goel( Publisher)

*************************************************************************

Vedic Musical String Instruments & Violin

Dr. Dipak Banerjee, Guest Assistant Professor, Rabindra Bharati University

Abstract: There are many types of Chordophone or musical string Instruments used in Vedic age. Of them only two instruments are related with Violin. They are Pinga and Gargara. Some Western experts say, Violin is the ancestor of Indian bowing Musical String Instrument. Through, Europeans Invented Violin in 16th Century. According to the base of both information, this easy try to relate with Vedic Musical String Instruments and Violin.

Keywords: Vedic age, Vedic Musical String Instruments, Pinga, Gargara, Violin, relation with Violin.

Introduction: There were many types of musical string instrument used in Vedic age. Among this musical string instruments, one kind of musical string Instruments was bow shaped. Some experts of the West think that this kind of musical string Instrument was the ancestor of Violin. Pinga1 and Gargara2these two types of bowing musical string instruments were used in Vedic age. These types of musical string instruments are related with evolution of Violin. To find a relation between Violin and Vedic bowing musical string instruments is the major topic of this Article.

Vedic age, Vedic Music & Musical String Instruments: Historian suspected that Vedic civilization starts in India Probably in 2500-2000 B.C.3. In conformity with the report of the Historian, this civilization was enriching with music, literature and culture. Music and literature are the part of music. Culture is the part of Vedic age. At the end of the civilization of Indus Valley, the Vedic civilization starts. Aryans were the ruler of this civilization. They brought with them their music, the earliest records, which are Vedic Music. Four Vedas were successively written in Vedic age. The names of four Vedas are Rig-Veda, Sāmavēda, Yayurvēda, Atharbavēda.

Newly, the name of fifth Veda is Ayurveda in one side, but in another side the name of fifth Veda is Natya-Shastra. It is not only the religious books of Hindus, but also the records and musical records of this age. Rig-Veda is the first literature of this world. Rig-Veda, the oldest four Vedas, is a simple recitation with three tones. Each separated from next by a tone (three of four securities). This recitation of three notes is high, low and circumflex.

          The name of this application was Udatta (High), Anudatta (Low), Savarita (Circumflex). The Sāmavēda, which is more elaborate chanting of Rigveda, has seven notes arranged in certain degrees of descant and ascent. It is mainly as a descending type in music. It is starting from a high pitch and cascading down. This is the characteristic of all early music. This is closely related to psychophysiology of music and musical instruments.

          The Vedic chants were ecclesiastical purpose and hence highly symbolic, not easily permissible of change. In the rituals sacrifices various musical instruments used to accompany the chants. As the priests (Udgata) sang; their wives played various kinds of Veena such as : Bana veena, Karkari, Kanda veena Apaghatia, Godha, etc. But we have no clear idea about the tuning systems and construction of that Veena. Some musicologist may suspect that they were harps of dulcimers. There were many types of musical Instruments used in Vedic age. But here I discussed about only bowing musical string instruments which is related to Violin.

          In Vedic age – along with the spread of the Aryans, the influence of their music also extended throughout the country. Bowing musical string instruments were used in Vedic age. A musical instrument called Pinga is said to have in Rigveda. It is found in Rigveda of 8th Mondal, 69 Sukta and in 9th Sloka. The following sloka in identify about Pinga. It is a bowing string instruments. Following sloka is written bellow:

“Ava Swarati Gargara Goda Parisaniswanat.

Pinga Pari Cha Niskaddindaya Brahmadyaetam”4

          Pinga was bow shaped instrument. The string of this instrument was made up by animal intestines which have been the colour of gray-tinted-half-blue. According to the colour of string, the instrument is thus called Pinga, which stands for colour (Dhar Choudhury, 2010, 42) 5.

          The other Instruments called Gargara, which is equally bow shaped is named according to the sound it makes when in use. The sloka has been interpreted in this way. According to the sloka, Gargara, the musical instruments of Vedic age, is making tremendous sound; another musical instruments Pinga, was shape like bow. The Production of the sound comes through its string. Veda analyst Sayna Acharya (14th Century A.D) was given a note about this instrument.

          The two Vedic musical instruments namely Pinga and Gargara, have retained their structural shape through various, stages of formation and transformation in subsequent periods and have been the source instruments; of what latter called as Dhanuryantram of more preferably Dhanurveena. According to the opinior of Swami Prajnananda the Vedic musical instruments, which is called Pinga known as Dhanuryantram, which was subsequently reconcile as Ravanastram in the Period of Post Vedic age. The bowing musical string instruments Pinga is believed to be the source instruments of what is now-a-days known as Violin. (Prajnanda, 1953, 27) 6

About Violin: Acoustically the Violin is one of the most popular perfect instrument. It has an extra ordinary musical versatility. No one known who in vented Violin 7 and it is most unlikely that a single person did so. The modern Violin is supposed to has been constructed in 1555 by Andra Amati. But the date is doubtful. Generallly, A Violin has four strings. A violin is played with bow. The strings of Violin tuned with MaG, SaD,, PaA, RaE 8 according to Indian music. It is also tuned with PaG, SaD, PaA, SaE in Indian music system. But, other tuning methods are used in Europe. It is said that Violin is played with bow. The first shape of the Bow Stick was joined with horse hair. It is arranged like semi circular shape. It looks like Bow, means like Dhonuk (in Indian Language). So, this polishing stick was called Bow. And the Instrument was called bowing string instrument. The structural changes of Violin in Europe throughout the world come in 17th, 18th and 19th century. In 19th century modern Violin formed. Acoustical research is continued on about Violin.

          Bowed Instruments may have originated in the equestrian cultures of central Asia. It is believed that bowing musical string instrument eventually spread to China, India, and the Middle East, where they developed instrument such as Erhu (China) and the Rabab (Middle East) and Esraj (India). The violin in its present from emerged early 16th Century in Northern Italy, where the port towns of Venice and Genoa maintained extensive of Central Asia through the trades rules of Silk Road.

          Most likely first make of Violin borrowed from three types of current Instruments; the Rebac (10th Century), Renaissance fiddle, and Lira di braccio (Internet searching).

          According to the opinion of B.Chaitanyadeva,- “It is certain that the ancestor of Violin came from central Asia, if not from India. It is supposed that the instruments came to Europe through the Balkan Peneinsila one of the early illustration of a Violin prototype is from the 9th century A.D. It might have had as its precursors the fiddle, the Bizantine Kamang Rumi and Rebec, the last is obviously related to Rabab of Arabia.” (Chaityanadeba 1978, 171) 9. But Kshetra Mohan Goswami, has suggested that the Arabic musical instrument in the name of Kamanaga is only an imitation, with some minor alteration, of the ancient Indian musical instrument known the name of Amriti. Amriti is an off shoot of the primitive musical instrument Ravanastram (Dey, 1974, 64) 10.

          From the Groves Dictionary of Music & Musicians, 3rd Ed; Vol.- III page no-13 we get some valuable lines:-

“Kemangh – It is undoubtly one of the earliest of all bowed instruments, claiming its identity or descent from somewhat mythical Ravanastram of India”.11

          It is suspected that Kamanga and Kemangeh is a same type of musical Instruments. We also get few lines in the book of the Musical instrument of India, by S. Krishna Swami, that some western experts think, ancestor of Violin comes from India quoted lines of this books are written below:

“Some experts in the west are of the opinion that the Violin has an Indian ancestry and trace the gradual evolution of the Instrument to one of the many varieties of bowed instruments found all over India which are of great antiquity one such variety is the famous ravanhatha (ravanahasta or ravanstrom), a folk instrument of the stringed variety which is still used in some regions of Gujrat and Rajasthan. (Krishna Swami, 1977, 30)12

          This lines makes a relation with Pinga, bowing musical string instrument of Vedic age, is started before. Now the clear conception is that, Pinga is related to Ravanastram, Ravanstram is related to Violin.

Relation with Violin & Vedic bowing musical string Instrument : From this discussion about Violin and Vedic bowing musical string Instruments, we get two major opinions of the invention of Violin or construction of Violin (i) Violin is invented or constructed from Ravanshastram which is related with Vedic bowing musical string instrument Pinga and Gargara (ii) Violin is invented from Arabian Rabab.

          From this discussion, it is said origin and evolution of Violin comes from the Vedic bowing musical string Instrument, which is called Pinga. But some where we see the lines that – “Violin is a Western Instrument” (Krishna Swami, 1971, 30) 13.

May be, both of these opinion are true. But, it is bring out from this discussion if Vedic age or Prevedic ages of India, the Indians are the inventor or constructer of bowing musical string instruments, then Western i.e. Europeans are the modifier of this Vedic musical string instruments, which is Violin.

Conclusion: Modern Violin of this century is now enriched, developed structurally and acoustically. But evolution of Violin is related to bowing musical string instrument of Prevedic and Vedic age. Although, the modern Violin in invented or constructed from Europe. Yet, nobody can deny origin and evolution of Violin or one kind of source of Violin from India, from Prevedic and Vedic age.

Notes & References:-

  1. Rigveda Bengali Version, 2nd Part, Haraf Prokashani, Kolkata; P-259. Ed.2000.
  2. Ibid; Vedic Index of names and subjects (Vol-II); P-544, Motilal Baranasi Dass, Varanasi; Ed. 1958.
  3. Advanced History of India; K.A. Nilkanta Sastri, G.Srinivas Acharya, Calcutta, 1970.
  4. Rigveda, Ibid.
  5. The origin and Evolution of Violin as a Musical string Instrument, Sisir Kona Dhar Choudhury; Ramkrishna Vedanta Math; Kolkata, Ed.2010.
  6. Sangeet O Sanskriti; (Bengali Book). Swami Prajananda, Ramkrishna Vedanta Math, Calcutta, Ed.1953.
  7. The New Grove Dictionary of Music & Musicians; Stanliy Sadie, Macmillan Publishers Limited, London, Vol-19, P-825, 995; Ed.1995.
  8. G,D,A,E is the name of Violin String.
  9. Musical Instrument of India; B.Chaitanyadeva, Firma KLM Private Limited, Calcutta, Ed. 1978.
  10. The Music and Musical Instrument of Southern India and the Deccan; C.R.Dey, B.R. Publishing Corporation; New Delhi, P-103, Ed. 1974.
  11. The New Grove Dictionary of Music & Musicians; Ibid, Vol-II, P-13, 3rd Ed.1995.
  12.  Musical Instruments of India; S.Krishna Swami, Ministry of Information and Broad Casting, New Delhi; Ed.1977
  13.  Krishna Swami, Ibid.

Bibliography :

Aman Abdul Ali            Rigveda Sanghita, 2nd Vol       Haraf Prokashani : 2000

Chaitanya Deva, B        Musical                                 Firma KLM Pvt. Ltd :

                                      Instruments of India               1978.

Dey, C.R.                       The Music and Musical         B.R. Publishing Cor-

                                      Instrument of Southern          poration : New Delhi,

                                      India and the Deccan            1974

Dhar Choudhury,          The Origin and Evolution      Ramkrishna Vedanta

Sisir Kona                      of Violin as a Musical            Math: Kolkata 2010

                                      Instrument, Part-I

Krishna Swami, S          Musical Instruments               The Director Publication

                                      Of India                                 Division :

                                                                                    Ministry of Information

                                                                                    & Broad Casting, Govt.

                                                                                    of India; New Delhi; 1977

Macdoneill Arthur         Vedic Index of names and      Motilal Banarsi Dass:

Anthony & Keith           Subjects (Vol-II) P-544          Varanasi, 1982

Berriedale

Prajannada, Swami        Sangeet O Sanskriti               Ramkrishna Vedanta Math:

                                                                                    Calcutta, 1983

Sastri, K.A. Nilkanta     Advanced History of              Calcutta, 1970

Acharya Srinivas. G.     India

Dictionary :                   The New Grove                      Macmillan Publishers

Sadic, Stanley               Distionary of Music &           Ltd : London, 1995.

                                      Musicians; Vol-3, 19

Internet Searching: https://en.wikipedia.org/wiki/History-of-the-Violin.

লোক সংগীত সম্পর্কে রবীন্দ্র ভাবনা ও লোকসংগীতের বিষয় বিভাজন

                                       ড. পুতুল চাঁদ হালদার

ঊনবিংশ শতকের বাংলায় বহু প্রতিভাবান মনীষী জন্মগ্রহণ করেছিলেন-কি সাহিত্য জগতে, কি নাট্য জগতে, কি শিল্প, সংগীত, ধর্ম ও আধ্যাত্ম জগতে। তাঁদের পুণ্য স্পর্শে বাংলাদেশ শিক্ষা, সভ্যতা ও সাংস্কৃতি উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল। 

নদী মাতৃক বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু যেমন একদিকে বঙ্গকে শস্য শ্যামলা করেছে, তেমনি অন্যদিকে চিন্তাশীল প্রতিভা দীপ্ত মনীষীদের আবির্ভাবে বাংলার শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি সহ নানা বিষয় সরস, সুন্দর, সাবলীল ও হৃদয়স্পর্শী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববরেণ্য বিশ্বকবি রূপে বরণীয় হলেও তিনি বাংলার মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বাংলার শিক্ষা, দীক্ষা,আচার-ব্যবহার ও ধর্ম-সংস্কারকে ভিত্তি করেই তাঁর লোকোত্তর জীবনকে সর্ব সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রবীন্দ্র পূর্ব বাংলার সাধারণ সমাজ, রাষ্ট্রজীবন, সাহিত্য চর্চা, নাটক, কাব্য, দর্শন, সংগীত, শিল্প, ধর্ম এমনকি আধ্যাত্ম ভাবধারা রবীন্দ্রনাথের জীবনকে যে প্রভাবিত করেছিল তা একান্তভাবে স্বীকার্য। 

তবে তিনি সব কিছুকে তাদের নতুন রূপে, রসে ও ভাবে সুষমায়িত ও সমৃদ্ধ করেছিলেন একটি অভিনব ও স্বতন্ত্র দৃষ্টি ভঙ্গিতে। তাই তাঁর সকল সৃষ্টি আজ বাংলা তথা ভারতের সীমা অতিক্রম করে বিশ্ববাসীর অন্তর সিংহাসনে তাদের নিজস্ব আসন প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। 

শহর কলকাতার মধ্য স্থলের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শিশুকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী ও বিলাসিতা বিমুখ। তখন থেকেই তাঁর জীবনে লোকায়ত জীবনের সরলতা, সহজতা লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য সে সময় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গ্রাম্য জীবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন-গাছ-গাছালি, বাগান, পুকুর, ঢেঁকিশালা, পাঠশালা,

পাল-পার্বণ, ব্রত, পূজা, আলপনা ইত্যাদি নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ ছিল তা ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘ছেলেবেলা’ বই দুটি থেকে জানা যায়। 

ঠাকুর বাড়িতে প্রাত্যহিক কাজ কর্মের মধ্যদিয়ে যে সমস্ত লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চা হতো তা তাঁর ভালো লাগত ও তাঁকে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করত। ছেলেবেলাকার লোকায়ত জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের অজান্তে তাঁর মনে লোকায়ত শিল্প সংস্কৃতির বীজ বপন করে। কবিগুরুর জীবনে শৈশবের অনুশাসনের মুক্তি ঘটে যৌবনে। শৈশবে ঘটনা চক্রে কয়েকবার পল্লী গ্রামকে সামনা-সামনি উপভোগ করার সুযোগ পান রবীন্দ্রনাথ তবে ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল এই দশ বৎসর তাঁর জীবন শিলাইদহ ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে অতিবাহিত হয়। এরপর ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে লালমাটির দেশ বীরভূমে কবি তাঁর কর্মজীবন স্থানান্তরিত করেন। 

“রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর গানের যোগ্য পরিবেশ পেয়েছিলেন কলকাতা জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে একথা সকলেরই বিদিত। তাঁদের জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে হিন্দু-মুসলমান উস্তাদদের বসতো উচ্চাঙ্গ-সংগীতের আসর, সুতরাং সে আসরে সংগীত শোনার সুযোগ হয়েছিল তাঁর যথেষ্ট। বরোদা, গোয়ালিয়র, অযোধ্যা, দিল্লি, আগ্রা, মোরাদাবাদ ও আরো অন্যান্য দেশ থেকে সংগীত শিল্পীরা আশ্রয় নিতেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। “১

‘জীবনস্মৃতি’তে জানা যায়, বড়দের সংগীতের আসরে ছোটদের প্রবেশাধিকার না থাকলেও বালক রবীন্দ্রনাথ দরজার আড়াল থেকে তা অন্তর দিয়ে শুনতেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুর বাড়ির সংগীত শিক্ষকদের কাছে সংগীত শিক্ষার জন্য নিযুক্ত করা হয়। কবিগুরু বিষ্ণু চক্রবর্তী, শ্রীকণ্ঠ সিংহ, যদু ভট্ট ও মৌলাবক্স প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীদের কাছে নানা রাগ-রাগিনীর তালিম নেন। তবে তা নিয়ম নিবন্ধ করে নয়। ঐ সমস্ত রাগ-রাগিনীর সুর পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্ট সংগীতকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। তবে এখানেও তিনি তাঁর স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। রাগ-রাগিনীকে নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে তিনি তাদের যথাযথ ও সার্থক প্রয়োগ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি সৌন্দর্যকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। 

পল্লী বাংলার সহজ সরল জীবন যাত্রা রবীন্দ্রনাথকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করত। এই আকর্ষণ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা না করে তিনি তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জারি রেখেছিলেন। ফলে একদিকে কবির প্রকৃতি প্রেম অন্যদিকে দার্শনিক ভাবনা কবিকে আরও বেশি লোকসংস্কৃতিমুখী করে তুলেছিল। পল্লীগ্রামই বঙ্গ তথা ভারতের যে ভিত্তি ভূমি তা কবি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। অন্তর দিয়ে লোকায়ত জীবনের দুঃখ, যন্ত্রনা, হাসি-কান্নাকে উপলব্ধি করতেন কবি। 

কবিগুরু তাঁর জীবনের বেশ কিছু কাল অতিবাহিত করেন রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, শীলাইদহ ও পাতিসর সহ বীরভূমের নানা পল্লী অঞ্চলে। জমিদারি দেখা শোনার সুবাদে ঐ সব অঞ্চলে বসবাস কালে অগনিত লোক শিল্পীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তিনি তাঁদের গান শোনেন। ঐ সমস্ত লোক শিল্পীদের লোকসংগীত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে মূলত সুরগত ও বিষয়গত এই দুই ভাবে প্রভাবিত করেছিল। সুরগত প্রভাব অর্থাৎ লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারার গানের সুরের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গানে লক্ষ্য করা যায়। আবার বাউল তত্ত্ব বা কীর্তনাঙ্গের কিছু প্রচলিত গানের বিষয়গত সাদৃশ্য ও চিত্ররূপ তাঁর গানে পরিলক্ষিত হয়।

আমরা জানি ভারতীয় রাগ-রাগিনীর মতো বাঙলার প্রচলিত লোকসংগীত গুলি সুর প্রধান। আবার রবীন্দ্রসংগীতেও কথা ও সুরের অর্ধনারীশ্বর মূর্তিই প্রস্ফুটিত। গানের কথা ও সুর প্রসঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি’তে কবি বলেছেন -” গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয় না সেই সুযোগে গানকে ছাড়াইয়া যাওয়া,সেখানে সে গানেরই বাহন মাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্য্যেই বড়, বাক্যের দাসত্ব কেন সে করিতে যাইবে।…  … … বাক্য যাহা বলিতে পারে না, গান তাহাই বলে। এই জন্য গানের কথাগুলিতে কথার উপদ্রব যতই কম থাকে, ততই ভালো।”

বঙ্গ দেশের প্রতিটি প্রান্তে যে সমস্ত লোকসংগীত প্রচলিত আছে তা সহজ সরল কথা ও সুরে সমৃদ্ধ। তাই তাঁর গানে বাঙলা দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তের প্রতিটি পর্যায়ে লোকসংগীতের সুর ও কথা তথা বিষয় তাঁর গানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল একথা বলা যায়।

অনাদি কাল ধরে বিশ্ব সংগীত যেমন ভাবে তার রূপ-রসের বিস্তারে বৈচিত্র্যপূর্ণ তেমনই ভারতীয় সংগীতও বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী আদায় করতে সচেষ্ট হয়েছে। আমাদের ভারতবর্ষ গ্রামীণ সভ্যতাকে আশ্রয় করেই পল্লবীত হয়েছে।তাই ভারতের প্রতিটি প্রদেশে লোকায়ত সংগীত বস্তুত বৈচিত্র্যপূর্ণ। তবে বাংলার লোকসংগীত এতটাই বহুমুখী ধারায় প্রবাহিত যে তা সমগ্ৰ বিশ্বে বিরল। একই বঙ্গে বাংলা ভাষায় কত রকমের লোকসংগীতের সমাবেশ তা আমাদের অবাক করে। বৈচিত্র্যের মধ্যে পরম একতার সন্ধান বাংলার লোকসংগীতকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। লোকসংগীতকে আশ্রয় করে এ বাংলাদেশে কত যে বিচিত্র সংগীতমালা রয়েছে তা এখনও সম্পূর্ণরূপে আবিষ্কৃত হয়নি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী সম্প্রদায়, ধনী-দরিদ্র,

শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সুখে-দুঃখে, পতনে-উথ্বানে একই সঙ্গে আবহমান কাল ধরে বসবাস করে আসছে যে, মানুষ তার বহিঃপ্রকৃ বহিঃপ্রকৃতিতে যতোই কালের বিভিন্নতার ছাপ পড়ুক, অন্তরের ঐক্যানুভূতির ক্ষেত্রে অন্তরায় ঘটেনি আজও। নানা উৎসবে, ব্যসনে, পূজা-পার্বণে, অন্ন চিন্তায়, ধর্ম-চিন্তায়, সুখ-দুঃখের নানা অভিব্যক্তিতে গ্রাম্য কবিগণ রচনা করেছেন এই গান। 

সাধারণ ভাবে আমরা বাংলার লোকসংগীতকে

     নিম্নলিখিত পর্যায়ে ভাগ করতে পারি।

(ক) আঞ্চলিক শ্রেণী বিভাগ-: ভাটিয়ালী,ভাওয়াইয়া, ঝুমুর,বাউল। 

(খ) বিষয়গত শ্রেণী বিভাগ-: 

      ১| প্রেম বিষয়ক-:   সামাজিক-বৈধ, অসামাজিক-অবৈধ।

      ২| সমাজ বিষয়ক-: শস্য, উৎসব, মেলা, জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ।        

      ৩| বৈরাগ্য বিষয়ক-: শোক, সাধারণ ভক্তি। 

(গ) পরিবেশগত শ্রেণী বিভাগ-: একক, সমবেত, নৃত্য-  বাদ্যসহ সংগীত।        

 (ঘ) আধুনিক শ্রেণী বিভাগ-: ঋতু সংগীত, শ্রম সংগীত,   ভক্তি সংগীত,  আচার সংগীত।     সমগ্ৰ বঙ্গের লোকসংগীতের ভাষা, সুর ও ছন্দের প্রকৃতি এবং ধর্মীয় প্রভাব অনুসারে ৫টি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। 

(১) উত্তর বাংলার গান-: ভাওয়াইয়া, চটকা, গম্ভীরা,  মাহুত বন্ধুর গান, মইষাল ও গাড়িয়াল বন্ধুর গান। 

(২)মধ্য অঞ্চলের গান-: বাউল, বোলান, ঝাঁপান,

                                 আলকাপ। 

(৩) ভাগীরথীর পশ্চিমাঞ্চল বা রাঢ়বঙ্গের গান-: ভাদু, টুসু, ঝুমুর, লেটো, পটুয়ার গান ইত্যাদি।   

      (৪) পূর্বাঞ্চলের গান-: বিচ্ছেদী, সারি, ঝাঁপ, ফেরুসাই   প্রভৃতি অঙ্গের ভাটিয়ালী গান। 

(৫) দক্ষিণ অঞ্চলের গান-: মনসার গান, বনবিবির গান,  দক্ষিণরায়ের গান, গাজী সাহেবের গান, শীতলার গান ইত্যাদি।

এবার বিশিষ্ট্য লোক সংগীত গবেষক এনামূল হক মহাশয় বাংলার লোকসংগীতকে যে যে বিষয়গত পর্যায় বিভক্ত করেছেন তা লক্ষ্য করবো এবং ঐ সকল লোকসংগীতের সঙ্গে রবীন্দ্র সৃষ্ট সংগীতের সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক আলোচনায় অগ্ৰসর হব। 

এনামূল হক মহাশয় সমগ্ৰ বাংলার লোকসংগীতগুলিকে দশটি পর্যায় বিভক্ত করেছেন। যেমন-(১)প্রেম সংগীত  -: ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বারমাসী।                                                                                             

           (২) নৃত্য সংগীত-: ঝুমুর, ভাঁজোই, ঘাটু, লেটো।

           (৩) সহেলা-: ধামাইল, যাবতীয় মেয়েলী সংগীত। 

            (৪) শ্রম সংগীত-:সারি, বাইচ, ছাদপেটা, কর্ম প্রেরণার গান। 

           (৫) কৃষি সংগীত-: জাগ, কার্ত্তিকা, পুষালি।

           (৬) আনুষ্ঠানিক সংগীত-:গম্ভীরা, গাজন, ভাদু, টুসু

           (৭) পটুয়া সংগীত-: দেবপট, গাজীপট ইত্যাদি। 

           (৮) শোক সংগীত-: জারি গান,বিজয়া,  কান্নাগান।

            (৯) ভক্তি সংগীত-: শাক্ত সংগীত, পীর সংগীত, মাইজভান্ডারী। 

            (১০) তত্ত্ব সংগীত-: বাউল, মুর্শিদা, দরবেশী, মারফতী, দেহতত্ত্ব।

১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের- ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’-গানটিতে পূর্ববঙ্গের প্রচলিত ভাটিয়ালী-

”মন মাঝি সামাল সামাল ডুবলো তরী,

ভব নদীর তুফান ভারি’ – গানটির সুর ও কথার ভাব প্রতিফলিত।

‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ’ ও আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’- গান দুটিতে বঙ্গের প্রচলিত ভাটিয়ালী – ‘মন তোর মানবতরী বোঝাই ভারী’ – গানটির সুর পরিলক্ষিত হয়। 

রবীন্দ্রনাথের প্রায় শেষ জীবনে রচিত – ‘তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম সাড়া’- গানটিতে রাঢ়  বঙ্গের ভাদু গান ‘বড় মজা গেছে গো আইন পাশে’ এবং ‘ভাদুর আগমনে’এই গান দুটির সুর বর্তমান। 

ভক্তি সংগীত তথা শাক্ত পদাবলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি রাম প্রসাদ সেনের-‘মায়ের এমনি বিচার বটে, 

                          যে জন দিবা নিশি দুর্গা বলে

                          তার কপালেই বিপদ ঘটে’- গানটির 

প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কবিগুরু রচিত

(১) ‘আমারা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’,

(২) ‘শ্যামা এবার ছেড়ে চলেছি মা’,

(৩) ‘আমি শুধু রইনু বাকি’-এই গান তিনটিতে। 

প্রচলিত কীর্তন গানের সুরের কাঠামো কবিগুরুর অনেক গানেই পাওয়া যায়, যেমন-

(১) ‘হরি তোমায় ডাকি, সংসারে একাকী’

(২) ‘সখী বয়ে গেল বেলা শুধু হাসি খেলা’

(৩) ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’,

(৪) ‘তবু মনে রেখো’ -এই গান চারটিতে লালনের কীর্তন ভাঙ্গা সুরের-‘ক্ষম অপরাধ ওহে দীননাথ,  কেশে ধরে আমায় লাগাও কিনারে’ গানটির সঙ্গে 

মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাহেবধনী সম্প্রদায়ভূক্ত আউল কুবীর গোঁসাইয়ের-‘ডুব্ ডুব্ ডুব্ রূপ সাগরে আমার মন’ গানটির সুর কাঠামো লক্ষ্য করা যায় কবিগুরু রচিত-‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ গানটিতে। 

জানা যায় রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিলে বেদ,পুরাণ, কোরান, বাইবেল ও লালনের জীবনী গ্ৰন্থ সব সময় থাকত। জীবন সম্পর্কে বাউলদের ধ্যান-ধারণা, মন্ত্র-তন্ত্র, মন্দির, মসজিদ দেবতা নয় বরং মানব দেহ,আত্মা বা পরমাত্মাই তাদের সাধনার মূল লক্ষ্য। সাম্প্রদায়িকতাহীন ঐ স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের প্রতি কবিগুরু ছিলেন বিশেষ কৌতূহলী ও উৎসাহী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ফকির লালন সাহেবর গানের সংগ্রাহক। 

এ প্রসঙ্গে ড. শ্রী সুকুমার সেন মহাশয় বলেছেন-“বাউল গানের প্রচলন আমাদের দেশে চির দিনই ছিল, কিন্তু ভদ্র শিক্ষিত সমাজে তাহার কোন মূল্য ও মর্যাদা ছিল না। বাউল গান রবীন্দ্রনাথের আবিষ্কার বলিলে বেশি বলা হয় না। রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ রস পিপাসু কবিচিত্ত অবজ্ঞাত ও তুচ্ছ বলিয়া অবহেলিত অনেক রচনায় নব নব সৌন্দর্য্য প্রকাশিত করিয়া বাঙ্গালা সাহিত্যের রস সম্পদ বহুগুণিত করিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের দিয়াই আমরা বাউল গানের অতীন্দ্রিয় রস অনুভব করিতে শিখিয়াছি। রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তে বাউল গানের প্রভাব সামান্য নয়। বাউল গানের সংগ্রহেও রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টা প্রথমত ও শ্রেষ্ঠতম। “২

রবীন্দ্রনাথ বাউলগান ও বাউলতত্ত্বের প্রেরণা বাংলার রাঢ় অঞ্চল ও পূর্ববঙ্গের নানা অঞ্চলের বাউল সাধকদের রচিত গান ও ধর্ম সাধনা থেকে লাভ করলেও তাঁকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল লালন শাহের সংস্পর্শ ও তাঁর রচিত গান। বিখ্যাত লালনগীতি-“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”-গানটি তরুণ রবীন্দ্রনাথের মনে দীক্ষা মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল।

এরই সুবাদে অজস্র রবীন্দ্র সঙ্গীতে বাউল গানের সুর প্রতিফলিত হয়েছে বলা যায়। যেমন-প্রচলিত বাউল  গান  ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা। ‘হরি নাম দিয়ে জগত মাতালে’-অনুকরণে কবি গুরুর গান ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে। ‘নদীয়া অঞ্চলের বৈষ্ণবীয় বাউল গান -‘সোনার গৌর কেন কেঁদে মরে ও নরহরি’-গানটির অনুসরণে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘ও আমার দেশের মাটি।গগন হরকরার- ‘ও মন অসার মায়ায় ভুলে’-গানটির অনুকরণে-‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, এবং ‘দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা’-গানটির আদলে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ ইত্যাদি অগনিত গান রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন। 

প্রথম দিকে বাউলের সম্প্রদায়গত বন্ধন দৃঢ় ছিল না। ব্যক্তিমনের ব্যাকুলতা আর অভিযোগই প্রকাশ পেয়েছে আদি পর্বের রচনা গুলিতে। পরবর্তীকালে বাউল সম্প্রদায় একটি সংকীর্ণ ধর্মের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়েছে বলে এ থেকে লোকসংগীতের জীবন মুখিতা লোপ পেতে চলেছে। 

দেহতত্ত্ব ও মানবজীবনের অসারতার গানগুলি পরবর্তীকালের রচনা। এগুলি স্বভাবতঃ লোকসংগীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেনি। আধুনিক কালের বাউল গান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন -“অধিকাংশ আধুনিক বাউল গানের অমূল্যতা চলে গেছে। অচলিত সস্তা দামের জিনিস হয়ে পথে বিকোচ্ছে। তা অনেক স্থলে বাঁধি বোলের পুনরাবৃত্তি এবং হাস্যকর উপমা তুলনার দ্বারা আকীর্ণ।”৩


       লোকসংগীতের বিষয়গত বৈচিত্র্য সহজে বোঝা যায় এর গঠনগত রূপ অনির্দিষ্টে। উচ্চতর সমাজ সৃষ্ট উচ্চাঙ্গ- বা ধ্রুপদী গানের দুই থেকে চার কলি ভাগের মতো লোকসংগীতের নিয়ম নেই। টুসু-ভাদু সহ অনেক লোকসংগীতের এক বা দুই তুক বারংবার সুরে আবৃত্তি করা হয়। আবার চার বা ততোধিক তুক বা কলিতে কিংবা বিবৃতিধর্মী ও আখ্যানধর্মী সুদীর্ঘ রচনায় নানা প্রকারের গান রচিত। যেহেতু সুর সর্বস্বতাই লোকসংগীতের ধর্ম, সেজন্য ভাষার দৈন্য, অসংলগ্নতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে অনেক লোকসংগীতে। প্রেমমূলক লোকগীতি মোটামুটি ভাবে সমৃদ্ধ রচনা, আনুষ্ঠানিক গীত দীর্ঘ ও আবৃত্তি প্রধান। বৃহৎ রচনা হয় পটুয়া ও বিবিধ আখ্যানমূলক গীত গুলিতে, এতে সুরের ভূমিকা কম। 

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবার আমরা লোকসংগীতের সর্বজন সম্মত প্রধান দুটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি।

১| অঞ্চল ভিত্তিক লোকসংগীত।

২| বিষয়বস্তুগত লোকসংগীত।

অঞ্চল ভিত্তিক লোকসংগীতকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-

ক) পাহাড়ের গান। 

খ)  নদীর গান। 

গ) সমভূমির গান। 

বিষয়বস্তুগত লোকসংগীতকে আমরা চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি-

ক| উৎসব ও অনুষ্ঠানের গান। 

খ) কর্ম ও শ্রম কেন্দ্রিক গান। 

গ) প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের গান।

ঘ) ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের গান। 

কর্ম ও শ্রম লোকসংগীতের একটি মৌলিক প্রেরণা। কৃষি-সমাজে কৃষির সঙ্গে কর্ম ও শ্রম জড়িত। এরই প্রেরণায় উর্বরতা তন্ত্র ভিত্তিক বহু উৎসব ও সেই সমস্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে বিচিত্র সংগীতের উৎসারিত ঘটেছে লোকসমাজে। সেই সংগীত গুলির মধ্যে একদিকে যেমন লোক সমাজের আশা ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তেমনি বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও ধ্বনিত হয়েছে রূপকের আড়ালে। 

বর্তমানে বৈশিষ্ট্যহীন লোকসংগীত আমাদের মনোরঞ্জন করছে বটে তবে যথার্থ লোকসংগীত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবেশনে যথেষ্ট যত্নবান না হলে কবিগুরুর প্রিয় লোকসংগীতের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য গুলি অবলুপ্ত হবে। 

তথ্যসূত্র

১|স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ ; সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান ;    পৃঃ ৩

২| শ্রী সুকুমার সেন; বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস; প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৯৯২

৩|দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত ; বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, ২০০৪,পৃঃ ১৪২-১৪৩

_____________________________________

সহযোগী গ্রন্থ  

১| প্রঞ্জানানন্দ স্বামী      : সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ,১৯বি,    রাজা রাজকৃষ্ণ ষ্ট্রীট, কলকাতা, ১৯৬৫

২| সেন শ্রী সুকুমার  : বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, কোলকাতা।

৩| হক এনামুল: লোকসংগীত ও গণসংযোগ, আকাদেমি অব ফোকলোর, কোলকাতা, ১৯৯৯

৪|বড়ুয়া সুধাংশু বিমল,  চৌধুরী  দুলাল (সম্পাদিত)  : বাংলার লোকসংস্কৃতির  বিশ্বকোষ, আকাদেমি অব ফোকলোর, ২০ বি,সেন্ট্রাল রোড, কোল-৬, ২০০৪

৫|   সাহা রীতা: লোকসুরাশ্রয়ী রবীন্দ্র সঙ্গীত, (গবেষণা অভিসন্দর্ভ), লোকসংস্কৃতি বিভাগ,

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের নদীয়া, ২০০৬

সর্পদেবী মনসা, নাগাম্মা, বালনাগাম্মা, মুদামা ও মঞ্চাম্মা

বিষহরি পূজা’ই  প্রকারান্তরে মনসা পূজা। আমাদের দেশে যেখানেই সাপের ভয় বা সাপের উৎপাত বেশি সেখানেই সাপের দেবী রয়েছে। তার পুজো হয়। নানা লোকাচার পালিত হয় সর্দপদেবীকে কেন্দ্র করে। বাংলায় বিশেষ করে দক্ষিন ও দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে সাপের উৎপাত বেশি। তাই সাপের দেবীর মাহাত্ম নিয়ে লোকাচারও বেশি। এখানে সাপের দেবতা – মনসা ।গ্রামে গ্রামে মনসার থান আছে। সেখানে নিয়মিত মনসার পুজো হয়। আবার বাড়িতেও তুলসী তলার পাশে একটা মনসার ডাল পোঁতা থাকে। সেই মনসার গাছেও মনসা দেবীর অধিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। বাংলার বাইরেও সাপের নানা দেবতা আছে। কোথাও নাগরাজ, কোথাও নাগাম্মা। আবার বালনাগাম্মা, মুদামা ও মঞ্চাম্মা ইত্যাদি আরো কতো নাম। দেবীর মাহাত্মনিয়ে অনেক গল কথা মুখেমুখে প্রচলিত। তা নিয়ে কত গল্প , নাটক সিনেমা হয়েছে। এখনো তা মানুষের কাছে অসীম আগ্রহের বিষয়।

গ্রামের সার্বজনীন মনসা থানে সমবেত হয়ে যে সমস্ত বার ব্রত ও উপবাস গুলির পালন করা হয় তার মধ্যে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল দশমীতে অনুষ্ঠিত বিষহরি মনসা পূজার ব্রত অন্যতম এক মাঙ্গলিক ব্রত রূপে বিবেচিত হয়।যদিও  দক্ষিনবঙ্গে এই একই দিনে দশহরা গঙ্গা পূজারও আয়োজন হয়ে থাকে।

ব্রতগুলি গ্রামীন মহিলাদের অজস্র সংস্কারে আকীর্ণ। প্রতিটি পূজার ব্রতর ন‍্যায় মনসা পূজার ব্রততেও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। সধবা নারীরা এই পূজার ব্রতাচার পালন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ঠিক পূজার আগের দিন নিরামিষ খাবার রান্না করে থাকে। দশহরা পূজার দিন রান্নার কোনো বাহ‍্যিক রীতি রিয়াজ বা নিয়ম নাই। ওই দিন দশ প্রকার পুষ্পবতীপত্র, ফুল ও ফলমূলাদি সহ দুধ-কলা ও মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয় বলে এরূপ পূজার নামকরণ দশহরা পূজা রাখা হয়েছে। প্রধানত দুধ-কলা ও চিনি সন্দেশের নৈবেদ্যে পূজা দেয়া এই ব্রতের অন‍্যতম প্রধান রীতি ও নিয়ম। এই ব্রততে দেবী মনসার সন্তুষ্ট হওয়ার নানান মাহাত্ম্য কথা লোক সমাজে অধিক প্রচলিত আছে। তিনি সর্প কূলের আরাধ‍্য দেবী। আষাঢ় ও শ্রাবনের পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে আমন ধানের ফলন খুব ভালো হয়ে থাকে। কিন্তু অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে যেমন ধানে অপরিণত শষ‍্যের (আগড়ার)পরিমাণ বাড়ে। আবার এই অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের উৎপাতে মানুষ বেশি অতিষ্ট হয়। আবার অতিরিক্ত বৃষ্টিতে যখন মাঠ ঘাটে জলে ভরপুর হয় তখনও এই একই পরিণতি ঘটে। শুধু তাই নয় অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের বিষের পরিমাণ ও তার তীক্ষ্ণতা এতোটাই বাড়ে যে (কালাচ, কেউটে, চন্দ্রবোড়া) সাপের কামড়ে বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসার প্রাগ মূহুর্তে প্রাণ হারায়। তাই বিষধর কাল সাপের কামড়ের হাত থেকে বিরত থাকার অন‍্যতম এক মানসিক শক্তি লাভের পথ হিসাবে মানুষ বিষহরা মনসা পূজার প্রচলন শুরু করেছিল এমনই কিছু অনুমান করা হয় লোক শিক্ষার অন্দর মহলে। মনসা কালসাপ কূলের প্রধানা রূপে খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে উপশাস্ত্রীয় দেবীপুরাণে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। মনসা মঙ্গলের পালাতে মনসার লীলামহিমার ভয়াবহ ঘটনায় তার সেই বাহন কালসর্পের পরিচয় অতি সহজেই মেলে। তাই সেই বাহন স্বরূপ কাল সাপের হাত থেকে জীবন রক্ষার দরুন বিষহরি ব্রত ও পূজার আয়োজন করে থাকে দক্ষিণবঙ্গ তথা অখণ্ড বাংলার নারী সমাজ। ব্রতের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা মূর্তি হলেও প্রকৃত পক্ষে পূজার নৈবেদ্যাদি নিবেদন সমার্পন করা হয় একটি কাটা সিজ মনসার ডালের সন্নিকটে। যেখানে লাল রঙের সিঁদুর দিয়ে রাঙায়িত করা হয়। তার সামনে দুধের বাটি ও কলা নিবেদন করেন গ্রামের মায়েরা। এই সিজ মনসার ডাল পূজার প্রচলন যে ঠিক কবে সে বিষয়ে সঠিক তথ্যের উপস্থাপন মোটেই সহজ নয়। তবে অধিকাংশ লোক দেবদেবীদের মূর্তি পূজার পূর্বে  যেমন তাদের (আটেশ্বর, পেঁচাপেচি, ধর্মঠাকুর)  বৃক্ষ পূজারই অধিক প্রচলন ছিল। মনসা পূজার ক্ষেত্রেও এই তথ‍্য একেবারে অযৌক্তিক নয়। বৃক্ষের মধ‍্যে বট, অশ্বথ্ব, পাকুর, বেল, তাল, সিজ মনসার বহুল প্রচলিত ছিল বলেই অনুমান করা হয়।

মায়েদের অনেকেই এদিন উপোস রাখে। গ্রামের মন্দিরে আবার অনেকেই গন্ডিও দিয়ে থাকে পরিবারের সদ‍স‍্যদের কল‍্যাণার্থে। আবার অনেকে বাড়িতে ব‍্যাক্তিগত ভাবে সিজ মনসার ডাল লেপন করে সেখানেও পূজা দেয়। আবার অনেকে বলেন এই ব্রততে গঙ্গা ধরণীর বক্ষে পদার্পন করেন। তাই এ দিন গঙ্গা স্নানে দশ প্রকার পাপ খণ্ডিত হয় বলে অনেকে গঙ্গা পূজার ব্রতও পালন করে গঙ্গা স্নান সুসম্পন্নের মধ‍্যে দিয়ে।

বিষহরা ব্রত পালনকারী যযমান দের প্রতি প্রত‍্যেকের ঘরে ঘরে পান্তা খেয়ে পূজার রীতি রক্ষা করে। উনুন জ্বালানোর রীতি নাই। লোক সমাজে পৌরাণিক গল্পের কাহিনীতে বর্নিত রয়েছে যে ওই দিন উনুন জ্বালানো হলে দেবী মনসা তাঁকে স্বপ্নে সাপের ভয় দেখান। এমনকি বাস্তবেও বিষাক্ত কালসর্প এই অপরাধের কারণে দংশনও করতে পারে। তাই সমস্ত দক্ষিণ বঙ্গ জুড়ে বেশ ঘটা করে এই পূজার নিয়ম কানুন, ব্রত ও উপাচার পালন করতে দেখা যায়।

গ্রামের মহিলাদের বেশীরভাগ মায়েরা সর্প দংশনের ভয়ে ভীত হয়ে এই দেবীকে বেশ ঘটা করে পূজা দেয়। কারণ মনসার পালা গানে এই দেবীর চন্দ্রধরের নিকট থেকে পূজা নেওয়ার কৌশল অন‍্যান‍্য অঞ্চলে অজানা থাকলেও এদের অজানা নয়। তাই অন্যান্য দেবীর তুলনায় এই লোক দেবীর প্রতি অনেক বেশী ভক্তি বর্ষিত হয়। ভক্তির সঙ্গে হোক বা ভয়ে ভয়ান্বিত হয়েই হোক দীর্ঘদিন ধরে মানুষ এই নাগদেবী কে পূজা দিয়ে আসছে।

এই ব্রত ও পূজার আয়োজনে কোনো প্রকার মূর্তি পূজা করা হয় না। কিন্তু যাদের বাড়ির আরাধ্য দেবী মনসা তাদের বাড়িতে বেশ ঘটা করে পূজার আয়োজন করা হয়। মূলত ঠাকুর ঘরের এক কোণে বা তুলসী মন্ডপের পাশে একটা সিজ মনসার কান্ড কে কাদার মধ্যে পুঁতে সেখানে এই পূজার যাবতীয় উপাচার গুলির আয়োজন করা হয়। কোনো কোনো জায়গায় গ্রামের সার্বজনীন মনসার থানে পূজার আয়োজন করা হয় পূজার উপাচার গুলি নিয়ে। সিজ মনসার কান্ড কে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। তার সামনে ধূপ, দ্বীপ, চন্দন, ফুল ও ফল মূলাদি, মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয়। যখন সমস্ত গ্রাম জুড়ে প্রচন্ড সাপের উৎপাতের স্বীকার হয় তখন গ্রামের সার্বজনীন থানে সকলে একত্রিত হয়ে গন্ডি দেয়, ছলনা করে, মানত করে, পূজা দেয়, সিন্নি -ষষ্ঠী দেয়, পুরোহিত ডেকে মঙ্গল ঘট বসিয়ে পূজার শান্তি জল দেবীর চরনামৃত স্বরূপ গ্রহণ করে। দশহরা পূজার এই পূন্য লগ্নে বহু থানে মনসার পালা গানের আয়োজন করা হয়।অনেকে আছেন যারা আর্থিক দিক থেকে সবল তাঁরা ব্যক্তিগত মনসার গানের দল বায়না করে। সমস্ত পরিবারকে সাপের উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য গৃহস্থরা এই পূজার  আয়োজন করে। দক্ষিণ বঙ্গের বহু গ্রামাঞ্চল রয়েছে যেখানে নারী সমাজের বিশ্বাস ইচ্ছাধারী নাগদেব দেবী আজও জগতে বসবাস করে। এদের পূজার আয়োজন হয় দিন,বার ও তিথির পুন্য মূহুর্তে।ভক্তরা নাগদেবী রূপী এই সাপের সেবনের জন্য পাত্রে ভরে দুধ ও কলা দিতে দেখা যায় দু’এক জায়গায়। মনসার মৃন্ময়ী মূর্তির পিছনে এদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে অনায়াসে এরা সেই দুধ সেবন করে আবার গর্তে  ঢুকে যায়। গ্রামের মানুষ বলেন এরা কারো কোনো ক্ষতি বা অনিষ্ট করে না।বরং বহিরাগত শত্রু দের হাত থেকে গ্রামের মানুষ কে রক্ষা করে আসছেন বহু বছর ধরে। তাই মনসা দেবী শুধুমাত্র আর দশটা দেব দেবীদের মত ঠিক তা নয়। তিনি গ্রামের মানুষের থেকে একদিকে যেমন পূজা নেন বিনিময়ে গ্রামের মানুষের রক্ষার ভার ও তিনি বহন করেন। তাই শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে মনসা দেবীকে কেন্দ্র করে বহু প্রকার বার, ব্রত ও  উপাসনার নিয়ম রয়েছে।

দক্ষিনবঙ্গের গ্রাম সমাজে পূজনীয় সর্পের দেবী মা মনসা

 পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে আর দশটা লোক দেবদেবীর মধ‍্যে বিষাক্ত সাপের থেকে ত্রাণের একমাত্র দেবী রূপে মা মনসার মূর্তি সবচেয়ে বেশি পূজিত হতে দেখা যায়। এই মনসা মূর্তির আচ্ছাদিত পোশাক একদিকে যেমন শ্বেতবস্ত্র পরিধানে তিনি বিশ্ব শান্তি প্রদায়িনী, জগতের কল‍্যাণ রূপী, জগতের ধারক বাহকের স্নেহ বাৎসল‍্য রূপী মমতাময়ী জননীর এক ভাব মূর্ত প্রতীক স্বরূপ, ঠিক এর বিপরীতার্থে এই দেবীর এক রুদ্র ও বিনাশী ভাবমূর্তি রয়েছে যা অত‍্যন্ত ভয়াল ভয়ঙ্করী। শাস্ত্র অনুসারে কাল বিষাক্ত সর্প এই দেবীর অন‍্যতম প্রধান বাহন। তাই এই দেবীর প্রতি অশ্রদ্ধা ও অভক্তির পরিণতি বিষাক্ত সাপের কামড়ে প্রানের বিনাশ ছাড়া আর কিছু নয় এমন কিছু কাহিনীর কথা প্রচলন রয়েছে এই অঞ্চলের সামাজিক রীতি নীতিতে। তাই এই দেবীর অনুগত ভক্তদের বেশিরভাগ ভক্তি অপেক্ষা ভয়ে এই দেবীকে বেশি পূজা দেয়। ফলতঃ জনপ্রিয়তা অতি সহজেই অর্জিত হয়ে যায়। প্রতিটি গ্রামের সার্বজনীন থানে আর অন‍্যান‍্য দু দশটি দেবদেবীর সঙ্গে একদিকে যেমন তাঁর দেবী মূর্তি অনুগত ভক্তদের থেকে পূজা পেয়ে আসছে আবার অজস্র ব‍্যাক্তিগত মন্দির বা থান রয়েছে যে মন্দিরের আরাধ‍্য লৌকিকদেবী রূপে শুধুমাত্র তারই দেবীমূর্তি স্থান পেয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজে মনসা দেবীর পত্তন, সময়কাল, লীলার মাহাত্ম‍্য কথা বিস্তারিত তথ‍্যে নিম্নে বর্ণনা করা হল ।

মনসা দেবীর সৃষ্টি রহস্য ও দক্ষিণাঞ্চলে তার পূজার পত্তন

মঙ্গল কাব্যের যে সমস্ত দেবী, দেবতারা বাংলার বুকে সুদীর্ঘদিন ধরে পূজিত হয়ে আসছে এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও ভয়াল ভয়ঙ্কর দেবী হিসেবে মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মা মনসার নাম। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে যে তিনি নাগকুলের মূল আধিষ্ঠাত্রী সর্পকুলের প্রধান দেবী রূপে জগতে প্রতিষ্ঠিত। মনসা আদি বৈদিক যুগের বা পুরাণের মহিমান্বিত বা রামায়ণ অথবা মহাভারতের যুগের মানুষের আরাধ্য কোনো দেবী নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শাস্ত্র গুলি ভালো করে অধ্যায়ন করে স্পষ্ট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে সেকালে কেবলমাত্র বাসুকি নাগ ও পরবর্তীতে কৃষ্ণের কালে কালীও নাগ নামটি ছাড়া আর অন্য কোনোও বিশেষ সর্পের দেব দেবতার নাম পুরাণাদি গ্রন্থগুলিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগ কুলের অধিষ্ঠাতা দেবতা বাসুকি হলেন নাগেদের রাজা। সাংস্কৃত শাস্ত্র ও উপপুরানে বলা হয়েছে নাগরাজ বাসুকির ভগিনী হল এই মনসা দেবী। সর্পকূলের দেবী নাগিনী নামটির দ্বারা এই সীদ্ধান্তে অনুমান হওয়া যায় যে ইহা আধা নর ও আধা সর্পের এক ভয়ঙ্কর মূর্তি বিশেষ কোনো রূপ অথবা ঐশ্বরিক শক্তিতে বলিয়ান কোনো বিশেষ বিষধর সর্প হবে যার মধ‍্যে রূপ পরিবর্তন করার ইচ্ছাশক্তি আছে । ইতিহাসের পাতায় যা স্কাইথীয় নামে পরিচিত। কিন্তু মনসা নামটির সঙ্গে সর্পের সম্পর্ক ঠিক কবে থেকে জগতে প্রচলিত হয়েছে তা গভীর অনুসন্ধানের একটা বিষয়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে তাহার নাগ পরিবার, নাগরাজ বাসুকির ভগিনী তিনি তাই সেই কারনে দেবীর সঙ্গে সর্পের এই রূপ সম্পর্ক। যদিও শৈবপুরাণে দেবাদিদেব মহাদেবের সন্নিকটে যে বিষধর সর্পটির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে উদয় নাগ উহাতে সর্প দেবতাদের অনুচর স্বরুপ পূজিত হয়ে এসেছে। ব্যাক্তিস্বতন্ত্র রূপে কোনো দেবতা বা দেবী রূপে অধিষ্ঠানের কথা পুরাণের কোথাও বা শাস্ত্রে উল্লেখ নেই। বৈদিক যুগের মানুষ দেবীমূর্তি আরাধনার পরিবর্তে নিরাকার ব্রহ্মের ধ্যান, যাগযজ্ঞ ও প্রকৃতি পূজার প্রতি বেশি মনোযোগী হতেন। বেদ, পুরাণে স্পষ্ট তার প্রমাণ দেওয়া হয়েছে – ‘ধ্যায় শূন্য অহর্নিশম’। অতএব এত্যদ্বারা এই সত্য প্রমাণিত হয় যে মনসা পূজার সৃষ্টি বিগত আটশো নয়শো বছরের মধ্যবর্তী কোনোও এক সময় হবে, ইহার পূর্বে নহে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনও পর্যন্ত যে কয়টি পৌরাণিক মনসা মন্দির ও মনসা দেবীর খোদায় করা মূর্তির সন্ধান পেয়েছে ইহাদের অধিকাংশ মূর্তি সর্বোচ্চ সেন বংশের রাজাদের আমল পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সেনরাজ বিজয় সেনের আমলে প্রতিষ্ঠিত মনসা মূর্তির কয়েকটি প্রমাণ ও পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ ইহার থেকে আরো বিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে এই দেবীর জগতে অধিষ্ঠান হলেও সত্য হতে পারে কিন্তু তাহার এক কাঁচা পূর্বে নয়। কিন্তু মনসামঙ্গল কাব্যের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা নামটির আদি সৃষ্টি বা উৎপত্তি ঠিক কবে এ সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত শাস্ত্র অথবা পুরাণ গুলির একটিতেও মনসা নামটি খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বপ্রথম সাংস্কৃত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, দেবী পুরাণ ও দেবী ভাগবত উপপুরাণে মনসা নামটির সহিত সাক্ষাৎ লাভ করা যায়। এই সমস্ত গ্রন্থের প্রতিটির রচনা খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর এক কাঁচাও পূর্বে নয়।

মনসা শব্দটি ভারতীয় অর্বাচীন অনার্য ভাষা গোষ্ঠী হইতে এসেছে । মনসা নামটি অলুক সমাস। এখন অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন নামটি এসেছে তো এসেছে কোথা থেকে।  

দক্ষিণ ভারতের লোক সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দ্রাবিড় সভ্যতার নিম্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা আজও বহু সর্পের দেব দেবীর পূজা করে আসছে। যেমন- নাগাম্মা, বালাম্মা, মুদামা ইত্যাদি। নাম গুলি শুনে মনে হয় দাক্ষিণাত্য তেলেগু ভাষায় রচিত বিশেষ সর্প রূপের জাগ্রত দেবীই হবে। নাগাম্মা মা সর্প ও বালাম্মা ইহার কন্যা। প্রতিটি সর্পদেবীর আঞ্চলিক ভেদে নানান মাহাত্ম্যও রয়েছে। যেমন নাগাম্মা দেবীর কাহিনী পুতুল নাচ, সামাজিক পালাগানের মধ্যে দিয়ে আজও বর্ণনা করে চলেছে অন্ধ্রপ্রদেশের একশ্রেণীর স্ত্রী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দল। শুধু অন্ধ্রে নয় চেন্নাই সহ দক্ষিণের সমগ্র গ্রামাঞ্চল তথা শহরাঞ্চলেও বহুজাতিক সর্পের দেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে।

কর্নাটকের মহীশূরে মুদামা নামে এক বিশেষ ধরনের সর্প দেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে আজও। সমগ্র দক্ষিণের নারী সমাজ আজও দেবী রূপে ইহাকে পূজা করে। দাক্ষিণাত্যে প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ববিদরা ভাস্কর্য খোদায় করা এই দেবীর বহু মূর্তির সন্ধান পেয়েছে।  এই সর্প দেবীর মূর্তি অন্যান্য সর্পদেবীর মূর্তির তুলনায় একটু আলাদা। এই মূর্তির বিশেষত্ব হলো ইহার উদরের নিম্ন ভাগ সর্পাকৃতি ও উদর থেকে মস্তক পর্যন্ত কন্যাকৃতি। অর্থাৎ আধা নাগিনী ও আধা নারী মূর্তি বিশেষ মূর্তি।

আবার নাগাম্মা, বালনাগাম্মা, মুদামা ভিন্ন দক্ষিন ভারতের কানাড়া প্রদেশে মঞ্চাম্মা নামে এক দেবীর পূজার ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। ইহার মাহাত্ম্য হল ইহার কোনো মানবী রূপী দেবী মূর্তি বা রূপ নাই। মনে মঞ্চাম্মা এক অদ্ভুত অদৃশ্য সর্পের নাম। এই সর্পটি স্বর্গের নাগ জাতিগোষ্ঠীর একাংশ বলে মনে করা হয় বলে সর্পটির উপর দেবীত্ব আরোপ করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই মঞ্চাম্মা দেবীর পূজার আয়োজন করে ভক্তরা। বল্মীক রূপ এক স্তুপ  বা ঢিবির সামনে পূজার নৈবেদ্যাদি ফুল,পুষ্পচন্দনে সুসজ্জিত করে পূজা দেওয়া হয় এই দেবীকে।

এখন অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন বাংলার অনার্য সভ্যতার ভাষাগোষ্ঠীর শব্দভাণ্ডারে সৃষ্ট এই মনসা নামের সঙ্গে ইহাদের মিল কতখানি। উপরিউক্ত যে সর্প দেব দেবীদের নাম গুলি দেওয়া হয়েছে তার প্রতিটি নাম দেখে ও উচ্চারন বুঝে স্পষ্ট বলা যেতে পারে ইহাদের প্রতিটি নাম স্ত্রী লিঙ্গ অর্থাৎ দেবীমাতা। তেলেগু, তামিল, বা কন্নড় যে ভাষায় দেবী গুলির নাম যে ভাবেই সৃষ্টি হউক না কেন প্রতিটি দেবীর নামের উৎপত্তি গত ও ব্যাকারণ গত মাধূর্য আছে। মনে মঞ্চাম্মা দক্ষিন ভারতের সর্পের দেবীর নাম। আবার আমাদের বাংলার সর্পের দেবীর নাম মনসা। দক্ষিণ ভারতের এই দেবী বাংলাদেশের বুকে নাম একটু বদলে মঞ্চাম্মা’থেকে মনসা আম্মা রূপে পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব নহে। শুধু মঞ্চা-এর চা এর পরিবর্তে সা শব্দটি উচ্চারণ করিলে মনসা উচ্চারণ হতে পারে। এখন বিচার করা প্রয়োজন যে, যদি এই তথ্যের ভিত্তিতে মনসা নামটি এসে থাকে তবে এই নামের বার্তা বাহক কে বা কারা ? একমাত্র সর্পদের নিয়ে খেলা দেখাতে দেখাতে বেদিয়া সাঁপুরের দল এর বার্তা বাহক হতে পারে। কিন্তু এই তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট করে বলা যায় না যে এই তথ্য সম্পূর্ণ সত্য। যদিও এককালে বেদে সাপুড়ের দল সারা দেশে ভ্রমণ করতে করতে সাপ খেলা দেখাত।

আবার নাগাম্মা রুপী দক্ষিন ভারতের সর্প দেবীর সঙ্গে মনসা দেবীর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিচার করে দেখলে কিছু কিছু মিল ও অমিল পরিলক্ষিত হয়। নাগাম্মার প্রকৃত রুপ যেহেতু আধা নাগিনী ও আধা কন্যা তাই মনসার সঙ্গে ইহার পার্থক্য রয়েছে। শুধু তাই নয় বৈসাদৃশ্যের দিক দিয়ে আরোও কিছু কিছু পার্থক্যও রয়েছে। মনসা মঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও দক্ষিণ ভারতের এই প্রতিটি সর্প দেবীর মাহাত্ম্য কাহিনীও সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এখন দক্ষিনবঙ্গে মনসা ও তার অন্যতম প্রধান বাহন সর্পের কয়েকটি লোক বিশ্বাস সম্পর্কে দেওয়া হল। যেগুলি খুব আন্তরিক ভাবে মান‍্য হয়ে আসছে কয়েক দশক আগে থেকে।

মনসার বাহন সাপ সম্পর্কে দক্ষিনবঙ্গে গ্রাম‍্য সমাজে প্রচলিত কিছু যাদুকরী লোকবিশ্বাস

1.            সর্পের দেবী মনসার স্বপ্নবরে ঘর সংসার সুখী হওয়ার জন্য গুপ্তধন, রত্নসম্পদের সুযোগ সন্ধান সম্পর্কিত কিছু আবেগপ্রবন লোক গল্পের প্রবাদ প্রচলন এই সমাজে রয়েছে। সর্পের মাথার মণি সাত রাজার ধন। তাই তাকে প্রসন্ন করতে পারলে অনেক বেশি রত্ন সম্পদের মালিক হওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় বুক বাঁধে নারীপুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের সবাই।

2.            দেবী মনসাকে দুধ-কলা ও অন‍্যান‍্য নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারলে তার কৃপায় নিজদের শাঁখা সিঁদুর সতীসাবিত্রী ও বেহুলার ন‍্যায় চির অক্ষয় থাকবে এরকম একটা কল্পনাও সচরাচর করা হয়।

3.            বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীর দেহে পুনরায় প্রান ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র এই দেবীর। মনসামঙ্গলে তার রূপ চিত্রায়ন হয়েছে। তাই অন্যান্য লোক দেবীর পূজা অপেক্ষা এই দেবীর পূজায় বাস্তবিক জীবন সুস্থ সবল ও বিপদমুক্ত থাকার একটা মানসিক তৃপ্তিও অনুভব করা হয়।

4.            বিষধর সর্পের কোনো প্রকারে একবার মৃত্যু ঘটলে  কোনো কোনো জায়গায় তার বিষদাঁত ভেঙে তা সংগ্রহ করে রাখার রীতি নীতি রয়েছে। পরে ওই বিষদাঁত টি মাদুলি ও কবচে ভরা হয়। এই মাদুলি ও কবচ বয়োঃজ‍্যাষ্ঠ মানুষদের বাতের ব‍্যাথা হলে তাকেই পড়িয়ে দেওয়া হয়। বাতের ব‍্যাথা থেকে চীর মুক্তি লাভের আশায় আশায়।

5.            যারা নিতুই বিষধর সর্পের স্বপ্ন দেখে, বহুমূত্র ব‍্যাধির স্বীকার, পরিণত কৈশোরেও বিছানায় ঘুম ঘোরে মূত্রত্যাগ করে তাদের অধিকাংশই সাঁপুরে, বাজিকরদের স্মরণাপন্ন হয়। বাজিকরেরা যখন গ্রামে গঞ্জে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াত তখন তাদের ঝোলাতে নানান রোগ নিরাময়কারী ঔষধের সম্ভার থাকত। প্রতিটি রোগের মাদুলি ও কবচের ব‍্যবহার। অর্থাৎ এই সুযোগে সাঁপুরে বাজিকরদের দল ঔষধ বিক্রি করার একটা ফাঁদ পেতে বসে।

6.            প্রতিটি বাড়িতে একটি করে বাস্তুসাপ থাকে। এই সাপ কারো ক্ষতি করে না।  গ্রামের প্রতিটি মানুষ বাস্তুর মঙ্গল কামনার্থে এই সাপের রক্ষণাবেক্ষণ  করে থাকে।

7.            কোনো সাপের একবার মৃত্যু ঘটলে তাকে দাহ করার রীতি দক্ষিনবঙ্গের প্রায় সর্বত্র প্রচলিত রয়েছে। এক্ষেত্রে বাস্তুসাপ মারা গেলে অনেক গৃহস্থ ভক্তরা ক্ষৌরকর্ম, শ্রাদ্ধ শান্তি ও মস্তক মুণ্ডনও পর্যন্ত করে থাকে। তবে কারো আঘাতে কোনো বিষধর সর্পের মৃত্যু ঘটলে মূলত তার বংশোদ্ভূতদের দ্বারা প্রতিশোধ নেওয়ার এক ভৌতিক লোক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস বিশেষত তার চোখ ও স্মৃতিতে ওই আঘাতকারী ব‍্যাক্তির প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়ে যায়। তাই সাপের মুখমণ্ডল দাহ করে দিলে এর থেকে চীর মুক্তি পাওয়া যায়।

8.            রাত্রে এলোমেলো বিছানায় বিষধর সাপের কামড়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। তাই গ্রামের মানুষের লোক বিশ্বাস মনসা ও তার স্বামীর নাম স্মরণ করে বালিশে ‘আস্তিমাতা ‘টোকা দিলে আর এরূপ অনিষ্ট ঘটে না।

9.            বিনের আওয়াজে মনসার বাহন কালসর্প খুবই নেশা গ্রস্থ হয় এমন এক অদ্ভুত ধারণা আজও বেদেদের একদল গ্রামে গঞ্জে ঘুরে খেলা দেখিয়ে প্রমাণ করে বেড়ায়। শুধু তাই নয়  ধূনার গন্ধেও সে ঝিমিয়ে পড়ে। তাই তার পূজার পূণ্যমূহুর্তে কোনোরূপ ধূনা ব‍্যবহারের রীতি নাই। এসবের ব‍্যবহারে তিনি রুষ্ট হন বলে পুরোহিতদের একদলকে বলতে শোনা যায়।

10.          হেঁতালের গন্ধে কালসর্প ঝিমিয়ে পড়ে। তাই তার পূজার পূণ্য লগ্নে হেঁতালের ব‍্যবহৃত ছড়ির পরিবর্তে কঞ্চির ছড়ি ব‍্যবহার করে কাঁসা বাজানোর  রীতি রিয়াজ আজও কমবেশি চোখে পড়ে।

11.          সাপে কাটা রোগীর দেহে প্রাণ বিয়োগ হলে সেই দেহে কেবলমাত্র মনসার সাধনায় সিদ্ধ গুনীন, বদ্যি  ও ওঝারাই  প্রান ফিরিয়ে আনতে পারেন- এই কথা আজও নিরক্ষর মানুষের মনে বিশ্বাস। ওঝা ও গুনীনরা এই দেবীর আশির্বাদ ধন্য মানস বা বরপুত্র। তাদের কাছে সাপে কাটার যাবতীয় ঔষধের সম্ভার রয়েছে ।তাই গ্রামের মানুষ বিজ্ঞানের ধারাপাত অপেক্ষা মনসা ও তার আশির্বাদধন‍্যা ওঝা, বদ‍্যিদেরকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

12.          সর্পে দংশিত রোগীরা মারা গেলে তাদের পোড়ানোর রীতি দক্ষিনবঙ্গের লোক সমাজে নাই। সমাধি দেওয়া হয় এই কারনে রোগীর দেহে পুনরায় প্রাণ ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায়, বিশ্বাসে ও কল্পনায়।

13.          লোক সমাজে প্রবাদ প্রচলন রয়েছে যে সাপে কাটা রোগীদের প্রান দেহের মধ্যে থেকে যায়। বিষের জ্বালায় নীল হয়ে যায় সমস্ত শরীর। শ্বাস প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য মৃতদের আগুনের সৎকারে মৃতদেহ চীর ভষ্মীভূত হয়ে যায় শ্মশানে। কিন্তু সাপে কাটা রোগীদের মৃতদেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। তার একটি মাত্র কারন কোনো সহৃদয় ওঝা বা গুনীনের সান্নিধ্যে এসে যদি আবার পুনঃজন্ম লাভ করে এমন কিছু কাঙ্ক্ষিত আশায়।

14.          সাপের বিষ থেকে যে  (SAVS)   স্নেক এন্টি ভেনম সিরাম তৈরি করা হয় তা দিয়ে  সাপে কাটা রোগীর প্রান বাঁচানো সম্ভব। তাই একটি বুদ্ধিজীবী মানুষের চিন্তা ভাবনায় বিষাক্ত সাপকে হত্যা না করে বরং তাঁকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

15.          সাপ বংশের ধারক বাহকের প্রতীক। নিঃসন্তান মাতাপিতা একটি  সন্তান কামনায় এই দেবীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে ভক্তি দিয়ে পূজা করে, ছলনা দেয়, গন্ডি দেয় ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

মনসার বন্দনা গান

গ্রামের সার্বজনীন মন্দির গুলির মহোৎসব পর্বে মনসা দেবীর উত্থান ও পূজা পার্বণের পুণ্য লগ্নে সমগ্র উনবিংশ, বিংশ শতাব্দী থেকে আজও গ্রামের সধবা মহিলাদের একদল সমবেত কণ্ঠে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মঙ্গল ঘট বসিয়ে এক সুন্দর লোক সুরের আঙ্গিকে মনসার বন্দনা গান গায় দশহরার ব্রত পালন করে। প্রতিটি গ্রামের সার্বজনীন থান বা মন্দিরে সমগ্র গ্রামের মাঙ্গলিক লোক দেবী রূপে দীর্ঘকাল যাবৎ ভক্তদের কাছে থেকে মনসা পূজা নিয়ে আসছে। তাই বৎসরান্তে এক দুই বার তার মহিমা কীর্তন পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে মানসিক সুখ শান্তি অনুভব করে দক্ষিণ বঙ্গে এই দেবীর অনুগত ভক্তরা। লোক সঙ্গীতের আর অন্যান্য শৈলীর মতো মনসার পাঁচালীগান বা অভিনয়ের মধ‍্যে দিয়ে যাত্রা পাঁচালী পরিবেশনের মধ‍্যে দিয়ে তারা দেবীর গুনকীর্তনে আনন্দে মাতে।

মনসার পাঁচালী গান‌ সম্প্রদায়ের শিল্পীরা দেবী মাহাত্ম্য কীর্তনের পালায় অনুপ্রবেশের পুণ্য মূহুর্তে পুরুষ ও মহিলা চরিত্রের সমস্ত নরনারীরা সর্বপ্রথমে ‘আশাবারী’ খনন করে দেবীকে আনয়ন করে। লোক সমাজের প্রতিটি গৃহস্থের ধারণা এই সময় মনসা দেবী জাগ্রত হয়ে তার অনুগত ভক্তদের কৃপা করেন। সেই কৃপা বর্ষনের সামান্য করুণা লাভের আশায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলাদের একদল গন্ডি দেয় থানের চতুর্দিকে। অন‍্যান‍্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষরা এই পবিত্র সঙ্গীতানুষ্ঠানেও কমবেশি উপস্থিত হয়। সেই পুন‍্য ক্ষনে শিল্পীরা মহানন্দে মনসা বন্দনা পরিবেশনের মধ‍্যে দিয়ে দেবীর চরণে নিবেদন রেখে সকলে উচ্চৈঃস্বরে গাইতে থাকে ;

জয় জয় মা মনসা, জয় বিষহরি গো ।

বন্দনা করি মাগো মা মনসার চরণে।।

তার পরে বন্দনা করি  মহাদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা

তার পরে বন্দনা করি ভগবতীর চরণে।জয় জয় মা মনসা

তার পরে বন্দনা করি মা কালীর চরণে। জয় জয় মা মনসা

ও মা – – –

মাগো আকাল বন্দন পাতাল বন্দন বন্দনা করলাম,

আমি গুরুদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা

তার পরে বন্দনা করি তেত্রিশ কোটি দেবতা। (জয় জয়)

সামাজিক গুরুত্ব

 এখন অনুসন্ধান করা প্রয়োজন মনসা দেবীর এই বাস্তবিক পূজার সামাজিক গুরুত্ব কতখানি। সেক্ষেত্রে দেখা যায় দক্ষিণ বঙ্গে অধিকাংশ গ্রামগুলির সার্বজনীন থানে মনসা দেবীর মূর্তি পূজার একটা বেশ বড়সড় রীতি রিয়াজ পালন করা হয়ে আসছে বহু পূর্বাপুরুষ ধরে। যদিও সেখানে দেবাদিদেব মহাদেব (পঞ্চনন্দ), বনবিবি, শীতলা, লক্ষ্মী, কালি, চণ্ডী, বারা ঠাকুর সহ আরো আট দশটা দেব দেবীকে পূজা করে গ্রামের মানুষ। কিন্তু তার সত্বেও সার্বজনীন মন্দিরের বাইরেও এমন কিছু কিছু থান বা মন্দির রয়েছে যেগুলোতে শুধুমাত্র মনসা দেবীর মূর্তি ব্যাতিত আর অন্য কোনো দেব দেবীর মূর্তি পূজা করা হয় না অর্থাৎ ব‍্যাক্তিগত ভাবে শুধুমাত্র মনসা দেবীর জন্য বহু মনসা মন্দির রয়েছে। সেগুলি মনসার থান নামে পরিচিত। দক্ষিণ বঙ্গের চাষাবাদ যুক্ত পল্লী গ্রামাঞ্চল গুলিতে এ জাতীয় মনসা মন্দির সচরাচর বহু পরিমাণে দেখা যায়। কোনো স্থানে একবার মনসা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলে সেই স্থান দিনের পর ভক্তদের সমাগম বাড়ে কিন্তু কমে না। শুধু তাই নয় সেই মন্দির নির্মাণের উপাদান প্রথমে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনি হলেও দিনের পর দিন অজস্র ভক্তের গুপ্ত ব‍্যাধি তথা নানান রোগ নিরাময় ও অন‍্যান‍্য বহু সুখ সমৃদ্ধির মূলে দেবীর মহিমাকে দায়ী করে তাঁকে স্বর্ণ, রৌপ্য ও নানান গহনাদি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। পাড়ার বয়স্ক মোড়ল মতিব্বরদের উপস্থিতিতে সকলকে সাক্ষী করে ব‍্যাক্তিগত জায়গায় সৃষ্ট  পূজনীয় স্থানকে মনসা দেবীর মন্দিরের নামেই উৎসর্গ করে জমির মালিক পক্ষ। এরপরে ধুমধাম করে জাগ্রত করা হয় পুরোহিতের পূজার নানান সাংস্কৃত মন্ত্রে। গ্রামের কুমারী, সধবা ও বিধবা মহিলারা প্রতিনিয়ত সকাল সন্ধ্যায় এইসব থানে বা মন্দিরে ভোগ লাগাতে শুরু করে।

বহু ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ মনসা দেবীর থানের সন্নিকটে রয়েছে সিজ মনসার গাছ। এই গাছকে দক্ষিণাঞ্চলের মনসা ভক্তদের একাংশ স্বয়ংসিদ্ধ মনসা দেবীই জ্ঞান করে। বহু স্থানে কিছু পুরানো মনসা মন্দির রয়েছে। যেখানে সিজ মনসার গাছ গুলি প্রচণ্ড বড় এবং তার নিচের অংশ গুঁড়ির আকারে পরিণত হয়েছে। তাই মনসা দেবীর মুর্তি পূজার সঙ্গে সঙ্গে সীজ মনসার ডাল পূজার প্রচলনও রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মনসা ভক্তদের একদল অনুগত ভক্তরা বলেন যে সমস্ত গৃহে মনসা মূর্তি নাই তাঁরা সীজ মনসার কান্ড কাদায় প্রতিষ্ঠিত করে যদি পূজা দেয় তবে সেই পূজাতেও এই দেবী সন্তুষ্ট হয়। মনসা রূপী এই সীজ মনসার ডালের সামনে পূজার নানান নৈবেদ্যাদি সাজিয়ে পূজার আয়োজন করা যেতে পারে। বস্তুত মনসা মূর্তি ও সীজ মনসার কান্ড পূজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দী হতে পল্লী বাংলার গ্রামাঞ্চল গুলিতে গৃহস্থের নিজের আরাধ্য দেবীর পূজার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মনসা। এই দেবীর ভাক্তাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়তার যে কারণ গুলি মানা ‌হয় তা বিস্তারিত তথ্যে উপস্থাপন করা হল;

1.            অখণ্ড বাংলায় আর দশ বিশটি লৌকিক দেবদেবীর মতো খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে মনসা দেবীর উত্থান হয়েছিল সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গ তথা বাংলার লোক সমাজে। প্রতিটি লোক দেব দেবীর বাহনের ন্যায় এই দেবীর প্রধান অনুচর কাল বিষাক্ত সর্প। যার  কামড়ের হাত থেকে রক্ষার্থে অতি সহজেই তার পূজার জনপ্রিয়তা কয়েক দশকের মধ্যে তুঙ্গে উঠে যায়। তার ভক্তরা স্বেচ্ছায় নয় বরং ভয়ে ভয়ে দেবীকে বেশি পূজা দেয় কেবলমাত্র কাল সর্পের কামড়ের হাত থেকে সপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের রক্ষার্থে।

2.            প্রতিটি লোক দেবী দেবীর উত্থানের পিছনে একটি মহান উদ্দেশ্য থাকে। গ্রামের মোড়ল মতিব্বরদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় এই সব দেব দেবীর মূর্তি রাখার প্রধান উদ্দেশ্য বহিরাগত শত্রুদের আক্রমণ থেকে সমগ্র গ্রাম কে রক্ষা করা। অনুরুপ কালসর্পমূর্তি বিশেষ মনসা দেবীর এই ভয়ঙ্কর মূর্তি প্রতিষ্টার পিছনে এটাই মহান উদ্দেশ্য।

3.            শিবের অসাধ্য হাম, বসন্ত, গুটি বসন্তের মতো কতকগুলো রোগের প্রকোপে অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গ্রামের পর গ্রাম মড়ক দেখা দিত। যার ফলশ্রুতিতে উজাড় হয়ে যেত সমগ্র গ্রামের নিরপরাধী মানুষ। এই সমস্ত রোগের কোনো চিকিৎসা তো ছিলই না বরং বলা হত শীতলা, মনসা ও বিবি মায়ের মতো কিছু দেব দেবীর ব্রত ও  পূজা পার্বনের কর্মকাণ্ডে ভুল ত্রুটি হলে তার পরিবর্তে রুষ্ট হয়ে দেবদেবীরা এসব অনিষ্ট দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি করেন। তাই ভক্তি সহকারে ধুমধাম করে তাদের পূজা ও সন্তুষ্টিতে এহেন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এমন ধ্যান ধারণায় শীতলা বনবিবির ন্যায় মনসার ও সামাজিক গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

4.            মনসা ভয়াল, ভয়ঙ্কর সর্পের দেবী রূপে জগতে পূজিতা হয়ে আসছে। কিন্তু মনসা মঙ্গল কাব্যের একেবারে শেষ মূহুর্তে আমরা এই দেবীর একটু বিপরীত চরিত্র খুঁজে পায়। চাঁদ বনিকের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার কাহিনী বঙ্গের কোনোও নারীর অজানা নয়। বেহুলার সতীত্ব ও সত্য বচন রক্ষার্থে চাঁদ সওদাগর মনসাকে বাম হাতে পূজা দেয়। চাঁদ সওদাগরের মনসা পূজার পরিবর্তে মনসা যখন সন্তুষ্ট হয়ে লক্ষীন্দর সহ ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দিল, তার প্রিয় বন্ধু শঙ্কর গারুরীর জীবন ফিরিয়ে দিল, সপ্ত ডিঙ্গার প্রতি ডিঙ্গা জলে ভাসিয়ে দিল এবং মহাজ্ঞান মন্ত্র সহ হাতি শালের হাতি, ঘোড়া একে একে সব ফিরিয়ে দিল এসমস্ত ঘটনায় আমরা কাহিনীতে আমরা মনসার ভক্ত বাৎসল্য রূপ খুঁজে পাই। সেই হারানো কাঙ্ক্ষিত সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তি পুনরায় ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় দক্ষিণ বঙ্গে মনসার দেবীর পূজা খুবই শীঘ্রই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

5.            মনসার প্রধান অনুচর কাল সর্প। যা বংশবৃদ্ধি ও বংশগতির ধারাবাহিকতার  অগ্রগতির বিশেষ প্রতীক। স্নেহ বাৎসল‍্যময়ী এক পুত্র সন্তানের বা কন‍্যা সন্ততির জননী হওয়ার আশা বা বাসনা প্রতিটি সধবা রমনীর মনে থাকে। সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ব‍্যাথা বেদনায় সে মনসার কাছে আকুণ্ঠ ভরে প্রার্থনা করে শুধুমাত্র একটি পুত্র বা কন‍্যা পাওয়ার আশায়।

6.            দেবী ভাগবত বা দেবী পুরাণে দুই হিন্দু দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় যাদের প্রধান বাহন শ্বেত হংস। এই দুই দেবীর একদিকে মা স্বরস্বতী ও অন‍্যদিকে মা মনসা। যদিও দেবী স্বরস্বতী বৈদিক যুগের সুরের আরাধ্য দেবী। তার প্রধান বাহন হংস হলেও এযুগের লোক দেবী মনসারও প্রধান বাহন হংস। হিন্দু সম্প্রদায়ের আর দশ বিশটি দেব দেবীদের ভিন্ন ভিন্ন বাহন দেখা গেলেও শ্বেত হংস সচরাচর  নম্র, ভদ্র ও শ্বেতশুভ্র শান্তির পথিক। পঙ্কিল সলিলে হংস যেমন তার প্রয়োজনীয় খাদ‍্যবস্তু গ্রহন করে অপ্রয়োজনীয় খাদ‍্যবস্তু পরিত‍্যাগ করে। তৎরূপ ভক্ত বাৎসল‍্যময়ী এই মনসা ভক্তদের মন কেই ভালোবাসে, কোনো পূজার বাহ্যিক আড়ম্বরে নয়। তাই তার ভক্তদের একাংশ বিনম্র ভক্তি ও শ্রদ্ধায় তাঁকে পূজা করে।

7.            দক্ষিণাঞ্চলের লোক সঙ্গীতের আসরে এক শ্রেণীর সঙ্গীতজীবি সম্প্রদায়ের কাছে এই দেবীর গুরুত্ব অসীম। মনসামঙ্গল কাহিনীর মূল মাহাত্ম্য কথা মনসার গান আজ বাংলার কোণায় কোণায় প্রচলিত রয়েছে। পূর্বে এই পালাগান সিঙ্গেল পাঁচালির মতো করে গান ও অভিনয়ের প্রথা প্রচলন থাকলেও বর্তমানে শ্রোতাদেরকে রসাপ্লুত ও দৃষ্টিগোচরে অত‍্যন্ত আকর্ষণীয় করে তোলার জন‍্য যাত্রাপাঁচালির প্রচলন শুরু হয়েছে। এহেন লোক শিল্পীরা বছরে প্রায় সত্তর, আশি, এমনকি একশো পালা পর্যন্ত মনসা, শীতলা ও বনবিবির গান করে তাদের সংসার খরচ বহন করে আসছে। তাই এদিক দিয়ে এই দেবীর সামাজিক গুরুত্ব অনেক খানি।

গ্রন্থঋণ :-

বাংলা মঙ্গল কাব‍্যের ইতিহাস – ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য।

সুন্দরবনের লোকদেবতা – ড . দেবব্রত নস্কর।

আলোর উৎসব : কুলকুলোতি

তুলসী প্রদীপ

পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলি জেলার জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কুলকুলোতি ব্রত ও উৎসব হয়ে থাকে। ‘কুলকুলোতি’ বা ‘কুলকুলতি’  গ্রামীন লোকাচার পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে বা হারিয়ে যাওয়া মানুষদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে থাকে।আবার কুলের মঙ্গল কামনাতেও এই ব্রত হয়ে থাকে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকেই  এই ব্রত বা লোকাচারপালনের রীতি চালু রয়েছে। চলে কার্তিক সংক্রান্তি পর্যন্ত।

আশ্বিন মাস জুড়ে দুর্গা পুজো, তার  পরেই লক্ষীপুজো, কালীপুজো চলে। আশ্বিনে লক্ষীর পুজো হয়ে থাকে। লক্ষ্মীর ব্রত হয় পৌষ মাসে।  আশ্বিন মাস পুজোর মাস।  কার্তিক মাসে ‘কুলকুলোতি’, অগ্রহায়ন মাসে নবান্ন, ইতু পুজো, পৌষ মাসে তুসু পুজো আর লক্ষীর ব্রত হয়। বাঙালির ঘরে ব্রত, আর পুজো অবশ্য সবই মিলে মিশে রয়েছে।  কার্তিক, অগ্রহায়ন আর পৌষ এই তিন মাস বাংলার গ্রামাঞ্চল উৎসবমুখর হয়ে থাকে। ছোট-বড় সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, যদিও সাধারণভাবে কুমারী ও সধবা মহিলারা এই উৎসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে শামিল হয়। কিন্তু তা’ সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িয়ে  রয়েছে,।

কুল প্রতিহত তুলসী তলায় গর্ত খুঁড়ে প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে ফুল ও কুল গাছের পাতা দূর্বাঘাস, তুলসীপাতা দিয়ে কোন দেবীর উদ্দেশ্যে গান গাওয়া হয়। এখনো হয়ে থাকে। আবার অনেকে তুলসী তলায় একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে আর টুকরো করে কাটা কলাগাছের খোলার ওপর প্রদীপ জ্বালিয়ে কিছু ফুল দিয়ে সেই কলার ভেলাটি পুকুরে বা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কলার ভেলাটি ভাসানোর সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা গান গাইতে থাকে। ভেলা ভেসে চলে দূরের পানে। আলো নিয়ে ভেলা যায় পূর্ব প্রজন্মের মানুষদের কাছে।

সাধারণত ছোট ছোট মেয়েরাই এই ব্রত করে। তবে বাড়ির ছোট ছেলেরাও এই ব্রত পালনে অংশ নেয়। মা কাকিমাদের শাড়ি পরে গিন্নির মত সেজে আলো জ্বালানো, শাঁখ বাজানোর ব্রত যেন গার্হস্থ জীবনের হাতে খড়ি। এরা কার্তিক মাসের আগে থেকেই কাদামাটির প্রদীপ গড়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। কেউ কেউ উনুনের আঁচে বা কাঠের আগুনে একটু পুড়িয়েও নেয়। প্রতি দিন তিনটি করে প্রদীপ লাগে। তাই অনেক প্রদীপ গড়তে হয়। প্রদীপ গড়া নিয়ে বেশ প্রতিযোগিতাও চলে ছোটদের মধ্যে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনটি কুলপাতা, তিনটি দূর্বা ঘাস নিয়ে তিনটি প্রদীপে তেল সলতে দিয়ে সাজাতে হয়। এরপর পুকুর ঘাট থেকে জল আনতে হয় একটি পাত্রে করে। জল আনার সময় পুকুর ঘাটে গান গাইতে হয়-

জলে আছে জলকুমারী,

ডাঙায় আছে হরি,

এক ঘটী জল দাও মা,

হরি পূজা করি।

পুকুর ঘাট থেকে জল এনে তুলসি তলায় জল ঢেলে প্রদীপ জ্বলানো হয়। প্রদীপ জ্বালানো হয় গান গেয়ে । প্রদীপ জ্বালানোর গান :

সাঁঝ সলতে পরমবাতি,

সন্ধ্যে দেখায় ভগবতী,

কোথায় আছে দেবগণ,

সন্ধ্যে দেখায় নারায়ণ।

পুজোর মন্ত্র

কুলকুলতি কুলের বাতি,

তোমার তলায় দিয়ে বাতি,

অরণ ঠাকুর বরণে,

ফুল ফুটেছে চরণে।

এ ফুলটি যে তুলবে,

সাত ভাইয়ের বংশে,

সাবিত্রী সত্যবান।

কার্তিক মাসে রাসে,

ধুপ ধুনো বাসে,

ধুপ, দীপায় নমঃ।

তুলসী গাছে জল ঢালার মন্ত্র

তুলসী তুলসী মাধবলতা,

ও তুলসী কৃষ্ণ কোথা?

কৃষ্ণ গেছে গোচারণে।

তোমার শিরে ঢালি জল,

অন্তর থেকে দিও স্থল।

কোথাও আবার এই গানের ভিন্ন রূপও শোনা যায়।

তুলসী তুলসী মাধবীলতা

কও তুলসী মিষ্টি কথা

কিষ্ট কথা শুনলাম কানে

গড় করি মা শ্রীচরণে

জলে আছে জলকুমারী

ডাঙ্গায় আছে হরি

একঘটি জল দাওমা

তুলসী পূজা করি ।

তিনবার এই গান গেয়ে হাত জোড় করে কিশোরীরা বাড়ির মঙ্গল কামনা করে। এই গান গাওয়ার পরে কুলপাতা দেওয়ার পর্ব শুরু হয়। তখন গাওয়া হয় :

”কুলপাতা কুলপাতা ঝাঁকড়ি

সতীন বেটা মাকড়ি।

সাত সতীনের সাত কৌটা

আমার মায়ের নব কৌটা।

নব কৌটা নড়ে চড়ে

সাত সতীনের মুখটী পুড়ে।”

শাঁখ বাজানোর সময় গাওয়া হয়

শাঁখে আছে শঙ্খধ্বনি,

শাঁখ বাজায় মহামুনি।

দিকদিগন্ত ব্লগপোস্টে লেখা হয়েছে, ‘ছোট্ট মেয়েরা প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা এইভাবে পুজো করার পর, মাসের শেষ দিনে ভোগ দিতো। সেটা বেশ খুশির দিন। ভোগ তৈরি হতো চিঁড়ে, দুধ, কলা, বাতাসা দিয়ে। সঙ্গে থাকতো অন্যান্য ফল, আলাদা থালায়। রোজকার মতো ওইদিনও পুজো করে নিতে হতো সন্ধ্যেবেলা। কিন্তু ভাসানোটা ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে। তখন তাদের বেশ কান্না পেতো। দুটো কারণ, এক – পুজো শেষ তাই মন খারাপ, দুই – ওই ভোরে ঠাণ্ডায় চান করা।

প্রদীপ ভাসানোর জন্যে কলার ভেলা তৈরি করতে হতো। কলার ভেলায় আবার প্রদীপ আর মোমবাতি ওই ভাবেই কুলপাতা, দুর্বা, অনেক ফুল দিয়ে সাজিয়ে আর একবার পুজো করতে হতো। যারা একই পুকুরে ভাসাতো তারা আবার  একজায়গায় জুটে গল্প করতো। কার প্রদীপ কতক্ষণ অব্দি জ্বলে, কারটা আগে আগে নিভে গেলো? যার প্রদীপ যত বেশিক্ষণ জ্বলতো তার চোখ মুখও ঠিক ততক্ষণই থাকতো প্রদীপের শিখার মতো উজ্জ্বল।

তারপর আসতো চানের পালা। যে শীতকে অগ্রাহ্য করে ঝপাং করে জ্বলে পড়ে যেতো পারতো, সে-ই সেরা। সবাই সবসময় চান করতো না। যারা করতো না তারা পরেরদিন সকালের আলোচলার পাত্রী হয়ে উঠতো। তাই নিয়ে একটু আধটু চাপা রাগ, মুখ ব্যাঁকানো থাকতো বটে তবে আহামরি কিছু ঘটতো না। ধীরে ধীরে অনেকেই ঠাণ্ডার জন্যে চান করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।

এখন তো পুরো পুজোই বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আমার বাড়ির কচিকাঁচাদের কাছে জানতে চাইলাম তারা এই পুজো করে কিনা। জানা গেলো তারা করে না, এমনকি নামটাও আগে কখনো শোনেনি। পাড়ার কেউ করে কিনা চানতে চেয়েও “না” উত্তরটাই পেলাম। তারা বললো আমরা তোমার কাছেই নাম শুনছি, আমাদের বাড়িতে বা পাড়ায় এখন কেউ এটা করে না।’

এই মাস জুড়ে আকাশে স্বর্গ বাতি দেবার রীতিও উক্ত অঞ্চলগুলিতে প্রচলিত রয়েছে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকেই স্বর্গে বতি দেওয়া হয়। একটি লম্বা বাঁশ পোঁতা হয় বাড়ির কাছে বা পুকুর পাড়ে। বাঁশের ডগায় রঙ্গীন কাগজ দিয়ে ঘেরা এক পাটাতনের উপরে প্রদীপ জ্বেলে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। বা একটি লণ্ঠন জ্বেলে বাঁশের ডগায় টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। রাত আলো জ্বলে। ধারণা হয় এই আলোয় পথ চিনে মর্তে আসবেন পূর্বপুরুষেরা। আবার কেউ কেউ আলো জ্বেলে ফানুস উড়িয়ে দেয় পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে। এটা পরে চালু হয়েছে। লণ্ঠন টাঙ্গিয়ে দেওয়ার রীতি চালু রয়েছে বহুকাল।

ডি এইচ সাহা তার ফেসবুকে লিখেছেন, পুরো কার্তিক রজনীতেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ আকাশ বাত্তি বা আকাশ প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন। প্রতি সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে একটি দীর্ঘ বাঁশের মাথায় ছোট বাঁশের ফ্রেমে, হরেক রঙিন কাগজে মোড়া বাক্সে প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বেলে তুলে দেওয়া হয়। দূরে থেকে গ্রামের এমন আলো আজও কোথাও কোথাও দেখা যায়। আবার কোথাও তুলসী তলায় একটি লম্বা খুঁটির মাথায় প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয়। দীপাবলীর রাতে এই আকাশ প্রদীপ বা স্বর্গ বাতি জ্বলে পুরো চার প্রহর। মৃত আত্মীয়গণ স্বর্গ থেকে পথ দেখে আসার জন্য তাদের উত্তর পুরুষরা এই আয়োজন করে থাকেন। লোক-বিশ্বাস, এই আলোর পথে পূর্ব পুরুষেরা স্বর্গলোক থেকে নেমে এসে দেখে যাবেন তাঁদের রেখে যাওয়া ভিটেতে তাঁদের বংশধরেরা কেমন আছেন । 

গর্ত খুঁড়ে আলো দান

কুলকুলোতির গানে ভাতৃত্ব বোধ ও স্নেহবতীর সুখ স্বাচ্ছন্দের কামনা রয়েছে। কূলকুলোতি কথার অর্থ কুলের লক্ষী। আদর্শ বোন বা আদর্শ নারীর গুনাবলী অর্জনের লক্ষ্যে এবং ভাইদের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত বা উৎসব। কুলকুলোতি সম্বন্ধে ছাপানো কোন বইতেই আলোচনা বা উল্লেখ নেই। শুধু ফেসবুকে কেউ কেউ এব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। সেই অভিজ্ঞতার নিরীখে এবং ওইসব অঞ্চলের মানুষদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কুলকুলোতি বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে কুলকুলোটি ব্রতর গান বা পাঁচালী গাওয়া হয়ে থাকে। এগুলি উদ্ধৃত করে আলোচনা করা হল।

কুলকুলোতি’ কুলবতী

অরুন ঠাকুর বরণে। 

ফুল ফুটেছে চরণে। 

এ ফুলটি তুলবে যে

সাত ভাইয়ের বোন সে। 

সাত ভাইরে সাঁতুল তুল।

আমার বোনটি পারুল ফুল।

সাত সতীনের সাত কৌটো

আমার বোনের নবকৌটো।

নবকৌটো নড়ে চড়ে

সাত সতীনের মুখটি পুড়ে।  

কার্তিক মাসের রাশে। 

ধূপধুনো ভাসে।

গানটি সর্বত্র যে একই বা এক রকম সুরে গাওয়া হয় তা নয়, গানের কথা অনেক ক্ষেত্রে বদলে যায়, কোথাও বেশ দীর্ঘ হয় এই গান। তবে গানের মূলভাব বা বিষয়বস্তু একই থাকে। এটিকে  ঠিক গান বলা যায় না। এটি অনেকটা পাঁচালী ঢঙের কবিতার মত করে পরিবেশন করা হয়। একসঙ্গে সকলে মিলে উচ্চারণ করার সময় স্বতঃস্ফূর্ত সুর যুক্ত হয়। তবে যেখানে সঙ্গী-সাথী থাকেনা সেখানে একা একাও গাওয়া হয়। বা  আবৃত্তি করা হয়। প্রায় সব জায়গাতেই এই গানের সুর প্রায় একই রকম। ভিন্ন কথার ‘কুলকুলোতি’ গানের কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হল। 

কবিতা ঘোষাল ঘোষ তাঁর ছোট বেলার লোকাচার সম্বন্ধে উল্লেখ করে  লিখেছেন, তাঁরা ছোটবেলায় বাড়িতে  কুলকুলোতি পুজো করতেন। গান গেয়ে নানা লোক উপকরণ দিয়ে পুজো বা ব্রত উদজাপন করা হত।  তাঁরা যে গান গাইতেন সেটি নীচে উল্লেখ করা হল।

কুলকুলোতি কুলোবতী,

সাত ঘরে দিয়ো বাতি ৷

অরুণঠাকুর বরণে,

ফুল ফুটেছে চরণে ৷

এই ফুলটি যে নেবে,

সাত ভাইয়ের বোন হবে৷

কার্তিক মাসে রাসে,

ধূপধূনো ভাসে৷

ফুলমালা আর আলোর মালা,

ছোট্টো ভেলা দোলায় দোলা৷

কুলোবতীর হাতের নাড়া,

ভেলা ভাসে গন্ধে ভরা৷

এই গন্ধ যেদিক যায়,

সাত ভাই পাই সেথায় ৷

এসো আমার সাত ভাই,

তার জন্য ভেলা ভাসাই ৷

সাতটি ঘরে বাতি দিই,

কুলোবতীর পুণ্যি নিই৷

দেহের ঘর শুদ্ধ করি,

তোমায় ঠাকুর গড় করি ৷

গড়বেতার তপন আচার্য লিখেছেন, 19 January · 

‘দেখতে দেখতে কার্তিক থেকে পৌষ তিনটি গ্রাম্য উৎসবের মাস প্রত্যেক বৎসরের মতো অতিক্রান্ত হয়ে গেল। গড়বেতা ও সংলগ্ন গ্রামকেন্দ্রিক উৎসবগুলি আবহমান কাল ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এবং এগুলি গড়বেতার নিজস্ব উৎসব ও সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। যদিও আধুনিকতার স্পর্শে এই তিনমাসের তিনটি মুখ্য উৎসব গৌণ হয়ে গেছে’।

কার্তিক মাসে কুলকুলোতি অঘ্রাণ মাসে ইতু পুজো, পৌষ মাসে টুসু ।

অনামিকা সরকার লিখেছেন, Anamika Sarkar 19 January

‘তিনমাস ধরে এই উৎসবগুলি একসময় প্রাণবন্ত করে রাখতো গড়বেতাকে। কুলকুলোতি টুসু ও ইতুপুজো ছিল একান্তই মেয়েদের। ইতুর কোন গান আমি করতে শুনিনি। টুসুপুজোও ছিল মূলতঃ গ্রাম্যসঙ্গীত নির্ভর। কুলকুলোতি হোত তুলসীতলায় একটি গর্ত খুঁড়ে প্রতি সন্ধ্যায় ফুল,কুলপাতা, তুলসী, দুর্বাঘাস নিয়ে সমবেত ভাবে গান গেয়ে পুজো করা হোত’।

অনামিকা সরকার উদ্ধৃত গানটি এই রকম-

ফুল দেওয়ার মন্ত্রগান ছিল-

কুলকুলোতি কুলোবতি,

সাত ঘরে সাত দিও বাতি;

অরণ ঠাকুর বরণে,

ফুল ফুটবে চরণে;

এই ফুলটি তুলবে যে

সাত ভাইয়ের বোন সে,

কার্তিক মাসের রাসে

কলার ভেলা ভাসে;

ফুল দিলাম, তুলসী দিলাম

স্বর্গে দিলাম বাতি

সব ঠাকুরকে প্রণাম করি

লক্ষ্মী সরস্বতী।

কুলপাতার মন্ত্রগান-

কুলগাছ কুলগাছ ঝাঁকুড়ি,

সতীন বেতীন মাকুড়ি,

সাত সতীনের সাত কৌটা,

আমার একটি নবকৌটা;

নবকৌটা নড়ে চড়ে,

সাত সতীনের মুখটি পোড়ে।

ওরে পাখি ময়না,

সতীন যেন হয়না।

দুর্বা দেওয়ার মন্ত্রগান

দুর্বা দুর্বা নারায়ণ

তুমি দুর্বা ব্রাহ্মণ,

তোমার শিরে ঢালি জল

অন্তকালে পাবো ফল।

তুলসীপাতা দেওয়ার মন্ত্রগান-

তুলসী তুলসী মাধবীলতা,

তুমি তুলসী কৃষ্ণকথা,

কৃষ্ণকথা রইল মনে

জল ঢালি তোমার শ্রীচরণে।

সেখানে পুরো কার্তিকমাস জুড়ে আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হোত। এখনো হয়। গড়বেতার তপন আচার্যর বাড়ির কাছে বা আশপাশের এলাকায়  এই আকাশপ্রদীপ জ্বালাতেন ‘কুমোর পাড়ায় সুভাস দাস ও আলোক দাসের বাবা কাকারা। একমাস ধরে কুলকুলোতি পার্বণ পালন করার পর কলার ভেলায় একটি প্রদীপ জ্বেলে কুলকুলোতি ঠাকুরকে কোন পুকুরে বা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হোত। তারপর দিন থেকে শুরু হোত ইতুপূজা’।

আকাশ প্রদীপ কার উদ্দেশ্যে দেওয়া হত বা হয়ে থাকে তা নিয়ে মতান্তর আছে। বেশিরভাগ মানুষ পূর্বপুরুষের পথ চেনাতে আলো দেখানোর জন্য আকাশে আলো তুলে ধরেন। আবার কেউ কেউ দেবতাদের উদ্দেশ্যে আলো দেন। তাদের ধারণা দেবতারা সুখ সম্পদ শষ্য দান করে এই সময় আলো দেখালে। অনেকে আবার দুটোকেই বিশ্বাস করেন। একজন বিভিন্ন গ্রন্থের আলোচনা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘কার উদ্দেশে এই প্রদীপ জ্বালানো হয় বলা খুব মুশকিল। সুবলচন্দ্র মিত্রের সরল বাঙ্গালা অভিধান অনুয়ায়ী আকাশদীপ বা আকাশপ্রদীপ শব্দের অর্থ হল লক্ষ্মী-নারায়ণের উদ্দেশে কার্তিক মাসে উঁচু বাঁশ প্রভৃতির উপর শূন্যদেশে যে প্রদীপ দেওয়া হয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস সঙ্কলিত ও সম্পাদিত বাঙ্গালা ভাষার অভিধান অনুযায়ী হিন্দুগৃহে দেবোদ্দেশে আকাশে যে দীপ দেওয়া হয়; বাঁশ পুঁতিয়া তার আগায় এই দীপ বাঁধিয়া দেওয়া হয় এবং কার্তিকমাস-ভোর প্রতি সন্ধ্যায় ঐ দীপ জ্বালা হয়। রাজশেখর বসু সংকলিত চলন্তিকা আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান অনুযায়ী, কার্তিক মাসে উঁচু বাঁশ ইত্যাদির উপরে যে প্রদীপ দেওয়া হয়। প্রথমে নির্দিষ্ট ভাবে লক্ষ্মীনারায়ণের নাম করা হলেও পরে সার্বিক ভাবে দেবতার কথা বলা হল এবং শেষে কার উদ্দেশে এই প্রদীপ তার উল্লেখ নেই।’

বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় গ্রন্থে কার্তিক মাসে দীপ জ্বালানোর কথা বলা হয়েছে। কার্তিক মাসে দীপ জ্বালালে স্বয়ং বিষ্ণু প্রীত হন। তিনি তার সব পাপ দূর করেন। এই রকম আরো নানা ক্তহা বলা হয়েছে। যেমন শ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থের ১৬শ বিলাস অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কার্তিক মাসে দেবালয়ে ভক্তিভাবে দীপদান, অখন্ড দীপাবলীর আয়োজন, বাড়িতে বাড়িতে দীপমালা সজ্জা ও আকাশ প্রদীপ দান করলে ভগবান শ্রীহরি প্রীতিলাভ করেন। ‘স্কন্দ পুরাণে’ বলা হয়েছে যে যদি কেউ ঘিয়ের প্রদীপ বা তিল তৈলের প্রদীপ বিষ্ণু মন্দিরে কার্তিক মাসে প্রজ্জ্বলিত করেন তাহলে সে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ করেন। কারও বংশে কোন সন্তান যদি কার্তিক মাসে বিষ্ণু মন্দিরে দীপদান করার মাধ্যমে শ্রীবিষ্ণুর প্রীতিসাধনে উদ্যোগী হয়, তাহলে বংশের সকলেই মুক্তি লাভের অধিকারী হয়। এমনকি কারও যদি মন্দার পর্বতের মতো বিপুল পরিমাণ পাপও সঞ্চিত থাকে, কার্তিক মাসে ভক্তিসহকারে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের মন্দিরে দীপদান করলে নিঃসন্দেহে তাঁর সমস্ত পাপ বিনষ্ট নয়।   

সোমা দত্ত লিখেছেন, ‘আমার ছেলের হাতে বানানো #প্রদীপ…..এগুলো ঠিক দীপাবলীর প্রদীপ নয়…কারন ওগুলো হয় ,বেশ বড় আকারের এবং লম্বাটে…কিন্তু এগুলো গোল গোল আকৃতির এবং আকারে বেশ ছোট হয়….এগুলির নাম #কুলোবাতি….’

‘আমরা ছোটবেলায় জাঠতুতো ,খুড়তুতো সব বোনেরা মিলে কুলকুলোতি পূজা করতাম….পুকুর পাড়ের কুল গাছের গোড়া থেকে মাটি কেটে এনে …সেই মাটি দিয়ে গোল গোল পাকিয়ে এইরকম প্রদীপ বানাতাম…ছাদে রোদ্দুরে শুকিয়ে নিয়ে মনের মতন রঙ করতাম…পুরো কার্ত্তিক মাস ধরে প্রতি সন্ধ্যা বেলা তিনটি করে এই প্রদীপ, কুলপাতা এবং কুল সহযোগে কুলদেবীর আরাধনা করতাম এবং তিন কুলের(পিতৃকুল,মাতুলকুল ও শ্বশুর কুল) অমরত্ব প্রার্থনা করতাম …তখন অতটা বুঝতাম না…কেন কি কারনে এই পূজা …তবে সব বোনেরা মিলে তুলসীমঞ্চের সামনে যখন শাঁখ আর উলুধ্বনী দিয়ে পূজা করতাম …সারাবাড়ি গমগম করত….

মেয়ে তো নেই…. তাই ছেলেকেই প্রদীপ বানানো শেখালাম…ব্রত টা না করুক…ঐতিহ্যটা মনে রাখুক’.১০

কুলকুলোতির উপকরণ

কুলকুলোতি সম্বন্ধে হুগলী জেলার বিদগ্ধ মানুষ সুফল চন্দ্র বাগ১১ জানিয়েছেন, কুলকুলোতি আর ‘যমপুকুর ব্রত’ কিছুটা সমার্থক। কোনো অঞ্চলে একই ব্রতকে কুলকুলতি ব্রত বলা হয় আবার কোথাও একই ব্রতকে বলে যমপুকুর ব্রত। আসলে এই ব্রতর উদ্দেশ্য যমকে সন্তুষ্ট রাখা। যাতে সে পরিবারের কারো উপরে রুষ্ট না হয়। যমপুকুর ব্রতর নিয়ম কুলকুলোতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। যমপুকুর ব্রত পালন করা হয় পুকুর পাড়ে। আর কুলকুলোতি তুলসি তলায় ও পুকুরে ভেলা ভাসিয়ে।

স্বর্গ বাতি বা আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর রীতি সম্পর্কে কল্যান চক্রবর্তী লিখেছেন, আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর শেষ দিন: পূর্বপুরুষ কিংবা লক্ষ্মীনারায়ণের উদ্দেশ্যে তিলতেল বা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয় স্তম্ভের মাথায়, বাড়ির ছাদ বা টালির চালে কিংবা তুলসী তলায়। আজকাল মোমবাতি বা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর রেওয়াজ হয়েছে। কার্তিক সংক্রান্তিতেই আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর সমাপ্তি।১২

আকাশ প্রদীপ সম্পর্কে অনেক কথা আছে অনেক জায়গায়। পূর্ব পুরুষতো বটেই, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও জীবন ও মরনের এক সেতু বন্ধন। যেন মৃত্যুর পরেই সব শেষ নয় এই কথা আকাশ প্রমান সত্য। এটা প্রমান হয় আকাশ প্রদীপে। এ সম্পর্কে  প্রতিদিন পত্রিকায় অনির্বাণ চৌধুরী লিখেছেন, এই প্রদীপ আসলে দেহেরই প্রতীক। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম- এই পঞ্চভূতে যেমন তৈরি হয় এই নশ্বর শরীর, মাটির প্রদীপটিও তাই! ক্ষিতি বা মাটি তার কায়া তৈরি করে। অপ বা জলে তা আকার পায়। তেজ বা আগুন আত্মার মতোই স্থিত হয় তার অন্তরে। মরুৎ বা হাওয়া সেই আগুনকে জ্বলতে সাহায্য করে। আর ব্যোম বা অনন্ত শূন্য জেগে থাকে তার গর্ভে।
পিতা আরও বলতেন, কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ দেওয়া শুধুই বিষ্ণুর আশীর্বাদ যাচনা নয়। তাঁকে তো স্মরণ করতেই হবে। এই পৃথিবীকে পালন করেন তিনি, মৃত্যুর পরেও মানুষের উপরে রয়েছে তাঁরই অধিকার। তাই আকাশপ্রদীপ দেওয়ার সময় উচ্চারণ করা হয় মন্ত্র- ‘’আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।‘’ আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করছেন যে বিষ্ণু, তাঁর উদ্দেশে দেওয়া হল এই প্রদীপ। এ বাদেও আকাশপ্রদীপ শীতঋতুতে মানুষের অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাস। যা অনেক পরে রূপান্তরিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের অগ্নিহোত্র রক্ষার আচারে।১৩

প্রানের বাংলা ডট কমও একথাই লিখেছে। এখানে শীলা চৌধুরী লিখেছেন, ‘আকাশপ্রদীপ ওই বিদেহী আত্মাদের আলোর কাঠি ,তার আলোতেই ওই আত্মারা স্বর্গে ফেরেন। তাই কার্তিক মাস এলেই দেখতাম বরেন্দ্র জেঠু, কেশব দাদা , মাখন দাদা নন্দ পিসিদের বাড়ির বাঁশ ঝাড় থেকে সবচেয়ে লম্বা বাঁশ কেটে খুব ভালো করে পরিস্কার করে সেই বাঁশের উপরের দিকে একটা ঢোলের মতো ফ্রেম কাপড় দিয়ে বানাতো। সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গেই মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই ঢোলাকৃতির ফ্রেমের ভেতর বসিয়ে সূতো দিয়ে টেনে টেনে সেটাকে বাঁশের উপরে বেঁধে রাখতেন । আমাদের বাড়িতে আলাদা প্রতি বংশের ঘরেই এই আকাশ প্রদীপ পূর্ব পুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে পুরো কার্তিক মাস জুড়েই জ্বালানো হয়’।১৩  

কুলকুলোতি সম্বন্ধে বর্তমান বৈজ্ঞানিক ধারণা অন্য রকম। সেখানে বলা হয় কার্তিক মাসে আমন ধানের শিষে চাল জন্মানো শুরু হয় বা ধানে দুধের মতো তরল জন্মে। এটা খুবই সুস্বাদু। তাই প্রচুর পোকা জন্মে ধান ক্ষেতে। একরকম সবুজ রঙের ছোট্টো ছোট্টো পোকার নাম শ্যামা পোকা। এরা সব ধানের রস শুষে নেয়। ফসল নষ্ট করে। এই কীট পতঙ্গদের দমন করার উদ্দেশ্যেই আলো দান। আলোর দিকে তারা ধাবিত হয়। আগুনে পুড়ে মরে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিটি আলোর পাশে হাজার লক্ষ পতঙ্গ ভীড় করে থাকে ও পুড়ে মারা যায়। প্রতি বাড়িতে বা পুকুরে এরকম হয়।  যখন ভেলায় আলো জ্বলে, পতঙ্গকূল আগুনের দিকে ছুটে আসে আর জলে পড়ে। মাছেরা তাদের খেয়ে ফেলে।

‘কার্তিক অমাবস্যায় যেখানে উত্তর ভারতে লক্ষ্মীর পূজা চলছে, পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জাঁকজমকে ঘটা করে পালন করা হয় কালীপূজা। অবশ্য সেদিন আদি পশ্চিমবঙ্গ বাসিন্দারা, ঘটিরা, বাড়িতে লক্ষ্মীর পূজাও করে থাকেন। তবে আদি বাংলাদেশি হিন্দুদের, বাঙালদের, এই নিয়ম নেই; তা অনেকে বাড়িতেও কালী পুজো করেন, যদিও এই পুজোর বারোয়ারি ভাবে পালন হওয়ার প্রচলন বেশি। কদাচিৎ কালীপুজোর দিন আর দেওয়ালির দিন পৃথকও হতে পারে; দেওয়ালির তারিখটা একদিন পরে কিংবা আগেও পড়া সম্ভব। কেননা কালীপূজার লগ্ন অমাবস্যার মাঝরাত্রিতে ঠিক হয়, আবার দীপাবলির লক্ষ্মী পূজার লগ্ন নিশ্চিত করা হয় অমাবস্যার সন্ধ্যেতে, তাই পুজোর লগ্ন অনুযায়ী দুই পুজোর তারিখে মাঝে মাঝে অন্তর ঘটে থাকে। দেওয়ালির দিনে প্রদীপের আলোয় বাড়ি-বাড়ি ঝকমক করে ওঠে। নানান রঙের বাজিতে আকাশটাও রীতিমত চকচক করে থাকে। দীপাবলি সারি-সারি প্রদীপের আলোকে স্বর্গের দেবতাকে মর্তের কুটিরে বরণ করে নেবার উৎসব’।[১৪]

কালীপূজোর দিনে সন্ধ্যায় এইসব অঞ্চলে ‘ম্যড়াগাছ’ পোড়ানো হয়। আলোর রোসনাইও পোড়ে। সেও আলো-আগুনের উৎসব। প্রতি বাড়িতে একটি বড়ো লম্বা কাঁচা বাঁশের প্রতিটি গাঁটে দুটি করে তাল গাছের শুকনো পাতা বেঁধে বাঁশটিকে দশ বারোজন মিলে একটি গর্তের উপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। এটিকেই ‘ম্যাড়া গাছ’ বলে।  সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে মিলে একসঙ্গে ওই বাঁশের তালপাতা যুক্ত মহীরুহের সামনে জড়ো হয়। লম্বা পাট কাঠির গুচ্ছ সবাই হাতে নেয়, সকলেই সেগুলিতে আগে আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে ওই দণ্ডায়মান শুকনো তালপাতার ‘ম্যাড়াগাছ’টিতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ‘ম্যাড়াগাছ’। আর সবাই মিলে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘ইঁজোলারে পিঁজোলা’। এই কথাটির হয়তো কোন বিশেষ অর্থ থাকবে, কিন্তু আমার তা জানা নেই। অজস্র পোকা- মাকড় ধানের ক্ষেত থেকে ছুটে আসে ‘ম্যাড়াগাছের’ দিকে। পুড়ে মরে।

কালী পুজোর উৎসবে ঘরে ঘরে দরজা-জানালায়, উঠোনে, তুলসি তলায়, দেব দেবীর বিগ্রহের সামনে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘক্ষন ধরে আলো জ্বলে। পতঙ্গকূল পোড়ে। দীপালিকার মাহাত্ম এখানেই।  

তথ্যসূত্র

১।https://www.facebook.com/permalink.php?id=171692543018713&story_fbid=317711441750155

২। https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH

৩।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH.

৪।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH/BOX ৫।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH/BOX

৬।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH/BOX

৭।।https://www.dailyo.in/bangla/arts/why-fourteen-spinach-bhootchaturdashi-why-aakash-pradip-diya-diwali-deepabali-kalipuja/story/1/27631.html

৮। https://www.facebook.com/sagar.bhowmick.58/posts/2469502046625787

৯।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH ১০।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH

১১। সুফল চন্দ্র বাগ হুগলী জেলার কালীপুর অঞ্চলের একজন বিখ্যাত লোক শিল্পী। গ্রামীন শিল্প ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর চেতনা গভীর। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী ও যাত্রা শিল্পী হিসাবে তিনি অধিক পরিচিত।

১২।কল্যানচক্রবর্তী-https://m.dailyhunt.in/news/india/bangla/presscard+news-epaper-pressc/kartik+sankrantir+katha-newsid-86546582

১৩। https://pranerbangla.com/আকাশ-প্রদীপ/#.XbsIwDAzbIU  

১৪।https://bn.wikipedia.org/wiki/দিপাবলী