November 1, 2019

নাট্য সংগঠক ও শিক্ষক কুমার রায়

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ড. বিশ্বজিৎ মণ্ডল

অধ্যাপক কুমার রায়

 বহুরূপীর বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে কুমার রায়ের সম্পর্ক শৈশব থেকে। এই দীর্ঘদিনের ভিজ্ঞতায় বাংলা থিয়েটারের আঙ্গিনায় মঞ্চ, পোষাক, সঙ্গীত পরিবেশনা প্রভৃতি সর্ব ক্ষেত্রে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তার কর্মের মধ্যে বৈচিত্রের স্বাদ পাওয়া যায়। এর প্রস্তুতিকাল খুব ছোটবেলা থেকে শুরু হয়েছিল। আধুনিকতার ছোঁয়া সর্বসময় সাধারণ স্রোতের উল্টোমুখে হাঁটে। প্রত্যেক যুগেই আধুনিকরা আসে এবং তারা সবসময় চলমান থাকে, এই চলমানতা পুরোনো কর্ম ঝেড়ে ফেলে নতুন কর্মের দিকে এগিয়ে যায়। কুমার ঠিক তারই একজন অগ্রদূত। তিনি কখনও পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইতেন না। একটা চিন্তার পেছনে তাঁর আর একটা চিন্তা কাজ করতো। মঞ্চ,পোষাক,অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে একাত্ম হওয়ার কথা ভাবতেন। সেই ভাবনা থেকেই বিভিন্ন মুহূর্তে নাটকীয় সংঘাত উঠে আসত। তাঁর চিন্তা,চেতনা সবসময় একটা নিজেস্ব মৌলিক কোনো আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা করতো। তাঁর কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাথমিক ব্যাপার ছিলো শিল্প স্বয়ং। মানুষের মধ্যে শিল্পবোধ জাগিয়ে তোলা দর্শকের রুচির দোরগোড়ায় সঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া নাটকের মূল উদ্দেশ্য। নাটক পরিচালনার মধ্যে বিপুল বৈচিত্র নিয়ে আসা, আধুনিক বুদ্ধিজীবি মননকে তুষ্ট করতে পারা, মানুষের মনে ভেসে ওঠা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সেগুলি সমালোচনামুক্ত করা ছিলো তাঁর লক্ষ্য। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পঁচিশ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে প্রায় উনিশটি নাটকে তিঁনি নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন। নাটক পরিচালনার প্রথম পট অর্থ্যাৎ নাটক নির্বাচন করা, নাটক পড়া ইত্যাদি এইসমস্ত কাজগুলি করার সময় কোনোরকম অসম্মতির উপর পরতে হয়নি। ফলে সেই কাজটি তিঁনি খুব অনায়াসে করে ফেলতে পারতেন। নাটক বাছাই করার ক্ষেত্রে দেখা যায় তার বৈচিত্রের সন্ধানই নানাধরণের নাটক করার ব্যাপারে তাঁর খুব উৎসাহ। একটি নাটক বাছাইয়ের পর অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্বস্তভাবে একটি চরিত্রকে দাঁড় করিয়ে দিতেন। এইভাবে তিঁনি বাংলানাট্যের প্রায় প্রতিটি বিভাগে তাঁর অবদান রেখে গেছেন। মানুষ হিসেবে তিঁনি ছিলেন অত্যন্ত পরিমিতি বোধ সম্পন্ন। কোনো চরিত্রের স্বাভাবিকতাকে তিঁনি নষ্ট হতে দেননি। কবি শঙ্খ ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন বই থেকে কিভাবে এক একটা সংলাপ সত্য হয়ে ওঠে মঞ্চে, বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের সংলাপ, তাঁর ভাষণের মধ্যে তৈরী হয়ে উঠতে থাকে একটি বাচিক অভিনয় ও তার নানা স্তর-স্তরান্তর। এ হল শিল্পচর্চায় কোনো একটা পরম কিছুকে ছুঁতে পাবার সম্ভাবনার কথা, সেটা যে অল্প সময়েই পাওয়া যায়,সেখানে পৌঁছতে যে নিরন্তর সাধনা লাগে এই বিষয়টি কুমার রায় নিজে যেমন অন্তস্থ করেছিলেন তেমনি তার সান্নিধ্যে আসা সমস্ত শিষ্য এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও এই চিন্তার বীজ বপন করতে তিঁনি সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। তাই তিঁনি প্রকৃত নাট্য শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ছেলেবেলা থেকে বাড়ির আঙ্গিনায় ছবি আঁকা, অভিনয় করার নেশা সবসময় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াতো। ওর মানসিক প্রস্তুতির জন্য বহুপথ অতিক্রম করতে হয়েছে। এর জন্য পরবর্তীকালে নাটকের ছেলে-মেয়েদের তিঁনি নানা বেড়াজাল টপকে সেই পথের দিশারী করে তুলতেন, তিঁনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন নাটকের প্রতিটি ডায়লগকে ভিসুয়ালাইজ করতে হবে, সেইদিক থেকে তাঁর ছিলো অসাধারণ ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার জন্য প্রতিটি সিনকে একটার পর একটা মঞ্চে দাঁড় করিয়েছেন। কুমার রায় ছিলেন নানা কাজের মানুষ। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে থিয়েটারকেও একটা কাজ হিসেবে ভাবতেন, এবং নাটকের ছেলেমেয়েদেরকেও সেই ভাবনায় ভাবিত করে তুলতেন। কুমার রায়-এর আর একটি পরিচয় রয়েছে, তিঁনি একজন বড় মাপের প্রশিক্ষক। একটা নাটককে কিভাবে মঞ্চায়ন করতে হয় অর্থ্যাৎ কিভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং একটা চরিত্রকে মঞ্চে দাঁড় করাতে হলে তাকে সেই চরিত্র সম্পর্কে কল্পনা করতে হবে। সেই কল্পনার মধ্যে যে নতুন কিছু আবিস্কৃত হবে সেই আবিস্কারকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করতে হবে। তারপর তার থেকে পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি বেড়িয়ে আসবে। যতক্ষণ না কোনো প্রতিচ্ছবি মানসলোকে ধরা পড়ছে ততক্ষণ কল্পনাশক্তি দিয়ে সেটা পরিপক্ক করে তুলতে হবে। এই যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নাট্যপরিচালক ও অভিনেতাদের জীবনে একটা অভিরূপ সৃষ্টি করেন এই কথাই তিঁনি ছাত্র-ছাত্রীদের সবসময় বোঝাতেন। কুমার রায় একজন স্বাধীন শিল্পী। থিয়েটারে সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ, তিঁনি একাধারে যেমন নাট্যপরিচালক, অভিনেতা, মঞ্চশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী তেমন অন্যদিকে তিঁনি একজন নাট্যসংগঠক। তাঁর অবিস্মরণীয় ও মৌলিক চিন্তা-ভাবনার জন্য তিঁনি নাট্যকর্মীদের কাছে শিক্ষক হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন।

তিঁনি সবসময় বাস্তবের আঙ্গিনার মঞ্চের কাঠামোকে বাঁধতেন, সেই বাস্তব হচ্ছে একজন শিল্পীর বাস্তবতা,  যারা মঞ্চের মধ্যে আবর্তন করতেন। এমনকী যারা নেপথ্য শিল্পী হিসেবে কাজ করতেন তাদের বোধ ও বোধির অভিনয়ের প্রতিটির অঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেটাকে আমরা বিশেষ করে থিয়েটার কর্মী ও দর্শক হিসেবে উপলব্ধি করতে পারি। আজও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই নিজের অজান্তে কুমার রায়ের মননশীলতাকে অনুকরণ করে চলেছে। নাট্যপরিচালক মেঘনাথ ভট্টাচার্য্য বলেছেন,“আমাদের সমস্ত নাট্যকর্মীদের শেখা উচিত কিভাবে জীবনকে, থিয়েটারকে দেখতে হয়, বিচার করতে হয়। কিভাবে নিজেকে আড়ালে রেখে সচেতনভাবে এক নতুন ধরণের নাট্যশিল্প গড়তে যৌথ উদ্যোগের সামিল হতে হয়, নেতৃত্ব দিতে হয় কতটা নীরবে, কতটা প্রচার বিমূখ হয়ে।” কুমার রায়কে শুধুমাত্র অভিনেতা বা নির্দেশক বললে তাঁর কাজের পরিধিটা ছোট হয়ে যায়। থিয়েটারের জগতে অনেক কর্মী আছেন যারা কুমার রায়ের ছাত্র-ছাত্রী, মঞ্চ পরিকল্পনা, পোষাক, নাটকের সংগীত ও বিভিন্ন বিষয়ে কুমার রায়ের সঙ্গে থেকে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। তাঁর প্রতিটি প্রযোজনা নবীন অভিনেতাদের কাছে শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠত।

নাট্যসংগঠক হিসেবেও কুমার রায়ের আর একটা গুণ হলো সংযম এবং সতর্কতা। তিঁনি দলের মধ্যে নেতাগিরিকে প্রশ্রয় দিতেন না। এই কারণে নাট্যজনেদের কাছে অনেক সম্মানে ভূষিত হতে পেরেছেন। যিনি পরিচালক হবেন বা নির্দেশক তার রীতিজ্ঞান সম্পন্ন এবং দক্ষ হওয়া চাই। এর সব গুণই ছিলো কুমার রায়ের মধ্যে, যার জন্য তিঁনি সব অভিনেতাদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। অভিনয়ের পেছনে মনন, নিষ্ঠা এবং পারদর্শিতা একসঙ্গে কাজ করতো। অভিনীত চরিত্রগুলির প্রত্যেকটাকে অভিনয়ের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেন। নানাদিক থেকে একটা বাধা আসা সত্যেও নিজেস্ব কলাকৌশলের দ্বারা অতিক্রম করতেন। তাই কুমার রায়কে একটি নতুন যুগের স্রষ্টা বলা যেতে পারে। বহুরূপী নাট্যদলের বহু প্রযোজনা তৈরী হয়েছে তাঁর হাত ধরে। নতুন ধারার থিয়েটার নিয়েই সারাজীবন তিঁনি ব্যস্ত থেকেছেন। দেশী-বিদেশী অনেক নাটক প্রযোজনা করেছেন। শুধুমাত্র যারা অভিনয় করেন তাদের নিয়ে ব্যস্ত না থেকে নাট্যের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করতেন। যেমন মঞ্চ, আলোক, পোষাক, রূপসজ্জা সব বিষয়ের দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। দলের কর্মীদের মধ্যে যে যেরকম কাজ পছন্দ করতো তাকে সেই ভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন। সেইসব কর্মীরা নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সুপ্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। নাট্যজগতের এই সম্মিলিত প্রয়াস বা তার সাংগঠনিক প্রতিভা ও দক্ষতা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভাবনার দিক উন্মোচিত করেছে। অধ্যাপক দেবাশিস রায়চৌধুরী বলেছেন-“রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে তাঁর জীবন ও জীবিকা এক হলেও তিঁনি যে এক সুশৃঙ্খল শিক্ষাব্রতী ছিলেন তার কারণ হলো বহুরূপীর মতো নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা, এত জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন যে ছাত্রদের দাবীতেই নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধে আমাদের নাট্যবিভাগে বেশ কিছু উন্নতমানের প্রযোজনা করেছেন। তাঁর কাছে নাট্যসাহিত্যের পাঠ নিলেও কোনো নাট্য প্রযোজনার সময় তিঁনি হতেন অভিনয় শিক্ষক তথা নাট্য নির্দেশক (নাট্য আকাশবাণী প্রবক্তা ১৪)।” 

কুমার রায় ছিলেন একজন প্রোথিতযশা শিক্ষক এবং একজন নাট্যসংগঠক। এ বিষয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন –  “শম্ভু মিত্রের উদ্যোগে যে বহুরূপী স্থাপিত হয়েছিল সেখানে অনেক নাট্যব্যক্তিত্য ছিলেন। তুলসী লাহিড়ী, গঙ্গাপদ,মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য এইরকম অনেক নাট্যব্যক্তিত্য, সেই বহুরূপীকে তিঁনি ধরে রেখেছেন। এখনও বহুরূপী নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ করছে। বহুরূপী নামের যে পত্রিকা সেটাকেও তিঁনি সচল রেখেছেন। অনেক নাটকের পত্রিকা শুরু হয় আবার বন্ধ হয়ে যায়। তাই বাংলায় যেরকমভাবে উল্লেখযোগ্য নাটকের পত্রিকা আর নেই, বহুরূপীই রয়ে গেছে এখনও। আমরা তো এখনও বাংলা নাটক সম্পর্কে চিন্তা করতে গেলে প্রথমে কুমার রায়ের কথা মনে পড়ে। গ্রুপ থিয়েটার যে পথ নির্দেশ করেছে বহুরূপী তার অগ্রগামী।” এই সাংগঠনিক ক্ষমতা নিয়ে বাংলা থিয়েটারের ভিতকে তিঁনি সুদৃঢ় করেছিলেন। তিঁনি শুধু থিয়েটারে নন্‌ সাহিত্য, চিত্রকলা , সঙ্গীত ইত্যাদি শিল্পের নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজও করেছিলেন। থিয়েটারের মতো একটি শিল্পরূপের জন্য জীবনপণ করা সামান্য কৃতিত্ব নয়। অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী তাঁর কাছে সংলাপ বলার ভঙ্গী, শব্দের উচ্চারণ, কণ্ঠস্বরের নিয়ন্ত্রণ, শরীরের ব্যবহার ইত্যাদি নানাবিষয়ের তালিম পেয়েছেন। থিয়েটারে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে চরিত্রাভিনয়ের নতুন বৈশিষ্ট সৃষ্টি করে সেগুলি মঞ্চায়নের মাধ্যমে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। তাঁর নাটকের বিচার বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা যখন ছাত্র-ছাত্রীরা  আলোচনা করতেন তখন মনে হত পূর্বের কোনো শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নানাভাবে বিস্তার করে দিচ্ছেন। তিঁনি সবসময় বলতেন কোনো তাত্ত্বিক বিষয় আলোচনা না করে জীবনকে সহজ ও সহানুভূতিশীল করে তুলতে হবে।

“গত ৬২ বছর বহুরূপী নাট্যপত্র প্রকাশ পাচ্ছে। প্রথম প্রকাশ ১৯৫০ সালে মে মাসে, প্রথম ৩৫ সংখ্যার সম্পাদক গঙ্গাপদ বসু(১৯৫০-র সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭০)। ২২শে মে ১৯৭১-এ গঙ্গাপদ বসুর প্রয়াণ ঘটে। ৩৬ থেকে ৪৯ সংখ্যা সম্পাদনা করল শম্ভু মিত্র। (১৯৭১ থেকে ১৯৭৮) তাঁর সহযোগী সম্পাদক চিত্তরঞ্জন ঘোষ। ৫১ সংখ্যা থেকে প্রধান সম্পাদক কুমার রায়। (১৯৭৯ জুন – ২০০৬) তাঁর সহযোগী সম্পাদক চিত্তরঞ্জন ঘোষ এবং প্রভাত কুমার দাস। ১৯৭৮-এ শম্ভু মিত্র বহুরূপী ছেড়ে চলে গেলেও তার নির্দেশিত পথ ও ভাবনা – আদর্শই দল ও নাট্যপত্র চলতে থাকে কুমার রায়ের যোগ্য নেতৃত্বে।”৪  এর থেকে অনুধাবন করা যায় শুধু নাটক পরিচালনা বা অভিনয় নয়। থিয়েটারের সামগ্রিক বিষয়ে তার দক্ষতা পারদর্শিতা ও নিষ্ঠা দিয়ে শম্ভু মিত্রের পরবর্তী বহুরূপীকে তিনি একটি মজবুত সংগঠনে পরিণত করায় যে কৌশল, যে কর্মদক্ষতা তা যথাযথভাবে পালন করেছেন বলে থিয়েটারের মানুষেরা আজও স্বীকার করেন। 

এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৌমিত্র বসু বলেছেন –“১৯৮০ সালে হঠাৎই মারা গেলেসভাপতি অনিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জায়গায় দলের সভাপতি হলেন কুমার রায়। খুবই টালমাটালের সময়ে তাঁকে দলের হাল ধরতে হয়েছে। একদিকে যেমন শম্ভু মিত্র ও শাঁওলী মিত্র ছেড়ে দিয়েছেন দল, তৃপ্তি মিত্রও কিছুটা নিষ্ক্রিয়, তার মধ্যে দল ছেড়ে দিলেন রমাপ্রসাদ বণিক এবং আরও তিনজন তরুণ, তৃপ্তি মিত্রও পদত্যাগ করলেন শেষ পর্যন্ত। রমাপ্রসাদরা তৈরী করলেন চেনামুখ নাট্যগোষ্ঠী; তৃপ্তি মিত্র হল সেই দলের সভানেত্রী। বলা বাহুল্য, প্রচুর গুজব এখন ছড়িয়ে যাচ্ছে বহুরূপীকে নিয়ে, সেই সময় শান্ত মনে শুধু প্রযোজনার কথা ভাববার অবকাশ ছিলোনা। মনে পড়ছে, সেই সময়েই একদিন রাত্রিবেলা দরজা ভেঙে চুরি হয়  বহুরূপীতে। পরেরদিন বিশাল মাপের এক তালা কিনে লাগানো হল দরজায়। বলাই গুপ্ত তারঁ অবিশ্বাস্য সরল গলায় বলেছিলেন – ‘বাব্বা, এ তো লক্‌আউটের তালা।’ হাসির কথা, কিন্তু শুকনো ঠোঁটে আমাদের হাসিও ফোটেনি অনেকের। তখন তো বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, বহুরূপী  শেষ হয়ে গেল এবার। এই সংকট এবং দলের আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে বার করে আনতে কুমার রায় নির্দেশক হিসেবে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা করে গেছেন। দলের সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন নায়ক হেসেবে, এবং এইভাবে দলকে আবার এক শক্ত ভিতের ওপড় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। শুধু আশি সালে নয়, পর পর বেশ কয়েক বছর ভাঙন যেন তাড়া করে ফিরছিলো তার দলকে। দল থেকে চলে গেলেন শান্তি দাস, কালিপ্রসাদ ঘোষ, অমর গাঙ্গুলি, দেবতোষ ঘোষ। এ তো কেবল  অভিনেতাদের চলে যাওয়াই নয়, যাঁদের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে চিনতেন, সেই সুবাদে পাশে থেকে পরামর্শ দিতে পারতেন, বুঝতে পারতেন অনেক না বলা ব্যকুলতা, আবেগ, তাঁদের অভাবে আরও বেশি বেশি করে একা হয়ে যাওয়া, তাঁদের জায়গায় নিশ্চই নতুন মানুষ আসেন, তৈরী হয় নতুন সম্পর্ক, কিন্তু পুরনোদের জায়গা কি আর নেওয়া সম্ভব? দীর্ঘ বহুরূপী জীবনে অনুমান করতে পারি, একা থেকে আরও একা হয়ে যেতে হয়েছে তার এই প্রধান স্থপতিকে।”৫ 

কুমার রায়ের যে গুণগুলো বাংলা রঙ্গমঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছিলো সেই গুণাবলীর মধ্যে বিশেষ এবং প্রধান গুণ সংগঠক হিসেবে নিজের জীবনাচরণকে তিঁনি কোনো বিতর্কের মধ্যে রাখতেন না। তাঁর স্বভাবের মধ্যেই ছিল অপরিমেয় সংযম এবং সতর্কতা। তিঁনি কখনওই থিয়েটার দলের মধ্যে কেউ একজন তারকা থাকবেন এটা তিঁনি বিশ্বাস করতেন না। তিঁনি বিশ্বাস করতেন দলে সকলের সমান অধিকার এবং মর্যাদা থাকবে, কমবয়সী হলেও সাংগঠনিক মর্যাদায় তিঁনি গুরুত্ব দিতেন। তিঁনি আচার-আচরণে কখনওই ভদ্রতা এবং সংযমের গণ্ডী না ছাড়িয়েও হো হো করে প্রাণ খুলে হাসতে পেরেছেন, স্নেহের সম্পর্ক তৈরী করতে পেরেছিলেন তাঁর ছাত্র-ছাত্রী সুলভ নাট্যকর্মীদের কাছে। কুমার রায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডঃ অশোক মিত্র তাঁর একটি লেখাতে বলেছেন – “আমার বার বার মনে হয়েছে যে বাংলা ও বাঙালীর সংস্কৃতির ও বাঙালী সৌজন্যের পরাকাষ্ঠা কুমার রায়ের মধ্যে দেখেছি। এই মানুষটির মধ্যে একধরণের মহত্ত্ব দেখেছি, যেটা বাঙালী মহত্ত্ব এবং যেটা সমাজের শতস্খালন সত্ত্বেও আমাদের বাঙালী হিসেবে গর্ব বোধ করতে সাহায্য করে।” 

তথ্যসূত্র

বিশেষ কুমার রায় সংখ্যা –

১। বহুরূপী পত্রিকা – ১১৪/অক্টোবর ২০১৪।

২। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমী পত্রিকা – কুমার রায়, মার্চ ২০০৬।

৩। ইলোরা পত্রিকা – ১১ বর্ষ, ২০০৬।

৪। ইলোরা পত্রিকা – ১১ বর্ষ, ২০০৬।

৫। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমী পত্রিকা – মার্চ ২০০৬।

৬। নাট্য মুহূর্ত – কুমার স্মারক বক্তৃতা – ২০১৩।