November 1, 2019

Empowering Minds: A Historical Analysis of Women’s Education in Bengal Over 170 Years

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. jayanti Mandal

Abstract: During the last time of the second half of the nineteenth century, the status of girls in Bengal reflected a complex societal landscape. Despite the abolition of sati-dah, the clandestine practice persisted in various parts of Bengal. Polygamy, child marriage, and the prevalence of the Gauridan society further underscored the challenges faced by women. The society’s opposition to Ishwarchandra Vidyasagar’s advocacy for widow marriage added to the tumultuous environment. Against this backdrop, the idea of girls’ education seemed implausible. In April 1848, Drinkwater Bethune, the President of the Education Council of India, arrived in Bengal. Collaborating with scholars like Madanmohan Tarkalanka and Ishwarchandra Vidyasagar, Bethune recognized the urgent need to address the plight of girls in Bengal through education. Understanding that education was crucial for girls to break free from superstitions, Bethune, with Vidyasagar’s support, embarked on a mission to educate women. The initial challenge was the establishment of schools. Suhrid Dakshinaranjan Mukhopadhyay generously offered the living room of his Sukiya Street home for a girls’ school. Despite Bethune’s enthusiasm, finding students proved difficult as a majority of the population opposed girls’ education. Some believed it would lead to widowhood, while others argued that girls lacked the intelligence for learning. Undeterred, Madanmohan Tarkalanka and a few others defied these superstitions by enrolling their daughters in Bethune’s school, marking the beginning of a transformative journey for women’s education in Bengal.

     বাংলার স্ত্রীশিক্ষা : পায়ে পায়ে ১৭০ , ড. জয়ন্তী মণ্ডল

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত সেই সুদূর উনিশ শতকে স্ত্রীশিক্ষার বিপক্ষে বেথুনকে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন-

‘আগে ছুঁড়ি গুলো ছিল ভালো ব্রত ধর্ম করত সবে
একা বেথুন এসে শেষ করেছে আর কী তাদের তেমন পাবে?’

তাঁর মতো স্ত্রী শিক্ষা বিরোধীরা শিক্ষিত মেয়েদের ভবিষ্যৎ পরিণতির আশংকায় এরকম আতঙ্কিত হলেও বেথুন, মদনমোহন, বিদ্যাসাগরদের মতো সচেতন অনেক মানুষই এই সত্যটি জানতেন- 

‘সেদিন সুদূর নয়-

যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর জয়!’

     ১৮৪৮র এপ্রিল। বাংলার আকাশ বাতাসে বসন্তের হাওয়া। শিমুল, পলাশ, অশোক পরেছে রঙীন বেশ। এমন বসন্তের দিনে কোকিলের কুহুতানে বাঙালী মেয়েদের কানে এল নতুন কথা….। বেথুন এসেছেন বাংলায়।

সময়টা উনিশ শতকের দ্বিতীযার্ধের শেষ লগ্ন। বাংলায় মেয়েদের অবস্থানটা তখন এরকম। –সতীদাহ রদ হলেও বাংলার নানা জায়গায় লুকিয়ে চুরিয়ে তখনো সতীদাহ চলছে। পুরুষের বহুবিবাহ, মেয়েদের বাল্যবিবাহ, গৌরিদান সমাজে জাঁকিয়ে বসে আছে। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের স্বপক্ষ যুক্তির বিরুদ্ধে সমাজ তখন উত্তাল। বাংলার সমাজ চিত্রটা যখন এরকম, তখন মেয়েদের লেখাপড়ার কথা ভাবা দূর অস্ত। 


     ১৮৪৮ এর এপ্রিল মাসে ইংলণ্ড থেকে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ভারতের এডুকেশন কাউন্সিলের সভাপতি, গভর্নর জেনারেলের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য হয়ে বাংলায় এলেন। কদিনের মধ্যেই বেথুনের সঙ্গে পরিচয় হল মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পন্ডিতদের সঙ্গে। বাংলার মেয়েদের এমন দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে এদের সঙ্গে বেথুনও একমত হলেন যে, দুঃখ মোচনের একমাত্র এবং প্রধান উপায় মেয়েদের লেখাপড়া শেখা। মেয়েদের শিক্ষিত করতে না পারলে মেয়েরা নিজেদের সম্পর্কে সচেতন হবে না। কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে না।
     কিন্তু এরকম একটা সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের লেখাপড়ার পাঠ কি ভাবে সম্ভব? বেথুন সরকারি উচ্চপদে আসীন। তিনি দৃঢ় সঙ্কল্প ছিলেন বাংলার নারীদিকে লেখাপড়ার পাঠ দেবার জন্য। বিদ্যাসাগরেরাও বেথুনকে সঙ্গে পেলেন।


        লেখাপড়ার জন্য প্রথমেই দরকার বিদ্যালয়, এবং বিদ্যালয় গৃহ। বন্ধু, সুহৃদ দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ির বৈঠকখানাটি বেথুনকে দান করলেন মেয়েদের বিদ্যালয় করার জন্য। বেথুন মহা খুশি। কিন্তু ছাত্রী পাওয়া যায় কোথায়?
         তখন বাংলার বেশিরভাগ মানুষ মেয়েদের লেখাপড়ার এক্কেবারে বিরুদ্ধে। তাঁদের কারোর ধারণা মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হবে। কেউ কেউ মনে করেন লেখাপড়া শেখার মত মেয়েদের বুদ্ধিই নেই। কেউ মনে করেন স্ত্রীশিক্ষা লোকাচার বিরুদ্ধ। এসব কুসংস্কারকে অগ্রাহ্য করে প্রথমেই এগিয়ে এলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তিনি তাঁর দুই মেয়ে ভুবনমালা, কুন্দমালাকে ভর্তি করে দিলেন বেথুনের স্কুলে। রামগোপাল ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বসু, নীলকমল ব্যানার্জি, হরমোন চট্টোপাধ্যায় তাঁদের বাড়ির ছোটো ছোটো মেয়েদের ভর্তি করে দিলেন বেথুনের স্কুলে।
        

স্বাধীনতা সংরামে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন

১৮৪৯  এর ৭ই মে দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ্যায়ের বৈঠকখানা বাড়িতেই প্রথমে দুজন, তারপর সাতজন আরো পরে একুশজন মেয়ে নিয়ে শুরু হল বেথুন স্কুলের পথ চলা। কিন্তু বিদ্যালয়ের নিজস্ব গৃহ নেই। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বেথুনকে র্মির্জাপুরে একখন্ড জমি দান করলেন। কিন্তু অতটুকু জমিতে বিদ্যালযের উপযুক্ত গৃহ সম্ভব নয়। দক্ষিণারঞ্জনের জমির পাশেই বেথুন দশহাজার টাকায় আর একখন্ড জমি কিনে নিলেন।
        

সমস্যা হল ভদ্র ঘরের মেয়েদের কে পাঠাবে মির্জাপুরে ? বেথুনের অনুরোধে সরকার মির্জাপুরের জমির বদলে বেথুনকে হেদুয়ার পশ্চিম প্রান্তে জমি দান করলেন।

     ১৮৫০ এর নভেম্বর। কলকাতা জুড়ে শীতের আমেজ। সকাল হলেই কলকাতার রাস্তায় নলেন গুড়ের ফেরিওলা হাঁক দিয়ে যায় ….নলেন গুড়…চন্দ্রপুলি….। এমনই এক শীতের সকালে হেদুয়ার পশ্চিমদিকে বিশাল জমিখণ্ডে বালিকা বিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন বেথুন। উৎসবে পৌরহিত্য করলেন বাংলার ডেপুটি গভর্নর স্যার জন হান্টার লিটলার। বেথুনের অনুরোধে বিদ্যালয় জমির প্রান্ত ভাগে একটি অশোক গাছ রোপন করলেন লেডি লিটলার।

বেথুনের  বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সারা বাংলা জুড়ে হৈ হৈ রব পড়ে গেল। চারদিক শুধু গেল গেল রব। কলকতার গোঁড়া ব্রাহ্মণরা ক্ষেপেই আগুন। পন্ডিতে পন্ডিতে রাস্তায় দেখা হলেই বলে ওঠে ‘ওরে মদনা করলে কি? ওরে মদনা করলে কি?’
         সে সময়ের সংস্কৃত পন্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন ব্যঙ্গ করে খবরের কাগজে  লিখলেন, ‘এক ‘আনো’ শিখিয়েই রক্ষা নেই। ‘চাল আনো’, ‘ডাল আনো’, ‘কাপড় আনো’ করে অস্হির করে, অন্য অক্ষরগুলো শেখালে কি আর রক্ষা আছে।
         বিদ্যালয়ের পথে বেথুন স্কুলের গাড়ি বের হলে ছোটো ছোটো মেয়েগুলির উদ্দেশ্যে গোঁড়াপন্থীরা নানা কটূক্তি ছুঁড়ে দিতে থাকল।
         মদনমোহন বিদ্যাসাগরেরা হাত গুটিয়ে বসে রইলেন না। স্ত্রী শিক্ষা যে শাস্ত্র সম্মত, শাস্ত্র থেকে বাণী এবং যুক্তির, উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিপক্ষের যুক্তিকে খণ্ডন করতে লাগলেন প্রতিনিয়ত। সমাজের এত বিরোধিতা সত্বেও বেথুন স্কুল চালু রাখলেন। স্কুলের মাসিক  ব্যয় আটশ টাকা নিজের থেকেই দিতে থাকলেন। বেথুনের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ই বাংলায় প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ বালিকা বিদ্যালয়।
         এদিকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত এক বছর পর অকাল প্রয়াণ হল বেথুনের। এতদিন যাঁরা বেথুনের পাশে ছিলেন তাঁরা অনেকেই স্কুল থেকে সরে গেলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর, মদনমোহন পিছপা হলেন না।
               

ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন

বাংলায় ‘বেথুনের স্কুলে’র আগেও মেয়েদের বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। সেসব বিদ্যালয় সবই মিশনারিদের প্রচেষ্টায়। খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারই এসব স্কুলের মূল লক্ষ্য ছিল। ফলে উচ্চবিত্তও মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকেরা মিশনারিদের সেসব স্কুলে নিজ বাড়ীর কন্যাদের পাঠ নিতে পাঠালেন না।

প্রথমে দুজন, পরে একুশজন বালিকা নিয়ে বেথুন স্কুল করলেও সরকারি হস্তক্ষেপের পর বিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে হয় ৫৫। এই সংখ্যা প্রতি বছর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধীরে ধীরে বাংলার মানুষের মন থেকে কিছুটা হলেও ভয়, কুসংস্কার দূরীভূত হলে উনিশ শতকে বাংলায় স্ত্রী-শিক্ষা একটা ব্যাপক আন্দোলনের রূপ নেয়। এবছর একশ সত্তরে পা দিল বংলায় স্ত্রীশিক্ষা।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

১৮৮১  তে বেথুন স্কুলে বি.এ.ক্লাস খোলা হলে কাদম্বিনী বসু এবং চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজেই ভর্তি হয়ে যায়। ১৮৮৩ তে দু’জনেই বি.এ.পাস করেন। এঁরাই বাংলা তথা ভারতের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট। এরপর কাদম্বিনী কলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়ার জন্য ভর্তি হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারী পাস করে কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ভারতের প্রথম বাঙালী মহিলা চিকিৎসক হলেন। অন্যদিকে চন্দ্রমুখী বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ.পাস করে প্রথম এম.এ পাস বাঙালি মহিলার সম্মান অর্জন করেন। সেই ধারাকে আজও গৌরবের সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছে বেথুন স্কুল। এবারেও উচ্চমাধ্যমিকে পঞ্চম হয়ে বাংলায় মেয়েদের প্রথম স্থানটি দখল করে নিয়েছে বেথুন স্কুলের ছাত্রী দিশা ঘোষ। সেই সুদূর উনিশ শতক থেকে আজও বেথুন স্কুল গরবিনী।


                 

আলোকবর্তিকা
অবলা বসু

মদনমোহন, বিদ্যাসাগর, বেথুনের স্বপ্ন সার্থক করে এযুগের মেয়েরা শিক্ষা-স্বাধীনতার সর্বোচ্চ শিখরে আসীন। আজকের মেয়েরা সেনাবাহিনী পরিচালনা করছে, রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ২০১৭’র পরিসংখ্যান বলছে স্কুলে পড়তে আসা ছেলেদের সংখ্যাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে বাংলার মেয়েরা। স্নাতকেও ছাত্রীরা খুব পিছিয়ে নেই। কর্মসংস্থানেও মেয়েরা আগের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে।
         মেয়েদের শিক্ষার এত উন্নতির যুগেও এখনো অনেক অন্ধকার মেয়েদের ঘিরে রয়েছে। আজও বহু মেয়ে স্কুলের পাঠ নিতে পারে না। খবরের কাগজে প্রায়ই খবর বিয়ের পণ দিতে না পারায় বধূ আত্মঘাতী। হাজারো বাধা পায়ে পায়ে চলতে হয় মেয়েদের। তবু তারা হার মানে না। কাগজ খুললেই চোখে পড়ে কিশোরী বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে গেছে থানায়,পড়া শেষ করে তবেই বিয়ে করবে। আজ তাই সভা সমিতি থেকে হাজার নারী কণ্ঠে স্লোগান ওঠে, ‘দয়া’ নয়, ‘দাক্ষিণ্য’ নয়, শিক্ষা আমাদের জন্মগত অধিকার’।   

সহায়ক গ্রন্থ

১। ঈশ্বর গুপ্তর কবিতা

২। কাজী নজরুল ইসলাম- নারী কবিতা

৩। নির্মল দাশ সম্পাদিত – মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্মারক গ্রন্থ; পারুল প্রকাশন, ২০০৮, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৮

৪। ইন্দ্র মিত্র – করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, আনন্দ, কলকাতা, ১ ম সংস্করণ, ১৯৬৯, পৃষ্ঠা -১৯৯৯।