November 1, 2019

উত্তাল শাহবাগ ও মুক্তির গান

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

দেবাশিস মণ্ডল

সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন। ফেসবুক, ট্যুইটার, মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ইনস্ট্রাগ্রাম ইত্যাদি সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ও সংগঠিত হয় অসংগঠিত আন্দোলন।  মৌলবাদীদের নায়ক রাজাকার মিরপুরের ‘কসাই কাদের’ ওরফে আব্দুল কাদের মোল্লা ও অন্যান্য খুন,ধর্ষন, লুঠপাটের খল নায়কদের বিরুদ্ধে  লক্ষ লক্ষ মানুষের আন্দোলনে থেকে গর্জে ওঠে শাহবাগ চত্বর। মৌলবাদের বিরুদ্ধে পরোক্ষ থেকে আন্দোলন ক্রমে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে মানবতাকে সামনে রেখে লড়াই করেছিল সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ। সেই আন্দোলনের যে মানবতার জয়গান রচিত হয়েছিল সেই জয়গানগুলিই নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছিল ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনে। এখানেও জয়ী হয়েছিল মানুষ আর মানবতা। সেই আন্দোলন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এখনো তার আওয়াজ শোনা যায় সোস্যাল মিডিয়ায়। গানে গল্পে, নাটকে, সাহিত্যে। একদিকে ধর্ম বিদ্বেষ অন্যদিকে সত্য সন্ধানীদের লড়াইয়ে এখনো প্রতিদিন নতুন করে জয়ী হচ্ছে মানবতা।  

স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলাদেশের জামাত ইসলামী শিবির নৃশংস হত্যালীলা চালিয়েছিল। পাকিস্তান সেনা শিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা লক্ষাধিক মানুষকে খুন, জখম ও মহিলাদের ধর্ষণ করেছিল। দেশের মধ্যে থেকে বিজাতীয় মনোভাব নিয়ে এই হত্যালীলা চলেছিল। এর বিরুদ্ধে দেশের অধিকাংশ মানুষ সরব হলেও স্বাধীনতার পরে ৪২  বছর ধরে তাদের বিচার ও  শাস্তির কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দেশের বিভিন্ন সরকার নানা সময়ে এর বিরুদ্ধে কথা বললেও ‘আইন আইনের পথে চলবে’ এই জাতীয় কথা বলে নিজেদের দায়িত্ব  এড়িয়ে চলছিল। ফলে সাধারণ সব মানুষ ক্রমশ: বুঝতে পেরেছিল যে কোনো সরকারই জামাত শিবির ও তাদের নেতা রাজাকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায়না। ফলত: এই শিবির ক্রমে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলে। আধুনিক  জনসংযোগ ব্যবস্থার সুবাদে ফেসবুক টুইটার, ইমেল বিভিন্ন ওয়েব পেজ এর মাধ্যমে সাধারণ সব ধরনের মানুষের মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠে। তাতেই প্রথম প্রতিবাদের ভাষা সঞ্চারিত হয়। বিপুল অংশের মানুষের মধ্যে এই সম্মিলন তাদের নতুন পথের সন্ধান দেয়।  প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবনার সমাবেশ হতে থাকে। অদ্ভুত ব্যঞ্জনায় তা কখনো কাব্যে, গানে কখনো স্লোগানে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশে। নির্দিষ্ট দিন ক্ষণে হাজার থেকে লাখো মানুষের সমাবেশে গান আর স্লোগানে ভরে ওঠে শাহবাগ চত্বর। শেষ পর্যন্ত সেইসব হত্যা, লুন্ঠন ও ধর্ষনকারীদের ফাঁসির দাবিতে রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে আন্দোলনের মধ্যদিয়েই গড়ে ওঠে শাহবাগের আন্দোলন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’।

শাহবাগ আন্দোলনের শুরুর দিন থেকে তিন বছর সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। তার পরিণতি নিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নানা আলোচনা করছেন করবেন বহুকাল ধরে। আমার আলোচনা এই আন্দোলনের গান সে দেশের মানুষদের জন জাগরণে কতটা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এবং আগামী দিনে এই আন্দোলনের গান মানুষকে কতখানি অনুপ্রেরণা দেবে তা নিয়ে। তবে ঘটনাটা কী হয়েছিল তা আগে জানাই। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল শাহবাগের আন্দোলন।

বাংলাদেশের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামী আব্দুল কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণা করে।  কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা, আলুব্দি গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষ হত্যা সহ মোট ৬টি অপরাধের ৫টি প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। কিন্তু এতোগুলো হত্যা, ধর্ষণ, সর্বোপরী গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঢাকার শাহবাগে জড়ো হতে শুরু করে এবং এর অনুসরণে একসময় দেশটির অনেক স্থানেই সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়।

৫ই ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে কাদের মোল্লাকে ৩টি অপরাধের জন্য ১৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ২টির জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এতো বড় সব অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে যারা মেনে নিতে পারেনি তারা।  শাহবাগে অহিংস বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করে। একসময় তা দেশব্যাপী বিক্ষোভের রূপ নেয়। দেশের অন্য যেসব স্থানে উল্লেখযোগ্য বিক্ষোভ ও সমাবেশ হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, চট্টগ্রামের প্রেস ক্লাব চত্বর, রাজশাহীর আলুপট্টি মোড়, খুলনার শিববাড়ি মোড়, বরিশালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বগুড়ার সাতমাথা, যশোরের চিত্রা মোড়, কুমিল্লার কান্দিরপাড়া, কুষ্টিয়ার থানা মোড় ইত্যাদি। শাহবাগের অনেকে বলেন তারা মৃত্যুদণ্ডের রায় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চত্বর ছেড়ে যাবেন না’।[i]

প্রথমে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে এ আন্দোলন শুরু হলেও পরে এ দাবির সঙ্গে আরো দাবি যুক্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি। ডাক আসে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিষ্ঠান বর্জনেরও। আন্দোলন শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই সফলতা পায় গণজাগরণ মঞ্চ।

শুধু আইন সংশোধনের অধিকারই অর্জন করেনি গণজাগরণ মঞ্চ। আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী কাদের মোল্লার ফাঁসিও এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় বেশির ভাগ নেতার ফাঁসিও হয়েছে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেছে জামায়াতের। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। এই জায়গায় গণ জাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে দীর্ঘায়ত করে।

মাতৃভাষায় কথা ও কাজকর্মের অধিকার রক্ষার দাবি উঠেছিল ১৯৫২ সালের আগে থেকেই। ১৯৫২ সালে তা খুব বলিষ্ঠ আন্দোলনের রূপ পায়। ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় গান ও কবিতা বলিষ্ঠ হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আর ভাষা বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকরা তাদের লেখনীতে যুক্তি তত্ব ও তথ্য দিয়ে আন্দোলনকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলেন। সবে মিলে তা সর্বাত্মক হয়ে ওঠে। জনচেতনা ও গণজাগরণ মানুষকে ঘর থেকে পথে টেনে আনে। আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ভাষা বিজয়ের গান। ভাষা আন্দোলনের গানের মধ্যে ক্রমেই মুক্তির স্বপ্ন দেখে বাঙালিরা। ভাষা আন্দোলন ক্রমে মুক্তি আন্দোলনে পরিণত হয়।  বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি আন্দোলনে নতুন করে স্বদেশী গান মুখরিত হয়। এইসব গান বাংলার সর্বসাধারণকে ভিতর থেকে জাগিয়ে তোলে। সেই আন্দোলনের সুত্র ধরেই মৌলবাদের থেকে মুক্তির ডাক শোনা গেছে শাহবাগের আন্দোলনে। শাহবাগের আন্দোলন থেকে উঠে এসেছে মানবতার স্পষ্ট বার্তা। ধর্মান্ধ হিংসার থেকে মুক্তি, উন্মত্ত দাঙ্গার আর বিভীষিকার অবসান। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশে এসেছিল মুক্তির ডাক। মুক্তি হল স্বাধীনতার আন্দোলনে, আর এই আন্দোলনের সূত্রেই সজ্জিত হল শাহবাগের সমাবেশ। নরপশু রাজাকার কাদের মোল্লার শাস্তির দাবিতে লাখো-লাখো মানুষের কন্ঠস্বর শোনা গেল ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি। শাহবাগের আন্দোলনে সূচনা হল ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। শাহবাগ বাংলার মানুষকে নতুন পথ দেখাল। নরপশুদের বিরুদ্ধের আন্দোলন পরিণত হল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তলার আন্দোলনে। বাংলাদেশের এই আন্দোলন পথ দেখল ভারতকে। এই আন্দোলন থেকে হয়তো সারা পৃথিবীর ধর্ম-নিরপেক্ষ মানুষ নতুন পথের সন্ধান পেয়েছে। একদিন এই পথকেই গ্রহণ করবে সব মানুষ এই বিশ্বাস রাখতে পারলে হয়তো পৃথিবী অনেক হিংসা ও হত্যা থেকে মুক্তি পাবে।

বাংলাদেশে যে শাহবাগ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার সাথে যোগসূত্রের সন্ধান করতে গিয়ে সেখানকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের কথা বলেছেন অনেকেই। ভাষা আন্দোলন ক্রমে মুক্তিযুদ্ধে রুপান্তরিত হয়েছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের সূত্রে নরপশু রাজাকারের ফাঁসির দাবি এবং রাজাকারের মদতদাতা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘জামায়াত’ শিবির কে নিষিদ্ধ করার দাবী ওঠে। জামায়াত শিবির আসলে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। ফলে জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনে পরিণত হয়।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকেই গানকে বলিষ্ঠ হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে সে দেশের মানুষ। ভাষা আন্দোলনের গান ক্রমে জাতীয়তাবোধকে প্রবল করে তোলে। জাতীয়তাবোধের আবেগ থেকেই তারা অনুভব করে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা, শুরু হয় মুক্তির গান, মুক্তি আন্দোলন। অনেক রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আসে সেই স্বাধীনতাকেও এক শ্রেণীর মানুষ হরণ করার চেষ্টা করে। সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাসে অন্ধকার নামতে শুরু করে। ক্রমে উত্থান হয় জামায়াত শিবিরের এবং তাদের মদতদাতাদের রাজনৈতিক দলের। এর বিরুদ্ধে নতুন করে গণজাগরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের চেয়ে অনেক বেশী কঠিন। কারণ, মুক্তির দাবী দেশের সব মানুষের আর ধর্মীয় মুক্তির দাবি সব ধর্মের  বর্ণের মানুষের ক্ষেত্রে একই রকম নয়। সারা পৃথিবীতে বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আন্দোলন হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বর্ণ বিদ্বেষের  বিরুদ্ধে মুখর হয়েছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সেভাবে বৃহৎ আন্দোলন দানা বাঁধেনি। বাংলাদেশে রাজাকারের ফাঁসির দাবিকে সামনে রেখে মৌলবাদের বিরুদ্ধে যে সতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা সত্যিই নজির বিহীন। শেষ পর্যন্ত শাহবাগের দাবি মানতে বাধ্য হয়। ফাঁসি হয় রাজাকারদের। এখনো যুদ্ধপরাধীদের বিচার চলছে, আন্দোলনও চলছে ধিকিধিকি করে। সোস্যাল মিডিয়া থে থাকেনা, থাকবেনা। এখানেই ভয় দাঙ্গাবাজদের।   

শাহবাগ আন্দোলনে গান

শাহবাগের আন্দোলন সম্পর্কে কবীর আহমেদ ২৮শে মার্চ ২০১৩ তারিখে লেখেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সারা  দেশের মানুষের মধ্যে মুক্তি যুদ্ধের চেতনার বীজকে আবার উত্থিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর মানুষ সমূহ ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে কন্ঠে তুলে নিয়েছে ‘তুই রাজাকার’ স্লোগান যুদ্ধপরাধী কসাই ওরফে কাদের মল্লার যাবজ্জীবন রায়ের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম দাঁড়িয়েছিল ঋজু ভঙ্গিমায় প্রতিবাদে শ্লোগানে। পরবর্তিতে এর সাথে যোগ হয়েছে সারা দেশের মানুষ। ৫০দিনের আন্দোলনে ৪২ বছরের   জঞ্জাল শেষ হবার নয়। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। এ সাফল্যের পথ ধরেই আমরা হেঁটে যেতে চাই অনন্তকাল; রাজাকার মুক্ত আর জামায়াত শিবির মুক্ত বাংলাদেশকে নিয়ে।’[ii]

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের গান মুক্তিযুদ্ধের  গান নতুন করে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করেছে শাহবাগ আন্দোলনে। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলামের গানও প্রেরণা সঞ্চার করেছে এই আন্দোলনের তরুণ প্রজন্মকে।  ‘ঢাকা শহরের উপকন্ঠে শাহবাগ প্রাঙ্গণে অহোরাত্র মাতৃভাষা প্রেমিকরা জড়ো হয়ে আছেন, তারা প্রেরণার গান গাইছেন, প্রতিজ্ঞার গান গাইছেন, একটির পর আর একটি কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা অথবা নজরুলের, দুই বাংলার ঘরে ঘরে যেসব কবিতা প্রতিদিন মন্ত্রের মত উচ্চারিত হয় সে সমস্ত কবিতা। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানের প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে, যারা জড়ো হয়েছেন, হচ্ছেন আগামী দিনেও হবেন তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ যত ষড়যন্ত্রই হোক, যত নতুন নতুন বাধা পথ রোধ করে দাঁড়াক না কেন,  যে মাতৃভাষার স্বপ্ন বুকে জড়িয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, জয়লাভ করেছিলেন, গোটা পৃথিবীকে তারা দেখিয়ে দিয়েছিলেন মাতৃভাষায় কি অমৃতের স্বাদ, সেই ভাষা তাদের জন্মগত অধিকার, কোন দুশমনই ছিনিয়ে নিতে পারবেনা।’[iii]

ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সংগীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে বহু গান রচিত হয়েছে। এইসব গান সমাজে উদ্দীপনার জোয়ার এনেছে, দেশপ্রেমে উদ্দুদ্ধ করেছে মানুষকে। অবহেলিত ও অত্যাচারিত মানুষের আবেগ উৎসারিত হয়েছে গানের ভাষায়। উনাবিংসা শতকে শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে স্বদেশ-ভাবনার স্রোত বইতে শুরু করে। দেশে মানুষের দুঃখ, দারিদ্র ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে খুঁজতে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় স্বদেশী গান, মুক্তির গান। কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থাত বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি নয়, বিদেশী শোষনের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ স্বদেশের দুঃখ, দৈন্য থেকে মুক্তি, দেশীয় শিল্প-বানিজ্যের মুক্তি, বিদেশী ভাষার কর্তৃত্ত থেকে মুক্তি, দেশবাসীর বিচ্ছিন্নতাবোধ ও সাম্প্রদায়িক অসংহতি থেকে মুক্তি। সমকালীন সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মত দেশাত্মবোধক ও স্বদেশী গান রচনাও কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার ব্যাপকতা ছিল অনেক গভীর। সেখানে সামগ্রিকভাবে ক্রমশঃ প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের মুক্তিচিন্তা – তাই এইসব গান আরও ব্যাপক অর্থে মুক্তির গান। এই মুক্তির গানে যেমন পরাধীনতার গ্লানির কথা, দেশের গৌরব ও শ্রীহীনতার কথা আছে তেমনি আছে অতীত ঐতিহ্যের কথা, আত্মশক্তি বিকাশের কথা, আত্মনির্ভরতার কথা বা দেশকে মাতৃরূপে কল্পনায় বন্দনা।[iv]  (সুভাষচৌধুরী ২০০৩)

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে স্বদেশী গান একাত্ম হয়ে পড়েছিল হিন্দুমেলার সময় থেকেই। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় স্বদেশী গান আরো মুখর হয়ে ওঠে। এরপর মুক্তির গান ক্রমশঃ সর্বসাধারনের মধ্যে কল্লোলিত হয়ে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধের অবসান হল বাংলাদেশের স্বাধীনতায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শত সহস্র হত্যাকারীদের সাজা হলনা। ৪২ বছর ধরে বিচারের নাম নিরবতায় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। ন্যাহ্য বিচারের দাবিতে পথে নামল বাংলাদেশের মানুষ। শাহবাগ আন্দোলন তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নতুন প্রজন্ম ভাষা  আন্দোলন দেখেনি, দেখেনি মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলন, হত্যা, ধর্ষণ, নারকীয়তা ।  তারা পড়েছে ইতিহাস, মুখে মুখে শুনেছে অত্যাচারের নানান কাহিনী।  তাই তারা ফাঁসি চেয়েছে রাজাকার ও তার দোসরদের।  তারা গেয়েছে গান কখনো স্লোগান দিয়েছে. স্লোগানের ভাষা ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। তুই রাজাকার বাংলা ছাড়.তোমার ঠিকানা আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। তুমিকে আমিকে-বাঙালি বাঙালি- জয়বাংলা। শাহবাগের আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে যোগ দিয়েছে শিল্পীরা।  তারাও দিন রাত আন্দোলনের সাথে প্রহর গুনেছে।  তাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে হাজারো গান. আন্দোলনের প্রেরনায় কত সহস্র গান মুখে মুখে রচিত হয়েছে প্রতিদিন কে তার হিসাব রাখে? আন্দোলনের প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছে গান ও কবিতা রচনার কেন্দ্রস্থল। ‘শ্লোগানে জেগেছিল, জাগিয়াছে শাহবাগ/বলছে মোদের ধর্মখানা/ধর্ম নাকি ওদেরই জানা/ নিজের মাটি লুটলি নিজেই মীরজাফর/ ধর্ম দোহায় কিকরে হয় যায়েজ তোর/আল্লাহ মোদের সাথেও থাকে/সবার সকল পথের বাঁকে/ বিচার আবার হবেইরে তোর রোজ হাসর’। গানটি নীতেশ বড়ুয়ার লেখা। সুর মিশু খান এর ।  নীতেশ বড়ুয়ার লেখা আরো অনেক গান শাহবাগ আন্দোলনকে কেন্দ্রকরে প্রকাশিত হয়েছে। শহীদুল্লাহর লেখা একটি জনপ্রিয় গান ‘শাহবাগ চত্বর /বাঙালি জাতির অন্তর/ এ বিজয় জনতার/ এবিজয় চেতনার/তারুণ্যের অহংকার’। শিল্পী পুলক দুটি গান রচনা করেছেন। ‘তুই রাজাকার’ এবং ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ এই দুটি গান। জানি হক লিখেছেন, ‘শাহবাগ তুমি’। ব্যান্ডের গান ও শাহবাগ চত্বরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার ছিঁড়া ব্যান্ডের দল গেয়েছে-

‘আমি দেখেছি দুই শূণ্য তেরো

দেখিনি একাত্তর

দেখেছি শাহবাগ জনসমুদ্দুর।

আমাকে আজও মিছিল টানে

জয় বাংলা স্লোগানে

একসাথে বাঁচি একসাথে লড়ি

একসাথে এসো গিটার ধরি

দাবিদাওয়া শুধু ফাঁসির দড়ি’।

একটি গানের দল ‘সার্কেল’ গেয়েছে,-

‘খুব ভোরে এসেছি এখানে

জনস্রোতে হারায় এক হয়ে

নতুন সূর্যটাকে দেখব বলে, নতুন করে

আজ এখানে মিশে যাই এক শরীরে।

তোমার দেওয়া কথা রাখব বলে

আমার চিত্কার বাতাসে মিশে

বধির তুমি, শুনতেকি পাও তা,

পুরানো স্বপ্নকে নতুন করে সাজাই

আমরা ক’জনা’।

শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনকে ঘিরে কতযে গান রচনা হয়েছে তার হিসাব নেই। অনেকে গান গেয়ে ফেসবুকে, ইউটিউবে আপলোড করেছে। সেসব গান শুনেছে হাজারো, লাখো মানুষ। গানগুলির শৈল্পিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও কোনো ঘাটতি নেই, সাহিত্য গুনও যথেষ্ট উন্নত।এসম্পর্কে সূর্যসারথী নামে একজন লিখেছেন,

‘মায়ের ছেলেরা আজো যাইনিতো মরে

আগামী ফোটাব সূর্য সাজানো ভোরে।

ভাই হত্যার প্রতিশোধে দৃঢ় প্রত্যয় আজ

বুকে বেঁধেছি দৃপ্তপ্রাণ

আর মাথায় মরণ তাজ’।

গানটির কথায় ও সুরে যে বলিষ্ঠ প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছিল সেটাই ছিল শাহবাগের শপথ। শাহবাগ সারা পৃথিবীর কাছেই ঘোষণা করেছে নরঘাতক আর মৌলবাদ শেষ কথা নয়। শেষ কথা হবে মানুষ। এই শ্লোগান আর গান শাহবাগ চত্বর থেকে বাংলাদেশের মাঠ ময়দান কারখানায়, কলে ধ্বনিত হয়েছে ২০১৩র ফেব্রুয়ারিতে।

       বাংলাদেশের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সারা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের বাঙালিরা সরব হয়েছে। গান লিখেছে তারাও। ফেসবুকে, ইউটিউবে আপলোড করে নিজেদের গান পৌঁছে দিয়েছে ঘরে ঘরে। এপার বাংলার কবির সুমন বেশ কিছু গান রচনা করেছেন। তাঁর কথায় ও সুরে একটি গান-

বিমানে উড়তে তিরিশ মিনিট

এত কাছে তবু দূর

বিলকূল নেই পাশপোর্ট ভিসা

সীমানা চেনেনা সুর।

সীমানা চিনিনা আছি শাহবাগে

আমার গিটারও আছে

বসন্ত আজ বন্ধুরা দেখো

গান দাবি হয়ে বাঁচে।

কবীর সুমনের গানের মধ্যদিয়ে শাহবাগের পঞ্চম দিনের আন্দোলন শুরুহয়। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডট কম লিখেছে, “শনিবার সকালেই আন্দোলনের শুরুতেই সুমনের গান বেজে ওঠে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাইকে। ভারতীয় বাঙালি গায়ক ও গীতিকার কবীর সুমনের সে দেশে বসেই লেখা গানটি শুনেই উদ্দীপ্ত হন সমবেত মানুষেরা।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেশের মানুশের পাশাপাশি গানের সুরে সংহতি  জানিয়ে সুমন গানটি লিখে ও সুরারোপ করে পাঠান শুক্রবার। এরপর থেকে ‘সীমানা চেনেনা সুর’ গানটি অলিখিতভাবে গণ আন্দোলনের  থিম সং এ পরিণত হয়েছে। গানে গানে সুমনের সংহতি প্রমান করে সত্যিই ‘সীমানা চেনেনা সুর’। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে অনুভুত হয় সুমন ও তার গিটারের অস্তিত্ব”।[v]

বাংলাদেশের তরুণ সংগীত শিল্পী প্রীতম আহমেদ এর অনেক গান শাহবাগ আন্দোলনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক গানটি আন্দোলনের চতুর্থ দিনে আন্দোলনের শুরুতে জাতীয় সংগীতের পরেই গাওয়া হয়। গানটি আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে নতুন মাত্রা যোগ করে বলে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা হয়। প্রীতমের গাওয়া জনপ্রিয় অন্যতম গান ‘শাহবাগ কলিং আবার একাত্তর’ শাহবাগের লাখো জনতাকে উজ্জীবিত করেছে। তার প্রতিটি গানই  জয় করেছে মুক্তিযুদ্ধের মানসিকতাকে। প্রীতমের আর একটি গান ‘আমার ধর্মটাও তোমার কাছে জিম্মি হয়ে গেলো’ মৌলবাদের হিংস্রতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়েছে। সব ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিভেদের ও বৈষম্যের অন্যায় প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কালজয়ী গান লিখেছেন প্রীতম। এই গান বাঙালির অহংকার। লালনের ভাষা যেন নতুন করে নতুন ব্যঞ্জনায় নতুন সুরে জেগে উঠেছে প্রীতমের কন্ঠে। মৌলবাদের হিংস্রতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ধ্বনিত হয়েছে এই গানে।

শাহবাগের আন্দোলন শুধু রাজাকারের ফাঁসির দাবিতেই নয়, সেখানে নতুন করে জেগে উঠেছিল মাতৃভাষার প্রকৃত অধিকারের দাবি, মুক্তি আন্দোলনের সুর, ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি, সর্বোপরি সত্য ও মানবতার অধিকারের দাবি। শাহবাগ পথ দেখায়, শাহবাগ দৃষ্টিকে সুন্দর করে, শাহবাগ দূরকে কাছে টানে, শাহবাগ একসঙ্গে পথ চলার শপথে বলীয়ান। ধর্মনিরপেক্ষ, স্বাধীন সার্বভৌম নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার দাবি উঠেছে শাহবাগ থেকে। মুক্তি আন্দোলনে হত্যাকারী, লুন্ঠনকারী  ও ধর্ষকদের ফাঁসি আর তাদের মদতদাতাদের দলকে বে-আইনী ঘোষনার দাবি আপোষহীন বলিষ্ঠতার প্রকাশ ঘটায় সারা বাংলাদেশ জুড়ে। আর শাহবাগ স্কোয়ারে আন্দোলন তারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।  

১৯৫২ সালে ও তার পরে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ঘিরে অজস্র গান রচিত হয়েছে ও গাওয়া হয়েছে। ১৯১৩ সালের শাহবাগের গান নতুন করে সেই আবেগকে জাগিয়ে তুলেছিল। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণাকে স্মরণ করিয়ে দুই বাংলার আত্মিকতাকে আরো জাগিয়ে তুলেছিল। কোথাও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ সুকান্ত, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, আব্দুল গফফর চৌধুরী, প্রীতম আহমেদ, কবীর সুমন সবার মুক্তির গান, শিকল ভাঙ্গার গান, বাংলার গান, বাংলা ভাষা ও মাতৃভাষার গান ও  মানবতার গানে যে চেতনা তা জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিকতায় উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র, শোষনের বিরুদ্ধে  সেই আন্দোলন না হলেও মানবতা দিয়ে যার সূচনা ও বিস্তার তা একদিন পৃথিবীর সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে গান গাইবে। বিশ্বের সব প্রান্তের সঙ্গে মিলবে দুই বাংলার মানুষের সুর এই আশ্বাস আমরা পেয়েছি ওপার বাংলার শাহবাগের আন্দোলনে।

তথ্যসূত্র


[i]https://bn.wikipedia.org/wiki/ ২০১৩-র_শাহবাগ_আন্দোলন ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে অ্যাক্সেস হয়েছে।

[ii] কবীর আহমেদ।শাহবাগ চত্বর . 21 August 2013. www.amarblog.com/category September 21, 2013 অ্যাক্সেস হয়েছে।

[iii]শাহবাগ চত্বর . 21 August 2013. www.amarblog.com/categor (September 21, 2013 অ্যাক্সেস হয়েছে।

[iv] সুভাষচৌধুর।মুক্তির গান(কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি) ২০০৩ । পৃষ্ঠা-৯।

[v]www.বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।