সর্পদেবী মনসা, নাগাম্মা, বালনাগাম্মা, মুদামা ও মঞ্চাম্মা

বিষহরি পূজা’ই  প্রকারান্তরে মনসা পূজা। আমাদের দেশে যেখানেই সাপের ভয় বা সাপের উৎপাত বেশি সেখানেই সাপের দেবী রয়েছে। তার পুজো হয়। নানা লোকাচার পালিত হয় সর্দপদেবীকে কেন্দ্র করে। বাংলায় বিশেষ করে দক্ষিন ও দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে সাপের উৎপাত বেশি। তাই সাপের দেবীর মাহাত্ম নিয়ে লোকাচারও বেশি। এখানে সাপের দেবতা – মনসা ।গ্রামে গ্রামে মনসার থান আছে। সেখানে নিয়মিত মনসার পুজো হয়। আবার বাড়িতেও তুলসী তলার পাশে একটা মনসার ডাল পোঁতা থাকে। সেই মনসার গাছেও মনসা দেবীর অধিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। বাংলার বাইরেও সাপের নানা দেবতা আছে। কোথাও নাগরাজ, কোথাও নাগাম্মা। আবার বালনাগাম্মা, মুদামা ও মঞ্চাম্মা ইত্যাদি আরো কতো নাম। দেবীর মাহাত্মনিয়ে অনেক গল কথা মুখেমুখে প্রচলিত। তা নিয়ে কত গল্প , নাটক সিনেমা হয়েছে। এখনো তা মানুষের কাছে অসীম আগ্রহের বিষয়।

গ্রামের সার্বজনীন মনসা থানে সমবেত হয়ে যে সমস্ত বার ব্রত ও উপবাস গুলির পালন করা হয় তার মধ্যে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল দশমীতে অনুষ্ঠিত বিষহরি মনসা পূজার ব্রত অন্যতম এক মাঙ্গলিক ব্রত রূপে বিবেচিত হয়।যদিও  দক্ষিনবঙ্গে এই একই দিনে দশহরা গঙ্গা পূজারও আয়োজন হয়ে থাকে।

ব্রতগুলি গ্রামীন মহিলাদের অজস্র সংস্কারে আকীর্ণ। প্রতিটি পূজার ব্রতর ন‍্যায় মনসা পূজার ব্রততেও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। সধবা নারীরা এই পূজার ব্রতাচার পালন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ঠিক পূজার আগের দিন নিরামিষ খাবার রান্না করে থাকে। দশহরা পূজার দিন রান্নার কোনো বাহ‍্যিক রীতি রিয়াজ বা নিয়ম নাই। ওই দিন দশ প্রকার পুষ্পবতীপত্র, ফুল ও ফলমূলাদি সহ দুধ-কলা ও মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয় বলে এরূপ পূজার নামকরণ দশহরা পূজা রাখা হয়েছে। প্রধানত দুধ-কলা ও চিনি সন্দেশের নৈবেদ্যে পূজা দেয়া এই ব্রতের অন‍্যতম প্রধান রীতি ও নিয়ম। এই ব্রততে দেবী মনসার সন্তুষ্ট হওয়ার নানান মাহাত্ম্য কথা লোক সমাজে অধিক প্রচলিত আছে। তিনি সর্প কূলের আরাধ‍্য দেবী। আষাঢ় ও শ্রাবনের পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে আমন ধানের ফলন খুব ভালো হয়ে থাকে। কিন্তু অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে যেমন ধানে অপরিণত শষ‍্যের (আগড়ার)পরিমাণ বাড়ে। আবার এই অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের উৎপাতে মানুষ বেশি অতিষ্ট হয়। আবার অতিরিক্ত বৃষ্টিতে যখন মাঠ ঘাটে জলে ভরপুর হয় তখনও এই একই পরিণতি ঘটে। শুধু তাই নয় অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের বিষের পরিমাণ ও তার তীক্ষ্ণতা এতোটাই বাড়ে যে (কালাচ, কেউটে, চন্দ্রবোড়া) সাপের কামড়ে বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসার প্রাগ মূহুর্তে প্রাণ হারায়। তাই বিষধর কাল সাপের কামড়ের হাত থেকে বিরত থাকার অন‍্যতম এক মানসিক শক্তি লাভের পথ হিসাবে মানুষ বিষহরা মনসা পূজার প্রচলন শুরু করেছিল এমনই কিছু অনুমান করা হয় লোক শিক্ষার অন্দর মহলে। মনসা কালসাপ কূলের প্রধানা রূপে খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে উপশাস্ত্রীয় দেবীপুরাণে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। মনসা মঙ্গলের পালাতে মনসার লীলামহিমার ভয়াবহ ঘটনায় তার সেই বাহন কালসর্পের পরিচয় অতি সহজেই মেলে। তাই সেই বাহন স্বরূপ কাল সাপের হাত থেকে জীবন রক্ষার দরুন বিষহরি ব্রত ও পূজার আয়োজন করে থাকে দক্ষিণবঙ্গ তথা অখণ্ড বাংলার নারী সমাজ। ব্রতের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা মূর্তি হলেও প্রকৃত পক্ষে পূজার নৈবেদ্যাদি নিবেদন সমার্পন করা হয় একটি কাটা সিজ মনসার ডালের সন্নিকটে। যেখানে লাল রঙের সিঁদুর দিয়ে রাঙায়িত করা হয়। তার সামনে দুধের বাটি ও কলা নিবেদন করেন গ্রামের মায়েরা। এই সিজ মনসার ডাল পূজার প্রচলন যে ঠিক কবে সে বিষয়ে সঠিক তথ্যের উপস্থাপন মোটেই সহজ নয়। তবে অধিকাংশ লোক দেবদেবীদের মূর্তি পূজার পূর্বে  যেমন তাদের (আটেশ্বর, পেঁচাপেচি, ধর্মঠাকুর)  বৃক্ষ পূজারই অধিক প্রচলন ছিল। মনসা পূজার ক্ষেত্রেও এই তথ‍্য একেবারে অযৌক্তিক নয়। বৃক্ষের মধ‍্যে বট, অশ্বথ্ব, পাকুর, বেল, তাল, সিজ মনসার বহুল প্রচলিত ছিল বলেই অনুমান করা হয়।

মায়েদের অনেকেই এদিন উপোস রাখে। গ্রামের মন্দিরে আবার অনেকেই গন্ডিও দিয়ে থাকে পরিবারের সদ‍স‍্যদের কল‍্যাণার্থে। আবার অনেকে বাড়িতে ব‍্যাক্তিগত ভাবে সিজ মনসার ডাল লেপন করে সেখানেও পূজা দেয়। আবার অনেকে বলেন এই ব্রততে গঙ্গা ধরণীর বক্ষে পদার্পন করেন। তাই এ দিন গঙ্গা স্নানে দশ প্রকার পাপ খণ্ডিত হয় বলে অনেকে গঙ্গা পূজার ব্রতও পালন করে গঙ্গা স্নান সুসম্পন্নের মধ‍্যে দিয়ে।

বিষহরা ব্রত পালনকারী যযমান দের প্রতি প্রত‍্যেকের ঘরে ঘরে পান্তা খেয়ে পূজার রীতি রক্ষা করে। উনুন জ্বালানোর রীতি নাই। লোক সমাজে পৌরাণিক গল্পের কাহিনীতে বর্নিত রয়েছে যে ওই দিন উনুন জ্বালানো হলে দেবী মনসা তাঁকে স্বপ্নে সাপের ভয় দেখান। এমনকি বাস্তবেও বিষাক্ত কালসর্প এই অপরাধের কারণে দংশনও করতে পারে। তাই সমস্ত দক্ষিণ বঙ্গ জুড়ে বেশ ঘটা করে এই পূজার নিয়ম কানুন, ব্রত ও উপাচার পালন করতে দেখা যায়।

গ্রামের মহিলাদের বেশীরভাগ মায়েরা সর্প দংশনের ভয়ে ভীত হয়ে এই দেবীকে বেশ ঘটা করে পূজা দেয়। কারণ মনসার পালা গানে এই দেবীর চন্দ্রধরের নিকট থেকে পূজা নেওয়ার কৌশল অন‍্যান‍্য অঞ্চলে অজানা থাকলেও এদের অজানা নয়। তাই অন্যান্য দেবীর তুলনায় এই লোক দেবীর প্রতি অনেক বেশী ভক্তি বর্ষিত হয়। ভক্তির সঙ্গে হোক বা ভয়ে ভয়ান্বিত হয়েই হোক দীর্ঘদিন ধরে মানুষ এই নাগদেবী কে পূজা দিয়ে আসছে।

এই ব্রত ও পূজার আয়োজনে কোনো প্রকার মূর্তি পূজা করা হয় না। কিন্তু যাদের বাড়ির আরাধ্য দেবী মনসা তাদের বাড়িতে বেশ ঘটা করে পূজার আয়োজন করা হয়। মূলত ঠাকুর ঘরের এক কোণে বা তুলসী মন্ডপের পাশে একটা সিজ মনসার কান্ড কে কাদার মধ্যে পুঁতে সেখানে এই পূজার যাবতীয় উপাচার গুলির আয়োজন করা হয়। কোনো কোনো জায়গায় গ্রামের সার্বজনীন মনসার থানে পূজার আয়োজন করা হয় পূজার উপাচার গুলি নিয়ে। সিজ মনসার কান্ড কে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। তার সামনে ধূপ, দ্বীপ, চন্দন, ফুল ও ফল মূলাদি, মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয়। যখন সমস্ত গ্রাম জুড়ে প্রচন্ড সাপের উৎপাতের স্বীকার হয় তখন গ্রামের সার্বজনীন থানে সকলে একত্রিত হয়ে গন্ডি দেয়, ছলনা করে, মানত করে, পূজা দেয়, সিন্নি -ষষ্ঠী দেয়, পুরোহিত ডেকে মঙ্গল ঘট বসিয়ে পূজার শান্তি জল দেবীর চরনামৃত স্বরূপ গ্রহণ করে। দশহরা পূজার এই পূন্য লগ্নে বহু থানে মনসার পালা গানের আয়োজন করা হয়।অনেকে আছেন যারা আর্থিক দিক থেকে সবল তাঁরা ব্যক্তিগত মনসার গানের দল বায়না করে। সমস্ত পরিবারকে সাপের উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য গৃহস্থরা এই পূজার  আয়োজন করে। দক্ষিণ বঙ্গের বহু গ্রামাঞ্চল রয়েছে যেখানে নারী সমাজের বিশ্বাস ইচ্ছাধারী নাগদেব দেবী আজও জগতে বসবাস করে। এদের পূজার আয়োজন হয় দিন,বার ও তিথির পুন্য মূহুর্তে।ভক্তরা নাগদেবী রূপী এই সাপের সেবনের জন্য পাত্রে ভরে দুধ ও কলা দিতে দেখা যায় দু’এক জায়গায়। মনসার মৃন্ময়ী মূর্তির পিছনে এদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে অনায়াসে এরা সেই দুধ সেবন করে আবার গর্তে  ঢুকে যায়। গ্রামের মানুষ বলেন এরা কারো কোনো ক্ষতি বা অনিষ্ট করে না।বরং বহিরাগত শত্রু দের হাত থেকে গ্রামের মানুষ কে রক্ষা করে আসছেন বহু বছর ধরে। তাই মনসা দেবী শুধুমাত্র আর দশটা দেব দেবীদের মত ঠিক তা নয়। তিনি গ্রামের মানুষের থেকে একদিকে যেমন পূজা নেন বিনিময়ে গ্রামের মানুষের রক্ষার ভার ও তিনি বহন করেন। তাই শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে মনসা দেবীকে কেন্দ্র করে বহু প্রকার বার, ব্রত ও  উপাসনার নিয়ম রয়েছে।

দক্ষিনবঙ্গের গ্রাম সমাজে পূজনীয় সর্পের দেবী মা মনসা

 পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে আর দশটা লোক দেবদেবীর মধ‍্যে বিষাক্ত সাপের থেকে ত্রাণের একমাত্র দেবী রূপে মা মনসার মূর্তি সবচেয়ে বেশি পূজিত হতে দেখা যায়। এই মনসা মূর্তির আচ্ছাদিত পোশাক একদিকে যেমন শ্বেতবস্ত্র পরিধানে তিনি বিশ্ব শান্তি প্রদায়িনী, জগতের কল‍্যাণ রূপী, জগতের ধারক বাহকের স্নেহ বাৎসল‍্য রূপী মমতাময়ী জননীর এক ভাব মূর্ত প্রতীক স্বরূপ, ঠিক এর বিপরীতার্থে এই দেবীর এক রুদ্র ও বিনাশী ভাবমূর্তি রয়েছে যা অত‍্যন্ত ভয়াল ভয়ঙ্করী। শাস্ত্র অনুসারে কাল বিষাক্ত সর্প এই দেবীর অন‍্যতম প্রধান বাহন। তাই এই দেবীর প্রতি অশ্রদ্ধা ও অভক্তির পরিণতি বিষাক্ত সাপের কামড়ে প্রানের বিনাশ ছাড়া আর কিছু নয় এমন কিছু কাহিনীর কথা প্রচলন রয়েছে এই অঞ্চলের সামাজিক রীতি নীতিতে। তাই এই দেবীর অনুগত ভক্তদের বেশিরভাগ ভক্তি অপেক্ষা ভয়ে এই দেবীকে বেশি পূজা দেয়। ফলতঃ জনপ্রিয়তা অতি সহজেই অর্জিত হয়ে যায়। প্রতিটি গ্রামের সার্বজনীন থানে আর অন‍্যান‍্য দু দশটি দেবদেবীর সঙ্গে একদিকে যেমন তাঁর দেবী মূর্তি অনুগত ভক্তদের থেকে পূজা পেয়ে আসছে আবার অজস্র ব‍্যাক্তিগত মন্দির বা থান রয়েছে যে মন্দিরের আরাধ‍্য লৌকিকদেবী রূপে শুধুমাত্র তারই দেবীমূর্তি স্থান পেয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজে মনসা দেবীর পত্তন, সময়কাল, লীলার মাহাত্ম‍্য কথা বিস্তারিত তথ‍্যে নিম্নে বর্ণনা করা হল ।

মনসা দেবীর সৃষ্টি রহস্য ও দক্ষিণাঞ্চলে তার পূজার পত্তন

মঙ্গল কাব্যের যে সমস্ত দেবী, দেবতারা বাংলার বুকে সুদীর্ঘদিন ধরে পূজিত হয়ে আসছে এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও ভয়াল ভয়ঙ্কর দেবী হিসেবে মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মা মনসার নাম। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে যে তিনি নাগকুলের মূল আধিষ্ঠাত্রী সর্পকুলের প্রধান দেবী রূপে জগতে প্রতিষ্ঠিত। মনসা আদি বৈদিক যুগের বা পুরাণের মহিমান্বিত বা রামায়ণ অথবা মহাভারতের যুগের মানুষের আরাধ্য কোনো দেবী নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শাস্ত্র গুলি ভালো করে অধ্যায়ন করে স্পষ্ট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে সেকালে কেবলমাত্র বাসুকি নাগ ও পরবর্তীতে কৃষ্ণের কালে কালীও নাগ নামটি ছাড়া আর অন্য কোনোও বিশেষ সর্পের দেব দেবতার নাম পুরাণাদি গ্রন্থগুলিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগ কুলের অধিষ্ঠাতা দেবতা বাসুকি হলেন নাগেদের রাজা। সাংস্কৃত শাস্ত্র ও উপপুরানে বলা হয়েছে নাগরাজ বাসুকির ভগিনী হল এই মনসা দেবী। সর্পকূলের দেবী নাগিনী নামটির দ্বারা এই সীদ্ধান্তে অনুমান হওয়া যায় যে ইহা আধা নর ও আধা সর্পের এক ভয়ঙ্কর মূর্তি বিশেষ কোনো রূপ অথবা ঐশ্বরিক শক্তিতে বলিয়ান কোনো বিশেষ বিষধর সর্প হবে যার মধ‍্যে রূপ পরিবর্তন করার ইচ্ছাশক্তি আছে । ইতিহাসের পাতায় যা স্কাইথীয় নামে পরিচিত। কিন্তু মনসা নামটির সঙ্গে সর্পের সম্পর্ক ঠিক কবে থেকে জগতে প্রচলিত হয়েছে তা গভীর অনুসন্ধানের একটা বিষয়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে তাহার নাগ পরিবার, নাগরাজ বাসুকির ভগিনী তিনি তাই সেই কারনে দেবীর সঙ্গে সর্পের এই রূপ সম্পর্ক। যদিও শৈবপুরাণে দেবাদিদেব মহাদেবের সন্নিকটে যে বিষধর সর্পটির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে উদয় নাগ উহাতে সর্প দেবতাদের অনুচর স্বরুপ পূজিত হয়ে এসেছে। ব্যাক্তিস্বতন্ত্র রূপে কোনো দেবতা বা দেবী রূপে অধিষ্ঠানের কথা পুরাণের কোথাও বা শাস্ত্রে উল্লেখ নেই। বৈদিক যুগের মানুষ দেবীমূর্তি আরাধনার পরিবর্তে নিরাকার ব্রহ্মের ধ্যান, যাগযজ্ঞ ও প্রকৃতি পূজার প্রতি বেশি মনোযোগী হতেন। বেদ, পুরাণে স্পষ্ট তার প্রমাণ দেওয়া হয়েছে – ‘ধ্যায় শূন্য অহর্নিশম’। অতএব এত্যদ্বারা এই সত্য প্রমাণিত হয় যে মনসা পূজার সৃষ্টি বিগত আটশো নয়শো বছরের মধ্যবর্তী কোনোও এক সময় হবে, ইহার পূর্বে নহে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনও পর্যন্ত যে কয়টি পৌরাণিক মনসা মন্দির ও মনসা দেবীর খোদায় করা মূর্তির সন্ধান পেয়েছে ইহাদের অধিকাংশ মূর্তি সর্বোচ্চ সেন বংশের রাজাদের আমল পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সেনরাজ বিজয় সেনের আমলে প্রতিষ্ঠিত মনসা মূর্তির কয়েকটি প্রমাণ ও পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ ইহার থেকে আরো বিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে এই দেবীর জগতে অধিষ্ঠান হলেও সত্য হতে পারে কিন্তু তাহার এক কাঁচা পূর্বে নয়। কিন্তু মনসামঙ্গল কাব্যের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা নামটির আদি সৃষ্টি বা উৎপত্তি ঠিক কবে এ সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত শাস্ত্র অথবা পুরাণ গুলির একটিতেও মনসা নামটি খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বপ্রথম সাংস্কৃত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, দেবী পুরাণ ও দেবী ভাগবত উপপুরাণে মনসা নামটির সহিত সাক্ষাৎ লাভ করা যায়। এই সমস্ত গ্রন্থের প্রতিটির রচনা খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর এক কাঁচাও পূর্বে নয়।

মনসা শব্দটি ভারতীয় অর্বাচীন অনার্য ভাষা গোষ্ঠী হইতে এসেছে । মনসা নামটি অলুক সমাস। এখন অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন নামটি এসেছে তো এসেছে কোথা থেকে।  

দক্ষিণ ভারতের লোক সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দ্রাবিড় সভ্যতার নিম্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা আজও বহু সর্পের দেব দেবীর পূজা করে আসছে। যেমন- নাগাম্মা, বালাম্মা, মুদামা ইত্যাদি। নাম গুলি শুনে মনে হয় দাক্ষিণাত্য তেলেগু ভাষায় রচিত বিশেষ সর্প রূপের জাগ্রত দেবীই হবে। নাগাম্মা মা সর্প ও বালাম্মা ইহার কন্যা। প্রতিটি সর্পদেবীর আঞ্চলিক ভেদে নানান মাহাত্ম্যও রয়েছে। যেমন নাগাম্মা দেবীর কাহিনী পুতুল নাচ, সামাজিক পালাগানের মধ্যে দিয়ে আজও বর্ণনা করে চলেছে অন্ধ্রপ্রদেশের একশ্রেণীর স্ত্রী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দল। শুধু অন্ধ্রে নয় চেন্নাই সহ দক্ষিণের সমগ্র গ্রামাঞ্চল তথা শহরাঞ্চলেও বহুজাতিক সর্পের দেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে।

কর্নাটকের মহীশূরে মুদামা নামে এক বিশেষ ধরনের সর্প দেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে আজও। সমগ্র দক্ষিণের নারী সমাজ আজও দেবী রূপে ইহাকে পূজা করে। দাক্ষিণাত্যে প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ববিদরা ভাস্কর্য খোদায় করা এই দেবীর বহু মূর্তির সন্ধান পেয়েছে।  এই সর্প দেবীর মূর্তি অন্যান্য সর্পদেবীর মূর্তির তুলনায় একটু আলাদা। এই মূর্তির বিশেষত্ব হলো ইহার উদরের নিম্ন ভাগ সর্পাকৃতি ও উদর থেকে মস্তক পর্যন্ত কন্যাকৃতি। অর্থাৎ আধা নাগিনী ও আধা নারী মূর্তি বিশেষ মূর্তি।

আবার নাগাম্মা, বালনাগাম্মা, মুদামা ভিন্ন দক্ষিন ভারতের কানাড়া প্রদেশে মঞ্চাম্মা নামে এক দেবীর পূজার ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। ইহার মাহাত্ম্য হল ইহার কোনো মানবী রূপী দেবী মূর্তি বা রূপ নাই। মনে মঞ্চাম্মা এক অদ্ভুত অদৃশ্য সর্পের নাম। এই সর্পটি স্বর্গের নাগ জাতিগোষ্ঠীর একাংশ বলে মনে করা হয় বলে সর্পটির উপর দেবীত্ব আরোপ করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই মঞ্চাম্মা দেবীর পূজার আয়োজন করে ভক্তরা। বল্মীক রূপ এক স্তুপ  বা ঢিবির সামনে পূজার নৈবেদ্যাদি ফুল,পুষ্পচন্দনে সুসজ্জিত করে পূজা দেওয়া হয় এই দেবীকে।

এখন অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন বাংলার অনার্য সভ্যতার ভাষাগোষ্ঠীর শব্দভাণ্ডারে সৃষ্ট এই মনসা নামের সঙ্গে ইহাদের মিল কতখানি। উপরিউক্ত যে সর্প দেব দেবীদের নাম গুলি দেওয়া হয়েছে তার প্রতিটি নাম দেখে ও উচ্চারন বুঝে স্পষ্ট বলা যেতে পারে ইহাদের প্রতিটি নাম স্ত্রী লিঙ্গ অর্থাৎ দেবীমাতা। তেলেগু, তামিল, বা কন্নড় যে ভাষায় দেবী গুলির নাম যে ভাবেই সৃষ্টি হউক না কেন প্রতিটি দেবীর নামের উৎপত্তি গত ও ব্যাকারণ গত মাধূর্য আছে। মনে মঞ্চাম্মা দক্ষিন ভারতের সর্পের দেবীর নাম। আবার আমাদের বাংলার সর্পের দেবীর নাম মনসা। দক্ষিণ ভারতের এই দেবী বাংলাদেশের বুকে নাম একটু বদলে মঞ্চাম্মা’থেকে মনসা আম্মা রূপে পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব নহে। শুধু মঞ্চা-এর চা এর পরিবর্তে সা শব্দটি উচ্চারণ করিলে মনসা উচ্চারণ হতে পারে। এখন বিচার করা প্রয়োজন যে, যদি এই তথ্যের ভিত্তিতে মনসা নামটি এসে থাকে তবে এই নামের বার্তা বাহক কে বা কারা ? একমাত্র সর্পদের নিয়ে খেলা দেখাতে দেখাতে বেদিয়া সাঁপুরের দল এর বার্তা বাহক হতে পারে। কিন্তু এই তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট করে বলা যায় না যে এই তথ্য সম্পূর্ণ সত্য। যদিও এককালে বেদে সাপুড়ের দল সারা দেশে ভ্রমণ করতে করতে সাপ খেলা দেখাত।

আবার নাগাম্মা রুপী দক্ষিন ভারতের সর্প দেবীর সঙ্গে মনসা দেবীর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিচার করে দেখলে কিছু কিছু মিল ও অমিল পরিলক্ষিত হয়। নাগাম্মার প্রকৃত রুপ যেহেতু আধা নাগিনী ও আধা কন্যা তাই মনসার সঙ্গে ইহার পার্থক্য রয়েছে। শুধু তাই নয় বৈসাদৃশ্যের দিক দিয়ে আরোও কিছু কিছু পার্থক্যও রয়েছে। মনসা মঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও দক্ষিণ ভারতের এই প্রতিটি সর্প দেবীর মাহাত্ম্য কাহিনীও সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এখন দক্ষিনবঙ্গে মনসা ও তার অন্যতম প্রধান বাহন সর্পের কয়েকটি লোক বিশ্বাস সম্পর্কে দেওয়া হল। যেগুলি খুব আন্তরিক ভাবে মান‍্য হয়ে আসছে কয়েক দশক আগে থেকে।

মনসার বাহন সাপ সম্পর্কে দক্ষিনবঙ্গে গ্রাম‍্য সমাজে প্রচলিত কিছু যাদুকরী লোকবিশ্বাস

1.            সর্পের দেবী মনসার স্বপ্নবরে ঘর সংসার সুখী হওয়ার জন্য গুপ্তধন, রত্নসম্পদের সুযোগ সন্ধান সম্পর্কিত কিছু আবেগপ্রবন লোক গল্পের প্রবাদ প্রচলন এই সমাজে রয়েছে। সর্পের মাথার মণি সাত রাজার ধন। তাই তাকে প্রসন্ন করতে পারলে অনেক বেশি রত্ন সম্পদের মালিক হওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় বুক বাঁধে নারীপুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের সবাই।

2.            দেবী মনসাকে দুধ-কলা ও অন‍্যান‍্য নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারলে তার কৃপায় নিজদের শাঁখা সিঁদুর সতীসাবিত্রী ও বেহুলার ন‍্যায় চির অক্ষয় থাকবে এরকম একটা কল্পনাও সচরাচর করা হয়।

3.            বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীর দেহে পুনরায় প্রান ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র এই দেবীর। মনসামঙ্গলে তার রূপ চিত্রায়ন হয়েছে। তাই অন্যান্য লোক দেবীর পূজা অপেক্ষা এই দেবীর পূজায় বাস্তবিক জীবন সুস্থ সবল ও বিপদমুক্ত থাকার একটা মানসিক তৃপ্তিও অনুভব করা হয়।

4.            বিষধর সর্পের কোনো প্রকারে একবার মৃত্যু ঘটলে  কোনো কোনো জায়গায় তার বিষদাঁত ভেঙে তা সংগ্রহ করে রাখার রীতি নীতি রয়েছে। পরে ওই বিষদাঁত টি মাদুলি ও কবচে ভরা হয়। এই মাদুলি ও কবচ বয়োঃজ‍্যাষ্ঠ মানুষদের বাতের ব‍্যাথা হলে তাকেই পড়িয়ে দেওয়া হয়। বাতের ব‍্যাথা থেকে চীর মুক্তি লাভের আশায় আশায়।

5.            যারা নিতুই বিষধর সর্পের স্বপ্ন দেখে, বহুমূত্র ব‍্যাধির স্বীকার, পরিণত কৈশোরেও বিছানায় ঘুম ঘোরে মূত্রত্যাগ করে তাদের অধিকাংশই সাঁপুরে, বাজিকরদের স্মরণাপন্ন হয়। বাজিকরেরা যখন গ্রামে গঞ্জে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াত তখন তাদের ঝোলাতে নানান রোগ নিরাময়কারী ঔষধের সম্ভার থাকত। প্রতিটি রোগের মাদুলি ও কবচের ব‍্যবহার। অর্থাৎ এই সুযোগে সাঁপুরে বাজিকরদের দল ঔষধ বিক্রি করার একটা ফাঁদ পেতে বসে।

6.            প্রতিটি বাড়িতে একটি করে বাস্তুসাপ থাকে। এই সাপ কারো ক্ষতি করে না।  গ্রামের প্রতিটি মানুষ বাস্তুর মঙ্গল কামনার্থে এই সাপের রক্ষণাবেক্ষণ  করে থাকে।

7.            কোনো সাপের একবার মৃত্যু ঘটলে তাকে দাহ করার রীতি দক্ষিনবঙ্গের প্রায় সর্বত্র প্রচলিত রয়েছে। এক্ষেত্রে বাস্তুসাপ মারা গেলে অনেক গৃহস্থ ভক্তরা ক্ষৌরকর্ম, শ্রাদ্ধ শান্তি ও মস্তক মুণ্ডনও পর্যন্ত করে থাকে। তবে কারো আঘাতে কোনো বিষধর সর্পের মৃত্যু ঘটলে মূলত তার বংশোদ্ভূতদের দ্বারা প্রতিশোধ নেওয়ার এক ভৌতিক লোক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস বিশেষত তার চোখ ও স্মৃতিতে ওই আঘাতকারী ব‍্যাক্তির প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়ে যায়। তাই সাপের মুখমণ্ডল দাহ করে দিলে এর থেকে চীর মুক্তি পাওয়া যায়।

8.            রাত্রে এলোমেলো বিছানায় বিষধর সাপের কামড়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। তাই গ্রামের মানুষের লোক বিশ্বাস মনসা ও তার স্বামীর নাম স্মরণ করে বালিশে ‘আস্তিমাতা ‘টোকা দিলে আর এরূপ অনিষ্ট ঘটে না।

9.            বিনের আওয়াজে মনসার বাহন কালসর্প খুবই নেশা গ্রস্থ হয় এমন এক অদ্ভুত ধারণা আজও বেদেদের একদল গ্রামে গঞ্জে ঘুরে খেলা দেখিয়ে প্রমাণ করে বেড়ায়। শুধু তাই নয়  ধূনার গন্ধেও সে ঝিমিয়ে পড়ে। তাই তার পূজার পূণ্যমূহুর্তে কোনোরূপ ধূনা ব‍্যবহারের রীতি নাই। এসবের ব‍্যবহারে তিনি রুষ্ট হন বলে পুরোহিতদের একদলকে বলতে শোনা যায়।

10.          হেঁতালের গন্ধে কালসর্প ঝিমিয়ে পড়ে। তাই তার পূজার পূণ্য লগ্নে হেঁতালের ব‍্যবহৃত ছড়ির পরিবর্তে কঞ্চির ছড়ি ব‍্যবহার করে কাঁসা বাজানোর  রীতি রিয়াজ আজও কমবেশি চোখে পড়ে।

11.          সাপে কাটা রোগীর দেহে প্রাণ বিয়োগ হলে সেই দেহে কেবলমাত্র মনসার সাধনায় সিদ্ধ গুনীন, বদ্যি  ও ওঝারাই  প্রান ফিরিয়ে আনতে পারেন- এই কথা আজও নিরক্ষর মানুষের মনে বিশ্বাস। ওঝা ও গুনীনরা এই দেবীর আশির্বাদ ধন্য মানস বা বরপুত্র। তাদের কাছে সাপে কাটার যাবতীয় ঔষধের সম্ভার রয়েছে ।তাই গ্রামের মানুষ বিজ্ঞানের ধারাপাত অপেক্ষা মনসা ও তার আশির্বাদধন‍্যা ওঝা, বদ‍্যিদেরকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

12.          সর্পে দংশিত রোগীরা মারা গেলে তাদের পোড়ানোর রীতি দক্ষিনবঙ্গের লোক সমাজে নাই। সমাধি দেওয়া হয় এই কারনে রোগীর দেহে পুনরায় প্রাণ ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায়, বিশ্বাসে ও কল্পনায়।

13.          লোক সমাজে প্রবাদ প্রচলন রয়েছে যে সাপে কাটা রোগীদের প্রান দেহের মধ্যে থেকে যায়। বিষের জ্বালায় নীল হয়ে যায় সমস্ত শরীর। শ্বাস প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য মৃতদের আগুনের সৎকারে মৃতদেহ চীর ভষ্মীভূত হয়ে যায় শ্মশানে। কিন্তু সাপে কাটা রোগীদের মৃতদেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। তার একটি মাত্র কারন কোনো সহৃদয় ওঝা বা গুনীনের সান্নিধ্যে এসে যদি আবার পুনঃজন্ম লাভ করে এমন কিছু কাঙ্ক্ষিত আশায়।

14.          সাপের বিষ থেকে যে  (SAVS)   স্নেক এন্টি ভেনম সিরাম তৈরি করা হয় তা দিয়ে  সাপে কাটা রোগীর প্রান বাঁচানো সম্ভব। তাই একটি বুদ্ধিজীবী মানুষের চিন্তা ভাবনায় বিষাক্ত সাপকে হত্যা না করে বরং তাঁকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

15.          সাপ বংশের ধারক বাহকের প্রতীক। নিঃসন্তান মাতাপিতা একটি  সন্তান কামনায় এই দেবীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে ভক্তি দিয়ে পূজা করে, ছলনা দেয়, গন্ডি দেয় ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

মনসার বন্দনা গান

গ্রামের সার্বজনীন মন্দির গুলির মহোৎসব পর্বে মনসা দেবীর উত্থান ও পূজা পার্বণের পুণ্য লগ্নে সমগ্র উনবিংশ, বিংশ শতাব্দী থেকে আজও গ্রামের সধবা মহিলাদের একদল সমবেত কণ্ঠে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মঙ্গল ঘট বসিয়ে এক সুন্দর লোক সুরের আঙ্গিকে মনসার বন্দনা গান গায় দশহরার ব্রত পালন করে। প্রতিটি গ্রামের সার্বজনীন থান বা মন্দিরে সমগ্র গ্রামের মাঙ্গলিক লোক দেবী রূপে দীর্ঘকাল যাবৎ ভক্তদের কাছে থেকে মনসা পূজা নিয়ে আসছে। তাই বৎসরান্তে এক দুই বার তার মহিমা কীর্তন পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে মানসিক সুখ শান্তি অনুভব করে দক্ষিণ বঙ্গে এই দেবীর অনুগত ভক্তরা। লোক সঙ্গীতের আর অন্যান্য শৈলীর মতো মনসার পাঁচালীগান বা অভিনয়ের মধ‍্যে দিয়ে যাত্রা পাঁচালী পরিবেশনের মধ‍্যে দিয়ে তারা দেবীর গুনকীর্তনে আনন্দে মাতে।

মনসার পাঁচালী গান‌ সম্প্রদায়ের শিল্পীরা দেবী মাহাত্ম্য কীর্তনের পালায় অনুপ্রবেশের পুণ্য মূহুর্তে পুরুষ ও মহিলা চরিত্রের সমস্ত নরনারীরা সর্বপ্রথমে ‘আশাবারী’ খনন করে দেবীকে আনয়ন করে। লোক সমাজের প্রতিটি গৃহস্থের ধারণা এই সময় মনসা দেবী জাগ্রত হয়ে তার অনুগত ভক্তদের কৃপা করেন। সেই কৃপা বর্ষনের সামান্য করুণা লাভের আশায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলাদের একদল গন্ডি দেয় থানের চতুর্দিকে। অন‍্যান‍্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষরা এই পবিত্র সঙ্গীতানুষ্ঠানেও কমবেশি উপস্থিত হয়। সেই পুন‍্য ক্ষনে শিল্পীরা মহানন্দে মনসা বন্দনা পরিবেশনের মধ‍্যে দিয়ে দেবীর চরণে নিবেদন রেখে সকলে উচ্চৈঃস্বরে গাইতে থাকে ;

জয় জয় মা মনসা, জয় বিষহরি গো ।

বন্দনা করি মাগো মা মনসার চরণে।।

তার পরে বন্দনা করি  মহাদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা

তার পরে বন্দনা করি ভগবতীর চরণে।জয় জয় মা মনসা

তার পরে বন্দনা করি মা কালীর চরণে। জয় জয় মা মনসা

ও মা – – –

মাগো আকাল বন্দন পাতাল বন্দন বন্দনা করলাম,

আমি গুরুদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা

তার পরে বন্দনা করি তেত্রিশ কোটি দেবতা। (জয় জয়)

সামাজিক গুরুত্ব

 এখন অনুসন্ধান করা প্রয়োজন মনসা দেবীর এই বাস্তবিক পূজার সামাজিক গুরুত্ব কতখানি। সেক্ষেত্রে দেখা যায় দক্ষিণ বঙ্গে অধিকাংশ গ্রামগুলির সার্বজনীন থানে মনসা দেবীর মূর্তি পূজার একটা বেশ বড়সড় রীতি রিয়াজ পালন করা হয়ে আসছে বহু পূর্বাপুরুষ ধরে। যদিও সেখানে দেবাদিদেব মহাদেব (পঞ্চনন্দ), বনবিবি, শীতলা, লক্ষ্মী, কালি, চণ্ডী, বারা ঠাকুর সহ আরো আট দশটা দেব দেবীকে পূজা করে গ্রামের মানুষ। কিন্তু তার সত্বেও সার্বজনীন মন্দিরের বাইরেও এমন কিছু কিছু থান বা মন্দির রয়েছে যেগুলোতে শুধুমাত্র মনসা দেবীর মূর্তি ব্যাতিত আর অন্য কোনো দেব দেবীর মূর্তি পূজা করা হয় না অর্থাৎ ব‍্যাক্তিগত ভাবে শুধুমাত্র মনসা দেবীর জন্য বহু মনসা মন্দির রয়েছে। সেগুলি মনসার থান নামে পরিচিত। দক্ষিণ বঙ্গের চাষাবাদ যুক্ত পল্লী গ্রামাঞ্চল গুলিতে এ জাতীয় মনসা মন্দির সচরাচর বহু পরিমাণে দেখা যায়। কোনো স্থানে একবার মনসা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলে সেই স্থান দিনের পর ভক্তদের সমাগম বাড়ে কিন্তু কমে না। শুধু তাই নয় সেই মন্দির নির্মাণের উপাদান প্রথমে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনি হলেও দিনের পর দিন অজস্র ভক্তের গুপ্ত ব‍্যাধি তথা নানান রোগ নিরাময় ও অন‍্যান‍্য বহু সুখ সমৃদ্ধির মূলে দেবীর মহিমাকে দায়ী করে তাঁকে স্বর্ণ, রৌপ্য ও নানান গহনাদি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। পাড়ার বয়স্ক মোড়ল মতিব্বরদের উপস্থিতিতে সকলকে সাক্ষী করে ব‍্যাক্তিগত জায়গায় সৃষ্ট  পূজনীয় স্থানকে মনসা দেবীর মন্দিরের নামেই উৎসর্গ করে জমির মালিক পক্ষ। এরপরে ধুমধাম করে জাগ্রত করা হয় পুরোহিতের পূজার নানান সাংস্কৃত মন্ত্রে। গ্রামের কুমারী, সধবা ও বিধবা মহিলারা প্রতিনিয়ত সকাল সন্ধ্যায় এইসব থানে বা মন্দিরে ভোগ লাগাতে শুরু করে।

বহু ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ মনসা দেবীর থানের সন্নিকটে রয়েছে সিজ মনসার গাছ। এই গাছকে দক্ষিণাঞ্চলের মনসা ভক্তদের একাংশ স্বয়ংসিদ্ধ মনসা দেবীই জ্ঞান করে। বহু স্থানে কিছু পুরানো মনসা মন্দির রয়েছে। যেখানে সিজ মনসার গাছ গুলি প্রচণ্ড বড় এবং তার নিচের অংশ গুঁড়ির আকারে পরিণত হয়েছে। তাই মনসা দেবীর মুর্তি পূজার সঙ্গে সঙ্গে সীজ মনসার ডাল পূজার প্রচলনও রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মনসা ভক্তদের একদল অনুগত ভক্তরা বলেন যে সমস্ত গৃহে মনসা মূর্তি নাই তাঁরা সীজ মনসার কান্ড কাদায় প্রতিষ্ঠিত করে যদি পূজা দেয় তবে সেই পূজাতেও এই দেবী সন্তুষ্ট হয়। মনসা রূপী এই সীজ মনসার ডালের সামনে পূজার নানান নৈবেদ্যাদি সাজিয়ে পূজার আয়োজন করা যেতে পারে। বস্তুত মনসা মূর্তি ও সীজ মনসার কান্ড পূজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দী হতে পল্লী বাংলার গ্রামাঞ্চল গুলিতে গৃহস্থের নিজের আরাধ্য দেবীর পূজার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মনসা। এই দেবীর ভাক্তাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়তার যে কারণ গুলি মানা ‌হয় তা বিস্তারিত তথ্যে উপস্থাপন করা হল;

1.            অখণ্ড বাংলায় আর দশ বিশটি লৌকিক দেবদেবীর মতো খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে মনসা দেবীর উত্থান হয়েছিল সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গ তথা বাংলার লোক সমাজে। প্রতিটি লোক দেব দেবীর বাহনের ন্যায় এই দেবীর প্রধান অনুচর কাল বিষাক্ত সর্প। যার  কামড়ের হাত থেকে রক্ষার্থে অতি সহজেই তার পূজার জনপ্রিয়তা কয়েক দশকের মধ্যে তুঙ্গে উঠে যায়। তার ভক্তরা স্বেচ্ছায় নয় বরং ভয়ে ভয়ে দেবীকে বেশি পূজা দেয় কেবলমাত্র কাল সর্পের কামড়ের হাত থেকে সপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের রক্ষার্থে।

2.            প্রতিটি লোক দেবী দেবীর উত্থানের পিছনে একটি মহান উদ্দেশ্য থাকে। গ্রামের মোড়ল মতিব্বরদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় এই সব দেব দেবীর মূর্তি রাখার প্রধান উদ্দেশ্য বহিরাগত শত্রুদের আক্রমণ থেকে সমগ্র গ্রাম কে রক্ষা করা। অনুরুপ কালসর্পমূর্তি বিশেষ মনসা দেবীর এই ভয়ঙ্কর মূর্তি প্রতিষ্টার পিছনে এটাই মহান উদ্দেশ্য।

3.            শিবের অসাধ্য হাম, বসন্ত, গুটি বসন্তের মতো কতকগুলো রোগের প্রকোপে অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গ্রামের পর গ্রাম মড়ক দেখা দিত। যার ফলশ্রুতিতে উজাড় হয়ে যেত সমগ্র গ্রামের নিরপরাধী মানুষ। এই সমস্ত রোগের কোনো চিকিৎসা তো ছিলই না বরং বলা হত শীতলা, মনসা ও বিবি মায়ের মতো কিছু দেব দেবীর ব্রত ও  পূজা পার্বনের কর্মকাণ্ডে ভুল ত্রুটি হলে তার পরিবর্তে রুষ্ট হয়ে দেবদেবীরা এসব অনিষ্ট দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি করেন। তাই ভক্তি সহকারে ধুমধাম করে তাদের পূজা ও সন্তুষ্টিতে এহেন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এমন ধ্যান ধারণায় শীতলা বনবিবির ন্যায় মনসার ও সামাজিক গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

4.            মনসা ভয়াল, ভয়ঙ্কর সর্পের দেবী রূপে জগতে পূজিতা হয়ে আসছে। কিন্তু মনসা মঙ্গল কাব্যের একেবারে শেষ মূহুর্তে আমরা এই দেবীর একটু বিপরীত চরিত্র খুঁজে পায়। চাঁদ বনিকের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার কাহিনী বঙ্গের কোনোও নারীর অজানা নয়। বেহুলার সতীত্ব ও সত্য বচন রক্ষার্থে চাঁদ সওদাগর মনসাকে বাম হাতে পূজা দেয়। চাঁদ সওদাগরের মনসা পূজার পরিবর্তে মনসা যখন সন্তুষ্ট হয়ে লক্ষীন্দর সহ ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দিল, তার প্রিয় বন্ধু শঙ্কর গারুরীর জীবন ফিরিয়ে দিল, সপ্ত ডিঙ্গার প্রতি ডিঙ্গা জলে ভাসিয়ে দিল এবং মহাজ্ঞান মন্ত্র সহ হাতি শালের হাতি, ঘোড়া একে একে সব ফিরিয়ে দিল এসমস্ত ঘটনায় আমরা কাহিনীতে আমরা মনসার ভক্ত বাৎসল্য রূপ খুঁজে পাই। সেই হারানো কাঙ্ক্ষিত সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তি পুনরায় ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় দক্ষিণ বঙ্গে মনসার দেবীর পূজা খুবই শীঘ্রই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

5.            মনসার প্রধান অনুচর কাল সর্প। যা বংশবৃদ্ধি ও বংশগতির ধারাবাহিকতার  অগ্রগতির বিশেষ প্রতীক। স্নেহ বাৎসল‍্যময়ী এক পুত্র সন্তানের বা কন‍্যা সন্ততির জননী হওয়ার আশা বা বাসনা প্রতিটি সধবা রমনীর মনে থাকে। সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ব‍্যাথা বেদনায় সে মনসার কাছে আকুণ্ঠ ভরে প্রার্থনা করে শুধুমাত্র একটি পুত্র বা কন‍্যা পাওয়ার আশায়।

6.            দেবী ভাগবত বা দেবী পুরাণে দুই হিন্দু দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় যাদের প্রধান বাহন শ্বেত হংস। এই দুই দেবীর একদিকে মা স্বরস্বতী ও অন‍্যদিকে মা মনসা। যদিও দেবী স্বরস্বতী বৈদিক যুগের সুরের আরাধ্য দেবী। তার প্রধান বাহন হংস হলেও এযুগের লোক দেবী মনসারও প্রধান বাহন হংস। হিন্দু সম্প্রদায়ের আর দশ বিশটি দেব দেবীদের ভিন্ন ভিন্ন বাহন দেখা গেলেও শ্বেত হংস সচরাচর  নম্র, ভদ্র ও শ্বেতশুভ্র শান্তির পথিক। পঙ্কিল সলিলে হংস যেমন তার প্রয়োজনীয় খাদ‍্যবস্তু গ্রহন করে অপ্রয়োজনীয় খাদ‍্যবস্তু পরিত‍্যাগ করে। তৎরূপ ভক্ত বাৎসল‍্যময়ী এই মনসা ভক্তদের মন কেই ভালোবাসে, কোনো পূজার বাহ্যিক আড়ম্বরে নয়। তাই তার ভক্তদের একাংশ বিনম্র ভক্তি ও শ্রদ্ধায় তাঁকে পূজা করে।

7.            দক্ষিণাঞ্চলের লোক সঙ্গীতের আসরে এক শ্রেণীর সঙ্গীতজীবি সম্প্রদায়ের কাছে এই দেবীর গুরুত্ব অসীম। মনসামঙ্গল কাহিনীর মূল মাহাত্ম্য কথা মনসার গান আজ বাংলার কোণায় কোণায় প্রচলিত রয়েছে। পূর্বে এই পালাগান সিঙ্গেল পাঁচালির মতো করে গান ও অভিনয়ের প্রথা প্রচলন থাকলেও বর্তমানে শ্রোতাদেরকে রসাপ্লুত ও দৃষ্টিগোচরে অত‍্যন্ত আকর্ষণীয় করে তোলার জন‍্য যাত্রাপাঁচালির প্রচলন শুরু হয়েছে। এহেন লোক শিল্পীরা বছরে প্রায় সত্তর, আশি, এমনকি একশো পালা পর্যন্ত মনসা, শীতলা ও বনবিবির গান করে তাদের সংসার খরচ বহন করে আসছে। তাই এদিক দিয়ে এই দেবীর সামাজিক গুরুত্ব অনেক খানি।

গ্রন্থঋণ :-

বাংলা মঙ্গল কাব‍্যের ইতিহাস – ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য।

সুন্দরবনের লোকদেবতা – ড . দেবব্রত নস্কর।

আলোর উৎসব : কুলকুলোতি

তুলসী প্রদীপ

পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলি জেলার জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কুলকুলোতি ব্রত ও উৎসব হয়ে থাকে। ‘কুলকুলোতি’ বা ‘কুলকুলতি’  গ্রামীন লোকাচার পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে বা হারিয়ে যাওয়া মানুষদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে থাকে।আবার কুলের মঙ্গল কামনাতেও এই ব্রত হয়ে থাকে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকেই  এই ব্রত বা লোকাচারপালনের রীতি চালু রয়েছে। চলে কার্তিক সংক্রান্তি পর্যন্ত।

আশ্বিন মাস জুড়ে দুর্গা পুজো, তার  পরেই লক্ষীপুজো, কালীপুজো চলে। আশ্বিনে লক্ষীর পুজো হয়ে থাকে। লক্ষ্মীর ব্রত হয় পৌষ মাসে।  আশ্বিন মাস পুজোর মাস।  কার্তিক মাসে ‘কুলকুলোতি’, অগ্রহায়ন মাসে নবান্ন, ইতু পুজো, পৌষ মাসে তুসু পুজো আর লক্ষীর ব্রত হয়। বাঙালির ঘরে ব্রত, আর পুজো অবশ্য সবই মিলে মিশে রয়েছে।  কার্তিক, অগ্রহায়ন আর পৌষ এই তিন মাস বাংলার গ্রামাঞ্চল উৎসবমুখর হয়ে থাকে। ছোট-বড় সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, যদিও সাধারণভাবে কুমারী ও সধবা মহিলারা এই উৎসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে শামিল হয়। কিন্তু তা’ সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িয়ে  রয়েছে,।

কুল প্রতিহত তুলসী তলায় গর্ত খুঁড়ে প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে ফুল ও কুল গাছের পাতা দূর্বাঘাস, তুলসীপাতা দিয়ে কোন দেবীর উদ্দেশ্যে গান গাওয়া হয়। এখনো হয়ে থাকে। আবার অনেকে তুলসী তলায় একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে আর টুকরো করে কাটা কলাগাছের খোলার ওপর প্রদীপ জ্বালিয়ে কিছু ফুল দিয়ে সেই কলার ভেলাটি পুকুরে বা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কলার ভেলাটি ভাসানোর সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা গান গাইতে থাকে। ভেলা ভেসে চলে দূরের পানে। আলো নিয়ে ভেলা যায় পূর্ব প্রজন্মের মানুষদের কাছে।

সাধারণত ছোট ছোট মেয়েরাই এই ব্রত করে। তবে বাড়ির ছোট ছেলেরাও এই ব্রত পালনে অংশ নেয়। মা কাকিমাদের শাড়ি পরে গিন্নির মত সেজে আলো জ্বালানো, শাঁখ বাজানোর ব্রত যেন গার্হস্থ জীবনের হাতে খড়ি। এরা কার্তিক মাসের আগে থেকেই কাদামাটির প্রদীপ গড়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। কেউ কেউ উনুনের আঁচে বা কাঠের আগুনে একটু পুড়িয়েও নেয়। প্রতি দিন তিনটি করে প্রদীপ লাগে। তাই অনেক প্রদীপ গড়তে হয়। প্রদীপ গড়া নিয়ে বেশ প্রতিযোগিতাও চলে ছোটদের মধ্যে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনটি কুলপাতা, তিনটি দূর্বা ঘাস নিয়ে তিনটি প্রদীপে তেল সলতে দিয়ে সাজাতে হয়। এরপর পুকুর ঘাট থেকে জল আনতে হয় একটি পাত্রে করে। জল আনার সময় পুকুর ঘাটে গান গাইতে হয়-

জলে আছে জলকুমারী,

ডাঙায় আছে হরি,

এক ঘটী জল দাও মা,

হরি পূজা করি।

পুকুর ঘাট থেকে জল এনে তুলসি তলায় জল ঢেলে প্রদীপ জ্বলানো হয়। প্রদীপ জ্বালানো হয় গান গেয়ে । প্রদীপ জ্বালানোর গান :

সাঁঝ সলতে পরমবাতি,

সন্ধ্যে দেখায় ভগবতী,

কোথায় আছে দেবগণ,

সন্ধ্যে দেখায় নারায়ণ।

পুজোর মন্ত্র

কুলকুলতি কুলের বাতি,

তোমার তলায় দিয়ে বাতি,

অরণ ঠাকুর বরণে,

ফুল ফুটেছে চরণে।

এ ফুলটি যে তুলবে,

সাত ভাইয়ের বংশে,

সাবিত্রী সত্যবান।

কার্তিক মাসে রাসে,

ধুপ ধুনো বাসে,

ধুপ, দীপায় নমঃ।

তুলসী গাছে জল ঢালার মন্ত্র

তুলসী তুলসী মাধবলতা,

ও তুলসী কৃষ্ণ কোথা?

কৃষ্ণ গেছে গোচারণে।

তোমার শিরে ঢালি জল,

অন্তর থেকে দিও স্থল।

কোথাও আবার এই গানের ভিন্ন রূপও শোনা যায়।

তুলসী তুলসী মাধবীলতা

কও তুলসী মিষ্টি কথা

কিষ্ট কথা শুনলাম কানে

গড় করি মা শ্রীচরণে

জলে আছে জলকুমারী

ডাঙ্গায় আছে হরি

একঘটি জল দাওমা

তুলসী পূজা করি ।

তিনবার এই গান গেয়ে হাত জোড় করে কিশোরীরা বাড়ির মঙ্গল কামনা করে। এই গান গাওয়ার পরে কুলপাতা দেওয়ার পর্ব শুরু হয়। তখন গাওয়া হয় :

”কুলপাতা কুলপাতা ঝাঁকড়ি

সতীন বেটা মাকড়ি।

সাত সতীনের সাত কৌটা

আমার মায়ের নব কৌটা।

নব কৌটা নড়ে চড়ে

সাত সতীনের মুখটী পুড়ে।”

শাঁখ বাজানোর সময় গাওয়া হয়

শাঁখে আছে শঙ্খধ্বনি,

শাঁখ বাজায় মহামুনি।

দিকদিগন্ত ব্লগপোস্টে লেখা হয়েছে, ‘ছোট্ট মেয়েরা প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা এইভাবে পুজো করার পর, মাসের শেষ দিনে ভোগ দিতো। সেটা বেশ খুশির দিন। ভোগ তৈরি হতো চিঁড়ে, দুধ, কলা, বাতাসা দিয়ে। সঙ্গে থাকতো অন্যান্য ফল, আলাদা থালায়। রোজকার মতো ওইদিনও পুজো করে নিতে হতো সন্ধ্যেবেলা। কিন্তু ভাসানোটা ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে। তখন তাদের বেশ কান্না পেতো। দুটো কারণ, এক – পুজো শেষ তাই মন খারাপ, দুই – ওই ভোরে ঠাণ্ডায় চান করা।

প্রদীপ ভাসানোর জন্যে কলার ভেলা তৈরি করতে হতো। কলার ভেলায় আবার প্রদীপ আর মোমবাতি ওই ভাবেই কুলপাতা, দুর্বা, অনেক ফুল দিয়ে সাজিয়ে আর একবার পুজো করতে হতো। যারা একই পুকুরে ভাসাতো তারা আবার  একজায়গায় জুটে গল্প করতো। কার প্রদীপ কতক্ষণ অব্দি জ্বলে, কারটা আগে আগে নিভে গেলো? যার প্রদীপ যত বেশিক্ষণ জ্বলতো তার চোখ মুখও ঠিক ততক্ষণই থাকতো প্রদীপের শিখার মতো উজ্জ্বল।

তারপর আসতো চানের পালা। যে শীতকে অগ্রাহ্য করে ঝপাং করে জ্বলে পড়ে যেতো পারতো, সে-ই সেরা। সবাই সবসময় চান করতো না। যারা করতো না তারা পরেরদিন সকালের আলোচলার পাত্রী হয়ে উঠতো। তাই নিয়ে একটু আধটু চাপা রাগ, মুখ ব্যাঁকানো থাকতো বটে তবে আহামরি কিছু ঘটতো না। ধীরে ধীরে অনেকেই ঠাণ্ডার জন্যে চান করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।

এখন তো পুরো পুজোই বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আমার বাড়ির কচিকাঁচাদের কাছে জানতে চাইলাম তারা এই পুজো করে কিনা। জানা গেলো তারা করে না, এমনকি নামটাও আগে কখনো শোনেনি। পাড়ার কেউ করে কিনা চানতে চেয়েও “না” উত্তরটাই পেলাম। তারা বললো আমরা তোমার কাছেই নাম শুনছি, আমাদের বাড়িতে বা পাড়ায় এখন কেউ এটা করে না।’

এই মাস জুড়ে আকাশে স্বর্গ বাতি দেবার রীতিও উক্ত অঞ্চলগুলিতে প্রচলিত রয়েছে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকেই স্বর্গে বতি দেওয়া হয়। একটি লম্বা বাঁশ পোঁতা হয় বাড়ির কাছে বা পুকুর পাড়ে। বাঁশের ডগায় রঙ্গীন কাগজ দিয়ে ঘেরা এক পাটাতনের উপরে প্রদীপ জ্বেলে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। বা একটি লণ্ঠন জ্বেলে বাঁশের ডগায় টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। রাত আলো জ্বলে। ধারণা হয় এই আলোয় পথ চিনে মর্তে আসবেন পূর্বপুরুষেরা। আবার কেউ কেউ আলো জ্বেলে ফানুস উড়িয়ে দেয় পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে। এটা পরে চালু হয়েছে। লণ্ঠন টাঙ্গিয়ে দেওয়ার রীতি চালু রয়েছে বহুকাল।

ডি এইচ সাহা তার ফেসবুকে লিখেছেন, পুরো কার্তিক রজনীতেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ আকাশ বাত্তি বা আকাশ প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন। প্রতি সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে একটি দীর্ঘ বাঁশের মাথায় ছোট বাঁশের ফ্রেমে, হরেক রঙিন কাগজে মোড়া বাক্সে প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বেলে তুলে দেওয়া হয়। দূরে থেকে গ্রামের এমন আলো আজও কোথাও কোথাও দেখা যায়। আবার কোথাও তুলসী তলায় একটি লম্বা খুঁটির মাথায় প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয়। দীপাবলীর রাতে এই আকাশ প্রদীপ বা স্বর্গ বাতি জ্বলে পুরো চার প্রহর। মৃত আত্মীয়গণ স্বর্গ থেকে পথ দেখে আসার জন্য তাদের উত্তর পুরুষরা এই আয়োজন করে থাকেন। লোক-বিশ্বাস, এই আলোর পথে পূর্ব পুরুষেরা স্বর্গলোক থেকে নেমে এসে দেখে যাবেন তাঁদের রেখে যাওয়া ভিটেতে তাঁদের বংশধরেরা কেমন আছেন । 

গর্ত খুঁড়ে আলো দান

কুলকুলোতির গানে ভাতৃত্ব বোধ ও স্নেহবতীর সুখ স্বাচ্ছন্দের কামনা রয়েছে। কূলকুলোতি কথার অর্থ কুলের লক্ষী। আদর্শ বোন বা আদর্শ নারীর গুনাবলী অর্জনের লক্ষ্যে এবং ভাইদের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত বা উৎসব। কুলকুলোতি সম্বন্ধে ছাপানো কোন বইতেই আলোচনা বা উল্লেখ নেই। শুধু ফেসবুকে কেউ কেউ এব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। সেই অভিজ্ঞতার নিরীখে এবং ওইসব অঞ্চলের মানুষদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কুলকুলোতি বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে কুলকুলোটি ব্রতর গান বা পাঁচালী গাওয়া হয়ে থাকে। এগুলি উদ্ধৃত করে আলোচনা করা হল।

কুলকুলোতি’ কুলবতী

অরুন ঠাকুর বরণে। 

ফুল ফুটেছে চরণে। 

এ ফুলটি তুলবে যে

সাত ভাইয়ের বোন সে। 

সাত ভাইরে সাঁতুল তুল।

আমার বোনটি পারুল ফুল।

সাত সতীনের সাত কৌটো

আমার বোনের নবকৌটো।

নবকৌটো নড়ে চড়ে

সাত সতীনের মুখটি পুড়ে।  

কার্তিক মাসের রাশে। 

ধূপধুনো ভাসে।

গানটি সর্বত্র যে একই বা এক রকম সুরে গাওয়া হয় তা নয়, গানের কথা অনেক ক্ষেত্রে বদলে যায়, কোথাও বেশ দীর্ঘ হয় এই গান। তবে গানের মূলভাব বা বিষয়বস্তু একই থাকে। এটিকে  ঠিক গান বলা যায় না। এটি অনেকটা পাঁচালী ঢঙের কবিতার মত করে পরিবেশন করা হয়। একসঙ্গে সকলে মিলে উচ্চারণ করার সময় স্বতঃস্ফূর্ত সুর যুক্ত হয়। তবে যেখানে সঙ্গী-সাথী থাকেনা সেখানে একা একাও গাওয়া হয়। বা  আবৃত্তি করা হয়। প্রায় সব জায়গাতেই এই গানের সুর প্রায় একই রকম। ভিন্ন কথার ‘কুলকুলোতি’ গানের কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হল। 

কবিতা ঘোষাল ঘোষ তাঁর ছোট বেলার লোকাচার সম্বন্ধে উল্লেখ করে  লিখেছেন, তাঁরা ছোটবেলায় বাড়িতে  কুলকুলোতি পুজো করতেন। গান গেয়ে নানা লোক উপকরণ দিয়ে পুজো বা ব্রত উদজাপন করা হত।  তাঁরা যে গান গাইতেন সেটি নীচে উল্লেখ করা হল।

কুলকুলোতি কুলোবতী,

সাত ঘরে দিয়ো বাতি ৷

অরুণঠাকুর বরণে,

ফুল ফুটেছে চরণে ৷

এই ফুলটি যে নেবে,

সাত ভাইয়ের বোন হবে৷

কার্তিক মাসে রাসে,

ধূপধূনো ভাসে৷

ফুলমালা আর আলোর মালা,

ছোট্টো ভেলা দোলায় দোলা৷

কুলোবতীর হাতের নাড়া,

ভেলা ভাসে গন্ধে ভরা৷

এই গন্ধ যেদিক যায়,

সাত ভাই পাই সেথায় ৷

এসো আমার সাত ভাই,

তার জন্য ভেলা ভাসাই ৷

সাতটি ঘরে বাতি দিই,

কুলোবতীর পুণ্যি নিই৷

দেহের ঘর শুদ্ধ করি,

তোমায় ঠাকুর গড় করি ৷

গড়বেতার তপন আচার্য লিখেছেন, 19 January · 

‘দেখতে দেখতে কার্তিক থেকে পৌষ তিনটি গ্রাম্য উৎসবের মাস প্রত্যেক বৎসরের মতো অতিক্রান্ত হয়ে গেল। গড়বেতা ও সংলগ্ন গ্রামকেন্দ্রিক উৎসবগুলি আবহমান কাল ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এবং এগুলি গড়বেতার নিজস্ব উৎসব ও সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। যদিও আধুনিকতার স্পর্শে এই তিনমাসের তিনটি মুখ্য উৎসব গৌণ হয়ে গেছে’।

কার্তিক মাসে কুলকুলোতি অঘ্রাণ মাসে ইতু পুজো, পৌষ মাসে টুসু ।

অনামিকা সরকার লিখেছেন, Anamika Sarkar 19 January

‘তিনমাস ধরে এই উৎসবগুলি একসময় প্রাণবন্ত করে রাখতো গড়বেতাকে। কুলকুলোতি টুসু ও ইতুপুজো ছিল একান্তই মেয়েদের। ইতুর কোন গান আমি করতে শুনিনি। টুসুপুজোও ছিল মূলতঃ গ্রাম্যসঙ্গীত নির্ভর। কুলকুলোতি হোত তুলসীতলায় একটি গর্ত খুঁড়ে প্রতি সন্ধ্যায় ফুল,কুলপাতা, তুলসী, দুর্বাঘাস নিয়ে সমবেত ভাবে গান গেয়ে পুজো করা হোত’।

অনামিকা সরকার উদ্ধৃত গানটি এই রকম-

ফুল দেওয়ার মন্ত্রগান ছিল-

কুলকুলোতি কুলোবতি,

সাত ঘরে সাত দিও বাতি;

অরণ ঠাকুর বরণে,

ফুল ফুটবে চরণে;

এই ফুলটি তুলবে যে

সাত ভাইয়ের বোন সে,

কার্তিক মাসের রাসে

কলার ভেলা ভাসে;

ফুল দিলাম, তুলসী দিলাম

স্বর্গে দিলাম বাতি

সব ঠাকুরকে প্রণাম করি

লক্ষ্মী সরস্বতী।

কুলপাতার মন্ত্রগান-

কুলগাছ কুলগাছ ঝাঁকুড়ি,

সতীন বেতীন মাকুড়ি,

সাত সতীনের সাত কৌটা,

আমার একটি নবকৌটা;

নবকৌটা নড়ে চড়ে,

সাত সতীনের মুখটি পোড়ে।

ওরে পাখি ময়না,

সতীন যেন হয়না।

দুর্বা দেওয়ার মন্ত্রগান

দুর্বা দুর্বা নারায়ণ

তুমি দুর্বা ব্রাহ্মণ,

তোমার শিরে ঢালি জল

অন্তকালে পাবো ফল।

তুলসীপাতা দেওয়ার মন্ত্রগান-

তুলসী তুলসী মাধবীলতা,

তুমি তুলসী কৃষ্ণকথা,

কৃষ্ণকথা রইল মনে

জল ঢালি তোমার শ্রীচরণে।

সেখানে পুরো কার্তিকমাস জুড়ে আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হোত। এখনো হয়। গড়বেতার তপন আচার্যর বাড়ির কাছে বা আশপাশের এলাকায়  এই আকাশপ্রদীপ জ্বালাতেন ‘কুমোর পাড়ায় সুভাস দাস ও আলোক দাসের বাবা কাকারা। একমাস ধরে কুলকুলোতি পার্বণ পালন করার পর কলার ভেলায় একটি প্রদীপ জ্বেলে কুলকুলোতি ঠাকুরকে কোন পুকুরে বা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হোত। তারপর দিন থেকে শুরু হোত ইতুপূজা’।

আকাশ প্রদীপ কার উদ্দেশ্যে দেওয়া হত বা হয়ে থাকে তা নিয়ে মতান্তর আছে। বেশিরভাগ মানুষ পূর্বপুরুষের পথ চেনাতে আলো দেখানোর জন্য আকাশে আলো তুলে ধরেন। আবার কেউ কেউ দেবতাদের উদ্দেশ্যে আলো দেন। তাদের ধারণা দেবতারা সুখ সম্পদ শষ্য দান করে এই সময় আলো দেখালে। অনেকে আবার দুটোকেই বিশ্বাস করেন। একজন বিভিন্ন গ্রন্থের আলোচনা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘কার উদ্দেশে এই প্রদীপ জ্বালানো হয় বলা খুব মুশকিল। সুবলচন্দ্র মিত্রের সরল বাঙ্গালা অভিধান অনুয়ায়ী আকাশদীপ বা আকাশপ্রদীপ শব্দের অর্থ হল লক্ষ্মী-নারায়ণের উদ্দেশে কার্তিক মাসে উঁচু বাঁশ প্রভৃতির উপর শূন্যদেশে যে প্রদীপ দেওয়া হয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস সঙ্কলিত ও সম্পাদিত বাঙ্গালা ভাষার অভিধান অনুযায়ী হিন্দুগৃহে দেবোদ্দেশে আকাশে যে দীপ দেওয়া হয়; বাঁশ পুঁতিয়া তার আগায় এই দীপ বাঁধিয়া দেওয়া হয় এবং কার্তিকমাস-ভোর প্রতি সন্ধ্যায় ঐ দীপ জ্বালা হয়। রাজশেখর বসু সংকলিত চলন্তিকা আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান অনুযায়ী, কার্তিক মাসে উঁচু বাঁশ ইত্যাদির উপরে যে প্রদীপ দেওয়া হয়। প্রথমে নির্দিষ্ট ভাবে লক্ষ্মীনারায়ণের নাম করা হলেও পরে সার্বিক ভাবে দেবতার কথা বলা হল এবং শেষে কার উদ্দেশে এই প্রদীপ তার উল্লেখ নেই।’

বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় গ্রন্থে কার্তিক মাসে দীপ জ্বালানোর কথা বলা হয়েছে। কার্তিক মাসে দীপ জ্বালালে স্বয়ং বিষ্ণু প্রীত হন। তিনি তার সব পাপ দূর করেন। এই রকম আরো নানা ক্তহা বলা হয়েছে। যেমন শ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থের ১৬শ বিলাস অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কার্তিক মাসে দেবালয়ে ভক্তিভাবে দীপদান, অখন্ড দীপাবলীর আয়োজন, বাড়িতে বাড়িতে দীপমালা সজ্জা ও আকাশ প্রদীপ দান করলে ভগবান শ্রীহরি প্রীতিলাভ করেন। ‘স্কন্দ পুরাণে’ বলা হয়েছে যে যদি কেউ ঘিয়ের প্রদীপ বা তিল তৈলের প্রদীপ বিষ্ণু মন্দিরে কার্তিক মাসে প্রজ্জ্বলিত করেন তাহলে সে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ করেন। কারও বংশে কোন সন্তান যদি কার্তিক মাসে বিষ্ণু মন্দিরে দীপদান করার মাধ্যমে শ্রীবিষ্ণুর প্রীতিসাধনে উদ্যোগী হয়, তাহলে বংশের সকলেই মুক্তি লাভের অধিকারী হয়। এমনকি কারও যদি মন্দার পর্বতের মতো বিপুল পরিমাণ পাপও সঞ্চিত থাকে, কার্তিক মাসে ভক্তিসহকারে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের মন্দিরে দীপদান করলে নিঃসন্দেহে তাঁর সমস্ত পাপ বিনষ্ট নয়।   

সোমা দত্ত লিখেছেন, ‘আমার ছেলের হাতে বানানো #প্রদীপ…..এগুলো ঠিক দীপাবলীর প্রদীপ নয়…কারন ওগুলো হয় ,বেশ বড় আকারের এবং লম্বাটে…কিন্তু এগুলো গোল গোল আকৃতির এবং আকারে বেশ ছোট হয়….এগুলির নাম #কুলোবাতি….’

‘আমরা ছোটবেলায় জাঠতুতো ,খুড়তুতো সব বোনেরা মিলে কুলকুলোতি পূজা করতাম….পুকুর পাড়ের কুল গাছের গোড়া থেকে মাটি কেটে এনে …সেই মাটি দিয়ে গোল গোল পাকিয়ে এইরকম প্রদীপ বানাতাম…ছাদে রোদ্দুরে শুকিয়ে নিয়ে মনের মতন রঙ করতাম…পুরো কার্ত্তিক মাস ধরে প্রতি সন্ধ্যা বেলা তিনটি করে এই প্রদীপ, কুলপাতা এবং কুল সহযোগে কুলদেবীর আরাধনা করতাম এবং তিন কুলের(পিতৃকুল,মাতুলকুল ও শ্বশুর কুল) অমরত্ব প্রার্থনা করতাম …তখন অতটা বুঝতাম না…কেন কি কারনে এই পূজা …তবে সব বোনেরা মিলে তুলসীমঞ্চের সামনে যখন শাঁখ আর উলুধ্বনী দিয়ে পূজা করতাম …সারাবাড়ি গমগম করত….

মেয়ে তো নেই…. তাই ছেলেকেই প্রদীপ বানানো শেখালাম…ব্রত টা না করুক…ঐতিহ্যটা মনে রাখুক’.১০

কুলকুলোতির উপকরণ

কুলকুলোতি সম্বন্ধে হুগলী জেলার বিদগ্ধ মানুষ সুফল চন্দ্র বাগ১১ জানিয়েছেন, কুলকুলোতি আর ‘যমপুকুর ব্রত’ কিছুটা সমার্থক। কোনো অঞ্চলে একই ব্রতকে কুলকুলতি ব্রত বলা হয় আবার কোথাও একই ব্রতকে বলে যমপুকুর ব্রত। আসলে এই ব্রতর উদ্দেশ্য যমকে সন্তুষ্ট রাখা। যাতে সে পরিবারের কারো উপরে রুষ্ট না হয়। যমপুকুর ব্রতর নিয়ম কুলকুলোতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। যমপুকুর ব্রত পালন করা হয় পুকুর পাড়ে। আর কুলকুলোতি তুলসি তলায় ও পুকুরে ভেলা ভাসিয়ে।

স্বর্গ বাতি বা আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর রীতি সম্পর্কে কল্যান চক্রবর্তী লিখেছেন, আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর শেষ দিন: পূর্বপুরুষ কিংবা লক্ষ্মীনারায়ণের উদ্দেশ্যে তিলতেল বা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয় স্তম্ভের মাথায়, বাড়ির ছাদ বা টালির চালে কিংবা তুলসী তলায়। আজকাল মোমবাতি বা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর রেওয়াজ হয়েছে। কার্তিক সংক্রান্তিতেই আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর সমাপ্তি।১২

আকাশ প্রদীপ সম্পর্কে অনেক কথা আছে অনেক জায়গায়। পূর্ব পুরুষতো বটেই, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও জীবন ও মরনের এক সেতু বন্ধন। যেন মৃত্যুর পরেই সব শেষ নয় এই কথা আকাশ প্রমান সত্য। এটা প্রমান হয় আকাশ প্রদীপে। এ সম্পর্কে  প্রতিদিন পত্রিকায় অনির্বাণ চৌধুরী লিখেছেন, এই প্রদীপ আসলে দেহেরই প্রতীক। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম- এই পঞ্চভূতে যেমন তৈরি হয় এই নশ্বর শরীর, মাটির প্রদীপটিও তাই! ক্ষিতি বা মাটি তার কায়া তৈরি করে। অপ বা জলে তা আকার পায়। তেজ বা আগুন আত্মার মতোই স্থিত হয় তার অন্তরে। মরুৎ বা হাওয়া সেই আগুনকে জ্বলতে সাহায্য করে। আর ব্যোম বা অনন্ত শূন্য জেগে থাকে তার গর্ভে।
পিতা আরও বলতেন, কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ দেওয়া শুধুই বিষ্ণুর আশীর্বাদ যাচনা নয়। তাঁকে তো স্মরণ করতেই হবে। এই পৃথিবীকে পালন করেন তিনি, মৃত্যুর পরেও মানুষের উপরে রয়েছে তাঁরই অধিকার। তাই আকাশপ্রদীপ দেওয়ার সময় উচ্চারণ করা হয় মন্ত্র- ‘’আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।‘’ আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করছেন যে বিষ্ণু, তাঁর উদ্দেশে দেওয়া হল এই প্রদীপ। এ বাদেও আকাশপ্রদীপ শীতঋতুতে মানুষের অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাস। যা অনেক পরে রূপান্তরিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের অগ্নিহোত্র রক্ষার আচারে।১৩

প্রানের বাংলা ডট কমও একথাই লিখেছে। এখানে শীলা চৌধুরী লিখেছেন, ‘আকাশপ্রদীপ ওই বিদেহী আত্মাদের আলোর কাঠি ,তার আলোতেই ওই আত্মারা স্বর্গে ফেরেন। তাই কার্তিক মাস এলেই দেখতাম বরেন্দ্র জেঠু, কেশব দাদা , মাখন দাদা নন্দ পিসিদের বাড়ির বাঁশ ঝাড় থেকে সবচেয়ে লম্বা বাঁশ কেটে খুব ভালো করে পরিস্কার করে সেই বাঁশের উপরের দিকে একটা ঢোলের মতো ফ্রেম কাপড় দিয়ে বানাতো। সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গেই মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই ঢোলাকৃতির ফ্রেমের ভেতর বসিয়ে সূতো দিয়ে টেনে টেনে সেটাকে বাঁশের উপরে বেঁধে রাখতেন । আমাদের বাড়িতে আলাদা প্রতি বংশের ঘরেই এই আকাশ প্রদীপ পূর্ব পুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে পুরো কার্তিক মাস জুড়েই জ্বালানো হয়’।১৩  

কুলকুলোতি সম্বন্ধে বর্তমান বৈজ্ঞানিক ধারণা অন্য রকম। সেখানে বলা হয় কার্তিক মাসে আমন ধানের শিষে চাল জন্মানো শুরু হয় বা ধানে দুধের মতো তরল জন্মে। এটা খুবই সুস্বাদু। তাই প্রচুর পোকা জন্মে ধান ক্ষেতে। একরকম সবুজ রঙের ছোট্টো ছোট্টো পোকার নাম শ্যামা পোকা। এরা সব ধানের রস শুষে নেয়। ফসল নষ্ট করে। এই কীট পতঙ্গদের দমন করার উদ্দেশ্যেই আলো দান। আলোর দিকে তারা ধাবিত হয়। আগুনে পুড়ে মরে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিটি আলোর পাশে হাজার লক্ষ পতঙ্গ ভীড় করে থাকে ও পুড়ে মারা যায়। প্রতি বাড়িতে বা পুকুরে এরকম হয়।  যখন ভেলায় আলো জ্বলে, পতঙ্গকূল আগুনের দিকে ছুটে আসে আর জলে পড়ে। মাছেরা তাদের খেয়ে ফেলে।

‘কার্তিক অমাবস্যায় যেখানে উত্তর ভারতে লক্ষ্মীর পূজা চলছে, পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জাঁকজমকে ঘটা করে পালন করা হয় কালীপূজা। অবশ্য সেদিন আদি পশ্চিমবঙ্গ বাসিন্দারা, ঘটিরা, বাড়িতে লক্ষ্মীর পূজাও করে থাকেন। তবে আদি বাংলাদেশি হিন্দুদের, বাঙালদের, এই নিয়ম নেই; তা অনেকে বাড়িতেও কালী পুজো করেন, যদিও এই পুজোর বারোয়ারি ভাবে পালন হওয়ার প্রচলন বেশি। কদাচিৎ কালীপুজোর দিন আর দেওয়ালির দিন পৃথকও হতে পারে; দেওয়ালির তারিখটা একদিন পরে কিংবা আগেও পড়া সম্ভব। কেননা কালীপূজার লগ্ন অমাবস্যার মাঝরাত্রিতে ঠিক হয়, আবার দীপাবলির লক্ষ্মী পূজার লগ্ন নিশ্চিত করা হয় অমাবস্যার সন্ধ্যেতে, তাই পুজোর লগ্ন অনুযায়ী দুই পুজোর তারিখে মাঝে মাঝে অন্তর ঘটে থাকে। দেওয়ালির দিনে প্রদীপের আলোয় বাড়ি-বাড়ি ঝকমক করে ওঠে। নানান রঙের বাজিতে আকাশটাও রীতিমত চকচক করে থাকে। দীপাবলি সারি-সারি প্রদীপের আলোকে স্বর্গের দেবতাকে মর্তের কুটিরে বরণ করে নেবার উৎসব’।[১৪]

কালীপূজোর দিনে সন্ধ্যায় এইসব অঞ্চলে ‘ম্যড়াগাছ’ পোড়ানো হয়। আলোর রোসনাইও পোড়ে। সেও আলো-আগুনের উৎসব। প্রতি বাড়িতে একটি বড়ো লম্বা কাঁচা বাঁশের প্রতিটি গাঁটে দুটি করে তাল গাছের শুকনো পাতা বেঁধে বাঁশটিকে দশ বারোজন মিলে একটি গর্তের উপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। এটিকেই ‘ম্যাড়া গাছ’ বলে।  সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে মিলে একসঙ্গে ওই বাঁশের তালপাতা যুক্ত মহীরুহের সামনে জড়ো হয়। লম্বা পাট কাঠির গুচ্ছ সবাই হাতে নেয়, সকলেই সেগুলিতে আগে আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে ওই দণ্ডায়মান শুকনো তালপাতার ‘ম্যাড়াগাছ’টিতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ‘ম্যাড়াগাছ’। আর সবাই মিলে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘ইঁজোলারে পিঁজোলা’। এই কথাটির হয়তো কোন বিশেষ অর্থ থাকবে, কিন্তু আমার তা জানা নেই। অজস্র পোকা- মাকড় ধানের ক্ষেত থেকে ছুটে আসে ‘ম্যাড়াগাছের’ দিকে। পুড়ে মরে।

কালী পুজোর উৎসবে ঘরে ঘরে দরজা-জানালায়, উঠোনে, তুলসি তলায়, দেব দেবীর বিগ্রহের সামনে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘক্ষন ধরে আলো জ্বলে। পতঙ্গকূল পোড়ে। দীপালিকার মাহাত্ম এখানেই।  

তথ্যসূত্র

১।https://www.facebook.com/permalink.php?id=171692543018713&story_fbid=317711441750155

২। https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH

৩।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH.

৪।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH/BOX ৫।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH/BOX

৬।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH/BOX

৭।।https://www.dailyo.in/bangla/arts/why-fourteen-spinach-bhootchaturdashi-why-aakash-pradip-diya-diwali-deepabali-kalipuja/story/1/27631.html

৮। https://www.facebook.com/sagar.bhowmick.58/posts/2469502046625787

৯।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH ১০।https://www.facebook.com/search/top/?q=কুলকুলোতি&epa=SEARCH

১১। সুফল চন্দ্র বাগ হুগলী জেলার কালীপুর অঞ্চলের একজন বিখ্যাত লোক শিল্পী। গ্রামীন শিল্প ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর চেতনা গভীর। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী ও যাত্রা শিল্পী হিসাবে তিনি অধিক পরিচিত।

১২।কল্যানচক্রবর্তী-https://m.dailyhunt.in/news/india/bangla/presscard+news-epaper-pressc/kartik+sankrantir+katha-newsid-86546582

১৩। https://pranerbangla.com/আকাশ-প্রদীপ/#.XbsIwDAzbIU  

১৪।https://bn.wikipedia.org/wiki/দিপাবলী

Identity of Santhal within their Music and Dance form

Dr.  Saswati Sinha Babu. Assistant Professor, Saldiha College, Bankura, West Bengal

1

Santali language is the second highest speaking language in West Bengal. In India one of the six persons is Santal. But here my objective is not to discuss the Santali language. I think it is too important to locate the cultural origin and the life style of the Santal community. The Santali folk song is an important cultural theme of their community. It has saved with its own vitality from the unsafe cultural disturbs. These modest folk songs are the most valuable art of this community. They have not mislaid their culture though they are poor, suppressed and suffering from many aspects in the society. They understand that their culture is their identity and this identity will help them to take breath to live together. It should be noted that the Santal tribe community was never associate with the greater Hindu culture though they are living with Hindus. 

Their music origin is with full of sorrow. It is indispensable to dissertation the collective effort and general identity and cultural characters in their Song and Dance form. We observe the fearlessness in the Santali male dance within a queue. In the female dance forms we found the rhythm of irony life. Especially their dance shift us towards the openness of nature and out of the law and to the primitive feelings of history. The dance and songs of primitives originated from the nature and these are bearing the symbol of their inheritances.

Generally Santal folk songs are derived into three classes. These are religious, collective and affectionate. The appeal of the affectionate songs is most important. Their span is short but it is bearing the feelings of the decades. Usually the simple and uncritical tribes cannot hide their emotions long time and they couldn’t disclose their sentiment massively.

Art and culture is the pillar of a nation and a community. Dance form of every tribal community is very much associated to their melodies. Santals dance form is too simple as their melodies. The Santali language is also a rich language. The Missionaries in the nineteenth century observed their developed folk song, rhyme, proverbs, etc. and they being charmed. Today we are observing their culture with a great exclamatory and collecting resources for our cultural breathing. If anyone wants to get a touch of infant past of India then he or she have to go to the tribal society.

I live in a Santal based jungle area. Every day I observe their culture and their simple life. They are fearless but uncritical, they are laborious, live together and have community feelings. I would like to find the cultural history and it’s reality with their lives. I want to show that the dance and music is not only the cultural aspect, it is also bears the identification of a that community.

Nritya Yoga – An Amalgamation of Dance and Yoga

Rahul Dev Mondal Assistant Professor , Rabindra Bharati University

          1

Bharatnatyam and yoga are the two ways that help us understand the manifestation of the Divine in the human form. Both of these wonderful art forms are product of the Santana Dharma. Which is the bedrock of Indian culture. The Natya Shastra of Bharatamuni lays emphasis on not merely the physical aspects of Bharatnatyam, but also on the spiritual and esoteric nature of this art . Both these arts are also evolutionary sciences for the overall development of the human being, from the conscious to the state of the  super conscious and finally the Divine.

Bharatnatyam is a Yoga, If Yoga means Union. For surely this ancient art is one of the most beautiful and satisfying ways of expressing the human longing for union with the Divine. As an art form. Bharatnatyam demands conscious understanding of the body, mind and emotions. The sincere dancer must understand the nature of Bhakti and Gyana and the innate longing in all living creatures for samadhi or cosmic consciousness. The Divine dance of Energy in the universe, so graphically and beautifully represented by the Lord Nataraja – The Lord of Dance is the source of inspiration for the Bharatnatyam artists who can understand the deeper aspects of their art. Especially for the youth this divine art is a boon, for it prepares the body for graceful, controlled yet beautiful movements the mind into alertness and sensitivity and the emotions into purified receptors for the deepest inner longings of the human kind. Lord Shiva himself blesses those people, who take to this art, offering their profound interest, their immense devotion and their discipline as Dakshina such true Sudhaks then find that Satyam,Shivam and Sundaram – Truth, Goodness and beauty flourishing in their lives, boons granted glady by the Lord to this ardent devotees, and life turning into a beautiful journey towards enternity.

In modern time, both these elevating spritual arts have been the victim of degeneration to such an extent that Bharatnatyam is only treated as a decorative performing art and Yoga as a ‘keep fit’ exercise thus negating the very soul of these arts. The depths of the spritual concepts of this forms have been by and far lost and are being practised only at a very superficial and mundane level. However, there exists a ray of hope at all the end of this dark tunnel because slowly and steadily many of the pracitioners of these arts are awakeing their real inner meaning; many of them are taking concrete steps to bring back the real meaning into the practice of these arts, Which are actually complete ‘lifestyles’ in their true spirits.

BENEFITS OF YOGA FOR DANCERS

According to the Abhinaya Darpana of Nandikeswara, the important  inner Qualities of the dancer (Antah Prana) are as follows :

“ JAVAHA  STHIRATVAM  REKHA

BRAHMARI DRISHTI  AASHRAMAHA

MEDHA SHRADDHA VACHO GEETAM”

JAVAH – Swiftness or speed.

STHIRATVAM –   steadiness.

REKHA – Line and Symmetry.

BRAHMARI – Versatility in circular movements.

DRISHTI – Glances of the eyes.

AASHRAMAHA – Ease and tirelessness.

MEDHA – Intelligence.

SHRADDHA – Confidence and interest.

VACHO – Clear speech.

GEETAM – Capacity of song.

All of these inner qualities can be developed and maintained through the practice of Yoga and in addition to the above mentioned aspects of the personality, it is important for the dancer to have numerous physical and mental abilities that can be obtained through a dedicated practice of Yoga as a way of life.

          STRENGTH, BALANCE AND CONCENTRATION :

These physical qualities are essential for the dancer at all stages of their artistic career. The standing poses such as Pudahastasana, Padangushtasana, Trikonasana, Natarojasana, Virasana and its variations, are especially useful to develop strength in the legs and thighs . One legged poses such as the Natarajansana=,Ekapadasana And Ardha Chandrasana help to develop and excellent sense of balance as well as improved single minded concentration.

The hand balancing poses such as Mayurasana, Matsasana, Veishikasana and Hamsasana help to develop strength in the shoulder, arms and wrists that is essential for holding the arms and up in numerous Nritta sequences such as in the Alarippu, Varnam and Tillana.

                   CARRIAGE AND CENTRE

Yogasana helps develop proper carriage. Back bending postures such as Ushtrasana,Bhujangasana, and Chakrasana avoids the hunchbacks that are common in modern school going children from carrying heavy loads of books. Repeated practice of balancing poses and right and left and sides as well as from different position such as supine. Prone and the tipsy curvy

poses, the centre of gravity is improved and this leads to a perfect positioning of the body in performance for the various items .

Flexibility :

One of the important physical attributes required by a dancer is flexibility of the body. Jattis and other practices of the Shetali Karana Vyayama.spinal Twists such as Ardha Matsyandrasana and Vakrasana back banding asanas like Rajakapotasana, Chakrasana and Dhanurasana Podahastasana, Paschimottasana and Halasana ENSURE FLEXIBILITY OF THE BODY.The body can then be a supple and well- tuned instrument that allows it to perform any movement that it wishes effortlessly and gracefully while dancing. This effortlessness is essential a dancer because, When he makes any movement with strain , not only does she suffer by the sensitive rasikas or dance lovers but are also jarred out of the smooth bhramri that had been earlier effected in them by easy and flowing movements.

Co-ordination :

Practice of Suryanamaskara alter nate nostril breathing Pranayamas such as Nadi Shuddhi and Loma Viloma as well as various jattis help to develop

Right-left co-ordination and balance in the dancer.Asanas wherein the hands are joinedto the feet like Padahasthasana, paschimottasana and Akarna Dhanurasana are very useful to develophand foot as well as right left co-ordination, very essential for a smooth performance.

          Yoga is isometric and internal .It is a contest between our inherent inertia and the power of the will. Paris of the body are pitted againt one another and a unique harmony of body, mind and breath is perceived.

This internal struggle when handled successfully deepens the consciousness of not only the working of the body but also of the mind and emotions.

Right – left brain function is improved by Pranayamas as right nostril breathing stimulates the left brain and vice versa. This helps to improve co-ordination between the two halves of the body and thus produce and artistic and perfect symmetry essential for a good dancer.

          Physiological Function  :

Yoga helps to develop all systems of the human body (cardiovascular, respiratory, digestive, eliminative, endocrine, nervous and musculoskeletal) thus strengthening, cleansing and purifying the human body so that it is brought under our conscious will. This is vital for the dancers.

Yoga stimulates and strengthens the neuro – endocrine system and it counter acts the body stiffness, changes in skin tone and hair loss, which are common problems due to glandular imbalance. Youthfulness that is essential for a dancer is the byproduct of neuro-endocrine health and this can be attained by a regular Yoga practice.

All sound health is developed which will stand the dancer in good stead even after retirement, saving them the “post retirement blues and breakdowns”.

Energy :

In the science of Yoga body movement and breath must be synchronized .The body is lifted on the incoming breath and lowered on the outgoing breath, Bhastrika of the “bellows breath” activate the solar plexus, which is an energy reservoir, as well as strengthens the diaphragm thus producing strength, vitality and endurance. Pranyamas such as Mukha Bhastrika stimulate the internal cleansing of toxins. Breath is directly related to energy levels, life span, and quality of emotions, state of mind and the clarity and subtlety of thoughts. This use of breath power with the body movements brings about revolutionary effects on the performance of the dancer. Laya Yoga practices such as the Mantralaya as well as pranayamas like the Kapalabhati , Surya Pranayama and Surya Bhedama and other practices such as Suryanamaskaram, Paschinottasanas, Nauli and Agnisara help to create an energy reservoir tht can be tapped into at will.

Strees and Relaxation :

Yoga has lot to offer in terms of stress reduction. Dancers face a lot of stress in terms of preparation for performances and high expectations from the teachers, friends, relatives and the general audience. Critics and other writers also tend to increase the pressures on the dancer.Yogic Asanas, Pranayamas and Jnana yoga Kriyas, work on the various koshas of our body and clear up all the subconscious “quirks” in our brain from the billions of years of evolutioin from animal to the human state. An understanding of these “quirks” helps us to understand our reaction to various situations and helps us to prevent our “stress response” to them. ‘Stress Relievers’ from Hatha Yoga and Jnana Yoga are of immense benefit in relieving pent up emotions and tempering our reactions to stressful situations.

Yoga has a lot to offer to dancers through the field of relaxation. In the dance world , all is PUSH, PUSH, and PUSH. There is little room for relaxation in the arena. Yoga teaches us that there has to be a balance in everything.

The Yogic concept of “Spandha-Nishpandha” or “exertion-relaxation-exertion-relaxation in an alternating rhythm and unique to the yogic art of relaxation and provides a counterfoil to the extreme stress of comp[etitive and performance related pressures, thus fostering  mental , emotional and physical health.

Pranayams such as Brahmari, Pranava, Shetali and Sitkari are excellent stress relievers . Shavasana with a great variety of relaxation practices as well as the Bhajangini Mudras and Pavana Mukta Kriyas are an excellent foil against stress. Yoga Nidra and the performance of Savitri Pranayama in Shavasana can help to produce total relaxationat all levels.

A true yogi is neither an introvert, not an extrovert. He or she is an ambient, a person who is equally at home irrespective of whether he is introspecting within himself or whether he is interacting vibrantly with the external environment. Therefore to make sure that the natural introversion of Yoga is balanced with healthy extroversion, some from of extroverted activity such as sports, music or art and craft skill need to be deliberately cultivated.

Dance provides a dynamic activity to offset the static activity of Yoga and many modern yoga practitioners can benefit from such as associations. Dance also pro0vides a great source for emotional catharsis and this can help the yoga sadhaka to get over many of the emotional hung ups that continue to bother them in his or her sadhana.

The Traditional Identity of The Folk Music of Chhattisgarh

Dr. Asish Chakraborty

Introduction

Nature is an indispensable part of human race and society, as has given birth to it and nourishes every moment through untiring supply of all needs. Unlike the other lively creatures of earth the livelihood of human beings has totally been depending on it according to the physical and mental requisite, since its first trace of existence. As to emphasize on human culture the nature’s invincible contribution, is to be focused in a precise manner. The culture of human society is directly involved and inspired by nature, on contrary they both are inseparable. In fact all the cultures existing on the earth has been derived from nature and through a continue practice for eras it has rendered a core effect to form a heritage for human society, is consequently called as folk culture. One of these culture, the folk music culture of Chhattisgarh, as per the topic, we are going to explore about. It is regarded as a backward state, mainly dominated by tribal population. The state is rich in culture field with flora and fauna and the people are the friends of jungle, counted as an indispensable part of their life. Geographically it is situated at the heart of India. The state is endowed with the rich cultural heritage and traditions. The land is completely surrounded by hilly areas and planes, adorned with its natural beauty including dense forest, mesmerizing waterfalls, land scape, and assorted wildlife.

Chhattisgarh District Map

 

Basic Folk Music Culture of Chhattisgarh

Chhattisgarh, has a rich folk culture and being maintained by the inhabitants as their traditions, very caressingly, as an entity of their heritage. Music of Chhattisgarh is deeply related with relevant Dance form in maximum cases, because the traditional ceremonial performances is meant to offering and enjoying the entire repertoire, to the inhabitants and they give their fullest while doing. In order to do that through the music by all means, Dance cannot be taken apart because body movement adds an extra feather to the emotional urge of the purpose. Therefore, while describing the Music forms underneath, we may also touch and explore the relevant dance forms as well, excluding of which the full profile of them cannot be accomplished. But before exploring the concerned changes we need to be clear about the Idea of Lok Geet or Folk Song  and Local Song. Local song is written in local language but that is not Lok Geet or Folk song. The famous Chhattisgarhi Folklore specialist and researcher Mr. Niranjan Mahavar has explained beautifully about this idea.  According to him the local song is Lok Bhasha Geet or the song composed in local language merely, thus cannot be embraced as a folk song. A folk song must have had its tradition and heritage. The Karma, Dadaria, Sua, Mata Seva Geet, Phag Geet, Jas Geet, Sohar Geet etc all are in this Folk song Category because all of them have got a deep heritage.

          In Folk songs the feeling and emotion of the common people is the key thing that exists. That is why the main emotion of it, acts like a person in the songs and be always free from the constraints of the theories and typical norms of the basics of music. Normally there is no scripture where from they are followed precisely but rather the emotion speaks always. Mr. Niranjan Mahawar said very clearly  that we can hardly find the lyricist and composer of Folk music but due to the practice singing from a long time span it is set to our mind and voice and thus continues its journey onwards.

Classification of Chhattisgarhi Folk Song:-  The folk songs of Chhattisgarh area could be divided into four categories.

Some of these songs along with adequate details has been given below:

 

Sohar Geet

At the eve of a child birth Sohar Geet gets performed by the local women to wish the child and the mother for a long and healthy life. The comprising of this kind of songs are mainly about the labor pain of the mother, conversation between Nanad and Sister in law, the birth of Lord Rama and Krishna etc. take place. Although in this segment yhere are several kinds of songs for the different stages of conceiving and delivery. After the successful completion of fifth month of pregnancy the relatives of in laws starts celebrating. Even when the labor pain rises up and being intolerable for the mother, depicting all these, there are some particular songs as well. Here is an example of Sohar Geet given below.

Song: –                  “Sate sakhi aagu chale, sate sakhi chale, sate          sakhi ho lalana

                             Beech me dashada maharani chale ho Yamuna                                                        paani ho

Vivah Geet

Vivah means marriage. According to Chhattisgarhi rituals in marriage there are several kind of segments or slots of this ritual i.e. collecting soil from local pond to make a local oven at home called ‘ Mangni, Chulamati, then Tel chadhi ( Oil and Turmeric coating to bride groom) , Inviting the deities,  Maap Moudi (Roti ritual),Nahdholi ( Bathing ritual), Pardhani (welcoming the Groom Party), Hardahi game, Madbani, Samdhi, Samdhin, Dulha, Dulhan, Bhaoji, Kanyadan, and at last Vidai Geet ( departing of bride from her home). For each and every segment there are special songs. One example of TelChadhi Geet is given below.

                             “ Ek tel Chadhge Ho hariyar hariyar

                             Mandva ma dhularu to badan kumhalay

                             Ram Lakhan ke ho Ram Lakhan ke

                             Tel o chadhat hai Kanhaba ke diyana hove                                                             anjor”-

Mrityu Geet

Kabir Panth and Satnaami Panth both have made their deep impact on the state along with the Mahanadi Basin area. The Kabir Panth of Sage Dharamdas and Satnami Panth of Guru Ghasidas both are the believers of ‘Niguna Man’. The Mrityu Song or the song of demise these both have explained in the same way and rather emphatically.Both of them said the sole is immortal and unleashed. One of the songs has given as an instance.

Humko uda do chadariya kale ke bera hai

Sangi saathi jarkar aaye aaye

Angna me khade bartiya

Charjane mil bohkar le gaye

 

Bhojli Geet

Bhojli ceremony gets celebrated in the entire time span, from Nag Panchmi to Raksha Bandhan. With the touch of rainy season, after intolerable summer, the nature herself turned up with its utmost productivity. New corps, new life, new enthusiasm erupts with endless delight. This time the farmers sow the seeds to grow crops and for that they celebrate this ceremony through some rituals and expect the good crops as a boon from Bhojli mother.First they welcome mother Ganges through the song given below:

Aho Devi Ganga,

Devi Ganga, Devi Ganga, lahar turanga

Hamar Bhojli Dai ke Bhije Aatho Anga.

[ Hail Goddess Ganges your waves are drenching eight limbs of our Bhojli Maa].   Apart from this, for welcoming Rainy season the local women sing the songs

Maata Seva Geet

This kind of song is specially sung for being cured or staying safe from the pox, one of the most contagious diseases. There is a strong believe exists among the local rural people that if they please Shitala Maata, the deity of this disease by their offerings, as a boon she could bless them of staying safe from it. One part of this type song as an example is given below:

Sharda Maay saraswati Bhabanila

Bando karajod ho may

Bhule akshar devi kah samjhabe

Kanthe baithmukh bol ho may.

Suva Geet

Suva is basically a dance style performed by women only. Mails are not allowed to take part. Suva dance is accompanied by Suva geet. In this ceremony a replica of a parrot is kept, symbolizing the emotion of soul, abiding that they share their pain with that. They make a nest of Suva in a basket and keep the replica there, surrounding that they dance and sing. While dancing they clap and act like parrot. Suva geet is composed in very simple but rich literature. One example is given below:

Saas mor moray nanad gaari devay

He suvana! Ke raja mor gaye hai videsh

Lahura devar more janam ke bayri

Re suvana! Le jabe tiriya sandes

Goura Geet

Goura is the Goddess of Gond tribe, largest in number amongst all tribes. This goddess is being worshipped from Navratra till Dussehra. They sing Bhajan along with doing the worship. Apart from Gond, some other tribes are doing this aas well. One song given below as an instance.

Ek patri raini jhaini ray rattan durga devi

Tor shital chhav may jaago gouri jaago gouri

Jaaago sahar ke log

Jhain jhain jhule jhare, sejri bichhay

 

Phaag Geet

Phaag is the name of Holi which is equallyimportant like Deepavali to the people of India. It mainly celebrates the timing of harvesting Rabi crops. This happens in spring season. All the way the nature is fully garnished and adorned with all beauty of it. People celebrate with different type of colors and at night they sing Phaag geet along with nagada.

Baaje nagada dasao jaoriha radha kishan khelay holi

Duno haat dharei pichkari dharei pichkari

Rang gulal sabei bori, haan radha kishan khelay hori

Before start the actual song the singers sing for the deities for offering their devotion

Chala haan re pahile, sumiro Ganapati ko na

Jinki Parvati hai may, re pahile sumeero

Chalaa haan re Gajanan sab devan me aguva hai

So pujo dhyan lagaye.

In Phaag Geet love and Holi playing between Radha Krishna and Lord Rama and Sita make the matter.

Hori khelay birij ma Kanhaiyan

Hori khelay birij ma

Kakar haat ma rang katora

Kakar haat pichkari!

Radha ke haat ma Rang katora

Krishna ke haat ma pichkari…….

 

Raut Dance Song

Raut is an exclusive cast of Chhattisgarh, one of the most important amongst all the casts dwell in the state. Basically they are Pashu Palaks although they think themselves as the successors of Yadav family. Govardhan Puja in Diwali is their main ritual.They start their dancing ceremony in ‘Kartik Ekadasi’. On the second day they place a pole (Maatri Stambh) by digging soil and worship that. Nextly they gift some garland of peacock feather to the cattle of their clients and dance at those concerned houses.

Dhan godani bhuina pawa, pawa humar asis

Nati put lai ghar jaabe, jiba lakh bais.

Some other copulates are as follow:

Bhanta dekheb dumdumia, ulhere dekheb gay ho,

Aadhe dekhab kaari kamaria, aaohi nanad ke bhay ho.

Nadi teer ma chandan rukhba, je tar maadhe duihan ho,

Dara dara ma pandra Bachura, palha bagar gay gay ho.

Karma

Karma is a main Dance form of Gond tribes. Gond is the main tribal community of entire Chhattisgarh region and second largest in Central India. Apart from Gond of this area, Raigar’s Uraon, Mandla’s Baigas, Bilaspur’s and Sargujas Korba and Baghelkhand’s Gond and Baigas perform this dance. Basically from Satpura Range to Mekal and Pathar of Bastar, all Gond tribes are mainly doing this dance form but other tribes also embraced this form to their practice and perform accordingly in concerned festivals. Factually, Music is unlike the stream of water or blow of fresh breeze that renders the effect indiscriminately to all people around. Thus, although Karma is an entity of Gond tribe, whether could be any of the Gonds from other places as well, all the villagers of the state embraced it to their culture.

There is a legend, popular in Northern India, of Dharma and Karma. There are two causes behind the progression of human race- 1. Dharma, which runson the track of norms and ideology and the another one is 2. Karma, which booms us to endeavor in all perspectives. Without these nothing is possible to do in life. The tribal people entirely follow the senses of these two motivating factorsin their life thus eventually very less corruption could be found in their society.

According to the legend Karmasen was a king who confronted many type of hostility in life. He started worshipping God to come out of the situation and succeeded. Thus he, as a gratitude to the almighty expressed his offerings through song and dance. There from Karma started its journey. According to the legend, king Karmasen, after his death became Karma Tree. Young man and women, that’s why, by placing a Karma Tree, dance around, this is what actually Karma dance. It is also the main music of Ghasia tribe because according to another legend Karmasen was born at one of the house of the Ghasias. About the derivation of the Karma one song is given below-

Karmaseni ke aawati, jaani suni pawati

Ahan Ram Ghasi ghar, lihe Avtaar

Aho Ram Chowk Chanden, Pidhli Madhaye

Milhar ke daar tutge

Aho sakhi,

Karma dance and song is called as ‘Geeto ka Raja’ means ‘The king of all songs’ because the variety of style it has got, no other Chhattisgarhi song have it. There are 14 types of dancing style in Karma. It is basically the dance of joy and delight and that give an extra flavor of vivacity. Karma dance starts with some ritual in Bhadra month Shukla ekadasi. The young boy and girls situate a branch of Karm tree at the center point of the performing lawn and worship that in a traditional way. Some varieties of Karma are Lagda, Jhumar, Lahki, Thada, Ragini etc, which could be recognized on the basis of their dance style. Karma dance style, as said, starts with offering God through some particular traditional ritual.

Pahli panvaro Gouri, pher gavo debi Sharda

Kakar gavo, kakar bajavo kakar karo parnam

Guru ke gavo, dev ke bajavo, Sarsuti ke karo parnam

Kahan baythe jogni, kahan baithe devi Sharda

Kahe ma guru banahi

Dadaria

The word Dadaria might have been derived from the Sanskrit word ‘Dvidaria’. These are basically the couplets, actually sung in the field during cultivating or harvesting the crops, or during collecting Mahua flower or during some other works, by young couples. This song is based on some questions- answers asked by the boys to the girls or the visa versa, always give a gesture of love, dating and adequate things. They are composed in the field itself while doing concerned works out there. When these all couplets are accumulatively sung with a basic time cycle or taal then it is called as ‘Salho’. At the starting the boy intimates the girl rather allegorically to be alert and listen to it minutely because he is going to propose his love to her:

Batki ma basi, chivti ma dhare noon

Mai gavat hou dadaria, te kaan dhare sun

After this the boy says again:

Datvan la karei bahera rukh ke

Ek boli suna de apne mukh ke

Then the girl answers:

Ek thin ama ke dui fanki

Mor aankhiv aankhi jhuleithe torech aankhi

Means one bisected mango as possess a gap as if your eyes are staring on my eyes every time.

Chaalni maa chalev supa me phunev

Torkaaran bar thura sayar dhaneyv

[I have done everything to get you in my life].

Pandwani

Pandwani is basically a Katha singing style of Chhattisgarh.Verbal traditional Pandwani is mainly sung by the Pardhan and Devar.Although this Katha singing theme has been derived from Mahabharata but many distortion has happeed to it. More over some local myth from Gond folk tales has been piled up with it.Although present Pandwani that has been being impended on the stages is basically a solo presentation of Mahabharat epic but as said arlier, according to that the main hero of the Katha is Bheema, the eminent war of Kurukshetra is called as the war of Mahadhan. The city of the Pandavas is called as Jeyta instead of Indraprastha and the domain of Kouravas is named as Hasna which might have derived from the word Hastinapur. According to the main Pandwani The Kauravas were 21 brothers instead of 100.Pardhan’s Pandwani the folk themes were been emphasized upon, where as in Jhaduam Dewangan or Teehen Bai’s performance this thing is absent but totally based on The Mahabharata of Sabal Sing Chouhan. Pardhans Pandwani gets rendered in such a way that it appears  as the local creation and perspective.

Padwani ( Pardhan)

Kanwra Pandvon ka Danda Dahori khel-

Jaita nigari me panch pritur pandava

Aur hasna nigari me ekkis bhai kanwra hai re bhaia

Ramayni

Ramayni is also a ‘Katha’ singing style, is sung mainly by Pardhans and derived from the epic Ramayana but the key character is Lakshman instead of Rama. The main focus is on this character has added a unique taste to the repertoire moreover some character of Mahabharata has also been compiled with it very successfully.  Here we may see the example from the chapter ‘Lakshman ki sat pariksha’

Lachhman Aur Indar Kamni

Hund mahal ke basera bane hai re bhaia

Sat kotha sattar darvaja bane hai bhai

Bawan khirki lage havein re dada

Naag ke khura resham ke guthna

Ek ajgar mudesa, ek gudesa hai re bhai

Palaka par soy rahe hei tapsi lachhman ho

Ho indar kamniatra machhi banke chipke havei

Rasta deikh rahe hei. Kah thei soye havei beiree

Conclusion:

We have discussed till now, some of the main folk music forms of      Chhattisgarh with every relevant character wise detailing. The fragrance of folk culture is indispensably being carried by the folk music of any region and without that the entity of any community is definitely baseless. Unfortunately now a days Due to massive industrialization and consequent urbanization, the core character of the folk fragrance is being annihilated. Its, as a whole, is not about only Chhattisgarh but all the communities are supposed to be conscious about the purity and sanctity of their heritage and traditions which is needed to be preserved because the disappearance of cultural identity is just like a body without spine.

                                                                            

                                                                          Author :   Dr. Ashis Chakraborty

Reference

  1. www.powermin.nic.in/sites/default/files/uploads/join_initiative_of_govt_of_india_and_chhattisgarh.pdf
  1. http://hydrologyproject.cg.gov.in/Basin%20details/river_basin_in_chhattisgarh.html
  1. http://shodgandha.inflibnet.ac.in/bitstream/10603/314821/7/07_chapters%201.pdf
  1. http://shodgandha.inflibnet.ac.in/bitstream/10603/314821/7/07_chapters%201.pdf
  1. http://shodhgandha.inflibnet.ac.in/bitstream/10603/29568/4/04chapter%201.pdf
  1. http://www.cmaindia.org/cms/Chhattisgarh.php

 

Unveiling Nostalgia: Exploring Call Songs and Record Songs Through the Annals of Time

Anindya Banerjee

Abstract: This study delves into the captivating realms of call songs and record songs, timeless artifacts that echo through the corridors of history. Serving as auditory time capsules, these musical expressions not only mirror the cultural landscapes of their eras but also bear witness to the evolution of communication and recording technologies. Through a meticulous exploration of archival materials, musical compositions, and technological advancements, this research aims to illuminate the significance of call songs and record songs in preserving and transmitting cultural narratives. As we journey through the pages of the past, this investigation seeks to unravel the intricate tapestry of human expression embedded within these unique musical forms, fostering a deeper understanding of their enduring impact on societies across time.

অতীতের পাতা থেকে : কলের গান, রেকর্ডের গান

পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় 

লেখাটা শুরু করা যাক প্রখ্যাত গায়িকা আঙ্গুরবালা দেবীর স্মৃতিচারণ দিয়ে।

স্কুলে যাওয়ার পথে একটি বাড়ির জানালার বাইরে ভিড় দেখে আর গানের আওয়াজ শুনে আমি আর আমার বোন বিজু দাঁড়িয়ে পড়লাম।

…জানলার গরাদের ভেতর দিয়ে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে অবাক। …একটা কালো মতন কি যেন ঘুরছে আর একটা বিরাট চোঙের ভেতর থেকে একটা মেয়ে গান গাইছে। 

বিজু বিজ্ঞ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললে, ‘ওই যে বাক্স টা, ওটার মধ্যে একটা মেয়ে বসে গান গাইছে, আর চোঙটার ভিতর দিয়ে সেই গান বাইরে চলে আসছে’। 

বিজু বললে, হাত পা সব কেটে নিয়ে, ছোট করে ওর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। গান তো গাইবে গলা দিয়ে, হাত পায়ের কি দরকার বল। 

যারা কলের গান করে তাদের হাত-পা আগে থেকে কেটে কেটে ছোট করে দেয়।  

কৌতুহল

আমি বললাম, মেয়েটা খাবে কি করে?  

বিজু বললে, ‘ওই যে অতো বড় চোঙটা দেখছিস, ওটা তবে কি জন্যে?  ওর ভেতর দিয়ে মাছ, মাংস, ভাত,  রসোগোল্লা সব দিয়ে দেয়,  আর মেয়েটা চোঙের ওপারে বাক্সোর ভেতর থেকে গপ্‌ গপ্‌ করে খেয়ে নেয়। 

আঙ্গুরবালা দেবী এই স্মৃতিচারণা করেছেন দেশ পত্রিকার বিনোদন সংখ্যা বাংলার ১৩৯৯ ইংরেজি ১৯৯১ সালে। তার প্রায় ৯০ বছর আগে ১৯০১ সালের ২৭ শে জুলাই লন্ডনে ফোন কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াটসন হদ কলকাতায় এসে পৌঁছেছিলেন এদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্যে। কলকাতায় এসে ওয়াটসন বুঝেছিলেন, কলকাতা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ব্যবসার জন্য আদর্শ জায়গা। তাই তিনি লন্ডনে গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন যে তারা যেন অবিলম্বে কলকাতায় একটি শাখা খোলেন এবং তার জন্য একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ রেকর্ডস পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কোম্পানির আবেদন কে গুরুত্ব দিয়ে ফ্রেডরিক  উইলিয়াম গেইসবার্গ এবং তার সহকারী ডিলনার্টকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। .১৯০২সালের ২৭শে অক্টোবর ছশো মোমের চাকতি আর রেকর্ডিং এর আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কলকাতায় এসে উপস্থিত হন গেইসবার্গ ও ডিলনার্ট।

প্রথমে চৌরঙ্গী ওপরে ডালহৌসিতে গ্রামোফোন কোম্পানি তাদের অফিস খুলেছিল। গান রেকর্ড করার মতন উপযুক্ত শিল্পীর সন্ধানে তারা কলকাতার বেশ কয়েকটি থিয়েটার হলে যাতায়াত শুরু করেন। তখন থিয়েটারে অভিনেতা-অভিনেত্রীর গলায় গান শুনতে দর্শকরা ছিলেন আকুল। এই ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিলেন জন ওয়াটসন হদ। ক্লাসিক থিয়েটারের অমরেন্দ্রনাথ দত্ত করিন্থিয়ান থিয়েটারের জামসেদজি ফ্লেমজি ম্যাডাম। একদিন এক ধনী বাঙালি বাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়ে গান শুনলেন সেযুগের কিংবদন্তি শিল্পী গহরজানের কন্ঠে। আর তখনই তারা মনস্থির করে ফেলেছিলেন যে এই গহরজানের গান দিয়েই শুরু করবেন রেকর্ডিং। গওহরজান রেকর্ডিং করে্ন ১৯০২ সালের ১১ ও ১২ নভেম্বর। ৯টি বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়ে গান রেকর্ড করে পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছিলেন ৩০০০ টাকা। গহরজানের রেকর্ডিং-এর আগে ৮ নভেম্বর ১৯০২ সালে গেইসবার্গ শহরের একটি হোটেলে পরীক্ষামূলকভাবে রেকর্ডিং শুরু করেন অয়াল্টার স্ট্যানলে বার্কের এবং ক্লাসিক থিয়েটারের ১৪ ও ১৬ বছর বয়সী শশীমুখী ও ফনীবালার গান দিয়ে। গহরজান ছাড়াও আর যাদের গান রেকর্ডিং করেছিলেন সেইসব শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শৈলী বা শীলাবাঈ, হরিমতি, সুশিলা, মিস আচারিয়া,মিস মহতাল,মিস কিরণ,  পান্নালাল  সরকার, লালচাঁদ বড়াল,  ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। 

সেই সময় শিল্পীদের গান রেকর্ড করা হত মোমের চাকতিতে।  পরে পাঠানো হতো জার্মানির হ্যানোভার শহরে। সেখান থেকে গলার রেকর্ডে ছাপ নিয়ে আসতো এদেশে। ১৯০৮-এ বেলেঘাটায় স্থাপিত হয় গ্রামোফোন কোম্পানির কারখানা। পরে এই কারখানা চলে আসে দমদমে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকলেও ওয়াটসন চেষ্টা করেছিলেন এদেশের সংগীত সম্পদ, যা কিনা আটকে ছিল রাজদরবারের চার দেওয়ালের মধ্যে,  জমিদারদের জলসাঘরে কিংবা বাঈজিদের কোঠায় সেই ঐতিহ্যকে রেকর্ডের মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে।  গ্রামোফোন রেকর্ড এর মাধ্যমে এদেশের ‘পপুলার কালচার’ যেমন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি হয়ে উঠেছিল সুখী গৃহকোণের প্রতীক।

গোড়ার দিকে গ্রামোফোন কোম্পানি ৭ ও ১০ ইঞ্চি রেকর্ড প্রকাশ করার পর ১২ ইঞ্চি রেকর্ড প্রকাশ করে। এগুলি বাজতে সময় নিত যথাক্রমে দেড়, তিন ও চার মিনিট।  গ্রামোফোন কোম্পানি ছাড়াও কলকাতায় আরো বেশ কিছু রেকর্ড কোম্পানি গড়ে ওঠে সেগুলো হল হেমেন্দ্র মোহন বসুর এইচ বোসেস রেকর্ড, ফ্রান্সের প্যাথোফোন কোম্পানি,বেকা রেকর্ডস, জিতেন্দ্রনাথ ঘোষের মেগাফোন, চণ্ডীচরণ সাহার হিন্দুস্থান রেকর্ডস, ডোয়ার্কিন অ্যান্ড সন্স, ইউনিভার্সাল রেকর্ড,  নেলোফোন ডিস্ক ফোনগ্রাফ রেকর্ড, রয়াল রেকর্ড, রামাগ্রাফ রেকর্ড, জেমস অপেরা রেকর্ড, সিঙ্গার রেকর্ড, ওডিয়ন রেকর্ড, এলিফোন রেকর্ড, সান ডিস্ক রেকর্ড, কমলা রেকর্ড ইত্যাদি।  

গানের পাশাপাশি সে সময় রেকর্ডিং প্রকাশিত নাটকের অংশ হাসির গান ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ডিং রবীন্দ্র সংগীত শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় অনেক পরে প্রথমদিকে গীতিকার ও সুরকার উল্লেখ থাকত না বরাবরই রেকর্ড কোম্পানিগুলোর নিজেদের শিল্পী তালিকায় শ্রেষ্ঠ দের ধরে রাখতে তখন শিল্পী একটি রেকর্ড কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ হয় অন্য কোম্পানিতে গান করতে পারতেন না আবার ব্যতিক্রম ছিল একই শিল্পী একাধিক কোম্পানিতে রেকর্ড করেছেন তবে এ ব্যাপারে কয়েকজন শিল্পীর আপত্তি থাকায় তাদের গান কখনো রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি।

গহরজান

গ্রামোফোন রেকর্ড বাতিল হওয়া শুরু হয় পঞ্চাশের দশক থেকে। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বাজারে আসে বৈদ্যুতিন রেকর্ড। ষাটের দশক থেকে কমতে থাকে গ্রামোফোন রেকর্ড। একসময় সেটাও হারিয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে এইচএমভি মাইক্রোগ্রুপ রেকর্ড প্রকাশ করে প্রথমবারের মতন। ১৯৫৯ সালে দমদমে লং প্লেইং রেকর্ড প্রসেসিং কারখানা স্থাপন করা হয়। এর সঙ্গে প্রকাশিত হতে থাকে ই পি রেকর্ড ও। এইচএমভি-র দেখাদেখি হিন্দুস্থান, সোনেলা, মেগাফোনও লং প্লেইং রেকর্ড-প্রকাশ করতে শুরু করে। যা অব্যাহত ছিল নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবনে ক্যাসেট সিডির রমরমা।  আর স্মৃতির খাতায় নাম লেখালো গ্রামোফোন রেকর্ড বা কলের গান।

লোকরামায়ণ : বাল্মিকী ও সাধারণ মানুষ

রামায়ণ গানের দল

দীপঙ্কর হালদার, গবেষক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলার দক্ষিণ বঙ্গের লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে রামায়ণ গানের চর্চা অত্যন্ত সুদীর্ঘকালের। বাল্মীকি মুনি বিভিন্ন লোক কাহিনীকে সুসংহত ভাবে লিপিবদ্ধ করে রামায়ণ রচনা করে থাকতে পারেন। যদিও তার প্রতিটি বিষয় সেই যুগে বাস্তবায়িত হয়েছিল বলে হিন্দু ধর্মের মানুষেরা অনেকেই বিশ্বাস করেন।  লোকসমাজে বাল্মীকি রামায়নের নানান কাহিনী নিয়ে এক এক রকমের রূপ দেওয়া হয়েছে। অথবা বাল্মীকির রামায়ণের আগে থেকেই এই সব লোক কাহিনী প্রচলিত হয়ে আছে। যেখানে লোককাহিনীতেও ঋষি বাল্মীকি মুনির শৈশব জীবনের চরিত্রের বহু গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। এইসব লোককাহিনীতে শৈশবে বাল্মিকীর নাম ছিল রত্নাকর। চুরি, ডাকাতি ছিল তাঁর শৈশবের পেশাগত বৃত্তি। শৈশবে সে এত মস্তবড় দস্যু ছিল যে সাধু,গুরু, মহাত্মাদেরও হত্যা করতে সে দ্বিধা বোধ করত না। চুরি ডাকাতি করে পিতা মাতা ও স্বপরিবারের ভরন পোষন করত। পথেঘাটে যে যা  স্বর্ণ, রৌপ্য, হিরে ও অন্যান্য মুল্যবান রত্ন সম্পদে সুসজ্জিত হয়ে যেত, মেরে ফেলার  ভয় দেখিয়ে সে অনায়াসে তা কেড়ে নিত। চুরি ডাকাতি করার জন্য বহু মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করত। তাঁর নর হত্যার পাপের মাত্রা এতখানি উচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল যে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার আসন পর্যন্ত টলে গিয়েছিল। অবশেষে তাঁকে কৃপা করার জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা ও নারদ এসে তাঁকে রাম নাম মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু প্রচন্ড পাপের কারণে রামনাম মন্ত্র উচ্চারণ করার মতো শক্তি বা সাধ্য তার ছিল না। অবশেষে ব্রহ্মা ভেবে নিলেন যে এভাবে তাঁর মুখ থেকে রাম নাম বলানো যাবে না। তিনি চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ করার জন্য একটি মরা বৃক্ষ দেখিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি ?

রামায়ণ পালার আসর

দস্যু রত্নাকর সহজ সরল ভাবে উত্তর দিলেন -ওটা একটা মরা গাছ।

ব্রহ্মা বুঝলেন যে ‘মরা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে তাঁর কোন অসুবিধা হচ্ছে না কারণ এরকম মরা সে প্রতিদিনই দেখে। জীবিতকে মরা বানানোর কায়দায় সে অভ্যস্ত। তাই মরা শব্দটি বার বার উচ্চারণ বা জপ করলে তাঁর মুখে এক সময় রাম নামের প্রতিধ্বনি উচ্চারিত বা ধ্বনিত হবে। আর তারপর নামের অসীম শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তাঁর জীবনের স্বভাব চরিত্র সমস্ত কিছু একদিন বদলে যাবে। তখন ব্রহ্মা তাকে বারেবারে মরা কথাটি উচ্চারণ করতে বলল। রত্নাকর তাই করতে থাকল। আর তার ফলেই তার রাম নাম উচ্চারণ করা সহজ হল।

ব্রহ্মার এই গোপন রাম নামের বীজ মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার পর রত্নাকর সর্বত্র ধ্যান মগ্ন হয়ে এই নাম জপ করতে থাকল সরযুর তীরে এক কুঠিরে। দীর্ঘকাল যাবৎ এই যোগসাধনা করতে করতে তাঁর সমগ্র শরীরে বাল্মীক (উইপোকা) বাসা করে। তাঁর যোগসাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে রত্নাকর থেকে বাল্মীকি নামে আখ্যায়িত করেন। সমস্ত দেহে বল্মীক বাসা করেছিল বলে, ব্রহ্মা তাঁর নাম বাল্মীকি দিয়েছিল।

যোগ সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার পর মুনিবর রামায়ণ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। লোককাহিনী অনুযায়ী রত্নাকরের জন্ম প্রকৃত পক্ষে সত্য যুগে অর্থাৎ ১০০০ থেকে ৫০০০ অব্দে। কিন্তু তিনি যোগ সাধনার বলে বলীয়ান হয়ে পরবর্তীকালে ত্রেতা যুগ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন । কারন শৈশবের চুরি, ডাকাতি, দস্যুবৃত্তি লীলা থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে লব কুশ কে মানুষ করা পর্যন্ত বাল্মীকি চরিত্রের পরিচয় আমরা রামায়নে অতি সহজেই দেখতে পাই। মানুষের বিশ্বাসে বিজ্ঞান মিলিয়ে যায়। সেখানে কী সত্য কী মিথ্যা তা জানার অবকাশ থাকেনা। সাধারণ মানুষ বিশ্বাসেই সেই আনন্দ খুঁজে পায়। তারা সত্যের জন্য মোটেই সচেষ্ট নন। তাই গবেষকের সত্য সবসময় দূরেই থেকে যায়। বিশ্বাসেই রাম দেবতা, বিশ্বাসেই বাল্মিকীর আয়ুস্কাল লক্ষাধিক বছর। আর মানুষ একশ বছরেই শেষ।

বাল্মীকি রামায়ণ ও অদ্ভুত রামায়নে  যুগের পরমায়ু ও যুগের মানবদের পরমায়ু নির্ধারণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। বলা হয়েছে সত্য যুগের পরমায়ু ছিল আনুমানিক সতেরো লক্ষ আঠাশ হাজার বছর , সেখানে মানুষের পরমায়ু ছিল এক লক্ষ বছর, ত্রেতা যুগের পরমায়ু ছিল আনুমানিক বারো লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার বছর, মানুষের পরমায়ু ছিল আনুমানিক দশ হাজার বছর , দ্বাপর যুগের পরমায়ু ছিল আনুমানিক আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার বছর , মানুষের পরমায়ু ছিল আনুমানিক এক হাজার বছর, অবশেষে এই কলি যুগের পরমায়ু নির্ধারন হয় চার লক্ষ বত্রিশ হাজার বছর ও মানুষের আয়ুস্কাল অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য মাত্র একশো বছর।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিনাঞ্চলে রামায়ণ গানের মূল বিষয়বস্তু

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্ভুক্ত। । যে দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার গ্রামীণ জনপদের অধিকাংশ মানুষ সমগ্র বিংশ শতকে ও তৎপূর্ব সময়রেখায় পৌরাণিক কাহিনী বিচিত্র অজস্র সামাজিক পালাগানের প্রতি বিমোহিত হয়েছিল। লোক সমাজের অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ সঙ্গীত চর্চার গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিরক্ষর লৌকিক সমাজের বেশিরভাগ মানুষের হৃদয়ের আঙ্গিকতা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গাম্ভীর্য কালোয়াতি আলাপ, বিস্তার, বন্দিশ ও তানের  বেড়াজালে সীমাবদ্ধতার পরিবর্তে লোক সঙ্গীতের উন্মুক্ত সুরে বিমুগ্ধ হয়েছে। তাই যুগে যুগে তারা লোক সঙ্গীতের নানান সঙ্গীত শৈলীগুলিকে বুকে আঁকড়ে ধরে তার সুমধুর সুরের প্লাবনে সর্বত্র ভেসে আসছে।

তৎকালে  যেসমস্ত পৌরাণিক, সামাজিক ও মাঙ্গলিক পালাগান গুলি বিশেষ জনপ্রিয়তার শিখর প্রান্তে  হাত বাড়িয়েছিল তার মধ‍্যে সহজ সরল বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠিত রামায়ন গান এক সর্বকালজয়ী, শ্রেষ্ঠ লোক পালাগানের দাবি রাখে।  সুদীর্ঘকাল পূর্ব থেকে সমগ্র বিংশ শতাব্দী ধরে দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার ক‍্যানিং, বারুইপুর, সোনারপুর, কাকদ্বীপ, নামখানা, সাগরদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার, মগরাহাট, উস্থি, গোসাবা, জয়নগর, কুলতলি, বাসন্তী, মন্দিরবাজার, কুলপি থানার অঞ্চলভুক্ত গ্রামগুলির বেশিরভাগ মানুষ রামায়ন পালাগানের প্রতি সবচেয়ে বেশী খুবই বিমুগ্ধ ও বিমর্ষতা লাভ করেছিল। সমগ্র বিংশ শতাব্দী ধরে রামায়ন গানের পালাগান গুলি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিল। যদিও বর্তমানে সেই ধারাপাতে আজ সম্পূর্ন ভাটা পড়ে গিয়েছে। পণ্ডিত অনাথবন্ধু অধিকারী মহাশয়ের সুচতুর গায়নে ও তার কলমের লিখনে পৌরাণিক পালাগানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে রামায়ন গান পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তার লেখনীর কাব‍্যছন্দে রামায়ন গানের মূল বিষয়বস্তুর স্পষ্টতই এক সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়।

তিনি এ প্রসঙ্গে কাব‍্য ছন্দে সুন্দর ভাবে একটি কলম দিলেন ;

“আদি কান্ডে রামের জন্ম, বিবাহ সীতার।

অযোধ্যাতে বনবাস ত্যাজি রাজ্যভার।।

অরন্য কান্ডেতে গেল পঞ্চবটি বন।

সুযোগ পেয়ে সীতা মায়ের হরিল রাবন।।

কিস্কিন্ধা কান্ডেতে হইল সুগ্রীব মিলন।

বহু ভক্ত উদ্ধারিল রাম প্রান ধন।।

সুন্দরা কান্ডেতে হইল সাগর বন্ধন।

লঙ্কাকান্ডে রাখিল রাম রাবনেরি রণ।।

উত্তরা কান্ডেতে হল সপ্ত কান্ড হল শেষ।

জনম দুঃখীনি সীতার পাতালে প্রবেশ।।

এই সুধামাখা সপ্ত কান্ড রামায়ণ।

মহামুনি বাল্মীকি তা করেন রচন।।“

রামায়ণ গান পরিবেশনের সময়, আসর, সাজসরঞ্জাম

সমগ্র বিংশ শতক ধরে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজে অন‍্যান‍্য  সামাজিক, পৌরাণিক পালাগানের ন‍্যায় রামায়ন গান অত‍্যন্ত ব‍্যাপক ভাবে যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল সেকথা দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজের ইতিহাস অধ‍্যায়ন করলে স্পষ্ট জানা যায়। ভক্তি ও রসামৃতে সমৃদ্ধ এই রামায়ণ পালাগানের প্রতিটি পৌরানিক বিষয়বস্তু একথা কারো অজানা নয় । মনোমুগ্ধকর তার সুর ও বিভিন্ন চরিত্রে যাদুকরী অভিনয়ের গভীর যুগলবন্দীতে ভরপুর রামায়ন পালার সপ্তকাণ্ডের প্রতিটি কান্ড। তাই শুরু থেকে বোধহয় রামায়ন গানের সুমধুর সুর ও তালের প্রতি নিরক্ষর লৌকিক সমাজের হৃদয়ের অভ‍্যন্তরে এক গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল। শুধু তাই নয় আঞ্চলিক শিল্পীদের দ্বারা তার পরিবেশন কৌশল ও এক অদ্ভুদপূর্ব সুন্দর মানসিকতার পুনঃজন্ম দিতে পেরেছিল।  নিকটবর্তী জেলে, মৌলে, বাউলে থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, ব‍্যবসায়ী ও দিনমজুরদের নিত‍্যুই হাড়ভাঙ্গা কঠোর পরিশ্রমের মধ‍্যে দিয়েও তারা দিনের অন্তরালে শুধুমাত্র একটু সমাজিক, পৌরাণিক পালাগানের মধ‍্যে তারা মানসিক শান্তি লাভ করে আসে। জীবনে সুখ সমৃদ্ধির সম্পূর্ণ ভার ঈশ্বরে তথা দৈব শক্তির পায়ে উৎসর্গ করে নিজদের মনপ্রাণ কে সমর্পণ করে এসেছে নানান লোক দেবতার শ্রীচরণ পাদপদ্মে। সেই দৈব শক্তির আশীষ কে মাথায় নিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের পথ চলা শুরু হয়। তখন অনুষ্ঠিত হয় নানান শৈলীর পালাগান। শুধুমাত্র রামায়ন গান নয় তৎকালে ডাকনাম, কবিগান, তরজা, বাউল, যাত্রাপালা থেকে শুরু করে মনসা শীতলা ও বনবিবির পাঁচালী ,ভক্তিগীতি, হরিনাম সংকীর্তন অত‍্যন্ত জনপ্রিয় সঙ্গীতশৈলী রূপে লোক সামাজে অধিষ্ঠিত হয়।

অধিকাংশ পৌরাণিক, মাঙ্গলিক পালাগানগুলি রাত্রি প্রথম প্রহর থেকে অনুষ্ঠিত হওয়ার রীতি রিয়াজের প্রচলন ছিল। রামায়ন পালাগানও এই সুনির্দিষ্ট সময়কালেই পরিবেশিত হয়ে আসছে সুদীর্ঘ কাল যাবৎ ধরে। জীবিকার তাগিদে প্রতিটি মানুষের দিনের অধিকাংশ সময় নানান কর্মসূত্রে ব‍্যাস্ততার মধ্যে কাটে বলে তাই সন্ধ‍্যার পর থেকে রামায়ন গানের আসর গুলি বসার রীতি রিয়াজ ছিল। প্রতিটি পালাগান রাত্রি দ্বিতীয় ও সর্বোচ্চ তৃতীয় প্রহরে পরিসমাপ্তি করা হতো।

ক্ষেত্র সমীক্ষার নানান গবেষণার নীরিখে দেখা গেছে যে বিংশ শতাব্দীতে রামায়ন হিন্দু ধর্মের প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষের হৃদয়ে গভীর ভাবে সাড়া জাগালেও মূলত রাজবংশী, কৃষক, তিওর, ও জেলে সম্প্রদায়ের মানুষদের মনে রামের স্থান সবচেয়ে বেশী। তাদের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভক্তির ধরাপাত এওকটু বেশি গভীর। তাদের শিক্ষা ও জ্ঞান অপেক্ষা বিশ্বাসেই তাদের জীবন বেশি তরঙ্গায়িত। শুধু ঈশ্বরের প্রতি যে বিনম্র শ্রদ্ধা ভক্তি তা নয় তাদের আচার আচরণ থেকে শুরু করে শিল্পীর প্রতি সামাজিক দায় দায়িত্ব কর্তব‍্য অত্যন্ত নিষ্ঠা পরায়নতার দাবি রাখে।  দেখা গেছে, হিন্দু সমাজের অন‍্যান‍্য  সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্মিত আসরের সঙ্গে এদের নির্মিত রামায়ন গানের আসরের গঠনভঙ্গি, সাজসজ্জা, আয়তন ও অন‍্যান‍্য  পরিকাঠামো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়। আসরের নির্মাণের প্রতিটি পদক্ষেপ তারা ধর্মীয় শাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী নির্মাণকরা হয়ে থাকে।  প্রথাগত বংশের নিয়ামানুযায়ী আসরের অস্তিত্ব রক্ষা করে রামায়ন শিল্পীদের সঙ্গীত চর্চার মানকে চূড়ান্ত পর্যায়ে মর্যাদা দিয়ে আসছে।

দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র রামায়ন শিল্পীদের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, গ্রাম থেকে সুদূর গ্রামে তৎকালে রামায়ণের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছিল। তৎকালীন সমাজের অন‍্যতম এক প্রতিষ্ঠাবান সামাজিক খ‍্যাতি সম্পন্ন  রামায়ন শিল্পী অনাথবন্ধু অধিকারীর শিষ‍্যদের থেকে জানা যায় যে ১৯৮০- ৮২ সালে পণ্ডিত অনাথবন্ধু অধিকারী মাহাশয়ের আর্থিক দক্ষিনার মানদন্ড সাতশো টাকার মতো ছিল। সেই সময় তার প্রতিষ্ঠিত শিষ‍্যদের দক্ষিনার অঙ্ক সত্তর আশি টাকার মতোই ছিল। তার উর্ধে ছিল না। তবে গানের জনপ্রিয়তা এতো বেশি প্রধান‍্য অর্জন করেছিল যে, সূদুর গ্রাম থেকে পল্লী গ্রামে গান গাইতে গাইতে শিল্পী কখন যে বৎসরান্তে এক দেড়শ পালা গান ছাড়িয়ে যেত তার হিসাব নিকাশ থাকত না। এক দেড়শ পালা গান খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিল। ভালো খারাপ বিমিস্র এতো প্রচারের মধ‍্যে দিয়েও তবুও শিল্পীর মর্যাদা সামান্য ক্ষুন্ন হয়নি। আজকের সমাজের মতো আশঙ্কাজনক অবস্থা সেযুগে মোটেও ছিল না। আজকের সমাজের পটচিত্র কতখানি বদলে গেছে। শিল্পী ও তার সম্প্রদায়ের প্রতিটি গুণবান ব‍্যাক্তিকে সেদিন গৃহের মঙ্গলার্থে বাড়ির পুত্র বধূদের দ্বারা চরণ বিধৌত করে আঁচল দিয়ে পা দুখানি মুছিয়ে দেওয়ার রীতি রিয়াজ পর্যন্ত ছিল। আজ সেই সভ‍্যতা সম্পূর্ণ ধারিয়ে গেছে। সেই সামাজিক রীতি এখনো কমবেশী চোখে পড়ে তবে একেবারে অজ গ্রাম বাংলার দিকে। যেখানে শিক্ষা ও সভ্যতার আলো যত কম, সেখানেই বিশ্বাস আর দেবতার প্রতি শ্রদ্ধার গভীরতা তত বেশি ও অকৃত্রিম। শহরাঞ্চলে ও শহর ঘেঁষা জনপদে এই সব রীতি নীতি হারিয়ে গেছে। তবে আচরণের মধ্যে শহুরে রীতি থাকলেও ধর্মের বাঁধন এখোনো রয়েছেই।

আমি দক্ষিন চব্বিশপরগনা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে কিছু রামায়ন গান সংগ্রহ করে সেগুলির তাৎপর্য ব্যখ্যা করেছি। এখানে লক্ষনের শক্তিশেল নিয়ে একটি পালার কয়েকটি গানের উল্লেখ করেছি।

দশ মাথায় দশ মনি , জ্বলছে যেন দিন মনি , রণ সাজে সাজিলো রাবন।

জয় শিব শম্ভু বলে , ধনু্র্বান হাতে তোলে , কুড়ি হাতে বলয় কঙ্কন।।

পুত্র শোকে পাগল হল ,  ধনুর্বান হাতে নিল , রথের উপর উঠিল রাবন।

রামায়ণে যেভাবে রাম, সীতা ও রাবনের বিষয়বস্তু বর্ণিত রয়েছে এখানে বর্ননার সঙ্গে তার পরিচয় একটু ভিন্ন স্বাদের কথা অনুভব করায়। সাধারনের দৃষ্টির আড়াল থেকে রাবনের এক অসাধারন রূপ মাধুর্যের বর্ননা করা হয়েছে এই গানে। রামানুজ লক্ষনের বানে প্রিয় বীর পুত্র ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর ঘটনায় রাবন শোকে দুঃখে পাগল হয়েছে ঠিকই কিন্তু রণ সাজে সুসজ্জিত হয়ে প্রতিশোধের জন্য উদ্বিগ্ন হয়েছে তার ব‍্যাথিত মনপ্রাণ। আর সেই রণের সুসজ্জিত বেশভূষা গানের কাব‍্যিক ছন্দে সুন্দর ভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তার দশ মাথায় একটা দুটো নয় দশ মনির মুকুট দিয়ে সুসজ্জিত। আর প্রতিটি মনির উজ্জ্বলতা দিনের আলোর মতো যেন ঝলমল করছে।

রাক্ষস কূলাধিপতি রাবন যে শুধুমাত্র লঙ্কা রাজ‍্যের কূলাধিপতি ছিলেন ঠিক তেমনটা নয়। একাধারে তিনি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সম্পর্কেও জ্ঞাত ছিলেন। তাই তাকে সেযুগে ত্রিকালদর্শী পণ্ডিত বলা হত। তিনি আপনার দিব‍্যদৃষ্টিতে সুস্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে দৈব শক্তির কাছে তার পরাজয় সুনিশ্চিত। তা সত্বেও সে যুগাবতার রাম লক্ষনের সঙ্গে ধনুর যুদ্ধে জয়লাভের জন্য অনড়। গানের পটচিত্রে শ্রেষ্ঠ বীর, পরাক্রমীদের ন‍্যায় সে মহাযোদ্ধার সাজে সুসজ্জিত হয়েছে মৃত পুত্রের নামে শপথ করে। রামানুজ লক্ষণকে সে আজ শক্তিশেল বানে নিধন করার জন্য।

বাজে রণ দামামা রণ দামামা। রাবনের রণে বাজে রণ দামামা।।

বাজে রণ দামামা রণ দামামা। লক্ষ লক্ষ শঙ্খ বাজে রণ দামামা।।

ঝাঁঝরি কাঁকরি বাজে বাজে দামামা।।গানের এই পটচিত্রে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে রাম রাবনের যুদ্ধ শীঘ্রই আসন্ন। তাই রণের সুমঙ্গল ধ্বনিতে মুখরিত সমগ্র স্বর্ন লঙ্কার আকাশ বাতাস। যুদ্ধের পুণ্য লগ্নে কখনো শৃঙ্গা বাজছে, দামামা বাজছে, ঝাঁই-ঝাঁঝরি বাজছে, আবার কখনো বা মঙ্গল শঙ্খের পবিত্র ধ্বনিতে শিহরিত হচ্ছে উভয় পক্ষের বীর সৈনিকদের শিরা উপশিরা। এই গানের মধ্যে দিয়ে আমরা বাহ‍্যিক জগতে সুর ও অসুরদের মধ‍্যে এক মহাযুদ্ধের প্রলয়ঙ্করী ভয়াবহ পরিণতির এক রূপমাধূর্য অনুভব করি। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ  রামায়ণ শিল্পীরা বাস্তব সমাজের ভিত্তিকে শক্তিশালী দৃঢ়, সুন্দর ও সুপ্রতীভ করার জন্য একটু ভিন্ন স্বাদের মধ‍্যে দিয়ে এই গানের ব‍্যাখ‍্যা করে শ্রোতাদের অনুভব করতেন। শিল্পীরা বলেন রাম রাবনের যুদ্ধের এই পটচিত্র থেকে আমদের প্রতি প্রত‍্যেকের বাস্তবিক জীবনের কিছু শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। জ্ঞান, বিচার বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনা, দান, ক্ষমা, ধৈর্য, সংযমশীলতা, আধ‍্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ বিকাশাদি প্রতিটি বিষয় শুভ শক্তির প্রতীক স্বরূপ। এগুলি ভগবান শ্রীরামের সৈন্য স্বরূপ। অন‍্যদিকে কাম, ক্রোধ, স্ত্রীআসক্তি, পরস্ত্রীকাতরতা, লোভ, মায়া, মোহ, সঞ্চয়প্রবৃত্তি, স্বার্থ, কুপ্রবৃত্তি, কু মনো-বাসনা, মদ, মাৎসর্য‍্য ও উগ্রতা ইত‍্যাদি অশুভ শক্তির প্রতীক। বাস্তবে এরাই রাবনের অনুচর স্বরূপ। তাই রামায়ণে রাম রাবনের যুদ্ধের পুণ্য ক্ষনে শিল্পী আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শুভ শক্তির সঙ্গে অশুভ শক্তির লড়াইয়ের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেন।

শোনরে পবন নন্দন আমার দাদারে বোলো। রণ স্থলের মাঝে লক্ষন জীবন হারাইল।।

আমি মরলাম রণস্থলে , দাদা মরিবে শোকানলে। মরন কালে দাদার সঙ্গে দেখা নাহি হল।।

বলো পবন নন্দন দাদারে বোলো। রণ স্থলের মাঝে লক্ষন জীবন হারাইলাম।।

রামায়ন পালার এই দৃশ্যে রাবনের শক্তিশেল বানের শিকার রামানুজ লক্ষন। লক্ষন কর্তৃক মেঘনাদের অহেতুক হত‍্যায় রাবন আপন পুত্র শোকে পাগল হয়ে শত্রুপক্ষের নায়ক রামের হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করার জন্য একদিকে যেমন সীতা হরন করেছে অন‍্যদিকে রামের সহোদর ভাই লক্ষনকেও বানে নিধন করেছে।  রামায়নের অন‍্যতম এক প্রিয় চরিত্র লক্ষনের মৃত‍্যুর পুণ্য লগ্নকে শিল্পী গানের মধ‍্যে দিয়ে এইভাগে রঘুবংশের এক বেদনাদায়ক করুন ভাবকে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় প্রয়াস হয়ে এসেছেন। এই গানের পটচিত্রে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে, রণস্থলে রাবনের শক্তিশেল বানের আঘাতে লক্ষন ধরাশয়ী হয়ে মৃত্যুর কাতর শয‍্যায় শায়িত হয়। এমতাবস্থায় লক্ষন অনুনয় বিনয় করে পবন নন্দন হনুমানের সন্নিকটে যুদ্ধের সমস্ত ঘটনাবলী তার দাদা রামকে বলার জন্য অনুরোধ করছে। তার মৃত্যুর পুণ‍্যক্ষনে সে এও বুঝে ফেলেছে যে তার এই মৃত্যুর শোকে, দুঃখে মূহ‍্যমান হয়ে বোধ হয় তার তার দাদা শ্রী রাম চন্দ্রেরও মৃত্যু হতে পারে।   

ওঠরে লক্ষন, সুমিত্রা নন্দন। ডাকরে দাদা বলে,জুড়াবে জীবন।।

অযোধ্যাতে গেলে জিজ্ঞাসিবেন মাতা।একা এলে রাম লক্ষন আমার কোথা।।

কি বলে বুঝাব ,মায়ে প্রবোধ দিব।কি বলে সন্তোষিব দুঃখিটারে জীবন।।

দেশে হারাই পিতা ,বনে হারাই সীতা।রণে হারাই আমি প্রাণের ভাই লক্ষন ।।

গানের এই ভাগের বর্ণনায় সুন্দর ভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে ভাই লক্ষনের প্রতি রামের অকৃত্রিম, গভীর ও নিগূঢ় ভাতৃত্ব প্রেম। দাসী মন্থরার কুমন্ত্রণায় মেজ রানী কৈকেয়ী নিজের গর্ভজাত সন্তান ভরতকে সূর্য বংশের রাজা করার উদগ্র নেশায় রঘুবংশের বড়ছেলে রামকে দিয়ে ছিল চৌদ্দ বছরের বনবাস। মেজ রানীর এই সিদ্ধান্তে রাজা দশরথ পাগলের ন‍্যায় হয়ে গেলেও বীর পুত্র রামচন্দ্র সৎ মায়ের দেওয়া এই সিদ্ধান্তকে মাথায় করে বরন করে নেন। সহজ সরল রাম স্বেচ্ছায় রাজত্ব ছেড়ে বনবাসে যাওয়ার ক্ষনে সুমিত্রা নন্দন লক্ষনও দাদার সঙ্গে বনে যাওয়ার জন‍্য অটল অনড় ভাবে নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে। রামের শত নিষেধাজ্ঞা সেদিন লক্ষনকে আটকাতে পারেনি। রাম এমতাবস্থায় নিরূপায় হয়ে সুমিত্রা জননীকে কথা দিয়েছিল যে শত বিপদ আপদ ও  দুঃখ কষ্টে লক্ষনের পাশে  থাকবে এবং তাকে রক্ষা করবে। বনের সামান্য তরুলতার কাঁটার আঁচড় পর্যন্ত তার গায়ে লাগতে দেবেনা।  রামানুজ লক্ষন যখন দুষ্টু রাবনের শক্তিশেল বানের দ্বারা আঘাতে ক্ষতবিক্ষত শরীরে অজ্ঞান অবস্থায় ধূলায় লুটিয়ে পড়েছিল তখন সেই অবস্থা দেখা মাত্র রামের হৃদয়খানি সকরুণ ব‍্যাথায় ও বেদনায় ভরে উঠেছিল। আজ এই মহা বিপদের দিনে সুমিত্রা মাতাকে দেওয়া কথা তার বারবার মনে পড়ছে। স্নেহের প্রিয় ভাই লক্ষন আর ইহলোকে নেই এই কথা মনে পরতেই তার বাহ্যিক বাকশক্তি হারিয়ে গেছে। কৈকেয়ী কর্তৃক রামের বনবাসের খবরে মর্মাহত হয়ে তার কিছুদিনের মধ‍্যে রাজা দশরথ মারা গেলে অন্তর্যামী রাম একথা হৃদয়ান্তরে জেনে ফেলেন। আবার বনবাসে রাবনের ও তার নিশাচর দের ছলনায় তার প্রিয় পত্নী সীতাকেও সে বনমধ‍্যে হারায়। আবার এই গভীর শোকের মধ‍্যেও সে লক্ষনকেও হারিয়েছে। তার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ গুলো একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে। চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষ হলে সে যখন অযোধ‍্যায় ফিরবে তখন কনিষ্ঠ মাতা সুমিত্রা কে সে কি জবাব দেবে। তাই করুন কণ্ঠে ভাই লক্ষনকে পুনঃজীবিত হওয়ার জন‍্য অনুরোধ করছে গানের মধ‍্যে দিয়ে।

আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে, কাঁদে বনলতা। নিস্ঠুর রাবন বুঝল না হায় রামের মনের ব্যাথা।।

নল কাঁদে, নীল কাঁদে, কাঁদে হনুমান।মস্তকে হাত দিয়ে কাঁদে মন্ত্রী জাম্বুবান।।

নদ কাঁদে, নদী কাঁদে, কাঁদে সর্বজন।রামচন্দ্র বসে কাঁদে কোলেতে লক্ষন।।

গানের এই পটচিত্রে আমরা দেখতে পাই রামের ভাই লক্ষনের অকাল মৃত্যুতে শোকাকুল আকাশ, বাতাস, বনের লতাপাতা, নদ, নদী, পাহাড়, পর্বত ও রামভক্ত হনুমান বানরদের হৃদয়খানি। অর্ধাঙ্গিনী সীতার অকাল বিয়োগে রাম যতখানি না ব‍্যাথা পেয়েছে তার চেয়ে শতাধিক বেশী ব‍্যাথায় ব‍্যাথিত হয়েছে রাবনের শক্তিশেল বানে ক্ষতবিক্ষত লক্ষনের অকাল মৃত্যুতে। যে লক্ষন তাদের যুগল মূর্তি কে আজীবন পিতামাতার মতো ভালোবেসে পূজা করে এসেছে।

নীল বর্ণ ফল ফুল, পিঙ্গল বর্ন পাতা।রক্ত বর্ণ ডাঁটা তার স্বর্ণ বর্ণ লতা।।২

গন্ধ মাদন পর্বতে আছে মহানদী।তার কূলে আছে সে মহা ঔষধী।।

রামের ভাতৃত্ববোধের প্রেমের বন্ধন বোধহয় স্বয়ং স্রষ্টার হৃদয়ে করুণা ও দয়ামায়ার সৃষ্টি করেছিল। গানের এই পটচিত্রে আমরা কিস্কিন্দার বানরদের নিঃস্বার্থ সাহায্যের এক সুন্দর মূহুর্ত কে অনুভব করতে পারি। সীতা উদ্ধারের পথ সুগম করার জন্য রাম বানর দলের দুই অধিপতি বলিরাজ ও সুগ্রীপের মধ্যে রামচন্দ্র সুগ্রিবের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে গোপন ভাবে বান নিক্ষেপ করে বলিরাজকে হত‍্যা করেন। সুগ্রীপ বানরদের রাজা স্বরূপ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়। সেই বানর দলের একজন বয়োঃবৃদ্ধ বানর ছিলেন যিনি সারাটি জীবন কবিরাজি ঔষধের চর্চায় নিজেকে সর্বত্র ধ‍্যানমগ্ন রাখতেন। নাম তার সুষেন বদ‍্যি।  

নিম্নে অভিনয়ের মূল পটদৃশ্যের সামান্য অংশ বর্ননা করা হল ; লক্ষনের ধরাশায়ী দেহখানি যখন স্থির, নিশ্চল, মৃতপ্রায়। তার ওই চাঁদ বদন ও দেহটাকে দেখে শ্রী রামচন্দ্র যখন নীরবে রোদন করে চলছেন তখন রামের এহেন করুণ অবস্থায় সুষেন বদ‍্যি নিজেকে আর স্থির না রাখতে পেরে প্রভু শ্রী রামের সন্নিকটে এসে প্রণাম করে বললেন –সুষেন :- প্রভু ঠাকুর লক্ষনের জীবন পুনঃজীবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যদি কাল প্রাতের পূর্বে ওর ওষ্ঠ বদনে মৃত সঞ্জিবনী (বিশল‍্যকরুনী) তরুলতার রসামৃত তথা মহামৃত দেওয়া যায়। তবে ঠাকুর লক্ষন আবার পুনঃজীবন লাভ করতে পারে।

রামচন্দ্র – তবে কোথায় আছে সেই বিশল‍্যকরুনী তরুলতা। যে তরুলতার রসামৃতে আমার ভাইয়ের প্রান বাঁচে। (ব‍্যাকুল ভাবে) বলো বলো সুষেন আর চুপ থেকো না।

সুষেন – কিন্তু, কিন্তু সে মহৌষধ তো যত্রতত্র পাওয়া যায় না প্রভু। গন্ধমাদন পর্বতে সেই মহৌষধীর সম্ভার রয়েছে। যে ঔষধিতে লক্ষন ঠাকুরের প্রাণ বাঁচতে পারে। যেখানে যেতে  একযুগ সময় লাগে। একদিনের মধ‍্যে কে পারবে সেই অসাধ‍্য সাধন করতে। কাল প্রাতের পূর্বে ওই মহৌষধ না আনতে পারলে লক্ষন ঠাকুরের আর প্রাণে বাঁচানো সম্ভব হবে না।

প্রভু শ্রীরামচন্দ্র আবার পুনরায় নীরবে রোদন করতে শুরু করলে হনুমান তা সহ‍্য করতে না পেরে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে এসে বলল – আমি যাব সেই গন্ধমাদন পর্বতে। যেখানে আছে সেই ঠাকুর লক্ষনের প্রানে বাঁচার অমূল্য মহৌষধ। যাত্রা কালে পবন নন্দন হনুমান দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েও রওনা হন, যে যদি আমি এই কাজে সফল হয়ে ফিরতে পারি তবে শ্রীরামচন্দ্র ও আমার এইসব আত্মীয় স্বজনদের সন্নিকটে এই মুখ আমি আবার দেখাবো। আর যদি ব‍্যর্থ হই তবে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে প্রাণ বিসর্জন করব। হনুমানের যাত্রার প্রাগ মূহুর্তে কবিরাজ সুষেন বদ‍্যি এই গানের মধ‍্যে দিয়ে মৃত সঞ্জিবনী তরুলতার রূপ মাধূর্যের গঠন বর্ননা হনুমানকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝাচ্ছেন। এভাবে সধারণ লোকসমাজের মর্ম বেদনা, ভাতৃত্ববোধ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় বহন করছে এইসব লোক রামায়নে। সাধারণ মানুষ বাল্মিকী শ্লোক বা তার আভিজাত্যের পরোয়া করেনা। নিজের কল্পনায় সত্যকে নিজের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে নেয়। সেখানে তার হৃদয়বোধ ও বিবেকের তাড়না অনেক গভীর। সহজ সরল গ্রাম্য জীবন তাই এখনো এই ভাতৃত্বকে সন্মান দেয়। এখনো পরষ্পরের দুঃখে বেদনায় পরষ্পরের পাশে থাকে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র

১। সাক্ষাৎকার – রেখারানী হালদার, পূর্ব কড়ামনুরাজ, মগরাহাট, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।

২। সাক্ষাৎকার – গৌরী হালদার-পূর্ব কামারপুকুরিয়া, মগরাহাট, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।

শিল্পে নান্দনিকতা : দর্শন

লোপামুদ্রা চক্রবর্ত্তী, অতিথি অধ্যাপিকা, মেমরি কলেজ

শিল্প বিষয়টি মানব সভ্যতা সৃষ্টির সাথে সাথে রূপ লাভ করেছে। যতদিন মানব-সভ্যতার প্রকৃত বিকাশ ঘটেনি ততদিন সে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার সাথে লড়াই করেছে শুধুমাত্র জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য কিন্তু যেদিন থেকে মানুষ তার জীবন ধারণের সমস্যা কিছুটা দূর করতে পারলো, সেদিন থেকেই সে জীবন এবং জগতের সৌন্দর্য্যতা সম্পর্কে জ্ঞাত হতে থাকলো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “শিল্প হচ্ছে তাই যা নিছক প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি তাগিদ থেকে মানুষকে চালনা কোরে শিল্প সৃষ্টিতে নিযুক্ত করে”। রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি শিল্প তত্ত্ব সম্পর্কে অনেকটাই যুক্তিযুক্ত সুতরাং বলা যাচ্ছে যে, কোনো সভ্যতার আমরা তখনই দিক্‌-চিহ্ন নির্ণয় করি যখন থেকে মানুষ নানা ভাবে জীবন, জগৎ ও প্রকৃতির মধ্যেকার সৌন্দর্য্য খোঁজার এবং তাকে জীবনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার সাধনায় মেতে ওঠে।

শিল্পের জগৎ এবং শিল্পের বিষয়বস্তু এত বিভিন্ন ও এত বৈচিত্র্যময় যে তাকে বিশেষ একটি কোনো সংজ্ঞা বা বিশেষণের মাধ্যমে হয়তো সঠিকভাবে বোঝানো যায় না। তাই শিল্পের সংজ্ঞা বিষয়ে অনেক মত ও মতান্তর আছে। বিভিন্নভাবে শিল্পের ব্যাখ্যা আছে, বিভিন্নভাবে শিল্প ও সৌন্দর্য্যের সম্পর্ক নির্ণয় করা আছে, বিভিন্ন বিষয়ে যেমন নাটক, গান, কবিতা, ছবি অথবা বৃহত্তর অর্থে শিল্পের নানাবিধ শাখা-প্রশাখার মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন বড় বড় সংগীতজ্ঞ, শিল্প ও কবিদের মধ্যে শিল্পের আদর্শবাদ অথবা প্রয়োজনবাদ নিয়ে বহু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু তারা দুটি বিষয়ে একমত হয়েছেন। প্রথমত, তাঁদের মতানুযায়ী শিল্প হচ্ছে, মানুষের মধ্যে ভাব প্রকাশের যে একটি অবিরত তাগিদ আছে তারই বাহ্যিক রূপায়ণ এবং দ্বিতীয়ত, শিল্প মানুষকে সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের কাছাকাছি নিয়ে যায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাগেশ্বরী প্রবন্ধমালা’ গ্রন্থে শিল্পের বিষয়ে বড় সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। তিঁনি বলেছেন- “মানুষের আদিমতম শিল্পে তার প্রথম জয়যাত্রার আনন্দ ও উৎসাহের প্রভাব এবং তেজ লক্ষ্য করা যায়। জড়তা থেকে মুক্তি দেওয়ার আনন্দ ও ভোগের অধিকার বাড়িয়ে দেওয়া এবং মানুষকে ক্ষমতাবান করে তোলা, রস-সৃষ্টি ও রূপ-সৃষ্টি বিষয়ে এই হ’লো শিল্পের কাজ।” অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তি একজন বড় প্রতিভাবান শিল্পীর অন্তরের কথা এবং তা একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা। এই ছোট্ট বক্তব্য থেকে আমরা শিল্প সম্মন্ধে অনেকগুলি তথ্য ও তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত হই। প্রথমত, শিল্প ও আনন্দ পরস্পর অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত এবং যিনি সৃষ্টিশীল ব্যক্তি তার প্রতিভার মধ্যে সৃষ্টির শুধু উৎসাহই নেই, আছে অমিত তেজ; দ্বিতীয়ত, আমরা জানতে পারি শিল্পের একটি বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। তার বক্তব্য অনুযায়ী শিল্প হচ্ছে জীবন্ত। শিল্প স্থবির নয়, জড় নয়; স্থবিরত্ব বা জড়ত্ব থেকে মুক্তিলাভেই শিল্পের সার্থকতা। আধুনিক যুগে বহু ইউরোপীয় পণ্ডিত এই ভারতীয় শিল্প তত্ত্বের বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ত্ব দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত শিল্প সমালোচক Roger Fry বলেছেন – “Art demands the most complete detachment from the meanings and implications of appearances.” অর্থ্যাৎ শিল্পীর কাছে তিনি একটি নিরপেক্ষ ও নির্বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী আশা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গী Objective শিল্প সৃষ্টির পক্ষে প্রভুত সহায়ক। ভারতীয় ধারণাতেও এই নির্বিশেষ ও নিরপেক্ষ বক্তব্য বহু আগেই ঘোষিত হয়েছে। শুধুমাত্র তাই না, শিল্প সৃষ্টি কার্যে শিল্পী যে এক ধরণের বৈরাগ্য আনা প্রয়োজন সেই কথাও ভারতীয় এবং ইউরোপীয় উভয়তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে জানা যাচ্ছে।

বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু বলেছেন যে, শিল্প হলো ‘বিশেষ সৃষ্টি’, তা স্বভাবের অনুকরণ নয়। শিল্প হলো শিল্পীর ধ্যান বা চিন্তা। উদাহরণ স্বরূপ, ভারতবর্ষে আমরা ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি দেখে আসছি; বহু ভাস্কর্যের খোদাই করা মূর্তি। যেখানে সেই মূর্তি সঠিক শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সেখানে আমরা খুব সহজেই আন্দাজ করতে পারি যে শিল্পীর মানসিক গঠনে এবং শিল্প-সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মুহুর্তে বুদ্ধের ধ্যান গম্ভীর প্রকাশকে তিনি অবশ্যই উপলব্ধি করেছেন। নাহলে, বুদ্ধের ধ্যানী মূর্তি সার্থকতার সাথে তিনি আমাদের উপহার দিতে পারতেন না। দর্শক যখন এই ধ্যানী বুদ্ধ মূর্তি দেখার সময় কিংবা পরবর্তী সময়ে এক বিশেষ চেতনার দ্বারা আচ্ছন্ন হন, তখনই শুরু হয় নান্দনিক প্রক্রিয়া। তাই আমরা দেখতে পাই যে, শিল্পতত্ত্ব এবং নন্দনতত্ত্ব একটি অপরের পরিপূরক কিন্তু যদিও সমার্থক নয়। শিল্পী যে বুদ্ধমূর্তি কল্পনা করে তাকে রূপদান করেছেন তা কোনো নির্দিষ্ট বুদ্ধ নয়। একটি নিরপেক্ষ ও নির্বিশেষ ধারণা যা একদিকে ধ্যানগম্ভীর ভাবের প্রতিরূপ, এমন কল্পনার মাধ্যমেই ধ্যানীবুদ্ধের লীলাকে শিল্পী ধরে রেখেছেন। দর্শক, শ্রোতা বা পাঠক যখন ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি প্রত্যক্ষ করছেন, শকুন্তলার পতিগৃহে যাওয়ার সময় কণ্বমুনির উপদেশ শুনছেন অথবা Hamlate-এর সেই সুবিখ্যাত স্বগোতোক্তি “to  be  or  not  to  be” ইত্যাদি নিজকণ্ঠে স্থিরচিত্তে আবৃত্তি করছেন অথবা ভারতীয় সংগীতের ধ্রুপদাঙ্গ আলাপ শুনছেন ভৈরবী রাগের মধ্য দিয়ে তখন তাদের দিক থেকেও এক ধরণের ‘কল্পনা-প্রতিভার’প্রয়োজন এই সব শিল্পকলার মধ্যে দিয়ে অনির্বচনীয় ‘রস’-কে হৃদয়ে এবং মানসিক ভাবে ধারণ করার জন্য। শ্রোতা বা পাঠক বা দর্শকের কাছে যখন কোনো শিল্পকলা উপস্থাপিত হয় তখনই শুরু হয় শিল্পের দ্বিতীয় পর্যায় অর্থ্যাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে হয় ‘শিল্প-সৃষ্টি’ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয় ‘রস-সৃষ্টি’—তখন শিল্পকলা আর শিল্পীর নিজস্ব ভাণ্ডারে না থেকে সমগ্র কাছে ছড়িয়ে যায়।

ভারতীয় রসবাদীগণ সুন্দরকে রস, ধ্বনি এবং ব্যঞ্জনার মধ্যে খুঁজেছেন; পাশ্চাত্য তাত্ত্বিকগণ শিল্পকে দর্শন, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্রের মধ্য দিয়ে খুঁজেছেন আর শিল্প-রসিক হচ্ছেন একদিকে শিল্প-সৃষ্টি ও অন্যদিকে সৌন্দর্য্য খোঁজার মধ্যবর্তী সেতুবন্ধ। সৌন্দর্য্য শাস্ত্রকে I.A. Richards বলেছেন- ‘It  is  a  value’;  কোলরিজ এবং রবীন্দ্রনাথ সুন্দরকে বলেছেন- ‘রুচির প্রকাশ’; আর সর্বপ্রথম Baumgarten ‘Aesthetics’ শব্দটিকে ব্যবহার করে নন্দনতত্ত্বের বিষয়টিকে সৌন্দর্য্য-চেতনার সমার্থক অর্থে ব্যবহার করেছেন।

১। ‘কল্পনা-প্রতিভা’ শব্দটি কবি জীবনানন্দ দাস সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছেন কাব্য-সৃষ্টির সময়।

তাহলে আমরা বলতে পারি যে, প্রথম পর্যায়ে ঘটনাবলী শিল্পতত্ত্বকে কেন্দ্র করে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘটনাবলী নন্দনতত্ত্বকে কেন্দ্র করে। এইভাবেই শিল্পশাস্ত্র ও সৌন্দর্য্য-চেতনা তথা নন্দনতত্ত্ব পরস্পরের হাত ধরে একটি পরিপূর্ণ অখণ্ড সৃষ্টির আনন্দতত্ত্ব মানব-সমাজকে উপহার দিয়েছে। এখন শিল্পশাস্ত্র বিষয়টি সম্পর্কে বলতে গেলে বলাই বাহুল্য যে শিল্প-সৃষ্টির প্রক্রিয়া, শিল্প-বস্তু, শিল্পী এবং শিল্পীর বিভিন্ন মানসিক অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনা। অন্যদিকে নন্দনতত্ত্ব বিষয়টি শিল্প-দর্শন সম্মন্ধিত অথবা শিল্প-আস্বাদনের ফলস্বরূপ যে রস বা আনন্দ-চেতনা দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় তাকেই কেন্দ্র করে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। এখানে শিল্প অর্থে এর বৃহত্তর পটভূমিকে কল্পনা করা হয়েছে অর্থ্যাৎ সংগীত, নৃত্য, নাটক, কাব্য, সাহিত্য, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য প্রভৃতি ক্রিয়াত্মক শিল্প-কলা সমস্তই এর অন্তর্ভূক্ত।

শিল্পের যে প্রধান ধারাগুলি আছে প্রথমে সেইগুলি সম্পর্কে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন যার মাধ্যমে আমরা শিল্পের একটি সাধারণীকৃত রূপ খুঁজে পাবো। প্রথম বিষয়টি নেবো চিত্রকলা বা অঙ্কন শিল্প- এই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত “ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ” গ্রন্থে একটি প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। এই শ্লোকটি বাৎস্যায়ন রচিত কামসূত্রের টীকাকার যশোধর পণ্ডিত কর্তৃক রচিত; এখানে আলেখ্য হিসেবে বর্ণিত হলো-

“রূপভেদাঃ প্রমাণানি ভাবলাবণ্যযোজনম্‌।

সাদৃশ্যং বর্ণিকাভঙ্গ ইতি চিত্রং ষড়ঙ্গকম্‌।।”

অর্থ্যাৎ চিত্রশিল্পের যে ছয়টি অঙ্গ আছে যথা- রূপভেদ, প্রমাণ, ভাব, লাবণ্য, সাদৃশ্য এবং বর্ণিকাভঙ্গ এই ছয়টি অঙ্গ বিশেষরূপে সজ্জিত হলে একটি চিত্রকলা আমাদের কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গ্রন্থে আরো জানা যায় যে তিনি ঐতিহ্যময় জাপানী শিল্পরীতিকেও অত্যন্ত মর্যাদা দিয়েছেন অর্থ্যাৎ জাপানী শিল্পরীতির যে সহজ-সরল সৌন্দর্য্য যেমন- একটি অতিসামান্য তুলির টানে যে নিরাভরণ সুন্দরের সৃষ্টি জাপানী শিল্পীরা করেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠকুর তাকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। কাব্য বা কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই ভিক্টোরীয় যুগের প্রখ্যাত কবি ও সমালোচক Mathew  Arnnold  বলেছেন- “Poetry  is  the  criticism  of  life”.  এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারছি যে কবিতা বা কাব্য মানুষের জীবনবোধের সাথে শুধু অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িতই নয়, কাব্য বা কবিতা হচ্ছে জীবণের এক বিশেষ ধরণের সম-আলোচনা বিশেষ অর্থ্যাৎ কবিতা বা কাব্যে জীবণকে শুধুমাত্র দেখে তার হুবহু প্রকাশ নয় বরং কবি বা শিল্পী জীবনকে যে ভাবে দেখতে চান, জীবনের নিগূঢ় অন্তর্নিহিত অর্থ যেভাবে খুঁজে পেলে তার মন জীবনসত্যকে উপলব্ধি করতে পারবে সেইভাবেই জীবনকে কাব্যের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান করে তোলেন। সাহিত্যের প্রসঙ্গে আমরা কবিগুরুর কথা আলোচনা করতে পারি।

২। বাগেশ্বরী প্রবন্ধমালা— অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কবিগুরু ‘সহিত’ শব্দটির উপর বিশেষভাবে জোড় দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে- মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পারিক সম্পর্কই হলো সাহিত্য সৃষ্টির মূল। তিনি আরো বলেছেন যে- “আমরা যাকে বলি সাহিত্য, বলি ললিতকলা, তার লক্ষ্য এই উপলব্ধির আনন্দ, বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর একাত্ম হয়ে যাওয়ার আনন্দ। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশে শিল্পকে বাস্তববাদীতার সঙ্গে একাত্ম করে দেখানো হয়ে থাকে। George Lukace-এর মন্তব্য এই প্রসঙ্গে বিশেষ স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন যে- “ Art  is  one  of  the  forms  through  which  man  can  reflect  or  grasp  reality.”

এবার আমাদের শিল্পকলার আরো দুটি প্রধান শাখা নাটক ও সংগীত বিষয়ে জানা প্রয়োজন। আচার্য ভরত নাট্যশাস্ত্র নামক সুবৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন এবং সেই গ্রন্থে নাট্যচর্চার বিশদ-বিশ্লেষণ করে নাটককে তিনি ‘পঞ্চমবেদ’ নামে অভিহিত করেছেন। এই ‘পঞ্চমবেদ’ নামকরণের পিছনে পৌরাণিক একটি কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে। কাহিনীটির সংক্ষিপ্তসার হলো এই যে—একসময় ব্রহ্মার কাছে দেবতাগণ নিবেদন করলেন যে ব্রহ্মা এমন একটি বেদ রচনা করুন যা সর্বসাধারণ্যে জ্ঞাত হবে এবং যা দৃশ্য ও শ্রাব্য-ও হবে। এই নিবেদন শুনে ব্রহ্মা এমন একটি বেদ রচনা করলেন যা সর্বতোভাবে লোকাশ্রয়ী, যা ‘পঞ্চমবেদ’ নামে পরিচিত এবং এই ‘পঞ্চমবেদ’-ই নাট্যবেদ যা সর্বস্তরের লোকের মনোরঞ্জন করায় সক্ষম। আচার্য ভরত যে শ্লোকে এই নাট্যসৃষ্টির কথা বলেছেন তাতে কয়েকটি বিষয় পরিস্কার ভাবে লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত তিনি বলেছেন যে, ত্রিলোকের অধিবাসীদের জন্য এই নাট্যশিল্প-কলা; দ্বিতীয়ত বলেছেন, নাট্য হচ্ছে লোকবৃত্তির অনুকরণ অর্থ্যাৎ ব্যক্তি-মানুষের সামাজিক ক্রিয়া-কর্মের প্রতিরূপ; তৃতীয়ত উত্তম, মধ্যম এবং অধম সর্বস্তরের মানুষ নাট্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে; চতুর্থত, এই নাট্য হচ্ছে মানব মনের ‘ভাবানুকীর্তন’। অপর একটি শ্লোকে তিনি বলেছেন যে-            

“ন তদ্‌জ্ঞানং ন তচ্ছিল্পং ন সা বিদ্যা ন সা কলা।

ন তৎ কর্মং ন যোগোহসৌ নাটকে যন্নদৃশ্যতে।।”

অর্থ্যাৎ এমন কিছু বাস্তবে নেই যা নাট্যশিল্পে নিহিত নেই বা অধিগত হবেনা। নাট্যশিল্পের এমন সার্বজনীন ও গণতান্ত্রিক ধারণা এযুগের পক্ষেও রীতিমতো আধুনিক মনে হবে। সংগীত বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে গেলে প্রথমে প্রাচীন বর্ণিত কিছু কথা আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রথমত, আমরা সংগীতকে নাদবিদ্যা বলে জানি। ‘বৃহদ্দেশী’ গ্রন্থ রচয়িতা মতঙ্গমুনি এই নাদকে ব্রহ্মস্বরূপের সাথে একাত্ম করে দেখেছেন। সুতরাং সেই দিক থেকে বিচার করে আমরা সংগীতকে ব্রহ্মবিদ্যা বলে থাকি। আবার ক্রিয়াত্মক দিক্‌ থেকে সংগীতকে আমরা নৃত্য, গীত ও বাদ্যের মিলিত শিল্পজনিত সমাহার রূপেও আখ্যা দিতে পারি। তাহলে দেখা যাচ্ছে গীতের সাথে বাদ্য ও নৃত্য এই দুটি শিল্পও জড়িত। নৃত্যের মধ্যে দিয়ে অভিনয়ের ভাব, ছন্দোরূপ ও লাস্যরূপ এই তিনটিই আমরা পাচ্ছি এবং বাদ্যের মাধ্যমে লয় ও মাত্রার আশ্রয় গ্রহণ করেছি। এই ব্যাখ্যাকেও আমরা Aesthetics  Approach বলতে পারি।

প্রাচীন ভারতীয় সংগীতশাস্ত্র পড়লে আমরা দেখতে পাই সংগীতের ভিত্তি যে নাদের মধ্যে নিহিত, সেই নাদের সম্পূর্ণ দার্শনিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দিতে মতঙ্গমুনি তাঁর ‘বৃহদ্দেশী’ গ্রন্থে নাদের সম্পূর্ণ দার্শনিক ব্যাখ্যা করেছেন যাকে ভাববাদী প্রত্যয় বলে চিহ্নিত করা যায়। সুতরাং সংগীতকে আমরা এমন একটি বৃহৎ শিল্প-পরিধির মধ্যে দেখতে পাই যেখানে কলা, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদির সাথে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার সম্মিলিত রূপ প্রকাশিত হয়েছে।

প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের বক্তব্য অনুসারে—“শিল্প-শাস্ত্র সমূহের দ্বারা যজমান নিজের আত্মাকে ছন্দোময় করিয়া যথার্থ যে সংস্কৃতি তাই লাভ করেন এবং প্রাণের সহিত বাক্যকে, চক্ষুর সহিত মনকে,  শ্রোত্রের (কর্ণ) সহিত আত্মাকে মিলিত করেন।” এই ধারণা ঋষিগণ আধ্যাত্ম-চেতনার অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তাই বলে এই নয় যে এর সাথে লোকায়ত চিন্তা সম্পৃক্ত ছিলোনা। ভারতীয় ভাস্কর্য্য লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে ভারতীয় সমাজ ও তার বৈচিত্রময় ইতিহাসের প্রতিফলন কিভাবে তার মধ্যে দেখা গেছে। প্রেমের শরীরি অস্তিত্ত্বকে বা প্রজননের বিষয়টিকেও যে কত সহজ-সরল ভাবে বাস্তবতা এবং সৌন্দর্য্যের সাথে দেখেছেন ভারতীয় শিল্পীরা তার প্রমাণ মন্দিরগাত্রের অসংখ্য অজস্র মৈথুনচিত্র। পাশ্চাত্য শিল্প-রসিকগণ ভারতীয় শিল্পকে অনেক সময় সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি এবং সেই কারণের নীহার রঞ্জন রায় সম্ভবতঃ মন্তব্য করেছেন— “it  was  prejudiced  for  long  by  what  seems  to  me  a  wrong  approach”.  আবার রবীন্দ্রনাথও শিল্পের সংজ্ঞা বিচার করতে গিয়ে কল্পনাকেই প্রধান স্থান দিয়েছেন।

দর্শন ও শিল্প সম্মন্ধে আলোচনা করতে গেলে এদের মধ্যেকার সম্মন্ধটুকু আগে আমাদের নির্ণয় করা প্রয়োজন। দর্শন ও শিল্প উভয়ে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে অনুস্যূত। এই পারস্পারিক মিলটুকু দুটি অর্থে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, শিল্প এবং দর্শন এই দুটিকেই সৃষ্টি ও নির্মাণ বলা চলে। চিত্রশিল্পী যখন ক্যানভাসের উপর ছবি আঁকেন তখন তিনি সেই ক্যানভাসের উপর একটি ক্ষুদ্র জগতের সৃষ্টি করেন। রং, তুলি, রেখা প্রভৃতি দ্বারা তিনি মনের ভাবকে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় মেতে ওঠেন অর্থ্যাৎ “আপন মনের মাধুরী মিশায়ে” একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আলো, রেখা, রং তার শিল্পকর্মের উপাদান। কবি তার কাব্যে অথবা সংগীত শিল্পী তার সংগীতে অতীতে দেখা অনেক ঘটনার স্মৃতি বা অতীতে শোনা কোনো রাগ-রাগিণীর রেশটুকু যখন তাদের শিল্পে যুক্ত করেন তখন সেই কাব্য বা সংগীত হয়ে ওঠে অনবদ্য। গায়ক স্বরগ্রামের অনন্ত সীমাহীন বৈচিত্রটুকু নিজের সংগীতের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তখনই জন্ম নেয় Sonata  বা Symphony। দ্বিতীয়ত, শিল্পীর মতো দার্শনিকও সবটুকু গ্রহণ না করে প্রয়োজন মতো অংশ নিয়ে নিজের আপন জগতটুকু নির্মাণ করেন। মানুষের অভিজ্ঞতার অসংখ্য, সীমাহীন ইন্দ্রিয়পাত্তের মধ্যে থেকে তিনি বাছাই করা

৩। An  Approach  to  Indian  Art.

গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীকে নির্বাচন করেন এবং সেই ঘটনাবলী সাজানোর মৌল নীতিগুলির মধ্য থেকে কতগুলো নীতি বাছাই করে নেন। এই বাছাই করা নীতির মাধ্যমে তিনি তার দর্শন-সংস্থা গড়ে তোলেন; তার নীতি সংস্থার গঠন গড়েন; জীবন, জগৎ ও ভাগ্য সম্মন্ধে নিজের চিন্তা থেকে একটি সামগ্রিক দর্শনচিন্তার রূপ দান করেন। আমরা এবং অনেক শিল্পীরাও মনে করেন যে, শিল্পীরা শিল্প-উপাদান এবং ঘটনাবলীকে নির্বাচন করে ভাবাবেগের দ্বারা চালিত হয়ে এদের একত্রিত শিল্প রূপটুকু সৃষ্টি করেন। অবশ্য শিল্পীর এই হৃদয়াবেগ বিবেচনার দ্বারা পরিশীলিত এবং একজন দার্শনিকও এই একই ধরণের কাজ করেন। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, একজন শিল্পী এবং একজন দার্শনিক মানব জীবন ও জগতকে নিয়ে একই ধরণের কারবার করেন। উভয়ে একই ধরণের প্রাকৃতিক সত্যকে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেন, তাদের উভয়ের মধ্যে রয়েছে একটি গভীর ধ্যানমূর্তি এবং শিল্প যে দর্শনের সাথে একই আসনে আসীন সে কথা গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের উক্তির মাধ্যমে জানা যাবে যে- “দর্শন হলো একপ্রকার সূক্ষ্ম-সংগীত”। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শিল্পের সাথে দর্শনের একটি ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। সেই যোগসূত্র কখনও প্রত্যক্ষ এবং কখনও পরোক্ষ। বেনেদাত্তো ক্রোচের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে খুবই স্মরনীয় এবং সেই সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন উক্তি থেকে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে ক্রোচের শিল্প সম্মন্ধে দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা ও নান্দনিক ধারণা যে কতখানি পরিব্যাপ্ত এবং বিস্তৃত ছিলো। উক্তিটি হলো— “The  most  lofty  manifestations ,  the  summits  of  intellectual  and  of  intuitive  knowledge  shining  from  afar,  are  called  as  we  know,  Art  and  Science.  Art  and  Science  then, are  different  yet  linked  together , they  meet  on  one  side, which  is  the  aesthetic  side.”

তাহলে আমরা বলতে পারি যে একজন দার্শনিক শিল্পকে অথবা একজন শিল্পী দর্শনকে কখনও ন্যায়সঙ্গত ভাবে উপেক্ষা করতে পারেননা। দার্শনিক সামগ্রিক চিন্তার আশ্রয় নিয়ে যে বিচারটুকুর অনুধাবনে প্রত্যহ যত্নবান এবং যে প্রজ্ঞাটুকুকে তিনি আবিস্কার করেন এই সৃষ্টির মধ্যে, একজন শিল্পীও তাকেই খুঁজে ফিরেছেন তার নিজের সৃষ্টির ছোট্ট ভুবনে নিজস্ব শিল্প উপকরণটুকুকে আশ্রয় করে। শিল্পীর সৃষ্টির জগতে আমরা দার্শনিকের চিন্তা-শৃঙ্খলার মূর্তি দেখি। শিল্প দার্শনিকগণের সযত্ন-দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কারণ দার্শনিক যে শৃঙ্খলাটুকু প্রদর্শন করার জন্য যত্নবান, শিল্পীর শিল্প-কর্মে তারই প্রতিষ্ঠা; বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড চরাচরে যে প্রজ্ঞার নিদর্শন রয়েছে শিল্প তারই অনুকার। এই প্রসঙ্গে আমরা দেখি গ্রীক দার্শনিক প্লেটো যদিও বলেছিলেন “Art  is  doubly  removed  from  reality”  অর্থাৎ শিল্প হচ্ছে অনুকরণের নিছক অনুকরণ মাত্র কিন্তু প্লেটোর প্রত্যক্ষ শিষ্য অ্যারিস্টটল reality  বলতে অন্য একটি বক্তব্য দাঁড় করিয়েছেন। Reality  প্রসঙ্গে তিঁনি বস্তুর ‘বিশেষরূপ’-কে মনে করেছেন অর্থ্যাৎ reality-র ক্ষেত্রে সামান্যীকরণের পরিবর্তে ‘বিশেষ’-এর নির্দিষ্ট এবং প্রতিভাত রূপকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শিল্প ও সত্যের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক সম্মন্ধেও তিঁনি প্লেটোর থেকে ভিন্ন ধারণা পোষণ করতেন। প্লেটো শিল্পকে অনেকটাই মিথ্যার জগৎ মনে করতেন কিন্তু অ্যারিস্টটল শিল্পকে সত্যের আধার-রূপ বলেছেন অর্থ্যাৎ শিল্প-বস্তুর মধ্য দিয়ে আমরা জীবনের এমনকিছু শাশ্বত অথচ নির্দিষ্ট মূল্যবোধে পৌঁছই যা আমাদের সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে কবি Keats-এর ‘Ode  on  a  Grecian  Urn’ নামক কবিতাটি মনে করা যেতে পারে। গ্রীসের সেই শিল্প-কর্মটির মধ্যে দিয়ে Keats  শিল্পের চিরন্তন রহস্য বুঝতে পেরেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিঁনি এই সত্যে পৌঁছান যে, সত্য ও সুন্দর সমাত্মক। সুতরাং অ্যারিস্টটল প্রসঙ্গে আমরা শিল্পকে যে সত্যের আধার মনে করেছি, Keats-এর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেই উক্তি সমর্থিত হয়। অ্যারিস্টটল আমাদের কাছে- শিল্প মানুষের কাছে কি ধারণা অথবা কি ধরণের অবস্থার সঞ্চার করে- সে বিষয়ে সুন্দর একটি তত্ত্ব উপহার দিয়েছেন। যেমন- কোনো দর্শক নাটক দেখাকালীন নাটকের ঘটনাবলী, চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাতে এমনকি যাকে আমরা বলে থাকি অতি-নাটকীয় ঘটনা, সেই সমস্ত ঘটনাবলী দর্শকের মনে প্রচণ্ড আলোরণ সৃষ্টি করে যা থেকে শিল্প ও শিল্পের দৃশ্যরূপ সম্পর্কে দর্শকের মনে ভীষণভাবে অভিঘাতের সৃষ্টি হয়। গ্রীক ভাষায় এই তত্ত্বকে অ্যারিস্টটল ‘Katharsis’ নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে সংসারে অনেক অতিরঞ্জিত ঘটনা ঘটে যা নাটকেও প্রকাশ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু নাট্যকার যখন তাকে শিল্প-রূপ দেবেন তখন তাতে আবেগ সঞ্চারিত নিশ্চই হবে, বিয়োগান্ত নাটকে দর্শকের মন দ্রবীভূত হবে তা সত্ত্বেও নাট্যকার শেষ পর্যন্ত দর্শককে এমন এক জগতে নিয়ে যাবেন যেখানে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা এবং বিয়োগব্যাথার স্তর অতিক্রম করে দর্শকের মনের মধ্যেকার আলোরণ পরিশেষে শান্ত হবে এবং জগত সংসারকে এক স্বচ্ছ ও মোহমুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম হবে। ইংরেজ কবি John Milton  তাঁর ‘Samson Agonistes’ নাটকের শেষে বলেছেন, দর্শকের মনে যেন এই আবেগই সঞ্চারিত হয় যার স্বরূপ ‘Calm  of  mind  all  passion  spent’Milton-এর এই সুন্দর বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা অ্যারিস্টটলের ‘Katharsis’-এই তত্ত্বটি অনুধাবন করতে সক্ষম হই। অ্যারিস্টটল শিল্প সম্মন্ধে বলতে গিয়ে আরো বলেছেন যে— “A  beautiful  objects  depends  on  magnitude  and  order”  ‘Magnitude’ বলতে আমরা শিল্পের ভাব-সম্পদের গভীর তত্ত্বকে বুঝি এবং ‘Order’ বলতে বুঝি পরিমিতি, সামঞ্জস্য এবং রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন ‘সংযম’ তাই বুঝি। সৌন্দর্য্যস্বরূপ বলতে কবিগুরু বলেছেন— “The  beautiful  is  that  good  which  is  pleasant  because  it  is  good”  অর্থ্যাৎ সৌন্দর্য্যকে তিঁনি সম্পূর্ণরূপে বিষয়-নিরপেক্ষ সত্ত্বা হিসেবে দেখেননি। তিঁনি ‘Goodness’-এর কথা বলেছেন এবং মানব ও মনুষ্য-সমাজের মঙ্গলের কথাও শিল্পের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন।

শিল্প হল অপ্রয়োজনের প্রয়োজন। শিল্পের ক্ষেত্রে নিয়ম কানুনের বাঁধা-ধরা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন। শিল্পীর সৃজনশীল আত্মা কোনো বন্ধন মানে না, কোনোরকম শৃঙ্খল-নিয়ম-কানুন মানে না। শিল্প নিজের তালেই নেচে বেড়ায়, তাই সে মুক্ত জীবনানন্দ। অবনঠাকুরের মতে এই প্রয়োজনটুকু হচ্ছে শিল্পের আন্তর প্রয়োজন। রূপকার বিশ্বপ্রকৃতির এই অধরা রূপকে রূপের আধারে ধরার জন্য একটির পর একটি সৃষ্টি করেন এই প্রয়োজনের তাগিদে। এই হল শিল্পীর লীলা। মানুষ যেখানে বন্ধনমুক্ত সেখানে শিল্প ভগবান, সে পরমব্রহ্ম। শিল্প হল মানুষের চিন্ময়ী শক্তির লীলারূপ।  শিল্পী পরম সুন্দরের হঠাৎ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যে আনন্দ অনুভব করে থাকেন তা তাঁর রূপ তৃষ্ণাকে না কমিয়ে উত্তোরোত্তর বাড়িয়ে দেয়।      

পরিশেষে তাহলে আমরা দেখতে পাই যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে শিল্প এবং দর্শন বিষয়দুটি নিয়ে আবহমান আলোচনা চলেছে। শিল্পী, শিল্প-সমালোচকগণ এবং সাধারণ শ্রোতা বা দর্শকগণও শিল্পের দার্শনিকতা ও নান্দনিকতা নিয়ে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এর থেকে একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিস্কার হয় যে, শিল্পের মধ্যে এমনকিছু সাধারণীকৃত রূপ-সৃষ্টি আছে যা সমগ্র মানব-সমাজকে প্রাণোচ্ছল তথা প্রাণচঞ্চল করে তোলে। প্রাচীনযুগে আদিম অসভ্য জাতি থেকে আধুনিক যুগে অতি সুসভ্য সংস্কৃতি সম্পন্ন জাতি প্রত্যেকে শিল্পের মধ্যেকার দর্শনকে উপলব্ধি করে শিল্পকে ভালোবেসেছেন, শিল্প-চর্চা করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি যে, অত্যাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো রুচিসম্মত গৃহস্থের বসার ঘরে ঢুকলে যেমন একটা মার্জিত, পরিশীলিত সংস্কৃতির ছাপ পরিলক্ষিত হয় তেমনই অশিক্ষিত, অপরিশীলিত গ্রাম্য আদিবাসী পল্লীতে ঢুকলেও দেখা যাবে যে তাদের মেয়েদের বেণীবন্ধে ফুলের গুচ্ছ। মাঠ থেকে ফেরার পথে একে অপরের হাতে হাত রেখে একসাথে গান গাইতে গাইতে তারা ঘরে ফিরছে। আমার মনে হয় কোনো শিল্প-রসিকের কাছে এখানে তথাকথিত শিক্ষা এবং অশিক্ষার কোনো প্রভেদ থাকা উচিত নয়। রসিক দর্শকের উচিত তার শিল্প-দৃষ্টি দিয়ে এই যূথবদ্ধ গ্রাম্য রমণীকুলকে দেখা ও তাতে আনন্দ লাভ করা। এখানে সূর্যাস্তের সময় এই দলবদ্ধ গ্রাম্য রমণীদের ঘরে ফেরার ছন্দ বিশ্ব-প্রকৃতির ছন্দের সাথে কোথায় যেন একসূত্রে বাঁধা আছে, যা আমাদের শহরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রেক্ষাগৃহে বসে কখনওই সুসংস্কৃত নৃত্য-ভঙ্গীমায় অনুভব করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমারা অদ্ভুতভাবে উপলব্ধি করতে পারছি যে, শিল্পের কাছে জাতবিচার ও দেশবিচার কোনোটাই নেই। এমনকি সুপ্রাচীন ‘মায়া’ সভ্যতার অসামান্য শিল্প-নিদর্শন বা বৈদিক যুগে উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত স্থানস্বরে সাম্‌বেদের মন্ত্রপাঠ আমাদের মনে এলে এক তীব্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সময় যেন কোনো বাধা নয়, দেশ-কাল নিরপেক্ষ অথবা দেশ-কাল-অতীতের আবেদন। সেই জন্যই কবিগুরুর ভাষায় —

“আজি অকারণ বাতাসে বাতাসে যুগান্তরের সুর ভেসে আসে,

মর্মরস্বরে বনের ঘুচিল মনের ভার।

যেমনই ভাঙিল বাণীর বন্ধ উচ্ছ্বসি ওঠে নূতন ছন্দ,

সুরের সাহসে আপনি চকিত বীণার তার

অজানা খনির নূতন মণীর গেঁথেছি হার……” ।।

৪। আর্ট – অন্নদাশঙ্কর রায়।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী

১। ভট্টাচার্য অরূণ – নন্দনতত্ত্বের সূত্র; বলাকা পুস্তক বিপণি(১৯৮১)।

২। বন্দ্যোপাধ্যায় হিরণ্ময় – বিশ্ব জিজ্ঞাসা; রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়(১৯৭৫)।

৩। নন্দী কুমার সুধীর – নন্দনতত্ত্ব; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ(১৯৭৯)।

৪। রায় অন্নদাশঙ্কর – এল্যায়েড অফসেট(পুনশ্চ সংস্করণ, ১৯৮৯)।

৫। চৌধুরী কান্তি বিদ্যুৎ – যোগপ্রভা প্রকাশনী(২০১১)।

দক্ষিনের বারান্দায় অবন ঠাকুর

দক্ষিনের বারান্দায় অবন ঠাকুর

জয়ন্তী মণ্ডল   


                                                              
পাঁচ নম্বর জোড়াসাঁকো বৈঠকখানা বাড়ির দক্ষিণের বারান্দা। বারান্দায় কালো বর্মা কাঠের নকশা করা চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হাতে দিসতে খাতা। একমনে যাত্রার পালা লিখছেন। অকালমৃতা কন্যা কুমুদিনী পুত্র মোহনলাল ধরেছে নাটক লিখে দিতে হবে। ওরা নাটক করবে। তাই দাদামশায় নিজের লেখা ‘এসপার ওসপার’ নাটককে যাত্রার পালায় লিখে দিচ্ছেন।                                                           
         পালাটা লেখার পরই শুরু করে দিলেন মহড়া। ক’দিন মহড়া চলার পর তা’ সাড়ম্বরে অভিনয় হল দোতলার হলঘরে। হ্যাজাকের আলোয়। পর পর তিনদিন অভিনয়। শেষ দিন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এলেন যাত্রা দেখতে। যাবার সময় হেসে বলে গেলেন, ‘এ জিনিস অবন ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না।’
         এরপর ধরলেন হিতোপদেশের গল্পগুলোকে। প্রথমেই হিতোপদেশের গল্প নিয়ে পালা বাঁধলেন ‘উড়নচন্ডীর পালা’। তারপর চলল কথামালা, পঞ্চতন্ত্র, ঈশপের গল্প নিয়ে  যাত্রার পালা বাঁধা,গান রচনা।
         সেই সময় রাজশেখর বসুর গল্প গুলো প্রকাশ হচ্ছে। জনপ্রিয়তাও বেশ। প্রথমেই তিনি রাজশেখর বসুর অর্থাৎ পরশুরামের ‘লম্বকর্ন’কে পালায় রূপ দিলেন। তারপর ‘জাবালি’। এক এক করে কতকগুলো গল্প যাত্রা পালায় বেঁধে ফেললেন। কথায়,গানে গল্পগুলো পালায় হয়ে উঠল অনবদ্য। একটা করে পালা লেখেন আর নাতি নাতনিদের শোনান। নাতি নাতনীদেরও খুব উৎসাহ। এরকম বেশ চলছে। কেউ ছবি আঁকার কথা বললে অবনীন্দ্রনাথ বিরক্ত। অমনি মুখ গম্ভীর। একদিন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘অবন তোমার হলটা কী ?

অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কী জানো রবিকা, এখন যা ইচ্ছে করে তাই এঁকে ফেলতে পারি। সেই জন্যেই চিত্রকর্মে আর মন বসেনা। নতুন খেলার জন্যে মন ব্যস্ত।’

         এরকম করে দিন যায়। মাস যায়। বছর গড়ায়। যাত্রা পালা লিখে, ঢোল বাজিয়ে বাড়ির ছোট বড় সকলকে নিয়ে অভিনয় করেন অবনীন্দ্রনাথ।
         এবার ঝুঁকলেন রামায়ণের কাহিনীর দিকে। নিজের সংগ্রহের রামায়ণ বইটা ছেঁড়া। খাস চাকর রাধুকে দিয়ে ছেঁড়া রামায়ণটা বাঁধিয়ে আনালেন। রামায়ণ কাহিনী নিয়ে পালা লিখছেন ঠিকই। তবে  মনোমত হয় না। লেখেন আবার ছিঁড়ে ফেলেন। কাহিনীকে পয়ারের ছাঁদ থেকে বের করতে না পারলে যে যাত্রাপালা জমছে না। অনেক কাটছাঁট করে পয়ারকে বেঁধে ফেললেন গদ্যে। ঠিক পুঁথির মতো করে। এবার সেই পুঁথির রামায়ণ কাহিনী যাত্রা পালায় গড়গড়িয়ে চলল।
         যাত্রা, নাটক, রূপকথার গল্প,ভূত-পেত্নীর গল্প আরো কত কী ! লিখছেন, কাটছেন, অভিনয় করছেন এসব নিয়ে মেতে আছেন প্রায় এক যুগ। রাধু প্রভুর পাশে রাখা জার্মান সিলভারের গোল গামলাটাতে প্রতিদিন জল ভরে রাখে। প্রভু ছবি আঁকবেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের সে সবে ধ্যান নেই। এখন ছবির ছুটি। খালি গামলা পড়ে থাকে। রাধু একদিন রাগ করে গামলাখানা উল্টে রেখে দিল।
         এরকম একদিন সকালবেলা। দক্ষিণের বারান্দার পুব দিকের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে অবন ঠাকুর যাত্রাপালা লিখছেন। অবনীন্দ্রনাথেরই এক পুরোনো ছাত্র মুকুল দে তাঁর নিজের ছবি আঁকার সাজ সরঞ্জাম সমেত হাজির। এসেই কাঁধের ঝোলা থেকে মস্ত একখানা আধ আঁকা ছবি বের করে অবন ঠাকুরের পায়ের কাছে মেলে বসে গেলেন।
      অবনীন্দ্রনাথ ব্যাপারখানা দেখে হতবাক। ছাত্রের উদ্দেশে জানতে চাইলেন ব্যাপারখানা কী? মুকুল দে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, আমি শুধু আপনার পায়ের কাছে বসে ছবি আঁকতে চাই। আপনি যাত্রা পালা লিখুন। অবনীন্দ্রনাথ ছাত্রের কথা শুনে কোনো উত্তর করলেন না। পুনরায় যাত্রা পালায় মন দিলেন।
      এরকম করে মুকুল দে মাঝে মাঝেই চলে আসেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। এসেই বড় বড় কাগজ মেলে প্রতিদিনকার মতো অবনীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে ছবি আঁকতে শুরু করেন। ওদিকে চেয়ারে বসে গুরুদেব একমনে লিখে চলেন যাত্রাপালা। বেশ চলছে।
      একদিন মুকুল দে বড় একখানা কাগজ মেলে একমনে ছবি আঁকছেন। অবনীন্দ্রনাথ যাত্রা পালা লেখায় মগ্ন। হলে কী হবে। লেখার মাঝে মাঝেই চোখ চলে যায় ছাত্রের ছবির আঁকার দিকে।
      কদিন এমন চলার পর। একদিন মুকুল দে’কে অবনীন্দ্রনাথ বললেন বেশি করে রঙ গুলতে। অমনি মুকুল দে রঙ গুলে নিয়ে ধরলেন গুরুর কাছে। অবনীন্দ্রনাথ মোটা ব্রাশখানা একবার রঙে ডুবিয়ে ছবিটাকে ব্রাশ করলেন। তারপর ব্রাশটা জলে ডুবিয়ে ছবিটা ধুয়ে দিলেন।এভাবে কয়েকবার ফ্ল্যাট ব্রাশ চালিয়ে মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো মুকুল দের আঁকা মেয়েটির পরনের ঝলমলে কাপড় খানা করে দিলেন একেবারে পুরোনো ফ্যাকাসে। এমনি করে সেদিন মুকুল দের আঁকা ছবি গুরুর ছোঁয়ায় সৃস্টি হল ‘মহাকালের মন্দিরে’।
      এরকম মুকুল দে প্রায়ই জোড়াসাঁকোর বাড়ি আসেন। এসে বড় একখানা ছবি মেঝেতে ফেলে আঁকতে থাকেন। অবনীন্দ্রনাথও ছবিগুলোকে মাঝে মাঝে ঠিক করে দেন।
      ক’মাস এরকম চলার পর। প্রতিদিনকার মতো একদিন, খুব সকালে মুকুল দে এসে দেখেন গুরু অবনীন্দ্রনাথের হাতে যাত্রা পালার দিসতে খাতার বদলে ছবি আঁকার কাগজ, রঙ, তুলি। ছবি আঁকছেন। কাগজ বলতে মুকুল দের আঁকার কাগজের ছাঁটগুলো। যে ছবিটা শুরু করেছিলেন সেটা তখন আঁকা প্রায় শেষ।
         এরকম করে অনেক দিনের ছবি আঁকার বন্ধ দরজা খুলে গেল। অবন ঠাকুর আবার ফিরে এলেন পুরনো ফর্মে। নিঃশেষে এঁকে চললেন,কবি কঙ্কন-চন্ডী,কৃষ্ণমঙ্গল,পারাবত চিত্রাবলী প্রভৃতি সে প্রায় একশো খানা ছবি।
         সেই যে ছোটো বেলায় নর্মাল স্কুলে মেটে কুঁজো আর গ্লাস দিয়ে ছবি আঁকার শুরু হয়েছিল। যাত্রার পালা,নাটক লিখতে গিয়ে সে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন প্রায় দশ বছরের বন্ধ দরজা খুলে গেল।
      নর্মাল স্কুলে ছবি আঁকার হাতে খড়ি হলেও আসল ছবি আঁকার শুরু বিয়ের পর। মেজমা সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদা নন্দিনী দেবীর উৎসাহে। একবার রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ দিজেন্দ্রানাথ ঠাকুরের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে,অবনীন্দ্রনাথ নিজে থেকেই ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ এর ছবিগুলো প্রায় এঁকে ফেললেন। ছবিগুলো দেখে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী অবনীন্দ্রনাথকে ধরলেন ছবি আঁকা শেখার জন্য। দেরি না করে তিনি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ গিলার্ডির কাছে অবনীন্দ্রনাথকে ভর্তি করে দিলেন।
         ক’মাসেই গিলার্ডির কাছে তেল রঙ, পোট্রেট করা শিখে ফেললেন অবনীন্দ্রনাথ। তবে ইউরোপীয় স্টাইলে ছবি এঁকে তাঁর মন ভরে না। 
         এই সময় কলকাতায় প্লেগের মড়ক দেখা দিলে, নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্লেগ রুগীদের সেবায়। মড়কের কবল থেকে জোড়াসাঁকোর বাড়িও রেহাই পেল না। অবনীন্দ্রনাথের ছোটো মেয়ে শোভা প্লেগে মারা গেলেন।
         অবনীন্দ্রনাথ ভীষণ ভেঙে পড়লেন। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কিছুতেই মন টেকে না। চলে গেলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর চৌরঙ্গীর বাড়িতে। জ্ঞানদা নন্দিনী দেবীর বাড়িতে আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল হ্যাভেলের সঙ্গে অবনিন্দ্রনাথের পরিচয় হল। দু’জন দু’জনের গুনে মুগ্ধ।
         অবনীন্দ্রনাথ হ্যাভেলের কাছে ছবি আঁকার তালিম নিতে শুরু করলেন। হ্যাভেলের কাছে অবনীন্দ্রনাথ পেলেন দেশীয় শিল্পের রূপ-সৌন্দর্য এবং সৌরভের পাঠ। এরপর অবনীন্দ্রনাথ দেশীয় শিল্প সংগ্রহ করতে উৎসুক হয়ে পড়লেন।
         দেশি শিল্প সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখলেন দেশি শিল্প তখনও পটের ছবিতে বন্দী। কিন্তু হ্যাভেলর কাছে তিনি দেশি শিল্পের অন্তরের সৌরভের সন্ধান পেয়ে গেছেন। এবার তিনি তুলিকে স্বদেশী মনের রঙে রাঙিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় বসে এঁকে চললেন কৃষ্ণ চরিত্র, বুদ্ধচরিত্র, বেতাল পঞ্চবিংশতি আরো কত ছবি। দেশি ছবিতে যাতে বিদেশি ছোঁয়া না লাগে সেজন্য বিদেশি ছবি দেখা বা বিদেশি বই পড়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন।
      এরপর হ্যাভেলের ইচ্ছেয় অবনীন্দ্রনাথ আর্ট স্কুলে দেশি রীতিতে ছবি আঁকা শেখানোর জন্যে শিক্ষক নিযুক্ত হলেন। পরে আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষের পদেও নিযুক্ত হয়েছিলেন। আর্ট স্কুলে দেশি রীতিতে ছবি আঁকা শেখাতে শুরু করলে ধীরে ধীরে  সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু প্রমুখ এক ঝাঁক দেশি চিত্রকলার ছাত্র ও  পৃষ্ঠপোষক গড়ে উঠল।
       এঁদের সঙ্গে নিয়ে এঁদের উদ্যোগে কিছুদিন পর  অবনীন্দ্রনাথ গড়ে তুললেন, ‘দ ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ইন্ডিয়ান আর্ট’। দেশি বিদেশি বহু গণ্য মান্য ব্যক্তি ছিলেন সোসাইটির পৃষ্ঠপোষক। সেই সময় বাংলার ছোটলাট লর্ড কারমাইলও ছিলেন এই সোসাইটির সমর্থক। এখানেই রোদেনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়। এরপর থেকে দেশজ শিল্প রীতি এদেশের মানুষের মনে জায়গা পেল।
      অনেককাল পরে অবনীন্দ্রনাথ এসব দেশি শিল্পের অনুরাগী ছাত্র ও পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ে জোড়াসাঁকোর লাল বাড়ি ‘বিচিত্রা’য় ‘বেঙ্গল স্কুল’ গড়ে তুলেছিলেন। অবশ্য অর্থাভাবে বছর খানেকের বেশি চলে নি ‘বেঙ্গল স্কুল’।
      অবনীন্দ্রনাথের নাম ডাক তখন জগৎ জোড়া। দেশ বিদেশ থেকে নামি দামি চিত্রকররা তাঁর কাছে আসছেন। জোড়াসাঁকো বৈঠকখানা বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, দেশি-বিদেশি চিত্রকররা ছবি আঁকছেন। একবার জাপানি চিত্রকর টাইক্কান, হিসিদা সুনসো অবনীন্দ্রনাথদের জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়িতে অতিথি আসেন। তখন তাঁদের কাছে অবনীন্দ্রনাথ শিখে নেন ছবি আঁকায় ওয়াস পদ্ধতিটি। এমনি করে অবনীন্দ্রনাথ কখনো এঁকে চলেছেন দেশি স্টাইলের ছবি, কখনো ওয়াস পদ্ধতিতে বিদেশি স্টাইলের ছবি।
      যখন ভারত জুড়ে বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলন শুরু হল। রেনেসাঁসের প্রাণকেন্দ্র জোড়াসাঁকো বাড়ির আনাচে কানাচে তখন স্বদেশী হাওয়ার ঝড়। জোড়াসাঁকো বাড়ির সভ্যরাও সেই হওয়ায় আন্দোলিত। সকলেই দেশের জন্য কিছু একটা করতে চাই। সব কিছুতেই স্বদেশিয়ানা আনতে হবে। শুধু শিল্পে নয়। নিজেদের সাজপোশাকের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির অন্দর মহলেও আনলেন স্বদেশিয়ানা। পাঁচ নম্বর বাড়ির ভিক্টরিয়ান যুগের ঢাউস ঢাউস আসবাব গুলোকে অবন ঠাকুর, গগন ঠাকুরেরা বদলে ফেললেন। বাড়ির মিস্ত্রি আচারীকে দিয়ে নিচু স্টাইলের আসবাব বানালেন। আসবাবের অলংকরণ হল সাঁচি, অজন্তার শৈলীর রীতিতে।
       এভাবে দক্ষিণের বারান্দায় দুই ভাই মেল বন্ধন ঘটালেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিল্প রীতির। সেই সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ভারতীয় শিল্পকে দিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পের মর্যাদার আসনটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় ‘ অবন দেশের সব রুচি বদলে দিয়েছে। ‘
       জগৎ জোড়া নাম জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর ও ছ নম্বর বাড়ির রথী মহারথী রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথদের। তাঁদের কাছে দেশ বিদেশ থেকে কবি-সাহিত্যিক, চিত্রকরদের আনাগোনার শেষ নেই। এসব দেখে বাড়ির ছোটদের মনেও খুব সাধ ,তারাও গল্প লিখতে চাই। কিন্তু গল্পের জন্য একটা কাহিনী দরকার। কাহিনী পাওয়া যায় কোত্থেকে! কিশোর মোহনলাল এসে এই দুঃখের কথা জানাল দাদামশায় অবনীন্দ্রনাথকে।
      দাদামশায় সব শুনে বললেন এ আর এমন কী কঠিন! তোরা স্বপ্ন দেখিস তো? সেই স্বপ্নগুলোই সকালবেলা লিখে দে গল্পে।
      দাদামশায়ের কথামতো মোহনলালেরা পরদিন সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে এসে হাজির দাদামশায়ের কাছে দক্ষিণের বারান্দায়। দ্যাখে দাদামশায় তখন দু তক্তা শ্রীরামপুর কাগজ লম্বা লম্বা চারটুকরো করে আঠা দিয়ে  চিটিয়ে রেখে দিয়েছেন। তার ওপর ওদের গল্প লিখতে হবে। মোহনলালেরা একে একে সবাই একটা করে গল্প লিখে চলল। একজনের শেষ হলে শ্রীরামপুরী লম্বা কাগজখানা গুটিয়ে গুটিয়ে রাখার ব্যবস্হা।
      দাদামশায়ের কথামতো সেদিন পড়ার আগে চলল গল্প লেখা। তারপর পড়াশুনো। সকালবেলা মাষ্টারমশাই পড়াতে এসে এসব দেখেশুনে হতবাক। মাষ্টারমশাই চুপ করে বসে রইলেন। মোহনলালেরা একের পর এক গল্প লিখে চলেছে। সবার গল্প লেখা শেষ হলে মাস্টারমশায়ও একখানা গল্প লিখে দিলেন। সেদিন আর পড়া হল না। গল্প লিখতে লিখতে পড়ার সময় শেষ।
      অবনীন্দ্রনাথ পত্রিকার নাম দিলেন ‘স্বপ্নের মোড়ক’। বেশ এগিয়ে চলছিল ‘ স্বপ্নের মোড়ক’। ছোটরা বাড়ির বড়দের ধরে গল্প দেওয়ার জন্য। বাড়ির বড়োরাও লিখে দিলেন ‘স্বপ্নের মোড়কে’। অবনীন্দ্রনাথ ও লিখে দিলেন একখানা গল্প। মাঝে মাঝে দাদামশায়ের চারদিকে গোল হয়ে বসে ‘স্বপ্নের মোড়ক’ পড়া হয়। ক’মাস পর মোহনলালদের লেখায় তেমন আর গতি নেই। কিছুদন পর ‘স্বপ্নের মোড়ক’ বন্ধই হয়ে গেল।
     ‘স্বপ্নের মোড়ক’ এ মোহনলালদের যখন কিছুটা হাত পেকেছে। ওরা আবার দাদামশায়কে গিয়ে ধরল। এবার একটা আস্ত হাতের লেখা পত্রিকা বের করতে চায়। শুনে অবনীন্দ্রনাথের দ্বিগুন উৎসাহ। পত্রিকার নামও ঠিক করে দিলেন। শিশুরা যখন মায়ের কোলে হাসে কাঁদে তখন সেটা হয় দেয়ালা। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতের লেখা গল্প পত্রিকার তাই নাম দিলেন’ দেয়ালা’। মোহনলালকে সম্পাদক করে দিলেন।
      অমনি নাতিরা দারুণ উৎসাহ নিয়ে আয়োজন শুরু করে দিল। খাতা বাঁধাই। খাতার ওপর পত্রিকার নাম লেখা। এসব কী কম কাজ! এরপর শুরু হল লেখা জোগাড় করার পর্ব। প্রথমেই গিয়ে ধরলেন অবনীন্দ্রনাথকে। অবনীন্দ্রনাথ ও একখানা গল্প লিখে দিলেন। 
      কিছুদিনে পত্রিকা বেশ জমে উঠল। নিজেরা যেমন লেখে।তেমনি বাড়ির বড়দেরও ধরে লেখা দেওয়ার জন্য। মোহনলাল এর বাবা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় তখন নামকরা সাহিত্যিক। মোহনলাল তাঁকেও ধরলেন ‘দেয়ালা’তে লেখা দেওয়ার জন্য। মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় লিখে দিলেন গল্প। সামনে বৈশাখ সংখ্যা। মোহনলালের হাতে সব সময় একখানা খাতা পেন্সিল। কখনো লেখা চলছে। কখনো পত্রিকার অঙ্গসজ্জা।
      বৈশাখের সংখ্যা প্রায় তৈরি। এমন সময় অবনীন্দ্রনাথ এসে নাতিদের বললেন ধাঁধা নইলে পত্রিকা মানায় না। তারপর নিজেই একখানা ধাঁধা লিখে দিলেন।
      ছোটরা বড়দাদু গগনেন্দ্রনাথকে ধরলেন ছবির জন্য। গগনেন্দ্রনাথ ছবি এঁকে দিলেন। এত সুন্দর ছবি হাতের লেখা খাতা পত্রিকায় দিতে যে মন সরে না মোহনলালদের। তারা ছাপার জন্য তা তুলে রেখে দিল। অবনীন্দ্রনাথ নিজের স্কেচ সহ ‘সহজ চিত্রশিক্ষা’ ‘দেয়ালা’ তে বের করতে থাকলেন।
       বাড়ির ছোটদের সঙ্গে ক্ষুদেদের আঁকায়, লেখায় ‘দেয়ালা’ বেশ জমে উঠল। কিন্তু ক’মাস যেতে না যেতে লেখার রসদে পড়ল ভাটা। লেখাও তেমন আর সংগ্রহে নেই। নাতি নাতনিরা গগন ঠাকুরকে গিয়ে ধরল একখানা গল্প লিখে দেওয়ার জন্য। তিনি ‘দাদাভায়ের দেয়ালা’ নামে একটি গল্প লিখে দিলেন।
      এদিকে লেখার রসদ ফুরিয়ে এসেছে। ছোটদের উৎসাহও কমে গেল। এক বছরের কাছাকাছি এসে ‘দেয়ালা ‘বন্ধ হয়ে গেল। গগন ঠাকুরের গল্পটি আর’ দেয়ালা ‘ তে বের হল না। সেটি অনেক পরে সিগনেট প্রেস থেকে ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ নামে বের হয়। এমনি করে অবনীন্দ্রনাথ খেলার ছলে নাতি নাতনিদের সাহিত্যের হাতেখড়ি দিয়ে দিতেন।
      শিশুর মতো কোমল ছিল তাঁর মনটি। সহজেই বাড়ির ক্ষুদেরা সেই মনের নাগাল পেয়ে যেত। তাই তাঁর সকল কাজের সঙ্গী মোহনলালেরা। তাদের মতো করে গল্প লেখাতেও তিনি অনবদ্য। তাঁর লেখা ‘শকুন্তলা’, ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘বুড়ো আঙলা’, ‘রাজকাহিনী’ পড়তে পড়তে মনে হয় মোহনলাল, শোভনলালেরা যেন তার সামনে বসে। তিনি গল্প গুলো তিনি বলে চলেছেন।
      শুধু কী লেখায় ?  ‘কুটুম-কাটাম ‘এর পাথর খোঁজার সঙ্গীই তো ছিলেন মোহনলালেরা।
      একবার হল কী! অবনীন্দ্রনাথের স্ত্রী সুহাসিনী দেবীর হাত থেকে পড়ে একটা সাদা রঙের পাথরের বড় প্লেট ভেঙে গেল। সুহাসিনী দেবীর মনটি বেশ খারাপ। ভাঙা প্লেট দেখে অবনীন্দ্রনাথ খুব খুশি। প্লেটের ভাঙা টুকরো গুলো সযত্নে তুলে নিলেন। কদিন পর ছেনির হালকা টাচে এক একটা টুকরো হয়ে গেল এক একটা চমৎকার মূর্তি। আগেই শুরু হয়েছিল পুরোনো, ফেলে দেওয়া, বাতিল জিনিসের নতুন করে রূপদান। দিনে দিনে তা আরো গতি পেল।
     দক্ষিণের গোল বাগান হোক বা দূরে কোথাও। যেখানেই বেড়াতে যান। প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে কুড়িয়ে আনাচাই নানা রকমের পাথর। তারপর সেগুলিকে ধুয়ে নিজের কাছে রেখে দিতেন। অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে এরকম কতরকম পাথর যে থাকত। আরো থাকত কাঠের, পুঁতির, বাঁশের, ভাঙা আসবাবের কত যে টুকরো। অবন ঠাকুর তাঁর সঙ্গের এসব জিনিস পত্তরকে বলতেন এসব তাঁর কুটুম। ছেনি, হাতুড়ির হালকা কাটিং এ এসব কুটুম হয়ে উঠত এক একটি শিল্প। ছেনির হালকা টাচে একখন্ড পাথরের টুকরো কখনো হয়ে যেত আস্ত একখানা পাউরুটি। আবার কখনো একখন্ড গাছের গুঁড়ি রূপ পেত গাছের ডালে বসা শকুন। এসব কুটুমদের অবনীন্দ্রনাথ নাম দিলেন ‘কুটুম-কাটাম’।
      সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখছেন পাঁচ নম্বর ও ছ-নম্বর জোড়াসাঁকোর বিরাট দুই ঐতিহাসিক বাড়িতে কত মানুষের আসা যাওয়া। কত সৃষ্টি মুখর দিনরাত। কখনো নাটকে, কখনো যাত্রায়, কখনো ছবি আঁকায়, নাটকের অভিনয়ে দুই বাড়ি জমজমাট। এমন আমুদে বাড়ি ছেড়ে ছোট অবন ঠাকুরের ইস্কুল যেতে মন চাইত না। নিত্য নানা অজুহাতে স্কুল কামাই। অগত্যা বাড়িতেই মাষ্টারমশায় রাখা হল। স্কুল নেই বেশ ভালো। তবে এতবড় দুপুর। কখনো এবারান্দা-ওবারান্দা। কখনো দেউড়ির দারোয়ানদের কাছে। কখনো আপিসে সরকারদের কাছে উঁকি। তবু দুপুর যে কাটে না।
      টুক করে হয়তো একবার মায়ের কাছে। কিন্তু পরক্ষণেই অন্দর মহল থেকে বিতাড়িত। অগত্যা আর পাঁচটা ধনী বাড়ির শিশুর মতো ছোট অবনীন্দ্রনাথেরও দিন কাটে দাস-দাসীদের  ধমকে, আদরে,গল্পে,তামাশায়। সন্ধের পর ঘুম চোখে দাসীই ভরসা। ঘুম পাড়ানো মাসীর মুখে ভূত-পেত্নী, দত্যি-দানব, রাক্ষস-রাক্ষুসীর গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ছোট অবনীন্দ্রনাথের চোখ ঘুমে ঢুলে পড়ে। একেবারে ভোর হয় দেউড়িতে ঘোড়ার দলাই-মলাই এর ধপ ধপ,টপ টপ শব্দে।
      আশৈশব লালিত জোড়াসাঁকোর এই অট্টালিকা সম বাড়ি ছেড়ে অবনীন্দ্রনাথকে একসময় যেতে হল বরানগরের গুপ্ত নিবাসে। সুখ দুঃখের স্মৃতিতে জড়াজড়ি করে রইল এ বাড়ির দালান-দেউড়ি,সরকার, আপিস, চাকর-বাকর, দাস-দাসী, ঘুম পাড়ানো মাসি সবকিছুই। হৃদয় মথিত করা বেদনা বিধুর সে সব স্মৃতি মণি-মুক্তোর মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেল অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে, লেখায়। জীবনের প্রান্তে বসে তাঁর লেখা ‘মাসি’ গল্প পড়তে পড়তে মনে হয় গল্পের অবু যেন কিশোর অবনীন্দ্রনাথ। যে অবু অনেককাল পরে  তাঁর সেই পুরোনো অট্টালিকাসম বাড়িতে গিয়ে মাসিকে দেখতে না পেয়ে অস্ফুটে বলে ‘এমন কাউকে দেখি না যে শুধিয়ে জানি, মাসি কোথায়। মাসি মাসি ব’লে ডেকে ডেকে গলা চিরে গেল। একবার মনে হল অন্দরবাড়ির দিকটায় কে যেন ডাকল ‘মাসি গো মাসি’। তারপরেই যে চুপ সেই চুপ, নিঃসাড়া পুরী। ছুটলাম অন্দর বাড়ির  দিকে, বলি মাসির যদি দেখা পাই সেখানে।………একছুটে দোতলায় উঠে গেলাম তোমার ঘরে, মাসি। কোথায় মাসি ! খালি ঘর চুপচাপ সবুজ খড়খড়ি বন্ধকরে অঘোরে পড়ে আছে।’

ঝুমুর গানের রূপ ও রূপান্তর

পুরুলিয়ার ঝুমুর নাচ ও গান

ড: সোমা দাস মণ্ডল, অধ্যাপিকা, অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটি

আদিবাসী সংস্কৃতির প্রবাহিত ধারায় লালিত ও বিকশিত হয়েছে বাংলা ঝুমুর গান। বাংলা ছাড়াও আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও আরো বিভিন্ন রাজ্যে ঝুমুর নামের গান ও নৃত্য ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে বহুকাল। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে রাঢ় বাংলায় প্রচলিত লোকসংগীতের ধারাগুলির মধ্যে ঝুমুর গান অন্যতম | বহু প্রাচীন কাল থেকেই ঝুমুর গানের অস্তিত্ব রয়েছে | তবে বিভিন্ন সময়ে এই সংগীতের রূপ রেখার নানা পরিবর্তন ঘটেছে | নাগরিক সভ্যতার প্রভাবে গ্রামীন কৃষ্টির যেরূপ বিবর্তন ঘটছে, তাতে করে উল্লেখিত ঝুমুর গান বৈচিত্রপুর্ন হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক |

এই প্রবন্ধে ঝুমুর গানের বৈচিত্র্যের দিকটাই তুলে ধরা হয়েছে | ঝুমুর গানের বিভিন্ন প্রকার গুলি ও তাদের বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সমন্ধেও এই প্রবন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও ঝুমুর গানের উংস এবং স্বতন্ত্রতা সমন্ধেও কিছু আলোচনা এই প্রবন্ধে করা হল |

আদিবাসী সংস্কৃতি হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত দেশেরই আদি সংস্কৃতি বা কৃষ্টির উৎস | লোকসংগীতের আদি অবস্থা আদিবাসীদের নাচ গান বাজনার মধ্যেই সীমিত ছিল | লোকসংগীত হল লোকসমাজ কর্তৃক মুখে মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্ট | লোকসংগীত মাটির গান অর্থাৎ গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা, গ্রামীণ সংস্কার ও আচার ব্যবহার, চিরাচরিত ধর্মীয় বিধি নিষেধ ও অনুষ্ঠান, বৃত্তি, রীতি, ভাষা-ভঙ্গী, জীবিকা নির্বাহ প্রভৃতি ঘটনাবলী জড়িয়ে রয়েছে| এছাড়াও লোক-জীবনের দুঃখ-দুর্দশা ইত্যাদি লোকসংগীতের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে | শুধু তাই নয়, গানের ভাব ও ভঙ্গী, আবেগ প্রভৃতি সবই আঞ্চলিক-ভাবে সীমাবদ্ধ | গানের বিষয়বস্তু ও অঞ্চলের নামানুসারে লোকসংগীতের নামকরণ হয়ে থাকে | এইভাবে লোকসংগীত বিভিন্ন শাখায় প্রসারিত হয়েছে |

রাঢ় একটা প্রাচীন জনপদ | এই জনপদের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয় পুরাতত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকধারার ঐতিহ্য পর্যালোচনা দ্বারা | অতীতে বঙ্গ, বরেন্দ্র, বঙ্গাল জনপদের ভৌগোলিক অস্তিত্ব থাকলেও সামগ্রিক ভাবে রাঢ় সংস্কৃতি বঙ্গসংস্কৃতির অংশীভূত হয়ে গেছে| প্রাচীন ঐতিহাসিক পর্বে রাঢ় ও বঙ্গ পৃথক জনপদ রূপে আখ্যা লাভ করলেও মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, চতুর্দশ শতক হতে গৌড়, রাঢ়, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, সমতট, বঙ্গ, বঙ্গাল, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি পৃথক পৃথক অঞ্চল সমূহের একত্রীকরণের ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বঙ্গ দেশের সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু প্রচলিত বাংলা উপভাষা ও সমাজ বিন্যাসের ক্ষেত্রে আজও বঙ্গ, রাঢ় ও বরেন্দ্রভুমিক পৃথক অস্তিত্ব বজায় আছে | পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশের অধিকাংশ ভূ-ভাগ প্রাচীন রাঢ়ভূমির অন্তর্গত ছিল | ‘রাঢ়’ শব্দটি মূলত অস্ট্রো-এশিয়াটিক কোল ভাষাভাষী গোষ্ঠীর দেশনাম | (য চৌধুরী ২008, 3.) মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল হতে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এক বিস্তৃত ভূখণ্ডে বসবাসকারী মুন্ডা, সাঁওতাল, হো, ওরাঁও, লোহার, মালপাহারিয়া, কেওট, ভূমিজ প্রভৃতি উপজাতি গন কোল গোষ্ঠীর বংশধর | ভূভাগে পাথরের অংশ অধিক হওয়ার জন্য কোল ভাষাভাষী গোষ্ঠীর নিকট বসবাসের স্থানটি রৌড়দিশম নাম পরিচিত ছিল | কোল ভাষায় রৌড় শব্দের অর্থ পাথর বা পাথরের নুড়ি | “রৌড়দিশম” বলতে বোঝায় রাঢ় দেশ বা পাথুরে রুঢ়-রুক্ষ মাটির দেশ | (য চৌধুরী ২008, ২.) অনেকে অনুমান করেন যে, রৌড় শব্দ হতে ঝাড়খন্ডী উপভাষায় রড়া বা লড়া শব্দের পরিবর্তিত রূপ নিয়ে আরও পরে লাড় বা রাঢ় শব্দটি এসেছে |

বোলপুরের খোয়াইতে লোকসংস্কৃতির মেলায় ঝুমুর নাচ ও গান

পরিবর্তিত প্রকৃত রূপ হল রাল বা লাল | প্রকৃত ভাষায় রাল বা লাল শব্দের সংস্কৃত রূপ হল ‘রাঢ়’ | ‘রাঢ়’ শব্দ সংস্কৃত-মূলক নয় | এটি খাঁটি দেশী শব্দ | সাঁওতালী ভাষায় রাঢো শব্দ আছে, তার অর্থ নদী গর্ভস্থ শৈলমালা বা পাথুরে জমি | সাঁওতালি বা দেশী শব্দ হতে সম্ভবত রাঢ় শব্দের উৎপত্তি হয়েছে | (বিশ্বকোষ তারিখ নেই) এখন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে নিম্নবর্গের মানুষের কথ্য ভাষার ‘র’ স্থলে ‘ল’, ‘ল’ স্থলে ‘র’, ‘র’ স্থলে ‘অ’, ‘ন’ স্থলে ‘ল’ উচ্চারণ বিধি প্রচলিত আছে | পাথরের ন্যায় শক্ত বা কর্কশ ভূভাগে বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর, বাকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলী, সিংভূম, মানভূম, হাজারীবাগ, ধানবাদ, সাঁওতাল পরগণা সহ ভাগলপুর, রাঁচি ও পালামৌ জেলার কিয়দংশ নিয়ে বৃহৎ রাঢ় জনপদ গড়ে উঠেছিল | (য চৌধুরী ২008, 3.) রাঢ় অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমার যে বর্ণনাটি দেওয়া হল, তা সামগ্রিকভাবে রাঢ় অঞ্চলের জনপদকে বোঝায় | এই অঞ্চলগুলির মধ্যে ঝুমুরের প্রচলন বৃহৎ আকারে বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর, বাকুড়া, পুরুলিয়া থেকে শুরু করে ওড়িষা হয়ে মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেখা যায় |

কৃষি নির্ভর বাংলার গ্রামীণ জীবনে পালা-পার্বণ, ব্রত, উৎসবের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ | তাকে ঘিরেই সংস্কৃতির সূচনা ও বিস্তার ঘটেছে | ঝুমুর গানের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় না | ঝুমুর গানের বিষয়সূচি করম, জাওয়া, ঝিঙ্গাফুল্যা, ভাদুরিয়া প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত | এই ধারার কিছু গান দাঁইড় নাচ, বুলবুলি নাচ ও মাদলিয়া নাচের মধ্য দিয়ে পরিণতি পেয়েছে | অরণ্য বেষ্টিত এই অঞ্চলের সংগীত সংস্কৃতিতে দেবদেবীর প্রভাব ও লক্ষণীয় | ধরম, করম, বড়পাহাড়ী, সাতবহিনী, টুসু, ভাদু, রঙ্কিনি, দুয়ারসিনি ও বাশলির মাহাত্ম্য প্রভৃতি আচার পরবের অন্ত নাই | এছাড়া টুয়া গান, জাগ্ গান, বাঁধনা কিম্বা অহীরা পরবের গানের মধ্য দিয়েও বৈচিত্র্যের সমারোহ ঘটেছে | এই গান প্রধানত নারী কন্ঠে পরিবেশিত হয় এবং পুরুষেরা নৃত্যে ও বাদ্যে অংশগ্রহন করে থাকে |

রাঢ় বাংলার লোকসংগীতের অন্যতম প্রাণ সম্পদ ঝুমুর গান | শাল, পিয়াল, কেঁদ, করম আর মহুয়ার জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি প্রকৃতি ঘিরে যে গানের প্রভাহমানতা এক সুউচ্চ সংগীত শৈলীর পরিচয় প্রদান করে- তাই ঝুমুর গান নাম পরিচিত | ঝুমুর ছিলো হাঁকা পর্যায়ের শব্দ উদগিরণের একটি কলা মাত্র | ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বর তাল মাত্রা এবং ছন্দের বিভাজনে সুরের বিধিবদ্ধতায় তা সংগীতে উত্তীর্ণ হয়েছে | প্রধানত তিন চারটি স্বর বিশিষ্ট এই গানের ধারাটি ঝুমুর অঞ্চলের সকল শ্রেণীর গানেই ক্রিয়াশীল | উঁচু স্বর থেকে অবরোহণে আসার এই কৌশলটি ঝুমুর গানের আদিম বৈশিষ্ট্য | আদিবাসী সমাজ থেকে উদ্ভূত এই গানের সঙ্গে নৃত্য ধারা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে | পুরুলিয়া জেলার ঝুমুরের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন | এই এলাকার আদিম জনজাতিদের জীবনযাপন ও আচার সংস্কার অনুযায়ী গড়ে উঠেছে এই সমৃদ্ধশালী পরম্পরা | ধামসা, মাদল, কেদ্দরী, বাঁশি, ঘুঙ্গুর প্রভৃতি নৃত্যগীতিবাদ্যে শিল্প সমন্বিত যে রূপ বর্তমানে প্রচলিত, সংগীতগুনীরা তার পূর্ব ইতিহাস ভিন্নতর ছিল বলে মনে করেন|

মোটামুটিভাবে ঝুমুরকে এর সাহিত্য বা বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে | সিন্দুরিয়া, ভাদুরিয়া, আধ্যাত্মিক | ভাদুরিয়া বিভাগটি নির্ভর করে ঝুমুর গানের সাহ্যিতকে কেন্দ্র করে | শ্রীরাধা নানা সাজে সজ্জিত হয়ে কৃষ্ণের দর্শনের অপেক্ষায় বসে আছে কিন্তু তার দর্শন না হওয়ায় যে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে, এইরূপ বিষয়বস্তু নিয়ে ভাদুরিয়া ঝুমুর তৈরী হয় | যুবক-যুবতীর প্রেম বিরহের কথাই সিন্দুরিয়া ঝুমুরের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে | সিন্দুরিয়া ভাদুরিয়া ঝুমুরগান ছাড়াও যে আধ্যাত্মিক কাঠামোর উপর গড়ে উঠেছে | সামগ্রিকভাবে ঝুমুর গানের যে অবয়ব, তাকে কেন্দ্র করে যে বিভাজনটি লক্ষ্য করা যায়, তাতে ঝুমুর গানের নানা ভাগ উপভাগ এবং নানান ধারাও লক্ষ্য করা যায় | ঝুমুর প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত | লৌকিক ও দরবারী | লৌকিক ধারাটি শ্রুতি নির্ভর, অন্য ধারাটি শিল্প গুনাত্মিক |

যে কোনো লৌকিক কৃষ্টির মধ্যে ব্যাকরণের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, সেই জন্যই প্রাচীনকাল থেকেই লৌকিক সংগীতের কোনো শাস্ত্র তৈরী হয়নি | লৌকিক সংগীতকে কখনও বাধা যায় না, বিভিন্ন অঞ্চলভেদে, সম্প্রদায় ভেদে, জাতিভেদে, যুগ ভেদে পরিবর্তনশীল | লৌকিক ঝুমুরের ক্ষেত্রে এই একই নিয়ম লক্ষ্য করা যায় | খুব সাধারণ মানুষের মধ্যে এই গানগুলি প্রচলিত হই বলে লৌকিক ঝুমুরগুলির মধ্য সাহিত্যের চটুলতা বা লঘু সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় | লৌকিক ঝুমুরের প্রকারভেদ করা হয়েছে – দাঁইড়শালিয়া ধারা ও পাতাশালিয়া ধারা | দাঁইড়শালিয়া ধারাটি দাঁড় ঝুমুর বা টাঁড় ঝুমুর নামে প্রচলিত | টাঁড় শব্দটির অর্থ হল মাঠ | কৃষিকর্মের সঙ্গে সঙ্গে দাঁইড়শালিয়া শ্রেণীর গান মাঠে প্রান্তরে আচার বিধির সঙ্গেও যুক্ত | করম কিম্বা যে কোনো উৎসবেই দাঁইড়শালিয়া ঝুমুর পরিবেশিত হয়ে থাকে | ধামসা, মাদল, ঘুঙ্গুর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র এই গানে বব্যহৃত হয়ে থাকে | পুরুষেরাই নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ করে থাকে | রামসীতা, রাধাকৃষ্ণ কিম্বা মানবিক

আবেদন যুক্ত গানই এর বিষয়বস্তু হয়ে থাকে | পাতাশালিয়া ধারাটি পাতা নাচের গান, পাতানাচাড়ী অথবা মাদল নাচের গান নামে পরিচিত | নারী পুরুষ সমবেত ভাবে নৃত্যগীত বাদ্যসহ এই ঝুমুর গান হয়ে থাকে | মূলত: করম উৎসবের মধ্যেই উদযাপিত হয় | করম উৎসবটি ধান তোলার বা ধানের বীজ রোপণ জাতীয় কৃষিকাজ ঘিরে পালিত হয় | ভাদ্রমাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে করম পূজা হয়ে থাকে | নারী পুরুষ উভয় কণ্ঠেই এই গীত শোনা যায় | সম্মিলিত নৃত্য গীতের মধ্য দিয়েই এই উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে |

কোনো কোনো লোকসংগীত গুণীর মতে নাচনীশালিয়া ধারা নামক আর এক প্রকার ঝুমুরের উল্লেখ পাওয়া যায় | এই ঝুমুর লৌকিক ধারার মধ্যে প্রধানতম পর্যায় | সিংভূম, মানভূম, ধলভুম অঞ্চলে রসিকদের নাচনী পোষা এক করুন কিংম্বদন্তী | নাচনীরা মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য যেখানে নাচ পরিবেশন করেন, সেই জায়গাটিকে বলা হয় নাচনীশাল | নাচনীদের নাচের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত চটুল রসের যে গান হয়, তাকেই বলে নাচনীশালিয়া ঝুমুর | (২0১3 গিরি, 57)

উদাহরণ: “কোমর পাইড়া নীল শাড়ি

আবোল বেড়ি করি

বাজু ঝুলনি, কত গরব নারী বেশভুষনী || “

লৌকিক ঝুমুরের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি বিশেষভাবে স্বতন্ত্রতার দাবী রাখে, তা হল লঘু সাহিত্যের প্রভাব এবং সুর কাঠামো | যেমন সাহিত্যের কথা বলতে গেলে, দৈনন্দিন জীবনের কথা, কর্মজীবনের কথা, দেবদেবীর কথা এবং প্রকৃতির বর্ণনার কথা আমরা এই ঝুমুরে পেয়ে থাকি | লৌকিক ঝুমুরের গানগুলির মধ্যে সাহিত্যের চটুলতা বা লঘু সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় | সুর বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উঁচু স্বর থেকে নিম্নে আসার বা অবরোহণের গতির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় | কয়েকটি তুকে একটি গান বিন্যস্ত থাকে | দেখা যায় প্রত্যেকটি তুকের সুরগুলি একই রকম ভাবে রচিত | স্বর সন্ধর্ভের মধ্যে বেশী জটিলতা দেখা যায় না | শুদ্ধ স্বরগুলির পর পর প্রয়োগের মাঝে অল্প করে কোমল স্বরের প্রয়োগ লৌকিক ঝুমুর গানগুলির মধ্যে এক মাদকতার সৃষ্টি করে | এছাড়া যন্ত্রানুষঙ্গ ধামসা, মাদল, ঘুঙ্গুর, বাঁশী ইত্যাদি সহযোগে লৌকিক ঝুমুর গানটি একটি স্বতন্ত্র সংগীত হিসাবে স্বীকৃতি পায় বলে আমার মনে হয় |

দরবারী ঝুমুর রাঢ় বাংলার ঝুমুর গানের প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ার পরবর্তী সময়ে তা সমাজের গণ্য মান্য ব্যক্তিদের নজরে আসে | কোনো কোনো সংগীত গুণীরা মনে করেন লৌকিক ধারার খেমটি থেকে নাচনী নাচের ঝুমুরে, এর উত্তরণ ঘটেছে | কোনো ওস্তাদ দ্বারা তালিম প্রাপ্ত কোনো নাচনী নাচের ঝুমুর দরবারে স্থান করে নেয়, ক্রমে আরও পরিশীলিত রূপ নেয় এবং মনোরঞ্জনের জন্য সাধারণের প্রচারে আসে | প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় যখন ঝুমুর গান আশ্রয় পেল, তখন থেকে দরবারী ঝুমুরের সৃষ্টি হল | আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকের পরবর্তী সময়ে মহারাজের রাজসভায় এই ঝুমুর গান পরিবেশিত হত | কৃষ্ণদাস কবিরাজের “শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত ‘মহাগ্রন্থে চৈতন্যদেবের মথুরা ভ্রমণের সময় দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলার কিয়দংশ পরিক্রমার কথা উল্লেখ করা যায় | (1997 সিংহ, 4) ফলে এই দরবারী ঝুমুরে কীর্তনের সুরের আভাষ লক্ষ্য করা যায় | সুরের বৈচিত্র্যের দিকে নজর করলে দেখা যাবে যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগ রাগিণীর প্রভাবও এই দরবারী ঝুমুরে বিশেষভাবে লক্ষণীয় | লৌকিক ঝুমুরে যে সকল বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হত তা অধিকাংশে দরবারী ঝুমুরে ব্যবহৃত হত | কীর্তনের সুর যখন দরবারী গানে ব্যবহৃত হতে লাগলো, তখন সেই গানের ভাবকে যথাযথ বজায় রাখার জন্য খোল, করতাল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হতে সুরু হয় |

উদাহরণ: “যাকর ঘুঘী তাকর মাছ মিছাই কর সাতপাঁচ || “

সুতরাং দরবারী ঝুমুরে দেখা যাচ্ছে সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটু পরিশীলিত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরের বৈচিত্র্যর ক্ষেত্রে কীর্তন সুরের ও রাগরাগিণীর প্রভাব ও রয়েছে | যা অন্যান্য অঙ্গের ঝুমুর গানের থেকে সহজেই দরবারী ঝুমুরকে অন্য ভাবে বুঝতে সাহায্য করে | নিম্নে কগুলি বৈচিত্র্যপূর্ণ দরবারী ঝুমুর গানের উদাহরণ দেওয়া হল-

“আসিল বসন্ত ঋতু হরসিত প্রাণ, নবসুরে কোকিলা, কোকিল করে গান “

“ওরে কানা ভ্রমর তুমি নাগর

কইর না আর ছটর ফটর “

উপরোক্ত দুটি দরবারী ঝুমুর গানে দেখা গেছে স্বর কাঠামো একই রকম কিন্তু স্থানভেদে বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ঘটেছে | এছাড়া অন্য কয়েক ধরণের ঝুমুরের প্রচলন বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় |

“কার গরভে কৃষ্ণ দশমাস রইল হরি হায়রে, কার দুধ পিয়ে বড় ভেলায় যমুনা তীরে, বাঁশীয়া বাজায় ধীরে ধীরে || “

রাঢ় বাংলার মধ্যে বিহারের ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশের অস্তিত্ব আছে বলে দেখা যায়, তাই এখানকার ঝুমুর গানে হিন্দি ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় | এই ঝুমুর গানগুলিকে ঝাড়খণ্ডি ঝুমুর বলে আখ্যা দেওয়া হয় |

আবার চা বাগান, কয়লাখনি অঞ্চলে প্রভৃতি কর্মস্থলে বিভিন্ন জাতির মানুষের সমাবেশ হয় বলে অর্থাৎ শ্রমিক বৃন্দের মধ্যে একটা মিশ্র ভাষা যুক্ত ঝুমুর গানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় |

উদাহরণ: “আল কিনারে নাহর গাছে

বগা বগা ফুল

ফুল কে দেখিয়া ছুরি

ধ্যাচাকে চামড়াইল || “

সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, যেকোন প্রকার ঝুমুর গানই হোকনা কেন, তার মধ্যে কখনও অনড় নিয়ম থাকতে পারে না. দেখা গেছে, একটি বিশেষ ঝুমুর গান যার অঞ্চল, জাতি বা সম্প্রদায় ভেদে ভিন্নরূপ গ্রহন করেছে. কোথাও দেখা যায় সাহিত্যের, কোথাও দেখা যায় সুরের ভঙ্গির এবং উচ্চারনের পরিবর্তন ঘটেছে. যাইহোক, রাঢ় বাংলার অন্যান্য গানের ধারাগুলির মধ্যে ঝুমুর গান বিশেষ ভঙ্গি, সাহিত্য, সুরবৈচিত্র্য, যন্ত্রানুসঙ্গ এবং নৃত্যের প্রয়োগে আপন মহিমায় জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রচলিত হয়ে চলেছে. এই ঐতিহ্যপূর্ণ ঝুমুর গানে কোনরুপ বিকৃতি না ঘটে, তার জন্য আমাদের সকলকেই সজাগ থাকতে হবে।


গ্রন্থপঞ্জী:

আশীষ গিরি. আরশী নগর . কলকাতা: রূপশালী, ২০১৩.
আশুতোষ ভট্টাচার্য. “লোকসংগীত রত্নাকর.” নিভা মুখোপাধ্যায় রচিত. কলকাতা, ১৩৭৪.
চিত্তরঞ্জন দেব. বাংলার পল্লীগীতি . কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা: লি: প্রথম মুদ্রণ, ১৯৬৬.
যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী. রাঢ়ের সাংস্কৃতিক ইতিহাস . নবদ্বীপ: নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ, ২০০৮.
দিনেন্দ্র চৌধুরী. “গ্রামীণ গীতি সংগ্রহ.” কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত একাডেমী, ১৯৯৯.
বিশ্বকোষ . ১ ম প্রকাশন. সংখ্যা ১৬ খণ্ড. কলকাতা.
শান্তি সিংহ. লোকসংগীত সংগ্রহ ঝুমুর . প্রথম সংস্করণ. কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত একাডেমী, ১৯৯৭.