January 1, 2020

গায়কী তৈরির উপায়

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture
নূর নবী মিরণ- ভয়েস ট্রেইনার, ঢাকা, বাংলাদেশ

গায়কী নামে একটি কথা আমাদের কন্ঠসঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিপুলভাবে প্রচলিত এবং আলোচিত। সাদামাটাভাবে গায়কী বলতে বোঝায় গান গাওয়ার ঢং। অন্তত আমি বিষয়টিকে এইভাবে বুঝি। গায়কী তৈরির বিষয় নিয়ে আমার বিশেষ কিছু ধারনা আছে যা প্রচলিত মতের সাথে কিছুটা ভিন্ন রূপ প্রকাশ করে। তাই গায়কী কথাটাকে আমি যেভাবে বুঝেছি তা আপনাদের সামনে বিস্তারিত ব্যাখ্যায় উপস্থাপন করতে চাই। আমার ভাবনার সাথে আপনার ভাবনার মিল হবে বা আপনি সহমত হবেন সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছিনা। যেহেতু আপনার ভাবনা আপনার মত আর আমার ভাবনা আমার মত হবে এটাই সত্যি। তবে সঙ্গীতাঙ্গনে দীর্ঘদিনের পদচারণা, সক্রিয়ভাবে এর সাথে পথ চলা এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিজ্ঞতার ফলে গায়কী নামক কথার প্রচলিত ধারণার সাথে আমার ধারণার কিছুটা তফাৎ আমার কাছে সুস্পষ্ট। সেই ভিন্নতার কথাই আজ আমি আপনাদের কাছে উপস্থাপন করতে চাই।
প্রচলিত ধারা মতে গায়কী হলো এক ধরনের গান গাওয়ার প্রক্রিয়া। যেমন খেয়াল, ধামার, টপ্পা, ঠুমরী, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, লোকসংগীত ইত্যাদি গানের প্রত্যেকটিই আলাদা আলাদা ঢং আছে এবং সেই আলাদা আলাদা ঢঙে গাওয়াকে বলা হয়ে থাকে গায়কী। আরো একটু খুলে বললে বলা যায় যদি রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া হয় তখন যেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো হয়, যখন নজরুল সংগীত গাওয়া হবে তখন যেন নজরুল সঙ্গীতের মত মনে হয়। আবার যখন খেয়াল গান গাওয়া হবে তখন যেন খেয়াল গানের আকার-আকৃতি ও রূপ খেয়াল গানের মতোই মনে হয়। অর্থাৎ শুনেই একজন শ্রোতা যিনি গান সম্বন্ধে মোটামুটি ধারনা রাখেন তিনি অনায়াসে বলে দিতে পারেন এটি কোন পর্যায়ের গান। তার মানে শ্রোতা গান শুনেই বলে দিতে পারেন কোনটি খেয়াল, কোনটি রবীন্দ্র সংগীত, কোনটি নজরুল সংগীত, কোনটি লোকসংগীত। অর্থাৎ শিল্পীর গান পরিবেশনার মধ্যে যেন গানের প্রকৃতির প্রকাশ সহজ ভাবে বোঝা যায় বা সহজে গানের প্রকৃতি নির্ণয় করা যায় সেইরকম পরিবেশনার প্রক্রিয়াকে বলা যায় গায়কী।

গান শুনে গানের প্রকৃতি চিনতে পারার বিষয়টি কি শুধু কণ্ঠসঙ্গীতের বেলাতে প্রয়োজন নাকি যন্ত্রসঙ্গীতের বেলাতেও সমানভাবে প্রয়োজন হয়। আমার বিশ্বাস পাঠকরা আমার সাথে একমত হবেন যে গান শোনার পর সেটি কোন পর্যায়ের গান তা বুঝতে পারা কণ্ঠসঙ্গীত এবং যন্ত্রসংগীত উভয় ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োজন। এখানে একটি প্রশ্ন দাঁড়ায় যে গায়কী কথাটা এককভাবে কণ্ঠসঙ্গীতের বেলায় প্রযোজ্য হলে যন্ত্রসঙ্গীতের বেলায় কি হবে। কথাটাকে যদি ধরে নেই গায়ক যেভাবে গান করেন, তাহলে যন্ত্রসঙ্গীতের বেলাতেও সেই অর্থের একটি যুৎসই শব্দ ব্যবহার করা দরকার। সেরকম কোন শব্দ আমার জানা নেই। আর যদি গায়কী শব্দকে ঢং হিসাবে চিহ্নিত করি তাহলে কন্ঠ এবং যন্ত্রের ক্ষেত্রে সমানভাবে এর ব্যবহার চলে। এই ক্ষেত্রে গানের প্রকারভেদ বা কোন পর্যায়ের গান সেটি বোঝার জন্য গায়কি নাকি ঢং কোন শব্দটি অধিক প্রযোজ্য তা পাঠক নিজগুণে বিবেচনা করবেন।

আমার আলোচনা কণ্ঠসঙ্গীত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। তারপরও বোঝার স্বার্থে প্রাসঙ্গিকভাবে যন্ত্রসঙ্গীতের উপমা এসে যেতে পারে। এ পর্যায়ে ধরে নিতে পারি গান গাওয়া ছাড়াও কেবল যন্ত্রের মাধ্যমে কোন গানের সুর বাজালেও সে গান কোন পর্যায়ের অর্থাৎ রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সঙ্গীত, লোকসংগীত ইত্যাদি পর্যায় বোঝা যেতে পারে। তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে গানের ঢং কে ঠিক করে দেন এবং তাতে কণ্ঠশিল্পীর করণিয়ই বা কি হয়ে থাকে।

এ নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে। তবে এখানে আমি আমার মতামত উপস্থাপন করছি। উপরের প্রশ্নমতে গানের ঢং কে ঠিক করেন তার উত্তরে প্রথম কথাতেই বলতে হয় যিনি গানের সুর সংযোজন করেন তিনি গানের ঢং সৃষ্টি করেন। রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করে বলা যায় যে তার লেখা সব গানে তিনি নিজেই সুর বসিয়েছেন। শুধু তাই নয় তার সমস্ত গীতিকবিতায় সুর বসানোর ধরন একেবারেই স্বতন্ত্র। নিজস্ব একটা ঢং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সেই কারণে বাংলা গানের প্রসঙ্গ এলেই রবীন্দ্রনাথের গানের কথা আসতেই হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা বাদ দিয়ে যেরকম বাংলা গানের কথা আলোচনা করা মুশকিল সেরকম নজরুল, রজনীকান্ত, ডিএল রায়, লালন ফকির সহ বহু সাধক কবি আমাদের বাংলা সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু আমার আলোচনা তাদের নিয়ে নয় বলে সেই দিকে যেতে চাইছি না। নজরুল ইসলামের গানের বেলায় দেখা যায় তার সব গানের সুর তিনি নিজে দেননি। নজরুল ছাড়া অন্য যারা তার গানে সুর বসিয়েছেন তাদের মধ্যে কমল দাশগুপ্ত, চিত্ত রায়, নিতাই ঘটক, শুভল দাশগুপ্ত এদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে মজার বিষয় হলো তারা সকলেই নজরুলের গানের সুরের বৈশিষ্ট্য নজরুলের মতো রেখেই সুর করেছেন। সে কারণে নজরুলের গানের সুরের ঢং আলাদা মাত্রা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে নজরুলের গানের ঢংয়ের কোন মিল পাওয়া যায়না দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া।

বিপরীত ধারার এই দুই ধরনের গানের মূল পার্থক্যের গোড়ার বিষয় দুইটি। একটি গীত রচনা অর্থাৎ শব্দ চয়ন আর অন্যটি সুর বসানোর প্রক্রিয়া। এই দুটির পার্থক্যের কারণেই বিখ্যাত এই দুই গীতিকবির গানের আলাদা বৈশিষ্ট্য রচিত হয়েছে। উপরে যদিও বলেছি সুরকারেই গানের ঢং তৈরি করেন এখন সেই কথার সাথে গানের কথাকেও সম্পৃক্ত করতে চাই। তাহলে দাঁড়ালো গানের কথা এবং সুর মিলিয়ে গানের ঢং সৃষ্টি হয়।

প্রশ্নের বাকি অংশ শিল্পীর করণীয় কি হওয়া দরকার। তার জবাবে বলব সেই ঢং কে প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করাই হলো শিল্পীর একমাত্র কাজ। এই গানের ঢং প্রতিষ্ঠার কাজে গায়কী নামক ভারি কথার চালে গানে ঢং প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে জটিল করার কোন আবশ্যকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। যত সহজ ভাবে বলা যাবে শিল্পীর পক্ষে গানে ঢং প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তত সহজ হবে। কেননা গানের ঢং প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ কৌশলগত বিষয়।

শ্রোতার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত একটি গানের তিনটি ধাপের শেষটিকে আমরা সাধারণ শ্রোতারা দেখে থাকি এবং শিল্পীর পরিবেশনা কে চূড়ান্ত হিসেবে ধরে থাকি। সেই কারণেই গীতিকার এবং সুরকারের অংশ যতই ভালো হোক না কেন যদি শিল্পীর অংশ অর্থাৎ শিল্পীর পরিবেশনার অংশটুকু খারাপ হয় তাহলে পুরো প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হতে বাধ্য। আবার গীতিকার ও সুরকারের অংশের কাজ যদি ততটা ভালো নাও হয় কিন্তু শিল্পী তার নিজ গুনে তাতে সফলতার ছোঁয়া দিতে সমর্থ হন। তাই গানের বিষয়ে শিল্পীর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।

গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে একজন শিল্পী কিভাবে নিজেকে তৈরি করবেন সে বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য আমি তিনটি ধাপ বিবেচনা করি। প্রথমটি গলা সাধা দ্বিতীয়টি গান সাধা এবং তৃতীয়টি হলো গান গাওয়া বা গান পরিবেশন করা। একজন কণ্ঠশিল্পীর জন্য এই তিনটি ধাপ পর্যায়ক্রমে সফলভাবে পার করা একান্ত প্রয়োজন। একটি গানের ক্ষেত্রে গীতিকার এবং সুরকারের কাজটি এককালীন হলেও শিল্পীর কাজটি এককালীন এর গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। তাকে প্রতিনিয়ত শাণিত করতে হয়।

আগেই বলেছি গানের ঢং নির্ভর করে তার কথা এবং সুর এর উপর। শুধু সুরের উপর নির্ভর করে গানের ঢং যেমন নিশ্চিত হয় না তেমনি কথার উপর নির্ভর করে ও ঢং নিশ্চিত করা যায় না। দু একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করতে চাই। যেমন “হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই” এই গানটি শুনলে আমাদের একটুও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটি একটি লোকসংগীত। এর সাথে আমাদের মাটির সম্পর্ক নিবিড় ভাবে মিশে আছে। রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুরে অন্য কথা বসালেন — “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে”। এর ফলে কি হলো! একই সুরে থাকা সত্ত্বেও গান পাল্টে গেল। কারণ দুটি গানের কথা একেবারেই আলাদা। একটি সাদামাটা কথা আর অন্যটি কাব্যকথা। এই ধরনের আরেকটি গান হলো —” মন মাঝি সামাল সামাল ডুবলো তরি ভব নদীর তুফান ভারী”। রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন— “এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী”। এই দুটি গানের ক্ষেত্রেও একই রকমের অবস্থা আমরা দেখতে পাই।

বিভিন্ন স্বরস্থানে ধ্বনির রং কিভাবে পাল্টায় তার একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা যাক। এখানে শব্দ না বলে ধ্বনি বলছি তার কারণ যেকোনো একটি স্বর যখন বিভিন্ন স্বরস্থানে উচ্চারিত হতে থাকে তখন প্রত্যেকটি স্বরস্থানের জন্য তার রং পাল্টাতে থাকে। বিভিন্ন স্বর হলে তো কথাই নেই। তাই শুরুতে শব্দ না বলে ধ্বনি কথাটা ব্যবহার করছি।

যেসব বস্তু দেখা যায় তার রূপ পাল্টাবার বিষয়টি আমরা সহজেই বুঝতে পারি। কারণ সেটি আমাদের কাছে দৃশ্যমান হওয়ায় তা নিয়ে আমাদের সংশয় থাকেনা। কিন্তু শব্দের বেলায় তা শ্রুতি নির্ভর হওয়ার জন্য আর সেটি আমরা দেখতে পাই না বলে শব্দের রূপ পরিবর্তনের বিষয়টি আমাদের বুঝতে একটু অসুবিধা হয়ে থাকে। তবে দৃশ্যমান এবং শ্রুতিমান উভয় ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ধারা একই নিয়মে হয়ে থাকে। এই শ্রুতির বিষয়টি বোঝার জন্য প্রথমে দৃশ্যমান বস্তু উদ্ধৃত করছি।

একটি লম্বা রেলগাড়ির দৃশ্য আমরা কি রকম ভাবে দেখি। এর একটি ছবি দেখলে আমাদের কাছে বিষয়টি একেবারে পরিস্কার হবে। আমরা দেখতে পাই রেলগাড়ির যে অংশ আমাদের কাছে থাকে তা বড় দেখায় আর রেলগাড়ির যে অংশটি আমাদের থেকে ক্রমশ দূরে থাকে তা ধীরে ধীরে সরু হয়ে যায়। আমরা যখন একটি লম্বা রেল গাড়ির ছবি দেখি তখন আমরা এইরকম দেখি। বাস্তব ক্ষেত্রে রেলগাড়ি কিন্তু সরু থাকেনা। আগাগোড়া একইরকম সমান থাকে। তারপরও আমরা ওইরকম দেখি— এটি হলো লম্বা বস্তুকে দেখার অনুভূতি। কাছে থেকে দূরে দেখার যে অনুভূতি নিচ থেকে উপরে দেখার অনুভূতিও একই রকম হয়ে থাকে।

আওয়াজ বা ধ্বনির বেলাতেও বিষয়টি একই রকমের হয়ে থাকে। এটি বোঝার জন্য আরেকটি উপমা উপস্থাপন করছি। ধরুণ আপনি কোন একটি রেললাইনের পাশে দাঁড়ালেন। দেখতে পেলেন দূর থেকে একটি ট্রেন আসছে আর সেটি বা দিক থেকে এসে আপনার সামনে দিয়ে ডান দিকে দিগন্তে মিলিয়ে গেল। সে ক্ষেত্রে দূর থেকে ট্রেন আসা, কাছে এসে আবার দূরে চলে যাওয়ার যে একটি অনুভূতি তা কমবেশি আমাদের অনেকেরই রয়েছে। চোখ বুজে এই ট্রেন যাবার দৃশ্য বিবেচনা করলে আওয়াজ শুনেই বলে দেয়া যায় ট্রেনটি ঠিক কখন সামনে দিয়ে পার হতে শুরু করেছে এবং কখন পুরো ট্রেন পার হয়ে গেল। ট্রেনটি যখন দূরে ছিল তখন ট্রেনের আওয়াজ ক্ষীণ ছিল। যাকে আমরা সরু আওয়াজ বলতে পারি। ট্রেন যত কাছে আসছে আওয়াজের জোর তত বাড়তে থাকে এবং যখন সবচেয়ে কম দূরত্বে আসে তখন আওয়াজ সবচেয়ে জোরে শোনায়। আবার যখন অন্য দিকে ক্রমশ দূরে চলে যেতে থাকে তখন আওয়াজ ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং একটা সময় ট্রেন অদৃশ্য হয় এবং সেইসাথে আওয়াজও মিলিয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে একটি বিষয় আমরা সকলেই জানি যে একই বেগে চলা ট্রেনের আওয়াজ কখনো জোরে কখনো আস্তে হয় না। একই রকম থাকে। তাহলে আমাদের কাছে আওয়াজ এর অনুভূতি এমন হবে কেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের জানতে হবে কখন এবং কিভাবে আওয়াজ পাল্টায়। আওয়াজকেও অনেকটা নিউটনের গতিসূত্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। নিউটনের সূত্রটি —কোন বস্তুর ওপর বাহ্যিক বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির থাকবে এবং গতিশীল বস্তু সমগতিতে চলতে থাকবে।

এই কেন এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখলাম একই গতিতে ট্রেন চলার পরেও আমরা কেন এ ধরনের আওয়াজ শুনতে পাই বা ট্রেন চলার আওয়াজ কেন আমাদের কাছে এমন অনুভূত হয়। যেহেতু এখানে ট্রেনকে উপমা হিসেবে ধরেছি তাই ট্রেনের কথাই বলার চেষ্টা করছি। ট্রেনের আওয়াজ আমাদের কাছে একই রকম না হয়ে ভিন্ন হওয়ার পেছনে দুটি কারণ সুনির্দিষ্ট বলে আমার মনে হয়। একটি ট্রেনের অবস্থানগত কারণ আর অন্যটি ট্রেনের অবস্থাগত কারণ। এই দুটির যে কোনটির সামান্য পরিবর্তনের জন্য ট্রেনের আওয়াজ আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন রকম শোনাতে বাধ্য। যে ধরনের আওয়াজের অনুভূতির কথা এখানে বলার চেষ্টা করেছি অর্থাৎ সরু থেকে মোটা হয়ে আবার সরু হবার যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়ে থাকে সেটি হয়ে থাকে ট্রেনের অবস্থানগত কারণের জন্য। আপনার অবস্থান থেকে ট্রেনের অবস্থান পাল্টে যাওয়ার কারণেই আপনার তেমন অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। যদি আপনার সাথে ট্রেনের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন না ঘটে তবে আপনি ট্রেন চলার আওয়াজের এই রকম অনুভূতি পাবেন না। যেমন আপনি যদি সেই ট্রেনে যাত্রী হন, তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা এরকম হবে না নিশ্চয়ই। আপনি ট্রেন চলার একই রকম আওয়াজ শুনে থাকবেন।

আপনি যখন ট্রেনের যাত্রী হবেন তখন সাধারণভাবে ধরে নেয়া যায় যে ট্রেনের অবস্থান এর সাথে আপনার অবস্থান এক অর্থাৎ ট্রেন ও আপনি সহ অবস্থান করছেন। এই অবস্থাতে যদি আপনি ট্রেনের আওয়াজ এর কোন পরিবর্তন অনুভব করেন তাহলে আপনি নিঃসন্দেহে বলতে পারবেন এটি ট্রেন চলার অবস্থাগত কারণের জন্য ঘটছে। অবস্থানগত কারণ একটি হলেও অবস্থাগত কারণ অনেক রকমের হতে পারে। আর যখন অবস্থান এবং অবস্থা দুটোই পরিবর্তনশীল হয় তখন কত ধরনের আওয়াজ সৃষ্টি হতে পারে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

ট্রেন নিয়ে অনেক কথাই বলেছি। এবার আমার মূল কথা আমাদের কণ্ঠস্বর বিষয়ে ফিরে আসি। আমাদের কণ্ঠস্বর ট্রেনের আওয়াজ এর মত অবস্থান ও অবস্থার পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন হতে থাকে। তবে এই পরিবর্তনের ধারা ও প্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এতে অবস্থান এবং অবস্থা এত দ্রুত পাল্টাতে থাকে যে তার হিসেব রাখা অত্যন্ত কঠিন। আমাদের কণ্ঠস্বর এর ক্ষেত্রে অবস্থান হলো স্বরস্থান (Pitch) আর অবস্থা হলো ধ্বনি বা কথা।

হারমোনিয়াম কে আমরা সবাই চিনি। এটি আমাদের সংগীতচর্চার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এই যন্ত্রের আওয়াজ তৈরীর অংশটিকে আমরা বাইরে থেকে দেখতে পাই না। যাকে বলা হয় রিড। ভিন্ন ভিন্ন রিডের ভিতর দিয়ে বাতাস বের হওয়ার ফলেই বিভিন্ন স্বরস্থানের আওয়াজ আমরা শুনতে পাই। বিভিন্ন স্বরস্থানের জন্য এর অবস্থা দেখলে আমরা বুঝতে পারবো যে ধ্বনি যত দূরে বা চড়ার দিকে যেতে থাকে রিডের আকার ততই ছোট হতে থাকে। লম্বা ট্রেনের ছবির মত যেমন কাছের অংশ বড় দেখায় এবং দূরের অংশ ছোট দেখায়। একইভাবে নিচু স্বরস্থানের বেলায় রিডের আকার বড় হয় আর চড়া বা দূরের স্বরস্থানের জন্য রিডের আকার ছোট হতে থাকে। হারমোনিয়ামের ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্বরস্থানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রিড ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের কণ্ঠস্বর এর জন্য আলাদা আলাদা রিড থাকে না। আমাদের ভোকাল কর্ডকে যদি রিডের সাথে তুলনা করা হয় তবে এই ভোকাল কর্ড নামক একটি রিড দিয়েই আমরা সব ধরনের স্বরস্থানের আওয়াজ তৈরি করে থাকি। ভোকাল কর্ডের আকার-আকৃতির পরিবর্তনের মাধ্যমে এই কাজটি সম্পন্ন করা হয়। সুতরাং আমাদের কন্ঠস্বরের মাধ্যমে আওয়াজ তৈরীর ক্ষেত্রে ট্রেন দেখার দৃশ্যগত অনুভূতির মত আওয়াজের অনুভূতি বুঝতে পারা দরকার। অর্থাৎ আওয়াজ তৈরীর ক্ষেত্রে নিচু স্বরস্থান বা কাছের আওয়াজ এর জন্য আওয়াজ মোটা হবে এবং দূরে বা চড়া স্বরস্থান বোঝাবার জন্য আওয়াজ সরু হবে। আমাদের কণ্ঠস্বর এর বেলায় এই সরু আওয়াজের তীক্ষ্ণতা বেড়ে যায়। আমাদের কণ্ঠস্বরের স্বরস্থানের পরিবর্তন এবং শব্দের পরিবর্তন দুই জায়গা থেকে হয়ে থাকে। কিন্তু একসাথে। স্বরস্থানের পরিবর্তন হয় স্বরযন্ত্রের মাধ্যমে আর শব্দের পরিবর্তন হয় বাগযন্ত্রের মাধ্যমে।

এবার দেখা যাক আমাদের স্বরযন্ত্র কিভাবে কাজ করে এবং স্বরস্থান তৈরিতে এর ভূমিকা কি রকম হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্বরযন্ত্রের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত কাজের উল্লেখ করছি। স্বরযন্ত্রের মূল অংশ ভোকাল কর্ড। ফুসফুস থেকে বের হওয়া বাতাসের ধাক্কায় ভোকাল কর্ডে কম্পনের সৃষ্টি হয়। তার ফলে আমাদের প্রাথমিক ধ্বনি বা মূল ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এই প্রাথমিক ধ্বনি বাগযন্ত্রের ভিতর এসে শব্দের রূপ নেয়। তবে স্বরস্থানের (Pitch) পরিবর্তন ভোকাল কর্ডের অবস্থাগত কাজের ফসল। যখন আমরা নিচু স্বরস্থানের আওয়াজ করি তখন ভোকাল কর্ড লম্বায় ছোট এবং পুরু থাকে। আবার যখন আমরা উচ্চ স্বরস্থানের আওয়াজ তৈরি করি তখন ভোকাল কর্ড স্বরস্থানের সাথে সঙ্গতি রেখে লম্বা হতে থাকে। এতে করে ভোকাল কর্ড সরু এবং পাতলা হতে থাকে। তিন মাত্রা বিশিষ্ট নরম তুলতুলে একটি রাবার খন্ডের দুই প্রান্ত ধরে হালকাভাবে টানলে যে রকম রাবার খণ্ডটি মাঝখানে চিকন ও পাতলা হতে থাকে ভোকাল কর্ড লম্বা হলে অনেকটা সেরকম হয়ে থাকে। আর তার ভিতর দিয়ে বাতাস প্রবাহের ফলে সৃষ্ট ধ্বনির স্বরস্থান উঁচুতে উঠে আসে। এই অবস্থাতে উঁচু স্বরস্থান যুক্ত ধ্বনি তৈরীর ক্ষেত্রে ভোকাল কর্ডের কম্পন তৈরির জন্য বাতাস প্রবাহের বাড়তি চাপের দরকার হয় না। অর্থাৎ নিচু স্বরস্থানের জন্য বাতাসের যে চাপ উঁচু স্বরস্থানের জন্যও বাতাসের চাপ সমান থাকে। স্বরস্থান তৈরীর জন্য ভোকাল কর্ডের ছোট থেকে বড় বা বড় থেকে ছোট একই সাথে পাতলা সরু ইত্যাদি আকারের পরিবর্তনকে বলা হচ্ছে এর অবস্থার পরিবর্তন। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন স্বরস্থানের জন্য ভোকাল কর্ডের অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যদিও আমরা সমস্ত রকমের কথা ধ্বনি বা আওয়াজ আমাদের বাগযন্ত্রের সাহায্যে করি তথাপি সেই কথা ধ্বনি বা আওয়াজকে কাছে বা দূরে বলার অনুভুতি তৈরিতে ভোকাল কর্ড সরাসরি কাজ করে। ভোকাল কর্ডের সরাসরি ভূমিকা ছাড়া কথার মাধ্যমে কাছের-দূরের অনুভূতি তৈরি করা সম্ভব নয়।

মানুষ যত ধরনের কথা বলে, যত ভাষায় কথা বলে সবই হয়ে থাকে বাগযন্ত্রের সাহায্যে। স্বরযন্ত্র থেকে সৃষ্ট অস্ফুট ধ্বনি বাকযন্ত্রের মধ্যে এসে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হয়ে শব্দে রূপান্তর হয়। সেই শব্দকে আমরা আমাদের প্রয়োজনে নানাভাবে ব্যবহার করি। কখনো কাছে কখনো দূরে কখনো আস্তে আবার কখনোবা জোরে ইত্যাদি। যেহেতু শব্দ দৃশ্যমান হয় না সে ক্ষেত্রে আমরা অনুভূতির সাহায্যে শব্দের এসব রূপ বুঝতে পারি।

বাগযন্ত্র হল রূপান্তর প্রক্রিয়া। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ার মূল কাজের অঙ্গগুলি যেমন মুখের ফাঁপা অংশ, নাকের ফাঁপা অংশ, জীভ, আলজিভ, মুখের নরম তালু, শক্ত তালু, চোয়াল, গাল ইত্যাদি অংশ নানা ধরনের চাপের মাধ্যমে স্বরযন্ত্র থেকে আসা ধ্বনিকে শব্দে রূপান্তর করে। এই রূপান্তরিত শব্দ কেবল একটি শব্দ হয়। রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট এই শব্দকে আমাদের ব্যবহার উপযোগী অনুভূতি প্রকাশক করবার জন্য আরেকটি প্রক্রিয়া এর সাথে যোগ হয়। যাকে বলা হচ্ছে অনুরণন বা রেজোন্যান্স। এই অনুরণন প্রক্রিয়া আমাদের বাগযন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আমাদের সকল প্রকার বাচিক কাজ যেমন— কথা বলা, গান করা, কবিতা পড়া, অভিনয় করা, সংবাদ পাঠ করা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা, শিক্ষকতা করা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনুরণনই মূল ভূমিকা পালন করে। কেননা অনুরণন উচ্চারিত প্রতিটি শব্দকে অর্থবহ করে তোলে। একই শব্দকে বিভিন্ন ভাবে বলার ঢং এর কারণে বিভিন্ন রকম অর্থ প্রকাশ পায়। একটি শব্দকে বিভিন্ন রকম করার পিছনে আমাদের শরীরের যে প্রক্রিয়া কাজ করে তাকে বলা হয় অনুরণন। অনুরণন হলো আমাদের শরীরের একটি শারীরিক প্রক্রিয়া যা আমরা একপ্রকার অনুভুতি হিসেবে বুঝে থাকি। এই অনুভূতি আমাদের সকল ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশকে সহজ করে, বোধগম্য করে।

যেহেতু আমাদের আলোচনার বিষয় গান গাওয়ার ঢং বা গায়কী তাই গান গাওয়ার ক্ষেত্রে গায়কী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনুরণন এর ভূমিকার মধ্যে আলোচনা সীমিত রাখার চেষ্টা করছি। গান গাওয়ার ক্ষেত্রে অনুরণন কিভাবে কাজ করে। গানকে যদি একটি গল্প বলার বিশেষ রীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তবে বিষয়টি বোঝার ক্ষেত্রে অনেক সহজ হবে বলে আমি মনে করি। কেননা গীতি কবিতায় অন্তর্নিহিত একটি গল্প থাকে। গান গাওয়ার বিশেষ ঢঙে সেই গল্প দর্শক শ্রোতার কাছে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। যে শিল্পী সেই গল্পকে যত আবেগময় করে উপস্থাপন করতে পারেন তিনি তত সফলকাম হন। গানের গল্পকে আবেগময় করার একমাত্র উপায় হলো অনুরণন।

এবার দেখার চেষ্টা করি গান করবার ক্ষেত্রে অনুরণন কিভাবে কাজ করে। আগেই বলেছি আমরা বাচিক যে কাজই করি না কেন তার মূলে থাকে একটি আওয়াজ। অর্থহীন আওয়াজ। যার উপর ভর দিয়ে বা বলা যায় সে অর্থহীন আওয়াজকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শব্দে রূপান্তর করা হয়। মূল আওয়াজ তৈরি করার সময় অনুরণন এর ভূমিকা থাকে। অর্থাৎ মূল আওয়াজ তৈরীর সময় অনুরণন যুক্ত আওয়াজ তৈরি করা প্রয়োজন। অনুরণন সম্বৃদ্ধ আওয়াজ একবার তৈরি করা সম্ভব হলে সেই আওয়াজ দিয়ে যত ধরনের শব্দ তৈরি করা হবে সব শব্দই অনুরণন যুক্ত হবে। এখন প্রশ্ন হলো আওয়াজ তৈরীর সময় অনুরণন কি আপনাতে হয় নাকি অনুরণন যুক্ত আওয়াজ তৈরি করতে হয়। আমরা সাধারণভাবে প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে যেভাবে কথা বলি তাতে সঠিকমাত্রায় অনুরণন না থাকলেও অনুরণন যুক্ত কথাই বলে থাকি। এটি কথা বলবার স্বাভাবিক ধারার একটি রূপ। শরীরকে শান্ত রেখে, চাপমুক্ত রেখে, কথা বলবার জন্য আলাদা কোনো চাপ সৃষ্টি না করলে উৎপন্ন ধ্বনি বা শব্দ আপনাতেই অনুরণন যুক্ত হয়। স্বাভাবিক কথোপকথনের সময় আমরা এক একজনের কথা বলার ধরন একেক রকম দেখি। কারো আওয়াজ ক্ষীণ, কারো আওয়াজ তীক্ষ্ণ, কারো আওয়াজ ফ্যাঁসফ্যাঁসে, কারো আওয়াজ কর্কশ, কারো আওয়াজ ভাঙ্গা ভাঙ্গা শুনি। আবার কোন পুরুষের কণ্ঠস্বর মেয়েদের মতো হয়ে থাকে। যদি শারীরিক সমস্যা না থাকে তবে এত ভিন্ন ধরনের আওয়াজ বা ভিন্ন ধরনের কণ্ঠস্বর এর মূল কারণ ধ্বনি যন্ত্র ব্যবহার প্রক্রিয়ার ভিন্নতা। অনুরণনের মাত্রার ভিন্নতার কারণেই এমন হয়ে থাকে। সঠিক পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে এই সব সমস্যার সমাধান দেয়া সম্ভব।

কিন্তু বাচিক শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখা দরকার। কেননা বাচিক শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক ধরনের অভিব্যক্তিকে দর্শক-শ্রোতার কাছে গ্রহনযোগ্য করে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। অনুরণন এর অবস্থা, অবস্থান এবং মাত্রার তারতম্যের উপর নির্ভর করে অভিব্যক্তির প্রকাশভঙ্গি। তাই প্রথমে শব্দ বা ধ্বনিতে সঠিক অনুরণন তৈরীর কৌশল শিখতে হবে। তারপর এই অনুরণনকে প্রয়োজন মত ব্যাবহার করার পদ্ধতি শিখতে হবে। একজন বাচিকশিল্পীর জন্য এই দুইটি কৌশল শেখা অত্যন্ত জরুরী। এই দুইটি কৌশল ভালোভাবে আয়ত্ত করতে না পারলে একজন শিল্পীর প্রকৃত গায়কী বা গান গাওয়ার ঢং তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।

অনেকেই বলে থাকেন গান গাওয়ার সময় কিভাবে আবেগ দেওয়া যায়। এই ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে আবেগ দেওয়া যায় না। অর্থাৎ বাইরে থেকে চাপের মাধ্যমে গানে আবেগ তৈরি করা যায় না। আবেগ আপনাতেই তৈরি হবে। এই আবেগকে তৈরি করে অনুরণন। সঠিক অনুরণনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হল আবেগ। সুতরাং সঠিক অনুরণন সৃষ্টি করতে পারলেই সঠিক আবেগ প্রকাশ আপনাতেই হবে। তাই গানের সঠিক গায়ন পদ্ধতি বা গায়কী তৈরীর মূল কাজ হলো আওয়াজে অনুরণন তৈরি করার সঠিক কৌশল রপ্ত করা। প্রকারান্তরে বলা যায় গায়কী হলো কৌশলগত বিষয়। ভাবগত বিষয় নয়। আমরা অনেকেই গায়কীকে ভাবগত বিষয়ের অন্তর্গত করে এটিকে অত্যন্ত জটিল পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। এরকম জটিল গোলকধাঁধার ভিতর থেকে আমাদের বের হওয়া দরকার। তা না হলে সামনে এগোবার পথ আমাদের খোলা থাকবে না।

এখন দেখার চেষ্টা করি অনুরণন কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে। আমরা যখন নিচু স্বরস্থানের কোন শব্দ উচ্চারণ করি তখন আমাদের বুকে এক ধরনের কম্পন অনুভব করি। সেটি হল ভোকাল কর্ডের সাহায্যে মূল ধ্বনি উৎপাদন প্রক্রিয়ার অনুরণন। সঠিক পদ্ধতিতে শব্দ উৎপন্ন হলে বুকের মধ্যকার সেই কম্পনের রেশ উৎপন্ন ধ্বনিতে মিশে নির্দিষ্ট স্বরস্থানের একঘেয়ে ধ্বনিকে ঝংকৃত ধ্বনিতে রূপান্তর করে। বিশেষ কিছু পদ্ধতিতে গলা সাধার মাধ্যমে ধ্বনির অনুরণন তৈরি করা সম্ভব।

আমাদের কন্ঠের ব্যপ্তিকে সাধারণভাবে তিনটি রেজিস্টার বা অঞ্চলে ভাগ করা হয়। যেমন চেষ্ট রেজিস্টার, মিড রেজিস্টার এবং হেড রেজিস্টার। আমরা যখন নিচু স্বরস্থানে ধ্বনি তৈরি করি তখন আমাদের চেস্ট রেজিস্টারে অনুরণন হয়। আমরা যখন ধ্বনিকে উচ্চ স্বরস্থানের দিকে নিতে থাকি তখন উচ্চ স্বরস্থানে যাবার গতির সাথে তাল মিলিয়ে চেস্ট রেজিস্টারের অনুরণন মিড রেজিস্টার হয়ে হেড রেজিস্টার এর দিকে যায়। আবার যখন উচ্চ স্বরস্থান থেকে ধ্বনিকে নিচু স্বরস্থানের দিকে নামানো হয় তখন একই নিয়মে অনুরণন হেড রেজিস্টার থেকে মিড রেজিস্টার হয়ে চেস্ট রেজিস্টারে নেমে আসে। এটি হলো ধ্বনি নিচু থেকে উঁচুতে বা উঁচু থেকে নিচে চলাচলের আদর্শ নিয়ম।

এবার দেখব অনুরণন আমাদের গান পরিবেশনের ঢং তৈরিতে বা গায়কীতে কিভাবে কাজ করে। আমরা সবাই জানি গানের কথা এবং স্বরস্থান দুটোই অনবরত পাল্টাতে থাকে। কথা এবং স্বরস্থান যতভাবে পাল্টাক না কেন ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নির্ধারিত কথার একটি সমন্বিত রেশ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকা একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে গানের মাধুর্য নষ্ট হয়। আর এই কাজটি করে থাকে অনুরণন। ভিন্ন ভিন্ন স্বরস্থানে যেরকম ভিন্ন ভিন্ন শব্দের আকার-আকৃতি পাল্টায় তেমনি একই স্বরস্থানে ভিন্ন ভিন্ন শব্দেরও আকার-আকৃতি পাল্টায়। আবার একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন স্বরস্থানের ক্ষেত্রে আকার আকৃতির পরিবর্তন ঘটে।

সাধারণভাবে নিচু স্বরস্থানের ক্ষেত্রে আওয়াজ এর উৎপত্তিস্থল কাছে এবং উঁচু স্বরস্থানের ক্ষেত্রে আওয়াজের উৎপত্তিস্থল দূরে হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ হওয়া দরকার। সাধারণভাবে নিচু স্বরস্থানের আওয়াজ এর ক্ষেত্রে শব্দের জোর বাড়বে এবং তীক্ষ্ণতা কমবে আর উঁচু স্বরস্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রে শব্দের জোর কমবে এবং তীক্ষ্ণতা বাড়বে। কাছের আওয়াজ আর দূরের আওয়াজ এর অনুভূতি সৃষ্টি করবার একমাত্র উপায় হলো অনুরণনের অবস্থান পরিবর্তন। কাছের আওয়াজের জন্য অনুরণনকে চেস্ট রেজিস্টার এ রাখা এবং দূরের আওয়াজের জন্য অনুরণনকে ধারাবাহিকভাবে হেড রেজিস্ট্রারের দিকে প্রেরণ করা হলো আদর্শ উপায়।

স্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গিমায় গানের কথা উপস্থাপন করা একজন কন্ঠশিল্পীর বড় কাজ। কথা যে স্বরস্থানে থাকুক বলার ভঙ্গিমা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সাধারন হওয়া বাঞ্ছনীয়। গানের ক্ষেত্রে কথাকে ভিন্নরূপে বা ভিন্ন রকমের উচ্চারণে বলা সঠিক নয়। একটি শব্দ গানের ক্ষেত্রে যে কয়টি স্বরস্থান থেকে শুরু হোক তাতে শব্দের প্রমিত উচ্চারণ এর পরিবর্তন করা যুক্তিযুক্ত হয় না। স্বরস্থানের পরিবর্তনের কারণে আমরা শব্দের যে ভিন্ন রকমের আওয়াজ শুনি তা শব্দের আকার-আকৃতির পরিবর্তনের রূপ। ভিন্ন শব্দের রূপ নয়। যদি ভিন্ন স্বরস্থানের কারণে শিল্পী নিজে কোন একটি শব্দকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ করেন তবে তিনি নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবেন। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে ভিন্ন স্বরস্থানের কারণে শব্দের আকার পরিবর্তন হয় কিন্তু আকৃতির পরিবর্তন হয় না। কেননা আমরা শব্দ উচ্চারণ করি আমাদের বাগযন্ত্রের সাহায্যে। অর্থাৎ ধ্বনি যন্ত্র থেকে উৎপন্ন ধ্বনিকে আমরা শব্দে রূপ দেই। এটি প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ভাগ। বাগযন্ত্রের সাহায্যে শব্দের সঠিক উচ্চারণ বজায় রাখা একমাত্র কাজ। সেই শব্দ যে স্থানের হোক আমাদের উচ্চারণ বা বলার ভঙ্গি একই থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন স্থানের জন্য শব্দের আকারের যে পরিবর্তন হয় তা বাগযন্ত্রের কারণে হয় না। তা হয় ধ্বনিযন্ত্রের কারণে। যে মূল ধ্বনিকে শব্দে রূপ দেয়া হয় যদি তার আকার-আকৃতি পাল্টে যায় তবে সেই পরিবর্তিত ধ্বনির সাহায্যে যে শব্দ তৈরি করা হবে তার রূপ আপনাতেই পাল্টাবে।

আমাদের আলোচনার মূল বিষয় হল গান গাওয়ার ঢং বা গায়কী। আলোচনার এই পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে যে একজন কন্ঠশিল্পীর গায়কী নির্ভর করছে শব্দের আকার আকৃতি এবং ঘনত্বের উপর। যে শিল্পী যত নিখুঁতভাবে এই তিনটি অবস্থার সঠিক সমন্বয় করতে পারবেন তাঁর পরিবেশনা তত প্রাঞ্জল হবে। এখানে আকৃতি বলতে গানের কথা /শব্দ/ ধ্বনি বা বর্ণকে বোঝানো হয়েছে। আকার বলতে বোঝানো হয়েছে স্বরস্থানকে। আর ঘনত্ব বলতে বোঝানো হয়েছে কথা বা ধ্বনির তীব্রতা অর্থাৎ কতটা জোরে বা কতটা আস্তে বলা হবে সেই বিষয়টিকে। আগেই বলেছি এই তিনটির যে কোনটির পরিবর্তনের কারণে ধ্বনির ভিন্নতা তৈরি হয়।

পরিশেষে এইটুকুই বলতে চাই যে গান গাওয়ার ঢং বা গায়কী কোন ভাবগত বিষয় নয়। এটি সম্পূর্ণ কৌশলগত বিষয়। যত স্বাভাবিক অবস্থায় থেকে একজন শিল্পী কথার আকার আকৃতি এবং তীব্রতা সৃষ্টির যত ধরনের কৌশল রপ্ত করতে পারবেন তার গায়কী তত ভালো হবে। কৌশল গুলি ধারাবাহিকভাবে প্রথমে চর্চা করতে হবে, চর্চার মাধ্যমে সেগুলিকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে এবং চূড়ান্তভাবে স্বভাবে পরিণত করতে পারলেই শিল্পীর সার্থকতা।