May 1, 2023

বাংলা চলচ্চিত্রে আবহসংগীত ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ড. চন্দন কুমার রায়, অতিথি শিক্ষক, যন্ত্রসংগীত বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

হেমন্ত মুখো পাধ্যায়‘–এই নামটি শুধুমাত্র একজন সংগীত শিল্পী-র নয়, একজন সংগীত পরিচালকের নয়, একজন বিশিষ্ট সূরকারের নয়, —এটি একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। হেমন্ত মুখো পাধ্যায় একজন কণ্ঠসংগীত শিল্পী, এই প্রসঙ্গে যদি আলোচনা হয়, তবে আলোচনার শেষ হয় না। তাঁর কন্ঠই ছিল মনে আবেশ ধরানোর একটা বিষয়। তারপর তাঁর সাংগীতিক ভাব প্রকাশ, সংগীতের নান্দনিকতা–এগুলি বহু আলোচ্য বিষয়। কণ্ঠ-সংগীত শিল্পী হিসাবে এক কিংবদন্তী, এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। এরপর আসি একজন সংগীত পরিচালক ও সুরকারের কথায়। এখানেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেন একটি বিশেষ দর্শন। তাঁর সুরে অসংখ্য গান চিরন্তন হয়ে আছে। শুধু বাংলাতেই নয়, তৎকালীন বোম্বাই শহরে পৌঁছে তিনি গায়ক ও সংগীতকার হিসাবে একটা দাগ রেখে গেছেন। যদিও তিনি বোম্বাইতে বেশি কাজ করেন নি, বাংলাতেই তিনি ফিরেছিলেন এবং আরও নতুন নতুন সংগীত সম্ভারে ভরিয়ে দিয়েছিলেন শ্রোতার মন। হেমস্ত মুখোেপাধ্যায় এমন একটা যুগে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, যে সময়ে সংগীত ছিল গায়ক-বাদক-নর্তকদের কাছে একটা সাধনা, গীতিকারের সাধনা, শ্রোতার সাধনা, দর্শকের সাধনা। এর ফলেই সৃষ্টি হতো এক-একটি অমূল্য সংগীত, অমূল্য সম্পদ। সুরকার যখন সুর করতেন, তখন তিনি বসতেন গীতিকারের সঙ্গে এবং যাঁদের কথা ও সুরে যে শিল্পী গান গাইবেন, তিনিও বসতেন তাঁদের সঙ্গে। এর উদ্দেশ্য কী ছিল?–গীতিকারের গীতিকাব্যের ভাব বা দর্শন অনুযায়ী সুরকার সুর করবেন এবং শিল্পী কথা ও সুর অনুযায়ী তাঁর গানকে ফুটিয়ে তুলবেন। ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৬ জুন ১৯২০ – ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯)

একজন কিংবদন্তি বাঙালি কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রযোজক ছিলেন। তিনি হিন্দি সঙ্গীত জগতে হেমন্তকুমার নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি বাংলাহিন্দি এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন। তিনি রবীন্দ্র সংগীতের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন। তিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়ক বিভাগে দু-বার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়াও ফিল্মফেয়ার সহ অসংখ্য দেশি ও বিদেশি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি উপমহাদেশের সবথেকে শ্রেষ্ঠ একজন শিল্পী ছিলেন, বিভিন্ন ঘরানার গানে তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। নানামুখী গানে আর কোন শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সমকক্ষ হতে পারেনি।হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে বলা হয় সঙ্গীতের ঈশ্বর ’।[i]

Hemanta Mukherjee: কবিতা কৃষ্ণমূর্তির নাম কবিতা

আমরা সেই স্বর্ণযুগের রেশ ধরে যদি হেমন্ত মুখাোপাধ্যায়ের গান নিয়ে আলোচনা করি, তবে এটুকু বলতে পারি, এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে, তবুও এই অনন্ত সুর-সাগরের তল পাওয়া খুবই দুঃসাধ্য। আমি আমার যৎসামান্য সাঙ্গীতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে সেই প্রসঙ্গে নাই বা গেলাম। বরং একটি স্বল্প-আলোচিত দিক–অর্থাৎ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন চলচ্চিত্রে আবহ-সংগীতকার হিসাব যে অবদান রেখেছেন, সেই বিষয়ে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।

আবহ সংগীতকার হিসেবে হেমন্ত মুখোেপাধ্যায়ের অবদান আলো চনা করার আগে একটু দেখে নিই, তাঁর পুর্বে বাংলা চলচ্চিত্রের আবহসঙ্গীত কেমন ছিল। ‘চিত্রভাষ’পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট পরিচালক তপন সিংহ বলেছিলেন,–

“….ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের একটা স্বতন্ত্র ডেফিনিশন আছে। আমিও এটা ডিসটিঙ্কট্ করতে পারিনি, ভারতীয় ছবিতেও এর সঠিক প্রকাশ হয় না। আগেকার ছবিতে (ভারতীয় ছবি সাধারণত টিয়ারজার্কার টাইপ) একটা করুণ দৃশ্যে হাতে বেহালা নিয়ে একটা দেশ রাগের সুর বাজিয়ে দেওয়া হত। কিংবা একাকিত্বের কিছু একটা বোঝাতে নীলাম্বরী বলে ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট একটা সুর বাজিয়ে দেওয়া হল। এইটাই বহুদিন ধরে বাংলা ছবিতে চলে আসছিল। রবিবাবু (রবিশঙ্কর) এসে এটা ভাঙলেন। একদম দেশজ সুর উনি ব্যবহার করলেন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে যেখানে কোনো ওয়েস্টার্ন নোটস্ থাকবে না।”[ii]  তপনবাবু সময়ের কথা বলছেন, সেটা হল পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিক। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি’ (১৯৫২), তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৫৪) ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন রবিশঙ্কর। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ (১৯৬০)-এ সুরারোপ করেছিলেন উস্তাদ আলি আকবর খা। কিন্তু এগুলিকে ঠিক মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি হিসেবে ধরা হয় না। বাংলায় ‘বাণিজ্যিক ছবি’ বলতে আমরা যা বুঝি, তাতে অনেক কালজয়ী গান ব্যবহৃত হয়েছে রাইচাদ বড়াল-পঙ্কজকুমার মল্লিকের আমল থেকে; কিন্তু আবহসংগীতের বিমূর্ত রূপটির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ১৯৫০-এর দশকে মূল ধারার বাংলা চলচ্চিত্রে আবহসংগীত ব্যবহারে গভীর চিন্তা-ভাবনার পরিচয় দিলেন হেমন্ত মুখোেপাধ্যায়, যা বহুলাংশে ব্যতিক্রমী।

আবহসংগীত সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার ব্যাপ্তি কতখানি ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর একটি নিবন্ধ আলোেচনায় (‘কান পেতে রই’, ২ আগস্ট ১৯৮৬, ‘দেশ’ পত্রিকা)। এখানে তাঁর বক্তব্য-“চলচ্চিত্রের সংগীতের কিন্তু আরও একটি রূপ হয়েছে, সেটা কথা সংগীত বা গান নয়, আবহসংগীত। আবহসংগীত বিহীন কোনো চিত্র কল্পনাই করা যায় না। আবহসংগীত বাণিজ্যিক ছবিই হোক বা আর্ট ফিল্ম-ই হোক, তার একটি বিশেষ প্রয়ো  জনীয় ব্যাপার।… বিদেশি ছবিতে আবহসংগীত ছবির মুখ্য ব্যাপার হলেও, আমাদের বাংলা ছবিতে এদিকে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। আগের যুগে আবহ-সংগীত রচনার দায়িত্ব সবসময়ে সংগীত পরিচালকেরও থাকত না। কোনো অর্কেষ্ট্রার দলকে দায়িত্ব  দেওয়া হত। কিন্তু এখন আবহ-সংগীত রচনার দায়িত্বও সংগীত পরিচালকেরই।

কিন্তু তার জন্য ছবিটির প্রজেকশন্ একাধিকবার দেখা দরকার এবং তারও পূর্বে সমগ্র চিত্রনাট্যটি সংগীত-পরিচালকের সঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলো চিত হওয়াও প্রয়ো  জন। কিন্তু এ ব্যাপারে অনেকেই বড় অসাড়। এবং যা হয় একটা টাইটেল মিউজিক বা সূচনাসংগীত এবং তারপর যেখানে-সেখানে দু’-চারটি যন্ত্রের টুং টাং করে আবহ-সংগীত রচনা করা হয়। ফলে বহু নাটকীয় মুহুর্তও বিস্বাদ হয়ে যায়।” আবহ সংগীতের ক্ষেত্রে হেমন্ত সাধারণত উচ্চকিত শব্দগ্রাম পছন্দ করতেন না। চরিত্র বা ঘটনার আবেদনকে যোগ্য সঙ্গত দেবার জন্য যতটুকু প্রয়ো  জন ততটুকুই রাখতেন।

চলচ্চিত্রে দৃশ্যটি উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে, না কি ঘরের মধ্যে অভিনীত হয়েছে, সে বিষয়ে দৃষ্ঠি রাখতেন এবং সেই অনুযায়ী আবহের ‘সাউন্ড এফেক্ট’ নির্ধারণ করতেন। এ প্রসঙ্গেপরিচালক তরুণ মজুমদারের স্বৃতিচারণ থেকে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়–

‘বালিকা বধু’ ছবির শেষ দূশ্যে-যেখানে নায়ক-নায়িকার পূনর্মিলন ঘটছে, সেখানে হেমন্ত আবহে ‘আমার পরাণ যাহা চায়’ গানটির সুর ব্যবহার করলেন বেহালায়। এবার ছবির সঙ্গ সুর মেলানোর জন্য যখন রি-রেকর্ডিং হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই আওয়াজ বাড়িয়ে দেওয়া হল। কিন্তু শুনতে গিয়ে তরূণবাবুর মনে হল, বেমানান লাগছে। সেকথা হেমন্তবাবুকে জানানো  হতেই তিনি বললেন, “বাড়াচ্ছেন কেন মিউজিকটা, আমি তো সেভাবে করিনি। মনে হবে যেন অনেক দূর থেকে সুরটা ভেসে আসছে, কখনও কখনও প্রায় শোনাই যাবে না। যেমন আছে সেভাবেই রেখে দিন, ভালো লাগবে।” তাঁর কথামতো কাজ হতেই দেখা গেল, শেষ দূশ্যে ঠিক যেরকম আবেদন চাইছিলেন পরিচালক, সেরকমই পেয়ে গেলেন।

গান নেই, সংলাপ নামমাত্র, এমন এক-একটি দৃশ্যকেও শুধু আবহসংগীত প্রয়োগে উত্তীর্ণ করে দিতে পেরেছেন হেমন্ত। মনে পড়ে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে নায়ক-নায়িকার সম্পর্কের টানাপোড়েনের দৃশ্যগুলি। আবহে ব্যবহার করলেন সানাইয়ের সঙ্গে ভায়োলিন –বােনের বিয়ের মন্ত্রোচ্চারণের পশ্চাৎপটে মনে পড়ে গেল অর্চনার বিবাহবিচ্ছেদের করুণ সুর।

‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে নির্মল হাস্যরস সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করেছেন ড্রাম এবং তবলা। কড়া মেজাজের সরস্বতী যখন দলবল নিয়ে এগিয়ে আসে, তখন আবহে বাজতে থাকে কুচকাওয়াজের ড্রাম। আর ‘ছন্দবাণী’ ক্লাবের দূশ্যটিতে যেভাবে তবলা-বাদকের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে চলেছে সবাই, তা দেখলেই কৌতুকের আবেশে মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ‘ক্ষণিকের অতিথি’ ছবির শীর্ষসংগীতে তিনি  রবীন্দ্রনাথের ‘হে ক্ষণিকের অতিথি/এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া’ গানটির সুর ব্যবহার করেছেন, যা এই চলচ্চিত্রের কাব্যিক মেজাজকে ধারণ করে রাখে। শেষ দৃশ্যেও আবার সেই একই সুর ফিরে আসে ক্ষণিকের জন্য —আবার তার সঙ্গে মিলে যায় এসরাজ, বাঁশি আর ভায়োলিনের মিশেলে একটা অনবদ্য কম্পোজিশন।

‘খো কাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ছবিতে রাইচরণরূপী উত্তমকুমার যখন খোকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তখন ট্রাম্পেট, পিয়ানো আর ভায়ো  লিনের সমন্বয়ে এক মর্মস্পর্শী আবহ দৃশ্যটির বেদনা ও উদ্বেগকে ঘনীভূত করে তোলে। ছবিতে প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট ধরে খোঁজাখুঁজির দৃশ্যটি চলতে থাকে। মাঝে মাঝে ‘খো কাবাবু’বলে ডাক ছাড়া আর কোনো সংলাপ নেই। শেষে যখন নদীর ধারে এসে দাঁড়ায় রাইচরণ, আর ঢেউ পাগলের মতো আছড়ে পড়ে পাড় ভাঙতে থাকে, তখন হেমন্তের গলায় শোনা যায় ,’ র্ম – র্গ র্ম র্গ র্র র্স ন (কোমল) ধ প গ ম গ ‘– স্বরগুলি ছুঁয়ে এক করুণ আলাপ, যা দৃশ্যটিকে এক অপরিমেয় গভীরতায় ঋদ্ধ করে। এভাবে আবহে নিজের কন্ঠ ব্যবহারের এই পরিকল্পনা সে যুগের নিরিখে অভিনব। কনরাড রুকসের বিদেশি ছবি ‘সিদ্ধার্থ’তেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মিলনদৃশ্যে তিনি আবহরূপে কণ্ঠ ব্যবহার করেছেন। অন্যত্র ভৈরবী সুরে বাঁশি ব্যবহারও করেছেন এই ছবিতে।

‘কাঁচ কাটা হীরে’ ছবিতে কোন গান ছিল না, তা সত্ত্বেও আবহ সংগীতর মাধ্যমে চরিত্রের সংঘাত, দোলাচল–বিভিন্ন মানসিক বিবর্তনের স্তর পরিস্ফুট করতে পেরেছেন হেমন্ত। ‘আলোর পিপাসা’ ছবিতেও দেখা যায় এক অভিনব প্রয়ো  গ–সংস্কৃত স্তোত্রেরআবহে পিয়ানো এবং তার-সানাইয়ের ব্যবহার।

এবপর আসি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে–এক-একটি গানকে কীভাবে তিনি আবহের অঙ্গ করে তুলেছেন, অথবা গানের মাঝে কীভাবে যন্ত্রসংগীতের আবহ প্রয়োেগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বাংলা ও হিন্দী চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছি। কিন্তু একটা কথা বলতেই হয়,আমার বাক্তিগত পর্যবক্ষণে তাঁর সুরারোপিত এক-একটি গানই যেন বিষয় সংশ্লিষ্ট এক-একটি আবহ-সংগীতের অবতারণা করেছে, অর্থাৎ ঘুরে ফিরে তাঁর সংগীতেই আমাদের ফিরে আসতে হয়। প্রথমেই আসা যাক তার বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীতকার হিসাবে ভূমিকার কথায়– ১৯৫৫ সালে ‘শাপমােচন’ ছবিটিতে হেমন্ত মুখাপাধ্যায় সংগগীত পরিচালনা করলেন।

এখানে ‘বাগেশ্রী’ রাগে ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ গানটিতে দেখতে পাই একটি প্রবল ঝঞ্ঝার রাতে মহানায়ক উত্তম কুমারের লিপে এই গানটি দেওয়া হয়েছে। ‘বাগেশ্রী’ একটি করুণ রসের রাগ,তাকে ব্যবহার করা হয়েছে একটি উথালপাথাল করা ঝড়ের পরিবেশে। এখানে যেন প্রাকৃতিক ঝড় বাদলের মতো ব্যক্তি বিশেষে মনের ঝড়ও উঠেছে। গানটি ত্রিতালে শিল্পী নিজেই গেয়েছেন এবং গানের পূর্বসূর (Pre-lude) এবং মধ্যবর্তীসুরে (Inter-lude) বাঁশিতে অভূতপূর্ব ভাবে ঝড়ের আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে।

১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কিছু ছবির মধ্য থেকে দুটি ছবিকে বেছে নিলাম। একটি ‘হারানো  সুর’ ও আর একটি ‘লুকোচুরি’। বিষয়গত দিক থেকে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের ছবি। একটিতে দুঃখ-বিরহের অসীম সাগর পার হয়ে প্রেমের পরিণতি এবং অপরটিতে বিরহ ও মিলন যুগপৎ চলে। তবে দ্বিতীয়টিতে বিরহের ভাগটা অত্যন্ত কম এবং হাস্যরসেই প্রেমের পরিণতি। ‘হারানো সুর’ ছবিতে ‘তুমি যে আমার ওগাে তুমি যে আমার’ গানটির মধ্যে প্রেমের কোমল স্পর্শ যেভাবে সুরে প্রকাশ পায়, তেমনি দীর্ঘ বিরহের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সুরটিই হেমন্তবাবু ব্যবহার করেছেন বারবার।যা বিরহের যন্ত্রণাকে যেন আরও প্রকট করে তোলে, আবার ওই সুরটি ধরেই বিরহান্তক প্রণয়ের পরিণতি ঘটেছে। পাশাপাশি ‘লুকোচরি’-র মতো একটি চটকদার হাস্যরসের ছবিতে ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’-এই গানটি একটি বিরহ ভাবকে কীভাবে ফুটিয়ে তোলে তা আমরা সকলেই জানি। গানটি বিষয়ের আবহকে পরিষ্কার করে ফুটিয়ে তাোলে। যেমন ‘এই তো হথায় কুঞ্জ ছায়ায়’, গানটি অভিনেতা কিশোরকুমারের চরিত্রের সঙ্গে অনবদ্য ভাবে যায়। এই ছবিটির বিশেষত্ব হল এখানে কিশোর কুমার দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। একজন শান্ত ভদ্র সংগীত শিল্পী আর একজন তাঁর যমজ ভাই, চটুল ছটফটে এক যুবক। যে দুটি গানের কথা উল্লেখ করেছি, তা শান্ত কিশোর কুমারকে ঘিরে সহজেই বােঝা যায়, কিন্তু চঞ্চল নায়ক কিশোর যখন লবণদানি নিয়ে খেলাচ্ছলে প্রেমের গান গাইছেন– ‘এক পলকে একটু দেখা’, তখন তার আবহ একদম ভিন্ন। গানটি সুরময় (Melodic),অথচ একটু যেন চটুল। আবার সংগীতের যান্ত্রিক ব্যবসার মূলে কুঠারাঘাত করে কিশারের মুখে যে ব্যাঙ্গাত্মক গানটি- ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ ব্যবহার করেছেন, তা বাংলা ছবির গানে এক সম্পদ।

এবার ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত একটি ছবিকে যদি বেছে নিই, সেটি হল উল্লেখযোগ্য ছবি “দীপ জেলে যাই”। ‘এই রাত তোমার আমার’–গানটি সমগ্র চলচ্চিত্রের একটা আবহ তৈরি করে, একটা বার্তা নিয়ে আসে। সূরকার হেমন্ত এর প্রিল্যুড হিসেবে ‘হুইসল্’-এর সঙ্গে ব্যবহার করলেন হামিং। নায়িকা সুচিত্রা যখন দেবাশিসের প্রেমে পড়লেন, এবং বিচ্ছেদও ঘটল, সেই মুহর্তে এই গানটি একটি বিশেষ ভাবান্তরের সৃষ্টি করল–স্বপ্প ভাঙার গান, আবার যখন নায়ক বসন্ত চৌধুরীর মানসিক রোগের চিকিৎসায় সাহায্য করবার জন্য নায়িকা নিযুক্ত হলেন এবং নায়কের প্রতি মনে মনে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেন, ঠিক তখনই নায়ক সম্পূর্ণ মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেন, তাঁকে বোঝানো হল যে চিকিৎসার স্বার্থে তাঁর সাথে অভিন করেছেন। এবারও মিলন রইল অধরা। তীব্র মানসিক আঘাতে নিজেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঐ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হলেন নায়িকা। এই পরিস্থিতিতে সুরকার ওই গানটির সুরকেই আবহ সুর হিসাবে ব্যবহার করেছেন। গানটির কথা ও সুর রোম্যান্টিক, কিন্তু এখানে সেটিকে ব্যবহার করা হল এমন ভাবে, যা হৃদয়স্পর্শী দীর্যশ্বাসের মতো।

১৯৬০ সালে হেমন্ত মুখো পাধ্যায়ের সুরে একটি ছবি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ছবিটির নাম, ‘শেষ পর্যন্ত’। আদ্যন্ত এটি একটি হাস্যরসাত্মক কাহিনি। এতে প্রেম, বিরহ,মিলন আছে এবং তার গানও আছে। ‘এই বালুকা বলায় আমি লিখেছিনু’ – সাগরের ঢেউ পাড়ে আছড়ে আছড়ে পড়ছে যেমন, তেমনই নায়কেরে হৃদয়ে বিরহের ঢেউ আঘাত করছে। গানটির সুরেতেই যেন একটা বিরহের ভাব, তার সঙ্গে কাব্যরসও তুলনাহীন। আবার ‘এই মেঘলা দিনে একলা’–এই গানটির মধ্যে যে সুর আছে তার মধ্যে একাকিত্বের ভাব থাকলেও একটা আশার, একটা স্বপ্নের আবহ আছে।

১৯৬১ সাল। ‘সপ্তপদী’ ছবির এই বিখ্যাত গান–’এই পথ যদি না শেষ হয়’। এই গানটির পরিচয় বিশেষ ভাবে দেবার কোনো প্রয়ো  জন পড়ে না। কিন্তু ছবিতে এই গানটি আরম্ভ হওয়ার পূর্বে নায়ক-নায়িকার মোটর বাইকে সওয়ার হবার অনুষঙ্গে একটা ছন্দময়

সুর চমৎকার ভাবে সেই দৃ শ্যের অবতারণা করে। এরপর শুরু হয় গানটি– যা এক ইতিহাস। এ ছবির আর একটি জায়গায় আবহসংগীতের গভীর দর্শন মন ছুঁয় যায়। নায়ক যখন ধর্মান্তরিত হয়, আর নায়িকা তাকে ভূল বোঝে, আবহে মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি মিলিয়ে যায় গির্জার ‘বেল’-এর সংগীতে।

এই আলো চনা প্রসঙ্গে দৃটি ছবির কথা উল্লেখ না করলেই নয়–একটি ‘মণিহার’ ও আর একটি ‘অদ্বিতীয়া’। ১৯৬৬ সালে ‘মণিহার’-এ অনেকগুলি গান বিশেষ উল্লখযোগ্য। ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখীরা’–পাহাড়ের টিলায় দাঁড়িয়ে গােধুলি বেলায় নায়িকা গান গাইছেন। গানটিতে হেমন্ত ‘পাহাড়ী’ রাগের সুর এমন ভাবে লাগিয়েছেন, যা প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে মনকে স্পর্শ করে যায়। এর ঠিক পরের বছর ১৯৬৭-তে ‘অদ্বিতীয়া’ ছবিটি প্রকাশ পায়। মিশ্র ভৈরবী সুরে ‘চঞ্চল মন আনমনা হয়’ গানটি যেমন প্রভাতী স্নিগ্ধতার একটা পরশ দেয়, তেমনি ‘চঞ্চল ময়ুরী এ রাত’-মিশ্র আশাবরী-তে তৈরি এই গানটি একটি রাতের দৃশ্যকে যে ভাবে প্রকটিত করে, তা সত্যই মর্মস্পর্শি। ‘হেমন্ত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সলিল চৌধুরির কথায় ও সুরে চলচ্চিত্রের বাইরে একটা গান গাঁয়ের বধূ রেকর্ড করেন। দু-পিঠের ৭৮ আরপিএম ছ-মিনিটের ওই ডিস্ক রেকর্ডে বাংলার ভিন্ন গতির এক আবেগমথিত প্রচলিত কাঠামোকে নিবদ্ধ করেছিল। এই গান এক উন্নত এবং মমতাময়ী গ্রাম্য নারীর জীবন ও পরিবারকে সরল শান্ত মনোরম করে ফুটিয়ে তুলেছিল এবং বর্ণিত হয়েছিল কীভাবে দুর্ভিক্ষের দৈত্য ও আসন্ন দারিদ্র্যের দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছিল। এই গান হেমন্ত এবং সলিলকে পূর্ব ভারতে এক অভাবনীয় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল, এককথায়, হেমন্তকে তার সমসাময়িক পুরুষ গায়কদের থেকে এগিয়ে রেখেছিল। পরবর্তী কয়েক বছরে হেমন্ত এবং সলিল জুটি সমাজকে অনেক গান উপহার দিয়েছিল। প্রায় এই সমস্ত গানেই জনপ্রিয়তার প্রমাণ ছিল।‘[iii]

১৯৬৮ সাল ‘মন নিয়ে” ছবিটিতে আমরা অনেকগুলি জনপ্রিয় গান পেয়েছি, কিন্তু একটি গানের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। সেটি হল ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়’। ছবিটিতে উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবী অভিনয় করেছেন। সৃপ্রিয়া দেবীর দ্বৈত চরিত্র–একজন উত্তমকুমারের স্ত্রী ও আর একজন তাঁর শ্যালিকা। মনস্তত্ব নিয়ে কাহিনি। ভালো বাসার অত্যন্ত গভীরতা একজন নারীকে কীভাবে মানসিক দিক দিয়ে রুদ্ধ করে দেয়,অসুস্থ করে দেয়, তার কাহিনি। কাহিনির উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ছবিটির সমাপ্তি

ঘটেছে। শেষের দিকে একটি দূশ্যে সাগরতীরে একাকী সুপ্রিয়া দেবী এই গানটিতে ঠোঁট মেলাচ্ছেন। লতা মুঙ্গেশকারের কন্ঠে এই গানটি সৃষ্টি করেছে অন্তহীন সাগরের তীরে নিঃসঙ্গ হৃদয়ের বেদনা, জীবনের বৈরাগ্য আর নতুন পথের আশাসন্ধানী আবহ। জীবন

দর্শনের একটি সম্পূর্ণ রূপ একটি গান কীভাবে প্রকাশ করতে পারে, তার নিদর্শন দিয়েছেন হেমন্তবাবু। এই পর্বে আর একটি কথা বলতে হয়, ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘কুহেলী’ ছবিটি সম্পর্কে। এই ছবিটি সম্পূর্ণ রহস্যঘেরা। সমস্ত ছবিটিতে গান সহ বিভিন্ন আবহসংগীত রহস্য দূশ্যকে প্রকটিত করে তোলে, দর্শকের গা ছমছম করে।অনেক জায়গায় সংগীত-ই কাহিনির বিন্যাসকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে।


[i] https://bn.wikipedia.org/wiki/হেমন্ত_মুখোপাধ্যায়

[ii] ‘চিত্রভাষ’পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার

[iii] https://bn.wikipedia.org/wiki/হেমন্ত_মুখোপাধ্যায়