May 1, 2023

টুসুগানে ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব : ঐতিহ্য ও আধুনিকতা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

শ্রুতি সেন

সারসংক্ষেপঃ

সংগীতের গতিপ্রকৃতি ও বিবর্তন সংক্রান্ত পর্যালোচনা ও গবেষণা বর্তমানে সংগীতের উপর ডিজিটাল মিডিয়ার প্রভাব এবং তার বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। শুধুমাত্র সংগীতের উপরেই নয়, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর সর্বাতিশায়ি প্রভাব লক্ষণীয়। তবে এই ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার খুব বেশী পুরাতন নয়, ১৫ থেকে ২০ বছর পূর্বের। অর্থাৎ ২০০০ সালের পর থেকে এই মাধ্যমের আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। কারণ, এই সময়কাল থেকে ইন্টারনেটের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় এর ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যা পূর্বে এত প্রকট ছিল না। তখন দূরদর্শনে গান গাইতে গেলে রেকর্ড করা গানই শোনানো হত, কোনরকম লাইভ টেলিকাস্টের ব্যবস্থা ছিল না। যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার কম করা হত, আঞ্চলিক গানে যন্ত্রশিল্পী থাকতেনই না, বর্তমানে এই চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইন্টারনেট আসার ফলে সমগ্র সংগীত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। টুসু গানও এই ডিজিটাল মাধ্যমের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। এই টুসু  মুখ্যত রাঢ়বঙ্গের কৃষি উৎসব এবং লোকগীতি।

এ কথা সত্য যে, ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্যে পুরো বিশ্বব্যাপী এই ধরণের স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীর যে নিজস্ব গান, তাকে রক্ষা করার বা সংরক্ষণের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে এবং এর ফলশ্রুতি স্বরূপ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বসে থাকা মানুষ এই ধরণের অপ্রচলিত গান  উপভোগ করতে পারছেন।  

অন্যদিকে, টুসু গানের উপর ডিজিটাল মাধ্যমের প্রভাবের ফলে এর নিজস্ব পরম্পরাগত সত্তা থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে বিচ্যুতি ঘটছে। যার ফলশ্রুতিস্বরূপ এই সংগীতগুলোকে রক্ষা করার জন্য UNESCO ২০০৩ সালে Intangible Cultural Heritage অধিবেশনের মাধ্যমে এক প্রয়াস শুরু করেছে।

ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে সংগীতের যে সব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়ছে, সেগুলি থেকে সংগীতকে মুক্ত করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পর্যবেক্ষণ এবং তদারকি অনিবার্য হয়ে পড়েছে ।

ভূমিকাঃ

বাঙালি সংস্কৃতির সূচনাকাল থেকে বাঙালির লোকজ ধ্বনিচিত্র ছিল স্থানীয় মানুষের প্রাণের গান। এই লোকগানে তাদের সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার স্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। এই লোকগানটি প্রচলিত মৌখিক ঐতিহ্য হিসাবে এবং সামাজিক সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। তাছাড়া, লোকগীতি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে বিলক্ষণ। গবেষণার্থে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার কৃষি-উৎসব তথা লোকসংগীত টুসুর সমাজ ও সান্সকৃতিক প্রভাবে পরম্পরাগত বিবর্তন এবং সেই সঙ্গে বর্তমানে এই সঙ্গীতে ব্যবহৃত লোক বাদ্যযন্ত্রগুলি কীভাবে মানব ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও গানগুলিতে কীভাবে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব নিহিত রয়েছে তা অন্বেষণ করতে প্রয়াসী হয়েছি । বাঁকুড়ার অধিবাসী হওয়ার সূত্রে আমার গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণার্থে ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্ত্বিক পাঠ্য তথ্য সংগ্রহ করতে প্রয়াসী হয়েছি ।

টুসু কী?

টুসু প্রকৃতপক্ষে কৃষিকেন্দ্রিক উৎসব এবং সেই সঙ্গে গান, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা ও বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা, ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনা, ধানবাদ ও রাঁচি এবং হাজারীবাগ জেলা, উড়িষ্যা ও ছত্রিশগড়  ইত্যাদি অঞ্চলে মুখ্যত শোনা যায়। বিশেষত, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার দক্ষিণ- পশ্চিম অংশের আদিবাসী সম্প্রদায়- সাঁওতাল, কুড়মি, ভূমিজ, কর্মকার, মুন্ডা, শবর প্রভৃতি পিছিয়ে যাওয়া জনজাতি এই উৎসবের ধারক ও বাহক। তবে বর্তমানে বহু শহরমুখী শিক্ষিত মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরাও এই উৎসবে প্রচুর পরিমাণে অংশগ্রহণ করেন।

নামকরণ:

টুসুর নামকরণ সম্বন্ধে গবেষকদের মধ্যে নানান মতামত প্রচলিত আছে। যেমন ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে, ‘তুষ্’ থেকে ‘টুসু’ শব্দটি এসেছে । আবার দীনেন্দ্রনাথ সরকারের মতে, ‘তিষ্যা’ বা ‘পুষ্যা’ নক্ষত্র থেকে অথবা ‘উষা’ থেকে ‘টুসু’ শব্দটি এসেছে । আবার কখনো তিনি বলেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রজনের দেবতা ‘টেশুব’ থেকে ‘টুসু’ শব্দটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই উপরিউক্ত প্রতিটি মতই ভিত্তিহীন, কারণ ‘তুষ্’ শব্দটি বাংলা ভাষাভাষী ক্ষেত্রে টুসু শব্দের সঙ্গে মিল আছে ঠিকই কিন্তু ‘তুষ্’ শব্দের অর্থ ভুসা। ভুসার তুষ্-কে কেউ আরাধনা করতে পারে না। যদি করে তো ধানকে করবে অর্থাৎ লক্ষীকে করবে – সুতরাং এর কোন সঠিক যুক্তি নেই। পরিষ্কারভাবে ‘টুই’ এবং ‘সু’ এই দুটি শব্দের মিলনেই হয়েছে টুসু। কুড়মালিতে ‘টুই’ শব্দের অর্থ ‘চূড়া’ অর্থাৎ একদম শেষ প্রান্ত। সূর্য দক্ষিণায়ণ আসার শেষ প্রান্ত হচ্ছে এই মকরটি। তারপর সে উত্তরায়ণ যাত্রা শুরু করবে। আমাদের এখানে ‘আওরি’, ‘চাউরি’, ‘বাউরি’, ‘মকর’ ও ‘আখান’ -এই শেষোক্ত ‘আখান’ শব্দের অর্থ ‘সূর্য’। কাল থেকে সে আবার উত্তরায়ণ যাত্রা শুরু করবে। একদম বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা সূর্যের বার্ষিক গতিকে লক্ষ্য করে, তার এক একটা সময়কে কেন্দ্র করে আমাদের কৃষিকাজ বা আচার অনুষ্ঠানগুলো হয়। টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের উপরিউক্ত শেষ পাঁচ দিন আউরি, চাউরি, বাউরি, মকর ও আখান নামে পরিচিত। ‘আউরি’ মানে কুড়মালী ভাষায় ‘আউরান’, যার অর্থ হল কোথাও পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্ব মুহূর্ত অর্থাৎ সূর্য পদক্ষেপ করার পূর্ব মুহূর্ত হল ‘আউরান’। ‘চাউরি’ কথাটি এসেছে কুড়মালী ভাষায় ‘চৌড়ান’ শব্দ থেকে। ‘চৌড়ান’ মানে এরপর সূর্য পদক্ষেপ শুরু করল , ‘বাউরি’ কথাটি এসেছে ‘বাউয়া-মৌরি’ থেকে অর্থাৎ পদক্ষেপ শুরু করার পর যে গতিতে যে মুখে যাচ্ছিল তার থেকে অন্য মুখে শুরু করল অর্থাৎ ডান হাত থেকে সূর্য বামের দিকে চলতে শুরু করল। এর জন্য ‘বাউরী’ শব্দটির প্রবর্তন। আর শেষ অবস্থা তার নাম ‘মকর’ অর্থাৎ সেদিনটা শেষ প্রান্ত, তারপরের দিন ‘আখান’ – সেদিন থেকে আবার বছরের সময় শুরু হল। ‘অখন’ মানে সময় আবার ‘আখান’ মানে সূর্য।

দ্বিতীয়তঃ অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে একমাস আগে বাড়িতে ডিঙি নিয়ে আসা হয় তারপর ধান কাটা হয়। সেখান থেকে একটা ধানগাছকে নিয়ে আসে। যেটাকে ডেঙি বা ডিঙি বলে – সেটা মাথায় করে লক্ষ্মী হিসাবে খামারে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে ধান শিস্-টিকে নিয়ে টুসু হিসাবে স্থাপন করা হয়, সেটা সবচেয়ে বড়, ভালো ও পুষ্ট। তারপর একটি সরাতে আলো চাল, গোবরের মন্ডা, চালের গুড়ি মাখিয়ে সরার গায়ে সিঁদুর দিয়ে তার উপর ধানের শীষ্-টিকে স্থাপন করা হয়। এটাকেই বলা হয় টুসু।  সুতরাং লক্ষ্মীর ভাবনা এসেছে আমাদের এই টুসু থেকে। পরবর্তীকালে সেটিকে মূর্তি রূপে লক্ষ্মী হিসেবে পূজো করা হয়। এখানে ধান বা শস্য বা সমস্ত উদ্ভিদ জগৎ সূর্যকে বাদ রেখে হতে পারে না । তাই আমাদের এখানে দুই দেবতাই পূজিত হয় – এক সূর্য, দ্বিতীয়টি ধান্য।

ঐতিহ্যবাহী টুসু গানঃ

অগ্রহায়ণ-সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এই এক মাসব্যাপী প্রতিদিন বিকাল বেলা বা সন্ধ্যাবেলায় পা ধুয়ে আসার পর প্রথমে পূজা করা হয় তারপর এক ঘন্টা গোল হয়ে বসে কুমারী মেয়ে থেকে শুরু করে মা, দিদিমা, ঠাকুমা, জেঠিমা, পিসিমারা সকলেই টুসু গান করে থাকেন, এটি একটি অদ্ভূত পরম্পরা। তারপর ভোগ বিতরণ করা হয়। ঐতিহ্যবাহী টুসুগানের কোন লিখিত রূপ ছিল না, এই কারণে টুসু গানের কবি খুঁজে পাওয়া যায় না। খুবই কম কবি টুসু গান লেখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। যখন টুসু পাতা হত, তখন ছোট ছোট মেয়েরাও তাতে অংশগ্রহণ করত, তারা তাদের মা, দিদিমা, ঠাকুমা, জেঠিমা, পিসিমার কাছে শুনে শুনে গানগুলো পরিবেশন করত। অর্থাৎ এই টুসু নামক লোকগীতিটি পরম্পরানির্ভর এবং শ্রুতিমূলক । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রাচীন বৈদিকসাহিত্য যেমন গুরু-শিষ্য-প্রশিষ্য ক্রমে শুনে শুনে বিবর্তিত হয়েছিল, কোন লিখিতরূপ ছিল না, ঠিক তেমনি এই টুসু বা ভাদু গানগুলিরও লিখিত রূপ না থাকায় পরবর্তী কালে এই বিনাশপ্রাপ্তির সম্ভাবনা অঙ্কুরেই নিহিত ছিল । কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্যে বর্তমান প্রজন্ম নতুন করে এই প্রায় অবলুপ্ত লোকগীতির পুনরুজ্জীবনে সচেষ্ট হয়েছে, যেটা যুগের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

যেহেতু টুসু গান তাঁদের পৈত্রিক সম্পত্তি এবং তাঁদের প্রাণের সাথে জড়িত, তাই তারা টুসু গানের মধ্যে দিয়ে তাঁদের আনন্দ থেকে দুঃখ – সমস্ত কিছুই যেমন ভালোবাসা কথা, সকল অভাব অভিযোগ, ধান চাষ না হওয়ার কষ্ট, আনন্দ, বেদনার কথা তারা টুসুর কাছেই নিবেদন করেন। এমনকি অতীতে শুধু টুসু পরবের সময় এই গান করা হত এমন নয়, গ্রামীণ পরিবেশে মেয়েরা কাজের মধ্যে ধান কাটা, ঢেকি কুটা, বিড়ি বাধা ইত্যাদি আপন কাজের তালে তালে তাঁদের কাজের শ্রমকে লাঘব করার জন্যও তারা এই গীত গেয়ে থাকতেন। এই গান তাদের নিজেদের সৃষ্টি। কিন্তু এই গানে যেহেতু কোন লিখিত রূপ ছিল না। শিল্পী নিজেও লেখেন নি বা সেটা শুনেও কেউ লেখেননি। তাই ঐতিহ্যবাহী টুসুগান বিলুপ্ত হচ্ছে এবং নতুন রূপ নিচ্ছে। তাছাড়া প্রাচীন যারা টুসু শিল্পী তারা মারা যাওয়াতেও এই গানগুলো-কে আমরা হারিয়ে ফেলেছি শুধুমাত্র সংরক্ষণের কারণে। সে যুগে এই গানের শিক্ষাগুরুও ছিল না বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল না। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত টুসু কবি কিরীটি মাহাত বলেন, “আমাদের পুরুলিয়াতে যে সব স্থগিত লোকসংগীত আছে- যেমন ঝুমুর, টুসু, ভাদু, বিবাহের গান ইত্যাদি, এদের মধ্যে ঝুমুর সব থেকে বেশি প্রচলিত, প্রসারিত ও জনপ্রিয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ঝুমুরেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা এর আগে পর্যন্ত ছিল না। সম্প্রতি সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে কিন্তু অন্যান্য লোকসংগীত বিশেষ করে টুসু বা ভাদু গান,অহিরা গীত ইত্যাদি যে সমস্ত গীত এখানে আছে তার কোনরকম প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রথাগত শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তাদের মা, দিদিমা, ঠাকুমা, জেঠিমা, পিসিমার কাছে শুনে শুনে গানগুলো পরিবেশন করে থাকে। এটি একটি অদ্ভুত পরম্পরা”।

অগ্রহায়ণ-সংক্রান্তির দিন যে গীত দিয়ে টুসু পাতা হয়…….

ফস্কো গ্রামে বিখ্যাত টুসু শিল্পী দৈবকি কুমারের ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি টুসু গান –

আতপ চালে থাপি মাকে

স্বর্গ ফুল পূঁজিব

বছর বছর আসবে টুসু

এ কাঙালের বাড়ি গো।

৩০ দিন রাখিলে টুসু

৩০ ফুলে রাঢ়ে গো

আর রাখিতে লাড়ব টুসু

মকর আইল বাদী গো।

মকর আইলো লিতে টুসু

বাউরি আইলো বাদী গো। [1]

অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিনে টুসু পাতা হয় বা টুসুকে আহ্বান করা হয় আতপ চাল, ফুল দিয়ে – সেই কথায় বলা হচ্ছে। তারপর তারা ৩০ দিনে ৩০ টি ফুল দিয়ে টুসুর কাছে আত্মনিবেদন করেন। বাউরির দিনে টুসুকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিতে আসে, সেই দিনই রাত জাগরণ হয় এবং পরের দিন অর্থাৎ মকরের দিন বিদায় দেওয়া হয়। পরের বছর যাতে টুসু আসতে পারে, সেই জন্য তারা কলকাতায় কেসের ডিগ্রী করিয়ে এনেছেন। অর্থাৎ এখন যদি সরকার বলেও যে এই টুসু পরব তাদের বন্ধ করতে হবে, তাহলে হিসাব মতন ডিগ্রি করে নেওয়া আছে। তাই এই উৎসব কোনমতেই বন্ধ করা যাবে না।

এছাড়া তাঁর আরও একটি ঐতিহ্যবাহী গান হল –

চলো গো ফুল তুলিতে যাব

টুসু ধনকে আমরা পূজিব…

এখন আসবে ও কখন আসবে

আসবে গো সন্ধ্যা হলে

রেখেছি ফুলডালি এ তুলে

টুসু ধনকে হবে পূজিতে।

টুসু ধনকে জলে দিব না

আমার বড় মনের বেদনা।

আয় টুসু মা, আয় টুসু মা

ডাকছি গো বিনয় করে।

জবা যামিন আজির ফুলে

পূজব মা সবাই মিলে

আয় টুসু মা, আয় আমাদের ঘরে।

ওগো দক্ষিনেতে লক্ষী আইল, বায়েতে সরস্বতী

জয়বিজয়া সঙ্গে লইয়া

কন্ঠে কর বসতি….

নম মাগো মা সরস্বতী

কৃপা কর মাগো জননী

জয় মাগো মা সরস্বতী।। [2]

টুসুগানের আধুনিকতাঃ

বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কাছে ঐতিহ্যবাহী যে টুসু গান বা টুসু পরব তা বিবর্তিত হয়ে নতুন রূপ নিয়েছে,  যেমন পূর্বে টুসু-গানে কোন বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ ছিল না, খালি গলায় গাওয়া হত, অধুনা টুসুগানে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ হচ্ছে। যেমন – হারমোনিয়াম, ঢোল, ধামসা, কী-বোর্ড, বাঁশী, গীটার, মেলাকোশ ইত্যাদি। তাছাড়া বর্তমানে স্টুডিওতে গিয়ে রেকর্ড করে ইউটিউবে ছাড়ছে টুসু গান। তারপর সেখান থেকে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে দেশে – বিদেশে, তারা ভালো ভালো কমেন্ট করছেন। তাতে তাদের উৎসাহ দ্বিগুণ বাড়ছে, সেই আনন্দে তারা আরও চারটে গান ছাড়ছে এইভাবে তাদের একটা রোজগারের সুবিধা হচ্ছে । এই ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্ম টুসু গান-কে সংরক্ষণ করছেন ঠিকই কিন্তু সেই চিরাচরিত ব্যাপারটা হারিয়ে যাচ্ছে। এই হিসাবে পুরো টুসু পরবটা বা টুসু পরবের গানগুলো মরে যাবে না। আমাদের কাছেই থাকবে কিন্তু ধরণটা পরিবর্তন হয়ে যাবে।

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আধুনিকভাবে সৃষ্ট টুসু গান হল –

আমার টুসু মান করেছে, কিনবে সে আজ মোবাইল ফোন….

শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেও, খোঁজ মিলবে গো সারাক্ষণ।। [3]

টুসু গান, প্রতিবছরেই  নতুন করে তৈরী করা হয়। এক গান বছরের পর বছর ধরে চলে না।

সদ্য প্রয়াত লোকসংগীত শিল্পী সুভাষ চক্রবর্তীর আনুষ্ঠানিক টুসু গান হল –

উঠান ভরা আল্পনা গোলাভরা ধান

গাও গো টুসুর গান দেখো পরব লেগেছে

মকর পরবে মদনা ছোড়া ধামসা বাজাইছে।

আরে টুসুমনি ধামসার বোলে কেমন দেখো নাচাইছে’।। [4]

ডিজিটাল মাধ্যমের ক্রমোন্নতির ফলে আজ লুপ্তপ্রায় এই টুসু-গানগুলিকে নতুন উদ্যমে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চলছে। এই গানগুলির আধুনিকীকরণে বর্তমান সংগীতের গবেষকগণ, শিক্ষক-শিক্ষিকা, সংগীতপ্রেমী আপামর মানুষরা সচেষ্ট হচ্ছেন, এটা অত্যন্ত আনন্দ ও আশার কথা । এই গানগুলির আধুনিকীকরণের ফলে যে ঘটবে, প্রাচীন লোকজীবন-সংস্কৃতি নতুনরূপে ও নতুন আঙ্গিকে ফিরে আসবে। প্রাচীনতা ও ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করেই এই লোকসংগীতগুলি জীবন্তরূপ পাবে বলেই বিশ্বাস ।  এই সংগীতগুলির মধ্যেই বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর আত্মতুষ্টি, ভালোলাগার উপকরণ নিহিত থাকায় এই সংগীতগুলি বাঁচলে এই প্রাচীন জনগোষ্ঠী গুলি বেঁচে থাকবে । অর্থাৎ ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সম্মিলনেই একটা সভ্যতা- সংস্কৃতি বেঁচে থাকে ।

টুসুগানে ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজ ও সাংস্কৃতিক প্রভাব –

পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়, সবকিছুই পরিবর্তনশীল। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হয়ে চলেছে এবং পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে প্রযুক্তির একটা ঢেউ সমাজ এবং সংস্কৃতির মধ্যে এসে পড়ছে। কারণ, বিশ্বায়ন এবং উদার-নৈতিক বাজার ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বাস করছি। এক কথায় বিশ্বায়ন বা উদারনৈতিক বাজার ব্যবস্থাকে সংক্ষেপে বোঝাতে উদাহরণের মাধ্যমে বলতে পারি যে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কলকাতা শহরে থেকে একটি ব্র্যান্ডেড শার্ট কিনতে পারি। যে ব্র্যান্ডেডটি একই সাথে বিদেশেও পাওয়া যায়। যেমন একটি ব্র্যান্ড হল পিটার্- ইংল্যান্ড, আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে দেখেছি আমাদের মা-বাবাদের সময় কোন ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র কিন্তু পাওয়া যেত না, কিন্তু এখন পাওয়া যায়। তার কারণ গ্লোবাল বাজার এখন উন্মুক্ত অর্থাৎ গোটা পৃথিবী জুড়ে যে আমদানি-রপ্তানি হয় তার পিছনে একটি রাজনীতি ও মুক্ত-অর্থনীতি আছে। যে কারণে আমাদের কাছে বিদেশি প্রোডাক্ট বলে আলাদা কিছু থাকছে না। সমস্ত জিনিসপত্র সর্বত্রই উপলব্ধ হচ্ছে । এটিকে বলা হয় বিশ্বায়ন বা উদারনৈতিক বাজার ব্যবস্থা বলা হয়। এই যুগে দাঁড়িয়ে আমাদের বিভিন্ন রকম প্রযুক্তির যে অনুপ্রবেশ তা পরিবর্তনশীল সমাজ এবং সংস্কৃতির মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। যখনই এই প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটছে এবং বিশ্বায়নের ফলে কিবোর্ড, গিটার, বাঁশি ইত্যাদি যেগুলো এ দেশে তৈরি হয়নি, সেই বাদ্যযন্ত্রগুলি আসতে আসতে টুসু শিল্পীদের আয়ত্তের মধ্যে চলে আসছে। কারণ আমরা তাদেরকে বাধ্য করছি এই যন্ত্রব্যবস্থার সাহায্য নিতে। নচেৎ এই গানগুলি নিতান্তই সেকেলে বলে মনে হবে। যুগরুচির পরিপন্থী বলেই মনে হবে। আমরা লক্ষ্য করছি বিভিন্ন গানে এই বাদ্যযন্ত্রগুলি ব্যবহার হচ্ছে এবং আমরা সেই কারণেই ভাবা হচ্ছে বিভিন্ন গানে যখন বিদেশী বাদ্যযন্ত্র গুলির প্রয়োগ হচ্ছে, তাহলে টুসু গানে তার প্রয়োগ হবে না কেন? তাই আমরা টুসুগানেও এই বিদেশী যন্ত্রব্যবস্থার সাহায্য নিচ্ছি । এই ফলশ্রুতিস্বরূপ এই গানগুলি আর সেকেলে বা একপেশে হয়ে থাকছে না। উদার-অর্থনৈতিক বাজার ব্যবস্থার ফলে এই গানগুলির মার্কেটিং অনায়াসেই হয়ে যাচ্ছে । আবার আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, অতি সাম্প্রতিক কালে এক শ্রেণীর মানুষ ইউটিউবার নামে পরিচিত হচ্ছেন এবং ব্যবসার করছেন । ফলে সহজেই এই লোকসংগীতগুলি ইউটিউবের মাধ্যমে কোটি কোটি সংগীতপ্রেমী হোক আর নাই হোক মানুষের মধ্যে সেকেণ্ডের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।  আসলে আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, দুটো গানের আলাদা রূপ, আলাদা আত্মসামাজিক পরিবেশ এবং ভৌগোলিক পরিবেশ । আসলে আমরা সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন নই। কারণ আমরা সংস্কৃতিকে পণ্যদ্রব্যের চোখে দেখি। যেমন, শিল্প এখন কেনা যায়, যে মুহূর্তে আমরা শিল্প কিনে নিচ্ছি, সেই মুহূর্তে আমরা গান কিনে নিচ্ছি বা গানকে নিয়ে আমরা ব্যবসা করছি। তখন স্বাভাবিকভাবেই যারা গানগুলো-কে তৈরি করছেন তাদের কোন বক্তব্য থাকছে না, স্বীকৃতিও থাকছে না। কিন্তু অতীতে ব্যাপারটা সেরকম ছিল না। আসলে শিল্প অনেক সহজে অধিক অর্থে বিক্রয়যোগ্য হয়ে উঠেছে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পৃথিবীতে একটা জামার থেকে পেইন্টিং এর দাম অনেক বেশি, একটা ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাওয়ার যে টিকিট তার থেকে অরিজিৎ সিং এর কনসার্টের টিকিটের দাম বেশি। এইরকম সময় দাঁড়িয়ে  United Nations নামে একটা সংগঠন তৈরি হয়। এরা UNESCO নামে একটি ডিপার্টমেন্ট চালু করেন ; যারা সারা পৃথিবীর শিল্প এবং সংস্কৃতিকে খুঁজে বেড়ায়। কোথায় কে গান করে, কার গান পৃথিবীতে কেউ শোনেনি কখনো ইত্যাদি অনুসন্ধান করা তাদের কাজ। যেমন বাউল কখনো ভাবেইনি যে, তারা স্টেজে উঠে গান গাইবে। তারা নিজেদের মতন করে সাধন-ভজন কে গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করবে। আসলে সংগীত শুধুমাত্র প্রমোদানুষ্ঠানের সাথেই যুক্ত নয়, গান হল একটি মনের ভাব, একটি ভাষা, যা আমাদের চিন্তা ভাবনাকে প্রকাশ করার একটি মাধ্যম।

উপসংহারঃ

ভারত উপমহাদেশেই শুধুমাত্র নয়, লোকসংগীতের সৃষ্টি হয়েছে একটা খুব ছোট পরিসরে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে আনন্দ দানের জন্য। ২০০৩ সালে UNESCO এর উদ্যোগে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেটি হল ‘Intangible Cultural Heritage’। এই সংস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য হল এই যে, বাউল প্রভৃতি লোকসংগীতের মূল স্রোত ও স্বরূপ যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। আধুনিকীকরণের নামে যেন এই সংগীতের স্বরূপ বিঘ্নিত না হয় । এই অবস্যই একটি সাধু উদ্যোগ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আজ পর্যন্ত  টুসু গানকে এই সংস্থার আওতায় আনা সম্ভব হয় নি। আমার মনে হয় এই লুপ্তপ্রায়  গানগুলিকে সার্বজনীন করে তুলতে এবং টুসু শিল্পীদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে অতিশীঘ্রই এই সংস্থার অধীনে আনা উচিৎ । একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, প্রাচীন কালে এই গানগুলি যাঁরা স্রষ্টা বা শিল্পী, তাঁরা অর্থনৈতিক কারণে এই গানগুলি লিখতেন না। আজ ডিজিটাল মাধ্যমের কারণে বা উদার- অর্থনীতির সুবাদে এই গানগুলির শিল্পীরা বা স্রষ্টারা বেঁচে থাকবেন এমনকি বেশী পরিমাণে টুসু গান লিখতে উদ্যোগী হবেন । অর্থাৎ উদার বাজার অর্থনীতির সুবাদে শুধুমাত্র আনন্দ দানই লোকসংগীতের উদ্দেশ্য থাকছে না, এর সংগীতের প্রেক্ষিত আরও ব্যাপক হচ্ছে ।

তথ্যসূত্র


[1] উক্ত লোকগানটি ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত এবং সেটি পুরুলিয়া জেলার আড়ষা থানার অন্তর্গত ফস্কো-নিবাসী টুসু শিল্পী দৈবকী কুমারের মুখনিঃসৃত। 

[2] উক্ত লোকগানটি ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত এবং সেটি পুরুলিয়া জেলার আড়ষা থানার অন্তর্গত ফস্কো-নিবাসী টুসু শিল্পী দৈবকী কুমারের মুখনিঃসৃত। 

[3], সীমান্তবাঙলার লোকযান।  শ্রী সুধীরকুমার করণ । কলিকাতা – এ মুখার্জী অ্যাণ্ড কোং প্রাঃ লিঃ, ১২। প্রথম সংস্করণ – ফাল্গুন, ১৩৭১, পৃ. ৩২

[4] https://youtu.be/qhkU-TkRO8w

সহায়ক গ্রন্থ

১. করণ, সুধীরকুমার। সীমান্ত বাঙ্গলার লোকযান । কলিকাতা । এ মুখার্জী অ্যাণ্ড কোং প্রাঃ লিঃ। ১৩৭১ (প্রথম সংস্করণ )।

২. মুখোপাধ্যায়, গৌতম।বঙ্গ বহির্বঙ্গের লোকসংস্কৃতি । ২০২১ (প্রথম প্রকাশ )।

৩. ঠাকুর, স্বপনকুমার।  বাংলার কৃষিকাজ ও কৃষিদেবতা। কলকাতা । ২০২০ (প্রথম প্রকাশ)।

৪. বিশ্বাস, সুজিতকুমার । রাঢ়বাংলার লোকসংস্কৃতি । আনন্দ প্রকাশন।  ২০১৫ (প্রথম প্রকাশ)।

৫. সিংহ, শান্তি । টুসু । লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র । তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ । পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কোলকাতা।

৬. ভট্টাচার্য্য, আশুতোশ । বাংলার লোকসাহিত্য (৩য় খণ্ড) । প্রদ্যোৎ কুটির, ১৯৫৪।

৭. দেব, চিত্তরঞ্জন । বাংলার পল্লীগীতি । শ্যাম মিত্র লেন । কোলকাতা । ১৯৬৬ (প্রথম প্রকাশ)।

৮.মুখোপাধ্যায়, দিলীপ । উত্তর রাঢ়ের লোকসংগীত । কল্যানী প্রকাশন ।  ১৩৬৬ (প্রথম প্রকাশ)।

৯. চট্টোপাধ্যায়, ভোলানাথ ।  মানভূমের ঝুমুর। (সম্পা.) দিলীপকুমার গোস্বামী, পুরুলিয়া । পারিজাত প্রকাশন । ২০১৫।

১০. বসু, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ।  বাংলার লৌকিক দেবতা।  দে’জ পাবলিশিং।  কোলকাতা। ২০০৮ (চতুর্থ সংস্করণ) (১৯৬৬ (প্রথম প্রকাশ)।