Women’s Brata : Rituals in Bengali Folk Culture

Dr. Srabani Sen, Associate Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College

e-mail-srabanisn1@gmail.com  Mobile no- 6290242709

Brata is an age-old religious ritual practiced by women of West Bengal. Bratakhatas have an intricate relationship with the worship of gods and goddesses in the community life of the Bengali people. Bratas act to maintain traditional Hindu values but also emphasize the power of women. Bratas are performed to gain such goals as a healthy family, a good husband, and a happy life. Bratinis is also performed so that the performers develop such virtues as devotion, humility, and compassion. Brata is celebrated through special rituals. There is a story in every Brata of Bengal.

লোকসংস্কৃতির আঙিনায় বাংলার মেয়েলি ব্রত

বাংলার সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে আছে হাজারো মেয়েলি ব্রতানুষ্ঠান, উৎসব-পার্বন আর মেলা। মানুষের মনের কাম্যবস্তু বা কর্মের সাদৃশ্যে আচার-অনুষ্ঠান মনের মনস্কামনা পূর্ণ করে – এই বিশ্বাস থেকেই ব্রতের জন্ম। ব্রত হল দেবতাদের কাছে সমবেতভাবে কামনা-বাসনা নিবেদন করার প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার আশায় বাংলায় নানা ব্রত অনুষ্ঠান পালনের রীতি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বছরের নানা সময়ে নানা রকম উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ব্রতগুলোর সূত্রপাত হয়েছিল। লোক দেব-দেবীর কাছে পারিবারিক কল্যাণ কামনায় নারীরা ব্রত পালন করে। ব্রত নারী মনের দর্পণ। লৌকিক দেবদেবী বা গৃহ দেবতার সঙ্গে তাদের মানসিক একাত্মতা ব্রতের মাধ্যমেই স্থাপিত হয়েছে। তাই আপন মনের দুয়ার খুলে যাবতীয় কামনা-বাসনা সুখ-দুঃখ নিবেদন করতে ভারতীয় নারী কুন্ঠিত হয়নি। 

আদিম ব্রতের মূল কথা ধর্ম-নিরপেক্ষতা। একান্ত মানবিক প্রয়োজনে এগুলো সূত্রপাত হয়েছিল। লোকসমাজের পার্থিব কামনা-বাসনার অকৃত্রিম আবেগকে সার্থক করার জন্য আদিস্তরের মানুষেরা সঙ্গবদ্ধ অনুষ্ঠান করত। নিষাদ ও কিরাত গোষ্ঠীর মানুষেরা একসময় তাদের গোষ্ঠীর মঙ্গল কামনায় ব্রত আচার পালন করতে শুরু করে। পরবর্তীকালে প্রাক আধুনিক যুগে এগুলি মধ্যবিত্তের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। ব্রতের সঙ্গে উচ্চ সমাজের ধর্ম-দর্শনের মৌলিক সম্পর্ক না থাকায়, সম্প্রদায়গত কোন সীমা না থাকায়, ভেদাভেদের কোন অস্তিত্ব নেই।

ব্রত দুই প্রকার- শাস্ত্রীয় ব্রত ও মেয়েলি ব্রত। মেয়েলি ব্রত দুপ্রকার – নারী ব্রত ও কুমারী ব্রত।

ভারতে আর্যদের অনুষ্ঠান, পুরাণ ভেঙে শাস্ত্রীয় ব্রতের উদ্ভব। শাস্ত্রীয় ব্রতের অধিকাংশই শুরুতে লৌকিক স্তরে ছিল। পাঁচ ছয় থেকে আট, নয় বছরের অবিবাহিত মেয়েদের ব্রত হল -কুমারী ব্রত। আর সব বয়সের বিবাহিত মেয়েদের ব্রত –নারী ব্রত। বাংলার কুমারীরা প্রচলিত ধারার অনুসরণে নিজেরাই এসব ব্রত পালন করে। এখানেও পুরোহিত ও শাস্ত্র নির্দেশের কোন স্থান নেই। আচার-নিয়মের নিষ্ঠাও ব্রতের মূল লক্ষ্য।  ব্রত পালনের প্রয়োজনীয় উপকরণের সঙ্গে কামনা পূরণের একটা প্রতিকী সম্পর্ক থাকে। ধান, দূর্বা শস্য গাছের পাতা, ডাল, কাদা, মাটি, ফুল, ঘট, গোবর, দীপ, তুলসী, মধু, ঘি, গুড়, পান, সুপারি, ইত্যাদি উপকরণ রূপে ব্যবহৃত হয়।  ছড়ায়, গানে বা গদ্যে সংলাপ দিয়ে ব্রতের পর্যায়ে গুলি ক্রমানুসারে পালন করা হয়। তুষ তোষালি, কুল কুলপি ইত্যাদি ব্রতের অনুষ্ঠানে পূজার উপকরণ আহরণ তারপর ব্রতের বিভিন্ন করণীয় কাজ (আচরণ)- কামনা নিবেদনের অনুষ্ঠান এবং সবশেষে একত্রে বসে ব্রত কথা শোনা – ব্রত উদযাপনের এই প্রক্রিয়া মনে চলা হয় । ব্রত আচরণের  অন্যতম প্রধান দিক হলো সদৃশ্য চিত্র রচনা, অন্যভাবে ফুল পাতা বা অন্য কোন পশু পাখি ইত্যাদির চিত্র  অঙ্কন করা। এর মধ্যে দিয়েও কামনা-বাসনার প্রতিরূপ চিত্রিত হয়। মনের কামনা আলপনা চিত্রের ভাষা রেখার মাধ্যমে রূপ পায়। বাস্তবের যথার্থ প্রতিরূপ না হলেও এটা প্রতীক রূপে সার্থক। আচরণ অংশে পিটুলি গোলা, মাটি, গোবর পাথর, ডালপালা ইত্যাদির সাহায্যে কামনার ছবি বা মূর্তি করা হয়, যার সামনে দীপ ও ফুল ধরা হয়। ব্রতের একটি মূল অংশ হলো ছড়া। মেয়েরা মুখে মুখে ছড়া রচনা করে তার মধ্যে আপন মনের ছবি ফুটিয়ে তোলে। ছড়া, নাচ,গান, অভিনয় এসবের মাধ্যমে ব্রতীরা ব্রত পালনে মেতে ওঠে। ব্রত পালনে প্রত্যেকে নারীর কিছু না কিছু ভূমিকা থাকে। ব্রতের শেষ অংশ হল কথা শ্রবণ। একে ব্রতকথা বলা যায়, যাতে বিশেষ ব্রতটির উৎপত্তি কিভাবে হল তার বিবরণ ব্রত কথা হয়ে গেলে ব্রত শেষ হয়। বাঙালি মেয়েদের ভবিষ্যৎ- সংসারজীবনে প্রবেশের আগে মনের দিক থেকে তৈরি হওয়ার আচরণগুলো এইসব ব্রতের মাধ্যমে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে। বিবাহিত জীবনে ভালো ঘর, ভালো বর নিয়ে সুখে শান্তিতে কালযাপনের কামনা তাদের ব্রতগুলিকে প্রভাব বিস্তার করে।  এগুলো ব্রতীরা লোকসমাজের ঐতিহ্য ধারা থেকে লাভ করে। ভাদু, টুসু, তোষলা, পুকুর এবং অন্যান্য ব্রতকথার সাহিত্যিক উপযোগিতা এখানেই। মেয়েলি ব্রতগুলো ও শাস্ত্রীয় ব্রতগুলি প্রায় সবই এক ছাঁচে ঢালা, একই ছকের অনুবৃত্তি মাত্র।  মেয়েলি ব্রতকথা বৈচিত্র্যপূর্ণ। বলা যায় মেয়েলি ব্রত বাংলার খাঁটি ব্রত। এই ব্রতগুলোর মধ্যে বাঙালি নারীর কৃত্রিম কামনার ছবি স্বচ্ছন্দে বিকশিত হতে পেরেছে। ব্রতাচার পালন মূলক গীত এর মধ্যে ভাদু- টুস- গম্ভীরা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেয়েলী ব্রতের মধ্যে কার্তিক ব্রত, কুল-কুলতি ব্রত, জাওয়া ব্রত, ষষ্ঠী ব্রত, নানান কৃষি ব্রত – এসবের সঙ্গে মেয়েলি গীতের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এসব গানে বাস্তব জীবনের সুখ- দুঃখ, বঞ্চনা- বেদনার ছায়াপাত ঘটে। 

মাঘ মন্ডল ব্রত –  পৌষ লক্ষ্মীকে ঘরে তুলে আনার কর্ম শেষ হলেও পরবর্তী ফসলের জন্য কৃষি তথা শস্যের কথা মনে রেখেই সূর্যকে আরাধনা উদ্দেশ্যে ‘মাঘ মন্ডল’ ব্রতে নারীরা উদ্যোগী হয়। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষভাবে বর্তমান বাংলাদেশে মাঘ মন্ডল সূর্যদেবের আরাধনা।  প্রতি মাঘ মাসে পাঁচ বছর ধরে মাঘ মন্ডল ব্রতের আয়োজন করা হয়। গৃহের আঙিনায় একটি ব্রত মন্ডল অঙ্কন করা হয়। পূর্বে সূর্য ও পশ্চিমে চন্দ্র – উভয়ের মধ্যস্থলে থাকে বৃত্তাকার আয়ণমন্ডল করা হয়। প্রতি বছর এক একটি করে আয়ণমন্ডল বাড়াতে হয়। মাঘের প্রথম দিন থেকে সংক্রান্তি অর্থাৎ পুরো একমাস ধরে ব্রতী নারী এই ব্রত পালন করে থাকে।

সূর্যোদয় পূর্বে শুচি শুদ্ধভাবে রমনীরা একত্রে জলাশয়ে যায় এবং সূর্যের উদ্দেশ্যে মন্ত্র উচ্চারণ করে। সূর্যোদয় পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করে। ছায়ার সঙ্গে সূর্যের বিবাহের বর্ণনা এই ব্রত কথায় পাওয়া যায়। মাঘমণ্ডল কুমারী ব্রত বলেই এর মধ্যে বিবাহ প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। কোথাও কোথাও এই ব্রত উদযাপনের সময় কলাগাছকে সূর্যের প্রতীক অর্থাৎ টোটেম রূপে পুজো করা হয় । ব্রতে নারীরা বাড়ির সংলগ্ন পুকুরের ধারে কলা গাছকে পুঁতে তাতে সিঁদুর লাগায়, প্রতি অল্প পরিসরে কলা গাছ পূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং সূর্যরশ্মির সাহায্যে বৃক্ষ যেমন অল্প দিনে ফলবান হয়ে ওঠে, তেমনি  কুমারীদের বিবাহের বাসনা যথা শীঘ্র ফলপ্রসু হয়ে ওঠবে এমন অভিপ্রায় এই ব্রতের মধ্যে নিহিত থাকে।

পুণ্যিপুকুর ব্রত –

পুণ্যিপুকুর ব্রত বাংলার মেয়েলি ব্রতের অন্তর্গত কুমারী ব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালী হিন্দুবাড়ীর পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কুমারী মেয়েরা চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ মাসের শেষদিন পর্যন্ত একমাস ধরে এই ব্রত পালন করে। বৈশাখ মাসের গরমে নদী-নালা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ায় শুকনো আবহাওয়ায় নদীয়া, মুর্শিদাবাদ বীরভূমের কিছু গ্রামে এই ছড়া কেটে পুণ্যিকুর ব্রত পালন করা হয়। যেখানে এখনো পুকুরের জলই পান করা হয় সেখানে এই ব্রত করে মানুষ পর্যাপ্ত জলের জন্য প্রার্থনা জানায়। বাড়ির উঠোনে গর্ত কেটে তাতে জল ভর্তি করে নেওয়া হয়। ওই ভরাট গর্ত আসলে ভরন্ত পুকুরের প্রতীক।

পুন্যি পুকুর ব্রতের তিনটি পর্যায়ে যথাক্রমে- আহরণ, ক্রিয়া ও ছড়া। প্রথম পর্যায়ে ব্রত পালনের প্রয়োজনীয় উপাচার অর্থাৎ সাদা ফুল চন্দন, দুর্বা ঘাস, তুলসী গাছ, পাতা সমেত বেল গাছের ডাল কয়েকটি কড়ি ও এক ঘটি জল সংগ্রহ করতে হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে চৌখুপি নকশার ভেতরে আঁকা,  চারপাশে পান সুপুড়ি এঁকে নদীকে ভরে রাখার ইঙ্গিত রাখা হয় এই ব্রতের আল্পনায়। এক একটি ব্রতের সঙ্গে সংগতি রেখে এক এক রকম আলপনা দেওয়া হয়। চারদিকে চারটি ঘটসহ চৌকো একটি পুকুর কেটে প্রতিটি ঘাটের দুপাশে কড়ি দিয়ে সাজিয়ে পুকুরের মাঝখানে ফুলের মালা দিয়ে তুলসী গাছ বা বেল গাছের ডাল বসানো হয়। তৃতীয় পর্যায়ে চার-ছয় পংক্তির ছড়া আবৃত্তি করে ঘটি দিয়ে গাছে জল ঢালা হয়। ব্রতের শেষে তিনবার চন্দন সহযোগে সাদা ফুল ও দুর্বা ঘাস পুকুরে অঞ্জলি দিয়ে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করতে হয়। 

পুণ্যি পুকুর ব্রতমালা

কে করে গো সকাল বেলা

আমি সতী, লীলাবতী

      সাতভায়ের বোন, ভাগ্যবতী। … ১

করম ও জাওয়া – দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার জনজাতী এবং কুর্মি মাহাত সম্প্রদায়র অনুষ্ঠান করম ও জাওয়া । ভরা বর্ষায় ভাদ্র মাসে একাদশীর এক দিন আগে করম ও জাওয়া অনুষ্ঠিত হয়। মাটিতে ডাল পুঁতে তার নিচে বালি ভর্তি ডালায় ধান, গম, যব বা ছোলার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিদিন হলুদ জল ছিটানো হয়। এই সময়গান, নাচ ও ব্রত কথা চলতে থাকে। মেয়েরা বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে। আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে মেলামেশার অন্তরঙ্গ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। করম ও জাওয়া ব্রত অনুষ্ঠানের শেষে বোনেরা ভাইকে ফোঁটা দিয়ে সাফল্য কামনা করে। 

পৌষ পার্বণ – অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সারা বছর ধরে বিভিন্ন পালা পার্বণ এবং উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। স্থানভেদে উৎসব গুলোর মধ্যে কোনোটি স্বতন্ত্র, কোনোটি অভিন্ন। ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলার এই পার্বণ তথা উৎসবটি মূলত ঋতুর সঙ্গে জড়িত। ক্ষেতের ধান, গাছের গুঁড় ও নারকেল থেকে গুরুপাক জাতীয় রসনামধুর খাদ্য প্রস্তুত কর হয় যা তাদের দেহের উত্তাপ বাড়িয়ে শীতের হাত থেকে রক্ষা করতে শেখায়। এইসব উপাদেয় খাদ্যবস্তু শস্য বা ফসল থেকে উৎপন্ন। এই বাস্তব ভিত্তি থেকেই বাংলার জনপ্রিয়  ‘পৌষপার্বণ’ নামক উৎসবের  সূচনা। তাই শ্স্যদেবী তথা লক্ষ্মীকে সাদরে বরণ করাও পৌষপার্বণের অঙ্গ। যদিও শস্যজাত খাদ্যগ্রহণের পূর্বে শস্যদেবীর বন্দনাও এর অঙ্গ। এই উদ্দেশ্যে চালের গুঁড়ো, সামান্য গুড় ও দুটি খড় নিয়ে বাঁধায় ‘বাউনি’ অর্থাৎ বন্ধনী, যার দ্বারা লক্ষ্মীকে বাঁধা হয়। অর্থাৎ উৎসব চলাকালীন তিন দিন তিনি যেন গৃহস্থের ঘরে বাঁধা থাকেন বা বাস করেন। বাউনি বাধা হয় পৌষ সংক্রান্তির সন্ধ্যায়। বাউনি দিয়ে ঘরের খুঁটি, দরজা এমনকি আলমারি, সিন্দুক, চালের হাঁড়ি প্রভৃতি বাধা হয়।  এইসব স্থান এবং সামগ্রীতে বাউনি বাঁধার অর্থ হলো লক্ষ্মী তথা সুখসমৃদ্ধি সংরক্ষণ করা। লোক বিশ্বাস, এইসব আবদ্ধ স্থানে গৃহস্থের নিত্য প্রয়োজনীয়  মূল্যবান সামগ্রী থাকে। তাই বাউনি বাধার সময় বলতে হয়-

‘‘আউনি বাউনি কোথাও না যেও।

           তিন দিন ঘরে বসে পিঠে বলি খেও।।’’…… ২

মকর সংক্রান্তির দিন বাংলায় পৌষ পার্বণের সাড়া পড়ে যায়। কলার ভেলার নৌকো ফুলমালায় সজ্জিত করে বাড়ির পুরুষদের নামে গঙ্গাসানো হয়। ঐ নৌকা গঙ্গায় বা জলে ভাসানোর সময় কোথাও কোথাও ছড়া বলার রীতিও আছে। যেমন-

দুয়ো গেল ভেসে।

        শুয়ো এলো হেসে।।…..  ৩

অর্থাৎ সারা বছরের দুঃখ- দুর্দশার যেন অবসান ঘটে এবং, সুখের আগমন হয় – এই কামনা ও নৌকা ভাসানোর লোকাচারের অন্তর্নিহিত সত্য। এইজন্যএই নৌকোভাসানোকে কোন কোন অঞ্চলে বলা হয় সুয়ো-দুয়ো ভাসানো।

পৌষ পার্বণ সম্পূর্ণরূপে নারীরাই পালন করে । বাউনি বাঁধা থেকে শুরু করে পিঠে পায়েস প্রস্তুতিতে নারীরাই অংশগ্রহণ করে । তবে গঙ্গায় নৌকা ভাসানোয় নারী–পুরুষ এমন কি ছোট ছেলে মেয়েরা অংশগ্রহণ করে। মূল বাউনি ছোট একটি হাঁড়িতে বাঁধা হয় এবং সেটি পরবর্তী বছরের জন্য সংরক্ষিত থাকে। অর্থাৎ এক পৌষ সংক্রান্তি অতিক্রান্ত হলেও পরবর্তী বছরের জন্য মানসিক প্রস্তুতি রক্ষায় এর উদ্দেশ্য। এই ভাবেই গ্রাম বাংলার প্রতিটি গৃহকোণ পৌষ সংক্রান্তিতে আনন্দমুখর হয়ে ওঠে।

পশ্চিমবাংলার ইতু ব্রত – ইতুর ব্রত প্রকৃতপক্ষে সূর্যের উপাসনা। কার্তিক সংক্রান্তিতে এই ব্রতের সূচনা হয়। রবির বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থানকালে অর্থাৎ অঘ্রান মাসের প্রতি রবিবার রমণীরা এই ব্রত পালন করে । এই ব্রতে সূর্যের মূ্র্তির পরিবর্তে মাটির সরা ও ঘট ব্যবহৃত হয়। জানা যায় মিত্র ও আদিত্য শব্দ থেকে ইতু শব্দের উৎপত্তি। সূর্য দেবের প্রতিকৃতি যাতে প্রতীয়মান হয়, সেই জন্য ঘট জল দ্বারা পূর্ণ করা হয়ে থাকে। একটি মাটির সরায় ভিজে মাটিতে ধান, যব, গম, সর্ষে, ছোলা ও মটরের দান রোপন করা হয়। প্রতি রবিবার ঐ সরায় গঙ্গাজল অথবা বিশুদ্ধ জল সূর্য প্রণাম মন্ত্রসহ সিঞ্চন করতে হয়। ক্রমে শস্যদানাগুলো অঙ্কুরিত হয়ে সজীব বৃক্ষে পরিণত হয়। প্রতি রবিবারের পরিবর্তে কার্তিক সংক্রান্তি ও অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে ব্রত পালন করা হয়ে থাকে। ইতু অর্থাৎ সূর্য দেবের পূজার পর ঋতুব্রত কথা শ্রবণ করা হয়। রবির বৃশ্চিক রাশি ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ অগ্রহায়ণের সংক্রান্তিতে শস্যপূর্ণ ঘট জলাশয় বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের আগে ইতুর ঘট ফুল মালায় করে শাঁখ উলুধ্বনি দিয়ে বিদায় বরণ করা হয়। বরণের পরই ইতুর ঘট মাথায় করে শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিতে দিতে ব্রতীনীরা গঙ্গা, কোন নদী বা জলাশয়ে ইতুর ঘট বিসর্জন দেয়।ব্রতিনীরা আটটি দূর্বা ও আটটি আতপ চাল নিয়ে ইতু ব্রত কথা শ্রবণ করে-

হাতে অষ্ট চাউল অষ্ট দূর্বা লয়ে।

      শোনো সবে ইতুকথা ভক্তিযুক্ত হয়ে।।

ইতু দেবের বর।

         ধন ধান্যে পুত্রে পৌত্রে ভরে উঠুক ঘর।।…… ৪

সূর্যের সাতটি রশি বা ঘোড়া সহ স্বয়ং সূর্যদেব- এই নিয়েই আট সংখ্যা। তাই আটটি চাল ও আটটি দূর্বা অন্যতম উপকরণ। ব্রতকথা শ্রবনের পর ইতু ঘটে ব্রতিনীরা এই বলে জল দেয়- 

         কাটি কটি কুড়াতে গেলাম। ইতুর কথা শুনে এলাম।।

    এ কথা শুনলে কি ফল হয়? নির্ধনের ধন হয়।।

 অপুত্রের পুত্র হয়। আইবুড়োর বিয়ে হয়।।

অশরণের শরণ ।অন্ধের চক্ষু হয়।।    

 মনোবাসনা পূরণ হয়। অন্তকালে স্বর্গে যায়।। …..৫

রাল দুর্গা – পশ্চিমবাংলার সূর্যোপাসনার নিদর্শন যেমন ইতু পূজায় পাওয়া যায়, তেমনি  রাল দুর্গা ব্রতের উদ্দেশ্য হল সূর্যদেবের কৃপালাভ। সধবা স্ত্রীলোকেরা কুষ্ঠরোগীর আরোগ্য এবং পুত্র সন্তান কামনায় রালদুর্গা ব্রতপালন করে থাকে। ‘রাল’ শব্দটি পূর্ব ময়মনসিংহে ‘রাউল’ রূপে উচ্চারিত হয় এবং এর দ্বারা ধর্ম বা সূর্যকেই বোঝানো হয়ে থাকে। আবার রাতুল> রাউল> রাল হয়েছে। রাতুল শব্দের অর্থ রক্ত তুল বা লালবর্ণ, রক্তিম।  সূর্যের বিশেষণ বা সূর্যের রক্তিম রুপকে বোঝাতে ‘রাল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বলা চলে। 

রাল দুর্গা নামের সঙ্গে সূর্যপূজার সম্পর্ক খুঁজলে দেখা যাবে লোকায়ত ধর্মের ইতিহাসে পৌরাণিক দুর্গা বা চণ্ডী বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বহু লৌকিক দেবীতে রূপান্তরিত। এইসব দেবীদের মাহাত্ম্য এবং লোকপ্রিয়তাকে অতিক্রম করা পৌরাণিক পুরুষদেবতাদের প্রায় সাধ্য ছিল না। তাই সূর্যদেবকেও ‘দুর্গা’ নামে আত্মগোপন করতে হয়েছে। বাংলার ‘রাল দুর্গা’ মূলত সূর্যদেব।

লোকোবিশ্বাস, রালদূর্গার ব্রত সধবা রমণীরা ভক্তি ভরে পালন করলে সূর্যদেবের কৃপায় তার সমস্ত বিপদ বাধা দূরীভূত হয়। বাংলার লোকায়ত ধর্মানুষ্ঠান বা ব্রত রালদূর্গার মধ্যে নিহিত । অঘ্রাণ মাসের শুক্লা প্রতি পদে সতেরোটি ধান, সতেরোটি দূর্বা, কলা গাছের মাঝ পাতায় অর্ঘ্য সাজিয়ে সিন্দুর, শ্বেত ও রক্তচন্দন, ওর ফুল, জোড়া কলা, জবা ফুলের মালা একটি তামার পাত্রে রেখে তার ওপর জলপূর্ণ ঘট বসাতে হয়। পনের দিন ঐ ঘটের উপর ফুল জল দিতে হয়। পূর্ণিমার দিন ভক্তি ভরে রালদূর্গার পুজো করে সতেরো মুঠো চালের সিদ্ধ ভাত খেতে হয়। এই নিয়মে পৌষ মাসের পনের দিন পুজো করে পূর্ণিমার দিন যথাশক্তি রালদূর্গার পূজার পর সতের মুঠো চালের পরমান্ন খেতে হয়। মাঘ মাসে একই নিয়মে পুজো করে সতেরো মুঠো চালের দই ভাত খেতে হয়এবং ফাল্গুন মাসে একই নিয়মে ব্রত পালন করে সতের মুঠো চালের গুড়ির পিঠে পুলি খেতে হয়। এইভাবে বার বৎসর ব্রত করে উদযাপন করে পূর্ণিমার দিন সূর্যদেবকে অর্ঘ্য দান করে তঁর কাছে বর ও আরোগ্য কামনা করতে হয়। রালদুর্গা ব্রত কথায় নারায়ণের অভিশাপে কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত ব্রাহ্মণ কন্যাকে রাজকন্যা ইছামতীর বিবাহ এবং শিবের বরে রাজকন্যার রালদুর্গা ব্রত পালন ও সূর্যদেবের কৃপায় ব্রাহ্মণের সুস্থ সবল দেহ লাভ এবং রূপবান পুত্র লাভের দীর্ঘ কাহিনীর বর্ণনা পাওয়া যায়।

  টুসুব্রত –  টুসু কৃষি ব্রত। তুষলা বা তোষলা যে নামেই বাংলায় চলিত থাকুক না কেন, প্রকৃতি ও সত্তা সর্বত্র এক। গ্রামের কুমারী মেয়েরা মূলত এই ব্রত করে থাকে। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে শুরু হয়ে পৌষের সংক্রান্তি পর্যন্ত এই ব্রত পালনের কাল। টুসু নামে পৌষ মাসে সারা বছর  সংসারের দুঃখ দৈন  আনন্দ- বেদনার স্মৃতি সুরে আবৃত্তি করে, কামনা থাকলে নিবেদন করে। তুষ টুসু ব্রতের অন্যতম উপকরণ। ধানের ক্ষেত সোনালি শিসে দুলিয়ে ঝলমল হয়ে উঠলেই সাফল্য ও সম্ভাবনার আনন্দ উচ্ছসিত হয়ে থাকে। বছর বছর তার পুনরাবর্তনের জন্য কামনা নিবেদন টুসু ব্রতের মূল প্রেরণা।

আলো খলা পাতার দিন থেকে ব্রত শুরু। এই খলায় রাখা হয় গোবর গোলা ,দুব্বো ঘাস, গুঁড়ি, আলোচাল, সরষেও মূলার ফুল, গাধা, আকন্দ ফুল, সিঁদুর ইত্যাদি। মাটির ঘরে কুলুঙ্গিতে এই খলা পাতা হয়। খড়িমাটি বা পিটুলি গোলা দিয়ে দরজা ও উঠোনে লক্ষ্মীর পা, ধানের মরাই ,মাছ ,পাখি ইত্যাদির চিত্র-বিচিত্র আলপনা আঁকা হয়। গাঁদা ফুলের ব্যবহার বেশী হয়ে থাকে। ব্রত পালনের কুমারী মেয়েরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও সধবারাও অংশ নেয় । টুসুর শীতল ভোগ হয়। তারপর দিনান্তে পাড়ায় পাড়ায় কুমারী কন্ঠের মিলিত গানে গ্রাম মুখরিত হয়। সংক্রান্তির আগের রাতে হয় টুসুর জাগরণ। এই রাতে মেয়েদের টুসু গানের উচ্ছ্বাস বাঁধভাঙ্গা জলস্রোতের মতো উচ্ছল হয়ে ওঠে। টুসুব্রতের অনুষ্ঠান অংশ সবটাই গানে ভরা। সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন অঞ্চলে টুসু গানের আধিক্য।জাগরণের রাত ভোর হলে (সংক্রান্তির দিন) শুরু হয় শোভাযাত্রা। খাল, নদী বা কোন জলাশয় টুসু খলা বা মূর্তি ভাসান উপলক্ষে যথেষ্ট জনসমাগম ঘটে ।

 আমার টুসু ধনে বিদায় দিব কেমনে

      মাসাবধি টুসুধনকে পূঁজেছি যতনে।…. ৬

বাংলার শীতলা পূজা – বসন্ত ব্যাধির নিরাময়কারী লৌকিক দেবী শীতলা ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহ পূজিত হন। বাঙালির সর্পভীতি ও ব্যাঘ্রহভৃতি থেকে যেমন মনসা, বনবিবি ও দক্ষিণ রায়ের জন্ম, তেমনি বসন্ত ব্যাধির প্রতি ভীতি থেকে বিহার, বাংলা ও উষ্ণপ্রধান ভারতের গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা বসন্ত রোগ নিরাময়কারী লৌকিক দেবী শীতলার জন্ম দিয়েছে।

চৈত্রের কৃষ্ণাষ্টমীতে শীতলা মাতার পূজা কোন কোন স্থানে ‘ভগবতী পুজন’ নামেও পরিচিত। এই পূজার বিশেষ তেমন বিধি নেই। গৃহেই ভগবতীকে ‘শীতল ভোগ’ দেওয়া হয়। এই দিন তেল ছাড়া রান্না খেতে হয়। উনুন জ্বালানো এই দিন নিষিদ্ধ। পুরুষ এবং রমণী যারা এই ব্রত করে তারা দুপুরে পূজা বা ব্রত পালনের পর ব্রতকথা শুনে একবার মাত্র ভোজন করে। শীতলা মাতার নামে যেসব লোকগীত প্রচলিত, সেগুলোতে নৈষ্ঠিক ভক্তের প্রগাঢ় ভক্তির  পরিচয় পাওয়া যায়। এইসব গীতে বসন্ত রোগাক্রান্ত বালকের জন্য আরোগ্য প্রার্থনা করা হয়। শীতলা ভক্তের মনোবাঞ্ছা  পূরণ করেন এমন ভাবনা একটি লোকগীতে ফুটে উঠেছে –

         নিমিয়া কী ডালি মাইয়া লারেলী হিলোর হুয়া ওয়া

কি ঝুলী ঝুলী।

মাইয়া গাবেলী গীত কি ঝুলা ঝুলী।।…৭

শীতলা একই সঙ্গে সন্তান দাত্রী ষষ্ঠী রূপেও পূজিতা। অগ্নি প্রজনন বা সন্তান কামনাও শীতলা পূজার অপর উদ্দেশ্য। মাঘের শুক্লা ষষ্ঠীতে শীতলা মাতার যে পূজা অনুষ্ঠিত হয় তার মূল উদ্দেশ্য সন্তান কামনা। শীতল বা ঠান্ডা খাবার এই শীতল ষষ্ঠীর দিনেও গ্রহণ করতে হয়।পঞ্চমীর রাত্রে রান্না করা বাসি খাবার এই দিন খেতে হয় বলে, অনেক স্থানে এর নাম ‘বাসিয়ৌরা’। প্রভাতে স্নানের পর ঘরে বা মন্দিরে শীতলার পূজায় বাসি ভোগ নিবেদন করে বাসি খাবার গ্রহণ করতে হয়।

বিহারের লোকগীতের মতই বাংলাদেশের শীতলার গান প্রচলিত। শীতলার গান প্রধানত রাত্রে পরিবেশিত হয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মালঞ্চ থেকে কিছু দূরে ফুলবাড়ি গ্রামে চৈত্র বা বৈশাখে ‘শীতলামঙ্গল’ পালাগান প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চলে। এই পালায় পুরুষেরাই অংশগ্রহণ করে। কখনও শীতলা যাত্রাও অভিনীত হয়। হুগলির রাধানগর গ্রামেও শীতলার গান শোনা যায়। শীতলা গানে শীতলার ঘট স্থাপনের কথা উল্লেখ একটি গানে পাওয়া যায়য়-

   পদ্মের আসন পদ্মের চাটন পদ্মের সিংহাসন

পদ্মের পাতায় জন্ম নিলেন সত্যনারায়ণ।

 ঘট কেন নড়ে রে দেবী, আস্ন কেন টলে।

      ঐ আসতেছেন মা শীতলা এই আসরের পরে।….. ৮

বাংলার জিতাষ্টমী – বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সন্তানের কল্যাণার্থে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে জিতাষ্টমী ব্রত পালন করা হয়ে থাকে। লৌকিক দেবদেবীর কাছে তাঁরা সন্তানের দীর্ঘ জীবন ও সুখশান্তি কামনায় ব্রত পালন করে থাকে। বিহার এবং পশ্চিমবাংলায় জননীদের সন্তানের কল্যাণ কামনায় অনুষ্ঠিত ব্রত হল জীবৎপুত্রিকা বা জিওতিয়া এবং জিতাষ্টমী। বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, পুরুলিয়া এবং মেদিনীপুরের বহু গ্রামে এই পূজার প্রচলন আছে। এই জিতাষ্টমীর ব্রতকথায় জীমূত বাহন সূর্যপুত্র হিসেবেই কথিত। অর্থাৎ তিনি পৌরাণিক দেবতা। তাই ব্রাহ্মণেরা তাঁর পূজারী। সন্ধ্যায় জীমূত বাহনের পূজা হয়ে থাকে। তবে রাত্রেও কোথাও কোথাও পূজা হয়। সন্তানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনার উদ্দেশ্যেই জিতাষ্টমীর ব্রত পালিত হয়।

জিতাষ্টমী মূলত গৃহবধূ এবং কুমারীরা পালন করে। স্থানভেদে পূজার বিধি কিছুটা স্বতন্ত্র হলেও সর্বত্র যে বিধিটি অভিন্ন সেটি হল – বাড়ির উঠোনে বটগাছের একটি ডাল কেটে এনে পোঁতা। এই বটের ডালকেই পূজা করা হয়। যা শান্তি বা দীর্ঘায়ুর প্রতীক অর্থাৎ টোটেম ধর্মী।

 মানভুম ও পুরুলিয়ায় ইদ পরবের বারো দিন পর অর্থাৎ আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রমণীরা, জীতাষ্টমী ব্রত করে। সপ্তমীতে পূজার শুরু। পিতলের ঘড়া ঘড়ার গায়ে সিঁদুরের টিপ এঁকে শালুক ফুলের মালায় ঘড়াটি সাজানো হয়। জল পূর্ণ করার মুখে বাটির উপর ভেজানো ছোলা, মাদাল বা আতা। আমলকি ও ভেলা রাখা হয়। ঘড়ার নিচে ছড়ানো থাকে শশা।  সেখানে পূজার পর ব্রতিনীরা জ্বলন্ত প্রদীপ বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রদীপের কাজল পুত্র কন্যাদের পড়ানো হয়। ব্রতিনীরা মাটির শিয়াল ও শকুন তৈরী করে তাদের পূজা করে।  লোকবিশ্বাস এই যে শেয়াল মৃত্যু এবং শকুনি অমঙ্গল বা অশুভের প্রতীক। পুত্র সন্তানদের মঙ্গল বা শুভার্থে এদের সন্তুষ্ট বা পূজা করা হয়। পূজার পরের দিন বটের ডাল শিয়াল শকুন ও পূজার অন্যান্য সামগ্রী জলে বিসর্জনের পর ব্রতিনীরা জলে ডুব দিয়ে শশাটিতে আড়াই কামড় দিয়ে উপবাস বা পান্না ভঙ্গ করে মেঘ দর্শন করেন। কারণ জীমূতবাহনের বাহন হল মেঘ। ব্রতীনিরা মেঘ ও সূর্যের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে তাদের মত পবিত্র ও দীপ্তিমান হওয়ারঅঙ্গীকার করে। পূজার সামগ্রী উৎসাহ ভরে জলে ভাসানোর সময় শিশুর দল ছড়া কাটে –

  শকুনি গেল জলে      শেয়াল খেলো খালে

ও শিয়াল মরিস না।

       লোক হাসাহাসি করিস না।…… ৯

 আমাদের সমাজজীবনে প্রতিপালিত, সমাজজীবন থেকে দ্রুত বিলুপ্ত হতে বসা লোকাচারকেন্দ্রিক এই ব্রতানুষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব এতটাই যে, অবক্ষয়গ্রস্ত হয়েও সংহত জীবনভাবনার রূপায়ণে সেগুলো যেন নতুন পথের দিশারি।

তথ্যসূত্র

১। লোকগীতি – পৃঃ-৬৮।

২। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-১২৯।

৩। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-১৩০।

৪। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় -পৃঃ-১৪।

৫। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-১৮।

৬। ভাদু ও টুসু- পৃঃ-৩৪।

৭। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি – পৃঃ-৪৪।

৮। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-৬২।

৯। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-৬৬।

সহায়ক গ্রন্হ

১। শান্তি সিংহ – টুসু

২। আশুতোষ ভট্টচার্য – বাংলার লোক-সাহিত্য  (৩য় খণ্ড)।

৩। মানস মজুমদার – লোকসাহিত্য।

৪। রামশংকর চৌধুরী – ভাদু ও টুসু।

৫। আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলার লোক-সংস্কৃতি।

৬। বুদ্ধদেব রায় – লোকগীতি।

৭। চিত্তরঞ্জন লাহা – ধলভূমের লোকগীতি (দ্বিতীয়খণ্ড – মকর)।