July 1, 2023

An Uncertain Future for the Children of the Brick Factory

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Tushar Kanti Paroi

Abstract:

This study delves into the multifaceted challenges faced by children living in the proximity of brick factories in India, examining the complex interplay of socio-economic factors that shape their uncertain future. The brick industry, a significant contributor to India’s construction boom, has inadvertently become a crucible for child labour, inadequate education, and compromised health standards. The research employs a multidisciplinary approach, combining sociological, economic, and educational perspectives to comprehensively analyze the conditions under which these children grow up. Drawing on field observations, interviews, and statistical data, this study sheds light on the harsh realities faced by the children of brick factory workers. It explores the pervasive issues of insufficient access to quality education, healthcare, and recreational facilities, contributing to a cycle of poverty that extends across generations. Additionally, the research examines the psychological impact of such conditions on the children’s cognitive and emotional development. The study also investigates the role of government policies, non-governmental organizations, and community initiatives in addressing the challenges faced by these children. It assesses the effectiveness of existing interventions, highlighting potential areas for improvement and the need for a holistic, collaborative approach to uplift the affected communities. In conclusion, this research serves as a poignant exploration of the uncertain future faced by the children of the brick factory in India. By providing a nuanced understanding of the systemic issues at play, it advocates for targeted interventions that prioritize education, healthcare, and socio-economic support to break the cycle of poverty and secure a more promising future for these vulnerable children.

ইটভাটার শিশু শ্রমিকদের বিপন্ন ভবিষ্যৎ

তুষার কান্তি পাড়ৈ

কালনা কলেজ, কালনা, পূর্ব বর্ধমান

সারসংক্ষেপঃ ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশু শ্রমিক এক জ্বলন্ত সমস্যা। সারা ভারতজুড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিশু শ্রমিকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এরা কলকারখানা, ইটভাটা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান বাজার প্রভৃতি স্থানে কাজ করতে বাধ্য হয়। আমার এই অনুগবেষণাটি খামারগাছিতে অবস্থিত কয়েকটি ইটভাটাকে কেন্দ্র করে। এই সকল ইটভাটাতে যে সমস্ত শ্রমিক কাজ করে তাদের সন্তানদের দেখি খুব ছোট বয়স থেকে তারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজে নিযুক্ত থাকে। এইসব শিশুরা পড়াশোনার মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। যে শিশুরা আগামী দিনের দেশ ও জাতি গঠনের অগ্রণী ভূমিকা নেবে তাদের শৈশব এক অন্ধকার জগতে নিমজ্জিত হচ্ছে। তারা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছে শিশু কাল থেকেই এবং শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে নানা ধরনের শোষণ ও অপব্যবহার শিকার হচ্ছে। যে শিশুরা শিশু কাল থেকে এইভাবে বড় হয় তারা কোনদিন সুস্থ নাগরিক হতে পারে না। যে সমস্ত পিতা-মাতা শিশুদের কর্মে নিযুক্ত করছেন তাদের পরিবারকে কর্মের নিশ্চয়তার মাধ্যমে আর্থিক সুরক্ষা দিতে হবে এবং শিশুরা যাতে অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটুকু গ্রহণ করে সেদিকে পিতামাতা ও সরকারের নজর দিতে হবে।

সূচক শব্দঃ শিশু শ্রমিক, ইটভাটা, পড়াশুনা, বঞ্চিত, সুস্থ নাগরিক, আর্থিক সুরক্ষা।

আধুনিক বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির গভীরতর সমস্যা হল শিশু শ্রমিক সমস্যা। এই সমস্যার শিকর বিস্তারিত আরও গভীরে।  যে শিশুরা সমগ্র বিশ্বকে আগামীর পথ চলতে শেখাবে; হয়ে উঠবে জাতির ভাবি কালের কান্ডারী, তারাই যখন নিজেদের অমূল্য শৈশব বিসর্জন দিয়ে কোন হোটেলে, কল-কারখানা, দোকান-বাজার, ইটভাটায় কাজ করতে বাধ্য হয়,  তখন তারা হয়ে ওঠে শিশু শ্রমিক। সাধারণভাবে আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সীরাই শিশু (The child labour prohibition and regulating act, 1986)। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল ক্ষেত্রে শিশুর জন্য শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকর এবং শিশুর প্রয়োজন ও অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বঞ্চনামূলক শ্রমই শিশুশ্রম। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক কাঠামো অনুযায়ী শিশু শ্রমিকদের দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়- (১) গ্রামীণ শিশু শ্রমিক, (২) শহুরে শিশু শ্রমিক। আমাদের দেশে শহুরে শিশু শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। গ্রামীণ শিশু শ্রমিকরা প্রধানত ইটভাটা, কিছু ক্ষেত্রে বিড়ি তৈরি, চায়ের দোকান, মুদি দোকান, মিষ্টির দোকান সহ নানা ধরনের কাজ করে। অন্যদিকে শহরে শিশু শ্রমিকরা মোটর গ্যারেজ, রেস্তোরাঁ, কলকারখানায় কাজ করে। জনগণনা ২০১১ অনুযায়ী ভারতে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১০.১ মিলিয়ন, যেখানে মোট শিশু সংখ্যা ২৫৯.৬ মিলিয়ন। সব থেকে ভয়াবহ তথ্য হল ভারত তথা বিশ্বের শিশু শ্রমিকদের একটা বড় অংশকেই কাজে লাগানো হয় মাদক পাচার ও যৌন ব্যবসায়। ভারতে এরকম পেশায় নিযুক্ত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯ মিলিয়ন। অসহায় বাবা-মা বাধ্য হয়েই তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে হীন অবস্থায় পাঠিয়ে দেয় বাস্তবের রণক্ষেত্রে। দারিদ্রতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষার অভাব, পুষ্টির অভাব, স্বাস্থ্য, বেকারত্ব, পিতামাতার অক্ষমতা, ধনবৈষম্যের বিভাজন নীতি, ধনী-দরিদ্রের অবস্থানগত পার্থক্যই শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে (censusindia.gov.in, 2011)।

১৯৮৬ সালের শিশু শ্রমিক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইনঃ শিশুশ্রম বন্ধ করা ও অবাঞ্চিত ক্ষেত্রে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজে যুক্ত হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে অন্যান্য আইনের পাশাপাশি ১৯৮৬ সালে শিশু শ্রমিক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। শিশুদের জন্য উপযুক্ত কাজের পরিবেশ যা শিশুর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত এবং উপযুক্ত কাজের শর্ত সুনিশ্চিত করতে গুরুপদ স্বামীর সুপারিশ অনুসারে ১৯৮৬ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর শিশু শ্রমিক আইন প্রণয়ন হয়। এই আইনে বিশেষ বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে শিশুদের কাজ করানো প্রতিরোধ করা এবং তাদের উপযুক্ত কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। উপরোক্ত ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৮৭ সালের জাতীয় শিশু শ্রমনীতি নির্ধারণ করা হয়। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত শিশুদের সমাজে প্রতিস্থাপন ও তাদের কর্ম প্রক্রিয়া যাতে আর না সম্পাদিত হয় তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া (The child labour prohibition and regulating act, 1986)।

শিশু শ্রমিকের মতো বড় মাপের সমস্যা প্রতিরোধ করতে গেলে দেশের সরকার এবং শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। শিশুকে শিক্ষার আলো দেখায় জন্মদাতৃ মা। তাই নারী শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী পরিবার গুলির দিকে। কারণ শিশুশ্রমিক সৃষ্টির মূলে রয়েছে আমাদের আর্থিক বৈষম্যযুক্ত সামাজিক কাঠামো। সরকারকে এ বিষয়ে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই জন্য ২০০২ সালের ৮৬ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৬ থেকে ১৪ বছরের প্রতিটি বালক বালিকাকে শিক্ষাদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা হয় (21A ধারা)। প্রতিটি শিশুর পিতা-মাতারও মৌলিক কর্তব্য হল তাদের শিশুটিও যাতে ৬ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত বিদ্যালয় গিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করে তার দিকে নজর দেওয়া (প্রামানিক, ২০০২ পৃঃ ১৮৭)।  প্রচারে নয়, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে সকল শিশু যেন তার সুবর্ণ শৈশব বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে কাটাতে পারে। তাদের দিতে হবে আর্থিক অনুদান, খাদ্য, বস্ত্র এবং উপযুক্ত জীবন ধারণের পরিবেশ। আর এই দায়িত্ব সরকার যদি পালন করে তাহলে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে ভারতবর্ষ এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে উত্তরণের আলোকবর্তিকা খুঁজে পাবে। রাষ্ট্রসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে বুঝতে হবে আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। সেই শিশুই যদি অচল, অসার ও দুর্বল হয়ে পড়ে তবে আমাদের সভ্যতা নিমজ্জিত হবে অতল অন্ধকারে। তাই আমাদের মোহ আবরণ উন্মোচন করে হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করতে হবে-

“যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

                                     (ছাড়পত্র – সুকান্ত ভট্টাচার্য)

উদ্দেশ্যঃ শিশু শ্রমিকের মতো গুরুতর সমস্যা নিয়ে কাজ করার মূল উদ্দেশ্য গুলি নিচে আলোচনা করা হল-

(ক) প্রথমেই জানতে ইচ্ছা করে শিশুরা তাদের স্বপ্নের শৈশব ছেড়ে কেন শ্রমিকের কাজকে বেছে নিচ্ছে।

(খ) শিশুরা অভিভাবকদের চাপে পড়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে কি না?

(গ) শিশু শ্রমিকের পিতা-মাতার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন? তারা দারিদ্রতার কারণেই কি শিশুদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন?

(ঘ) শিশু শ্রমিক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৮৬) সম্পর্কে ঐসব শিশুর পিতা-মাতাদের কোন ধারণা আছে কিনা? আইন জেনেও তারা কি শিশুদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন?

(ঙ) যারা শিশু শ্রমিককে নিযুক্ত করছেন তারা কি শিশু শ্রমিক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৮৬) সম্পর্কে অবগত হয়ে কাজে নিযুক্ত করছেন? শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে তারা কি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন?

(চ) নিয়োগ কর্তারা শিশু শ্রমিকদের কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করছেন কি না? তা জানাও দরকার।

উপরিক্ত বিষয়গুলির যথাযথ উত্তরের খোঁজে হুগলি জেলার বলাগড় থানার অন্তর্গত সিজা কামালপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রায় দশটিটি ভাটার, মধ্যে পাঁচটি ভাটায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য ইটভাটার শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রশ্ন পত্র তৈরি করে তাদের সাক্ষাতে উক্ত প্রশ্ন গুলির উত্তর খুঁজেছি। এই সকল ইটভাটায় যে সকল শ্রমিক কাজ করে তাদের সন্তানদেরও দেখি খুব ছোট বয়স থেকে তাদের সঙ্গে কাজ করছে, আবার কখনো ওই এলাকার ছোট শিশুরাও কাজ করছে। এই সব শিশুরা পড়াশোনার মূল স্রোত থেকে বিছিন্ন হয়ে এক অন্ধকার জগতে হারিয়ে যেতে থাকে। আমার কাজের সুবিধার জন্য আমার এলাকার এই ইটভাটা গুলি বেছে নিয়েছি, ফলস্বরূপ খুব সহজে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি যথাযথভাবে সংগ্রহ করতে পারবো। কারণ এটা আমার এলাকার সমস্যা বলে তথ্য সংগ্রহ আমার কাছে অনেকটাই সহজলভ্য হবে। শিশুদের পিতা মাতাদের কাছ থেকে বহু জিজ্ঞাসার মাধ্যমে উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে। যেগুলি বিশ্লেষণ করলে শিশু শ্রমিকদের প্রকৃত কারণগুলি খুঁজে বার করা যাবে।

শিশু শ্রমিক সমস্যা বোঝার জন্য শিশু শ্রমিক সংক্রান্ত ছোট্ট গবেষণার Data সংগ্রহের মাধ্যম হিসাবে গুণগত পদ্ধতি বা Qualitative Method ব্যবহার করে গবেষণার লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে এবং প্রশ্নের উত্তর গুলি সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে গুনগত পদ্ধতির অন্যতম কৌশল ব্যখ্যামূলক (Interpretive) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া প্রশ্নমালার সাহায্যে উত্তর খোঁজা, ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণ কৌশলের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন যাত্রা প্রণালী বিশেষ ভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে। পিতা মাতা কেন শিশুকে কাজ করাচ্ছে? কেন মালিকপক্ষ তাদের কাজে নিযুক্ত করছে? কেন আইন থাকা সত্ত্বেও শিশু শ্রমিক রদ হচ্ছে না – এইসব মূল সত্যের অনুসন্ধান একমাত্র মানুষগুলির সঙ্গে কথা বলেই খুঁজতে হবে। 

নমুনা চয়নের কৌশল ও আকৃতি (Sample Size): হুগলী জেলার বলাগড় থানার অন্তর্গত সিজা কামালপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ১০ টি ভাটার মধ্যে ৫টি ভাটাকে বেঁছে নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করা হয়। এখানে ৩৯৯ জন শ্রমিকের মধ্যে প্রথম ভাটা থেকে ৮০ জন শ্রমিকের মধ্যে ১৬ জনকে, দ্বিতীয় ভাটার ৭৫ জনের মধ্যে ১৫ জনকে, তৃতীয় ভাটার ৮৪ জনের মধ্যে ১৭ জনকে, চতুর্থ ভাটার ৭০ জনের মধ্যে ১৪ জনকে এবং পঞ্চম ভাটার ৯০ জনের মধ্যে ১৮ জনকে (মোট ১৬+১৫+১৭+১৪+১৮=৮০ জন)। অর্থাৎ মোট শ্রমিকের শতাংশ শ্রমিকের তথ্য সংগ্রহের জন্য ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এখানে সম্ভবনা নির্ভর নমুনা চয়ন পদ্ধতির (Probability Sampling Method) ধরণ হিসাবে সরল পক্ষপাতহীন নমুনা চয়ন (Simple Random Sampling) কৌশলটি ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

শিশু শ্রমিকদের অবস্থা জানার জন্য যেসকল ইটভাটাকে অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হিসাবে বাছাই করা হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে শ্রমিকদের বিভিন্ন রকম কাজ করতে হচ্ছে এবং কিছু কিছু কাজে জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত বিদ্যমান। এখানে শিশু শ্রমিকরাও বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তথা মাটি কাটা, মাটি কাঁদা তৈরি করা, ছাঁচের মাধ্যমে কাঁচা ইট তৈরি করা, ইট মাথায় করে নিয়ে গাদা করা, গাড়িতে ইট বোঝাই করা, গাড়ি খালি করা ইত্যাদি কাজে রত রয়েছে। কেন ইটভাটার শিশু শ্রমিকরা পড়াশুনা বাদ দিয়ে ইটভাটায় কাজ করছে তার উত্তর খুঁজতে ইটভাটার শ্রমিকদের জন্য কিছু প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়েছিল এবং তাদের সাক্ষাতে উক্ত প্রশ্নগুলির উত্তর অনুসন্ধান, এবং তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত তথ্য পরিসংখ্যান আকারে নিচে উল্লেখ করা হল-

সারণি নং-১

ইটভাটায় নিযুক্ত শ্রমিকদের (নারী ও পুরুষ) শিক্ষাগত যোগ্যতা 

ভাটার নামশ্রমিকের সংখ্যাশিক্ষাগত যোগ্যতা
V পাশVIII পাশনিরক্ষর
প্রথম ভাটা৮০ জন৮ জন৫ জন৬৭ জন
দ্বিতীয় ভাটা৭৫ জন৭ জন৪ জন৬৪ জন
তৃতীয় ভাটা৮৪ জন৮ জন৬ জন৭০ জন
চতুর্থ ভাটা৭০ জন৪ জন৫ জন৬১ জন
পঞ্চম ভাটা৯০ জন১০ জন৮ জন৭২ জন
মোট৩৯৯ জন৩৭ জন (০৯%)২৮ জন (০৭%)৩৩৪ জন (৮৪%)

তথ্যসূত্রঃ ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

Data Analysis (উপাত্ত বিশ্লেষণ)

উপরের সারণিতে প্রদত্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে আমরা যে বিষয়টি খুঁজে পাই সেটি হল – উল্লিখিত ভাটা গুলিতে শ্রমিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিসর খুবই হতাশা জনক। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর ভাটায় কর্মরত মানুষগুলি শিক্ষা সম্পর্কে এই অসচেতনতা, আমাদের দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলির বাস্তব অবস্থা আমাদের সামনে উঠে আসে। স্বাভাবিকভাবেই এই শিক্ষার প্রভাব এই ভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের সাধারণ জীবনকে যেমন প্রভাবিত করেছে, একই সাথে তাদের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রথাগত শিক্ষার অভাব তাদের শিশুদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিষয়টিকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এই শিক্ষার অভাবের জন্যই শ্রমিকরা তাদের শিশুদের ভালোমন্দ না বুঝে, স্কুলে না পাঠিয়ে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মোট ৩৯৯ জন শ্রমিকের মধ্যে ৮৪ শতাংশ শ্রমিকের কাছে তাদের সন্তানদের ন্যুনতম প্রাথমিক শিক্ষা দানের বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি, কারণ তাদের কাছে সন্তান অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার স্বরূপ। অশিক্ষাজনিত অসচেতনতা যেমন এক্ষেত্রে দায়ী তেমনি দৈনন্দিন জীবনে রূঢ় বাস্তব তাদের কাছে অত্যন্ত ভয়াবহ। যাদের পেটে সুষম খাদ্য নেই, মাথার উপরে নিশ্চিন্ত ছাদ নেই, পরণে ভদ্রস্থ পরিধান নেই, যাদের এক দিন শ্রম বিনিয়োগ করতে না পারলে উপার্জন নেই, অসুখ করলে পথ্য ও ঔষধ নেই, ইটভাটার চৌহদ্দিতে কোনো স্কুল নেই এবং এরা যেহেতু পরিযায়ী শ্রমিক এবং বেশির ভাগ হিন্দি ভাষী – তাই তাদের শিশুদের উপযোগী কোনো বিদ্যালয় নেই – এতকিছু বাধার সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম ও উপায় হীন রূঢ় বাস্তব, শিক্ষার প্রতি তাদের বিমুখ করে তোলে। উপায়হীন হতভাগ্য শ্রমিক পিতা-মাতার এক মাত্র সম্বল শ্রমশক্তি, যে শক্তি বিনিয়োগ করে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। স্বাভাবিক কারণেই তাদের সন্তান সন্ততি ভবিষ্যতে শ্রম বিনিয়োগ করার রসদ মাত্র। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষা তাদের কাছে রসদ নয়। সমীক্ষা ভুক্ত ইটভাটাগুলির মালিক পক্ষও উৎসাহী বা উদ্যোগী নয় যে, কর্মরত শ্রমিকদের শিশু সন্তানরা লেখাপড়া শিখুক। কারণ লেখাপড়ার খরচ চালাবে কে? শ্রমিক পিতামাতার সেই সামর্থ্য নেই, ,আবার মালিক পক্ষ শিক্ষা অর্জনের জন্য পয়সা খরচ করতে অনাগ্রহী থাকে। বরং মালিকের কাছে অনেক বেশি কাম্য- শিশু সন্তান অজ্ঞ থাকলে তার সুবিধা। পরবর্তী কালে সস্তায় শ্রমিক জোগানের পথটা পরিস্কার থাকে। এই শিশুরাই তাদের ইটভাটায় পরবর্তী সময়ে শ্রমিক হিসাবে কাজ করবে। এই দ্বিমুখী চাপে শিশু শৈশব হারিয়ে শ্রমিকে পরিনত হয়। হুহু করে বর্ধিত হয় শিশু শ্রমিকের হার।

সারণি নং-২

ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের (নারী ও পুরুষ) প্রতিদিনের মজুরী 

ভাটার নামশ্রমিকের মজুরী
প্রথম ভাটা২৫০ টাকা
দ্বিতীয় ভাটা২৭০ টাকা
তৃতীয় ভাটা৩০০ টাকা
চতুর্থ ভাটা২৬০ টাকা
পঞ্চম ভাটা২৮৫ টাকা

তথ্যসূত্রঃ ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

Data Analysis (উপাত্ত বিশ্লেষণ)

যেকোনো মানুষের জীবনের সামগ্রিক উন্নতির জন্য অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু উপরিউক্ত সারণিটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, প্রত্যেকটি ভাটার শ্রমিকদের দৈনিক আয় খুবই ন্যুনতম। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে এই স্বল্প আয় একটি পরিবারের পক্ষে স্বাভাবিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে খুবই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নিজের ভরণ- পোষণের সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রদান এই আয়ে কখনোই কাঙ্খিত রূপ পায় না। ভারতীয় শ্রমিক আইন অনুসারে নির্ধারিত প্রাপ্ত মজুরির সমতুল্য হলেও এই মজুরি কোনভাবেই একটি পরিবারের স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। এই মজুরি যেহেতু সারা বছর একইভাবে নির্দিষ্ট নয় তাই তাদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততিদের কাঙ্খিত ভবিষ্যৎ দিতে সমর্থ হয় না। ফলে শিশুরাও পিতা মাতার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজে লেগে পড়তে বাধ্য হয়। বিখ্যাত অধ্যাপক Ranger Nurkse যে, “দারিদ্রের দুষ্টচক্র” – এর কথা বলেছিলেন, এখানেও শ্রমিকদের সেই দুষ্ট চক্র আবর্তিত হয়, এদের আয় কম তাই সঞ্চয় কম, সঞ্চয় কম তাই মুলধন কম, একারণে তাদের বিনিয়োগ কম (অর্থাৎ শিক্ষা অর্জনের বিনিয়োগ অথবা সুষম খাদ্যের বিনিয়োগ) (Nurkse, 1953) । স্বাভাবিক ভাবেই তাদের দারিদ্র থেকে মুক্তির আশা কম। দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় তাদের নাগালের মধ্যে নেই।

সারণি নং-৩

শিশুরা স্কুলে যায় 

ভাটারনামশিশু সংখ্যাস্কুলে যায় স্কুলে যায় না
প্রথম ভাটা৪০ জন৫ জন৩৫ জন
দ্বিতীয় ভাটা৩৭ জন৪ জন৩৩ জন
তৃতীয় ভাটা৪২ জন২ জন৪০ জন
চতুর্থ ভাটা৩৫ জন১ জন৩৪ জন
পঞ্চম ভাটা৪৫ জন৩ জন৪২ জন
মোট১৯৯ জন১৫ জন (৭.৫%)১৮৪ জন (৯২.৫%)

তথ্যসূত্রঃ ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

Data Analysis (উপাত্ত বিশ্লেষণ)

সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো জনসমাজের উন্নতিতে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে পিতা মাতার মধ্যে শিক্ষার সচেতনতা একটি আবশ্যিক নির্ধারক হয়ে ওঠে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে। উপরোক্ত সারণিতে প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে এই ভাটা গুলিতে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি খুবই হতাশা জনক। এক্ষেত্রে পিতামাতার শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনাতার অভাব তাদের শিশুদের ওপরে পড়েছে। ফলস্বরূপ শিশুদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ইটভাটা গুলির ১/২ কিলোমিটারের মধ্যে শিক্ষার পরিকাঠামোর অভাব, উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, শিক্ষার প্রতি অনিহা, শৈশব থেকেই দুর্বিসহ জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়া, পুষ্টির অভাব, স্বাস্থ্যের অভাব ইত্যাদি কারক গুলি এক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহনের ইচ্ছা বা তাগিদকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে। ফলত শিক্ষা গ্রহনের হার এদের ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ থেকে যায়। 

সারণি নং-৪

শিশু শ্রমিক আইন সম্পর্কে ধারনা আছে কি না? (হ্যাঁ/ না এর মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য)

ভাটারনামশ্রমিকের সংখ্যাহ্যাঁনা
প্রথম ভাটা৮০ জন২ জন৭৮ জন
দ্বিতীয় ভাটা৭৫ জন১ জন৭৪ জন
তৃতীয় ভাটা৮৪ জন২ জন৮২ জন
চতুর্থ ভাটা৭০ জন১ জন৬৯ জন
পঞ্চম ভাটা৯০ জন৩ জন৮৭ জন
মোট৩৯৯ জন৯ জন (২.৩%)৩৯০ জন (৯৭.৭%)

তথ্যসূত্রঃ ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

Data Analysis (উপাত্ত বিশ্লেষণ)

ভারতীয় সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বর্ণিত, “১৪ বছরের নীচে কোনও শিশুকে কোনও কারখানা, খনি বা কোনও বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত করা যাবে না।” ১৯৮৬ সালে শিশু শ্রম (রোধ ও নিয়ন্ত্রন) আইন তৈরি হয়। এই আইন বলে, ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিদের শিশু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই আইনের লক্ষ্য শিশুদের কাজের সময় ও কাজের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা এবং কিছু বিপজ্জনক শিল্পে শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা। কিন্তু ভাটায় কর্মরত শ্রমিকরা অধিকাংশই অশিক্ষিত হওয়ার জন্য ১৯৮৬ সালের শিশু শ্রমিক আইন সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। এই ধারনা না থাকার জন্য শিশু শ্রম যে দন্ডনীয় অপরাধ তা তারা না ভেবেই তাদের শিশুদের পড়াশুনা না করিয়ে তাদের সহযোগী হিসাবে কাজে লাগায়। এই সরণিতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে যে খুবই অল্প সংখ্যক শ্রমিকের শিশুশ্রমিক আইন সম্পর্কে ধারণা রয়েছে। এই ধারণাটি শ্রমিকরা পেয়েছে স্থানীয় ক্লাব, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বদান্নতায়। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্রের ভুমিকা ততটা না হলেও এই সমস্ত সংস্থার ভুমিকা বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মোট শিশুশ্রমিকের ২.৩% অভিভাবকগণ শিশু শ্রমিকের আইন সম্পর্কে অবগত হয়েও তাদের শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করতে বাধ্য হয় মূলত দারিদ্র্যের তীব্র চাপ। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের ন্যুনতম প্রয়োজন মেটানোর জন্য যে সম্পদ বা আয় প্রয়োজন, সেটুকুও তাদের কাছে সহজলভ্য নয়। ফলতঃ তারা গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বাধ্য হয় তাদের সন্তান-সন্ততিদের সহযোগী হিসেবে কাজে লাগাতে, যাতে করে নিজের ন্যূনতম মজুরি ও শিশুর ন্যূনতম মজুরি আয়ের পরিসরকে কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করতে পারে। দুঃখজনক হলেও এই মানসিকতা তাদের কাছে যতটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়, শিক্ষা বা শিক্ষার আলো তাদের শিশুকে আলোকিত করুক – এমন চিন্তা ভাবনা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। তাদের কাছে শিক্ষা অর্জনের জন্য অর্থ ব্যয় অপচয় মাত্র। এছাড়া উচ্চশিক্ষা দানের জন্য যে সময় ও অর্থের প্রয়োজন সেটাও এতটাই অপ্রতুল যে তারা শিশুদের শিক্ষাদানের বিষয়টিকে বাহুল্য বলে মনে করে। এছাড়া সমাজ ও সামাজিক মানসিকতা এমনভাবে তাদের মনে গ্রথিত হয়ে আছে যে, দারিদ্র্যকে তারা বিধাতার লিখন বা স্বাভাবিক বলে মনে করে। তাই শ্রমিকের ঘরে জন্মানো শিশু শ্রমিক হয়েই জীবন কাটাবে – এটাই তাদের স্বাভাবিক ধারণা ফলে তাদের শিশু যাতে পরবর্তী সময়ে শ্রমিকের কাজটা এই ভাটাতেই পায় সেটার প্রশিক্ষণ শিশু পর্ব থেকেই বাবা-মায়েরা তাদের শিশুকে দিয়ে থাকেন। মালিক পক্ষ শিশুর অভিভাবকদের এই মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে এবং সস্তায় শিশুশ্রমিক নিয়োগে পরক্ষে সহায়তা করে। সুতরাং আইন আইনের জায়গায় থেকে যায়। আর্থ-সামাজিক সঙ্কট যা দৈনন্দিন জীবনে অভিভাবকরা ভোগ করেন, যেখানে আইন তার তাৎপর্য হারায় এই সব হতদরিদ্র মানুষদের কাছে। ফলত অনেক ইতিবাচক আইন থাকা সত্বেও বাস্তবের চিত্রটা আজও বদলায়নি। 

সারণি নং-৫

অভিভাবকরা শিশুদের নিজেদের প্রয়োজন মত কাজে লাগায় কিনা (হ্যাঁ অথবা না এর মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য)

ভাটারনামশিশুর সংখ্যাহ্যাঁনা
প্রথম ভাটা৪০ জন৩৫ জন৫ জন
দ্বিতীয় ভাটা৩৭ জন৩৪ জন৩ জন
তৃতীয় ভাটা৪২ জন৩৮ জন৪ জন
চতুর্থ ভাটা৩৫ জন৩০ জন৫ জন
পঞ্চম ভাটা৪৫ জন৩৮ জন৭ জন
মোট শতাংশ৮৭.৯%১২.১%

তথ্যসূত্রঃ ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

Data Analysis (উপাত্ত বিশ্লেষণ)

ইটভাটার শ্রমিকরা বাইরের রাজ্য থেকে কাজে আসতে বাধ্য হয় কারণ তাদের রাজ্যে ঠিকমতো কাজ ও মজুরি পায় না। এছাড়া তারা শিশুদের কাজে লাগাতে বাধ্য হয় কারণ তাদের পারিবারিক অবস্থাও ভালো নয়। তারা সপরিবারে কাজ করতে আসে কারণ তারা তাদের ছেলেমেয়েকে একা একা রেখে আসতে চায় না। প্রায় আট মাস ধরে তারা এরাজ্যে কাজ করে রুটি রুজির জন্য, বাকি চার মাস নিজের রাজ্যে থাকে। আর্থিক সঙ্গতি ভালো নয় বলে তারা একটু বেশি উপার্জনের আশায় সপরিবারে অর্থাৎ শিশুদেরও কাজে নিযুক্ত করে। উপরিক্ত সারণির উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, ইটভাটায় কর্মরত অধিকাংশ অভিভাবকগণ কাজের সাহায্যের জন্য নিজেদের সন্তানদের ইটভাটার কাজে ব্যবহার করেন। খুব অল্প সংখ্যক শিশুরা আছে যাদের পিতা-মাতা শিশুদের কাজে ব্যবহার করেন না। এক্ষেত্রে সারণির বিশ্লেষণার্থে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য সেটি হল প্রাথমিকভাবে ভারতের সংবিধানে উল্লিখিত (৮৬ তম সংবিধান সংশোধন) মৌলিক কর্তব্যের বিষয়টি পুরোপুরিভাবে পিতা মাতা কর্তৃক উপেক্ষিত হয়েছে। আইনগতভাবে শিশুদের শিক্ষার অধিকার (21A) দেওয়া হলেও, রাষ্ট্র নিজেও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এক কথায় তাদের সুস্থ স্বাভাবিক শৈশব অবহেলার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। সুশীল সমাজ, রাষ্ট্র, অভিভাবক বৃন্দ নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা দূর করতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে আরও বেশি দ্বায়ীত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্র ওই শ্রমিকদের যদি আর্থসামাজিক দিকটির উন্নতি ঘটায় এবং আইনগত দিক গুলি সঠিক ভাবে প্রয়োগ করে তাহলে এই সমস্যা মেটা সম্ভব।

শিশু শ্রমিক সংক্রান্ত ছোট গবেষণায় অনেকগুলি গবেষণা সংক্রান্ত প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছিল এবং সেই সমস্ত প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ব্যক্তিগত কর্মের মাধ্যমে। প্রথমে ইটভাটা মালিকদের প্রশ্ন করা হয় যে, ইটভাটায় শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয় কিনা এবং শিশু শ্রমিক আইন মানা হয় কিনা। এই প্রশ্ন দুটির উত্তর হিসাবে আমি পেয়েছিলাম যে শিশুদের কাজে লাগানো হয় না এবং শিশু শ্রমিক আইন মানা হয় কিন্তু পরিস্থিতির চাপে কখনো কখনো সম্পূর্ণ মানা হয় না। এরপর ইট ভাটার কয়েকজন শ্রমিকের কাছে জানতে চাই যে তাদের কত ঘন্টা কাজ করতে হয় এবং কত টাকা মজুরি পায়, সপরিবারে কাজ করতে এসেছে কিনা? তাদের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ইটভাটায় কাজ করে কিনা? শিশুদের কি কাজ করতে বাধ্য করা হয়? তাদের ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায় কিনা? ইটভাটায় চিকিৎসা পরিষেবা আছে কিনা?

উপরোক্ত বিষয়গুলি জানতে গিয়ে উত্তর হিসেবে পাওয়া গেল ইটভাটায় শ্রমিকদের ৮-৯ ঘন্টা কাজ করতে হয়। তারা প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরি পায়। অনেক সময় শিশুরা নিজেরাও স্কুলে যেতে চায়না এবং তারা সাংসারিক স্বচ্ছলতা আনতে বাবা মায়ের সঙ্গে কাজে যুক্ত হয়। এছাড়াও জানতে পারি তারা বেশিরভাগই বিহার ও ঝাড়খন্ড থেকে এই ইটভাটা গুলিতে কাজ করতে এসেছে এবং তারা সপরিবারে এসেছে, কারণ তারা ছেলেমেয়েদের একা রেখে আসতে চায় না এবং তাদের পক্ষে টাকা পাঠানো অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে। তারা বলে তাদের ছেলেমেয়েরা অর্থনৈতিক সংকটের জন্য তারা তাদের শিশুদের ইটভাটায় কাজে নিযুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। এই শিশু গুলি স্কুলে যায় না কারণ তাদের ভাষায় ইটভাটা সংলগ্ন এলাকায় কোন স্কুল নেই। এছাড়া ইটভাটার শ্রমিকরা বলে যে তারা প্রয়োজনমতো চিকিৎসা পরিষেবা পায় না এবং তারা শিশু শ্রমিক আইন সম্পর্কে অবগত নয়।

সুপারিশঃ ভারতবর্ষ তথা সমগ্র পৃথিবীর একটি জ্বলন্ত সমস্যা হলো শিশু শ্রমিক। এই শিশুশ্রমিক সমস্যার সমাধান খুবই জরুরী, Case Study, রিপোর্ট ব্যাখ্যা ও সমীক্ষা থেকে যে তথ্যগুলি পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে শিশু শ্রমিক সমস্যার সমাধানের জন্য কিছু সুপারিশ করা হল, যে সুপারিশ গুলি শিশুশ্রমিক সমাধানের ক্ষেত্রে উপযোগী হবে বলে আমার মনে হয়। সুপারিশ গুলি হল –

১. National child labour এর অধীনস্থ পদক্ষেপগুলিকে যথাযথভাবে কার্যকরী করা।

২. রাজ্য ও জেলা স্তরে শিশু শ্রমিক আইনের বিষয়ে আরো বেশি করে প্রচার চালাতে হবে যাতে শিশুশ্রম কমে যায়। সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কোনো শিশু নিরক্ষর, ক্ষুধার্ত, চিকিৎসাহীন, পরিচর্যাহীন অবস্থায় না থাকে তা দেখে এ শিশুশ্রমিক ব্যবস্থার দূরীকরণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৩. সংবাদপত্র, টেলিভিশন, এবং বাস্তব জীবনকে ভিত্তি করে রচিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে।

৪. NGO ও Self Help Group কে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে যাতে শিশুশ্রমে সময় ব্যয় না করে তারা পড়াশুনার দিকে এগিয়ে আসতে পারে।

৫. প্রত্যেক স্থানীয় প্রশাসনকে তার নিজের এলাকা পরিদর্শন করে দেখতে হবে যে কোন শিশু শ্রমিক কাজ করছে কিনা এবং প্রয়োজন মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।

৬. দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে উন্নত করতে হবে। প্রতিটি শ্রমিক জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত মজুরী পেয়ে তাদের শিশুদের প্রতিপালন করতে পারে সেটা দেখতে হবে।

৭. সরকারকে শিশু শ্রমিকদের সুস্থ ও সবল জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।

৮. প্রতিবছর সার্ভে করতে হবে এবং শিশু শ্রমিকদের চিহ্নিত করতে হবে।

৯. শিশুদের বিদ্যালয় মুখী করতে হবে তারা যাতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ন্যুনতম পড়াশুনাটা শেখে সেদিকে পিতামাতা ও সরকারকে নজর দিতে হবে এবং তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের জন্য বই এনে পড়াতে হবে।

উপসংহারঃ শিশু শ্রমিক সমগ্র পৃথিবীর তথা ভারতবর্ষের এক জলন্ত সমস্যা। এই সমস্যার মূল সমাজের গভীরে পৌঁছে গেছে। ফলে যে শিশুরা আগামী দিনের দেশ, জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নেবে তাদের শৈশব এক অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। তারা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছে। আর আমরা সবাই জানি নিরক্ষরতার অন্ধকার কত ভয়ংকর। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা নানা ধরনের শোষণ ও অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে শিশুকাল থেকেই। যে শিশুরা এভাবে বড় হয় তারা কোনদিন দেশের সুস্থ নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। ফলস্বরূপ উন্নত দেশ ও জাতি গঠন করে ‘জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ অর্জনের লক্ষ্যে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি।

শিশু শ্রমিক সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়েই এই অনুগবেষনাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এই গবেষণার ক্ষেত্র হিসাবে খামারগাছি এলাকার ইটভাটায় গিয়ে এবং সেখানে কর্মরত শিশুদের পিতা-মাতার সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করা হয়েছে যে তারা শিশুদের কেন কাজে যুক্ত করেছেন। তাদের দেওয়া উত্তরের ভিত্তিতে বোঝা যায় এই শিশু শ্রমিকের প্রধান কারণ অরথনীতি, তারা আর্থিকভাবে খুবই দুর্বল। প্রতিদিন সকলে মিলে কাজ করেন তবেই তাদের ন্যূনতম গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হয়। এছাড়া অনেক শ্রমিক আছে যারা শিশু শ্রমিক সংক্রান্ত আইন জানেন না। কেউ ভিন্ন রাজ্য থেকে কাজে আসায় তাদের আঞ্চলিক ভাষার বিদ্যালয় না থাকায় শিশুদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কাজে নিযুক্ত করে দিচ্ছেন। অনেক সময় কম অর্থ প্রদান করে শ্রমিক পাওয়ার জন্য মালিকের তরফে উৎসাহ দেওয়া হয় শিশু শ্রমিক নিয়োগে। ইটভাটা গুলি বেশিরভাগ লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় শিশুদের অনেক সময় বিপদজনক কাজেও লাগানো হচ্ছে।

ইটভাটায় শিশু শ্রমিক কাজ না করার জন্য সরকারের তরফ থেকে কিছু ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। যে সমস্ত পিতা-মাতা শিশুদের কর্মের নিযুক্ত করছেন তাদের পরিবারকে কর্মের নিশ্চয়তার মাধ্যমে আর্থিক সুরক্ষা দিতে হবে। একই সঙ্গে আইন তৈরি করে ক্ষ্যান্ত হলেই হবে না তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। সুনিপুণ তদন্তের মাধ্যমে এই সমস্যার মূল পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিক কে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে। আর যে শিশু ৬ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটুকু গ্রহণ করে সেদিকে পিতা-মাতা ও সরকারের নজর দিতে হবে। এসব সমস্যা সমূলে উৎপাটন করলে শিশুশ্রম মেটানো সম্ভব হবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অন্ধকার জগত থেকে মুক্তি পেয়ে আলোর দিশারী হয়ে উঠবে।

তথ্য সূত্রঃ

১. censusindia.gov.in, 2011, Retrieved from https://censusindia.gov.in/census.website

২. The child labour prohibition and regulating act, 1986  Retrieved from https://labour.gov.in/sites/default/files/act_2.pdf.

৩. প্রামানিক, নিমাই (২০০২) ভারতীয় শাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতির রূপরেখা, ছায়া প্রকাশনী।

৪. Nurkse, R. (1953), “Problems of Capital Formation in Underdeveloped Countries”, Oxford: Basil Blackwell.