May 1, 2024

Music in Secular Rituals and Festivals of Bengal

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ড.শ্রাবণী সেন, আ্যসোসিয়েট প্রফেসর,সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী

Music in Secular Rituals and Festivals of Bengal

Rituals and traditions play a vital role in cultural preservation. Festivals provide a platform for the transmission of cultural values, rituals and traditions from one generation to the next. They also provide a sense of identity and belonging for individuals and communities. Through participation, observation and storytelling, younger generations learn about their cultural heritage. Traditional heritage plays a significant role in shaping the cultural identity of a community or society. Folk music is an indispensable part of functions such as childbirth, weeding etc. In the rural parts of the country, there are a number of songs associated with agricultural activities like planting and harvesting. Cultural heritage represents the values, beliefs, customs and traditions of a particular group of people and helps them to connect with their roots and heritage.

সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা ও লোকসংস্কৃতির আলোচনায় লোকসমাজ ও লোকমানসের প্রসঙ্গ ঘুরে-ফিরে আসে। লোক সমাজ বলতে কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যযুক্ত সমাজ বোঝায় না।‘লোক’ শব্দটির দ্বারা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, পশ্চাৎপদ জনসমাজ, সাধারণ মানুষ, কৃষিমাজকে নির্দেশ করে যেখানে ঐতিহ্যের ভূমিকাই প্রধান। লোকসমাজের অন্তর্গত বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক মানুষের ভাষা, আচার সংস্কার ও জীবনযাপনের রীতি, ভাবধারার উপর গ্রামীণ সমাজমনের গভীর ঐতিহ্যানুসারী গ্রামীণ ভাবধারা সতেজ রয়ে গেছে। সুতরাং লোকসমাজ কোন বিচ্ছিন্ন নরগোষ্ঠীর সমাজ নয়। বৃহত্তর সাধারণ সমাজের ঐতিহ্যানুগত  জীবন ও মনের মধ্যেই লোকসমাজ টিকে আছে। লোকসমাজের অন্তর্গত ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ, জীবন প্রণালী ও দৈনন্দিন চিত্তবিনোদনের সহজাত মাধ্যমের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে স্থানভিত্তিক নানা লোকজ আচার অনু্ষ্ঠান।

লোককথা, উপকথা, রূপকথা, ধর্মকথা- যা লুকায়িত থাকে আলোর নীচে তা লোকায়িত সংস্কৃতি বা লোকঐতিহ্য। এইসব লোকঐতিহ্য মূলত লালিত পালিত হয় অঞ্চল বিশেষের নিম্নবর্ণের মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কার দ্বারা। যে কোন জাতির ইতিহাস,ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধর্মকথাকে উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাই সাধারণ মানবজীবনকে আবদ্ধ রাখতে ধর্মের ভূমিকা খুব গরুত্বপূর্ণ। সমাজ বিকাশেও ধর্মের ভূমিকা গৌণ নয়। ধর্ম হলো এমন সব আচরণ ও চিন্তার পুঞ্জ যা কাউকে প্রসন্ন করা বা আত্মনিবেদন করার ভাব থেকে আসে। ধর্মচার পালনের জন্য যা আচার অনুষ্ঠান তা হল পূজা – দেবতার কাছে প্রার্থনা। । দেবতাদের তুষ্ট করার উপায় রূপে পূজাকেই ভরসা করা হয়। ধর্মীয় আচার বা ব্রত পালনের জন্য যেসব ক্রিয়াত্মক আচরণ করা হয় তার একটা  যৌক্তিকতা পুরাণ বা myth এ অন্বেষণের বিষয়। ধর্মের ব্যবহারগত দিককে আচার (Rituals) বলা যায়। আচার (Rituals)- কে বলা হয়েছে The implementation of belief – সংশ্লিষ্ট বিশ্বাসগুলোকে রূপ দেয় আচার।  ধর্মের মানসভাব অভিব্যক্ত হয়  আচার ও বিশ্বাস রূপে। নির্দিষ্ট রীতি অনুসারে কিছু ক্রিয়া সম্পাদন হল আচার, তারা পালনকারীর সঙ্গে অনৈসর্গিক শক্তির মধ্যস্থতা করে দেয়। আবার বিশ্বাসগুলো আচারকে যুক্তিগ্রাহ্য করে। সরল নিরক্ষর মানুষের কাছে ধর্মের বাহ্যিক বা আনুষ্ঠানিক অংশের কদর বেশি। কোন কোন আচারে বিশেষ রকমের সাজসজ্জা ও নাচ গান-বাজনার যোগও লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি লোকাচার বা লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের প্রচলন আছে। বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণে আচার পার্বণের সংখ্যা অসংখ্য। আচারগুলো প্রধানত তিথি, মাস, ঋতুভিত্তিক। আচারের মূলে আছে অন্ধ ও অলৌকিক বিশ্বাস ও নানা সংস্কার। এরূপ বিশ্বাস-সংস্কারেরের অনুকূলে কতগুলো কৃত্যানুষ্ঠান সংযুক্ত করে ধর্মীয় আচারে পরিণত করা হয়।

এ ভূখণ্ডের প্রাগৈতিহাসিক ঐতিহাসিক যুগের জাতি গোষ্ঠীর লৌকিক অলৌকিক বিশ্বাস- সংস্কার, ধ্যান-ধারণাকে আশ্রয় করে নানা প্রথা-পার্বণ, আচার-উৎসব গড়ে উঠেছে। আচারগুলো উপলক্ষ্য, আয়োজন, উপাদান, কৃত্যানুষ্ঠান বিশ্লেষণ করলে আদিবাসী সংস্কার- বিশ্বাসের সঙ্গে বেশ মিল পরিলক্ষিত হয়। মানব জীবন নানা আশঙ্কা ও ভীতি, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, কল্যাণ মঙ্গল চিন্তায় ইত্যাদি অভিব্যক্তির মধ্যে আবর্তিত হয়। এর সঙ্গে রয়েছে মানুষের দৈবশক্তির সহাবস্থান। সুতরাং মানুষের দৈনিক বিশ্বাস ও  বৈষয়িক  মঙ্গল চিন্তা থেকেই লোকায়ত সমাজে আচারের উদ্ভব। দেবদেবী মাত্রেরই প্রসস্তিমূলক পুরাকথা লিখিত বা মৌখিক রূপে গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত। উপাস্যের অর্চনায় পরম্পরাগত আচরণীয় বিধি বা নিয়মের অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এগুলো সাধারণত লোকপ্রচলিত নিয়ম, যেখানে শাস্ত্রীদের যাদের বিধান নেই। কিন্তু পরে কিছু কিছু শাস্ত্রাচার গৃহীত হয়েছে। এই আচার নানারকম। যেমন- স্ত্রী-আচার, শাস্ত্রাচার, গৃহাচার ইত্যাদি পালনীয় অনুষ্ঠান লৌকিক ক্ষেত্রেই শুরু হলেও সমাজে ধীরে ধীরে এইসব অনুষ্ঠানের প্রবল প্রতিষ্ঠা ঘটে। ধর্মবিধিকে দুর্বল করে দিয়ে অনুষ্ঠানগুলো বলীয়ান হয়ে ওঠে। লোকসমাজে শাস্ত্রের ভূমিকা গৌণ বলে আচারের ভুমিকা স্পষ্ট। সামাজিক অনুষ্ঠানেও এইসব আচার-বিধি গুরুত্ব পেয়েছে। আচার দিয়ে অনুষ্ঠানের শুদ্ধি নির্ণয় করা হয়। তাই আচার-বিচার যুগ্মক রূপে প্রচলিত। লোকসমাজের জন্য শুভ বা মঙ্গল কামনা করে ব্রত পালন করা হয়। যেখানে কোন তন্ত্র মন্ত্র বা পুরোহিত রাখা হয় না, বিশেষত শুদ্ধ খাঁটি ব্রত গুলোর ক্ষেত্রে। ব্রতী নিজের মনস্কামনা উদ্দিষ্ট্যের কাছে ব্যক্ত করতে যেসব আচরণ সম্পন্ন করে তা থেকেই আচারের উদ্ভব। ব্রতের সঙ্গে যুক্ত  নাচ, গান, অভিনয়, কথকতা ও আনুষাঙ্গিক বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ। শাস্ত্রীয় আচারে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় প্রকার কামনা প্রকাশিত হলেও  লোকাচারে কেবল পার্থিব কামনা- বাসনাই প্রতিফলিত হয়। লোকাচার প্রতি পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই অংশগ্রহণ করে বেশি।

নতুন ধান ঘরে এলে  গ্রাম- বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব এর ধুম পড়ে যায়- এটি সর্বাঞ্চলিক আচার- উৎসব। বৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘হুদম দেওয়া’ ক্রিয়া অনুষ্ঠানটি শুধু কোচ- রমণীদের মধ্যে প্রচলিত আছে,যা আঞ্চলিক। লোকাচারগুলোতে জাতীয় অতীত ইতিহাস, বিচিত্র সাংস্কৃতিক, সামাজিক  ও নৃতাত্ত্বিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রচলিত লোকাচার ও প্রথাসমূহকে মানব, পশু ও কৃষি এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। সাংসারিক অনুভব-নীতি, আদেশ, উপদেশ ও অনুষ্ঠানে প্রসঙ্গে বহুগীতি প্রচলিত আছে। সাধারণত এ সব গান নারীকণ্ঠে গীত হয়। বিবাহ, গর্ভাধান, পঞ্চামৃত, সাধভক্ষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গীত প্রচলিত আছে। বিয়ের গানগুলোর মধ্যে জল ভরার গান আচার মূলক অনুষ্ঠানে জনপ্রিয়। ‘জল ভর কাঞ্চন কন্যা জলে দিয়া মন’- বিবাহে – সাধারণ জল ভরার গান পাওয়া যায়। হলুদ কোটার গান, গায়ে হলুদের গান। স্ত্রী আচারের গানে সন্তান জন্মের পরের অনুষ্ঠান- নামকরণ, চূড়াকরণ, অন্নপ্রাশন কেন্দ্রিক নানা মেয়েলি গীতের প্রচলন আছে। বিবাহের গীত- জলসওয়া থেকে শুরু করে স্ত্রী আচার- যার মধ্যে বাসরের গান উল্লেখযোগ্য। নারী- পুরুষ সকলের কন্ঠে এই গান শুনতে পাওয়া যায়।

বাংলার লোকসমাজের ইতিহাস অতি প্রাচীন, বৈচিত্র্যময় এবং ব্যাপক। বাঙালি জীবন যাপনের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো উৎসব, যা ছাড়া বাঙালির জীবন অসম্পূর্ণ। বাংলার সমাজ জীবনে উৎসব প্রিয়তাকে প্রাধান্যকে দিয়ে প্রচলিত হয়েছে-’ বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।

কোন জনগোষ্ঠীর জীবন ঘনিষ্ঠ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে লোকসংস্কৃতি এবং পালন করা হয় লোকউৎসব। সামাজিক-পারিবারিক স্তরে, জাতীয় স্তরে, ধার্মিক প্রেক্ষাপটেও ঋতু ভেদে বিশেষ দিনগুলোতে আনন্দ সহকারে উৎসবগুলো পালন করা হয়। জন্ম- বিবাহ-ব্রত-পাঁচালী, শারদ উৎসব ইত্যাদি প্রতিটা মুহূর্তের সাথেই বাঙালির উৎসব জড়িয়ে আছে।

আবার কোন কোন উৎসব ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় গ্রহণ – বর্জনের মধ্যে দিয়ে এখনো টিকে আছে । এইসব উৎসবের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার ,বিশ্বাস- অবিশ্বাস, আচার–আচরণ যুক্ত হয়ে আছে। কয়েকটি লোক উৎসব- করম, চরক, নবান্ন, ও পৌষ পার্বণ, বৃষ্টির আগমনী, টুসু ,ভাদ, নৌকাবাইচ গ্রাম বাংলার জনগণের প্রিয় উৎসব।

 পারিবারিক উৎসবগুলোর মাধ্যমে সপরিবারের মধ্যে একত্রিত হওয়ার সুযোগ গড়ে ওঠে এবং একে অপরের দুঃখ অথবা আনন্দের অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেয়। ভাইফোঁটা, অন্নপ্রাশন, বিবাহ, জামাইষষ্ঠী প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলো তারই উদাহরণ ।কবি বলেছেন-

উৎসব মানে এক মিলনের মেলা

          কিছু দেওয়া কিছু নেওয়া জীবনের খেলা। ১

তবে বাঙালির উৎসবে নানা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। উৎসবকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়- ধর্মীয় উৎসব, ঋতু উৎসব, জাতীয় উৎসব, লোক উৎসব, সামাজিক- পারিবারিক উৎসব প্রভৃতি। গ্রাম প্রধান বাংলাদেশ গ্রামের জনগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে তাদের নিজস্ব জীবনযাপন প্রণালীকে ভিত্তি করে  নানামুখী যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাই আমাদের লোকসংস্কৃতি এবং লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ লোকসংগীত যা বাংলার লোকউৎসবের প্রাণ। বাংলা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ বছরের বিভিন্ন সময় ধর্মকে কেন্দ্র করে একাধিক উৎসবের আয়োজন করে থাকে, একে অপরের উৎসবের অংশগ্রহণ করে, আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠে।  হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যকে আরও বেশি বর্ণিল করে তুলেছে বাঙালির উৎসবগুলো। লোক উৎসব গ্রামবাংলা জনগণের প্রিয় উৎসব।  লোক উৎসবের মধ্যে করম, চরক, নবান্ন, পৌষ পার্বণ, নৌকা বাইচ, আগমনী, টুসু, ভাদু উল্লেখযোগ্য। বাংলার লোকসংগীত যথেষ্ট সমৃদ্ধ। লোকসংগীত অনবদ্য রূপ গ্রহণ করে যখন গীত, বাদ্য ও নৃত্যের সমন্বয় ঘটে এই সংগীতের সাথে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় –

 আরে আল্লাহ নাম জপি ছাড়িলাম নাও

 ওরে ছাড়িলাম হাসনের নাও রে

ভাইরে হাসন রাজার নাও……২

ঐতিহ্যের  ধারক নৌকাবাইচের অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে নদীর বুক চিড়ে পাল্লা দিয়ে এক সুরে মাল্লারা গান গেয়ে এগিয়ে চলে নৌকা।

চৈত্র সংক্রান্তির অন্যতম উৎসব চড়ক। গ্রামীণ লোকজ উৎসবের অন্যতম উৎসব চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। চৈত্র সংক্রান্তি এবং বৈশাখকে ঘিরে আয়োজনও হয় ব্যাপক। দুটো উৎসবই যেন একে অপরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। দুটো উৎসবকে ঘিরে প্রচলন রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উৎসবের। বছরের শেষ দিনে শুভবিদায় জানিয়ে বিভিন্ন বন্দনা, গান গাওয়া হয় আর বৈশাখের শুরুতে নতুন বছরকে আহ্বান জানিয়ে পালন করা হয় নববর্ষ।

বাঙালির উৎসবের একটা প্রধান উৎস হলো ঋতু উৎসব। বিশেষ বিশেষ ঋতুকে ঘিরে ঋতু ভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করে বাঙালি। ভাদ্র মাসে কুমারী মেয়েরা ভাদুমূর্তিকে সামনে রেখে একমাস ধরে পালন করে ভাদুউৎসব। ভাদুমূর্তির সামনে গাওয়া হয় ভাদু গান। নতুন ফসল ওঠার পর অগ্রহায়ণ মাসে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। শীত ঋতুতে পৌষ পার্বণ পালন করা হয়। এটি মূলত শস্যোৎসব। তাই শস্যদেবী তথা লক্ষ্মীকে সাদরে বরণ করাও পৌষপার্বণের অঙ্গ। যদিও শস্যজাত খাদ্যগ্রহণের পূর্বে শস্যদেবীর বন্দনাও এর অঙ্গ। এই উদ্দেশ্যে চালের গুঁড়ো, সামান্য গুড় ও দুটি খড় নিয়ে বাঁধায় ‘বাউনি’ অর্থাৎ বন্ধনী, যার দ্বারা লক্ষ্মীকে বাঁধা হয়। অর্থাৎ উৎসব উপলক্ষ্যে বাউনি বাধা হয় পৌষ সংক্রান্তির সন্ধ্যায়।

‘‘আউনি বাউনি কোথাও না যেও।

           তিন দিন ঘরে বসে পিঠে বলি খেও।।’’…… ৩

এই উৎসব উপলক্ষ্যে মুসলিম রাখাল ছেলেরা মানিক পীরের গান গায় আর হিন্দু রাখাল ছেলেরা লক্ষ্মীর নামে ছড়া কেটে সারা পৌষ মাস সন্ধ্যার পর বাড়ি বাড়ি মাগন করে। মাগন শেষে তারা পৌষ সংক্রান্তির সকালে পিঠে বা শিরনি রান্না করে দেবতাকে উৎসর্গ করে।

 একে পিঠে পর্বও বলা হয়।

মকর সংক্রান্তির দিন বাংলায় পৌষ পার্বণের সাড়া পড়ে যায়। কলার ভেলার নৌকো ফুলমালায় সজ্জিত করে বাড়ির পুরুষদের নামে গঙ্গাসানো হয়। ঐ নৌকা গঙ্গায় বা জলে ভাসানোর সময় কোথাও কোথাও ছড়া বলার রীতিও আছে। যেমন-

  দুয়ো গেল ভেসে।

        শুয়ো এলো হেসে।।…..৪

আবার বসন্তকালে যখন সব কিছু রাঙিয়ে ওঠে তখন বাঙালি দোলযাত্রাকে কেন্দ্র করে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়।

 ব্রতচার পালনের গীত এর মধ্যে ভাদু, টুসু, গম্ভীরা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেয়েলী ব্রতের মধ্যে কার্তিক ব্রত, জাওয়া ব্রত, নানা ষষ্ঠী ব্রত, নানা কৃষি ব্রত- এসবের সঙ্গে যুক্ত মেয়েলি গীত পাওয়া যায়। এসব গানে বাস্তব জীবনের সুখ- দুঃখ, বঞ্চনা- বেদনার ছায়াপাত ঘটে। গাজন, ভাঁজো, উমা, ভাইফোঁটার গান পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের করম পূজা ও জাওয়া পরবের গীত প্রচলিত আছে। গাজনের গীত শিব ধর্ম ঠাকুরের উৎসব উপলক্ষ্যে গাওয়া হয়। বাঁধনা পরব, ঈদ ও নবান্নের গান আছে। মকর সংক্রান্তিতে  টুসু গানের কদর বেশি। শারদীয় উৎসবে আগমনী- বিজয়া এবং ভাইফোঁটার গান শোনা যায়।

পশ্চিম সীমান্ত বাংলার সর্বাধিক জনপ্রিয় লোক উৎসব টুসু। টুসুকে কেন্দ্র করে আত্মপ্রকাশনার উৎসব গড়ে ওঠে গ্রাম বাংলায়। কালো জল দেখে তাতে টুসুকে ভাসাবার পরিবর্তে প্রিয় কালাকে মনে পড়ার কথা গানে ফুটে ওঠে। টুসু উৎসবে বিশেষত লোকোদেবী টুসুদেবীর পরিবর্তে স্নেহের পুত্তলি কন্যারূপের সমাদৃত। অগ্রহায়ন মাসের সংক্রান্তির দিন থেকেই সাঁওতাল ভূমিজ ভুইয়া কুরমি মাহাতো সম্প্রদায়ের মানুষ টুসু উৎসব করেন-

আমার টুসু ধনে, বিদায় দিব কেমনে

     মাসাবধি টুসু ধনকে পূজেছি যতনে ।…. ৫

বাঁকুড়া ঘেষা অঞ্চলটিতে ভাদু উৎসব টুসু উৎসবের মতোই জনপ্রিয়। ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদু উৎসব পালিত হয়। ভাদু যেন ঘরের কন্যা।  সাধারণত বাগদি, বাউরিয়ারা এই উৎসব পালন করে। এই উৎসব একমাস ধরে চলে। ভাদু গানের মাধ্যমে কুমারীর যন্ত্রনা, শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সামাজিক কু- আচার ইত্যাদি থাকে ।

ভাদু কৃষিভাবনাজাত লোক উৎসব। ভাদ্রে  ভাদুই বা আউশ ধান হয়।  ভাদুই ধান ঘরে তোলার আনন্দ থেকেই ভাদু পরব। এই পরবে কৃষিলক্ষ্মী মূর্তিমতী নারীরূপা বন্দিতা –

ভাদুর আগমনে

কি আনন্দ হয় গো মোদের প্রাণে

ভাদু আজ এলো ঘরে গো

এলো গো শুভদিনে।….৬

কুরামি সম্প্রদায়ের মানুষের ‘জাওয়া উৎসব’ এক বিশেষ উৎসব। জাওয়া-পরব ভাদ্রমাসের শুক্লা কাদশী তিথিতে করমের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে কিশোর- কিশোরীরা পরস্পরকে কোমর ধরে যূথবদ্ধ নাচ-গানে অংশগ্রহণ করে। ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীতে করম উৎসব পালিত হয়। জাওয়া ডালিতে থাকে ‘পঞ্চশস্য’। জাত শব্দজাত ‘জাওয়া’ শস্যোৎসব। তাই জাওয়া গানে শোনা যায়-

  উপর ক্ষেতে হাল দাদা নাম ক্ষেতে কামিন রে।

                      কন্ ক্ষেতে লাগাব দাদা ক্ষেতে কামিন-কাজল ধান রে।।….৭

পলি-আবর্ত সমভূমিতে করম উৎসব শস্য উৎসবে পরিণত হলেও অরণ্য অরণ্যাশ্রিত ভূমিতে করম উৎসবের প্রকৃতি বদলে যায় শিকার আঙ্গিকে। বিনপুর- ১ (লালগড়)  ও গড়বেতা- ৩ ( চন্দ্রকোনা রোড) ব্লকে এই দিনই ইদ পরব। এই উৎসবে শস্য ও সন্তান কামনায় উদ্ভিদের দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জাদুক্রিয়া মিশ্রিত আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ।

করম কুমারী মেয়েদরই পরব। অনেক জায়গায় বিবাহিত কিশোরী বিয়ের পরেও এইপরবে অংশ গ্রহণ  করে। তাই প্রবাসী কান্তের বিরহে বিরহিণী পশ্চিম সীমান্ত বাংলার যৌবনবতীও করম গান গেয়ে ওঠে-

 পখইর্ কুঁড়ালে বঁধু না বাঁধাইলে ঘাট।

ডালিম লাগায়েঁ  বঁধু গেলে পরবাস।।

     পাকিল ফাটিল  ডালিম পরে ভাঁইয়ে খায়।

ইদেশে পণ্ডিত নাই সঁয়াকে বুঝায়।।

      পাকিল ফাটিল  ডালিম চোরে ভাঁইঙে খায়।

      আমার বঁধু ঘরে নাই জইবন্ বইয়ে যায়।। ৮

অরণ্যচারী আদিম আদিবাসী সাঁওতাল, মুন্ড্‌ কোডা প্রভৃতি মূল জনজাতির প্রধান দেবতা বড়াম- যার অবস্থান শল গাছের তলায় এক একটি অখোদিত বড় পাথরকে কেন্দ্র করে। এখানে বড়াম দেবতা ছাড়া অন্য দেবতা আছে। যেমন মারং, বুরুং, বোন্ডা, জাহের আরা প্রভৃতি। বড়ামের রূপান্তরিত নাম ‘গরাম’। হিন্দু ধর্মাশ্রিত জাতি উপজাতির জনগোষ্ঠী মাহাতো কুরমি, লোধা, শবর, ভূঁইয়া, মাঝি, দুলে, বাগদি প্রভৃতির পাশাপাশি সাঁওতাল, মুন্ডা বেড়া প্রভৃতি। গ্রামের প্রবেশ পথে কিংবা গ্রামের এক প্রান্তে কোন বড় গাছের তলায় এরা পুজো করে ।

আদিবাসীদের আরেকটি উৎসব হল বাঁধনা পরব। গবাদিপশুর উৎসব। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে  কালীপূজার দিন এই উৎসব শুরু হয়। বাঁধনা-পরব প্রকৃতপক্ষে গো-মহিষের প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন গো-বন্দনা । বাঁধনা-পরব উপলক্ষে যেসব গান-গাওয়া হয় তার শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ধাঙরদের অসংবৃত ও শ্লীলতাহীন নাচে গ্রামের রাস্তা চঞ্চল হয়ে ওঠে। 

‘মাছি খেদা উৎসব’ ও ‘আশ পোড়ান’ নামক লৌকিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে । ‘মাছি খেদা উৎসব’ গ্রাম থেকে অশুভ শক্তি ও অপদেবতা বিতারণের আদিবাসী আচার। ধর্ম ঠাকুরের পুজো উপলক্ষে ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ মেতে ওঠেন। এই পুজো উপলক্ষে রথযাত্রা মেলা,  রাসযাত্রা, ঝুলন, দোলযাত্রা, ভীম পুজো আকর্ষণীয় উৎসব। মুর্শিদাবাদ জেলার বোলান গানে শিবের গাজন পালিত হয়। নীল উৎসব কে কেন্দ্র করে শোলক গানের জন্ম হয়। পূজার পর দশ অবতার, দক্ষযজ্ঞ প্রভৃতি শিবে বিষয়ক সংগীত সন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন। কোন কোন উৎসব ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় গ্রহণ বর্জনের মধ্যে দিয়ে এখনও টিকে আছে। এসব উৎসবের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার, বিশ্বাস- অবিশ্বাস, আচার–আচরণ যুক্ত হয়ে আছে।

বাংলা তথা বাঙালীর জীবন যাপনের প্রতিটি মূহুর্তে বয়ে চলেছে এই উৎসবের ধারা। এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে বাংলা তার সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে বিশ্বের দরবারে। বর্তমানে বাংলার এই উৎসবের যতই আধুনিকরণ  হোক না কেন, আজও বাঙালি সেই প্রাচীন পন্থাগুলোকে অনুসরণ করে চলেছে। বাঙ্গালী তার  নিজের স্বচ্ছন্দতা, ধারাবাহিকতাকে  বজায় রেখে আজও লৌকিক আচার, উৎসব পালন করে চলেছে। ধর্মীয় ভাব ও অলৌকিক বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে  গ্রামীণ মানুষের যাবতীয় আচার-উৎসব, গীত, গল্প ও সমাজিক চেতনার ঐতিহ্য।

তথ্যসূত্র

১। বাংলার লোকসংস্কৃতি- পৃঃ-৩৮।

২। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য- পৃঃ- ৫৬

৩। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-১২৯।

৪। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-১৩০।

৫। ভাদু ও টুসু- পৃঃ-৩৪।

৬। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি – পৃঃ-৪৪।

৭। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-৬২।

৮। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় – পৃঃ-৬৬।

সহায়ক গ্রন্হ

১। আশুতোষ ভট্টাচার্য- বাংলার লোকসংগীত রত্নাকর।

২। মানস মজুমদার – লোকঐতিহ্যের দর্পণে।

৩। সৌগত চট্টোপাধ্যায় – প্রসঙ্গঃ লোকসংস্কৃতি।

৪। আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলার লোকসাহিত্য, ১ম খণ্ড।

৫। রামশংকর চৌধুরী – ভাদু ও টুসু।

৬। শান্তি সিংহ – টুসু

৭। বুদ্ধদেব রায় – লোকগীতি।

৮। প্রবোধকুমার ভৌমিক – লোকসমাজ ও সংস্কৃতি।