July 1, 2024

In Search of the Roots of Bhawaiya  Song

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. Srabani Sen, Associate Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College, e-mail-srabanisn1@gmail.com  Mobile no- 6290242709

Traditional culture is the mirror of the community. Rajbanshi is the most influential caste among the Hindu ethnic groups of Eastern India. The Bhawaiya is the folk song of Rajbanshis. The Bhawaiya is associated with Rajbanshis in every step of the life of the society. The origin of the Bhawaiya song is from Bhava. The theme and the melody of the song are deeply expressive and all these songs leave the listener’s mind in awe. In Bhawaiya, the main inhabitants of North Bengal have mixed their own language. Major part of the Bhawaiya song was devoted to female emotion and expressional aspects. But the songs were sung by the male singers. The Bhawaiya folk song must be seen in the context of its rural social environment like agriculture, riverwork, rituals, festivals, and romantic views also.

ভাওয়াইয়া গানের শিকড়ের সন্ধানে

  কোন অঞ্চলের সাহিত্য সঙ্গীত সেই সমাজ বা অঞ্চলের দর্পণ বলা যায়। বিশেষ করে সঙ্গীতেই আমরা সমাজ জীবনের ছবি দেখতে পাই। সেইদিক থেকে বলা যায় লোকসাহিত্য বা লোকগীতি কোন অঞ্চলের নিজস্ব সম্পদ। বিচিত্র পরিবেশের খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের স্বতস্ফূর্ত মুখনিঃসৃত গান।এ গান উচ্চতর সাহিত্যের সাথে সম্পর্কিত নয়। গ্রামবাংলার মানুষ কাজের অবসরে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান বাঁধে এবং তাঁদের করুণ ও আনন্দপূর্ণ জীবনগাথা তুলে ধরে সুরেরে মাধ্যমে।

  বিচিত্র এবং বিপুল লোকসঙ্গীতে ভরা বাংলার প্রতিটি অঞ্চল আর এই লোকসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় দখল করে রেখেছে ‘ভাওয়াইয়া’ গান। ভাওয়াইয়া প্রকৃত অর্থে লোকসংগীত  অর্থাৎ  একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সংগীত। নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে বলা যায় ভাওয়াইয়া উত্তর বাংলার রাজবংশী জনগোষ্ঠীর লোকোজীবনের  সুরধারা। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ও রাজবংশী জনগোষ্ঠীর জীবনকে কেন্দ্র করেই ভাওয়াইয়ার সৃষ্টি। কামরূপের রাজবংশী জীবন-মনন প্রকৃতির অমূল্য রূপ গানকে প্রতিফলিত করে। প্রাচীন ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে রাজবংশী সম্প্রদায় রাজবংশের সময় কোচবিহারের শাসন সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কোচবিহারের রাজবংশী সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে যা অন্যান্য সম্প্রদায়ের থেকে আলাদা। এই সংস্কৃতি বিশেষ করে তাদের সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত হতে সাহায্য করে। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী লোকগীতিতে নারীর একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। বেশীরভাগ গানই নারীর বিরহ, বেদনা, আশা-আকাঙ্খা, আনন্দের গান। এই গানগুলো বিশ্লেষণ করলে রাজবংশী নারীদের একটা বিশেষরূপ ধরা পড়ে। নারীরা কখনও জননী, প্রেমিকা আবার কখন প্রেরণাদাত্রী। রাজবংশী লোকগীতিতে নারীজীবনের কথা বিশেষভাবে প্রাধন্য পেয়েছে। ভাওয়াইয়া লোকগীতিতে শুধু নারীজীবন নয় সমগ্র রাজবংশী সমাজের ছবি ফুটে ওঠে। গায়কীতে ধরা পড়ে সমাজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, গতি ও প্রকৃতি।

  উত্তরবাংলা ও সন্নিহিত অসমের গোয়ালপাড়া, ধুবুড়ি ও কামরূপ, মেঘালয়ের তুরা, বাংলাদেশের রংপুর, কুড়িগ্রাম, বিহারের কিশানগঞ্জ, পুর্ণিয়া এবং নেপালের ঝাঁপা, মোরঙ প্রভৃতি জেলায় বসবাসকারী রাজবংশী ক্ষত্রিয় ও স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায় এবং অন্যান্য স্থানীয় আদিবাসীদের প্রাণের গান ভাওয়াইয়া- এই অঞ্চলের উন্নত সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপাদান। তবে এ গান সবচেয়ে বেশি প্রচলিত জনপ্রিয় বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলে। আসামের গোয়ালপাড়া  ভাওয়াইয়া গানের আদিভূমি। আর রংপুর অঞ্চল ভাওয়াইয়া গানের উর্বর বা চর্চা ভূমি বলা যায়। ধরলা-তিস্তা- ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গানের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লক্ষ্য করা যায়।

  ভাব শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রেম, প্রীতি, প্রণয়, প্রকৃতি, ভক্তি, আবেগ প্রভৃতি। ‘ভাব’ শব্দের সাথে ইয়া প্রত্যয় যুক্ত করে ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গের অতি-গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যার মধ্যে অবিভক্ত উত্তরবঙ্গ, নিম্ন অসমের সমাজ, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য এবং ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলের গাড়িয়াল, দফাদার মৈষালদের কথা যেমন ভাওয়াইয়া গানে জড়িয়ে আছে তেমনি তিস্তা, ধরলা, যমুনার উথাল-পাথাল নদীর ঢেউয়ের কথাও আছে। ভাওয়াইয়া গান মূলত নারী, নদী ও প্রকৃতি নির্ভর। এই গানে উত্তর জনপদের গ্রামীণ নর-নারীর জীবন- জীবিকা, আশা আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ খেটে খাওয়া সাধারণ বা শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের জনজীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ, ভাষার সাথে এ গানের ভাব- ভাষা ও সুরের নিগুঢ় সম্পর্ক আছে।

  সব লোকসঙ্গীতের মতো ভাওয়াইয়াও,  আঞ্চলিক-অবিভক্ত বাংলার উত্তরাঞ্চল, গোয়ালপাড়া, গৌরীপুর, কোকরাঝাড়,বঙ্গাইগাও ইত্যাদি নিয়ে আসামের পশ্চিমাঞ্চল দ্বারা সেই অঞ্চলের সীমারেখা চিহ্নিত করা যায়। এই এলাকার আঞ্চলিক জীবন, অর্থাৎ  কৃষি নির্ভর শ্রমজীবন, অঞ্চলিক ভাষা অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষা- ভাষার শব্দ  সম্ভার,  উচ্চারণ ভঙ্গি ইত্যাদি সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে ভাওয়াইয়া। বলা যায় কামরূপে রাজবংশী শ্রমজীবী মানুষ, মাটি ও প্রকৃতির একাত্ম বাঁধনে সৃষ্টি হয়েছে বিশিষ্ট সুর ও ছন্দ- যা  গড়ে তুলেছে সুর ও গীতরীতির আঞ্চলিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে আরও বিশিষ্টতা দিয়েছে  আঞ্চলিক কণ্ঠভঙ্গি ও আঞ্চলিক উচ্চারণ ভঙ্গি। আবার শ্রম এবং প্রেম এখানে একসাথে মিশে গেছে। লোকসংগীত তাই এখানে প্রেম ও প্রকৃতির অবাধ বিচরণ ও মিলনের ফলশ্রুতি। ভাওয়াইয়া মূলত প্রেম সংগীত হলেও প্রেমের মিলন মধুর দিকের থকেও বিরহের দিকটি প্রধান। তাই ভাওয়াইয়া বিরহের গান। এই গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য দীর্ঘ টানা সুরের ভাঙন – এই লোকসঙ্গীতের এটি আরও একটি বৈশিষ্ট্য তার আঞ্চলিকতা। গানের গায়কিতে যেমন, তার শব্দ প্রয়োগ সেইরূপ আঞ্চলিকতা স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। এই গানের দ্বৈত সংগীতও একক সংগীতের মত পরিবেশিত হয়। ভাওয়াইয়া গানে প্রশ্নোত্তর থাকলেও তা একজনই গায়। রাজবংশী সমাজ ব্যবস্থার ফলেই এই বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়েছে। কারণ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের পুরুষের চেয়ে গান করার অনুমোদন কখন পাওয়া যায় নি, ফলে নারীর বিরহ বা পারস্পরিক প্রেম নিবেদনের গান সবই পুরুষ কণ্ঠে এবং একক কন্ঠে গীত হতে দেখা যায়।

  রাজবংশী লোকগীতি জীবন থেকে উঠে আসা খাঁটি জীবনের জয়গান, আছে বেদনার্ত মানুষের জীবনগাথা। নারীর আকঙ্খায় পুরুষ নাইয়া, মইষাল, গাড়িয়াল ও মাহুত। তাই তো রাজবংশী ভাওয়াইয়া গানে মইষাল, গাড়িয়াল ও মাহুতবন্ধুর কথা শোনা যায়। ভাওয়াইয়া গানের প্রসঙ্গে হাতি, মাহুত, মহিষ, বাথান, মইশাল, গরু, গরুর গাড়ি, গাড়িয়াল, গ্রাম্য বধুর বাবার বাড়ি যাওয়া বা বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি আসা, বন্য পরিবহনের একমাত্র বাহন গরু ও মহিষের গাড়ি বিষয়গুলো প্রাধন্য পায়। বিরহকাতরা নারী হৃদয়ের সমবেদনা প্রকাশে, অশ্রুসিক্ত প্রেমিকার নিখুঁত চিএরূপায়ণে গানগুলো অপূর্ব শিল্প মণ্ডিত হয়ে উঠেছে। বিরহ বিচ্ছেদ তাই লোকসংগীতের মূল সুর এবং ভাওয়াইয়ার ক্ষেত্রে এই অবস্থার বহুল প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ভাওয়াইয়ার সুরধারা আলোচনা প্রসঙ্গে রাজবংশী জীবন ও সংস্কৃতির প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

   উত্তরবঙ্গে তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা নদীর বিস্তীর্ণ চরে মহিষ চড়াতে আসা মইষাল বন্ধুর সঙ্গে কুমারী ও পথিক বধূদের দুদিনের মানসিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মইষাল বন্ধুর প্রেমাস্পদকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা আর নারীর বিরহের করুণ রস প্রকাশ পায় ভাওয়াইয়া গানে। একটি বিশেষ সুরের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের হৃদয়ের সুগভীর অনুভূতিকে প্রকাশ করে থাকে। আব্বাস উদ্দিনের পরিচিত গান “তোর্ষা নদীর উতাল পাতাল রে’- গানটিতে রাজবংশী জনজীবনের উপর উত্তরবঙ্গের পাহাড়, জঙ্গল, নদী, নালা ভরা নিসর্গ প্রকৃতির প্রভাব চোখে ভেসে ওঠে। অন্য একটি গানে ধরা পড়েছে প্রেমের চিত্র-

    ‘‘ প্রেম জানে না রসুক কালাচান

কালা ঝুইরা থাকে মন

       কতই দিনে বন্ধুর সনে হব দরিশন বন্ধু রে।

                   ও বন্ধুরে, নদী ওপারে তোমার বাড়ি যাওয়া আইসা অনেক দেরী

  যাব কি রব সদায় করে মনা

হাঁটিয়া গেইতে নদীর জল

                           খাকলাং কি খুকলুং কি খাল্লাউ করে হায় হায় পরাণের বন্ধু রে।’’১

  নদীর ধারে গড়ে উঠে গরু মহিষ বাথান বা ভইষের বাতান। মৈষালদের হেফাজতে থাকা পশুদের কাজের অবসরে মইষালরা, দোতারা, বাঁশি সারিন্দা বাঁচিয়ে মনের সুখে ও দুঃখে গায় ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া সুরধারায় এভাবে যুক্ত হয়েছে মইষালি ভাওয়াইয়া যা ভাওয়াইয়া আঙ্গিকের একটা বড় জায়গা দখল করে রয়েছে।

 ‘মৈষ চরান মোর মৈশাল বন্ধুরে,

মইশাল কোন বা চরের মাঝে

             এলা ক্যানে ঘন্টীর বাজন না শোনাং মোর কানে মৈশাল রে।’ ২

ইত্যাদি গান উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জীবনের, রাজবংশী সংস্কৃতির বড় পরিচয়ক।

  বাতান সন্নিকটস্থ গ্রাম থেকে নারী পুরুষ নির্বিশেষে গ্রামবাসীরা নদীর ঘাটে স্নান করতে বা জল আনতে গেলে ভেসে আসা মিষ্টি সুরের দোতারা বাদন ও ভাওয়াইয়া গানে মন মজে যুবতীর। জলের ঘাটে আসা-যাওয়ার পথে প্রেমিক যুবা মইষালের বিদায়ে প্রেমিকার তীব্র মনঃকষ্ট গানে প্রকাশ পায়-

‘‘ ঠিক ধিক ধিক মইশাল রে মইশাল ঠিক গাবুরালি এহেন সুন্দর কইন্যা ক্যামনে যাইবেন মইষাল রে।

প্রেমিকা ভাবছি তার মত সুন্দরী কে ছেড়ে মহিশাল চলে যাচ্ছে নিশ্চয়ই অন্য কারো প্রেমে পড়েছে –

তখনেই না মইশাল রে

মইশাল না জান গোয়ালপাড়া

গোয়ালপাড়ার চেংড়ি গুলা জানে ধূলাপড়া মৈশালরে।৩

  গাড়িয়াল, মাহুত, মইষাল এই তিন চরিত্র ভাওয়াইয়া গানের সঙ্গে জড়িত। উত্তরবঙ্গের সামাজিক জীবনযাত্রা, প্রাকৃতিকশোভা, নদ-নদী, ঋতু পর্যায় প্রভৃতি উপাদান ভাওয়াইয়া সংগীতে বিশেষভাবে জায়গা নিয়েছে। বিচ্ছেদ কাতরা বিরহিনী নারীর নায়ক কোথাও বন্ধু, কোথাও গাড়িয়াল ভাই, কোথাও বা মইশাল বন্ধু বা মাহুত বন্ধু। কোন দূর প্রবাস যাত্রী-বন্ধুর উদ্দেশ্যে প্রেম-পাগলিনী নারী গায়-

     কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে,

 কোন্ দিন আসিবেন বন্ধু

 কয়া যাও, কয়্যা যাও রে। ৪

একইভাবে  গাড়িয়াল ভাইয়ের জীবন নিয়েও গান রচিত হয়েছে –

‘বাওকুমটা বাতাস যেমন ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে,

কি ওরে ঐমতন মোর গাড়ির চাকা পন্থে পন্থে ঘোরেরে. 

                                   অকি গাড়িয়াল মুই চলোং রাজপন্থে’  ৫

গাড়িয়ালের এই গানগুলো রাজবংশী সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে।

  গাড়িয়ালের জীবন চলমান। কখনো উজানে কখনো বা ভাটিতে, নানা গা গঞ্জ, হার্ট বন্দর জনপদ ঘুরে আসতে সদা ব্যস্ত। গ্রামের সাধারণ মানুষ গাড়িয়ালকে নিয়ে গ্রাম্য কন্যার প্রেম বিরহ প্রসঙ্গে নানা কাহিনী রচনা করে।প্রিয়মানুষের গরুর গাড়ির চাকার শব্দ নারীমনকে ভালোবাসায় আন্দোলিত করে। নারী মনের উপচে পড়া ভালবাসার নীরাবরণ প্রকাশ ভাওয়াইয়া গানে ফুটে উঠেছে –

‘… ও কি গাড়িয়াল ভাই

 কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে

 যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়

 নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে

 ও কি গাড়িয়াল ভাই

কত কান্দিম মুই নিধুয়া পাথারে রে। ৬

  কর্মব্যস্ত প্রেমিক দুর দেশ থেকে কবে ফিরবে তার প্রতীক্ষার দীর্ঘ ব্যবধান কি করে সইবে হতভাগিনী নারী, প্রিয়তম স্মৃতিচিহ্ন বুকে নিয়ে শান্তি পেতে চায়-

 যদি বন্ধু যাবার চাও

 ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে, 

  বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে-

 মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে

 কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে। ৭

প্রিয়জনের প্রতীক্ষার ব্যাকুল আগ্রহে পথপানে চেয়ে বিরহিনী নারীর করুন আর্তি-

পতিধন মোর দূর দূরদ্যাশে

  মৈলাম পৈল কালা চিকন ক্যাশে রে’ ৮

আবার গরুর গাড়ি করে বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার পথে নারী গায়-

‘ ওকি গাড়িয়াল ভাই

কত কান্দিম মই নিধুয়া পাথারে’ ৯

 বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার পথে আপনজনদের ছেড়ে যাওয়ার ব্যাকুলতায় বঁধুর কন্ঠে উচ্চারিত হয়-

‘ আস্তে বোলাও গাড়ি রে গাড়িয়াল

ধীরে বোলাও গাড়ি

আরেক নজর দ্যাখিয়া নেও মুই

দয়াল বাবার বাড়ি….’ ১০

গানগুলোতে গ্রামীণ বঁধুর বাবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার, আপনজনদের ছেড়ে যাওয়ার যে ব্যথা, যে মায়া, যে ব্যাকুলতা তা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে।

  উত্তরবঙ্গ ছাড়া হাতীর গান বা মাহুতের গান অন্য কোথাও শোনা যায় না। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স অঞ্চলের, ভুটান দুয়ারের জঙ্গলে কাজে লাগানোর জন্য হাতি ধরার কঠিন কাজ করতেন গৌরীপুরের জমিদার ও কোচবিহারের মহারাজা। খেদা ও ফান্দি পদ্ধতিতে হাতি ধরার পর সন্ধ্যেবেলা অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে মাহুতের কয়েকজন মিলে গাইতেন ভাওয়াইয়া গান, অন্যরা গানের সঙ্গে সঙ্গে ধৃত হাতিকে ট্রেনিং দিত-

“ হস্তীর কইন্যা হস্তীর কইন্যা বামোনের নারী

মাথায় নিয়া কামকলসী ও

সখি হস্তে সোনার ঝাড়ি সখি ও

                    ওমোর হায় হস্তির কইন্যারে যেদিন মাউত উজান যায় নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে।’’ ১২

হাতি, মাহুত নিয়ে এরকম গান ভাওয়াইয়া শৈলীর অনন্য সম্পদ হয়ে উঠেছে।

   ভাওয়াইয়া রাজবংশীদের লোকগান। আজ ভাওয়াইয়া গান অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। তবে এখন এই গানের ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছে রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষজন। এখনও এই গানগুলো উত্তর অঞ্চলের মানুষের হাসি- কান্নাকে ধরে রেখেছে। এসব গান শুধু রংপুর বা দিনাজপুর নয়, ভারতের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার অঞ্চলের প্রধান লোকসংগীত হিসেবে এখনও বেঁচে আছে। প্রকৃতির কোলে অনাদরে লালিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষণবিহীন, অক্ষর-জ্ঞান-রহিত-প্রায় ভাওয়াইয়ার অখ্যাত, অনামি শিল্পী ও গীতিকারদের সূক্ষ্ম, শৈল্পিক রসবোধ ও দর্শন, জ্ঞান যে কত উচ্চমানের তা ভাওয়াইয়া গান শুনলে বোঝা যায়। বর্তমানে ভাওয়াইয়া সংগীতের বহু পরিবর্তন ঘটেছে। অল্প সংখ্যক অরণ্য এলাকা, মজা নদী, ভাষার ভাব ও মানসিকতার দ্বন্দ্ব – এসবের সঙ্গে  রাজবংশী সমাজ পুরোপুরি সমান ভাবে মিলিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটেছে। প্রাণবন্ত গীত, মইশাল, মাহুত হারিয়ে গেলেও প্রাণের স্পন্দনটুকু আজও বাংলার মাটির বুকে কান পাতলে শোনা যায়। সম্প্রতি আধুনিকতা এবং বিশ্বায়নের ফলে কোচবিহারের রাজবংশী সম্প্রদায়ের নিজস্ব এবং মৌলিক সংস্কৃতি তার সক্রিয়তা হারিয়ে পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বলা যায় ভাওয়াইয়ার সাহিত্যে সুক্ষ্ম ললিত কলা, শব্দবন্ধন, দর্শন, অলংকার ও রসমাধুর্য, ভাব ও ব্যঞ্জনার সুচারু ও পরিবেশনা- বাংলা, ভারত তথা বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বিশেষ মর্যাদার দাবিদার।

তথ্যসূত্র

১। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-৮২।

২। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-৮৩।

৩। বাংলার লোকসংস্কৃতি- পৃঃ-৩৮।

৪। লোকগীতি – পৃঃ-৬৮।

৫। বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-৮৮।

৬। বাংলার লোকসংস্কৃতি- পৃঃ-৩৮।

৭। বাংলার লোকসংস্কৃতি- পৃঃ-৩৮।

৮। লোকগীতি- পৃঃ-৭২।

৯। বাংলার লোকসংস্কৃতি- পৃঃ-৩৮।

১০।বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য-পৃঃ-৮৬।

১১। বাংলার লোকসংস্কৃতি- পৃঃ- ৩৬।

গ্রন্থপঞ্জি

১। আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলার লোক-সংস্কৃতি।

৩। দিনেন্দ্র চৌধুরী – পূর্ব বাংলার লোকসংগীত।

৪। মণি বর্ধন – বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য।

৫। বুদ্ধদেব রায় – লোকগীতি।

৬। আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলার লোকসাহিত্য, ১ম খণ্ড।

৭। মানস মজুমদার – লোকঐতিহ্যের দর্পণে।