Charulata: from the Language of Literature to the Language of Film
Dr. Pratiti Pramanik Dey
Abstract: “Charulata,” directed by the legendary Satyajit Ray in 1964, stands as a cinematic rendition of Rabindranath Tagore’s 1901 story ‘Nashtaneed.’ The film, produced by RD Bansal, features remarkable performances by Soumitra Chatterjee, Madhabi Mukherjee, Shailen Mukherjee, Shyamal Ghoshal, Geetali Roy, and others, with Satyajit Ray himself handling the music direction. Released on 17th April 1964, the film unfolds the poignant tale of Charulata, brilliantly portrayed by Madhabi Mukherjee, alongside Soumitra Chatterjee as Amal and Shailen Mukhopadhyay as Bhupati. The adaptation from literature to film inevitably brings forth modifications, as seen in Ray’s interpretation of Charu’s loneliness. Rabindranath’s detailed literary descriptions find condensed yet visually potent expression in the film. Charu’s coping mechanisms, such as observing the street through an opera-glass and swinging, differ from the original story but effectively convey her solitude. The film masterfully explores Charu’s emotions, a task that Rabindranath handled through language, using inventive visual scenes and storytelling techniques. Central to the film’s narrative is the role of music, skillfully employed to convey Charulata’s inner turmoil. Satyajit Ray uses the melody of ‘Momo Chitte Niti Nritye’ as instrumental music, skillfully avoiding lyrics due to limited dialogue space. The music’s tempo and mood parallel Charu’s emotional journey, intensifying during moments of joy and slowing down during moments of melancholy. The film’s musical arrangement preserves the essence of Rabindra Sangeet while infusing a fresh perspective, showcasing Ray’s mastery in creating a harmonious blend of traditional and contemporary elements. ‘Charulata’ remains a captivating cinematic exploration of Tagore’s timeless narrative, bridging the gap between literature and film with artistic finesse.
Key words- wastefulness, charm, literary medium, visual medium, solitude, ambient music.
চারুলতা – সাহিত্যের ভাষা থেকে চলচ্চিত্রের ভাষা
কাহিনী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১), পরিচালনা – সত্যজিৎ রায়
প্রযোজনা – আর ডি বনশল
অভিনয় – সৌমিত্র চ্যাটার্জী , মাধবী মুখাজ্জী, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল ঘোষাল, গীতালি রায় প্রমুখ ।
সঙ্গীত পরিচালনা – সত্যজিৎ রায়
মুক্তি – ১৭ই এপ্রিল, ১৯৬৪ (শ্রী, প্রাচী, ইন্দিরা)
সংক্ষিপ্তসার– রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রটি তৈরি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ গল্পটি রচনা করেন ১৯০১ সালে, সত্যজিৎ গল্পটির চিত্ররূপ দেন ১৯৬৪ সালে। পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘নষ্টনীড়’ নামে তখন একটি ছবি নির্মিত হয়েছিল। তাই বিশ্বভারতীতে আবেদন করে ছবির জন্য সত্যজিৎ চারুলতা নামটির অনুমোদন চান এবং পেয়েও যান। এক অসাধারণ চিত্ররূপ। নাম ভূমিকায় মাধবী মুখাজ্জী, অমলের চরিত্রে সৌমিত্র চ্যাটার্জী , ভূপতির চরিত্রে শৈলেন মুখোপাধ্যায় নিজেদের অসামান্য শিল্পীসত্তার পরিচয় দিয়েছেন।
মহৎ সাহিত্য যখন চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়তখন কিছু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। মূল উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ বাইশ পাতা জুড়ে চারুর নিঃসঙ্গতা বর্ণনা করেছেন, আর ভাষার মাধ্যমে রচিত সাহিত্যে এ ধরণের বর্ণনার বেশ খানিকটা অবকাশ থাকে। কিন্তু দৃশ্যমাধ্যমে তা দুর্বলতার লক্ষণ। সেখানে একটি বা দুটি অমোঘ দৃশ্যে ভাবকে ব্যক্ত করতে হয়। তাই সত্যজিৎ চারুর এই নিঃসঙ্গতা ব্যক্ত করার দৃশ্যটির ক্ষেত্রে সময় নিয়েছেন ৫-৬ মিনিট। নিজের নিঃসঙ্গতা কাটাতে চারু সর্বদা নিজেকে ব্যস্ত রাখে। সে অপেরা গ্লাসের মধ্যে দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখার চেষ্টা করে, এই দৃশ্যটির অনুরূপ বর্ণনা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নেই। মাধ্যমগত ভিন্নতার কারণে চলচ্চিত্রে উদ্ভাবিত দৃশ্যাবলী সাহিত্যের সাথে একরকম নাও হতে পারে। অমলের প্রতি চারুলতার অনুরাগের এবং সেই অনুভূতির মধ্যে দিয়ে চারুর নিজেকে অনুভব করা – এই বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুপম ভাষায় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু চলচ্চিত্রকার এই বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন চারুর দোলনায় দোলার দৃশ্যের মাধ্যমে। মূল গল্পে কোন দোলনার উল্লেখ ছিল না। এছাড়াও চারু তার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য গুনগুন করে গান গাইত, একা একা ঘুরে বেড়াত, এম্ব্রয়ডারির কাজ করত। এগুলি উভয় শিল্পে প্রকাশ পেয়েছে।
‘চারুলতা’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রের একাকীত্বকে সোচ্চার করে তুলতে সঙ্গীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানের সুরের আদলকে যন্ত্রসঙ্গীতে প্রয়োগ করে চারুর মানসিকতাকে এঁকেছেন সত্যজিৎ। সংলাপের অবকাশ কম বলে গানের বাণীও পরিহার করা হয়েছে। অমলের আবির্ভাবের পর ছবিটি হয়ে উঠেছে সঙ্গীতে পরিপূর্ণ। ছবিতে এই গানের সুরটিও দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম সুরটি যখন ব্যবহৃত হয় তখন চারু আনন্দে উদ্বেলিত। তাই চঞ্চল ছন্দে গানের আবহটি বেজেছে। পরে যখন সুরটি ফিরে আসে, তখন গভীর বিষদাচ্ছন্ন চারুর মানসজগতে – তার সঙ্গে মিল রেখে সুরটি বাজে ধীর লয়ে। গানটির সুরের বিন্যাস অভ্যস্ত লয়ের ধাঁচ ভেঙ্গে অর্কেস্ট্রায় রূপান্তরিত হয়ে শ্রোতার কাছে আনন্দদায়ক মুহূর্ত উপহার দেয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের চলনটি রক্ষা করে অথচ তার লয়ের মাধুর্যে তিনি এক নতুন সৃজনের আবহ সৃষ্টি করেছেন।
সূচক শব্দ- নষ্টনীড়, চারুলতা, সাহিত্যমাধ্যম, দৃশ্যমাধ্যম, নিঃসঙ্গতা, আবহসঙ্গীত।
রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রটি তৈরি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ গল্পটি রচনা করেন ১৯০১ সালে, সত্যজিৎ গল্পটির চিত্ররূপ দেন ১৯৬৪ সালে। পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘নষ্টনীড়’ নামে তখন একটি ছবি নির্মিত হয়েছিল। তাই বিশ্বভারতীতে আবেদন করে ছবির জন্য সত্যজিৎ চারুলতা নামটির অনুমোদন চান এবং পেয়েও যান। এক অসাধারণ চিত্ররূপ। নাম ভূমিকায় মাধবী মুখাজ্জী, অমলের চরিত্রে সৌমিত্র চ্যাটাজ্জী, ভূপতির চরিত্রে শৈলেন মুখোপাধ্যায় নিজেদের অসামান্য শিল্পীসত্তার পরিচয় দিয়েছেন।
‘নষ্টনীড়’ ও ‘চারুলতা’ – দুইক্ষেত্রেই চরিত্র সংখ্যা পাঁচ, চারু, ভূপতি, অমল, মন্দা ও উমাপদ। সত্যজিৎ এই চলচ্চিত্র তৈরির ক্ষেত্রে ‘ক্লাসিক্যাল স্টাইলের’ কথাই ভেবেছেন। মূল কাহিনীতে যে ত্রিকৌণিক জটিলতার কথা রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন, সত্যজিৎ তাকেই রূপান্তরিত করেছেন প্রধান পরিকাঠামো অক্ষুন্ন রেখেই। অমলের চরিত্রের গভীরতা তিনি কমিয়েছেন, কিন্তু চারুর নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণাটুকু যেভাবে সত্যজিৎ হাইলাইট করেছেন তাতে তারও সুগভীর অন্তদ্বন্দ্বটা অনেক বেশি দর্শকের দৃস্টিগোচর হয়েছে। মূল কাহিনীতে বর্ণিত অনেক ঘটনা আবার সিনেমায় বাদ পড়েছে। যেমন ক্রুদ্ধ ভূপতির আকস্মিকভাবে নিজের লেখার খাতাগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া, প্রি-পেড টেলিগ্রামের জবাব হাতে পেয়ে চারু-অমলের সম্পর্ক সম্বন্ধে ভূপতির অবগত হওয়া, সাহিত্যিক মাধ্যমে এগুলি অত্যন্ত সহজভাবে প্রকাশ করা গেলেও চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এগুলি হয়ত এগুলি অতিনাটকীয়তা হিসাবেই প্রকাশ পেত। লেখকের ভাবনার সেই মৃদু অথচ গভীর আবেদন সিনেমার মূল উপজীব্যের মধ্যেও যথাযথ বজায় রয়েছে। সত্যজিৎ তা বজায় রেখেছেন রবীন্দ্রনাথের ভাবনা্র পাঠবৃত্তকে নিটোল রাখার প্রয়োজনেই। এ বিষয়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছেন –
“ পালটে দিয়ে মজা পাওয়া যাবে বলে কেউ মূল রচনার পরিবর্তন ঘটান না। সাধারণত যেকোনো পরিবর্তনের আরও গভীর কোন কারণ থাকে। আমি তো এমন একটাও উদাহরণ মনে করতে পারি না যেখানে কোন ক্লাসিক সার্থকভাবে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে, অথচ তার আদিরূপ থেকে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত থেকেছে। কারণ কোন লেখকই চলচ্চিত্র মিডিয়ামের চরিত্রের কথা ভেবে লিখতে বসেন না। আমার তো মনে হয় কিছু কিছু পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে । আমাকেও কিছু কিছু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন করতে হয়েছে।’’ ১
রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়ে’র কয়েকটি জায়গা সত্যজিৎ রায়কে ভীষণভাবে ইমপ্রেস করেছিল। তারমধ্যে অন্যতম চারুর নিঃসঙ্গতা। বিশাল অট্টালিকায় সে একা একা থাকে, স্বামী সর্বদাই নিজের কাজে সময় কাটায়।। তার নিঃসঙ্গতা, স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং মাঝখানে হঠাত করেই ঝোড়ো হাওয়ার মতো অমলের প্রবেশ – এই তিনটি ঘটনার গভীরতা একটি বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে।মহৎ সাহিত্য যখন চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়তখন কিছু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। মূল উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ বাইশ পাতা জুড়ে চারুর নিঃসঙ্গতা বর্ণনা করেছেন, আর ভাষার মাধ্যমে রচিত সাহিত্যে এ ধরণের বর্ণনার বেশ খানিকটা অবকাশ থাকে। কিন্তু দৃশ্যমাধ্যমে তা দুর্বলতার লক্ষণ। সেখানে একটি বা দুটি অমোঘ দৃশ্যে ভাবকে ব্যক্ত করতে হয়। তাই সত্যজিৎ চারুর এই নিঃসঙ্গতা ব্যক্ত করার দৃশ্যটির ক্ষেত্রে সময় নিয়েছেন ৫-৬ মিনিট। নিজের নিঃসঙ্গতা কাটাতে চারু সর্বদা নিজেকে ব্যস্ত রাখে। সে অপেরা গ্লাসের মধ্যে দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখার চেষ্টা করে, এই দৃশ্যটির অনুরূপ বর্ণনা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে নেই। মাধ্যমগত ভিন্নতার কারণে চলচ্চিত্রে উদ্ভাবিত দৃশ্যাবলী সাহিত্যের সাথে একরকম নাও হতে পারে। অমলের প্রতি চারুলতার অনুরাগের এবং সেই অনুভূতির মধ্যে দিয়ে চারুর নিজেকে অনুভব করা – এই বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুপম ভাষায় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু চলচ্চিত্রকার এই বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন চারুর দোলনায় দোলার দৃশ্যের মাধ্যমে। মূল গল্পে কোন দোলনার উল্লেখ ছিল না। এছাড়াও চারু তার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য গুনগুন করে গান গাইত, একা একা ঘুরে বেড়াত, এম্ব্রয়ডারির কাজ করত। এগুলি উভয় শিল্পে প্রকাশ পেয়েছে।
সত্যজিতের চলচ্চিত্রে আবহসঙ্গীত রচিত হয়েছে মূল সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। একটি বা দুটি মূল সুর ভিন্ন তাল, লয়, মাত্রা সহযোগে যন্ত্রানুসঙ্গ বদলে সারা ছবিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দৃশ্যের মুড অনুযায়ী এমনভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে যাতে এই ছন্দ পার্থক্য বোঝা না যায়। আবার কখনো বা একই কম্পজিশান সচেতনভাবে বারবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যখন ওই সঙ্গীত আসে দর্শক যেন কিছুর ইঙ্গিত পান। একটি বিশেষ অনুভূতি তাঁর অবচেতন মনকে ছুঁয়ে যায়। চারুলতার সঙ্গীত সম্পর্কে পরিচালক মন্তব্য করেছেন –
“আজ অবধি যে কটা ছবিতে আমি নিজে সঙ্গীত রচনার দায়িত্ব নিয়েছি তার মধ্যে চারুলতার সঙ্গীত আমার কাছে অপেক্ষাকৃত সাবলীল ও সুপ্রযুক্ত বল্রে মনে হয়েছে। এর একটা কারণ অবিশ্যি অভিজ্ঞতা। আবহসঙ্গীতের কাজে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক। ছবির মেজাজ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকলেও কোন দৃশ্যে বা কোন কোন যন্ত্রে কোন সুর কোন লয়ে বা কোন তালে বাজালে সেই মেজাজের সঙ্গে মিলবে এ জ্ঞান সহজলভ্য নয়। তাই সঙ্গীতের কাজে এখনও অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায়।’’ ২
‘চারুলতা’ ছবিতে একটি গান আমরা অমল ও চারু দু’জনের কন্ঠেই শুনতে পাই – ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কি বা মৃদু বায়’। ১৮৮২ সালে গানটি রচিত। ওই সালে রবীন্দ্রনাথ ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্যের দ্বিতীয় দৃশ্যে বনদেবীদের সমবেত কন্ঠে গাইবার প্রয়োজনে গানটি রচনা করেন। ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রের সংলাপ থেকে জানা যায় অমল এতদিন হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত, এখন পরীক্ষা শেষ তাই পিসতুতো দাদার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তার জন্য একটি ভালো ঘর বরাদ্দ হয়েছে। অমল তখন ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কি বা মৃদু বায়’ গানটি গায়। বোঝায় সে গান গাইতে পারে (নেপথ্যে অমলের কন্ঠে গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার)। পরে চারু বলেছিল ‘এত ভাল গলা তোমার’। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার প্রয়োজনে কিশোর কুমারকে নির্বাচন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের। সিনেমায় প্রথম এই গানটি গায় অমল। কিন্তু সম্পূর্ণ গানটি গায় না, চারুর সাথে কথার ফাঁকে ফাঁকে অমল গুনগুণ করে গানটি গায়। তার মুখে খুশীর ভাব থাকলেও কথোপকথন থেকে জানা যায়, তার দাদার বাড়িতে এত ভালো ব্যবস্থাপনায় সুখ সইবে কি না সে শঙ্কায় সে শঙ্কিত। আরও কিছুক্ষণ পরে চারুকেও এই গানটি গাইতে শোনা যায়, সেখানেও উপস্থিত চারু ও অমল। চারু দোলনায় দুলছে আর অমল মাদুরে শুয়ে ভাবছে, সে অন্যমনস্ক। দোলনায় দুলতে দুলতে চারু এই গানটি করে। এখানে মাধবী মুখাজ্জী স্বকন্ঠে গানটি গেয়েছেন, একই গান দু’রকমভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। অনেকটা পাশ্চাত্যসঙ্গীতের ভঙ্গীতে। আর একই সুর দু’ভাবে উপস্থাপনার কারণে দুটি ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে দর্শকদের কাছে। অমল যখন গানটি গাইছিল তখন তার পরিবেশ ছিল অনেক উজ্জ্বল, কিন্তু তারমধ্যেও একটা শঙ্কা চাপা ছিল। চারু যখন গানটি গায় তখন দু’জনেই ঘর থেকে বাগানে এসেছে, অমল আনমনে। চারু অনেক ভাবনা থেকেই সেই গানটি গেয়ে ওঠে এবং চারুর মুখে সম্পূর্ণভাবে গানটি শোনা যায়। চরিত্রের শঙ্কা এখানে চাপা নয়, বরং অনেকটাই প্রকাশিত। যদিও চারু এখানে ‘হায় হায়’ শব্দের পরিবর্তে গেয়েছে ‘হুম-ম হু’। গঠনের দিক থেকে ‘চারুলতা’ ছবির দুটো গুণ সবচেয়ে বেশি মন কেড়ে নেয় – প্রাণোচ্ছলতা ও বিষাদ। মাঝে মাঝে দু-চার কলি গানের ব্যবহার – সেই গান কখনও গুনগুনিয়ে কখনও খোলা গলায় আবার কখনও বা চারুর দোলনায় দীর্ঘায়িত দোলার সাথে। এ কারণেই এই ছবিটি অন্য ছবিগুলির থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র্য।
এই ছবিতে ব্যবহৃত আর একটি গান ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’ও দুবার শোনা যায় এবং প্রথম গানটির সম্পূর্ণ বিপরীত ভঙ্গীতে। এই গানটি রচিত হয়েছে ৪ই অক্টোবর, ১৮৯৫(২৫শে আশবিন,১৩০২), গানটি শিলাইদহে রচিত। এই গানটিও প্রথমে অমল গায়, প্রথমে পিয়ানো বাজিয়ে শুরু করে পরে সে ঘুরে ঘুরে সম্পূর্ণ গানটিই গেয়ে ফেলে। গানের নৃত্যময় সুরের প্রয়োগে আলাদা এক অভিনয়ের মাত্রা যোগ করেছেন পরিচালক ছন্দের দোলায় অমলকে দুলিয়ে। অর্থাৎ গানটি কেবল গাওয়া নয়, মজা করে দুলে দুলে পারফর্ম করা – যা চারু-অমলের বোঝাপড়ার উন্মেষ পর্ব। সংশয়, অভিমান ও অব্যক্ত প্রেম তখনও তাদের ওপর কোন প্রভাব ফেলেনি। তাই এ গানটি স্বতঃস্ফূর্ত সাবলীল। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে স্বরলিপি করা এই গানের তিনটি মুদ্রিত রূপ পাওয়া যায়। একটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের, একটি দীনেন্দ্রনাথের আর একটি সরলা দেবীর করা। তবে লক্ষ্যণীয় যে, কোন স্বরলিপিরই হুবহু মিল নেই। অথচ প্রত্যেকটির মাধ্যমেই মূল গানটিকে চেনা যায়। সত্যজিৎ রায় তিনটি স্বরলিপি পিয়ানোয় বাজানোর পর অবশেষে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের করা স্বরলিপি অনুযায়ী গানটি তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেন। তাই এই গানটির প্রয়োগ সংলাপ – অভিব্যক্তির তুলনায় দৃশ্যটিকে অনেক বেশি ফলপ্রসূ করে তুলেছে। অমল গানটি গাইবার ঈষৎ পরেই চারু গুনগুন করে গানটি গায়। অমলের পুরনো চটি পালটে নিজে হাতে তৈরি করা পশমের চটি উপহার দেওয়ার জন্য অন্য ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই এই গানটি গুনগুন করে চারু।
অমল যখন গানটি গাইছে তার শেষ লাইনে অমল গাইছে – ‘ আমি চিনি গো চিনি তোমারে – ও বউঠাকুরাণী’। অর্থাৎ বিদেশিনীর পরিবর্তে বউঠাকুরাণী শব্দটির প্রয়োগ করে অমল। ফলে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না অমলের মনে বউঠাকুরাণী চারুই রূপান্তরিত হয়েছে বিদেশিনীতে। আমরা তার প্রমাণ পাই অমলের চোখ দিয়ে, গানের ছন্দে নাচতে নাচতে লজ্জিতা, কম্পিতা চারুর দিকে ধীরে ধীরে যখন অমল এগিয়ে আসে, অমলের গানের কথা তখন –
‘ আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ
ওগো বিদেশিনী
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন বেশে
আমি অতিথি তোমারই দ্বারে
ওগো বিদেশিনী ।’
ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান সম্পূর্ণভাবে দর্শকদের ইনভল্ভমেন্ট বাড়িয়ে দেয়, এই গানটি সত্যজিৎ রায় এই সময়ে প্রয়োগ করেছেন কারণ অমলের মনে চারুর একটি বিশেষ মূর্তি তৈরি হয়েছে। এই গানটির মর্মার্থ রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন ‘জীবনস্মৃতি’র ‘গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ’ নামক প্রবন্ধে ১১৫ পাতায় –
“আমি বাল্যকালে একটা গান শুনিয়াছিলাম। ‘তোমায় বিদেশিনী কে সাজায়ে দিলে’ – সেই গানের একটিমাত্র পদ মনে এমন একটি অপরূপ চিত্র আঁকিয়া দিয়েছিল যে আজও ওই লাইনটা মনের মধ্যে গুঞ্জন করিয়া বেড়ায়। একদিন ওই গানের ওই পদটির মোহে আমিও একটি গান লিখিতে বসিয়াছিলাম ……… ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’। সুরের মন্ত্রগুণে বিদেশিনীর এক অপূর্ব মূর্তি মনে জাগিয়া উঠিল। আমার মন বলিতে লাগিল আমাদের এই জগতের মধ্যে একটি কোন বিদেশিনী আনাগোনা করে, কোন রহস্যসিন্ধুর পরপারে ঘাটের উপর তাহার বাড়ি। তাহাকেই শারদপ্রাতে, মাধবীরাতে ক্ষণে ক্ষণে দেখিতে পাই, হৃদয়ের মাঝখানেও ক্ষণে ক্ষণে আভাস পাওয়া গেছে ………… সেই বিশ্বব্রম্ভান্ডের বিশ্বমোহিনী বিদেশিনীর দ্বারে আমার গানের সুর আমাকে আনিয়া উপস্থিত করিল এবং আমি কহিলাম –
“ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন বেশে
আমি অতিথি তোমারই দ্বারে
ওগো বিদেশিনী ।’’
চলচ্চিত্রে এই বিশেষ পর্বে অমলের মুখে এই গান আমাদের কাছে অমলের হৃদয়ের অনেক কথার ব্যঞ্জনা এনে দেয় যা সুস্পষ্টভাবে বলার দুঃসাহস অমলের ছিল না।
‘চারুলতা’ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রের একাকীত্বকে সোচ্চার করে তুলতে সঙ্গীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানের সুরের আদলকে যন্ত্রসঙ্গীতে প্রয়োগ করে চারুর মানসিকতাকে এঁকেছেন সত্যজিৎ। সংলাপের অবকাশ কম বলে গানের বাণীও পরিহার করা হয়েছে। অমলের আবির্ভাবের পর ছবিটি হয়ে উঠেছে সঙ্গীতে পরিপূর্ণ। ছবিতে এই গানের সুরটিও দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম সুরটি যখন ব্যবহৃত হয় তখন চারু আনন্দে উদ্বেলিত। তাই চঞ্চল ছন্দে গানের আবহটি বেজেছে। পরে যখন সুরটি ফিরে আসে, তখন গভীর বিষদাচ্ছন্ন চারুর মানসজগতে – তার সঙ্গে মিল রেখে সুরটি বাজে ধীর লয়ে। গানটির সুরের বিন্যাস অভ্যস্ত লয়ের ধাঁচ ভেঙ্গে অর্কেস্ট্রায় রূপান্তরিত হয়ে শ্রোতার কাছে আনন্দদায়ক মুহূর্ত উপহার দেয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের চলনটি রক্ষা করে অথচ তার লয়ের মাধুর্যে তিনি এক নতুন সৃজনের আবহ সৃষ্টি করেছেন।
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাই সমগ্র চলচ্চিত্রের গঠনটি চারটি পর্যায়ক্রমে বিভক্ত –
১) একাকী চারু
২) অমলের আবির্ভাবে উজ্জীবিত চারু
৩) অমলের সঙ্গে চারুর যুগলবন্দী
৪) পুনরায় নিসঙ্গতার বৃত্তেই নির্বাসিত চারু।
চারুলতার মানসিক পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখেই ছবিতে কন্ঠসঙ্গীত ও আবহসঙ্গীত প্রয়োগ করা হয়েছে। চারুলতার প্রতিটি চিন্তা চেতনা সুস্পষ্ট। মাধবী মুখাজ্জীর মধ্যে সত্যজিৎ রায় ভারতীয় নারীর এক বিশেষ রূপ খুঁজে পেয়েছেন, তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারিণী সংবেদনশীলা বাহ্যিক রূপের দিক থেকে কমনীয় ও স্নিগ্ধ এই রমণী নিরালায় থেকেও সংসারের স্পন্দন হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম।
ডঃ প্রতীতি প্রামাণিক দে
গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ
সঙ্গীত বিভাগ
চলমান – ৯৪৩৩৩০৮১২০
তথ্যসূত্র
১) ১৯৭৬ সালে সত্যজিতের চলচ্চিত্র জীবনের প্রথম ২৫ বছর উপলক্ষ্যে দেয় এক সাক্ষাৎকার, দূরদর্শন কেন্দ্রে। ইংরেজি থেকে অনুদিত, এপিক থিয়েটারে পত্রিকায় আগস্ট ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত, পৃষ্ঠা – ১২১
২)এপিক থিয়েটারে পত্রিকায় আগস্ট ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত, পৃষ্ঠা – ৬৭
—————–