পোক্ত খেলোয়াড়

   প্রত্যয়ী মল্লিক

পাইনি তো সে বিচার এখনো

পঞ্চাশ দিন তো প্রায় সম্পূর্ণ,

সবার ঘরে হাজার টাকা দিয়ে 

করছো চুরির ফন্দি ? 

লজ্জা হয়নি তোমার এখনো পার করে নিজের গণ্ডি? 

তুমি আবার নাকি রাজ্য শাসক 

মূর্খদের মন্ত্রী! 

তোমার জন্য বাড়ছে ধর্ষক,

মজুরি না পেয়ে মরছে কৃষক,

দশ লক্ষ ? মানুষ তুমি ?

আড়াল করো নির্যাতক ?

চাইছো তুমি বিচার আবার! 

 পোক্ত খেলোয়াড়

 

কখন যেন

শংকর কুশারী

সবার চোখের অলক্ষ্যে, সবার অজান্তে, 

কখন যেন মরে গেলো মেয়েটা 

মেয়েটা অমলকান্তি হতে চেয়েছিলো,

অমলকান্তির মতো রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো । 

মেঘেদের সাথে লড়াই করে 

রোদ্দুর ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো 

এই বন্ধ্যা জমির বুকে । 

রোদ্দুরে ভরিয়ে দিতে চেয়েছিলো 

আকাশের সুনীল ক্যানভাস ।

বাঁচতে চেয়েছিলো, বাঁচাতে চেয়েছিলো 

এই সবুজ পৃথিবীটাকে । 

লড়াই করতে করতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত শরীরটা 

দুমড়ে মুচড়ে গেছিলো অসহ্য যন্ত্রণায়। 

প্রাণপণ লড়াইয়ের শেষে 

তার নিস্পন্দ শরীরটা পড়ে রইলো অনাদরে 

তার বড়ো সাধের সাধনাস্থলের এক কোনে । 

মরে গেলো মেয়েটা ।

সুদূর নীহারিকা মন্ডলের গোপন কুলুঙ্গিতে

থেকে গেলো শুধু শেষ কটা কথা …

“রাতের খাওয়াটা এবারে খেয়ে নাও মা, 

আর দেরি কোরো না .. বাপিকে বোলো 

সুগারের ওষুধটা যেন ভুলে না যায়” …

মেয়েটা,

আমাদের মেয়েটা শেষমেশ মরেই গেলো ।

এবং 

তার চিতাভস্ম থেকে জন্ম নিলো 

এক অবশ্যম্ভাবী অনাবিল অনন্ত দ্রোহকাল ।

নাই কেন আত্মগ্লানি?

প্রত্যয়ী মল্লিক

ভেবেছিলাম, 

 ঘরের মেয়ে করে আনবো তোমায়, 

কিন্তু তাদের যে আজ ভারি বিপদ!

জানতো না সেই ছোট্ট মেয়েটি, 

আত্মরক্ষাই একমাত্র সম্পদ।

লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, প্রভৃতির 

ঊর্ধ্বে তো মা ওরা! 

অবোধ শিশু থেকে সবোধ বৃদ্ধা 

সবাই যে ওদের ক্রীড়া!

ধর্ষণ আজ সেজেছে মাগো 

আত্মহত্যার ছলে! 

তাই কালের ঘরের কালী হয়ে 

এসো তুমি যুগের বদলে।

ধর্ষকদের লোকাবে বলে 

মত্ত হয়েছে মহারানী!

তিলোত্তমার বিচারহীনতায় 

নাই কেন তার আত্মগ্লানি?

 

Bengali Song: A Reflection of Bengali Culture and Spirituality

 Tamal Das, Research Scholar, Vocal Music, Rabindra Bharati University

Banglagan embodies the essence of Bengali culture, with its melodies intricately woven into the fabric of the Bengali language for over a thousand years. Over this extensive period, the music has evolved, diversifying in melody, mood, and lyrical depth. This evolution reflects the emotional and cultural expressions of a vast region’s people, enriching the legacy of Bengali music. Among the many genres of Bengali music, Padavali songs hold a unique place. Based on their characteristics, Padavali songs are categorized into two main types:

  1. Vaishnava Padavali: Emerging in the early Middle Ages, these songs are centered around devotion to Lord Krishna and reflect the profound spiritual ethos of the Vaishnava tradition.
  2. Shakta Padavali: Developed later, during the late medieval period, these compositions are dedicated to the worship of Mother Shakti, embodying the deep reverence and devotion towards the divine feminine.

Both genres are deeply devotional, but the Shakta Gita, being the younger form, has distinct features. Shakta Padavali songs are devoted to the praise of Mother Shakti and resonate with themes of love, devotion, and surrender. Their spiritual and emotional depth has earned them an eternal place in Bengali culture. The promotion and propagation of Shakta Padavali began with the saint-poet Sri Ramprasad Sen, whose compositions are revered for their simplicity and profound spiritual messages. Another notable contributor was Kamalakanta Bhattacharya, who enriched the genre with his poignant songs. These early compositions set the foundation for a flourishing tradition, inspiring musicians from various parts of Bengal, including Kabials (poet-singers), Panchalikars (folk playwrights), and Jatrapalaks (theater performers), to contribute to this body of work. By the late 18th century, the collective repertoire of Shakta songs came to be recognized under the umbrella of Shakta Padavali. These compositions, filled with melodic and lyrical richness, represent a rare and unparalleled expression of maternal devotion in Indian music. Shakta Padavali stands as a remarkable example of India’s matri-centric musical heritage, celebrating the universal reverence for Mother Shakti.

বাংলার শক্তি সাধনা ও বাঙালির শাক্তগীতি

বাংলাগান বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়কে বহন করে। সুদীর্ঘ এক হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার সাথে সুর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই এক হাজার বছর ধরে একটি সুদীর্ঘ অঞ্চলের মানুষের মনের ভাব সুরের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার দরুন বাংলাগান সুর-ভাব-কথার বিচিত্রতায় বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে। এতে বাংলা গানের সম্ভার ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়েছে। বাংলাগানের বিভিন্ন ধারার মধ্যে ‘পদাবলী গান’ একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংগীত। এই পদাবলী গানের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথমটি হলো ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ যা বাংলাভাষার মধ্যযুগের সূচনায় রচিত হতে শুরু করে। আর দ্বিতীয়টি হল ‘শাক্ত পদাবলী’, যা মধ্যযুগের অন্তিম পর্যায়ে রচিত হতে শুরু করে। ‘পদাবলী’ সংগীতের দুটি ধারাই ভক্তিভাবে আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। এদের মধ্যে শাক্তগীতিগুলি রচনার দিক থেকে বৈষ্ণব পদাবলীর তুলনায় নবীন। প্রধানত মাতৃশক্তির বন্দনার উদ্দেশ্যে শাক্তপদগুলি রচিত হয়। শাক্তপদগুলি ভাবে-ভক্তিতে, স্নেহে-বাৎসল্যে এমনভাবে পরিপূর্ণ হয়েছে যে বাংলার আপামর জনমানসে এগুলি চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। শাক্তপদাবলীর প্রচার ও প্রসার শুরু হতে থাকে সাধক কবি শ্রী রামপ্রসাদ সেনের হাত ধরে। এরপর আরেকজন সাধক তথা কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যও এই ধারার অনেক গান রচনা করেন। সাধনালব্ধ বাণীর গভীরতা ও কথার সারল্য ছিল এই গানগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এদের পরবর্তী পর্যায়ে গানগুলি এত জনপ্রিয় হয় যে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন সংগীতকার এমন ধরনের গান লিখতে শুরু করেন। এদের মধ্যে কবিয়াল, পাঁচালীকার, যাত্রাপালাকার সবাই এই ধরনের গান রচনা করেছেন। ফলস্বরূপ শাক্তগীতিগুলির পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনই সুরের বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সমগ্র শাক্তগীতিগুলিকে একত্রিত করে শাক্তপদাবলী নামকরণ করা হয়। শাক্ত পদাবলীর মত বৈচিত্র্যপূর্ণ মাতৃবন্দনামূলক গান সমগ্র ভারতের মাতৃসংগীত জগতে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

বিষয় সূচক শব্দ:

বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী, মাতৃসংগীত, কবিয়াল, পাঁচালীকার, চর্যাপদ, সান্ধভাষা, গীত গোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, যজুর্বেদ, মার্কেন্ডেয় চন্ডী, চামুন্ডা তন্ত্র, মহানির্বাণ তন্ত্র, যোগ দর্শন, কৈবল্য, সুষুম্না নাড়ী, উমাসংগীত, শ্যামাসংগীত।

বাংলার শক্তি সাধনা ও বাঙালির শাক্তগীতি

বাংলা ভাষা ও বাংলার গান :

বাংলার সংস্কৃতির একটি বড় অংশ হলো সংগীত। বাংলার গান বাংলার মানুষজনের মনের ভাবকে ব্যক্ত করে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে স্থিত একদা অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন ধারার সংস্কার তথা বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি বাঙালির গানকেও বৈচিত্রে পরিপূর্ণ করেছে। ফলস্বরূপ বাংলাগানের সম্ভার সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয়েছে। তাই বাংলা অঞ্চলের মতো গানের এত বৈচিত্র্য সম্ভবত ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে পাওয়া যায় না।

কণ্ঠসংগীতের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় রচিত যেকোনও গানকে সহজ সরলভাবে বাংলাগান বলা যেতে পারে। অবশ্য অনেক বাংলাগানেই আমরা বিদেশি বা ভিন রাজ্যের শব্দের প্রয়োগ দেখতে পাই। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গানগুলিতে বাংলা ভাষার আধিক্য থাকার জন্য তাকে বাংলাগানই বলা হয়। তাছাড়াও বাংলার বিভিন্ন মানুষের স্থায়ী বসবাস হওয়ার ফলে বাংলা ভাষাতেও এর প্রভাব পড়েছে। বাংলাভাষী মানুষ অন্যান্য ভাষাভাষীর শব্দকে গ্রহণ করে তাকে ব্যবহারিক প্রয়োগ করার ফলে সেগুলিরও বাংলা শব্দের অভিধানে অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। যেমন- কাগজ (ফারসি শব্দ), চাবি (পর্তুগিজ) ইত্যাদি শব্দ।

বাংলায় রচিত বাঙালির শাক্তগান বাংলাগানের জগতে এক বিশেষ সম্পদ। বাংলার বিভিন্ন ধরনের গানকে একত্রে বলা হয় বাংলাগান। এখন প্রশ্ন হলো এই বাংলাগানের উৎস কি? এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে যে তথ্য-প্রমাণাদি পাওয়া যায় তা থেকে মনে করা হয় খ্রিস্টীয় দশম-দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত চর্যাপদই বাংলাগানের উৎস।

এই চর্যাপদের সময়কে বলা হয় সান্ধ্য ভাষার যুগ। অর্থাৎ এই সময়তেই পুরাতন ও নতুনের সংমিশ্রণে বাংলা ভাষা তার নতুন অবয়ব ধারণ করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তনের সাথে সাথে গানও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মূলত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাদের আধ্যাত্মিক চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন গান বা এই চর্যাপদগুলির মাধ্যমে। তাই একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে বাংলা ভাষা ও গান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার আদি যুগ থেকে গান তার বিবর্তনের সঙ্গী হয়েছে।

আসলে চর্যাগীতিগুলি ছিল বৌদ্ধ ধর্মের উপাসনা গীত। বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনগুলি বৌদ্ধাচার্য্যদের লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। বৌদ্ধ দর্শনের একটি নমুনার সামান্য অংশ নিচে দেখানো হলো-

কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।

চঞ্চল চী এ পইঠা কাল।।

অর্থাৎ বৃক্ষ রূপ শরীরে পঞ্চ ইন্দ্রিয় হল শাখা-প্রশাখা স্বরূপ। আর এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কারণে চিত্ত চঞ্চল হয়।

উপরের এই উদাহরণটি উদ্ধৃত হল শুধু এটুকু দেখানোর জন্য যে বাংলাগানের সূচনা হয় আধ্যাত্ম দর্শনের হাত ধরে। আলোচ্য বিষয়বস্তু ‘শাক্তপদ’ গুলিও আধ্যাত্ম চেতনার আরেক রূপ। বাংলা ভাষা তথা গানের প্রায় কয়েক শত বছরের বিবর্তনের পর বাংলা সাহিত্যে শাক্তপদগুলির সংযোজন হয়।

বাংলাগানের প্রাচীন যুগ যেটি আনুমানিক দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিল তাকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল-

১) চর্যাপদ ২) গীতগোবিন্দ ৩) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন

এবার পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বাংলাগানের যে মধ্যযুগ শুরু হয় সেটি পাঁচভাগে বিভক্ত। সেগুলি হল-১) পদাবলী সাহিত্য ২) মঙ্গলকাব্য ৩) অনুবাদ সাহিত্য ৪) লোকসংগীত ৫) অন্যান্য গান।

এদের মধ্যে পদাবলী সাহিত্যকে দুইভাগে ভাগ করা যায়-

১) বৈষ্ণব পদাবলী ২) শাক্ত পদাবলী

এইভাবে বাংলাগানের মধ্যযুগের অন্তিম পর্যায়ে শাক্তগানগুলি বাংলা সাহিত্যে সংযোজিত হতে শুরু করে।

বাংলায় শাক্তগীতির উদ্ভব :

বাংলাগানে তথা সাহিত্যে কিভাবে শাক্তপদগুলির প্রবেশ হয় সেই দিকে আলোকপাত করা যাক।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাগানের মধ্যযুগ শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। মধ্যযুগের সূচনায় পদাবলী সাহিত্যের মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীগুলি রচিত হতে শুরু করে। তাই তুলনামূলকভাবে বৈষ্ণব পদাবলী প্রাচীন। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচিত হয়। সেই সময় বাংলায় কৃষ্ণ সাধনা প্রবল হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পর বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে বাংলার মানুষ জাতির ভেদাভেদ ভুলে কৃষ্ণপ্রেমে মেতে ওঠে। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও প্রসারের একটি বড় মাধ্যম ছিল কীর্তন গান। এই গান সাহিত্যে-রসে ও কাব্যে এত উন্নত ছিল যে সমগ্র বাংলা কৃষ্ণপ্রেমে অবগাহন করল।

এক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উৎসাহে ও প্রচেষ্টায় বৈষ্ণব সাহিত্যে অসংখ্য পদাবলী কীর্তন সংযোজিত হলো, যার ধারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোভাবের পরেও কয়েক শতাব্দি যাবত অক্ষুন্ন ছিল।

কিন্তু বাংলায় ইংরেজ প্রবেশের প্রাক্কালে সামাজিক ও রাজনৈতিক চরম বিশৃঙ্খলা পূর্ণ অবস্থাতে মানুষের নিত্য চাহিদা ও নিরাপত্তার চাহিদা এতটা প্রবল হয়ে উঠেছিল যে সাধারণ মানুষ অত্যাচার ও নিষ্পেষণের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য মাতৃরূপের বন্দনায় ব্রতী হল, যিনি একাধারে ভয়ঙ্করী ও শুভঙ্করী। এই দেবীর বর্ণনা আমরা পুরাণ ও মঙ্গলকাব্যে পেয়ে থাকি। মনে করা হয় যে সাধক শ্রী রামপ্রসাদ সেনের হাত ধরেই বাংলায় শাক্তগানের সূচনা। আসলে রামপ্রসাদ সেনের আবির্ভাবের পূর্বেও কতিপয় শাক্তপদ রচিত হয়েছিল। তবে রামপ্রসাদের রচনার মানের কাছে সেগুলি নিষ্প্রভ হয়ে যায়। সাধক কবি শ্রী রামপ্রসাদ সেনের আবির্ভাব এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে হয়েছিল, যখন মুসলমান রাজত্বের অন্তিম সময় ও ইংরেজরা রাজত্বের সূচনার পথ প্রশস্ত করছিল। এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা রামপ্রসাদের সাধক কবি মনে দৃঢ় ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার ফলস্বরূপ শাক্ত সাহিত্যে এইসব মূল্যবান শাক্ত গানগুলি প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর এই গানগুলি যেন পুষ্পস্বরূপ মাতৃচরণে অঞ্জলি নিবেদন। গানগুলি আবেগে, আকুলতায়, সরলতায়, বীরতায় ভালবাসার অকৃত্রিমতায় যে প্রেরণা সঞ্চার করেছিল তাকে বাংলার আপামর জনসাধারণ নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে গ্রহণ করেছিল। ফলে রামপ্রসাদ সেনের সময় থেকেই লোকমুখে শাক্তগীতিগুলি প্রচারিত-প্রসারিত হতে শুরু করে।

বাংলায় শাক্তবাদের উৎস :

আমরা পূর্বে বাংলাভাষা, বাংলাগান ও শাক্তগীতির উদ্ভব সম্বন্ধে কিছুটা ধারনা পেলাম। এইবার ‘শাক্তবাদ’ ব্যাপারটি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। ‘শাক্তগীতি’ কথাটি এসেছে ‘শক্তি’ এই শব্দটি থেকে। শক্তির উপাসককে বলা হয় ‘শাক্ত’। যেমন সূর্যের উপাসককে বলা হয় ‘সৌর’। বিষ্ণুর উপাসককে বলা হয় ‘বৈষ্ণব’। শক্তি বলতে বিশ্বজগতের চালিকাশক্তি যা সমগ্র বিশ্বের সমস্ত জড় যথা জীবের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে তাকে অনুভব করা। সেই শক্তিকে অন্তরে অনুভব করে তার প্রতি শ্রদ্ধা অর্পন করাই হল শক্তির উপাসনা। কথিত আছে- ‘যাহা আছে ব্রহ্মান্ডে তাহা আছে দেহ ভান্ডে’।

এই ব্রহ্মান্ডের শক্তির স্ফুরণকে নিজের দেহ-মনে চেতনায় অনুভব করাই হলো শক্তির উপাসনার প্রথম সোপান। তাই শক্তি উপাসনার মূল বিষয় বা গুঢ় অর্থ নিয়ে যে গানগুলি রচিত হয়েছে, সেগুলির উল্লেখ এই সকল গানগুলি রচনার বহু বহু পূর্বে প্রাচীন শাস্ত্রগুলিতেই উল্লেখ আছে। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রের প্রায় সবগুলোতেই এর উল্লেখ আছে। বেদ, পুরাণ, যোগশাস্ত্র, তন্ত্রশাস্ত্র সবগুলিতেই শক্তির মহত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।

শক্তিবাদ এর আলোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে যে শক্তি উপাসনা হেতু উপাসকরা নারী মূর্তিকে মাতৃশক্তি রূপে আবাহন করেছে। শুধু প্রাচীনকাল থেকেই দেখা গেছে শক্তির উপাসনার জন্য আলম্বন হিসাবে মাতৃমূর্তি স্থাপনার মাধ্যমে নিরাকার স্বত্তায় উন্নত হতে সচেষ্ট হয়েছে। মনে স্বাভাবিকভাবেই মাতৃশক্তির মাহাত্ম্য ও গুরুত্বের কারণ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহ হয়।

শক্তির উপাসনায় মাতৃশক্তির মহিমা :

মাতৃশক্তির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যতটুকু ধারনা উপলব্ধ হয় সেগুলো নিম্নে ব্যাখ্যায়িত হল-

১। কোন নতুন প্রজন্মের বীজ গঠিত হয় মাতৃগর্ভে। বীজ সৃস্টির জন্য পুংশক্তির প্রয়োজন

   হলেও সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে শক্তি সঞ্চয় করে মাতৃগর্ভে।

২। নবজাতক জন্মলাভ করার পর মাতৃস্তন পান করে প্রথম জীবনীশক্তি লাভ করে।

৩। প্রাণীকুলের যেকোনো শিশুই মায়ের মননশক্তি দিয়েই জগতকে দেখতে শেখে। মা-

    ই তাকে পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়।

৪। সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে জাগতিক বস্তুই মায়া। এই মায়া হলো প্রকৃতি। সুতরাং

    জাগতিক বিষয়ের ভোগ ও তার সমাপন সম্পূর্ণ বিষয়টিতেই মাতৃশক্তির বন্দনা

    অপরিহার্য।

এই ভাবেই যুগ যুগ ধরে শক্তি আরাধনার সাথে সাথে মাতৃশক্তির বন্দনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে।

প্রাচীন বৈদিক যুগ পুরুষ দেবতা প্রধান হলেও মায়ের মহিমাকে ক্ষুন্ন করা হয়নি। যজুর্বেদের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো-

যথে মাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ

ব্রহ্মারাজন্যাভাং শুদায় চার্যায় চ স্বায় চারনীয়চ।।

অর্থাৎ কল্যাণময়ী মা সমাজের সকলস্তরের লোকের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, অরণ্যবাসী এবং অন্যান্য) কল্যান করেন।

আবার মার্কেন্ডেয় চণ্ডী তে দেখা যায়-

দুর্গাসি দুর্গ ভবসাগর নৌ-রসঙ্গা

অর্থাৎ দুর্গম ভবসাগরে নৌকা স্বরূপ বলে তুমি দুর্গা।

এইরকম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখন্ডে দেবীশক্তির বর্ণনা পাওয়া যায় এইভাবে-

যয়া বিনা চ বিশ্বেষু সর্ব্বং কর্মাতিনিষ্ফলম

মোক্ষদা যা মুমক্ষুনাং কামিনাং সর্বকামদা।।

অর্থাৎ সর্বপ্রকার কামনা-অভিলাষ পরিপূর্ণকারী এই দেবী বা মাতৃশক্তিই মোক্ষদায়িনী যিনি জীবন-মরনের চক্রাবর্ত থেকে জীবকে মুক্ত করতে পারেন।

আবার তন্ত্রশাস্ত্রে তো মাতৃশক্তির মহিমাই সর্বোপরি ব্যবহৃত হয়েছে, চামুন্ডাতন্ত্রে যে দশমহাবিদ্যার বর্ণনা পাই তার একটি নমুনা হলো এই রূপ-

কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী

ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।

বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মামিকা

এত দশ মহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীর্তিতাঃ।।

দশমহাবিদ্যার এই দশ দেবীই বিশেষ বিশেষ শক্তির অধিকারিনী। সাধকগণ তার অভীষ্ট সিদ্ধিহেতু উক্ত দেবীগণের শরণাপন্ন হন।

আবার যোগ সাধনায় যে কুল কুণ্ডলিনী জাগরণের জন্য ‘ষটচক্র’ সাধনার বিধান আছে সেই চক্র সাধনায় ‘ষটচক্র’ অর্থাৎ ‘আজ্ঞাচক্রে’ (ভ্রু যুগলের মধ্য স্থান) শিব ও কালীর অধিষ্ঠান বলে মনে করা হয়।

তাহলে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা এইটুকু পরিষ্কার হওয়া গেল যে সাধনায় দেবী শক্তির এক বিশেষ প্রভাব রয়েছে।

উপরিউক্ত আধ্যাত্ম দর্শনবোধই পরবর্তীকালে বাংলায় শাক্তগীতিগুলি রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। এবার শাক্তগীতি গুলির বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারবো যে কিভাবে উপরিউক্ত দর্শনগুলি শাক্তগীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

মহানির্বাণ তন্ত্রে কালীর কালো রূপের পিছনে যে ব্যাখ্যাটি আছে সেটি হল- ‘কাল’ অর্থাৎ ‘সময়’। বর্তমানকাল অতীত হলেই তা স্মৃতিতে পরিণত হয়। তারার বাস্তব অস্তিত্ব থাকে না। জাগতিক সব ভালো মন্দই কালগর্ভে পতিত হয়। এই ‘কাল’ অর্থাৎ ‘সময়’কে যিনি হরণ করেন তিনি ‘কালী’ বা ‘মহাকালী’।

সাধক কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য এই দর্শনটিকেই তাঁর কাব্যে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন-

সদানন্দময়ী কালী

মহাকালের মনমোহিনী

তুমি আপনি নাচো আপনি গাও মা

আপনি দাওনা করতালি।।

আবার পাতঞ্জল যোগ দর্শনের কৈবল্যবাদের সর্বশেষ সূত্রে বলা হয়েছে-

পুরুষার্থশূন্যাং গুনানাং প্রতি প্রসবঃ কৈবল্যং

স্বরুপ প্রতিষ্ঠা বা চিতি শক্তিরিতি।

অর্থাৎ পুরুষ যখন ‘কেবল’ বা ‘নির্গুণ’ হন মানে যখন প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক বস্তু প্রতিবিম্বিত হয়না আত্মা যখন চৈতন্য রূপে প্রতিষ্ঠিত থাকেন, বিকার হয় না এইরকম নির্বিকার হওয়াকে ‘কেবল’ বা ‘কৈবল্য’ বলা হয়। শক্তি মতে এইজন্যই শিব-কালী যুগলমূর্তি বা শায়িত শিব বা দণ্ডায়মান কালীমূর্তি এত গুরুত্বপূর্ণ একটি আলম্বন। অর্থাৎ কিনা বস্তুগত ও প্রাকৃতিক যা কিছু সবই মায়ের অধীনস্থ। তাই মায়ের আরাধনা করেই জীবন মুক্ত হওয়া যায়। এরকম ভাবে ভাবিত হয়েই কবি নজরুল লিখেছেন-

কালো মেয়ের পায়ের তলায়

দেখে যা আলোর নাচন

রুপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব

যার হাতে মরণ বাঁচন।।

এরকমভাবে তন্ত্র তত্ত্বের কিছু গুঢ় তত্ত্বকে রামপ্রসাদ সেন কাব্যে তুলে ধরেছেন-

এবার আমি ভালো ভেবেছি

এক ভাবির কাছে ভাব শিখেছি

যে দেশেতে রজনী নাই

যে দেশের এক লোক পেয়েছি।

এই কবিতার একটি স্থানে আছে-

‘সন্ধ্যাকে বন্ধ্যা করেছি’।

এভাবে ‘যে দেশেতে রজনী নাই’ প্রভৃতি কলীগুলি তন্ত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।

‘যোগশাস্ত্র’ বা ‘তন্ত্রশাস্ত্রে’ এইরকম মনে করা হয় যে মেরুদন্ড থেকে মস্তিস্ক পর্যন্ত গঠনের মধ্যে তিনটি প্রধান নাড়ী অবস্থান করে। এদের মধ্যে মধ্যস্থিত নাড়ীটিকে বলা হয় সুষুম্না নাড়ী। এই সুষুম্না নাড়ির গতিপথ খুলে গেলে সাধকের সিদ্ধিলাভ হয়। তখন অন্তরে দিবারাত্রির মধ্যবর্তী সান্ধ্যকালীন নির্মল অবস্থা বিরাজ করে। এই কারণেই তিনি উপরিউক্ত শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন।

ভক্তি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হল শাক্তগীতি

পূর্বোল্লিখিত পদগুলির সবকটিতেই আমরা সাধন তন্ত্রের ইঙ্গিত পাই। এছাড়াও শাক্তপদগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রধানত দুই ধরনের সংগীতের মধ্যে বিরাজমান।

১) উমা সংগীত ২) শ্যামা সংগীত

সমগ্র ভারতে মাতৃশক্তি ‘মা’ রূপে পূজিত হলেও বাংলায় তিনি ঘরের মেয়ে রূপে সমাদৃতা। এই ভাব নিয়ে রচিত গানগুলি উমাসংগীত নামে পরিচিত। গানগুলিতে সাধনতন্ত্রের কথা না থাকলেও ভক্তিতে, স্নেহের পরকাষ্ঠায়, বাৎসল্যের দিক থেকে অতুলনীয়। তৎকালীন যুগ থেকে আজ অবধি গানগুলির জনপ্রিয়তা সত্যই মনে রাখার মতো ব্যাপার। এইরকম গানগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় কয়েকটি গান আজও আশ্বিন মাসে শারদোৎসবের সময় ধ্বনিত হয়-

১) কবে যাবে বল গীরিরাজ গৌরীরে আনিতে।

    ২) এবার আমার উমা এলে আর উমায় পাঠাব না।

এইভাবে বাংলার শক্তিসাধনার সঙ্গে শাক্তগানগুলি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। কোন গানে আমরা মাতৃশক্তির বৃহৎ ব্যাপক রূপকে অনুমান করি আবার কোন গানে আমরা কন্যাস্বরূপ বাৎসল্যে পরিপূর্ণ হই। এইভাবে বাঙালির শাক্তগান বাঙালির মননে, বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। সম্ভবত সমগ্র ভারতের কোন স্থানের দেবী সাহিত্য ভক্তির আকুলতায়, ভক্তের আকুতিতে, সরলতায়, স্নেহ বাৎসল্য রসে দ্রবীভূত হয়ে এইভাবে সমৃদ্ধশালী হয়নি।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. সেন, পৃথ্বীরাজ, ভারতের ঋষি ও জীবন সাধনা, কোলকাতা, গিরিজা লাইব্রেরি, ২০১৬।

২. চক্রবর্তী, জাহ্নবী কুমার, শাক্তপদাবলী ও শক্তিসাধনা, কোলকাতা, ডিএম লাইব্রেরি,১৩৯৪ রথযাত্রা।

৩. দাশগুপ্ত, শশীভূষণ, ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য, কোলকাতা, সাহিত্য সংসদ প্রাঃ লিঃ, ১৩৬৭ ভাদ্র।

৪. বসু, অরুণ কুমার, শাক্তগীতি পদাবলী, কোলকাতা, পুস্তক বিপণি, ১৪০৮।

ছবি

https://horoppa.wordpress.com/category/এলোমেলো-ভাবনা/দর্শন/বাঙালির-লৌকিক-ভাবদর্শন/শক্তি-সাধনা/

https://bn.wikipedia.org/wiki/শাক্তধর্ম

https://www.facebook.com/tdasgupto/posts/সাধক-কবি-কমলাকান্ত-পূর্বগামী-শাক্তকবি-রামপ্রসাদের-বিপুল-ছটায়-তিনি-কিছুটা-ঢাকা-পড়/3213943828629164/

Why Music: An Exploration of the Role and Significance of Music in Human Life

Smarajit Sen

Abstract:

Music is an extraordinary and multifaceted form of human expression, capable of transcending cultural, linguistic, and temporal boundaries to connect people in profound ways. Through melody, rhythm, and harmony, music conveys emotions that words often fail to capture, fostering a deep emotional resonance between artist and listener. Embedded in human cultures worldwide, music serves as a vital medium for preserving traditions, values, and histories, often playing a central role in rituals and communal activities. Moreover, research highlights the cognitive benefits of music education, including enhanced memory, creativity, and critical thinking. Beyond entertainment, music’s therapeutic potential is widely recognized in healthcare, aiding in mental and emotional well-being. Music’s universality fosters social cohesion and collective experiences, breaking down barriers and creating a shared emotional language. From a scholarly perspective, music encompasses the rigor of science, the precision of mathematics, and an aesthetic appeal that contributes to personal and spiritual growth. This paper explores these multifaceted dimensions of music, examining why it is far more than mere entertainment and delving into its vast potential as a subject for study, therapy, and cultural enrichment.

Keywords:
Music, Emotional Expression, Cultural Heritage, Cognitive Benefits, Music Therapy, Universal Language, Scientific Basis of Music, Mathematics in Music, Aesthetic Experience, Social Connection

Music is one of the most powerful forms of expression and has a unique ability to connect people across cultures, time, and space. Here are a few reasons why music holds such a profound place in human life. Music allows individuals to express complex emotions in a way that words often can’t. It can evoke and convey feelings of joy, sorrow, love, and nostalgia, creating a deep emotional connection between the artist and the listener.

Music is deeply embedded in human cultures. Different types of music reflect the values, traditions, and histories of various societies. It plays a role in rituals, celebrations, and community building, serving as a medium for preserving cultural heritage. Studies show that learning and listening to music enhances cognitive abilities such as memory, attention, and problem-solving. Music education can foster creativity and critical thinking while also improving spatial reasoning and linguistic skills.

Music therapy is used in healthcare to help with mental health issues, physical rehabilitation, and stress reduction. Music can act as a tool for healing, helping people manage anxiety, depression, or trauma. Music is a universal language that helps to break barriers between individuals. Whether through communal singing, dancing, or simply sharing songs, music fosters social connections and collective experiences. Many people are drawn to music for its intrinsic beauty. The combination of harmony, rhythm, and melody creates patterns that can inspire awe, wonder, and admiration, offering listeners a deep aesthetic experience.

For some, music is a path to spiritual awakening or personal growth. It can be a form of meditation, helping people reflect, contemplate, or find peace within themselves. For you as a music researcher and professor, the significance of music could also stem from its endless potential for study, analysis, and exploration of how it shapes human life.

It is often seen that people ask Why you are learning music? Even sometimes, a learner of Music also asks, is it only for Entertainment? Or it has more broader aspects?

Music is a SCIENCE. (It includes Sound, Harmonics, Harmonies, Overtones, Pitch, Timbre, Magnitude etc, plus the approach and it has very much Logical Reasoning of everything)

Music is MATHEMATICS. (In Indian Music, we have plenty of Rhythm Fractions, Variations, Tihais, Chakradhars etc, Layakaris, different time fractions, Jati etc Lot of things, In Western Music, we have Cadences, Intervals and a lot of things related to Mathematics)

Music is an INTERNATIONAL LANGUAGE (As it has no barriers of wordings, like Human Emotions have! Specially in the case of Instrumental Music, where words stop, music begins, because emotions are always same everywhere in the world, irrespective of Language, and Music is more about feeling than understanding.)

Music is a PHYSICAL EDUCATION (Practice of Music is very much similar to sports exercises, like jogging, push-ups, sit-ups, and running etc, music also needs 500 Sapat, 2hrs of continuous technical skill development practices incessantly with Rigorous Hard Work)

Music includes History (We must know the evolution and development of each Gharanas, the history and foundation of different schools of Music.)

Music needs GEOGRAPHICAL KNOWLEDGE. (We have to study the different origins, Climates and areas that generate different features and Genres of Music)

Music is deeply attached to PSYCHOLOGY (it evokes different layers of our mind, and with the Benign Embellishment of the Aesthetics and Spectrum of Dexterity, it pulls us through a trance where the sweetest notes of our heart tells the saddest thoughts)

Music has a Deep Connection with our BIOLOGY (You must have heard the term “MUSIC THERAPY”, a medication process which is purely based on the Effects of Musical waves in our Brain, Blood Circulations etc)

Above all, Music is an ART! (Undoubtedly, it’s the Greatest Form of ART ever created by Human beings for the sake of Mankind)

That’s why we are learning Music, not just to be a musician only, but to be a GOOD HUMAN BEING, with a Noble Heart, Penetrative Thinking Power, Right Decision to Choice anything.

Role of Music for Mankind:

Music also has a crucial role in human development and well-being, especially in the cognitive, emotional, and social domains. Here are some reasons why music is essential for mental health and cognitive development:

Emotional Development: 

Music is a powerful medium for expressing and regulating emotions. It can help individuals process and express complex emotions, leading to emotional well-being.

Cognitive development: 

Learning music can have a positive impact on cognitive abilities such as memory, attention, and executive functions. It can also enhance skills like language development and mathematical reasoning.

Creativity with Reasoning:

Music encourages creativity, reasoning skills and problem-solving skills. It requires individuals to think critically, make decisions, and think differently with proper logic, reason and develops knowledge.

Stress Reduction: 

Listening to music can help reduce stress and anxiety levels. It can have a calming effect on the mind and body, promoting relaxation and overall well-being.

Social connection: 

Music has the power to bring people together and strengthen social bonds. Whether through group performances or shared musical experiences, music can foster a sense of community and belonging.

In terms of the role of media in propagating the true meaning of well-being through music, media platforms, including social media and digital marketing, play a significant role in shaping public perceptions and promoting the benefits of music for mental health. Here are some ways media can contribute:

Education and awareness: 

Media platforms can educate the public about the benefits of music for mental health and well-being. They can raise awareness about the importance of music education and engagement for individuals of all ages.

Promotion of positive messages: Media can promote positive messages about music and its impact on mental health. By highlighting success stories and testimonials, media can inspire others to engage with music for their well-being.

Access to resources: 

Media can provide access to resources such as online music lessons, virtual concerts, and mental health support services related to music therapy. This can make it easier for individuals to explore music for their well-being.

Community building

Media platforms can create online communities centred around music and mental health, where individuals can share their experiences, seek support, and connect with like-minded individuals.

In conclusion, music plays a vital role in promoting mental health and cognitive development, and media platforms have the power to amplify the message of well-being through music. By leveraging media channels effectively, we can raise awareness, educate the public, and inspire individuals to incorporate music into their lives for improved well-being.

Bibliography

Books

  1. Bose, Mandakranta. The Dance and Music of India: Rhythms of Culture. Delhi: Motilal Banarsidass, 1991.
  2. Daniélou, Alain. The Ragas of Northern Indian Music. London: Barrie & Jenkins, 1968.
  3. Lath, Mukund. A Study of Dattilam: A Treatise on the Sacred Music of Ancient India. New Delhi: Munshiram Manoharlal, 1978.
  4. Neuman, Daniel M. The Life of Music in North India: The Organization of an Artistic Tradition. Chicago: University of Chicago Press, 1990.
  5. Rowell, Lewis. Music and Musical Thought in Early India. Chicago: University of Chicago Press, 1992.
  6. Sanyal, Ritwik and Richard Widdess. Dhrupad: Tradition and Performance in Indian Music. Aldershot: Ashgate, 2004.
  7. Tagore, Rabindranath. The Religion of Man. London: Macmillan, 1931.

Journal Articles

  1. Clayton, Martin. “Time, Gesture, and Attention in a Khyal Performance.” Asian Music, vol. 38, no. 2, 2007, pp. 71-96.
  2. Farrell, Gerry. “Reflecting Surfaces: The Use of Elements from Indian Music in Popular Music and Jazz.” Popular Music, vol. 7, no. 2, 1988, pp. 189-205.
  3. Leante, Laura. “The Lotus and the King: Imagery, Gesture, and Meaning in a Hindustani Raga Performance.” Ethnomusicology Forum, vol. 22, no. 1, 2013, pp. 49-71.
  4. Napier, John. “The Distribution of Authority in the Performance of North Indian Vocal Music.” Ethnomusicology, vol. 47, no. 1, 2003, pp. 107-138.
  5. Widdess, Richard. “Aspects of Form in North Indian ālāp and dhrupad.” Ethnomusicology, vol. 24, no. 2, 1980, pp. 183-214.

Conference Papers

  1. Mandal, Debasish. “The Role of Indian Classical Music in Cultural Identity.” Paper presented at the International Conference on Musicology, Delhi, India, March 2023.
  2. Jones, Catherine. “Rhythmic Structures in Indian Music and their Cognitive Impact.” Paper presented at the Symposium on World Music and Psychology, New York, USA, July 2019.

Theses and Dissertations

  1. Sharma, Anuradha. The Impact of Indian Classical Music on Human Emotions: A Psychological Exploration. PhD diss., University of Delhi, 2016.
  2. Iyer, Arjun. The Evolution of Raga Structure in Hindustani Classical Music. Master’s thesis, Jawaharlal Nehru University, 2021.

Online Resources

  1. Ministry of Culture, Government of India. “The Cultural Significance of Indian Classical Music.” IndiaCulture.gov.in. https://indiaculture.gov.in/classical-music (accessed August 15, 2024).
  2. Indian Musicological Society. “Research in Indian Classical Music: Current Trends.” IMS Journal. http://ims.org.in/research (accessed August 15, 2024).

Guru-Shishya Parampara: Cultural Significance and Relevance of Indian Classical Dance

Subarna Saha, Ph.D Research Scholar, Performing Arts (Dance), Sister Nivedita University, DG1/2, New Town, Action Area-1, New Town, Kolkata: 700156, West Bengal, India.

The Guru-Shishya Parampara, or the traditional teacher-disciple lineage, holds a pivotal role in the preservation and transmission of Indian classical dance. Rooted in the cultural and spiritual ethos of India, this ancient practice is more than a pedagogical method; it is a sacred bond that embodies respect, dedication, and continuity of knowledge. This tradition has enabled the oral transmission of dance forms like Bharatanatyam, Kathak, Odissi, and others, ensuring their survival through generations. By immersing themselves in the guidance of a Guru, disciples cultivate technical mastery and internalize the philosophies and aesthetics that underpin Indian classical dance. This parampara has historically upheld the cultural integrity of dance by emphasizing direct experiential learning, where disciples receive personalized instruction and embody the art form as a way of life. However, in modern times, with changing educational structures and a growing inclination toward institutionalized training, the Guru-Shishya Parampara faces challenges and adaptations. This paper explores the cultural significance of this traditional pedagogy, its impact on the transmission of dance heritage, and its contemporary relevance. It highlights the evolving dynamics between Gurus and Shishyas and considers ways to preserve this invaluable lineage within the context of modern educational frameworks.

Keywords: Guru-Shishya Parampara, Indian classical dance, cultural heritage, Bharatanatyam, Kathak, traditional pedagogy, dance transmission, Indian aesthetics, experiential learning, modern relevance

  • সংক্ষিপ্তসার

গুরু-শিষ্য পরম্পরা ভারতীয় সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা, যা প্রাচীন আধ্যাত্মিক শিক্ষায় জন্ম নিয়ে পরবর্তীতে শাস্ত্রীয় নৃত্য, সঙ্গীত ও দর্শনে বিস্তার লাভ করেছে। গুরু-শিষ্য পরম্পরার বিশেষত্ব হলো গুরুর সঙ্গে শিষ্যের গভীর ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যা কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতা নয় বরং আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক উন্নয়নেও সহায়ক। ঔপনিবেশিক যুগে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং আধুনিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, গুরু-শিষ্য পরম্পরা ভারতের শাস্ত্রীয় শিল্পে স্থিতিশীলভাবে টিকে রয়েছে এবং আধুনিক শিক্ষার সাথে সহাবস্থান করছে। বর্তমান প্রজন্মের জন্য হাইব্রিড শিক্ষণ মডেল এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই ঐতিহ্যের প্রসার আরও সহজতর হয়েছে। গুরু-শিষ্য পরম্পরার মডেল একে শুধুমাত্র দক্ষতার বিকাশ নয় বরং ব্যক্তিগত সংযোগ, মানসিক বিকাশ এবং সামাজিক পরিবর্তনের জন্যও শক্তিশালী মাধ্যম করে তুলেছে। এর স্থিতিস্থাপকতা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অভিযোজন ক্ষমতা নিশ্চিত করেছে যে পরম্পরা আগামী প্রজন্মের জন্য মূল্যবান এক শিক্ষামূলক উত্তরাধিকার হিসেবে রয়ে যাবে।

  • মূলশব্দ

গুরু-শিষ্য পরম্পরা, পরম্পরার ঐতিহ্য, ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, স্থিতিস্থাপকতা, পরম্পরার ভবিষ্যৎ।

  • ভূমিকা 

গুরু-শিষ্য পরম্পরা, ভারতের একটি কাল-সম্মানিত শিক্ষক-শিষ্য ঐতিহ্য, 5000 বছরেরও বেশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিস্তৃত প্রজন্মের মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহক হিসেবে কাজ করে। প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত, এই শিক্ষাধারা শাস্ত্রীয় নৃত্য, সঙ্গীত এবং দর্শন সহ বিভিন্ন শাখাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ঔপনিবেশিক যুগে প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা উত্থাপিত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, গুরু-শিষ্য পরম্পরা উন্নতি লাভ করে চলেছে, বিশেষ করে পারফর্মিং আর্টে, যেখানে গুরু এবং শিষ্যের মধ্যে গভীর বন্ধন ঐতিহ্যগত শিল্পশৈলীগুলিকে সংরক্ষণ এবং স্থায়ী করার জন্য অপরিহার্য।

এই গবেষণাটির জন্য গুরু-শিষ্য পরম্পরার ঐতিহাসিক উৎস এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের সন্ধান করতে গিয়ে বেদ এবং উপনিষদের মতো প্রাচীন গ্রন্থে এর শিকড় এবং সেইসাথে মহাভারত এবং রামায়ণের মতো মহাকাব্যের বর্ণনায় এর চিত্রায়ন খুঁজে পাওয়া যায়। অন্বেষণটি ঔপনিবেশিকতা এবং আধুনিকতার দ্বারা সৃষ্ট শিক্ষাগত দৃষ্টান্ত পরিবর্তন ও তার বিশ্লেষণের পাশাপাশি অনুকরণীয় গুরু-শিষ্য সম্পর্ক এবং তাদের সমসাময়িক প্রকাশগুলিকে তুলে ধরে। তদ্ব্যতীত, আলোচনাটি প্রতিফলিত করে যে কীভাবে গুরু-শিষ্য পরম্পরা আধুনিক শিক্ষাগত পদ্ধতির সাথে সহাবস্থান করতে পারে এবং সমৃদ্ধ করতে পারে, বিশেষ করে শিল্পকলার মধ্যে, গভীর ও রূপান্তরমূলক শিক্ষাগত অভিজ্ঞতা প্রদানের অনন্য ক্ষমতার উপর জোর দেয় যা নিছক দক্ষতা অর্জনকে অতিক্রম করে।

  • ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যে গুরু-শিষ্য ঐতিহ্যের বিবর্তন এবং স্থিতিস্থাপকতা

গুরু-শিষ্য পরম্পরা ভারতীয় শাস্ত্রীয় শিল্পকলায় বিশেষভাবে উন্নতি লাভ করেছে। এখানে, এটি ভরতনাট্যম, ওড়িশি, কত্থক নৃত্য সহ হিন্দুস্তানি এবং কর্নাটিক সঙ্গীতের মতো শৈলীগুলির অখণ্ডতা রক্ষায় একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, যেখানে জ্ঞান প্রায়শই মৌখিকভাবে এবং অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। প্রযুক্তিগত দক্ষতার বাইরে, শিষ্যরা তাদের শিল্পের সূক্ষ্মতা, আবেগ এবং আধ্যাত্মিক মাত্রাগুলি শিখতে পারে। গুরুর দ্বারা শেখানো এই সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতাগুলি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ধরা কঠিন, যেখানে গুরু-শিষ্য পরম্পরা প্রদান করে এমন ব্যক্তিগত পরামর্শের অভাব থাকে।

ঔপনিবেশিকতার আবির্ভাব এবং 19 শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তনের সাথে, ঐতিহ্যগত ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতিগুলি দেশীয় শিক্ষার কাঠামোকে ব্যাহত করেছিল, মানসম্মত, পশ্চিমা পাঠ্যক্রমের পক্ষে যা ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক লক্ষ্যগুলির সাথে সংযুক্ত ছিল। এই শিক্ষাগত পরিবর্তন প্রায়শই গুরু-শিষ্য পরম্পরার মৌলিক সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মাত্রাগুলির উপর জোর দেয় না। ফলস্বরূপ, জ্ঞান সঞ্চালনের ঐতিহ্যগত রূপগুলি, বিশেষ করে শিল্পকলায়, প্রান্তিক হয়ে পড়েছিল কারণ পশ্চিমা শিক্ষার মডেলগুলি বিজ্ঞান, গণিত এবং ইংরেজির মতো বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দেয়৷

স্বাধীনতার পর, ভারত তার শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের সাথে লড়াই করে, কিন্তু সমাজের দ্রুত আধুনিকীকরণ এবং বিশ্বায়ন পরম্পরকে টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে। আধুনিক জীবনধারা প্রায়শই নমনীয়তার দাবি করে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য ঐতিহ্যবাহী পরম্পর প্রয়োজনের নিবিড়, নিমগ্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া কঠিন করে তোলে। কঠোর সময়সূচী, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, এবং কর্মজীবনের আকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য বজায় রেখে, অনেক শিক্ষার্থী গুরু-শিষ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগতভাবে প্রত্যাশিত আজীবন অধ্যয়নে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারে না। এরপরও গুরু-শিষ্য পরম্পরা স্থিতিস্থাপক থেকে যায় এবং মানিয়ে নিতে থাকে। সরকারী সংস্থা, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং নিবেদিত গুরুদের প্রচেষ্টা আধুনিক শিক্ষাগত পদ্ধতির সাথে মিশ্রিত করে ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করেছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস (ICCR) এবং সংস্কৃতি মন্ত্রক কর্তৃক সূচিত গুরু শিষ্য পরম্পরা প্রকল্পের মতো সরকারি প্রকল্পগুলি গুরু এবং তাদের শিষ্যদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, তাদের এই ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। সঙ্গীত নাটক আকাদেমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলিও শাস্ত্রীয় নৃত্য ও সঙ্গীতের বিভিন্ন রূপকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করেছে, যা এই শিল্পগুলিতে গুরু-শিষ্য বন্ধনের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে।

অধিকন্তু, অনেক গুরু হাইব্রিড শিক্ষণ মডেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন যা ব্যক্তিগত পরামর্শ এবং নমনীয় শেখার সময়সূচী উভয়ের জন্যই অনুমতি দেয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ওয়ার্কশপ, এবং অনলাইন ক্লাসগুলি ক্রমশ সাধারণ হয়ে উঠেছে, যে ছাত্রদের ঐতিহ্যগত, নিমগ্ন অধ্যয়নের জন্য সম্পদ বা সময় নাও থাকতে পারে তারা এখনও গুরুর জ্ঞান থেকে উপকৃত হতে পারে। যদিও এই অভিযোজনগুলি প্রথাগত গুরুকুল পদ্ধতি থেকে আলাদা হতে পারে, তারা পরম্পরকে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে এবং আধুনিক ছাত্রদের প্রয়োজনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম করে।

  • সমসাময়িক শিল্প ও শিক্ষায় গুরু-শিষ্য পরম্পরার ভূমিকা

শিল্পকলায়, বিশেষ করে, গুরু-শিষ্য পরম্পরা নতুনত্বের অনুমতি দেওয়ার সময় সত্যতা রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ঐতিহ্যের অধীনে প্রশিক্ষিত শিষ্যরা অভিব্যক্তি, ছন্দ এবং উন্নতির সূক্ষ্মতা শিখে যা শাস্ত্রীয় ভারতীয় শিল্পকলাকে সংজ্ঞায়িত করে, যা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে বোঝানো কঠিন। অধিকন্তু, এই শিল্পশৈলী গুলির সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক দিকগুলির উপর জোর দেয়, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের অনুশীলনের অন্তর্নিহিত দার্শনিক ভিত্তিগুলিকে বুঝতে পারে। এই পদ্ধতিটি পশ্চিমা শিক্ষার মডেলগুলির সাথে বৈপরীত্য, যা প্রায়শই আধ্যাত্মিক বৃদ্ধি এবং মানসিক গভীরতার চেয়ে প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেয়।

এই পরম্পরা শুধুমাত্র শিষ্যের জন্যই পরিবর্তনশীল নয় বরং গুরুকেও সমৃদ্ধ করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বৃদ্ধির সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই গতিশীলতা শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ এবং তাদের ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্ককে স্পষ্ট করে, যেখানে শিক্ষক এবং ছাত্র উভয়ই শিল্পের বিবর্তনে অবদান রাখে। শিষ্যরা প্রায়শই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সৃজনশীলতা নিয়ে আসে, যা শৈল্পিক অভিব্যক্তির নতুন রূপের দিকে পরিচালিত করে এবং ঐতিহ্যের ভিত্তিতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ,  শাশ্বতী সেন সোনাল মানসিংহ মতো সমসাময়িক শিল্পীরা তাদের শাস্ত্রীয় প্রশিক্ষণের নাগালকে প্রসারিত করেছেন ও সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে নৃত্যকে ব্যবহার করেছেন। এই উদাহরণগুলি দেখায় যে গুরু-শিষ্য পরম্পরা একটি নির্দেশের ব্যবস্থার চেয়ে বেশি; এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য যা সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়ায় শিল্প ফর্মগুলিকে বিকশিত হতে দেয়।সামনের দিকে তাকিয়ে, গুরু-শিষ্য পরম্পরা সামগ্রিক বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে এমন পরামর্শের মডেল প্রদানের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষাকে  সমৃদ্ধ করার সম্ভাবনা রয়েছে।এই পরম্পরা ধৈর্য, ব্যক্তিগত মনোযোগ, দীর্ঘমেয়াদী দিকনির্দেশনা এবং আধ্যাত্মিক গভীরতার উপর এর জোর প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে।

গুরু-শিষ্য পরম্পরার নীতিগুলিকে আধুনিক শিক্ষামূলক কাঠামোর সাথে একীভূত করলে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি চরিত্র বিকাশে উপকৃত হতে পারে। সৃজনশীলতা, মানসিক বুদ্ধিমত্তা এবং নৈতিক ভিত্তি প্রয়োজন এমন ক্ষেত্রের জন্য এই পদ্ধতিটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

গুরু-শিষ্য পরম্পরা নিছক শিক্ষাগত পদ্ধতি নয়; এটি এমন একটি জীবনধারা যা সহস্রাব্দ ধরে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রূপ দিয়েছে। ব্যক্তিগত রূপান্তর, শ্রদ্ধা এবং শৃঙ্খলার উপর এর দৃষ্টিপাত এটিকে অনন্য করে তোলে, এমনভাবে জ্ঞানের পরিধিকে পরিসর করে যা ব্যক্তিগত এবং আধ্যাত্মিক বৃদ্ধিতে গভীরভাবে নিহিত। যেহেতু ভারত আধুনিকীকরণ অব্যাহত রেখেছে, পারম্পার নীতিগুলি শিক্ষার মডেলগুলির একটি মূল্যবান বিকল্প প্রস্তাব করে যা ব্যক্তিগত সংযোগের চেয়ে গভীরতা এবং মানককরণের উপর জোর দেয়।

পরম্পরাকে টিকিয়ে রাখার ও বিকশিত করার জন্য সমসাময়িক গুরু, শিষ্য এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় ঐতিহ্যের অভিযোজন দেখা যায়।কিন্তু একই সাথে হাইব্রিড লার্নিং মডেলগুলিকে আলিঙ্গন করে, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে একীভূত করে, এবং ঐতিহ্যগত শিল্পের মধ্যে উদ্ভাবনকে উত্ৎসাহিত করে। গুরু-শিষ্য পরম্পরা আজকের বিশ্বে প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত গুরুরা তাদের জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং শিষ্যরা শিখতে আগ্রহী, ততক্ষণ গুরু-শিষ্য পরম্পরা প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত, লালনপালন এবং সংযোগ করতে থাকবে।পরম্পরার স্থিতিস্থাপকতা এবং ভবিষ্যত গুরু-শিষ্য পরম্পরার স্থায়ী উত্তরাধিকারের প্রতিফলন, আজকের বিশ্বে এর প্রাসঙ্গিকতার উপর জোর দেয়। সৃজনশীল অভিযোজনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক বৃদ্ধির পথ প্রদান করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।

  • ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যে কিংবদন্তি গুরু-শিষ্য জুটি

1. বিরজু মহারাজ এবং শোভনা নারায়ণ (কথক)

পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, কথকের একজন কিংবদন্তি, শোভনা নারায়ণকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, যিনি এখন ভারতের “কথক রানী” হিসাবে পালিত। শোভনা ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল ব্যালে এবং স্প্যানিশ ফ্লামেনকোর মতো বৈশ্বিক নৃত্যের ফর্মগুলির সাথে কথকের মধ্যে নতুনত্ব এনেছেন। তার গুরুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, তিনি কত্থককে একটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত শিল্পের রূপ দিয়েছেন, দেখিয়েছেন যে কীভাবে গুরু-শিষ্য ঐতিহ্য অভিযোজিত হয় এবং ধ্রুপদী শিল্পের সীমানাকে ঠেলে দেয়।

2. বিরজু মহারাজ ও শাশ্বতী সেন (কথক)

পণ্ডিত বিরজু মহারাজের আরেকজন খ্যাতিমান শিষ্যা হলেন শাশ্বতী সেন, আন্তর্জাতিকভাবে কত্থক সংরক্ষণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তার গুরুর শিক্ষার প্রতি শাশ্বতীর প্রতিশ্রুতি,তার অভিনয় এবং একজন শিক্ষক হিসাবে তার কাজের মধ্যে উজ্জ্বল। তাদের সম্পর্ক শাস্ত্রীয় শিল্পকে প্রাণবন্ত রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরু-শিষ্য পরম্পরার ভূমিকার ওপর জোর দেয়।

3. মৃণালিনী সারাভাই এবং মল্লিকা সারাভাই (ভারতনাট্যম)

 মৃণালিনী সারাভাইয়ের মেয়ে মল্লিকা, তার মায়ের দর্পনা একাডেমিতে প্রশিক্ষিত।মেমরি ইজ আ র্যাগড ফ্র্যাগমেন্ট অফ ইটার্নিটির মতো প্রযোজনার মাধ্যমে যৌতুকের মৃত্যুর মতো সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় তিনি তার শিল্প ব্যবহার করেন।এই উদাহরণটি দেখায় যে কীভাবে গুরু-শিষ্য ঐতিহ্য প্রযুক্তিগত নির্দেশকে অতিক্রম করতে পারে।

4. কেলুচরণ মহাপাত্র এবং সোনাল মানসিংহ (ওড়িশি)

ওড়িশিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য শ্রদ্ধেয়, কেলুচরণ মহাপাত্র সোনাল মানসিংহকে প্রশিক্ষন দিয়েছিলেন, যিনি তার দৃষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে যান। সোনালের কাজ ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী এবং সমসাময়িক থিম, যেমন পরিবেশবাদ এবং নারীর অধিকার উভয়ই অন্বেষণ করে। একজন শিক্ষক এবং অভিনয়শিল্পী হিসেবে, সোনাল নিশ্চিত করে যে তার গুরুর উত্তরাধিকার বেঁচে থাকবে, ঐতিহ্যের মধ্যে থাকা অবস্থায় আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে।

5. ইয়ামিনী এবং ভাবনা রেড্ডির সাথে রাজা এবং রাধা রেড্ডি (কুচিপুড়ি)

কুচিপুড়ি জুটি রাজা এবং রাধা রেড্ডি একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি তৈরি করেছে, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ফেস্টিভ্যাল এবং অ্যাভিগননের আন্তর্জাতিক নৃত্য উৎসবের মতো ইভেন্টগুলিতে বিশ্বব্যাপী পারফর্ম করে। গুরু হিসাবে, তারা তাদের দক্ষতা তাদের কন্যা, ইয়ামিনী এবং ভাবনাকে দিয়েছিলেন। উভয় কন্যাই উৎকর্ষ সাধন করেছে, ইয়ামিনী ডাবলিনে গোল্ডেন কী পেয়েছে এবং ভাবনা একজন নেতৃস্থানীয় কুচিপুডি অভিনয়শিল্পী হয়ে উঠেছে, এমনকি গ্র্যামির আফটার-পার্টিতে তার প্রতিভা প্রদর্শন করেছে। রেড্ডি পরিবার উদাহরণ দেয় যে কীভাবে গুরু-শিষ্য পরম্পরা শৈল্পিক উৎকর্ষতা এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণকে লালন করে, একটি গভীর বন্ধনের উপর জোর দেয় যা প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধি উভয়কেই উৎসাহিত করে।

6.  রামানকুট্টি নায়ার এবং কলমণ্ডলম গোপী (কথাকলি)

কথাকলিতে, কলামণ্ডলম রমনকুট্টি নায়ার এবং তার শিষ্য কলমণ্ডলম গোপীর মধ্যে বন্ধন গুরু-শিষ্য ঐতিহ্যকে মূর্ত করে। রমনকুট্টির নিপুণতা গোপীকে কথাকলির অন্যতম সেরা অভিনয়শিল্পীতে পরিণত করেছিল, যা কিরমিরা ভাদামের মতো কাজগুলিতে তার ভূমিকার জন্য পরিচিত। তার গুরুর শিক্ষার প্রতি গোপীর নিবেদন এবং তার ক্রমাগত সাফল্য কথাকলিতে পরামর্শদানের তাৎপর্যকে তুলে ধরে।

  • অন্যান্য পারফর্মিং আর্টে গুরু-শিষ্য পরম্পরা

1. পন্ডিত রবিশঙ্কর এবং জর্জ হ্যারিসন (ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত)

ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের বাইরে গুরু-শিষ্য ঐতিহ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণগুলির মধ্যে একটি হল পণ্ডিত রবি শঙ্কর, কিংবদন্তি সেতার বাদক এবং দ্য বিটলসের প্রধান গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের মধ্যে সম্পর্ক। রবি শঙ্কর, বিশ্বব্যাপী ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার জন্য পরিচিত, 1960-এর দশকে দুজনের দেখা হওয়ার পর হ্যারিসনের গুরু হন। শঙ্করের নির্দেশনায় হ্যারিসনের সেতার শিক্ষা বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

তাদের সহযোগিতা শুধুমাত্র ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত ঐতিহ্যের সেতুবন্ধনই করেনি বরং গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারণাকে বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অগ্রভাগে নিয়ে এসেছে। গুরু হিসাবে শঙ্করের ভূমিকা সঙ্গীত নির্দেশকে অতিক্রম করেছিল, কারণ তিনি আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধ প্রদান করেছিলেন যা হ্যারিসনের বিশ্বদর্শন এবং সঙ্গীতকে প্রভাবিত করেছিল। এই অংশীদারিত্ব সাংস্কৃতিক দিগন্ত সম্প্রসারণ এবং ঐতিহ্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান বৃদ্ধিতে গুরু-শিষ্য পরম্পরার রূপান্তরকারী শক্তির উদাহরণ দেয়।

2. ওস্তাদ জাকির হুসেন ও শক্তি ব্যান্ড (ফিউশন মিউজিক)

সঙ্গীতে গুরু-শিষ্য ঐতিহ্যের আরেকটি আধুনিক উদাহরণ হল ওস্তাদ জাকির হুসেন, গুণী তবলা বাদক এবং ফিউশন ব্যান্ড শক্তির মধ্যে সম্পর্ক, যার মধ্যে গিটারের কিংবদন্তি জন ম্যাকলাফলিনও ছিলেন। জাকির হোসেনের মেন্টরশিপ ওয়েস্টার্ন জ্যাজের সাথে ঐতিহ্যগত ভারতীয় ছন্দকে ফিউজ করতে সাহায্য করেছে, একটি যুগান্তকারী আন্তঃসাংস্কৃতিক সহযোগিতা তৈরি করেছে। শক্তির সাফল্য সমসাময়িক সঙ্গীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরার অভিযোজনযোগ্যতার একটি প্রমাণ, যেখানে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উপাদানগুলির সংমিশ্রণ শৈল্পিক অভিব্যক্তির জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে।

ব্যান্ডের একজন পরামর্শদাতা হিসাবে জাকির হুসেনের ভূমিকা গুরু-শিষ্য সম্পর্কের গভীর দিকগুলিকে প্রতিফলিত করে, যেখানে গুরু কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতাই নয়, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, আবেগ এবং সৃজনশীলতার বোঝাও দেয়। এই সহযোগিতার মাধ্যমে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং তাল নতুন শ্রোতাদের কাছে পৌঁছেছে, যা আধুনিক সময়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরার বৈশ্বিক প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছে।

  • গুরু-শিষ্য পরম্পরার ভবিষ্যৎ

গুরু-শিষ্য পরম্পরা, ভারতীয় সংস্কৃতিতে নিহিত একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্যবস্থা, জ্ঞান স্থানান্তর এবং আধ্যাত্মিক বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে স্থায়ী কাঠামোর মধ্যে একটি। এই প্রাচীন ঐতিহ্য গুরু (শিক্ষক) এবং শিষ্য (শিক্ষার্থী) এর মধ্যে একটি গভীর, ব্যক্তিগত বন্ধনের উপর জোর দেয়, সামগ্রিক বিকাশকে উৎসাহিত করে যা নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং মানসিক বৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা অতিক্রম করে। যদিও এর ঐতিহাসিক উৎস গভীরভাবে আধ্যাত্মিক শিক্ষার সাথে জড়িত, পরম্পার প্রভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য ও সঙ্গীতে প্রসারিত হয়েছে। ভারতীয় সমাজ, শিক্ষা এবং প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন সত্ত্বেও, গুরু-শিষ্য ঐতিহ্য উল্লেখযোগ্যভাবে স্থিতিস্থাপক রয়ে গেছে।

  • উপসংহার

গুরু-শিষ্য পরম্পরা ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড়ের প্রতিচ্ছবি। এই অনন্য ব্যবস্থা নিছক শিক্ষা সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক উন্নতির এক নিরবধি পথ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি ভারতীয় সংস্কৃতি, দর্শন এবং কলায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে, যা আমাদের আত্মিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে সমৃদ্ধ করেছে। পরম্পরার ওপর আধুনিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, তার মানানসই রূপান্তরের ক্ষমতা এটিকে আজও প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে।

যেহেতু বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, গুরু-শিষ্য পরম্পরা একটি গভীর, অর্থপূর্ণ শিক্ষা মডেল হিসেবে বিদ্যমান। এই ব্যবস্থা ছাত্রদের জন্য শুধু দক্ষতার শিক্ষা নয়, বরং আত্মোপলব্ধি, মানসিক গভীরতা ও মানসিক বিকাশের সুযোগ এনে দেয়। আধুনিক বিশ্বে, বিশেষ করে প্রযুক্তির অগ্রগতির প্রেক্ষিতে, এই ঐতিহ্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ভারসাম্য এনে দিতে পারে যা মননশীলতা এবং সাংস্কৃতিক সচেতনতার বিকাশকে আরও উৎসাহিত করবে।

সামগ্রিকভাবে, গুরু-শিষ্য পরম্পরা শুধু অতীতের ঐতিহ্য নয় বরং বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য এক অনুপ্রেরণা। এই প্রাচীন শিক্ষা মডেল, এর সৃজনশীল অভিযোজনের মাধ্যমে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এক স্থায়ী উত্তরাধিকার হিসেবে রয়ে যাবে, যা আমাদের শিক্ষার কাঠামোকে আরও মানবিক এবং সমন্বিত করে তুলবে।

  • গ্রন্থপঞ্জি

1. Chakravarty, Udayan. Guru-Shishya Parampara in Indian Classical Dance and Music. New Delhi: Indira Gandhi National Centre for the Arts, 2006.

2. Desai, Vishakha N. Dance and the Nation: Performance, Ritual, and Politics in India. University of Chicago Press, 1999.

3. Kapur, Neelam. India’s Performing Arts: A Mosaic. New Delhi: Aryan Books International, 2000.

4. Subramanian, Arudra. Indian Dance and Music through the Ages: Tradition, Practice, and Continuity. Chennai: Orient Longman, 2012.

  • প্রবন্ধ এবং জার্নাল 

1. Bhattacharya, Rituparna. “The Impact of Digital Platforms on the Guru-Shishya Tradition in Contemporary India.” International Journal of Performing Arts, vol. 11, no. 1, 2021, pp. 60–74.

2. Kamath, Arjun. “Guru-Shishya Parampara and Its Role in Modern Performing Arts Education.” Journal of Indian Studies, vol. 14, no. 2, 2018, pp. 102–119.

3. Sen, Ananya. “Colonialism and Indian Education: Challenges to the Guru-Shishya System.” South Asian Cultural Journal, vol. 5, no. 3, 2020, pp. 215-232.

Internet Links:

https://kathakbyneha.in/guru-shishya-parampara-in-indian-classical-dance-and-music/

Role of Music Journalism in Indian Music

Subhraparna Biswas,
Ph.D Research Scholar, Performing Arts (Music), Sister Nivedita University, DG1/2, New Town, Action Area-1, New Town, Kolkata: 700156, West Bengal, India.

Abstract:

Music journalism has long been a vital component of the global music ecosystem, documenting the development of musical trends, artists, and industries. In India, where music is deeply woven into the cultural and social fabric, music journalism has played an integral role in chronicling the evolution of various music genres and their interactions with society. The Indian music industry, rooted in classical traditions yet embracing modern popular forms, provides a unique context for understanding the function of music journalism. This paper explores the historical significance, current trends, and challenges facing music journalism in India, examining its role in shaping public discourse, promoting musical talent, and influencing the industry’s dynamics.

  • Key Words:

Music Journalism in India, Indian Classical Music, Hindustani Music, Carnatic Music, Bollywood Music, Indian Indie Music, Rock Music in India, Playback Singers, Music Critics, Print Media, Digital Media, Streaming Platforms, Music Festivals in India, Indian Music Industry, NH7 Weekender, Sunburn Festival, Fan Magazines, Alternative Music Scene, Film Music Reviews, Cultural Preservation in Music, Algorithm-driven Music Discovery, Impact of Social Media on Music, Music Criticism, Emerging Artists in India, Challenges in Music Journalism

  • Introduction:

The role of music journalism in India is multifaceted, reflecting the diverse musical traditions that have evolved across centuries, ranging from classical forms like Hindustani and Carnatic music to contemporary genres such as Bollywood soundtracks, indie music, and fusion. As a mediator between artists and audiences, music journalism not only serves to inform and entertain but also contributes to shaping public perceptions and the evolution of music itself. However, the digital revolution has fundamentally transformed the landscape of music journalism, presenting both opportunities and challenges in an era dominated by social media, streaming platforms, and algorithm-driven content.

This paper seeks to examine the history and impact of music journalism in India, focusing on its influence on the development of Indian music, the promotion of artists, and the industry’s adaptation to modern media ecosystems. By tracing the evolution of music journalism from its early days in print media to the current dominance of online platforms, we aim to highlight the critical role this form of journalism plays in preserving India’s musical heritage while also nurturing new musical forms.

  • The Evolution of Music Journalism in India:
  • Early Beginnings:

Music journalism in India has a long history, particularly tied to print media that began flourishing during the colonial period. With the rise of newspapers and magazines in the early 20th century, music critics and journalists started to engage with classical music forms such as Hindustani and Carnatic, providing reviews of performances, discussions on the aesthetics of music, and commentaries on the emerging trends. Publications like The Illustrated Weekly of India and Shankar’s Weekly regularly featured music reviews and interviews with prominent musicians, thus setting the stage for a sustained dialogue between artists and audiences.

During the pre-independence era, music journalism primarily focused on classical forms, documenting performances and providing educational articles aimed at promoting cultural nationalism. The voices of renowned classical artists were amplified through such platforms, helping to codify what is considered the “classical” canon in India. Critics like B.V. Keskar, who played a significant role in All India Radio’s music programming, emerged as influential figures in shaping public taste and defining what constituted “good music.”

  • Bollywood and the Rise of Popular Music:

The 1950s and 1960s witnessed a seismic shift in Indian music journalism with the emergence of Bollywood and its associated music industry. Music became an inseparable part of Indian cinema, and film songs gained unprecedented popularity. This shift was mirrored in the content of music journalism, as magazines like Filmfare and Screen began covering Bollywood music extensively, reviewing soundtracks, discussing trends, and offering glimpses into the lives of playback singers and composers. Playback singers such as Lata Mangeshkar, Kishore Kumar, and Mohammed Rafi became household names, and music journalists played a significant role in shaping their public personas.

This period also saw the rise of “fan magazines,” which catered to the growing middle class’s fascination with film music and stars. These publications served not only as a source of entertainment but also as a platform for critical engagement with Bollywood music, discussing trends, influences, and the industry’s changing dynamics. Music journalists, while often focusing on the celebrity aspects of musicians, also provided space for critical discussions on the quality of music, the influence of Western genres, and the evolving tastes of the Indian public.

  • The Indian Rock and Indie Music Scene:

From the late 1980s onwards, India saw the emergence of an alternative music scene, particularly in urban centres like Mumbai, Delhi, and Bangalore. Rock bands like Indus Creed, Parikrama, and Indian Ocean began gaining popularity, and a new breed of music journalists emerged to cover this burgeoning scene. Publications like Rock Street Journal (RSJ) became key players in documenting the evolution of Indian rock and indie music, providing a platform for reviews, interviews, and features on underground bands that were largely ignored by mainstream media.

RSJ, in particular, is credited with nurturing the Indian indie music scene by giving voice to a generation of musicians who were experimenting with genres like rock, jazz, blues, and electronic music. These journalists not only helped shape the narrative around alternative music in India but also fostered a community of listeners who supported non-mainstream music. This period also saw the rise of fanzines and other grassroots publications, which played a crucial role in promoting local bands and organizing music festivals that have now become iconic, such as the NH7 Weekender and Sunburn Festival.

  • The Role of Music Journalism in Shaping Public Perception:
  • Cultural Preservation:

One of the primary functions of music journalism in India has been the preservation and promotion of its classical and folk traditions. Through in-depth coverage, interviews with maestros, and reviews of classical performances, journalists have played a pivotal role in keeping these forms alive, especially in an era where they might otherwise have been overshadowed by the dominance of popular music. Magazines like Sruti and columns in newspapers such as The Hindu have long provided spaces for critical engagement with classical music, helping both to document its evolution and to introduce it to newer generations.

For instance, Carnatic music, with its complex raga system and spiritual significance, has found a consistent place in music journalism, where critics have debated its innovations, reviewed concert seasons like the Chennai Margazhi festival, and spotlighted emerging artists. Similarly, Hindustani classical music has been chronicled in great detail, with critics offering insights into the gharana system, individual performances, and changing aesthetics within the genre.

  • Influencing Popular Music and Trends:

In terms of popular music, Indian music journalism has both reflected and shaped the tastes of the masses. From the early days of Bollywood soundtracks to contemporary pop and indie genres, music journalists have often served as gatekeepers, determining which artists and songs gain visibility and success. The review culture, particularly for film music, has had a profound impact on the success of soundtracks. Critics’ reviews in leading newspapers and magazines can influence audience perceptions, and positive reviews often contribute to a song or album’s commercial success.

Moreover, music journalists often serve as cultural critics, examining how music interacts with broader social and political contexts. For example, in recent years, the rise of independent music in India, often referred to as the “indie” scene, has been accompanied by a wave of journalistic coverage that not only reviews the music but also discusses its cultural significance. This genre, which includes artists like Prateek Kuhad, Ritviz, and Nucleya, has been framed by journalists as representative of a new, globalized Indian identity, one that blends Western influences with local elements.

  • Music Journalism in the Digital Age:

With the advent of the internet, the nature of music journalism in India has undergone a profound transformation. The rise of blogs, social media platforms, and music streaming services has democratized access to both music and music criticism. Today, anyone with a smartphone and internet access can become a music critic, and platforms like Twitter, Instagram, and YouTube have emerged as critical spaces for music discourse.

This has led to the decline of traditional print publications, with several long-running music magazines either shutting down or transitioning to digital formats. However, this shift has also given rise to a new generation of music journalists who utilize online platforms to reach a broader, more global audience. Websites like Rolling Stone India, The Wild City, and Score Magazine have embraced the digital age, offering multimedia content that includes written reviews, video interviews, and live-streamed performances.

In the digital space, music journalism also plays a crucial role in giving visibility to marginalized voices and alternative forms of music that may not fit within the commercial mainstream. The internet allows for the creation of niche communities around genres such as Indian hip-hop, EDM, and experimental music, providing a platform for artists and fans to connect and engage in dialogue.

  • Challenges Facing Music Journalism in India:
  • Decline of Print Media:

As with other forms of journalism, the decline of print media has had a significant impact on music journalism in India. Many music publications have struggled to survive in the face of dwindling subscriptions and advertising revenues. This has led to the consolidation of media houses and a reduction in the number of platforms available for in-depth music criticism.

While digital media has opened up new avenues, it has also contributed to the phenomenon of “clickbait” journalism, where the quality of music criticism is often sacrificed in favour of generating web traffic. Short-form reviews, listicles, and sensationalized headlines have become common, undermining the depth and rigor that traditionally characterized music journalism.

  • The Role of Streaming Platforms:

The dominance of music streaming platforms like Spotify, Apple Music, and YouTube has also changed the landscape of music journalism. These platforms, driven by algorithms, have replaced critics as the primary gatekeepers of music discovery. In this environment, the role of the music journalist has shifted from one of authority to that of a curator, helping listeners navigate the overwhelming volume of music available online.

Moreover, the reliance on algorithms has created an environment where popular artists receive the most attention, while emerging or alternative musicians struggle to gain visibility. Music journalists, therefore, have a vital role to play in highlighting underrepresented artists and genres, offering critical perspectives that go beyond the metrics of streaming numbers and chart rankings.

  • Conclusion:

Music journalism in India has played a crucial role in documenting the evolution of Indian music, from its classical roots to its contemporary forms. It has influenced public perception, promoted emerging talent, and provided a critical framework for understanding the broader cultural and social implications of music in Indian society. From its early beginnings in print media, with a focus on classical music and the rise of Bollywood, to the coverage of indie and alternative scenes, music journalism has not only reflected the changing tastes of audiences but also actively shaped them.

In the digital age, music journalism faces both unprecedented challenges and opportunities. The decline of print media, the rise of digital platforms, and the dominance of algorithm-driven music discovery have altered the role of the music journalist. While traditional models of criticism and gatekeeping are waning, the democratization of content creation has opened the door to more diverse voices, enabling a wider representation of genres, artists, and perspectives. Nevertheless, the challenge for music journalists remains the same: to maintain the depth, rigor, and cultural insight that has historically defined their craft, even as they adapt to the demands of a rapidly changing media landscape.

As the Indian music industry continues to evolve, embracing new genres, technologies, and global influences, music journalism will remain an essential part of this ecosystem. It will continue to preserve India’s rich musical heritage while championing new and experimental sounds, offering audiences not just a window into the world of music, but also a deeper understanding of its cultural significance. By providing critical analysis, fostering dialogue, and promoting a diversity of voices, music journalism will help ensure that Indian music continues to thrive, both within the country and on the global stage.

  • Bibliography and References:

Books:

  1. Bhattacharya Mehta, Rini, and Rajeshwari V. Pandharipande. Bollywood and Globalization: Indian Popular Cinema, Nation, and Diaspora. Anthem Press, 2011.
  • Booth, Gregory D. Behind the Curtain: Making Music in Mumbai’s Film Studios. Oxford University Press, 2008.
  • Dasgupta, Rohit K. Bollywood’s India: Hindi Cinema as a Guide to Modern India. Reaktion Books, 2016.
  • Dwyer, Rachel. Filming the Gods: Religion and Indian Cinema. Routledge, 2006.
  • Hesmondhalgh, David. The Cultural Industries. SAGE Publications, 2012.
  • Raja, Deepak. Hindustani Music: A Tradition in Transition. Bibliophile South Asia, 2006.
  • Sanyal, Ritwik, and Richard Widdess. Dhrupad: Tradition and Performance in Indian Music. Routledge, 2004.
  • Sruti Magazine archives. Various issues between 1980 and 2020.
  • Subramanian, Lakshmi. From the Tanjore Court to the Madras Music Academy: A Social History of Music in South India. Oxford University Press, 2006.

Journal Articles / Magazine Articles:

  1. Ghosh, Tanya. “How Streaming Services Are Shaping India’s Music Industry.” Variety India, 2021.
  • Gurbaxani, Amit. “The Rise of Indie Music in India.” Rolling Stone India, June 2017.
  • Khan, Zaid. “The Role of Algorithms in Music Discovery: India and Beyond.” TechCrunch India, 2021.
  • Sankar, Kiran. “Digital Journalism and the Streaming Revolution in India.” The Score Magazine, April 2020.

Interview:

  1. The Wild City. Ritviz and Nucleya interview, March 2020.

Tala and Rhythm in Rabindranath’s songs

Rima Dey, Research Scholar, Department of Performing Arts, Sister Nivedita University

Abstract:
Tala (rhythmic cycles) and rhythm hold a foundational role in the compositions of Rabindranath Tagore’s songs, which blend classical Indian music traditions with a distinctive poetic sensibility. Tagore’s approach to rhythm transcends mere metric patterns, embodying the nuanced moods, thematic content, and emotional depth of each song. In his compositions, tala is not only a structural component but also a vehicle for enhancing the expressive character of lyrics. By exploring the intricacies of Tagore’s rhythmic innovations, this study illuminates how he adapted and reinvented traditional talas, creating new rhythmic textures that resonate with both his poetic language and the thematic requirements of his compositions. The interplay between tala and melody in Tagore’s songs provides insight into his artistic vision and his contribution to modern Indian music. This paper examines Tagore’s approach to tala and rhythm, analyzing its impact on the listener’s experience and its significance in the broader context of Indian musicology.

Keywords:
Rabindranath Tagore, Tala, Rhythm, Indian Music, Tagore Songs, Poetic Expression, Melody, Rhythmic Innovation, Indian Musicology

রবীন্দ্রনাথের গানে তাল ও ছন্দ

রিমা দে, রিসার্চ স্কলার, পারফর্মিং আর্টস ডিপার্টমেন্ট,  সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি

রবীন্দ্রনাথ ,কবি , সাহিত্যিক, গীতিকার , নাট্যকার , সংগীত বিশ্লেষক এবং জীবনের প্রায় উপান্তে এসে চিত্র  শিল্পীও। এ যেন একের মধ্য শতক সম্ভার এবং তার সহস্র সার্থক প্রকাশ ।তবে তাঁর সৃষ্টির অন্যতম সার্থক নিদর্শন তাঁর গান।যা সর্বজন গৃহীত। এ গান যেন তৎকালীন সময়ের সামনে উত্তর আধুনিকতার প্রতীক।যাকে বাংলা সংস্কৃতির নবজাগরণ বল্লে অতিশয়োক্তি হবেনা।আমাদের দেশজ রাগ-রাগীনির বৈচিত্র্য এবং ব্যাপ্তি (বাংলার লোকগান, কীর্তন, পুরাতনী ইত্যাদি সকল প্রকার গান) তাঁকে আকৃষ্ট করে,সমভাবে তিনি প্রবল অভিসন্ধিৎসু হন বৈচিত্র্যময় “তাল” এর প্রতি। যার প্রভাবে অনবদ্য ছন্দের স্বাদ পেল তাঁর গান।তাল বিষয়ে কবির স্বচ্ছ নব চিন্তাভাবনা, তাঁর গানে নতুন তাল-ছন্দের প্রয়োগ এই বিষয়ে “সংগতচিন্তা” প্রবন্ধ সংকলনের “সংগীতের মুক্তি” প্রবন্ধে তাঁর মতামত “কাব্যে ছন্দের যে কাজ, গানে তালের সেই কাজ।” ব্যাকরণের যুক্তি মেনে গানের কথার সাথে তালের দাঙ্গার বরাবরের বিরোধী রবীন্দ্রনাথ, কবিতার কথার সাথে ছন্দের যে সক্ষতা, গানের কথার সাথে তালের সেইরূপ বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তাঁর কবিতা ও গান নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করেছেন।  “ তাল জিনিসটা সংগীতের হিসাব-বিভাগ। এর দরকার খুবই বেশী সে কথা বলাই বাহুল্য”।(সঃ মুঃ;

রবীন্দ্রনাথ) উদাহরণ হিসাবে পাই – 

“কাঁপিছে দেহলতা থরথর,

চোখের জলে আঁখি ভরভর।।

দোদুল তোমাদেরই বনছায়া তোমার নীলবাসে নিল কায়া,

বাদল-নিশীথেরই ঝরঝর

তোমার আঁখি-‘পরে ভরভর”।।

১২৩৪ এর ভাদ্রে “সবুজপত্র পত্রিকা”য় “সংগীতের মুক্তি” প্রবন্ধে এই কবিতাটি প্রথম গান রূপে

প্রকাশিত । এখানে লক্ষণীয় যে প্রতি লাইনে মাত্রা সংখ্যা ১১। কবিতার এই ছন্দকেই স্বরলিপিতে তালে

বাঁধা পাওয়া যায় (৩+৪+৪=১১ মাত্রা)।

                                                 ১      ২    ৩       ৪    ৫   ৬    ৭        ৮   ৯   ১০   ১১

। কাঁ   পি  ছে । দে   হ    ল    তা   ।  থ    র   থ      র ।

।চো   খে  র  । জ  লে  আঁ  খি   । ভ   র   ভ   র।‌‍

এই ছন্দের তালে কাব্য পাঠ করলেও কথার ভাবার্থ বজায় থাকে দেখা যায়। (একাদশী তাল। পরে আলোচনা করা হয়েছে।)

“কবিতায় যেটা ছন্দ,সংগীতে সেইটাই লয়।এই লয় জিনিসটি সৃষ্টি ব্যাপিয়া আছে,…………………………….এই লয়কে যদি মানি তবে তালের সঙ্গে বিবাদ ঘটালেও ভয় করিবার প্রয়োজন নাই” – এই যুক্তিতে কবির সাক্ষ এই কবিতা,

 “ ব্যাকুল বকুলের ফুলে

ভ্রমর মরে পথ ভুলে।

আকাশে কী গোপন বাণী

বাতাসে করে কানাকানি,

বনের অঞ্চলখানি

পুলকে উঠে দুলে দুলে”।।

‘সংগীত চিন্তা’য় কবির সরল স্বীকারোক্তি “এটা যে কী তাল তা আমি আনাড়ি জানি না”।এক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতি লাইনে মাত্রা সংখ্যা ৯ (৩+৬=৯) এবং এবারেও গানে এবং কবিতায় ছন্দে তালে কোন বিরোধ ঘটল না।কথার ভাবও থাকল অব্যাহত।(নবতাল, পরে আলোচনা করা হয়েছে।)

      এবার আমরা কবিতার ছন্দে কবি গানকে তালে বাঁধলেন কিভাবে তা সংক্ষিপ্তাকারে দেখে নেব। অনেক রবীন্দ্র গবেষক বলেন, তাঁর এই কাজ কবিতা পর্বকে তাল পর্বে চিহ্নিত করা কেবল, সেখানে বাড়তি সুরসংযোজন এর কারুকার্য নেই। মুদ্রিত স্বরে সুর বসানো মাত্র।

 উদাহরণ ১:- (৯ মাত্রার তাল)

            ১      ২     ৩       ৪    ৫     ৬     ৭    ৮       ৯

        ।  ব্যা    কু    ল ।  ব    কু   লে    র    ফু     লে ।

        ।   ভ্র     ম     র ।  ম    রে   প     থ    ভু     লে ।

        ।  আ    কা  শে। কী  গো  প     ন    বা     ণী ।

        ।  বা     তা    সে। ক   রে   কা    না  কা     নি । 

 এই গানটিই আবার ভিন্ন ছন্দেও স্বরলিপি পাওয়া যায় ‘গীতপঞ্চাশিকা’তে (পর পর দুটি স্বরলিপি আছে)। এখানে কবিতাটি ৫+৪=৯ ছন্দে ভাগ করা।গানের ছন্দ বজায় রাখতে কোথাও কোন অসুবিধা হলো না ।

 উদাহরণ  ২:- 

           ১     ২      ৩      ৪    ৫       ৬     ৭      ৮       ৯

        । ব্যা    কু    ল     ব     কু ।  লে     র     ফু      লে ।

        ।  ভ্র     ম    র      ম    রে ।  প      থ     ভু      লে ।

আবার ‘সংগীতের মুক্তি‘ প্রবন্ধে এই ৯ মাত্রার আরো একটি উদাহরণ আমরা পাই। যেখানে ছন্দ ৬+৩=৯ এ বিভক্ত।

উদাহরণ  ৩:-

    ১     ২     ৩     ৪      ৫        ৬     ৭      ৮        ৯

। যে    কাঁ    দ    নে     হি     য়া । কাঁ     দি     ছে ।

। সে    কাঁ    দ    নে     সে    ও ।  কাঁ    দি      ল  । 

। যে    বাঁ     ধ     নে    মো   রে । বাঁ      ধি    ছে ।

। সে    বাঁ     ধ    নে     তা    রে । বাঁ      ধি     ল ।

যদিও  কবিতার ছন্দকে গানের তালের ছন্দে মেলানতেই কবির আনন্দ ছিল, তবুও স্বরবিতান ১৬ তে এই গানটিতেই আরো তিন মাত্রা যোগ করে (৩+৩+৩+৩=১২) একতালে নিবদ্ধ স্বরলিপি রয়েছে ।হয়ত কবিতার ৯ মাত্রায় গীত গানটি সুখশ্রাব্য মনে হয়নি তাঁর , তাই পরিবর্তন করে গায়নরীতিতে স্বস্তি এনেছেন । ( এখানে এই প্রসঙ্গটি অপ্রাসঙ্গিক, তাই বিস্তারিত আলোচনা করা হলো না।)

উদাহরণ  ৪:-

“দুয়ার মোর পথপাশে,

সদাই তারে খুলে রাখি।

কখন তাঁর রথ আসে

ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি।”

এক্ষেত্রে লক্ষণীয় প্রতি লাইনে স্বর সংখ্যা ৯ । ৪-৫ বা ৬-৩ এ নয়-ছয় না করে কবিতার স্বর অনুসারে একটানা ৯ এ তাল যোগ করলেন কবি।

   ১     ২      ৩     ৪      ৫      ৬     ৭      ৮        ৯

। দু     য়া     র    মো     র     প     থ     পা      শে ।

। স     দা     ই     তা     রে    খু     লে    রা      খি ।

। ক    খ     ন      তা     র      র      থ    আ     সে  ।

।ব্যা    কু    ল      হ      য়ে     জা    গে  আঁ      খি  ।

কবিতার ছন্দকে গানের তালের সাথে মিলিয়ে দেবার আনন্দে কবির এই গবেষণা বলা যেতে পারে। তবে ‘নবতাল’, ‘একাদশী’ তালের নাম ‘সংগীতচিন্তা’য় উল্লেখ পাওয়া যায় না।

               এ পর্যন্ত ছন্দ যে নিয়মে কবিতায় চলে ,সেই নিয়মে গানকে তালবদ্ধ করার তাগিদে কবির যে চিন্তাধারা এবং তাল-ছন্দ বিভাগ ‘সংগীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে উদাহরন সহ কবি দেখিয়েছেন তা আলোচনা করা হলো; এবার তাঁর গানে তালের সর্বাঙ্গীন ব্যবহার সম্বন্ধে আমরা সংক্ষিপ্তকারে নজর দেব। পরিচিত গতে-বাঁধা পথ ধরেই সর্বদা নতুন পথ সৃষ্টি করা কবির সহজাত, তার নিদর্শন তাঁর সৃষ্টি সম্ভারে আমরাপ্রতিনিয়ত পাই।সাধারণত উত্তর ভারতীয় সংগীতে প্রচলিত সব তালেই প্রায় রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেছেন।তাছাড়াও নতুন তাল সৃষ্টিতে কবি নিপুনতার দাবী রাখেন। ‘নবতাল’ এর বিভিন্ন ছন্দ ও গানের উদাহরণ আমরা আগেই জেনেছি। ষষ্ঠী, ঝম্পক, অর্দ্ধঝাঁপ, রূপকড়া, একাদশী, নবপঞ তালের স্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই কৃতিত্ব দেওয়া হয়। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দক্ষিন ভারতে প্রচলিত কিছু তালের নমুনা পাওয়া যায় যাদের চলন বড় বিচিত্র।বাংলার কীর্তনে কিছু তাল প্রচলিত আছে যেগুলি অন্যান্য কোন সংগীতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় না, বা ব্যবহার করা হয় না।কবি সম্ভবত এই তালগুলি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন তাল সৃষ্টি করলেন। যেমন, দক্ষিণ ভারতের ‘সারতাল’ (৩।২।২)এর সাথে ‘রূপকড়া’ তালের মিল পাওয়া যায় ।কর্ণাটি ‘দুষ্কর’ তালের মাত্রা (৫।২।২) সংখ্যা এবং বরীন্দ্রনাথের ‘নবতাল’ এর মাত্রা সংখ্যা ৯। কর্ণাটি ‘মণিতাল’, ‘বিন্দুতাল’, ‘নীলতাল’ এবং রবীন্দ্রনাথ কৃত ‘একাদশী’ সমতুল্য (৩।২।২।৪)। তবে তাঁর সৃষ্ট নতুন তালগুলিতে ফাঁকের হিসেব রাখেননি কবি,হয়তো তালের ওজন কোথাও ক্ষুন্ন না হয় সেই চিন্তাধারায় ।কবিতার ছন্দে তাল, গানের তাল- ছন্দ সমগ্র বিষয়টি তাঁর সুদক্ষ চিন্তাধারায় যেভাবে প্রকাশিত তার আভাস নিম্নে আলোচিত করা হলো  –

 ২|২  ছন্দ; বলা হয় সমপদী তাল (নামকরণ হয়নি)। মাত্রা সংখ্যা: ৪

     ১              ২          ৩            ৪           ১

। ধাগে    তেটে । তাগে    তেটে । ধাগে

     +                         ২                         +

গান:-  ১. আজি ঝরঝর মুখর বাদরদিনে

             ২. এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে

             ৩. মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে

             ৪. সবারে করি আহ্বান।

অখন্ড ৪ মাত্রা ছন্দ। সমপদী তাল(নামকরণ হয়নি)। মাত্রা সংখ্যা: ৪

   ১    ২      ৩    ৪        ১

। ধা   ধা    ধি    না ।  ধা

+                                  + 

গান:-  ১. নির্জন  রাতে নিঃশব্দ চরণখানি

 ৩।২ ছন্দ। ঝম্পক তাল। বিষমপদী। মাত্রা সংখ্যা: ৫

    ১       ২      ৩      ৪       ৫       ১

। ধি      ধি     না ।  ধি      না ।  ধি

    +                    ২               +

গান:-  ১. আমারে যদি জাগালে আজি 

             ২. এই লভিনু সঙ্গ তব

             ৩. বিপদে মোরে রক্ষা করো

          ৪. নিবিড় অমা তিমির হতে

২।৩ ছন্দ। অর্দ্ধঝাঁপ তাল । বিষমপদী । মাত্রা সংখ্যা: ৫

   ১        ২     ৩      ৪     ৫    ১

। ধি     না । ধি     ধি    না । ধি

  +                 ২                       +

গান :- ১. একদা তুমি প্রিয়ে

          ২. তোমার আমার এই

          ৩. দীপ নিবে গেছে মম

          ৪. মিলনরাতি পোহালো

২।৪ ছন্দ । ষষ্ঠী তাল । বিষমপদী । মাত্রা সংখ্যা: ৬ (দক্ষিণ ভারতীয় ‘পত্তি’ তালের তুলনীয়)

    ১      ২      ৩       ৪        ৫         ৬        ১

। ধি     না ।  ধিন     ধিন    নাগে     তেটে । ধি

    +                 ২                                                  +

গান:-  ১. এবার এল সময়ের তোর

          ২. কে রঙ লাগালে বনে বনে

          ৩. নিদ্রাহারা রাতের এ গান

          ৪. মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে

          ৫. শ্যামল ছায়া নাইবা গেলে

[বিঃ দ্রঃ: – যদিও রবীন্দ্রসৃষ্ট তাল হিসাবে ‘ষষ্ঠী’ চিহ্নিত, কিন্তু হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৩ তে প্রথম

ব্রহ্মসংগীতে এইরূপ তাল ব্যবহার করেন পাওয়া যায়।তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে ‘চপক’ নামে সমরূপ একটি তালের উল্লেখ পাওয়া যায় ।]

৪।২ ছন্দ। বিষমপদী তাল ( নামকরণ হয়নি) । মাত্রা সংখ্যা: ৬

   ১       ২      ৩        ৪         ৫      ৬         ১

।ধা     গে     তে      টে ।   ধা      গে ।   ধা

   +                                         ২                 +

গান:- ১ . হৃদয়  আমার প্রকাশ হল

অখন্ড ৬ মাত্রা । নামকরণ হয়নি। মাত্রা সংখ্যা: ৬

   ১      ২      ৩        ৪         ৫        ৬      ১

। ধি     না      না      ধি       না        ধি । ধি

   +                                                  +

গান: – ১. একটুকু ছোঁয়া লাগে

            ২. জয় ভৈরব জয় শঙ্কর

           ৩. ধীরে বন্ধু গো, ধীরে

           ৪. হিমগিরি ফেলে নীচে নেমে এলে

 ৩। ৪ ছন্দ। বিষমপদী (নামকরণ হয়নি)। মাত্রা সংখ্যা: ৭ (শাস্ত্রীয়  ‘পোস্তা’ তালের সমরূপ)

     ১       ২       ৩       ৪         ৫         ৬        ৭        ১

।  ধা    দেন     তা  ।  তেটে    কতা    গদি    ঘেনে । ধ

    +                                   ২                                               +

গান :-  ১. তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি

           ২. তোমার  বৈশাখে ছিল

৩।২।৩ ছন্দ। রূপকড়া তাল । বিষমপদী। মাত্রা সংখ্যা: ৮ [দক্ষিণ ভারতীয় ‘মতং’ তালের সমরূপ]

     ১       ২      ৩     ৪       ৫     ৬      ৭      ৮     ১

।  ধি      ধি      না ।  ধি      না ।  ধি      ধি      না ।   ধি

    +                        ২               ৩                       +

গান:-  ১. কেন সারাদিন ধীরে ধীরে

           ২. কত অজানারে জানাইলে তুমি

          ৩. গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে

          ৪. শরৎ আলোর কমল বনে

৩।২।২ ছন্দ। নবতাল । বিষমপদী । মাত্রা সংখ্যা: ৯

     ১      ২       ৩         ৪            ৫          ৬         ৭          ৮             ৯         ১

।  ধা    দেন্    তা । তেটে    কতা । গদি     ঘেনে । ধাগে     তেটে । ধা

    +                        ২                  ৩                        ৪                  ১

গান :- ১. নিবিড় ঘন আঁধারে

          ২. প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে

বিঃ দ্রঃ- প্রাচীন তালশাস্ত্রে ৯ মাত্রার তালের উল্লেখ পাওয়া যায় । রবীন্দ্রনাথের ৯ মাত্রার তাল-ছন্দের Experiment এর উৎসাহ সেখান থেকেও হতে পারে। প্রসঙ্গত ৩+৬ , ৬+৩ , ৫+৪ , অখন্ড ৯ মাত্রার আলোচনা আমরা আগে করেছি। তালের ঠেকা তবলায় এবং পাখোয়াজ এ ভিন্ন। আবার গানের কথা ও পরিবেশনার প্রক্ষিতে ভিন্ন ভাবে বাদক তাল পরিবেশন করেন। এখানে প্রচলিত ঠেকা ব্যবহার করা হয়েছে।

      এখানে রবীন্দ্রনাথের গানে যে ছন্দ বিভাগ পাওয়া যায় সেগুলি ঠেকা সহ আমরা দেখে নেব । (আগে আলোচিত তাল ছন্দগুলি ব্যাতিরেখে)

# অখন্ড ৯ মাত্রা। নামকরণ হয়নি

     ১       ২       ৩       ৪      ৫      ৬      ৭        ৮        ৯      ১

।  ধা    দেন্    তা     ক     তা     গ     দি      ঘে       নে  ।  ধা

     +                                                                                          +

গান :- দুয়ার মোর পথপাশে

# ৫।৪ ছন্দ । নামকরণ হয়নি 

    ১    ২       ৩      ৪       ৫     ৬      ৭        ৮       ৯     ১

।  ধা    ধি     না     ধি      না । ধা     ধি       ধি      না ।   ধা         

    +                                            ২                                     +

গান :- ব্যাকুল বকুলের ফুলে

# ৩।৬ ছন্দ। নামকরণ হয়নি

 ১        ২       ৩      ৪      ৫      ৬       ৭        ৮       ৯      ১

। ধা     ধি      না ।  ধা      ধি      ধি       না        ধি          না ।   ধি

   +                           ২                                                                  +

গান :- ব্যাকুল বকুলের ফুলে 

# ৬।৩ ছন্দ । নামকরণ হয়নি

   ১          ২         ৩            ৪           ৫       ৬      ৭       ৮       ৯     ১

। ধিন্    ধিন্     ধাগে    তেটে    ধিন্    না  ।  ধি      ধি      না  । ধা

   +                                                                           ২                        ১

গান:- যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে

# ৫।৫ ছন্দ । নামকরণ হয়নি  [ পূর্বে আলোচিত কবিতার ছন্দ, গানের ছন্দ মেলানো পরীক্ষার আরেকটি

উদাহরণ। ]

১         ২        ৩       ৪        ৫      ৬       ৭        ৮         ৯          ১০   ১

।ধা     ধি       ধি      না       ধি  ।  না       ধি       ধি        না        তি ।  ধা

+                                                      ‌‍‌২                                                     +

গান:- ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল

# ৩।২।২।৪ । একাদশী 

  ১         ২      ৩       ৪          ৫         ৬         ৭          ৮           ৯         ১০         ১১        ১

। ধা   দেন   তা । তেটে   কতা । গদি   ঘেনে । ধাগে    তেটে   তাগে   তেটে । ধা

  +                            ২                           ৩                    ৪                                   +

(পাখোয়াজ এর বোল দেওয়া হল।দক্ষিণ ভারতীয় তালের প্রসঙ্গ পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। )

গান:-  দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া

#  ৩।৪।৪ ছন্দ । নামকরণ হয়নি

    ১      ২     ৩      ৪      ৫      ৬      ৭      ৮       ৯     ১০     ১১      ১

। ধা   দেন্   তা । কৎ   তাগে  দেন্   তা । তেটে   কতা   গদি   ঘেন । ধা

    +                           ২                                      ৩                                             +

গান:-  কাঁপিছে দেহলতা থরথর

২।৪।৪।৪।৪ ছন্দ । নবপঞ্চ তাল 

    ১      ২ ।   ৩     ৪    ৫     ৬  ।    ৭      ৮       ৯     ১০ ।

। ধা   গে । ধা   গে   দেন্   তা । কৎ    তাগে   দেন্    তা ।

  +                 ২                          ৩

  ১১      ১২      ১৩     ১৪        ১৫      ১৬      ১৭       ১৮         ১

তেটে    কতা   গদি    ঘেনে । ধাগে    তেটে   তাগে   তেটে ।  ধা

   ৪                                        ৫                                       +

গান:- জননী তোমার করুন চরণখানি

        দেখা গেল রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্ট তালগুলিতে ফাঁকের ব্যবহার করেননি।অর্থাৎ বলা যেতে পারে ছন্দে লয়ে গান, গানের কথার ভাব প্রকাশকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। যদিও ঝম্পক, অর্দ্ধঝাঁপ, ষষ্ঠী, রূপকড়া,নবতাল, একাদশী ও নবপঞ্চ রবীন্দ্রসৃষ্ট তাল বলে পরিচিত ,কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে এই তালগুলির নামকরণ করেছিলেন এমন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না।বিশ্বভারতী প্রকাশিত স্বরলিপি গ্রন্থসমূহে এই তালগুলির নাম পাওয়া যায়। 

        উপরি উল্লিখিত তালগুলি ছাড়াও  রবীন্দ্রনাথের গানে ৬ থেকে ১৮ মাত্রা পর্যন্ত তালের প্রয়োগ আমরা পেয়ে থাকি।রবীন্দ্রগানে যে তালগুলির প্রয়োগ পাওয়া যায় তার একটি তালিকা (একটি করে গানের উদাহরণ সহ ) নিম্নে প্রদত্ত হল – 

৬ মাত্রার তাল (৩।৩) ‘দাদরা’  – আলো আমার আলো ওগো 

৭ মাত্রার তাল (৩।২।২) ‘তেওরা’ – আমার মাথা  নত করে

৭ মাত্রার তাল (৩।২।২) ‘রূপক’  – হে মন তাঁরে দেখো

৮ মাত্রার তাল (৪।৪) ‘কাহারবা’ – অগ্নিশিখা এসো এসো

৮ মাত্রার তাল (২।২।২।২) ‘যৎ’  – কেন জাগে না

১০ মাত্রার তাল (২।৩।২।৩) ‘ঝাঁপতাল’ – প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী

১০ মাত্রার তাল (৪।২।৪) ‘সুরফাঁকতাল’ – প্রতিদিন তব গাথা

১২ মাত্রার তাল (৩।৩।৩।৩) ‘একতাল’ – মন্দিরে মম কে

১২ মাত্রার তাল (৩।৩।৩।৩) ‘খেমটা’ – এরা পরকে আপন করে

১২ মাত্রার তাল (৩।৩।৩।৩) ‘আড়খেমটা’ – আমার প্রাণের পরে 

১২ মাত্রার তাল (২।২।২।২।২।২) ‘চৌতাল’ – বাণী তব ধায়

১২ মাত্রার তাল (৪।৪।৪) ‘চতুর্মাত্রিক একতাল’ – নয়ান ভাসিল জলে

১৪ মাত্রার তাল (২।৪।৪।৪) ‘আড়া চৌতাল’ – শুভ্র আসনে বিরাজ

১৪ মাত্রার তাল (৩।২।২।৩।৪) ‘ধামার’ – জাগে নাথ জোছনা রাতে

১৪ মাত্রার তাল (৩।৪।৩।৪) ‘দীপচন্দ্রী’ – মেঘ বলেছে যাব যাব

১৫ মাত্রার তাল (৪।৪।৪।৩) ‘পঞ্চমসওয়ারী’ – আজি মোর দ্বারে

১৬ মাত্রার তাল (৪।৪।৪।৪) ‘ত্রিতাল’ – রাখো রাখো রে জীবনে

১৬ মাত্রার তাল (৪।৪।৪।৪) ‘ঢিমা ত্রিতাল’ – আজি মম জীবনে

(ঠেকা আলোচনা করা হল না বিষয়টিকে আরো দীর্ঘায়িত না করার তাগিদে)।  এগুলি ছাড়া একটি গানে বিভিন্ন তালের প্রয়োগ আছে তেমন কিছু গানও আমরা পাই। যেমন: আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে, নৃত্যের তালে তালে প্রভৃতি।

         রবীন্দ্রনাথের গান এক অনন্ত সাগর। বর্তমান সময়ে যখন সারা বিশ্বের সংগীতের সঙ্গে সব

প্রজন্মের নিত্য পরিচিতি ঘটছে, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতকার রবীন্দ্রনাথের কালোত্তীর্ণ সুরগুলি বৈচিত্র্যময় তাল এর সমারোহে সমকালীন সংগীতের প্রতিভূ রূপে আত্মপ্রকাশ করছে। তাঁর চিন্তাধারার একটি দিক এই স্বল্পপরিসরে আলোচনা করা হল। 

উল্লেখপঞ্জী:-

১. ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ,  সংগীতচিন্তা (পৃষ্ঠা: ৫৮, ৫৯), বিশ্বভারতী

২. প্রজ্ঞানানন্দ স্বামী, সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান  (পৃষ্ঠা:৪৭), শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ

৩.  বসু অরুণকুমার, রবীন্দ্রসংগীতের রূপ-রূপান্তর (পৃষ্ঠা:১৭৪), দে’জ পাবলিশিং 

৪.  ঘোষ ইন্দ্রাণী, রবীন্দ্রসংগীতে তাল ও ছন্দ বৈচিত্র্য, রবীন্দ্রসংগীত (পৃষ্ঠা: ৯৪) রবীন্দ্রভারতী

বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা

লেখিকা পরিচিতি:- 

রিমা দে

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।

রিসার্চ স্কলার, পারফর্মিং আর্টস ডিপার্টমেন্ট,  সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি।

যোগাযোগ: 9433345582 (Whatsapp)

Mail : rimadoc2024@gmail.com

Rabindranath Tagore and Lalon Shah

Dr. Srabani Sen Associate Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College, Email: srabanisn1@kami Mobile no- 6290855102

Abstract
Lalon Shah is celebrated as one of the most influential figures in the Baul tradition, lastingly impacting Bengali music and spirituality. His songs, deeply embedded in the oral tradition, resonated profoundly with the common people. Lalon’s philosophy was radical for its time, rejecting societal distinctions based on caste, class, and creed, and denouncing racism and religious conflicts. His teachings on humanism and inclusivity remain significant in today’s world, offering a pathway to universal humanity. Lalon’s profound simplicity and spiritual depth left a lasting impression on Rabindranath Tagore, inspiring a philosophical and stylistic transformation in his poetry. Tagore’s engagement with Lalon’s existential humanism reshaped his worldview, infusing his work with Baul-inspired themes of devotion and unity.

Keywords: Lalon Shah, Baul tradition, existential humanism, Rabindranath Tagore, Bengali philosophy, oral tradition, universal humanity, caste and creed

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লালন শাহ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লালন শাহ ফকির দুজন ভিন্ন সাংস্কৃতিক বৃত্তের মানুষ। প্রথমজন উনিশ শতকের কলকাতার অভিজাত ঠাকুর পরিবারের সন্তান ও অন্যজন অনভিজাত পল্লীসন্তান। লালনের ছিল সমন্বয়কামী উদারতা এবং বহুজনের সঙ্গে সংযোগ-ধর্মনির্লিপ্ত অবস্থান। লালন যে শুধু ভাবমগ্ন গীতিকার ছিলেন তা নয়, ছিলেন সংগঠক ও প্রচারকারী। লালন নিজেকে এক ভাবসাধকরূপে বৃত্তায়িত না রেখে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমাবেশে ও সংগ্রামে।

 লালন ফকিরের জীবন ও গানই তাঁর প্রাথমিক জনপ্রিয়তার কারণ। বিশেষত সেকালের নিম্নবর্গে ও গ্রামীণ বঙ্গে। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম সমাজের প্রান্তিক মানুষ রূপে বাউল ফকিররা বেঁচে  থাকত মাধুকরী করে। নিজেদের আখড়ায় নিজেদের মতে সাধন ভজন করে, গান গেয়ে। গ্রাম সমাজের কাছে তারা না ছিল সমাদৃত, না ঘৃণিত। শান্ত, ভক্তিমান, উচ্চাসাহীন এই বর্গের রহস্যমাখানো গান  মধ্যবিত্ত শহরবাসীর কাছে একসময় ভোগ্যপণ্য হয়ে উঠে, বিশেষত তারা এসব গানে খুঁজে পায় সমাজসত্যের দ্যোতনা আর উচ্চবর্গের শোষণ দমনের প্রচ্ছন্ন ইতিহাস। লালন আর দুদ্দু শাহের গানে, পাঞ্জু শাহ বা হাসন রাজার বাণীময়তায় খুঁজে পায় মধ্যবিত্ত ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যের নানা সারকথা। উনিশ শতকে রুচিমান শিক্ষিত সমাজে লালন গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন কাঙাল হরিনাথ, অক্ষয় কুমার মৈত্র, মীর মশাররফ ও জলধর সেনের প্রয়াসে। ঠাকুর পরিবারও বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের কাছে তাঁর প্রচারে অংশ নেয়। বলা যায় রবীন্দ্রনাথের পক্ষে লোকায়ত সাধকদের সঙ্গে সংযোগ সাধনও অনেকটা প্রাণের টানে। পদ্মাতীরবর্তী শ্যামশোভাময় গ্রামগুলোর নিরক্ষর মানুষগুলোর মূক মুখে ভাষা দেবার সংকল্প ছিল তাঁর।

লালনের ধর্মমত নিভৃত পল্লীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্ম মতের মধ্যে অন্যতম এক গৌণধর্ম (Minor sect), যাতে মিশেছে মুসলমান ও জৈন ধর্মের স্রোত। লোকায়ত সাধনার আদর্শায়নে তথা ভাবে লালনের সাধনপথ পুরোপুরি ভাবায়িত নয়, তা পরম দেহতত্ত্বের জটিল ও রহস্যময় আচরণবাদে নিগূঢ় বস্তুবাদী। লালন গীতির অন্তর্বাণী মরমি মানুষদের জন্য, যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, জাতপাত ও স্থান মাহাত্ম্যের অনেক ঊর্ধ্বে তাঁকে যথার্থ আসনে বসিয়েছেন। লালনের দার্শনিক ভাবনার অভিনবত্ব, মানব প্রেম, মানুষকে জাতপাতের খন্ড সীমানায় না দেখার দৃষ্টি, আত্মতৃপ্তি, প্রশান্তি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে। এমন মহান সৃষ্টিশীল মানুষ ভাবের আবেগে বাউল গান রচনা করতেন, গানের মাধ্যমে সাধনার কথা বলতেন। 

 পারিবারিক সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ লালন সাঁইয়ের কথা প্রথমে জেনেছিলেন বলে অনুমান করা যায়।

ঠাকুরবাড়ির অনেকের সঙ্গেই যেমন- সত্যেন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের আলাপ-পরিচয় ছিল। সেই সুবাদে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে লালনের যাতায়াত ও সমাদর ছিল। প্রধানত কলকাতার ঠাকুর পরিবার তাঁদের শিলাইদহ- কুষ্টিয়া ও পাবনা-সাজাদপুরে জমিদারী পরিচালনা সূত্রে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন ওই অঞ্চলের বাউলদের। তাদের ধর্মকর্ম বা আচরণে নয়, ঠাকুর পরিবার আকৃষ্ট হন তাদের গানের ভাবে ও সুরে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাউলদের সম্পর্কে অনুকম্পায়ী ও  গুণগ্রাহী। লালন ও গগন  হরকরার গানে তারা বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের ভাগ্নি সরলা দেবী সংগ্রহ করেছিলেন অন্য অনেক বর্গের লোকায়িত গান। ‘বীণা বাদিনী’ পত্রিকায় ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী লালনগীতির স্বরলিপি প্রকাশ করেন। বাঙালি সমাজে লালন সম্পর্কে সন্ধিৎসা ও আগ্রহ জাগাতে রবীন্দ্রনাথও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এইসব মরমি সাধকের পরিচয়ের পরিধি প্রসারে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াস ছিল প্রেরণাসঞ্চারী। রবীন্দ্রনাথ প্রথম লালনের গানের উল্লেখ করেন ভাদ্র ১৩১৪ এর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’- লালনের এই একই গানের উল্লেখ মেলে ‘জীবনস্মৃতি’ (১৩১৯) গ্রন্থের ‘গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ’ অধ্যায়ে।

 শিলাইদহে জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের পর লালনের গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়। শিলাইদহের মরমি কবি গগন হরকরার কণ্ঠে তিনি লালনের গান শোনেন। লালন-শিষ্যদের সাহচর্যও তাঁকে লালনের গান শোনার সুযোগ করে দেয়। লালনের গানের সুরের বৈচিত্র্য, বাণীর কাব্যময়তা ও উচ্চাঙ্গের তত্ত্বকথা তাঁকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে। বাংলার মূল বিদ্বজ্জনের চেতনা-প্রবাহে, বৃহত্তর বাঙ্গালীদের কাছে লালন প্রথম পরিচিতি পান ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ ভারতী’ পত্রিকায় সরলা দেবীর রচনায়। লালনের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে, ১৩০২ সালের ভাদ্র সংখ্যায়, ‘লালন ফকির গগন’ নামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এতে আটটি লালনের গান, দুটি গগনের এবং একটি ভণিতাহীন গান মুদ্রিত হয়।

 রবীন্দ্রনাথ সরলা দেবীর কাছে শোনা বেশ ক’টি লৌকিক গানের সুর নিয়ে নতুন গান বেঁধেছেন অনেক বছর পরে। সরলা দেবী জানিয়েছেন ‘ভারতী’ পত্রিকায়-কুষ্টিয়ার সন্নিহিত প্রদেশে সামান্য বৈরাগীর মুখে তাঁর (অর্থাৎ লালন) ও তাঁহার কোন শিষ্যের রচিত কতিপয় গান শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া তাহাদের কতকগুলি গান সংগ্রহ করিয়াছিলাম। অধিক সংগ্রহের সময় ছিল না, যে কয়টি পাইয়াছি, তাহাই পাঠকদের উপহার দিতেছি। ১

  সরলাদেবী সংগৃহীত গগনের দুটি গানের সুর যা ‘ভারতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত, রবীন্দ্রনাথকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে ১৩১২ সালে ( ১৯০৫) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষ্যে তিনি সেই সুরে দুটি নতুন গান রচনা করেন। গগনের গান দুটির প্রথম পংক্তি হল – ‘আমি কোথায় পাব তারে’ এবং ‘ও মন, অসার মায়ায় ভুলে রবে’। এই দুটির ভাঙ্গা রবীন্দ্রগান হল ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’। বাউল গানের সুর বিন্যাসের ছক রবীন্দ্রগীতিপ্রতিভার দেশোদ্দীপনার গানে বদলে গেছে। গগনের গানের সুর ও চাল রবীন্দ্রনাথকে যতখানি টেনেছিল লালনের গানের সুর ততটা টানে নি। তাই লালনের সুর ভেঙে রবীন্দ্রনাথ বেশি গান রচনা করেন নি।

  লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল এমন সুনশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। লালনের আখড়া ও তাঁর সংস্কার পুনর্নির্মাণের সূত্রেই লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা বিচিত্র যোগাযোগের বার্তা আমরা পাই। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ লালনের সমাধি অঞ্চলের অর্থাৎ ছেউড়িয়ার জমিদার ছিলেন। তাই লালন শিষ্য মনিরুদ্দিন সা জমিদার রবীন্দ্রনাথ সকাশে যে আবেদনপ্র পাঠান তার থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে প্রজা লালনের আখড়ার লালন পালনে সংরক্ষণে জমিদারের কিছু দায় ছিল। লালন প্রয়াণের পর ১৮৯০ সালে এবং ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঐ অঞ্চলের প্রজাপালনের দায়িত্ব পান। তার আগে জমিদারি তত্ত্বাবধানের সূত্রে লালন সঙ্গে যোগাযোগ হয় মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ও মেজ বৌদি জ্ঞানদানন্দিনীর, নতুনদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের চিঠির সূত্রে জানা যায় সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুরেন্দ্রনাথও লালনকে প্রত্যক্ষভাবে জানতেন। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবী ১৮৯৫ সালে তার সম্পাদিত’ ভারতী’ পত্রিকায় ‘ লালন ও গগন’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন  যা ‘হিতকরী’-র প্রতিবেদনের পরবর্তী প্রয়াসে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘ বীণা- বাদিনী’  পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি ইন্দিরা দেবী ১৮৯৫  আর ১৮৯৯ সালে ‘পারমর্থিক গান’ আখ্যা দিয়ে লালনের দুটি গানের স্বরলিপি প্রকাশ করেন। লালনগীতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্বরলিপি হিসেবে এই দুটি গানের ঐতিহাসিক মূল্য আছে। গানগুলোর অভিনবত্ব, গূঢ় আধ্যাত্মিকতা এবং রহস্যময় (maystic) উদ্ভাষণ এতই আকর্ষণীয় ও অনুভবনীয় যে রবীন্দ্রনাথ নিজে উদ্যোগ করে সেই গানের খাতা সংগ্রহ করেছেন, ব্যক্তিগত হেফাজতে রেখেছেন। শিলাইদহে অবস্থানকালে লালনের গান সংগ্রহের উদ্যোগ তাঁর। ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে তিনি মনিরুদ্দীন শাহ- লিপিকৃত লালনের গানের দুটি পুরনো খাতা সংগ্রহ করেন, যা এখনও বিশ্বভারতীর ‘রবীন্দ্রভবন’ এর সম্পদ। এই দুটি খাতা প্রতিলিপি-সংস্করণ ‘রবীন্দ্রনাথ- সংগৃহীত লালনের গানের পান্ডুলিপি’ আবুল হাসান চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিলাইদহ ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্য লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপকরণ এবং সেইসঙ্গে লালনের কিছু গান সংগ্রহ করেন।২

 ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কুড়িটি লালনগীতি স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করেছিলেন তার সংগৃহীত খাতা থেকে অনুলিপি করে। লালনের গান সম্পর্কে তাঁর এতটাই আসক্তি ছিল যে তাঁর সংগৃহীত গানের খাতার দুর্বোধ্য পাণ্ডুলিপির কোনও কোনও শব্দ (যা আঞ্চলিক ও অপ্রচলিত) বিশেষ যত্ন নিয়ে পড়ে তার শিষ্টরূপটি খাতার মার্জিনে লিখেরেখেছেন। শব্দের অক্ষর গঠনের ছাঁদ এবং শুদ্ধ বানান লেখা বেশ কঠিন। ফলে রবীন্দ্রনাথকে তার পাঠোদ্ধারে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তার উপরে লালনের রচনায় ছিল কুষ্টিয়া অঞ্চলের বেশ কিছু নিজস্ব লব্জ। যেমন-

        ১। মন আমার কুসর-মলা জাঠ হল রে।

২। পিতৃধন তোর নিল চোরে

                     হলি রে মন ফোকতাড়া।

৩। কাজ দেখি পাগলের মতন

                     কথায় যেমন কাঠফাড়া। ৩

লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছিল। লালনের প্রয়াণের পর শিষ্য-প্রশিষ্যর অবস্থান ক্রমেই দ্বন্দ্বে ও বিরোধে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনে রয়েছে দুখানি লালনগীতির খাতা যেখানে লালনের হস্তচিহ্ন স্পষ্ট পাওয়া যায়। । দুটি খাতারই আখ্যাপত্রে লেখা আছে Songs of Lalon Fakir- Collected by Rabindranath। মোট গানের সংখ্যা ২৯৮। গানের পান্ডুলিপীর হস্তাক্ষর অত্যন্ত দুর্বল ও অপরিচ্ছন্ন। তাতে কোথাও কোথাও রবীন্দ্রহস্তাক্ষরে সঠিক পাঠ লেখা আছে।  লালন গীতি সংগ্রহের অভিজ্ঞতা তিনি নিজেই লিখেগেছেন : I remember  how troubled they were,  when I asked some  of them to write down for me a collection of their songs. When they did verture to attempt it. I found it almost impossible to decipher their writing – the spelling and lettering were so outrageously in conventional. ৪

  ঠাকুরবাড়ির আলোকপ্রাপ্ত সদস্যরা যে লালন ফকির সম্পর্কে এত  উৎসাহ  ছিলেন।  লালনের গানে অচিন পাখি-র মায়া রবীন্দ্রনাথকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তিনি  উচ্ছ্বাসভরে লেখেন ও ভাষণে বলেন :  That  this unknown Is the profound reality, though difficult of comprehension, is equally  admitted by the English poet as by the nameless village singer of Bengal, in whose music vibrate the wing-beats of the unknown  bird, only Shelley’s utterance is for the cultured few, while the Baul song is for the tillers of the soil, for the simple folk of our village households,  who are never bored by the mystic transecendentalism. ৫

 ‘প্রবাসী পত্রিকায় বৈশাখ ১৩২২ থেকে লোকসাহিত্য-সংগ্রহ প্রকাশের ‘হারামণি’ নামে একটি নতুন বিভাগ প্রবর্তিত হয়। ১৩২২ এর আশ্বিন থেকে মাঘ পর্যন্ত চার কিস্তিতে রবীন্দ্র- সংগৃহীত লালনের মোট কুড়িটি গান প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে মাত্র একটি গান ভবনে রাখা খাতা থেকে গৃহীত। এ থেকে ধারণা হয় রবীন্দ্রনাথ অন্য সূত্র অর্থাৎ লালন- শিষ্য কিংবা শিলাইদহের কোন বাউলের সৌজন্যেও লালনের গান সংগ্রহ করেছিলেন।

 রবীন্দ্রনাথ ও লালনের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে বিতর্ক আছে। এই সাক্ষাতের পক্ষে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য বা প্রামাণ্য বিবরণ পাওয়া যায় না, কেবল জনশ্রুতি ও অনুমানই ধারণার উৎস। লালনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতন পল্লীসেবা বিভাগের গ্রামসেবার কাজের ধারা নির্ধারণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিদেব ঘোষের পিতা কালীমোহন ঘোষকে বলেছিলেন :

 তুমি তো দেখেছো শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগণের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। তারা গরীব। পোশাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার যো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারত। ৬

 এই উক্তি থেকে ধারণা জন্মায় যে রবীন্দ্রনাথ লালন নন, তার শিষ্যদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, বাউলপন্থা নিয়ে তাঁর কৌতুহল ছিল, বাউল গানের সুরকাঠামো তাঁর সাংগীতিক মানসে স্থায়ী ছাপ রেখেছিল। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হোক আর নাই হোক, একথা স্বীকার করতেই হয় যে, রবীন্দ্রনাথের লালন-আবিষ্কার এবং রবীন্দ্র মানসে লালনীয় প্রভাব ও প্রেরণার সঙ্গে শিলাইদহবাসের সম্পর্ক অতি নিবিড়।

 লালনের গানের বস্তুসত্য রবীন্দ্রনাথ হয়তো তেমন করে অনুধাবন করতে চাননি, তবে তাঁর অন্তর্লীন ভাবসত্য তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। কালী মোহন ঘোষকে যখন তিনি লালনের আখড়ায় পাঠালেন গান সংগ্রহের বরাত দিয়ে তখন কালীমোহন তাদের আহ্বান করলেন গুরুদেবের কাছে যেতে। কালীমোহন জানাচ্ছেন: পরদিন অপরাহ্ণে নৌকোর উপর কবি গভীর আনন্দের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁহাদের আলোচনা করিতে লাগিলেন। তাহারা চলিয়া যাইবার পর আমাকে বলেদেন, ইহারা লেখাপড়া জানে না। কিন্তু সকলেই জ্ঞানী, বড় বড় কথা এমন সহজ ভাবে বুঝিতে পারে যে এদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া যে আনন্দ পাইয়াছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীদের সঙ্গে আলোচনা করিয়াও তাহা কচিৎ পাওয়া যায়।

 রবীন্দ্রনাথের বাউলচিন্তা ও মরমীভাবনা তাঁর জীবনচেতনার অন্তর্গত বিষয় হিসেবে বিবেচিত। এই প্রেরণা তিনি লাভ করেছিলেন শিলাইদহে এসে। মূলত শিলাইদহের বাউল-সম্প্রদায়ের প্রেরণা ও প্রভাবেই তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন ‘রবীন্দ্রবাউল’- এ। তার শিল্প-কর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্ম- দর্শন – বাউলভাবের পরিচয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। বাউলের মত রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিক ধর্মকে অগ্রাহ্য করে অন্তরের শুভ-প্রেরণাকেই আপন ধর্ম বলে মানতেন। বাউলের ধর্ম নিজেকে জানার ধর্ম, শাস্ত্রাচারহীন মহামিলনের ধর্ম, ভাবপ্লাবী হৃদয়বৃত্তির ধর্ম, সহজ ধর্ম। রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনি ; ‘আমার ধর্ম কি, তা যে আজও আমি সম্পূর্ণ এবং সুস্পষ্ট করে জানি, এমন কথা বলতে পারিনে – অনুশাসন আকারে তত্ত্ব আকারে কোনো পুঁথিতে লেখা সে তো নয়।’

অন্যভাবে এই কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় লালনের গানে:

  সব লোকে হয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন।

     লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।। ৭

রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, ‘বাউলের গান শিলাইদহে খাঁটি বাউলের মুখে শুনেছিও তাদের পুরাতন খাতা দেখেছি।’ সম্ভবত এই খাতা লালন ফকিরের গানের খাতা, কারণ ১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন থেকে মাঘ সংখ্যা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘হারামণি’ বিভাগে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লালনের কুড়িটি গান প্রকাশ করে বিদ্বজ্জন সমাজে লালন ফকিরকে পরিচায়িত করেন। 

লালন শিষ্যদের মধ্যে শীতল শাহ, ভোলাই শাহ পাঁচু শাহ, মলম শাহ, মানিক শাহ ও মনিরুদ্দীন শাহ শিলাইদহে কবির কাছে যাতায়াত করতেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রজনক দেবেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রসহোদর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের পরিচয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ লালনের শিষ্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ছেঁউড়িয়া ও শিলাইদহের মধ্যে এক নিবিড় যোগসূত্র রচনা করেন। শোনা যায়, কোনও এক সময় লালন- শিষ্যদের আমন্ত্রণে তিনি ছেঁউরিয়া আখড়াতেও গিয়েছিলেন। ছেঁউরিয়ায় লালন-আখড়া পাকা করার বিষয়ে তাঁর উদ্যোগ লালন-শিষ্যদের অন্তর্কলহে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ -সমীপে লালন- শিষ্য মনিরুদ্দীন শাহের একটি দরখাস্তে কবির সঙ্গে লালন- শিষ্যদের যোগাযোগের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

একটি সূত্র থেকে জানা যায়……… লালন শাহের মৃত্যুর পর শিষ্যসাগরেদের মধ্যে দুই বা তিন জন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে সাক্ষাৎ করেন এবং রবীন্দ্রনাথ লালনের মৃত্যুর খবর শুনে লালনের শ্রাদ্ধশান্তির জন্য নগদ দুইশত টাকা দান করেন।

 বাউল আর শান্তিনিকেতন এক সুদীর্ঘ যুগলবন্দী এবং তার সূচনা রবীন্দ্রনাথ থেকে। রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক উৎসাহ ছিল পৌষ মেলাকে ঘিরে গড়ে তোলা, গ্রামীণ সংস্কৃতির উজ্জীবন। প্রথম থেকেই সেখানে বাউলদের যাতায়াত ছিল। নিম্নবর্গ থেকে উচ্চবর্গ পর্যন্ত বাউল গানের স্বতঃস্ফূর্ত চলাচল চলছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বাউল গানের ভাবমূল্যে ও ছন্দে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং দেশবাসীকে প্রথম সচেতন করেছিলেন বাউল গানের নিজস্বতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি যেসব অভিনব স্বদেশী গান লেখেন তার সুরকাঠামোয় বাউল গানের স্পন্দন ও উদ্দীপনা অত্যাশ্চর্য নৈপুণ্যে ব্যবহার করেন। পরে তাঁর গানে বাউল গানের অন্তর্জগতের গভীর বাণী ছাপ ফেলেছে। 

  লালন ফকির বিষয়ের যথাযথ মূল্যনির্ধারণে আমাদের পেড়োতে হবে আরো অনেক বিতর্কের পর্যায়। সে বিতর্ক শুধু তাঁর গানের শুদ্ধসত্তাকে নিয়ে বা পুঁথির  অকৃত্রিমতাকে ঘিরে নয়, বরং অনেক বড় মাপের জিজ্ঞাসায় ও প্রযত্নে। সেখানে প্রশ্ন উঠবে লালনের জাতিসত্তার, তাঁর ধর্ম ধারণা,  গুপ্তসাধনার জটিলতা নিয়ে। দেখা যাবে লালন তাঁর লোকায়ত জীবনসাধনার পরম্পরা মেনে নিয়েও কেমন করে হয়ে উঠেছেন সর্বাধুনিক উচ্চারণের গীতিকার। কিন্তু তাঁর বর্তমান লোকপ্রিয়তা এবং বিস্তৃতি প্রসিদ্ধি তথা লালন গীতির প্রচার-প্রচলন নিঃসন্দেহে ব্যাহত হত যদি না লালনের আখড়াটি থাকত কুষ্টিয়াতে এবং সেখানে না থাকত ঠাকুরবাড়ির জমিদারি এবং ঠাকুরদের আসা-যাওয়া। ঠাকুর পরিবার লালনের গানের গভীরতা ও সারল্য প্রকাশ না করলে তাঁর নাম সীমায়ত থেকে যেত কুষ্টিয়ার সন্নিহিত অঞ্চলের  লালনপন্থী মারফতি বাউলদের কন্ঠে আর বিলীয়মান আখড়ার কিছু শিষ্যসেবকের আন্তরিক স্মরণবৃত্তে। তাঁর গান পেত না প্রসারণ ও প্রচার, প্রার্থিত মর্যাদা মূল্যবত্তা। লালনের আজকের যে প্রসিদ্ধি ও পরিচিতি, তার মূলে ছিল রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহিতা। মূলত রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগ ও প্রেরণায় উৎসাহিত হয়ে পরবর্তীকালে অনেক পন্ডিত ও মরমি ব্যক্তি লালন সম্পর্কে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন এবং সমগ্র বাংলায় লালনগীতি সংগ্রহ এবং লালন জীবনের তথ্য বিষয় প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা চলতে থাকে, যা আজও ক্ষান্তিহীন।

তথ্যসূত্র

১। ব্রাত্য লোকায়ত লালন, পৃঃ-২১

২। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৮৩

৩। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৩০

৪। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-২৯

৫। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৩৪

৬। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৮৪

৭। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৮৯

সহায়ক গ্রন্থ

১। শান্তিদেব ঘোষ – রবীন্দ্রসঙ্গীত

২। বাংলার বাউল ও বাউল গান- অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঙ্গীতচিন্তা, বিশ্বভারতী, ১৯৬৬

৪। সুধীর চক্রবর্তী, বাউল ফকির কথা

৫। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল,প্রথম প্রকাশ:২০২১,পুস্তক বিপণি,২৭ বেনিয়াটোলা লেন,কলকাতা ৯

৬। সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন

A Popular Character in Folk Drama Puppets: Puppet Dance

Farjana Yasmin, PhD Research Scholar, Performing Arts (Dance), Sister Nivedita University, DG1/2, New Town, Action Area-1, New Town, Kolkata: 700156, West Bengal, India.

Puppetry, one of the oldest forms of theatre, plays a significant role in the folk dramas of Bengal, often referred to as “folk plays.” These performances are typically staged on small to medium-sized platforms, where puppeteers expertly bring human or animal puppets to life through skilful manipulation. In Bengal, puppetry has a rich tradition dating back nearly a thousand years, featuring various forms of puppets including wire, stick, braided, and shadow puppets. Each type has its own unique method of control, from the fine wires used in wire puppets to the hand manipulation of braided puppets, known locally as “Beniputul.”

Historically, puppet shows were a beloved form of entertainment in rural Bengal, captivating audiences of all ages with their ability to portray human emotions like joy, sorrow, and humour. The relatable expressions of the puppets resonated deeply with audiences from all social classes. Puppet performances were particularly popular at fairs and festivals, where the colourful puppets, often made from wood or straw, danced in sync with music, reflecting the morals and daily life of the community.

Globally, puppetry has deep roots, with traditions spanning from Europe to Asia. In Europe, Germany, Italy, and France were early practitioners of puppetry, while Egypt, China, Korea, Myanmar, and the Philippines have also preserved their unique forms of art. In modern Bengal, institutions like the Calcutta Puppet Theatre and People’s Theatre are dedicated to keeping this ancient tradition alive.

Despite its rich history, puppetry in Bengal is facing a decline, with modern civilization rendering it unfamiliar to younger generations. However, some artists continue to champion the art form, hoping for a revival. Platforms such as social media offer potential avenues for promoting puppet shows, breathing new life into this traditional form of entertainment. Puppetry not only entertains but also educates, offering valuable social and moral lessons, particularly for children.

As puppetry evolves, with performers even dressing as puppets to engage audiences, there is hope for a resurgence of this ancient art form. The fusion of traditional and contemporary techniques could revitalize puppetry, capturing the imagination of modern audiences.

Keywords: puppetry, folk drama, Bengal, traditional arts, cultural heritage.

লোকনাট্যের জনপ্রিয় একটি চরিত্র পুতুল : পুতুল নাচ

ফারজানা ইয়াসমিন, পিএইচডি রিসার্চ স্কলার, পারফর্মিং আর্টস (নৃত্য), সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি, ডিজি ½, নিউ টাউন, অ্যাকশন এরিয়া-১, নিউ টাউন, কলকাতা: ৭০০১৫৬, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। farjanayasminmili@gmail.com

লোকনাট্যের জনপ্রিয় একটি চরিত্র পুতুল : পুতুল নাচ

সারসংক্ষেপ

লোকজীবনের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে মুখে মুখে রচিত এবং অভিনীত নাটককে সাধারণত লোকনাট্য বলা হয়। লোকনাট্যের একটি জনপ্রিয় চরিত্র হলো পুতুল। পুতুল নাটকের প্রাচীন রূপগুলির মধ্যে একটি।

বাংলার পুতুলনাচ লোকনাট্যের একটি প্রাচীন মাধ্যম, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পাপেট, পাপেট্রি, পাপেট শো বা পাপেট থিয়েটার। পাপেট শোর জন্য  ছোট বা মাঝারি আকারের একটি মঞ্চ আবশ্যক। এক বা একাধিক ব্যক্তি তাদের হাতের নিপুণ কুশলতায় মানুষরূপী পুতুল বা প্রাণিরূপী পুতুল দিয়ে একটা গল্প তুলে ধরে।

পুতুলশিল্প হল নাটকীয় অভিব্যক্তির একটি রূপ যা নির্দিষ্ট পুতুল দ্বারা উপস্থাপিত হয়। বাংলার পুতুলনাচের প্রায় হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে।

পুতুল নাচে সাধারণত চার ধরনের দেখা যায়। তারের পুতুল, লাঠিপুতুল, বেণীপুতুল ও ছায়াপুতুল। তারের পুতুল সূক্ষ্ম তার বা সুতার সাহায্যে এবং লাঠিপুতুল লম্বা সরু লাঠির সাহায্যে নাচানো হয়; আর দুই বা ততোধিক পুতুল যখন একসঙ্গে বেঁধে হাত দিয়ে নাচানো হয় তখন তাকে বলে বেণীপুতুল।

গ্রামীণ শিশু-কিশোর ও সর্বস্তরের মানুষের কাছে পুতুল নাচ খুব জনপ্রিয় ছিল এক সময়।

যেকোনো গল্প বা কাহিনী অবলম্বনে পুতুলগুলি দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয় বিভিন্ন চরিত্রে। চরিত্রানুযায়ী পোশাক-পরিচ্ছদে, রূপসজ্জায় পুতুলের অভিনয়। মানুষের মতোই পুতুলগুলি হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, রাগ-দুঃখ ইত্যাদির অভিনয় করে।ফলে পুতুলনাচ হয়ে ওঠে সবার কাছে  খুব প্রিয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুতুলনাচ একটি পুরাতন শিল্পকলা হিসেবে পরিচিত। ইউরোপে পুতুলনাচের সবচেয়ে প্রাচীনতম ধারক জার্মানি। মধ্যযুগে ইতালিতে ‘পুলসিনেলো’ নামে আবির্ভাব ঘটে সুতা পাপেটের, ফ্রান্সে যার নতুন নাম হয় ‘পলসিনেল’। এছাড়াও মিশর, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইন, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় পুরানো ও আধুনিক ধারার পুতুলনাচের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ক্যালকাটা পাপেট থিয়েটার, পিপলস থিয়েটার, ডলস থিয়েটার এবং বর্ধমান পাপেট থিয়েটার আধুনিক ধারায় পুতুলনাচের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।

পুতুল খেলা শিশুদের কাছে উৎসবের মতো। মেয়ে পুতুলের সাথে ছেলে পুতুলের বিয়ে এ যেন গ্রাম বাংলার সাধারণ রূপ। আর তার সাথে যদি সেই জড় পুতুল নাচে, কথা বলে তাহলে ছোট থেকে বড় সবাই যেন তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুভব করে। বাংলার সংস্কৃতিতে বিনোদনে বড় মাধ্যম এটি। রাত জেগে পুতুল নাচ দেখতে গ্রামীণ মানুষ ভীড় করতো এই পুতুল নাচ-গানের আসরে।

পুতুল নাচের গল্পে তুলে ধরা হতো সে সময়ের মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখ–দুঃখ, রঙ্গরস, হাসি-ঠাট্টা ও নিত্যদিনের জীবনাচরণ। কাঠের পুতুল অথবা সোলা দিয়ে পুতুল তৈরী করে, সেটাতে রং তুলির আচড় দিয়ে, বিভিন্ন বর্ণিল সাজে সাজিয়ে বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে সুতা দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে নাচায় এই পুতুল নাচের আসরে। আগেকার দিনে কোন মেলা বা উৎসব হলে সেখানে পুতুল নাচ/পাপেট শোয়ের আয়োজন করা হতো। তবে কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী এই পুতুল নাচ আজ প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় নাম লিখিয়েছে।

আধুনিক সভ্যতায় নতুন প্রজন্মের কাছে পুতুল নাচ অনেকটা  অপরিচিত। এখনো শিল্পীরা জীবন-জীবিকা ও রুজি-রোজগারের টানে এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমি চাই গ্রামবাংলায় পুতুল নাচ আগের মতো ফিরে আসুক। সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মিডিয়ায় পুতুল নাচের ভিডিও বেশি করে প্রচার করতে হবে। তাহলে একদিকে সামাজিক শিক্ষা অন্যদিকে শিশু মনের বিকাশ ঘটাতে পুতুল নাচ অনবদ‍্য ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি । বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার পণ্ডিতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রমাণগুলি থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, পুতুলগুলি  প্রায় সভ্যতার মতোই পুরানো।  মূল পাপেট শো-এর প্রকৃতি যাই হোক না কেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে মধ্যযুগ থেকে পুতুল শিল্প ইতিহাস জুড়ে বিনোদনের একটি জনপ্রিয় রূপ।

বর্তমানে পুতুল নাটিকা বিবর্তন হয়ে মানুষ নিজেই  পুতুল সেজে  নৃত্য করছে যা  বর্তমান দর্শক  অথবা জনসাধারণ  মনোরঞ্জন, বিনোদন করছে এবং পুতুল নাচ আবারো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অর্থাৎ  অতীতের পুতুল নাটিকা নতুনভাবে প্রকাশ পাচ্ছে  যেখানে  মানুষ পুতুল সেজে পুতুল নাটিকার চরিত্র করছে ।

মূলশব্দ : পুতুল, লোকনাট্য ,বাংলার, নাটক ও নাচ।

লোকনাট্য : লোকজীবনের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে মুখে মুখে রচিত এবং অভিনীত নাটককে সাধারণত লোকনাট্য বলা হয়।

পুতুল নাচ  হলো থিয়েটার বা পারফরম্যান্সের একটি রূপ যেখানে পুতুলের মাধ্যমে কাহিনী বলা হয়।

পুতুল নাচ সাধারণত চার ধরনের দেখা যায়।

  • তারের পুতুল,
  • লাঠিপুতুল,
  •  বেণীপুতুল ও
  •  ছায়াপুতুল।


তারের পুতুল : তারের পুতুল নাচ ইংরেজী নাম ম্যারিয়োনেট বা স্ট্রিং পাপেট।তারের পুতুল সূক্ষ্ম তার বা সুতার সাহায্যে নাচানো হয়। পুতুল তৈরি হয় মূলত শোলা দিয়ে। উচ্চতা প্রায় ১ থেকে ৩ ফুট। পুতুলের কোমরে, হাতে ও মাথার সাথে তার বা সুতা বাঁধা থাকে যাতে আড়াল থেকে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।নানা ধরনের কাজের জন্য একটি তারের পুতুল নাচের দলে ১০ থেকে ১৮ জন লোকশিল্পী, কলাকুশলী ও কর্মী থাকে।

ডাঙ্গের পুতুল বা লাঠি পুতুল : লাঠিপুতুল স্টেজের নীচের অংশ থেকে লম্বা সরু লাঠির সাহায্যে নাচানো হয়। একে ডাং বা ডাঙ্গের পুতুলও বলে। খড়, যজ্ঞডুমুর বা পিপুল গাছের কাঠ দিয়ে এ ধরনের পুতুল তৈরি হয়। লম্বায় এরা প্রায় পূর্ণবয়স্ক মানুষের সাইজের হয়। ভেলভেট কাপড়ে এদের সাজসজ্জা করা হয়।ডাঙ্গের পুতুল বা লাঠি পুতুল নাচের পুতুলগুলি কাঠের তৈরী। নীচ থেকে নাচটি পরিচালনা করা হয় কাঠ বা বাঁশের সাহায্যে।

বেণী পুতুল বা খেঁদি পুতুল : দুই বা ততোধিক পুতুল যখন একসঙ্গে বেঁধে হাত দিয়ে নাচানো হয় তখন তাকে বলে বেণীপুতুল। এ পুতুল বানানোর জন্য মাটির বা কাঠের বা থার্মোকলের মুখের ছাঁচ তৈরি করে তারপর পেপার ম্যাশের মুখ করা হয়। এ পুতুলের হাত সবসময় কাঠের হয়।

ছায়া পুতুল : ছায়া পুতুল শ্যাডো প্লে ,শ্যাডো পাপেট্রি নামেও পরিচিত , এটি গল্প বলার এবং বিনোদনের  একটি প্রাচীন রূপ যা আলোর উৎস এবং একটি স্বচ্ছ পর্দা বা স্ক্রিনের মধ্যে ফ্ল্যাট আর্টিকুলেটেড কাট-আউট ফিগার (ছায়া পুতুল) ব্যবহার করে । পুতুলের কাট-আউট আকারে কখনও কখনও স্বচ্ছ রঙ বা অন্যান্য ধরণের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত থাকে। পুতুল এবং আলোর উৎস উভয়ই সরানোর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রভাব অর্জন করা যেতে পারে। একজন প্রতিভাবান পুতুলের মতো চিত্রগুলিকে হাঁটতে, নাচতে, লড়াই করতে, মাথা নাড়াতে এবং হাসতে দেখাতে পারে

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুতুলনাচ একটি পুরাতন শিল্পকলা হিসেবে পরিচিত। ইউরোপে পুতুলনাচের সবচেয়ে প্রাচীনতম ধারক জার্মানি। মধ্যযুগে ইতালিতে পুলসিনেলোনামে আবির্ভাব ঘটে সুতা পাপেটের, ফ্রান্সে যার নতুন নাম হয় পলসিনেল।এছাড়াও মিশর, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইন, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় পুরানো ও আধুনিক ধারার পুতুলনাচের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ক্যালকাটা পাপেট থিয়েটার, পিপলস থিয়েটার, ডলস থিয়েটার এবং বর্ধমান পাপেট থিয়েটার আধুনিক ধারায় পুতুলনাচের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে

বাংলাদেশে পুতুল নাচের ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। প্রাচীন বৃহত্তর বাংলার বিহার, ওড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুরের নদীতীরবর্তী জেলাগুলোতে পুতুল নাচের প্রচলন ছিলো। আর্যরা যখন বঙ্গদেশে এলো সেসময় অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশকে গৌড় বলা হতো আর দক্ষিণ বঙ্গকে বলা হতো সমতট। দক্ষিণবঙ্গের বিস্তার বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জ থেকে শুরু করে হুগলি নদীর পূর্বতট সুন্দরবন পর্যন্ত। এই ভৌগলিক সীমানার মধ্যে বাংলার পুতুল নাট্যপালার চর্চা ছিলো। এটাই ছিলো সনাতন পুতুল শিল্পীদের আদি ভূখন্ড। এসব অঞ্চলে পুতুল তৈরির পর্যাপ্ত উপকরণ, উপযুক্ত কারিগরি জ্ঞান, নদী নালার পথে যাতায়াত সহজলভ্য হওয়ায় পুতুল শিল্পচর্চা গড়ে উঠেছিলো বলে ধারণা করা হয়।

পুতুল খেলা শিশুদের কাছে উৎসবের মতো। মেয়ে পুতুলের সাথে ছেলে পুতুলের বিয়ে এ যেন গ্রাম বাংলার সাধারণ রূপ। আর তার সাথে যদি সেই জড় পুতুল নাচে, কথা বলে তাহলে ছোট থেকে বড় সবাই যেন তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুভব করে। বাংলার সংস্কৃতিতে বিনোদনে বড় মাধ্যম এটি। রাত জেগে পুতুল নাচ দেখতে গ্রামীণ মানুষ ভীড় করতো এই পুতুল নাচ-গানের আসরে।

এক সময় পেশাজীবী পুতুল-নাচিয়ে দল গ্রামে-গঞ্জে পুতুলনাচ প্রদর্শন করতো এবং তারাই বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পমাধ্যমটিকে বাঁচিয়ে রাখে।  বিভিন্ন মেলা ও লোক উৎসব-অনুষ্ঠানে পুতুল নাচের আসর বসে। এটি  লোকমনোরঞ্জনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। পুতুল নাচ,গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ছিলো গানের তালে তালে ঐতিহ্য এবং কাহিনীর সাথে বাদ্ধযন্ত্র ও সুরের মোর্ছনায় পুতুলের নৃত্য। গ্রামীণ শিশু-কিশোর ও সর্বস্তরের মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল এক সময়।

পুতুল নাচের গল্পে তুলে ধরা হতো সে সময়ের মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখ–দুঃখ, রঙ্গরস, হাসি-ঠাট্টা ও নিত্যদিনের জীবনাচরণ। কাঠের পুতুল অথবা সোলা দিয়ে পুতুল তৈরী করে, সেটাতে রং তুলির আচড় দিয়ে, বিভিন্ন বর্ণিল সাজে সাজিয়ে বাদ্যন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে সুতা দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে নাচায় এই পুতুল নাচের আসরে। তবে কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী এই পুতুল নাচ আজ প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় নাম লিখিয়েছে।

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত পুতুল নাচ

বাংলাদেশে আমি যখন প্রত্যয় ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষকতা করতাম,তখন বেশ কয়েকবার  আমরা  কয়েকজন শিক্ষক মিলে পুতুল নাচের, নাটিকার আয়োজন করেছিলাম।ফলে ছাত্রছাত্রীরা পুতুল নাচ সম্পর্কে জানতে পেরেছিলো ও অনেক উপভোগ করেছিলো।

বাংলাদেশের  বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপা তার শিক্ষার্থীদের পুতুলের মতো সাজিয়ে পুতুল নাচ করিয়েছেন,দর্শক মুগ্ধ হয়ে মানুষের আদলে পুতুল নাচ উপভোগ করেছিলো।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে পুতুলের আদলে শিশুদের নাচ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।যারফলে অনেকে পুতুল নাচ সম্পর্কে জানতে পেরেছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সূর্যমুখী কিন্ডার গার্টেন এন্ড উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় শিশু শিক্ষার্থীদের দিয়ে পুতুলের আদলে অসাধারণ নৃত্য প্রদর্শন করা হয়। যা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। অনুষ্ঠানে স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীরা পায়ের আঙ্গুলের সাথে হাতে সূতো বেঁধে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে ও গায়ে বাঙ্গালীয়ানা পোশাক পরিধান করে নাচ প্রদর্শন করে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে,আধুনিক সভ্যতায় নতুন প্রজন্মের কাছে পুতুল নাচ অনেকটা  অপরিচিত হলেও মানুষের আদলে পুতুল নাচ দেখে সবাই মুগ্ধ হচ্ছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির জাঁতাকলে পড়ে, ঘরে ঘরে অত্যাধুনিক মোবাইল হাতের নাগালে আসায় গ্রামবাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য পুতুল নাচ হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনো শিল্পীরা জীবন-জীবিকা ও রুজি-রোজগারের টানে এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।আমি চাই গ্রামবাংলায় পুতুল নাচ আগের মতো ফিরে আসুক। সেজন্য সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মিডিয়ায় পুতুল নাচের ভিডিও আরো বেশি করে প্রচার করতে হবেতাহলে একদিকে সামাজিক শিক্ষা অন্যদিকে শিশু মনের বিকাশ ঘটাতে পুতুল নাচ অনবদ‍্য ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি । বর্তমানে পুতুল নাটিকা বিবর্তন হয়ে মানুষ নিজেই পুতুল সেজে নৃত্য করছে যা বর্তমান দর্শক অথবা জনসাধারণ মনোরঞ্জন, বিনোদন করছে এবং পুতুল নাচ আবারো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অর্থাৎ অতীতের পুতুল নাটিকা নতুনভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যেখানে মানুষ পুতুল সেজে পুতুল নাটিকার চরিত্র করছে।

মূল পাপেট শো-এর প্রকৃতি যাই হোক না কেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে মধ্যযুগ থেকে পুতুল শিল্প ইতিহাস জুড়ে বিনোদনের একটি জনপ্রিয় রূপ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলার ঐহিত্য লোকসংস্কৃতির অংশ এই পুতুল নাচ যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য এ পুতুল নাচ ধরে রাখতে সরকার ও বিভিন্ন সংগঠনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।