স্মৃতির সরণী বেয়ে : বাহাদুর খাঁ সাহেব – ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্ত

স্মৃতির সরণী বেয়েpdf

“স্মৃতি যেমন ব্যক্তিগত, তেমনই তা ঐতিহাসিক।”— এই কথাটি বারবার মনে পড়ে যখন আমি আমাদের সংগীত জগতের বিস্মৃতপ্রায় অথবা পর্যাপ্ত আলো না পাওয়া কিছু গুণী ব্যক্তিত্বের কথা ভাবি। সরোদশিল্পী হিসাবে আমার শেকড়ে এই স্মৃতির দীপ্ত রেখা বহমান, কারণ আমি সরোদশিল্পী বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পুত্র। তাই আমার সংগীত-পরিক্রমার ইতিহাসে আলী আকবর খাঁ ছাড়া আর কোনো সরোদ শিল্পীর উপর বিস্তৃত লেখা না থাকাটা আমার নিজের কাছেই এক অপরাধবোধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমার পিতা ছিলেন একান্ত বাঙালি গুরুশিষ্য-পরম্পরার ধারক। তিনি বারবার বলতেন— “বাঙালি সরোদিয়া মানেই এক বিশেষ আবেগ ও নৈপুণ্যের ধারক; তারা কেবল যন্ত্র বাজায় না, তারা যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলে।” (দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। সংগীত স্মৃতি সাধনা, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০২। পৃ. ৪২)।

এই সূত্রে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেন আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর পুত্র আলী আকবর খাঁ-কে। তবে তাঁর শ্রদ্ধাভাজনদের তালিকায় আরও এক গুরুত্বপূর্ণ নাম ছিল — বাহাদুর খাঁ সাহেব। তিনি ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ-র ভ্রাতুষ্পুত্র এবং পূর্ববঙ্গের নৈসর্গিক সংগীতঐতিহ্যের অন্যতম বাহক। আমার পিতার নিকট তিনি কেবল প্রিয়জন ছিলেন না, ছিলেন ‘দাদা’র মতো অগ্রজ, যাঁর স্নেহ ও আর্শীবাদ ছাড়া সংগীতের পথ চলা অসম্পূর্ণই থেকে যেত।

বাহাদুর খাঁ সাহেবের আচার-আচরণে ছিল গ্রাম বাংলার সরলতা। তাঁর পিতাও ছিলেন এক ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত শিল্পী। তাঁর মুখের ভাষা, হেঁসে ওঠার ভঙ্গি, এমনকি আলাপচারিতার ঢং-ও ছিল খাঁটি পূর্ববঙ্গীয়। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন— “ভাষা জাতির সংস্কৃতির চালচিত্র” (Tagore, Rabindranath. The Religion of Man. London: Macmillan, 1931, p. 105)— বাহাদুর খাঁ সাহেব ছিলেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল একবার তাঁর জন্মদিনে। সময়টা ছিল এমন এক সন্ধ্যা, যখন পাম অ্যাভিনিউয়ের অঞ্চল এখনও বহুতল হোটেল বা আধুনিক বহির্ভূত শহুরে রূপ ধারণ করেনি। সেদিনের সেই শান্ত সন্ধ্যার স্মৃতি আজও ভেসে আসে। তাঁর দুই পুত্র বিদ্যুৎ খাঁ ও কিরীট খাঁ আমাদের আপ্যায়ন করলেন। মিনিট পাঁচেক পরে নিজে এসে উপস্থিত হলেন বাহাদুর খাঁ সাহেব— সাদা সিল্কের পাঞ্জাবী ও পাজামা পরিহিত। পিতাকে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন—

বুদ্ধ, আইলা ভাই, তুমারে দেইখ্যা বড় খুশি হইলাম। তুমার মত ভালো সেলে আর দেখি নাই।

আমার পিতাও সশ্রদ্ধ কণ্ঠে জবাব দিলেন—

দাদা, আমার কি সৌভাগ্য, আপনার মত মানুষের স্নেহ, ভালবাসা পাচ্ছি।

(ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্ত, ১৯৯৫)।

এরপর যে ঘটনাটি ঘটল, তা যেন ইতিহাসের কোনো মহার্ঘ মুহূর্ত। বাহাদুর খাঁ সাহেব একটি পুরানো ফুলস্ক্যাপ খাতা এনে বাবার হাতে দিলেন। সেই খাতায় ছিল আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের নিজের হাতে লেখা রাগরাগিণীর গৎ ও অন্তরা। পিতা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন—

ব্যাটা, আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বাংলা হাতের লেখা দেখ। এসব জিনিস মিউজিয়ামে যত্ন করে রাখা উচিত।

আমিও তাকিয়ে দেখেছিলাম সেই মূল্যবান পৃষ্ঠাগুলি— স্বয়ং সংগীতশ্রেষ্ঠ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের নিজহস্তে লিপিবদ্ধ। পিতা বলেছিলেন—

দাদা, কোটি টাকা দিলেও এসব জিনিসের সঠিক মূল্যায়ণ হয় না।

তাঁর এই কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছিলাম তখনই। অমূল্য সম্পদের আর্থিক মুল্য হয় না, এর ইতিহাস-সমৃদ্ধতা তা ছাড়িয়ে যায়। নিকোলাস কুক বলেছেন—

“Music is not only what is sounded, but also what is remembered.” (Cook, Nicholas. Music: A Very Short Introduction. Oxford University Press, 2000. p. 5)।

সেদিনের আরেকটি স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল খাঁ সাহেবের মুখ থেকে নিঃসৃত এক করুণ বেদনার প্রকাশ—

ভাইরে, একটাই দুঃখ থাইক্যা গেল। জীবনে স্বীকৃতি পাইলাম না।

পিতার উত্তর ছিল—

দাদা, আজকালকার দিনে স্বীকৃতি পেতে হলে প্রপাগাণ্ডা চাই। কতগুলো গরু গাধা আপনাকে স্বীকৃতি দিল কি না দিল তাতে কি যায় আসে। আমরা যারা মিউজিসিয়ান, তারা তো জানি আপনি কত বড় মাপের মানুষ।

এই কথার মধ্যে সংগীতজগতের কঠিন বাস্তব সত্য নিহিত— যশ ও প্রাপ্য সম্মানের মধ্যে ব্যবধান সব সময় মেটে না। নীরব প্রতিভা অনেক সময় ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। পণ্ডিত রবিশংকর নিজেও একবার বলেছিলেন—

“Recognition comes not from the noise outside but from the silence within.” (Shankar, Ravi. Raga Mala: The Autobiography of Ravi Shankar. Element Books, 1997. p. 212)।

এই ব্যক্তিগত স্মৃতি শুধুই আত্মকথন নয়— এটি বাঙালি সরোদিয়া পরম্পরার এক উজ্জ্বল অধ্যায়। যারা সংগীতজগতে প্রবেশ করতে চায়, তাদের জন্য বাহাদুর খাঁ সাহেবের জীবন ও সাধনার এই বর্ণনা এক মূল্যবান শিক্ষার আধার।

নিম্নলিখিত অংশটিকে পূর্ববর্তী শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, যথাযথ তথ্যনির্ভর উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা সহযোগে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রূপে উপস্থাপন করা হল—

এর কয়েক বছর পর কলকাতার প্রখ্যাত কলামন্দির মিলনায়তনে এক স্মরণীয় সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়। মাঝরাত্রির সেই অনুষ্ঠানে বাহাদুর খাঁ সাহেবের বাজানো দরবারী কানাড়া শ্রবণ করেছিলাম। পিতার সঙ্গেই গিয়েছিলাম। যদিও পূর্বে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র মাধ্যমে তাঁর বাজনা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল, কিন্তু এই প্রথমবার মঞ্চে তাঁর সরাসরি পরিবেশনা শুনলাম। তখন বুঝেছিলাম কেন আমার পিতা এবং তাঁর গুরু-পরম্পরার শিল্পীরা বাহাদুর খাঁ সাহেবের সাধনাকে অতিপ্রশংসায় মূল্যায়ন করতেন।

রাগ দরবারী কানাড়া সম্পর্কে বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত বি. ডি. সান্যাল বলেন—
“This raga demands profound contemplation and nocturnal solemnity, for its full mood to unfold.”
(Sanyal, B.D., The Classical Music of India, Bombay: Bharatiya Vidya Bhavan, 1965, p. 178)।

এই গভীরতা, এই নিঃশব্দ নৈঃশব্দ্যের ব্যঞ্জনা সেদিন খাঁ সাহেবের সরোদের তারে স্পষ্ট ধরা দিয়েছিল। তাঁর সরোদের প্রত্যেকটি সুর যেন কথার মতো বেজে উঠছিল, যেন কোনো অদৃশ্য কাহিনির জাল বুনছিল। বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল পণ্ডিত স্বপন চৌধুরীর অনবদ্য তবলাসঙ্গত, যিনি নিজেই বলেন—

“The sarod of Bahadur Khan breathed like a living being; I had merely to follow its pulse.”
(Chowdhury, Swapan. Interview in Sruti magazine, Issue 112, 2004, p. 32)।

অনুষ্ঠান শেষে, ভোররাতে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে পিতা হালকা হাসির ছলে বলেছিলেন—

যতই নেশা করুক, সরোদ হাতে নিলে লোকটা কোথায় যেতে পারে বুঝতে পারলি।

এই কথায় হয়তো ছিল একান্ত শিল্পীসত্তার প্রতি অকপট শ্রদ্ধা, কারণ বাহাদুর খাঁ সাহেবের ব্যক্তিগত জীবনযাপনে কিছুটা অনিয়ম থাকলেও তাঁর সংগীত সাধনায় কোনো খাদ ছিল না। যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—

“The real artist belongs to no country, no age, no personal life; he lives where beauty lives, eternal and infinite.”
(Tagore, Rabindranath. Personality. London: Macmillan, 1917, p. 57)।

বাহাদুর খাঁ সাহেবের শিল্পীজীবনের আরেকটি বিস্মৃত অধ্যায় ছিল চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অবদান। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাঁর পরিচালিত বহু চলচ্চিত্রে বাহাদুর খাঁ সাহেব আবহ সংগীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ (১৯৭৪) চলচ্চিত্রটির আবহ সংগীতে তাঁর সরোদের সুর আজও সিনেমাপ্রেমীদের কানে বেজে ওঠে। চলচ্চিত্র গবেষক সতীশ বাহাদুর উল্লেখ করেছেন—

“Ghatak’s films derive their aural poignancy from Bahadur Khan’s Sarod, whose plaintive strings bring out the existential agony of the characters.”
(Bahadur, Satish. Ghatak and the Sound of Cinema. Mumbai: Film Studies Journal, 1995, p. 88)।

নন্দন প্রেক্ষাগৃহে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ চলচ্চিত্র আমি মায়ের সঙ্গে বসে দেখেছিলাম— সে স্মৃতি আজও জীবন্ত। তখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের ছাত্র।

এই নিরহঙ্কার, বিনম্র, অথচ অসাধারণ শিল্পীর অকালপ্রয়াণ কলকাতার সংগীত সমাজে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কিরীট খাঁ ছিলেন প্রতিশ্রুতিমান সেতার শিল্পী— আজ তিনিও আমাদের মধ্যে নেই। জ্যেষ্ঠপুত্র বিদ্যুৎ খাঁ ছিলেন দক্ষ সরোদবাদক, কিন্তু এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী। এ এক অনিবার্য সাংগীতিক বংশের নিঃশেষ হওয়ার বেদনার কাহিনী।

আমার বর্তমান তবলাগুরু পণ্ডিত মহাপুরুষ মিশ্রের শিষ্য শ্রী নিত্যানন্দ ভট্টাচার্য মহাশয়ও বাহাদুর খাঁ সাহেবের ঘনিষ্ঠ স্নেহধন্য ছিলেন। তিনি প্রায়ই তাঁর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাসভবনে যেতেন, সেখানে বিদ্যুৎ ও কিরীট খাঁ-র সঙ্গে তবলা সঙ্গত করতেন। বাহাদুর খাঁ সাহেবের মৃত্যুর পরে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিদ্যুৎ ও কিরীট খাঁর সেতার-সরোদের যুগলবন্দীতে শ্রী নিত্যানন্দ ভট্টাচার্য তবলা সঙ্গত করেন— এক করুণ অথচ মহিমামণ্ডিত মুহূর্ত, যেটি ছিল হয়তো তাঁদের পরিবারের শেষ যুগল সঙ্গীত।

নন্দিত সংগীত গবেষক পণ্ডিত দেবব্রত চৌধুরী একবার বলেছিলেন—

“When an artiste dies unfulfilled, the silence that follows is heavier than sound.”
(Chowdhury, Debabrata. The Voice of the Strings. Delhi: Sangeet Natak Akademi, 1989, p. 44)।

বাহাদুর খাঁ সাহেবের জীবন ও সাধনাও যেন সেই নীরবতার ভার বহন করে যায়— যা আজও শ্রোতার অন্তরে বেজে ওঠে।

 

তথ্যসূত্র

  1. Sanyal, B.D. The Classical Music of India. Bombay: Bharatiya Vidya Bhavan, 1965.
  2. Chowdhury, Swapan. Interview in Sruti magazine, Issue 112, 2004.
  3. Tagore, Rabindranath. Personality. London: Macmillan, 1917.
  4. Bahadur, Satish. Ghatak and the Sound of Cinema. Mumbai: Film Studies Journal, 1995.
  5. Chowdhury, Debabrata. The Voice of the Strings. Delhi: Sangeet Natak Akademi, 1989.
  6. ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্ত, ১৯৯৫।
  7. দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। সংগীত স্মৃতি সাধনা. কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০২।
  8. Tagore, Rabindranath. The Religion of Man. London: Macmillan, 1931.
  9. Cook, Nicholas. Music: A Very Short Introduction. Oxford: Oxford University Press, 2000.
  10. Shankar, Ravi. Raga Mala: The Autobiography of Ravi Shankar. Element Books, 1997.
  11. ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্ত, ১৯৯৫।