Echoes of Tradition: Exploring Folk Language and Culture
Dr. Srabani Sen
Abstract
Echoes of Tradition: Exploring Folk Language and Culture” delves into the rich tapestry of folk language and cultural expressions that resonate through generations. This study investigates the enduring influence of traditional forms of communication, storytelling, and linguistic nuances within communities. By examining the echoes of tradition in language, the research sheds light on how cultural heritage is preserved and transmitted through oral traditions, folk tales, and linguistic idiosyncrasies. Through a multidisciplinary lens, the abstract explores the intricate interplay between language and culture, providing insights into the dynamic processes that shape and sustain the collective identity of communities over time. This exploration invites readers to appreciate the enduring vitality of folk traditions as integral components of our shared human heritage.
লোকভাষা ও লোকসংস্কৃতি
ড.শ্রাবণী সেন
আ্যসোসিয়েট প্রফেসর,সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী
ভাষা মানুষের আত্মপ্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ধ্বনি থেকে ভাষার উৎপত্তি হলেও অনুন্নত প্রাণী ও মানুষের সৃষ্ট ধ্বনির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সমাজ গঠনের মৌলিক আবেগের সঙ্গে ভাষা গঠনের আবেগ জড়িত। সামাজিক মানুষের মুখোচ্চারিত বহুজনবোধ্য ধ্বনির প্রতীকগুচ্ছকেই ভাষা আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভাষা একদিকে যেমন ব্যক্তি সত্তার স্বরূপ প্রকাশ করে, আবার অন্যদিকে দেশ বা জাতির সংযোগ-সেতুরূপে কাজ করে। ভাষা শব্দটি একটি জাতির উত্থানের সচেতন ঐক্য ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে জড়িত। বস্তুত জাতীয় আবেগ সৃষ্টি, তার প্রসার ও পুষ্টি সাধনে ভাষাই প্রধান হাতিয়ার। তাই ভাষা ও জাতি সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
মানুষ চিন্তা করে, সে চিন্তা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে চায়। সামাজিক মানুষ পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের অপরিহার্যতা অনুভব করে, সেই প্রয়োজনকে বলিষ্ঠ ভাবে নির্বাহ করার জন্য ধ্বনিপ্রতীক ও তার সমষ্টিকে সুবিন্যস্ত করার চেষ্টা করেছিল। প্রথমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালনার মাধ্যমে প্রকাশ করলেও পরবর্তী সময়ে স্পষ্টোচ্চারিত কথার উদ্ভব হয়।১ অঙ্গ-ভঙ্গীর প্রতীক ক্রমে শব্দ-প্রতীকে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে। ইঙ্গিত-সংকেত মুখোচ্চারিত ধ্বনিতে আশ্রয় গ্রহণ করে রূপ নেয় ভাষায়।
ভাষা পদ্ধতি সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, আচার-বিচার আত্মীয়রীতি ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভাষাকে লোকবিজ্ঞানীরা তিনটি স্তরে চিহ্নিত করেছেন – শিষ্ট ভাষা, জনভাষা ও লোকভাষা। শিক্ষিত শহুরে উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষের বাচনই হল শিষ্ট ভাষা। আঞ্চলিক ভেদের মধ্যে দিয়ে তা শিষ্ট ভাষায় উন্নীত হয়। সাধারণ মৌখিক ব্যবহার বা কথ্যভাষার স্তর জনভাষা। লোকভাষা যা বিশেষ সামাজিক স্তরের ভাষা ব্যবহারের স্তর। লোকভাষা কোন বিশেষ অঞ্চলের উপভাষা নয়। নাগরিক ভাষার সঙ্গে বাংলার ক্ষেত্রে মান্য-মার্জিত কলকাতার বা শহরের শিষ্ট ভাষার সঙ্গে বিরোধে যে-ভাষা গ্রাম্য বলে চিহ্নিত হতে পারে তা-ই ‘লোকভাষা’। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে একে কখনও কখনও rural languageও বলা হয়ে থাকে।
বৈচিত্র্যের দিক থেকে আবার ভাষা তিন রকম – ভাষা, উপভাষা ও বিশিষ্ট বা দপ্তরি ভাষা। লোকভাষাকে কেউ কেউ আঞ্চলিক বা উপভাষা সমার্থক মনে করেন, কেউ মনে করেন- এটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরে থাকা সর্বসাধারণের ভাষা, আবার কারও মতে লোকসাহিত্যের ভাষাই লোকভাষা। মূলত, লোকভাষা ভাষারই একটা রূপভেদ। সাধারণত আঞ্চলিক ভাষা যার মধ্যে বিশেষ ধ্বনিগত রূপগত বা বাক্যবিন্যাসগত স্বতন্ত্র রয়েছে, সেই মুখের ভাষাই হল উপভাষা। তার একটি মার্জিত, কিছুটা কৃত্রিম, পরিচালিত রূপ আমরা শহরের বা গ্রামের শিক্ষিত লোকেরা ব্যবহার করে থাকি। এর বাইরে একেবারে গ্রামের তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষের মুখের প্রাণবন্ত অকৃত্রিম জীবন্ত ভাষাই হল লোকভাষা। মর্যাদার বিচারে উপভাষা অলিখিত হলেও ভাষার লিখিত রূপই গ্রাহ্য। কিন্তু লোকভাষা বিশেষ কোন গঠনগত বৈচিত্র্যের নাম নয়। আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রে ভাষাগতভেদ, সম্প্রদায়, জাত, দল, গোষ্ঠী পরিবার ও ব্যক্তির স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। তাই বলা যায় ‘লোকভাষা’ হল বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও কৌমজনের ভাষা – যা নানা কারণেই ক্রমক্ষয়িষ্ণু।
ভাষার ভিত হল সমাজ। সমাজ ও ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। ভাষা যেমন সংযোগের মাধ্যম, তেমনি গোষ্ঠীসমূহকে সনাক্ত করার উপায়ও। R.Firth এর অভিমত-Hudson এর ভাষায় ‘To study speech without reference to the societywhich use itto exclude the possibility of finding social explainations for the structure that are used. ২
লোকসংস্কৃতির জন্ম সাধারণ মানুষের মুখে মুখে, তাদের চিন্তায় ও কর্মে। ঐতিহ্যানুসারে বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, তাদের আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান, জীবন-যাপন প্রণালী, শিল্প ও অভিনন্দন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিকে সহজ ভাষায় লোকসংস্কৃতি বলা হয়।লোকভাষা লোকোসংস্কৃতি বিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লোকসমাজে প্রচলিত লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান-সমন্বিত ভাষাভঙ্গীর নাম লোকভাষা। লৌকিক শব্দে প্রাকৃত জন বোঝায়। তাই লোকযুক্ত নানা অর্থবাচক শব্দ -লোকসমাজ, লোকোবিদ্যা, লোককথা ইত্যাদি লোকসংস্কৃতির অঙ্গীভূত বিষয়। ভাষা সম্পর্কিত লোকসংস্কৃতির সমাজ, সাহিত্য ,কৃষি, শিল্প, গীত, অভিনয় ইত্যাদি জীবনের সবদিকই এই ভাষার বিশ্লেষণে আলোকিত হয়। লোকসংস্কৃতিবিদেরা মনে করেন লিখিত ভাষার তুলনায় লৌকিক ভাষা অনেক বেশি রক্ষণশীল। লোকসমাজের বিশ্বাস, আচার বিচার, শিল্প, সাহিত্য সবই মূলত ঐতিহ্যবাহী। লোকভাষা তাই রক্ষণশীল। উপভাষার মতো লোকভাষার বিকাশও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঘটে। লোকভাষার উপর সামাজিক উপাদানগুলির ক্রিয়াশীলতা আছে।
সাধারণভাবে বাংলা লোককথা, লোকগাথা, ছেলেভুলানো ছড়া, ব্রতকথা, আউল-বাউলের গান প্রভৃতির মধ্যে লোকভাষার নিদর্শন পাওয়া যায়। লোকভাষা থাকে লোকোসমাজের মনন, সৃষ্টি ও উপভোগকে ধারণ ও প্রকাশের মধ্যে। তাই লোকভাষাকে সমাজভাষা বিদ্যার অংশ বলা যায়। Folk শব্দটি Common people বা সাধারণ জন অর্থে বোঝায়। Folk এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘লোক’। তাই সাধারণ ভাষার যে বৈচিত্র্য লোকস্তরে প্রচলিত আছে, লোকভাষা বলতে তাকেই বোঝান হয়। ভাষার সাধারণভাবে গ্রামীণতার যে লক্ষণগুলোকে শহরের লোক আলাদা করে চিহ্নিত করে সেগুলোই লোকভাষা বা গ্রাম্য ভাষার নির্ণায়ক। এই কারণে আমরা Folk language এর বাংলা হিসেবে গ্রাম্য ভাষা কথাটি বলে থাকি, লোকভাষা নয়। গ্রাম্য শব্দের প্রচলিত অর্থ অমার্জিত, নিকৃষ্ট ইত্যাদি। লোকভাষাকে অনেক ক্ষেত্রে গ্রাম্য ভাষার সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। লোকসমাজে প্রথাগত শিক্ষার ধারা নেই। তারা কথ্য ভাষার সহজাত অধিকারকে প্রকৃতির দান বলে মনে করে। লোকসমাজ বিষয়ক নানা তথ্য আলোচিত হয় লোকোসংস্কৃতি বিদ্যায়, লোকভাষা তার একটি অঙ্গ মাত্র।
লোকভাষার সঙ্গে লোকসমাজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। লোকসমাজের মধ্যেই লোকভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। লোকসমাজ গোষ্ঠীবদ্ধ এবং সামাজিক অনুশাসন মানে। সুতরাং গোষ্ঠী অনুভূতি-লব্ধ সংহত সামাজিক ঐক্য গঠন করে। যদিও তাদের ভাষিক ঐক্যের দিকগুলো যতটা সমাজগত ততটা ভাষাগত নয় । তাই লোকভাষার অস্তিত্ব স্বতন্ত্র কোন অঞ্চল বা জাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে অভিন্ন নয় । বরং পরম্পরাক্রমে বয়ে হয়ে আসা সমবেত অভিজ্ঞতার বিচিত্র রূপ যার মধ্যে ধরা থাকে তাকেই লোকভাষা বলা যায়। লোকভাষার স্থায়ী, স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট কোন সীমানা নেই, সন্নিহিত ভাষা অঞ্চলগুলোর মধ্যে পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্নতা রক্ষা করা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পারস্পরিক মেলামেশার নানা উপলক্ষ্য – হাট, মেলাপরব, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান যোগাযোগ রক্ষার অন্যতম মাধ্যম রূপে ব্যবহৃত হয়। এইভাবে আঞ্চলিক ভাষারীতি সীমানা নিত্য পরিবর্তনশীল।৩ কিন্তু লোকসমাজের অঞ্চলসীমার মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে কৌম জনগোষ্ঠীগুলোর বসতি থাকায় তারা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে, পরস্পরের মধ্যে এবং সাধারণ লোকসমাজের সঙ্গে মেলামেশা করলেও নিজস্বতা ত্যাগ করে না। বর্তমানে এই অবস্থার সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়- নদী, পর্বত এবং দুর্গম অরণ্য মালভূমি অঞ্চল লোকভাষার সম্পর্ক গঠনে বাধা সৃষ্টি করে না। উন্নয়নশীল জনগোষ্ঠীগুলো লোকোভাষাকে জনভাষায় উন্নীত করতে চেষ্টা করে চলেছে ।
লোকসমাজে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যসম্মত ভাষিক রূপ ধরা পড়ে। লোকভাষায় ঐতিহ্যবাহিতার সঙ্গে পরিবর্তনও স্বচ্ছন্দে চলে। ভাষিক স্তরবিন্যাসে লোকভাষার উপরে আছে জনভাষা, শিষ্টভাষা এবং মান্যভাষা। তাই লোকভাষার ভেদরূপের প্রভাব উপভাষার মধ্যে দেখা যায়, যেমন- নোয়া (লৌহ) এবং সত্য (সতীন) ইত্যাদি। লোকভাষাকে কোন অঞ্চল-সীমায় বাঁধা যায় না, তা বিশেষ লোকসংস্কৃতি-বৃত্তের অধীন। লোকভাষার সাধারণ রূপই হয়, কোন ব্যক্তিভেদ বা গোষ্ঠীভেদ হয় না। মৌখিক বা কথ্যভাষা রূপে উপাদান লোকভাষায় প্রচ্ছন্নভাবে ধরা থাকে মাত্র। লোকসংস্কৃতির উপাদান গুলোর মতই তা পরিবর্তন ক্রিয়াশীল। লোকসমাজের সীমায় লোকভাষা আবদ্ধ। যদিও উপভাষার স্তরেই লোকভাষার অবস্থান, তবু উপভাষার চেয়ে তার মর্যাদা অনেক বেশি। এই ভাষিক প্রক্রিয়া যখন অন্য কোন মাধ্যমকে আশ্রয় করে থেকে যায়, তখন বলা হয় লোকসাহিত্য ।
লোকভাষার মুখ্য আলোচ্য বিষয় বাক্-রীতি ও শব্দভান্ডার বলে অনেক মনে করেন। কিন্তু লোকসংস্কৃতিবিদগণ লোকভাষার ক্রিয়াশীলতা বিচারে নিষেধ (taboo) সংস্কার (superstition) লোক-নিরুক্ত (Folketymology) প্রভৃতি প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। লোকভাষা সীমিত সমাজ ও সংস্কৃতির স্তরে আবদ্ধ, লোকভাষা ও সংস্কৃতির পরম্পরার অঙ্গীভূত। লোকভাষায় সংকেতগুলো কম পরিবর্তনশীল। তাই তাতে সংরক্ষণশীল উপাদানের পরিমাণও বেশি। লোকভাষার শব্দ-ভাণ্ডার লোকধারার আনুষঙ্গিক শব্দ-সম্পদে পূর্ণ। যেমন- সাতভউনি, তিরপূর্নির ঘাট, বেঙ্গমা-বেঙ্গমী, সাত সমুদ্র তেরো নদী, তেপান্তর ইত্যাদি। লোকভাষা অন্তর্গূঢ় ও বদ্ধ। শিষ্টভাষায় যেমন শব্দের মধ্যে পরিবর্তনের বীজ লুকিয়ে থাকে, লোকভাষায় শব্দের নমনীয়তা অনেক কম। ধ্বনির আগম, লোপ, সাম্য ও বৈষম্য, সাদৃশ্য, লোক-নিরুক্তি ইত্যাদি সূত্রের সাহায্যে ধ্বনি প্রক্রিয়া যাচাইয়ের মাধ্যমে লোকভাষার আঞ্চলিক তারতম্য উপলব্ধি করা যায়। লোকভাষার স্বরূপ বুঝতে গেলে প্রবাদ ও ধাঁধার বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
লোকভাষার প্রকরণ বা উপাদানগুলোর বিন্যাসের রূপভেদগত চারটি ভাগ – ১) স্থানু বা নিশ্চল ২) বিকার বা রূপান্তর ৩) ভেদ বা বৈচিত্র ৪) চলমানতা। ভাষিক উপাদান পূর্বাপর যে ভাবে চলে আসছে, তাই তার স্থানুত্ব যেমন বেঙ্গমাবেঙ্গমী, সুয়োদুয়ো, রাক্ষস খোক্ষস, প্রাণভোমরা—রূপকথায় ব্যবহার; ইতু, এয়োতী, নোয়া— ব্রতকথায় ব্যবহার; ছড়াও ধাঁধার সঙ্গে—আঁটুল-বাঁটুল, নোটন নোটন, ইকির মিকির, সাপুর সুপুর ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার হয়েছে। তেমনি ভাষিক উপাদানের বিকার বা পরিবর্তন ঘটে- জুতা> জুতোয়া, বেড়ান> বেড়ু, উঁচু কপাল> উচকপালি ইত্যাদি শব্দে। লোকনিরুক্তির ফলে অতল>ইতল, অরণ্য> আরুণ, ত্রিবেণী> তিরপুন্নি ইত্যাদি শব্দ হয়। সমজাতীয় রূপাদর্শের মধ্যে বিভিন্ন প্রকরণের স্থান- বিনিময় ঘটেছে যাকে ভেদরূপ লোকপ্রকরণ বলা যায়, যেমন মানুষ> মিনসে, মেয়ে মানুষ> মাগী ইত্যাদি। লোকভাষায় পুনরাবৃত্তির বিশেষ ভূমিকা আছে। যেমন- তুলসী—তুলসী নারায়ণ,কুল—কুলতি—কূলবতী, ধন—ধন—ধনীয়া ইত্যাদি।
লোকভাষা চর্চার আরেকটি প্রধান লোকসাহিত্য। সৃষ্টি ও ব্যবহারে মৌখিক হলেও সাহিত্য ভাষা বলে সমাজের সাধারণ ভাষার সঙ্গে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কারণ লিখিত সাহিত্যের ভাষা কথ্য রূপের তুলনায় যতখানি পার্থক্য স্বীকার করে, লোকসাহিত্যের ভাষায় সেই পরিমাণ শীলন ও মার্জনের সুযোগ নেই। তাছাড়া লোকভাষা পারস্পরিক ও সামাজিক উপাদানে সমৃদ্ধ। তাই মৌখিক সাহিত্যে রূপান্তর তত স্পষ্ট নয়। রূপান্তর এমন ভাবে চলে যা লোকসমাজের সাধারণ রূপান্তরের সমান। ঐতিহ্যানুগ নিরর্থক শব্দের সঙ্গে নতুন শব্দের পাশাপাশি অবস্থান পুরনো ধ্বনির জগতই সৃষ্টি করে। ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, কথা ইত্যাদি রচনা ও পরিবেশনে পারিপাট্যের ছোঁয়া ও শিল্পবোধের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। তাই লোকভাষার আলোচনায় লোকসাহিত্যের ভাষা হল প্রধান ভিত্তি।
লোকসাহিত্যে লোকভাষার যে দৃঢ় এককগুলো চিহ্নিত করা দরকার তা হল কথাবীজ এবং লোকপ্রকরণ। সমাজভাষিক প্রকরণই লোক প্রকরণ। সমাজবন্ধনের যৌথ আবেগ থেকে নানা লোকপ্রকরণের উদ্ভব হয়। লোকভাষার সংজ্ঞাপন রীতির প্রকৃতির একটু স্বতন্ত্র। তার প্রায়োগিক পরিবেশে লিঙ্গ, বয়স, বৃত্তি, কৌম, ধর্ম, ঐতিহ্য ও প্রথার গুরুত্ব আছে। লোকসাহিত্যে এদের যথাক্রমে মেয়েলি ছড়া,, ছেলে ভুলানো ছড়া, পটুয়া গান, মেছুনি গান, ব্রত কথা, ডাক ও খনার বচন এবং গীতিকা বা গাথায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। লোকভাষার শব্দ ও তার অর্থভেদ বাহ্যিক – তার মধ্যে বৃত্তি, লিঙ্গ, শ্রেণী, জাতি ও গোষ্ঠীভেদের পরিচয় প্রচ্ছন্ন থাকে। প্রত্যেক বৃত্তিধারীর নিজস্ব কিছু শব্দ থাকে, যা নিজেদের মধ্যেই শুধু প্রচলিত – ঘরামি, ছুতোর, কামার, কুমোর, ডোকরা, তক্ষক, বাজনদার ইত্যাদি।
দেখা যায় লোকসাহিত্য ভাষারূপের দিক থেকে আঞ্চলিক ও সামাজিক বৈচিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলা লোকসাহিত্যে ভাষার বাকরীতি ও শব্দ ভান্ডারের মুখ্য বিষয় ধ্বনি ও রূপগত সরলতা। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের মতো লোকমনে এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। লোকসাহিত্যের ভাষায় কথ্যরীতির চলন জীবনের চলমানতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলে এবং মূল বা উৎস থেকে আগত শব্দের লোকসংগত রূপান্তরই টিকে থাকে। যেমন-বেঙ্গমা-বেঙ্গমী, শত্তুর,পুত্তুর, দুগ্গা, বদ্দি ইত্যাদি।
ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে লোকসমাজের নাড়ির যোগ, তা লোকভাষায় আঞ্চলিক ভেদ ও সামাজিক সংস্কারের মিলিত প্রতিক্রিয়ার ফল। তাই লোকভাষার ভাষিক উপাদানের মধ্যে লোকভাবনা ও সমাজ মনস্তত্ত্ব স্পষ্ট ভাবে থাকে। জনভাষার সংকেত গুলোর সঙ্গে লোকভাষার সংকেত গুলো নির্বাহিক বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। কিন্তু লোকসংস্কৃতি ধারণার সঙ্গে তা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত থাকায় দুটি ধারণাই পারস্পরিক নির্ভরতা দাবি করে।
লোকভাষা চর্চাকে আরো স্বাধীন, যথাযথ ও বিস্তৃত করতে হবে। লোকসমাজের অভিবাসন-রীতি, প্রতিবেশী ভাষার সঙ্গে সংযোগ ও বিচ্ছিন্নতাবোধ, উপভাষা ও লোকভাষার সম্পর্ক, সামাজিক স্তর -বিন্যাস ও শ্রেণী ভেদ, পরিবেশগত ভাষিক রূপ এবং বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে লোকভাষার স্বরূপ বোঝা কঠিন। লোকস্তরে সমাজে, সাহিত্যে, নাট্যে শব্দ ও বাক্যগত বিশ্বাস-সংস্কার ও অভিজ্ঞতার মধ্যে বাচিক বোধগম্যতা ও সক্ষমতার দিকগুলো অন্বেষণে জোড় দিতে হবে। লোকভাষার মৌলিক বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কিছু থাকলে তার সন্ধান করা প্রয়োজন। লোকভাষার গোষ্ঠী-অনুভব যতটা ভাষিক ঐক্য গড়ে তোলে, তার চেয়ে বেশি গড়ে তোলে সামাজিক ঐক্য। তাই বলা যায় লোকভাষার Unit ভাষাগত নয় সমাজগত।
তথ্যসূত্র
১। সায়েন্স অফ ল্যাঙ্গুয়েজ- পৃঃ-৪।
২। Socio linguistics – Page 3.
৩। লিঙ্গুইস্টিক্স -পৃঃ- ২৭৭।
সহায়ক গ্রন্হ
১। আই.জে.কে তারাপোরওয়ালা – সায়েন্স অফ ল্যাঙ্গুয়েজ।
২। এল.আর.পামর- লিঙ্গুইস্টিক্স ।
৩। পল্লব সেনগুপ্ত – লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ।
৪। মানস মজুমদার – লোকসাহিত্য।
৫। আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলার লোকসংস্কৃতি।
৬। প্রবোধকুমার ভৌমিক – লোকসমাজ ও সংস্কৃতি।
e-mail-srabanisn1@gmail.com Mobile no- 6290242709