Exploring Raga Music on Western Instruments in India

Debasish Mandal

Abstract: This research delves into the captivating fusion of traditional Indian Raga music with Western instruments, transcending cultural boundaries and creating a unique musical landscape. Through a comprehensive exploration of the historical context and the evolution of Raga music, this study aims to analyze the intricate adaptation and interpretation of these melodic frameworks on Western instruments within the Indian musical milieu. By examining the interplay of diverse musical traditions, the research seeks to unveil the creative processes, challenges, and artistic innovations that arise when Western instruments engage with the rich tapestry of Raga music in the Indian context. The findings contribute to a broader understanding of cross-cultural musical expressions, fostering appreciation for the dynamic synthesis of traditions that enrich the global musical mosaic.

পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রে রাগ সঙ্গীত

ড. দেবাশিস মন্ডল,  প্রফেসর, যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

কলকাতায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই। বানিজ্যিক প্রয়োজনে কলকাতা শহরের পত্তন হয়েছিল। তিনশোর বেশি বছর আগেই কলকাতা শহর দেশ বিদেশের সঙ্গে বানিজ্যিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বহু মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে। সে সময় বানিজ্য হত মূলত জলপথে। ফলে গঙ্গা ও তার উপনদীগুলির অববাহিকা অঞ্চলে বেশি ঘর-বাড়ি গড়ে ওঠে। কলকাতাও গঙ্গার পূর্ব দিকে ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে। সে সময় কলকাতায় বসবাস করত মূলতঃ বণিক ও ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষেরা তাদের পরিবার। এদের শিক্ষা, চিকিত্সা, ও অন্যান্য প্রয়োজনে আরো মানুষ আসে। এভাবেই কলকাতা ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ নগরে পরিণত হয়। বিত্তবান মানুষদের সুখ স্বাচ্ছন্দ ও বিনোদনের ব্যবস্থা হয়। কিছু শিল্পীও কলকাতার আশে-পাশে জড়ো হয়। মাঝে মাঝে তাদের ডাক পড়ত জমিদার ও বনিকদের বাড়িতে। কলকাতায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা ও অনুষ্ঠান শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। আর ঊনবিংশ শতাব্দীতে উচ্চাঙ্গ সংগীতের বেশ সমৃদ্ধি হয়। এই শতাব্দীর শেষের দিকে কলকাতায় আসেন অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। তার সংগে একটা বড়ো সংখ্যক কবি ও সংগীত শিল্পী কলকাতায় এসেছিল।  তিনি নিজে উচ্চাঙ্গ সংগীত করতেন। কলকাতার মেটিয়াবুরুজে নিয়মিত উচ্চাঙ্গ  সংগীতের আসর বসাতেন। বহু জ্ঞানী গুনী মানুষ, রাজা জমিদার ও পাত্র-মিত্র আমন্ত্রিত হতেন তাঁর সভায়। সেখানে খেয়াল, ঠুংরী গান হত, কত্থক নাচ বা বাইজী নাচ হত। এই সময় থেকেই কলকাতা ও তার আশ-পাশের রাজা জমিদাররাও সংগীতের আসর বসাতে শুরু করে। ক্রমে তা আরো প্রসারিত হয়। অভিজাতদের বাড়িতে প্রথমে বৈঠক খানাতে, পরে বাড়ির অন্দর মহলে জায়গা পায় উচ্চাঙ্গ সংগীত। সাধারণ মানুষদের মধ্যে এই সংগীতের প্রসার ঘটে। সাধারণ মানুষেরাও উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চা শুরু করে। এর আগে পর্যন্ত সংগীত, নৃত্য ছিল গরিব বা নিম্ন বর্ণের মানুষদের চর্চা বা পরিবেশনের বিষয়। এই সময় থেকে সংগীত ক্রমে অভিজাত ও সাধারণ মানুষের চর্চা ও শিক্ষার উপকরণ হয়ে ওঠে। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সংগীতকে সম্মানজনক  অবস্থায় পোঁছুতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু কলকাতা ও আশ-পাশে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই সময় থেকে। আদি কলকাতা বা উত্তর কলকাতার বিত্তবান পরিবারগুলিতে ধ্রুপদ ও খেয়াল বেশ সমাদৃত হলেও বাইজী নাচ ও গান সেভাবে সম্মান পায়নি। এর সঙ্গে জমিদারদের স্বেচ্ছাচারিতা ও পদস্খলনের অনেক সামাজিক কারণ জড়িয়ে ছিল। যাই হোক ইংরেজদের আমলেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুপ্রসার ঘটে কলকাতায়।

ভারতীয় সংগীতের সূচনা হয়েছিল প্রত্নতাত্ত্বিক সভ্যতার যুগে।  কিন্তু সেই যুগে সংগীতের রূপ কি রকম ছিল তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তার কারণ সে সময়কার সংগীত সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা বা প্রামান্য তথ্য পাওয়া যায়নি।  ভারতের সংগীত সম্পর্কে আমরা প্রথম জানতে পারি বৈদিক যুগ থেকে।  সে সময় যারা মন্ত্র তন্ত্র নিয়ে কাজ করত, তারা মন্ত্রগুলিকে সুরে ও ছন্দে উচ্চারণ করতেন। বারে বারে তা উচ্চারিত হত। ফলে সাধারণের মনের মধ্যে তা গাঁথা গয়ে যেত। তাই বেদ মন্ত্রগুলিকে কে বলা হত শ্রুতি।  পরবর্তীকালে সুরে উচ্চারিত মন্ত্রগুলি সংগীতে পরিণত হয়। যাকে আমরা বৈদিক সংগীত বা সাম গান বলে থাকি। বৈদিক সভ্যতা হাজার বছর ধরে বিস্তৃত ছিল। এ সময় ভারতের সংগীত কিরকম ছিল তা বৈদিক মন্ত্রগুলি থেকে কিছুটা ধারণা করা যায়। বিভিন্ন সংগীত গবেষক বৈদিক যুগের সংগীত সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। তা থেকে জানা যায় বৈদিক সংগীত বিকশিত হয়েছিল নির্দিষ্ট নিয়ম ও ধর্মীয় বিধি-নিষেধ এর অনুকরণের মধ্য দিয়ে। ধর্মীয় বিধি নিষেধের কারনেই বৈদিক সংগীত অপরিবর্তিত থেকেছে বা বেশি পরিবর্তীত হয়নি।   কিন্তু বৈদিক যুগের প্রথমের দিকে মন্ত্রগুলি লিখে রাখা হতো না। মুখে মুখে প্রচারিত ও স্মৃতিতে ধরে রাখার কারণে তার মধ্যে নানা পরিবর্তন ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। যাই হোক, ধর্মীয় আচার আচরণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল ধরে এই মন্ত্রগুলি পরিবেশিত হয়ে এসেছে এবং বিকশিত হয়েছে। ধর্মীয় আচার-আচরণের ক্ষেত্রে যারা মূল দায়িত্ব পালন করতেন তারা ঋত্বিক বা হোতা। তারা এই মন্ত্র গুলি উচ্চারণের নিয়ম পদ্ধতি নিরূপণ করছেন। সুনির্দিষ্ট প্রণালীর মধ্য দিয়ে এই মন্ত্রগুলি প্রবাহিত হয়ে এসেছে। বিভিন্ন যুগে এক স্বর থেকে সাত স্বরের বিকাশ হয়েছে। বৈদিক মন্ত্রগুলিও উন্নততর হয়েছে। বৈদিক মন্ত্রগুলির সঙ্গে বিভিন্ন ছন্দের ব্যবহারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।  বৈদিক মন্ত্রগুলি যে সংখ্যক অক্ষর নিয়ে রচিত হত তার ওপর ভিত্তি করেই বৈদিক ছন্দের মান নির্ধারণ করা হত।  

বৈদিক মন্ত্র গুলি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছিল এবং নির্দিষ্ট পরিসরের বাইরেও তার প্রভাব পড়েছিল।  অভিজাত ও সাধারণের মধ্যে বৈদিক মন্ত্রগুলি যাগ-যজ্ঞ ব্যতীত গাওয়া নাহলেও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে হয়তো অনুরূপ সংগীত পরিবেশিত হত। সেগুলো সব সময় সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে গীত হত না। কিন্তু সে যুগের সঙ্গীত গুনীরা এই বিপথগামী সঙ্গীতগুলিকেও প্রনালীবদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করেন।   এই সময়ের  উন্নত সংগীতগুনীদেরকে বলা হত গন্ধর্ব। গন্ধর্বরা যে সব উন্নত গান পরিবেশন করতেন তাকে বলা হত গান্ধর্ব সঙ্গীত। এঁরা একাধারে সঙ্গীত গুনী অন্যদিকে সঙ্গীত তত্ত্ববিশারদ। এঁরাই সঙ্গীতের তত্ত্ব সম্বন্ধে নানা গবেষণা করে তার তার রূপ নির্ধারণ করেছেন। ভরত মুনী তার মধ্যে একজন বিশিষ্ট্য সঙ্গীতগুনী। সেই যুগে যেসব গন্ধর্বদের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি তারা হলেন তম্বরু,  অখিল, বিশ্বাবসু, দত্তিল, মতঙ্গ  প্রমূখ।  এই অভিজাত সংগীত পরবর্তীকালে আরো সুনির্দিষ্ট প্রনালীবদ্ধ রূপ গ্রহণ করে মার্গসংগীতে পরিণত হয়।  যা ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের এবং অত্যন্ত প্রণালীবদ্ধ সংগীত। উৎকৃষ্ঠ ও প্রণালীবদ্ধ বলেই এই সঙ্গীতকে বলা হতো প্রবন্ধ গান। বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ গান এই যুগে বিকশিত হয়েছিল। পরবর্তী যুগে এই গানগুলি সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলেও আরো বিস্তৃত পরিসরে তার ব্যাপ্তি ঘটেছিল। তার মধ্যে বর্তমান পাকিস্তান, আফগানিস্তান, রাজস্থান ইত্যাদি রাজ্যের নাম উল্লেখ করা যায়। এখনো এইসব অঞ্চলের প্রচলিত বিভিন্ন সঙ্গীতের সঙ্গে বর্তমান রাগ সঙ্গীতের যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। যা থেকে একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে উত্তর ভারতের প্রচলিত অভিজাত সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ধারাগুলির আরো উন্নত রূপ হল রাগসঙ্গীত বা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত।   

তখনও ভারতে প্রচলিত বর্তমান যে উচ্চাঙ্গসংগীত তার রূপ চোখে পড়েনি।  সেই যুগেই বিকশিত উন্নত সংগীতগুলি হল প্রবন্ধ গান। প্রবন্ধ গান হল প্রকৃষ্ট রূপে নিবন্ধ এক ধরনের সংগীত যা কোন নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে গাওয়া হতো। বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ গান ছিল। তার পরিধিও বিস্তৃতি ছিল ভিন্ন ধরনের। দীর্ঘদিন ধরে প্রবন্ধ গান ভারতের প্রায় সর্বত্রই পরিচিতি লাভ করেছিল ও বিস্তৃতি লাভ করেছিল।  মুসলিম শাসনের যুগে আরব এবং পারস্যদেশ থেকে যে সব মানুষেরা ভারতে এসেছিল তাদের সংগীত ও সংস্কৃতির সঙ্গে  ভারতীয় সংগীতের সংমিশ্রণ ঘটে।  ভারতীয় প্রবন্ধ গানগুলিরও পরিবর্তন ঘটে।  কেউ কেউ বলে থাকেন প্রবন্ধ গানের সঙ্গে পারস্য সঙ্গীতের সংমিশ্রনের ফলে ভিন্ন ধরনের সংগীত বিকশিত হয়। অনেকে মনে করে থাকেন কৈবাট প্রবন্ধ থেকে খেয়াল এবং ধ্রুব প্রবন্ধ থেকে ধ্রুপদ গানের সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও এ সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য ভিন্ন মত রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ গান এই যুগে বিকশিত হয়েছিল। পরবর্তী যুগে এই গানগুলি সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে ও আরো বিস্তৃত পরিসরে ব্যপ্ত হয়েছিল। তার মধ্যে বর্তমান পাকিস্তান, আফগানিস্তান, রাজস্থান ইত্যাদি রাজ্যের নাম উল্লেখ করা যায়। এখনো এইসব অঞ্চলের প্রচলিত বিভিন্ন সঙ্গীতের সঙ্গে বর্তমান রাগ সঙ্গীতের যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। যা থেকে একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে উত্তর ভারতের প্রচলিত অভিজাত সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ধারাগুলির আরো উন্নত রূপ হল রাগসঙ্গীত বা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত।   

অনেকে মনে করেন  মুসলিম আমলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিকাশ হয়েছিল। যারা উচ্চাঙ্গ সংগীত বিকশিত হতে সাহায্য করেছিলেন তাদের মধ্যে আমির খসরু ছিলেন অন্যতম বিশিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।  সে সময় আলাউদ্দিন খিলজী ভারতে রাজত্ব করতেন। আরো পরে মুঘল রাজাদের সময় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আরো সমাদর লাভ করে। মূলত নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই সংগীত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। যখন আকবর তার দরবারে সঙ্গীত গুনীদেরকে জায়গা করে দিয়েছিলেন এবং তিনি নিজে সঙ্গীতের একজন সমঝদার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অন্যান্য কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত সংগীতের আসর বসাতেন এবং সংগীত গুণীদের কে যথাযথ পারিশ্রমিক বা উপঢৌকন দেওয়ার মধ্যে সম্রাট আকবরের সাংগীতিক বোধের পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সময়ে তার সভা সভা গায়ক হিসেবে ছিলেন মিয়া তানসেন। তাঁর সম্পর্কে আমরা অনেক কাহিনী মুখে মুখে শুনতে পাযই। তার মধ্যে যথার্থতা যতখানি থাকুক না কেন, একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে নবাব আকবরের দরবারে যে স্থান করে নিয়েছিলেন এবং সম্রাট আকবর তানসেন কে যেভাবে মূল্যায়ণ করেছিলেন তা সত্যিই অতুলনীয়। তার সূত্র ধরে সে সময় সেখানকার পাশাপাশি অঞ্চলে সংগীত শিক্ষা এবং সংগীত শ্রবনের প্রতি গুরুত্ব অনেকখানি বেড়ে যায়।  দেখা দেখি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় জমিদারেরা উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। এভাবেই ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত দিল্লি থেকে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে  পড়ে।  দিকে দিকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে নানা গবেষণা (চর্চা) শুরু হয় এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কে আরো জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে বহু মানুষ তাদের প্রতিভাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। এক দিক দিয়ে যেমন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হিসাবে ধ্রুপদ খেয়াল বিকাশিত হয়েছে। ভারতীয় নৃত্য শৈলীর প্রসার ঘটেছে এই সব উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নৃত্য এবং অন্যান্য ভারতীয় বিভিন্ন চারুকলা শুধুমাত্র আরব থেকে আসেনি এগুলি ভারতের সনাতন শিল্প-সংস্কৃতির ধারক-বাহকও বটে। শিল্প সংস্কৃতির মিশ্রণের ফলে নতুন নতুন সঙ্গীত ধারা গড়ে ওঠে এবং তা বিকশিত হতে থাকে। দিল্লির পাশাপাশি বেনারস ও সংলগ্ন অঞ্চলে উচ্চাঙ্গসংগীত জনপ্রিয়তা গভীর হয়। বহু মানুষ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং তার সত্যতা হিসাবে গড়ে ওঠে পাশাপাশি সংগীতের সঙ্গে উচ্চাঙ্গ নৃত্য এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি কত্থক নৃত্য। ১৮৫৭ সালে কলকাতায় মেটিয়াবুরুজে স্থানান্তরিত হয়ে পড়লে তার সঙ্গে লোকজনও কলকাতায় আসে। সংগীত নৃত্য শিল্পী বাদ্য বাদ্যযন্ত্র নির্মাতারাও তার সঙ্গে কলকাতায় আসে। এইসব ঘটনা চক্রে কলকাতা সে দিক থেকে কতকগুলি সাঙ্গীতিক উপকরণ পেয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে মেটিয়াবুরুজে এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলের সঙ্গীত চর্চা বাড়তে থাকে। কলকাতায়ও তার নানা প্রভাব পড়ে। কলকাতার রাজা জমিদার এবং বিশিষ্ট মানুষেরা উচ্চাঙ্গ সংগীতের স্বাদ পেতে থাকে। তারাও তাদের নিজস্ব পরিসরে নিজেদের জায়গায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চা  উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আয়োজন করতে থাকে।  এভাবেই উচ্চাঙ্গ সংগীত কলকাতায় একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে। 

এই সময় ও এর আগে কলকাতায় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মূলত বাংলার গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছিল।  সেই ধারার সঙ্গে যখন বাদশাহী নতুন ধারা এসে হাজির হয়। কলকাতার মানুষ তাকে সাদরে গ্রহণ না করলেও ক্রমে গুণী মানুষেরা তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন এবং তারাও সেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চার মধ্যে নিজেদের কে নিযুক্ত করেন। ইতিমধ্যে ইংরেজদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে,  কলকাতায় ইংরেজরা তাদের শাসন পরিচালনার জন্য কলকাতাকে রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলেছে। তার সূত্র ধরেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগমন ঘটেছে কলকাতায।

ওলন্দাজ, ইংরেজ ও পোর্তুগিজ বনিক, মিশনারী ও প্রশাসকদের ছেলেমেয়েদের লেখা-পড়া ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার জন্য কলকাতায় অনেক স্কুল চালু হয়। যা বাঙালিদেরও অনুপ্রাণিত করে। কলকাতায় বাঙালিদের জন্যও স্কুল চালু হয় দেশীয় অগ্রণী মানুষদের প্রচেষ্টায়। সংগীত শিক্ষারও ব্যবস্থা হয়। সংগীতের স্কুল গড়ে ওঠে। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের সংগীত শেখানোর জন্য অভিজাতরা এগিয়ে আসেন। নিজেদের বাড়িতে গৃহ শিক্ষক রেখে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখানোর বন্দোবস্ত হয়। কলকাতায় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মানের সঙ্গে গাওয়ার রীতি চালু হয় ইংরেজ আমলে। বাংলার নব জাগরণ ভারতীয়দের সেভাবেই এগিয়ে দেয়। পাশ্চাত্য ভাবনা বাঙালি ও ভারতীয়দের ক্রমে আধুনিক করে তোলে। যা কলকাতায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রসারে বিশেষ সহায়তা করেছে।

কলকাতায় বেতার তরংগের সম্প্রসারণের ফলে উচ্চাঙ্গ সংগীত প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। উচ্চাঙ্গ সংগীতের স্বাদ অনুভব করে সাধারণ মানুষ। গ্রামোফোন রেকর্ড উচ্চাঙ্গ  সংগীতের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতীয়দের একপ্রান্তের মানুষের পরিবেশনা উপভোগ করেছে অন্য প্রান্তের মানুষও। গ্রামোফোন থেকে রেকর্ড প্লেয়ার বাজিয়ে একই রচনা বহুবার ধরে শুনেছে উপভোগ করেছে শত সহস্র মানুষ। উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষার ক্ষেত্রে এই গ্রামোফোন থেকে শুরু হয়েছে নতুন অভিযান। কলকাতার সঙ্গে ভারতের সকল প্রান্তের সাংগীতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এই সময় থেকে। ভারতের বাইরেও গেছে ভারতীয় সংগীতের রেকর্ড। অভারতীয়রা কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে উপভোগ করেছে ভারতের উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুরধ্বনি। কলকাতার অনেক সংগীতগুনী আমন্ত্রিত হয়ে সংগীত পরিবেশন করেছেন বিদেশে।  বিদেশ থেকে অনেকে সংগীতের টানে কলকাতায় এসেছেন। এভাবেই কলকাতার সঙ্গে বহির্বিশ্বের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে।

দ্বারকানাথ, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ অনেকেই ইংলণ্ডে গিয়েছিলেন। সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার আধুনিকতাকে এঁরা গ্রহণ করেছেন। ভারতীয়দেরও আধুনিক করে তোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহন করেছেন। প্রথমে নিজেদের বাড়িতে আত্মীয় পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের জন্য বিদেশ থেকে সে-দেশের বাদ্যযন্ত্র এনেছেন। শিখিয়েছেন নিজের ছেলে-মেয়েদের। বিদেশের সংগীতের সঙ্গে এভাবেই সম্পর্ক স্থাপন শুরু হয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। দেশি ও বিদেশি গানের চর্চা পাশাপাশি চলেছিল। দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠ সন্তান দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি সদস্যকে শিক্ষা সাংস্কৃতিক চেতনায় আধুনিক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টার অন্ত ছিলনা। বাড়িতে সব ধরণের শিক্ষার ব্যবস্থাই ছিল। গান বাজনা শেখানোর শিক্ষকও ছিল একাধিক। পাশ্চাত্য সঙ্গীত শেখানোর জন্য ইংরেজ শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছিল। বিষ্ণু, শ্রীকণ্ঠ সিংহ, যদুভট্ট শেখাতেন ভারতীয় সংগীত। ভারতীয় সঙ্গীতে পাশ্চাত্য প্রভাব পড়েছিল অষ্টাদশ শতকে ও পরবর্তীকালে। ঠাকুরবাড়িতে পিয়ানো বাজাতে পারতেন দেবেন্দ্রনাথ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ খুব ভালো পিয়ানো বাজাতেন। কত সুর তিনি রচনা করতেন পিয়ানোতে। কলকাতার পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বাজানো সম্ভবত হারমোনিয়ামেই শুরু হয়। যদিও ডায়াটনিক স্কেল। কাটা কাটা আওয়াজ। তবুও রাগের স্বরূপকে ধরতে বেশি অসুবিধা হয়নি। সন্তুর ভারতীয় বাদ্য হলেও পাশ্চাত্য বাদ্যের অনুসরণে তৈরি। কতকটা পিয়ানোর মত। তাতেও যে সুর রচিত হয় তা ঠিক শ্রুতির বিচারে মেলে না।

বিদেশের সংগে যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি পায় স্বাধীনতার পরে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভারতীয় সংগীত শিল্পীরা আমন্ত্রিত হতে থাকেন। অ-ভারতীয়দের মধ্যে ভারতীয় সংগীতের প্রতি প্রীতি বাড়তে থাকে। স্বাধীনতার পরে কলকাতায় ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহু সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বিদেশে সংগীত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন আলি আকবর খান। তিনি সুইজারল্যাণ্ডে, ইংলণ্ডে, আমেরিকায় ‘আলি আকবর কলেজ অব মিউজিক’ গড়ে তোলেন। সেখানে বহু বিদেশী ভারতীয় সংগীত চর্চার সুযোগ পান। আলি আকবর নিজে ও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা সেসব কলেজে সংগীত শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ভারতীয়দের পাশাপাশি অভারতীয়রাও ভারতীয় সংগীতকে নিয়ে নানা গবেষণা শুরু করেন। ভারতীয় সংগীত ক্রমে আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কলকাতার সঙ্গে ভারতের বাইরেও বিভিন্ন দেশের সংগে সাংগীতিক সম্পর্ক নিবিড় হয়। কলকাতায় বাদ্য যন্ত্রের কারিগরদের দক্ষতা সম্বন্ধে পৃথিবী জুড়েই সুনাম রয়েছে। ফলে বিদেশীরা বাদ্য যন্ত্র কেনা বা তৈরি করানোর জন্য কলকাতায় আসতে থাকেন বা অর্ডার দিতে থাকেন। এভাবেও কলকাতার সংগে অ ভারতীয় শিল্পীদের সম্পর্ক বাড়তে থাকে।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল কলকাতায় সারা দেশের ও সারা পৃথিবীর সব দেশের মানুষ মিলে মিশে বসবাস করেন। প্রতিদিন দেশ বিদেশের বহু মানুষের আনাগোনার শহর কলকাতা। তাই কলকাতাকে অনেকে ‘ছোট্ট পৃথিবী’ বলে থাকেন। এছাড়া ভারতীয়রা কলকাতাকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী মনে করেন। বিশেষ করে সংগীত শিল্পীরা কলকাতায় অনুষ্ঠান করে যে সমাদর পান ভারতের আর কোথাও এই সমাদর পান না। ফলে সমস্ত গুনী শিল্পীরা কলকাতায় অনুষ্ঠান করার জন্য সুযোগের অপেক্ষা করেন। বিদেশীরাও কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিশ্বায়নের পরে কলকাতার সঙ্গে দেশ বিদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার আরো উন্নতি হয়। 

কলকাতার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়েও পরীক্ষা গবেষণা চলেছে বহু কাল ধরে। বেহালা যেভাবেই আসুক তার সুর ভারতীয় রাগ রচনায় অনবদ্য একথা সবাই মানবেন। উস্তাদ আলী আকবর খান বিদেশে ‘আলী আকবর কলেজ অফ মিউজিক’ চালু করেছিলেন বিংশ শতকে। এরপর বিদেশে ভারতীয় সঙ্গীত এর চাহিদা বাড়ে। বড়, মাঝারি মাপের বহু শিল্পী কলকাতা থেকে ডাক পান আমেরিকায়, ইউরোপে। আলোচনা অনুষ্ঠান বাড়তে থাকে। বিদেশ থেকেও কলকাতায় আসেন বহু মানুষ এখানে থেকে বিভিন্ন গুনী শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হতে, আর শিখতে। তারাও সেতার, সরোদ বেহালায় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে বুঝতে ও বাজাতে শেখে। ভারতীয় সুর শিখে বুঝে নিজেদের যন্ত্রে ভারতীয় সুর বাজানোর চেষ্টা করে, সফলও হয়। যদি অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সম্পূর্ণরূপ একেবারে ঠিক ভাবে প্রকাশিত হয় না, তথাপি তা নতুনতর আবেশ সৃষ্টি করে। তাদের বাদন পদ্ধতি ভারতীয় সুরকে সমৃদ্ধ করেছে। সম্প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বহু বিদেশী শিল্পী কলকাতায় ভারতীয় পোশাক পরে নিজেদের বাদ্য যন্ত্রে বিভিন্ন রাগের সফল অনুষ্ঠান করছেন। এর মধ্যে কলকাতায় বেশ নাম করেছেন অল্টো স্যাক্সোফোনে অ্যানড্রিউ কে, সুপ্রানো স্যাক্সোফোনে জোনাথন কে। জেসে ব্যানিষ্টারও সম্প্রতি কলকাতায় বেশ কিছু অনুষ্ঠানে স্যাক্সোফোনএ ভারতীয় রাগ সংগীত পরিবেশন করেছেন। এরা ভারতীয় রাগ সংগীত পরিবেশন করছেন কলকাতার উত্তরে-দক্ষিনে, পূবে সর্বত্র। কলকাতা থেকেই ব্যাপ্তি ঘটছে ভারতীয় সংগীতের। এইসব শিল্পীরা কলকাতায় আসছেন। বহু অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হচ্ছেন। আবার কলকাতায় বহু গুরুর কাছে সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন কেউ কেউ। বিশ্বায়ণের এর পর গণমাধ্যম বিশেষ করে ইন্টারনেট এর মাধ্যমে যোগাযোগ বেড়েছে। আমেরিকা, ইউরোপে বসে কলকাতার সঙ্গীত গুরুর কাছে তালিম নিচ্ছে বহু শিক্ষার্থী। কলকাতায় ভারতীয় সংগীত শিখতে আসছে অভারতীয় বিদেশীরা অনেকেই। জাপান, ফিলিপাইন্স, আমেরিকা, ইউরোপ থেকে প্রতি বছরই ছাত্র আসছে। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের সঙ্গে মিশছে, বিদেশী সুর। হয়তো সমৃদ্ধ হচ্ছে। তবে পরীক্ষা নীরিক্ষার পর্ব শুরু হয়েছে বিশ্বায়ণের যুগে। এর সুফল নিশ্চয় মিলবে।

বিশ্বায়ণের পরে বিভিন্ন গণ মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ভারতীয় সংগীত চর্চা কী রকম চলছে সে সম্বন্ধে জানা যাচ্ছে। কারা কোথায় ভারতীয় সংগীত পরিবেশন করছে বা চর্চা হচ্ছে কীভাবে এসব জানা যাচ্ছে খুব সহজে। তা থেকে দেখা যাচ্ছে বহু ফরাসী, ইংরেজ, আমেরিকান সেতার সরোদ ও অন্যান্য বাদ্য যন্ত্রের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। international list of teachers on classical Indian music এর ওয়েব সাইটে বহু ভারতীয় শিল্পীর নাম দেখা যাচ্ছে। যারা নিয়মিত বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিবেশন করেন। এর মধ্যে ফ্রান্সে নিকোলাস ডিলাইক (Nicolas Delaigue ), আয়ারল্যাণ্ডে ম্যাথু ন্যুন (Matthew Noone), ইটালির ফ্যাবিরজিও ব্রুয়া (Fabrizio Brua), ফ্রাজ আলি (Fraaz Ali), রিকার্ডো বাটাগিলা ( Riccardo Battaglia), নেদারল্যাণ্ডের শ্রুথি আপ্পু (Sruthy Appu), লণ্ডনের এরমিস সাভন্তোগ্লৌ (Ermis Savvantoglou), বুধাপেস্ট এর টোথ জাবি (Toth Szabi) প্রমুখ। পৃথিবীর সব দেশেই ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের কদর ক্রমশ দিনদিন বেড়েই চলেছে।  শ্রোতার সংখ্যাও বাড়ছে। কলকাতায়ও অনেক অভারতীয় নিয়মিত আসছে। ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রে অভারতীয়দের হাতে বাজছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত। আবার বিদেশীরা অনেকেই তাদের দেশীয় বাদ্যযন্ত্রেও বাজাচ্ছে ভারতীয় সুর ঝঙ্কার। কলকাতায় আসছে বিদেশীরা। কলকাতা শ্রোতারা সব ধরণের গুনীদের সমাদর জানে। তাই বিদেশীরাও চান নিজেদের শৈল্পিক দক্ষতার মান যাচাই করে নিতে। তারা কলকাতায় অনুষ্ঠান করার জন্য যথেষ্ট উদগ্রীব থাকে। বিশ্বায়নের ফলে বিদেশের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পরষ্পরের সম্পর্ক নিবিড় হয়। ভারত ও কলকাতার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের যোগাযোগ বাড়ে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর সব দেশের মধ্যেকার সব খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশের শিল্পীদের সঙ্গে ভারতীয়রা পরিচিত হয়। নানাভাবে কলকাতায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের নতুন নতুন দিক উন্মেষিত হচ্ছে।                

The Philosophical Perspective on Biodiversity Conversation

SK ASRAFUL ISLAM , Assistant Professor Department of Philosophy, Government General Degree College Salboni , West Bengal, India

Email ID – skasrafulislam74@gmail.com

Abstract: We humans, like other species, share a common bond with this world. We accept that we are part of the animal world as a fundamental feature of our existence. In this world, we are related to each other in a relationship of interdependence. Ecosystems and the balance of the environment survive based on this reciprocity. Biodiversity generally refers to the diversity of life in a region’s ecosystems. This biodiversity includes microscopic organisms that cannot see with the naked eye and significant plants and animals. We, as humans, are only a part of it. All our food and survival depend on these diverse plants and animals. However, we cannot always bring this awareness that we are putting biodiversity in jeopardy through our activities.

So at the end of the 20th century, human life is now facing a complicated and unimaginable truth: environmental disaster and endangered human existence. Technology is being used almost arbitrarily by the need for wealth and abundance. As a result, the life force has been harmed by depriving nature of its essential resources and ordering ordinary practical objects to become useless.

The first thing needed to conserve biodiversity is to be aware of our environment and nature. Ancient Vedic literature says that moral order, the Rita Shakti binds the entire world. This moral code we cannot transgress and thereby owe to the whole of nature.

The relationship between the individual and the environment is reciprocal. We are all aware of what is happening due to our destruction of biodiversity. Humans have a greater responsibility to conserve biodiversity. If we look back to ancient India, we can see that the concept of biodiversity conservation is present there. The essence of Jain and Buddhist non-violence is to distribute love to all living beings and plants. So by ending the concept of anthropocentrism, we can hope to preserve biodiversity in the future by fostering virtues such as ethics by interacting with nature while maintaining harmony.

Keywords: environment, biodiversity, ecosystem, morality.

Introduction: Philosophy mainly deals with the world and life. Moreover, in this biodiversity is the mutual diversity of different organisms world, there are social, human beings and there are animals and plants. Therefore, biodiversity is the mutual diversity of different organisms. One can detect diversity among organisms primarily based on food environment and temperament. Therefore, even though biodiversity conservation is only a part of science, it can be discussed from the perspective of philosophy because philosophy has discussed how to protect the value of life by improving the quality of human life.

Furthermore, life means diversity in that life. In the same way that every portion of the human body is unique, so are all living things in this vast globe. Biodiversity in the language of science refers to the presence of different types of organisms ethnically or ecologically in a particular region or ecosystem in nature. In other words, ‘biodiversity’ refers to the wide variety of life on Earth. Scientists have discovered and named about 1.8 million different species of organisms, yet we still do not know how many species exist on Earth.

Causes of Biodiversity Destruction: Ours is one Earth, and only here is the diversity of life and life on Earth. Green plants on the land and plants in the sea provide the oxygen we use to breathe. If trees and oceans cannot absorb the carbon dioxide humans exhale into the sky, global temperatures will rise, posing a threat to life on Earth. All species depend on each other for survival. Thus, the linkages between different species bind animal life together. If a species dies, other species that depend on it die out or suffer a lot. However, we have lost biodiversity due to our various activities, that is, the people’s attitude towards this world and the environment and the vast biodiversity facing destruction due to various artificial reasons. According to the Bible, we find that when God created this world, everyone mentioned ‘they are good. We have now lost our superiority over the Creator. Thus in the kingdom of hunger, everything has become prosaic. Today we have eaten everything in pursuit of a livelihood.

Moreover, there are ethical reasons, cultural reasons, economic reasons and scientific research that have directly and indirectly destroyed biodiversity.

We can also claim several reasons behind the destruction of biodiversity in general, such as –

  1. Many species are losing their natural homes because of the large amounts of deforestation to make more farmland and cities. In addition, the human population is increasing exponentially, indirectly destroying biodiversity.
  2. People kill many wild animals for their food and fun.
  3. Illegal commerce across international borders involves many plant and animal species.
  4. Inability to find alternative habitats for wildlife that are losing their habitats.

Again, it is necessary to say that today, society has been bound by the political fence in such a way that day by day, people are becoming violent, cruel, and losing their pure spiritual qualities. As a result, people are becoming more immoral. People are not afraid to kill people, then how will he think about biodiversity? How will he give love to other creatures in the environment? Thus man has become self-indulgent. There is nothing he cannot do for happiness and enjoyment. Therefore, all human activities, lifestyles and work ethics, in a word, all our behaviours, affect the environment in one way or another.

Ancient India in Biodiversity Conservation: We will discuss why to save biodiversity. What is the need to conserve biodiversity? We can understand this by looking at ancient India to conserve biodiversity. Human love for nature and human fascination with nature’s beauty has become a subject of consideration since ancient times.

Swami Vivekananda’s words, “He who loves life, serve God”, is the seed mantra of biodiversity conservation. Mahapurusha has repeatedly spoken of saving living beings. Some say killing living beings is a great sin, and others serve living beings with knowledge of Shiva. Shri Vishnu said to preserve the biosphere by suppressing evil and observance of creation – to establish religion in this world burdened with adharma, which means removing harmful elements for the biosphere and establishing beneficial elements. As the guardian of the living world, he kills the snake in Kalika and protects the animals along the Yamuna. He portrayed Govardhan Parvat as a form of nature to show the importance of flora and fauna in human life and that the role of nature in their nourishment is much more acceptable than that of Indra, the thunder god.

We find that different deities have their vehicles. Most vehicles are wildlife specific, such as tigers, lions, elephants, snakes, mice, owls and swans. Targeting all these animals are herbivores and carnivores on the one hand, terrestrial and aquatic animals, birds and insects on the other. Besides, some imaginary animals or gods and goddesses have animal parts. Like Garuda, Siddhidata Sri Ganesha Hiranyakashipu etc. Again, the close relationship of different gods and goddesses with some types of plants can be observed, such as the jaba flower with Kali, tulsi with Narayan, the banana tree with Shri Ganesha, betel tree with Kartika, Manasa with Fonimansa tree, Dhutra with Shiva, Akunda, Aparichita and Bel tree. So there is a close relationship with Hindu gods and goddesses. So it is good to accept that biodiversity conservation was present even in ancient Indian and Puranic times.

Buddhist and Jain non-violence in biodiversity conservation: Again, we can draw upon the non-violence of the Jains to preserve this biodiversity. Similarly, the Buddhist theory of non-violence is equally acceptable. Today, human violence is increasing due to their skyrocketing needs. We need to stop this violence. In this situation, we can talk about the Pancha Mahavrata of Jains. That is, one of the five Mahavrata is non-violence. Jains say ‘Ahimsa param dharma’ – they claim that only the killing of living beings belongs to violence. Careless killing is also violent. Jains say to refrain from three types of violence: kaya (body), bachik (by words), and mental. Jains walked cautiously to avoid killing living beings. However, because the Jains of the world find it very difficult to observe the vow of non-violence, they speak of Anuvrata and of giving love to all living beings. We should think of all living things as human beings without looking down on other living things, and we should think that we are dependent on them in our life.

Similarly, non-violence is one of the five pillars of Buddhist philosophy. It also says that we cannot kill living things. We have to offer our love to all living beings, and we have to protect them not just as animals but as worthless creatures and there not only should people control their behaviour, but also that no one should control the behaviour of other people. Is spoken

Environmental ethics in biodiversity conservation: Moreover, from the point of view of morality, it can be said that killing living beings is immoral. Morally a person can never kill. We must be moral. Besides, Australian philosopher Peter Singer’s famous essay “All animals are equal”,- published in 1974, fueled the animal liberation movement. In his essay, he draws on famous philosopher Jeremy Bentham’s utilitarianism to change our misguided view of animals, which states that we should seek that happiness that maximises individual well-being. Thus we need to formulate a philosophical basis for animal welfare.

We believe ethics is a human creation and therefore needs to be limited in its scope to the human species. However, we cannot continue to adhere to the way of thinking that the fundamental concepts of water, land, and space take into consideration. By the principle of ‘equality of common interest,’ we can say that those beings with conscience deserve moral justice. Putting human suffering on the moral stage, the logic of the principle of equality says that animal suffering and the cruel treatment of animals should also be ethical because animals have the same value as humans.

Our attitude is that nature is liable to meet all our demands and needs. So for centuries, we have done many evil things in water, land and space, and we are used to thinking that this dumb nature will tolerate our behaviour forever, but nature’s unforgiving resistance to droughts, floods, earthquakes and tsunamis is ours. We explained that our relationship with nature is not one-sided. It is a reciprocal relationship.

Conclusion: Concluding the discussion, today we need to realise that as nature helps us in the meaningful growth and preservation of our existence, we also have some moral responsibilities and duties towards the environment, nature and life. This way, appropriate attitudes and environmental behaviour can protect our life circle. Not only will we protect this nature for future generations, but we will also protect nature for its value. Moreover, if not, it will not be long before we lose our biodiversity entirely.

Reference:

  1. Dr Santosh Kumar Pal, Phalita Nitishastra, Pratham khanda, levant books- Kolkata, August 15, 2012, Parivesh Niti Shastra page 150 – 165.
  2. Deepak Kumar Bagchi, Bhartiya Niti Vidya, Pragati seal Prakashan- Kolkata- 73, November 2004,  Baudha Darshan o Niti Vidya page 84 to 94, Jaina Darshan o Nati Vidya page  95 – 105.
  3. Pavitra Jyoti Mondal Ujjwal Khan, Aranya o Banyapranee Sanrakshane Prachin Bharat, November 23, 2017.
  4.  

জ্যেষ্ঠতাত

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

কোনো-এক কাজ যদি না করিয়া থাক, তবে তোমার বড়ই অন্যায় হইয়াছে, আর যদি করিয়া থাক, তাহা হইলে কাজটা ভালো হয় নাই।

 একশ্রেণীর লোক আছে, তাহাদিগকে দেখিলেই চোখ বুজিতে ইচ্ছা করে, তাহারা যদি কথা কয় তবে কানে হাত দিতে ইচ্ছা হয়। অনেক ঘরের কোণে অতিশয় কদাকার একপ্রকার ব্যাঙ বাস করে, তাহারা যখন মাঝে মাঝে কট্‌কট্‌ শব্দ করিয়া উঠে তখন প্রাণ চমকিয়া যায়, হঠাৎ যদি খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে চোখের সামনে আসিয়া উপস্থিত হয়, তবে ছুটিয়া পলাইতে ইচ্ছা করে। জানোয়ারের মধ্যে এগুলি যেমন, মানুষের মধ্যে জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়েরা ততোধিক। ইহাদের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ হইলে আর জীবনে ইহাদিগকে ভুলিতে পারা যায় না।

 এক নম্বরে, খবরওয়ালা জ্যেষ্ঠতাত। জগতে এমন ঘটনা নাই, যাহার কথা ইনি শুনিয়া রাখেন নাই। তুমি যদি তাহার কোনো সামান্য বিষয়ে অজ্ঞতা প্রদর্শন কর, তাহা হইলে ইনি অতিশয় আশ্চর্যাম্বিত হইবেন। যদি কোনো কথা তুমি অন্যরূপ জান বলিয়া প্রকাশ কর, তবে তোমার আর রক্ষা নাই, তোমাকে এমন একটা সার্টিফিকেট দিয়া বসিবেন যে, তেমন সাটিফিকেট সচরাচর কেহ কাহাকেও দেয় না। কিন্তু হয়তো এর পরেই তোমার নিকট হইতে উঠিয়া যাইবেন।

 দুয়ের নম্বরে, পণ্ডিত জ্যেষ্ঠতাত। ইনি খবরওয়ালা মহাশয়েরই বড় ভাই। ইহার স্বভাবও অনেকটা তাঁহারই মতন। ইনি যে শ্রেণীতে পাঠ করেন, তাহার তিন-চারি ক্লাশ উপরের পাঠ্যপুস্তক লইয়া নাড়াচাড়া করেন। যে-সকল পুস্তক কোনোদিন চক্ষে দেখেন নাই, তাহাতে কি লেখা আছে, সেই কথাটা বিশেষ করিয়া তোমাকে বার বার বলিলেন। ইস্কুলে গিয়া মাস্টারমহাশয়কে যে-সকল পুস্তকের কথা বলিতে হইবে, তাহার খবর খুব কমই রাখেন। এই শ্রেণীর অনেক জ্যেষ্ঠতাত দেখিয়াছ। এরা প্রায়ই একটু নীচ-প্রকৃতির হইয়া থাকে। ছাত্রসভায় বক্তৃতা করিতে হইলে বই মুখস্থ করিয়া আইসে। এই শ্রেণীর একজন আমাকে একবার চিঠি লিখিয়াছিল, সেই চিঠিখানি মেকলে সাহেবের একখানা পত্রের অবিকল নকল।

 তিনের নম্বরে, মুরবিব জ্যেষ্ঠতাত। তোমার কোন বিষয়ে কি ত্রুটি আছে, তাহা বাহির করিয়া তোমাকে তিরস্কার করা ইহার ব্যবসায়। কোনো-এক কাজ যদি না করিয়া থাক, তবে তোমার বড়ই অন্যায় হইয়াছে, আর যদি করিয়া থাক, তাহা হইলে কাজটা ভালো হয় নাই। ইনি যদি তোমার সহপাঠী হন, তবে তোমাকে এমন সকল আক কষিতে দিবেন, যাহা তাঁহার বিদ্যাতে কিছুতেই কুলায় না। তাহতে যদি তোমার একটু দেরি হয় তবে বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিবেন যে,তিনি খুব অল্প সময়েই এরূপ আক সব কবিয়া ফেলেন। যদি খুব শীঘ্রই আকটা কষিয়া ফেলিতে পার, তবে বলিলেন, ‘বড় ঘুরিয়াছ। যদি একটা কোনো সহজ উপায় দেখাইয়া দিতে বল, তবে হয়তো বলিবেন যে, তাঁর অনেক কাজ আছে, সময় কম। এই বলিয়া প্রস্থান করিবেন।

 এই শ্রেণীর একটা লোক এমনভাবে কথাবার্তা বলিত যেন তাহার মতন ভালো জিনিস কিনিতে কেহ জানে না। অন্য কেহ একটা কোনো জিনিস কিনিয়া আনিলেই বলিত, “তোমাকে ঠকাইয়াছে। আমি এর চাইতে কম দামে আনিতে পারিতাম। অনর্থক পয়সাগুলি জলে ফেলিয়াছ। নিজের বিদ্যাবুদ্ধি অতি কমইছিল। কিন্তু সেই বাড়িতে যে-সকল কলেজ ক্লাশের ছেলে থাকিত তাহাদের পড়াশুনা কেমন চলিতেছে তাহার খবরটা রীতিমতো রাখা হইত। মাঝে মাঝে তাহদের বই খুলিয়া দু-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হইত। এই ব্যক্তি একদিন চিৎপুর রোড দিয়া যাইবার সময় দেখিল যে দুইজন লোক কতকগুলি সোনার ফুল কুড়াইয়া পাইয়াছে, আর একজন তাহাকে সেগুলি লইয়া যাইতে দিতেছে না। জ্যেষ্ঠতাতকে দেখিয়া তাহারা উভয়েই মধ্যস্থ মানিল। বিচারের মীমাংসা এই হইল যে, ফুলগুলিকে তিনভাগ করিয়া তিনজনে পাইবে, এবং যে ব্যক্তি প্রথমে কুড়াইয়া পাইয়াছিল তাহাকে অপর দুজনে সামান্য মূল্য দিবে। জ্যেষ্ঠতাতের সঙ্গে তিনটি টাকা ছিল, তাহা দিয়া সে কুড়িটি ফুল কিনিল। বাড়ি আসিয়া সে সেদিন আর আস্তে কথা কহিতেপারে না। অধিক বুদ্ধি থাকিলে ব্যাপারটা কিরূপ হয় সকলকে ডাকিয়া তাহাই বুঝাইয়া দিতে লাগিল। একজন একটি ফুল হাতে লইয়া দেখিল যে ফুলটি পিতলের, তাহার উপর সামান্য গিণ্টি। এই কথা যখন জানা গেল, তখন হাসির ধুম পড়িল। এর পরে অনেকদিন পর্যন্ত জ্যেষ্ঠতাত কোনো উৎপাত করে নাই।

 চতুর্থ নম্বরে — বড়লোক জ্যেষ্ঠতাত। যাহার সমকক্ষ, তাহদের সহিত ইহারা কথা কহিবে না। যাহারা নিজের অনেক উপরে তাহদের সঙ্গে মিশিতে চাহিবে এবং তাহাদের পদলেহন করিবে। ক্লাশে মাস্টারমহাশয়ের সঙ্গে ইয়ারকি দিবে, লোকের নিকট টাকা ধার করিয়া বাবুগিরি করবে। টাকা চাহিলে বিরক্ত হইবে। নিজের যেমন অবস্থা তেমনি অবস্থার লোকদিগকে ঘৃণা করিবে, কোনো ভালো কাজের জন্য কিছু দিতে বলিলে খাতায় স্বাক্ষর করিবে না—যদি করে, তবে নিশ্চয়ই তাহা দিবে না। ঘূণায় যাহাঁদের সহিত কোনোদিন মিশে না, মাঝে মাঝে হঠাৎ এক-একবার তাহদের নিকট অত্যাধিক আত্মীয়তা দেখাইতে আসিবে। তাহদের সামান্য কোনো জিনিস থাকিলে তাহার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করিয়া বেশি দাম দিয়া একটা ভালো জিনিস কিনিতে বলিবে। সেই উপলক্ষে নিজের কেমন সব উচ্চদরের জিনিস না হইলে ব্যবহার হয় না, বড়-বড় বইনা হইলে পড়া হয় না, তাহ তাহাকে বুঝাইয়া দিবে। এরপর নিজের একটা খুব বড় কাজ করিতে হইবে, আর অধিক সময় নাই, এইবলিয়া বিদায় লইবে। যাইবার সময় হয়তো বলিবে, ভাই কিছুটাকা দিতে পার? কাল দিব। নাহয় এমন একটা কোনো কাজের ভার দিবে যে তাহ হয় তাহার বিদ্যাবুদ্ধির অতীত, নাহয় তাহা নিজে করিতে সে লজ্জিত হয়, পাছে লোকে তাহাকে ছোটলোক মনে করে।

এরপর সমালোচক জ্যেষ্ঠতাতের কথা বলিয়া শেষ করিব। এমন বিষয় নাই। যাহা লইয়া এ ব্যক্তি নাড়াচাড়া না করিবে। এমন লোক নাই নিজের চাইতে সে যত বড় লোকই হউকনা কেন, যাহার সম্বন্ধে সে দু-চার কথা না বলিবে—নিজের যাহা নয়, বা নিজে যাহা করে নাই, সাধ্য সত্ত্বেও তাহার প্রশংসা করিবে না। যদি দায়ে পড়িয়া নেহাত দুই কথা বলিতে হয়, তবে এমন একটা খট্‌কা দিয়া রাখিয়া দিবে যে তাহাতেই তাহার নিজের কাজ সিদ্ধ হয়। এমন কিছু প্রশংসকার কাজ হইতে পারে না যাহা সে মনে করে যে সে করিতে পারে না, এতদিন যে তাহা করিয়া ফেলে নাই তাহা তাহার অনুগ্রহ। অন্যের যাহা দেখিয়া নিন্দা করিবে, সে জিনিসটা নিজের হইলে আবার তাহারই প্রশংসা করিবে।

কমলাকান্তের জোবানবন্দী

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


সেই আফিঙ্গখোর কমলাকান্তের অনেক দিন কোন সম্বাদ পাই নাই। অনেক সন্ধান করিয়াছিলাম, অকস্মাৎ সম্প্রতি একদিন তাহাকে ফৌজদারী আদালতে দেখিলাম। দেখি যে, ব্রাহ্মণ এক গাছতলায় বসিয়া, গাছের গুঁড়ি ঠেসান দিয়া, চক্ষু বুজিয়া ডাবায় তামাকু টানিতেছে। মনে করিলাম, আর কিছু না, ব্রাহ্মণ লোভে পড়িয়া কাহার ডিবিয়া হইতে আফিঙ্গ চুরি করিয়াছে-অন্য সামগ্রী কমলাকান্ত চুরি করিবেনা-ইহা নিশ্চিত জানি। নিকটে একজন কালোকোর্ত্তা কনষ্টেবলও দেখিলাম। আমি বড় দাঁড়াইলাম না-কি জানি যদি কমলাকান্ত জামিন হইতে বলে। তফাতে থাকিয়া দেখিতে লাগিলাম যে, কাণ্ডটা কি হয়।
কিছুকাল পরে কমলাকান্তের ডাক হইল। তখন একজন কনষ্টেবল রুল ঘুরাইয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া এজ্লাসে লইয়া গেল। আমি পিছু পিছু গেলাম। দাঁড়াইয়া, দুই একটি কথা শুনিয়া ব্যাপারখানা বুঝিতে পারিলাম।
এজ্লাসে, প্রথমত মাচানের উপর হাকিম বিরাজ করিতেছেন। হাকিমটি একজন দেশী ধর্ম্মাবতার-পদে ও গৌরবে ডিপুটি। কমলাকান্ত আসামী নহে-সাক্ষী। মোকদ্দমা গরুচুরি। ফরিয়াদি সেই প্রসন্ন গোয়ালিনী।
কমলাকান্তকে সাক্ষীর কাটরায় পূরিয়া দিল। তখন কমলাকান্ত মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল। চাপরাশী ধমকাইল- “হাস কেন?”
কমলাকান্ত যোড়হাত করিয়া বলিল. “বাবা, কার ক্ষেতে ধান খেয়েছি যে, আমাকে এর ভিতর পূরিলে?”
চাপরাশী মহাশয় কথাটা বুঝিলেন না। দাড়ি ঘুরাইয়া বলিলেন, “তামাসার জায়গা এ নয় –হলফ পড়।”
কমলাকান্ত বলিল, “পড়াও না বাপু।”
একজন মুহুরি তখন হলফ পড়াইতে আরম্ভ করিল। বলিল, “বল আমি পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জানিয়া…”
কমলাকান্ত। (সবিস্ময়ে) কি বলিব?
মুহুরি। শুন্‌তে পাও না-“পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে__”
কমলা। পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে! কি সর্বনাশ!
হাকিম দেখিলেন, সাক্ষীটা কি একটা গণ্ডগোল বাধাইতেছে। জিজ্ঞাসা করিলেন, “সর্বনাশ কি?”
কমলা। পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনেছি-এ কথাটা বল্‌তে হবে?
হাকিম। ক্ষতি কি? হলফের ফারমই এই।
কমলা। হুজুর সুবিচারক বটে। কিন্তু একটা কথা বলি কি, সাক্ষ্য দিতে দিতে দুই একটা ছোট রকম মিথ্যা বলি, না হয় বলিলাম-কিন্তু গোড়াতেই একটা বড় মিথ্যা বলিয়া আরম্ভ করিব, সেটা কি ভাল?
হাকিম। এর আর মিথ্যা কথা কি?
কমলাকান্ত মনে মনে বলিল, “তত বুদ্ধি থাকিলে তোমার কি এ পদবৃদ্ধি হইত?” প্রকাশ্যে বলিল, “ধর্ম্মাবতার, আমার একটু একটু বোধ হইতেছে কি যে, পরমেশ্বর ঠিক প্রত্যক্ষের বিষয় নয়। আমার চোখের দোষই হউক, আর যাই হউক; কখনও ত এ পর্য্যন্ত পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলাম না। আপনারা বোধ হয় আইনের চসমা নাকে দিয়া তাঁহাকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পারেন-কিন্তু আমি যখন তাঁহাকে এ ঘরের ভিতর প্রত্যক্ষ পাইতেছি না-তখন কেমন করিয়া বলি-আমি পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে__”
ফরিয়াদীর উকিল চটিলেন-তাঁহার মূল্যবান সময়, যাহা মিনিটে মিনিটে টাকা প্রসব করে, তাহা এই দরিদ্র সাক্ষী নষ্ট করিতেছে। উকীল তখন গরম হইয়া বলিলেন, “সাক্ষী মহাশয়!” Theological Lecture টা ব্রাহ্মসমাজের জন্য রাখিলে ভাল হয় না? এখানে আইনের মতে চলিতে মন স্থির করুন।”
কমলাকান্ত তাঁহার দিকে ফিরিল। মৃদু হাসিয়া বলিল, “আপনি বোধ হইতেছে উকীল।”
উকীল । (হাসিয়া) কিসে চিনিলে?
কমলা। বড় সহজে। মোটা চেন আর ময়লা শামলা দেখিয়া। তা মহাশয়! আপনাদের জন্য এ Theological Lecture নয়। আপনারা পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ দেখেন স্বীকার করি-যখন মোয়াক্কেল আসে।
উকীল সরোষে উঠিয়া হাকিমকে বলিলেন, “I ask the protection of the Court against the insults of this witness.”
কোর্ট বলিলেন, “O Baboo! the witness is your own witness, and you are at liberty to send him away if you like.”
এখন কমলাকান্তকে বিদায় দিলে উকীল বাবুর মোকদ্দমা প্রমাণ হয় না-সুতরাং উকীল বাবু চুপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন। কমলাকান্ত ভাবিলেন, এ হাকিমটা জাতিভ্রষ্ট-পালের মত নয়।
হাকিম গতিক দেখিয়া, মুহুরিকে আদেশ করিলেন যে, “ওথের প্রতি সাক্ষীর objection আছে-উহাকে simple affirmation দাও।” তখন মুহুরি কমলাকান্তকে বলিল, “আচ্ছা, ও ছেড়ে দাও-বল, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি-বল |”
কমলা। কি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেটা জানিয়া প্রতিজ্ঞাটা করিলে ভাল হয় না?
মুহুরি হাকিমের দিকে চাহিয়া বলিল, “ধর্ম্মাবতার! সাক্ষী বড় সেরকশ্ |”
উকীল বাবু হাঁকিলেন, “Very obstructive.”
কমলা। (উকীলের প্রতি) শাদা কাগজে দস্তখত করিয়া লওয়ার প্রথাটা আদালতের বাহিরে চলে জানি-ভিতরেও চলিবে কি?
উকীল । শাদা কাগজে কে তোমার দস্তখত লইতেছে?
কমলা। কি প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে, তাহা না জানিয়া, প্রতিজ্ঞা করা, আর কাগজে কি লেখা হয় তাহা না দেখিয়া, দস্তখত করা, একই কথা।
হাকিম তখন মুহুরিকে আদেশ করিলেন যে, “প্রতিজ্ঞা আগে ইহাকে শুনাইয়া দাও-গোলমালে কাজ নাই |” মুহুরি তখন বলিল, “শোন, তোমাকে বলিতে হইবে যে, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি যে সাক্ষ্য দিব, তাহা সত্য হইবে, আমি কোন কথা গোপন করিব না-সত্য ভিন্ন আর কিছু হইবে না |”
কমলা। ওঁ মধু মধু মধু।
মুহুরি। সে আবার কি?
কমলা। পড়ান, আমি পড়িতেছি।
কমলাকান্ত তখন আর গোলযোগ না করিয়া প্রতিজ্ঞা পাঠ করিল। তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার জন্য উকীল বাবু গাত্রোত্থান করিলেন, কমলাকান্তকে চোখ রাঙ্গাইয়া বলিলেন, “এখন আর বদ্‌মায়েশি করিও না-আমি যা জিজ্ঞাসা করি, তার যথার্থ উত্তর দাও। বাজে কথা ছাড়িয়া দাও |”
কমলা। আপনি যা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাই আমাকে বলিতে হইবে? আর কিছু বলিতে পাইব না?
উকীল । না।
কমলাকান্ত তখন হাকিমের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “অথচ আমাকে প্রতিজ্ঞা করাইলেন যে, ‘কোন কথা গোপন করিব না |’ ধর্ম্মাবতার, বে-আদবি মাফ হয়! পাড়ায় আজ একটা যাত্রা হইবে, শুনিতে যাইব ইচ্ছা ছিল; সে সাধ এইখানেই মিটিল। উকীল বাবু অধিকারী-আমি যাত্রার ছেলে, যা বলাইবেন, কেবল তাই বলিব; যা না বলাইবেন, তা বলিব না। যা না বলাইবেন, তা কাজেই গোপন থাকিবে। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের অপরাধ লইবেন না |”
হাকিম। যাহা আবশ্যক বিবেচনা করিবে, তাহা না জিজ্ঞাসা হইলেও বলিতে পার।
কমলাকান্ত তখন সেলাম করিয়া বলিল, “বহুৎ খুব |” উকীল তখন জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন, “তোমার নাম কি?”
কমলা। শ্রী কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী।
উকীল । তোমার বাপের নাম কি?
কমলা। জোবানবন্দীর আভ্যুদয়িক আছে না কি?
উকীল গরম হইলেন, বলিলেন, “হুজুর! এ সব Contempt of Court.” হুজুর, উকীলের দুর্দ্দশা দেখিয়া নিতান্ত অসন্তুষ্ট নন-বলিলেন, “আপনারই সাক্ষী |” সুতরাং উকীল আবার কমলাকান্তের দিকে ফিরিলেন, বলিলেন, “বল। বলিতে হইবে |”
কমলাকান্ত পিতার নাম বলিল। উকীল তখন জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি জাতি?”
কমলা। আমি কি একটা জাতি?
উকীল । তুমি কোন্ জাতীয়।
কমলা। হিন্দু জাতীয়।
উকীল । আঃ! কোন্ বর্ণ?
কমলা। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ।
উকীল । দূর হোক ছাই! এমন সাক্ষীও আনে! বলি তোমার জাত আছে?
কমলা। মারে কে?
হাকিম দেখিলেন, উকীলের কথায় হইবে না। বলিলেন, “ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কৈয়বর্ত্ত, হিন্দুর নানা প্রকার জাতি আছে জান ত-তুমি তার কোন জাতির ভিতর?”
কমলা। ধর্ম্মাবতার! এ উকীলের ধৃষ্টতা! দেখিতেছেন আমার গলায় যজ্ঞোপবীত, নাম বলিয়াছি চক্রবর্ত্তী-ইহাতেও যে উকীল বুঝেন নাই যে, আমি ব্রাহ্মণ, ইহা আমি কি প্রকারে জানিব?
হাকিম লিখিলেন, “জাতি ব্রাহ্মণ |” তখন উকীল জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বয়স কত?”
এজ্লাসে একটা ক্লক ছিল-তাহার পানে চাহিয়া হিসাব করিয়া কমলাকান্ত বলিল, “আমার বয়স একান্ন বৎসর, দুই মাস, তের দিন, চারি ঘণ্টা, পাঁচ মিনিট ___”
উকীল । কি জ্বালা! তোমার ঘণ্টা মিনিট কে চায়?
কমলা। কেন, এইমাত্র প্রতিজ্ঞা করাইয়াছেন যে, কোন কথা গোপন করিব না।
উকীল । তোমার যা ইচ্ছা কর! আমি তোমায় পারি না। তোমার নিবাস কোথা?
কমলা। আমার নিবাস নাই।
উকীল । বলি, বাড়ী কোথা?
কমলা। বাড়ী দূরে থাক, আমার একটা কুঠারীও নাই।
উকীল । তবে থাক কোথা?
কমলা। যেখানে সেখানে।
উকীল । একটা আড্ডা ত আছে?
কমলা। ছিল, যখন নসী বাবু ছিলেন। এখন আর নাই।
উকীল । এখন আছ কোথা?
কমলা। কেন, এই আদালতে।
উকীল । কাল ছিলে কোথা?
কমলা। একখানা দোকানে।
হাকিম বলিলেন, “আর বকাবকিতে কাজ নাই-আমি লিখিয়া লইতেছি, নিবাস নাই। তারপর?
উকীল । তোমার পেশা কি?
কমলা। আমার আবার পেশা কি? আমি কি উকীল না বেশ্যা যে, আমার পেশা আছে?
উকীল । বলি, খাও কি করিয়া?
কমলা। ভাতের সঙ্গে ডাল মাখিয়া, দক্ষিণ হস্তে গ্রাস তুলিয়া, মুখে পুরিয়া গলাধঃকরণ করি।
উকীল । সে ডাল ভাত জোটে কোথা থেকে?
কমলা। ভগবান্ জোটালেই জোটে, নইলে জোটে না।
উকীল । কিছু উপার্জ্জন কর?
কমলা। এক পয়সাও না।
উকীল । তবে কি চুরি কর?
কমলা। তাহা হইলে ইতিপূর্ব্বেই আপনার শরণাগত হইতে হইত। আপনি কিছু ভাগও পাইতেন।
উকীল তখন হাল ছাড়িয়া দিয়া, আদালতকে বলিলেন, “আমি এ সাক্ষী চাহি না। আমি ইহার জোবানবন্দী করাইতে পারিব না |”
প্রসন্ন বাদিনী, উকীলের কোমর ধরিল; বলিল, “এ সাক্ষী ছাড়া হইবে না। এ বামন সত্য কথা বলিবে, তাহা আমি জানি-কখনও মিছা বলে না। উহাকে তোমরা জিজ্ঞাসা করিতে জান না-তাই ও অমন করিতেছে। ও বামনের আবার পেশা কি? ও এর বাড়ী ওর বাড়ী খেয়ে বেড়ায়, ওকে জিজ্ঞাসা করিতেছ, উপার্জ্জন কর! ও কি বলবে?”
উকীল তখন হাকিমকে বলিল, “লিখুন, পেশা ভিক্ষা |”
এবার কমলাকান্ত রাগিল, “কি? কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী ভিক্ষোপজীবী? আমি মুক্তকণ্ঠে হলফের উপর বলিতেছি, আমি কখনও কাহারও কাছে এক পয়সা ভিক্ষা চাই না |”
প্রসন্ন আর থাকিতে পারিল না-সে বলিল, “সে কি ঠাকুর! কখন আফিঙ্গ চেয়ে খাও নাই?”
কমল। দূর মাগি ধেমো গোয়ালার মেয়ে! আফিঙ্গ কি পয়সা! আমি কখন একটি পয়সাও কাহারও কাছে ভিক্ষা লই নাই।
হাকিম হাসিয়া বলিলেন, “কি লিখিব কমলাকান্ত?”
কমলাকান্ত নরম হইয়া বলিল, “লিখুন, পেশা ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ-গ্রহণ” সকলে হাসিল-হাকিম তাই লিখিয়া লইলেন।
তখন উকীল মহাশয় মোকদ্দমায় প্রবৃত্ত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি ফরিয়াদীকে চেন?”
কমল। না।
প্রসন্ন হাঁকিল, “সে কি ঠাকুর! চিরটা কাল আমার দুধ দই খেলে, আজ বল চিনি না?”
কমলাকান্ত বলিল, “তোমার দুধ দই চিনি না, এমন কথা ত বল্‌তেছি না-তোমার দুধ দই বিলক্ষণ চিনি। যখনই দেখি এক পোয়া দুধে তিন পোয়া জল, তখনই চিনিতে পারি যে, এ প্রসন্ন গোয়ালিনীর দুধ; যখনই দেখ্‌তে পাই যে, ঘোলের চেয়ে দই ফিকে, তখনই চিনতে পারি যে, এ প্রসন্নময়ীর দুধ। দুধ দই চিনি নে?”
প্রসন্ন নথ ঘুরাইয়া বলিল, “আমার দুধ দই চেন, আর আমায় চিনিতে পার না?”
কমলাকান্ত বলিল, “মেয়েমানুষকে কে কবে চিনিতে পেরেছে, দিদি? বিশেষ, গোয়ালার মেয়ের কাঁকালে যদি দুধের কেঁড়ে থাকিল, তবে কার বাপের সাধ্য তাকে চিনে উঠে?”
উকীল তখন আবার সওয়াল করিতে লাগিলেন, “বুঝা গেল; তুমি বাদিনীকে চেন-উহার সঙ্গে তোমার কোন সম্বন্ধ আছে?”
কমল। মন্দ নয়-এত গুণ না থাকিলে কি উকীল হয়!
উকীল । তুমি আমার কি গুণ দেখিলে?
কমল। বামনের ছেলে গোয়ালার মেয়েতেও আপনি একটা সম্বন্ধ খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন।
উকীল । এমন সম্বন্ধ কি হয় না? কে জানে তুমি ওর পোষ্যপুত্র কি না?
কমল। ওর নয়, কিন্তু ওর গাইয়ের বটে।
উকীল । বুঝা গেল, তোমার সঙ্গে বাদিনীর একটা সম্বন্ধ আছে, একেবারে সাফ বলিলেই হইত-এত দুঃখ দাও কেন? এখন জিজ্ঞাসা করি, তুমি এ মোকদ্দমার কি জান?
কমল। জানি যে, এ মোকদ্দমায় আপনি উকীল, প্রসন্ন ফরিয়াদী, আমি সাক্ষী আর এই নেড়ে আসামী।
উকীল । তা নয়, গোরুচুরির কি জান?
কমল। গোরুচুরির আমার বাপ-দাদাও জানে না। বিদ্যাটা আমায় শিখাইবেন?-আমার দুধ দধির বড় দরকার।
উকীল । আঃ-বলি গোরুচুরি দেখিয়াছ?
কমল। একদিন দেখিয়াছিলাম। নসী বাবুর একটা বক্‌না-এক বেটা মুচি-
উকীল । কি যন্ত্রণা! বলি, প্রসন্ন গোয়ালিনীর গোরু যখন চুরি যায়, তখন তুমি দেখিয়াছ?
কমল। না-চোর বেটার এত বুদ্ধি হয় নাই যে, আমাকে ডাকিয়া সাক্ষী রাখিয়া গোরুটা চুরি করে। তাহা হইলে আপনারও কাজে সুবিধা হইত, আমারও কাজের সুবিধা হইত।
প্রসন্ন দেখিল, উকীলকে টাকা দেওয়া সার্থক হয় নাই –তখন আপনার হাতে হাল লইবার ইচ্ছায়, উকীলের কাণে কাণে বলিয়া দিল, “ও বামুন সে সব কিছুর সাক্ষী নয়-ও কেবল গোরু চেনে |”
উকীল মহাশয় তখন কূল পাইলেন। গর্জ্জিয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি গোরু চেন?”
কমলাকান্ত মধুর হাসিয়া বলিল, “আহা চিনি বই কি-নহিলে কি আপনার সঙ্গে এত মিষ্টালাপ করি?”
হাকিম দেখিলেন, সাক্ষী বড় বাড়াবাড়ি করিতেছে-বলিলেন, “ও সব রাখ |” প্রসন্ন গোয়ালীর শামলা গাই আদালতের সম্মুখে মাঠে বাঁধা ছিল-দেখা যাইতেছিল। ডিপুটি বাবু সেই দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এই গোরুটিকে চেন?”
কমলাকান্ত যোড়হাত করিয়া বলিল, “কোন্ গোরুটি, ধর্ম্মাবতার?”
হাকিম বলিলেন, “কোন্ গোরুটি কি? একটি বই ত সাম্‌নে নাই?”
কমল। আপনি দেখিতেছেন, একটি-আমি দেখিতেছি অনেকগুলি।
হাকিম বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “দেখিতে পাইতেছ না-ঐ শামলা?”
কমলাকান্ত শামলা গাইয়ের দিকে না চাহিয়া উকীলের শামলার প্রতি চাহিল। বলিল, “এ শামলাও চুরির না কি?”
কমলাকান্তের নষ্টামি হাকিম আর সহ্য করিতে পারিলেন না-বলিলেন, “তুমি আদালতের কাজের বড় বিঘ্ন করিতেছ-Contempt of Court জন্য তোমার পাঁচ টাকা জরিমানা |”
কমলাকান্ত আভূমিপ্রণত সেলাম করিয়া যোড়হাত করিয়া বলিল, “বহুৎ খুব হুজুর! জরিমানা আদায়ের ভার কার প্রতি?”
হাকিম। কেন?
কমল। কিরূপে আদায় করিবেন, সে বিষয়ে তাঁহাকে কিছু উপদেশ দিব।
হাকিম। উপদেশের প্রয়োজন কি?
কমল। ইহলোকে ত আমার নিকট জরিমানা আদায়ের কোন সম্ভাবনা নাই- তিনি পরলোকে যাইতে প্রস্তুত কি না জিজ্ঞাসা করিব।
হাকিম। জরিমানা না দিতে পার, কয়েদ যাইবে।
ক। কত দিনের জন্য, ধর্ম্মাবতার?
হাকিম। জরিমানা অনাদায়ে এক মাস কয়েদ।
কমল। দুই মাস হয় না?
হাকিম। বেশী মিয়াদের ইচ্ছা কর কেন?
কমল। সময়টা কিছু মন্দ পড়িয়াছে-ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ আর তেমন সুলভ নয়-জেলখানায় যাহাতে মাস দুই ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ হয়, সে ব্যবস্থা যদি আপনি করেন, তবে গরীব ব্রাহ্মণ উদ্ধার পায়।
এরূপ লোককে জরিমানা বা কয়েদ করিয়া কি হইবে? হাকিম হাসিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি যদি গোল না করিয়া সোজা জোবানবন্দী দাও, তবে তোমার জরিমানা মাপ করা যাইতে পারে। বল-ঐ গোরু তুমি চেন কি না?”
হাকিম তখন একজন কনষ্টেবলকে আদেশ করিলেন যে গোরুর নিকট গিয়া প্রসন্নের গাই দেখাইয়া দেয়। কনষ্টেবল তাহাই করিল। বিষণ্ণ উকীল বাবু তখন জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঐ গোরু তুমি চেন?”
কমল। সিংওয়ালা গোরু-তাই বলুন।
উকীল । তুমি বল কি?
কমল। আমি বলি শামলাওয়ালা-তা যাক্-আমি ও সিংওয়ালা গোরুটা চিনি। বিলক্ষণ আলাপ আছে।
উকীল । ও কার গোরু?
কমল। আমার।
উকীল । তোমার!
কমল। আমারই।
হরি হরি! প্রসন্নের মুখ শুকাইল! উকীল দেখিল, মোকদ্দমা ফাঁসিয়া যায়। প্রসন্ন তখন তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া বলিল, “তবে রে বিটলে! গোরু তোমার!”
কমলাকান্ত বলিল, “আমার না ত কার! আমি ওর দুধ খেয়েছি, ওর দই খেয়েছি-ওর ঘোল খেয়েছি, ওর ছানা খেয়েছি-ওর মাখন খেয়েছি, ওর ননী খেয়েছি-ও গোরু আমার হলো না, তুই বেটী পালিস্ ব’লে কি তোর বাবার গোরু হলো!”
উকীল অতটা বুঝিলেন না। বলিলেন, “ধর্ম্মাবতার, witness hostile! permission দিন আমি ওকে cross করি |”
কমল। কি? আমায় cross করিবে?
উকিল। হাঁ করিব।
কমল। নৌকায়, না সাঁকো বেঁধে?
উকিল। সে আবার কি?
কমল। বাবা! কমলাকান্ত-সাগর পার হও, এত বড় হনূমান্ তুমি আজও হও নাই।
এই বলিয়া কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী রাগে গর্ গর্ করিয়া কাটরা হইতে নামিয়া যায়-চাপরাশী ধরিয়া আবার কাটরায় পূরিল। তখন কমলাকান্ত আলু থালু হইয়া নিশ্চেষ্ট হইল-বলিল, “কর বাবা ক্রস্ কর!-আমি অগাধ সমুদ্রে পড়িয়া আছি-যে ইচ্ছা লম্ফ দাও-‘অপামিবাধারমনুত্তরঙ্গং!-উকিল মহাশয়! এ প্রশান্ত মহাসমুদ্র তরঙ্গ বিক্ষেপ করে না আপনি স্বচ্ছন্দে উল্লম্ফন করুন |”
উকীল তখন কোর্টকে বলিলেন, “ধর্ম্মাবতার, দেখা যাইতেছে যে, এ ব্যক্তি বাতুল; ইহাকে আর ক্রস্ করিবার প্রয়োজন নাই। বাতুল বলিয়া ইহার জবানবন্দী পরিত্যক্ত হইবে। ইহাকে বিদায় দেওয়া হউক |”
হাকিম কমলাকান্তের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইলে বাঁচেন, বিদায় দিতে প্রস্তুত, এমত সময়ে প্রসন্ন হাত যোড় করিয়া আদালতে নিবেদন করিল, “যদি হুকুম হয়, তবে আমি স্বয়ং উহাকে গোটা কত কথা জিজ্ঞাসা করি, তার পর বিদায় দিতে হয়, দিবেন |”
হাকিম কৌতূহলী হইয়া অনুমতি দিলেন। প্রসন্ন তখন কমলাকান্তের প্রতি চাহিয়া বলিল, “ঠাকুর! মৌতাতের সময় হয়েছে না?”
কমল। মৌতাতের আবার সময় কি রে বেটী –“অজরামরবৎ প্রাজ্ঞঃ বিদ্যাং নেশ্চাঞ্চ চিন্তয়েৎ |”
প্রসন্ন । অং বং এখন রাখ –এখন মৌতাত করিবে?
কমল। দে!
প্রসন্ন । আচ্ছা, আগে আমার কথার উত্তর দাও –তার পর সে হবে।
কমল। তবে জল্‌দি জল্‌দি বল – জল্‌দি জল্‌দি জবাব দিই।
প্রসন্ন । বলি, গোরু কার?
কমল। গোরু তিন জনের; গোরু প্রথমে বয়সে গুরুমহাশয়ের; মধ্যবয়সের স্ত্রীজাতির; শেষ বয়সে উত্তরাধিকারীর; দড়ি ছিঁড়িবার সময়ে কারও নয়।
প্রসন্ন । বলি, ঐ শামলা গাই কার?
কমল। যে ওর দুধ খায় তার।
প্রসন্ন । ও গোরু আমার কি না?
কমল। তুই বেটী কখন ওর এক বিন্দু দুধ খেলি নে, কেবল বেচে মর্‌লি, গোরু তোর হলো? ও গোরু যদি তোর হয়, তবে বাঙ্গাল বেঙ্কের টাকাও আমার। দে বেটী, গোরুচোরকে ছেড়ে দে-গরীবের ছেলে দুধ খেয়ে বাঁচুক।
হাকিম দেখিলেন, দুই জনে বড় বাড়াবাড়ি করিতেছে-আদালত মেছো-হাটা হইয়া উঠিল। তখন উভয়কে ধমক দিয়া জিজ্ঞাসাবাদ নিজহস্তে লইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রসন্ন এই গোরুর দুধ বেচে?”
কমল। আজ্ঞে, হাঁ।
“উহার গোহালে এই গোরু থাকে?”
কমল। ও গোরুও থাকে, আমিও কখন কখন থাকি।
“ওই খাওয়ায়?”
কমল। উভয়কে।
বাদিনীর উকীল তখন বলিলেন, “আমার কার্য্য সিদ্ধ হইয়াছে-আমি উহাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাই না”। এই বলিয়া তিনি উপবেশন করিলেন। তখন আসামীর উকীল গাত্রোত্থান করিলেন। দেখিয়া কমলাকান্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, “আবার তুমি কে?”
আসামীর উকীল বলিলেন, “আমি আসামীর পক্ষে তোমাকে ক্রস্ করিব”।
কমল। একজন ত ক্রস্ করিয়া গেল, আবার তুমি কুমার বাহাদুর এলে না কি?
উকীল । কুমার বাহাদুর কে?
কমল। রাজপুত্রকে চেন না? ত্রেতা যুগে আগে ক্রস্ করিলেন, পবনাঙ্গজ মহাশয়। তার পর ক্রস্ করিলেন, কুমার বাহাদুর।20
উকীল । ও সব রাখ-তুমি গোরু চেন বলেছ-কিসে চেন?
কমল। কখন শিঙ্গে-কখন শামলায়!
উকীল রাগিয়া উঠিয়া, গর্জ্জন করিয়া টেবিল চাপড়াইয়া বলিলেন, “তোমার পাগলামি রাখ-তুমি এই গোরু চিনিতে পারিতেছ কিসে?”
কমল। ঐ হাম্বা-রবে।
উকীল হতাশ হইয়া বলেন, “Hopeless” উকীল মহাশয় বসিয়া পড়িলেন-আর জেরা করিবেন না। কমলাকান্ত বিনীতভাবে বলিল, “দড়ি ছেঁড় কেন বাবা?”
উকীল আর জেরা করিবেন না দেখিয়া হাকিম কমলাকান্তকে বিদায় দিলেন। কমলাকান্ত উর্দ্ধ্বশ্বাসে পলাইল। আমি কিছু কাজ সারিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিলাম যে, কমলাকান্ত থেলো হুঁকা হাতে করিয়া বসিয়া আছে-চারি দিকে লোক জমিয়াছে-প্রসন্নও সেখানে আসিয়াছে। কমলাকান্ত তাহাকে তিরস্কার করিতেছে আর বলিতেছে, “তোর মঙ্গলার বাঁটের দিব্য, তোর দুধের কেঁড়ের দিব্য, তোর ঘোলমউনির দিব্য, তোর ফাঁদি-নথের দিব্য, তুই যদি চোরকে গোরু ছেড়ে না দিস্!”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “চক্রবর্ত্তী মহাশয়! চোরকে গোরু ছাড়িয়া দিবে কেন?”
কমলাকান্ত বলিল, “পূর্ব্বকালে মহারাজ শ্যেনজিৎকে এক ব্রাহ্মণ বলিয়াছিল যে, ‘বৎস, গোপস্বামী ও তস্কর, ইহাদের মধ্যে যে ধেনুর দুগ্ধ পান করে, সেই তাহার যথার্থ অধিকারী। অন্যের তাহার উপর মমতা প্রকাশ করা বিড়ম্বনা মাত্র।21 এই হলো ভীষ্মদেব ঠাকুরের Hindu Law, আর ইহাই ইউরোপের International Law। যদি সভ্য এবং উন্নত হইতে চাও, তবে কাড়িয়া খাইবে। গো শব্দে ধেনুই বুঝ, আর পৃথিবীই বুঝ, ইনি তস্করভোগ্যা। সেকন্দর হইতে রণজিৎ সিংহ পর্য্যন্ত সকল তস্করই ইহার প্রমাণ। Right of Conquest যদি একটা right হয়, তবে Right of theft, কি একটা right নয়? অতএব, হে প্রসন্ন নামে গোপকন্যে! তুমি আইনমতে কার্য্য কর। ঐতিহাসিক রাজনীতির অনুবর্ত্তী হও। চোরকে গোরু ছাড়িয়া দাও |”
এই বলিয়া কমলাকান্ত সেখান হইতে চলিয়া গেল। দেখিলাম, মানুষটা নিতান্ত ক্ষেপিয়া গিয়াছে।

তৈল

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

তৈল যে কি পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি । স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে , তাহার নাম স্নেহ । তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে ?
সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপে স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন।
বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য , যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য,তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্ধারা সিদ্ধ হইতে পারে।
যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে,সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সকল কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না — উকীলিতে পসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না , বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোন কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না।যে তৈল দিতে পারিবে,তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসার হইতে পারে। আহাম্মুক হইলেও ম্যাজিষ্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্ণর হইতে পারে।
তৈলের মহিমা অতি অপরূপ ।তৈল নহিলে জগতের কোন কাজ সিদ্ধ হয় না ।তৈল নহিলে কল চলে না, প্রদীপ জ্বলে না,ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহেরা খোলে না , হাজার গুন থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না,তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না।
সর্বশক্তিময় তৈল নানারূপে সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তৈলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম ভক্তি,যাহাতে গৃহিণীকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম প্রণয়; যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম মৈত্রী; যাহা দ্ধারা সমস্ত জগৎকে স্নিগ্ধ করি,তাহার নাম শিষ্টাচার ও সৌজন্য “ফিলনথপি।”যাহা দ্ধারা সাহেবকে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম লয়েলটি ;যাহা দ্ধারা বড়লোককে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম নম্রতা বা মডেষ্টি ।চাকর বাকর প্রভৃতিকেও আমরা তৈল দিয়া থাকি, তাহার পরিবর্তে ভক্তি বা যত্ন পাই ।অনেকের নিকট তৈল দিয়া তৈল বাহির করি।
পরস্পর ঘর্ষিত হইলে সকল সকল বস্তুতেই অগ্ন্যুদ্গম হয় । অগ্ন্যুদ্গম নিবারণের একমাত্র উপায় তৈল ।এইজন্যই রেলের চাকায় তৈলের অনুকল্প চর্বি দিয়া থাকে ।এইজন্যই যখন দুজনে ঘোরতর বিবাদে লঙ্কাকাণ্ড উপস্থিত হয় ,তখর রফা নামক তৈল আসিয়া উভয় ঠাণ্ডা করিয়া দেয় ।তৈলের যদি অগ্নিনিবারণী শক্তি না থাকিত, তবে গৃহে গৃহে গ্রামে গ্রামে পিতাপুত্রে স্বামী-স্ত্রীতে রাজায়-প্রজায় বিবাগ বিসম্বাদে নিরন্তর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইত ।
পূর্বেই বলা গিয়াছে, যে তৈল দিতে পারে , সে সর্বশক্তিমান ,কিন্তু তৈল দিলেই হয় না। দিবার পাত্র আছে,সময় আছে,কৌশল আছে।
তৈল দ্ধারা অগ্নি পর্যন্ত বশতাপন্ন হয়। অগ্নিতে অল্প তৈল দিয়া সমস্ত রাত্রি ঘরে আবদ্ধ রাখা যায় । কিন্তু সে তৈল মূর্তিমান্।
কে যে তৈল দিবার পাত্র নয় ,তাহা বলা যায় না। পুঁটে তেলি হইতে লাটসাহেব পর্যন্ত তৈল দিবার পাত্র । তৈল এমন জিনিষ নয় যে,নষ্ট হয় । একবার দিয়া রাখিলে নিশ্চয়ই কোন না কোন ফল ফলিবে। কিন্তু তথাপি যাহার নিকট উপস্থিত কাজ আদায় করিতে হইবে, সেই তৈলনিষেধের প্রধান পাত্র। সময় — যে সময়েই হউক, তৈল দিয়া রাখিলেই কাজ হইবে । কিন্তু উপযুক্ত সময়ে অল্প তৈলে অধিক কাজ হয় ।
কৌশল — পূর্বেই উল্লেখ করা গিয়েছে, যেরূপেই হউক, তৈল দিলে কিছু না কিছু উপকার হইবে। যেহেতু তৈল নষ্ট হয় না, তথাপি দিবার কৌশল আছে ।তাহার প্রমাণ ভট্টাচার্যেরা সমস্ত দিন বকিয়াও যাহার নিকট পাঁচ সিকা বৈ আদায় করিতে পারিল না ,একজন ইংরেজিওয়ালা তাহার নিকট অনায়াসে ৫০ টাকা বাহির করিয়া লইয়া গেল। কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না ।
ব্যক্তিবিশেষে তৈলের গুনতারতাম্য অনেক আছে। নিষ্কৃত্রিম তৈল পাওয়া অতি দুর্লভ। কিন্তু তৈলের এমনি একটি আশ্চর্য সম্মিলনীশক্তি আছে যে, তাহাতে যে উহা অন্য সকল পদার্থের গুনই আত্নসাৎ করিতে পারে। যাহার বিদ্যা আছে,তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে,তাহার আরও মূল্যবান।তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক,হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।
তৈল দিবার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি সকলেরই আছে এবং সুবিধামত আপন গৃহে ও আপন দলে সকলেই ইহা প্রয়োগ করিয়া থাকে, কিন্তু অনেকে এত অধিক স্বার্থপর , বাহিরের লোককে তৈল দিতে পারে না।তৈলদান প্রবৃত্তি স্বাভাবিক হইলেও উহাতে কৃতকার্য হওয়া অদৃষ্টসাপেক্ষ।
আজকাল বিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতি শিখাইবার জন্য নানাবিধ চেষ্টা চলিতেছে।যাহাতে বঙ্গের লোক প্রাকটিক্যাল অর্থাৎ কাজের লোকের হইতে পারে; তজ্জন্য সকলেই সচেষ্ট, কিন্তু কাজের লোক হইতে হইলে তৈলদান সকলের আগে দরকার। অতএব তৈলদানের একটি স্কুলের নিতান্ত প্রয়োজন। অতএব আমরা প্রস্তাব করি, বাছিয়া বাছিয়া কোন রায়বাহাদুর অথবা খাঁ বাহাদুরকে প্রিন্সিপাল করিয়া শীঘ্র একটি স্নেহ-নিষেধের কালেজ খোলা হয় । অন্ততঃ উকীলি শিক্ষার নিমিত্ত ল’ কালেজে একজন তৈল অধ্যাপক নিযুক্ত করা আবশ্যক। কালেজ খুলিতে পারিলে ভালই হয়।
কিন্তু এরূপ কালেজ খুলিতে হইলে প্রথমতই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তৈল সবাই দিয়া থাকেন — কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দেই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার । এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমত লেকচার পাওয়া যায় না । যদিও কোন রীতিমত কালেজ নাই, তথাপি যাঁহার নিকট চাকরীর বা প্রমোশনের সুপারিস মিলে , তাদৃশ লোকের বাড়ী সদাসর্বদা গেলে উত্তমরূপ শিক্ষালাভ করা যাইতে পারে ।বাঙালীর বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা তৈল — বাঙালীর যে কেহ কিছু করিয়াছেন, সকলই তৈলের জোরে, বাঙালীদিগের তৈলের মূল্য অধিক নয়; এবং কি কৌশলে সেই তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হয়, তাহাও অতি অল্পলোক জানেন । যাঁহারা জানেন,তাঁহাদিগকে আমরা ধন্যবাদ দিই। তাঁহারাই আমাদের দেশের বড় লোক, তাঁহারাই আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া আছেন।
তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হইবে, ইচ্ছা করিলে সে শিক্ষা এদেশে হওয়া হওয়া কঠিন । তজ্জন্য বিলাত যাওয়া আবশ্যক। তত্রত্য রমণীরা এ বিষয়ের প্রধান অধ্যাপক, তাহাদের থ্রু হইলে তৈল শীঘ্র কাজে আইসে।
শেষে মনে রাখা উচিত ,এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।


The 1795-1833 Armed Mass Struggle of Landlords and Adivasis in Manbhum against British Colonial Rule

Pranab Kumar Mahato

Abstract: This historical study delves into the largely overlooked but significant period between 1795 and 1833 when the landlords and Adivasis of Manbhum engaged in a formidable armed mass struggle against the British colonial forces. Fueled by a complex interplay of socio-economic grievances, cultural affronts, and the erosion of traditional land rights, this resistance movement unfolded in the rugged landscapes of Manbhum, leaving an indelible mark on the trajectory of anti-colonial struggles in India. Through an examination of primary sources and oral histories, this research aims to shed light on the motivations, strategies, and consequences of this resistance, highlighting the resilience and agency of the local population in their quest for autonomy and justice. The study contributes to a deeper understanding of the multifaceted nature of colonial resistance in India during a critical period in history.

       

মানভূমের জমিদার ও আদিবাসীদের ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র গণসংগ্রাম ১৭৯৫-১৮৩৩

প্রণব কুমার মাহাত, সিধো-কানহো-বীরশা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়া, E-mail-pranab.prl1991@gmail.com , Mobile:9679147428

ভূমিকা :  অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগল সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগে ভারতে বেশ কিছু আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটে। এ প্রসঙ্গে বাংলা, অযোধ্যা ও হায়দ্রাবাদ ছিল উল্লেখযোগ্য। মোগল সম্রাটদের বার্ষিক রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে তারা নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীন ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। একইরকম ভাবে বাংলার নবাবদের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় বেশকিছু স্বাধীন জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটেছিল। এই জমিদার গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- পাঞ্চেত, মানভূম, বরাভূম, ধলভূম, ছাতনা, রাইপুর, কুইলাপাল, ঝালদা, মাঠা। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্বে এই জমিদারেরা জঙ্গল জমিদার নামে পরিচিতি লাভ করে ছিল। মোগল শাসনকালে বারো ভুঁইয়াদের মতোই নবাব আলীবর্দী খানের পরবর্তী সময়ে মানভূম অঞ্চলের জমিদারেরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ জমিদারিতে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তাই মানভূমের জমিদারি গুলিতে পৃথক ও স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে পাঞ্চেত জমিদারিতে দিগওয়ারী ব্যবস্থা ও বরাভূমের সর্দার ঘাটোওয়ালী এবং তরফ সরদারী  ব্যবস্থার কথা উল্লেখ যেতে পারে।[1]

১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব মীরকাশিমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি  বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের জমিদারি থেকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব লাভ করেন। এতে বর্ধমানের জমিদার তিলক চাঁদ ও কর্ণ গড়ের রাণী শিরোমণি ব্রিটিশ কতৃত্বের বিরুদ্ধে কোনরূপ আপত্তি জানায় নি। কিন্তু এই সময়কালে মেদিনীপুর চাকলার অন্তর্ভুক্ত মানভূম, ধলভূম, বরাভূম, পাঞ্চেত সহ বেশ কিছু অঞ্চলের জমিদারেরা যেহেতু নবাব আলীবর্দী খানের সময় থেকে নিয়মিত কোন ভূমিরাজস্ব প্রদান করতেন না, তাই তারা তাদের ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আরোপিত রাজস্বের দাবী মানতে অস্বীকার করেন। তাই মানভূম অঞ্চলের জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কোম্পানি কর্তৃপক্ষ জন্য ১৭৬৭খ্রী: থেকে অনবরত সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। এই সামরিক অভিযান গুলি ছিল মূলত পাঞ্চেত, মানভূম, বরাভূম, ধলভূম, কুইলাপাল, ছাতনা, রাইপুর, সুপুর ও অম্বিকা নগরের বিরুদ্ধে। [2]আর এই কারণেই হয়তো ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মানভূম অঞ্চলের জমিদারদের এক শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, ঠিক যেমটি হয়েছিল ভারতের মুসলিমদের সাথে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে উঠেছিল যে, শেষ পর্যন্ত তা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে মানভূমের জমিদার ও তাদের আদিবাসী প্রজারা যুদ্ধে পেরে উঠতে না পারায় ১৭৯০খ্রী: মধ্যেই সমগ্র মানভূম অঞ্চলের ওপর ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই অঞ্চলের জমিদার ও আদিবাসী প্রজারা বহিরাগত ব্রিটিশদের শাসন, আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। তাদের এই চির শত্রুতার সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটে অনবরত ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ গুলির মধ্যে।

১৭৯৫-১৮০৫খ্রী: পর্যন্ত মানভূমের জমিদার ও আদিবাসীদের সশস্ত্র ব্রিটিশ বিরোধী গণসংগ্রাম : ১৭৯৫-১৮০৫ খ্রি: মধ্যবর্তী সময়ে মানভূম জেলার ( অধুনা মানভূম) জমিদারি গুলিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন ও  অমানবিক শর্ত গুলির বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। মানভূমের প্রায় সকল জমিদার,আদিবাসী কৃষক ও সাধারণ মানুষ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চড়া রাজস্ব ও সূর্যাস্ত আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে চড়া রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হলে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পাঞ্চেত ও রাইপুর জমিদারি নিলামে ওঠায়। কলকাতার ব্যবসায়ী রামেন্দ্র সুন্দর মিত্র পুত্রের নামে নিলামে ওঠা পাঞ্চেত জমিদারি ক্রয় করেন এবং রাইপুর জমিদারি থেকে জমিদার দুর্জন সিংকে উচ্ছেদ করে কোম্পানি তার অনুগত এক ব্যক্তিকে জমিদারির দায়িত্ব প্রদান করেন। এইরকম পরিস্থিতিতে পাঞ্চেতের জমিদার গড়ুরনারায়ণ তার আদিবাসী ভূমিজ প্রজাদের নিয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং নব নিযুক্ত জমিদার যাতে করে জমিদারির দখল নিতে না পারে তার জন্য বিভিন্ন ধরনের হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করেন ।[3]ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও তৎকালীন বাংলার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় এই বিদ্রোহকে চুয়াড় বিদ্রোহ নামে অভিহিত করেছেন।কিন্তু তৎকালীন  অধুনা মানভূম তথা বাংলার জাতি কাঠামোর ইতিহাসে চুয়াড় জাতির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। চুয়াড় শব্দের অর্থ গালি/গাল। এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় মানভূমের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকেরা ব্রিটিশদের পাশাপাশি বাঙালী জমিদার, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে ছিল, তা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্রিটিশ অনুগ্রহপুষ্ট বাঙালী জাতি ভালোভাবে নিতে পারেন নি। তাই তারা সভ্য সংস্কৃতির বাইরে থাকা মানভূমের আদিবাসীদের প্রতি যেন একটা বিদ্রুপাত্মক বিশেষণ ব্যবহার করে পরিচয় দিয়েছেন ব্রিটিশ জাতির কাছে।[4]

পাঞ্চেতের মতো রাইপুরের জমিদার দুর্জন সিং, তাঁর আদিবাসী বিদ্রোহীদের (সভ্য সমাজের কাছে যারা চুয়াড়) সংগঠিত করে নব নিযুক্ত জমিদার , তহশিলদার ও নব নিযুক্ত জমিদারের সমর্থক প্রজাদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করেন। তিনি প্রথম দিকে ৪০০ জন এবং পরবর্তীসময়ে ১৫০০ বিদ্রোহী আদিবাসীদের সংগঠিত করে রাইপুর পরগণার ৩০ টি গ্রামে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। [5]এর পাশাপাশি তিনি ও তাঁর আদিবাসী বাহিনী সরকারি কাছারি ও অফিস একের পর এক লুন্ঠন ও ভষ্মীভূত করে। এইভাবে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়। বিদ্রোহীদের পরাক্রমতার জন্য সেখানে নব নিযুক্ত জমিদার প্রবেশ করতে সাহস পায় নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাঞ্চেত ও রাইপুর থেকে ব্রিটিশ বিরোধিতার আগুন ছড়িয়ে পড়ে বরাভূম, মানভূম, সুপুর, আম্বিকানগর প্রভৃতি জমিদারিতে। বিদ্রোহের আগুন এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে, তার আঁচ পড়েছিল কর্ণ গড়ের রাণী শিরোমণির জমিদারি তথা মেদিনীপুর চাকলাতে। ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে মানভূমের সকল জমিদার, তাদের আদিবাসী কৃষকদের সরকারকে রাজস্ব প্রদান করতে বন্ধ করেন।[6] মানভূমের জমিদার , কৃষক ও সাধারণ মানুষেরা অধিকাংশই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল বলেই হয়তো জমিদারদের ডাকে কৃষক ও সাধারণ মানুষ সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। মানভূমে যেন এক ব্যতিক্রমী চিত্র লক্ষ্য করা যায়, জমিদার ও আদিবাসী কৃষকদের সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধিতার ক্ষেত্রে। জমিদার ও কৃষক সম্প্রদায় পরস্পর স্বার্থ বিরোধী গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও তারা এক সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্রভাবে বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছিল। এই সময় পর্বে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহের আগুন কতটা ভয়াবহ রূপ লাভ করেছিল, তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় তৎকালীন সময়ে পাঞ্চেতে অবস্থানরত কোম্পানির দায়িত্ব প্রাপ্ত সামরিক অফিসার ওয়ালস -এর একটি মন্তব্যে। বিদ্রোহ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যটি হল- “The whole district is on the brink of ruin”.[7]

বিদ্রোহীদের হাতে রাইপুরের নায়েব কিনু বক্সী সহ অনেক তহশিলদার নিহত হন এবং বাহাদুর পুরের অত্যাচারী ইজারাদার কৃষ্ণ ভুঁইয়া নিহত হন। আদিবাসী বিদ্রোহীরা অসংখ্য গ্রাম অফিস, কাছারি বাড়ি লুন্ঠন করে। এমনকি তারা মেদিনীপুর জমিদারিতেও উপদ্রব চালিয়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে দুর্জন সিং এর দুই সেনাপতি লাল সিং ও মোহন সিং এর নেতৃত্বে শত শত বিদ্রোহী মেদিনীপুর চাকলাতে লুটপাট ও গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে, সেখান কার জন জীবনেও বিপর্যয় ডেকে আনে।[8] তৎকালীন মেদিনীপুরের কালেক্টর তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠিতে বিদ্রোহের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে-“আমি জেলার অবস্থা বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাই না। মেদিনীপুর পরগণার অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়, বিদ্রোহীরা সর্বত্রই অবাধে লুন্ঠন ও জনজীবনে ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে, যা এখানে বসে বসে আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। সমগ্র মেদিনীপুর পরগণা বাইরের যোগাযোগ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শত শত লোক নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মেদিনীপুর শহরে এসে ভীড় জমাছে  এবং শহরের লোকেরা শহর ছেড়ে পলায়ন করছে। এর কারণ হিসেবে শোনা যাচ্ছে যে বিদ্রোহীরা শিঘ্রই শহর আক্রমণ করে তা ধ্বংস করে ফেলবে।…… আমার অবস্থা এত ই শোচনীয় যে চুয়াড় দের এই অসহনীয় অত্যাচার আমাকে নীরব দর্শকের মতো চুপ করে দেখে যেতে হচ্ছে”।[9] মেদিনীপুর জেলা কালেক্টরের এই চিঠি থেকে স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় মেদিনীপুর পরগণাতেও বিদ্রোহের প্রভাব পড়েছিল লক্ষণীয়। এখানেও ব্রিটিশ প্রশাসন ব্যবস্থাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছিল  বিদ্রোহীরা।

মানভূম অঞ্চলে জমিদার ও আদিবাসী বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এই বিষয়ে প্রাইসের একটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন-“কেবলমাত্র দু-তিনটি ঘটনা ছাড়া এই বিদ্রোহ দমনে কোন ইংরেজ আধিকারিক চুয়াড় প্রভাবিত অঞ্চলগুলি পরিদর্শনের সাহস দেখাতে পারেননি “। [10]মানভূমের আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কাছে ব্রিটিশ শক্তির দম্ভ ও আস্ফালন যেন ফিকে হয়ে গিয়েছিল। আর এই কারণেই হয়তো ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মানভূমের জমিদারদের সঙ্গে আপোষ করে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কঠোর সূর্যাস্ত আইন বাতিল করেন। আদিবাসী জমিদারদের প্রায় সমস্ত দাবি মেনে নেন। ১৮০৫খ্রী:  ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বীরভূম, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত ২৫ টি পরগনা নিয়ে পৃথক জঙ্গলমহল জেলা গঠন করে।[11]

১৮৩২-৩৩খ্রী:মানভূমের জমিদার ও আদিবাসীদের ব্রিটিশ বিরোধিতা :১৮০৫ খ্রীষ্টাব্দে পৃথক জঙ্গলমহল জেলা গঠিত হলে, সাময়িক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বরাভূম জমিদারদের শক্তি দুর্বল করার জন্য , উত্তরাধিকারী দ্বন্দ্বে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। এখানকার আদিবাসীদের রীতি অনুসারে জমিদারের প্রথম স্ত্রীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র উত্তরাধিকারী মনোনীত হয়। কিন্তু তাদের এই উত্তরাধিকারী নিয়ম অমান্য করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ, নিজেদের অনুগত ব্যক্তিকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। তাই দেখা যায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ মানভূমের জমিদার বিবেক নারায়ণ সিংকে (১৭৭০খ্রী:) গদিচ্যুত করে, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র রঘুনাথ নারায়ণকে জমিদারি প্রদান করেন। এক্ষেত্রে বিবেক নারায়ণের প্রথম স্ত্রীর পুত্র লছমন  সিং জমিদারির নাহ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ১৭৯৮ খ্রী: রঘুনাথ নারায়ণের মৃত্যুর পর আবার উত্তরাধিকারী সংকট সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রেও,কোম্পানি কর্তৃপক্ষ রঘুনাথ সিংহের দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র গঙ্গা গোবিন্দ সিংকে জমিদার হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রথম স্ত্রীর পুত্র মাধব সিংকে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু স্থানীয় জমিদার ও সর্দারগণ রঘুনাথের প্রথম স্ত্রীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র মাধব সিংকে বৈধ জমিদার হিসেবে সমর্থন করেন।[12] এরকম পটভূমিতে গঙ্গা গোবিন্দ, মাধব সিং এর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন যে মাধব সিংকে আদিবাসী চুয়াড়রা নেতা হিসেবে মেনে নিয়ে বরাভূম পরগণায় বিভিন্ন গ্রামে লুন্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে। এতে ভয় পেয়ে মাধব সিং গঙ্গা গোবিন্দের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেন এবং গঙ্গা গোবিন্দ তাঁকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন। দেওয়ান নিযুক্ত হয়েই মাধব সিং বাতিল করেন গঙ্গা নারায়ণের উত্তরাধিকারী হিসেবে পাওয়া ‘পঞ্চ সর্দারী’ এবং প্রজাদের ওপর ‘ঘরতটী’ নামক এক ধরনের গৃহকর  চালু করেন।[13] এই ভাবে মাধব সিং বরাভূম পরগণায় আর্থিক শোষণ শুরু করলে আবার মানভূম অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বরাভূম পরগণার চিরাচরিত উত্তরাধিকারী নির্বাচন প্রথার ওপর কুঠারাঘাত করে ,লছমন সিং ও তার পুত্র গঙ্গা নারায়ণকে বঞ্চিত করেছিল, এতদিনে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের সময় এসে পড়ে। তাই ১৮৩২ খ্রী: বৈশাখ মাসে দেওয়ান মাধব সিং গোলাঘর পরিদর্শনে বেরোলে পঞ্চ সর্দারী ও সতেরখানির দুই সর্দার সহ বিরাট বাহিনী নিয়ে গঙ্গা নারায়ণ তাঁকে আক্রমণ করেন। এরপর তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বামনি পাহাড়ে এবং সেখানে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে গঙ্গা নারায়ণের নেতৃত্বে আরো একবার আদিবাসীরা সংঘবদ্ধভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করেন।[14]

খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গুলিতে। গঙ্গা নারায়ণের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা বরা বাজারের মুনসেফের কাছারি, থানা, রাজবাড়ি, দারোগার কার্যালয় লুন্ঠিত হয়। এক কথায় বলা যায় সমগ্র বরাভূম পরগণায় গঙ্গা নারায়ণের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বরাভূম পরগণার বাইরে আঁকরো,অম্বিকা নগর, রাইপুর, শ্যামপুর, ফুলকুসমা, শিলদা,কুইলাপাল প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। গঙ্গা নারায়ণের দুই সর্দার লাল সিং ও পঞ্চানন সিং এর সংঘবদ্ধ আক্রমণে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়েছিল। গঙ্গা নারায়ণের নেতৃত্বে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় সমস্ত স্তরের মানুষ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল এবং ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল।[15] এই বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় ইংরেজ কর্মচারী ডেন্ট- এর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লেখা একটি চিঠি থেকে। তিনি কলকাতার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান যে-“প্রায় প্রতিটি ভূমিজ, ঘাটোয়াল এবং রায়ত নির্বিশেষে গঙ্গা নারায়ণের দলে যোগদান করেছে। গঙ্গা নারায়ণ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি দেশের সমস্ত পুলিশ থানা গুলি সূদুর বেনারস রোড পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলবেন”।[16]

ডেন্ট- এর চিঠি থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে সমাজের সকল স্তরের মানুষ গঙ্গা নারায়ণের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদান করেছিল। প্রথম দিকে গেরিলা যুদ্ধে বিদ্রোহীরা বেশ কিছু সফলতা অর্জন করলেও, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীর আধুনিক অস্ত্র ও রণকৌশলের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। ব্রিটিশ বাহিনী অতর্কিতে বিদ্রোহীদের প্রধান ও গোপন ঘাঁটি বাঁধডি,বারুডি এবং বাওনি আক্রমণ করলে গঙ্গা নারায়ণ সিংভূমে পালিয়ে যায়। সিংভূমে তিনি  খারসওয়ার ঠাকুরদের বিরুদ্ধে অভিযানে মারা যান। গঙ্গা নারায়ণের মৃত্যুর সংবাদ বিদ্রোহীদের হতাশ ও নিরুৎসাহিত করেছিল। পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ডোম পাড়ার রঘুনাথ সিং এর আত্মসমর্পণ এবং সর্দার লাল সিং ও তাঁর পুত্র সহ অনেক বিদ্রোহী ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে বন্দী হলে বিদ্রোহীদের মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যায়। ফলে বিদ্রোহের আগুন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে।[17]

উপসংহার:মানভূমের আদিবাসী বিদ্রোহ গুলি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও, তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও ঐক্যবদ্ধতা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে ভীতি সঞ্চার করেছিল। বিদ্রোহীদের বেশিরভাগই ছিল ভূমিজ, কোল, মুন্ডা, কুর্মি, সাঁওতাল, হো প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক। মানভূমের বিদ্রোহ গুলি জমিদারদের নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও,আদিবাসী সমাজের সকল স্তরের মানুষ যোগদান করে গণবিদ্রোহের রূপ দিয়েছিল। তাই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানভূমের জমিদারদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিদ্রোহ গুলিকে চুয়াড় বিদ্রোহ না বলে, “জমিদার ও আদিবাসীদের ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র গণসংগ্রাম” বলাটাই হয়তো যুক্তিযুক্ত হবে।

                                                                   তথ্যসূত্র

1.Coupland. H, Bengal District Gazetteer, Manbhum, Vol- xxviii, Calcutta, 1911,Page-55

2. মুখোপাধ্যায়, সুভাষচন্দ্র ও চক্রবর্তী মুখার্জী, সুদীপ্তা, মানভূমে চুয়াড় বিদ্রোহ ও  বৃটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের যুগ, এ. কে. ডিস্ট্রিবিউটর্স, পুরুলিয়া, ২০১০,পৃ-১২৩-১২৪

3. Sen.N.N, West Bengal District Gazetteer, Puruliya, Calcutta, 1985,Page-96-98

4.রায়, সুপ্রকাশ, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, কলকাতা, ২০১২,পৃ-১৩৯-৪০

5.রায়,সুপ্রকাশ,২০১২,প্রগুপ্ত,পৃ-১৪৬-৪৭

6.মুখোপাধ্যায়, সুভাষচন্দ্র ও চক্রবর্তী মুখার্জী, ২০১০,প্রগুক্ত,পৃ-১৪৩

7.রায়, সুপ্রকাশ,২০১২,প্রগুক্ত,পৃ-১২০

8.Price, J,C,The Chuar Rebellion of 1799,Midnapore, Page-235

9. Ibid, Page-267

10.Malley,O,Bengal District Gazetteer,Bankura,Page-38-39

11.Coupland. H, Bengal District Gazetteer, Manbhum, Vol- xxviii, Calcutta, 1911,Page-62-63

12.De, Dipa,The Bhumij in Bengal in the Nineteenth and Twenteenth centuries a socio-cultural transformation, Ph.d theses, University of Burdwan, 2008,Page-45-46

13.ভট্টাচার্য, তরুণ দেব, পুরুলিয়া, ফার্মা. কে. এল.এম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮৬,পৃ-১৫৭

14.ভট্টাচার্য, তরুণ দেব,১৯৮৬, প্রথমগুক্ত, পৃ-১৫৮

15.টুডু, বুদ্ধেশ্বর, খেরওয়াড় ও চুয়াড় বিদ্রোহ, চায়না পাবলিকেশন, কলকাতা, ২০০৬,পৃ-৪০-৪১

16.মুখোপাধ্যায়, সুভাষচন্দ্র ও চক্রবর্তী মুখার্জী, ২০১০,প্রগুক্ত,    পৃ-১৬১

17.মুখোপাধ্যায়, সুভাষচন্দ্র ও চক্রবর্তী মুখার্জী, ২০১০,প্রগুক্ত,পৃ-১৭৪


মহাজনী পদে মানবতা

নাজমুল হক

” যে খুঁজে মানুষে খুদা

সেই তো বাউল

বস্তুতে ঈশ্বর খুঁজে

পাই তার উল

পূর্ব জন্ম না মানে

ধরা দেয় না অনুমানে

মানুষ ভজে বর্তমানে

হয় রে কবুল।

বেদ তুলসী মালা টেপা

এসব তারা বলে ধুঁকা

শয়তানে দিয়ে ধাপ্পা

করে ভুল

মানুষে সকল মেলে

দেখেশুনে বাউল বলে

দীন দুদ্দু কি বলে

লালন সাঁইজির কুল।‘[i]

                                                   ——দুদ্দু শাহ

‘চুয়াডাঙ্গার সাধক-শিল্পী লতিফ শাহর কণ্ঠে শোনা এই গানটির রচয়িতা হলেন বাংলাদেশের ঝিনাইদহ অঞ্চলের বাউল সাধক দুদ্দু শাহ। উপর্যুক্ত সংগীতের বাণীতে ‘বাউল মত’ তথা বাউলতত্ত্বের মূলকথাটা অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কেননা বাংলার বাউলদের মূল পরিচয়ের প্রধানতম একটি দিক হলো, তাঁরা মানুষেই স্রষ্টার সন্ধান করেন। দ্বিতীয় দিক হলো, তাঁরা প্রচলিত ধর্মগোষ্ঠীর লোকদের মতো অনুমানে বিশ্বাস করেন না, এমনকি পূর্বজন্ম বা জন্মান্তরবাদকে মানতে নারাজ; তৃতীয়ত বেদ তুলসী মালা টেপাকে তাঁরা ধোঁকার কাজ বলে গণ্য করেন। আসলে, প্রচলিত ধর্মীয় চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলার বাউল মত মূলত ‘মানুষে সকল মেলে’- এই তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে।‘[ii]

লালন সাঁইজির প্রথমদিকের ভাব শিষ্য দুদ্দু শাহ -র  এই গানের মধ্যেই অন্তর্নিহিত আছে  লিখিত এই বিষয়বস্তুর  একটি সামগ্রিক ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ| বাউল শব্দের ‘বা’ অক্ষরটি অতীন্দ্রিয়বাদের দত্তক। ‘উল’  শব্দের অর্থ হলো সন্ধান করা| লালন সাঁইজি এবং পরবর্তী সময়ে লালনোত্তর   মহাজনদের পদ বা সাধনা তত্ত্বে দেহতত্ত্ব, গুরুবাদী আধ্যাত্মবাদের বিষয়ের পাশাপাশি শুধু মাত্র মানুষকে মান্যতা বা প্রাধান্য দেওয়ার এক তত্ত্ব সুসংগত ভাবেই তাদের দর্শনে, ভাবনায়, পদে এক মানবতার জন্ম দিয়েছে | যুক্তিগ্রাহ্য, প্রমাণ সাপেক্ষ এক ভাবনা এবং নিরন্তর সাধনার পথে থেকে জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়হীন একমাত্র ‘মানুষ’ শব্দের প্রতি অন্তরের বিশ্বাস আর সাধনাগত নিগুঢ় উপলব্ধি বোধ এক মানবতার ইতিহাস রচনা করেছে |

  “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি”[iii]

                         ——–ফকির লালন সাঁই

বাংলার বাউল ফকিরি গান এর পরিসর কে যদি একটু বিশদ ভাবে বিশ্লেষণ করি  তাহলে এ সমস্ত গানের যারা স্রষ্টা  তাদের সমাজগত ভাবনাসহ সেই সময়ের ছবি, তার পটভূমি বা পশ্চাৎভূমি বিশ্লেষণের দরকার| যখন সামগ্রিকভাবে ভারতের সংস্কৃতি আর্য সংস্কৃতিতে পদদলিত হয়েছিল যখন দ্রাবিড় সভ্যতা বা অনার্য সভ্যতা কে সরিয়ে দিয়ে আর্যরা আধিপত্য লাভ করেছিল তখন কিন্তু বাংলা তথা বৃহত্তর বঙ্গভূমি এখানে পা মেলায়নি| সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র থেকে বাংলার প্রতিবাদী রূপ তখনও প্রতিষ্ঠিত ছিলো যার সন্ধান

ইতিহাস আমাদের দিয়েছে| উত্তরকালে একাদশ দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে বাংলার মানুষের জয়গানের সংস্কৃতি প্রসারিত হয়েছে| সম্প্রদায় বলতে শুধুমাত্র হিন্দু বা মুসলমান সম্প্রদায় নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ও যখন শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব এই সমস্ত ভাগে বিভক্ত থেকেছে  তখন একটি প্রতিবাদী স্বর শ্রীচৈতন্যদেবের নেতৃত্বে এই বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করেছে এবং পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে| অর্থাৎ পটভূমিটা ছিল সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে এক করে বেঁধে রাখা| আর সেই ধারাকে যুগ যুগ ধরে পরম্পরাগত ভাবে বয়ে নিয়ে চলেছে এই বাংলার বাউল ফকিরি সম্প্রদায়ের মহাজনী সাধকরা| আজকের এই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলার সাধু সাধকদের সাধনাগত দর্শনকে নতুন করে অনুসন্ধানের প্রয়োজন বলে মনে করছি|

” এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে

যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে “

          ——-ফকির লালন সাঁই

বাংলার বাউল বা ফকিরি সাধকরা কোন ধর্মগত জাতি বা সম্প্রদায়কেই মানতে চাননি| যদি তারা সম্প্রদায়কে মানতো তাহলে সমস্ত রকম সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে মানুষের জয়গান করতে পারত না| বরঞ্চ তারা  হিন্দুধর্মের যে বর্ণ বৈষম্য,  মুসলমান সম্প্রদায়ের শিয়া-সুন্নি-আহামদিয়ার ভাগ এক্ষেত্রেও মানুষে-মানুষে যে বিভাজন তারা মানেন নি| তার বাইরেও বিভাজনের আরো যে স্তর গরিব-ধনী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গুণী-অগুণী মানুষকে আমরা এভাবে দেখতে  অভ্যস্ত হলেও তারা এভাবে ভাবেন নি| তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন এবং মানুষের মাহাত্ম প্রচার করে গেছেন| মানবতাবাদী গানের ধারক বা প্রথম পুরুষ হিসেবে ফকির লালন সাঁইজি কে যদি ধরা হয় তাহলে লালনোত্তর সাময়ের মহজনী সাধকরা পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, কুবীর গোঁসাই, যাদু বিন্দু শরৎ গোঁসাই, আলাউদ্দিন সাঁই, জালালুদ্দিন সাঁই, হাসান রাজা, কালাচাঁদ দরবেশ, বিজয় সরকার, গুরুচাঁদ গোসাঁই, মাতাম চাঁদ গোসাঁই বাংলার অসংখ্য সাধকরা ভাবজগতের ভাবনাগত অবস্থানে থেকে অসংখ্য পদের সৃষ্টি করে এই ধারা বয়ে নিয়ে গেছে| যে গান চেতনার গান – মানবতার গান – উজ্জীবনের গান| ভাব সাগরে ডুবে থেকে মানুষের বিশ্লেষণে কোনোরকম মনগত দৈন্যতা কে প্রশ্রয় দেয়নি| বরঞ্চ মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার বোধ বা উপলব্ধি সমাজতন্ত্রের পথ কে প্রশস্ত করেছে যা সার্বিক ভাবে মানুষজাতির পক্ষে কল্যাণকর| ফকির লালন শুরুতেই তার পদে যে সুর বেঁধে দিয়েছেন পরবর্তী সময়ে তাঁর উত্তরসুরিরা সেই পথের অনুসন্ধানে অসংখ্য মানুষ ভজার পদ রচনা করে গেছেন |

“ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠ যার

 সর্বসাধন সিদ্ধ তার”

উচ্চবর্গের সম্প্রদায়ের মত এইসব দেহতত্ত্বের সাধকরা শাস্ত্র বা মন্ত্র না লিখে শুধু গান লিখেছেন| ভাব থেকে উঠে আসা মনের কথা গুলোই সুরের মিশ্রনে গানে রূপান্তরিত হয়েছে| আসলে তাঁদের কথাগুলোই হলো গান| জীব এবং জীবনের সাধনা করতে করতে মানব জীবনকে সকল জীবনের সেরা হিসেবে বর্ণিত করেছেন|

      ” কাশী কিংবা মক্কায় যাও রে মন

দেখতে পাবে মানুষের বদন ধ্যানধারণা ভজন পূজন মানুষ সর্ব ঠাঁই “

পৃথিবীর পাঠশালা থেকে যে জ্ঞান তারা আহরণ করেছিলেন পরবর্তী সময়ে সেই শিক্ষা বা জ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম|

লালন সাঁইজির বিখ্যাত গান

   ” সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে “

               বা

” জাত গেলো জাত গেলো বলে

  একি আজব কারখানা “

এই গানের পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে পাই “জাতের নামে বজ্জাতি সব” বা বিশ্বকবির  “আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে”। মানুষের জন্য এই সব মরমী বাণী যেন মহাজনী সাধকদের কথারই প্রতিধ্বনি|

লালন সাঁইজির শিষ্য দুদ্দু শাহের একটি পদ দিয়ে এই লেখাটা শুরু করেছিলাম| এই লেখার অন্য একটি পরিসর ধরার চেষ্টা করছি যেখানে এই গানের শেষ অন্তরাটি বলা প্রয়োজন| অন্তরাটি এমন –

      ” মানুষে সকল মেলে

     দেখে শুনে বাউল বলে

     দীন দুদ্দু কি বলে

    লালন সাইজির কুল “

মহাজনী পদ হল গুরুবাদী দর্শনের এক নিরন্তর ধারা| গুরু এবং শিষ্য| মুখোমুখি দুটি মানুষের ভাবের বিনিময়| একজন পথ দেখায় অন্যজন তা অনুসরণ করে| গুরু হচ্ছে পথপ্রদর্শক আর শিষ্য সেই পথে মুক্তির উপায় খুঁজে| সেই পথ সহজ হলে ও হোঁচট খাওয়ার ভয় থাকে|

 “সহজ পথে হোঁচট লাগে ওরে মন কানা

কানারে একলা নোস কানা |

তোর সাথে আছে দেখো আরো ছয় জনা

নিজের সরল না হইলে

সরলের পথ না যায় জানা ||

সরল হয়ে ধরাগা গুরুর পা’য়

হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দেবে সরলের উপায়

তখন অন্ধকারে দেখতে পাবি রাং কি সোনা

যাও যদি মন সহজ বাজারে

এই মানুষকে সঙ্গে লইয়ো শত হাজারে

যাদু বিন্দু বলে এবার

আমি গুরুর চরণ ছাড়বো না ||”

নিজেকে গুরুর কাছে সঠিকভাবে সঁপে দিতে পারলেই এই সহজ পথের সাধন সম্ভব| সহজ পথ ধরে উত্তরণের পথেই সৃষ্টি হয়েছে এই সমস্ত গান| যা কখনো দেহের বর্ণনা, কখনো বা মনের মানুষের খোঁজ, কখনো মনের মধ্যে মণি-মাণিক্যের সন্ধান| এ ভাবেই আউল-বাউল, ফকির, দরবেশি মহাজনরা নিজের মুক্তি লাভের উপায় খুঁজেছেন | সাধনমার্গ এর মধ্য দিয়ে মনকে সত্যের পথে ঠেলে দিয়েছে বারবার| ফকির দুদ্দু শাহ লালন সাঁইজির যে কুলের কথা বলেছেন সে কুল হলো মানুষ ভজার জগৎ|এই জগতে শুধু মানুষের জয়গান| সাদা-কালো, উঁচু-নিচু সব কিছুর উপেক্ষায় সাধকের সকল সাধনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হলো তাদের কাছে একমাত্র সত্য|

লালনোত্তর সময়ে যেসব মহাজনরা এসেছেন এই বাংলায়, যারা মানুষ তত্ত্বের দর্শনকে বেশি মাত্রায় প্রাধান্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, যাদু বিন্দু, বিজয় সরকার, গুরুচাঁদ গোসাই, কালাচাঁদ দরবেশ, আলাউদ্দিন সাঁই জালালুদ্দিন সাঁই সাধকরা অন্যতম| জালাল সাঁইজির একটা পদ সংগ্রহ করেছিলাম মানুষের সাধনে, বর্ণনায় আজও উজ্জ্বল| “মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরজন, মানুষ ধরো মানুষ পুজো শোন বলিরে পাগল মন” প্রত্যেক সাধকদের  পদ রচনায় ভাবনাগত বিষয়বস্তুর পার্থক্য থাকলেও গুরুদীক্ষা, ভাব বা সাধনাগত জায়গায় তারা এক| প্রত্যেকেই সাধক| গান সৃষ্টির মধ্য দিয়েই তাঁদের সাধনার পর্যায়গত অবস্থান নির্ণিত হয়|

“আঠারো মোকামের মাঝে

জ্বলছে এক রূপের বাতি

একি রে আজব কুদরতি “

কলকাতার লোকপ্রেমী মানুষরা সাধক কালচাঁদ দরবেশের গান এবং সাধনাগত যাপন সম্পর্কে অনেকটাই অবগত| সহজিয়া লোকগানের দলের পক্ষ থেকে গবেষক, বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী দেব চৌধুরী এই সাধক মানুষটির পাশে থেকে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন| কলকাতার রবীন্দ্রসদনে প্রতি বছর তার গান শুনতে হাজার হাজার নাগরিক শ্রোতা উপস্থিত থেকেছেন| বর্তমানে তিনি প্রয়াত| কালাচাঁদ দরবেশের একটি বিখ্যাত উক্তি ” নিরাকারে নয়রে সাধন ” আমরা আকার অর্থাৎ স্বরূপের সাধন করি| “স্বরূপে হয় রূপ দরশন”। কিন্তু পৌঁছাতে হয় নিরাকায় জায়গায়| সম্প্রদায়গত ধর্ম মান্যতার  একটা সহজ সরলীকরণ – ইসলামে আল্লার কোনো আকার নেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা একটা মূর্তিকে সামনে রেখে পূজা-পাঠ করে| কিন্তু এখানে কালাচাঁদ দরবেশ তার দর্শন ভাবনায়, তিনি একবার বলছেন নিরাকারে নয়রে সাধন আবার আকারে সাধন করলেই নিরাকের পৌঁছানো যাবে অর্থাৎ সাধনার পথ যাই হোক নিজের মধ্যে যে চেতনা সেই চেতনাকে উঁকি মেরে দেখতে হবে| নিজেকে জানার মধ্যেই সেই মুক্তি| কালচাঁদ দরবেশের একটি দরবশি গান –

“খ্যাপারে সিন্ধু পরের বন্ধু যে জন

তোরে পার করিবে দরিয়ায়

জানি না সে বন্ধুর বাড়ি আছে কুন জাগায়

মুর্শীদপুরে লুকিয়ে থাকে রসূলপুরে খেলা খেলায়”

এক পন্থীর ‘মুর্শীদ’ অন্য পন্থীর ‘রসূল’ মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্ম পালনে দুটি ধারাকে ‘এক’ করে দেখার এই উপলব্ধিগত চেষ্টা আমাদের বিস্মিত করে| আবার এই দরবেশি ভাবনাকে যুগ যুগ ধরে সমর্থন জুগিয়ে এসেছে লোকায়ত আর একটি ধারা — গাজীর গান

” মুসলমানে বলে গো আল্লা হিন্দু বলে হরি

নিদানকালে যাবেরে ভাই একই পথে পড়িরে

দয়ানি করিবা আল্লারে “

 তাঁদের মূল কথা মানুষকে মান্যতা দেওয়ায় হলো ধর্ম| যে ধর্ম হলো মানবতার ধর্ম| বাংলার সাধক কবি বিজয় সরকারের একটি বিখ্যাত পদ সাধকদের দর্শনকে বুঝতে আমাদের ভাবনার সহায়ক হতে পারে –

“জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি

আমরা বহু নামে ধরা ধামে কতো রকমে ডাকিতেছি

কেউ তোমায় বলে ভগবান

গড বলে কেউ করছে আহ্বান

কেহ খুদা কেউ জিহুদা

কেউ কয় পাপীয়ান…….”

এ প্রসঙ্গে নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি| তখন আমি লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক ড. সুধীর চক্রবর্তীর অধীনে সহ-গবেষক হয়ে বাংলার বাউল ফকিরি গানের সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত আছি|  মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়ার জেলার এই মহাজনী পদ জানা বাউল, ফকিরি শিল্পীদের কাছ থেকে এই পদ সংগ্রহ করা ছিল মূলত আমার কাজ| একদিন মুর্শিদাবাদের এক বিশিষ্ট ফকিরি গানের শিল্পী লালু ফকির আমাকে একটা গান শোনাচ্ছেন আর আমি আমার রেকর্ডারে তা বন্দি করছি–

‘ মানুষ থুয়ে খোদা ভজ এই মন্ত্রনা কে দিয়েছে….. ” মনের মধ্যে একটা ধন্দ বা সংশয় থেকে দ্বন্দ্ব শুরু হলো| একজন শরীয়তপন্থী মানুষ হয়ে তাঁদের এই কথা বলার স্পর্ধা নিয়ে মনে মনে ভাবছি আর সর্বশক্তিমান আল্লাহকে মানা নিয়ে এই প্রশ্নবোধক গান কিছুতেই মানতে পারছি না| অল্পবয়সী আমি সবেমাত্র রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে এম. এ সম্পূর্ণ করেছি| 

আসলে তখন আমি এই সব পদের আভ্যান্তরীণ বিষয় মানে কিছুই বুঝি না শুধু গানের বাহ্যিকতা বুঝি| পরবর্তী সময়ে বাউল ফকির সাধকদের সাধনতত্ব, তাঁদের ধর্মাচরণ, রূপকধর্মী গানের অর্থ অনুভব করা, তাঁদের যাপন, গোপন সাধনপথের সন্ধানে বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক ড. সুধীর চক্রবর্তী, ড. শক্তিনাথ ঝা, প্রভাস সাহা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের গবেষণালব্ধ গ্রন্থ আর ব্যক্তিগত জীবনে কিছু বাউল এবং ফকিরি গানের সাধক এবং শিল্পীদের সানিধ্যে থেকে মনে হয়েছে আল্লা খোদা বা ঈশ্বর মানতে তাঁদের কোনো বিরোধ নেই| তাঁদের সন্ধানের পথ আলাদা হতে পারে বরঞ্চ তারা আল্লা বা ঈশ্বরের খোঁজে গভীর নির্জন পথ ধরে অনাড়ম্বর এই একটা সাধনাতেই নিমগ্ন থেকেছেন বহু সময় ধরে| তাঁদের সাধনগত উপলব্ধি হলো মানুষের অস্তিত্বকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লা বা ঈশ্বর নয়| নিজের ধর্মাচরনে মানুষকে খাটো বা ছোট করে দেখা নয়| তাই যদি হতো লালন সাঁইজি বার বার মনকে বলতো না,

” আল্লা বলো মনরে পাখি একবার

মৌলা বলো মনরে পাখি “

এই রকম আল্লার প্রতি সমর্পন করার অনেক পদ তিনি রচনা করেছেন |

‘ আল্লার বান্দা কিসে হয় বলো গো আমায়

খোদার বান্দা নবীর উম্মত কী করিলে হওয়া যায়’

আল্লার করুনা পেতে হলে ‘আপনাকে’ জানতে বা চিনতে হবে | আত্ম অনুসন্ধান | পাঞ্জু সাঁইজির একটি গানে সেই কথার সারমর্ম মেলে –

‘ কয়েকজন মানুষ চিনি মহাজনের কৃপায়

মানুষ মানুষ বিরাজে চেনা হলো বিষম দায়

আল্লার নামে মেনে সিন্নি যাচ্ছেরে মসজিদ ঘরে

সেই সিন্নি আল্লাতে না খায় মানুষ খায়রে পেট পুরে… “

সহজ পথের সহজ কথা | সবধরণের মানুষকে মানতে হবে |

ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব মানুষকে মান্যতা দিয়েই তাঁদের সাধনা আর এখানেই এক ‘পন্থাগত’ বিরোধ আমাদের সামনে আসে| আসলে মানুষের সন্ধান, সমর্থন আর পক্ষে তাঁদের পদ রচিত হয়েছে, বিভাজনে নয়|  তার জন্য তারা দেহের সাধনা করে দেহকে কব্জা করার কাজে মগ্ন থেকেছেন | দেহকেন্দ্রিক কাম সাধনা থেকে নিষ্কাম সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে আধাত্মিক জীবন লাভের চেষ্টায় থেকেছেন| দেহের মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ… সাধনার মধ্যে দিয়ে ষড় রিপুর সংযমে তারা ভাবের মানুষে পরিণত হয়ে সমস্ত রকম জাগতিক বিষয় থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে মানুষ ভজার জগতে নিমগ্ন থেকেছেন| যেটা হলো তাঁদের আত্মমগ্নতায় চেতনার জগৎ| সাধক ভবা পাগলার একটি বিখ্যাত গান,

‘ভাব সাগরে ভাবের মানুষ বসে আছে ভাব ধরে

খুঁজতে গেলে কে বা মিলে আওয়াজ বুঝে লও ধরে…..’

আসলে কয়েকজন বাউল বা ফকিরি বেশধারী শিল্পীর মঞ্চে কয়েকটি গান শুনে এই সব মহাজনী সাধকদের আধ্যাত্মিক চেতনার জায়গাটি উপলব্ধি করা খুব সহজ বিষয় নয়| তাঁদের সৃষ্টি বা রচিত পদকে শুধু গান হিসেবে দেখলে হবে না আমি মনে করি তাঁদের এই পদ নিজেকে শৃঙ্খলিত সংযমী রাখার এক যুক্তিগ্রাহ্য উপদেশও| ফকির লালন সাঁই থেকে পরবর্তী সময়ে মহাজনী সাধকরা তাঁদের অসংখ্য পদ রচনার মধ্য দিয়ে মানবদর্শনকে যে ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন তা আমার এই সীমিত লেখাতে সম্পূর্ণ আলোচনা বা ব্যাখ্যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়| এই সব মানুষদের মূল পরিচয়ই হলো তাঁদের গান| লালন সাঁইজি ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতায় সমাজ-সংসার, শাস্ত্র-আচার ও জাত-ধর্ম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ ছিলেন বলেই পরবর্তী সময়ে তার সাধন জীবনে জাত-পাত-বর্ণহীন মানুষের জয়গানে নিমগ্ন থেকেছেন|

“জগৎ- কর্তা পতিত পাবন

এই মানুষে করে বিরজন

তিন রতিতে খেলছে মানুষ

তিন রসের সম্মিলনে”

মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের অন্বেষণ বা খোঁজ| দেহ ঘরেই হচ্ছে ঈশ্বরের ঘর| একের মধ্যে দুয়ের যাতায়াত| সাধকরা মনে করেন সমস্ত রকম জীব এমন কি জড়ের মধ্যেও ঈশ্বর আছে| এই দেহ ঘরের যত্নসাধনে মগ্ন হয়ে মনের যে উত্তরণ ঘটবে সেখানেই দেখা মিলবে পরমাত্মার| পরমাত্মা হলো আমার ভেতরের মানুষটি যে আমাকে বলে আমি তার কথা শুনি, অন্য কেও শুনতে পাই না| তাকে খোঁজা বা শোনার পথই হলো সাধনার পথ| গুরুই সেই পথের সন্ধান দেবে|

‘ ঘরের কেবা ঘুমায় কেবা জাগে

কে কারে দেখায় স্বপন

এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন ।।

শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়

নিঃশব্দে কে আছে সদাই

যেদিন হবে মহাপ্রলয়

কে কারে করবে দমন ।।

দেহের গুরু আছে কেবা

ভক্ত হয়ে কে দেয় সেবা

যেদিন তাহা জানতে পারবা

কূলের ঘোর যাবে তখন ।।

যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে

কোনখানে সে বসে আছে

সিরাজ সাঁই কয় তাই না খুঁজে

দিন তো বয়ে যায় লালন ।।

— লালন ফকির

আমরা আল্লা কে মানতে গিয়ে বলি সর্বশক্তিমান আল্লা আমাদের সৃষ্টি করেছেন কেউ বলেন ঈশ্বর আবার কেউ মনে করেন যীশু| এই সাধকদের মতে স্রষ্টা যেই হোক না কেনো তার সৃষ্টি জাতি বা মানুষকে যদি সেবা করতে না পারি যদি নিজের সম্প্রদায়গত ধর্মীয় অবস্থান থেকে অন্য সম্প্রদায়গত মানুষকে ‘ছোট ‘ করে দেখি তাহলে এতো ‘নামাজ রোজা পূজা পার্বন কেন ‘? কোনো শাস্ত্র জ্ঞান নয় অন্তরের জ্ঞান আরোহনে স্রষ্টা ও সৃষ্টির সংজ্ঞা নির্ণয়ে তাঁদের অবস্থানকে বোঝাতে চেয়েছেন তাঁদের সৃষ্টপদের মাধ্যমে| সব সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টা আছেন | তাঁকে খুঁজতে হবে এবং খুঁজে পেলেই মুক্তি| লালন সাঁইজির অনেক গানই সেই ভাবনার সন্ধান মেলে|

 ” বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা পড়শী বসত করে

আমি একদিন না দেখিলাম তারে “[iv]

রূপকধর্মী গানের আভ্যন্তরীণ অর্থটাই হল আসল| যে কথা আগেই বলেছি আমার দেহ ঘরে সে বিরাজ করছে অথচ তাকে দেখতে পাচ্ছি না| যার জন্যই সাধনা| যার জন্যই সাধক|

লালন সাঁইজির আর একটি বিখ্যাত পদ,

” কে কথা কয় রে দেখা দেয় না

নড়ে চড়ে হাতের কাছে

খুঁজলে জনমভর মেলে না ।।

খুঁজি তারে আসমান জমি

আমারে চিনি না আমি,

এ বিষম ভোলে ভ্রমি

আমি কোন্‌ জন, সে কোন্‌ জনা ।।

হাতের কাছে হয় না খবর

কি দেখতে যাও দিল্লি লাহোর

সিরাজ সাঁই কয়, লালন রে তোর

সদাই মনের ভ্রম গেল না ।।[v]

কি অসাধারণ আত্মচেতনার অভিব্যক্তি এই গানে| ‘আমি কোন জন সে কোন জনা ‘ ।

সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে অনুভব করতে সাধনপথের কতোটা গভীরে পৌছাতে  হয় এই গানে তার দৃষ্টান্ত মেলে –

‘ আমার আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি

দিবানিশি নাই সেখানে

মনের মানুষ যেখানে।[vi]

   ….ফকির লালন সাঁই

একজন দরবেশি ফকির একটা নির্জন অথচ কিছুটা প্রসস্থ পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে| দুদিকে বনারণ্য| বয়সের ভরে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে| হাতে একটা প্রাচীন লাঠি| অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে তার আভ্যান্তরীণ  সত্ত্বা এবং বাহ্যিক সত্ত্বা যেন একাকার হয়ে আছে| দুধারে প্রকৃতির শোভা, আলো, বাতাসের মধ্যে নিরন্তর ভাবে কিসের যেনো সন্ধান করে চলেছেন| দূর থেকে ভেসে আসছে একতারাতে লালন সাঁইজির একটি গান –

” আপ্ততত্ব না জানিলে ভজন হবে না পড়বি গোলে [vii]

দূরে দেখা যাচ্ছে একটা আখড়া বা আশ্রম গোছের আস্তানা| সে দিকেই এগিয়ে যায় দরবেশি ফকির| আরও এগিয়ে গেলে আস্তানাটি কাছাকাছি এসে পড়ে| ভেতর থেকে কে যেনো গাইছে,

” সত্য বল সুপথে চল

ওরে আমার মন

সত্য পথ না চিনিলে পাবিনা

মানুষের দরশন ‘[viii]

ধর্মীয় সংকীর্ণতা বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে এই মহাজনী সাধকদদের এই দর্শন বোঝা সম্ভব নয়| বৌদ্ধ সহজিয়া মত, ইসলামী সুফিবাদ এবং বৈষ্ণব সহজিয়া দর্শনের  সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই মতাদর্শকে বুঝতে হলে আমাদের সহজ হতে হবে| বুঝতে হবে যখনই জাত পাতের বিরোধ বেঁধেছে সমাজে তখন তারাই সমাজ সুধারকের ভূমিকায় থেকে সেই বিরোধ সামলানোর চেষ্টা করেছেন| নিজেদের এই পথকে স্বতন্ত্র রেখেছেন| এই সাধকদের মতবাদ বা বক্তব্য কে কোনো বিশেষ ‘ পন্থা ‘ হিসেবে আমি দেখি না| আমি মনে করি মানুষকে ভালোবেসে তাঁদের রচিত হাজার পদ সুনির্দিষ্ট ভাবেই মানবতার ইতিহাস তৈরী করে গেছে| তাঁদের পথ বুঝতে গিয়ে মনের ভিতরে কতগুলো শব্দ সুরের মিশ্রনে কবে যে গানে রূপান্তরিত হয়েছে, সময়টা বলতে না পারলেও যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন এই ধারা অব্যাহত থাকবে তার পথেই –

‘ ঈশ্বর তোমার জাত কি বলো শুদ্র না ব্রাহ্মণ

আল্লাহ তোমার জাত কি বলো শুদ্র না ব্রাহ্মণ

না কি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ না খ্রিস্টান

বড়ো জানতে ইচ্ছে করে মন |[ix]

জাতিভেদ আর বর্ণভেদের আজব কলের ফান্দে

তোমার সৃষ্টি মানুষ কেনো বন্দি হয়ে কান্দে রে

স্রষ্টার না থাকলে রে জাত

সৃষ্টিতে কেন হয় এমন..

        …….. নাজমুল হক

—————————————-

তথ্যনির্দেশ

#ড. শক্তিনাথ ঝা

# ড. সুধীর চক্রবর্তী রচিত

“গান হতে গানে” এবং “বাউল ফকির কথা”

# প্রভাস সাহা

# শ্যামসখা

# রাজুদাস বাউল

# মনোরঞ্জন দাস বাউল

# কোহিনুর আক্তার গোলাপি

# আমার সংগৃহীত কিছু মহাজনী পদ


[i] https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2014/04/14/72647

[ii] https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2014/04/14/72647

[iii] https://www.jiosaavn.com/lyrics/manush-bhojle-sonar-manush-hobi-lyrics/KiYzdjdaAHs

[iv] https://www.lalongeeti.com/barirkache/

[v] https://www.lalongeeti.com/barirkache/

[vi] https://www.lalongeeti.com/barirkache/

[vii] https://www.youtube.com/watch?v=gZ0Sfga4qvs

[viii] https://www.lalongeeti.com/shottobol/

[ix] https://www.youtube.com/watch?v=gZ0Sfga4qvs