January 1, 2023

মহাজনী পদে মানবতা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

নাজমুল হক

” যে খুঁজে মানুষে খুদা

সেই তো বাউল

বস্তুতে ঈশ্বর খুঁজে

পাই তার উল

পূর্ব জন্ম না মানে

ধরা দেয় না অনুমানে

মানুষ ভজে বর্তমানে

হয় রে কবুল।

বেদ তুলসী মালা টেপা

এসব তারা বলে ধুঁকা

শয়তানে দিয়ে ধাপ্পা

করে ভুল

মানুষে সকল মেলে

দেখেশুনে বাউল বলে

দীন দুদ্দু কি বলে

লালন সাঁইজির কুল।‘[i]

                                                   ——দুদ্দু শাহ

‘চুয়াডাঙ্গার সাধক-শিল্পী লতিফ শাহর কণ্ঠে শোনা এই গানটির রচয়িতা হলেন বাংলাদেশের ঝিনাইদহ অঞ্চলের বাউল সাধক দুদ্দু শাহ। উপর্যুক্ত সংগীতের বাণীতে ‘বাউল মত’ তথা বাউলতত্ত্বের মূলকথাটা অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কেননা বাংলার বাউলদের মূল পরিচয়ের প্রধানতম একটি দিক হলো, তাঁরা মানুষেই স্রষ্টার সন্ধান করেন। দ্বিতীয় দিক হলো, তাঁরা প্রচলিত ধর্মগোষ্ঠীর লোকদের মতো অনুমানে বিশ্বাস করেন না, এমনকি পূর্বজন্ম বা জন্মান্তরবাদকে মানতে নারাজ; তৃতীয়ত বেদ তুলসী মালা টেপাকে তাঁরা ধোঁকার কাজ বলে গণ্য করেন। আসলে, প্রচলিত ধর্মীয় চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলার বাউল মত মূলত ‘মানুষে সকল মেলে’- এই তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে।‘[ii]

লালন সাঁইজির প্রথমদিকের ভাব শিষ্য দুদ্দু শাহ -র  এই গানের মধ্যেই অন্তর্নিহিত আছে  লিখিত এই বিষয়বস্তুর  একটি সামগ্রিক ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ| বাউল শব্দের ‘বা’ অক্ষরটি অতীন্দ্রিয়বাদের দত্তক। ‘উল’  শব্দের অর্থ হলো সন্ধান করা| লালন সাঁইজি এবং পরবর্তী সময়ে লালনোত্তর   মহাজনদের পদ বা সাধনা তত্ত্বে দেহতত্ত্ব, গুরুবাদী আধ্যাত্মবাদের বিষয়ের পাশাপাশি শুধু মাত্র মানুষকে মান্যতা বা প্রাধান্য দেওয়ার এক তত্ত্ব সুসংগত ভাবেই তাদের দর্শনে, ভাবনায়, পদে এক মানবতার জন্ম দিয়েছে | যুক্তিগ্রাহ্য, প্রমাণ সাপেক্ষ এক ভাবনা এবং নিরন্তর সাধনার পথে থেকে জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়হীন একমাত্র ‘মানুষ’ শব্দের প্রতি অন্তরের বিশ্বাস আর সাধনাগত নিগুঢ় উপলব্ধি বোধ এক মানবতার ইতিহাস রচনা করেছে |

  “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি”[iii]

                         ——–ফকির লালন সাঁই

বাংলার বাউল ফকিরি গান এর পরিসর কে যদি একটু বিশদ ভাবে বিশ্লেষণ করি  তাহলে এ সমস্ত গানের যারা স্রষ্টা  তাদের সমাজগত ভাবনাসহ সেই সময়ের ছবি, তার পটভূমি বা পশ্চাৎভূমি বিশ্লেষণের দরকার| যখন সামগ্রিকভাবে ভারতের সংস্কৃতি আর্য সংস্কৃতিতে পদদলিত হয়েছিল যখন দ্রাবিড় সভ্যতা বা অনার্য সভ্যতা কে সরিয়ে দিয়ে আর্যরা আধিপত্য লাভ করেছিল তখন কিন্তু বাংলা তথা বৃহত্তর বঙ্গভূমি এখানে পা মেলায়নি| সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র থেকে বাংলার প্রতিবাদী রূপ তখনও প্রতিষ্ঠিত ছিলো যার সন্ধান

ইতিহাস আমাদের দিয়েছে| উত্তরকালে একাদশ দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে বাংলার মানুষের জয়গানের সংস্কৃতি প্রসারিত হয়েছে| সম্প্রদায় বলতে শুধুমাত্র হিন্দু বা মুসলমান সম্প্রদায় নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ও যখন শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব এই সমস্ত ভাগে বিভক্ত থেকেছে  তখন একটি প্রতিবাদী স্বর শ্রীচৈতন্যদেবের নেতৃত্বে এই বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করেছে এবং পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে| অর্থাৎ পটভূমিটা ছিল সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে এক করে বেঁধে রাখা| আর সেই ধারাকে যুগ যুগ ধরে পরম্পরাগত ভাবে বয়ে নিয়ে চলেছে এই বাংলার বাউল ফকিরি সম্প্রদায়ের মহাজনী সাধকরা| আজকের এই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলার সাধু সাধকদের সাধনাগত দর্শনকে নতুন করে অনুসন্ধানের প্রয়োজন বলে মনে করছি|

” এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে

যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে “

          ——-ফকির লালন সাঁই

বাংলার বাউল বা ফকিরি সাধকরা কোন ধর্মগত জাতি বা সম্প্রদায়কেই মানতে চাননি| যদি তারা সম্প্রদায়কে মানতো তাহলে সমস্ত রকম সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে মানুষের জয়গান করতে পারত না| বরঞ্চ তারা  হিন্দুধর্মের যে বর্ণ বৈষম্য,  মুসলমান সম্প্রদায়ের শিয়া-সুন্নি-আহামদিয়ার ভাগ এক্ষেত্রেও মানুষে-মানুষে যে বিভাজন তারা মানেন নি| তার বাইরেও বিভাজনের আরো যে স্তর গরিব-ধনী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গুণী-অগুণী মানুষকে আমরা এভাবে দেখতে  অভ্যস্ত হলেও তারা এভাবে ভাবেন নি| তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন এবং মানুষের মাহাত্ম প্রচার করে গেছেন| মানবতাবাদী গানের ধারক বা প্রথম পুরুষ হিসেবে ফকির লালন সাঁইজি কে যদি ধরা হয় তাহলে লালনোত্তর সাময়ের মহজনী সাধকরা পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, কুবীর গোঁসাই, যাদু বিন্দু শরৎ গোঁসাই, আলাউদ্দিন সাঁই, জালালুদ্দিন সাঁই, হাসান রাজা, কালাচাঁদ দরবেশ, বিজয় সরকার, গুরুচাঁদ গোসাঁই, মাতাম চাঁদ গোসাঁই বাংলার অসংখ্য সাধকরা ভাবজগতের ভাবনাগত অবস্থানে থেকে অসংখ্য পদের সৃষ্টি করে এই ধারা বয়ে নিয়ে গেছে| যে গান চেতনার গান – মানবতার গান – উজ্জীবনের গান| ভাব সাগরে ডুবে থেকে মানুষের বিশ্লেষণে কোনোরকম মনগত দৈন্যতা কে প্রশ্রয় দেয়নি| বরঞ্চ মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার বোধ বা উপলব্ধি সমাজতন্ত্রের পথ কে প্রশস্ত করেছে যা সার্বিক ভাবে মানুষজাতির পক্ষে কল্যাণকর| ফকির লালন শুরুতেই তার পদে যে সুর বেঁধে দিয়েছেন পরবর্তী সময়ে তাঁর উত্তরসুরিরা সেই পথের অনুসন্ধানে অসংখ্য মানুষ ভজার পদ রচনা করে গেছেন |

“ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠ যার

 সর্বসাধন সিদ্ধ তার”

উচ্চবর্গের সম্প্রদায়ের মত এইসব দেহতত্ত্বের সাধকরা শাস্ত্র বা মন্ত্র না লিখে শুধু গান লিখেছেন| ভাব থেকে উঠে আসা মনের কথা গুলোই সুরের মিশ্রনে গানে রূপান্তরিত হয়েছে| আসলে তাঁদের কথাগুলোই হলো গান| জীব এবং জীবনের সাধনা করতে করতে মানব জীবনকে সকল জীবনের সেরা হিসেবে বর্ণিত করেছেন|

      ” কাশী কিংবা মক্কায় যাও রে মন

দেখতে পাবে মানুষের বদন ধ্যানধারণা ভজন পূজন মানুষ সর্ব ঠাঁই “

পৃথিবীর পাঠশালা থেকে যে জ্ঞান তারা আহরণ করেছিলেন পরবর্তী সময়ে সেই শিক্ষা বা জ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম|

লালন সাঁইজির বিখ্যাত গান

   ” সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে “

               বা

” জাত গেলো জাত গেলো বলে

  একি আজব কারখানা “

এই গানের পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে পাই “জাতের নামে বজ্জাতি সব” বা বিশ্বকবির  “আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে”। মানুষের জন্য এই সব মরমী বাণী যেন মহাজনী সাধকদের কথারই প্রতিধ্বনি|

লালন সাঁইজির শিষ্য দুদ্দু শাহের একটি পদ দিয়ে এই লেখাটা শুরু করেছিলাম| এই লেখার অন্য একটি পরিসর ধরার চেষ্টা করছি যেখানে এই গানের শেষ অন্তরাটি বলা প্রয়োজন| অন্তরাটি এমন –

      ” মানুষে সকল মেলে

     দেখে শুনে বাউল বলে

     দীন দুদ্দু কি বলে

    লালন সাইজির কুল “

মহাজনী পদ হল গুরুবাদী দর্শনের এক নিরন্তর ধারা| গুরু এবং শিষ্য| মুখোমুখি দুটি মানুষের ভাবের বিনিময়| একজন পথ দেখায় অন্যজন তা অনুসরণ করে| গুরু হচ্ছে পথপ্রদর্শক আর শিষ্য সেই পথে মুক্তির উপায় খুঁজে| সেই পথ সহজ হলে ও হোঁচট খাওয়ার ভয় থাকে|

 “সহজ পথে হোঁচট লাগে ওরে মন কানা

কানারে একলা নোস কানা |

তোর সাথে আছে দেখো আরো ছয় জনা

নিজের সরল না হইলে

সরলের পথ না যায় জানা ||

সরল হয়ে ধরাগা গুরুর পা’য়

হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দেবে সরলের উপায়

তখন অন্ধকারে দেখতে পাবি রাং কি সোনা

যাও যদি মন সহজ বাজারে

এই মানুষকে সঙ্গে লইয়ো শত হাজারে

যাদু বিন্দু বলে এবার

আমি গুরুর চরণ ছাড়বো না ||”

নিজেকে গুরুর কাছে সঠিকভাবে সঁপে দিতে পারলেই এই সহজ পথের সাধন সম্ভব| সহজ পথ ধরে উত্তরণের পথেই সৃষ্টি হয়েছে এই সমস্ত গান| যা কখনো দেহের বর্ণনা, কখনো বা মনের মানুষের খোঁজ, কখনো মনের মধ্যে মণি-মাণিক্যের সন্ধান| এ ভাবেই আউল-বাউল, ফকির, দরবেশি মহাজনরা নিজের মুক্তি লাভের উপায় খুঁজেছেন | সাধনমার্গ এর মধ্য দিয়ে মনকে সত্যের পথে ঠেলে দিয়েছে বারবার| ফকির দুদ্দু শাহ লালন সাঁইজির যে কুলের কথা বলেছেন সে কুল হলো মানুষ ভজার জগৎ|এই জগতে শুধু মানুষের জয়গান| সাদা-কালো, উঁচু-নিচু সব কিছুর উপেক্ষায় সাধকের সকল সাধনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হলো তাদের কাছে একমাত্র সত্য|

লালনোত্তর সময়ে যেসব মহাজনরা এসেছেন এই বাংলায়, যারা মানুষ তত্ত্বের দর্শনকে বেশি মাত্রায় প্রাধান্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, যাদু বিন্দু, বিজয় সরকার, গুরুচাঁদ গোসাই, কালাচাঁদ দরবেশ, আলাউদ্দিন সাঁই জালালুদ্দিন সাঁই সাধকরা অন্যতম| জালাল সাঁইজির একটা পদ সংগ্রহ করেছিলাম মানুষের সাধনে, বর্ণনায় আজও উজ্জ্বল| “মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরজন, মানুষ ধরো মানুষ পুজো শোন বলিরে পাগল মন” প্রত্যেক সাধকদের  পদ রচনায় ভাবনাগত বিষয়বস্তুর পার্থক্য থাকলেও গুরুদীক্ষা, ভাব বা সাধনাগত জায়গায় তারা এক| প্রত্যেকেই সাধক| গান সৃষ্টির মধ্য দিয়েই তাঁদের সাধনার পর্যায়গত অবস্থান নির্ণিত হয়|

“আঠারো মোকামের মাঝে

জ্বলছে এক রূপের বাতি

একি রে আজব কুদরতি “

কলকাতার লোকপ্রেমী মানুষরা সাধক কালচাঁদ দরবেশের গান এবং সাধনাগত যাপন সম্পর্কে অনেকটাই অবগত| সহজিয়া লোকগানের দলের পক্ষ থেকে গবেষক, বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী দেব চৌধুরী এই সাধক মানুষটির পাশে থেকে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন| কলকাতার রবীন্দ্রসদনে প্রতি বছর তার গান শুনতে হাজার হাজার নাগরিক শ্রোতা উপস্থিত থেকেছেন| বর্তমানে তিনি প্রয়াত| কালাচাঁদ দরবেশের একটি বিখ্যাত উক্তি ” নিরাকারে নয়রে সাধন ” আমরা আকার অর্থাৎ স্বরূপের সাধন করি| “স্বরূপে হয় রূপ দরশন”। কিন্তু পৌঁছাতে হয় নিরাকায় জায়গায়| সম্প্রদায়গত ধর্ম মান্যতার  একটা সহজ সরলীকরণ – ইসলামে আল্লার কোনো আকার নেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা একটা মূর্তিকে সামনে রেখে পূজা-পাঠ করে| কিন্তু এখানে কালাচাঁদ দরবেশ তার দর্শন ভাবনায়, তিনি একবার বলছেন নিরাকারে নয়রে সাধন আবার আকারে সাধন করলেই নিরাকের পৌঁছানো যাবে অর্থাৎ সাধনার পথ যাই হোক নিজের মধ্যে যে চেতনা সেই চেতনাকে উঁকি মেরে দেখতে হবে| নিজেকে জানার মধ্যেই সেই মুক্তি| কালচাঁদ দরবেশের একটি দরবশি গান –

“খ্যাপারে সিন্ধু পরের বন্ধু যে জন

তোরে পার করিবে দরিয়ায়

জানি না সে বন্ধুর বাড়ি আছে কুন জাগায়

মুর্শীদপুরে লুকিয়ে থাকে রসূলপুরে খেলা খেলায়”

এক পন্থীর ‘মুর্শীদ’ অন্য পন্থীর ‘রসূল’ মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্ম পালনে দুটি ধারাকে ‘এক’ করে দেখার এই উপলব্ধিগত চেষ্টা আমাদের বিস্মিত করে| আবার এই দরবেশি ভাবনাকে যুগ যুগ ধরে সমর্থন জুগিয়ে এসেছে লোকায়ত আর একটি ধারা — গাজীর গান

” মুসলমানে বলে গো আল্লা হিন্দু বলে হরি

নিদানকালে যাবেরে ভাই একই পথে পড়িরে

দয়ানি করিবা আল্লারে “

 তাঁদের মূল কথা মানুষকে মান্যতা দেওয়ায় হলো ধর্ম| যে ধর্ম হলো মানবতার ধর্ম| বাংলার সাধক কবি বিজয় সরকারের একটি বিখ্যাত পদ সাধকদের দর্শনকে বুঝতে আমাদের ভাবনার সহায়ক হতে পারে –

“জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি

আমরা বহু নামে ধরা ধামে কতো রকমে ডাকিতেছি

কেউ তোমায় বলে ভগবান

গড বলে কেউ করছে আহ্বান

কেহ খুদা কেউ জিহুদা

কেউ কয় পাপীয়ান…….”

এ প্রসঙ্গে নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি| তখন আমি লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক ড. সুধীর চক্রবর্তীর অধীনে সহ-গবেষক হয়ে বাংলার বাউল ফকিরি গানের সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত আছি|  মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়ার জেলার এই মহাজনী পদ জানা বাউল, ফকিরি শিল্পীদের কাছ থেকে এই পদ সংগ্রহ করা ছিল মূলত আমার কাজ| একদিন মুর্শিদাবাদের এক বিশিষ্ট ফকিরি গানের শিল্পী লালু ফকির আমাকে একটা গান শোনাচ্ছেন আর আমি আমার রেকর্ডারে তা বন্দি করছি–

‘ মানুষ থুয়ে খোদা ভজ এই মন্ত্রনা কে দিয়েছে….. ” মনের মধ্যে একটা ধন্দ বা সংশয় থেকে দ্বন্দ্ব শুরু হলো| একজন শরীয়তপন্থী মানুষ হয়ে তাঁদের এই কথা বলার স্পর্ধা নিয়ে মনে মনে ভাবছি আর সর্বশক্তিমান আল্লাহকে মানা নিয়ে এই প্রশ্নবোধক গান কিছুতেই মানতে পারছি না| অল্পবয়সী আমি সবেমাত্র রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে এম. এ সম্পূর্ণ করেছি| 

আসলে তখন আমি এই সব পদের আভ্যান্তরীণ বিষয় মানে কিছুই বুঝি না শুধু গানের বাহ্যিকতা বুঝি| পরবর্তী সময়ে বাউল ফকির সাধকদের সাধনতত্ব, তাঁদের ধর্মাচরণ, রূপকধর্মী গানের অর্থ অনুভব করা, তাঁদের যাপন, গোপন সাধনপথের সন্ধানে বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক ড. সুধীর চক্রবর্তী, ড. শক্তিনাথ ঝা, প্রভাস সাহা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের গবেষণালব্ধ গ্রন্থ আর ব্যক্তিগত জীবনে কিছু বাউল এবং ফকিরি গানের সাধক এবং শিল্পীদের সানিধ্যে থেকে মনে হয়েছে আল্লা খোদা বা ঈশ্বর মানতে তাঁদের কোনো বিরোধ নেই| তাঁদের সন্ধানের পথ আলাদা হতে পারে বরঞ্চ তারা আল্লা বা ঈশ্বরের খোঁজে গভীর নির্জন পথ ধরে অনাড়ম্বর এই একটা সাধনাতেই নিমগ্ন থেকেছেন বহু সময় ধরে| তাঁদের সাধনগত উপলব্ধি হলো মানুষের অস্তিত্বকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লা বা ঈশ্বর নয়| নিজের ধর্মাচরনে মানুষকে খাটো বা ছোট করে দেখা নয়| তাই যদি হতো লালন সাঁইজি বার বার মনকে বলতো না,

” আল্লা বলো মনরে পাখি একবার

মৌলা বলো মনরে পাখি “

এই রকম আল্লার প্রতি সমর্পন করার অনেক পদ তিনি রচনা করেছেন |

‘ আল্লার বান্দা কিসে হয় বলো গো আমায়

খোদার বান্দা নবীর উম্মত কী করিলে হওয়া যায়’

আল্লার করুনা পেতে হলে ‘আপনাকে’ জানতে বা চিনতে হবে | আত্ম অনুসন্ধান | পাঞ্জু সাঁইজির একটি গানে সেই কথার সারমর্ম মেলে –

‘ কয়েকজন মানুষ চিনি মহাজনের কৃপায়

মানুষ মানুষ বিরাজে চেনা হলো বিষম দায়

আল্লার নামে মেনে সিন্নি যাচ্ছেরে মসজিদ ঘরে

সেই সিন্নি আল্লাতে না খায় মানুষ খায়রে পেট পুরে… “

সহজ পথের সহজ কথা | সবধরণের মানুষকে মানতে হবে |

ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব মানুষকে মান্যতা দিয়েই তাঁদের সাধনা আর এখানেই এক ‘পন্থাগত’ বিরোধ আমাদের সামনে আসে| আসলে মানুষের সন্ধান, সমর্থন আর পক্ষে তাঁদের পদ রচিত হয়েছে, বিভাজনে নয়|  তার জন্য তারা দেহের সাধনা করে দেহকে কব্জা করার কাজে মগ্ন থেকেছেন | দেহকেন্দ্রিক কাম সাধনা থেকে নিষ্কাম সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে আধাত্মিক জীবন লাভের চেষ্টায় থেকেছেন| দেহের মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ… সাধনার মধ্যে দিয়ে ষড় রিপুর সংযমে তারা ভাবের মানুষে পরিণত হয়ে সমস্ত রকম জাগতিক বিষয় থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে মানুষ ভজার জগতে নিমগ্ন থেকেছেন| যেটা হলো তাঁদের আত্মমগ্নতায় চেতনার জগৎ| সাধক ভবা পাগলার একটি বিখ্যাত গান,

‘ভাব সাগরে ভাবের মানুষ বসে আছে ভাব ধরে

খুঁজতে গেলে কে বা মিলে আওয়াজ বুঝে লও ধরে…..’

আসলে কয়েকজন বাউল বা ফকিরি বেশধারী শিল্পীর মঞ্চে কয়েকটি গান শুনে এই সব মহাজনী সাধকদের আধ্যাত্মিক চেতনার জায়গাটি উপলব্ধি করা খুব সহজ বিষয় নয়| তাঁদের সৃষ্টি বা রচিত পদকে শুধু গান হিসেবে দেখলে হবে না আমি মনে করি তাঁদের এই পদ নিজেকে শৃঙ্খলিত সংযমী রাখার এক যুক্তিগ্রাহ্য উপদেশও| ফকির লালন সাঁই থেকে পরবর্তী সময়ে মহাজনী সাধকরা তাঁদের অসংখ্য পদ রচনার মধ্য দিয়ে মানবদর্শনকে যে ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন তা আমার এই সীমিত লেখাতে সম্পূর্ণ আলোচনা বা ব্যাখ্যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়| এই সব মানুষদের মূল পরিচয়ই হলো তাঁদের গান| লালন সাঁইজি ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতায় সমাজ-সংসার, শাস্ত্র-আচার ও জাত-ধর্ম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ ছিলেন বলেই পরবর্তী সময়ে তার সাধন জীবনে জাত-পাত-বর্ণহীন মানুষের জয়গানে নিমগ্ন থেকেছেন|

“জগৎ- কর্তা পতিত পাবন

এই মানুষে করে বিরজন

তিন রতিতে খেলছে মানুষ

তিন রসের সম্মিলনে”

মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের অন্বেষণ বা খোঁজ| দেহ ঘরেই হচ্ছে ঈশ্বরের ঘর| একের মধ্যে দুয়ের যাতায়াত| সাধকরা মনে করেন সমস্ত রকম জীব এমন কি জড়ের মধ্যেও ঈশ্বর আছে| এই দেহ ঘরের যত্নসাধনে মগ্ন হয়ে মনের যে উত্তরণ ঘটবে সেখানেই দেখা মিলবে পরমাত্মার| পরমাত্মা হলো আমার ভেতরের মানুষটি যে আমাকে বলে আমি তার কথা শুনি, অন্য কেও শুনতে পাই না| তাকে খোঁজা বা শোনার পথই হলো সাধনার পথ| গুরুই সেই পথের সন্ধান দেবে|

‘ ঘরের কেবা ঘুমায় কেবা জাগে

কে কারে দেখায় স্বপন

এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন ।।

শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়

নিঃশব্দে কে আছে সদাই

যেদিন হবে মহাপ্রলয়

কে কারে করবে দমন ।।

দেহের গুরু আছে কেবা

ভক্ত হয়ে কে দেয় সেবা

যেদিন তাহা জানতে পারবা

কূলের ঘোর যাবে তখন ।।

যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে

কোনখানে সে বসে আছে

সিরাজ সাঁই কয় তাই না খুঁজে

দিন তো বয়ে যায় লালন ।।

— লালন ফকির

আমরা আল্লা কে মানতে গিয়ে বলি সর্বশক্তিমান আল্লা আমাদের সৃষ্টি করেছেন কেউ বলেন ঈশ্বর আবার কেউ মনে করেন যীশু| এই সাধকদের মতে স্রষ্টা যেই হোক না কেনো তার সৃষ্টি জাতি বা মানুষকে যদি সেবা করতে না পারি যদি নিজের সম্প্রদায়গত ধর্মীয় অবস্থান থেকে অন্য সম্প্রদায়গত মানুষকে ‘ছোট ‘ করে দেখি তাহলে এতো ‘নামাজ রোজা পূজা পার্বন কেন ‘? কোনো শাস্ত্র জ্ঞান নয় অন্তরের জ্ঞান আরোহনে স্রষ্টা ও সৃষ্টির সংজ্ঞা নির্ণয়ে তাঁদের অবস্থানকে বোঝাতে চেয়েছেন তাঁদের সৃষ্টপদের মাধ্যমে| সব সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টা আছেন | তাঁকে খুঁজতে হবে এবং খুঁজে পেলেই মুক্তি| লালন সাঁইজির অনেক গানই সেই ভাবনার সন্ধান মেলে|

 ” বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা পড়শী বসত করে

আমি একদিন না দেখিলাম তারে “[iv]

রূপকধর্মী গানের আভ্যন্তরীণ অর্থটাই হল আসল| যে কথা আগেই বলেছি আমার দেহ ঘরে সে বিরাজ করছে অথচ তাকে দেখতে পাচ্ছি না| যার জন্যই সাধনা| যার জন্যই সাধক|

লালন সাঁইজির আর একটি বিখ্যাত পদ,

” কে কথা কয় রে দেখা দেয় না

নড়ে চড়ে হাতের কাছে

খুঁজলে জনমভর মেলে না ।।

খুঁজি তারে আসমান জমি

আমারে চিনি না আমি,

এ বিষম ভোলে ভ্রমি

আমি কোন্‌ জন, সে কোন্‌ জনা ।।

হাতের কাছে হয় না খবর

কি দেখতে যাও দিল্লি লাহোর

সিরাজ সাঁই কয়, লালন রে তোর

সদাই মনের ভ্রম গেল না ।।[v]

কি অসাধারণ আত্মচেতনার অভিব্যক্তি এই গানে| ‘আমি কোন জন সে কোন জনা ‘ ।

সৃষ্টি এবং স্রষ্টাকে অনুভব করতে সাধনপথের কতোটা গভীরে পৌছাতে  হয় এই গানে তার দৃষ্টান্ত মেলে –

‘ আমার আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি

দিবানিশি নাই সেখানে

মনের মানুষ যেখানে।[vi]

   ….ফকির লালন সাঁই

একজন দরবেশি ফকির একটা নির্জন অথচ কিছুটা প্রসস্থ পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে| দুদিকে বনারণ্য| বয়সের ভরে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে| হাতে একটা প্রাচীন লাঠি| অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে তার আভ্যান্তরীণ  সত্ত্বা এবং বাহ্যিক সত্ত্বা যেন একাকার হয়ে আছে| দুধারে প্রকৃতির শোভা, আলো, বাতাসের মধ্যে নিরন্তর ভাবে কিসের যেনো সন্ধান করে চলেছেন| দূর থেকে ভেসে আসছে একতারাতে লালন সাঁইজির একটি গান –

” আপ্ততত্ব না জানিলে ভজন হবে না পড়বি গোলে [vii]

দূরে দেখা যাচ্ছে একটা আখড়া বা আশ্রম গোছের আস্তানা| সে দিকেই এগিয়ে যায় দরবেশি ফকির| আরও এগিয়ে গেলে আস্তানাটি কাছাকাছি এসে পড়ে| ভেতর থেকে কে যেনো গাইছে,

” সত্য বল সুপথে চল

ওরে আমার মন

সত্য পথ না চিনিলে পাবিনা

মানুষের দরশন ‘[viii]

ধর্মীয় সংকীর্ণতা বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে এই মহাজনী সাধকদদের এই দর্শন বোঝা সম্ভব নয়| বৌদ্ধ সহজিয়া মত, ইসলামী সুফিবাদ এবং বৈষ্ণব সহজিয়া দর্শনের  সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই মতাদর্শকে বুঝতে হলে আমাদের সহজ হতে হবে| বুঝতে হবে যখনই জাত পাতের বিরোধ বেঁধেছে সমাজে তখন তারাই সমাজ সুধারকের ভূমিকায় থেকে সেই বিরোধ সামলানোর চেষ্টা করেছেন| নিজেদের এই পথকে স্বতন্ত্র রেখেছেন| এই সাধকদের মতবাদ বা বক্তব্য কে কোনো বিশেষ ‘ পন্থা ‘ হিসেবে আমি দেখি না| আমি মনে করি মানুষকে ভালোবেসে তাঁদের রচিত হাজার পদ সুনির্দিষ্ট ভাবেই মানবতার ইতিহাস তৈরী করে গেছে| তাঁদের পথ বুঝতে গিয়ে মনের ভিতরে কতগুলো শব্দ সুরের মিশ্রনে কবে যে গানে রূপান্তরিত হয়েছে, সময়টা বলতে না পারলেও যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন এই ধারা অব্যাহত থাকবে তার পথেই –

‘ ঈশ্বর তোমার জাত কি বলো শুদ্র না ব্রাহ্মণ

আল্লাহ তোমার জাত কি বলো শুদ্র না ব্রাহ্মণ

না কি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ না খ্রিস্টান

বড়ো জানতে ইচ্ছে করে মন |[ix]

জাতিভেদ আর বর্ণভেদের আজব কলের ফান্দে

তোমার সৃষ্টি মানুষ কেনো বন্দি হয়ে কান্দে রে

স্রষ্টার না থাকলে রে জাত

সৃষ্টিতে কেন হয় এমন..

        …….. নাজমুল হক

—————————————-

তথ্যনির্দেশ

#ড. শক্তিনাথ ঝা

# ড. সুধীর চক্রবর্তী রচিত

“গান হতে গানে” এবং “বাউল ফকির কথা”

# প্রভাস সাহা

# শ্যামসখা

# রাজুদাস বাউল

# মনোরঞ্জন দাস বাউল

# কোহিনুর আক্তার গোলাপি

# আমার সংগৃহীত কিছু মহাজনী পদ


[i] https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2014/04/14/72647

[ii] https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2014/04/14/72647

[iii] https://www.jiosaavn.com/lyrics/manush-bhojle-sonar-manush-hobi-lyrics/KiYzdjdaAHs

[iv] https://www.lalongeeti.com/barirkache/

[v] https://www.lalongeeti.com/barirkache/

[vi] https://www.lalongeeti.com/barirkache/

[vii] https://www.youtube.com/watch?v=gZ0Sfga4qvs

[viii] https://www.lalongeeti.com/shottobol/

[ix] https://www.youtube.com/watch?v=gZ0Sfga4qvs