পটুয়া নারী : পটচিত্র ও গান
ড. জয়ন্তী মন্ডল, অতিথি অধ্যাপিকা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দ থেকে পট কথাটি এসেছে। ‘পট্ট’ শব্দের অর্থ কাপড়। পটচিত্র হচ্ছে একখণ্ড কাপড়ের উপর হিন্দু দেবদেবী কিংবা মুসলিম পীর-ফকিরদের বিচিত্র কাহিনী-সম্বলিত চিত্র। এই পটচিত্রের শিল্পীদেরই বলা হয় পটুয়া। পটুয়ারা সঙ্গীত সহযোগে পটচিত্র দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। তারা গানের সুরে দর্শক ও শ্রোতাদের পটচিত্রের আখ্যানভাগ বুঝিযে় দেয়। কাপড়ের উপর পট আঁকার রীতি ছিল প্রাচীন কালেও। তা থেকেই সাধারণভাবে কাপড়ে বা অন্য স্থানে আঁকা সব ছবিকেই পট বলার রীতি প্রচলিত হয়। যারা ছবি আঁকত তাদের বলা হত পটুয়া। এভাবেই পট ও পটুয়া কথার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে বাংলার মানুষ। প্রাচীন বাংলায় যখন কোন দরবারি শিল্পের ধারা গড়ে ওঠেনি তখন পটচিত্রই ছিল বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক। আর এ চিত্র যারা অঙ্কন করতেন বা এখনও পট রচনা করছেন তাঁদের বলা হয় পটুয়া।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পটের প্রচলন রয়েছে। বাংলার পটের সঙ্গে দক্ষিন ভারতের পটের চিত্রগত মিল পাওয়া যায়। ভারতের চিত্রকলা গ্রন্থেরব লেখক অলোক মিত্র লিখেছেন দাক্ষিনাত্য আর পশ্চিম বাংলার পশ্চিম দিকের জেলাগুলির সঙ্গে যে ঘনিষ্ট আদান প্রদান হত তা বোঝা যায় তিরুপতি তিরুনল মন্দিরের ছাদের চিত্র আর বাংলার জড়ানো পটের অদ্ভূত মিলে।’ দেওয়ালে ছবি আঁকার রীতি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই চলে আসছে। গুহার দেওয়ালে, বড় পাথরে খোদাই করে বাড়ির ভিতর ও বাইরের দেওয়ালে রঙ করে ছবি আঁকার রীতি বহুকাল ধরেই চলে আসছে। ছবির সঙ্গে কাহিনীর সম্পর্ক নিবিড়। যেকোন ছবিই কিছু বক্তব্য বহন করে থাকে। প্রকৃতির নানা বৈচিত্র ও জীব জগতের জীবন যাত্রার সঙ্গে মানুষের পরিচয়ের পাশাপাশি উন্নত মানুষ এই সবকে নানাভাবে ব্যখ্যা করেছে। এর মধ্য থেকেই তৈরি হয়েছে চরিত্র চিত্রন বা ভাবনা। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে তার প্রথম দিককার প্রকাশ ঘটত। যখন ভাষা আবিষ্কার হয়নি এক একটি ছবি বহু কথা বহন করত। বিপদ, আশঙ্কার অনুমান করতে পারত এইসব ছবি দেখে। পরবর্তীকালে ছবির সঙ্গে নিজেদের বিশ্বাস ও কল্পনা যুক্ত হয়েছে। রচিত হয়েছে লোককাহিনী।
পট ও পটুয়াদের ইতিহাস : সপ্তম ও অষ্টম শতক
সপ্তম শতাব্দীতে রচিত বানভট্টের হর্ষচরিতে যমপট ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ রয়েছে। গুরুসদয় দত্ত এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘রাজা প্রভাকর বর্ধনের পীড়ার কথা শুনিয়া হর্ষবর্ধন শিকার হইতে ফিরিয়া রাজধানীতে প্রবেশ করিয়াছেন। হর্ষবর্ধন নগরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন দোকানের পথে অনেকগুলি কৌতুহলী বালকদ্বারা পরিবৃত একজন যমপট্টিক বা যমপট ব্যবসায়ী পট দেখাইতেছেন। লম্বা লাঠিতে ঝুলানো পট বাঁ হাতে ধরিয়াছে, ডান হাতে একটা শর কাঠি দিয়া চিত্র দেখাইতেছে। ভীষণ মহিষারূঢ় প্রেতনাথ প্রধান মূর্তি। আরো অনেক মূর্তি আছে। যমপট্টিক গাহিতেছে-
‘মাতাপিতৃ সহস্রানি পুত্র দার শতানি চ
যুগে যুগে ব্যতিতানি কস্যতে কস্যবা ভবান’।।
কাপড়ের উপর আঁকা ছবির নানা বিবরণ পাওয়া যায় কিন্তু পট দেখিয়ে গান গাওয়ার ঘটনা সম্ভবত বাণভট্টই প্রথম উল্লেখ করেছেন। গুরুসদয় দত্তর লেখা থেকে জানা যায় বিশাখা দত্তের মুদ্রা রাক্ষস নাটকেও যম পটের উল্লেখ রয়েছে। মুদ্রা রাক্ষস রচিত হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে।
‘[নানা স্থান হইতে গুপ্ত তথ্য সংগ্রহ করিয়া পাটলিপুত্রে ফিরিয়া চানক্যের গৃহে প্রবেশ মুখে]
চর- পণমহ জমসস চলনে কিং কজ্জং দেব এহিং অন্নেহিং।
এসো কখু অন্নভর্তাণং হরই জীয়ং চডপডন্তং।।
অপিচ পুরিসসস জীবিদব্বং বিদমাদো হোই ভত্তিগহিয়াদো।
মাবেই সব্বলোঅং জোতেণ জমেণ জীয়ামো।।
জাব, এদং গেহং পবিসিঅ গী আইংগাআমি।’
সপ্তম শতাব্দী বা তার আগে বহুকাল ধরে বাংলায় পটচিত্র বা গীত সহযোগে বিভিন্ন কাহিনী পরিবেশন রীতি চলে আসছে বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। যমপটের মধ্যদিয়ে যমের ভয়াবহ রূপ এবং মানুষের ইহলোকে কৃত কর্মাদির জন্য যমলোকের বিচার ও দণ্ড নির্দিষ্ট হবে এই রকমই নানা ধরণের ছবি উপস্থাপন করা হত। গানের মধ্যদিয়ে সে কাহিনী বর্ণনা করা হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। যমের কাহিনী আমরা সপ্তম শতকে পেয়েছি আবার বানভট্টের হর্ষচরিতেও দেখতে পেয়েছি অষ্টম শতকে। বর্তমান কালে আমরা যেসব পট দেখি সেখানেও যম পটের কাহিনী বর্ণনা করা হয় বিবিধ পটে। এছাড়া প্রায় সব পটের শেষে যমলোকের দৃশ্যের ছবি দেখানো হয়। এসম্পর্কে সমস্ত লোকসংস্কৃতি গবেষক এক মত যে যমপট ব্যবসায়ীরা দীর্ঘকাল ধরে বংশানুক্রমে এইধরনের পট দেখাতে দেখাতে তাদের নিজেদের বৃত্তির মধ্যেই এই সংস্কার যুক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে পরবর্তীকালে জীবিকার জন্য নানা ধরণের পট আঁকা ও গান রচনা করা হলেও পটের শেষ দৃশ্যে মানুষের চরম পরিণতিতে যমলোকে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কথা তারা নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করে থাকে। যদিও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব পট সামাজিক সংস্কারের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বা হয়ে চলেছে সেই সব পটে যমলোকের দৃশ্য দেখাযায় না। গুরুসদয় দত্ত লিখেছেন-‘যমালয়ে পাপী যে নিদারুণ শাস্তি ভোগ করে চক্ষের সম্মুখে তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া মানুষকে পাপ ও অন্যায় হইতে বিরত করিবার উদ্দেশ্যে এই পটগুলি গীত সহযোগে প্রদর্শিত হইত। বাংলার পটুয়ারা অদ্যাপি এইরূপ যমপট দেখিয়া থাকে। এমনকি তাহাদের দেখাইবার প্রণালীও হর্ষচরিতে উল্লিখিত প্রণালীর অনুরূপ। ….. হর্ষচরিতের আমলে পটের সঙ্গে গান গাহিবার রীতি ছিল এখনো আছে। এখন রাম অবতার, কৃষ্ণ লীলা প্রভৃতি পটের শেষভাগে যমপটের স্থান; কাজেই মূল পালার শেষ অংশেই যমপটের গান থাকে।’
বাংলার পট ও পটের গানে ইসলামী প্রভাব
অষ্টম-নবম শতাব্দীতে বাংলায় ইসলামী প্রভাব পড়তে থাকে। সে সময় থেকেই বাংলায় সূফি মতাবলম্বীরা আরব পারস্য থেকে ভারতে আসতে থাকে। ভারতীয়রা সূফী মতের সঙ্গে ও ইসলাম ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে সে সময় থেকেই। ভারতে ধর্মীয় ক্ষেত্রে নতুন মতবাদ প্রচার ও প্রসারের ফলে বাংলার সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। দেশীয় সংস্কৃতিতেও তার প্রভাব পড়ে। পটচিত্রকলায়ও মসলিম ধরমের প্রভাব পড়ে। ‘ইসলামী প্রভাবে এখানকার পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে ইসলামী আখ্যান যুক্ত হয়। পাল্টে যায় দেব-দেবীর বেশভূষা চালচিত্র। তারা এক একজন বিভিন্ন নতুন আসনে অভিষিক্ত হতে থাকেন। যেমন, বন দুর্গা হয়ে ওঠেন বনবিবি, শীতলা লাভ করেন বনবিবির রূপ, দক্ষিণ রায়ে স্থলে অভিষিক্ত হন গাজী কালু, সত্যনারায়ণের স্খলে সত্যপীর ইত্যাদি। এ কারণে এই সকল পীর ফকিরসহ ইসলামী দেব-দেবী বাঙালি জীবনের নতুন অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এই অনুষঙ্গ নির্ভরতায় পটচিত্রের আখ্যান আর চরিত্রে রদবদল ঘটে। তাই কালিয়া দমন আর গোষ্ঠ লীলার পাশাপাশি দেখা যায় গাজীর পট। যা সুস্পষ্ট রূপে বাঙালি জীবনে ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণের পরিচয় বহন করে।
বাংলায় বৈষ্ণবীয় ধারায় পটচিত্র অঙ্কন করার রীতিও যথেষ্ট। নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণ থেকে শুরু করে নগর কীর্তনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে পট আঁকা হয়েছে । এই সকল পটচিত্র আবার কাহিনী আকারে মানুষের মধ্যে পরিবেশিত হওয়ার কথাও জানা যায়। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের পরবর্তীতে বৈষ্ণবীয় ধারার পটের প্রসার ঘটে বেশি। নগর কীর্তনের মতো পটের গানও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারে যথেষ্ট প্রভাব রাখে।’
পনের শতকে পট চিত্রের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। এই সময় পৌরাণিক কাহিনী গুলোকে সংস্কৃত থেকে বাংলায় বর্ণনা করার রীতি শুরু হয়। এই সময় পটুয়ারা পট রচনা করে সেগুলো বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে দেখাতেন। জাতকের গল্পে পটুয়াদের পরিচয় লিপিবদ্ধ হতে দেখে পট ও পটের গানের সূচনা আরো আগে বলে মনে করা যেতে পারে। বুদ্ধদেবের জন্ম কাহিনী ও তাঁর পূর্বজন্মের নানা কাহিনী পট ও পটের গানে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। ধর্ম প্রচারের জন্য গায়কেরা সাধারণের এই সব গান গাইতেন। এই গায়ক দলের মধ্যে ‘মস্করী’ নামে একটি ভিক্ষু শ্রেণি ছিল যাদের উদ্দেশ্যেই ছিল পট চিত্রের মাধ্যমে বুদ্ধের বাণী প্রচার করা। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্যের সঙ্গে পটচিত্রের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা যেতে পারে। শোনাযায় বুদ্ধদেব নিজে পটচিত্রের প্রশংসা করতেন। ‘আর্যমঞ্জশ্রীকল্প’ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে পটচিত্র অঙ্কন শিক্ষার রীতি বর্ণিত হয়েছে।
প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন স্থানে পট ও পটের গানের প্রচলন
কাপড়ের উপর পট আঁকার রীতি বাংলায় ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে হয়ে থাকে তবে কাঠিতে জড়ানো পটের ছবি দেখিয়ে পুরো একটি কাহিনী বা আখ্যানকে গান গেয়ে দেখানোর রীতি বাংলাতেই প্রচলিত রয়েছে। শুধু মাত্র ছবি আঁকা ছোট ছোট পট গুলিকে
চৌকা পট বলা হয় আর জড়ানো পটগুলি দীর্ঘ বলে এগুলিকে দীঘল পট বলা হয়ে থাকে। দীঘল পটের ছবিগুলি চলমান নয়। অনেকগুলি চিত্রের ও দৃশ্যের অবতারণা করা হয়ে থাকে দীঘল পটে। তবে প্রতিটি দৃশ্যের সম্পূর্ণ রূপ গানের মধ্যদিয়ে উপস্থাপন করা হয়। তবে পট ও গানগুলির কোনটিই এককভাবে পরিপূর্ণ নয়। গুরুসদয় দত্ত লিখেছেন-‘পটগুলি পটগীতির হুবহু প্রতিকৃতি মূলকভাবে রচিত হয় নাই; আবার পতগীতিগুলিও পটচিত্রের হুবহু বর্ণনাত্মক নহে। বস্তুতঃ ইহারা একে অন্যের পরিপোষক। চিত্রে যাহা রূপায়িত হইয়াছে, শিল্পীগণ গীতিকায় তাহার বর্ণনা না করিয়া তাহার অন্তর্নিহিত ভাব ও রসে অভিব্যঞ্জনা করিয়াছে এবং এক চিত্র হইতে অপর চিত্রের বিষয় বস্তুতে উপনীত হইবার পথে মধ্যবর্তী ভাব ও ঘটনার রসাত্মক বর্ণনা করিয়াছে। গীতিকায় যাহা উহ্য, তাহার অভিব্যঞ্জনা দেওয়া হইয়াছে চিত্রে; আবার চিত্রে যাহা উহ্য, তাহার অভিব্যঞ্জনা দেওয়া হইয়াছে গীতিকায়।’ অবিভক্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বহুলভাবে পটচিত্র ও পটগীতির প্রচলন ছিল। পরে দেশ ভাগের সময় এখানকার পটুয়ারা অনেকেই বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। এ সম্পর্কে বাংলাপেডিয়া ডট কমে লিখেছে- ‘বাংলাদেশের যশোর ও খুলনা অঞ্চলে পটুয়াদের ‘গাইন’ নামে অভিহিত করা হয়। বেশ কিছুবছর আগেও ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং দিনাজপুর অঞ্চলে পটুয়ারা বসবাস করত। দেশবিভাগের পর অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়। যারা থেকে যায় তাদের পেশায়ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভাটা পডে়। বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ, খুলনা, যশোর ও জামালপুর অঞ্চলে কদাচিৎ দুএকজন পটুয়া বা গাইন শ্রেণীর শিল্পীর সাক্ষাৎ মেলে। পটুয়ারা বিভিন্ন মেলা, ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান এবং গ্রামে-গঞ্জে পটচিত্র বিক্রয় করে। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন দেবদেবীর পট পূজা-অর্চনার জন্য সংরক্ষণ করে। পটুয়াদের একটি বড় অংশ বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের বিবাহাদি সামাজিক অনুষ্ঠান হিন্দু-মুসলমান রীতি অনুসারে হলেও মুসলমান বিবাহিত রমণীরা শাঁখা-সিঁদুর পরে।’ (আনোয়ারুল করীম)
পট ও পটের গানের মধ্যেকার সম্পর্ক
পটুয়াদের গানগুলির বা চিত্রগুলির পৃথক পৃথকভাবে আলোচনার কোন অবকাশ এখানে নেই। কেননা এগুলি পরষ্পরের মধ্যেকার যে ঘাটতি বা সেতু তা চিত্র ও গীতি পরস্পরেই রচিত হয়। পটুয়াদের কারও কারও তুলির টানে সৌন্দর্য নতুনভাবে ফুটে ওঠে বা শৈল্পিক প্রেরণা লক্ষ্য করাযায় ঠিকই তবে পটুয়ারা চিত্র শিল্পকে পৃথকভাবে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করার জন্য রচনা করেনা। অন্যদিকে কিছু শিল্পীর কণ্ঠে সুরের যাদুর পরশ থাকলেও কাহিনীর চিত্রথেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই গান পরিবেশনের জন্য রচিত হয়না। ফলে একটি পটের একটি দৃশ্যের সঙ্গে পরবর্তী পটগুলি যেমন সম্পর্কিত তেমনি গানের ক্ষেত্রেও একটি গানের কলি পরের কলির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে।
পটের রূপ ও রঙ
পট প্রধানত দু প্রকার দীর্ঘ জড়ানো পট ও ক্ষুদ্রাকার চৌকা পট। জড়ানো পট ১৫-৩০ ফুট লম্বা ও ২-৩ ফুট চওড়া হয়। আর চৌকা পট হয় ছোট আকারের। কাপড়ের উপর কাদা, গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে প্রথমে জমিন তৈরি করা হয়। তারপর সেই জমিনে পটুয়ারা তুলি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কন করেন। পটে নানা ধরনের দেশজ রং ব্যবহৃত হয়। গাছের পাতার রস, ফুলের রস, গাছের আঠা, ইঁটের গুঁড়ো, ভুসো কালি, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদিও রঙের কাজে ব্যবহার করা হয়। পটটিকে সাধারণত কয়েকটি অংশে ভাগ করে তার উপর লাল, নীল, হলুদ, গোলাপি, বাদামি, সাদা ও কালো রং লাগিয়ে ছবি আঁকা হয়। তুলি হিসেবে ব্যবহূত হয় কঞ্চির ডগায় পশুর লেজের চুল, লোম বা পাখির পালক।
ছবি ও কাহিনীর মধ্যে যেমন সম্পর্ক থাকেই তেমনি প্রতিটি পর্যায়কে সুন্দর ভাবে সহজ সরল ভাষায় ও পারম্পর্য বজায় রেখে প্রিবেশন করার মধ্যেও যথেষ্ট সৌন্দর্য লক্ষ্য করা যায়। ‘কোন কষ্ট কল্পিত বা আয়াস সাধ্য অলঙ্কারের বালাই ইহাতে নাই, অথচ অন্তরের ভাবের প্রচুর্যের ও ভক্তির একনিষ্ঠ প্রবাহের ফলে এই গীতিকাগুলি সহজ স্বতঃস্ফূর্ত রস সম্পদে ভরপুর।’
পটুয়া জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও জীবন জীবিকা
পটুয়া জনগোষ্ঠী কীভাবে উদ্ভব হল সে সম্পর্কে পটুয়াদের মধ্যে নানা বক্তব্য প্রচলিত রয়েছে। পটুয়া অজিত চিত্রকরের কথায় ‘হাবিল, কাবিল দুভাই। হিন্দু শাস্ত্র পড়ার জন্য হাবিল হিন্দু হল। আর কাবিল কোরান পড়েছিল বলে সে হল মুসলমান।
হাবিল পড়িল শাস্ত্র কাবিল কোরান
তাহা হইতে সৃষ্টি হল হিন্দু মুসলমান।’
আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে নিষ্পেষিত পটুয়া সম্প্রদায়। সবধর্মের মানুষের কাছেই তাদের যেতে হয়। কিন্তু হিন্দু ধর্মের উন্নাসিকতা ও প্রবল ধর্মীয় গোঁড়ামী হয়তো এদের মুসলমান হতে বাধ্য করেছিল। তা সত্বেও পূর্বপুরুষদের জাত ব্যবসা পট দেখানো থেকে এরা নিবৃত্ত হতে পারেনি। হিন্দু ও মুসলমানদের নানা ধরণের পট এরা দেখায়। সেসব পটের কাহিনির সঙ্গে মিলিয়ে গান বাঁধে। গান গায়। সে সব গান পুরুষানুক্রমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবাহিত হতে থাকে। তারা হিন্দুদের জন্য বাঁধে যম পট, মনসার পট, সাবিত্রী-সত্যবানের পট। এছাড়া ভারতীয় পৌরানিক নানা কাহিনীর থেকে অজস্র উপকরণ এদের পটে স্থান পায়। এরা মুসলমান হলেও হিন্দু ধর্মের সত্য, অনুশাসনগুলি নিজেদের জীবনেও মেনে চলে। তাই অসততা, অমানবিকতা এদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়না। তাই সত্যের পুজারীও বলা যায় এদের। এদের জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে আরো বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। ‘চিত্রকর সম্প্রদায় এক আখ্যানধর্মী লোকচিত্রকলার পেশায় নিয়োজিত।এ শিল্পকলার আদি উৎপত্তি সম্পর্কে যেমন কিছু জানা যায় না, তেমনি এ শিল্পকর্মে নিয়োজিত চিত্রকর সম্প্রদায়ের আদি উৎপত্তিও জল্পনা-কল্পনার বিষয়।
মধ্যযুগের হিন্দু জনসমাজ তাদের স্বকীয় যাথার্থ্যবোধে পেশাগত সোপানিক ভিত্তিতে সমাজে বর্ণপ্রথা গড়ে তোলে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে বিশ্বরূপকার বিশ্বকর্মার নয় ছেলে সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ঐ আখ্যান অনুযায়ী, নিচুজাতের এক রমণীর সঙ্গে বিশ্বকর্মার মিলনের ফলে ঐ নয় সন্তানের জন্ম হয়। ঐ নয় সন্তান তথা নব সায়কের নিয়তি নির্ধারিত হয় তাদেরকে গতর খাটিয়ে বেঁচে থাকতে হবে – এভাবে। পটচিত্রকরকে ঐ নয় সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান গণ্য করা হয়। আট সন্তান পেশাগত বা অন্যান্য উপায়ে সামাজিক পর্যায়ে তাদের অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হলেও, নবম চিত্রকর সন্তানটি তাতে ব্যর্থ হওয়ায় তার জন্মকালের ললাটলিপির বোঝাই তাকে বয়ে চলতে হয়্। চিত্রকরদের এ জনসমাজ সামাজিক পর্যায়ে তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য একযোগে ইসলাম গ্রহণ করে। তবে যেহেতু তারপরেও তাদের মধ্যে প্রতিমা পূজার রীতি থেকে যায় সে কারণে তারা মুসলিম জনসমাজের মূলধারায় সামাজিক পর্যায়ে গৃহীত বা স্বীকৃত হয় নি। আর তাই এ জন সমাজের লোকেরা তাদের দ্বৈত পরিচয় দিয়ে থাকে। নিজ সমাজের মধ্যে তারা তাদের মুসলিম নামে পরিচিত আবার তাদের হিন্দু গ্রাহকদের কাছে তাদের পরিচয় দেওয়া হয় হিন্দু নামেই। তবে তাদের নামের সাথে সাধারণ নাম: চিত্রকর -এ শব্দটি দেখেই তাদের পেশা ধরা যায়।’
বাংলা পটে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের মিশ্র প্রভাব
হিন্দুদের কাহিনীর পাশাপাশি গাজির পট, মানিক পীরের পট দেখায় পটুয়ারা। পটের মধ্যে ইসলামী প্রভাব সম্ভবত ষোড়শ –সপ্তদশ শতকে দেখা যায়। এর ফলে পটের ঘটনাবলী প্রায় একই থাকলেও হিন্দু মুসলিম মিশ্রিত পট নতুন রূপ পায়। ‘এই সময় ও তার পরে অসংখ্য সুফিমতবাদী ধর্ম প্রচারক মধ্য ইরান-আরব এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে। এঁদের প্রভাবে এদেশের মানুষ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারে। ইসলামের প্রভাবে এদেশের মানুষের ধর্মীয় জীবন হতে সামাজিক জীবনে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে দেশীয় সংস্কৃতির সকল আঙ্গিকে ইসলামী প্রভাব পড়তে থাকে। সেই প্রভাব পটচিত্রকলায়ও দেখা যায়। ইসলামী প্রভাবে এখানকার পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে ইসলামী আখ্যান যুক্ত হয়। পাল্টে যায় দেব-দেবীর বেশভূষা চালচিত্র। তারা এক একজন বিভিন্ন নতুন আসনে অভিষিক্ত হতে থাকেন। যেমন, বন দুর্গা হয়ে ওঠেন বনবিবি, শীতলা লাভ করেন বনবিবির রূপ, দক্ষিণ রায়ের স্থলে অভিষিক্ত হন গাজী কালু, সত্যনারায়ণের স্থলে সত্যপীর ইত্যাদি। এ কারণে এই সকল পীর ফকিরসহ ইসলামী দেব-দেবী বাঙালি জীবনের নতুন অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এই অনুষঙ্গ নির্ভরতায় পটচিত্রের আখ্যান আর চরিত্রে রদবদল ঘটে। তাই কালিয়া দমন আর গোষ্ঠ লীলার পাশাপাশি দেখা যায় গাজীর পট। যা সুস্পষ্ট রূপে বাঙালি জীবনে ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণের পরিচয় বহন করে।’ কিন্তু হজরত মহম্মদ বা হাসান হোসেনের মর্মান্তিক কাহিনীর কোন পট নেই। পটের গানও ঐসব কাহিনীকে আশ্রয় করে রচিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে নন্দকুমার ব্লকের শেরিফান চিত্রকর জানালেন-‘আল্লার কোন প্রার্থিব রূপ নেই। আমরা পৌত্তলিকতায়ও বিশ্বাস করি না। তাই মুসলমান ধর্মের উপর আমরা কোন পট আঁকিনা আর গানও করি না।’
দেশ ও বিদেশে পটের সমাদর
বাংলার পট চিত্র নির্ভর পটগীতির মধ্যেও রয়েছে কিছু মৌলিক উপাদান যা সমাজ বিন্যাসের স্তরটিকে শুধু চিহ্নিত করে না, সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে জাতীয় সংস্কৃতির রূপটিকেও বিশ্লেষন করতে সক্ষম হয়। বাংলায় পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া , বীরভুম , অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় পটুয়া শ্রেণির লোক বাস করে। এরা লৌকিক ও পৌরানিক দেবদেবীর চিত্র এঁকে এবং তাদের বর্ণনাগুলি গানের মধ্যে দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে বাড়িতে বাড়িতে গান গাওয়ার চলন এখন প্রায় নেই। বর্তমানে সব ধরনের শিল্পের প্রতি বিগত কয়েক দশক ধরে সরকার সব ধরনের শিল্পকে বিশেষত হারিয়ে যেতে বসা শিল্পের প্রতি সরকারী ভর্তুকি বা নজর দেয়। তার ফলে পট শিল্পীরা তাদের পট চিত্র গুলিকে গাঁয়ের মেলায়, ধর্মীয় মেলায়, সরকারী আয়োজনের মেলাতে পটচিত্রসহ গান গেয়ে বা পট বিক্রি করে করে জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমানে আধুনিক সভ্যতায় উন্নীত মানুষ ও পটচিত্রগুলি গৃহসজ্জার উপকরণ হিসেবে কিনে গৃহ সজ্জিত করে। বর্তমানে বহু পট শিল্পী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের পট দেখাবার জন্য ডাক পায়। সেখানে যারা যায় তারা অনেক পট বিক্রি করে কিছু অর্থ পান। সবাই বিদেশের ডাক না পেলেও বড় বড় পট শিল্পীদের দেখে মাঝারি বা অনান্য পট শিল্পীরা উত্সাহ পান। এছাড়াও বর্তমানে নিজ দেশ বা বিদেশ থেকে বহু মানুষ আসে পট শিল্পীদের কাছে। কেউ গবেষণার জন্য, কেউ পট শিল্প দেখতে, এরকম নানারকম অভিপ্সা নিয়ে কত মানুষ বর্তমানে পট শিল্পীদের কাছে হাজির হয়। এই অবসরে তাদেরকে পেয়ে পট শিল্পীরা শিল্পের পসরা নিয়ে বসে পড়ে তাদের নিজেদের পাড়ায় বা স্থানীয় এলাকায় কোথাও. পটচিত্রকে কেন্দ্র করে নিজেদের লিখিত গানগুলি তখন তারা অতিথিদের কাছে পরিবেশন করে। পট শিল্পীদের নিজেদের রচিত গানগুলি পটুয়া গীতি নাম পরিচিত।
পটচিত্রে ও পটের গানে সামাজিক প্রতিফলন
পটুয়া শিল্পীরা হিন্দু দেব-দেবীর ছবি এঁকে তাদের মহিমা কীর্ত্তন করলেও তারা বেশিরভাগই হিন্দু নয়. যদিও তারা হিন্দুদের সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকেই সম্পৃক্ত। পটুয়া পরিবারের মেয়েরা অনেকেই হিন্দুদের সামাজিক রীতি নীতি মেনে চলে। শাঁখা-সিঁদুর পরে. হিন্দুদের মত শাড়ি পড়ে। মাথায় ঘোমটা দেয়। পটুয়াদের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কিছু সীমারেখা বরাবরই ছিল। তাদের মধ্যেকার বৈবাহিক সম্পর্ক নিজ ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল. হিন্দু মুসলমান সমাজের মধ্যে বিয়ে সামাজিক স্বীকৃতি পেতনা. নানা জটিলতা হত। ইদানিং ধর্মের বন্ধনের পাশাপাশি এসেছে যুক্তিবোধ। হিন্দু পটুয়াদের সঙ্গে মুসলিম পটুয়াদের বিয়ে হচ্ছে. আবার পটুয়া নয় এমন মুসলমান পরিবারেও বিয়ে হচ্ছে মুসলমান পটুয়াদের। যেসব মুসলমান পটুয়া পরিবার, মুসলমান সমাজের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাদের মুসলমান সমাজের মধ্যে স্থান হয়না। পটুয়া শিল্পীদের সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে হয়। যেসব পটুয়া শিল্পী হিন্দু সমাজের অন্তর্গত ছিল তাদেরকেও হিন্দুসমাজ গ্রহণ করেনি। হিন্দু সমাজে এরা ব্রাত্য হবার কারণ সম্পর্কে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ইহারা দেবতার চিত্রাঙ্কন ও তাহাদের মহিমা কীর্ত্তন বিষয়ে পৌরাণিক আদর্শ রক্ষা করিবার পরিবর্ত্তে লৌকিক আদর্শেরই অনুসরণ করে- অতএব ব্রহ্মার শাপে ও ব্রাহ্মণের কোপ বশত: তাহাদের এই অবস্থা হইয়াছে’ এদের সম্পর্কে এরকম একটি জনশ্রুতি চলে আসছে। পটুয়া শিল্পীরা হিন্দু দেব-দেবীদের নিয়ে চিত্র এঁকে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করত বলে তাদের পটের উপকরণগুলিও হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত। দেব-দেবীরাও পটুয়া শিল্পীদের হাতে হিন্দু সমাজের চরিত্রে আদর্শে উপস্থাপিত হয়েছে।এরা যে পট নির্মান করে তাতে মহিষাসূরমর্দিনী, কমলে কামিনী, বেহুলা-লখিন্দর, মনসা-চাঁদ সওদাগর, কৃষ্ণ-রাধা, চৈতন্যলীলা কাহিনী থাকে। সাঁওতালদের মরং বুরু, মরা-হাজা, পিচলু বুড়ি ইত্যাদির কাহিনী থাকে। আর অন্যান্যদের জন্য পীরপট, গাজীর পট আঁকা হয়। এতে পীর যে সব অলৌকিক ঘটনা সম্ভব করেন তার কাহিনী থাকে। রাশিচক্র দেখিয়ে রাশিপট আঁকার বিষয়টিও খুব জনপ্রিয়। যম, যাদু ও চক্ষুদানপটের মতো রাশিপট যাদুটোনা ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। চৌকা পটের মধ্যে চক্ষুদান পট কৌতূহলোদ্দীপক। পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির চক্ষুবিহীন কাল্পনিক ছবি এঁকে তার স্বজনদের নিকট গিয়ে এই বলে পারিশ্রমিক দাবি করত যে, চোখ আঁকা না হলে তারা স্বর্গের পথ দেখতে পাবে না। পটশিল্পীদের পট ও পটগীতি সম্পর্তে গুরুসদয় দত্ত বলেছেন- ‘পটুয়া-শিল্পীর বৃন্দাবন বাংলাদেশে, অযোধ্যা বাংলাদেশে, শিবের কৈলাশ বাংলাদেশে; তাহার কৃষ্ণ, রাধা, গোপ-গোপীগণ সম্পূর্ণ বাঙ্গালী; রাম লক্ষণ ও সীতা বাঙ্গালী, শিব পার্ব্বতীও পুরা বাঙ্গালী। বড়াই বুড়ীর ছবি বাঙ্গালী ঠাকুরমা ও পিসীমার নিখুঁত প্রতিমূর্ত্তি। রামের বিবাহ হইয়াছে ছাতনাতলায়। পার্ব্বতীর কাছে সব অলঙ্কার হইতে শঁখার মর্য্যাদা ও আদর বেশি’। পটুয়া শিল্পীরা এইভাবে হিন্দু সমাজের দেব-দেবীকেও নিয়ে পটগীতি গাওয়ার ফলে হিন্দু সমাজে তারা আদরণীয় হলেও মুসলমান সমাজ এদেরকে আর গ্রহণ করল না। ফলে মুসলমান সমাজে এরা ব্রাত্য হয়ে পড়ল। এই সব নানা কারনে পটুয়াদের মধ্যে হিন্দু – মুসলমানের মিশ্র সংস্কৃতির প্রচলন হল।
পটুয়াদের গোত্র হিন্দুদের মত আর সংস্কার, রীতি, নীতি ইত্যাদি হিন্দু মুসলমানের মিশ্রন। ভারতে পটুয়াদের মতো বহু মিশ্র জনগোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া যায়। অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়া অনুসন্ধান করে দেখেছে ভারতের ৮৭ টি সম্প্রদায় হিন্দু ও শিখ, ৩৫ টি সম্প্রদায় হিন্দু ও ইসলাম, ২১ টি সম্প্রদায় হিন্দু ও জৈন, ১১৬ টি সম্প্রদায়হিন্দু ও খৃষ্টান, ২৯ টি সম্প্রদায় হিন্দু ও বৌদ্ধ। ফলে পটুয়ারাও ৩৫ টি হিন্দু ও মুসলমান মিশ্র শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। পটুয়াদের মধ্যে চারটি সম্প্রদায় বা ভাগ রয়েছে। এই ভাগ গুলিকে বলা হয় খুঁট। চিত্রকর, বেদে, পটু ও মালেই চার প্রকার খুঁটে এরা বিভক্ত। তবে এই চার খুঁটের মধ্যেই এদের বৈবাহিক সম্পর্ক ও আত্মীয়তা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য পটুয়াদের বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে মৌলবী, উকিল, মোক্তার। মুসলমানদের মতোই এদের বিয়ে অনুষ্ঠান হয়। তবে দিনক্ষন স্থির হয় হিন্দুদের পঞ্জিকা দেখে। নির্ধারিত দিনেবিয়ের পরে সিঁথিতে সিঁন্দ্যর পরে মেয়েরা। পায়ে আলতা ও হাতে শাঁখা পরে। বিয়ের পরে হিন্দুদের মতো অষ্ট মঙ্গলা হয়। আট দিন পরে শশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে আসে মেয়ে জামাই। অর্থাৎ হিন্দু লোকাচার অনুসরণ করা হয়।
কোথাও কোথাও পটুয়ারা সম্পূর্ণভাবে হিন্দুদের রীতি নীতি অনুসরণ করে থাকে। বাঁকুড়া জেলায় পটুয়াদের বলে পটেরি। এরা নিম্ন বর্ণের হিন্দু। হিন্দুদের সব পূজা পার্বণ করে। বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মন আসে। তবে এদের শিষ্য বা যজমান সাধারণতঃ সাঁওতাল হয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে পটুয়াদের অবস্থানের মধ্যে বহু ধরণের ভিন্ন ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে বেশিরভাগ জায়গাতেই হিন্দু ধর্মের প্রভাব বেশি। পটুয়াদের মধ্যে যারা মুসলমান ধর্মাবলম্বী তাদের অনেকের নাম হিন্দুদের মতোই। আবার কারো কারো একটা হিন্দু নাম, একটা মুসলমান নাম থাকে। তমলুক মহকুমার খাকরদার করুণা চিত্রকর এর মুসলমান নাম কোহিনুর। স্বামীর নাম অজয়। এখানকার গৌরী চিত্রকরের ছেলে শ্রীমন্ত্রর আর এক নাম ইনতাজ, সুষমার নাম সাবিনা। পটুয়াদের হিন্দু মুসলমান দ্বৈত্ব সত্বা প্রসঙ্গে রেবতী মোহন সরকার লিখেছেন, ‘পটুয়ারা একটি অন্তরিত গোষ্ঠী নয়- গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থার ধারায় এঁরা প্রত্যক্ষ্যভাবে যুক্ত এবং জাত অধ্যুসিত সমাজ দর্শনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের প্রভাব সবিশেষ বিস্তৃত হয়েছে। হিন্দু সমাজের অন্যতম সদস্য হিসাবে পটুয়ারা তাঁদের পটচিত্রের বিষয়বস্তুর জন্য হিন্দুশাস্ত্রের নানা ধর্মীয় ঘটনাকে উপস্থাপন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের শিল্পী মন হিন্দুশাস্ত্রের বিভিন্ন ব্যখ্যার কঠোরতাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে সায় দেয়নি। আপন চিন্তাধারার বিকাশে এগুলির উপস্থাপন ভিন্ন ভিন্ন পথে হয়েছিল। এই ঘটনাটিতে তদানিন্তন ব্রাহ্মন পরিচালিত সমাজ অসন্তুষ্ট হল এবংদেশজ চিন্তা ধারায় বিকশিত পটুয়াদের জনপ্রিয়তাকে উক্ত সমাজ হৃষ্টচিত্তে গ্রহন করতে পারলনা। …দীর্ঘদিন ধরে কঠোর সংগ্রামে ব্রতী হয়েও যখন পটুয়ারা বৃহত্তর হিন্দু সমাজে ব্রতী হতে পারলনা তখনই মসলমান ধর্মের পরিমণ্ডলে তারা আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। কিন্তু লক্ষ্যনীয় যে, অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত এরা সম্পূর্ণভাবে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়নি। ……একদিকে প্রচীন ঐতিহ্য এবং অপরদিকে আর্থিক সামাজিক বিপর্যয় এই বিশেষ শিল্পী গোষ্ঠীর সন্মুখে বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।’
পটুয়াদের অন্যান্য জীবিকা
সাপধরা, সাপের খেলা দেখানোও পটুয়াদের সমাজে আর এক কাজ ছিল। পটুয়াদের অনেকে যেমন পটের গান গেয়ে, পট দেখিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, তেমনি হয়তো তারা বা অন্যরা কেউ কেউ সাপের ঝাঁপিতে নানা জাতের সাপ নিয়ে সাপ খেলা দেখিয়ে গান গেয়ে বেড়াত। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই ধারা বাংলায় চলে আসছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাপের খেলা দেখানোকে জীবিকা করে নেওয়ার ব্যবস্থা বহুকাল ধরেই প্রচলিত ছিল। এখনো বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সাপ খেলা দেখায়। বেদে ভূমিজ ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ সাপ খেলা দেখায়। সাপের বিষ তোলে। নানা রকমের গাছ-গাছড়া, কবচ-তাবিচ ব্যবহার করে রোগ সারানোর বিধান দেয়। পটুয়ারা যেমন পটের গান গায় তেমনই সাপ খেলা দেখাবার সময় মনসার গান করে। চাঁদ বনিক আর মনসার পালা তাদের পটের মধ্যেও সর্বাধিক জনপ্রিয়। ফলে সাপের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নিবিড়। সাপ থেকে সাধারণ সব মানুষ দূরে থাকতে চায়। কিন্তু বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, নদী-নালা, খাল-বিলে সর্বত্র সাপের আনাগোনা। সাপের কামড়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। তাই সাপের বিষ, সাপের দৈবিক ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে নানা কল্পনা রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। চাঁদ সদাগর ও মনসা পূজার বৃত্তান্ত তার মধ্যে অন্যতম। পটুয়ারা তাদের মনসার পটে পুরো পালাটিকে গল্পের মতো করে গানে গানে গেয়ে শোনায়। আর সাপ খেলা দেখানোর সময় গায় মনসার ক্রোধ ও ক্ষমতার জয়গান। মনসাকে তারা বলে বিষহরি। সাপ খেলা দেখানোর পাশাপাশি সাধারণের সহজাত ভয়কে কাজে লাগিয়ে নানা কবচ তাইচ ও জরিবুটি দিয়ে এরা অর্থ উপার্জন করত। এর সঙ্গে নানা মন্ত্র তন্ত্র উচ্চারণ করে রোগ সারানোর জন্যে জলপোড়া, চালপোড়া ইত্যাদি মন্ত্রপুত ওষুধ দিত। পটুয়াদের মধ্যে বহুকাল ধরে এই বৃত্তি চলে আসছিল বলে মনে করা হয়। কেননা সাপকে বশ মানানো এবং তাদের নিয়ে খেলা দেখানোর দক্ষতা বংশ পরম্পরায় না হলে হঠাৎ করে হওয়া সম্ভব নয়। অনেকে মনে করেন পটুয়ারা আগে সাপের খেলা দেখাত। পরে তারা পট দেখানো শুরু করে। ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য এ সম্পর্কে তাঁর বাংলার লোকসাহিত্য গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কোন কোন অঞ্চলে ইহারা বিষবেদে বা সাপুড়ের ব্যবসায়ও অবলম্বন করিয়া থাকে। সাপুড়ের ব্যবসায়-ইহা এক পুরুষে কেহ আয়ত্ব করিতে পারেনা। অতএব একথা অনুমান করা ভুল হইবে না যে সাপুড়ের বৃত্তি পটুয়াদের কৌলিক বৃত্তি। …………সাপুড়েরাও এক প্রকার গীত ব্যবসায়ী- তাহারা গান গাহিয়াই সাপের খেলা দেখাইয়া থাকে, পটুয়াগণ পটের উপর চিত্র আঁকিয়া গানের ভিতর দিয়াই তাহা বর্ণনা করে। সর্পদেবী মনসার বৃত্তান্ত চিত্রের ভিতর দিয়া প্রদর্শন করানই সম্ভবতঃ ইহাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল, ক্রমে অন্যান্য বিষয় অবলম্বন করিয়াও ইহার চিত্রপট অঙ্কনও প্রদর্শন করিতে আরম্ভ করে। সেই জন্য এখন পর্যন্তও পটুয়াগণ সাপুড়ের ব্যবসায় গ্রহণ করিতে পারে।’ তবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দকুমার ব্লকের পিংলার পটুয়ারা জানালেন তাদের মধ্যে কেঊ সাপুড়ের বা ওঝার কাজ করেন না। আর তাদের জানাশোনা চিত্রকরদের কেউই সাপ খেলা দেখানোর সঙ্গে যুক্ত নন। তাদের মতে পটুয়ারা শুধুমাত্র পটের ব্যবসায় যুক্ত। তারা ইদানিং অন্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেও সাপ খেলা দেখানো বা মন্ত্র-তন্ত্রের কোন পেশার সঙ্গে তারা পরিচিত নন। তবে অন্য এলাকার পটুয়ারা কেউ কেউ এধরনের কাজে যুক্ত হলেও হতে পারে।
সাপ খেলা দেখানোর সময় যেমন গান গেয়ে থাকে তেমনই ওঝা বৃত্তির সঙ্গে কোথাও কোথাও বেদেদের একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে ওঝা বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রগুলি তারা মৃদু স্বরে গেয়ে থাকে। যাতে সাধারণ মানুষ সেই মন্ত্রে কথাগুলি শুনতে না পায় বা বুঝতে না পারে। এছাড়া মন্ত্র হিসাবে যখন সুর করে গাওয়া হয় তখন এর গতি বেড়ে যায় এবং সুরও ভিন্ন প্রকৃতির হয়। অনেকটা সংস্কৃত মন্ত্রের মতো বিভিন্ন স্থানে জোরের সাথে উচ্চারিত হয় এই মন্ত্রগুলি। ওঝা বৃত্তির সঙ্গে যে গান বা মন্ত্রগুলি উচ্চারিত হয় তাতে দেব দেবীদেরই স্মরণ করা হয়। তার সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণেরও আচার আচরণের মধ্যে বলিষ্ঠতা প্রকাশ করে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রোগীর বা আক্রান্ত ব্যক্তির মনে প্রত্যয় তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে দেওয়া হয় নানা ধরণের লতা পাতা শিকড়-বাকড়। সর্পাঘাত ও বিষধর পোকা মাকড়ের দংশন, পেটে ব্যথা, মাথায় ব্যথা,ইত্যাদি নানা রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেদে পটুয়াদের চিকিৎসা সুপ্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এর সঙ্গে প্রচলিত রয়েছে গোপন মন্ত্র। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। ডঃ চিত্তরঞ্জন মাইতি তাঁর ‘প্রসঙ্গ : পট, পটুয়া ও পটুয়া সংগীত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ওরা বলেন সাপ ধরার জন্য নানান যাদু মন্ত্র ব্যবহার করেন। কিন্তু ওদের খুব নিবিড় ভাবে মিশে জেনেছি-মন্ত্রতন্ত্র সাপ ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ কাজে লাগেনা। কাজ করে সাহস, হাতের কৌশল এবং একটি ২ ১/২ (আড়াই) হাত লম্বা ছড়ি। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ একটি গাছের শিকড় বেদে কাছে রাখেন। যার গন্ধে সাপ ফনা তুলতে পারেনা বা চোট দিতে পারেনা।……সাপে কাটা রোগী মন্ত্র দিয়ে বা বিভিন্ন গাছের পাতা ও শেকড়-বাকড় বেটে খেতে দিয়ে এই চিকিৎসা পদ্ধতি চলে। ভূত ছাড়ানো, নজর লাগা প্রভৃতির কাজে তন্ত্র মন্ত্র ব্যবহার করেন।’
পটুয়াদের মধ্যে মিশ্রধর্ম ব্যবস্থা পালনের রীতি
পটুয়াদের মধ্যে মিশ্রধর্ম ব্যবস্থা পালনের রীতি থাকলেও সর্বত্রই তারা মিশ্রধর্ম পালন করেনা। অনেক জায়গায় এরা শুধু হিন্দু কিংবা মুসলমান। আবার চিত্রকর হিসাবে এদের মধ্যে সম্পর্কও থাকে। কোথাও এরা আধা হিন্দু আধা মুসলমান। ধর্ম যাইহোক এদের পটচিত্র ও পটগীতির মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্টই রয়েছে। এদের উৎপত্তি সম্পর্কে এদের নিজেদের বিশ্বাস এরা একই পূর্বপুরুষের থেকে উদ্ভূত। হাবিল কাবিল থাকেই হিন্দু মুসলমানের সূচনা। তারাই এদের পূর্বপুরুষ। সাধারণভাবে দরিদ্র ও বঞ্চিত দিন আনা দি খাওয়া মানুষদের কাছে ধর্ম সামাজিক সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজন হয় ঠিকই কিন্তু ব্যক্তি জীবনের কাছে কোন বিশেষ ধর্মের গুরুত্ব এরা অনুভব করেনা। ফলে সমাজের স্বাভাবিক স্রোতের মধ্যেই চলেছে এই জনগোষ্ঠী। কোথাও সামাজিক চাপে বা প্রয়োজনের তাগিদে এরা কোথাও হিন্দু আবার কোথাও মুসলমান বা মিশ্র। যেভাবেই তাদের আকার আচরণ ও ধর্মের অনুশীলন
পটুয়ারা মূলতঃ নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরণের বৃত্তি অবলম্বন করে থাকে। এরা এক সময় ভব ঘুরে ছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। এরা অসীম সাহসী। ধর্মের ভালো-মন্দ গুলোকে এরা চেনে জানে, মানুষের ভয় ভীতি কোথায় কেন এও জানে। এর প্রতিকার দানের মধ্যেই কিছু উপার্জনের সম্ভাবনাকে তারা কাজে লাগায়। বিনয় ঘোষ তার বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজচিত্র গ্রন্থে লিখেছেন- ‘লোকশিল্পীদের মুমুর্ষু শাখা হল পটুয়ারা। যারা এখনও তাদের ঐতিহ্য পেশা আঁকড়ে আছে তারা চিত্র শিল্পী নয় এবং চিত্রশিল্প কী তারা জানেনা। তারা ভবঘুরে চারণ দল, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায়, ভিক্ষা করে,অশিক্ষিত গরিব গ্রামবাসীদের পটে চিত্রায়িত পুরাণাশ্রিত গানগুলি গেয়ে আনন্দ দেয়।’ চিত্রকাররা কোন পেশাদার শিল্পীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেনা, কিন্তু মানুষের জীবন ও মৃত্যুর মধ্যেকার নানা ভয়-ভীতিগুলিকে নিজেদের পছন্দ মত রূপদান করে গানের মধ্যদিয়ে তার বক্তব্যকে নিবিড় আকর্ষনীয় করে তোলে। তারা স্বর্গ নরকের ধারণা এবং মৃত্যুর দেবতা যমকে সামনে রেখে পাপ ও পাপীদের নরক যন্ত্রনার নানা দৃশ্য তুলে ধরে। যাকে বলা হয় যম পট।
লোকসাহিত্যে মানুষের মৃত্যু, মৃত্যুর পরের কল্পনাময় অবস্থাকে নানাভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে। বিশেষ করে নারীদের সম্পর্কে নরকযন্ত্রনার ভয়াবহতা বেশিকরে তুলে ধরা হয়েছে। মনসার পাঁচালী কিংবা চাঁদ সদাগরে কাহিনীতে জীবিত অবস্থাতেই বেহুলাকে নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছে। সতী সাধ্বী বেহুলার মাহাত্ব প্রচার করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন যমপটে ব্যভিচারী নারীর নরক যন্ত্রনা বা আধুনিকা নারীর মৃত্যুর পরবর্তীকালে যমলোকের শাস্তির বর্ণনার ভয়াবহতা তুলে ধরা হয় কল্পনার রঙে রাঙিয়ে কিংবা বিভিন্ন লোককাহিনীকে আশ্রয় করে। পটের গানগুলিতেও সমাজ সংসারের কল্যানে নারীদের যে আদর্শবোধ প্রচারিত হয়ে আসছে তাকেই নানা গল্প ও উপাখ্যানের ধারায় উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।
গুরুসদয় দত্ত ১৮ রকমের পট সংগ্রহ করেছিলেন। এর মধ্যে মহাভারত থেকে ৫টি পট, রামায়ণ থেকে তিনটি, গৌরাঙ্গ বিষয়ক দুটি, শিব –পার্বতী বিষয়ক ৫টি, অন্যান্য পটের মধ্যে ছিল গো পালন, ভগবতী মঙ্গল, পঞ্চকল্যানী ইত্যাদি। পটুয়াদের রামায়ন বাল্মীকির বা কাশীরাম দাসের রামায়ন নয়। এই রামায়ন ৪ খণ্ডে সমাপ্ত। ‘বর্তমান পটুয়ারা চারখণ্ডে লৌকিক রামায়ন সম্পূর্ণ করেছেন। রামায়ন পটের প্রথম অংশ সিন্ধু বধের কাহিনী, দ্বিতীয়াংশে শ্রীরামচন্দের জন্ম থেকে বিবাহ, তৃতীয় ও চতুর্থ যথাক্রমে রাবনবধ ও সীতার বনবাস।’ পঞ্চকল্যানী পট বিশেষ কোন লীলা কাহিনী বা আখ্যায়িকা অবলম্বনে রচিত নয়। নানা দেব দেবী সম্বন্ধে ছড়ার মতো পাঁচমেশালী সমাবেশ ঘটে এই ধরণের পটে। এই পটে পটুয়ারা সংস্কার মুক্ত মনে নানা ধর্মের সমন্বয় সাধনের ঐকান্তিক ইচ্ছা প্রকাশিত হয়ে থাকে। একটি পঞ্চকল্যানী পটের গানে বলা হয়েছে,
বামহাতে খড়্গখণ্ড গলে মুণ্ডমালা
হৃদনয়নে চেয়ে দেখমা, তোর পদতলে ভোলা।
এই ভোলা পতি নয় মা, আরো ভোলা আছে
দ্বিজ রামপ্রসাদ হয়েছে ভোলা
মায়ের রাঙ্গা চরণ পাবার আশে।।
পটুয়ারা প্রচলিত পটের গানের কথাকে আশ্রয় করেই পট রচনা করে থাকে। বিশেষ করে বীরভূম জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পটুয়ারা যে পট ও পটের গান পরিবেশন করে থাকে সেগুলি সবই পূর্ব প্রচলিত। অর্থাৎ পটের ছবি এবং গান বহুকাল ধরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। একটি নির্দিষ্ট এলাকার ঐ বিষয়ক সব পটই প্রায় একই আঙ্গীকের হয়ে থাকে। আর পটের গানগুলিও একই কথা সুরে সর্বত্র প্রচলিত বলে সেগুলিরও পরিবর্তণ করা হয়না। তবে আঞ্চলিক পার্থক্যের জন্য কোথাও কোথাও অল্প সল্প পরিবর্তণ হয়ে থাকে। ‘জড়ানো পটে ঘটনাবলী যা আঁকা হয় শিল্পীরা তা নিজেরা নির্বাচন করে না। শিল্পধারণা থেকে কাগজে তুলিতে রূপদান পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটাই পূর্ব প্রচলিত।’ সুদীর্ঘ পট অনেক সময় একাধিক খণ্ডে বিভক্ত করে সংক্ষিপ্ত করা হয়। পট দেখিয়ে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেশি জায়গায় পট দেখানোর প্রয়োজনে অতি দীর্ঘ পটগুলি ছোট করে নেওয়া হয় একাধিক খণ্ড করে।
পটের গানের ঐতিহ্য ও আধুনিকতা
পটের গান লিখে রাখার কোন রীতি পটুয়াদের মধ্যে প্রচলিত নয়। তারা ঐতিহ্যগত ভাবে এই গান স্মৃতিতে ধরে রাখে। যিনি পট আঁকেন তিনি ঐতিহ্যগতভাবে পটের গানকে স্মরণ করেই আঁকেন। কখনো কখনো কেউ কেউ নতুন দৃশ্যের অবতারণা করতে পারেন। যিনি গান গেয়ে পট দেখান তিনি নতুন গানের কলি যুক্ত করে নেন। এ ব্যাপারে পটুয়াদের স্বাভাবিক দক্ষতা রয়েছ বহুকাল ধরে। তবে সাধারণভাবে পূর্ব নির্দিষ্ট গানের পদগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই পট আঁকা হয়ে থাকে। পটুয়াদের অনেকেই আছেন, যিনি পট আঁকেন তিনিই গান করেন। আবার কেউ কেউ শুধু আঁকেন, আবার কেউ কেউ শুধু গান করেন বা পট দেখিয়ে বেড়ান। প্রাচীন কাহিনীর পটগুলির মোটামুটি একটা রূপ তাদের কাছে আছেই। ফলে তার খুব বেশি পরিবর্তণ দেখা যায়না। তবে শিল্পীর দক্ষতা অনুযায়ী পটের রূপ ফুটে ওঠে। তেমনি শিল্পীর কণ্ঠ মাধুর্য ও দক্ষতা অনুযায়ী গানগুলির মধ্যে সৌন্দর্য্য ও ভাব ফুটে ওঠে। পট চিত্রকর পটের কোন দৃশ্য না আঁকলেও পরিবেশক গান গেয়ে ঐ অংশের ফাঁক পূরণ করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালে বীরভুম জেলার পট সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দেবাশিস বন্দ্যপাধ্যায় তাঁর বীরভূমের যমপট ও পটুয়া গ্রন্থে লিখেছেন-‘পটের গান আখ্যান মূলক, অর্থাৎ ছবির অর্থ ও প্রসঙ্গ পরিস্ফূট করাই তার কাজ। গান ছাড়া ছবি বোবা। এ ওর পরিপূরক। এই দিক থেকে সে তার দায়িত্ব সম্যক রূপে পালন করে। কখনো কখনো চমৎকার চিত্রকল্পে বিরল প্রকৃতিও যন্ত্রনায় কাতর, বৃক্ষের পাতা সেই যন্ত্রনায় খসে পড়ছে; অথবা কৃষ্ণ লীলা পটে ভার বহন, নৌকা খণ্ড ইত্যাদি অংশ। বাঙালি গৃহস্থ গৃহবধূর পারিবারিক বা ঘরোয়া ছবিও নিখুঁত ফুটে উঠেছে শিব – পার্বতী বিষয়ক পটগুলিতে।’ তবে পটুয়াদের জাত ব্যবসা ঐতিহ্যপুর্ণভাবেই বেড়ে চলেছে। নানা সমস্যার সম্মুখীন হলেও তা থেকে উত্তোরণের রাস্তা করে নিয়ে এগিয়ে চলেছে পট ও পটের গান। কয়েক দশক আগেও পটুয়ারা নানা সমস্যার সন্মুখীন হয়েছিল। ইদানিং তাথেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। এর বড় কারণ বৃহত্তর সমাজের কাছে পটের সৌন্দর্য দিন দিন নানাভাবে স্বীকৃতি পেয়ে চলেছে। সরকারী ও বেসরকারী কিছু প্রচেষ্টাও এক্ষত্রে চোখে পড়ার মতো।
পশ্চিমবঙ্গে পটুয়াদের নারী ও পুরুষের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা
বর্তমানে পটুয়ারা অনেকেই তাদের পুরাতন পেশা ছেড়ে নানাভাবে উপার্জনের জন্য সচেষ্ট হয়েছে। যেভাবে চাষি, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে ইত্যাদিরা নিজেদের পেশায় আবদ্ধ থাকতে পারেনি অনেকটা সেভাবেই তাদের পেশা বদল করেছে পটুয়ারাও অনেকেই। তাদের শিল্প ও জীবিকা এক সময় একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। যদিও আয় ছিল কম। তবুও অন্যান্য পেশাকে তারা মেনে নিতে পারেনি বহুকাল। বর্তমান আধুনিকতা ও নাগরিক স্বাচ্ছন্দ তাদের ভাবনাকে বদলে দিয়েছে। যাই হোক পটুয়ারা তাদের বাড়ি বাড় গিয়ে পট দেখানোর প্রচলিত বৃত্তি থেকে সরে গেলেও এদের মধ্যে ছবি আঁকা, গান গাওয়া, পুতুল তৈরি করা কিংবা এই ধরণের অন্যান্য কাজের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছেই। সময় পেলেই তারা এইসব কাজ কর অনেকেই। ইদানিং কেউ কেউ এসব কাজে দেশ বিদেশের সম্মানও পাচ্ছেন। পশ্চিম বঙ্গে পটুয়াদের সংখ্যা বেড়েছে স্বাধীনতার পরে। অনেকেই বাংলাদেশ থেকে এপার বাংলায় চলে আসে দেশ ভাগের পরে। তারা এপারে পট দেখানো শুরু করে।
আগে ওপার বাংলায় যে পট ও পটের গানের প্রচলন ছিল তা বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়। আনোয়ারুল করীম বাংলাপিডিয়াতে লিখেছেন- ‘পটুয়ারা অনেকে সঙ্গীত সহযোগে পটচিত্র দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা গানের তালে তালে দর্শক-শ্রোতাদের পটচিত্রের আখ্যানভাগ বুঝিয়ে দেয়। যশোর ও খুলনা অঞ্চলে পটুয়াদের ‘গাইন’ নামে অভিহিত করা হয়। অতীতে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং দিনাজপুর অঞ্চলে পটুয়ারা বসবাস করত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভুমিতে দেশবিভাগের পর অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। যারা থেকে যায় তাদের পেশায়ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভাটা পড়ে। বর্তমানে ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জ, খুলনা, যশোর ও জামালপুর অঞ্চলে কদাচিৎ দু’একজন পটুয়া বা গাইন শ্রেণির শিল্পীর সাক্ষাৎ মেলে। পটুয়ারা বিভিন্ন মেলা, ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান এবং গ্রামে-গঞ্জে পটচিত্র বিক্রয় করে। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন দেবদেবীর পট পূজা-অর্চনার জন্য সংরক্ষণ করে।’
পশ্চিমবঙ্গে পটুয়াদের জনসংখ্যা
পটুয়াদের সম্পর্কে ভারতের জন গণনায় বলা হয়েছে পটুয়ারা নিজেদের পটিদার বা পটুয়া হিসাবে ও সমাজের অবহেলিত শ্রেণির অংশ বলে দাবি করে। তারা অতীতে পট দেখিয়ে সম্মান দক্ষিনা হিসাবে অর্থ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। এখনও কেউ কেউ সাময়িকভাবে এই কাজ করে ঠিকই কিন্তু সম্পূর্ণভাবে প্রতিদিন কেউ আর পট দেখিয়ে গান গেয়ে বেড়ায় না বা এই কাজের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেনা। তা সত্বেও পটের কাজে কিছু নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আগামী দিনেও পটের কাজ নতুন মাত্রা পাবে বলে অনেকেই মনে করছেন। এ সম্পর্কে পরের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
১৯৯৬ সালে বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নয়নে সরকার একটি কমিশন ‘WEST BENGAL COMMISSION FOR BACKWARD CLASSES’ গঠন করে। সেই কমিশনের ৫ম রিপর্টে উল্লেখ আছে তাদের কাছে বিভিন্ন দাবি ও সুপারিশ জমা পড়েছিল। তাতে একটি সুপারিশে দাবি করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে পটুয়াদের সংখ্যা প্রায় ৫১ হাজার। এদের মধ্যে পশ্চিম ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ১৫ হাজারের মতো পটিদার বা পটুয়া বাস করে। দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলায় ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ১০ হাজার করে ২০ হাজার পটুয়া বাস করে, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলায় ৫ হাজার করে ১০ হাজার, বীরভূম ও হাওড়া জেলায় ২ হাজার করে ৪ হাজার আর কলকাতায় বাস করে প্রায় ২ হাজার পটুয়া।
‘The stated population of ‘Patidar’ in West Bengal is about 51,000. They are mostly concentrated in the district of Midnapore, Birbhum, Murshidabad. They are also found in the districts of North and South 24-Parganas, Nadia, Howrah and Calcutta in the manner as detailed below:-
Midnapore — 15,000.
24-Parganas (S) — 10,000
24-Parganas (N) — 10,000
Nadia — 5,000
Murshidabad — 5,000
Birbhum — 2,000
Howrah — 2,000
Calcutta — 2,000’.
সমাজে পটিদার (পটুয়া) রা বহুকাল ধরে আর্থিক দিক থেকে খুবই দরিদ্র। এরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পট দেখিয়ে গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছে নিজেদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনের ন্যূনতম উপকরণগুলি সংগ্রহ করার জন্য। এই অর্থ সংগ্রহকে অনেকেই ভিক্ষা করার সামিল বলে মনে করেছেন। কেননা তাদের পারিশ্রমিকের কোন নির্দিষ্ট মূল্য ছিলনা। গৃহস্থের দয়া দাক্ষিন্যের উপরই নির্ভর করতে হত। সাধারণভাবে পারিশ্রমিক বা ভিক্ষা হিসাবে কেউ দিত চাল, কেউ দিত ক্ষেতের সবজি আবার কেউ কেউ দু একটা পয়সা দিত। তা’দিয়ে কোনক্রমে সংসার চললেও স্বাচ্ছন্দ ছিলনা। কমিশন যে বহু স্বাক্ষরিত পেয়েছে তাতে পটুয়াদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
‘The Commission received mass petition from Shri Niranjan Chitrakar, Vill : Habichak, P.O. Bandapur, Dist.- Midnapore, and others. The signatories to the mass petition included Bapi Patidar (Abul Kalam Patidar), Secretary, Patua Samiti, Vill : Habichak, Dist.- Midnapore, for inclusion of ‘Muslim Chitrakar and Patidar’ class of people in the list Backward Classes in the State of West Bengal. Shri Abul Kalam Patidar (Bapi Patidar), Secretary, Patua Samiti, and Shri Piyari Chitrakar, President of the said Samity appeared before the Commission on the date of their hearing on 22.07.1996. They took oath and presented necessary particulars in respect of their class ‘Patidar’ before the Commission. They made the submission that their class deserves inclusion in the list of the Backward Classes of the State of West Bengal because of their backwardness in every aspect of their life and activities – particularly in the social, educational and economic spheres’.
তারা তাদের লিখিত দাবির মধ্যে জানায় পটুয়ারাই পটিদার এবং অনেকে পটিকার হিসাবে বিভিন্ন স্থানে পরিচিত। তারা ধর্মের দিক থেকে অনেকেই মুসলমান। তারা হিন্দু ধর্মের পৌরানিক কাহিনী নিয়ে পট রচনা করেন। বর্তমানে তারা অনেক আধুনিক বিষয় নিয়েও পট রচনা করছেন। তারা বাড়ী বাড়ি গিয়ে পট দেখিয়ে গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও Sir H.H.Risley দেখেছিলেন যদিও পটিদাররা ধর্মে মুসলমান তবুও তারা নিজেদের ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদাসীন।
তাদের কাছে পীরের মাহাত্য অনেক। তারা পীরের মতো সাজতে ভালোবাসে ও কালো চিল দেখলে তার প্রতি তারা শ্রদ্ধা জানায়। পটিদাররা মনে করে কালো চিল দেখা সৌভাগ্যের লক্ষন। Sir H.H.Risley লিখেছেন পটুয়ারা হিন্দু ও মুসলিমদের মিলিত ধর্মীয় সম্প্রদায়। এরা আচরণে মুসলিম কিন্তু কর্মে হিন্দু। পটুয়ারা তাদের কাজের জন্য সর্বত্রই পরিচিত। তাদের আয় কম। ঐতিহ্যগত পেশাকে আঁকড়ে থাকতেই এরা বেশি ভালোবাসে। খুব কম পটুয়ারাই জমিতে চাষ করে। ভূমি সংস্কারের সময় কেউ কেউ জমি পেয়েছে। কিন্তু সে সংখ্যা খুবই কম। এরা অনেকেই সাক্ষর। কিন্তু বেশি লেখাপড়া এরা জানেনা। পট আঁকার পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করে। মেয়েরাও অন্যের বাড়িতে, জমিতে কাজ করে। তবে পুরুষরাই অন্যের বাড়িতে কাজ করে বেশি। মেয়েরা এখন পটের কাজ বেশি করে। তারা বাড়ির কাজের ফাঁকে পট আঁকে। সময় সুযোগ পেলে মেলায় পট নিয়ে যায় একা কিংবা দলবেঁধে। পটুয়ারা কমিশনের কাছে এ সম্পর্কে জানিয়েছে-
‘This ‘Patidar’ class is quite well known in West Bengal, for their distinctive style and techniques in painting. As stated earlier, their traditional occupations are scroll painting and singing of songs pertaining to the themes described in the scrolls and the idols. As per their submission, in the literacy drive programme of the State, their services are being quite profitably utilized by the Government of West Bengal for eradication of illiteracy from the rural society. They also brought some pictures and gave demonstrations by singing some songs before the Commission. Their performance reflects modern innovations in their techniques for infusing new ideas and knowledge into the traditional media for bringing changes in the outlook of the rural people. As per their submission, hardly 5% of them possess some land, another 5% have got some land and also work on others’ land. About 50% of them work on others’ land as labourers. There are, however, a few brigades also amongst them. Many of them, now-a-days, eke out their existence as day labourer, rickshaw-puller, cart driver, hawker, vendor, porter, toymaker, etc. Majority of their class, however, are below the poverty line. They are quite backward in the field of education. Usually after obtaining primary level of education, the children are compelled to leave the schools to assist their parents and augment the family income. It was stated in evidence that about 1% of the males and about 0.01% of the females got primary education. The rate of drop out is extremely high among them. Their environment in the house is also not congenial for carrying on with studies. A very few among them could reach up to college level.’
শিক্ষার অভাবে ও বহুকাল ধরে সামাজিক সুযোগ গুলিকে ব্যবহার করতে না পারায় সমাজের প্রায় কোন ক্ষেত্রেই এদের কোন নির্বাচিত প্রিতিনিধি নেই। নেই এম এল এ, এম পি। তাদের মধ্যে থেকে এখনো কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল হয়েছে বলে কোন তথ্য নেই। পটুয়াদের মধ্যে মাত্র ০.০১ শতাংশ সরকারী নিম্ন পদে কাজ করে। এদের জীবনযাত্রা খুবই নিম্ন মানের। আর্থিক দিক থেকে অস্বচ্ছল, থাকে কুঁড়ে ঘরে কিংবা মাটির দেওয়াল দেওয়া খড়ের ছাউনির বাড়িতে। একটিও পাকা বাড়ি এদের কারো নেই। ৯ এর দশক পর্যন্ত এদের ১০০ শতাংশই ফাঁকামাঠে প্রাত্যহিক মল মূত্র ত্যাগ করত। কারও বাড়িতে কোন শৌচালয় ছিলনা। গত প্রায় ৭-৮ বছর হল সরকারী প্রচেষ্টায় কিছু শৌচালয় হয়েছে।
‘They are a marginal class of people occupying a very low social position in the local social hierarchy. As per their submission majority of them are treated like the Scheduled Castes and the Scheduled Tribes. During Mohammedan rule in Bengal, many Chitrakars were converted to Islam. They forced them to draw, exhibit and sing Islamic theologies to the Hindu population of Bengal to attract them towards Islam. This led to the gradual decline in their social position. They are the descendants of those earlier convert and follow Muslim customs in general. They generally retain two names, one Hindu and the other Muslim. They occupy an intermediary position between Hindus and Muslims. They are looked down upon by both the Hindu and the Muslim people who enjoy higher social status.’
নারী পুরুষের অনুপাত ও শিক্ষা
এরাজ্যে নারী পুরুষের অনুপাত ৯৫৩ : ৯৪৪। এর মধ্যে গ্রামে বাস করে ৬৮.১৩ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ৬২,১৮৩,১১৩ জন। শহরে থাকে ৩১.৩৮ শতাংশ মানুষ। রাজ্যে মোট পুরুষ ৩১,৮৪৪,৯৫৪ জন, মহিলা বাস করে ৩০,৩৩৮,১৬৮ জন। গ্রাম এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ৯৫৩। রাজ্যে সাক্ষর পুরুষ ৭৮.৪৪ শতাংশ, নারী ৬১.৯৮ শতাংশ। পটুয়ারা আধুনিক ভাবনায় বা চেতনায় উন্নীত। এরা আধুনিক নানা বিষয়ে পট আঁকে। বিশেশ করে সচেতনতা মূলক পট। যেমন জনশিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা, শিশুদের স্বাস্থ্য বিধি মেনে টীকা দেওয়া, পালস পোলিও টীকা করণ, জন্ম মৃত্যু নিবন্ধীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে সরকারী উদ্যোগে এদের প্রশিক্ষিত করে এধরণের পট দেখানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। এরা অনেকটা সংস্কার মুক্ত ও অধিকতর বিজ্ঞান মনস্ক। সমাজের সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সঙ্গে এদের সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হয়। ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে এদের জ্ঞান ক্রমশ উন্নত হয়ে চলে।
পশ্চিমবঙ্গে পটুয়াদের গ্রাম
পশ্চিমবঙ্গে পটুয়ারা যেসব জায়গায় বসবাস করে সেগুলি নীচে উল্লেখ করা হল।
জেলা গ্রাম
পূর্ব মেদিনীপুর
ও পশ্চিম মেদিনীপুর : নয়া, বড়কুমারদা, ঠেকুয়াচক, কুমিরমারা, নানাকারচক, সালিগ্রাম, কুল্যাচন্দনপুর, জয়কৃষ্ণপুর, বাঘাগেড়ে, জরুমিয়া, কাখদা, হবিচক, কাশিজেড়া, কেশাববাড়, টাকাপুর, ক্যাঁকটা, সিঊড়িগ্রাম, নাড়াজোল (রাজার বাড়ির পাশে), চেতুয়া, নিইপুর, কেশিইয়াড়ী, ইত্যাদি।
বীরভূম : ষাটপালসা, শিবগ্রাম, তারাচি, মদিয়ান, বাগচোলা, মালঞ্চি,দাঁড়কা, দাদপুর, নলহাটি, কুসুমগ্রাম, পাকুড়হাস, কুসুমযাত্রা, ইঁটাগাড়িয়া, চাঁদপাড়া ইত্যাদি।
দক্ষিন ২৪ পরগনা : মালঞ্চ, জয়নগর, ডায়মণ্ডহারবার, ফতেপুর,বকুলতলা, গোবিন্দপুর, দূর্বাচটি, পাথর প্রতিমা, কয়লাবাড়, কঙ্কনবাড়িয়া ইত্যাদি।
মুর্শিদাবাদ : কাতুরহাট (করবেলা), গোকর্ণ, কান্দি, আমলাট, কান্দি বাজার, দিঘীর পাড়, বেলুড় কলাপাড়, (ভীমেশ্বর থানা), দিক্ষিন খণ্ড (কাদু ভরতপুর ২ নং থানা), পাঁচথুবি,কাতুর, আইরা (খড়গ্রাম থানা), আওগ্রাম, ঝিল্লি, (লঝিল্লিতোলা), সোনাপুদ্ধি, গণকর, গোর্কা, নোদা, মির্জাপুর প্রভৃতি।
পুরুলিয়া : গোডডি, বনবহাল, জাতুরি, নেতুরিয়া, রঘুনাথপুর ইত্যাদি।
বাঁকুড়া : ভরতপুর, কালীপাহাড়ী, বেলিয়াতোড়, খাতড়া প্রভৃতি।
বর্ধমান : কেতুগ্রাম, বরানপুর, পলিশগ্রাম, মাধবীতলা, মঙ্গলকোট প্রভৃতি।
হুগলী : তালচিনান, গোপীনাথপুর, জলঘাটা, ত্রিবাণী, পুইনান প্রভৃতি।
হাওড়া : আন্দুল, লিলুয়া, কুচি প্রভৃতি।
পটুয়াদের শতকরা হার
পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী পটুয়াদের শতকরা হার এই রকম-
জেলা শতকরা হার %
পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর ৫৯
বীরভূম ২৫
দক্ষিন ২৪ পরগনা ৫
মুর্শিদাবাদ ৩
পুরুলিয়া ৩
বাঁকুড়া ২
বর্ধমান ১
হুগলী ১
হাওড়া ১
পটুয়াদের মধ্যে শিক্ষা ও কর্ম সংস্থান
পটুয়াদের মধ্যে সাক্ষরতার হার বেশি। এরা বেশি লেখা পড়া না শিখলেও অল্প সল্প লেখা পড়া জানে। এদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে দেখা গেছে এই প্রজন্মের ছোট ছেলে মেয়েরা অধিকাংশই স্কুলে যায়। বড়োরাও নিজেদের প্রয়োজনে লেখাপড়া শিখে নেয়। পট আঁকা ও পটের গান শেখার জন্য ওদের লেখাপড়া শেখার প্রয়োজন হয়। যারা পটুয়া নয় এমন বাড়ি থেকে বউ হয়ে পটুয়াদের বাড়িতে আসে তাদের মধ্যে নিরক্ষর থাকলে তারাও অন্যদের কাছ থেকে লেখা পড়া শিখে নেয় বা নিতে বাধ্য হয়। এদের পেশার সঙ্গে লেখাপড়ার সম্পর্ক থাকায় এদের মধ্যে নিরিক্ষর প্রায় থাকেনা। বহুকাল ধরেই এই ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এরা নিজেদের পেশা ছেড়ে অন্য পেশা অবলম্বন না করায় এদের আর্থিক সচ্ছ্বলতাও খুব কম। ফলে এরা নিজেদের এই কাজ ছাড়া অন্য প্রয়োজনের দিকগুলিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। তাই পটুয়াদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষা প্রসারও ঘটেনি সেভাবে। এদের বাড়ির ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায়। সাধারণভাবে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনার পর নিজেদের পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। মাধ্যমিক পাশ খুব কম। ইদানিং পটুয়ারা অনেকে অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এই সংখ্যা এখনো খুবই কম। সরকারীভাবে এখন এই পট দেখানোর পেশার মানুষদের কিছু আর্থিক সহায়তা দেবার প্রক্রিয়া চলছে বলে পিংলা, সবং, ময়নার পটুয়ারা জানালেন। যদি তা সফল হয় তাহলে পটুয়ারা তাদের নিজেদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে আসা পট ব্যবসায় আরো বেশি করে আত্ম নিয়োগ করবে বলে আশা করা যায়। পটুয়াদেরও এই অভিমত।
পশ্চিমবঙ্গে মোট ৫১ হাজারের মতো পটুয়া বাস করে। এর মধ্যে মহিলা প্রায় ২৫ হাজার। সারা দেশের অঘোষিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মতো পটুয়াদের সমাজেও নারীদের সামাজিক মর্যাদা কম। স্বাধীনতার আগে ও পরে পটুয়াদের মেয়েরা বাড়ির কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু অন্যান্য দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া অবহেলিত অংশের মতোই পটুয়াদের আর্থিক অসচ্ছ্বলতার কারনে মেয়েদের উপর সামাজিক বেড়ি তত জোরে চেপে বসেনি, যতটা চেপে বসেছিল সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজে। তার কারণ এই অংশের মেয়েদেরও কমবেশি বাড়ির ও বাড়ির বাইরের কাজ করতে হত উপার্জনের জন্য। কিন্তু সাধারণভাবে পটুয়াদের মধ্যেও কিছু সংস্কার ছিলই। তাই পট আঁকতে এবং পটের গান গাইতে জানা সত্বেও পটুয়া পুরুষরাই এই পেশাকে বয়ে নিয়ে চলেছিল বহুকাল। তারাই পট দেখাতে যেত বাড়ি বাড়ি। সমাজে পটুয়া বলতে পুরুষদেরই বোঝাত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে গঞ্জে যে প্রভাব পড়েছিল তাতে পটুয়ারাও আলোকিত হয়েছিল। আলোকিত হয়েছিল পটুয়া নারীরাও। জ্ঞান বিজ্ঞান চেতনায় পটুয়ারাও ক্রমে নিজেদের উন্নীত করে তুলেছিল। একট একটু করে নারীরা বাড়ির বাইরে বেরুতে পেরেছিল। লক্ষনীয় যে পটুয়ারা মুসলিম বা হিন্দু যাই হোকনা কেন এদের মধ্যে পর্দানশীলতা ছিলনা। ফলে বাইরে বের হবার ক্ষত্রে খুব বেশি অসুবিধা হয়নি পটুয়া নারীদের। স্বাধীনতার পরে ক্রমে পরিস্থিতি ও পরিবেশ বদলে যেতে থাকল।
দেশ ভাগের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা এল তাতে প্রাণ গেল বহু লক্ষ মানুষের। দাঙ্গা বাধল। পূর্ব থেকে পশ্চিমে রাশি রাশি মানুষ এসে আশ্রয় নিল। কোথায় বা যাবে তারা! রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার ভাগাভাগিতে শুরু হয় হিংসা, লুঠতরাজ। অজস্র মানুষ মারা যান। গৃহহারা, সর্বশান্ত হয়ে পড়েন লক্ষ লক্ষ মানুষ। অনেক বেশি পরিমানে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হয় নারীরা। যাই হোক দলে দলে মানুষ চলে আসে, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বাড়ে। পটুয়ারাও অনেকেই এসে জড়ো হয় এপারে। সংস্কৃতির মেল বন্ধন হয়। কিন্তু জনসংখ্যা ও দারিদ্র বাড়ে। পট দেখিয়ে আগে যে উপার্জন হত তা কমে যায়।
অন্যদিকে স্বাধীনতার আগে ও পরে শিল্পায়নের কারনে বিভিন্ন রাজ্য থেকেও হাজার হাজার মানুষ এসে হাজির হতে থাকে এরাজ্যে। এই কারনে ও নানা সু্যোগ সুবিধার জন্য সারা পশ্চিমবঙ্গই বিশেষ করে কলকাতা হয়ে যায় এক ছোট ভারতবর্ষ। কলকাতার পাশাপাশি আশেপাশের জেলাগুলোতেও শহরাঞ্চলের প্রভাব পড়ে। নগরায়নের ফল নানাভাবে প্রভাবিত করে গ্রাম বাংলাকে। এত সত্বেও এপার ওপার বাংলার মানুষ সবাই সবাইকে কাছে টানে। সীমান্তের প্রহরীরা লোকসংস্কৃতির ব্যবধান বাড়াতে পারেনা। ওপারে ভাটিয়ালীর সুর এপারের মানুষের গলাতেও শোনা যায়। ওপার বাংলা থেকে আসা এপারের মানুষের কন্ঠে বাউল, মুর্শিদা, ভাটিয়ালী, সারি, জারি শোনাযায় অনাবিল আনন্দে। এপারের লোকসংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয় আরো। অন্য অনেকের সাথে বেশিরভাগ পটুয়ারা ওপার বাংলা থেকে চলে এল এপার বাংলায়। বিভিন্ন জেলার দূর দূরান্তের পটুয়াদের সমন্বয় হল। স্বাধীনতার সমসাময়িক কালে ও পরে পশ্চিমবঙ্গে দেশজ অন্যান্য লোকশিল্পের পাশাপাশি পট ও পটের গানের প্রতি মানুষের কৌতুহল ছিল যথেষ্ট।
বিংশ শতকে গুরুসদয় দত্ত ছিলেন একজন বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। তিনি একদিকে মানব কল্যনে ব্রতী হয়ে ছিলেন, আর আত্মনির্ভর সচেতন সু-নাগরিক গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চেতনায় উন্নীত করতে চেয়েছিলেন মানুষকে। সেই গুরুসদয় দত্তই প্রথম পট ও পটের গান সংগ্রহ করেছিলেন ১৯৩৯ সালের আগে। তাতে বিভিন্ন জেলার লোকশিল্পীদের গান রয়েছে। গুরুসদয় দত্তর সংগৃহীত গানগুলি থেকে জানাযায় সে সময় ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং দিনাজপুর অঞ্চলে পটুয়ারা বসবাস করত। সেখানে যেসব জায়গার নাম পাওয়া যায় সেগুলি হল দ্বারকা, দাদপুর, সোনাকান্দি, আয়াস, কাঁতুরহাট, পানুড়িয়া, পাকুড়হাঁস, বনকাপাসী, দুমকা ও বালিয়া। সম্ভবত এই জায়গাগুলির মধ্যে পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের কিছু জায়গার নাম রয়েছে।
পট ও পটের গানের বৈচিত্র্য
কৃষ্ণের অবতার নামের একটি পটের গানের উদ্ধৃতি দিতে পূর্বেকার কুমিল্লা অঞ্চলের অন্ধকবি ভবানীপ্রসাদ রচিত মানিক চন্দ্রের গানের উদাহরণ দিয়ে তুলনা করেছেন। গুরুসদয় দত্ত লিখেছেন
রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়
গিন্নির পাপে গিরস্ত নষ্ট ঘরের লক্ষী উড়ে যায়।
এই অংশের সঙ্গে ‘৩-৪ শত বৎসর পূর্বেকার কুমিল্লা অঞ্চলে অন্ধ কবি ভবানীপ্রসাদ রচিত মানিক চন্দ্রের গানে আছে-
রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট ভাবি চাহ মনে।
স্তীহ্ণ পাপে গ্রিহ লক্ষী পালাএ আপনে।।’
তা থেকে মনে হয় কয়েকশ’ বছর আগেও পটুয়ারা কুমিল্লা ও আশেপাশের এলাকায় বসবাস করত। ভবানীপ্রসাদ সেই সময়কার পটুয়াদের গান থেকে মানিক চন্দ্রের এই দু’লাইন নিজের কবিতায় সংকলন করেছিলেন। কিংবা ভবানীপ্রসাদের বহুল প্রচলিত পদগুলির থেকে এই দু’লাইন পটুয়াদের গানে এসে পড়েছে। উল্লেখ্য সামাজিক পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্য অভিজাত সমাজ থেকে ক্রমে লোকসমাজে এভাবেই ঢুকে পড়েছে। ফলে অভিজাত সমাজের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যেসব পট প্রাধান্য পেয়েছে সেগুলিতে নারীদের সতীত্ব, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব, নারীদের সত্যনিষ্ঠা ইত্যাদির কথাই বেশি করে প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু স্ত্রী-দের প্রতি স্বামীদের দায়িত্ব বা নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কোন কথা নেই অভিজাত সমাজের পৌরানিক সাহিত্যে। সেই নিয়ম নীতির মতোই লোকসংস্কৃতিতেও সেভাবে জায়গা স্ত্রীজাতির প্রতি যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হয়নি।
একইভাবে চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়কালে বৈষ্ণব কবি শিবাই দাস বা শিবানন্দ রচিত পদের সঙ্গে পটুয়াদের বেশ কিছু গানের মিল পাওয়া যায়। গুরুসদয় দত্ত সংগৃহীত এইরকম বেশ কিছু পটুয়াদের গান সম্বন্ধে গুরুসদয় দত্ত আলোচনা করেছেন। শিবাই দাস বা শিবানন্দ রচিত পদ-
স্বর্গে দুন্দুভি বাজে নাচে দেবগণ।
হরিহরি ধ্বনি ভরিল ভুবন।।
ব্রহ্মা নাচে শিব নাচে আর নাচে ইন্দ্র।
গোকুলে গোয়ালা নাচে পাইয়ে গোবিন্দ।।
নন্দের মন্দিরে গোয়ালা আইল ধাইঞা।
হাতে নড়ি কান্ধে ভার নাচে থৈয়া থৈয়া।
দধি দুগ্ধ ঘৃত ঘোল অঙ্গনে ঢালিয়া।
নাচেরে নাচেরে নন্দ গোবিন্দ পাইয়া।।
আনন্দ হইল বড় আনন্দ হইল।
এদাস শিবাইর মন ভুলিয়া রহিল।।
এই পদের সঙ্গে বালিয়া নিবাসী ত্রিলোকতারিণী চিত্রকরের গানের বেশ কিছু পদের মিল রয়েছে। যেমন-
শিব নাচে ব্রহ্মা নাচে আর নাচে ইন্দ্র
গোকুলে গোপাল নাচে পাইয়ে গোবিন্দ।
কি আনন্দ হলরে ভাই গোকুল নগরে
নন্দের ঘরে নন্দোচ্ছব
নন্দের মাথায় দধি দুগ্ধ ছানা মাখন ঢালিল।
খোল বাজে করতাল বাজে মৃদঙ্গ বাজে হাতে
বাকুমুরারী বাজে সখিগণের মুখে।
চারিধারে সখীগণ মধ্যে শ্যামরায়
ঢলে ঢলে পড়েন দেখ রমণীদের গায়।। ইত্যাদি।
এই রকম চণ্ডীদাস,ঘনরাম দাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবিদের পদ কোথাওবা কৃত্তিবাসী রামায়ণের পদের প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ ঘটেছে পটের গানে ও কাহিনীচিত্রে। শ্রীকৃষ্ণকে আদর্শ চরিত্র করা হয়েছে সহস্র গোপিনীর সঙ্গে সম্পর্কেও তার চরিত্রের কোন দোষ দেখেনি অভিজাত সমাজ। আর তা লোকসমাজেও স্বীকৃতি পেয়েছে সহজেই। ফলত পটুয়াদের সমাজেও নারীদের স্বাভাবিক মর্যাদার অভাব ছিল, এখন তা বেড়েছে ঠিকই তবে তা এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পিংলায় বাড়ি শেরিফান চিত্রকর, মহিলা, বয়স ৫৫। তিনি একা একাও বিভিন্ন স্থানে পট দেখান। কখনো স্বামীর সঙ্গে যান। তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি জানালেন তিনি সাধারণ মুসলিম পরিবারের থেকে পটুয়াদের পরিবারে বৌ হয়ে এসেছেন প্রায় ত্রিশ/বত্রিশ বছর আগে। পটের কাজ জানতেন না। বিয়ের পরে স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির অন্যদের কাছে পটের কাজ ও পটের গান শিখেছেন। পট দেখিয়ে আগে খুব কম পয়সা আয় হত। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন মেলায় পট দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন। কিছু পট বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ সরকারী অর্থ সাহায্য পাচ্ছেন প্রতি মাসে। তবে এখনো অনেকে খুব আর্থিক অসুবিধার মধ্যে আছেন।
কয়েকজন মহিলা পটুয়ার সাক্ষাৎকার
শেরিফান চিত্রকর কলকাতার মিলন মেলায় পট দেখাচ্ছেন।
শেরিফান চিত্রকর জানান, তাদের পাড়ায় প্রায় ৬৩ ঘর পটুয়া আছে। সেখানে কমবেশি ৩০০ পটুয়ার বাস। এরা সবাই পটের কাজ জানে। আর কেউ গেঞ্জির উপর ফরমায়েসী পট আঁকছেন একজন মহিলা চিত্রকর।
তরুণী চিত্রকর ছোট পট দেখাচ্ছেন হস্ত শিল্প মেলায়।
কাজ করে বছরের বিভিন্ন সময়ে। তারা বিভিন্ন হস্ত শিল্প মেলাতে যান পট দেখাতে। আবার বিভিন্ন মরসুমে চাষের কাজও করেন। কেই কেউ ব্যবসা করেন ছোট খাটো। তবে গান গেয়ে পট দেখানোর রেওয়াজ কমে গেছে। পট দেখে অনেকেই। গান শোনে কম।
প্রচলিত ধারার পট রচনার আগে পটের গান শেখা চাইই। পটুয়াদের আলাদা করে এই গান শেখার প্রয়োজন হয়না। কেননা নিজের অজান্তেই পটের গান শেখা হয়ে যায়। এই সব গান প্রচলিত বহুকাল ধরে। প্রচলিত পটের গানের কাহিনী অনুযায়ী চিত্রের বিন্যাস হয়। সেভাবেই পটুয়ারা পট আঁকে। পটুয়াদের বাড়ির ছেলে মেয়ে, বৌ সবাই মিলেই একাজে অংশ নেয়। এখন ছেলেরা অনেকে বাইরে নানা কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মহিলারাই বেশি করে এই কাজে করে থাকে। যাই হোক পূর্ণ দৈর্ঘের পট আঁকা হলে কাহিনীর অদল বদল করা হয়না। তবে খুব দীর্ঘ পট দেখাতে অনেক সময় লাগে। অনেক স্থানে পট দেখানোর জন্য পটকে অনেকে দু-তিনটি খণ্ডে ভাগ করে নেয়। আবার কেউ হয়তো পটকে ছোট করে নেন। সেখানে গান গেয়ে পট দেখানোর সময় পটের গানের কোন অংশ প্রয়োজনে বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট ছবি অনুযায়ী গানের পরের কলিগুলি গাওয়া হয়। কেউ প্রয়োজনে গানের একটু আধটু অদল-বদল করে নেন। তবে সাধারণভাবে গান কেটে ছেঁটে ঠিক করে নেওয়া হয়।
নয়ার মনি চিত্রকর, মহিলা। ছোট বেলায় পড়াশুনা করেছেন স্কুলে। এখন বয়স ৪৮। মেলায় মেলায় পট দেখান। নয়াতে প্রায় ৪০-৪৫ ঘর পটুয়া আছে। জনসংখ্যা প্রায় ২৫০। মনি চিত্রকর খুব ভালো পট আঁকেন। তাঁর ভাই বা গ্রামের অন্যদের সঙ্গে পট দেখাতে যান। ভালোই পট বিক্রি হয়। তবে পটের গান শোনার খরিদ্দার কম। এদের বসতি হিন্দু পাড়া থেকে কিছুটা দূরে। মুসলিম পাড়ার সংলগ্ন এলাকায়। মনি চিত্রকরের কাছে বহু বছরের পুরাতন পট আছে। তাঁর শ্বশুরের ও দাদা শ্বশুরের আঁকা পট। এক সময় যেগুলি নানা পুরস্কার পেয়েছে। মনি চিত্রকর ছাড়াও অন্যদের বাড়ির সব মেয়েরাই পটের কাজ করেন, পটের গান করেন।
মনি চিত্রকর এসেছেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পট দেখাতে।
ভানু চিত্রকরের বাড়ি নয়া গ্রামে। বাড়ি নয়া। মনি চিত্রকরের দাদা। গত বছর রাজ্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে। ছোট বেলায় পট আঁকা ছেড়ে রিক্সা চালাত। তখন পট এঁকে ভিক্ষাকরে দিন চালানো তার পছন্দ ছিলনা। গত প্রায় ১৫ বছরে অবস্থা কিছুটা বদল হয়। আর পট দেখিয়ে ভিক্ষা করতে হয়না। এখন পটের খরিদ্দার আছে। সরকারী সাহায্যে পট দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়। দেশ বেদেশে পট বিক্রি হয়। ঘর সাজাতে পট কেনে বিত্তবানরা। বড় বড় অফিসে পট দিয়ে অফিস সাজানোর রীতিও চালু হয়েছে। জানালেন ভানু চিত্রকর। তাঁর কথায় মেয়েরা অনেকেই পট বিক্রি করে দিন চালায়।
মনি চিত্রকর ও ভানু চিত্রকরের আঁকা পট।
মেলা প্রাঙ্গণের মূল প্রবেশদ্বারে পটের কাজ।
আকাশবানী ও দূরদর্শনের অনুষ্ঠান মঞ্চ সাজাতে পটচিত্রের ব্যবহার।
পট বিক্রি করছেন মহিলা চিত্রকর।
চিত্রকরের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন গবেষক ।
তৃতীয় অধ্যায়
আধুনিক ব্যবস্থায় পটুয়া মহিলাদের পারিবারিক ক্ষেত্রে অবস্থান
পটুয়া সমাজে নারীদের মধ্যে পর্দানশীলতা আগেও সেভাবে ছিলনা, এখনো নেই। সমাজে যারা ‘দিন আনে, দিন খায়’ তাদের সামাজিক সব নিয়ম মেনে চলার সমস্যা আছে। বহুকাল ধরেই পটুয়াদের নিত্যদিনের দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। নিজেদের গ্রাস, আচ্ছাদন ও বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে নারী পুরুষ একত্রে। বাড়ির ছোট ছেলে মেয়েরাও তাতে অংশ নিচ্ছে। লক্ষ্যনীয় সাধারণভাবে পটুয়ারা সামাজিক ন্যায় সম্বন্ধে মোটামুটি সচেতন। শাস্ত্রচর্চা ও সমাজ চর্চার পাশাপাশি সর্বত্র যাতায়াত ও মেলামেশার ফলে তাদের সামাজিক অভিজ্ঞতাও বেশি। এদের মহিলারা সন্তান পালন, রান্না বান্না ও অন্যান্য পারিবারিক কাজের পাশাপাশি পটের কাজও করত। রঙ প্রস্তুত, পট নির্মান, পটের গান রচনা ইত্যাদি সব কাজেই পটিয়সী নারীরা। পট দেখানোর জন্য ৩০-৩৫ বছর আগেও মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে বিভিন্ন যায়গায় যেত। কোথাও কোথাও একা যেত। এজন্য যে কোন অসুবিধা হতনা তা নয় তবে গ্রাস আচ্ছাদন ও বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের ‘জাত ব্যবসা’ ছাড়া কিছু করারও ছিলনা। ফলে পট দেখানোর কাজেও এরা অভ্যস্ত ছিল। মেয়েরাও পট দেখাতো। বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে মেলা মেশার জন্য এদের মনের মধ্যেকার আচ্ছন্ন সংস্কারের মুক্তি হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে এরা নিজেদের কখনো বিচ্ছিন্ন করেনি। এরা শাড়ী পরে মাথায় ঘোমটা দেয়,। মুসলিম ধর্মের অনুসারী হয়েও হিন্দু ধর্মের সনাতন সম্পর্কগুলি এরা আগলে রেখেছে নিজেদের মধ্যেও। তাই শাঁখা, সিঁন্দুর, আলতা, কাজল এদের অনেকেরই অঙ্গ সজ্জার উপকরণ। শাঁখ বাজানো, সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ জ্বেলে মঙ্গল কামনা বা তুলসী তলায় প্রনাম করে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার সংস্কার এখন কমে গেছে। এক সময় হিন্দু নারীদের মতো পটুয়াদের মধ্যেও এই সংস্কার ছিল। তবে যত দিন যাচ্ছে পট দেখানোর রীতি প্রায় উঠে যাচ্ছে। ফলে হিন্দুদের পূজা অর্চনা নিয়ে আগে যেসব পট নির্মান করত এখন তার সংখ্যা খুবই কমে গেছে। নিজেদের মধ্যেও হিন্দু ধর্মের সংস্কারগুলিও প্রতিদিন কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে মুসলিম সমাজের সংস্কার বাড়ছে।
পট দেখানোর জন্য এরা যে পট নির্মান করত তার অধিকাংশই ছিল হিন্দু দেবদেবী ও হিন্দু আখ্যানকে নিয়ে। সীতার বনবাস, সাবিত্রী সত্যবান, চাঁদ সদাগর, যমপুরী, রাধাকৃষ্ণ লীলা, শিবদূর্গার উপাখ্যান ইত্যাদি। ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়েও তারা পট আঁকত। মানব সভ্যতার বিকাশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পলাশির যুদ্ধ, শ্রীচৈতন্যদেব, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের নানা কাহিনী নিয়ে রচিত পটের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। বিশেষ করে মনসা মঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি।
পটুয়ারা পৌরানিক কাহিনীকে নিয়ে আঁকা পট ও পটের গানে নারীর যে মহত্ব বর্ণনা করত, তাতে সিঁদুর, আলতা, শাঁখা, কপালে লাল টিপ থাকত। সতী নারীর বর্ণনায় স্বামী শ্বশুরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ঘর-দোর গুছিয়ে রাখা, আঙ্গিনা নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখা, তুলসী তলায় প্রদীপ দান ইত্যাদির যে নিখুঁত হিন্দু সমাজের চিত্র ফুটে উঠত, সেই গৌরবকে মনে মনে শ্রদ্ধা করত পটুয়ারা। ছোট বয়স থেকেই পটুয়া কিশোরীদের মনে হিন্দু নারীদের আদর্শ ও গৌরব বিশেষ মর্যাদার আসনে থাকত। তাই বড়ো হয়ে যখন সে ঘর সংসার করত তখন সেই শিক্ষাটিকেই তারা বহন করে চলত। একদিকে মুসলমান সমাজের ধর্মীয় ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, অন্যদিকে বহুকাল ধরে চলে আসা হিন্দু নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা কোনটিকেই তারা উপেক্ষা করতে পারতনা। যার জন্যে পটুয়া নারীদের মধ্যে মিশ্রধর্ম ও সংস্কার বহুকাল ধরে চলে আসছিল।
গত ৩০-৪০ বছর ধরে এই অবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলায় ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা, জনশিক্ষা আন্দোলন ইত্যাদির ফলে যে কর্মোদ্যোগ সৃষ্টি হয় তার ফলে বাড়ি বাড়ি পট দেখানোর ক্ষেত্রে নতুন বিষয় বা উপাদান এসে যায়। সমাজ সংস্কার সম্বন্ধে জনচেতনা বৃদ্ধির কাজে সরকারীভাবে পটুয়াদেরও কাজে লাগানো হয়। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এইসব কর্মসূচি গৃহীত হয়। বাড়ি থেকে অর্থ সংগ্রহের পরিবর্তে রাজ্য সরকারই এদের আর্থিক সহযোগিতার কাজে পারিশ্রমিক দেয়। এছাড়াও ভূমি সংস্কারের ফলে অনেকে জমি পায়। তারা কৃষি কাজের সঙ্গে বেশি করে যুক্ত হয়ে পড়ে। সামগ্রিকভাবে আর্থিক উন্নতির ফলে ব্যবসা, পরিবহন ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে পটুয়া নারী পুরুষরা। আর্থিক স্বচ্ছলতা এল ঠিকই কিন্তু সামাজিক নানা কারণে ঐতিহ্যবাহী পটশিল্পের বেশ ক্ষতি হল।
পট দেখিয়ে পারিশ্রমিক অর্জন করাকে সমাজ সম্মানের চোখে দেখতনা। এই ব্যবস্থাকে এরা নিজেরাই ভিক্ষার সঙ্গে তুলনা করত। কথায়, কথায় এরা এখনও বলে ‘পট দেখিয়ে ভিক্ষা করার কাজ ছেড়ে দিয়েছি’। আসলে পট দেখার জন্য কোন নির্দিষ্ট দর দাম ছিলনা। অনেকে এক জায়গায় একসঙ্গে পট দেখত, গান শুনত। কেউ কেউ দু’চার পয়সা দিত। বাড়ির গৃহিনীরা দিত চাল, ডাল, সব্জী ইত্যাদি। কোন নির্দিষ্ট মজুরী ছিল না। নানা ভাবে উপার্জন ছাড়া সংসার চলতনা। পরবর্তী কালে কিছুটা আর্থিক সুরাহা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য পেশায় মন দেয় পটুয়ারা।
নানাভাবে সমাজের চরিত্র বদল হচ্ছে প্রতিদিন। লোকসমাজ যতদিন নিজের ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে পারে, ততদিনই তার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটি অটুট থাকে। কিন্তু প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নানা কারনে কোন সমাজই আবহমান কাল ধরে নিজের স্বাতন্ত্রকে শৃঙ্খলিত করে রাখতে পারেনা। ফলে নতুন নতুন উপকরণ যুক্ত হয়। সমাজের নানা অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে লোকসংস্কৃতিরও নানা পরিবর্তন ঘটে। পটুয়াদের পটের মধ্যেও সমাজের নানা বৈচিত্র ফুটে ওঠে আবার পটুয়াদের আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রেও যেমন যেমন পরিবর্তন হয় তেমনই পটচিত্রকলা, গান ইত্যাদির উপর তার প্রভাব পড়ে। যুগে যুগেই লোকসংগীত ও শিল্পকলা এভাবেই পরিবর্তীত হতে হতে নিজের আধুনিকতা বজায় রাখে। সেদিকথেকে বিচার করলে লোকশিল্প সর্বদাই তার মতো আধুনিক। সাধারণ মানুষ যাকে ন্যাহ্য ও সত্য বলে মনে করে লোকসাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে তাকেই স্থান দেবার চেষ্টা করে।
পটের ছবি এবং গান সেভাবেই নিজেকে আধুনিক করে রেখেছে। সমাজে চাহিদার দিকটিও মাথায় রেখেই লোক শিল্পীদের শিল্প সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়। গত চার দশকে পশ্চিমবঙ্গে নানা পরিবর্তন পটুয়াদের গানে, রঙ–তুলিতে ধরা আছে। গ্রাম উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনা, জনশিক্ষা, সৌচাগারের গুরুত্ব, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন, পুষ্টিবিধান, পালস পোলিও, টীকাকরণ, নারী-পুরুষের সমান অধিকার ইত্যাদি বহু বিষয়ে বিগত বছরগুলিতে পট রচিত হয়েছে ও পটের গানও রচিত হয়েছে। উল্লেখ্য পটুয়ারা আগে গান রচনা করে পরে পট নির্মান করে। আধুনিক ফরমায়েশি পট রচনার পাশাপাশি তারা ট্র্যাডিশন্যাল পটও রচনা করে। বিশেষ করে মাছের বিয়ের পট। সব পটুয়াদের কাছেই এই পটটি রয়েছে। যম পট প্রায় সব ট্র্যাডিশন্যাল পটের শেষ দৃশ্যেই দেখাযায়। যেখানে মনে করিয়ে দেওয়া হয় জীবনের চরম পরিণতির কথা। আর পরলোকে সব অন্যায়ের শাস্তিবিধানগুলিও এই অংশে সংক্ষেপে তুলেধরা হয়। তবে আধুনিক বিষয়ে ফরমায়েশি পটের শেষে যমপটের অবতারণা করা হয়না।
ফরমায়েশি পটগুলি সাধারণভাবে সরকারি নির্দেশেই আঁকাহয়। বিভিন্ন কর্মশালা করে সেখানে লোকশিল্পীদেরকে কতকগুলি সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে ভালোকরে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই বিষয়গুলিকে পরপর সাজিয়ে উপস্থাপন করার মতো করে পরিকল্পনা করে পটুয়ারা। তারা সেখানেই গান বাঁধে, পট আঁকে। কেউ কেউ কর্মশালায় বাঁধা গানগুলি লিখে নেয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো সরকারী প্রশিক্ষকদের সাহায্য নেয়। পরে এগুলি মুখস্ত হয়ে যায়। পট দেখাতে দেখাতে ওদের দক্ষতা এতটাই হয় যে প্রয়োজনে কাহিনী নির্ভর গান সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি করে পরিবেশন করে চলে। এতসব সত্বেও পটুয়ারা কাহিনী নির্ভর পট আঁকতে ও গান গাইতে বেশি ভালোবাসে। কেননা ফরমায়েশি পটের চাহিদা খুবই কম। অনেকটা প্রয়োজনের জন্য এই পট দেখানো হয়। আধুনিকতা পটুয়া নারীদের মধ্যেও এসে হাজির হয়েছ। রেডিও থেকে টিভি, মোবাইওল ফোন বিশ্ব সংসারকে নিয়ে এসেছে ঘরের মধ্যে হাতের মুঠোয়। গণমাধ্যম ও জনসংযোগের নতুন ব্যবস্থায় উথাস্ল পাথাল নতুন প্রজন্ম। এই ব্যবস্থায় পটুয়ারা নারী, পুরুষ ছেলে মেয়ে সবাই টিভি দেখে। নতুন নতুন আধুনিক সিরিয়াল, সিনেমা, হৈ-হুল্লোড়, খবর, গান, গল্প দেখে শোনে। আনন্দের উপকরণে সংযোজন হয় নিত্য নূতন কাহিনী। সীতাহরণ, রামের বনবাস, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, সতীর দেহত্যাগের মতো উপাখ্যানের জায়গায় সামাজিক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ প্রভৃতির প্রতিচ্ছবি। যুক্তি-তক্কো, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহুবিধ মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ। সমাজের দৈনন্দিন ঘটনা প্রবাহকে নিয়ে নানা অনুষ্ঠানের শত সহস্র টিভি চ্যানেলে চব্বিশ ঘন্টা ধরে চলে মনোরঞ্জন।
পট ও গ্রামীন লোক শিল্প সংস্কৃতির প্রতি মানুষের আকর্ষন, অন্যদিকে মোড় নেয়। পটুয়ারাও তা বোঝে। তাই তারা গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসে। পটের কাহিনী, গান বদলায়, রঙ বদলায়। ভেষজ রঙের জায়গায় কেমিক্যাল রঙ কিনে পট আঁকে। অনেকে মোটা দাগের জায়গায় সূক্ষ্ম দাগের ভরাট ছবি আঁকে। পটের গানের সুরে নতুনের ছোঁয়া লাগে। এক্ষেত্রেও গ্রামীন পটুয়া নারীদেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
রাজ্য সরকার ও ভারত সরকারের তত্বাবধানে যেসব মেলা হয়, সেখানে লোক শিল্প প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়। লোক শিল্পীরা তাদের গান শোনা, ছবি দেখায়। পটুয়ারাও পট দেখিয়ে, গান শুনিয়ে অর্থ উপার্জন করে। অনেকে পট কিনে বাড়ি নিয়ে যায় গৃহ সজ্জার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে সরকারী, বেসরকারী অফিস সাজানোর জন্যও পট কেনা হয়। জামা কাপড়ে পটের ছবি আঁকা ফেব্রিক্সের কাজ ভালো দামে বিক্রি হয়। পটুয়ারা সেদিকেও মন দেয়। গৃহ সজ্জার জন্য পটুয়ারা নানান পটের ছবি আঁকে বিভিন্ন গৃহ সজ্জার উপকরণের উপর। ফুলদানী, ঘট, বিভিন্ন পাত্রের উপর রঙ-বে-রঙ এর কাজ করে বিক্রি হয়। পটের গান এখানে অবান্তর হয়ে পড়ে। পট ও পটের গান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও পটুয়ারা এখনো বিভিন্ন পাত্রের উপরে যেসব ছবি আঁকে, সবই বিভিন্ন পৌরানিক কাহিনী আশ্রিত জড়ানো পটের দৃশ্যরূপ। তবু যখন পটের বিক্রির উপরে জোর দেওয়া হয়, তখন একই দৃশ্যের অনেক চিত্ররূপ আঁকা হয়ে থাকে। গান সেভাবে গাওয়া হয় না। মেলায় পটের গানের জন্য ফরমায়েশ করে দু একজন। বেশিরভাগ মানুষই পটের চিত্ররূপ দেখেই সন্তুষ্ট। স্বাভাবিকভাবেই পটের গান রচনায় ও গান পরিবেশনার ঐতিহ্য ক্রমেই গুরুত্ব হীন হয়ে পড়ছে। পট ব্যবসায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে পটুয়ারা নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য দক্ষ পটুয়ার কাছে পট আঁকার তালিমও নিচ্ছে কেউ কেউ।
শেরিফান চিত্রকর জানালেন তিনি এখনো পটের গান রচনা করেন ও পট আঁকেন নিজে নিজে। তাঁর সন্তান ও পুত্রবধূরা তাকে পটের গান রচনায় ও পট আঁকায় সাহায্য করে। পট হয় গানের কাহিনীর অনুসারী। তবে প্রাচীন ট্র্যাডিশন্যাল কাহিনীর যেসব গান বহুকাল ধরে চলে আসছে সেগুলির বিশেষ পরিবর্তন হয়না। শিল্পীর দক্ষতা অনুযায়ী এক একটি পালায় পটের দৈর্ঘ্য বাড়ে বা কমে। এর জন্য গানকে ছোট বড় করার দরকার হয়না। মূল কাহিনী একই থাকে পট দৃশ্য যেসব ঘাটতি তাও গানে গানে মিটিয়ে দেওয়া হয়।
শেরিফান পট দেখানোর জন্য মেলায় ও সরকারী জায়গায় যান। বাড়ির অন্যরা আলাদা পেশায় যুক্ত। তাঁর এক পুত্রবধূ তার সঙ্গে যায়। কাজে কর্মে থাকতে থাকতে সেও পট আঁকা ও পটের গান রচনায় বেশ কিছুটা দক্ষ হয়ে উঠেছে। তিনি সাধারণ মুসলিম পরিবারের থেকে পটুয়াদের পরিবারে বৌ হয়ে এসেছেন প্রায় ত্রিশ/বত্রিশ বছর আগে। পটের কাজ জানতেন না। বিয়ের পরে স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির অন্যদের কাছে পটের কাজ ও পটের গান শিখেছেন। বাড়ি বাড়ি পট দেখিয়ে আগে খুব কম পয়সা আয় হত। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন মেলায় পট দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন। পট দেখার সঙ্গে শোনার রেওয়াজ কমে গেছে। তবে দেশ বিদেশ থেকে অনেকে রেকর্ড করে নিয়ে যাবার জন্যে গান গাইতে বলে। ইন্টারনেটেও এইসব গান দেওয়া আছে। কিছু পট বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ সরকারী অর্থ সাহায্য পাচ্ছেন প্রতি মাসে। সবাই তা পায়না। অনেকে খুব আর্থিক কষ্টে আছে। তাদেরও সরকারী সাহায্য পাওয়া দরকার বলে মনে করেন শেরিফান চিত্রকর।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ বিদেশে পটুয়াদের পট ও পটের গান এক সঙ্গে পঁছে যায়। যারা কৌতুহলী তারা এব্যাপারে খোঁজ নিতে সরাসরি পৌঁছে যায় পটুয়াদের বাড়িতে। বড় ক্যামেরা নিয়ে এদের কেউ কেউ তথ্য চিত্রও নির্মাণ করেন। কেউ কেউ লেখালেখি করে এই প্রাচীন সংস্কৃতির ধারাটিকে নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে যায় পট। পটের বিক্রি বাড়ে। সরকারী উদ্যোগে বহু পটুয়াকে পুরস্কৃত করা হয়। সরকারের সংস্কৃতি দপ্তরে প্রায় সব পটুয়াদের পরিচিতি, ঠিকানা ও ফোন নম্বর রয়েছে। প্রয়োজন মত এদের ডাক দেওয়া হয় পটচিত্র প্রদর্শনের জন্য।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে পটুয়াদের শিল্প কীর্তি ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্প চর্চা কেন্দ্র ও বিভিন্ন গবেষক এই ধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তারাও পট ও পটের গান নিয়ে চর্চা করতে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে পটুয়াদের বাড়ি যায়। পটের ছবি তোলে, গান শোনে রেকর্ড করে নিয়ে যায়। পটুয়াদেরও ডাক পড়ে বিদেশে পট দেখানোর জন্য। গ্রামীণ দরিদ্র শিল্পীদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়। নতুন করে নিজেদের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার, সমৃদ্ধ করার কথা ভাবতে থাকে পটুয়ারা।
পটুয়াদের মধ্যে যারা আগে নিজেদের ‘জাত ব্যবসা’ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল তারাও কেউ কেউ পট শিল্পের কাজে আকৃষ্ট হয়ে পট নির্মান করতে শুরু করে। ক্রমে দেখাযায় পটুয়াদের প্রায় সব পরিবারেই নতুন করে পট নিয়ে চর্চা হচ্ছে। সক্ষম পুরুষ সদস্যরা অন্য পেশায় নিযুক্ত হলেও পরিবারের মহিলারা পটের কাজে সর্বতোভাবে নিজেদের নিয়োগ করেছে। এখন রাজ্য সরকারের কাছে যে পটুয়াদের নামের তালিকা রয়েছে সেখানে যেসব পুরুষ পটুয়াদের নামের তালিকা রয়েছে তারা বেশিরভাগই বেশ বয়স্ক। কিন্তু মহিলা পটুয়াদের বয়স তুলনায় অনেক কম। পাশাপাশি পুরুষ পটুয়া অপেক্ষা নারী পটুয়াদের সংখ্যা অনেক বেশি। মহিলারা বাড়ির কাজের পাশাপাশি পটের কাজ করে কিছু উপার্জন করার চেষ্টা করে। বাড়ির সন্তান সন্ততিরাও তাতে হাত লাগায়। ট্র্যাডিশন্যাল পটের গান ও ছবি তাদের মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে আছে। ফলে তাকে রঙে তুলিতে সাজিয়ে তুলতে খুব অসুবিধা হয়না। কেউ কেউ নতুন দৃশ্যের অবতারণা করে পটকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করে। কেউ কেউ পৌরানিক কাহিনীকে নিয়ে নতুন করে গান বেঁধে পট রচনা করে।
আধুনিক কালে বিভিন্ন ঘটনা ও গল্পকে নিয়েও পট রচনা হয়।স্বাভাবিকভাবেই পটের গান রচিত হয় নতুন গল্পকে নিয়ে। এই আধুনিক পট প্রায় সব পটুয়াদের কাছেই রয়েছে। তবে সেগুলির মধ্যে পারস্পরিক পার্থক্য অনেক বিশেষ করে গানে। একই রকমের বিভিন্ন দৃশ্যকে যখন গান গেয়ে দেখানো হয় তখন তার বর্ণনার ধরণ বদলে যায়। দৃশ্যগুলির মধ্যেও বেশ কিছু পার্থ্যক্য দেখা যায়। আধুনিকা নারীদের স্বার্থপরতা, বিদেশী পোষাকে নিজেদের উগ্র করে তোলা, শাশুড়ি ও পুত্র-বধূর বিবাদ ইত্যাদি মনস্তাত্বিক বিভিন্ন বিষয়ে পট রচিত হয়। যেগুলি একসময় সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। লক্ষণীয় পটগুলিতে যত আধুনিকতা থাকুকনা কেন সর্বত্রই মূলত নারীদেরকে কেন্দ্রকরেই রচিত, পরিবেশিত ও আবর্তিত হতে থাকে।
আধুনিক পটগুলি দেখলে মনে হয় নারীদের শিক্ষার অঙ্গণে প্রবেশ ও সামাজিক কাজ-কর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মতো বিষয়গুলিকে গ্রামীণ সমাজের অধিকাংশ মানুষ দীর্ঘদিন মেনে নিতে পারেনি। পটুয়ারা নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছা যাই হোকনা কেন সমাজের চাহিদাকে সামনে রেখে এধরণের পট রচনা করত। ক্রমেই দিন বদল হয়েছে। সমাজে মহিলারা সন্মানের স্থান দখল করতে পেরেছে। সামাজিক কাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে। আবার সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে মহিলারাও বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে। এইসব বিষয়গুলিকে নিয়ে বহু গান ও পট রয়েছে। অতি সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিকে নিয়েও পট রচিত হচ্ছে। সতী দাহের অভিশাপ, স্ত্রী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বহুকাল ধরেই পটুয়ারা পট দেখিয়ে আসছে। গুজরাটের রূপ কানোয়ারের সতী দাহের মতো ঘটনা নিয়ে এরা তৎক্ষণাৎ পট ও গান রচনা করে। নারী ভ্রুন হত্যা নিয়েও পট আঁকে। নারীদের অধিকার নিয়ে বারে বারেই পট আঁকে পটুয়ারা। শিক্ষা ক্ষেত্রে ও প্রশাসনে নারীদের সাফল্য তাদের চোখ এড়ায় না। সাম্প্রতিক কালে এরাজ্যে নাবালিকা সহ অজস্র নারী ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদ উঠে আসে পটুয়াদের রচনায়। মধ্যমগ্রামের কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা এদের পটে স্থান পায়।
পরিবারে পটুয়া নারীদের গুরুত্ব যথেষ্ট। অভিজাতদের মতো এরা সমাজে পুরুষ নির্ভর নয়। স্বাধীনভাবেই এরা বহু জায়গায় যাতায়াত করে। বাড়ির অন্দর মহলেও এদের কর্তৃত্ব যথেষ্ট। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভারতীয় অন্যান্য নারীদের মতোই। তবে বিবাহ বিচ্ছেদ যে হয়না তা নয়। কদাচিৎ বিবাহ বিচ্ছিদের প্রয়োজন হলে মুসলমান সমাজের প্রচলিত প্রথা এরা মেনে চলে। আগেই উল্লেখ করেছি পটুয়া সমাজে মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীন ও স্বাধিকার নিয়ে চলে। মুসলমান ও হিন্দু ধর্মীয় সমাজের যুগোপযোগী শিক্ষা ও সংস্কারের মধ্যে নিজেদের প্রয়োজন মতো এরা ব্যবহার করে বা মেনে চলে। বাড়ির উঠোনে সকল সন্ধ্যায় গোবর জল দিয়ে নিকিয়ে রাখে। এখন বাড়ির মাটির দেওয়ালে নানা পৌরানিক কাহিনীর মধ্যে থেকে নিজেদের পছন্দের কিছু অংশ এঁকে রাখে। অবশ্য এটা আগে ছিলনা। ইদানিং দূর দূরান্তের লোক তাদের পাড়ায় যায়। তারা যাতে পটুয়াদের আলাদা করে চিনতে পারে সেই জন্যেই নিজেদের পরিচয়কে প্রকাশ্যে আনতেই সম্ভবত দেওয়ালে পটের ছবি এঁকে রাখে। বাড়ির পাশে রাখা বিভিন্ন আসবাব পত্রেও এরা রঙ দিয়ে ছবি এঁকে সাজিয়ে রাখে। শীতকালে যখন তাদের গ্রামে পর্যটক আসে তখন এরা বাড়ির পাশেই পটগুলিকে সাজিয়ে রাখে। অনেকেই পট কেনে। কেউ কেউ গান শোনে, পট ও পটের গান ভিডিও করে নিয়ে যায়। দেখাযায় পট দেখানো, গান শোনানো থেকে দর দাম করে পট বিক্রি করার কাজে এরা বেশ দক্ষ। বিভিন্ন পটের বিভিন্ন দাম। দীঘল পট বা জড়ানো পটের দামে যেমন রকম ফের আছে তেমনি রকমফের আছে পটের এক একটি দৃশ্যেরও।
পঞ্চম অধ্যায়
পটুয়াদের লক্ষ্যদল-পট ও পটের গানের ব্যবহার কারী বা ক্রেতা
পটুয়াদের লক্ষ্যদল হল সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন বিত্ত পরিবারের মহিলারাই তাদের পটের দর্শক ও পটের গানের শ্রোতা। বহুকাল ধরেই তা হয়ে এসেছে। সকাল বেলায় পট নিয়ে বেরিয়ে পড়া ও তারপর সারাদিন পট দেখিয়ে দেখিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিছু পয়সা আর কিছু চাল সবজি সংগ্রহ করে এনে পরিবারের অন্ন সংস্থান হত। স্বাধীনতার আগে ও পর বহুকাল তাই চলেছে। বহুকাল ধরে এরা যথাযথ সম্মান পায়নি। শুধু পটুয়ারাই নয় বাংলার লোকশিল্পীদের সম্মান ছিল তাদের নিজেদের মধ্যে। অভিজাত সমাজ গান, চিত্রকলা কিংবা মুর্তি নির্মানকারী (ভাস্কর) দের সেভাবে সম্মান দিতনা। তবে বাড়িতে গেলে বৌ, ঝি-রা পট দেখত। তা’থেকে রস আস্বাদন করত এবং শিক্ষা গ্রহণ করত। লোকসমাজের ধর্ম শিক্ষা, নীতি শিক্ষার নানা উপকরণ থাকত পটের ছবি ও গানে। আবার সাধারণ সমাজে বৈচিত্র্যহীনতার মধ্যে বাড়িতে বসে যেটুকু রস পাওয়া যেত তা’ও সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করত গৃহস্থরা। সেসময় পটের ছবি ও কাহিনীর মধ্যে লোককাহিনী, পুরাণের গল্প, রামায়ন, মহাভারত, মঙ্গল কাব্যের কিছু কাহিনী নিজেদের মতো করে সাজিয়ে পরিবেশন করত এরা। সেখানে রাম- সীতা, কৃষ্ণ- রাধা, সাবিত্রী-সত্যবান, বেহুলা-লখীন্দর, হর-পার্বতী দেবতা হয়েও মানুষের মতো। একেবারে সাধারণ নিম্ন বিত্ত দরিদ্র পরিবারেরই এক এক জন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন যাত্রা, আকাঙ্খা, ইচ্ছা সবই বদলে যায়। সমাজের অন্তরে ও বাইরে কত পরিবর্তণ ঘটে চলে দিনে রাতে। স্বাধীনতার আগের সারল্য বদলে যায়। পরিবর্তণ হয় সমাজ ও সংস্কৃতির। কল-কারখানায় কাজ পায় লোকে। মেয়েরাও বাইরে বেরোতে শুরু করে। রাস্তা দিয়ে মোটর গাড়ি চলে। জীবনের গতিও ক্রমে বেড়ে চলে। ফলে সমাজের মধ্যেকার মেলা মেশা ও সংস্কৃতির মেল বন্ধন বাড়ে। নতুন নতুন উপকরণ এসে যায় লোকশিল্পে। এত সত্বেও পুরাতন চিন্তা চেতনার মধ্যে যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি। পুরাতন ও ঐতিহ্যের পাশেই জায়গা করে নেয় নতুন। পটের ছবির সঙ্গে গানের মিলগুলোও ধরা থাকে আবার নতুন নতুন আঙ্গীকে তার উপস্থাপনাও হতে থাকে। আগের মোটা দাগের চিত্রের জায়গায় ক্রমেই সূক্ষ্মতার মাত্রাও বাড়তে থাকে। গানের সুরেও নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। পটের আকর্ষণ বাড়ে। কাহিনী চিত্রের সঙ্গে পটের ছবিতে নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা করা হয়। স্বাধীনতার পরেও পটের আকর্ষণ কম ছিলনা। পটুয়ারা দূর-দূরান্তেও পট দেখাতে যেত। তাদের পেশা ও নেশা ছিল পট দেখানো। এর মধ্যে শৈল্পিক আনন্দও ছিল, আবার অন্ন সংস্থানের সুযোগও ছিল। গৃহস্থেরা পট দেখে পয়সা, চাল ইত্যাদি যা দিত তাতে খুব কষ্টেই দিন চলত এদের। কোন রকম স্বাচ্ছ্বল্য ছিলনা। ফলে নিজেদের ধর্ম, জাত ইত্যাদির সম্পর্কে এদের চিন্তার অবকাশ ছিল কম। কেননা এরা ধর্মে মুসলমান হলেও হিন্দু ধর্মের নিয়ম কানুন, লোকাচার সবই এদের জানা ছিল। কেউ কেউ হিন্দু ধর্মের অনেক লোকাচার মেনে চলত। শাঁখা সিন্দুর পরত, লক্ষ্মী পুজো, সকাল-সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো কিংবা শাঁখ বাজানোর প্রথা ছিল। কিন্তু ক্রমে এসব কমতে কমতে একেবারেই অপসারিত হয়ে গেছে। এর কারণ হল ইদানিং বাড়িতে গিয়ে পট দেখানোর রীতি নেই। ফলে হিন্দু ধর্মের বিষয় নিয়ে পট রচনা ও দেখানোর প্রথা মেনে চললেও হিন্দু বাড়ির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আর আগের মত নেই। ফলে ধীরে ধীরে পটুয়াদের মধ্যেকার মিশ্র ব্যবস্থাও ক্রমে দূর হচ্ছে। এবং পটুয়ারা ক্রমে মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মের সঙ্গে বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে বলে পটুয়ারাই জানালেন।
স্বাধীনতার পরে বহুবছর ধরেই পটুয়ারা পট দেখিয়েছে পাড়ায় পাড়ায়, বাড়তে বাড়িতে। গত প্রায় বিশ পঁচিশ বছর ধরে তা কমতে কমতে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কেউ পট দেখতে চাইলে গান শুনিয়ে পট দেখানোতে পটুয়ারা বেশ আনন্দ পায়। পটের নতুন গানও এরা রচনা করে। আর পুরাতন গান সব শিখে নেয় বয়স্কদের কাছে। এটাই রীতি। সাধারণভাবে আগে গান রচনা করা হয় পরে গানের মধ্যেকার ঘটনাগুলোকে দৃশ্যরূপ দেবার জন্য রঙ তুলিতে হাত পড়ে। সবাই যে এক পালায় একই রকমের দৃশ্যরূপ রচনা করে তা নয়। তবে একের সঙ্গে অন্যের বেশ মিল থাকে। বিশেষ করে একই পাড়ায় পটুয়াদের কাজের ধারার মধ্যে বেশি মিল লক্ষ্য করা যায়। পটের গানের মধ্যে অনেক পালাতে প্রায় কোন পার্থক্য থাকেনা। তবে বিভিন্ন পাড়া বা গ্রামে পট ও তার গানের রকম ফের হয়েই থাকে। পট চিত্রের বিষয়বস্তুকে সংগীতাকারে পরিবেশনের ফলে স্থির চিত্র দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই বাংলায় সিনেমা নির্মান ও প্রদর্শন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে হীরালাল সেন বাংলা তথা ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্দেশক। তাঁর নির্দেশনায় কলকাতায় নির্মিত হয় ‘বিল্বমঙ্গল’। এটি প্রযোজনা করেছিল ‘মদন থিয়েটার কোম্পানি অব কলকাতা’। আর ৯ই নভেম্বর ১৯১৯ তারিখে এটি মুক্তি পায়। এর ছ’বছর পরে মুক্তি পায় ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ছবিটি। এরপর ১৯৩০ সালে ঊর্দু ও পার্সিয়ান ভাষায় নির্মিত হয় ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র। ১৯৩১ সালে বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’ নির্মিত হয়। ১৯৩২ সালে নির্মিত হয় ‘চণ্ডীদাস’।
লোকসমাজে প্রথম দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যম হল পট ও পটের গান। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে বেশ আকর্ষনীয় ছিল চলমান পট। পটের ছবি তখন জীবন্ত হয়ে উঠত কল্পনার রঙে। এভাবেই চলেছিল বহুকাল। এরপর কলের গান এল। রেডিও এল। এল সিনেমা। সত্যিকারের চলমান ছবি, একেবারে জীবন্ত। ছবি কথা বলে, গান গায়, হাসে, কাঁন্দে। পটের ছবিতে তা নেই, কল্পনার রঙ দিয়ে তাকে দেখতে হয়। যত নতুন গণমাধ্যমের প্রসার বাড়ে, কমতে থাকে পটের চাহিদা। জীবন্ত সাবিত্রী সত্যবান দেখে আর পটের গানে ছবির আনাগোনা আর তত আনন্দ দেয়না।
নূরজাহান চিত্রকর
নূরজাহান চিত্রকর এর বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা থানার নয়াতে। স্বামী আনোয়ার চিত্রকর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছে ভালো পট আঁকার জন্য। উল্লেখ্য দীঘল পট বা জড়ানো পটের পাশাপাশি এরা দুজনেই চৌকা পটও আঁকে কালিঘাটের পটের আদলে। ছোট অনেকগুলি চৌকাপট পরপর একটি একটি করে দেখাতে দেখাতে গান গেয়ে কাহিনীর বর্ণনাও করে যায়। নূরজাহান নিজে পড়াশোনা করেনি স্কুলেও যায়নি। তবে ছেলে মেয়েদের যত্ন করেই পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। তার মেয়ের বয়স ১৬। ছেলের বয়স ১৩। মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলে এইটে পড়ে। ওরাও পট আঁকে। বেশ ভাল হাত ওদের। জানাল নূরজাহান চিত্রকর। নূরজাহানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কতদিন ধরে পট আঁকছে সে, পট দেখাতে কোথায় কোথায় যায়, পটের গান শোনার জন্য মানুষের আগ্রহ কী রকম, কীভাবে সংসার চলে ওদের, পট দেখানো ছাড়া অন্য কীছু কাজের সঙ্গে ওরা যুক্ত কিনা ইত্যাদি। নূরজাহান সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে সাবলীল ভাবে। বোঝাগেল এরকম প্রশ্নের উত্তর ওদের অনেককেই দিতে হয়। গবেষণার জন্য কলকাতা থেকে, অন্যান্য রাজ্য থেকে, ও দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকেই ওদের কাছে আসে।
নূরজাহান জানালো সে তার শ্বশুর বাড়িতে এসে প্রথম পট আঁকা ও পটের গান গাইতে শিখেছে। তার স্বামী শিখেছে ছোটবেলায় তার বাবার কাছে। এখন ছেলে মেরা দেখতে দেখতেই শিখে নিয়েছে। এর জন্যে ওদের আলাদা করে শেখানোর প্রয়োজন হয়নি। নূরজাহান তার স্বামীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলায় যেত। এখন একাও অন্যদের সঙ্গে যায়। আবার একসঙ্গেও যায়। নূরজাহানের স্বামী তাকে দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর আর এরাজ্যের বহু জায়গায় নিয়ে গেছে। দেশের বাইরে তার যাওয়া হয়নি। তার স্বামী আনোয়ার জাপান, জার্মান ও আরো নানা দেশে গেছে পট নিয়ে। বিদেশে বেশ সুনাম পেয়েছে সে। আয়ও হয়েছে বেশ ভালো। কলকাতায় মেলায় গেলে বেশ দাম পায় পটের। পটের গান শোনার আগ্রহ কম। এর জন্য তাদের খুব বেশি খেদ নেই। কেননা পটের গান শোনানোর জন্য সময় লাগে বেশি। আর এর জন্য দামও পাওয়া যায়না। তাই পট বিক্রি করেই লাভ বেশি হয়। এখন পটতো শুধু কাহিনীর বিন্যাসই নয়। এখন পট, গান বিচ্ছিন্ন কাহিনী বিচ্ছিন্ন চিত্র শিল্পও।পটের কোন বিশেষ অংশের কাহিনী চিত্র আঁকা হয় শাড়িতে, মাটির বাবাশের পাত্রে, বাড়ির নানা আসবাব পত্রে। ঘর সাজানোর নানা উপকরণ এখন পটুয়ারা তৈরি করে কিংবা বাজার থেকে নানা ধরনের জিনিস বা হস্ত শিল্প কিনে তার উপরে রঙ তুলির নানা ধরণের কাজ করে বাজারে পাঠায় বা নিজেরা বাজারে নিয়ে যায়। তার কাছে জানতে পারলাম কোন মেলায় নিজেরা যেতে না পারলে দরদাম ঠিক করে প্রতিবেশীদের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। এভাবেও পট বিক্রি হয়। একটা পুরো গ্রাম পটের আয়এ নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে।
নূরজাহান চিত্রকরের আঁকা চৌকা পট
আঙ্গুরা চিত্রকর
আঙ্গুরা চিত্রকরের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। গ্রামের নাম ঠেকুয়াচক। তাঁর বয়স ২৫-২৬। নিজেই জানাল আঙ্গুরা। পড়াশুনা করেছে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। বাবা মোটর গাড়ি চালায়। পটের কাজ করে না। আঙ্গুরা বিয়ের পরে পট আঁকা শিখেছে স্বামী শ্বশুরের কাছে। ছেলে হয়েছে। এখন ৮ বছরের। তাঁর পাড়ায় ১৫-১৬ টি পটুয়ার বসতি আছে। এখন তারাও সবাই পট আঁকেনা। কেউ গাড়ি চালায়, মেরামত করে, খালাসির কাজ করে, কেউ কেউ রাজমিস্ত্রি।
আঙ্গুরা চিত্রকর বিভিন্ন সরকারি মেলাতে আসে পট দেখাতে। পট বেচে বেশি আয় হয় তার। সরকারি মেলা ছাড়া পাড়ার পটের একজিবিশনেও পট বিক্রি হয়। তবে সব সম পট বিক্রি হয়না মাঝে মধ্যে বেশ বক্রি হয়। সারা বছর সংসার চালানোর প্রয়োজনে বিড়ি বাঁধে। শীতকালে মেলা হয়। তাই শীতের আগে থেকেই পট আঁকা শুরু করে। এর পর সারা শীতকাল পটের কাজে বেশি সময় দিতে হয়। তার স্বামীও পটের কাজে মন দেয়। পাশাপাশি রাজমিস্ত্রীর কাজও করে। সেখানে আয় বেশি। তবে সন্ধ্যার দিকে পট আঁকে। কিংবা যেদিন রাজমিস্ত্রীর কাজে যেতে হয়না সেদিন পট আঁকায় মন দেয়। পট দেখানো ও বিক্রির কাজে আঙ্গুরাকেই বেশি করে সময় দিতে হয়। আঙ্গুরার বেশ ভালো লাগে পট দেখাতে ও গান গাইতে। তবে এখন আর গান শোনার খদ্দের প্রায় নেই। পট কিনে বাড়ি নিয়ে যায় অনেকে। এছাড়া পটচিত্র আঁকা অন্যান্য সামগ্রী যেমন বাঁশের ফুলদানি, মাটির ফুলদানি, গেঞ্জি, জামা, শাড়ি, ব্লাউজে পটের ছবি এঁকে বেশ আয় হয়। গত তিন মাস ধরে সরকারি সাহয্য পাচ্ছে মাসে এক হাজার টাকা করে। তবে আঙ্গুরার ধারণা হয়তো ভোটের জন্যে এই টাকা তারা পাচ্ছে। আঙ্গুরা আমাকেই প্রশ্ন করে জানতে চায় ভোট শেষ হলে আর এই টাকা বন্ধ হয়ে যেতে পারে কিনা।
পুতুল চিত্রকর
পুতুল চিত্রকরের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াতে। পড়াশুনা একেবারেই নেই। বড় মেয়ে সেভেনে পড়ে। বহু প্রজন্ম ধরে এদের পট আঁকা চলছে। পুতুল তার বাবা দাদুর কাছে পট আঁকা শিখেছে। মেলা ছাড়াও ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি, মুম্বাই, বিভিন্ন জায়গায় কর্মশালায় যায়। গান গায় ভালো।
পুতুল চিত্রকরের আঁকা পটের বেশ কদর আছে গাঁয়ে ও দেশে বিদেশে সর্বত্র। তার স্বামীর নাম চন্দন চিত্রকর। তার পটও বেশ উন্নত মানের। চন্দন চিত্রকরের বেশ সুনাম আছে পট শিল্পী হিসাবে। কলকাতায় ও রাজ্যের বিভিন্ন জেলা শহরে পট বিক্রি, ঘর ও দেওয়ালে পট আঁকার ও ডেকরেশনের কাজে পুতুল ও তার স্বামী দুজনেই ডাক পায়। ওরা গ্রামের অন্যান্য শিল্পীদের নিয়ে কাজের কন্ট্যাক্ট নেয়। কলকাতা ও অন্য বিভিন্ন জায়গায় এবছর ২০১৫ সালে কলকাতার অন্যতম ‘আষাঢ় সঙ্ঘ’ ও কাঁকুড়গাছির ‘যুবক সংঘ’ দুর্গা পুজো প্যাণ্ডেল কন্ট্যাক্ট নিয়ে পট এঁকে সাজিয়েছে পুতুল ও তার স্বামী। প্রতিটি প্যাণ্ডেলেই কয়েক লাখ টাকা করে পেয়েছে ওরা।
কোনো কোনো বছর ওরা রাঁচিতেও পুজো প্যাণ্ডেল ডেকরেশনের জন্য যায় সবে মিলে।
আয় কম নয়। আগের তুলনায় অনেক স্বচ্ছন্দেই আছে ওরা। তবে পট আর পটের গান দুটোকে আর এক সংগে পাওয়া যায়না খুব একটা। তবু ওরা গান বাঁধে, পটের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে। ওদের কথায় – ‘যুগের সাথে পটও বদলে যাচ্ছে, আমরাও বদলে যাচ্ছি’।
একসঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পটের নানা সামগ্রী নিয়ে যায়। বাড়িতে ওরা চারজন। মেয়েরাও পট আঁকতে পারে। কখনো কখনো আঁকেও। পটের ছবি আঁকা হয় নানা সামগ্রীতে। বিক্রিও হয়। ঘর সাজানোর কাজে ব্যবহার হয় এসব। পুতুলের কথায় জানাযায়, আগের তুলনায় পটচিত্রের চাহিদা বেড়েছে। সরকারী সহায়তায় নানা স্থানে অংশগ্রহনের সুযোগ বেড়েছে। তবে পটের প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। যত দিন যাচ্ছে ততই আরো ভালো পট আঁকা হচ্ছে।
মীনা চিত্রকর
মীনা চিত্রকর এর বয়স ৭০এর কাছাকাছি। নিজের বয়স সে ঠিক ঠিক জানেনা। অনুমান করেই বয়স জানালো সে। তার বপের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। ১৪-১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয় নয়াতে। স্বামী অমর চিত্রকর। বাবা প্রতিমা তৈরি করত। স্বামীর বেশ নাম ডাক আছে পটের শিল্পী হিসেবে। মীনা চিত্রকরও বেশ ভাল পট আঁকে। স্বামীর কাছে সেই ১৬ বছর বয়স থেকে পট আঁকা শেখা, এরপর পট এঁকেই চলেছে। পটের কদর বেড়েছে। বিক্রি বেড়েছে। তার ছেলে মেয়েরা সবাই পট আঁকে। তাদেরও বেশ সুনাম আছে চিত্রকর হিসাবে। তার বড় মেয়ে স্বর্ণ চিত্রকর এখন একজন বিখ্যাত পট শিল্পী। দেশে বিদেশে সর্বত্র তার খুব নাম। অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। তার মোট চার ছেলে আর দু’মেয়ে। সেজ ছেলেও পট শিল্পী হিসাবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছে।
ইমরান চিত্রকর
ইমরান চিত্রকর এর বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াতে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে। তার আরো তিন বোন আছে। এরা সবাই পটের কাজ করে। বোনেদের স্বামীরাও পটের কাজে বেশ দক্ষ। ইমরানের স্বামী মনিরুল চিত্রকর। বিয়ে হয়েছে ন’ দশ বছর আগে। ছেলে হয়েছে তার। ছেলে ছোট। শ্বাশুড়ি থাকে তার ছোট ছেলের কাছে। সে এখনো পটের কাজ করে। ইমরান পটের কাছে শিখেছে তার বাবার কাছে। আট বছর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে মেলাতে যেত পট দেখাতে। এখনো তার বাবা মেলাতে যায়। মেলায় তার পট ভালই বিক্রি হয়। এবারও বেশ পট বিক্রি হয়েছে কলকাতার মেলাতে। গ্রামে পটের মেলা বসে। সেখানেও পট বেশ বিক্রি হয়। দূর দূরান্তের মানুষ পট দেখতে ও কিনতে আসে। দামও দেয় ভালই। ইমরান বেশ ভালো পট আঁকে। অর্ডার নিয়েও কাজ করে। অন্য কেউ মেলায় গেলে তার আঁকা পট বিক্রির জন্য দিয়ে দেয়। বিক্রি হলে দাম পায়। সারা গ্রামেই এরকম চলে। অন্যের পট নিয়ে যায়। বিক্রি হলে নির্ধারিত দাম পেয়ে যায়। ইমরান এরাজ্যের মধ্যেই পট বিক্রি করে। বিদেশে যায়নি কখনো। পট আঁকা, পট দেখানো ছাড়াও বাড়ির নানা কাজ করে। পটের কাজে এখন মেয়েরাই বেশি সময় দেয়।
মিনু চিত্রকর
মিনু চিত্রকরের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের পিংলা ব্লকের নয়া গ্রামে। বয়স ৩২ বছর। পড়াশুনা করেছে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত। বাড়িতে অন্য কোন আয় নেই। জমি জায়গাও নেই। এখন ওদের সংসার চলে পট বিক্রি করে। মিনু চিত্রকর প্রথমে তার বাবার কাছে পট আঁকার শিক্ষা পায়। পরে পাড়ার সম্পর্কের দাদু বিখ্যাত শিল্পী দুখু চিত্রকরের কাছে পট আঁকা শিখেছে বহুদিন ধরে। তার স্বামী রহিম চিত্রকরও বেশ ভাল পট আঁকে। মিনু চিত্রকর ২০০৫ সালে রাজ্য সরকারের থেকে পুরস্কার পেয়েছে। পটের গান গায় বেশ ভালো। স্বামী রহিম চিত্রকর ও সে দুজনেই সরকার থেকে লোক শিল্পীর ভাতা পায় ১০০০টাকা করে। আশে পাশের গ্রামে দুর্গা পুজোর সময় পুজোর কর্তারা স্টল করে দেয়। সেখানে পট সাজায় মিনু ও আরো অনেকে। তবে ওদের পট সেখানে বিক্রি প্রায় হয়না। লোকে দূর থেকে পট দেখে চলে যায়।
গ্রামের আশে পাশে যেসব মেলা হয় সেখানে অনেক ধরণের স্টল হয়। দূর দূরান্তের লোকজনও আসে। বেচা কেনা হয় অনেক। তবে সেখানে পটের স্টল বসার কোন সুযোগ থাকেনা। তাই পট বিক্রিরও সুযোগ হয়না। কলকাতা বা সরকারী উদ্যোগে যেসব মেলা হয় সেখানে নানা ধরণের আসবাবে ও জামা কাপড়ে আঁকা পটের ছবি বিক্রি হয় বেশি। তুলনায় দীঘল পটের চাহিদা খুবই কম। তবে ইদানিং পটের চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আর জামা কাপড়ে আঁকা পটের বিক্রিও বেশ হয়। এছাড়া মিনু পট আঁকে শাড়িতে। শীতের চাদর, ফুলদানী, হাত পাখা, ও অন্যান্য নানা ধরণের ঘর সাজানোর জিনিসে।
হাসিনা চিত্রকর
হাসিনা চিত্রকরের বয়স ৩০ বছর। বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের কেশববাড়। এই গ্রামে পটুয়ার পরিবারের সংখ্যা ১৬টি। সব কটি পরিবারের প্রায় সবাই পট আঁকে। জমি জায়গা প্রায় কারোরই নেই বললেই চলে। কারো কারো অল্প কিছু জমি, বাস্তু ভিটে আছে। লেখা পড়া খুবই অল্প। তার মেয়ে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। হাসিনা চিত্রকর পট আঁকা শিখেছে তার বাপের বাড়িতে নিজের মা-বাবার কাছ থেকে। তার স্বামী তপন চিত্রকর বেশ ভালো পট আঁকে। দুজনে মিলেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়োজনে আরবান হাট, দূর্গাপুরের হাট ও নানা জায়গায় ওরা যায় পট দেখাতে।
গ্রামের মেলাতে পটের পসরা বসানোর কোন সুযোগ থাকেনা তবে গ্রামের কোন কোন স্কুলের স্যারেরা ডাকলে পট দেখাতে যায়। সেখানে গিয়ে পূর্ব পুরুষেরা কীভাবে পট দেখাত, কেমন করে গান গাইতো এসব ছবি দেখিয়ে গান গেয়ে ছাত্র ছাত্রীদের বুঝিয়ে দেয় হাসিনা ও তপন চিত্রকর। এতে ওদের বেশ ভালো লাগে। পূর্ব পুরুষদের কথা মনে করতে পারলে, বা বলার সুযোগ পেলে ওরা খুশীই হয়। এখন জন চেতনামূলক পটও দেখাতে হয়। তবে এসব ফরমায়েসী পট। মনসা মঙ্গল, সীতা হরণ ও হিন্দুদের অন্যান্য দেব-দেবীদের নিয়ে বহু গান জানা আছে তপন ও হাসিনার। সেসব গান ওরা গায় বহু জায়গায়। হিন্দুদের এত সব নিয়ে ওদের কাজ কারবার হওয়া সত্বেও পুজো পাঠের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই ওদের। ওরা মুসলমানদের ধর্মীয় নিয়ম কানুন মেনে চলে। নামাজ পড়ে। ওদের গ্রাম কেশববাড়ে সবকটি পটুয়া পরিবারই মুসলিম ধর্ম মেনে চলে। তবে পট আঁকে হিন্দুদের দেব দেবীদের নিয়ে।এতে ওদের কোন অসুবিধা হয়ন। হিন্দু মসলমান সম্প্রদায়ের কোথাও ওদের কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি এতকাল। ওদের নিজস্ব ধর্ম থাকলেও ওরা বিশ্বাস করে মানুষই সবার চেয়ে বড়। সব মানুষ্কেই সমান সন্মান দেবার কথা ওরা জোর গলায় ঘোষণা করে।
যখন যেমন নির্দেশ আসে সরকার বা কোন সংস্থা থেকে তখন তেমন ভাবেই পট নির্মান করে, গান বাঁধে, পট দেখায়। তাতেও ওদের কিছু আয় হয়। নিজেরাও অনেক নতুন কথা জানতে পারে।ময়নাতে হাসিনার স্বামী তপন চিত্রকর সরকারী কর্মশালায় ও নানা অনুষ্ঠানে লোকশিল্পী হিসেবে ডাক পায় সমাজ চেতনার পটের গান ও অন্য গান গাইবার জন্যে।
সম্প্রতি আনন্দ বাজার পত্রিকায় লিখেছে ‘বছর ছয়েক আগে কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর পটশিল্পীদের সংস্থা ‘চিত্রতরু’র উদ্যোগে যখন পিংলার নয়া এলাকায় পটের মেলা শুরু হয়েছিলো তখন স্লোগান ছিল ‘শিল্পী বাঁচলে শিল্প বাঁচবে’। উদ্যোক্তারা বুঝেছিলেন, শিল্পকর্ম সৃষ্টি করলেই হবে না, তার বাজার তৈরি করাও জরুরি। সেই কাজে গ্রামের পটুয়াদের সাহায্য করেছিল সংস্থাটি। ফল মিলেছে তাতে। নয়া গ্রামের আনোয়ার চিত্রকরের আঁকা পট এখন ২৫-৩০ হাজার টাকায় বিকোয়।’
গত ছ’বছর আগে পিংলার নয়া এলাকায় পট চিত্রের মেলা শুরু হয়েছিল। সেই মেলা এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এবারের মেলা প্রাঙ্গণ সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছে ‘শিল্প আর শিল্পীর উত্তরণ রীতিমতো স্পষ্ট ষষ্ঠ বর্ষের পটের মেলা ‘পটমায়া’র প্রাঙ্গণে। গত শুক্রবার মেলা শুরু হয়েছে। প্রায় ৭০টি পরিবারের সদস্যরা নিজেদের বাড়িতে শুধু সাবেক পট আঁকছেন না, তাঁদের হাতে শিল্প ফুটে উঠছে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, টি-শার্ট, ছাতা আর ঘর সাজানোর নানান জিনিসে। ঘুরে ঘুরে সে সব পসরা দেখছেন, কিনছেন কলকাতা সহ রাজ্যের নানা প্রান্তের মানুষ। সেই ভিড়ে বিদেশিরাও আছেন। সনাতনী ভাবনার গণ্ডি ছাড়িয়ে বহতা নদীর মতোই পটশিল্প যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে তা গুণগ্রাহীদের আচরণেই মালুম পড়ছে। কেনাকাটা, দরাদরি, কোলাহল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রীতিমতো জমে উঠেছে পটের মেলা পটমায়া ।
পশ্চিমবং রাজ্য সরকার এই শিল্পীদের সম্পর্কে কিছু দায়িত্ব পালনের ঘোষণা করেছে ‘রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্রশিল্প এবং বস্ত্র দফতর আর ইউনেসকো-র উদ্যোগে এই নয়া গ্রামেই তৈরি হবে গ্রামীণ হস্তশিল্প কেন্দ্র (rural craft hub)। তার দায়িত্ব পেয়েছে মেলার উদ্যোক্তা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটিই। রাজ্যের ‘খাদি বিকাশ ইন্ডাস্ট্রি বোর্ড’ এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করবে। পুঁজি হিসেবে ৫ লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই বরাদ্দ হয়ে গেছে। গ্রামের মাঝে পটশিল্পীদের পুরোনো কমিউনিটি ভবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই তৈরি হবে দোতলা ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’। পটুয়াদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা থাকবে সেখানে। সংস্থার পক্ষে নির্মাল্য রায় জানালেন, গ্রামের শিল্পীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হয়েছে বেশ কিছু শিল্প বিপণির। এতে বাজারের পরিধি বাড়বে বলেই তাঁদেরর আশা’ ।
আনন্দবাজার পত্রিকায় মেলার শিল্পী ও সাধারন দর্শক ও ক্রেতাদের বেশ কিছু মতামত উল্লেখ করেছে যেগুলি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। “চিত্রকর বা স্বর্ণ চিত্রকররা জানালেন, ১৫-২০ বছর আগে পটিদার মানে পটশিল্পীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পটের গান শুনিয়ে বেড়াতেন। গান শুনে কেউ দিতেন টাকা, কেউ আবার চাল-ডাল। আর এখন গ্রামের চেহারা বদলে গিয়েছে। মাসে ২০ হাজার টাকা আয় করে এমন পরিবারের সংখ্যা কম নয়। আরও তাৎপর্যপূর্ণ সন্তানদের এই গ্রামের শিল্পীরা পটুয়াই বানাতে চান। সেই লক্ষ্যে প্রতি রবিবার নিয়ম করে পট আঁকার ক্লাস বসে। তাতে যেমন গ্রামের কচিকাঁচারা যোগ দেয়, তেমনই আশেপাশের গ্রামের লোকও আসে।
গ্রামের বাসিন্দা দশম শ্রেণির পড়ুয়া মনোরমা চিত্রকর ভবিষ্যতে পটুয়া ছাড়া আর কিছু হওয়ার কথা ভাবতেই পারেনা। তাই পড়াশোনা আর আঁকা একসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সেই গতানুগতিক পটচিত্র মানে মনসা মঙ্গল, রামায়ণ বা সাঁওতালদের বিয়ে তো ধীরে ধীরে একঘেয়ে হয়ে যেতে পারে। ভাবনার বিষয় বদল কি জরুরি নয়। তা যে জরুরি, বিলক্ষণ জানেন আনোয়ার চিত্রকর, সোনালি চিত্রকররা। আনোয়ার জানালেন, গতানুগতিক পট আঁকার পাশাপাশি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শুরু করেছেন। যা শিল্পীকে আলাদা করে পরিচিতি দেবে। আর আনোয়ারের আঁকা পটেও তারই প্রতিফলন। স্যারোগেট মাদার বা রামের বনবাস আর পাঁচটা গতানুগতিক পটচিত্রের মতো না। বিমূর্ত (অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট) ভাবনার প্রভাব পড়েছে তাঁর আঁকায়। সোনালি চিত্রকরও জানালেন একই কথা। তাঁর আঁকা দুর্গা বা বাবু-বিবির পট বিকোয় ৯ থেকে ১৫ হাজার টাকা দামে। বিদেশের মিউজিয়াম ভাল পটের জন্য ৫০ হাজার টাকাও দাম দেয়। আর পট আঁকা শাড়ি, কুর্তি, সালোয়ার-কামিজ বা ছাতা বিকোচ্ছে দেদার। রয়েছে নানা ঘর সাজানোর জিনিসও।
দুর্গাপুজোর সময়ে এখানে এসে পট আঁকা শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন বিমলকুমার রায় ঘটক। মেলায় এসেছেন দাদা কমল রায় ঘটককে নিয়ে। রজতকান্তি সুর, দেবদত্ত চৌধুরী, মৌসুমী সেনরা মেলা দেখে অবাক। জানালেন দারুণ পরিবেশে মেলা হচ্ছে। একই রকম অভিভূত কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেটের প্রিন্সিপাল কর্মাশিয়াল অফিসার জোনাথন টি ওয়ার্ডের। মনোরম প্রকৃতি আর শিল্পের সমাহার দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘জাস্ট আমেজিং। ছুটির দিনটা দারুণ কাটল।’’
কচিকাঁচা থেকে প্রবীণ গ্রামের সকলেই পট আঁকার পাশাপাশি বিকিকিনিতে ব্যস্ত। মেলার ক’দিন গোটা গ্রামকে একটা আস্ত ক্যানভাস বললেও ভুল কিছু বলা হয় না। সারা দেশ যখন ধর্মীয় আর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা নিয়ে আকচাআকচিতে ব্যস্ত, সেখানে সম্প্রীতির ছবি ধরা পড়ে এই পটের গ্রামে।
গ্রামের পটুয়ারা সবাই মুসলমান। তাঁরা নমাজ পড়েন, রোজা রাখেন। পালন করেন নানা ধর্মীয় আচার। তাঁরাই আবার রামায়ণের, মনসা মঙ্গলের, দুর্গার পট আঁকেন, গান শোনান। ক্যানভাসের রং আর শিল্প ভাবনা ছাপিয়ে যায় সব কিছুকে” ।
পিংলা থানা এলাকার নয়াতে পটচিত্র মেলার উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলা নাটক ডট কম। এখন সেখানে প্রতি বছর মেলা বসে। পটের কেনা বেচা হয়। বহু মানুষ পট দেখতে আসে। পটের গান শুনতেও আসে কেউ কেউ। নানা পত্রপত্রিকায় এই মেলার ছবি ও খবর প্রকাশিত হয়। ফলে দূর দূরান্তের মানুষেরা মেলা ও এই শিল্পীদের সম্পর্কে খবরা খবর পায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ যেমন আসে, তেমনই আসে বিদেশীরাও। এবারের মেলায় এসেছিল আমেরিকার উইসকনসিন গ্রিন বে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ক্রিস্টিন স্টাইল। তাদের কাছে পটুয়ারা পটের দাম পায় বেশি। ফলে পটুয়াদের অনেকেই বেশ খুশি। পাশাপাশি সরকারি সহায়তা নতুন করে শিল্প চর্চায় উৎসাহ দিচ্ছে। এবছরের মেলা সম্পর্কে গণশক্তি পত্রিকায় লিখেছে ‘পর্যটন দপ্তর এখানে পর্যটন কেন্দ্র বানাতে চায়। সেই কেন্দ্রের মালিক হবে এখানকার পটশিল্পীরাই। এখানে পটশিল্পীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে ক্লাস্টার ‘চিত্রতরু’। তার সম্পাদক মণ্টু চিত্রকর জানান, মোট ১৪৪ জন সদস্য রয়েছেন। ‘চিত্রকর’-র উদ্যোগে এখানে প্রতি রবিবার শুরু হয়েছে ছোটদের জন্য পটচিত্র অঙ্কনের প্রশিক্ষণ শিবির। আগামীকালের পটুয়াদের তুলে আনার দায়িত্ব নিয়েছে ‘চিত্রতরু’। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ঝুমুর চিত্রকর, চাঁদনি চিত্রকর, মুসলেম চিত্রকর, রূপযান চিত্রকর সহ মোট ৬৮ জন ৪-৯বছর বয়সীদের পটচিত্র শেখাচ্ছেন স্বর্ণচিত্রকর ও আনোয়ারা চিত্রকর।
এখন ৬২জন শিল্পী পটের গান গাইতে পারেন। আগামীতে পটের গানের কর্মশালা করার ব্যাপারে আগ্রহী মনু চিত্রকর, বাহাদুর চিত্রকর, গুরুপদ চিত্রকররা। ইতোমধ্যেই ভেষজ রঙ ব্যবহার করে পটচিত্র আঁকার কৌশল রপ্ত করা হয়েছে। বাহাদুর চিত্রকর বলছেন, আজ পটশিল্পীরা নিজস্ব ‘আইডেনটিটি’ বা পরিচিতি পেয়েছে পটমেলার সৌজন্যে। দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে নয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে’ ।
মেলায় পটচিত্রের প্রতিযোগিতার আয়োজনও রয়েছে। ২০০৬ সালে গ্রামের যুবক আনোয়ার চিত্রকর ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। আনোয়ার বলেন, “আমি হারিয়ে যাওয়া ‘কালীঘাট পটে’ বেশি জোর দিই। লালগড়ের মাওবাদী কার্যকলাপ নিয়েও পটচিত্র করেছি।” গ্রামের দু’একটি বাড়ি ছাড়া প্রায় সবই মুসলিম পরিবার। কী ভাবে তাঁদের ভাবনায় মঙ্গলকাব্য, শ্যামাসংগীত, রামায়ণ ঘুরপাক খায়? বিদেশ ঘুরে আসা ইয়াকুব চিত্রকর বলেন, “শুনেছি পূর্ব বাংলায় থাকা আমাদের পূর্বসূরিরা পীরের গান নিয়ে পট আঁকতেন। এখানে আসার পর জনপ্রিয়তা পেতেই পুরাণ-মহাকাব্যের দিকে ঝুঁকেছিলেন। আমরা সেই ধারাই অনুসরণ করছি।”
যুগের সঙ্গে পালটেছে পটের কাজও। এখন কাগজ ছাড়াও বিভিন্ন বস্ত্র, ব্যবহার্য জিনিসের উপরে পটের কাজ করে থাকে গ্রামবাসীরা। সময়োপযোগী পটের কাজ করে পটুয়ারা। দুর্গা পুজোয় পটুয়ারা দেবী দুর্গার উপর নানা চিত্র আঁকতে ব্যস্ত থাকে। পুরুষরা বেশিরভাগ রাজ্যের বিভিন্ন মণ্ডপে পটের তৈরি সামগ্রী সাজাতে যায়। আর মহিলারা বাড়িতে পটচিত্র আঁকতে ব্যস্ত থাকে। গ্রামের প্রবীণ পটুয়া স্বর্ণ চিত্রকর জানান, “পুরনো পদ্ধতিতে পট এঁকে এখন আর কেউই ভিক্ষে করে না। এখন পটের আধুনিকীকরণ হওয়াতে সময়োপযোগী পট তৈরি করে গান গেয়ে বিভিন্ন মেলাতে বসেই অনেক টাকা রোজগার করা যায়। বিদেশে গিয়েও ভালো রোজগার করা যায়। আর রোজগারের ভালো মরশুম শারদীয়া।” শুধু দেবদেবীর পটচিত্র আঁকা নয়। মুসলিম অধ্যুষিত এই গ্রামের পটুয়াদের মুখে দেবদেবীর আরাধনার গীতও শোনা যায়।
পটুয়ারা অনেকেই লেখা-পড়া জানে, তবে কম। মাধ্যমিক পাশ করছে এখন। গ্র্যাজুয়েটও হচ্ছে। তারা খুব বেশি পটের পেশায় যুক্ত নয়।
যারা পট আঁকে তাদের লেখা পড়া কম। কিন্তু এরা সামাজিক ক্ষেত্রে খুব সচেতন। এদের অনেক দারিদ্র আছে কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করার কথা ভাবেনা। এদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মানসিকতাও বেশ উল্লেখযোগ্য রকমের। এখন অন্যদের সহযোগিতায় অল্প লেখাপড়া জানা কিন্তু সমাজ সচেতন পটুয়ারা তাদের আঁকা ছবি ও গানগুলিকে নিয়ে বই প্রকাশ
করেছে কেউ কেউ। এদের মধ্যে দুখুশ্যাম চিত্রকরের নাম উল্লেখ করা দরকার। দুখুশ্যাম অত্যন্ত গুনী ও অগ্রণী শিল্পী। তার কাছে অনেকেই পট আঁকা শেখে, পটের গান শেখে। দুখুশ্যাম নির্বিবাদে সবাইকে আপন করে নেয়। শিখিয়ে দেয় যা তার জানা বোঝা আছে। যেকোন বিষয়কে সহজ করে বোঝাতে পারে দুখুশ্যাম। সাবলীলভাবে গান বাঁধতে ও ছবি আঁকতে পারে। দুখুশ্যাম, তার গান ও আঁকা নিয়ে সম্পাদিত একটি বই প্রকাশিত হয়েছ সম্প্রতি ২০১১ সালে। ‘গাঙচিল’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশ পেয়েছে। বইটি সম্পাদনা করেছে সুজিত কুমার মণ্ডল। বইটির নাম ‘দুখুশ্যাম চিত্রকর পটুয়া সংগীত’। অনেক গান আছে তাতে। প্রচলিত ও দুখুশ্যাম চিত্রকরের রচিত পটের গান। নয়ার অনেক মহিলা চিত্রকরের সাফল্যের সঙ্গে দুখুশ্যামের নাম যুক্ত হয়ে রয়েছে। দুখুশ্যাম বইটির শুরুতে শুভেচ্ছা পত্রে লিখেছে লেখক ‘আমার স্মৃতি থেকে গানগুলো টেনে বের করেছে’ । এই বইতে দুখুশ্যামের নানা অভিজ্ঞতার কথা লেখা আছে। পটুয়াদের জন্ম বৃত্তান্ত, সঁওতালদের জন্মলীলা, দুখুশ্যামের আত্মকথা,পটুয়াদের পরিচিতি লেখা আছে। রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, পির-ফকির ও ইসলামি বিষয়ক অজস্র গান ইত্যাদি সংকলিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আছে আধুনিক কালের নানা বিষয় নিয়ে পট। রাজনীতি বিষয়ক, মনিষীদের জীবন ও কর্মকাণ্ড, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সাম্প্রতিক নানা বিষয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, রোগ প্রতিরোধ, জন্ম নিয়ন্ত্রন, সুনামী, শৌচাগারের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে পটের গান আছে দুখুশ্যামের।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র বেশ কয়েকটি পটচিত্রের বই প্রকাশ করেছে ২০১১ সালে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতার মর্মকথাকে পটুয়ারা রূপদান করেছে পটচিত্রের নতুন সাজে। মনিমালা চিত্রকর ও ফরিদ চিত্রকর রূপদান করেছে ঐখানে মা পুকুরপাড়ে কবিতাটিকে। ১২ পৃষ্ঠার এই পুস্তিকাতে ন’টি পটচিত্র আছে। কবিতার নানা উপমাগুলিকে সুন্দরভাবে পটচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা লক্ষনীয়। উল্লেখ্য পুরুষ চিত্রকরের পাশাপাশি নারী চিত্রকরেরা সমান তালে তাদের কাজ করে চলেছে। বরঞ্চ অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে নারীরা।
ফজলু চিত্রকর ও স্বর্ণ চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের ছুটির দিনে কবিতাটির চিত্ররূপ দিয়েছে। ১০টি চিত্রে ‘ওই দেখমা, আকাশ ছেয়ে মিলিয়ে এল আলো, আজকে আমার ছুটোছুটি লাগলনা আর ভালো’র চিত্ররূপ দিয়েছেন এমনভাবে যেখানে মনের আলো পটের রঙে বর্ণময় হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের উৎসব কবিতাটি অপূর্ব চিত্র রূপ দিয়েছে সোনিয়া ও শুভ চিত্রকর। ‘দুন্দুভি বেজে ওঠে ডিম-ডিম রবে, সাঁওতাল পল্লীতে উৎসব হবে’। মনোরম চিত্রকলায় উৎসবের ও পল্লীর চিত্রকে ছোটদের মনের মতো করেই সাজিয়ে তুলেছে সোনিয়া ও শুভ চিত্রকর।
বাঁকু চিত্রকর রামায়ণ-কাহিনি নিয়ে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের আদ্যক্ষর ধরে গান বেঁধেছে।
রামায়ণের মূল ঘটনাগুলোকে লিখেছে অ আ ক খ-র ছোট ছোট ছড়ায়। যেমন, ‘আসন পেতে বসে তিনটি রানি, কৌশল্যা, কৈকেয়ী আর সুমিত্রা জননী’ কিংবা ‘গুহক চাঁড়াল তাদের কথা শুনে/নৌকামাঝে বসে তাঁদের পৌঁছে দিলেন বনে।’ এই বর্ণপরিচয় রামায়ণটি সে উৎসর্গ করেছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায় বইটির সম্পাদনা করেছে। আদ্যন্ত চিত্রিত এই বর্ণপরিচয় রামায়ণ প্রকাশিত হয়েছে ‘টেরাকোটা’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে। বাঁকু চিত্রকরের বাড়ি চণ্ডীপুর। সেখানে ১৫০ ঘর পটুয়া বাস করে। যার মধ্যে ৯০ জনই শিল্পী। অন্যরা কখনো কখনো একাজে যুক্ত হয়ে থাকে, তবে পেশা হিসেবে অন্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। কেউ পাউরুটি, মশলা বিক্রি করে, কেউ করেছে মনোহারি দোকান। বাকু চিত্রকর সম্পর্কে এই বইটিতে লেখা হয়েছে, ‘বাকু চিত্রকরের পরিবারের সবাই পট শিল্পী। বাবার নাম সুধীর চিত্রকর।, ভাই সুকুমার চিত্রকর। বাবা গত হয়েছেন। ভাই ও স্ত্রী রহিমা চিত্রকর দুজনেই দুজনেই পট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বাড়িতে ১০-১২ বছরের এক মেয়ে আছে রেশমা, যার ওপর ঘর সংসারের দায়িত্ব দিয়ে মেলায় মেলায় তাঁরা ঘুরে বেড়ান পট বিক্রির আশায়। কথা বলতে বলতে গল্প শোনাতে শোনাতে অসামান্য নৈপুণ্যে এঁকে চলেন, রঙের তুলিতে টান দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন একের পর এক কাহিনী চিত্র’।
উল্লেখ্য পটুয়াদের লক্ষ্যদল বদলে গেছে অনেক আগেই। এখন তা ক্রমে আরো বদলে যাচ্ছে। আগে পটুয়াদের পট দেখাতে যেতে হত দূর দূরান্তে। পরে ক্রমে তারা পট দেখানোর নানা সুযোগ পায়। মেলা বসে সরকারী উদ্যগে। সরকারী আর্থিক সহায়তা নিয়ে মেলাতে পট দেখাত, গান শোনাত। সরকারী নানা প্রকল্পের প্রচারের কাজেও পট ও পটের গান ব্যবহার করা হত। সেক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে বাড়তি কিছু অর্থের মুখ দেখতে পেলেও কোন ধারাবাহিকতা ছিলনা। পরে মালিনী ভট্টাচার্য ও অন্য কিছু মানুষের সহায়তায় ও পরামর্শে অনেক কর্মশালা হয় পটুয়াদের নিয়ে। এঁরা পরামর্শ দেন জামা কাপড়ে পট আঁকার জন্য। প্রথম প্রথম এর চাহিদা তত ছিলনা, তবে যত দিন যাচ্ছে পট আঁকা জামা কাপড় ও আসবাব পত্রের চাহিদা ক্রমে বেড়েই চলেছে। ফলে পটুয়ারা এখন অনেকটা স্বাচ্ছন্দের মধ্যে আছে। ঘর সাজছে পটের ছবিতে। পট দিয়ে সাজানো হচ্ছে দুর্গা পুজোর প্যাণ্ডেল। সবে মিলে পটুয়াদের কদর বেড়েছে। কদর বেড়েছে পটচিত্রের। কিন্তু পট চিত্রের সঙ্গে যেসব গান ও কাহিনী জড়িয়ে ছিল ও আছে সেগুলি ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে আসছে।
Panoramio – Photo of Pot Maya Festival 2010. banglanatak.com
www.panoramio.com
www.midnapore.in/festival/potmaya/pot-maya-naya-pingla.htmlhttps://www.facebook.com/midnapore…/ms.c.eJw9yskNwDAMA8GOAl
ষষ্ঠ অধ্যায়
ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ও আধুনিক পটের তুলনা এবং পটের গানে বৈচিত্র্যময়তা
প্রাচীনকাল থেকে বহুকাল ধরে বাংলায় চার ধরণের পট দেখা যেত। চক্ষুদান পট, যমপট, গাজিপট, হিন্দু পুরাণ ও ধর্ম কাহিনী নির্ভর রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, কৃষ্ণলীলা ও চৈতন্য লীলা ইত্যাদি পট।
চক্ষুদান পট প্রচলিত রয়েছে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলে। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রধানত সাঁওতাল। তাই এখানকার পটচিত্র শিল্পীরা সাঁওতাল উপকথা অনুযায়ী তাদের জন্মকথা চিত্রিত করত। এই উপকথাকে ‘কো রিয়াক কথা’ বলা হয়ে থাকে। যেখানে জন্মলগ্ন পৃথিবীর আকাশে উড়ছে হংস ও হংসী, কোথাও তাদের বসার মতো একটুকুও জমি জায়গা নেই।
একটি কেঁচো সেই থৈ থৈ জলের মধ্যে মাটির একটা সামান্য ভিত গড়ে তুলেছে। হংস ও হংসী সেই কেঁচোর তৈরি করা মাটিতে বসে দুটো ডিম পেড়েছে। সেই দুটি ডিম থেকে একজন পুরুষ ও একজন নারীর জন্ম হয়েছে। শেষে এই প্রথম নারী পুরুষের মিলনে জন্ম সাঁওতালদের জন্ম হয়েছে। এই ভাবেই সাঁওতাল সমাজ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে।
বহুকাল ধরে সাঁওতাল সমাজে এইরকম গল্প প্রচলিত যে এই সমাজে কোন পরিবারের কেউ মারা গেলে পটুয়ারা মৃতের একটি কল্পিত ছবি এঁকে হাজির হত সেই বাড়িতে। সেই মৃতের সাথে কল্পিত ছবির তুলনা করে রং ও রেখায় ছবিটি সম্পূর্ণ করলেও চোখের তারার জায়গা খালিই রাখা হত। সেই মৃতের শোকগ্রস্ত পরিজনদের চোখের তারা বিহীন ছবি দেখিয়ে বলত চক্ষুহীন অবস্থায় মৃতজন পরলোকে ঘুরে ঘুরে কষ্ট পাচ্ছে। সেই পরিবারের কাছ থেকে কিছু অর্থ দক্ষিনা হিসেবে পেলে তারা চোখের তারা এঁকে দেবে। আর তখনই ওই মৃত জন দৃষ্টি ফিরে পাবে ও পরিত্রাণ পাবে। এইভাবে মৃতজনের পরিবারের কাছ থেকে টাকা ও অন্যান্য জিনিষ পত্র নিয়ে ছবিতে চক্ষুদান করত পটুয়ারা। এটাই হল ‘চক্ষুদান পট’। এখন এধরণের পটের প্রচলন থাকলেও এই পট দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করার রীতি প্রায় নেই। ফলে নতুন করে এধরণের পটও আঁকা হয়না। এই পট আঁকার ক্ষেত্রে জীবিকার প্রয়োজনই ছিল সবথেকে বেশি। কিন্তু বর্তমানে এর প্রয়োজন প্রায় নেই। সেই জায়গায় এখন সাঁওতাল পটের নানা গল্পের সঙ্গে মিশ্রিত ছবিগুলি শিল্প মূল্যে বিক্রি হয়ে যায়। কারও বাড়ির অন্দর মহলে জায়গা নেয় সেই পট। পটুয়ারা এখন বাজারের চাহিদাকে অন্যভাবে যাচাই করে নেয়। ক্রেতাদের চাহিদার কথা মথায় রেখেই আগে গল্প তৈরি করা হত। এখন সেই গল্প বা অন্য গল্পের নানা দৃশ্যরূপ পটচিত্রে রূপদান করা হয়। তাই আগে গল্প ভিত্তিক পট আঁকার প্রথা থেকে
ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন পট ও আধুনিক পটের ছবির মধ্যে গুনগত মানের পার্থক্য ক্রমশঃ বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
Chalchitra
(a painting placed on top of the Durga idol during the Durga Puja Ceremony)
Kumartuli, Kolkata
Early 20th Century A.D.
(A personal collection by Shri Gurusaday Dutt)
২. ‘যমপট’- যমপট ও চক্ষুদান পটের মানসিকতাতেই পারলৌকিক বিষয় নিয়ে আঁকা। তবে এই পট সমতল বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচারিত হয়ে এসেছে। এতে যম অর্থাৎ ধর্মরাজের বিচারে দণ্ডিত মৃত ব্যাক্তির নরক যন্ত্রণা আর পুরস্কৃত ব্যাক্তির স্বর্গসুখের কাহিনীই এঁকে বর্ণনা করা হয়েছে। দণ্ডিত মৃত পাপীর নরক যন্ত্রণার দৃশ্যগুলি ভয়ানক ও বীভৎস। অন্যদিকে স্বর্গে প্রেরিত ব্যাক্তির স্বর্গ রমনীদের সাথে কামকেলীতে রত দৃশ্যগুলি আকর্ষণীয়। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রের চিত্রাঙ্কনই অমার্জিত। তবে এই যমপটের গুরুত্ব অবশ্যই শিল্পকর্ম হিসেবে নয়, এর গুরুত্ব নীতি শিক্ষার বাহক হিসেবে।
৩. ‘গাজিপট’- এই পটগুলি হল মুসলমানি পট। পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার মুসলিম যোদ্ধা ও গাজি – পীরদের বীরত্ব ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ বর্ণনা করা হয়েছে এই শ্রেনীর পটে। তাই এগুলো ‘গাজিপট’ নামেই খ্যাত। এই ‘গাজিপটের’ মধ্যে লৌকিক ব্যাঘ্র দেবী বনবিবির ছবিও দেখতে পাওয়া যায়। অঙ্কনরীতিতে এই পট অন্যান্য পটের তুলনায় পিছিয়েই ছিল। তবে কালু গাজির পট বাংলাদেশের কুমিল্লা, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলায় বিশেষ জনপ্রিয়। মৈমনসিংহ জেলাতেও পটচিত্রের যথেষ্ট প্রচলন ছিল।
৪. ‘হিন্দু পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, কৃষ্ণলীলা ও চৈতন্য লীলা পট’- সমতল বাংলার কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে এই পটচিত্রগুলির গুরুত্ব অনেক বেশী ছিল। হিন্দুদের এই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ধর্মগ্রন্থগুলির কাহিনী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেই পট আঁকা হয়েছে। এর মধ্যে মেদিনীপুরের কৃষ্ণলীলা ও মঙ্গলকাব্যের, বর্ধমান ও নদীয়ার চৈতন্যলীলার এবং বীরভুম ও বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার শাক্ত ও বৈষ্ণব বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনসা মঙ্গলের জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশী। রচনাশৈলীর বিচারেও এই পটের শিল্পীর দক্ষতা ছিল অনেক বেশী স্পষ্ট।
এই সব চিত্রে আদিম মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। কালো, গাঢ় খয়েরি, হলুদ ও কিছু কিছু গাঢ় লালের ব্যবহার দেখা যায়। অবশ্যই সাদা কাপড়ের ওপরে। এর তুলনায় গাজি পটের রঙের ব্যবহার ও রেখা কিছুটা উন্নত। তবে এই সব পটে আদিম চিত্ররীতিরধারাই বেশী। হিন্দু পুরান, মহাকাব্য, মঙ্গলকাব্য নির্ভর পটচিত্রগুলো অনেক বেশী উন্নত রঙের ও রেখার ব্যবহার চোখে পড়ে। যেমন প্রাথমিক লাল, হলুদ, নীল রঙে সীমাবদ্ধ না থেকে একাধিক বর্ণের ব্যাবহার মুগ্ধ করে।
গ্রাম বাংলার পটচিত্রের পরম্পরা এসে পড়ে কালীঘাটে। এখন বাঙালির নিজস্ব এক শিল্প- অভিব্যক্তি হিসেবে দেশে ও বিদেশে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে কালীঘাটের পট। তবে গ্রামের পটচিত্রের পাশাপাশি কালীঘাটের পটে নাগরিক চরিত্র খুব সহজেই চোখে পড়ে। কালীঘাটের পট যতই পৃথিবী বিখ্যাত হোক না কেন তার সৃজনশীলতার কালে এই পটশৈলীর আবেদন শিক্ষিত বাঙালির সমাজে ছিল নিকৃষ্ট চিত্রকর্মের উদাহরণ। তখনকার ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি সমাজে দুই শ্রেণীর চিত্রকলার প্রচলন ছিল ১. উন্নতমানের ২. নিম্নমানের। উন্নতমানের চিত্রকলার ধারা বলতে বোঝানো হতো জয়পুরের চিত্রকলা, আর নিম্ন মানের চিত্রকলা বলতে বোঝানো হত পটুয়াদের আঁকা ছবি। যেগুলো কালীঘাট ও তারকেশ্বরের হাটে এক পয়সা থেকে এক আনা মুল্যে হাজার হাজার বিক্রি হতো। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে, তখনও কালীঘাটের পটের গৌরব উজ্জ্বল সেই সময়ে গ্রামবাংলার হাটে, বাজারে ছবির চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। কালীঘাটের পটের সূচনা ঠিক কোন সময়ে তা স্পষ্টকরে বলা যায় না, তবুও মনে করা হয় উনিশ শতকের প্রথমের দিকে এই পটচিত্রের সূচনা হয়। আর বিশ শতকের প্রথম দিকেও এই চিত্রের ব্যবহার ছিল। এবং এই চিত্রের অবলুপ্তি ঘটে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে।
সাধারণত রুজি রোজগারের জন্যই গ্রামবাংলার পরম্পরাগত শিল্পীরা এসে হাজির হয়েছিলেন ব্যবসা- বানিজ্যে সরগরম এই কলকাতায়। বিশেষ করে কালীঘাটের আশেপাশে। পটুয়া ও চিত্রকর এই দুই পদবি থেকেই অনুমান করা যায় কালীঘাটের পটুয়াদের আদি নিবাস ছিল প্রধানত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও মেদিনীপুরে। উনিশ শতকে কলকাতার জীবন বইতো দুই ধারায়। একদিকে ছিল সাহেব পাড়া আর অন্যদিকে ছিল দেশী পাড়া। এই দুই অধিবাসীদের বিলাস-ব্যসনের দেখা মিলত কালীঘাটের পটে। সাহেব-বিবি প্রতিকৃতি, হাতিতে চেপে সাহেবের বাঘ শিকার, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ছবিতে রয়েছে সাহেব পাড়ার চিত্র। অন্যদিকে উচ্চবিত্ত বাঙালি বাবু কালচারের যে চিত্র টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’, কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বইদুটোতে যা পাই তারই চাক্ষুষ নিদর্শণ রেখে গেছেন কালীঘাটের পটুয়ারা তাঁদের পটচিত্রে।
কালীঘাটের শৈলীর বিশেষত্ব তার আঙ্গিকে নয় তার রূপাদর্শে। তাই দেখা যায় দেবদেবী কিংবা সাধারণ মানুষ সকলেরই রূপ নির্মাণ করা হয়েছে বিশেষ এক আদর্শ নিয়ে তার সৌন্দর্যবোধে। যেমন পটলচেরা চোখ, ধনুকের মতো ভ্রু বাবরি চুল, নধর বপু। এই গুলো ছিল কালীঘাটের পটচিত্রের বিশেষ ধারা। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কালীঘাটের পটুয়াদের প্রধান বিষয় ছিল দেবদেবীর চিত্র। এঁরা শুধুমাত্র যে কালীঘাট এর পটুয়া বলে কালীর পট আঁকবেন তা কিন্তু নয়। এঁরা দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, শিব, গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী, যশোদা, কৃষ্ণ, রাধা, রাম, সীতা, হনুমান, চৈতন্য, ইত্যাদি দেবদেবীর ছবিও এঁকে মনোরঞ্জন করতেন। দুর্গার নানান রূপ আঁকতেন, যেমন- গনেশ জননী, শিব- পার্বতী, অসুর দলনী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কৃষ্ণের নানান ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল যশোদা- কৃষ্ণ, রাধাকৃষ্ণ, ইত্যাদি।
গ্রাম বাংলার পটুয়াদের মতো কালীঘাটের পটুয়াদের আঁকা হয়েছে সেই জ্ঞান, শিক্ষা, আনন্দ, আর পুণ্যকে উদ্দেশ্য করে। রূপ নির্মাণের আদর্শে, পটরচনার উদ্দেশ্যের বিচারেও কালীঘাটের পটুয়ারা তাদের ধর্ম থেকে সরে যাননি। বরং আনন্দদানের ক্ষেত্রে কালীঘাটের পটুয়ারা স্বতন্ত্র হয়ে পড়েছেন গ্রামবাংলার পটুয়াদের থেকে। তাঁদের আঁকায় যেমন দেবদেবী ছিলেন তেমনই ছিল কলকাতার বাবু কালচার। যখন কোন শিল্পী আঁকেন জোড়া পায়রা, মাছ মুখে বেড়াল, সাপের মাছ গেলা তখন তার মধ্যে পুণ্যবোধের থেকে নীতি শিক্ষাই কাজ করে বেশী। সেখানে তিনি দর্শককে দিতে চান নির্মল এক আনন্দ। এই আনন্দ যে কেবল মাত্র গ্রাম বাংলার লতাপাতা ছেড়ে শহরের ‘চৌকস’ পট চিত্র আঁকার জন্য তা কিন্তু নয়। আনন্দদান ছিল নতুনের খোঁজে। নতুন নাগরিক পরিবেশে, ব্রিটিশ চিত্রকলার কাছাকাছি এসে, নতুন রসবোধের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে কালীঘাটের পটুয়ারা গুনগতভাবেই অনেকটা আধুনিক হয়ে ওঠেন। আর তার ছাপ পড়ে তাঁদের পটচিত্রে। কেউ কেউ হয়ে ওঠেন প্রকৃত অর্থে আধুনিক শিল্পী। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – নীলমণি দাস, বলরাম দাস এবং গোপাল দাস এবং একেবারে শেষের দিকে বিখ্যাত পটশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নিবারণ চন্দ্র ঘোষ, কালিচরণ ঘোষ।
তবে বাংলার পটচিত্র নাগরিক মন জয় করে কেবল মাত্র কিছুদিনের জন্য। এই পটচিত্রগুলি ক্রমশঃ তাদের প্রাণশক্তি হারাতে থাকে জার্মান থেকে ছেপে আসা ‘ওলিওগ্রাফ’ এর চাপে। যেখানে একটি সুন্দরী মেয়ে অভিমান করে এক দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে আর তার প্রেমিক যুবক সেই প্রেমিকার মানভঞ্জন না করে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে অভিমান করে। বিদেশী এই গুনগতমান দেশী পটচিত্রের থেকে অনেক বেশী। তাদের রঙের ব্যবহার, রেখার ব্যবহার অনেক উন্নত। এই অসম প্রতিযোগিতায় কালীঘাটের পটুয়ারা দুর্বল হতে থাকে এবং এক সময় সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে যায়। টান পড়ে তাঁদের রুজি রোজগারে। ক্ষিদের তাড়নায় তারা তখন পটচিত্র ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিতে শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে এই ভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায় পটশিল্পের এই সৃজনশীল ধারা।
তথ্যসূত্র
1. জীবেশ নায়ক- লোকসংস্কৃতি বিদ্যা ও লোকসাহিত্য ২০১০, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা -৪০৩
2. গুরুসদয় দত্ত, পটুয়া সংগীত- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৯, পৃষ্ঠা -১৴৹
3. গুরুসদয় দত্ত, পটুয়া সংগীত- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৯, পৃষ্ঠা -১৴৹
4. গুরুসদয় দত্ত, পটুয়া সংগীত- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৯, পৃষ্ঠা -১৷৶০
5. www.shapludu.com/1416/w2.php
6. গুরুসদয় দত্ত, পটুয়া সংগীত- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৯, পৃষ্ঠা – ১৷৶০
7. http://www.ebanglapedia.com/bn/article.php?article.php?id=2069&title=পটচিত্র#.VJw6ukANAA
8. গুরুসদয় দত্ত, পটুয়া সংগীত- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৯, পৃষ্ঠা – ১৷৶০
9. অজিত চিত্রকর-মেদিনীপুর
11. http://www.shapludu.com/1416/w2.php
12. শেরিফান চিত্রকর- নন্দকুমার, পূর্ব মেদিনীপুর
13. আশুতোষ ভট্টাচার্য –বাংলার লোকসাহিত্য, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলকাতা ১ম সংস্করন, ১৯৫৪ পৃষ্ঠা ১৭২
14. গুরুসদয় দত্ত- পটুয়া সংগীত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৯, পৃষ্ঠা ১
15. দীপক কুমার বড়পণ্ডা- পটুয়া সংস্কৃতি : পরম্পরা ও পরিবর্তণ শতাব্দী প্রকাশণ, কলকাতা ১৯৯৯ পৃষ্ঠা-১৭৩-১৭৪
16. আশুতোষ ভট্টাচার্য-বাংলার লোকসাহিত্য পৃষ্ঠা-১৭৩-১৭৪
17. চিত্তরঞ্জন মাইতি, প্রসঙ্গ : পট,পটুয়া ও পটুয়া সঙ্গীত সাহিত্যলোক, ২০০১, কলকাতা পৃষ্ঠা -৪২-৪৩
18. বিনয় ঘোষ-বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজচিত্র কলকাতা, অরুণা বাগচী (প্রকাশক),১৩৮৬ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা -১১৯
19. দেবাশিস বন্দ্যপাধ্যায়, বীরভূমের যমপট ও পটুয়া ১৯৭২, সুবর্ণরেখা, কলকাতা পৃষ্ঠা ১
20. দেবাশিস বন্দ্যপাধ্যায়, বীরভূমের যমপট ও পটুয়া ১৯৭২, সুবর্ণরেখা, কলকাতা পৃষ্ঠা ১
21. দেবাশিস বন্দ্যপাধ্যায়, বীরভূমের যমপট ও পটুয়া ১৯৭২, সুবর্ণরেখা, কলকাতা পৃষ্ঠা ১২
22. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=পটুয়া/
23. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=পটুয়া/
24. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=পটুয়া/
25. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=পটুয়া/
26. http://wbcbc.gov.in/advice/6th-rpt.pdf
27. লোকশ্রুতি (পত্রিকা), লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র কলকাতা volume 3, Issue 2,
December 2004 ‘মেদিনীপুর
জেলার পটুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় জীবন’ প্রবন্ধ- সংগীতা সেনের লেখা থেকে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৪
28. গরুসদয় দত্ত-বাংলার লোকশিল্প ও লোকনৃত্য
(সংকলন গ্রন্থ), ২০০৮, ছাতিম বুকস, পৃষ্ঠা ১৭
29. গরুসদয়
দত্ত-বাংলার লোকশিল্প ও লোকনৃত্য (সংকলন গ্রন্থ), ২০০৮, ছাতিম বুকস, পৃষ্ঠা ১৯
30. আনন্দবাজার
পত্রিকা, ১৬ পৌষ ১৪২২
শুক্রবার ১ জানুয়ারি ২০১৬
মেদিনীপুর, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫,
০১:৩৮:৪১
31. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ পৌষ ১৪২২
শুক্রবার ১ জানুয়ারি ২০১৬
মেদিনীপুর, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫,
০১:৩৮:৪১
32. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ পৌষ ১৪২২
শুক্রবার ১ জানুয়ারি ২০১৬
মেদিনীপুর, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫,
০১:৩৮:৪১
33. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ পৌষ ১৪২২
শুক্রবার ১ জানুয়ারি ২০১৬
মেদিনীপুর, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫,
০১:৩৮:৪১
34. http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=49025dated
01/01/2016
35. http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=49025dated
01/01/2016
37. দুখুশ্যাম চিত্রকর, দুখুশ্যাম চিত্রকর পটুয়া সংগীত
38. বাঁকু চিত্রকর-বর্ণপরিচয়
রামায়ণ পৃষ্ঠা ৭ টেরাকোটা,
বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া