July 1, 2021

ইউরোপের ঐতিহ্য, শিক্ষা ও আমাদের ৫১ দিন

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

শক্তি মণ্ডল ও মায়া মণ্ডল

আমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি। তাই আমি পৃথিবীর বাপ খুঁজিতে যাই না আর।” তিনি বিভোর ছিলেন বাংলার রূপ-মাধুর্যে। তবে কবি রবীন্দ্রনাথ যখন আহ্বান জানান, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে পাড়া”, তখন আর বাইরের ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় থাকে না।

আমাদের মেয়ে রিনি (সংকলিতা), গত দশ বছর ধরে রয়েছে জার্মানিতে গবেষণার কাজে। এখন পি-এইচ. ডি করে সেখানেই অধ্যাপনা করেছে। তারই একান্ত আগ্রহে, পরিকল্পনায় ও ব্যবস্থাপনার ইউরোপের কয়েকটি দেশে ঘুরেছি। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত। মাঝখানে আমাদের ছেলে সুমু (সায়ন্তন) এবং পুত্রবধূ সঞ্চারী কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ইউরোপের মোট ৬টি দেশের অংশবিশেষ ঘুরে দেখেছি। জার্মানি, ইতালি, ভ্যাটিকান সিটি, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্স। পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের মধ্যে ইউরোপের পুরোটাই রয়েছে উত্তর গোলার্ধে। তাই এখানে সারা বছরই শীত। তবে হয়তো বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে এবার এখানে শীতের প্রকোপ ছিল কিছুটা কম। আমরা জানি, ইউরোপের ভূখণ্ড ভারতের ৩.১ গুণ। কিন্তু জনসংখ্যা ভারতের প্রায় অর্ধেক (৫৭%)। প্রসঙ্গত স্মরণ করি যে পৃথিবীতে মোট স্বাধীন দেশের সংখ্যা প্রায় ২০০টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য দেশ ১৯৫টি। যদি আমরা ইউরোপ মহাদেশের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, এখানে মোট দেশের সংখ্যা ৪৪টি। ব্রিটেন বেরিয়ে যাবার পর এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশের সংখ্যা ২৭টি। এই সব দেশগুলিতে সাধারণ মুদ্রা হিসাবে ইউরো চলে। এছাড়া সুবিধা হল, এক ভিসাতে সব সদস্য দেশে যাওয়া যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সবথেকে জনসংখ্যা বহুল এবং শক্তিশালী দেশ হল জার্মানি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তার বাইরে থাকা ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি মানুষ কথা বলেন নিম্নোক্ত ভাষায়-

রুশ-১৪.৫০ কোটি, জার্মান- ৮.৩১ কোটি, ফরাসি ৬.৭৪ কোটি, ইংরেজি- ৬.৬৫ কোটি, ইতালিয়-

৬.৫০ কোটি,  স্পেনীয় – ৪.৬৮ কোটি

এখানকার জনসংখ্যা দীর্ঘদিন ধরে মূলত একই রকম আছে। তবে জার্মানি, রাশিয়া, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশে জনসংখ্যা একটু একটু করে কমছে। এখানে আমাদের ভ্রমণের বিস্তৃত বিবরণ দেবার সুযোগ নেই। কেবল এর কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

রামমোহন ১৮৩০ সালে বিদেশ গিয়েছিলেন জাহাজে করে। রবীন্দ্রনাথও ইউরোপ গিয়েছিলেন জাহাজে চড়ে। তবে আজকাল আমরা সকলেই দূর-দূরান্তে যাই হাওয়াই জাহাজে। আমাদের টিকিট রাশিয়ার অ্যারোফ্লট বিমানে। সোভিয়েতের পতন হয়েছে। কিন্তু বিমানে রয়ে গেছে কাস্তে হাতুড়ি।’ নয়াদিল্লি থেকে মস্কো হয়ে বার্লিনে যেতে সময় লেগেছে প্রায় ১৩ ঘণ্টা। বিমানের পর্দায় দেখলাম বিমান চলেছে ঘন্টায় ১১০০ কিলোমিটার বেগে। ৩৭,০০০ ফুট উপর দিয়ে বাইরের তাপমাত্রা শূনোর ৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে আমরা বার্লিনে পৌঁছেছিলাম (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯-৩০টায়। ভারতীয় সময় বেলা ১-০০টায়। বেশ ঠান্ডা। ৱিনি আমাদের নিতে এসেছিল বিমান বন্দরে। এই সেই বার্লিন, যার প্রতিটি পথে ছড়ানো আছে অনেক রোমাঞ্চকর ইতিহাস। গোথে, কেপলার, মার্কস, এঙ্গেলস আইনস্টাইন, ব্রেট, রোজা লুক্সেমবুর্গের স্মৃতি বিজড়িত এই মহানগর। আবার হিটলারের স্বৈরাচারে বিঁধ্বস্ত বার্লিন।

রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে এসেছিলেন তিনবার। ১৯২১,১৯২৬ এবং ১৯৩০ সালে। আর সুভাষচন্দ্র ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি তার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে গভীর রাতে গোপনে বের হয়ে পাঠানের ছদ্মবেশে গুমা-পেশোয়ার-কাবুল-মস্কো হয়ে আসেন বার্লিনে। এখানে তিনি ছিলেন ১৯৪১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই বার্লিনে বসেই তিনি আজাদ হিন্দ রেডিও (Free India Centre) থেকে রাতে ভারতীয়দের উদ্দেশে ভাষণ দিতেন। পরে ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জার্মানি থেকে সাবমেরিনে করে বিপদসঙ্কুল পথে মাদাগাস্কার পৌঁছান। সেখান থেকে রওনা হন আপানের পথে।

ইউরোপে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, শিরিষ বকুল, কৃষ্ণচূড়ার গাছ নেই। তবে সেপ্টেম্বরের বার্লিন ওক, ম্যাপল, উইলো, ফার, চিনারের নানা রঙ্গিন পাতায় ফুলে অপরূপ। আমরা থেকেছি বার্লিনের গায়ে লাগানো শহর পটসডামে, যেখানে সংকলিতা থাকত। এখান থেকে আমরা অন্য দেশগুলিতে গিয়েছি। আবার এখানে ফিরে দু’তিনদিন করে থেকে গিয়েছি অন্য দেশে। এইসব দেশগুলিতে যা যা না দেখেছি, তার মধ্যে কিছু বিষয়ের উল্লেখ এখানে করছি।

বার্লিন পটাসডাম

এখানে আমরা যা যা দেখেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

(১) ব্রান্ডেনবুর্গ গেট বা ভিক্টোরিয়া বিজয়স্তম্ভ (কোয়াড্রিজা), যাকে বলা হয় জার্মানির প্রতীক।

(২) রাইঘস্টাঘ বা পার্লামেন্ট। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এর চূড়াতে উঠে আমরা মহানগরটিকে সুন্দরভাবে দেখেছি। অনেকে জানেন ১৯৩২ সালের ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাত্র ৩৩% ভোট পেয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল হিটলারের নাজি পার্টি। ক্ষমতায় এসেই ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে তারা রাইখস্ট্যাগ পুড়িয়ে দেয়। মারিনাস ভ্যান দার লুবে নামে হল্যান্ডের একজন যুবকের প্রাণদণ্ড দেয়। বলা হয়, সে একজন কমিউনিস্ট চক্রান্তকারী। কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই বছরের ১০ মে পোড়ানো হয় ২৫,০০০ বিরোধী মতবাদের বই। স্বৈরাচারী হিটলারের শাসনকাল ছিল ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।

(৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমায় বিধ্বস্ত একটি চার্চ

(8) নিহত লক্ষ লক্ষ ইহুদিদের স্মরণে হলোকাস্ট মেমোরিয়াল।

(৫) ইউরোপের সবথেকে উঁচু বিশাল টি. ভি. টাওয়ার।

(৬) আলেকজান্ডার প্লাজ (কেন্দ্রীয় পার্ক)।

(৭) আধুনিক প্রযুক্তির নিদর্শন পাঁচতলা বার্লিন রেলওয়ে স্টেশন।

(৮) স্প্রি নদীর ধারে বার্লিন প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ (ইস্ট সাইড গ্যালারি): যে প্রাচীর গড়া হয়েছিল। ১৯৬১ সালে এবং ধ্বংস হয় ১৯৮৯ সালে। দুই অংশ এক হয়ে শক্তিশালী হয় পুঁজিবাদী জার্মানি। এই দেওয়ালে শিল্পীরা নিয়মিত ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন।

(৯) পটাসডামে অষ্টম শতকের জার্মান সম্রাট ফ্রেডরিক-২-এর বিশাল এলাকাজুড়ে সানসোসি (যত্নহীন) প্রাসাদ। অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা সনসোসি প্রাসাদ ঘিরে থাকে সুসজ্জিত আঙুর বাগিচা।

(১০) সংকলিতার বাঙালি বন্ধুদের আসর। এখানে হয়েছে সংকলিতার গান, নৃত্যশিল্পী শুভম মুখোপাধ্যায়ের নাচ ইত্যাদি। এখানে আমরা দুজনেই কবিতা পাঠ করেছি। করেছি ‘জবাব চাই’ কবিতাটি। দেখেছি ভারতীয় দূতাবাসে অনুষ্ঠিত প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলিত সুর-তরঙ্গ।

ইউরোপের প্রতিটি বড়ো শহরেই বাঙালিরা দুর্গাপুজো উপলক্ষে আনন্দে মেতে ওঠে। যোগ দেয় অবাঙালি এবং বিদেশিরাও। বার্লিনের দুর্গাপুজো এবার ৪৪তম বছরে পড়ল। এখানে আমি পুজো উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে দু’চার কথা বলেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছি। এখানে পুজোর পর প্রতিমাকে প্যাক করে বাক্সবন্দি করে রাখা হয়। পুজোর শেষ দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংকলিতা ও তার তৈরি ব্যান্ডের গান হল। সংকলিতাদের ‘ইউরোপিয়ান কয়্যার’ টিমের গানের মহড়া ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে গানেও অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটল। ইউরোপের সর্বত্র দেখেছি সাদা-কালো কাক। ইউরোপের বহু দেশেই সাইকেলের জন্য রয়েছে আলাদা লেন। বৃদ্ধ বৃদ্ধারা যুবক যুবতীদের মতোই নিশ্চিন্তে সাইকেলে ভ্রমণ করে মজা পান।

পৃথিবীতে যে কটি ভাষা রাষ্ট্রসংঘে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তার অন্যতম হল ইংরেজি। কিন্তু উৎসের দিক থেকে ধরলে ইংরেজি আসলে পশ্চিম জার্মানির একটি আঞ্চলিক ভাষা। প্রায় ৫০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এখানকার ‘এঞ্জেলস’ নামে আদিবাসী গোষ্ঠী ব্রিটেনে যায়। সেখানে বেশ কিছু অংশ দখল করে তারা স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। তাদের ভাষাই ক্রমে স্যাক্সন, জুট্টিস ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব বিস্তার করে। পরে এই ‘এঞ্জেলস’ গোষ্ঠীর নাম থেকেই ব্রিটেনের নাম হয় ইংল্যান্ড এবং তাদের ভাষার নাম হয় ইংলিশ।

ইংরেজি ভাষার মধ্যে মিশে আছে প্রচুর পরিমাণে জার্মান ও অন্যান্য ইউরোপীয় শব্দ। সাম্প্রতিক একটি বিশ্লেষণ থেকে (সূত্র- উইকিপিডিয়া) দেখা গেছে পুরোনো ইংরেজি থেকে আধুনিক ইংরেজি বিপুল পরিমাণে বদলে গেছে। আধুনিক ইংরেজিতে অন্যান্য ভাষা থেকে আত্মস্থ করা শব্দের পরিমাণ নিম্নরূপ-

-ল্যাটিন থেকে ২৯%

–ফরাসি থেকে ২৯%

-জার্মান থেকে ২৬%

-গ্রিক থেকে ৬%

এখনও নিয়মিতভাবে এই ভাষা বিশ্বের অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ-সম্ভাব আত্মস্থ করে থাকে। ভারতীয় ভাষা আত্মস্থ করা এরকম কয়েকটি শব্দ হল-জাঙ্গাল, কারি পাইজামা, বাংলো, বারান্দা, থাকি, শ্যাম্পু ইত্যাদি। আরবি থেকে কফি, অ্যালজেব্রা, লেমন, জেসমিন, অ্যালকোহল, অরেঞ্জ, সুগার, কাবাব ইত্যাদি।

আমরা ইতালিতে পৌঁছেছি বিদ্যাসাগরের জন্মদিন ২৬ সেপ্টেম্বর। দেখেছি (১) রোম, (২) ফ্লোরেন্স এবং (৩) পিসা। এরই সঙ্গে আমরা দেখেছি ভ্যাটিকান সিটি।

আমরা দেখেছি অ্যাম্পিথিয়েটার বা কলোসিয়াম, যা প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য। দু হাজার বছর আগে ইউরোপের সবথেকে ক্ষমতাশালী রোমান সম্রাটদের দম্বের প্রতীক। এটি দেখতে প্রতি বছর আসেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো রোম সভ্যতার সূচনা হয়েছিল কৃষির মধ্য দিয়ে। তখন এখানে এক ধরনের গ্রামীণ গণতন্ত্র ছিল। কৃষির উদ্বৃত্ত ও বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে নগরের পতন হল। গড়ে উঠল অভিজাততন্ত্র (রোমান ফোরাম)। প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক লুঠ ধনসম্পত্তি ও দাস আসতে লাগল। রোেম পরিণত হল দাস-সাম্রাজো। গড়ে উঠল অসীম ক্ষমতাশালী সম্রাট ও তার বিলাস-ব্যাসন। জনগণের কুৎসিত বিনোদনের জন্য তৈরি করা হল এই দৈত্যাকার ব্যবস্থা। এখানে একই দিনে অনেকগুলি করে মারণখেলা হত। যোদ্ধার সঙ্গে যোদ্ধার, মানুষের সঙ্গে বাঘ, সিংহ, ভালুক ইত্যাদির। এক পক্ষের মৃত্যু হওয়ার আগে যুদ্ধ থামত না। এটি তৈরি করতে লেগেছিল অনেক বছর। এটি প্রায় ৫০ মিটার উঁচু। তখন একসঙ্গে ৫০,০০০ মানুষ বসে খেলা দেখত। সম্রাট টিটাস এর উদ্বোধন করেন ৮০ সালে। তিন মাস ধরে চলত উৎসব। খেলাতে প্রাণ যেত 20,000 মানুষ ও ৯,০০০ পশুর।

রোমেরই একজন খেলোয়াড় (গ্ল্যাডিয়েটর) ছিলেন স্পার্টাকাস। তাঁর নেতৃত্বে ৭৩-৭১ খ্রিস্ট খৃষ্টপূর্বাব্দে হয়েছিল ঐতিহাসিক দাস বিদ্রোহ। ভিত কেঁপেছিল রোম সাম্রাজ্যের। আমরা দেখেছি প্রাচীন রোমের শাসন কেন্দ্র রোমান ফোরাম। এটি দীর্ঘকাল মাটির নীচে চাপা পড়েছিল। সম্প্রতি একে খুঁড়ে বের করা হয়েছে। এখানে ঘটেছে কত উত্থান-পতন। এখানেই হত নির্বাচন, বক্তৃতা সভা, বিজয় উৎসব, সেনেট সভা। এখানেই খুন হয়েছিলেন এখানকার সম্রাট জুলিয়াস সিজার। আমরা যে এখন ইংরেজি মাসের নামগুলি ব্যবহার করি, তার উৎপত্তি হয়েছিল রোম থেকে। যেমন জলের দেবতা মার্স থেকে এসেছে মার্চ, জুলাই এসেছে জুলিয়াস সিজার থেকে আগস্ট এসেছে জুলিয়াস অগস্টাসের নাম থেকে। দেখেছি পানথেয়ন। এটি খ্রিস্টধর্ম পত্তনের আগের একটি অন্য ধরনের ধর্মস্থান। এর মাথাটিতে কোনও চূড়া নেই। এখানকার প্রতিটি প্লাজাই নানা ভাস্কর্যে, ছবির পসরা এবং অদম্য সাংগীতিক উপকরণে পরিপূর্ণ। কী প্রাণবন্ত নরনারী। এখানে সান্ধ্য আড্ডা খুবই জমজমাট।

ভ্যাটিকান সিটি

পৃথিবীতে সবথেকে ছোট্যে রষ্ট্রটি হল ভ্যাটিকান সিটি, ক্যাথলিক ধর্মের প্রধান কেন্দ্র, পোপের রাজত্ব। অথচ এককালে পোপের সাম্রাজ্য ও প্রভাব ছিল বিশ্বজোড়া। আর আজ এই রাষ্ট্রের মোট নাগরিক ১,০০০ জন। চৌহদ্দি রোমের একটি প্রান্তের দেওয়াল ঘেরা অংশটুকু। এখানে দেখেছি জগৎ বিখ্যাত সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকা, সিস্টাইন চ্যাপেল ও সেন্ট পিটার স্কোয়ার।এককালে এটি ছিল জলাভূমি। বলা হয় যে এখানে যিশুর ১২ জন প্রধান শিষ্যদের একজন সেন্ট পিটার একটি কুটির তৈরি করে ক্রিতদাস ও দেউলিয়া নাগরিকদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতেন। পরে তার সঙ্গে যোগ দেন সেন্ট পল। সেই অপরাধে সম্রাট নীরো দুজনকেই ৬৫ থেকে ৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ক্রুশকাঠে বিদ্ধ করে হত্যা করেন। সেই কবরের উপর গড়ে ওঠে পুরোনো গির্জা। পরে সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্টধর্মকে রাজধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনিই এখানে বড়ো করে একটি গির্জা তৈরি করে দেন। তবে এখানকার আকর্ষণীয় রাজকীয় স্থাপতা ও চিত্রকলাগুলি তৈরি হয়েছিল রেনেসাঁর যুগে। সিস্টিন চ্যাপেলটি তৈরি হয় ১৪৭৩ থেকে ৯ বছর ধরে। ব্যাসিলিকাটি ১৫০৬ সাল থেকে ১৬২৬ সাল পর্যন্ত ১২০ বছর ধরে।

ধর্মকেন্দ্র ছাড়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এখানকার বৃহৎ গির্জা বা ব্যাসিলিকার দেওয়ালে এবং ছাদে (সিলিং-এ) রাফায়েল, মাইকেল অ্যান্ড্রোলোর-র মতো প্রখ্যাত শিল্পীদের আঁকা নানা ধরনের অসাধারণ সব চিত্র, ফ্রেসকো এবং ভাস্কর্য। বাইবেলের কাহিনি এর ভিত্তি হলেও রেনেসাঁর যুগে এগুলি সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখকেই মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছে।

ফ্লোরেন্স

ফ্লোরেন্স এক স্বপ্নের রাজ্য। বিশ্বের পর্যটকদের প্রিয় গম্ভব্য। আমরা এখানকার সৌন্দর্যে অভিভূত হয়েছি। এটি ইতালির তাসকানি প্রদেশের রাজধানী। ছোটো ছোটো ঢেউ খেলানো পাহাড়ের কোলে অনো নদীর দুপাশে এটি গড়ে উঠেছে। এখানে একটিও বহুতল বাড়ি নেই। সব বাড়িই ৩-৪ তলা।প্রতিটি বাড়িই সোনালি টালি দিয়ে ঢাকা। আমরা এখানে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি শাস্তা মারিয়ার ব্যাসিলিকা,অনো নদীর দুই তাঁর, পিয়েলে মাইকেল অ্যাঞ্জোলো-তে বহিবেলের চরিত্র ডেভিডের মানবীয় মধ্যযুগে এটি ছিল ইউরোপের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। এরা চালু করেছিল ‘ফ্লোরিন’ নামে অতি সুন্দর সোনার মুদ্রা, যা ইউরোপে বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। এরা তৈরি করে শক্তিশালী ব্যাঙ্ক, যেখান থেকে এমনকি ব্রিটেনের রাজারাও (শতবর্ষের যুদ্ধের সময়) ঋণ নেয়। ফ্লোরেন্সকে ১৩শ

থেকে ১৫ শতকে নবজাগরণের জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। মহাকবি দান্তে, পেত্রার্ক, বোকাচ্চিও; মেকিয়াভেলি, মাইকেল অ্যান্ড্রোলো প্রমুখ মহা শক্তিশালী কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিত্রকরের অবদা জন্য ফ্লোরেন্স বিশ্বে অগ্রণী স্থান দখল করে। এখানকার ভাষাই সারা ইতালির মান্য চলিতের মর্যাদা লাভ করে।

আমরা দেখতে গিয়েছি পিসার হেলানো টাওয়ারটিকে। একে মধ্যযুগের বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি বলে মনে করা হয়। কিন্তু অনেকে মনে করেন এটি আসলে স্থাপত্যগত অতিকায় ত্রুটির একটি উদাহরণ। পিসার শাসকরা সিসিলি দ্বীপের ‘সিটি অফ পালার্মো’ জয়ের পর লুঠ করে আনে বিপুল সম্পদ। নিজেদের কৃতিত্বকে জাহির করার জন্য ১১৭৩ সালে তারা বিজয় ময়দানে গড়ে তোলেন মার্বেল পাথরের বিরাট গির্জা (ব্যাসিলিকা), ডোম এবং আটতলা উঁচু এই ঘণ্টা ঘর (বেল টাওয়ার)। তিনটি তলা তৈরির পর নরম মাটির জন্য এটি হেলে পড়ছে তা বোঝা যায়। তারপর নানা সাবধানতা অবলম্বন করে এটি তৈরির কাজ চলতে থাকে। মাঝখানে যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য একশো বছর কাজ বন্ধ থাকে। পরে আটটি তলা শেষ করা হয়। তবে এখনও টাওয়ারটি বছরে ১.২ মিমি (০৫ ইঞ্চি) করে হেলে চলেছে।

পিসা শহরেই ১৫৬৪ সালে সেকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এর বলা হয়, তিনি এই টাওয়ারে পৃথিবীর অভিকর্ষ সম্পর্কে একটি পরীক্ষা করেছিলেন। সেটি হয়তো গল্পকথা। তবে তিনি ‘পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে এই তত্ত্ব সরল ভাষায় বই লিখে প্রচার করায় তাঁর বন্ধু পোপ বারবিরিনিন তাকে সারা জীবনের জন্য গৃহবন্দী করে রাখেন। সেখানেই (১৬৩৮ সালে) তিনি অন্ধ হয়ে যান এবং মারা যান (১৬৪২ সালে)। এর আগে একই ‘অপরাধে’ ১৬০০ সালে পোপের বিচারে জিওর্দানো ব্রুনো-কে নগ্ন করে উল্টো দিকে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। সমরখন্দে তৈমুরী সাম্রাজ্যের সম্রাট উলুম কোকে হত্যা করা হয় ১৪৪৯ সালে, জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে। পিসার একটি বাঙালি রেঁস্তোরা-তে আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছি। গিয়েছি অদূরে ভূমধ্যসাগরের তীরে। সাগরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় প্রশান্তি অনুভব করেছি।

ভেনিস

ফ্লোরেন্স থেকে দ্রুতগামী ট্রেনে আমরা পৌঁছেছি ভেনিসের দ্বারপ্রাস্তে। সংকলিতার দুই বন্ধু ফ্রানচেস্কা ও আলেকজান্দ্রো এখানে আমাদের স্বাগত জানাল। হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া ঘুরে সুমু ও সঞ্চারী (বৌমা) এখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। আমরা এসে পড়েছি অতীতের এক স্বপ্নময় জগতে ।

আমরা অনেকেই শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ পড়েছি। আড্রিয়াটিক সাগরে পো এবং পিয়েতে নদী দুটির বয়ে আনা পলিমাটিতে তৈরি ১১৮ টি ছোটো চরের উপর এই বন্দর শহরটি যেন অদ্ভুতভাবে সরাসরি সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে। সারা বিশ্বে এই অপরূপ নগরীর কোনও তুলনা নেই। রেলওয়ে স্টেশনের পর স্থলযান চলাচলের কোনও পথ নেই। সুন্দর গন্ডোলা, জল-ট্যাক্সি, বোঁট, লঞ্চের ছড়াছড়ি। এখানে চারশো-র বেশি প্রাকৃতিক খাল। প্রথমে ১৫৫৮ সালে তৈরি করা হয়েছিল একটি বড়ো সেতু, রিয়েলটো। এখন সেতুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে চারশো। এজন্য এই কন্দর নগরীটিকে বলা হয় ‘‘ক্যানেলের শহর’ বা ‘সেতুর শহর’। সেতুর পাশে অজস্র জলযান। আর ভেনিসের অলিগলি, জনশিক্ষা ভাবনা, একাদশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা ও দ্বাদশ বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা, 2020 মানে রকমারি আঁকাবাকা বাধানো খাল।

১৩শ শতকে ভেনিস ছিল ইউরোপের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। সে সময় এখানে থাকত ৩৩০০ জাহাজ এবং ৩৬০০০ নাবিক। তখন দেশ-বিদেশের ধনী লোকেরা এখানে নানা কারুকার্যময় প্রাসাদ তৈরি করাতেন। সেখানে আভিজাতের অন্যতম চিহ্ন ছিল চিত্রকলা ও ভাস্কর্য। নবজাগরণে বিশেষ অবদান রাখে ভেনিস। বিশ্বের বৃহত্তম তেল-রঙে আঁকা চিত্র টিনটোরেটোর ‘প্যারাডাইস’ আঁকা হয়েছিল এখানেই।

তবে কলম্বাসের নতুন মহাদেশ আবিষ্কার ও পরবর্তীকালে নতুন বাণিজ্য পথ আবিষ্কারের ফলে ভেনিসের গৌরব কমতে থাকে। আইন অনুসারে এখানে কোনও বাড়ির কাঠামোতে বদল করা চলে না। তাই এটি সবথেকে সংরক্ষিত মধ্যযুগের শহর। তবে এখন প্রতি বছর শহরটি ৯ ইঞ্চি করে মাটিতে বসে যাচ্ছে। বছরে ১০০ বার করে এখানে বন্যা হচ্ছে।

আমরা মুগ্ধ চোখে দেখেছি ভেনিসের অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ বুরানো। এখানের প্রথম বাসিন্দা ছিল মাত্র কয়েক ঘর জেলে। তারা ঠিক করেছিল, আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন রঙে বাড়ির দেওয়াল রঙ করবে। এখনও সেই ধারা বজায় রয়েছে। এটি তাই আশ্চর্য এক রঙিন দ্বীপ। আমরা ফিরলাম বার্লিন। বিমান থেকে দেখলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত আল্পস পর্বতমালা। এই আল্পস ছড়িয়ে আছে ১২০০ কিলোমিটার জুড়ে ইউরোপের অনেকগুলি দেশে। প্রস্থ প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। তবে লম্বায়, চওড়ায় এবং উচ্চতায় হিমালয় অনেক বড়ো। হিমালয়ের দৈর্ঘ্য ২৩০০ কিলোমিটার। প্রস্থ ১৫০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার। পৃথিবীর উঁচু চূড়াগুলি রয়েছে হিমালয় ও কারাকোরাম পর্বতমালায়। সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্টের উচ্চতা ২৯:০২৯ ফুট। অন্যদিকে আল্পসের সর্বোচ্চ চূড়া মন্ট ব্লাঙ্কের উচ্চতা ১৫,৭৭৭ ফুট।

সুইজারল্যান্ড

বার্লিন থেকে বিমানে করে আমরা এসে পড়েছিলাম চির বসন্তের দেশ সুইজারল্যান্ডে। চারদিকে যা দেখেছি, তাতে অবাক হয়েছি। এত সুন্দরও কোনও দেশ হতে পারে। আমরা উঠেছিলাম এই দেশের সবথেকে বড়ো এবং আন্তর্জাতিক শহর জুরিখে। জুরিখ হ্রদের স্বচ্ছ নীল জল আমাদের মন ভরিয়ে দিল। লঞ্চে করে আমরা এক ঘণ্টা ধরে হ্রদের চারদিক ঘুরে দেখলাম। এরপর আমরা এলাম আর একটি শৈল শহর লুসার্নে। এখানে বইছে বসন্তের রোমাঞ্চকর আবহাওয়া। দেখলাম আল্পসের পিলেতাস ও রিগি পাহাড়ের পাদদেশে রিউস নদী এবং তার উপর তৈরি নয়নভোলানো চ্যাপেল সেতু। অনেক বিয়ের অনুষ্ঠান এখানে হয়।

পরদিন সুইজারল্যান্ডের একেবারে মধ্য ভাগ দিয়ে সীমান্তে অবস্থিত জেনেভা হ্রদ পর্যন্ত দীর্ঘ সোনালী ভ্রমণ (Golden Panoromic Trip)-এর জন্য বিশেষভাবে সজ্জিত আরামদায়ক ট্রেনে চেপে বসলাম। যেদিকেই দেখি সবুজ ঘাসের গালিচা, রঙিন গাছপালা, ছোটো ছোটো হ্রদ, বিচিত্র সব পাহাড়ের সারি, ছবির মতো ছোটো ছোটো সাজানো বাড়ি। দূর থেকে আমরা দেখলাম জাংফ্লোজোেক পর্বতশৃঙ্গ। এখানেই রয়েছে ইউরোপের সবথেকে উঁচু ইয়াংফাউ রেলওয়ে স্টেশন (১১,৩৩২ ফুট)।ইউরোপের সর্বত্র আমরা দেখেছি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য নিরন্তর কতো আয়োজন। আর আমাদের দেশে কত কিছু থাকতেও কী নিদারুণ অবহেলা। ভূস্বর্গ কাশ্মীরকেও আমাদের শাসকশ্রেণি রাজনৈতিক স্বার্থে নরককুন্ডে পরিণত করেছে।

শুরুতে লুসার্ন থেকে ইন্টারলকেন পর্যন্ত ট্রেনে সব ঘোষণা হচ্ছিল সুইস জার্মানে। তারপর মন্ট্রো জংশন পর্যন্ত ঘোষণা হতে থাকল সুইস ফরাসিতে। এই বৈচিত্রোর কারণ হল চারশো বছরেরও আগে এই এলাকার চারটি ভাষাভাষীর মানুষ অস্ট্রিয়া ও বুরগুন্ডির বিরুদ্ধে একসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য গঠন করেছিল একটি কনফেডারেশন। তারপর তথাকথিত ‘পবিত্র’ রোমান সাম্রাজ্য থেকে মুক্তিলাভ করে তারা ১৬৪৮ সালে তৈরি করেছিল স্বাধীন দেশ সুইজারল্যান্ড। তখন থেকে এরা একসঙ্গেই আছে। সুইজারল্যান্ড এর সরকারি ভাষা চারটি। মোট ৭৫.৮১ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে এই চার ভাষাভাষীর সংখ্যা হল নিম্নরূপ

১. সুইস জার্মান ৬৩%

২. সুইস ফরাসি ২২.৭%

৩. সুইস ইতালিয় ৮.৪%

৪. রোমানিশ (স্থানীয় ইতালিয়) ০.৪%

এত কম জনসংখ্যার দেশে চারটি সরকারি ভাষা থাকার ফলে কোনও অসুবিধা তো হচ্ছেই না, বরং সংহতি আরও দৃঢ় হয়েছে। যে যার মাতৃভাষায় শিক্ষা ও সমস্ত সরকারি-বেসরকারি কাজ করতে পারায় তাদের বিকাশ হচ্ছে স্বচ্ছন্দভাবে। জানতে পারলাম, এখন প্রযুক্তির বিপুল প্রসারের ফলে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষাগুলিতে রূপান্তর ওদের কাছে অনেক সহজ হয়ে গেছে।

ওদের এই ভাষা-গণতন্ত্র দেখে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার দুর্দশা মনে যন্ত্রণার জন্ম দিল। সারা

বিশ্বে কোন্ মাতৃভাষায় কতজন কথা বলেন, তার প্রথম পাঁচটি ভাষাভাষীর চিত্রটি নিম্নরূপ—

মান্দারিন (চিনা)

১. স্পেনিয় – ১১.৮ কোটি

২. ইংরেজি – ৪৬.০ কোটি

৩. ইংরেজি-৩৭.৯ কোটি

৪. হিন্দি – ৩৪.১ কোটি

৫. বাংলা – ২২.৮ কোটি

সাম্প্রতিক আর একটি তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে এখন সারা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। অথচ আমাদের দেশে ইংরেজির চাপ এবং হিন্দিওয়ালাদের আগ্রাসনে বাংলাভাষা ও বাঙালিরা ক্রমে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। দুঃখজনক যে এই বিষয়ে শাসক বা বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দলই সোচ্চার নয়।

সুইজারল্যান্ডে এখন মোট স্বশাসিত ক্যান্টনের সংখ্যা ২৬টি। লোকসংখ্যা ৭৬ লক্ষ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে ১৯৫ জন।

প্রকৃতি যেন সব সৌন্দর্য উজাড় করে সাজিয়ে তুলেছে এই দেশের সব কিছুকে। সৌন্দর্যের অসীমতায় ভাসতে ভাসতে আমরা এসে পৌঁছালাম মন্ট্রিয়াক্স পাহাড়ের পাদদেশে অতুলনীয় জেনেভা হ্রদে। দেশ বিদেশের পর্যটকদের কোলাহলে সদ্য মুখরিত জেনেভা। আমরা এখানে হ্রদের ধাত্রে প্রাণভরে আনন্দের সুবাস নিলাম। লঞ্চের ছাদে চড়ে কলি (কাপুচিনো) খেতে খেতে যতটা পারি সুখের স্বাদ নিলাম।।

আমরা এসে পড়েছি ইতিহাসের বহু উত্থান-পতনের গীলাভূমি স্পেনে। এর অবস্থান ইউরোপের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে। এর গায়ে লাগানো ছোট্ট দেশ পর্তুগাল আর ঠিক দক্ষিণে বিশাল আফ্রিকা মহাদেশ।

আমরা অনেকেই আলতামিরার গুহাচিত্রের কথা ইতিহাসে পড়েছি। এখন থেকে প্রায় ৩৮১০০ বছর আগে থেকে ৪,০০০ বছর ধরে প্রস্তর যুগের মানুষেরা এখানকার আঠারোটি গুহাতে বাস করেছে। গুহার দেওয়াল ও ছাদে শিকারের ছবি এঁকেছে ১০০টিরও বেশি। আমরা আলতামিরায় যেতে পারিনি। কিন্তু স্পেনে এসে এসম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি।

নৃতত্ত্ববিদরা বলেন হোমো ইরেকটাস, নিয়েনতারথেল, ক্রো-ম্যাগননের স্তর পেরিয়ে আধুনিক চেহারার মানুষের বিকাশ হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকাতে। তখন তারা ছিল ফলমূল সংগ্রহকারী। তারপর তাদের রূপান্তর ঘটতে থাকল শিকারি হিসাবে। তারপর পশু পালনকারী হিসাবে। বহুকাল ধরে এরা ছিল অরণ্যচারী এবং ভ্রাম্যমান। এই মানুষদেরই একটি দল হয়তো ফলমূল, শিকার বা চারণভূমির সন্ধানে জিব্রালটার প্রণালী পেরিয়ে এই স্পেনে এসে গুহাবাসী হয়েছিল। আবার অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে আদিম মানুষেরা পূর্ব আফ্রিকা থেকে আনাতোলিয়া (তুরস্ক) হয়ে বসপোরস প্রণালী পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রিস, ইতালি, স্পেন ও রাশিয়ায়। আমরা স্পেনে এসে আদিম মানুষদের এই জীবন সংগ্রামের কাহিনির সঙ্গে আরও বেশি করে পরিচিত হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি। স্পেনে আমরা বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছি বার্সেলোনায়।

আমরা প্রাণভরে দেখেছি বার্সেলোনা বন্দর ও বিস্তৃত সমুদ্র সৈকতের রূপমাধুর্য। ফুটবল পাগল শহরে আমরা দেখলাম অলিম্পিক বন্দর। দেখলাম পাহাড়ের ঢালে ক্যাটালোনিয়া রাজপ্রাসাদ, রোমানদের তৈরি প্রাচীন শহরের অলিগলি, প্রখ্যাত স্থপতি গাউদির সারা জীবন ধরে এবং তারপরেও মোট ১৩৫ বছর ধরে নির্মিয়মাণ ‘গাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া’ নামে একটি গির্জা (ব্যাসিলিকা) হলেও কার্যত এ এক ভিন্ন ধরনের অসাধারণ স্থাপত্য। পুরোনো শহরের সুরক্ষা প্রাচীর ভেঙ্গে আড্ডা ক্ষেত্র (বুলেভার্ড) লারালা, যা সবাই পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে আটলান্টিক সাগর পেরিয়ে প্রাচ্যের জলপথের সন্ধানে ১৪৯২ সালে এই স্পেন থেকেই তিনটি ছোটো জাহাজে ১২০ জন নাবিককে নিয়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাস দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়েছিলেন। নাবিকদের বিজ্ঞাহে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে বসেছিল। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকার ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, বাহামা, কিউবা প্রভৃতি। আটমাস পরে তিনি ফিরেছিলেন এই বার্সেলোনা বদরে। এখানে রাজা ফার্ডিনান্ত ও রানি ইসাবেলা তাকে বীরের অভ্যর্থনা জানান। এখানকার আর একটি উত্তেযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা হল. জেনারেল ফ্রাস্কোর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-যুদ্ধ ভারতে হিটলারের বাহিনী ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল পার্শ্ববর্তী যান্ত অঞ্চলের ওয়ের্নিকাতে ভয়ংকর বোমা বর্ষণ করে। বীভৎস সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পাবলো পিকাসো ‘ওয়ার্নিকা’ নামে ছবিটি আঁকেন।

আমরা এখানকার এবং ইউরোপের সর্বত্র মানুষদের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার বহু পরিচয় পেয়েছি। ওদের মতে, মাতৃভাষাই নিজেদের বৈশিষ্ট্যের মূল পরিচয়। আমাদের দেশের তুলনায় ওখানে অনেক কম লোক ইংরেজি জানেন। কিন্তু সকলেই ব্যবহার করেন নিজের নিজের মাতৃভাষা।

বার্সেলোনাতে রয়েছে ভূমধ্যসাগরের জলজ জীবদের শ্রেষ্ঠ মিউজিয়াম। আমরা সেখানে ঢুকছি। সেখানে কত রকমের মাছ, কোরাল, জলজ প্রাণী, সবুজ চিংড়ি, পেঙ্গুইনদের সংসার। সমুদ্রের একাংশকে ঘিরে রয়েছে অ্যাকোরিয়ামের সবথেকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী। সমুদ্রের নীচে ফাইবার টানেলের মধ্য দিয়ে এসকালেটরে করে যেতে যেতে হাঙর, তরোয়াল মাছ, ক্যাটল ফিস, তারা মাছদের দেখার কী দারুন অনুভূতি! বিচিত্র ধরনের মাছের বাজার দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। তবে শুধু মুগ্ধ হওয়া নয়, আমরা চেখে দেখেছি বহু রকম মাছ ও সামুদ্রিক জীবের স্বাদ; যেমন অক্টোপাস, সালমন, ক্যাটল, সার্জিন, ঝিনুক, কুমির, সামুদ্রিক শ্যাওলা; নানা মাছের টুকরো দিয়ে তৈরি পিথেরা, তাপাস, পায়া ইত্যাদি।

অবশেষে আমরা ঢুকেছি ফ্রান্সে। গৌরবময় গণ-বিপ্লব ও সৌন্দর্যের পীঠস্থান ফ্রান্সের রাজধানীতে এসে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, তার জানালা দিয়ে দেখা যেত আইফেল টাওয়ারকে। এটি মানুষের তৈরি একমাত্র লোহার কাঠামো, যার দিকে মুগ্ধ চোখে ঘন্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা যায়। এখানে একঘণ্টা ছাড়া ছাড়া ৫ মিনিট ধরে মাঝামায় রঙিন আলোর অপূর্ব নৃত্য। এই টাওয়ারটি এখন হয়ে উঠেছে ফ্রান্সের প্রধান পরিচয় চিহ্ন। প্রতি বছর ধরে প্রবাহিনী সাইন নদীর পাশে দাঁড়ানো এই অভ্রভেদী টাওয়ারে টিকিট কেটে ওঠেন ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। অথচ ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে বিশ্ব উৎসবে যোগ দিতে আসা অতিথিদের স্বাগত তোরণ হিসাবে এরকম একটি টাওয়ার গড়ে তোলার জন্য মরিস কোয়েচলিন এবং এমিল নওগুয়েক যখন আইফেল কোম্পানির কাছে এর নক্সা পেশ করেন তখন প্যারিস জুড়ে বিদ্রুপের বান ডেকেছিল। এই স্বাগত তোরণের পাশেই ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে শুরু হয়েছিল সমাজতান্ত্রিকদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’। সেখান থেকেই আমেরিকাতে ১৮৮৬ সালে আঁটি ঘণ্টা কাজের সময়সীমা বেঁধে দেবার আন্দোলনের সমর্থনে প্রতি বছর ১ মে ‘মে দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

আমরা একটি পুরো দিন ধরে দেখলাম বিশ্বের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালা মিউজিয়াম। প্রথমে এটি ছিল দুর্গ। তারপর হল বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদ। রাজারা প্রায় এক বছর ধরে ছিলেন চিত্রের সমঝদার। তারা চিত্রকর ও শিল্পীদের ভরণপোষণ করতেন। তবে এগুলি দেখার অধিকার ছিল কেবল রাজপরিবারের সদস্য ও উচ্চ অভিজাতদের। সাম্য, মৈত্রী স্বাধীনতার ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপ্লবী পরিষদ ১৭৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘোষণা করে। ফৈব্বরাচারী ষোড়শ লুই ও রানি মেরি আঁতিয়োনেত হাজার হাজার প্রতিবাদী নরনারীকে বাস্তিল দুখে বছরের পর বছর আটকে রেখেছিলেন, শত শত জনকে খুশিমতো গিলোটিনে হত্যা করেছিলেন, তাদেরও গিলোটিনে হত্যা করা হয়। কিন্তু একটিও শিল্পদ্রব্য নষ্ট না করে বিপ্লবীরা ১৯৭৩ সালে। মিউজিয়াম হিসাবে এটিকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। কেবল ২০১৭ সালে এই মিউজিয়ামটি দেখেছেন ৮১ লক্ষ মানুষ। আমরা এখানে দেখেছি লিওনার্দো-দ্যা-ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা। দেখলাম মিশরের প্রায় চারশো হাজার বছর আগেকার হায়ারোগ্লিফিক লিপি, যা তৈরি হয়েছিল প্রায় সব লিখিত ি ভাষার উৎস ফোনেশিয় লিপি থেকে।

লুতে মিউজিয়ামে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক গ্যালারিটিও বিশাল। এখানে আদিম মানুষদের ব্যবহৃত কত হাতিয়ার, শিল্পকলা, বাদ্যযন্ত্র, হস্তশিল্পের সমারোহ। মধ্যযুগের নৃপতিদের আস্ত তোরণ, নানা কারুকার্যের নিদর্শন এখানে শোভা পাচ্ছে।

আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম একটির পর একটি প্রশস্ত হল ঘরে আনাতোলিয়া (তুরস্ক), গ্রিস, মেসোপটেমিয়া ও মিশরের প্রাচীন সভ্যতা বিকাশের কত শত নিদর্শন এখানে যত্নের সঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে। আজকের দিনের অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন, আধুনিক মানুষের উদ্ভব যেমন হয়েছিল পূর্ব আফ্রিকাতে, তেমনই তাদের একটি অংশ বন্য, যাযাবর জীবনকে অতিক্রম করে প্রায় ৯,০০০ বছর আগে আদিম চাষ এবং তার অনুসঙ্গ হিসাবে স্থায়ী বাসের পত্তন করেছিল আনাতোলিয়াতে। আগে বন্য মানুষেরা ইঙ্গিত এবং নানা আওয়াজের মধ্য দিয়ে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করত। কিন্তু চাষবাসের জন্য দরকার হল আরও বেশি ভাব বিনিময়ের। এর ফলে ভাষার দ্রুত বিকাশ হল। তারপর মানুষ নানা কারণে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। কিন্তু তাদের ভাষাতে রয়ে গেছে তার চিহ্ন। তাই কিছু মূল শব্দ অধিকাংশ ভাষাতে একই রকম, যেমন বাংলাতে মা, জার্মানিতে মাট্রার, রুশ ভাষায় মটি, পার্শিতে মাডার, ইংরেজিতে মাদার, ল্যাতিনে মাটের, আরবিতে আম্মা, পোলিশে মাটকা। বর্ণমালাকে ইংরেজিতে বলা হয় আলফাবেট। কিন্তু আলফা মানে তো ষাঁড়, আর বিটা মানে ঘর। সুমেরিয়া বণিকেরা এবং ক্রিট দ্বীপ-সহ গ্রিসের নাবিকেরা কীভাবে চিত্রলিপি থেকে আজকের দিনে বহু ব্যবহৃত ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালা গড়ে তুলল, তারপর মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম, মিশরের হায়রোগ্লিফিক লিপির বিপুল বিস্তার ঘটল তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এখানে দেখেছি পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র গ্রিসের অতুলনীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। হোমার, আর্কিমিডিস, সক্রেটিস এবং অলিম্পিক খ্যাত গ্রিসকে এখানে অনন্য নিপুণতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এতে আমরা এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছি যে আমাদের পরবর্তী ইউরোপ ভ্রমণের অবশ্য গন্তব্য হবে গ্রিস এবং আনাতোলিয়া (যার বড়ো অংশটাই রয়েছে এশিয়া-ভূখণ্ডে)।

আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম মিশর ও মেসোপটেমিয়ার বিপুল প্রত্নসম্ভার, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের আঁকা অসাধারণ চিত্রকলা, দেওয়াল জোড়া ফ্রেসকো, বহু যুগ সঞ্চিত শিল্প ও ভাস্কর্য সম্ভার। কিন্তু আমরা একদিনে কতটুকু দেখেছি। কেননা এখানে যত দ্রষ্টবা আছে তার প্রতিটিকে যদি কেবল এক মিনিট করে দেখা হয়, তবে দেখতে সময় লাগবে ৬৪ দিন।

আমরা দেখলাম ৩০,০০০ শিল্পীর ৫০ বছর ধরে তৈরি (প্যারিস থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে জনবসতি উচ্ছেদ করে) রাজাদের নতুন বিলাস-ব্যাসনের লীলাভূমি ভার্সাইল রাজপ্রাসাদ। এত আড়ম্বর, এত বিলাসিতা এর আগে আর কোথাও দেখিনি। রাজার ‘হল অফ মিরর এবং অন্যান্য বিলাসবহুল প্রশস্ত কক্ষের পর কক্ষে দেওয়াল ও ছাদ জুড়ে বিখ্যাত শিল্পীদের সৃষ্টি অতি কারুকার্যময় অসংখ্য ঘর, যুদ্ধ চিত্র দেখে আমরা নির্বাক হয়ে গেছি।

এখানে বাছাই করা দার্শনিক ও বিপ্লবীদের সঙ্গে বসানো হয়েছে জোয়ান অফ আর্কের মর্মর মূর্তি, যিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করে সেনা সহায়তা নিয়ে অর্লিয়েন্সকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করেন। কিন্তু ফরাসি অভিজ্ঞাতরা তাকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়। পোপের আদেশে তাকে ডাইন বলে চিহ্নিত করে প্রকাশ্য বাজারে পিলারের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়।

চারদিকের দিগন্তবিস্তৃত বাগান-সহ রাজপ্রাসাদটি গড়ে উঠেছিল ৮.২ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে । এখানেই রাজার টেনিস কোর্টে বসেছিল জনসাধারণের প্রতিবাদী সভা। পরে ১৭৮৯ সালের ৫ অক্টোবর 6 এখান থেকেই রাজা-রানিকে প্যারিসে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদের বহু সাধের প্রাসাদটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল জনসাধারণের জন্য।

আমরা অনেকেই ভিক্টর হুগোর ‘হ্যাঞ্চব্যাক অফ নোেতরদাম’ পড়েছি। আমরা দেখেছি সেই নোতারদাম গির্জা, যার গঠনপ্রণালী একেবারেই ভিন্ন ধরনের। এখানেই পোপকে সামনে রেখে রাজমুকুট পরেছিলেন নেপোলিয়ন।

আমার দেখেছি প্যারিসের ব্যস্ত ১২ টি রাস্তার কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত বিজয় স্তম্ভ (ভিক্টি অফ ট্রিয়াম্ফ)। এটি তৈরি করেছিলেন নেপোলিয়ান। পরবর্তীকালে নেপোলিয়ানের দেহ সেন্ট হেলেনা দ্বীপ থেকে এখানে এনে সমাহিত করা হয়। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের যোদ্ধারা অন্যতম প্রধান প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন এখানেই। অবশ্য তখন এই স্তম্ভ ছিল না। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ব্যঙ্গচিত্র শার্লে এবদোর দপ্তরে হামলা চালিয়ে আল কায়দা সম্পাদকীয় দফতরের ১১ জনকে খুন করে। পরের সপ্তাহে নিয়মিত ৬০,০০০ কপির জায়গায় ৬টি ভাষায় ৭৯৫ লক্ষ কপি পত্রিকা ছাপা * হয়। আর ১১ জানুয়ারি এই বিজয় স্তম্ভ সহ প্যারিসের নানা জায়গায় ২০ লাখ নরনারী জমায়েত হয়ে ধ্বনি তোলেন ‘আমরাও শার্লে এবদো’। আমরা পরজন্মে স্বর্গ চাই না। এই জন্মেই পৃথিবীকে সুখ ও শাস্তির আবাস হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। বর্তমানে এটিই প্যারিসের ইয়োলো ভেস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি। 

আমরা চড়েছি প্যারিসের চালকহীন ট্রেনে। দেখেছি বিখ্যাত মমার্ত, যেখানে শিল্পী, সাহিত্যিক ও চিত্রকরদের সাদ্ধা মজলিস বসে। মমার্ত থেকে প্যারিস মহানগরীর দৃশ্য অতুলনীয়। ইউরোপের যে বিষয়গুলি আমাদের বিশেষ নজর কেড়েছে তা হল এখানে নেই কোনও জাত-পাতের অস্তিত্ব। নেই তপশিলি জাতি, উপজাতি, ও.বি.সি. ইত্যাদি। • নেই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা খাদ্য নিয়ে কোনও বাছবিচার। ইদানিং ওখানে ঈশ্বর উদাসীন ও নিরিশ্বরবাদীর সংখ্যা বাড়ছে।

এখানে সাক্ষরতার ও ন্যূনতম শিক্ষার হার প্রায় ১০০ শতাংশ। এরা মাতৃভাষাকেই আত্মপরিচয়ের প্রধান চিহ্ন বলে মনে করে। নাগরিকরা এখানে অনেক বেশি গণতন্ত্র সচেতন ও উদার মনোভাবাপন্ন। মেয়েরাও এখানে পুরুষদের সমানতালে যোগ্য মর্যাদা নিয়ে কাজ • ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব সমানভাবে মা ও বাবারা করে চলেছে। শুরু থেকেই শিশুদের দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।

এখন এইসব উন্নত দেশের বেশ কিছু মেয়ে মা হতে চাইছে না । এখানকার এক একটি দেশ ছোট্ট হলেও গুণমানে অনেক বড়ো দেশের থেকেও এগিয়ে আছে। এখানে উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার। উন্নত রুচিসম্মত অট্টালিকা, প্রশস্ত রাস্তা, দিনরাত যান-বাহন। মানুষের বেশি আয় ও বেশি ব্যয়। এরা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পর্কে খুবই সচেতন, সংযমী ও শৃঙ্খলাপরায়ণ। এখানকার কোনও দেশেই একটিও ট্রাফিক পুলিশ বা বাস-ট্রামের কন্ডাক্টর দেখলাম না। বয়স্ক নর-নারীরাও বেশ ফুর্তির সঙ্গে গান, আড্ডা, সাইকেল চড়া, মাছধরা নিয়ে মেতে থাকে। গান ও শিল্পকলা ও খেলা পাগল স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স। এই দেশের নেতারা তৃতীয় বিশ্বে বেসরকারীকরণ, উদারনীতির কথা বললেও নিজের দেশের মানুষের জন্য উন্নত সামাজিক সুরক্ষা বজায় রেখেছে। এখন কোথাও কোথাও পুঁজিবাদী সংকটের কবলে পড়ে এই সুরক্ষাকে সংকুচিত করার বা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ তৈরির প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে অসন্তোষ, গণবিক্ষোভ ও স্বচ্ছন্দে বাঁচার জন্য নতুন পথের সন্ধান।

প্রতিবেদক শক্তি মণ্ডল ‘সত্যেন মৈত্র জনশিক্ষা সমিতির সভাপতি এবং মায়া মণ্ডল একজন লেখিকা ও ভ্রমণ পিপাসু।