July 1, 2021

চিত্তপটে নাট্যভাবনা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

কৃষ্ণপদ দাস

ভূমিকা ––

রুশ নাট্যকার লেবেডফের হাত ধরেই বাংলা নাটকের সূচনা – এ কথা কোনদিনই অত্যুক্তি হবে না । কেননা  রুশদেশীয় নাট্যকার লেবেডফ এদেশে এসে এদেশের সংস্কৃতিতে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে এদেশের ভাষা শিক্ষা জরুরী বলে মনে করলেন । স্থির হল শ্রদ্ধেয় গোলকনাথ দাসের তত্ত্বাবধানে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করবেন । টানা সাত বছর ভাষা চর্চা করে শেষ পর্যন্ত তৈরি করলেন বাংলা নাটক । যদিও অনুবাদ নাটক – তবু বিদেশীর সৃষ্টি বাংলা নাটক তো বটে । নাটক দুটি ‘Disguise’ এবং ‘Love is the Best Doctor’. বাঙালী নাট্যকার হিসেবে প্রথমেই আসেন রামনারায়ণ তর্করত্ন বা নাটুকে রামনারায়ণ । তবে নাটকে আধুনিকতা এলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে । তারপর উঠল পালাবদলের ঢেউ । পরাধীনতা–বঙ্গভঙ্গ–বিশ্বযুদ্ধ–সাম্রাজ্যবাদ–যড়যন্ত্র মামলা–নিয়ন্ত্রণ আইন–ভাষা–সভ্যতা–সংস্কৃতি–কোম্পানির থিয়েটার–পেশাদারি থিটেয়ার–গণনাট্য–নবনাট্য–গ্রুপ থিয়েটার সর্বত্র । এই পালাবদলের সূরে আগুন জ্বালিয়েছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি । নাট্যকারের হাতে যখন এসব বিষয় ‘নাটক’ হয়ে উঠতে লাগল তখনই বিধিনিষেধের বন্যা ধেয়ে আসতে লাগল । তবু নাটক একাধারে আনন্দনায়ক এবং বার্তাবাহক – তাই নাট্যশিল্পকে বাঁচাতে লড়াইকে সঙ্গী করেই পথ চলেছেন নাট্যকারেরা । জীবনধর্মী শিল্পই যে আত্মার মুকুর । মানুষ যখন হাতুড়ি, ছেনি, বাটালি কিছুই ধরতে জানতে না – তখনও তার চোখে ছিল স্বপ্ন বা রূপকল্প । তখন তার ‘প্রযোজন’ আর ‘ইচ্ছা’র মাঝে দাঁড়িয়ে সে নিজের ভাবনা অনুযায়ী ‘ইচ্ছা’কে কাজ লাগিয়ে ‘প্রয়োজন’ মিটিয়েছে । সে হয়ে উঠেছে শিল্পী । আর শিল্প থেকে যে জীবনবোধ উঠে এসেছে সেই জীবনবোধেই ‘শিল্পী’ হয়ে উঠেছেন ‘নাট্যকার’এই পালাবদলের পথ মোটেই সুখকর ছিল না । তবি নাটক সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল । কেবল সেই কারণেই নাটক আর চারদেয়ালের মধ্যে বন্দী রইল না । মাঝে–মঞ্চে–পথে–ঘাটে জনপ্রিয় হয়ে উঠল নাটক । শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত এঁদের অবদান এই শিল্পের ভিতকে মজবুত করে গেছেন । গোটা ভারত জুড়ে যত বেশি রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলেছে ততই এসব অবলম্বন করে নাট্যশিল্প মানবমনের চৈতন্যের জাগরণ ঘটিয়েছে । আর সেই জাগরণের জোয়ারে ২১ শতকের নাট্যভাবনা চিত্তপটে স্থান করে নিয়েছে । )

একেবারে যদি একুশ শতকেই চলে আসি – তখনই দেখব নাটকের ক্ষেত্রে কত পরিবর্তন আসছে বিষয়-মঞ্চ-সংলাপ-উপস্থাপনা-পোশাক-নাট্যকারের ভাবনা সব ব্যাপারে । ৮০ দশকের নাট্যকার যাঁরা ছিলেন অর্থাৎ বাদল সরকার, মনোজ মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের মত বিদগ্ধজনেরা একুশ শতকে নাট্য-মহীরুহ হয়ে বিরাজ করলেন । নাট্য এবং নাটক গোটা বিষয়টাতেই অর্থাৎ উপস্থাপনার ভঙ্গিমাতেও বদল এল, বিষয়ের মধ্যেও বদল এল । নাট্যকারও নতুন এলেন । সব নাট্যকারেরাই যে নতুন এলেন হঠাৎ করে তা বলা যায় না । অনেক পুরানো নাট্যকার যাঁরা ছিলেন বিশেষ করে আশির দশকে – নব্বই-এর দশকে যাঁদের উত্থান এবং সত্তরের দশক থেকেও যাঁদের উত্থান এবং আশির-নব্বই-এর দশকে যাঁরা রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং তাঁদের বহু নাটক প্রবাদ-প্রতিম হয়ে রয়েছে, সেই সমস্ত নাট্যকার যাঁরা প্রধান হয়ে পড়েছেন একুশ শতকে এসে, সেই নাট্যকারদের কথা আমাদের উল্লেখ করতে হবে । তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন নাট্যকারদের পাব । এই দুইয়ের মিশেলে বাংলা নাটক কিন্তু অনেক সমৃদ্ধ হলো । এবার প্রবীণ নাট্যকারদের মধ্যে যাঁদের কথা না উল্লেখ করলেই নয় – তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসবে – বাদল সরকার, তারপর আসবে মোহিত চট্টোপাধ্যায় । এঁরা যদিও একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত দুজনেই জীবিত ছিলেন ।  একজন মারা গেলেন ২০১১-তে, অপরজন মারা গেলেন ২০১২ সালে । কাজেই প্রথম একটা দশক কিন্তু তাঁরা সক্রিয় ছিলেন । ২১ শতকের প্রথম দশকে মোহিত চট্টোপাধ্যায় ও বাদল সরকার রীতিমত প্রৌঢ় । শেষ অবস্থায় তাঁরা যে খুব দাগ কেটেছেন এমন বলাও যায় না । কিন্তু তাঁদের উপস্থিতিটাই আসলে আমাদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় এবং উজ্জ্বল বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে । আরেকজনের নাম করতে হয় এই সময় । তিনি হলেন – মনোজ মিত্র । তিনিও প্রৌঢ় হয়ে পড়েছেন এবং জীবিত আছেন এখনও । তবে একুশ শতকের প্রথম দশকে তাঁর বেশ কিছু নাটক আমরা পেয়েছি । তাঁর নিজের দল সুন্দরম্ ।

18

সেই দলে তিনিও অভিনয় করেছেন চুটিয়ে প্রথম দশকে । দ্বিতীয় দশক থেকে তিনি ক্রমে ক্রমে আরো প্রৌঢ় ও বার্ধক্যজনিত কারণে কমিয়ে দিয়েছেন তাঁর এই সমস্ত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ । এছাড়া, যে সমস্ত নাট্যকাররা এলেন – তাঁদের মধ্যে প্রথমেই চন্দন সেনের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় । চন্দন সেন  তাঁদের মধ্যে খুবই উল্লেখযোগ্য নাম । তারপরে একঝাঁক নতুন নাট্যকার এলেন এই একুশের দশকের প্রথম দশকে এবং প্রতিষ্ঠা পেলেন । তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন – ব্রাত্য বসু, তীর্থঙ্কর চন্দ, উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় এবং একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আরো দু-একজন নাট্যকার প্রতিষ্ঠা পেলেন – তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন – কৌশিক চট্টোপাধ্যায় আর অন্যান্যরা হলেন অধিকারি কৌশিক, কৌশিক কর, সুভাষিক খামারু – এই তো গেল – নাট্যকারদের সম্পর্কে কথা । এরপর যাদের কথা বলতে হয় তাদের কথা না বললেই নয় । তাঁরা হলেন একঝাঁক অভিনেতা – অভিনেত্রী । যাঁরা এই সময়ে বাংলা নাটককে নাড়িয়ে দিলেন, কাঁপিয়ে দিলেন । তাঁদের অবদান যে খুব বেশী সেকথা বলতেই হয় । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিনেতা ছিলেন – দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, ব্রাত্য বসু নিজে । এই রকম একঝাঁক নতুন অভিনেতা – অভিনেত্রী, যাঁরা বাংলা নাটককে দিশা দেখালেন । বিজয়লক্ষ্মী বর্মন, আরেকজন উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী । কৌশিক সেন এঁরা আসতে লাগলেন বাংলা নাটকের জগতে । কাজেই এদের কথা বলতে হবে আমাদের । বিশ শতকের প্রথম দশকে এঁরা এলেন । বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে নতুন নতুন নাট্যদলও এলো, যাঁরা তাঁদের প্রথম প্রযোজনতাই চমকে দিয়েছেন – সেই রকম নাট্যদলের কথা উল্লেখ না করলেই নয় । ‘বেলঘরিয়া অভিমুখ’ – তাঁদের অন্যতম একটি নাটক এবং তাঁদের প্রথম প্রযোজনা – ‘কোজাগরি’ । দু হাজার ষোল – সতেরো সাল নাগাদ নির্মিত । সেই ‘কোজাগরি’ দিয়ে তারা বাংলা নাটকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়েছেন – চমকে দিয়েছেন এবং সেই কোজাগরির মাধ্যমেই নাট্যকার কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের উত্থান বলা যেতে পারে । এই হল একুশ শতকের বাংলা নাটকের নাট্যভিনয়ের যে গতিপ্রকৃতি তার প্রাথমিক একটা চিত্র আমরা এখানে এঁকে নিলাম । এইবার আমরা পরপর আলোচনা করবো সেই সমস্ত নাট্যকার – অভিনেতার অবদান কী কী ? তার আগে, যাঁদের নাম আমরা এই প্রসঙ্গে আলোচনা করলাম – তাঁদের নাটকগুলো বিস্তারিত বলতে থাকবো ।

        নাট্যচর্চা একটা প্রক্রিয়া – একটা পদ্ধতি । কাজেই একুশ শতক নিয়ে বলতে গেলে বিশ শতকের নাট্যচর্চার যে ধারাবাহিকতা ছিল, সেটাই একুশ শতকে এসে পৌঁছেছে । একুশ শতকে যাঁরা নাট্যকার – নাটক রচনার দিক থেকে বলা যায় প্রধান ভূমিকায় এলেন – পুরোনো এবং নতুন মিলে, তাঁদের মধ্যে দেখা গেল – যে বিশ শতকের উপান্ত থেকে যাঁরা থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন – তাঁরা একুশ শতকে এসেও বিশ্রাম নেননি । তাঁরা তখনও তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন । একই সঙ্গে একুশ শতকে আরও অনেক নতুন নতুন শক্তিশালী নাট্যকার, শক্তিশালী নির্দেশক, শক্তিশালী অভিনেতা – বাংলা থিয়েটারকে সমৃদ্ধশালী করে চলেছেন । অর্থাৎ পুরোনোর ধারাবাহিকতা এবং নতুনের আগমন এই দুইয়ে মিলে বাংলা থিয়েটার একটা নতুন ধরনের সমৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে । এই ব্যাপারে প্রাচীন পন্থীদের হা-হুতাশ করার কোন অর্থ হয় না । কেননা দেখা যায় যে, উনিশ শতকে যাঁরা নাট্য চর্চা করতেন, তাঁরা বিশ শতকের যাঁরা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদেরকে প্রাথমিকভাবে আদর করতে পারেননি, সমর্থন করতে পারেননি বা তাঁদের সমর্থন করতে দ্বিধা ছিল । তাঁরা চাইতেন না সেই সময় বাইরের কোন লোক এগিয়ে আসুক । বাংলা নাট্যচর্চাকে একটা কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা সেই প্রধানদের ছিল ।

19

প্রধান নাট্য নির্দেশকরাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করেও তাঁরা নাটককে তাঁদের মতো করে বদলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন, তাঁদের সংখ্যাও কম নয় । যাঁরা পারলেন না তাঁরা হারিয়ে গেলেন । বিশ শতকের পর একুশ শতকে তাঁদের মধ্যে নতুন নাম আর পাওয়া গেল না । আর যাঁরা পারলেন, তাদের দেখা গেলে যে – নতুন সময়ের অভিঘাতে তাঁরা নিজেদের বদলে নিতে সক্ষম হলেন । যে পরিবর্তন করা দরকার, সেই পরিবর্তন করলেন তাঁরা । আবার একই সঙ্গে নতুন নাটক লিখছেন যাঁরা, তাঁরাও কিন্তু সেই পুরোনো নাট্যকারদের দেখে উদ্দীপিত হলেন । তাঁরা প্রবীণদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের মতো করে নতুন ধরণের নাটক লিখছেন । কাজেই বিশ শতকের প্রাচীনপন্থী যাঁরা, তাঁরা কিন্তু নতুনদের একটা পথপ্রদর্শক হয়ে উঠলেন । এটা একটা সুস্থতার লক্ষণ । এটা বোঝা গেল যে, একুশ শতকের বাংলা থিয়েটারের নাটক কোন অবস্থাতেই হীনবল হয়ে পড়েনি । বাংলা থিয়েটারের প্রচার কম – তা সত্ত্বেও বাংলা থিয়েটার ভারতবর্ষীয় প্রেক্ষাপটে তার বহুমাত্রিকতা পরিচয় রেখেছে । যার ফলে, একুশ শতকে বাংলা নাট্যচর্চার দিক থেকে তিনটে প্রধান ব্যাপার উল্লেখযোগ্য বলা যেতে পারে । (১) ঊনিশ শতক থেকে বিশ শতকের শেষ দিকে নাটকের ধারাবাহিকতা দেখা গেল দীর্ঘ সংলাপ পরিবর্তিত হয়ে আঁটোসাঁটো হল । অর্থাৎ দীর্ঘ সংলাপ কমে যাচ্ছে । প্রয়োজনীয় সংলাপ উঠে আসছে । আঁটোসাঁটো হচ্ছে সংলাপ । (২) মঞ্চপ্রীতি । মঞ্চ উপকরণের ক্ষেত্রে অনেকটা পরিবর্তন হলো । অর্থাৎ ঊনিশ শতক – এমন কি বিশ শতকের অনেকখানি জায়গা জুড়ে মঞ্চ ব্যবহার অনেকটা প্রাচীন ছিল সেটাকে পরিবর্তন করে নতুন ধারা আনা হলো । একুশ শতকে এসে সেটা আরো নবীন হলো । মঞ্চের ব্যবহার আরো অগ্রসর হলো বলা যায় । খুব অল্প বলে, অনেক বেশি বোঝানোর একটা প্রবণতা একুশ শতকে আমরা দেখতে পাচ্ছি । আর তাছাড়া, থিয়েটার এমন একটা শিল্প – সেখানে কম কথা বলে, কম জায়গা দেখিয়ে – কম দৃশ্যপট দেখিয়েও দর্শকদের কল্পনার জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং সেই দর্শকরা সব বুঝে নিতে সক্ষম হবে – ফলে দৃশ্যপটের একটা পরিবর্তন এল । সেটা নাট্যাকাররা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলেন । তার ফলে, একটা স্পেসকে কখনো বাজার বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে, রাজসভা বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে – পুকুর বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যা ইচ্ছে তাই বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে । ফলে, একুশ শতকে সেট ডিজাইন এবং মঞ্চে তার প্রয়োগের একটা অভিনবত্ব বলা যেতে পারে । আর এই কারণেই, একুশ শতকের নাট্যকাররা আলাদা করে আর ভাবতে দিলেন না একই সঙ্গে এতগুলো জটিলতা মঞ্চে আনা সম্ভব কিনা । সম্ভব যে, সেটা দেখালেন তাঁরা ।

21

এই প্রসঙ্গে চন্দন সেনের ‘কর্ণাবতী’ – নাটকের উল্লেখ করা যেতে পারে । নদী, পাহাড়, মরুভূমি একই সঙ্গে দেখবার চেষ্টা করছেন – নাট্যকার । সেই একটা জটিলতা তৈরি করেছিল । মেঘনাদ ভট্টাচার্য  – তাঁর দল সায়কে এটা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন । সেটা সেই সময় খালেদ চৌধুরীর মতো প্রাতঃস্মরণীয় মঞ্চকার – তিনি এই কাজটা করে দেখিয়েছিলেন । এক সাক্ষাৎকালে চন্দন সেন জানিয়েছেন, খালেদ চৌধুরী চন্দন সেনকে বলেছিলেন, একই মঞ্চে এতগুলো জিনিস পাহাড়, নদী, মেলা কী করে করা সম্ভব ? সেটা মজা করে তিনি চন্দন সেনের কাছে বলে ছিলেন । কিন্তু খালেদ চৌধুরী কাজটা করতে পেরেছিলেন । এতে তাপস সেন আলো করেছিলেন । সেও এক আশ্চর্য আলো । খালেদ চৌধুরীও তাপস সেন দুজনে মিলে বাংলা নাটকের একটা যুগলবন্দী তৈরি করলেন সেই সময় । এই  ‘কর্ণাবতী’ – নাটকে সেটা একটা ম্যাজিক তৈরি হয়েছিল । তবে নাট্যকার যদি এই একুশ শতকে নাটকটি লিখতেন, তবে নিঃসন্দেহে আরো নতুন কোন পরিচালক যদি পরিচালনা করতেন – তাহলে যে ডিজাইন কর্ণাবতী করতে গিয়ে খালেদ চৌধুরী ও তাপস সেনের যে যুগলবন্দী হয়েছিল তাঁদের তা হয়তো অন্যরকম হতে পারতো । অন্যভাবে হতে পারতো । নাট্যকারও এই কথা বিশ্বাস করেন । কারণ একথা আমরা বলতেই পারি, কেন না এই সময়ে দিল্লীতেও একটি দল কর্ণাবতীর অনুবাদ হিন্দীতে করিয়ে অভিনয় করেছিল । এবং তারা কিন্তু এই সময় দাঁড়িয়েও আশ্চর্যভাবে এই নাটকটি উপস্থাপিত করেছিল । খালেদ চৌধুরী ও তাপস সেনের চিন্তা ধারা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে তাঁরা কিন্তু তাঁদের মতো করে এই নাটকটি প্রয়োগ করেছিলেন । কাজেই বিশ শতকেও আমরা এই নাটক দেখেছি, একুশ শতকেও তা অভিনীত হচ্ছে – তখন কিন্তু একই Text, অথচ একই সঙ্গে ভাবনা-চিন্তার বদল হচ্ছে – নির্দেশকের ভাবনা-চিন্তা । সেই জন্য নব-নির্মিত হচ্ছে বলা যেতে পারে একুশ শতকের নাটক । এই নাটকটি মেঘনাদ ভট্টাচার্যের অন্যান্য নাটকের সঙ্গে কোন মিল ছিল না, কিন্তু এই কর্ণাবতী নাটকটি একেবারে আধুনিক হয়ে উঠেছিল । তার ফলে, এই সময় দাঁড়িয়ে সব কিছুই নির্মেদ হতে শুরু করল বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে । যত কম সময়ের মধ্যে অনেক কম কারুকৃতি দেখিয়ে অনেক বেশি দর্শককে মনোরঞ্জন করানো যায় – সেটা কিন্তু এই একুশ শতকের নাটক করে দেখালো ।

        তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার এই আলোচনা প্রসঙ্গে, তা হল একুশ শতকের প্রথম দশক বামফ্রন্ট সরকারের চলে যাওয়ার সময় । এই সময় আর মনে করা চলছিলো না যে আমরা সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে গেছি । বরং কোন কোন নাট্যকারের নাটককেও ‘সেন্সর’ করবারও চেষ্টা দেখা যাচ্ছিলো ।

22

আগে রাজনৈতিক নাটক অনেক বেশি করে লেখা ও অভিনীত হচ্ছিলো, কিন্তু এই সময়ে শাসক কি ভয় পেল নিজেদের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে ? তবে কোন কালেই কি শাসকের চোখ রাঙানিকে ভয় পেয়েছে নাটক ও নাট্যকার ? তাই কোন কোন নাট্যকার চেষ্টা করলেন আবার মঞ্চে রাজনৈতিক নাটককে ফিরিয়ে আনবার । এক্ষেত্রে চন্দন সেন, অশোক মুখোপাধ্যায়  বা তীর্থঙ্কর চন্দ-র কথা বলা যায় । চন্দন সেনের ‘দুই হুজুরের গপ্পো’ কিম্বা অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘বেলা অবেলার গল্প’ এগুলোতে পলিটিক্যাল আণ্ডারটোন আছে । সব ভয়কে উপেক্ষা করেই তাঁরা এই সময়ের রাজনীতির কথা তুলে আনছেন নাটকে । বর্তমান গবেষকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নাট্যকার চন্দন সেন এই বিষয়ের চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন।তিনি জানিয়েছেন—“আমি ‘দুই হুজুরের গপ্পো’ লিখছি । কিন্তু তার আগে বিভাসদার’ মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ বা আমার ‘দায়বদ্ধ’ অসম্ভব জনপ্রিয় নাটক । এই নাটকগুলো কিম্বা অশোকদার ‘বেলা অবেলার গল্প’ এর মধ্যে পলিটিক্যাল আণ্ডারটোন আছে । পরে যখন নাটক লেখা হচ্ছে তখন তার মধ্যে ফ্যামিলি ম্যাটার, রূপক, রূপকথা, কল্পনা এগুলো আসতে লাগলো।তার ফলে রাজনৈতিক নাটকের অত্যন্ত আকাল দেখা দিলো একটা সময় । একটা সময় আমি, তীর্থঙ্কর চন্দ সীমিত ভাবে আবার রাজনৈতিক নাটক লেখার চেষ্টা করলাম।তার ফলে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি হল । অর্থাৎ দেখা গেল আমার একটি নাটক যা এই সময়ের রাজনীতিকে, রাজনৈতিক সুবিধেবাদকে আক্রমণ করে লেখা হচ্ছে,তখন আমি একজন বামপন্থী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার নাটককেও সেন্সর করার চেষ্টা করা হচ্ছে । এ ঘটনাগুলো ঘটেছে।বামফ্রন্টের আমলেই ঘটেছে ।”

এর পর পরই বাংলা নাট্যমঞ্চে ব্রাত্য বসু একটি নতুন সুর নিয়ে এলেন ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকের মধ্যে দিয়ে । এই নাটকটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে গেল । মানুষ শুনতে চান শাসক নির্বিশেষে শোষণের বিরুদ্ধে, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা । এ দিক থেকে একটা নতুনত্ব নিয়ে এলেন ব্রাত্য বসু তাঁর নাটকে এবং অবশ্যই বাংলা থিয়েটারে । এই নতুনত্ব অবশ্যই  স্বাস্থ্যকর। এর পর একে একে তিনি লিখে গেছেন রাজনৈতিক নাটক ।

এর পর বাংলার রাজনীতিতে ও ভারতবর্ষের রাজনীতিতে যখন পালাবদল ঘটে গেল তখন আবার আমাদের রাজনৈতিক নাটকের ভাটা দেখা দিল । আর কোন দিক থেকেই রাজনৈতিক নাটক করার অনুকুল পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে না।তার নানাবিধ কারণ । আসলে শাসকের কাছে থিয়েটার সব সময় বিপজ্জনক । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে থিয়েটার কোন দিনই রাজ- প্রসাদ বা রাজানুগ্রহ পায় নি । রাজারা সব সময়ই মনে করেন যে থিয়েটার মানেই তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির জায়গা। ফলে বাম সরকারের শেষ দিকে যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে নাট্যকারদের যেতে হয়েছিলো, পালাবদলের পরও চিত্র কিছু বদলালো না থিয়েটারের ক্ষেত্রে । বরং থিয়েটারে একটা বিভাজন দেখা দিল । যারা বর্তমান তৃণমূল সরকারকে সমর্থন করেছিলেন সেই নাট্যকারেরা এক ধরণের নাটক করতে শুরু করলেন আর যারা সমর্থন করেন নি তাঁরা নাটক করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হলেন । সে বাধা অলিখিত । বোঝা যায় কিন্তু সহ্য করা যায় না।দেখা গেল সরকার নিয়ন্ত্রিত নাট্য একাডেমি আর নিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করতে পারলো না ।  যার শুরু হয়েছিলো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শাসনের শেষ সময় থেকে ।  যদিও বুদ্ধদেব কখনো চান নি থিয়েটার রাজনীতির দ্বারা চালিত হোক।তাঁর স্বপ্নকে ভেঙে দিচ্ছিল নাট্য একাডেমি বা মিনার্ভা নাট্যচর্চাকেন্দ্রের কিছু কিছু ভূমিকা । আর পালাবদলের পর সেটা আরো নগ্ন হয়ে গেল । ফলে নাট্য একাডেমিতে কোন প্রবীণ মানুষ রইলেন না, যাঁরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেন।যাঁরাও বা রইলেন তাঁদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ । কাজেই সমগ্র ভাবে একুশ শতকের বাংলা নাটক ও নাট্যচর্চা দলদাসের চর্চায় পরিণত হয়েছে।

23

পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও থিয়েটার তার জন্য কিন্তু থেমে থাকে নি।নিজের খাতে বয়ে চলেছে থিয়েটার । দলবৃত্তির আধিপত্যের মধ্যে যাঁরা অন্য রকম ভাবনার নাটক করতে সচেষ্ট হলেন তাঁদের এ ক্ষেত্রে কিন্তু বাধা দেওয়া হয় নি।কারণ বাধা দেওয়া হলে অন্য ধরণের লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিলো । সেই লড়াইয়ের ব্যাপকতা অনেক বেশি হতো।কারণ মহানগরের বাইরেই তো সিংহভাগ থিয়েটারের দল । তাঁরা বেশির ভাগই শাসকের সুরে সুর মেলান নি । তাঁরা ভাবেন অন্য ভাবে।শাসক তা জানতেন নিশ্চয়ই । তাই বাধা দেওয়ার কথা ভাবেন নি । একবার ‘নাট্যসুজন’ তৈরী করে সে শক্তি পরখ করে নিতে চেয়েছিলেন শাসক শিবির । কিন্তু ফল হয়েছিলো উল্টো । কিছুদিনের মধ্যে নিজেদের মধ্যে মতান্তর হয়ে তারা নিজেরাই ভেঙে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লো । মূল চালিকাশক্তি স্বতন্ত্র স্বর নিয়ে বেঁচে রইলো আজ অবধি ।

একুশ শতকের বাংলা নাটক ও নাট্যাভিনয়ের আরো কিছু গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করা যায় । একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মূলত বাংলা নাটকে নতুনভাবে আবার লেখা ছিল ‘কোম্পানি থিয়েটার’ শব্দটি । বাংলা থিয়েটারের প্রথম পর্যায়ে এই কোম্পানি থিয়েটার জাঁকিয়ে বসেছিল । অর্থাৎ একজন ব্যক্তিমালিক এই থিয়েটারকে নিয়ন্ত্রণ করবেন । তিনি তাঁর পছন্দ মতো অভিনেতা, পরিচালক, কর্মী নিয়োগ করবেন এবং নাট্য প্রযোজনা করাবেন তাঁদের দিয়ে । তার বিনিময়ে তারা মাস-মাইনে পাবেন । আর ঐ প্রযোজনার সম্পূর্ণ লভ্যাংশ থাকবে ঐ ব্যক্তিমালিকের । আমরা এ প্রসঙ্গে মনে করতে পারি প্রতাপচাঁদ জহুরির কথা । তাঁর থিয়েটারের নামও ছিল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ অধ্যাপক দর্শন চৌধুরী এই থিয়েটার সম্পর্কে বলেছন –

“প্রতাপচাঁদের ন্যাশনাল থিয়েটার পুরোপুরি পেশাদারি থিয়েটার এবং বাণিজ্যিক থিয়েটার ।”

        অধ্যাপক চৌধুরী এই ব্যক্তিমালিকানাধীন থিয়েটারের ধরণ সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে বলেছেন –

“গ্রেট ন্যাশনাল …… বাংলা থিয়েটারকে রক্ষা করেছিল ।”

গ্রেট ন্যাশনাল নীলামে উঠলে প্রতাপচাদ ২৫ হাজার টাকায় কিনে নিলেন । ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে । অবাঙালি ব্যবসাদার প্রতাপচাঁদ জহুরি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের বাড়িতে চালু করলেন ন্যাশনাল থিয়েটার । এই প্রথম একজন পাকাপোক্ত ব্যবসায়ী বাংলা রঙ্গালয়ের মালিক হলেন । তার আগে বেঙ্গল থিয়েটারের শরৎচন্দ্র ঘোষ কিংবা গ্রেট ন্যাশনালের ভুবনমোহন নিয়োগী-পুরোপুরি ব্যবসাদার ছিলেন না । বা বলা যেতে পারে, একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে রঙ্গমঞ্চের মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব নেননি । প্রথমে ছিল নাটক অভিনয় করা এবং অভিনয়ের উন্মাদনা ভোগ করা । তারপরে শখ শৌখিনতা এবং সবশেষে আর্থিক লেনদেনের ব্যবসা । যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শেষেরটি গৌণ হয়ে পড়েছিল। 

24

কিন্তু প্রতাপচাঁদ ঝানু ব্যবসায়ী । তার অন্যত্র জহরতের দোকান এবং অন্য নানাধরনের ব্যবসা ছিল । সে দেখেছিল, অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো বাংলা থিয়েটারেও ভালো ব্যবসা করা যায় । টাকা লগ্নী করা এবং ঠিকমতো পরিচালনার মাধ্যমে সেই লগ্নীকৃত টাকা ফেরত আনা-মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে বেশি করে মুনাফা লোটা–ব্যবসায়ের এই সাধারণ সূত্র তিনি থিয়েটারে প্রয়োগ করলেন । তিনি দেখেছিলেন, লোকে থিয়েটার দেখে পয়সা দিয়ে । তাদের উৎসাহিত করে থিয়েটারে বেশি বেশি আনতে পারলে টিকিট বিক্রি বেশি হবে । ফলে লগ্নীকৃত মূলধন সহজেই বহুগুণ হয়ে ফিরে আসবে । 

কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থাটিকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, আগের অনেক মালিকের মতোই তাকেও লোকসান দিয়ে ব্যবসা চালাতে হবে । তাই একটি নিয়মবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মতো তিনি থিয়েটারের প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখলেন । কর্মচারীদের নির্দিষ্ট বেতন, হাজিরা খাতা, আয়-ব্যয়ের হিসাব-সবই পেশাদারিভাবে চালু করলেন । এই নিয়মের আওতা থেকে কারও রেহাই ছিল না, সে অভিনেতা-অভিনেত্রী, ম্যানেজার, নাট্যকার কিংবা দারোয়ান, যেই হোক না কেন । 

এই থেকেই বাংলা থিয়েটারে পাকাপাকিভাবে পেশাদারি থিয়েটার বা ব্যবসায়িক থিয়েটার তার প্রথাসিদ্ধ পথ খুঁজে পেলো । মালিকানাধীন এবং মুনাফাভিত্তিক পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাংলা রঙ্গালয়ের নতুন যুগ শুরু হয়ে গেল । পূর্ববর্তী সাধারণ রঙ্গালয়গুলির মধ্যে এই পেশাদারিত্ব কিংবা বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি এত প্রখরভাবে ছিল না । প্রতাপচাঁদ বাংলা থিয়েটারে সেটিই যথাযথভাবে চালু করলেন ।

ব্যবসা পরিচালনার নিয়মনীতি এবং শৃঙ্খলা থিয়েটারে প্রয়োগ করা হলো । রঙ্গালয়ের ভিতর ও বাইরে এই প্রথম নিয়মশৃঙ্খলা প্রবর্তিত হল । ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো থিয়েটারও একটি প্রতিষ্ঠান—এর ভালোমন্দ, লাভ লোকসান সবই নির্ভর করে তার সুষ্ঠু ও যথাযথ পেশাদারি প্রথা, মনোভাব ও প্রয়োগের উপর ।

25

এইরকম একটি থিয়েটার-প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য একজন যোগ্য ম্যানেজারের দরকার । তিনি জানলেন, সেই সময়ে থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র সেই যোগ্যতম ব্যক্তি । গিরিশ তখন পার্কার কোম্পানিতে ১৫০ টাকার চাকুরি করেন । তাকে ১০০ টাকা বেতন দিয়ে ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার করে আনা হল । সঙ্গে বাড়তি বোনাস । গিরিশ চাকুরি ছেড়ে এই প্রথম থিয়েটারকে তার জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করলেন । বাংলা থিয়েটারে ‘এমেচারিস’ গিরিশ এই প্রথম পুরোপুরি ‘প্রোফেশনাল’ হলেন । 

প্রতাপচাঁদ ও গিরিশচন্দ্রের যোগাযোগের ফলে পেশাদার বাংলা থিয়েটারের ভিত্তিটি মজবুত হল । এই দুজনে মিলে পেশাদার থিয়েটার পরিচালনার যে সব নিয়মনীতি চালু করলেন, পরবর্তী বহুদিন সেই ধারাই বাংলা থিয়েটারে চলে এসেছে । বাধাবন্ধহীন উচ্ছলতায় বাংলা থিয়েটার যখন ভেসে যেতে বসেছিল, যাকে অভিনেত্রী বিনোদিনী বলেছে ‘অশুভ গ্রহ’, সেই সময়ে এই দুজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দৃঢ়বদ্ধ নিয়মনীতি প্রায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মতো করে বাংলা থিয়েটারকে রক্ষা  করেছিল । 

        আসলে একজন পাকা ব্যবসায়ী এবং একজন শক্তিশালী অর্থাৎ প্রতিভাশালী নাট্যশিল্পীর সমন্বয়ে তৈরী হলো এই পেশাদারী থিয়েটার । এই তো কোম্পানি থিয়েটার । তবে সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে এক সময় কোম্পানির থিয়েটার লুপ্ত হয়ে যায় সেখানে আসে গণনাট্য সংঘ । তারপর গ্রুপ থিয়েটার । এখন বর্তমানে গ্রুপ থিয়েটারের সাথে সাথে আবার কোম্পানি থিয়েটারের এই ধরণের বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে । এক্ষেত্রে মূলত ব্রাত্য বসুর নাম অগ্রগণ্য । যেমন ভাবে প্রতাপচাঁদ জহুরি ও গিরিশ ঘোষের যুগলবন্দী দেখা গেছিলো । সেই ধাঁচেই বর্তমানে কোম্পানির থিটেয়ার নির্মিত হচ্ছে । তবে একথা মূলগত পার্থক্য বর্তমানে লক্ষ্য করা যায় । তা হল, আগে সরাসরি কোন ব্যবসায়ী হাত ধরতেন নাট্যশিল্পীর । আর এখন প্রযোজক একজন থাকেন বটে তবে তিনিই মূলত নাট্যশিল্পী । তবে সেই প্রযোজক অবশ্য অন্য কোন ব্যবসায়ীর সাহায্য নিতেই পারেন । এ বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় ব্রাত্য বসুর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল । সেখানে তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে তাঁর থিয়েটার সম্পূর্ণ কোম্পানি থিয়েটার । আমরা সে সাক্ষাৎকারে সমগ্র অংশই এখানে তুলে ধরলাম । যাতে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করি আমরা ।

“ঢেউ উঠেছে, বেড়া ভাঙছে

. . . . . . . . উল্লাসটা অস্বীকার করি কী করে ?”

26

        তবে মোদ্দা কথা হ’ল থিয়েটার । সে যে ভাবেই হোক । ‘গণনাট্য’- তাঁদের একটা দর্শন ছিলো । গ্রুপ থিয়েটারও তাই । আর কোম্পানির থিয়েটারে এসে জুড়লো অর্থ । অর্থাৎ বাণিজ্য ও নাটক হাত ধরাধরি করে চলুক – এটাই তাঁদের চাওয়া । তাতে শিল্পীদের যেমন ভালো হলো, তেমনি নাট্য-মানের উত্তুঙ্গতা দেখা দিল । তবে এ ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হ’ল বাজার । থিয়েটারের বাজার খুবই ছোট । অল্প দর্শক তার । কাজেই কতদিন এই পেশাদারিত্ব রাখা সম্ভব হবে তা এক মাত্র সময়ই বলবে । তবে এই প্রবণতা স্বাস্থ্যকর বাংলা থিয়েটারের জন্য ।

        বাংলা থিয়েটার শুরু থেকেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে । আজ একুশ শতকে এসে তা আরো প্রবল হয়েছে । এই সময়ের অনেক প্রবণতার কথা আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি । তবে আরো এক ধরণের নাট্যচর্চার কথা না বললেই নয় । তা হ’ল নাট্যগ্রাম নির্মাণ করে নাট্যচর্চা অন্যান্য প্রদেশের সাথে সাথে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও ‘থিয়েটার ভিলেজ’ বা ‘থিয়ে-ভিলেজ’ বা নাট্যগ্রামের নাট্যচর্চার একটা বহমানতা রয়েছে । এই দশকে তা অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে কী এই থিয়েটার ভিলেজ ? নাটকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত কিছু মানুষ যাতে আরো ভালোভাবে নাটকটাই করতে পারেন তার জন্য তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে কোন একটি গ্রামের কিছু জমিতে চাষ বাস করে, পুকুরে মাছ চাষ করে কিম্বা ক্ষেত্রে সব্জী ফলিয়ে তার লভ্যাংশের কিছু অংশ পরিবারে দিয়ে এবং কিছু অংশ নাটকের কাজে ব্যয় করে জীবিকা ও শিল্প – দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়ে শিল্পচর্চাকে অগ্রাধিকার দেন, তাই হল থিয়েটার ভিলেজের ধারণা । আর্থাৎ থিয়েটার করতে গিয়ে কোথাও যেন পরিবার প্রতিপালন করতে অসুবিধে না হয় তাই তাঁরা বিকল্প জীবিকার সন্ধান করেন এবং এতে তাঁরা সফলও হন । আসলে থিয়েটারের লক্ষ্যে জীবিকা অর্জনে ব্যাপারটি প্রবেশ করল । কারণ আমাদের দেশে এখনো থিয়েটারকে পুরোপুরি পেশা করবার মতো পরিস্থিতি নেই । তাই থিয়েটার করে সংসার চালানো সম্ভব নয় । সেই কারণে মন দিয়ে থিয়েটার করতে গেলে বা সর্বক্ষণ থিয়েটার চর্চা গেলে একটা সুনির্দিষ্ট রোজগার দরকার । এই রোজগারেরও বন্দোবস্ত তাঁরা নিজেরাই করে নেন থিয়েটারের স্বার্থে । এখান থেকেই আসে ‘থিয়েটার ভিলেজ’ বা নাট্যগ্রামের ধারণা । আসাম, মণিপুর, কেরালা, ওড়িষ্যা, তামিলনাড়ু – প্রভৃতি রাজ্য এই ধরণের থিয়েটারের চর্চা আছে । আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি এই রকম নাট্যগ্রাম আছে বর্তমানে । এখানে নিরন্তর জাতীয়মানের নাট্য নির্মাণ লক্ষ্য করা যায় । সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের পরিচিতি ঘটেছে তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে ।

        প্রথমেই যে নাট্যগ্রামটির কথা উল্লেখ করতে হয় তার নাম ‘তেপান্তর’ নাট্যগ্রাম । তাঁদের কর্ণধার কল্লোল ভট্টাচার্য । এটি বীরভূমের অজয় নদের পাশে অবস্থিত । গ্রামের নামটি ভারি চমৎকার । সাতকাহনিয়া । বর্তমান পশ্চিম বর্ধমানের বনকাঠি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই সাতকাহনিয়া গ্রাম । এখানেই প্রায় দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলেছে নিবিড় নাট্যচর্চা । ইতিহাস বলছে ১৯৯৬ সালে গ্রামের জনা ২০ ছেলেকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘এবং আমরা’ নাট্যদল । এরা সকলেই প্রায় কৃষক পরিবারের সন্তান । কিন্তু খালি পেটে তো আর নাটক হয় না । তাই স্থির হলো গ্রামের পতিত জমিতে সব্জি চাষ করা হবে, হাঁস-মুরগি পালন করা হবে – এই ভাবে উপার্জিত অর্থের কিছুটা নাটকের কাজে লাগানো হবে এবং বাকিটা তুলে দেওয়া হবে পরিবারের হাতে । এই শুরু হলো নাট্যপরিক্রমা ।

27

পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে জমির মালিকের অনুমতি নিয়ে ১২ বিঘে বন্য জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে একটু একটু করে স্থায়ী ও অস্থায়ী চালা ঘর, ইটের গাথনি দেওয়া অথচ চাপ শনপাতার নির্মিত ঘর তৈরী হ’ল । পুকুর কাটা হ’ল মাছ চাষের জন্য । তারপর ২০০৪ সালে ঐ সমগ্র জমি নিজেরা কিনে নিয়ে নাম দিলেন ‘তেপান্তর’ । এই তেপান্তরের বিভিন্ন জায়গায় নাট্যমঞ্চ তৈরী হল । কোথাও ব্ল্যাকবক্স তৈরী হ’ল । এভাবে এখানে চলতে থাকলো নাট্য নির্মাণ প্রকৃতির সান্নিধ্যে । প্রবীর গুহ, বাদল সরকারের মতো মানুষের ভালোবাসা ও প্রেরণা পেয়েছে এই তেপান্তর নাট্যগ্রামটি । পরে তো বিশ্ববিখ্যাত হয়ে পড়ে এঁদের কাজকর্ম । ২০০৫ সালে ফ্লাইং ফিশ থিয়েটার কোম্পানি এখানে এসেছিল বার্লিন থেকে । ২০০৮ সালে আসে রাশিয়ান অ্যাকাডেমি ফর থিয়েটার আর্টস । আর দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন এঁদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে । এই গ্রামের মানুষজন বেশিরভাগই ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত । কঠোর জীবন সংগ্রাম করে তাঁরা দিনপাত করেন । কিন্তু এই তেপান্তরের নাটক এঁদের বোধের জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে । বর্ষাকাল বাদে বছরের বাকি সময়ে প্রায় প্রতিদিনই তাঁরা এখানে এসে নাটক দেখেন । নানা গল্প, পরিবেশ, সংস্কৃতির হদিস মেলে এখান থেকে । তাই তাঁরা অনেকেই নিরক্ষর হলেও অশিক্ষিত নয় । নাটক ঐ গ্রামের সকল মানুষের চেতনায় আঘাত হেনেছে ।   সংস্কৃত ও মার্জিত হয়েছে তাঁদের জীবনাচরণ । সবই এই তেপান্তরের হাত ধরে । তবে এই থিয়েটার ভিলেজের কর্ণধার কল্লোপ ভট্টাচার্যের আক্ষেপ যে কলকাতার দলগুলো তাঁদের কথা বলেন না । কলকাতা তাঁদের দেখেন জেলার দল হিসেবে । নাটকের এই বৈষম্য তাঁকে বেদনাহত করে বারে বারে । যাই হোক, তেপান্তরই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম থিয়েটার ভিলেজ – যাঁরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিও অর্জন করেছেন।

        এছাড়া এই বীরভূম জেলাতেই আরো দু’একটি নাট্যগ্রামের সন্ধান মেলে । সে রকম একটি নাট্যগ্রাম হল ‘নিভৃত পূর্ণিমা নাট্যগ্রাম’ ।  এটি বোলপুর শহরের মধ্যেই নির্মিত । এর কর্ণধার হলেন জুলফিকার জিন্না । অন্যদিকে বহরমপুরে ছ’বিঘে জমির ওপর তৈরি হয়েছে একটি নাট্যগ্রাম । ‘বহরমপুর গাঙচিল’ নাট্যদল এটি নির্মাণ করেছে ।

        এই থিয়েটার ভিলেজ একুশ শতকের প্রথম দুই দশকে বেশ সাড়া জাগিয়েছে । খুবই সাধারণ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা, আদিবাসী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা নিষ্ঠার সাথে এখানে কাজ করেন । তাঁরা এখন বাংলা নাটকের সর্বক্ষণের কর্মী । সম্পদ । শিল্পী । কলকাতা তাঁদের থেকে মুখ ফেরালেও তারা কিন্তু থেমে নেই । তাঁদের কাজ তাঁরা করে চলেছেন নিরন্তর । নিরলস । বাংলা নাটককে এক নতুন দিশা দেখাচ্ছেন তাঁরা । আস্তে আস্তে হয়ে উঠছেন বাংলা নাটকের এক দৃঢ় স্বর । তবে এই প্রচেষ্টা তো আর একদিনে করা যায় নি । প্রায় আড়াই দশকের লাগাতার শ্রম রয়েছে এর পেছনে । নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে । সব কিছুকে সামলে সামনে এগিয়ে চলা এবং উন্নতমানের প্রযোজনা উপহার দেওয়া যেমন সহজ কথা নয়, তেমনই বাংলা নাট্যজগতের জন্য তা শ্লাঘার বিষয়ও বটে ।

        একশ শতকের দ্বিতীয় দশকের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সমগ্র বিশ্ববাসী এক বিরাট মহামারির সম্মুখীন । কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কোটি কোটি মানুষ মারা যাচ্ছেন সারা পৃথিবী জুড়ে । আর যেহেতু এই ভাইরাস হাঁচি-কাশির মধ্যে দিয়ে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় তাই এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল মানুষ থেকে মানুষের দূরে থাকা । দূরত্ব বজায় রাখলে তো আর থিয়েটার হবে না । তাই নাটক এই বৈশ্বিক মহামারির কারণে সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ । ফলে অনেকেই এর বিকল্প পথ খুঁজছেন । প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে মানুষ গৃহবন্দী ।  স্কুল-কলেজ-বাস-ট্রেন-সিনেমা হল – সব বন্ধ । মানুষ মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পাচ্ছে না । তাই বাংলা থিয়েটারের মানুষজনও নতুন পথ খুঁজছেন । বড় বড় প্রসেনিয়াম মঞ্চে আর অভিনয় করা অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব নয় । তাই অনেকেই ছোট জায়গায় সামান্য ব্যয়ে নাটক করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন । ইতিমধ্যেই অনেক নাট্যদল তৈরী করে ফেলেছেন নিজস্ব ছোট মঞ্চ । যাকে বলা হচ্ছে ‘ইন্টিমেট থিয়েটার স্পেস’ বা ‘অন্তরঙ্গ মঞ্চ’ । অল্পকালের মধ্যেই সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে এরকম অন্তত আটটি হলের উদ্বোধন হয়েছে । দর্শকদের সঙ্গে এই মুহূর্তে দেখা হবার কোন সুযোগ নেই । গত বছর অক্টোবর মাসে থিয়েটার হলগুলো খুললেও তাতে দর্শকের দেখা মেলে নি । ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাটকওয়ালারা । তাই নাট্যদলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে এই ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন । এখন তাঁদের ভরসা বলতে ‘ব্ল্যাক বক্স’, ‘স্টুডিও থিটেয়ার’, কিংবা ছোট হলগুলো ।

28

        ‘ইফটা’ নাটকের দল দমদমের একটি বাড়ির ছাদে বানিয়েছে ‘থিয়ে অ্যাপেক্স’ নামের ছোট্ট একটি প্রসেনিয়াম মঞ্চ । এখানে ৫০ জন দর্শকের বসারও ব্যবস্থা আছে । এখানে মঞ্চ ছোট হলেও আলো এবং শব্দ প্রক্ষেপণের ব্যবস্থা কিন্তু আধুনিক । লকডাউনের ফলেই তাঁরা এমন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন । আবার ‘অমল আলোয়’ নাম দিয়ে অন্তরঙ্গ মঞ্চ নির্মাণ করেছেন ‘অশোকনগর নাট্যমুখ’ অশোকনগরে । এতে আসলে প্রযোজনার ব্যয় অনেক কম হচ্ছে ।   ফলে কাজ করতে সুবিধে হচ্ছে দলগুলোর । এই পথেই চাকদায় নির্মিত হয়েছে এই ধরণের মঞ্চ । ‘চাকদা নাট্যজন’ তৈরী করেছে ‘আঙিনা’ নামের একটি ব্ল্যাক বক্স । এরই সঙ্গে রয়েছে একটি ‘ক্যাফে থিয়েটার’ । এখানে নাটক দেখতে দেখতে কিছু খেয়েও নেওয়া যাবে । ‘মহিষাদল শিল্পকৃতি’ মহিষাদলে তৈরী করেছে ‘মহিষাদল নাট্যমঞ্চ’ । ‘কল্যাণী নাট্যচর্চাকেন্দ্র’ অবশ্য অনেক আগেই তৈরী করেছে একটি সুসজ্জিত অন্তরঙ্গ থিয়েটার মঞ্চ, যার নাম ‘তাপস সেন – কুমার রায়’ মঞ্চ । ‘চেতনা’ নাট্যদল কলকাতার আনোয়ার শাহ রোডে নির্মাণ করেছেন অত্যাধুনিক ‘ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়’ মঞ্চ । শুবাশিস মুখোপাধ্যায় ও ইশিতা মুখোপাধ্যায় বিক্রমগড়ে একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তুলেছেন তাঁদের নিজস্ব ‘স্টুডিও থিয়েটার’ ।

        এই অতিমারিকবলিত সময়ে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই ধরণের অন্তরঙ্গ মঞ্চগুলি । নাট্যদলগুলো তাঁদের প্রযোজনাগুলো সফল ভাবে মঞ্চস্থ করতে পারছে এই মঞ্চগুলি নির্মাণ করে । অল্প দর্শক আসন হওয়ায় তা পূরণ হতেও অসুবিধে হচ্ছে না । ফলে একুশ শতকের বাংলা নাটক এখন এক নতুন পথে চলেছে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে । সময়ের দাবী মেনেই এ বদল এসেছে বাংলা থিয়েটারে ।

কাজেই দেখা যাচ্ছে একুশ দশকে বাংলা নাটক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলেছে । তার সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে হচ্ছে তাকে । তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা নাটকের মান আরো ভালো হয়েছে । যারা পেশাদার দল নয় তারাও চেষ্টা করে চলেছেন ভালো মানের নাটক করবার । বিজ্ঞাপন বা প্রচারের জন্য দলগুলো এখন অতি সহজেই নানান সামাজিক মাধ্যমকে (ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি) ব্যবহার করে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারছে । শুধু স্থির চিত্র নয়, চলচ্চিত্র করেও বিজ্ঞাপন দিতে পারছেন এ সময়ের দলগুলো । আবার অন-লাইন টিকিট বিক্রির ফলে দর্শকদেরও অনেক সুবিধে হয়েছে টিকিট পেতে । ঘরে বলেই নিজের পছন্দমতো আসন কিনতে পারছেন । কাজেই অনেক ইতিবাচক দিক এসে পড়েছে প্রযুক্তির হাত ধরে বাংলা নাটকে একটা সীমিত সংখ্যক মানুষের শিল্প বা ‘মাইনরিটি আর্ট’ হলেও নাটক বরাবর তার নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে ক্রমাগত উন্নত হয়েছে বাংলা নাটক । তার ধারা আজও অব্যহত ।

29

সূত্র নির্দেশ

১)     বর্তমান গবেষক কর্তৃক নাট্যকার চন্দন সেনের সাক্ষাৎকার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

২)     বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস, দর্শন চৌধুরী, পঞ্চম পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ,

        ২০১১, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃঃ ১৭৫

৩)     তদেব পৃঃ ১৭৫-১৭৬ ।

৪)     আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪২০, রবিবার ৮ ডিসেম্বর, Link :

http://archives.anandabazar.com/archive/1131208/8edit2.html

৫)     You Tube link : http://youtu.be/6FbHj-07f4A

৬)     বর্তমান পত্রিকা, কলকাতা, মঙ্গলবার, ৬ জুলাই, ২০২১

        Link : http://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=26886

——————————————————————————————————————

লেখক পরিচিতি :  কৃষ্ণপদ দাস, গবেষক, (বাংলা বিভাগ) বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফোন নম্বর – 7003787726/ 9836680333, E-mail : krishnapadadas57@gmail.com