অঞ্জলী লহ সঙ্গীতে
পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
‘বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।’
নজরুল ছিলেন বাংলা গানের জগতে একজন সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত গীতিকার, সুরকার, এবং এবিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ শ্রেষ্ঠ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই আর গান ছিল নানা শাখায় পল্লবিত। যদিও রবীন্দ্রনাথের গানের সাংগীতিক শৃঙ্খলা, দার্শনিক ভাবের গভীরতা ও সুরের আত্তীকরণ এবং সহজ প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার যে প্রয়াস সংগীত গবেষকদের চোখে ধরা পড়েছে, সেগুলি আমরা নজরুলের গানে সেই অর্থে পাইনা। এতদসত্ত্বেও আমরা স্বীকার করতে কুন্ঠিত বোধ করব না যে রবীন্দ্রনাথের পরের প্রজন্মের বাংলা গানকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করার যে দুঃসাহসিকতা তিনি এই সময়টিতে দেখিয়েছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয় এবং অন্যান্য গীতিকার ও সুরকার দের মধ্যে সেই প্রচেষ্টার অভাবও লক্ষণীয়।
রবীন্দ্রনাথ একটা নিজস্ব স্টাইল বা শৈলী তৈরি করেছিলেন, যার সাহায্যে রাগ সংগীত, লোকসংগীত, কীর্তনাঙ্গ, টপ্পা এবং অন্যান্য দেশি-বিদেশি সংগীতকে আত্তীকরণ এর মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। সেটা কিন্তু নজরুল সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। এর ফলে কি হয়েছে বাণী বর্জিত গানের সুর শুনলেও আমরা সহজে বলতে পারি যে এটি রবীন্দ্র সংগীতের সুর। নজরুল কিন্তু এ ব্যাপারে বেশ গোঁড়া ছিলেন। ফলে তাঁর গানের সংগীত শৈলির ব্যবহার শুনে সব সময় নজরুলের গান হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। ফলে অন্যের দ্বারা নজরুলের গানের বিকৃতির এটা একটা প্রধান কারণ তা আমরা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বা রাগ সংগীতের প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের বিশেষ ঝোঁক ছিল কারণ বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী জমির উদ্দিন খান সাহেবের শিক্ষা উনাকে খুব প্রভাবিত করেছিল।সঙ্গীতকার হিসাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তার এই আগ্রহ ছিল সহজাত। তাঁর রচনায় শাস্ত্রীয় সংগীত মূলত খেয়াল, ঠুংরী ও গজল এর প্রভাব সর্বাধিক।এই কারণবশত নজরুলের গানে রাগ সঙ্গীতের আভাস মিললেও রাগ ভিত্তিক নজরুলগীতি আলাদা করা মুশকিল। কাব্যগীতি, ভক্তি গীতি, দেশাত্মবোধক, এহেন বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা গেলেও এর মূল নিহিত রয়েছে খেয়াল ও ঠুংরিতে।
তাই নজরুল ভিত্তিক গান বলতে আমরা তার খেয়াল ধর্মী গানকেই বুঝি। এটি একটি আধুনিক গানের ধারাও বটে। সেই সময়ের কলকাতাকেন্দ্রিক গ্রামোফোন কোম্পানি গুলিতে বিভিন্ন ধরনের সাঙ্গীতিক গবেষণার পরিসর ছিল। তাই রাগ সঙ্গীতের প্রাঙ্গণও ছিল বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নজরুল অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই ধারায় রচিত গান মূলত খেয়াল ধর্মী হলেও, এতে খেয়ালের সৃষ্টিশীলতা ও বাংলা গানের কাব্যময়তার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। নিজেকে এইটুকুতে সীমাবদ্ধ না রেখে নজরুল বেশ কিছু নতুন রাগ সৃষ্টি করেন এবং পুরনোগুলোর প্রসার ঘটান। সেই সময়ে সম্প্রসারিত রেডিও প্রোগ্রাম গুলির মাধ্যমে এই গানগুলি ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির মুখে মুখে।
নজরুলের রাগভিত্তিক গানগুলি কিছু ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে প্রথমে আসে ভাঙ্গা গানের প্রসঙ্গ। শাস্ত্রীয় সংগীতের বন্দিশ ভাঙ্গা গান এগুলি। মূল বন্দিশগুলি নজরুল জমির উদ্দিন খান ও এইচএমভির সঙ্গে যুক্ত শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদ দের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। দ্বিতীয় ভাগে আমরা রাখতে পারি সেইসব গান, যেগুলি ওনার সৃষ্ট নতুন রাগগুলির আধারে রচিত ও কিছু গান যেগুলি অপ্রচলিত রাগাশ্রিত।এই ক্ষেত্রে নজরুলের সাফল্য সর্বজনবিদিত এবং এই ধরনের গানে উনি পুরোধা। এ কথা মনে রাখা উচিত যে, এই কাজ উনি শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি। আকস্মিক রোগভোগ তার থেকে সবটুকু ছিনিয়ে নিয়েছিল।
জানাযায়, নজরুল তিরিশটির মত নতুন রাগ সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও শুধুমাত্র সতেরোটির সন্ধান কিছু লক্ষণ গীত রচনা করেছিলেন যাতে রাগ বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। ওর রচিত তাল গুলির মধ্যে ছ’টি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সেগুলি হলো প্রিয়া, স্বাগতা, মন্দাকিনী, মঞ্জুভাসিনি, মনিমালা ও নব নন্দন। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতে নজরুল যে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিলেন তার ফলস্বরূপ বিভিন্ন ধারায় সংগীত রচনা করে গেছেন তিনি। কাজরী, হোলি, ঝুলা, শাওনি, শাওন এর আধারেও গান রচনা করেছেন।
হিন্দুস্তানি রাগ প্রত্যেক মত অনুসারে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। মৌলিক রাগ গুলিকে শুদ্ধ, এক রাগে অপর একটি বা একাধিক রাগের ছায়া থাকলে সালগ বা ছায়ালগ এবং একাধিক রাগের স্পষ্ট মিশ্রণ ঘটলে মিশ্র বা সংকীর্ণ বলা হয়। বাঙালি সুরকারগণ এই প্রকৃতির সংকীর্ণ রাগ-রাগিনীকে অত্যন্ত খুশি মনে গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দুস্তানি ওস্তাদেরা বাঙালির এই স্বভাবকে খুশিমনে গ্রহণ করতে পারেননি।ফলে এই জাতীয় তৃতীয় শ্রেণীর মিশ্রণ বা সংকীর্ণ রাগ রাগিনী সারা ভারতের মধ্যে একমাত্র বাংলাতেই প্রচলিত ছিল। নজরুল ও তার প্রথম জীবনে এই জাতীয় রাগ অবলম্বন করে অনেক গান তৈরি করেছিলেন। যেমন-
অমর কানন মোদের – বেহাগ খাম্বাজ
আজি দোল পূর্ণিমাতে – কালাংড়া বসন্ত
আজি বাদল ঝরে মোর – ভৈরবী আশাবরী
আধো ধরণী আলো – তিলক কামোদ পিলু
আমরা পানের নেশায় পাগল -বাগেশ্রী কাফি
আসলো যখন ফুলের ফাগুন – দুর্গা মান্ড
ঊষা এলো চুপি চুপি – আশা টোড়ি
এত কথা কি গো কহিতে – খাম্বাজ দেশ
ওই পথ চেয়ে থাকি – খাম্বাজ পিলু
আমি চঞ্চল – শাহানা বাহার
আজি নন্দদুলালের সাথে – খাম্বাজ কাফি
আবার ভালোবাসার সাধ – ইমন পূরবী
আমরা দুঃখের বন্ধু – ছায়ানট কেদারা
এ কোন পাগল পথিক – মেঘ ছায়ানট
উচাটনো মন ঘরে রয় না – গারা খাম্বাজ ইত্যাদি।
এইসব ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে যেটা দেখা যায় সেটা হলো যে রাগটির নাম শেষে থাকে তার প্রাধান্য বেশি থাকে। তবে উল্টোটা যে দেখা যায় না তা নয়। নজরুলের গানে এই জাতীয় মিশ্র রাগে উভয় প্রকার রীতিই লক্ষনীয়।
নজরুল যেমন হিন্দুস্তানি পদ্ধতির শুদ্ধ সংকীর্ণ শ্রেণীর রাগকেও সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং প্রায় সব রকম মতকেই সম্মান জানিয়েছেন। তেমনি হিন্দুস্তানি পদ্ধতির মান রক্ষার জন্য অনেক সময় বাংলায় প্রচলিত মিশ্র বা সংকীর্ণ শ্রেণীর রাগগুলিকেও মিশ্র রূপে চিহ্নিত করেছেন।যেমন বেহাগ মিশ্র বা মিশ্র বেহাগ, মিশ্র মালবশ্রী, বা মালবশ্রী মিশ্র, বাগেশ্রী মিশ্র, ভূপালী মিশ্র, ভৈরবী মিশ্র, পিলু মিশ্র, খাম্বাজ মিশ্র, মিশ্র বেলাবল, মিশ্র খাম্বাজ ইত্যাদি।
নজরুল তাঁর গানে আরো তিন প্রকারের রাগরাগিণীর রূপের ব্যবহার করেছেন। যেমন উত্তরীয় লুটায় আমার- হৈমন্তী রাগে আধারিত। দ্বিতীয়তঃ বাংলার নিজস্ব কিছু শুদ্ধ রাগ রাগিনী বা প্রচলিত হিন্দুস্তানি রাগরাগিণীর থেকে ভিন্ন ছিল। যেমন শুদ্ধ মধ্যম যুক্ত হিন্দোল বা সোহিনী, কোমল নিযুক্ত ভৈরব, তীব্র মধ্যম বর্জিত রামকেলি, শুদ্ধ ‘ধা’ যুক্ত পূরবী, কোমল ‘নি’ যুক্ত মুলতানি ইত্যাদি। নজরুল এই জাতীয় রাগেও তাঁর গানের সুর করেছেন। সবশেষে নজরুল অনেক রাগ রাগিনী ও তৈরি করেছিলেন যেমন রেনুকা, দোলনচাঁপা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি স্বল্পসংখ্যক দক্ষিণ ভারতীয় রাগও ব্যবহার করেছেন। যেমন, নাগসরাবলী, মনোরঞ্জনী, কর্নাট সামন্ত ইত্যাদি।
এহেন সৃষ্টিশীলতার নান্দনিক প্রকাশে নজরুল রেখে গেছেন বাংলা গানের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। বাংলা আধুনিক সঙ্গীতের ধ্রুপদী ধারার তিনিই কান্ডারী।
তথ্যসূত্র
১। https://bani.com.bd/author/11/
নজরুলের বই সমূহের তালিকা http://nazrulinstitute.portal.gov.bd/sites/default/files/files/nazrulinstitute.portal.gov.bd/publications/d7989160_07b4_46fe_88ab_b594f55530df/Publication%20List%202017.pdf
নজ্রুলের গানের একটী গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট https://www.kazinazrulislam.org/%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%80%E0%A6%A4/