September 21, 2020

Rabindranath in Dual Contemplation: Exploring the Complexity of His Perspectives

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture


Dr. Mali Mitra. Memari College, Asst. Prof. In Music.
Abstract:
Of all the songs compiled in Rabindranath Tagore’s Gitabitan, those that are
formal can be expressed in a dual sense. These songs were originally printed
in the second volume of the Psalms. In this discussion, an attempt has been
made to express Rabindranath’s dualistic thinking by expressing the formal
songs of Rabindranath in written form rather than in tune. For example, the
first song at this stage can be said”Dual Contemplation, ‘Patiya Boso O
Hridyanath—“This song was composed by the poet on the occasion of the
marriage of a relative (1304). As such, this song can be called a “wedding
song”, but it can also be expressed in another way – formless through the
lyrics Brambha is invoked to sit on the throne for offering pujas.
In this discussion, an attempt has been made to bring out the dualistic style
of some formal songs composed by Rabindranath from the Writing Fence
through qualitative discussion.
Word index: Rabindranath, Gitbitan, formal stage, Ambiguity.etc.

দ্বৈত চিন্তায় রবীন্দ্রনাথ

ডঃ মলি মিত্র, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেশর, সঙ্গীত বিভাগ, মেমারী কলেজ, মেমারী, পূর্ব বর্ধমান

কালজয়ী সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের গান। তাঁর সাহিত্য, নাটক, নৃত্য ও সংগীত অমর কীর্তি বহন করে, যাতে আমরা নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার প্রাণ স্পন্দনকে কেন্দ্র করেই, আজ তার বিশাল ব্যাক্তি। সকল সম্প্রদায়িক ভাবের ঊর্ধ্বে সংগীত বলে আমার মনে হয়। তাঁর গানের চর্চার মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলছি এবং তাঁর রচনা থেকে নানা প্রকার আলোচনা করার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছি তাই আজ আমি রবীন্দ্রনাথের আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গান নিয়ে অর্থাৎ সেই গানের কথা আমার কাছে ঠিক কিভাবে পৌঁছায় তা আলোচনা করব বলে তৈরি হয়েছি।

প্রকৃতপক্ষে রবি ঠাকুর প্রকৃতির ও সৌন্দর্যের কবি । ধর্ম ও ছিল তা একান্তভাবে তাঁর কবির ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ কোন এক জায়গায় বলেছিলেন আমাদের দেশের গান অন্তরের অন্তস্থল থেকে উদ্ভূত হয়, ইউরোপীয় সংগীতের মতো তা সমাজের মধ্যে থেকে জীবন লীলার সূত্রে আসে না। তাঁর সচল অনুভূতি সকল প্রকার রচনার মধ্যেই অন্তর নিবিষ্ট ছিল। সেই জন্যেই আমাদের সংগীতে হাসির গান বা ওই জাতীয় চপল চালের চলন নেই । কথাটা বোধহয় সত্য যে গানের উদ্দেশ্য শুধু সাম্প্রদায়িক আনন্দদান , তার বাইরে তার আর কোন মূল্য থাকে না। তবে রবি ঠাকুরের গানের মধ্যে আমরা সদা সর্বদা উপলব্ধি করি যে গানের রস কে সুরে এবং কথার সুর সরস্বতীকে প্রতিস্থাপন করতে যা শুধু সাময়িক নয়।

আমি আমার মূল লেখাতে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় সকলকে জানানো আমার কর্তব্য বলে মনে হচ্ছে , তাই কিছু বিষয় সবাইকে অবগত করিয়ে আমি আমার মূল লেখাতে যাব।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সকল গান ই যে গীতসংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল তার নাম গীতবিতান। যা সর্বজন পরিচিত এবং জনপ্রিয় বটে । তবে একটা কথা বলা অবশ্যক যে এই গীত সংকলনটি প্রকাশের ক্ষেত্রে কবির বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কারণ গান একান্তই সুর নির্ভর হলে মুদ্রিত গানের কথায় সুরের অভাব কবিকে পীড়া দিত। যখন চিত্রাঙ্গদা (নৃত্যনাট্য) প্রকাশক উল্লেখ্য তাই একবার কৌতুক করে তিনি বলেছিলেন যে ওরাই যে পাখির ডানার ধর্ম তার মাটিতে হেঁটে চলা হাস্যকর ঠেকে।

তা সর্তে ও কবির গীতগ্রন্থ প্রকাশের দাবি ও প্রয়োজন ছিল, দুটি কারণে – প্রথমতঃ, কবির গানগুলির ক্রমশ জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছিল, পাঠকদের কাছে গানগুলির একত্র রূপে থাকা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ রবীন্দ্রনাথের গানগুলি সুর ছাড়া আদর্শ গীতি- কবিতা হিসাবে পাঠ করা যায় এবং তা অত্যন্ত সুখ শ্রাব্য এই কারণে ও গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

১৯২৫ সালে কবির  গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয় “প্রবাহিনী” নামে, এতে গানের সংখ্যা ছিল ২৩৪। গানগুলিকে গীতগান, প্রত্যাশা, পূজা অবসান ঋতুচক্র এবং বিবিধ এই পর্যায়ে গুলিতে ভাগ করা হয়েছিল, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তাঁর রচিত গানের সংখ্যা আরো বেশি ছিল,  এরপর চৈত্র ১৩৩২ থেকে জ্যৈষ্ঠ  ১৩৩৩ পর্যন্ত রচিত গান “প্রবাসী” পত্রিকায় “চৈতালি” নামে প্রকাশিত হয়, কিন্তু এগুলি ও গীত সংকলন হিসাবে প্রকাশিত হয়নি। তাই কবি ৭0 বছর বয়সে “গীতবিতান” প্রকাশের আয়োজন করা হয়।

১৯৩৮ সালে গীতবিতানের প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় , এই দুটিতে গানের সংখ্যা ১১২৮টি। পরের বছর প্রকাশিত হয় তৃতীয় খন্ড এতে গানের সংখ্যা ৩৫৭। অতএব গীতবিতান প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত কবির মোট গীতসংখ্যা ছিল ১৪৮৫ টি । এই তিনটি খন্ডের সম্পাদনা করেছিলেন তৎকালীন আশ্রম স্বামী শ্রী সুধীর চন্দ্র এবং একে সহায়তা করেছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। সম্ভবত এই কাজটির নেপথ্যে ছিলেন দীনেন্দ্রনাথের ।  প্রথম সংস্করণ “গীতবিতান” কবিকে প্রসন্ন  করেনি । এর গানগুলি কালানুক্রমিক ভাবে সাজানো হয়েছিল, অর্থাৎ কবির প্রথম বয়স থেকে  প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ বা গানের বই ধরে প্রকাশকালের হিসেব করে পরপর সাজানো হয়েছিল গানগুলিকে। এর সাথে ছিল বিস্তারিত সূচিপত্র,  কিন্তু প্রেম, পূজা, প্রকৃতি বা অনুরূপ কোনো বিষয় বিভাগ গানগুলিতে ছিল না। কবির নিজের ইচ্ছায় তাঁর রচিত ১৪৮ টি গান এতে বাদ দেওয়া  হয়েছিল।

রবীন্দ্রসংগীতের কালানুক্রমিক  ভাবে তাঁর বিচারে গীতবিতান প্রথম সংস্করণে যথেষ্ট ভুল ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে কবি স্বয়ং তাঁর সমগ্র সংগীতকে নতুন ভাবে বিন্যস্ত করলেন এবং ১৩৪৮ এর পূর্বে গীতবিতান প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড বর্তমানে আমরা যে রূপে পাই সেই রূপের নির্দেশে কবির নির্দেশে প্রস্তুত হয় এবং তার সাথে সাথে প্রকাশিত হয়।  

নতুন সংস্করনের গান গুলির গীতি পর্যায়ে কবি এইভাবে বিন্যস্ত করেছিলেন। প্রথম পূজা পর্যায়, দ্বিতীয় স্বদেশ পর্যায়, তৃতীয় প্রেম পর্যায়, চতুর্থ প্রকৃতি পর্যায় পঞ্চম বিচিত্র পর্যায় সর্বশেষ অর্থাৎ ষষ্ঠ আনুষ্ঠানিক পর্যায়। তিনি পূজা পর্যায়ের আবার কয়েকটি উপ পর্যায়ের তৈরি করেছিলেন সেগুলি যথাক্রমে গান, বন্ধু, প্রার্থনা, বিরহ, সাধনা ও সংকল্প, দুঃখ, আশ্বাস, অন্তর্মুখে, আত্মবোধন, জাগরণ, নিঃশ্বয়, সাধক, উৎসব, আনন্দ, বিশ্ব, সুন্দর, বাউল, পথ শেষ, পরিনয়় ও বিবিধ। এছাড়াও তিনি প্রেম পর্যায়ের দুটি উপপর্যয়কে দেখিয়েছেন প্রথম গান, দ্বিতীয় প্রেম বৈচিত্র।

কবির মৃত্যুর পরে আরো একটি খন্ড প্রকাশিত হয় গীতবিতানের। যা আমরা সবাই তৃতীয় খন্ড হিসেবে জেনে আসছি। এই খন্ডের গীত সংকলন গুলির ক্ষেত্রে কবির কোন নির্দেশ ছিল না। প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়নি এমন যাবতীয় গানই তৃতীয় খন্ডে স্থান পেয়েছে। ১৯৫১ সালে অর্থাৎ কবির মৃত্যুর ১০ বছর পর যখন প্রকাশিত হয় তখনকার গানের সংখ্যা ছিল ৭৩২। কবির আরো অনেক গানের সন্ধান পাওয়াতে সেই সংখ্যা বর্তমানে আরো বেড়েছে।এই খন্ডের স্ংকলিত গান গুলির বিষয়  বিভাগ ও গীতসংখ্যা এই রূপ- ভানুসিংহ (২০), নাট্যগীতি (১২৬), জাতীয় সংগীত (১৬), পূজা ও প্রার্থনা (৮২), অনুষ্ঠানিক (১৭), প্রেম ও প্রকৃতি (১০২), এছাড়াও এই  গ্রন্থে গীতিনাট্য বাল্মিকী প্রতিভা, মায়ার খেলা, ও মায়ার খেলা, নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, শ্যামা। এই খন্ডের গ্রন্থে শ্যামার পূর্ব রূপ পরিশোধ ও মায়ার খেলার নৃত্যনাট্য রূপ মুদ্রিত হয়েছে।

এর থেকে আমি বিশেষভাবে উপনীত হলাম যে আজকে আমি আমার আলোচনায় আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গান নিয়েই আলোচনা করব। তবে লেখনীর পরিধি যেহেতু সংক্ষিপ্ত সেই জন্য আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের সমস্ত গানকে নিয়ে আলোচনা না করে আমি বিশেষ কয়েকটি গানকে নিয়েই আলোচনা করব।

প্রথমে বলি আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গীতসংখ্যা। আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে বলে যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে গীতসংখ্যা ২১ এবং আনুষ্ঠানিক সংগীত ও বলে যে সংখ্যাটি রয়েছে সেটি হল ১৭।  এই অনুষ্ঠানিক পর্যায়ের যে ২১ টি গান আছে সেই ২১ টি গানের মধ্যেই কয়েকটি গানকে নিয়ে আলোচনা করব।

আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের প্রথম গানটি হল – “দুটি হৃদয়ের একটি আসন পাতিয়া বসো হে হৃদয়নাথ” – এই গানটি কবি মাত্র ৩৬ বছর বয়সে রচনা করেছিলেন, রচনা কাল ছিল ১৩০৪, এই গানটি স্বরবিতান ৫৫ তে আছে। কবি কোন এক আত্মীয়ের  বিয়ে উপলক্ষে এই গানটি রচনা করেন অর্থাৎ এই গানটি বিবাহ উপলক্ষে গাওয়া হয়ে থাকে। গানটি সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আসীন। গানটির কথা কে যদি আমরা লক্ষ্য করি সেখান থেকে একেবারেই ফুটে ওঠে যে কবি তাদের যথার্থভাবে আশীষ জানিয়েছেন। তাদের বিবাহ এবং বিবাহিত জীবন যেন সুখের হয়। তাই তিনি বলেছেন – “প্রাণেশ” , তোমার  প্রেম অনন্ত জাগাক হৃদয়ে ছিল বসন্ত, যুগল প্রাণের মধুর মিলনে করো হে ক্রন্দন নয়ন পাও।“ এই একই গানে তিনি আরো বলেছেন-  “আজি কি তোমার প্রসাদ অরুণ করুক প্রকাশ নবপ্রভাত তব মঙ্গল তব মহত্ব, তোমারি মাধুরী, তোমারে সত্য দোঁহার চিত্তে রহুক নিত্য নব নব রূপে দিবস রাত।“

রবি ঠাকুর এই গানটিকে বিয়ের গানে প্রকাশ করলেও অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে এর পূজার নিবেদন লক্ষ্য করা যায়। গানটির বিশ্লেষণের মধ্যে আমরা যদি যাই সেখানে দেখতে পাব রবি ঠাকুর এই রূপ গানের শব্দের মধ্যে বেশ কিছু শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে নিরাকার দেবতা সিংহাসনে আসীন। যেমন- “হৃদয়নাথ”, “প্রাণেশ”। এছাড়াও এই গানটি কে বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায় যে কবির ঈশ্বরের কাছে যে নিবেদন এই গানটির কথার দিক থেকে ও যথাযথ ভাবেই সেই নিবেদন । যেমন- “ তব মঙ্গল, তব মহত্ব, তোমারি মাধুরি তোমারি মতো দোঁহার চিত্তে রহুক নিত্য নব নব রূপে দিবস রাত।“ অর্থাৎ আমাদের সামনে অধিষ্ঠান করেন এবং তার মাহত্বের ফলে আমাদের জীবনে সকল প্রকার মঙ্গল সাধন , আর সবকিছুই সত্য। পুরো ঘটনাটা প্রত্যেক লাইনের ব্যাখ্যা না করে কিছু কিছু জায়গায় অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে লক্ষ্য করা যায় যে এটি শুধু অনুষ্ঠানের পর্যায়ের গান নয় এটি পূজার গান বটে। কারণ জেনে নিরাকার ব্রম্ভ তার ব্যাক্তি অপরিসীম তিনি নব নব রূপে বিরাজ করেন সর্বত্র।

এই পর্যায়ের আরো একটি গানের কথা উল্লেখ করি সেটি – “সুখে থাকো আরো সুখী করো সবে” – এই গানটি আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে পঞ্চম গান এই গানটিতে কবি যেমন দুটি নর-নারীর প্রেমের কথা বলেছেন ঠিক তেমনি ভাবেই তিনি তাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়ে দ্বৈত মনোভাবের কথা স্পষ্ট করেছেন বলে মনে হয়। এই গানটির কথাগুলিকে যদি আমরা পড়ি তাহলে আমরা সেখানে দেখতে পাবো তিনি আমাদেরকে পথভ্রষ্ট যাতে না হয়ে যাই সেদিকে তিনি লক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন হে করুণা-সিন্ধু তুমি আমাদের পথ দেখাও আমরা যেন সদা সর্বদা তোমার উপর নির্ভর  করে থাকতে । জীবনের যা কিছু কাজ আছে তা যেন নীরবে পালন করতে পারি। সব শেষে বলেছেন- হে দীন দয়াময় এমন বল দিও যাতে দুঃখ কষ্টেও অবিচল থাকতে পারি, শুধু তোমার নামে প্রেম বলে অটল থাকতে পারি। আমাদের  ইচ্ছা বিপদে, সম্পদে, শোকে, উৎসবে তুমি আমাকে তোমার ছায়ার তলে আটকে রেখো। এই অভিব্যক্তি বা অনুভুতি সম্পূর্ণ একান্তভাবেই তার বলে মনে হয়। এই গানটি খুবই ২৭ বছর বয়সে রচনা করেন। এই গানটির রাগ ইমন-ভূপালী, তাল – কাওয়ালী, গানটি স্বরবিতান ৮ নম্বর খন্ডে পাওয়া যায়। এই গানটি সম্পর্কে জানা যায় যে ফরমায়েশি গান, রবীন্দ্রনাথকে অনেক লিখতে হয়েছে জীবনে এই গানটি তারই আরো একটি দৃষ্টান্ত। সত্যেন্দ্রনাথের পর  দ্বিতীয় হলেন আই সি এস হল বিহারীলাল গুপ্ত। ঠাকুর পরিবার ও রবীন্দ্রনাথের সাথে অনেকদিন থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আটকে তিনি জেলা জর্জ ছিলেন।  রবীন্দ্রনাথ সেখানে  জমিদারি সংক্রান্ত কাজে গিয়ে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৩ সালে। এর পত্নী সৌদামিনী গুপ্ত সখি সমিতির অন্যতম সখী ছিলেন। এর কন্যা স্নেহলতার সঙ্গে কুমুদনাথ সেনের বিবাহ হয় ২রা মে ১৮৮৯ সালে। এদের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ (তিনি তখন মহারাষ্ট্রের কিরাকতে) আশীর্বাদী  স্বরূপ গানটি লিখে পাঠিয়ে দেন। স্নেহলাতা দেবীর আত্মীয় স্বজনের কাছে থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ সরলা দেবীকে গানটিতে সুর দিতে বলেছিলেন। সরলা দেবী বিবাহ সবাই গানটি করেন। সরলা দেবী মাতুলের প্রিয় অনুচরী ছিলেন।  শত গান নাম দিয়ে তার একশত গানের স্বরলিপি প্রস্তুত করেছিলেন।

আরো একটি গানের উল্লেখ করি, সেটি হল- “যে তরণী খানি ভাসালে দুজনে আজি,   / হে নবীন সংসারী, কান্ডারী করো তাহারে তাঁহার যিনি এ ভবের কান্ডারী” । এই গানটি অনুষ্ঠানিক পর্যায়ের অষ্টম গান রাগ — ভূপালী তাল – কাওয়ালী । স্বরলিপির রচনাকাল ১৩১০, কবির বয়স তখন মাত্র ৪২ এই গানটি বিবাহের গান এবং এটি ব্রাহ্মসমাজের জন্যই তিনি লেখেন। তাই  আবার অন্য উপলব্ধি থেকে বলতে পারি এই গানের  প্রতিটি কথাতেই তিনি যেন তাঁর জীবন দেবতাকে মিনতি জানাচ্ছেন কান্ডারী করো তাঁহার যিনি এ ভবের কান্ডারী। কবি জীবনের ঘাটে তরী ভিরিয়েছেন বার বার। বিশ্বের বুকে বিরহের গান তো বিচ্ছিন্ন, তার শুরু আছে, শেষও আছে। কিন্তু আদি- অন্তহীন ‘কান্ডারীর’ নিত্য সুরের গান ধ্বনিত হয় এক অনন্ত লোকে জীবন দেবতারই সভা মাঝে। কবি তাঁর জীবন দেবতার পায়ে সব কিছু উজাড় করে দিতে চান- “ তোমাদের প্রেম দিয়ো দেশে দেশে বিশ্বের মাঝে বিস্তারিত”। এটাই তো বিশ্বমানের পরিচয়। কবির জীবনদেবতা বিশ্বের বৈচিত্রের অনুপরমানুতে নিজেকে ছড়িয়ে রেখেছেন। তিনি অনন্ত অসীম।

“ মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল  প্রাণ, / ধুলিরে ধন্য করো করুনার পূণ্যে হে কোমল প্রাণ”। ২৫ শে বৈশাখ ১৩৩২ শান্তিনিকেতন কবির বয়স তখন ৬৪, আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের ১২ তম গান এই গানটি। রাগ – মিশ্র কেদারা, তাল – দাদরা।  রবীন্দ্রনাথের ৬৫ তম জন্মদিন উপলক্ষে গাওয়া হয়েছিল। ১৭ই বৈশাখ থেকে শান্তিনিকেতনের গ্রীষ্মকালীন ছুটি আরম্ভ হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথ আশ্রমেই ছিলেন।এইদিনে কলকাতা থেকে    আগত বহুজনের উপস্থিতিতে সকালে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়।  তিনি উত্তরায়নের উত্তর-পূর্ব কোণে পথের ধারে মন্ত্র ও “ মরু বিজয়ের কেতন উড়াও” গানের সঙ্গে পঞ্চবটি রোপন ।১ (রবি জীবনী – প্রশান্ত কুমার পাল পৃঃ ৯)।

এছাড়াও জানা যায় যে শান্তিনিকেতনের যে বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় সেখানে এই গানটি মানে “মরু বিজয়ের কেতন উড়াও” নৃত্য সহযোগে গাইতে গাইতে গাছের চারা গুলিকে নিয়ে উৎসবে স্থানে যাওয়া হয়। অর্থাৎ কবি এই বৃক্ষরোপণের মধ্যে দিয়ে নগর পত্তনিক সভ্যতার সাথে সাথে যে বৃক্ষ সম্পদ লোপ পাচ্ছে তার প্রতি ও তাঁর দৃষ্টি সজাগ ছিল। গাছের সবুজ পাতা ঋতু পরিবর্তনের পর পরেই  ফুলে ফুলে নতুন নতুন পাতার রঙে প্রাণচঞ্চলের একটা বিশেষ রূপ ফুটে ওঠে এবং এই জীবন্ত ছোঁয়ায় শিশুর বা বয়স্ক মানুষের মনের কোমলতা সজীবতার যোগসূত্র পাওয়া যায়। এ তো গেল কবির একদৃষ্টির কথা অন্য দৃষ্টিতে গানটি প্রকৃতি পর্যায়ের অন্তর্গত বলে মনে করছি, প্রকৃতি বলতে গ্রীষ্মকালকে উল্লেখ করছি। কেননা স্থায়ী তে উল্লেখ আছে – “ ধুলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ”।  আবার সঞ্চারিত বলছেন – পথিক বন্ধু, ছায়ার আসনপাতি এসো শ্যামসুন্দর । / এসো বাতাসের অধীর খেলার সাথী, মাতাও নীলাম্বর “ । কবির চিন্তার জগত থেকে দেখতে পাচ্ছি পথিক বন্ধুকে ছায়ার আসন পেতে দিচ্ছেন কবি । যা আমরা তপ্ত দগ্ধ গ্রীষ্মেই লক্ষ্য করে থাকি, এবং এই গানের মধ্যে দিয়ে কবি একদিকে বৃক্ষরোপণ উৎসবও করেছেন অন্যদিকে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। বিশেষ করে শান্তিনিকেতন গ্রীষ্মের দিনে খুবই ভয়াবহ। সেইখানে তিনি শিক্ষাধারা এবং পরিবেশের মধ্যে তৃণলতা বৃক্ষাদির ভূমিকাও আছে। এছাড়া শিশু মনের থেকে প্রাণ রস আরোহন করে , মানসিক উজ্জ্বলতা লাভ করে, বৃক্ষ বন্দনার মন্ত্রে এই উজ্জ্বলতা লাভ করে । বৃক্ষ বন্দনার মন্ত্রে এই বাণী যেন প্রতিধ্বনি করে।  

“আয়রে মোরা ফসল কাটি, ফসল কাটি , ফসল কাটি,

 মাঠ আমাদের মিতা ওরে, আজ তারি সওগাতে

মোদের ঘরের আঙন সারা ভরবে দিনে রাতে” ।  এই গানটি এই পর্যায়ের ১৬ তম গান। যখন এই গানটি কবি রচনা করেন তখন তাঁর বয়স ৬২ বছর। রচনাকাল পৌষ ১৩৩০, এই গানটি কবি শান্তিনিকেতনে রচনা করেন গানটির রাগ ভৈরব তাল দাদরা । এই গানটি চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য ব্যবহার করেছেন। এইরকম অনেক গান আছে যা বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহারে বিচিত্র রকমের ভাবের প্রকাশ করে।   পৃথিবীর দান গ্রহণ করতে করতে মানুষের লোভ বেড়ে উঠলো ক্রমশ, তখন অরণ্যের হাত থেকে কৃষি ক্ষেত্রে কে সে জয় করে নিল। অবশেষে কৃষি ক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে শেষ করে দিল। নানা প্রয়োজনেই গাছ কেটে কেটে পৃথিবীকে ছায়া বস্ত্রহরণ করে তাকে নগ্ন করে দিতে লাগলো, এবং কৃষি ক্ষেত্রে মানুষ নিজের মাতৃভাণ্ডারকে পূরণ করবার তাগিদ অনুভব  করেছেন । তাঁর জন্য ই কবি রচনা করলেন – “আয়রে মোরা ফসল কাটি” । এই গানটির প্রত্যেক কথার উপর দৃষ্টিপাত করলে কোথাও কি মনে হয় না যে এই গানটি আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গান না হয়ে প্রকৃতি পর্যায়ের গান হিসাবে এটিকে গণ্য করা যেতে পারে বলে। কেননা “আয়রে মোরা ফসল কাঠি , ফসল কাঠি,  ফসল কাঠি, / মাঠ আমাদের মিতা ওরে আজ তারি সওগাতে মোদের ঘরের আঙন সারা বছর ভরবে দিনে রাতে” । এই উদ্ধৃত অংশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে তিনি বলেছেন ফসল কাটি সবাই মিলে, মাঠ আমাদের সবার বন্ধু, এখানে ফসল ফলেছে এবং যা হয়েছে তাতে তাদের সারা বছর দিনে রাতের জন্য ভান্ডার ভর্তি। চারিদিকে শস্য শ্যামল বসুন্ধরা আমরা ঋতু চক্রের বর্ষাতেই লক্ষণীয় এবং এখানে কবি বলেছেন – “ বাদল এসে রচে ছিল ছায়ার মায়া ঘর / রোদ এসেছে সোনার জাদুকর ও সে সোনার জাদুকর” । অর্থাৎ এখানে কবি সেই বর্ষার গান ই গেয়েছেন। কবির কাছে বর্ষা এক নতুন সৃষ্টির পরশুরা নিয়ে আসে। তাই কবির এই গানটিতে বর্ষার আভাস পাওয়া যায়, এবং এই গানটিকে অন্য দৃষ্টিতে যদি প্রকৃতি পর্যায়ের অন্তর্গত বলে মনে করি সেখানে তাহলে বিশেষ একটা সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।

এই গানটি এই গানটি আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের সংযোজন বলে জানা যায়, গানটি হল – “বিশ্বরাজালয়ে বিশ্ববীণা বাজিছে” । রচনাকাল ১৩০২, (১৮৯৫) কবির বয়স তখন ৩৪ বছর। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ এই গানটির । এই গানটির রাগ – শঙ্করাভরণ । এটি দক্ষিণ ভারতীয় একটি রাগ। এই গানে তাল ঝাঁপতাল, আবার কেউ কেউ এটিকে কাহারবা তালে গেয়ে থাকেন । স্বরলিপিকার হিসেবে সরলা দেবী , জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর , ইন্দিরা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম পাওয়া যায়।

এই গানটি মারাঠি ভজনের আদর্শে রচিত। ভাঙ্গাগান – “নাথ বিদ্যা পরমব্রম্ভ রস” । এই গানটি মাঘোৎসবে গাওয়া হয়ে থাকে। এই একই আদর্শে রচিত – “বিশ্ববীণা রবে”- গানটি। এবার এই গানটির কথার দিকে লক্ষ্য করলে কি কোথাও অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাই না ? যে প্রকৃতির এক অপরূপ রূপের বর্ণনা করা আছে এই গানটির প্রতিটি ।  রবীন্দ্রনাথের এই পর্যায়ের এই গানের বিস্তৃত্ব অঙ্গনে বৈচিত্র্যের আলোছায়ায় আন্দোলিত। প্রাকৃতিক নৈব্যক্তিতার দেখা যেমন মিলে সেগুলি তেমনি আবার ব্যক্তিরস অনুভূতিতে ভরা। উৎসবের প্রয়োজনে রচিত হলেও উৎসবকে ছাপিয়ে এক বিশালতর রসের ক্ষেত্রে বিচরণ করে । “নব বসন্তে নব আনন্দ – উৎসব নব – / তব স্নিগ্ধ সুশোভন লোচনা শোভন শ্যাম  সভাতলে মাঝে , কলগীত সুললিত বাজে”।

প্রকৃতি ও মানুষের অন্তর রহস্য মিলেমিশে এক হয়ে দেখা দিয়েছে তাঁর অনুভূতিতে।  প্রকৃতির সভায় ঋতু উৎসবের আভাস যখন পাই , তখন আমাদের উচ্ছ্বাস আরো বড় হয়ে দেখা যায় । কবির এই সৃষ্টিগুলির মধ্যে দিয়ে কবির দ্বৈত উপলব্ধির কথা আলোচনা করছি। তাঁর মনের বিচিত্র ছবি ফুটে উঠেছে – “দিকে দিকে তব বাণী – নব নবতর গাঁথা – অবিরল রস ধারা” ।এই স্তবকের  কথাগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করলে শেষে একবারেই যেন বলতে পারি যা চিরকালই আছে তাকে কালে কালে উপলব্ধি করা । রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির প্রতিযে উপলব্ধি তিনি তাঁর অভিব্যক্তি গানে এত সহজে প্রকাশ করেছেন যা অনায়াসে মনকে অভিভূত করে।

সবশেষে কবির কথায় বলি –“সকল সৃষ্টির মধ্যে একটি দ্বৈত আছে; তার একটা দিক হচ্ছে অন্তরের সত্য,  আর – একটা দিক হচ্ছে তার বাহিরের বাহন। অর্থাৎ একদিকে ভাব, আর-এক দিকে ভাষা । দুইয়ের মধ্যে প্রাণগত যোগ আছে কিন্তু প্রকৃতিগত ভেদ দুইয়ের মধ্যে আছে। ভাষা সার্বজনীন নয়, অথচ এই সত্যে সার্বজনীন “।২ (সংগীত চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃষ্ঠা ১০২)।

এর থেকে কবি মনের উপলব্ধির কথা প্রকাশ পায় । লেখনীর মধ্যে দ্বৈত ভাবের অভিব্যক্তিকে কবি প্রকাশ করেছেন। কবি সংগীত চিন্তায় প্রকাশ করেছেন “এই বাহিরের জিনিসটা পাওয়ার অপেক্ষা করতেই হবে তা হলে ভিতরের জিনিসটিও ধরা দেবে” । ৩ (সংগীত চিন্তা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -পৃষ্ঠা ১০৩)  

আমাদের মধ্যে নানান অনুভূতির বাস আর সেই জন্যেই আমরা নানান প্রকার অনুভূতির প্রকাশ দেখতে পাই নানান রূপে বিশ্ব প্রকৃতি আমাদের কাছে সামগ্রী মনের সঙ্গে হৃদয়ের সহচর হয়ে ওঠে মনের মধ্যে কখনো যে দ্বৈত ভাব কখনো বহু বিচিত্র ভাব ফুটে ওঠে বিচিত্র প্রকাশ ঘটে এই দ্বৈত ভাবে এবং নানান প্রকার ভাবের মধ্যে নানান রকমের উপলব্ধি হয় কোথায় সুরে এমনই উপলব্ধির ফল আমরা কবির আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গানের মধ্যে দেখতে পাই।  

তথ্যপঞ্জী  :

১) রবি জীবনী – প্রশান্ত কুমার পাল – পৃষ্ঠা ৯

২) সংগীত চিন্তা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – পৃষ্ঠা ১০২।

৩) সংগীত চিন্তা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -পৃষ্ঠা ১০৩।

গ্রন্থপঞ্জী :

১) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – জীবনস্মৃতি – বিশ্বভারতী।

২) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – গীতবিতান – বিশ্বভারতী।

৩) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – স্বরবিতান – বিশ্বভারতী।

৪) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – সংগীত চিন্তা – বিশ্বভারতী।

৫) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – ছবি ও গান – বিশ্বভারতী।

৬) দেবনাথ ধীরেন্দ্রনাথ- রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মৃত্যু – রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

৭) বসু  ডঃ অরুন কুমার – বাংলা কাব্য সংগীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত – দেজ পাবলিশিং।

৮) বন্দ্যোপাধ্যায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বীরেন্দ্র – রবীন্দ্রসংগীতঃ কাব্য ও সুর – করুণা প্রকাশনী।

৯) মুখোপাধ্যায় প্রভাত কুমার – গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী – টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

১০) স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ – সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান – শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা।