November 1, 2020

শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ফতিমা আক্তার

বিশ্বায়ন শব্দটি বিংশ শতকের ছয় এর দশক থেকে বেশি করে শোনা যেত। কিন্তু বিংশ শতকের শেষের দিকে যে বিশ্বায়ন হয়েছে তা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন অন্যদিকে তেমনি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিশ্বায়নও বটে।  বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য হল বিশ্বের যা কিছু সম্পদ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ইত্যাদি সবকিছুই বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তোলা। যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর অনেক মিল এবং অমিল রয়েছে। তথাপি বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বেড়েছে অনেক বেশি। যেটাকে বিশ্বায়ন বলা হচ্ছে। এখানে বিশ্বায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। আমি এখানে মূলত সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব এবং সঙ্গীত কিভাবে বিশ্বায়নের ফলে সাধারণ বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাছে সহজলভ্য হয়েছে ও সমাজে তার কি ধরনের প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করছি এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি।

১৮৯৮ সালে অবিভক্ত বাংলার কলকাতায় আসে গ্রামোফোন। গ্রামোফোনের মাধ্যমে আরো সহজ হয় গানকে ধরে রাখার। গানকে বারবার শোনার মাধ্যমে গান শেখা আরো সহজ হয়ে ওঠে। একসঙ্গে অনেক মানুষ গান শুনতে ও শিখতে পারে। গানকে সংরক্ষণ করাযায়। ফলে গানের জগতে এক যুগান্তকারী অবস্থার সৃষ্টি হয়। গান শোনার ও শেখার আগ্রহ আরো বাড়ে। গানের রেকর্ড নির্মান, রেকর্ড বিক্রি, গ্রামোফোন নির্মাণ ও বিক্রির এক বিশাল বাজার তৈরি হয়। বহু মানুষ প্রত্যক্ষ্যভাবে এইসব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।এভাবেই বিকশিত বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রাগ সঙ্গীত সহ সব ধরনের সংগীত ও চারুকলার প্রকাশ ঘটতে থাকল। সে সময় থেকেই বিশ্বায়নের শুরু বলা চলে। যদিও তখন বিশ্বায়ন শব্দের ব্যবহার শুরু হয়নি। ইউরোপের মাধ্যমে সারা  পৃথিবীর সঙ্গে সেসময় থেকেই ভারতের যোগসুত্র তৈরি হয়। যুগে যুগে এমন অনেক খারাপ অবস্থার মধ্যেও নতুনকে খুঁজে পেয়েথাকি, আর ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মধ্যে আমরা পেলাম আধুনিক, উন্নত ও বিজ্ঞান মনস্ক চিন্তা চেতনাকে। পেলাম নবতর সঙ্গীত ও সঙ্গীত প্রকাশের নানা মাধ্যম। উচ্চাঙ্গ সংগীতের নানা নতুন ধারার বিকাশ ঘটেছে এই সময়ে। এছাড়া পাশ্চাত্য সুরের সংমিশ্রণে নানা নতুন ধারার গান রূপ লাভ করলো। সেটা ছিল মূলত পাশ্চাত্যের সঙ্গে মেল্বন্ধন। এরপর বাংলাদেশের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে।  দুবার ধরে দেশ ভাগ ও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার মানুষ বিশ্বমানবতার মধ্যেই নিজের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এসেছে বিশ্বায়ন। মূলত অর্থনীতির ক্ষেত্রেই এই শব্দটি বেশি প্রচলিত ব্যবস্থা। কিন্তু তার সিঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের মানুষ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এর মধ্যেই রয়েছে দেশ ও দেশের বাইরের সঙ্গীত।   

যদিও উন্নততর দেশগুলির ক্ষেত্রে এই বিশ্বায়নের সুফল অনেক বেশি। তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া বা উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বিশ্বায়নের সুপ্রভাবের পাশাপাশি খারাপ প্রভাব বেশি করে এসে পড়েছে। যেখানে সরকার মানবিক দৃষ্টিতে নিজেদের দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনার চেষ্টা করে সেখানে বিশ্বায়নের খারাপ দিক গুলিকে নিয়ন্ত্রন করে বা দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণের গণ্ডি টপকে অনেক ক্ষেত্রেই নানা রকম অমানবিক ও অনৈতিক বিষয় বিশ্বায়নকে কলুষিত করার চেষ্টা করে চলেছে। যাইহোক বিশ্বায়ন সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অনেক আলোচনা হয়েছে এবং আরো অনেক আলোচনা হয়ে চলেছে। সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন বিশ্বায়নের প্রভাব আছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অনেক বেশি। বিশ্বায়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে গবেষক শুভজিৎ চ্যাটার্জী ‘বিশ্বায়ন ও প্রান্তীয়করণ : একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ নামের গবেষণায় লিখেছেন, ‘ বিশ্বায়নের ভিনটে দিক । বর্তমান আলোচনাতে বিশ্বায়নের তিনটি দিন (Dimension) বা প্রকাশ (Manifestations) পরিলক্ষিত হয়। এগুলি হল অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন (Economic Globalization) রাজনৈতিক বিশ্বায়ন (Political Globalization) এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন (Cultural Globalization) অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্বায়নকে সমরূপকরণ (Homogenization) করা না হলে বিষমরূপকরণ (Heterogenization) এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হয়ে থাকে। যেমন সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নকে যখন সমরূপকরণ দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয় তখন মনে করা হয় যে, বিশ্বব্যাপী একই ধরণের রীতিনীতি অভ্যাসের বিস্তার ঘটে চলেছে। আবার একে যখন বিষমরূপতার দৃষ্টিতে দেখা হয় তখন মনে করা হয় যে, বিশ্বসংস্কৃতির ও স্থানীয় সংস্কৃতির মিথক্রিয়াতে একটা সংকর সংস্কৃতি (Hybrid culture) সৃষ্টি হয়েছে’।

বিংশ শতকের শেষ দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করে। বিশেষ করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলো  উন্নততর প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকে। পৃথিবীর প্রত্যন্ত জায়গা গুলো মানুষের কাছাকাছি এসে হাজির হয়। বলা যায় হাতের মুঠোয় এসে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় সংস্কৃতির অনেক কিছুই হারিয়ে যায়, আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নানা ধরনের সাংস্কৃতিক উপকরণ এসে পড়ে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের কাছে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এর বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সুদূর আফ্রিকা, ইউরো্‌ ইরা,-ইরান ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রচলিত লোকসংগীত, লোকনৃত্য, ধ্রুপদী সঙ্গীত- নৃত্য ইত্যাদি অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক গণমাধ্যমের মধ্যে ঢুকে পড়ে। গণমাধ্যম ব্যবহারের সহজ লভ্যতা ও আধুনিকতার পরিপূর্ণ ব্যবহারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মানুষ নিজেদের মতো করে সংগীত ও সংস্কৃতি জগতে পদার্পণ করে। আগে যেখানে অন্য কোনভাবে এইসব গণমাধ্যমে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার কোনো সুযোগ তারা পেত না, সে জায়গায় সহজলভ্যতার কারণে অনেক সাধারণ মানুষ এই মাধ্যমকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার সুযোগ পায়। তাদের প্রতিদিনকার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সৃষ্টি সৌন্দর্য ইত্যাদি সবই গণমাধ্যমে এসে পড়ে। এর ফলে একদিকে যেমন ভালো হয়েছে অন্যদিকে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের।

প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে অজস্র রকমের সঙ্গীত ও সংস্কৃতির উপকরণ  সোশ্যাল মিডিয়াতে জড়ো হচ্ছে। ফলে সাংস্কৃতিক উপকরণের পাহাড় থেকে কোন বিশেষ একটি কে খুঁজে নেওয়া বা ঠিক ভালো উপকরণগুলিকে বেছে নেওয়া জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক অশালীন বা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর নানা ধরনের উপকরণ সোশ্যাল মিডিয়াকে কলুষিত করে তুলছে। রাজনৈতিক অভিসন্ধি মূলক নানা ধরনের পোস্ট সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়ে তুলছে।  সুযোগ সন্ধানী ও হিংস্র ব্যক্তিরা নানা ধরনের পোস্ট করে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যা সমাজকে ভয়ানকভাবে ক্ষতি করছে। এসব ক্ষেত্রে তারা তরুণ মেধাকে ব্যবহার করছে। সঙ্গীতকেও কাজে লাগাচ্ছে। 

বিশ্বায়নের পরবর্তীকালে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন এর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে, সহজ হয়েছে তেমনি সব দেশের সংস্কৃতি বিনিময়ের সম্পর্কগুলো অনেক সহজতর ও সহজলভ্য হয়েছে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যদিও কিছু নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং সেগুলোর প্রতি নজরদারি রয়েছে। দেশ-বিদেশে খুব সহজে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া বা এক দেশের পণ্য আরেক দেশে যথেচ্ছভাবে ঢুকে পড়ার ক্ষেত্রে নানা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে কোনোভাবেই এগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। কখনও কখনও কিছু রাজনৈতিক না সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বিভিন্ন বক্তব্য যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য নির্দেশ দেয়া হয় ঠিকই কিন্তু সাধারণভাবে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সঠিক ব্যবস্থা এখনও সরকার গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ এসব সামাজিক গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষ করে অশালীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নানা ধরনের পোস্টকে যাতে বন্ধ করা যায় সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া খুবই জরুরি ছিল।

প্রত্যেক দেশের সুযোগসন্ধানী, হিংস্র ও বিচ্ছিন্নতাকামী মানুষেরা নিয়ন্ত্রনহীন গণমাধ্যমকে নানা কাজে ব্যবহার করছে এবং অমানবিক আবেদন সৃষ্টি করার জন্য নানা ধরনের কর্মকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে মানবিক স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তে সংকীর্ণতা গ্রাস করছে। অথচ আমরা কাজী নজরুল, জসীমউদ্দীন, রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথকেই সামনে রেখে চলতে চাই। যেখানে একমাত্র মানবিকতাবোধ আমাদের উৎসাহিত করে। সব মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। যখন আমরা গান গাই ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম’ কিংবা ‘সত্যের পরে মন, মোরা করিব সমর্পণ, জয় জয় সত্যের জয়’ ইত্যাদি তখন আমাদের হৃদয় প্রসারিত হয়। সামাজিক গণমাধ্যমে আমরা ক্রমাগত এসব মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে জেগে উঠি। সবক্ষেত্রেই সঙ্গীত অনেক বেশি করে জায়গা করে নেয়। সাধারণভাবে আমরা যত সামাজিক গণমাধ্যমে পোস্ট দেখি তার মধ্যে অনেকটা জায়গা জুড়ে গান, নৃত্য ও যন্ত্রসঙ্গীতের পরিবেশনা বা কোন পরিবেশনার সঙ্গে সঙ্গীতের ব্যবহার লক্ষ্য করি।

বিশ্বায়ন ও সঙ্গীত আর অডিও মিডিয়া শীর্ষক বাংলাদেশ বেতারের পত্রিকা “বেতার বাংলা” পৌষ-মাঘ ১৪২৪ বঙ্গাব্দ (মহান বিজয় দিবস ) সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখা হয়েছে,  ‘সঙ্গীতের চিরন্তন একটি বিষয় হচ্ছে এর সুর এবং এটি অডিও। বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে সঙ্গীতের সুরের বিস্তৃতি এখন অনেক ব্যাপকতর এবং সহজতর হয়েছে। সঙ্গীত বিশ্বায়নের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন ভাবে আলোচনা করে থাকেন। বিশ্বায়নের একটি সরাসরি প্রভাব হচ্ছে এর সুরের মোহনীয়তা। ফলশ্রুতিতে বৈশ্বিক পপুলার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির যে কোনও গুনগত পরিবর্তন ট্রেডিশনাল লোকাল মিউজিক-কে প্রভাবিত করে। বর্তমান সময়ে ভোক্তা চাইলেই সঙ্গীতের এ্যালবাম দোকান থেকে কিনতে পারেন, ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করতে পারেন অথবা নিজের স্মার্ট ফোনের সহায়তায় সহজেই এ্যাপস স্টোর থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। সঙ্গীতের এই সহজ লভ্য বিস্তরণের কারণে, সঙ্গীত গবেষকগণ ধারণা পোষণ করেন, সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে বৈশ্বিক পপুলার মিউজিকের সুর ও উপস্থাপন ঢংয়ের থাবা ক্রমশ লোকাল মিউজিকের ব্যাপ্তিকে হ্রাস করে তুলছে। এই প্রবণতার ক্রম বিকাশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে লোকাল সঙ্গীতের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক’।

বিশ্বায়নের ফলে সঙ্গীত মানব জীবনে কতটা সহজলভ্য ও উপযোগী হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা করছি। আগেই উল্লেখ করেছি বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সংগীত আমাদের প্রত্যেকের হাতের মুঠোয় এসে হাজির হয়েছে। আমরা খুব সহজেই নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সেখান থেকে নানা ধরনের সঙ্গীত শুনতে দেখতে ও তাকে ব্যবহার করতে পারি। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রান্তের হারিয়ে যাওয়া লুপ্তপ্রায় সংগীত বা সংগীতের উপকরণগুলি সংগ্রহ করে সেগুলিকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রকাশ করার ফলে তার সজীবতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সাফল্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশেষ করে আদিবাসী সংস্কৃতি এবং লোকসংস্কৃতির নানা ধরনের উপকরণ সভ্যতার আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে। যেগুলিকে হয়তো আগামী দিনে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। সেগুলোকেউ অন্তত বহুল প্রচলিত ইন্টারনেট ব্যবস্থার মধ্যে যুক্ত করে দেওয়ার ফলে সংরক্ষিত হয়ে থাকবে।  এর ফলে মানব সভ্যতার বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শনগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাবে।

আরেকটি দিক হলো সংগীত শিক্ষা। ইন্টারনেট ব্যবস্থার বহুল প্রচলন এর ফলে যেকোনো ধরনের প্রান্তিক সংস্কৃতিকেও আমরা আমাদের কাছে পাই।  ইরাক-ইরান, মিশরীয় সভ্যতা, সুদূর আফ্রিকার প্রান্তিক সংস্কৃতি, নিকারাগুয়া বা সিনাই উপদ্বীপের মতো সব জায়গার সংগীত কে আমরা জানতে ও বুঝতে পারি। প্রয়োজনমতো আমরা সেগুলিকে শিখতে এবং তার থেকে বিশেষ কোনো উপকরণকে আমরা আমাদের বৃহত্তর সঙ্গীত জগতের সঙ্গে যুক্ত করে সেগুলিকে ব্যবহার করতে পারি। এরপরে সব ধরনের সংগীতের মধ্যে একটা আদান-প্রদানের নিবিড় সম্পর্ক এবং তার যে পরিধি ,সেই পরিধি ক্রমে ব্যাপকতার হতে থাকে। ফলে যারা নতুন প্রজন্মের সংগীত শিক্ষার্থীরা এই সব উপকরণের মধ্যে থেকে নিজের পছন্দের দিক বুঝে নিতে পারে এবং শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রেও এগুলো খুব সহায়ক হয়।

দূর ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সংগীত শিক্ষক এবং ছাত্রদের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ফলে খুব সহজেই সব প্রান্তের সংগীতকে শিক্ষা লাভ করা এবং অভিজ্ঞতার বিনিময় ঘটানো খুব সহজে হয়ে চলেছে মা হয়েছে। সাম্প্রতিক কোভিড ১৯ মহামারীর সময় বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে আমরা অনেক বেশি করে পেয়েছি। এসময়ে সংগীত শিক্ষার যা কিছু ব্যবস্থা তা হয়েছে মূলত ইন্টারনেটের সাহায্যে।ফলে আগামী দিনে এই ব্যবস্থা আমাদের আরও বেশি করে নিয়ন্ত্রণ করবে মানবিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট ব্যবস্থা। আগামী দিনে এই ব্যবস্থা আরও বেশি করে সম্প্রসারিত হবে সাধারণ দরিদ্র অংশের মানুষের কাছেও এই ব্যবস্থা হয়তো পৌছবে। এর নানা দিক গুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারলে তার সুফল কে আমরা বেশি করে খেতে পারব। আর যদি তাকে নিয়ন্ত্রনহীন করে দেওয়া যায় তাহলে তার কুফল সর্বগ্রাসী হতে পারে। যাই হোক, আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে থাকব এবং আধুনিক সভ্যতার নতুন নতুন সৃষ্টিগুলি কিভাবে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায় তা জানার ও বোঝার জন্য  হয়তো আরো অপেক্ষা করতে হবে।

অনুকরণ, কপি পেস্ট এর দুনিয়া খুলে গেছে। সঙ্গীতও এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সততা ও নিষ্ঠার জায়গায় ফাঁকি ও নিম্নগামিতা আমাদের অতলে নিমজ্জিত করার চেষ্টা করছে। আমরা তার থেকে মাথা তুলে বাঁচতে চাই। একজন অধ্যাপকের লেখা দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই। তিনি তাঁর ‘বিশ্বায়ন ও ভারতীয় সংগীতের ভাবিষ্যৎ’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বিশ্বানের এই ক’বছরেই ভারতে ও ভারতের পাশপাশি দেশগুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংগীতের প্রভাব আরো প্রকট ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলে মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ক্রমশঃ বাড়ছে। তথ্য-প্রযুক্তি সারা পৃথিবীর বাজার ছেয়ে ফেলেছে। টিভি, কম্পিউটার, আইপড, আইপ্যাড, হাতে হাতে মোবাইল আর তাতে মিনি কম্পিউটার। দেশ বিদেশের উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন আজ খুব কম দামে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীও ধরা দিয়েছে ওই সব তথ্য মাধ্যমে। মধ্যযুগের অধরা গান চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। ইউ টিউবে, ফেসবুকে গানের আপলোড ডাউনলোড চলছে অনর্গল। গান বাজনা নিয়ে অনর্গল পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। চলছে মেলানো মেশানোর নানা চেষ্টা। তাতে ভালো মন্দ দুই হচ্ছে। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘জীবনমুখী গানে’র সুত্রে নতুন নতুন গানের বিকাশ ঘটেছে। এসেছে ‘ব্যান্ডের গান’ নামের সমবেত সঙ্গীত, ‘ফিউশন মিউজিক’। রেকর্ডিংয়ের দুনিয়া গেছে বদলে। উপযুক্ত সফটওয়ার সহ একটা কম্পিউটার, কয়েকটা মাইক্রোফোন আর হেডফোন নিয়ে ঘরে ঘরে ষ্টুডিও চলছে। প্রতিদিন হাজার হাজার গান আর সুর রেকর্ডিং হয়ে বাজারে বেরোচ্ছে। ইউ টিউবে, ফেসবুকে গানের আপলোড ডাউনলোড চলছে। সমস্যা হচ্ছে এর মধ্যে ভালো মন্দ সব মাইল মিশে একাকার। গানের জঙ্গল তৈরি হয়েছে। ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের জায়গায় স্থান পাচ্ছে নীতিহীন চমক। জেল্লা চটকদারিত্বের অহংকার বেশি করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লক্ষ্য ও আদর্শহীন এক অদ্ভুত পরিবেশ রচিত হয়েছে।  নীতি ও নৈতিকতার পরিবর্তে অর্থহীন অশালীনতা, ঔধত্ব সমাজকে ঘিরে ধরেছে।  বিকৃত তথ্য ক্রমাগত দিশাহীন করে দিচ্ছে দেশ–কাল-সমাজকে।  তারও প্রভাব পড়ছে সংগীতে।  তবু ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে’।  এই সত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া শিল্পী সমাজের কিইবা করার আছে’?

তথ্যসূত্র

১।http://oaji.net/articles/2014/1115-1407154412.pdf

২। http://ahsan-habib.com/2017/07/19/globalization/

৩। https://debasishrbu.blogspot.com/2015/04/