May 1, 2025

বাঁশির সুরমাধুর্যে গৌর গোস্বামী ও সানাইয়ের সুরমূর্চ্ছনায় আলি আহমেদ: যন্ত্রবাদনের দুই দিকপাল – ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্ত

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Sabdam & Gour Goswami Memorial Committee | Sabdam & Gour Goswami Memorial Committee was organized a mesmerizing musical on 6th March 2025. We are extremely happy some video clips for you.... |Ustad Ali Ahmad Hussain ,Shehnai - YouTube

Abstract (সংক্ষিপ্তসার):
এই প্রবন্ধে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দুই অনন্য যন্ত্রশিল্পী—বাঁশির গৌর গোস্বামী এবং সানাইয়ের আলি আহমেদ হোসেন—এর সঙ্গীত জীবন, শিল্পসাধনা এবং প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। বাঁশির মৃদু সুর ও রাগভাষার সূক্ষ্মতাকে তুলে ধরতে গৌর গোস্বামী যেভাবে মাইহর ঘরানার ধারায় রাগসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন, তা একাধারে আবেগপূর্ণ ও কারিগরি দৃষ্টিকোণ থেকে নিখুঁত। অন্যদিকে, ঐতিহ্যগতভাবে লোকজ অনুষ্ঠানসমূহে ব্যবহৃত সানাইকে ধ্রুপদী রাগসঙ্গীতের এক গম্ভীর ও রসনীয় যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আলি আহমেদ।

প্রবন্ধে স্মৃতিকথার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে তাঁদের পরিবেশনা, ব্যক্তিগত জীবন, ও অপ্রতিষ্ঠানিক অবদান—যার অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির বাইরে থেকে গেছে। গৌর গোস্বামী ও আলি আহমেদ উভয়েই সঙ্গীতকে উপার্জনের মাধ্যমের চেয়ে বেশি এক সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখেছেন এবং নতুন প্রজন্মকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাঁদের উত্তরাধিকার রক্ষা করেছেন।

তাঁদের সংগীতজীবনের প্রতিভা ও নিষ্ঠা সত্ত্বেও যথোচিত স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে সঙ্গীত জগতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্ব ও সামাজিক কাঠামোর প্রভাবও আলোচিত হয়েছে। এই প্রবন্ধ দুই যন্ত্রবাদকের শিল্পসাধনার পাশাপাশি তাঁদের প্রতি প্রজন্মের ঋণ ও শ্রদ্ধা নিবেদনের এক আন্তরিক প্রচেষ্টা।

ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জগতে যন্ত্রসঙ্গীতের গুরুত্ব অপরিসীম। এই পরম্পরায় বাঁশি ও সানাই দুটি যন্ত্রই আপন স্বতন্ত্রতা ও রাগভাষার গভীরতা প্রকাশের এক-একটি শক্তিশালী মাধ্যম। যন্ত্রসঙ্গীতের এই দুই ধারার দুই বিশিষ্ট সাধক – গৌর গোস্বামী (বাঁশি) ও আলি আহমেদ (সানাই) – তাঁদের অসামান্য পরিবেশনা, সাধনা ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে ভারতীয় সঙ্গীতের ঐশ্বর্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
গৌর গোস্বামী ছিলেন একজন বরেণ্য বাঁশি বাদক যাঁর সঙ্গীতজীবনের মূলভিত্তি ছিল ভারতীয় রাগসঙ্গীতের উপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত।
তিনি মূলত মাইহর ঘরানার অনুগামী ছিলেন এবং কিংবদন্তি উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-এর শিষ্য ছিলেন বলে জানা যায়।
তাঁর বাঁশির সুরে ছিল এক অদ্ভুত আবেগময়তা, যা শ্রোতাকে সহজেই মুগ্ধ করত।
তিনি রাগ পরিবেশনায় আলাপ, জোর, ঝালা এবং গতের মধ্য দিয়ে বাঁশির এক সম্ভাবনাময় দিক প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে বাঁশি কেবল মিষ্টি সুর নয়, গভীর রাগভাবও প্রকাশ করতে সক্ষম।
তাঁর পরিবেশনায় রাগ মালকোস, ইমন, চায়ানট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গৌর গোস্বামী আকাশবাণী ও দূরদর্শন-এর নিয়মিত শিল্পী ছিলেন এবং বিভিন্ন জাতীয় সঙ্গীত সম্মেলনে বাঁশি পরিবেশন করেছেন।

আলি আহমেদ: সানাইয়ের গাম্ভীর্যে রাগভাষার উদ্ভাস সানাই যন্ত্রটি যদিও ঐতিহ্যগতভাবে বিয়ের ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত, তবু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তার রাগাশ্রয়ী রূপ তুলে ধরেন কিছুজন শিল্পী – তাঁদের মধ্যেই একজন আলি আহমেদ। আলি আহমেদ তাঁর সানাই পরিবেশনার মাধ্যমে যন্ত্রটিকে একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ ও সুললিত রাগমঞ্চে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁর পরিবেশনায় রাগের সূক্ষ্মতা, মেধাবী মীড় ব্যবহার ও টান – সবই ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
তিনি পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মঞ্চে পারফর্ম করেছেন, এবং তাঁর সানাইয়ের সুর শ্রোতাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি সানাইকে শুধুমাত্র লোকজ সুর নয়, বরং ধ্রুপদী রাগভিত্তিক পরিবেশনার একটি শক্তিশালী যন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
দুই যন্ত্র, দুই ধারা, এক সাধনা যদিও বাঁশি ও সানাই দুইটি আলাদা কাঠামোর এবং ধ্বনিসম্ভারের যন্ত্র, তবুও গৌর গোস্বামী ও আলি আহমেদ—এই দুইজনের সঙ্গীতচর্চায় একটি মিল স্পষ্ট: সাধনা ও শ্রদ্ধা: তাঁরা দুজনেই তাঁদের যন্ত্রকে কেবল একটি পরিবেশনের উপকরণ হিসেবে নয়, বরং সঙ্গীতসাধনার এক অনিবার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করতেন। রাগভাষার শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রকাশ: দুই শিল্পীর পরিবেশনায় ছিল রাগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও তার সঠিক চিত্তবিন্যাসে উপস্থাপন। শিক্ষাদান ও প্রেরণা: তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানোর কাজে যুক্ত থেকেছেন, এবং অনেকেই তাঁদের প্রেরণায় যন্ত্রসঙ্গীতকে গ্রহণ করেছেন।

বাঁশি বা সানাইয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনটি উল্লেখযোগ্য নাম খুব সহজেই আমাদের মনে আসে-পান্নালাল ঘোষ, বিসমিল্লা খাঁ ও হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। সারা পৃথিবী এঁদের নাম জানে। পান্নালাল বাবু আর বিসমিল্লা খাঁ সাহেব আজ আর ইহলোকে নেই, হরিপ্রসাদজী এখনো জীবিত আছেন। কিন্তু সঙ্গীত জগতে এমন কয়েকজন বাঁশী ও সানাই বাদক ছিলেন যাঁরা এঁদের মতো উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হতে না পারলেও তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কৃতিত্ব ও পারদর্শীতার পরিচয রেখে গেছেন। সঙ্গীত জগতে যশ বা খ্যাতি অর্জন করাটা শুধু মাত্র প্রতিভা ও দক্ষতার উপর নির্ভর করে না। এটা অনেকাংশেই ভাগ্য বা অদৃষ্টের ওপর নির্ভরশীল। বহু সুদক্ষ প্রতিভাবান শিল্পী আছেন যাঁরা দুর্ভাগ্যবশতঃ সঙ্গীত গগনের চন্দ্র বা সূর্য হতে পারেন নি, সারাজীবন আকাশবাণী বা চলচ্চিত্র জগতের কর্মী হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। আমাদের এমনই সমাজব্যবস্থা যে সঙ্গীতকে পেশা বা জীবিকা করে বহু পারদর্শী শিল্পী ভয়ঙ্কর অর্থাভাব ও অনাহারে হয় অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন না হয় মান সম্মান খুইয়ে এমন কিছু কাজকর্মে নিযুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন, যা তাঁদের সঙ্গীত চর্চাকে ভীষণভাবে ব্যাহত করেছে। এমনই দুজন মানুষ ছিলেন বাঁশী বাদক সঙ্গীতাচার্য গৌর গোস্বামী ও সানাইবাদক ওস্তাদ আলী আহমেদ হোসেন। ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক যে সঙ্গীত জগতেরই কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এঁদের বিরুদ্ধে জঘন্য চক্রান্ত করেছেন, যাতে এঁরা প্রথম সারিতে উঠতে না পারেন। গৌর গোস্বামী ছিলেন আকাশবাণীর কর্মী এবং আলী আহমেদ ছিলেন চলচ্চিত্র জগতের।

গৌর গোস্বামী (Gaur Goswami)
গৌর গোস্বামী ছিলেন একজন খ্যাতনামা বাঁশি বাদক, যিনি মূলত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিসরে বাঁশির পরিবেশনায় এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন। তিনি আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের শিষ্য হিসেবে মাইহর ঘরানার ঐতিহ্য বহন করতেন। তাঁর বাঁশির সুরে ছিল গভীর আবেগ ও সূক্ষ্মতা, যা রাগের ভঙ্গিমায় শ্রোতাদের মন জয় করত। তিনি বহু সঙ্গীত সম্মেলনে বাঁশি পরিবেশন করেছেন এবং আকাশবাণী ও দূরদর্শনের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। শিক্ষার্থী ও অনুসারীদের মধ্যে তিনি সাদাসিধে জীবনযাপন ও সংগীতের প্রতি নিষ্ঠার জন্য সুপরিচিত ছিলেন।

আলি আহমেদ (Ali Ahmed)
আলি আহমেদ ছিলেন একজন খ্যাতনামা সানাই বাদক, যিনি এই বিরল যন্ত্রটির পরম্পরাগত শৈলীকে ধরে রেখে একে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাঁর পরিবেশনায় আমরা উত্তর ভারতের সানাই পরিবেশনার মাধুর্য ও গাম্ভীর্য দেখতে পাই।
বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি সানাই পরিবেশন করেছেন। তিনি শুধু মাত্র বিয়ের অনুষ্ঠান বা লোকজ সঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রাগাশ্রিত পরিবেশনায় তাঁর সানাই এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি সানাই শেখানোর কাজেও যুক্ত ছিলেন।

আমার যখন ন-দশ বছর বয়স, তখন থেকেই আকাশবাণীতে গৌর গোস্বামীর অনুষ্ঠান শুনতাম। ছোট একটা সরোদ সবে হাতে পেয়েছি, তারে টোকা দিচ্ছি। রাগ-রাগিনী মোটামুটি চিনতে শিখেছি, তবে নিয়মমাফিক রাগের ব্যাকরণ শিখিনি। রাত নটার অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝেই ওনার বাঁশী বাদন সম্প্রচারিত হত। কলাবতী, ইমন, বাগেশ্রী ইত্যাদি নানাবিধ রাগ ওঁর কাছে আমি শুনেছি। তখনও ওঁনাকে চাক্ষুস দেখার সুযোগ পাইনি।

নবম শ্রেণীতে যখন উঠলাম তখন আমার বয়স হবে বছর চোদ্দ। সরোদে ‘সা রে গা মা’-র অধ্যায় শেষ করে সবে মধ্যলয়ের গৎ শিখছি, হঠাৎ একদিন বাবার চিঠি এলো আকাশবাণী থেকে। পরের রবিবার অখিল ভারতীয় কার্যক্রম (National Programme) এর রেকর্ডিং। রবিবার মানেই স্কুল ছুটি। সুতরাং অনেক বলে কয়ে আমার রাসভারী দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঠাকুমার কাছ থেকে বাবার সঙ্গে রেডিওতে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। মধ্যাহ্নভোজন সেরে বাবার গাড়িতেই রওনা দেওয়া হল। যেতে যেতে বাবা বললেন,আজকে গৌর গোস্বামী আমার রেকর্ডিং করবেন। দেয়া মার জ্যাঠামশাই বলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। ভুল যেন না হয়। তানপুরা ডান মিলিয়ে দেবেন, খুব সাবয়ানে হাড়বে। তার বেসুরো হলে Studio র মধ্যেই গায়ড় লাগাবো।” তানপুরা ছাড়ার দায়িত্বটা আমারই ছিল।

আকাশবাণীতে পৌঁছে যন্ত্রপাতি গাড়ি থেকে নামিয়ে এবার সঙ্গে Studio-তে ঢোকা মাত্রই এক ফর্সা মতো টাক মাথা ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। পরণে ধুতি পাঞ্জাবী। “এই যে বুদ্ধদেব, (পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত) এসো এসো। কেমন আছো বলো।” বাবা এগিয়ে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে বললেন-“গৌরদা, আমার কি সৌভাগ্য আজ, আপনি উপস্থিত আছেন।” তারপর আমায় বললেন, “ব্যাটা, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম কর।” পিতৃ-আজ্ঞা পালন করলাম। বুঝতে দেরী হল না, ইনিই গৌর গোস্বামী। বাবা বললেন-“ওনাকে জ্যাঠামশাই বলে ডাকবি।” তারপর সরোদ ও তানপুরা বার করা হল। বাবা সযত্নে সরোদ বাঁধলেন। গৌর জেঠু চোখ বুজে মনোযোগ দিয়ে তানপুরা বেঁধে দিলেন। একটু পরেই শ্যামল কাকু (তবলা বাদক শ্যামল বোস) এসে উপস্থিত হলেন। ওনাকেও প্রণাম করলাম। বাবা শ্যামল কাকুকে বললেন-“রাজাবাবু তানপুরাটা একটু দেখো তো ভাই।” তানপুরাটা আরেকবার মিলিয়ে শ্যামল কাকু আমার হাতে দিলেন। গৌর জেঠু Recording Room এ গিয়ে বসলেন। Recording শুরু হল। বাবা ধরলেন রাগ ছায়ানট। ছায়ানটে আলাপ, জোড়, ঝালা, বিলম্বিত ও দ্রুত তিনতালের গৎ বেশ ভালই জমে উঠল। তারপর হল নায়কী কানাড়ায় মধ্যলয় ও দ্রুত তিনতালের দুটি রচনা এবং সবশেষে আদ্ধা তালে একটি মিশ্র কাফির বন্দিশ। রেকর্ডিং চলাকালীন গৌর জেঠু সারাক্ষণ রেকর্ডিং রুমে বসে রইলেন এবং তারপর Studio-তে ঢুকে বাজনার উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করলেন।

সপ্তাহ দুয়েক পর উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্র থেকে বাবার আমন্ত্রণ এলো। সেখানে গৌর গোস্বামীও আমন্ত্রিত ছিলেন। বাবার অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময় ছিল রাত বারোটা আর ঠিক তারপরেই ছিল গৌর জেঠুর অনুষ্ঠান। দিনটা ছিল শনিবার। যথাসময়ে সরোদ ও তানপুরা সমেত বাবা উত্তরপাড়ার অনুষ্ঠান ভবনে উন্নহিত চালণ। আমি আছিন বসে ছিলাম বটে কিন্তু অনিবনা চিত্রে মঞ্চে সদর অবনতি পাই নি কারণ ভেসলিন আবার এক সন্ধ্যা চার একে আছি আজও কাকু বলে ডাকি, তিনি সেখানে উপস্থিত।

রাগ কাফি কানাড়া। তরলা সঙ্গতে ছিলেন সঙ্কর আয় (পণ্ডিত শঙ্কর মোয়)। হরই জোরগার মেজাজী রাজনা হল। বাবা ও পন্ধর কাকুর বাঘ সদত ও সওয়াল জমত্রের সরয় শ্রোতাদের হাততালির ফোয়ারা মুদিলো। তারপর ছিল নৈশভোজের ব্যবস্থা। যাওয়া-পাওয়ার লরেছি সৌর জেডে অনুষ্ঠান। উনি জমিয়ে করলেন রাগ ভালকোষ। তবলারকে ছিলেন ঠিক মনে নেই, তবে বাঁশীতে যে এইরক মালকোষ হতে পারে, সেটা সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম। পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ রাগসঙ্গীতে বাঁশীর ভাবুকর ছিলেন, কিন্তু তাঁকে আমি কাছ থেকে দেখিনি বা অলিনি। তবে সেদিন গৌর জেঠুর বাঁশীতে মালকোষ গুনে বাবার দত মানুষও বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলেন।

এই অনুষ্ঠানের পর প্রায় বছর খানেক গৌর জেঠুর সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। বাবা নিজের অফিস জার চাকরী নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কারণ সেই সময়ে তিনি একটি নামকরা বেসরকারী সংস্থায় এক দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাছাড়া গানবাজনার সূত্রেও সেখানে যেতেন সেখানে গৌর জেঠুর সঙ্গে বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ হত না। হঠাৎ একদিন সকালবেলায় আমার ঠাকুরদা স্টেটসম্যান কাগজটা পড়তে পড়তে চমকে উঠে বললেন, ‘একি। গৌর গোস্বামী মারা গেল।” দাদুর হাত থেকে কাগজটা দিয়ে দেখলাম যে ইংরেজীতে বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে-‘পরলোকে বাঁশীবাদক গৌর গোস্বামী’। সম্পূর্ণ খবরটা পড়ে জানতে পারলাম যে হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ায় উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বাবা খবরটা শোনা মাত্র ভীষণ ভেঙে পড়লেন। তারপর একদিন কলামন্দিরে কোনো এক অনুষ্ঠানে বাবা গিয়ে শ্রোতাদের বললেন-‘গৌরদা এতবড় একজন শিল্পী ছিলেন অথচ তিনি তাঁর উপযুক্ত স্বীকৃতি পেলেন না, যেহেতু তিনি বাঙালী। এর বিরুদ্ধে আমাদের যৌথভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।’ তারপরের বছর থেকেই উনি ওঁর দাদা-গুরু মহঃ আমীর খাঁ সাহেবের স্মৃতিতে “রাইসিং ট্যালেন্টস কনফারেন্স”-এর আয়োজন করেন। এই সংস্থার সভাপতি ছিলেন বাবার সঙ্গীতগুরু সর্বজনস্বীকৃত আচার্য রাধিকামোহন মৈত্র মহাশয়। ওনার মহাপ্রয়াণের পর এই সঙ্গীত সম্মেলনীর নাম দেওয়া হয় ‘বালিগঞ্জ মৈত্রেয়ী মিউজিক কনফারেন্স’। নবীন প্রতিভাবান বাঙালী শিল্পীদেরই এই অনুষ্ঠানগুলিতে গাইবার বা বাজাবার সুযোগ দেওয়া হত। অনুষ্ঠানগুলি প্রায় পনেরো বছর ধরে পর পর জ্ঞান মঞ্চ, মধুসূদন মঞ্চ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হয়েছিল। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গান্ধী ভবনে শেষবারের মত এটি আয়োজিত হয়। এখনকার কয়েকজন স্বনামধন্য বাঙালী শিল্পীর সঙ্গীত মহলে পরিচিতি হয় এই ‘রাইসিং ট্যালেন্টস কনফারেন্স’ থেকে।

গৌর গোস্বামীর মতো একজন পূজনীয় গুণী শিল্পী আজ বিস্মৃতির আঁধারে চলে গেছেন। উনি ধরাধাম ত্যাগ করার কয়েকবছর পর আকাশবাণীর ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায ছবি সমেত ওনার সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ওঁর স্মৃতিতে কোনো সঙ্গীত সমাবেশ বা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় নি। এটা খুবই দুঃখের বিষয়।

সানাই বাদক আলী আমহেদ হোসেন সাহেবের অনুষ্ঠানও আমি বাল্যকাল থেকেই রেডিওতে শুনে আসছি। আমি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন রবীন্দ্রসদনে আয়োজিত কোনো একটি অনুষ্ঠানে ক্ষণিকের জন্য ওনাকে একবার দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু তার বছর পাঁচেক পরে ওনার সঙ্গে ভালভাবে সাক্ষাৎ হল এক বিচিত্র জায়গায়। সেটা কোনো মার্গসঙ্গীতের আসর বা মজলিস নয়। টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিও, যেখানে ছায়াছবির অনুশীলন ও মহড়া হয়। প্রখ্যাত চিত্রতারকা অরুন্ধুতী দেবী তাঁর পরিচালিত ছায়াছবি ‘দীপার প্রেম’-এর আবহসঙ্গীতের জন্য বাবাকে একবার ইন্দ্রপুরীতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমিও বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম যন্ত্রবাহক হয়ে। গিয়ে দেখলাম সেখানে সঙ্গীত সমাজের তিনজন মহারথী উপস্থিত-ভি. বালসারা, আলি আহমেদ হোসেন ও অলোকনাথ দে (আরেকজন কিংবদন্তী বাঁশীবাদক, যিনি লঘু সঙ্গীতের জগতেই বেশী বিখ্যাত ছিলেন)। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে একটি বিশাল মিউজিক রুম আছে যেখানে যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরা অনুশীলন করেন। সেখানেই সবাই বসেছিলেন।

বাবা ও আমি মিউজিক রুমে ঢোকা মাত্রই আলি আহমেদ সাহেব উঠে এসে বাবাকে নমস্কার জানালেন। দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় হল। আমি ওনাকে প্রণাম করলাম। তারপর অলোকবাবুর তত্ত্বাবধানে শুরু হল আবহসঙ্গীতের মহড়া। বাবার সরোদ ও আলি সাহেবের সানাইয়ে এক সাথে শুরু হল পিলু রাগের ওপর ছোট আলাপ। বাবার প্রতিটি স্বরবিন্যাসের জবাব আলি সাহেব সুন্দরভাবে সানাইয়ে দিতে থাকলেন এবং ঘন ঘন দুজন দুজনকে বাহবা দিতে থাকলেন। মধ্যে মধ্যে অলোকবাবুর বাঁশিতেও পিলু রাগের কিছু অপরূপ সুরবৈচিত্র্য ফুটে উঠল। রিহার্সালের পর বাবা আমায় ১৫ মিনিট বসতে বলে একটু ঘরের বাইরে গেলেন। ঠিক তখনই ঘরে ঢুকলেন আরেকজন বিখ্যাত মানুষ-অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী। ঢুকেই বললেন, ‘আলি সাহেব, একটু জৌনপুরী শুনি।’ বলেই পাশের চেয়ারটায় বসলেন। আলি সাহেব জৌনপুরী শুরু করলেন। বাজালেন ঠিক ১০ মিনিট। সানাইতে অত সুন্দর জৌনপুরী আর কারো হাতে শুনেছি বলে মনে হয় না। এর দু-একদিন পর আসল শুটিং ও রেকর্ডিংটা হল। সেদিন আমি বাবার সঙ্গে যাইনি। অলোকনাথ দে ও ওনার এক ছাত্র বাবাকে যন্ত্রসমেত গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিলেন ও বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন।

যাইহোক, এই যোগাযোগের পর থেকে আলি আহমেদ হোসেন সাহেবের সঙ্গে বাবার সম্পর্কটা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। ওনার সুরেলা সানাই বাবাকে খুবই আকৃষ্ট করত। ওনার হাতে সাহানা রাগটি বাবা বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। বাবার আমন্ত্রণে আলি সাহেব বার দুয়েক আমাদের বালিগঞ্জ মৈত্রেয়ী সঙ্গীত সম্মেলনীতে সানাই বাদন পরিবেশন করেছিলেন এবং দুবারই বাবার অনুরোধে ‘সাহানা’ রাগটি দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেছিলেন।

বছর তিনেক হল, কিডনীর রোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহান সঙ্গীত শিল্পী পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ওঁর সুযোগ্য পুত্র হাসান হাইদার বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে সানাই বাদক হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। গৌর গোস্বামী ও আলি আহমেদ – এই দুই যন্ত্রবাদক তাঁদের নিজ নিজ যন্ত্রকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করেছেন, যেখানে শ্রোতা শুধু সুর উপভোগ করে না, বরং এক অনন্ত সঙ্গীততীর্থে প্রবেশ করে। তাঁদের সাধনা, নিষ্ঠা, এবং যন্ত্রের প্রতি ভালবাসা ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থপঞ্জি (References):
1. Dasgupta, Buddhadev. Buddhadev: My Journey in Music. Kolkata: Sangeet Kala Mandir Publications, 2008.
পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর স্মৃতিচারণে গৌর গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং আকাশবাণীর অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
2. Chaurasia, Hariprasad. Woodwinds of Change: The Evolution of the Bansuri. New Delhi: Roli Books, 2012.
বাঁশির শাস্ত্রীয় পরিবেশনা প্রসঙ্গে পণ্ডিত চৌরাসিয়ার বিশ্লেষণ, গৌর গোস্বামীর ধারার প্রেক্ষাপট বোঝাতে সহায়ক।
3. Khansaheb, Bismillah. Bismillah: An Autobiography. Translated by Rita Kotari, New Delhi: Penguin India, 2003.
সানাই যন্ত্রের ধ্রুপদী রূপ এবং আলি আহমেদ হোসেনের পূর্বসূরি হিসেবে উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ-এর প্রভাব ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে।
4. Banerjee, Rita. “Unsung Maestros of Indian Instrumental Music”, Sangeet Natak Journal, Vol. 35, Issue 1, 2007.
গৌর গোস্বামী ও আলি আহমেদের মতো শিল্পীদের মূল্যায়ন ও তাঁদের অবদানের আলোচনায় একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ।
5. All India Radio Archives
আকাশবাণীর সংগ্রহশালা থেকে গৌর গোস্বামী ও আলি আহমেদ হোসেনের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে। শ্রোতা ও গবেষকদের জন্য এই অডিও ফাইলগুলি মূল্যবান।
6. “বেতার জগৎ” পত্রিকা (All India Radio Monthly), 1987, Issue 3
গৌর গোস্বামীর প্রয়াণ উপলক্ষে একটি স্মরণপ্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে তাঁর জীবনের নানা দিক আলোচিত।
7. Jadavpur University Archives – Department of Music and Performing Arts
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে ‘বালিগঞ্জ মৈত্রেয়ী মিউজিক কনফারেন্স’-এর রেজিস্টার ও প্রচারপত্র সংরক্ষিত রয়েছে।
8. Personal Interview with Shubanishankar Dasgupta, 2024
ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে গৌর গোস্বামী ও আলি আহমেদের শিক্ষাদান ও শৈলী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে।
9. Sangeet Natak Akademi Digital Library
সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ডিজিটাল লাইব্রেরিতে সানাই ও বাঁশি বাদকের উপর একাধিক দুষ্প্রাপ্য রেকর্ডিং ও জীবনী উপলব্ধ।
10. Suresh, Sarla. Lost Melodies: Forgotten Instrumentalists of India. Mumbai: Navrang Publications, 2015.
ভারতীয় উপমহাদেশে অখ্যাত অথচ গুণী যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে লেখা একটি সংকলন। গৌর গোস্বামী ও আলি আহমেদের প্রতি উৎসর্গীকৃত একটি অধ্যায় রয়েছে।

লেখক পরিচিতি :  পণ্ডিত ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্ত প্রখ্যাত সবোদ বাদক পদ্মভূষণ পণ্ডিত বৃদ্ধদেব দাশগুপ্তর জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সুযোগ্য ছাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এবং আকাশবাণী ও দূরদর্শনের অনুমোদিত শিল্পী।