Rabindranath Tagore and Vaishnava  Literature

Dr. Srabani Sen
                               Associate Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College
e-mail-srabanisn1@gmail.com  Mobile no- 6290855102
Vaishnava Literature mainly deals with Vaishnava religion and philosophy. Rabindranath Tagore was influenced by Vaishnava literature and philosophy.Tagore was deeply impressed by the works of Govinda Das and wrote many Vaishnava and Baul pieces. In Bhanusingher Padavali literary concepts having an influence of Vaishnava lyrics. Bhanusingher Padavali was composed in Brajabuli language. Tagore emphasizes similarities between Vaishnava Soul Force and Tagore’s Maanvika Bhuma points out the philosophical significance in human- nature relationship.
পদাবলী সাহিত্য  ও রবীন্দ্রনাথ
বাংলা সাহিত্যে ষোড়শ ও সপ্তদশ – এই দুই শতক জুড়ে মহাজন কবিদের হাতে বৈষ্ণব পদাবলী শ্রেষ্ঠ নমুনাগুলো রচিত হয়েছিল। বৈষ্ণব পদাবলী সুর-সংযোগে গীত হত- এই গানই ‘পদাবলী কীর্তন’। বৈষ্ণব-পদাবলীর পরমরসাস্বাদক শ্রীচৈতন্যদেবের উদার ধর্মভাব ও মানবপ্রেমের প্রতিও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বৈষ্ণব-পদাবলীর বিকাশ ছিল শ্রীচৈতন্যদেবের বহু পূর্ব থেকে এবং বিদগ্ধ পদাবলী- রচয়িতা কবি জয়দেব, চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি  ছিলেন শ্রীচৈতন্যের পরম অনুসারী।
বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি কবির নিবিড় আকর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ভানুসিংহ-ঠাকুরের পদাবলী’। ‘ভানুসিংহ-ঠাকুরের পদাবলী’ বৈষ্ণব কাব্যের অনুকরণপ্রিয়তার নিদর্শন নয়, বরং বৈষ্ণবকাব্যরসলোভী মনের এক স্বাভাবিক প্রেরণারই পরিচায়ক – যা ছন্দ ও ভাষার উপর তার  অধিকারকেই ব্যক্ত করেছে। কবির স্বতঃস্ফূর্ত ভাবোচ্ছলতা, দার্শনিক মনোবৃত্তি ও গভীর রসোপলব্ধি তাঁর রচনাকে নিছক অনুকরণতাপ্রসূত ভাবক্লিষ্টতা ও ব্যঞ্জনার দৈন্য হতে সচ্ছন্দভাবে মুক্ত করে দিয়েছে ।
বৈষ্ণব-পদাবলী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রথম কৌতূহল উদ্দীপিত হয়েছিল ‘প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ’ পড়ে। গীতিকবিতাগুলো সম্বন্ধে কিশোরবয়স থেকে রবীন্দ্রনাথের কৌতূহল ছিল অসীম। ‘প্রাচীন কাব্য-সংগ্রহ’ গ্রন্থে সংকলিত বৈষ্ণব পদগুলোর মধ্যে চন্ডীদাস, বিদ্যাবতী ও গোবিন্দ দাসের রচনাগুলি কিশোর রবীন্দ্রনাথকে সর্বাধিক আকৃষ্ট করেছিল এবং বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্যবহৃত ব্রজবুলি ভাষার অর্থ বিশ্লেষণ করে রসাস্বাদ করেন এবং চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের পদগুলো পড়ে  মুগ্ধ হন। এই কবিত্রয়ের মধ্যে কবি বিদ্যাপতির উপর রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিদ্যাপতির কবিতার শব্দঝংকার,  ছন্দগ্রন্থনা  ও চন্ডীদাসের তুলনায় অগভীর কাব্যভাবনার প্রভাব ভানুসিংহের বিভিন্ন পদে লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন আলোচনায়, চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতি অপেক্ষা চন্ডীদাসকে অনেক উচ্চতর আসন দান করেছেন। চন্ডীদাসের কাব্যের  Romantic melancholy ও গীতিময়তা রবীন্দ্রনাথকে বেশি স্পর্শ করেছে।
এরপরই রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীর অনুসরণে পদ রচনা শুরু করেন। কিশোর কবি প্রাচীন কবিদের ভাষাও আঙ্গিকে লেখেন বিশুদ্ধ পদ। ইংরেজ বালক-কবি চ্যাটার্টনের দুঃসাহসিক সাহিত্য-প্রচেষ্টার কাহিনী বালক রবীন্দ্রনাথের মনে অনুপ্রেরণার আগুন জ্বালিয়েছিল। চ্যাটার্টন প্রাচীন ইংরেজ কবিদের নকল করে বহুসংখ্যক কবিতা রচনা করে ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন। সে রকমই প্রাচীন কবিদের অনুসরণে বালক রবীন্দ্রনাথ প্রতি পদের ভণিতায় ‘ভানুসিংহ’ ছদ্মনামটি জুড়ে দেন, এবং অর্থ বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দেন ‘ ভানুসিংহ’ ও ‘রবীন্দ্রনাথ’ সমার্থক।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ষোল বছর, ‘ভারতী’ পত্রিকায় ভানুসিংহের প্রথম সাতটি পদ প্রকাশিত হয়। বাকি তেরোটি পদ প্রকাশিত হয় তার পঁচিশ বছর বয়স কালের মধ্যে। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘ ভানুসিংহেরপদাবলী ছোট বয়স থেকে অপেক্ষাকৃত বড় বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকালের সূত্রে গাঁথা।’
যে বৈষ্ণবীও তত্ত্বাদর্শে নিষ্ঠাবান থেকে মহাজন পদকর্তাগণ পদ রচনা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তা থেকে অনেক দূরে। মহাজন- কবিদের মতে বৈষ্ণব পদাবলী সাধারণ নরনারী লৌকিক প্রেমের কাব্য নয়; রাধাও কৃষ্ণের প্রেমলীলা একটি রূপ মাত্র —এর মধ্যে দিয়ে বলা হয়েছে ভক্ত ও ভগবানের আধ্যাত্মিক সম্পর্কের কথা।
ভানুসিংহের পদাবলী কুড়িটি মাত্র খন্ডপদের সমষ্টি। ভানুসিংহের কুড়িটি খন্ডপদের মধ্যে  মধ্যে দিয়ে শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ দেখাবার কোন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় না। পূর্ব রাগ, অভিসার, মান, প্রেমবৈচিত্র্য, নিবেদন, মাথুর, মিলন, প্রার্থনা প্রভৃতি প্রথাবদ্ধ ধারনুক্রমে পদগুলো বিন্যস্ত নয়। ঊনিশ ও কুড়ি সংখ্যক পদ দুটো ছাড়াও এমন কিছু পদ কবি লিখেছেন  যেগুলো বাহিরাঙ্গিকে কিংবা আন্তর ভাব-গভীরতায় যে কোন প্রথম শ্রেণীর বৈষ্ণব কবির রচনার পাশে স্থান পাওয়ার যোগ্য।
 ‘ভানুসিংহের পদাবলী’র মাধুর্যরসনির্যাসের নিষ্কাশনে রবীন্দ্রনাথ  বলেছেন: “বিদ্যাপতি সুখের কবি ও চন্ডীদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে  সার বলিয়া জানিয়েছেন, চন্ডীদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়েছেন”। রবীন্দ্রনাথের কাছে চন্ডীদাস ছিলেন বিদ্যাপতি অপেক্ষাও সকরুণ, সচল ও কোমল, কিন্তু পদ- রচনার মাধুর্যে ও রস- সম্ভোগের ক্ষেত্রে উভয়েরই তুলনা নেই ।
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দের’ কাব্যরসের  আভাস ভানুসিংহের পদাবলীর অনেক স্থানে পাওয়া যায়। কবি জয়দেবের-
নামসমেতং কৃতসঙ্কেতং বাদয়তে মৃদু বেণুম্।
  বহু মনুতে নণু তনসঙ্গতপবনচলিতমপি রেণুম্।।
 পততি পতত্রে বিচলিতপত্রে শঙ্কিতভবদুপযানম্।
              রচয়তি শয়নং সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্।। ৫।১০-১১
ছায়া রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখা যায়-
    সতিমির রজনী, সচকিত সজনী, শূণ্য, নিকুঞ্জ অরণ্য,
    কলয়িত  মলয়ে, সুবিজন-নিলয়, বালা- বিরহ- বিষণ্ণ।
তৃষিত নয়নে, বনপথপানে নিরখে ব্যাকুল বালা।
   দেখন পাওয়ে , আাঁখি ফিরাওয়ে,গাঁথে বনফুলমালা।
সহসা রাধা চাহল  সচকিত, দূরে খেপল মালা —
        কহল সজনি, শুন বাঁশরী বাজে,  কুঞ্জে  আওল কালা। ১
জয়দেবের ছন্দ, কাব্য ও সুর কবির লেখনীর মাধ্যমে পেয়েছে নবজীবন এবং বৈষ্ণব-পদের সমতুল্যতা।
যদিও ভাবের গভীরতা দিক থেকে বিদ্যাপতি আরও ছাপিয়ে গেছেন। যেমন-
নিজ পহুঁ পরিহরি সঁতরি বিখম নরি
অঁগরি মহাকূল গারী
তু অ অনুরাগ মধুর মদে মাতলি
          কিছু ন গুণল বরনারী-ই।২
ভাবের গভীরতায়, প্রকাশের মাধুর্যতায় ও ব্যঞ্জনার সৌন্দর্যে এমনি অনেক বৈষ্ণব-কবিতাই নিঃসংশয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বীরূপে প্রতিয়মান হতে পারে, কিন্তু ভাষার সংযমতার পরিবেশ সৃষ্টির কুশলতায় ও প্রাকৃত বর্ণনার প্রাঞ্জলতায় কবির  পদটি উৎকর্ষতার পরিচয় দেয়। ভাব-বিচিত্রতার নব নব অবিভক্তি – যা ব্যক্ত হয়েছে দান, গোষ্ঠ, নৌকাবিলাস, রাস, মুরলীশিক্ষা প্রভৃতি লীলা বৈচিত্র্যের মাধ্যমে, রস-সাহিত্যকে করে তুলেছে সুসমৃদ্ধ,  তাদের অনুরূপ  সন্ধান কবির সৃষ্টির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাথের স্বভাব-সুন্দর কবি-মন বৈষ্ণবসাধকদের মতো প্রেমের জটিলতাকে উপলব্ধ করতে না পারায় ‘মান’ লীলাকে যথোপযুক্ত মূল্য দিতে সমর্থ্য হননি। তবু দার্শনিক ভাব ও মধুর রসের প্রতিচ্ছায়ার প্রতিফলন ঘটেছে কবির মনে। যার ফলে রচিত হয়েছে ‘কো তুহুঁ বোলবি মোয়’ -অনুরূপ পদ, সার্বজনীন প্রভাবের দিক থেকে যার সাথে বিদ্যাপতির- ‘‘সখি কি পুছসি অনুভব মোয়’’ পদটির সাদৃশ্য মেলে। যদিও এখানে বিদ্যাপতির ভাবগম্ভীর্য অতুলনীয় এবং তার বাচনিক অভিব্যক্তির সঙ্গে কবির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না ।
সখি কি  পুছসি  অনুভব মোয়
সেহো পিরিত                  অনুরাগ বখানইত
তিলে তিলে নূতন হোয়।
জনম অবধি হাম                রূপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল।৩
এবং
কো তুহুঁ বোলবি মোয়,
                হৃদয়- মাহ মঝুকু জাগসি অনুখন          আঁখ উপর তুহুঁ রচলহি  আসন
                                           অরুণ নয়ন তব মরণ সঙে মম,
          নিমিখন অন্তর হোয়                   কো তুহুঁ বোলবি মোয়। ৪
পাশাপাশি পড়লেই ভাব ও ছন্দের ঐক্য সহজেই ধরা পড়ে। বৈষ্ণব-মহাজন ও রবীন্দ্রনাথের রচনা পদ্ধতি ও ভাষার মধ্যে সাদৃশ্যও অনুভূত হয়।
ভানুসিংহের শ্রীরাধার প্রশ্নকাতরতা কবি বিদ্যাপতির প্রশ্নকাতরতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও উভয়ের রস ঠিক এক নয়। ভানুসিংহের রাধার মনে যে প্রশ্ন তা অজানার, আর বিদ্যাপতি রাধার প্রশ্ন অশেষের অতৃপ্তির। ভানুসিংহে রাধা বিস্মিতা, বিদ্যাপতির রাধা চির-আকাঙ্ক্ষিনী। তবু মানব-মনের চির-আকুলতা উভয়ের মধ্যেই প্রকট ।
 চন্ডীদাসের ‘কানুর পিরীতি মরণ অধিক’ -গান রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘ জীবনবল্লভ মরণ অধিক সো’-তে পর্যবসিত হওয়ার পূর্বে কবির চরণগুলি এক মাধুর্যপূর্ণভাবের সৃষ্টি করেছে, পদটিতে কোথাও অনুকরণে ছায়া লক্ষ্য করা যায় না। এভাবেই অনুকরণ করতে গিয়ে কবি বহুস্থানে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে বৈষ্ণব ভাবপ্রবাহের মধ্যে থেকে তাকে খুঁজে বের করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। যেমন উদ্ধবদাসের কবিতায়-
‘আষাঢ় গত পুণ মাহ শাঙন সুখদ যমুনা তীর।
ঘোর ঘটা ঘন দামিনী দমকত, বিন্দু বরিখত নীর।। ৫
এবং
‘শাঙন মাসে সগন ঘন গরজন পুলকিত দামিনী মাল।
বরিখত বারি পবন মৃদু মন্দ হি গঙ্গা-রঙ্গ বিশাল।।
শিবরাম দাসের ‘মাহ শাঙন বরিখে ঘন ঘন দুহুঁ ঝুলে কুঞ্জক মাঝ’ পদে। আবার  ‘গগন গরজনি দমকে দামিনী’,  ‘দুহুঁ গাওহে বহুবিধ তান’ প্রভৃতি এবং গোবিন্দ দাসের পদে-
‘ মন্দিরও বাহির কঠিন কবাট।
চলইতে  শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তঁহি অতি বাদর  দরদর রোল।
বারি কি বারই নীল নিচোল।।
সুন্দরি কইছে করবি অভিসার
হরি বহু মানুষ সুরধুনী পার।।
ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত।
শুনইতে শ্রবণ মরম জরি যাত।।
ইথে  যব সুন্দরি তেজবি গেহ ।
প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।। ৬
সমন্বিতভাবে রবীন্দ্রনাথের হাতে পায় নতুন রূপ-
 শাঙন -গগনে ঘোর ঘন ঘটা নিশীথ যামিনীরে।
কুঞ্জপথে অব কৈ-সে যাওব অবলা কামিনীরে।
 উন্মদ পবনে, যমুনা তর্জিত ঘন ঘন গর্জিত মেহ
       দমকত বিদ্যুত পথতরু লুন্ঠিত থর থর কম্পিত দেহ।
      ঘনঘন রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ বরখত নীরদ -পুঁঞ্জ।
     শাল- পিয়ালে তাল -তমালে নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ।
   কহলো  সজনী এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান
 দারুণ বাঁশি কাহে বাজায়ত সকরুণ রাধানাম। ৭
‘নীলশাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলা’ চন্ডীদাস নামাঙ্কিত পদে পাওয়া যায়-
 চলে নীল শাড়ি              নিঙগাড়ি নিঙগাড়ি
                   পরাণ  সহিত  মোর।
সেই হইতে মোর               হিয়া নহে থির
                    মনমথ-জ্বরে ভোর।। ৮
তাছাড়া ‘ গহন রয়ণ সে ন যাও বালা, নওল কিশোরক পাশ’ – কবিতাটি ভাবের অভিব্যক্তি ও বর্ণনাতে তা বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে সমতুল্যতার দাবি রাখে।
নায়িকার মনোবেদনা উৎকণ্ঠিতারপদে গোবিন্দ দাসের লেখনীতে মুহূর্ত হয়েছে-
‘ হামরহু সঙ্কেত আনত বহু কান
একলি  নিকুঞ্জে কুসুমো-সর হান
এ  সখি  হৃদয়ও জলত মঝু আগি
   কঠিন পরাণ রহত কথি লাগি। ৯
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে নূতনত্ব ধরা পড়ে- ‘ হৃদয়কে সাধ মিশাওল হৃদয়ে’পদটির মাধ্যমে। যথা-
      বিরহ বিষে দোহি বহিগল  রয়নি, নহি নহি আওল কালা।
   তৃষিত প্রাণ মম দিবস যামিনী শ্যামক দরশন আসে।
    আকুল জীবন থেহ ন মানে, অহরহ জ্বলত হুতাশে। ১০
রসসৃষ্টি ও ব্যঞ্জনার দিক থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় গোবিন্দ দাসের। কবির ভাষা ও ভাব-সম্প্রসারণেও অনুভূত হয় গোবিন্দ দাসের প্রভাব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শ্রীরাধার মধ্যে মানবীয় প্রেমের রূপ অধিক প্রকট এবং রাধার মধ্যে যে প্রেম ব্যক্ত হয়েছে তাতে ঐশী প্রেমের ছায়া ক্ষুণ্ণ হয়ে মানবীয় প্রেমকেই প্রকাশ করেছে। তাই  ভানুসিংহের শ্রীরাধার মধ্যে  অভিমানের তীব্রতা অপেক্ষাকৃত মৃদু। ভানুসিংহ পদাবলীর শ্রীরাধার মধ্যে আশা ও নিরাশার দোলা অনেকটা সাধারণ মানুষের মানসিক গতির দোলার মতো, এজন্য সাধারণের পক্ষে তাতে সরস প্রাণের ছোঁয়া সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
রসের বিচারে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’কে বৈষ্ণব- কাব্যধারার সমান মূল্য দেওয়া চলে, — ভাবের  দিক থেকে তা যদিও হালকা। তবে স্বাতন্ত্র্যের বিচারে কবি রবীন্দ্রনাথের কাব্য সৃষ্টি পদাবলী সাহিত্যের  পাশে স্থান পায়। যে রসের স্রোতে অবগাহন করে বৈষ্ণব- কবিরা আজও অমর হয়ে আছেন সেই স্রোতেই ডুব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাসিয়েছেন তার কাব্যের অর্ঘ্য যার এক প্রান্তে গাঁথা- চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও গোবিন্দ দাসের অমৃত-রত্নাবলীরূপ অম্লান কুসুমরাজি।
 অধ্যাত্ম-সাধনপথেররহস্যের  ইঙ্গিত রবীন্দ্রনাথ এ বৈষ্ণব সাধনা থেকে পৃথক হলেও মহাজন- পদাবলীর রস-মন্দাকিনীতে যে তিনি অবগাহন করেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথের কাব্যরসপূর্ণ সাহিত্যভাষা বৈষ্ণব- পদাবলীর ভাষা ব্রজবুলির শব্দ- ঝংকার ও ছন্দলালিত্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল বা সামঞ্জস্য  প্রকাশ না পেলেও তা কোন কোন অংশে প্রায় সমশ্রেণীভক্ত । পদকর্তা গোবিন্দদাস যেখানে রসায়িত পদলালিত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন –
শরদ চন্দ        পবন মন্দ
বিপিনে ভরল কুসুম-গন্ধ
ফুল্ল মল্লিকা মালতি যুথি
  মত্ত মধুকর- ভোরনি। ১১
‘ভানুসিংহের পদাবলী’র ভাষা বৈষ্ণব- পদাবলীর ভাষা কিছুটা কৃত্রিম হলেও গোবিন্দদাসের প্রায় অনুরূপভাবেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন –
“ গহন কুসুম- কুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর  বংশি বাজে
বিসরি ত্রাস লোক- লাজে
সজনি, আও আও লো।
অঙ্গ চারু নীল বাস,
হৃদয়ে প্রণয়- কুসুমরাশ,
হরিণ- নেত্রে  বিমল হাস
 কুঞ্জ- বনামে আও লো। ১২
বৈষ্ণব পদাবলী প্রত্যক্ষ প্রভাবে রচিত হয়েছিল ভানুসিংহের পদাবলী। পদাবলী সাহিত্যের পরোক্ষ প্রভাব সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যে  সুদূর প্রসারী।  বৈষ্ণব-পদাবলী-সাহিত্যের দ্বারা রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রকাব্য- প্রবাহ প্রভাবিত হলেও তারা স্বকীয়তার আসনে অধিষ্ঠিত ও মহিমান্বিত।
 ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব- কবিদের প্রত্যক্ষভাবে অনুকরণ না করলেও পরোক্ষভাবে অনুসরণ করেছেন বলা যায়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : “পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণব চিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই।” এখানে কবির স্বীকারোক্তিতে বৈষ্ণব-পদাবলীর সঙ্গে  স্বীয় জীবনের  অনৈক্য ভাব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে, কারন রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্ম-সাধনার, ধারা বৈষ্ণব-সাধনরীতি থেকে চিরদিন  পৃথকই ছিল।
তথ্যসূত্র
১। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ–১৭৭
২। ড.সনাতন গোস্বামী ,পৃঃ—৬২
৩। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৭৬
৪। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৭৬
৫। ড.সনাতন গোস্বামী,পৃঃ—৮২
৬। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, ,পৃঃ-১৭৩
৭। ড.সনাতন গোস্বামী, পৃঃ—৮০
৯। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৭৭
১০। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৭৮
১২। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৮৭
গ্রন্থপঞ্জি
১। অমল মুখোপাধ্যায় – রবীন্দ্রসংগীত পরিক্রমা
২। প্রজ্ঞানানন্দ- সঙ্গীতে রবীন্দ্রপ্রতিভার দান
৩। ড.সনাতন গোস্বামী- বৈষ্ণব পদাবলী
৪। শান্তিদেব ঘোষ-রবীন্দ্রসঙ্গীত
৫। প্রভাত কুমার গোস্বামী –ভারতীয় সংগীতের কথা
           :