রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে নারী চরিত্র : একটি দার্শনিক বিশ্লেষণ – অন্বেষা মুস্তাফী
সারসংক্ষেপ:
বিশ্বব্রহ্মান্ডের এক অতুলনীয় সৃষ্টি হল নারী। কবি মানসে নারী সর্বদাই কোমলতার রূপ, সৌন্দর্য্যের আধার। কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে নারীর অন্যরূপ ধরা পড়েছে। নারী চরিত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলি তিনি তাঁর সাহিত্যে, কাব্যে, নাটকে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণ হস্তে। রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যেও তার অন্যথা ঘটেনি। ‘শাপমোচন’ থেকে শুরু করে ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চন্ডালিকা’, ‘শ্যামা’ প্রতিটি নৃত্যনাট্য কালক্রমে যেমন অনেক পরিণত ও বলিষ্ঠ, তাদের চরিত্রায়ণ তেমনই অভিনব। বিশেষ করে, নারী চরিত্রগুলিকে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন অতুলনীয় রূপ। উল্লেখ্য , ‘শাপমোচন’ ছাড়া ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চন্ডালিকা’ ও ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের নামকরণ মুখ্য নারী চরিত্রের নামানুসারেই হয়েছে। তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলিতে কোথাও স্বৈরিনী নারীর চিত্র পাই, কোথাও পাই এক সমাজচ্যুত নারীর বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার লড়াই, কোথাও অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নারীর অস্তিত্ব সংকট আবার কোথাও পাই নারীর নিজের ও প্রেমাষ্পদের অন্তরের সন্ধান। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে নারী চরিত্রগুলির মধ্যে আসলে কত গভীর দর্শন লুকিয়ে আছে তা আমাদের সর্বদাই বিস্মিত করে। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে নারী চরিত্রের মর্মার্থ ও দর্শন উপস্থাপিত হল।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার জনজীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ঘটে, যার উৎস ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। বিশেষ করে, নাট্যাভিনয়ে ইউরোপীয় অপেরা স্টাইলে কলকাতার রঙ্গমঞ্চে নাট্যকর্তারা নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন। সাহিত্যে, শিক্ষায়, আদব-কায়দায় ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতার যে কয়েকটি পরিবার ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে স্বাগত জানিয়ে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সমন্বিত জীবনচর্চায়, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি তাদের মধ্যে অন্যতম। দেশীয় সঙ্গীত ও ইউরোপীয় সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি ছিল নিয়মিতভাবে তাদের নিজস্ব নাট্যমঞ্চে নাট্যাভিনয়ের আয়োজন। এই পরিবেশেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বেড়ে ওঠা। তাঁর ‘জ্যোতিদাদা’ এর সান্নিধ্যে বিলাতী সঙ্গীতের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হন। এরপর বিলাতে থাকার সময় ইউরোপীয় গান, ইউরোপীয় নৃত্য ও অপেরাকেন্দ্রিক নৃত্যাভিনয় সম্বন্ধেও তিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, যা পরবর্তীকালে গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যে সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। বিলাতফেরত রবীন্দ্রনাথের উপর ব্রাহ্মসমাজের বার্ষিক অধিবেশনে উপলক্ষ্যে অভিনয়ের উপযোগী নাটক রচনার ভার অর্পিত হয়, সৃষ্টি হয় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। গীতিনাট্যের শুরু এখান থেকেই। পরবর্তীকালে, কালমৃগয়া, মায়ার খেলা তাঁর সার্থক রচনা। কালক্রমে ‘মায়ার খেলা’ রচনার পর প্রাক্ শিশুতীর্থ হয়ে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যে উত্তরণ ঘটে। এরপর নৃত্যাভিনয়কে আরও সচেতনভাবে রূপ দেবার জন্য রচিত হল ‘শাপমোচন’। এরপর একে একে চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, শ্যামা পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্যরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। প্রত্যেকটি নৃত্যনাট্যে রবীন্দ্রনাথ নারীর বিভিন্ন রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন যার প্রকৃত সহযোগী হয়েছে সুর, বাণী এবং সুনিপুণ কাহিনি। নারী চরিত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মানসিক টানাপোড়েন, অস্তিত্বের সংকট, ন্যায়-অন্যায়, নীতিবোধ এইসব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনন্য রূপ দিয়েছেন তাঁর সৃষ্ট নৃত্যনাট্যগুলিতে।তাঁর রচনায় নারী শুধু সৌন্দর্য্যের আধার হয়ে অবস্থান করেনি, দেহজ সৌন্দর্য্যকে ছাপিয়ে অন্তরের ঐশ্বর্য্য কে মেলে ধরেছে। প্রতিটি নারী চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে গভীর দর্শন, যা কবি অত্যন্ত সহজভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
নৃত্যনাট্য ‘শাপমোচন’ ১৩৩৮ সালের মাঘ মাসে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয় কথা আকারে। পরবর্তীতে, ১৩৩৯ সালে ‘এম্পায়ার’ থিয়েটারে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রূপে প্রকাশিত হয়। নৃত্যনাট্য রচনার যুগ ‘শাপমোচন’ রচনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় বলে মনে করা হয়। ভূমিকাতে বলা হয়েছে, ‘রাজা’ নাটকের পরিবর্তিত রূপ হল ‘অরূপরতন’, সেই অরূপরতন কে নাচে গানে রূপায়িত করে সৃষ্টি হয়েছে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যটি। নৃত্যনাট্যের শুরুতে দেখা যায়, সুরলোকের গন্ধর্ব সৌরসেন তার প্রেয়সী মধুশ্রীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে মৃদঙ্গের তাল স্খলন হলে সুরসভার অভিশাপ তার উপর নেমে আসে। মনুষ্যলোকে জন্ম হল বিকৃত দেহে গান্ধাররাজকুলে ‘অরুণেশ্বর’ নামে। অন্যদিকে মধুশ্রী তার বিরহে কাতর হয়ে ইন্দ্রের কাছে মর্ত্যে যাবার অনুনয় করলে ইন্দ্রের বর অনুযায়ী মর্ত্যলোকে মদ্ররাজকন্যারূপে জন্ম হল ‘কমলিকা’ নামে। কালক্রমে দেখতে পাই রাজা অরুণেশ্বরের সাথে কমলিকার প্রতীকি বিবাহ- তার বিবাহ হয় অরুণেশ্বরের ‘বক্ষবিহারিণী বীণা’ এর সাথে। রাজবধূ পতিগৃহে এসে দেখে সে ঘর দীপহীন অন্ধকার। বধূ স্বামীকে দেখবার জন্য উৎসুক। কিন্তু রাজা দেখা না দিয়ে বলে ‘আমার গানেই তুমি আমাকে দেখো’। রাজাকে চাক্ষুস দেখবার অভিপ্রায় পূর্ণ না হওয়ায় রাণী অভিমানী হয়ে উঠল। রানীর অভিমানে সাড়া দিয়ে রাজা জানাল “কাল চৈত্রসংক্রান্তি। নাগকেশরের বনে নিভৃতে সখাদের সাথে আমার নৃত্যের দিন। প্রাসাদশিখর থেকে দেখো চেয়ে”। কিন্তু চৈত্রসংক্রান্তিতে রাজাকে দেখে আলাদা করে চিনতে পারেনি রানী। তার পরিবর্তে রাজাকে জানাল কোনো এক কুশ্রী মানুষ আবহে ছন্দপতন ঘটাচ্ছিল। সে আরও জানাল “রসবিকৃতির পীড়া সইতে পারে না’’। রাজা উত্তরে বলে, “একদিন সইতে পারবে আপনারই আন্তরিক রসের দাক্ষিণ্যে’’। কিন্তু কমলিকা যখন রাজাকে সচক্ষে দেখে তখন তার স্বপ্নভঙ্গ হল। ‘কী অন্যায়, কী নিষ্ঠুর বঞ্চনা’ বলতে বলতে কমলিকা ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে গেল। বহু দূরে বনের ভিতর মৃগয়ার জন্য তৈরী রাজগৃহে বাস করতে লাগল। কিন্তু এবার কমলিকার মধ্যে বিরহের সঞ্চার হল, “সখী,আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’’। রানী মনে ভাবে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল কৃষ্ণসন্ধ্যায়। সে গাইল-‘ হে অজানা তোমায় তবে/জেনেছিলেম অনুভবে-/গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে’। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- “কী হল রাজমহিষীর। কোন হুতাশের বিরহ তার বিরহ জাগিয়ে তোলে’’। রানীর মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন লক্ষিত হল। প্রথমে কমলিকা কে সৌন্দর্য্যের পূজারী মনে হলেও ক্রমশ সে ভালোবাসার পূজারী হয়ে উঠল। তা বোঝা যায়, যখন কমলিকার মনে হল “বীণাধ্বনি যেন আজ আর বাইরে নেই, এসেছে তার অন্তরের তন্তুতে তন্তুতে’’। একসময় সংগীতের মূর্চ্ছনায় কমলিকা নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না, জেগে ওঠে অভিসারের সুপ্ত ইচ্ছা। সেই অভিসারের গন্তব্য রাজা অরুণেশ্বর যাকে দেখে ঘৃণায় সে মহল ত্যাগ করেছে। কমলিকা অরুণেশ্বরের কাছে এলে রাজা বলে- “ভয় কোরো না, প্রিয়ে ভয় কোরো না”। কমলিকার কন্ঠে শোনা যায় দ্ব্যর্থহীন, সংশয়হীন অভিব্যক্তি –‘কিছু ভয় নেই আমার,জয় হল তোমারই’। এই জয় আসলে শুধু অরুণেশ্বরের জয় নয়, এই জয় কমলিকার হৃদয়সত্ত্বার জয়। কমলিকা যে বাইরের সৌন্দর্য্যের পূজারী থেকে কখন ও কীভাবে অন্তরের সৌন্দর্য্যের পূজারী হয়ে উঠেছে সেই বোধের উন্মেষই এই নৃত্যনাট্যের সবচেয়ে বড় সম্পদ। নৃত্যনাট্যের শেষে যখন দেখি রাজমহিষী কমলিকা প্রদীপ হাতে রাজা অরুণেশ্বরের মুখের কাছে তুলে ধরে বলে- ‘প্রভু আমার, প্রিয় আমার, এ কী সুন্দর রূপ তোমার!’ তখন বোধ হয় কমলিকা বুঝি রূপসাগরের সুধায় তলিয়ে গিয়ে সেই অরূপরতনের সন্ধান পেয়েছে। ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যে রাজা অরুণেশ্বরের চরিত্রটি বলিষ্ঠ। সে যেন একজন দেবতুল্য মানুষ। সে সবদিক থেকেই সম্পূর্ণ। তার জীবনে সুর,তাল,ছন্দ সবই আছে এবং তা দিয়ে সে মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে পৌঁছাতে পারে। তাই প্রেমের স্বরূপ কী তা অরুণেশ্বরের অজানা নয়। কিন্তু কমলিকাকে প্রেমের পাঠ পেতে হলে করতে হবে অরূপ রূপের সাধনা। সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে তবেই কমলিকা পাবে অরূপরতনের সন্ধান। তাই তো গোটা নৃত্যনাট্য জুড়ে আছে কমলিকার ধাপে ধাপে নিজেকে সেই সাধনায় উন্নত করবার প্রয়াস। এই সাধনা যে শুধু মানবীয় সাধনা তা নয়, প্রকারান্তরে রবীন্দ্রনাথ কমলিকাকে দিয়ে ঈশ্বরসাধনা করিয়েছেন। কমলিকাও নিষ্ঠার সাথে সেই সাধনায় উন্নীত হয়েছে। পেয়েছে নিজের অন্তরের সন্ধান। সেদিক থেকে ‘কমলিকা’ চরিত্রটি ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যের বড় সম্পদ একথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ –র কথা অংশ প্রকাশিত হয় কলকাতায় ‘নিউ এম্পায়ার’ থিয়েটারে ১৯৩৬ সালে অভিনয় উপলক্ষ্যে। বৈশাখ ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে স্বরলিপিসহ পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। নৃত্যনাট্যের বিষয়বস্তুটি মণিপুররাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা ও অর্জুন কে ঘিরে। মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশ কেবল পুত্রসন্তান লাভ করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন রাজকুলে চিত্রাঙ্গদা এর জন্ম হল তখন রাজা তাকে পুত্ররূপেই লালন পালন করলেন। রাজকন্যা যুদ্ধবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা প্রভৃতিতে পারদর্শী হয়ে উঠল। একদিন পুরুষবেশধারিণী চিত্রাঙ্গদা তাঁর সহচরীদের সঙ্গে বনে শিকার করতে গিয়ে অর্জুনের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানোয় অর্জুন ক্রোধিত হয়ে ওঠে। চিত্রাঙ্গদা নিজের ভুল বুঝতে পারলেও অর্জুনের এহেন ক্রোধ ও প্রত্যাখ্যানে তার বোধ জাগ্রত হয় যে, সে নারী। এখানেই রবীন্দ্রনাথ নাটকীয় গতিময়তা সৃষ্টি করলেন। একজন পুরুষশিক্ষায় শিক্ষিত নারীর মধ্যে নারীসত্ত্বা জাগিয়ে তুললেন। তাই চিত্রাঙ্গদার পরিবর্তন লক্ষ্য করে তার সখী বলেছে- “সখী, কী দেখা দেখিলে তুমি! এক পলকের আঘাতেই খসিল কি আপন পুরানো পরিচয়”। চিত্রাঙ্গদা এবার নিজ রূপ ধারণ করে অর্জুনের কাছে আত্মনিবেদন করলে অর্জুন তার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করল। রূপহীন চিত্রাঙ্গদা অনুভব করলেন পুরুষের বিদ্যায় পারদর্শী হলেও সৌন্দর্য্যময়ী, ছলনাময়ী নারীরূপ ধারণ করতে সে ব্যর্থ। এরপর সে মদন দেবের কাছে একবছরের জন্য ‘পুষ্পলাবণ্যে’ ভরা রূপ প্রার্থনা করলে মদনদেব তার প্রার্থনা পূরণ করেন। এখান থেকে নাটকের ঘটনাবর্ত নতুন রূপ নেয়। অর্জুন লাবণ্যময়ী চিত্রাঙ্গদা কে দেখে অভিভূত হয় ও চিত্রাঙ্গদার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা অনুভব করে এই রূপ লাবণ্য তো আসলে ছলনা, অর্জুনের মুগ্ধতা তো সেই বীর চিত্রাঙ্গদার প্রতি নয়। তার এই দ্বন্দ্বমূলক অভিব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব সৃষ্টি। একদিকে চিত্রাঙ্গদা অর্জুন কে পাওয়ার জন্য রূপ পরিবর্তন করে অথচ তার বীরের সত্ত্বা এই ছলনাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তাই চিত্রাঙ্গদা মদনের বর ফিরিয়ে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে অর্জুনের কাছে প্রকৃত রূপ মেলে ধরল-
“আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’’
রবীন্দ্রনাথের চোখে চিত্রাঙ্গদা একজন বীর্যবতী তেজস্বিনী নারী যে নিজেকে দেবীতুল্য মনে করে না আবার সাধারণ রূপেও মনে করে না, যে নিজ সত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন। রবীন্দ্রনাথ হয়তো চিত্রাঙ্গদা চরিত্রের মাধ্যমে একথাই বলতে চেয়েছেন যে অন্যের কারণে নিজেকে পরিবর্তন করা আসলে মূর্খামি। নিজের সত্ত্বাকে, আত্মশক্তিকে জাগরণ করেও অপরকে প্রভাবিত করা যায়। চিত্রাঙ্গদার মধ্যে সাম্যের স্বীকৃতি পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ পায় যখন সে বলে-
“পূজা করি মোরে রাখিবে উর্দ্ধে/সে নহি নহি, /হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে/সঙ্কটে সম্পদে/সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে/সহায় হতে/পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে’’।
অর্জুন রাজেন্দ্রনন্দিনীকে পেয়ে বলে –“ধন্য ধন্য আমি’’।
‘চিত্রাঙ্গদা’ চরিত্রটি রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যের এক অসমান্য সৃষ্টি। শাপমোচনের সূত্র ধরেই বলা যায় এই চরিত্রটিও অন্তরের পরম ঐশ্বর্য্যকে লাভ করেছে। চিত্রাঙ্গদা এমন একজন নারী যিনি সমানাধিকার চেয়েছেন,কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসার সংগ্রামে নামতে প্রস্তুত,যাকে পূজা করবার প্রয়োজন নেই আবার অবহেলায় দূরে সরিয়ে রাখবার স্পর্ধাটুকু রাখতে নেই,যার সমতাটুকুই শুধু কাম্য। এমন আধুনিকমনষ্কতাই ‘চিত্রাঙ্গদা’ চরিত্রের সার্থকতা।
নৃত্যনাট্য ‘চন্ডালিকা’ ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ভাদ্রে রচিত ও অভিনীত হয়। গদ্যছন্দের গীতিযোজনায় এটি একটি দুঃসাহসিক রচনা। শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন- “চন্ডালিকার সময় ভারতবর্ষে মহাত্মাজীর হরিজন আন্দোলন খুব জোরে চলেছে-এই আন্দোলনের সমর্থনেই গুরুদেব চন্ডালিকা নাটক লিখেছিলেন”। নেপালের এক বৌদ্ধ আখ্যান অবলম্বনে ‘চন্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যের সৃষ্টি। এই নৃত্যনাট্যে জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধতা আছে ঠিকই কিন্তু তারও গভীরে রয়েছে মন ও প্রকৃতির দ্বন্দ্ব। এই নৃত্যনাট্যে মূল চরিত্র দুই নারী চন্ডালিকা অর্থাৎ প্রকৃতি ও মায়া অর্থাৎ প্রকৃতির মা। তাদের ঘাত-প্রতিঘাত, সংঘাত এই নৃত্যনাট্যকে গতিময় করেছে। প্রকৃতি চন্ডাল কন্যা, তাই বসন্তের উত্তসবে সে আমন্ত্রিত নয়। দইওয়ালা, চুড়িওয়ালা, ফুলওয়ালির কাছে জিনিসপত্র কেনা তার মানা, তাকে অন্য মেয়েরা সদা সর্বদাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে সে অস্পৃশ্য, ব্রাত্য। এইসময় বৌদ্ধ ভিক্ষু আনন্দ তার কাছে তৃষ্ণার জল চায়। প্রকৃতি জানায় সে চন্ডাল কন্যা। আনন্দ বলে-“যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা”। প্রকৃতি আনন্দের করুণায়, তার রূপে মোহিত হয়, তার সমস্ত অন্তর পুলকিত হয়ে ওঠে। আনন্দের আচরণে প্রকৃতি প্রথমবার মানুষরূপে সম্মান পেল, তাই আনন্দকে নিজের করে পেতে চাইল। এই নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে বাহ্যিক ঘটনাবিহীন ঘটনার সন্নিবেশ দেখি। প্রকৃতি ও তার মায়ের বারংবার ঘাতপ্রতিঘাতপূর্ণ মুহূর্ত রবীন্দ্রনাথ সফলভাবে তুলে ধরেছেন। এই সংঘাত আসলে দুই নারীর অন্তরের অভিব্যক্তি। প্রকৃতি তার মায়ের কাছে অনুরোধ করে মন্ত্রশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যেন আনন্দকে তার কাছে উপস্থিত করা হয়। এখানেই প্রকৃতি ও তার মায়ের মধ্যে সংঘাতপূর্ণ কথোপকথন আমরা দেখি। প্রকৃতির মা তাকে বারবার সাবধান করে –“তাঁকে যদি আনতে পারি মূল্য দিতে পারবি কি তুই তার। জীবনে কিছুই যে তোর থাকবে না বাকি”। প্রকৃতি তার উত্তরে বলে-“…আজ জেনেছি, আমি নই অভাগিনী, দেবই আমি, দেবই আমি, দেব, উজাড় করে দেব আমারে”। এতদিন সে জানত, তার দেওয়ার মত কিছু নেই। এখন সে বুঝেছে যে, সে রিক্ত নয়, তারও সত্ত্বা আছে। তাই যে মানুষটির জন্য তার এই অনুভূতি তাকে পাওয়ার জন্য ভুলপথে গিয়ে নিজেকে যদি নিঃশেষ করে ফেলতে হয়, তাও সে প্রস্তুত। কিন্তু মায়া একজন মা, এই নৃত্যনাট্যে সেই প্রকৃতির প্রধান অভিভাবক, কারণ এখানে প্রকৃতির পিতার কোনো ভূমিকার উল্লেখ পাওয়া যায় না। সন্তানের আকুল অনুরোধ সে ফেলতে পারল না। তার শিষ্যদের ডাকল ‘আকর্ষণমন্ত্র’-এ অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু মন্ত্রবলে যখন আনন্দ কঠিন টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়ে ওঠে, সেই ম্লান, কিষ্ট আনন্দকে দেখে প্রকৃতির রূপান্তর ঘটে। সে যেন এই মহামানবের পরাভব মেনে নিতে পারছে না। প্রকৃতি তার মাকে মন্ত্র ফিরিয়ে নিতে বলে। এখানেই নাটকের গতিময়তা শিখরে পৌঁছেছে। প্রকৃতি মোহের বশে আনন্দকে মন্ত্রবলে কাছে টেনে আনছিল- “বাঁধব তারে মায়াবাঁধনে/জড়াব আমারি হাসি-কাঁদনে”, কিন্তু যে মুহূর্তে বুঝল মোহের নাগপাশে জোরপূর্বক কারুর মনকে বাঁধা যায় না, সেই মুহূর্তে প্রকৃতি আনন্দের সংকট দূর করল। জয় হল প্রকৃতির মধ্যেকার সুপ্ত অন্তরসত্ত্বার, যে সত্ত্বা আত্মশক্তিতে বলীয়ান। প্রকৃতপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ হয়তো চাননি যে তাঁর সৃষ্ট কোনো নারী তার নিজ সত্ত্বার বিসর্জন দিক, জোরপূর্বক বা মোহের নাগপাশে আবদ্ধ করে কিংবা ছলনার আশ্রয় নিয়ে আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ করুক। ‘চিত্রাঙ্গদা’ তেও এই কবিদর্শনের একঝলক আমরা পাই, কিন্তু চন্ডালিকায় এই দর্শন অনেক গভীর ও সুষ্পষ্ট। আনন্দকে জল দান করে প্রকৃতির হয়েছে নতুন জন্ম। এক লহমায় তার মন থেকে জাতিবৈষম্যের দুঃখ ঘুচে গেছে-“ শ্রাবণের কালো যে মেঘ/তারে যদি নাম দাও চন্ডাল/তা বলে কি জাত ঘুচিবে তার,/অশুচি হবে কি তার জল”। কত বড় দর্শন কবি ‘চন্ডালিকা’ চরিত্রের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। আনন্দকে জীবনে পাওয়ার ইচ্ছা তার অমূলক নয়, তার কারণ, আনন্দের কাছ থেকে জীবনে প্রথমবার মানুষ হিসাবে পরিচয়প্রাপ্তি। প্রকৃতি ভুলপথে আনন্দকে পেতে চাইলেও তার এই চাওয়া যেন মানবীয় প্রেমের চাহিদায় প্রেমিককে চাওয়া নয়, এই চাওয়া একজন ভক্তের ঈশ্বরকে চাওয়া। তাই তো প্রকৃতির কন্ঠে আমরা শুনি- “মোর অন্ধকারের উর্দ্ধে রাখো/তব চরণ জ্যোতির্ময়”। এই পূর্ণ আত্মসমর্পণ তো তার জীবনের ঈশ্বরের প্রতি। প্রকৃতির চরিত্রে এও এক অন্যসত্ত্বা, তাই সে বলেছে- “জন্ম নিয়েছি ধূলিতে/দয়া করে দাও ভুলিতে,/নাই ধূলি মোর অন্তরে”। নাটকের শেষে যখন প্রকৃতি নিজের ভুল আনন্দের কাছে স্বীকার করে নেয়, সেখানেও দেখা যায় অন্য এক সমর্পণ-“ক্ষমা করো, ক্ষমা করো-/মাটিতে টেনেছি তোমারে, /এনেছি নীচে”। এই দুই সমর্পণের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে তা হল শেষের সমর্পণটি আত্মশক্তিতে ভরপুর। প্রকৃতি আনন্দকে অধিকারবোধ থেকে মুক্ত করেছে। এই ছেড়ে দিতে পারার মধ্যেই ‘চন্ডালিকা’ তথা ‘প্রকৃতি’ চরিত্রটির সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য হিসাবে ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। অভিনয়ের পূর্বে নাটকটির নাম ‘পরিশোধ’ থেকে পরিবর্তন করে ‘শ্যামা’ রাখা হয়। সাম্যের বাণী ও নৈতিক জয় ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘চন্ডালিকা’ –য় নারী চরিত্রের মধ্যে সুস্পষ্ট, ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যটি প্রচলিত নৈতিক কর্তব্যের কথা বলে না। বস্তুত, ‘শ্যামা’ চরিত্রটি বেশ জটিল নারী চরিত্র, যাকে সহজে বিচার করা যায় না। নৃত্যনাট্যের প্রথম দৃশ্যে দেখি, বিদেশী বণিক বজ্রসেন ইন্দ্রমণির হার সংগ্রহ করেছে, কিন্তু কোটালের চোখ পড়ায় সে কোটালের হাত থেকে পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায় অসাধারণ সুন্দরী শ্যামা রাজনর্তকী, তার প্রেমে পাগল বালক উত্তীয়। স্বভাবতই এই প্রেম অসম ও একতরফা। শ্যামা রাজগৃহে নৃত্যগীতে যোগদানের পূর্বে যখন সাজসজ্জায় রত, সেইসময় বজ্রসেন ছুটে আসে ও তার পেছনে কোটাল তাড়া করে আসে। বজ্রসেনের মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি দেখে শ্যামা মুগ্ধ হয় এবং ঘটনাসম্পর্কে অবগত হয়ে বজ্রসেনকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য এমন কোনো বীরকে আহ্বান করে যে নিজ প্রাণ বিনিময়ে বজ্রসেনকে উদ্ধার করতে পারে। তখন উত্তীয় শ্যামার জন্য নিজের জীবনদান করতে কুন্ঠিত হয় না- “ন্যায়-অন্যায় জানিনে,জানিনে,জানিনে-/শুধু তোমারে জানি,তোমারে জানি/ওগো সুন্দরী।
চাও কি প্রেমের চরম মূল্য-দেব আনি,/ওগো সুন্দরী”।।
উত্তীয়ের এই প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বজ্রসেন কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে ও শ্যামার সাথে বজ্রসেনের প্রেমের পথ সুগম হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন বজ্রসেন জানতে পারে তার মুক্তির বিনিময়ে এক নিরপরাধ বালকের প্রাণবিসর্জন হয়েছে সে শ্যামাকে ধিক্কার জানিয়ে এমনকি পদাঘাত করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। শ্যামা পরে আবারও ক্ষমা চাইলেও বজ্রসেন কিছুতেই তাকে ক্ষমা করতে পারে না।
‘শ্যামা’ চরিত্রটির মধ্যে অনেকগুলি দিক আছে। একদিকে দেখা যায় যে, সে বজ্রসেনের প্রতি প্রেমে এতটাই অন্ধ ও আসক্ত হয়ে পড়েছিল উত্তীয়ের প্রতি নিষ্ঠুর অন্যায় করতে তার অন্তর বিচলিত হয়নি, বজ্রসেনকে সে যে পথে পেয়েছে তা ক্ষমাহীন পাপ, এই পাপের কারণেই বজ্রসেন তাকে ত্যাগ করেছে। আবার অন্যদিকে দেখা যায়, কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর যখন বজ্রসেন শ্যামাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে- “মুক্তিরূপা অয়ি লক্ষ্মী দয়াময়ী,তার উত্তরে শ্যামা বলেছে- “বোলো না, বোলো না, বোলো না –আমি দয়াময়ী।
মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা, বোলো না”।
শ্যামার এই স্বীকারোক্তি ‘শ্যামা’ চরিত্রটিকে অন্যমাত্রা দিয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। শুধু তাই নয়, উত্তীয়ের প্রাণ বিসর্জনের ঘটনাটি বজ্রসেনের কাছে গোপন করার পরামর্শ দিয়েছিল সখীরা- ‘নীরবে থাকিস সখী, ও তুই নীরবে থাকিস’। সেখানে বজ্রসেন তার মুক্তির ঘটনা জানতে চাওয়ায় শ্যামার সত্যভাষণ আমাদেরকে বিস্মিত করে। শ্যামা চাইলে তার সখীদের পরামর্শমতো সত্যঘটনা গোপন করতে পারত কিংবা ছলনার আশ্রয় নিতে পারত, শ্যামা তা করেনি, আসন্ন পরিণামের কথা চিন্তা না করেই সে সত্য ঘটনা নিজ মুখে স্বীকার করে নিয়েছে এবং শ্যামার অনুনয়ে যে উত্তীয়ের প্রাণ বিসর্জন হয়েছে সে কথাও স্বীকার করেছে, অর্থাৎ, প্রকারান্তরে উত্তীয়ের আত্মবলিদানের সব দায় শ্যামা নিয়েছে। আরেকটি কথাও স্মরণ রাখতে হয়, উত্তীয়কে বিদায়কালে শ্যামা যে রাজ অঙ্গুরী দান করেছিল তা কোনো ষড়যন্ত্র রচনা করবার জন্য নয়, উত্তীয়ের প্রেমকে শেষ সম্মান জানানোর জন্য-
“রাজ অঙ্গুরী মম করিলাম দান/তোমারে দিলাম মোর শেষ সম্মান”।
সেক্ষেত্রে মনে হয় যে, শ্যামা কিছুটা পরিস্থিতির শিকার। সে বজ্রসেনকে মরতে দিতে চায়নি আবার উত্তীয়কেও হারাতে চায়নি, যার কারণে বিলম্বে হলেও উত্তীয়ের প্রাণভিক্ষা করেছিল প্রহরীর কাছে। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। উত্তীয়ের প্রাণবিসর্জনের দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে বজ্রসেনের কছে সে হয়েছে অপরাধী। বজ্রসেনের কাছে ক্ষমা ও করুণা ভিক্ষা করলেও কিছুতেই সে ক্ষমা করতে পারেনা। আবার ক্ষমা করতে না পারার যন্ত্রণায় বজ্রসেন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে-
“ক্ষমিতে পারিলাম না যে/ ক্ষম হে মম দীনতা/ পাপীজনশরণ প্রভু”।
তাই গভীরভাবে বিচার করার পর একথা বোধ হয় যে, বজ্রসেন যে শ্যামার পাপকে ক্ষমাহীন পাপের দৃষ্টান্ত বলে মনে করছে তা কিছুটা হলেও অতি কঠোরতা কি না !
পরিশেষে বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ নারী মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবকে কি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন যার ফলস্বরূপ ‘কমলিকা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘প্রকৃতি’, ‘মায়া’, ‘শ্যামা’ চরিত্রগুলি সফল ভাবে নির্মিত হয়েছে। প্রত্যেকটি চরিত্র স্বতন্ত্র, কিন্তু কোথাও তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য বন্ধন আছে। প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে কোথাও সচেতনমূলক আত্মসত্ত্বা রয়েছে যা কোনো কোনো চরিত্রে প্রকট আবার কোনো কোনো চরিত্রে গভীরভাবে প্রচ্ছন্ন। ছলনার আশ্রয়ে প্রেমকে পাওয়া নয়, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে প্রেমাষ্পদকে অর্জন নয়, বরং নিজসত্ত্বা রক্ষা করে ভালোবাসার জয় যেন প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে। কবি হয়তো চেয়েছেন যে, প্রেম আসুক কল্যাণের পথ ধরে, মঙ্গলের পথ ধরে, কলুষিত প্রেমকে তিনি কোনোভাবেই সমর্থন করেননি। এই শুভময় প্রেমের চিত্রই যেন প্রত্যেক নারী চরিত্রের মধ্যে রয়েছে। শুধু প্রেমই নয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নারী চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে সেই সমস্ত বিষয়গুলি আলোকপাত করেছেন, যা আধুনিক সমাজে আলোচিত। নারী-পুরুষের সমতা, নারীর স্বতন্ত্রতা, নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা, নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার অধিকার প্রত্যেকটি নারী চরিত্রে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, আধুনিকতায় মোড়া নারীদর্শনকে রবীন্দ্রনাথ এত বছর আগে কিভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন তাঁর নৃত্যনাট্যে। তাই একথা স্বীকার করতেই হয় যে, নারী চরিত্রায়ণ রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যের মূল্যবান সম্পদ এবং জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
গ্রন্থপঞ্জি ঃ
• কুন্ডু, প্রণয় কুমার, রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৬৫
• মৈত্র, শেফালী, রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যঃ একটি নারীবাদী পাঠ, এবং মুশায়েরা, কলকাতা, ২০১৯
• গুহ ঠাকুরতা, প্রবীর, রবীন্দ্রসঙ্গীত মহাকোষ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৮
• ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, শাপমোচন, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ,কলকাতা, ১৯০৫
• ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ,নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ,কলকাতা,১৯৩৬
• ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ,নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ,কলকাতা, ১৯৩৮
• ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ,নৃত্যনাট্য শ্যামা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ,কলকাতা, ১৯৩৯
লেখক পরিচিতি
অন্বেষা মুস্তাফী
ছাত্রী, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগ
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (দূরশিক্ষা বিভাগ)
কলকাতা