July 1, 2023

Exploring the Influence of Javanese-Balinese Art Forms on Santiniketan Dance Style

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Somrita Chakraborty

Abstract:

This abstract delves into the dynamic interplay between Javanese-Balinese art forms and the distinctive dance style of Santiniketan, India. Rooted in the cultural crosscurrents of the early 20th century, the Santiniketan dance style, spearheaded by the visionary Rabindranath Tagore, was not insulated from external influences. This paper investigates the multifaceted ways in which the rich traditions of Javanese and Balinese dance have permeated and contributed to the evolution of Santiniketan’s unique dance form.

The exploration begins by contextualizing the historical and cultural milieu during which this cross-cultural exchange took place. Tagore, the founder of Santiniketan, actively sought inspiration beyond national borders, fostering an environment conducive to the amalgamation of diverse artistic expressions. The Javanese-Balinese influence is examined through an analysis of key choreographic elements, including movements, gestures, costumes, and musical accompaniments.

Furthermore, the paper explores the philosophical underpinnings shared by Javanese-Balinese and Santiniketan dance forms, investigating how concepts such as spirituality, nature, and the celebration of life find resonance in both traditions. By examining specific dance compositions, collaborations, and the pedagogical approaches adopted in Santiniketan, this study aims to discern the nuanced ways in which the Javanese-Balinese influence has been integrated into the fabric of the Santiniketan dance style.

In conclusion, this abstract provides a glimpse into the rich tapestry of cultural exchange that has shaped the Santiniketan dance style, shedding light on the cross-pollination of artistic ideas between the Javanese-Balinese and Indian dance traditions. The findings contribute to a deeper understanding of the global interconnectedness of artistic practices and highlight the role of cultural exchange in fostering innovation and diversity in dance forms.

শান্তিনিকেতনের  নৃত্যধারায় জাভা-বালিদ্বীপের  শিল্পকলার  প্রভাব

সোমঋতা  চক্রবর্ত্তী

জাভা-বালিদ্বীপের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্ক বহু প্রাচীন। ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে প্রভূত মিল পাওয়া যায় জাভা-বালির শিল্প-সংস্কৃতির। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি ইন্দোনেশিয়ার মানুষদের মুগ্ধতার ফলে তাদের সংস্কৃতিতে ভারতীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যার প্রমান স্বরূপ বলা যায়, ভারতের দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত জাভা-বালির নৃত্য-গীতের প্রধান উপাদান। এই বিষয়ের সমর্থন রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও পাওয়া যায়, “ভারতবর্ষের বিদ্যা একদিন ভারতবর্ষের বাইরে গিয়েছিল। কিন্ত সেই বাইরের লোক তাকে স্বীকার করেছে। তিব্বত মঙ্গোলিয়া মালয়দীপ সকলে ভারতবর্ষ জ্ঞানধর্ম বিস্তার করেছিল, মানুষের সঙ্গে মানুষের আন্তরিক সত্যসম্বন্ধের পথ দিয়ে। ভারতবর্ষের সেই সর্বত্র প্রবেশের ইতিহাসের চিহ্ন দেখবার জন্য আজ আমরা তীর্থযাত্রা করেছি।“

১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইন্দোনেশিয়ার আমন্ত্রণে জাভা, বালি, সিয়াম, কুয়ালালামপুর পভৃতি স্থানে ভ্রমণ করেন। রবীন্দ্রনাথ সে দেশের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে নাচকে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করেন। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, মীরা দেবী, অমিয় চক্রবর্তী ও রানী মহলানবিশকে লেখা একুশটি পত্রের মধ্যে ছ’টি পত্রেই রয়েছে তাঁর সে দেশের নৃত্য দেখার অভিজ্ঞতার কথা। ‘জাভা যাত্রীর পত্র-র অন্তর্গত ১১ সংখ্যক পত্রটিতে রবীন্দ্রনাথ রথীন্দ্রনাথকে বালিদ্বীপের নাচের প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানিয়ে লিখেছেন-                                                                “এ দেশের উৎসবের প্রধান অঙ্গ নাচ। এখানকার নারকেল বন যেমন সমুদ্র হাওয়ায় দুলছে তেমনি এখানকার সমস্ত দেশের মেয়ে-পুরুষ নাচের হাওয়ায় আন্দোলিত।“                  

রবীন্দ্রনাথের মতে, সেই দেশের নাচ যেন তাদের ভাষা। নিত্য দিনের সকল কাজ কর্মের মধ্যেই অর্থাৎ চলা-ফেরা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভালোবাসার প্রকাশ, ভাঁড়ামি  সবেতেই নৃত্য বর্তমান। বালিদ্বীপের নাচ দেখে রবীন্দ্রনাথ যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিলেন তা তাঁর লেখনী দ্বারাই পরিস্ফুট। তিনি ওখানের নাচে লক্ষ্য করেছিলেন সমস্ত অভিব্যক্তি প্রকাশের পুরো বিষয়টাই নৃত্যছন্দে গাঁথা। সেই নাচের সমস্ত ভাব প্রকাশের মাধ্যম দেহভঙ্গির ভাষা, অর্থাৎ ছন্দের মাধ্যমে দেহের গতি-প্রকৃতির বিচিত্র ভঙ্গি সকল প্রকার ভাবকে প্রকাশ করে।  “সেদিন এখানকার  এক রাজবাড়িতে আমরা নাচ দেখছিলুম। খানিক বাদে শোনা গেল, এই নাচ-অভিনয়ের বিষয়টা হচ্ছে শাল্ব-সত্যবতীর আখ্যান। এর থেকে বোঝা যায়, কেবল ভাবের আবেগ নয়, ঘটনা বর্ণনাকেও এরা নাচের আকারে গড়ে তোলে। মানুষের সকল ঘটনারই বাহ্যরূপ চলাফেরায়। কোনো-একটা অসামান্য ঘটনাকে পরিদৃশ্যমান করতে চাইলে তার চলাফেরাকে ছন্দের সুষমাযোগে রূপের সম্পূর্ণতা দেওয়া সংগত। বাণীর দিকটাকে বাদ দিয়ে কিম্বা খাটো করে কেবলমাত্র গতিরূপটিকে ছন্দের উৎকর্ষ দেওয়া এখানকার নাচ। পৌরাণিক যে আখ্যায়িকা কাব্যে কেবলমাত্র কানে শোনার বিষয়, এরা সেইটেকেই কেবলমাত্র চোখে দেখার বিষয় করে নিয়েছে।“ রবীন্দ্রনাথের এই নৃত্য দেখার অভিজ্ঞতার ফলেই হয়তো কোনো কাহিনী বা নাটকের কোনো বিষয়বস্তুকে নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করার ভাবনা উদ্ভূত হয়েছিল বলে ধরা যেতে পারে।                                                

রবীন্দ্রনাথ সেই নৃত্যে যুদ্ধের দৃশ্যও নাচের মাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখেছেন,যদিও প্রকৃত রণক্ষেত্রের সঙ্গে সেই যুদ্ধনৃত্যের প্রভূত পার্থক্য রয়েছে, তথাপি  রবীন্দ্রনাথের সেটা অস্বাভাবিক বা অসঙ্গত মনে হয়নি, কারণ রবীন্দ্রনাথের কাছে বাস্তবতার অনুকরণের চেয়ে ছন্দবদ্ধ ভাবের প্রকাশের সত্যতা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-  “বাস্তবের সঙ্গে এই অনৈক্য নিয়ে যাদের মনে অশ্রদ্ধা বা কৌতুক জন্মায় শেক্সপিয়রের নাটক পড়েও তাদের হাসা উচিৎ কেননা, তাতে লড়তে লড়তেও ছন্দ, মরতে মরতেও ছন্দ।“

কাহিনী আশ্রিত নৃত্য ছাড়াও বিশুদ্ধ নৃত্য দেখারও অভিজ্ঞতা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। বিশুদ্ধ নৃত্য বলতে- যেখানে কোনো কাহিনী বা গল্পের ভাব প্রকাশের বিশেষ দায় থাকেনা, কোনো বাজনা বা গানের সঙ্গে নাচ, যার মধ্যে technical  বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়।  “বিশুদ্ধ নাচ ও আছে। পরশু রাত্রে সেটা গিয়ানয়ারের রাজবাড়িতে দেখা গেল। সুন্দর সাজ করা দুটি ছোটো মেয়ে- মাথার মুকুটের উপর ফুলের দণ্ড গুলি একটু নড়াতেই দুলে ওঠে।…..গামেলান বাজনার সঙ্গে ছোট মেয়ে দুটি নাচলে;  তার শ্রী অত্যন্ত মনোহর। অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে সমস্ত শরীরে ছন্দের যে আলোড়ন তার কী চারুতা, কী বৈচিত্র্য, কী সৌকুমার্য, কী সহজ লীলা। অন্য নাচে দেখা যায়, নটী তার দেহ কে চালনা করছে; এদের দেখে মনে হতে লাগল, দুটি দেহ যেন স্বত-উৎসারিত নাচের ফোয়ারা।“

রবীন্দ্রনাথ নৃত্যের এই রূপকেই অন্তরে ধারণ করেছিলেন। এই নৃত্যের সহজ-সরল অথচ বৈচিত্র্যময় ও সৌন্দর্যে ভরপুর যে রূপ রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, তা তাকে বিশেষভাবে মোহিত করে, যা পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র সাহিত্য ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে যে নব নৃত্যের আবির্ভাব ঘটেছে তার মধ্যে এই রূপ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। সেখানকার গামেলান বাদ্যযন্ত্রের বিস্তারিত বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ করেছেন,-  

“গামেলান বাদ্য যন্ত্রের সঙ্গে দুজনে মিলে নাচতে লাগল।  এই বাদ্য সংগীত আমাদের সঙ্গে ঠিক মেলে না। আমাদের দেশের জলতরঙ্গ বাজনা আমার কাছে সংগীতের ছেলেখেলা বলে ঠেকে। কিন্তু, সেই জিনিসটিকে গম্ভীর, প্রশস্ত, সুনিপুণ বহু যন্ত্রমিশ্রিত বিচিত্র আকারে এদের বাদ্যসংগীতে যেন পাওয়া যায়। রাগ রাগিণীতে আমাদের সঙ্গে কিছুই মেলে না; যে অংশে মেলে সে হচ্ছে এদের মৃদঙ্গের ধ্বনি,সঙ্গে করতালও আছে। ছোটো বড়ো ঘণ্টা এদের সংগীতের প্রধান অংশ। আমাদের দেশের  নাট্যশালায় কন্সার্ট বাজনার যে নূতন রীতি হয়েছে এ সেরকম নয়; অথচ য়ুরোপীয় সংগীতে বহুযন্ত্রের যে হার্মনি এ তাও নয়। ঘণ্টার মতো শব্দে একটা মূল স্বরসমাবেশ কানে আসছে; তার সঙ্গে নানাপ্রকার যন্ত্রের আওয়াজ যেন একটা কারুশিল্পে গাঁথা হয়ে উঠছে।“

রবীন্দ্রনাথ ওখানের সংগীত সম্বন্ধে আরো লিখছেন, “এদের নাচ যেমন সুন্দর সজ্জিত অঙ্গের নাচ, এদের সংগীতে যে ছন্দের নাচ সেও খোল করতাল মৃদঙ্গের কোলাহল নয়- সুশ্রাব্য সুর দিয়ে সেই নাচ মণ্ডিত। এদের সংগীতকে বলা যেতে পারে স্বরনৃত্য, এদের অভিনয়কে বলা যায় রূপনাট্য।“

এই বর্ণনা থেকে এটা বোঝা যায় নৃত্যের সাথে সাথে বালিদ্বীপের সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রও রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট পছন্দ হয়েছিল। শান্তিনিকেতনের নৃত্য-গীতেও খুব বেশি বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না, জাভা-বালির নৃত্য-গীত-বাদ্যের সমন্বয়ের যে প্রকাশ- তার প্রতি মুগদ্ধতার ফলেই তাকে অনুসরণ করেই হয়তো শান্তিনিকেতনের নৃত্য-গীতে বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ খুব পরিমিত। যুগের সাথে প্রয়োজনানুসারে পরবর্তীতে কিছু বাদ্যযন্ত্রের সংযোজন ঘটেছে কিন্তু তাও যন্ত্রসংগীতের আধিক্য নৃত্য-গীতকে যাতে ছাপিয়ে না যায় সেই দিকে লক্ষ্য রাখা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় গামেলান সংগীতশিল্পীরা একসঙ্গে নৃত্যশিল্পীদের সাথেই মঞ্চে উপবেশন করেন, এই বিষয়টি রবিন্দ্রনাথকে ভীষণ ভাবেই  আকর্ষিত করেছিল। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের মঞ্চপরিকল্পনাতেও সেই ধারা লক্ষ্য করা যায়, যেখানে নৃত্যশিল্পী , সংগীত শিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী সকলে একই মঞ্চে একসাথে উপস্থিত থেকে একটি প্রযোজনাকে সমগ্রভাবে নান্দনিক রূপে পরিবেশন করে  থাকেন।  

“কাল রাত্রে যে নাচ হল সে ন’জন মেয়েতে মিলে। তাতে যেমন নৈপুণ্য তেমনি সৌন্দর্য, কিন্তু দেখে মনে হল, কাল রাত্রের সেই নাচে স্বত-উচ্ছ্বসিত প্রাণের উৎসাহ ছিল না; যেন এরা ক্লান্ত, কেবল অভ্যাসের জোরে নেচে যাচ্ছে। কালকের নাচে গুণপনা যথেষ্ট ছিল কিন্তু তেমন ক’রে মনকে স্পর্শ করতে পারেনি।“ 

উপরিউক্ত রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য থেকে নৃত্য বিষয়ে তাঁর ভাবধারা সম্পর্কে  অবগত হওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে তাঁর গানের সাথে নৃত্য করার সময় গানের কথা বা ভাব যাতে যথাযথ রূপে প্রকাশ পায় সেই দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার কথা বলেছেন। শান্তিনিকেতনের নাচের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সবসময় Technique-এর থেকে ভাবকে প্রাধান্য দিয়েছেন, অতিরিক্ত কলা-কৌশল শান্তিনিকেতনের নৃত্যশৈলীতে বিশেষ প্রদর্শিত হতো না। তাই সেই সময়কার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-সাহিত্য ও গান নির্ভর নৃত্যকে ভাবনৃত্য বলেই সম্বোধন করা হতো, সেই ভাবনৃত্যের মধ্য দিয়ে দর্শকের মনেও সেই নৃত্য ভাবনার রেশ দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হতো। বর্তমানে সেই নৃত্য ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ নামে পরিচিত, কিন্তু নামের  পরিবর্তন হলেও নৃত্যের ভাব-ধারা যথা সম্ভব রক্ষা করার চেষ্টা হয়ে থাকে।     

জাভা-বালিতে অনেকরকম নৃত্যশৈলী দেখে রবীন্দ্রনাথ সেই নৃত্যশৈলীর প্রতি বিশেষভাবে অনুরোক্ত হন, কারণ সেখানের নৃত্য চোখ-মনকে শান্তি দেয়, আরাম দেয়। য়ুরোপের নৃত্য কিছু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কাছে ঝম্পবহুল লেগেছে , তার সাথে তুলনা করে বালির নৃত্য দেখে সেই নৃত্য ঝরনার স্নিগ্ধ ধারার মতো মনে হয়েছে তাঁর। তাই শান্তিনিকেতনের নৃত্যেও তালের থেকে ভাবকে প্রাধান্য দিয়ে নৃত্যে সেই স্নিগ্ধতার পরশকেই রাখতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।  

“আসলে এরা গান গায় গলা দিয়ে নয় সর্বাঙ্গ দিয়ে; এদের নাচই যেন পদে পদে  টানা সুরের মিড় দেওয়া- বিলিতি নাচের মতো ঝম্পবহুল নয়। অর্থাৎ এদের নাচ বর্ষার ঝমাঝম  জলবিন্দুবৃষ্টির মতো নয়, ঝরনার তরঙ্গিত ধারার মতো। তাল যে ঐক্যকে দেখায় সে হচ্ছে কালের অংশগুলিকে যোজনা ক’রে, গান যে ঐক্যকে দেখায় সে হচ্ছে রসের অখণ্ডতাকে সম্পূর্ণ করে। তাই বলছি, এদের সংগীতই তাল, এদের নৃত্যই গান। আমাদের দেশে এবং য়ুরোপে গীতাভিনয় আছে,এদের দেশে নৃত্যাভিনয়।“  এই নৃত্যাভিনয় দেখেই হয়তো রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য থেকে নৃত্যনাট্যে উত্তরণ।       

জাপানের নৃত্য, মণিপুরী নৃত্য, জাভা-বালিদ্বীপের নৃত্য প্রভৃতি দেখেই নৃত্যের মধ্যে যে এক উচ্চমানের শিল্পরূপ বর্তমান তা রবীন্দ্রনাথ উপলবদ্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর প্রাণপ্রিয় শান্তিনিকেতন আশ্রমে নৃত্য চর্চা শুরু করিয়েছিলেন ও পরবর্তীতে আর পাঁচটা বিষয়ের মতো নৃত্যকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন ও দেশ-বিদেশে বিভিন্ন নৃত্য পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে নৃত্যকে আরো বেশি পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা করেছেন  জীবনের শেষ কাল অবধি।জাপান, ইন্দোনেশিয়া (জাভা-বালি) প্রভৃতি দেশের নাচ দেখে সেই তুলনায়  আমাদের দেশের বাঈনাচ রবীন্দ্রনাথের কাছে কেবল মাত্র পদার্থ হিসাবেই পরিগণিত হয়েছে। বাঈনাচের ক্ষেত্রে ভ্রু ও চোখের নানা রকম ভাব-ভঙ্গি রবীন্দ্রনাথের কাছে কুরুচির পরিচয় বাহক এবং তাদের আঁটো-সাটো ও জমকালো পোশাক তাঁর কাছে ভীষণ অশালীন ছিল এবং একেবারেই তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি রবীন্দ্রনাথের মনে। অপরদিকে জাভার নৃত্যের পোশাক রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবেই মুগ্ধ করেছিল। প্রতিমা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন-  “নাচের তালে দুটি অল্প বয়সের মেয়ে এসে মেজের উপর পাশাপাশি বসল। বড়ো সুন্দর ছবি। সাজে সজ্জায় চমৎকার সুছন্দ।  সোনায়-খচিত মুকুট মাথায়, গলায় সোনার হারে অর্ধচন্দ্রাকার হাঁসুলি, মণিবন্ধে সোনার সর্পকুণ্ডলী বালা, বাহুতে একরকম সোনার বাজুবন্দ- তাকে এরা বলে কীলকবাহু। কাঁধ ও দুই বাহু অনাবৃত, বুক থেকে কোমর পর্যন্ত সোনায়-সবুজে মেলানো আঁট কাঁচুলি, কোমরবন্দ থেকে দুই ধারার বস্ত্রাঞ্চল কোঁচার মতো সামনে দুলছে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত শাড়ির মতোই বস্ত্রবেষ্টনী, সুন্দর বর্তিকশিল্পে বিচিত্র; দেখবা মাত্রই মনে হয়- অজন্তার ছবিটি। এমনতরো বাহুল্যবর্জিত সুপরিচ্ছন্নতার সামঞ্জস্য আমি কখনও দেখি নি।“১০                                                        

জাভা দেশের এই নৃত্যের পোশাকের প্রভাব শান্তিনিকেতনের পূর্বের ভাবনৃত্য বা বর্তমানে রবীন্দ্রনৃত্য-এর উপর বিশেষভাবেই পড়েছে তা একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা সম্ভব। ভারতীয় আদর্শকে মাথায় রেখেই সম্পূর্ণ রূপে অনুকরণ নয়, তবে    অনুসৃত হয়েছে তা বলা বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন জাভার মেয়েরা নাচের সময় বক্ষ থেকে কোমর অবধি একটি কাঁচুলি ব্যবহার করে বক্ষ আবরণী   হিসাবে, শান্তিনিকেতনে নাচের ক্ষেত্রে শাড়ি পড়ার ধরণ অনেকটাই সেই রকম; আঁচলটাকে বুকের মধ্যে দিয়ে আঁট (Tight) করে ঘুরিয়ে এনে ডান দিকের কোমরে গিঁট দিয়ে পড়া হয়। আরো অন্যভাবেও শাড়ি পড়ার চল আছে শান্তিনিকেতনে , তবে এই ধরণটাই সর্বাধিক প্রচলিত। তবে জাভার মেয়েদের দুই কাঁধ যেখানে অনাবৃত থাকে, সেখানে ভারতীয় আদর্শকে রক্ষা করে শান্তিনিকেতনের নৃত্যের পোশাকে মেয়েরা ব্লাউজের ব্যবহার করে। জাভার মেয়েদের কোমর থেকে এক প্রকার বস্ত্রাঞ্চল ঝোলার কথাও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সেই ভাবে শান্তিনিকেতনে কোমরে ও দুই কাঁধে কাপড়ের ফেট্টি ও বাটিকের উত্তরীয় ব্যবহার শান্তিনিকেতনের নৃ্ত্যে পোশাকের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন  বিষয়ের প্রতি মুগ্ধ হয়েছেন, আকর্ষিত হয়েছেন, তবে কখনোই কোনো কিছুকে সম্পূর্ণভাবে অনুকরণ করেন নি, নিজের নান্দনিক ও সৃষ্টিশীল মনের সাথে সম্পৃক্ত হবে এমন কিছু সুন্দর জিনিসকে প্রয়োজন মতো অনুসরণ করেছেন।   

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুন্দরের পূজারী, সব কিছুর মধ্যে সুন্দরটাকে খুঁজে বের করে  আনতে চেষ্টা করতেন।  “কাল রাত্রে আমাদের এখানেও একটা নাচ হয়ে গেল। পূর্ব রাত্রে যে দুজন বালিকা নেচেছিল তাদের মধ্যে একজন আজ পুরুষ-সঙের মুখোষ পরে  সঙের নাচ নাচলে। আশ্চর্য ব্যাপারটা হচ্ছে, এর মধ্যে নাচের শ্রী সম্পূর্ণ রক্ষা করেও ভাবে-ভঙ্গীতে গলার আওয়াজে পুরো মাত্রায় বিদূষীকতা করে গেল। পুরুষের মুখোশের সঙ্গে তার অভিনয়ের কিছু মাত্র অসামাঞ্জস্য হল না। বেশভূষার সৌন্দর্যেও একটুমাত্র ব্যত্যয় হয় নি। নাচের শোভনতাকে বিকৃত না করেও যে তার মধ্যে ব্যঙ্গবিদ্রুপের রস এমন করে আনা যেতে পারে, এ আমার কাছে আশ্চর্যের ঠেকল। এরা প্রধানত নাচের ভিতর দিয়েই সমস্ত হৃদয়ভাব ব্যক্ত করতে চায়, সুতরাং বিদ্রুপের মধ্যেও এরা ছন্দ রাখতে বাধ্য। এরা বিদ্রুপকেও বিরূপ করতে পারেনা; এদের রাক্ষসেরাও  নাচে।“১১

সেখানের নাচ দেখেই রবীন্দ্রনাথের মনেও সেই বিষয়টা স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয় যে, কাহিনীর মধ্যে চরিত্র যাই হোক না কেন নাচের শোভনতা বা শ্রী যেন বজায় থাকে। সেই ভাবেই শান্তিনিকেতনের নৃত্যে বা নৃত্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে নাচের আঙ্গিক, অভিনয়, ও সাজ-সজ্জার মধ্যে অতিরঞ্জিত বিষয়কে বর্জন করে  শোভনতা , শালীনতার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন য়ুরোপীয় নৃত্য(কিছু ক্ষেত্রে) ও দেশীয় বাঈনাচের  মধ্যে কামনা বাসনার ইঙ্গিত বর্তমান, যা রবীন্দ্রনাথের কাছে অশালীন ঠেকেছে এবং যা শিল্পের উত্তরণের ক্ষেত্রে বাঁধা, এটিও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এবং  তাঁর সেই উলব্ধির অনেকাংশই জাভা-বালি দ্বীপের নৃত্য প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতার ফলেই তা বলা অত্যুক্তি নয়। শান্তিনিকেতনের নৃত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়গুলি বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নৃত্য প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতা ও তাঁর নিজস্ব ভাবনার দরুণ নৃত্য নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও চর্চার ফলে শান্তিনিকেতনে যে নব নৃত্যশৈলীর সূচনা হয় এবং যেই নৃত্যধারা অব্যাহত তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়- শান্তিনিকেতনের নৃত্যের আঙ্গিক ও আহার্যের দিক বিশ্লেষণ করলে তাতে কোনোরূপ কামনা-বাসনার ঈঙ্গিত পাওয়া যায় না,তা সম্পূর্ণভাবে শিল্প-সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ।   

তথ্যসূত্র

 ১) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৬

২) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৬৩

৩) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৬৪

৪) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৬৫

৫) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৬৬

৬) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৬৬

৭) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-১০৬

৮) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৮৯

৯) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৭০

১০) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৮৬

১১) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯২, ’জাভা-যাত্রীর পত্র’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ-৮৯

সহায়ক গ্রন্থঃ-

১) ঘোষ, শান্তিদেব, ১৪১৩, ‘জীবনের ধ্রুবতারা’, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স

২)সম্পাদনা- বন্দোপাধ্যায় ,শ্রুতি, ২০২৩, ‘নৃত্য ও সংগীতকলায় রবীন্দ্রনাথ’, কলকাতা, কারিগর

৩) Banerjee, Utpal K, 2011, ‘Tagore’s Mystique of Dance’ , Delhi, Niyogi books

৪) Bandopadhay, Sruti, 2019, ‘RABINDRANRITYA: The dance idiom created by Tagore, Haryana, Shubhi Publications