এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহাসমারোহে -শুভাশিস চৌধুরী
নাটক
রক্ত করবী অবলম্বনে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “রক্তকরবী”নাটকে মোহ আভরণে ঢাকা রয়েছে মূল প্রেমিক চরিত্র রঞ্জন।যাকে ভালোবেসে প্রাণ দিতে প্রস্তুত নন্দিনী।আর এই নন্দিনীকে পেতে আকুল যক্ষপুরের রাজা। যেই রঞ্জনকে আমরা মঞ্চে দেখতে পাই না,শুধু তার দু একটি সংলাপ শুনি,তা ও অন্য চরিত্রের মুখে,সেই চরিত্রই রাজার সামনে কাল্পনিক ভাবে উপস্থিত হলে কী বলতে পারে তাই নিয়েই এই ভাবনা-
“এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহাসমারোহে”
রঞ্জন:- সকল গর্ব দূর করি দিব,তোমার গর্ব ছাড়িব না।(গান গাইতে গাইতে চলে)
রাজা- ও কে যায়! রঞ্জন না!না না এ হতে পারে না।আমার সমস্ত অহংকার গর্ব আকাঙ্খা এই সামান্য একটা লোকের কাছে হেরে যেতে পারে না।কিছুতেই না।কে?কে যাও এই পথ বেয়ে।
রঞ্জন?
রঞ্জন-হ্যাঁ গো ঠিক ধরেছো।আমি সেই রঞ্জন।ঈশানী পাড়ার সেই মেয়েটি! যাকে পেতে তুমি আকুল! আমি তার পরম ধন।
রাজা-রঞ্জন!তুমি জানো ?আমি নন্দিনকে –
রঞ্জন-জানি, জানি, তুমি ওকে পেতে পাগল।ওর জন্য তুমি ফাঁদ পেতেছো এই যক্ষ ভুবন জুড়ে।
রাজা-সব জান?সব জেনেও তুমি ঐ মরনপথ ধরে হেঁটে চলেছো?তুমি জানো না এর শেষ কোথায়?
রঞ্জন-জানি তো।মরন রে তুহু মম শ্যাম সমান–
রাজা-আবার হেঁয়ালি?জানো তোমার নন্দিনকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার কথা!তোমাকে সে কীরকম ভালোবাসে ।
রঞ্জন-জানি!
রাজা -সে ও জানো?আশ্চর্য!বলো শুনি!তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই
রঞ্জন-আমার নন্দিন তোমাকে বলেছিল,’জলের ভিতরকার হাল যেমন আকাশের উপরকার পালকে ভালোবাসে-পালে লাগে বাতাসের গান,আর হালে জাগে ঢেউয়ের নাচ’
তুমি যখন মস্ত একটা লোভী ছেলের মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে চুপ করে শুনলে।হঠাৎ চমকিয়ে দিয়ে বলেছিলে
রাজা-ওর জন্য প্রাণ দিতে পার?
রঞ্জন-তখন ও বলেছিল ‘হ্যাঁ পারি।’তাতে তোমার লাভ কী?তখন তুমি কী বলেছিলে মনে পড়ে?
রাজা-জানি নে।যাও আমার ঘর থেকে যাও,যাও কাজ নষ্ট কোরো না। আচ্ছা এই যক্ষপু্রের সর্দারকেও তোমার ভয় করে না?
রঞ্জন-আমার নন্দিনীর কথায় বলি,ওর মতো মরা জিনিস আমি দেখি নি।যেন বেতবন থেকে কেটে আনা বেত।পাতা নেই,শিকড় নেই,মজ্জায় রস নেই,শুকিয়ে লিকলিক করছে।(হাসতে হাসতে)
রাজা-তুমি কি জান?বিধাতা তোমার নন্দিনীকে রূপের মায়ার আড়ালে অপরূপ করে রেখেছেন?তার মধ্যে থেকে ছিনিয়ে এনে তাকে আমি মুঠোর ভিতর পেতে চাচ্ছি,কিছুতেই ধরতে পারছি নে।আমি তাকে উলটিয়ে পালটিয়ে দেখতে চাই,না পারি তো ভেঙেচুরে ফেলতে চাই।
রঞ্জন- সেও জানি।
রাজা-সব চেয়ে ভয়ানক তার মাথায় ঐ রক্তকরবীর আভাটুকু।
রঞ্জন-জানি ও তোমার জন্য নয়।
রাজা-আচ্ছা রঞ্জন!নন্দিনীর ঐ রক্তকরবীর আভাটুকু ছেঁকে নিয়ে আমার চোখে অঞ্জন করে পরতে পারি নে কেন?সামান্য পাপড়ি-কটা আঁচল চাপা দিয়ে বাধা দিয়েছে।
রঞ্জন-রাজা!তোমাকে দেখে তো ওর মন নাচে না।যে তাল সে অনুভব করে আমাকে দেখে।সে নাচের তাল আলাদা ,সে তুমি বুঝবে না,নন্দিন বলে নি?
রাজা- তুমি বল।আমি বুঝতে চাই।আমি জানি,আমার সঙ্গে তোমার তফাতটুকু এই,আমার মধ্যে কেবল জোড়ই আছে,তোমার মধ্যে আছে জাদু।
রঞ্জন-(হাসতে হাসতে)আমার নন্দিন তোমাকে এইসব বলেছে? কী সেই জাদু?
রাজা-পৃথিবীর নীচের তলায় পিন্ড পিন্ড পাথর লোহা সোনা,সেইখানেই রয়েছে জোরের মূর্তি।উপরের তলায় একটুখানি কাঁচা মাটিতে ঘাস উঠছে,ফুল ফুটছে- সেইখানে রয়েছে জাদুর খেলা।দুর্গমের থেকে হীরে আনি,মানিক আনি;সহজের থেকে জাদুটুকু কেড়ে আনতে পারি নে।
রঞ্জন-তোমার এই কথার উত্তর তো নন্দিন দিয়েছিল। ও তো তোমার কাছ থেকে ঐ রকম লোভীর মতো কথা শুনতে চায় নি। তুমি আমাকে বাঁধতে চাইলে কেন?
রাজা-রঞ্জন তোমার মতো যৌবন থাকলে ওকে আমি ছাড়া রেখেই বাঁধতে পারতুম।হায় রে!সব বাঁধা পড়ে কেবল আনন্দ বাঁধা পড়ে না।
রঞ্জন-আচ্ছা রাজা!তুমি ওর মধ্যে কী এমন দেখলে?
রাজা-ওর মধ্যে! বিশ্বের বাঁশিতে নাচের যে ছন্দ বাজে সেই ছন্দ।সেই ছন্দে গ্রহ নক্ষত্রের দল ভিখারি নটবালকের মতো আকাশে আকাশে নেচে বেড়াচ্ছে।সেই নাচের ছন্দেই নন্দিনী এমন সহজ হয়েছে,এমন সুন্দর।আমার তুলনায় সে কতটুকু,তবু তাকে আমি ঈর্ষা করি।
রঞ্জন-তবে তুমি সহজ হয়ে ওর কাছে ধরা দাও না কেন?
রাজা-নিজেকে গুপ্ত রেখে বিশ্বের বড়ো বড়ো মালখানার মোটা মোটা জিনিস চুরি করতে বসেছি।কিন্তু যে দান বিধাতার হাতের মুঠির মধ্যে ঢাকা সেখানে নন্দিনীর চাঁপার কলির মতো আঙুলটি যতটুকু পৌঁছয়,আমার সমস্ত দেহের জোর তার কাছ দিয়ে যায় না। বিধাতার সেই বদ্ধ মুঠো আমাকে খুলতেই হবে।
রঞ্জন-তোমার কী মনে হয় নন্দিন তোমার কাছে ধরা দেবে?
রাজা-আমার অনবকাশের উজান ঠেলে তাকে আমি ঘরে আনতে চাই নে।যে দিন পালের হাওয়ায় সে অনায়াসে আসবে সেইদিন আগমনীর লগ্ন লাগবে।সে হাওয়া যদি ঝড়ের হাওয়া হয় সেও ভালো।এখনও সময় হয় নি।
রঞ্জন-সেই পালের হাওয়া নিয়ে যাবো আমি,এই বিশ্বাস রাখে আমার নন্দিন।ও বিশ্বাস করে আমি যেখানে যাই,ছুটি সঙ্গে নিয়ে যাই। আরও বলি,সেই ছুটিতে রক্তকরবীর মধু দিয়ে ভরে রাখতে পারি শুধু আমি,কেবল আমি।সে যে আমার মধ্যেই সুন্দরকে খুঁজে পেয়েছে।
রাজা-সুন্দরের জবাব সুন্দরই পায়,আর অসুন্দর জবাব ছিনিয়ে নিতে চায়,বীণার তার বাজে না,ছিঁড়ে যায়।এই জন্যেই তোমাকে আমি- ।আমি হয় পাব,নয় নষ্ট করব।যাকে পাই নে তাকে দয়া করতে পারি নে।তাকে ভেঙে ফেলাও একরকম করে পাওয়া।
রঞ্জন-আমার নন্দিন তোমাকে বলেছিল,যে জিনিসটাকে মন দিয়ে জানা যায় না,প্রাণ দিয়ে বোঝা যায়,তার’পরে তোমার দরদ নেই।
রাজা-আমি তার কাছ থেকে তার অলকের ঐ যে রক্তকরবীর গুচ্ছ তার গাল বেয়ে নেমে পড়েছে তা আমি চেয়েছিলাম।কিন্তু দেয় নি।
রঞ্জন-কী করে দেবে?ও তো আমাকেই ভালোবেসে ঐ ফুল ওর কানে দুল করে পরেছে।
রাজা-ঐ ফুলের গুচ্ছ দেখি আর মনে হয়,ঐ যেন আমারই রক্ত-আলোর শনিগ্রহ ফুলের রূপ ধরে এসেছে।কখনো ইচ্ছে করেছে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলি,আবার ভেবেছি নন্দিনী যদি কোনো দিন নিজের হাতে ঐ মঞ্জরি আমার মাথায় পরিয়ে দেয়-
রঞ্জন-তাই ভেবেছো,আমাকে বাঁধতে পারলে তুমি তাকে পাবে?তোমার সর্দারকে তো আমিই বলেই দিয়েছি,হুকুম মেনে কাজ করা আমার অভ্যেস নেই!গাম্ভীর্য নির্বোধের মুখোশ,আমি তাই খসাতে এসেছি।রাজা!ভেবেছিলে,তোমার খোদাইকরদের চাপে আমি বশ মানব।হলো উল্টো।শুরু হলো খোদাই নৃত্য। সে নাচে জুড়ে গেল সবাই।বলেছিল কোদাল ধরতে,ধরলাম কোদাল।তা দিয়েই তাল তুললাম।সেই তালে কাজের রশি খুলে দিয়েছি,তাকে টেনে চালাতে হবে না,নেচে চলবে।পরে ওরাই হাতে তুলে দিল একটা ভাঙা সারেঙ্গি।এই নিয়েই তো চলেছি।আমার নন্দিন এর সাথে আজ দেখা হবে যে!
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
রাজা-তুমি কোন রঞ্জন?তুমি কেন সেদিন তোমার নাম বললে না?নন্দিনী!ঠকিয়েছে ।ওরা আমাকে ঠকিয়েছে।সর্বনাশ!নন্দিনী!আমি যমের কাছে জাদু শিখেছি,জাগাতে পারি নে।জাগরণ ঘুচিয়ে দিতেই পারি শুধু(বিমর্ষ)আচ্ছা তুমি কেন সেদিন এমন করে নন্দিনীর নাম বললে?সে আমি সইতে পারি নি।হঠাৎ আমার নাড়ীতে নাড়ীতে যেন আগুন জ্বলে উঠল।হায়!আমি যৌবনকে মেরেছি-এতদিন ধরে আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে কেবল যৌবনকে মেরেছি।মরা যৌবনের অভিশাপ আমাকে লেগেছে।
রঞ্জন-এই দেখো!আমার চুড়ায় নন্দিনের দেওয়া সেই নীলকন্ঠ পাখির পালক,আর হাতে দেখ রক্তকরবীর মঞ্জরি। আমিও তোমাকে এই অচলায়তন থেকে নিয়ে যেতেই আবার ফিরে এলাম।
রাজা-রঞ্জন!তবে তাই হোক আমাকেও নিয়ে চলো তোমার সাথে, নন্দিনীও আমাকে ডেকে বলেছে,এই অন্ধকার অচলায়তন থেকে বেড়িয়ে আসতে আমি তোমাদের দোঁহের ডাকে সাড়া দিতে চাই। নিয়ে চলো রঞ্জন।
রঞ্জন-এসো।
“তোমায় গান শোনাবো—
@শুভাশিস চৌধুরী২/৬/২৪