May 1, 2025

একক মণিপুরী নৃত্যের বিবর্তন ও সমসাময়িক অবস্থান – ড.রিঙ্কি মাহাতো

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

 

সংক্ষিপ্তসার (Abstract)
এই নৃত্য বিষয় আলোচনা করার কারন হেতু বলা যেতে পারে পূর্বে মণিপুরী নৃত্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে একক নৃত্য দেখতে পেয়েছি। এই সকল নৃত্যই মূলত দলগত ভাবে করা হয়। কিন্তু পরবর্তী কালে যখন গুরুরা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী মন্দির প্রাঙ্গণে হওয়া নৃত্যগুলি সম্পর্কে বাইরের জগতে বহিঃপ্রকাশ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে গুরুরা এই সকল নৃত্য থেকে কিছু কিছু অঙ্গ ভঙ্গী, হস্ত সঞ্চালন, অঙ্গ সঞ্চালন আলাদা করে, বা কোন নৃত্য থেকে গল্প নিয়ে সেটিকে নৃত্য নাট্যে রূপ দিয়ে বহির্জগতে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। প্রথমেই বলা হয়েছে মণিপুরীরা যে কোন অনুষ্ঠান দেবতার উদ্দেশ্যেই করে থাকেন, তাই দেবতাকে রুষ্ট করে কোন কার্য তারা করেন না। মণিপুরী নৃত্য বহির্জগতে প্রকাশ্যে আনার জন্য গুরুজী রাসকে ছোট করে পরিবেশন করেছেন, কিন্তু কোন ভাবেই এর অন্তর্নিহিত ভাবকে ক্ষুণ্ণ করেননি, সেটি পরম্পরাগত ভাবে বজায় রেখেই করা হয়েছিল। বিবর্তন হওয়া অপরিহার্য। তাই কাল-ক্রমের সাথে সাথে গুরুরা মণিপুরী একক নৃত্যের বিবর্তনের দিকেও নজর দিয়েছেন, আর সেই কর্মে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মাইস্নাম গুরু অমুবী সিংহের কাছে থেকে। তিনি মণিপুরী নৃত্যে এক অমূল্য রতন।মণিপুরী নৃত্য দলগত প্রাধান নৃত্য হলেও একক নৃত্য সমান ভাবে প্রয়োজন। কিন্তু সময় এর সাথে সাথে একক নৃত্য কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে এর কারন হেতু এই গবেষণা কর্ম। এই গবেষণার ফলে একক নৃত্যের ক্ষেত্রে মার্গ নিদর্শন হবে বলে আশা করা যায়।

ভূমিকা
ভারতীয় নৃত্য বিবর্তনের ইতিহাস অতি প্রাচীণ। নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় নৃত্য নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে বর্তমানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। পৃথিবীর সর্ব প্রকার জীবের মধ্যে একমাত্র মানুষই কপ্লনা শক্তির অধিকারী। মানুষের এই সহজাত কল্পনাকে মানুষ প্রকাশ করতে চায়। এই প্রকাশের কয়েকটি মাধ্যম আছে। যেমন-কণ্ঠস্বর দ্বারা মানুষ ভাষা তৈরী করে মনের ভাব প্রকাশ করে। সুরেলা কৃত্রিম ধ্বনি দিয়ে গান গেয়ে আবেগ প্রকাশ করে। দেহের অঙ্গভঙ্গী দিয়েও মানুষ তার আবেগ ভাবনা প্রভৃতি ব্যক্ত করে যা ধীরে ধীরে নৃত্ত-নৃত্য-নাট্য রূপে বিকশিত হয়।
ঐতিহাসিক সূত্রে, অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে, মণিপুরের কোন প্রমাণ তথ্য না থাকলেও, ১৫৪ সালে একটি প্রাচীণ তাম্র লিপিতে নাকি মণিপুরের জনৈক রাজা “কোয়াই থম্পক” এর নাম পাওয়া যায়। তিনিও সঙ্গীত ও নৃত্যে বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে এখানে বৈষ্ণব ধর্মের প্রথম সূত্র পাত করেন তদানীন্তন রাজা পামহৈবা (১৭১৪ সালে) । এটাও জানা যায় যে, রাজা তাঁর ধর্ম গুরুর নির্দেশে পূর্বে কার ধর্ম সংক্রান্ত সমস্ত পুথি নষ্ট করে ফেলেন- অথচ অন্যান্য দেব-দেবীর (শিব-পার্বতী) প্রতিও কোন অসম্মান তিনি করেন নি। সেই সময় থেকেই মণিপুরীদের প্রতিটি ধার্মিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব ক্রমশ বিস্তারিত হতে থাকে।
মণিপুরী সংস্কৃতি পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত হয় রাজা পামহৈবার পৌত্র “চিঙাঙ খম্বার” সময়ে (১৭৬৪-১৭৮৯ সালে) – যিনি রাজা “ভাগ্য চন্দ্রের” নামে প্রসিদ্ধ। বীরত্বে, শৌর্যে, রাজ্য পরিচালন ক্ষেত্রে তিনি যেমন যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন তেমনি শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অসামান্য। মহারাস, বসন্ত রাস, কুঞ্জরাস ও ভঙ্গীঁপরেং এর প্রবর্তন তিনি করেন। রাস নৃত্য প্রবর্তনেরও একটি কাহিনী মণিপুরীদের কাছে শোনা যায়। সেটি হল- একদা শ্রী কৃষ্ণ রাজা ভাগ্য চন্দ্রকে স্বপ্না দেশ দেন যে তাঁর কন্যা লাইরেম্বী (বিম্বাবতী মঞ্জরী) যেন শ্রী রাধিকা রূপে শ্রী কৃষ্ণের মূর্তি মণ্ডলীকে বৃত্ত করে রাস নৃত্যের মাধ্যমে তাঁর পূজা ও প্রচার করেন, তা হলেই তিনি পরি তৃপ্ত হবেন। এর পর প্রতি রাত্রে মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নে শ্রী কৃষ্ণের রাস নৃত্য দর্শন করেন এবং পরের দিন প্রাতে কন্যাকে সেই নৃত্য শিক্ষা দেন। মনে করা হয় এই ভাবেই নাকি রাস নৃত্যের উদ্ভব হয় ও প্রচার লাভ করে। প্রচলিত আছে রাস নৃত্যে ব্যবহৃত পোশাক মহারাজা ভাগ্যচন্দ্রের স্বপ্নাদেশে দেখা শ্রী কৃষ্ণের রাসলীলার অনুসরণে প্রবর্তিত।
আমরা সকলেই জানি মণিপুরী নৃত্য দলগত প্রধান নৃত্য। আদি কাল থেকেই মণিপুরী নৃত্য দলগত ভাবে প্রদর্শিত হয়। মণিপুরের সবথেকে প্রাচীণ নৃত্য লাই হরাওবার দিকে দৃষ্টিপাত করলেও আমরা সেটি দলগত ভাবেই পেয়ে থাকি। মণিপুরী নৃত্য প্রথম মঞ্চে একক নৃত্য হিসেবে প্রস্ফুটিত হয় আলমোড়ায় গুরু মাইস্নাম অমুবী সিং এর হাত ধরে “নীল কমল দল শ্যাম” গানটির মাধ্যমে। যেটিকে মঞ্চে একক নৃত্য হিসাবে পরিবেশন করেছিলেন স্বর্গীয় গুরু অমলা শঙ্কর। এটি ছিল প্রথম মঞ্চে একক নৃত্য যা মণিপুরের বাইরে প্রথম মণিপুরী আঙ্গিকে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। যা দর্শক মহলে খুবই খ্যাতি অর্জন করেছিল। এটি গুরুজীকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল যে মণিপুরী একক নৃত্য এইভাবেও প্রকাশ করা যেতে পারে। মণিপুরে ফিরে তিনি মঞ্চের একক নৃত্য নিয়ে প্রচুর কাজ করেন। তিনি একের পর এক বহু একক নৃত্য নির্মাণ করেন এবং তাঁর শিষ্যদের দ্বারা সেটির প্রচারকার্য শুরু করেন।‘নীল কমল দল শ্যাম’, ‘শ্রীতকমল’, ‘দশাবতার’, প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য মঞ্চের একক নৃত্য নির্মাণ । এছাড়া রাস নৃত্য থেকে কৃষ্ণ নর্তন, কৃষ্ণ অভিসার, রাধা নর্তন, রাধা অভিসার, মকোক চিঙবি জগোই, মথঙ চৎপী জগোই প্রভৃতি নৃত্যগুলিকে আলাদা করে একক নৃত্য হিসেবে মঞ্চে উপস্থাপনা করা হয়েছিল। লাই হরাওবা থেকে ‘মাইবী’ নৃত্য ও ‘লৈমা জগোই’ নৃত্য একক নৃত্য হিসেবে মঞ্চে প্রস্ফুটিত হয়। ‘থাংতা’ মার্শাল আর্ট একক নৃত্য হিসেবে মঞ্চে স্থান পায়। পুং চোলোম যেটি দর্শকমহলে বিশেষ সাড়া ফেলেছিল। পুং এর সাথে নৃত্য, হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে পুং এর সাথে নৃত্য দর্শকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। এ সকল মণিপুরের খুবই জনপ্রিয় নৃত্য। গুরুরা এসকল নৃত্য নির্মাণের সময় কখনোই এর অন্তর্নিহিত ভাব কে বা ভক্তি কে ক্ষুণ্ণ করেননি, তা বজায় রেখেই নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে গুরু অমুবী সিং এর শিষ্যরাও একক নৃত্য প্রচারকার্যে নিজেদের নিয়োগ করেন। শুধু মণিপুরী নয় মণিপুরের বাইরে বহির্জগতে মণিপুরী একক নৃত্য প্রচার ও প্রসার লাভ করতে শুরু করে। এসকল বিষয়ে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেই সময় বিংশ শতাব্দীতে একক নৃত্য প্রচারকার্য শুরু হলেও, পরবর্তীকালে একক নৃত্য ধীরে ধীরে লোপ পেতে শুরু করে। এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে একক নৃত্য বলতে কি বোঝানো হচ্ছে? একক নৃত্য অর্থাৎ এই না যে মঞ্চে উঠে একটি দশ মিনিটের নৃত্য নির্মাণ পরিবেশন করা, একক নৃত্য অর্থাৎ শিল্পী একাই যে সম্পূর্ণ ৪৫ মিনিট বা এক ঘণ্টার একটি নৃত্য অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে। সেখানে তাকে মণিপুরী নৃত্যের বিভিণ্ণ রূপ পরিবেশন করে দর্শকদের মোহিত করে রাখতে হবে। এই সকল বিষয় নিয়ে বিভিণ্ণ গুরুরা বিভিণ্ণ রকমের চিন্তা ভাবনা করে কাজ করেছেন। বিভিণ্ণ রকম অর্থাৎ মঞ্চ উপযোগী নৃত্য রচনা করা। এ বিষয়ে গুরু বিপিন সিং এর নাম করতে হয়। যিনি এসকল বিষয় নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন তাঁর স্ত্রী কলাবতী দেবী ও তাঁর ছাত্রী পদ্মশ্রী দর্শনা ঝাভেরি। কিভাবে মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করলে সেটি দর্শকদের মোহিত করবে? রঙ্গমঞ্চে কি ধরনের নৃত্য নির্মাণ হওয়া দরকার? পোশাক কি হওয়া উচিত? এসকল বিষয় নিয়ে তাঁরা দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন। ‘মণিপুর স্টেট কলা অ্যাকাডেমী’ উদ্যোগ নিয়ে, ‘একক নৃত্য উৎসব’ সঞ্চালন করতে শুরু করেন, এর উদ্দেশ্য একটাই ছিল একক নৃত্য প্রচার ও প্রসার। এই নৃত্য উৎসবে শুধু মণিপুরে নয় বহির্জগতের মণিপুরী শিল্পীরা অংশগ্রহন করতে থাকে। গুরু বিপিন সিং এর ছাত্রী অধ্যাপিকা ড. শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায় ও গুরু প্রীতি প্যাটেল গুরু বিপিন সিং এর তত্ত্বাবধানে এই একক নৃত্য উৎসবে অংশগ্রহন করেছিলেন। এই সকল গুরুদের একটি লক্ষ্য ছিল মণিপুরী নৃত্য কে একক নৃত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করা। গুরু বিপিন সিং এর পরলোক গমনের পর পদ্মশ্রী গুরু দর্শনা ঝাভেরি ও কলাবতী দেবী এবং গুরু বিপিন সিং এর কন্যা গুরু বিম্বাবতী দেবী এই বিষয়ে নিজেদের কে নিয়োগ করেন। একক নৃত্য প্রচার ও প্রসার কার্যের জন্য মণিপুরে জওহরলাল নেহেরু মণিপুরী ডান্স অ্যাকাডেমী ডাইরেক্টর উপেন্দ্র শর্ম্মা যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছেন। মণিপুরী নৃত্য বিশ্বের অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের সাথে তার স্থান উচ্চমানের জায়গা করে নিয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একক নৃত্য হিসাবে মণিপুরী নৃত্য আজ লোপ পেয়েছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এর কারন কি? উত্তরে বলা যেতে পারে সঠিক পন্থা না জানা। অর্থাৎ কিভাবে নৃত্য পরিবেশন করলে দর্শকদের কাছে শিল্পীর একটি যোগসূত্র তৈরী হবে? কিভাবে নৃত্য গুলির ক্রোম সাজানো উচিত? মণিপুরী নৃত্যের পোশাকের বৈচিত্র্য আমরা দেখতে পাই এর যেমন একটি ভাল দিক আছে তেমনি একটি খারাপ দিক আছে। মঞ্চে যখন তাণ্ডব ও লাস্য উভয় দিক প্রদর্শন করতে হয় তখন পোশাকের বৈচিত্র্য এসে যায়। কারন তাণ্ডব আঙ্গিকে ধুতি ও লাস্য আঙ্গিকে ফানেক বা কুমিন। সমস্যা এখানেই। তাণ্ডব থেকে লাস্যে রূপান্তরিত হাওয়ার সময় কিংবা লাস্যে থেকে তাণ্ডবে মহিলা শিল্পীর পোশাকের পরিবর্তনের এক বিশাল সমস্যা সামনে এসে পড়ে। কারন এক নৃত্য থেকে আরেক নৃত্যে পদার্পণ করতে যে ধারাভাষ্য সেই সময়ে শিল্পী কে তাঁর পোশাক পরিবর্তন করতে হয়। সেটির সময় এক মিনিট বা দুই মিনিট ধার্য করা থাকে। তাতে শিল্পী বিশ্রামের সময় পায় না। এটি একটি কঠিন সমস্যা। বর্তমানকালে যারা একক নৃত্য মঞ্চে প্রদর্শন করছে তাদের সকলকেই এই কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গবেষিকা এই গবেষণার মুখ্য উদ্দেশ্য হল এই সকল সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা এবং সেটিকে একটি সঠিক পদ্ধতিতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা। যাতে পরবর্তীকালে একক নৃত্যশিল্পীদের এই সকল সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়। গবেষিকা গবেষণার অগ্রগতির জন্য বিভিণ্ণ গুরুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সাক্ষাৎকার পর্বে একক নৃত্য প্রচার ও প্রসার এর বিভিণ্ণ সমস্যা সামনে এলেও এর সঠিক সমাধান সামনে আসেনি। সাক্ষাৎকার পর্বে অনেকাংশ মনে করেন একক নৃত্য থেকে দ্বৈত নৃত্য বেশি শ্রেয়। দ্বৈত নৃত্য দর্শকদের মোহিত করে এবং নৃত্যর ক্ষেত্রেও এটি শ্রেয়। আবার অনেকাংশ মনে করেন একক নৃত্য প্রচার হওয়া বাঞ্ছনীয়। সকল গুরুরা যে পথ দেখিয়ে গিয়েছেন সেটি কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের কর্তব্য। একক নৃত্যের মাধ্যমে শিল্পী তার নিজের নৃত্য দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে পারে। একজন শিল্পী নিজেকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তাঁকে একক নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবেই। তবেই সম্ভব তাঁর শিল্পী সত্তা প্রকাশ করা। এ সকল বিষয়কে তুলে ধরেছে গবেষিকা তার গবেষণা কর্মে। এই গবেষণা কর্মের ফলে শিল্পীরা একক নৃত্যের ক্ষেত্রে একটি দিশা খুঁজে পাবে বলে আশা করা যায়।

মণিপুরী নৃত্য সমবেত নৃত্য প্রধান, যা প্রথম থেকেই সকলের কাছে মান্যতা পেয়ে এসেছে এবং সমবেত নৃত্যের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা আজ পৃথিবী খ্যাত। আধুনিক কালে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সমবেত নৃত্যের প্রতি মনোযোগ বেশি দিচ্ছেন। যে সকল সমবেত নৃত্য নির্মিতি দেখে থাকি যা উচ্চ প্রশংসনীয়- যেমন- আধুনিক কালে রচিত “কাইবুল ল্যামজাও” একটি জনপ্রিয় মণিপুরী ব্যালে নৃত্য। এছাড়া আধুনিক কালে তৈরি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের “বিদায় অভিশাপ” নৃত্য নাট্যটি বিশেষ জনপ্রিয়। সমবেত নৃত্যের ক্ষেত্রে সর্বদাই একটি সাংগঠনিকও প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো থাকে। যার ফলে সমবেত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
বর্তমান পৃথিবীর আধুনিক জীবনযাত্রায় বিভিণ্ণ প্রতিকূলতার প্রেক্ষিতে প্রয়োজন হয়েছে সেই দলগত নৃত্যধারায় পর্যালোচনার এবং পুনর্নবিকরন পর্বের। বর্তমান সময়ে দলগত নৃত্যের ক্ষেত্রে অন্যতম বাঁধার কারণ হয়ে দাড়ায় বহু সংখ্যক শিল্পী সমন্বয়ে একটি সাংস্কৃতিক দলকে বা বিভিণ্ণ সাংস্কৃতিক দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। জনসাধারণের মনে মণিপুরী নৃত্যকলার গ্রহণীয়তা বা জনপ্রিয়তা সর্বজন জ্ঞাত কিন্তু বিভিণ্ণ সময়ে এহেন জনপ্রিয় শিল্পকলা উপস্থাপনার প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বহুসংখ্যক শিল্পী সমন্বয়ের একটি দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করবার মত পৃষ্ঠপোষক বা তহবিলের সঙ্কুলান, কারণ যে কোনও ধারার সংস্কৃতিকে বিস্তৃত পরিসরে উন্মুক্ত করতে গেলে প্রয়োজন তাঁর নিরন্তর বিকাশের তথা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করা। আর সেই বিকাশের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার অর্থ হল তার মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা। বলা-বাহুল্য দলগত শিল্পকলা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিভিণ্ণ কারণে সেই মঞ্চায়নের সম্ভাবনাটি ব্যাহত হয়। বহুসংখ্যক শিল্পীর একটি দলের সাজ-সজ্জা, পোশাক-আশাক, তাদের এক স্থান হতে আরেক স্থানে যাওয়া বা থাকার ব্যবস্থা সকল বিষয়েই অত্যন্ত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এই ধরনের শিল্পকলা উপস্থাপনের কারণে প্রয়োজনীয় অর্থবল ও লোকবলের অভাব বহু ক্ষেত্রেই তার উপস্থাপনের প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এরসঙ্গে জড়িয়ে থাকে শিল্পীগনকে দেওয়া সাম্মানিকের বিষয়টিও। কারণ শিল্পীদের উপার্জনের দিকটিও কোনও ভাবেই অবহেলিত হতে পারে না। জীবন ও জীবিকার দিকটি শিল্পীদের শিল্পকলা উপস্থাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। মণিপুরী নৃত্যধারায় যেহেতু দলগত শিল্প উপস্থাপনার দিকটি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে সে কারণে মণিপুরী নৃত্যধারা বা মণিপুরী নৃত্যশিল্পীদের এই সকল বাঁধা গুলির সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত। এই কারণেই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারত সংস্কৃতির অন্যতম গৌরবময় উপাদান মণিপুরী নৃত্যকলার দেশে ও বিদেশে প্রচার-প্রসার এবং ভবিষ্যতের উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিষয় গুলি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা একান্ত আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে মণিপুরী নৃত্যকলার একক উপস্থাপন দলগত মণিপুরী নৃত্য উপস্থাপনার সেই সকল বাঁধা গুলি কাটিয়ে ওঠার অন্যতম উপায় হয়ে উঠতে পারে। দলগত নৃত্যে শিল্পীরা সেই ভাবে মান্যতা পাণনা। সাংগঠনিক পরিকাঠামোর সাহায্য ছাড়া মণিপুরী নৃত্য শিল্পীদের নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার একমাত্র পথ একক নৃত্য। প্রসঙ্গত একক নৃত্য শিল্পী বলতে সেই সেই শিল্পী কে বোঝানো হছে যে ৪০-৪৫ মিনিটের একটি সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান নৃত্যের মাধ্যমে সম্পূর্ণ করবে। আধুনিক কালে এই একক নৃত্যের ক্ষেত্রে শিল্পীদের সঠিক পরিকাঠামোর অভাব দেখা দিছে। ফলস্বারুপ শিল্পীদের সেইরুপ একক নৃত্য অংশ দেখা যাচ্ছে না। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে সঠিক পরিকাঠামো বলতে কি বোঝানো হয়েছে? পরিকাঠামো বলতে
• একক নৃত্যের ক্ষেত্রে কি ক্রম হওয়া উচিত?
• একক নৃত্যের শিল্পীর পোশাক কি হওয়া উচিত?
• একক নৃত্যের ক্ষেত্রে কিরূপ পরিকল্পনা হওয়া উচিত?
• একক নৃত্যের ক্ষেত্রে শিল্পীর কি কি গুনাগুন থাকা উচিত?
• পোশাক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কিরুপ পন্থা ব্যাবহার করা উচিত?
এই সকল প্রশ্নই শিল্পীদের কাছে অজানা। এই সকল প্রশ্নের উত্তর শিল্পীদের কাছে থাকলে তাঁরা সহজেই একক নৃত্যের সঠিক রুপে পরিকল্পানা করতে সক্ষম হবে এবং সহজেই নিজেকে একক নৃত্য শিল্পী হিসাবে জনসম্মুখে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

এই গবেষণার ফলে মণিপুরী নৃত্য শিল্পীরা মঞ্চে একক মণিপুরী নৃত্য বিষয়ে সম্যক ধারণা ও নৃত্য প্রদর্শনের রীতিনীতি জানতে পারবে, এবং শুধু তাই নয় সে জানতে পারবে কীভাবে পরিকল্পনা ও পরিবেশনকরলে অনুষ্ঠানটি সু-সম্পূর্ণ হবে। এর ফলে বহু একক নৃত্য শিল্পী তৈরি হবে এবং একক নৃত্যের ক্ষেত্রে মণিপুরী নৃত্য একটিবিশেষ ধারা সং-যোজন হবে।

একক মণিপুরী নৃত্য শৈলীর বিবর্তন ও সমসাময়িক অবস্থান বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যে গবেষণা প্রকল্পটি রচনা করা হয়েছে তাঁর লক্ষ্য মণিপুরী নৃত্যে একক নৃত্যের পুনর্নবিকরণ। একথা সকলেই কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করেছেন যে কবিগুরুর হাত ধরে মণিপুরী নৃত্য প্রথম বহির্জগতে প্রকাশিত হয়েছিলো এবং পরবর্তী কালে কবিগুরুর বিভিন্ন নৃত্য রচনায় মণিপুরী নৃত্য একক ভাবে আত্ম প্রকাশ করেছে। কবিগুরু রচিত “নটীর পুজায়” ক্ষম হে ক্ষম গানটি এর দৃষ্টান্ত। পরবর্তি সময় গুরু অমুবী সিং একক নৃত্য “নীল কমল দল শ্যাম” রচনা করেন যা সকলের কাছেই প্রশংসিত। সেই সময়কার গুরুরা তাঁদের সমসাময়িক সকল গুরুরা এবং পরবর্তী কালে অন্যান্য গুরুরা একক নৃত্যের মাধ্যমে মণিপুরী নৃত্যের একটি নতুন দিক সংযোজন করেছিলেন।আধুনিক কালে তাঁদের শিষ্যরাই সেই ধারা অব্যাহিত রেখেছেন। এই গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে গুরুদের একক নৃত্যের অবদান হেতু তাঁদের জীবনীকে তুলে ধরা হয়েছে। এই সকল গুরুদের অবদানকে দৃষ্টান্ত রেখে এই গবেষণা প্রকল্পের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে একক নৃত্যের বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে মণিপুরী নৃত্য শৈলীতে একক নৃত্যের পুনর্নবিকরণ। সম্ভাব্য একক নৃত্যের বিভিন্ন বাঁধার কারণকে সমাধান করে গবেষণার লক্ষ্য মণিপুরী নৃত্যে একক নৃত্যকে নতুন রুপে সংযোজন করা।
গবেষণা প্রকরণ ও পদ্ধতি (METHODOLOGY):
“একক মণিপুরী নৃত্যের বিবর্তন ও সমসাময়িক অবস্থান” সম্পর্কিত গবেষণা প্রকল্পে মণিপুরী নৃত্যে একক নৃত্য সম্পর্কিত অনুসন্ধান ও একত্রীকরণ করে নতুন তথ্য ও ভাবনা সংযোজনের মধ্যে দিয়েই এই গবেষণার প্রকৃতি নির্ধারিত করা হয়েছে। গবেষণা প্রকল্পটি সম্ভবপর হয়েছে নিম্নলখিত সকল পদ্ধতি অবলম্বণের মাধ্যমে-
১। মণিপুরের বিভিন্ন নৃত্য গুরু দের পরামর্শের উপদেশ ও সাহায্যেরমাধ্যম
২। মনিপুরের বাইরে বিভিন্ন মণিপুরী নৃত্য গুরুদের (কলকাতা, বম্বে, দিল্লী, শান্তিনীকেতন) কাছে উপদেশও পরামর্শের মাধ্যমে।
৩। মণিপুরের বিখ্যাত নৃত্য গুরুদের বিভিন্ন ঐতিহ্য পূর্ণ পুঁথি সংগ্রহের মাধ্যমে।
৪। বিভিন্ন মণিপুরী নৃত্য গুরুদের রচিত গাণ ও নৃত্য রচনা এবং নৃত্য গুরুদের জীবন সম্বন্ধে জ্ঞানঅর্জনের মাধ্যমে।
৫। সম্ভাব্য যে কোণ প্রামাণ্য গ্রহণীয় তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে।
৬। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত নৃত্য সমালোচকদের রচনা সারণি বদ্ধ করে এবং তাঁদের মতামতের গুরুত্ব বুঝে সকল তথ্যকে সমম্বয় মাধ্যমে গবেষণা প্রকল্পটি সম্ভবপর হয়েছে।
এরকম বিভিন্ন পন্থার মাধ্যমে সম্ভব হয়ে উঠেছে “একক মণিপুরী নৃত্য শৈলীর বিবর্তন ও সমসাময়িক অবস্থান”।
একক মণিপুরী নৃত্যের বিবর্তন ও সমসাময়িক অবস্থান বিষয়টিতে বিভন্ন গুরুদের অক্লান্ত পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। তাঁরা তাঁদের জীবনকাল ধরে এই শিল্পকে প্রচার ও প্রসারের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মণিপুরী একক নৃত্য ভারতীয় সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁদের কাজের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ এবং সম্মানিত।

একক মণিপুরী নৃত্যের বিবর্তন
একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টি ভঙ্গী থেকে বলা যায় যে-এটি একটি পরিচিত সত্য যে-কোন ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য সহ বিশ্বের সমস্ত ধ্রুপদী নৃত্য ঐতিহ্য বাহী এবং লোক শিল্প থেকে উদ্ভূত হয়েছে। মণিপুরী নৃত্যের অস্তিত্ব প্রাচীণ। মৈতৈ সম্প্রদায়ের প্রথম জন বসতির মতোই এর অস্তিত্ব প্রাচীণ। মণিপুরী নৃত্য একটি অনন্য ক্রম অনুসরণ করেছে যা মৈতৈ সম্প্রদায় দ্বারা পূজিত। সেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি হল লাই হরাওবা, যা স্বতন্ত্র রূপে প্রতিফলিত হয়। লাই হরাওবা নৃত্যটি বিশ্ব তত্ত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। যেমন শূন্য তা থেকে মহা বিশ্বের সৃষ্টি এবং পরবর্তী কালে মানব এবং অন্যান্য সমস্ত জীবের সৃষ্টি। লাই হরাওবা নৃত্যটি বিনোদনের নৃত্য নয়। লাই হরাওবা নৃত্যগুলি কঠোর ভাবে ধর্মীয় এবং ধর্মীয় প্রকৃতির। এই নৃত্যটি ‘মাইবী’ দ্বারা পরিচালিত। পৃথিবী সৃষ্টি, জীব জন্তুদের সৃষ্টি, মানুষের বসতির বিবর্তন, বৃদ্ধি এবং অগ্রগতি ইত্যাদি সমস্ত কিছু নৃত্যের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। লাই হরাওবা নৃত্য মৈতৈ সম্প্রদায়ের সাথে একটি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একটি জীবন্ত নৃত্য শিল্প। যা আজও সযত্নে নিয়মের সাথে করা হয়।
মণিপুরী নৃত্যের প্রথম উল্লেখ যোগ্য পর্যায়টি রাজা ‘চিংথাং খোম্বার’ সময় কাল থেকে পাওয়া যায়, যিনি রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র নামে অভিহিত হয়ে ছিলেন। তাঁর রাজত্বকাল মণিপুরের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ নামে খ্যাত (১৭৫৯-১৭৯৮)। ১৭৭৯ সালে রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র বিভিণ্ণ গুরুদের সহযোগিতায় প্রথম বিখ্যাত রাসলীলার উপস্থাপন করেছিলেন। সেখানে একদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও গোপীদের নিয়ে লীলা কার্যে ব্যস্ত, সেখানে প্রেমও ভক্তি দুই বিরাজমান, যা মহাপূরান ‘শ্রীমদভাগবতে’ বর্ণিত। এখনো প্রত্যেক বছর অক্টোবর নভেম্বর মাসে মণিপুরে শ্রী শ্রী গোবিন্দজির মন্দিরে পূর্ণিমায় মহারাস লীলা করা হয়। মহারাস ছাড়াও মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র আরও দুটি রাসলীলার প্রবর্তন করেন-বসন্ত রাস ও কুঞ্জ রাস। পরবর্তী কালে রাজা চূড়াচান্দের রাজত্বকালে আরও দুটি রাসলীলা নির্মাণ করা হয়-দিবারাস ও নিত্য-রাস। মণিপুর বাসী প্রত্যেক অনুষ্ঠান করে থাকে ভগবানের তুষ্টির উদ্দেশ্যে, তারা মনে করেন ভগবানকে তুষ্ট করতে পারলে তবেই সকল কার্য সিদ্ধ হবে। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র থেকে শুরু করে সমস্ত রাজারাই মণিপুরী নৃত্যের ঐতিহ্যকে সযত্নে বহন করে এনেছেন। মণিপুরী নৃত্যের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যময় ঘটনা হল যখন মণিপুরী নৃত্য প্রথম মণিপুরের বাইরে কলকাতায় পরিবেশন করা হয়।
গুরু মাইস্নাম অমুবী সিংহের নেতৃত্বে রাজা চূড়াচান্দের আদেশে ১৯২১ সালে কলকাতায় প্রিন্স অফ ওয়েলস্ এর সামনে প্রথম রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। আর সেখান থেকেই মণিপুরী নৃত্যের খ্যাতি ভারতের বিভিণ্ণ জায়গায় ছড়াতে শুরু করে। এটি ছিল প্রথম ঘটনা যেখানে মণিপুরী নৃত্য তার গণ্ডি অতিক্রম করে বাইরের জগতে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। সেই সময় মণিপুরে নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল না। নৃত্যের অনুষ্ঠান আয়োজন হত মন্দিরের জন্য যা রাজ গৃহে অনুশীলিত হত। মণিপুরীদের কাছে রাস নৃত্য ভগবান তুল্য, রাস নৃত্য কখনো বিনোদনের জন্য হতে পারে তা তাদের কল্পনারও বাইরে। তাঁরা তাঁদের ভক্তি ও ভালোবাসা রাসনৃত্যের মাধ্যমে কৃষ্ণ, রাধা ও ব্রজগোপীদের ওপর সেটি প্রকাশ করে । ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা গ্রামের খুল্লকে বা মন্দিরে যারা রাসনৃত্যে রাধা, কৃষ্ণ, গোপীর ভূমিকায় নৃত্য করে তাঁদেরকে তাঁরা ভগবান তুল্য মনে করে পূজা করেন। সেখানে রাজার দ্বারা আদেশ পেয়ে শিল্পীদের রাস নৃত্য চর্চা করানো কলকাতায় অনুষ্ঠানের জন্য সেটি সে সময় মানুষের কাছে যথেষ্ট আশ্চর্য কর ঘটনা বলে বলা যেতে পারে।
একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কিত একটি নৃত্যকে জনপ্রিয় করার জন্য বিভিণ্ণ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বিভিণ্ণ শ্রোতার কাছে সেই নৃত্যের রূপটি প্রকাশ করা প্রয়োজন। আর সেই রূপটি প্রকাশিত হয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রথম ত্রিপুরায় রাসলীলা দেখে মুগ্ধ হন, এই নৃত্যের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য তাঁকে আকর্ষিত করে তাই তিনি ১৯১৯ সালে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য শেখানোর উদ্যোগ নেন। এই ভাবে শুরু হয় মণিপুরী নৃত্যের প্রচার।
অন্যদিকে মণিপুরী একক নৃত্যের বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে মণিপুরের সকল নৃত্যই পর্যালোচনা করতে হবে। মণিপুরের প্রথম একক নৃত্য নির্মাণ করেন মাইস্নাম গুরু অমুবী সিং ১৯৩৯ সালে “নীলকমল দল শ্যাম” নৃত্যটি নির্মান করেন উদয়শঙ্কের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আলমোড়াতে থাকা কালীন এবং নৃত্যটি একক ভাবে পরিবেশন করেন স্বর্গীয় গুরু অমলা শঙ্কর। “নীল কমল দল শ্যাম” নৃত্যটি দর্শক মহলে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা অর্জন করেছিল। বলা যেতে পারে গুরু মাইস্নাম অমুবী সিংহের কাছে সেই সময় নৃত্যের একটি নতুন দিকের সূচনা হয়েছিল। ভারতের অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যগুলি প্রথম থেকেই একক নৃত্য রূপে বিকশিত হয়েছে এবং তা প্রথম থেকেই দর্শক মহলে সমাদৃত। সেখানে মণিপুরী নৃত্য দলগত রূপটি প্রধান। আমরা লাই হরাওবা থেকে শুরু করে রাস, যে কোন নৃত্যই দেখি না কেন তা দলগত ভাবেই করা হয়ে থাকে,অপরদিকে মণিপুরের প্রত্যেকটি নৃত্যেই ভক্তিরস বিরাজ মান। সেটি রঙ্গ মঞ্চের জন্য পরবর্তীকালে গুরুদের প্রচেষ্টায় আনা হয়েছে। বিবর্তন অর্থাৎ ক্রমবিকাশ। বিবর্তন সব কিছুতেই বিরাজমান। বিবর্তন এক ধর্ম যা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
অপরদিকে মণিপুরী একক নৃত্যের বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা কালে উঠে আসে মণিপুরের ঐতিহ্যময় নৃত্যের কথা। মণিপুরী নৃত্য পর্যালোচনা কালে –
 লাইহারাওবা
 থাংতা
 আদিবাসী নৃত্য
 রাসলীলা
 নট চোলোম
নৃত্যের কথাই মনে হয়। মণিপুরী নৃত্য উৎপত্তিগত ভাবেই দলগত নৃত্য। লাইহারওবা নৃত্য যা আদি কাল থেকেই মণিপুরের বিভিন্ন গ্রামে হয়ে আসছে কিংবা রাসলীলা যা মন্দির প্রাঙ্গণে সংঘটিত হয়ে থাকে। সকল নৃত্যই দলগত প্রধান নৃত্য। এসকল নৃত্য দলগত ভাবে সংঘটিত হলেও কিছু অংশে নৃত্যে নাটকীয় প্রয়োজনীয়তায় বা ঐতিহ্য বজায় রেখে একক নৃত্য হতেও দেখা যায়।
লাইহারাওবা নৃত্যের ক্রমে একক, দ্বৈত ও সমবেত নৃত্য লক্ষণীয়। এখানে এই ক্রম আলোচনার কারন হেতু বলা যায় এই সকল নৃত্য আজও ঐতিহ্যগত ভাবে গ্রামের প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মণিপুরী নৃত্য মঞ্চস্থ হওয়ার পর থেকেই এই সকল নৃত্য থেকে কিছু অংশ নিয়ে একক ভাবে গুরুরা মঞ্চস্থ করেন। প্রসঙ্গত লাইবুং এ অনুষ্ঠিত ‘লাইচিং জগোই’ মাইবীরা একক ভাবে পরিবেশন করেন কিন্তু নৃত্যের বিবর্তনের সাথে এই ‘লাইচিং জগোই’ মঞ্চের জনপ্রিয় একক নৃত্য হিসাবে আত্ম প্রকাশ করে। লাইহারাওবায় অনুষ্ঠিত ‘থৌগল জগোই’ যা ‘লৈমা জগোই’ নামেও মঞ্চে একক নৃত্য হিসাবে প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। বিভিন্ন গুরুরা নিজ নিজ মতে ‘লাইচিং জগোই’ এবং ‘থৌগল জগোই’ নৃত্য নির্মাণ করেছেন যা সকল ক্ষেত্রেই উচ্চ প্রশংসনীয়। শুধু একক নৃত্যই নয় লাইহারাওবা থেকে বিভিন্ন কাহিনী অবলম্বন করে বিভিন্ন দ্বৈত ও দলগত নৃত্য প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। প্রসঙ্গত খাম্বা থৈবী নৃত্য একটি জনপ্রিয় দ্বৈত নৃত্য আবার ‘ঔগ্রিহাঙ্গল’ নৃত্য একটি জনপ্রিয় দলগত নৃত্য। এ সকল নৃত্যই লাই হরাওবা থেকে কিছু অংশ বিশেষ নিয়ে তা মঞ্চের জন্য গুরুরা নতুন রুপে নির্মাণ করেছেন। শুধু তাই নয় সময়ের সাথে অনন্যা শাস্ত্রীয় নৃত্যের ন্যায় যখন মণিপুরী নৃত্যের খ্যাতি দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রসারিত হতে থাকলো তখন মণিপুরী নৃত্যের গুরুরা নতুন ভাবে বিভিন্ন পদের থেকে গান নিয়ে সেগুলি নবরূপে নির্মাণ করার প্রয়োজন বোধ করলেন, সেই সময় গুরুরা লাই হরাওবা থেকে বিভিন্ন হস্ত, অঙ্গ সঞ্চালন ও পদ চালনা তাঁদের নৃত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা কালে এই সকল তথ্য লাই হরাওবা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উঠে আসে।
থাংতা
থাংতা মণিপুরের জনপ্রিয় যুদ্ধবিদ্যা।মণিপুরের ইতিহাস থেকে যানা যায় প্রথম দিকে কেবল ছেলেরাই থাংতা বা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শি হতেন । এর কারন মনিপুরে এটি প্রচলিত যে জীবন রক্ষার জন্য সকল পুরুষ কেই এই যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শি হতে হয়, কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে আজ মহিলা ও পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই এই যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শি। মণিপুরী নৃত্য মঞ্চস্থ হওয়ার পর থেকেই এই থাংতা অস্ত্র বিদ্যা মঞ্চে প্রদর্শিত হল এবং দর্শক মহলে উচ্চ প্রশংসা অর্জন করল। বিবর্তনের সাথে সাথে থাংতা নৃত্য বিভিন্ন রুপের বিবর্তন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। থাংতা নৃত্য দলগত প্রধান নৃত্য এবং এটি তান্ডব আঙ্গিকেই প্রদর্শিত হতে দেখা জায়।বিবর্তনের সাথে সাথে এই থাংতা যুদ্ধ বিদ্যা কলাকে মঞ্চে কোন কোন ক্ষেত্রে একক ভাবেও প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। মনে করা হয় নৃত্যের বর্তমানের যে সকল ধারা মনিপুরে দেখা যায় তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি ই এই থাংতা নৃত্য কলার এক বিবর্তিত ও পরি- মার্জিত রূপ ।
আদিবাসী নৃত্য
মনিপুরে বসবাস কারি বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যে মাওনাগা ও কবুইনাগা আদিবাসী নৃত্য মণিপুরের জনপ্রিয় লোক নৃত্য। আদিবাসীরা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে ও উৎসবে নৃত্যগীতের মাধ্যমে মেতে ওঠেন। সাধারণ জীবনের সাথে নৃত্যগীতাদি জড়িয়ে আছে। মণিপুরী নৃত্য মঞ্চে আত্ম প্রকাশ করার পর এই আদিবাসী নৃত্য ও মঞ্চে অনুষ্ঠিত হতে থাকে এবং দর্শক মহলে যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করে। তাঁদের পোশাকের বৈচিত্র , তাঁদের নৃত্য কেবল তাঁদের মধ্যেই সিমাবদ্ধ না থেকে দেশে ও বিদেশের মানুষের সম্মুখে আত্ম প্রকাশ করতে থাকে। আদিবাসী নৃত্যের মধ্যে কাবুই নাগা একটি জনপ্রিয় আদিবাসী ন্রিত্য।প্রসঙ্গত গুরু তরুণ কুমার ‘কাবুই নাগা’ নৃত্য একক নৃত্য হিসাবে প্রথম মঞ্চের জন্য নির্মাণ করেন। মণিপুরী নৃত্যের দক্ষ শিল্পীরা এই কাবুই নাগা নৃত্য মঞ্চে পরিবেশন করেন এবং গুরু দেবযানী চালিহা নিজে বহুবার ‘কাবুই নাগা’ নৃত্য মঞ্চে একক নৃত্য হিসাবে মঞ্চে পরিবেশন করেছেন। আদিবাসী নৃত্য দলগত ভাবে প্রদর্শিত হলেও বিবর্ত নের ইতিহাস এ এর একক রূপটিও খুঁজে পাওয়া যায়। দর্শক মহলে ‘কাবুই নাগা’ নৃত্য একটি জনপ্রিয় লোকনৃত্য হিসাবে পরিচিত।
নটপালা সংকীর্তন
নট পালাকীর্তন একটি ধার্মিক অনুষ্ঠান। নট পালা কীর্তনের মাধ্যমে গবিন্দজীর মন্দিরে পূজা হয় নট পালা কীর্তনের মাধ্যমে। মনিপুরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা নট পালা কীর্তনের হতে দেখে থাকি। নট পালা কীর্তনে পুং চোলোম , খুবাক ঈশৈ, করতাল চোলোম, মন্দিলা নৃত্য, নুপি পালা প্রভৃতি বিভিন্ন ধরণের বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যের সমাবেশ দেখে থাকি। ববর্তনের সাথে সাথে মণিপুরী নৃত্যের সকল প্রকার রূপকেই গুরুরা মঞ্চে প্রদর্শন করেন। নট পালা কীর্তনে আয়জিত পুং চোলোম ও মন্দিলা নৃত্য মঞ্চের একটি জনপ্রিয় নৃত্য। দর্শক মহলে পুং চোলোম উচ্চ প্রশংসা অর্জন করেছে সেক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ নেই। গুরুরা প্রয়োজন অনুসারে পুংচোলোম ,ঢোল ঢোলক চোলোম প্রভৃতি নৃত্য গুলিকে নিজেদের মতন করে মঞ্চের জন্য নির্মান করেছেন। পুং চোলোম, ঢোল ও ঢোলক চোলোম পুরুষ প্রধান নৃত্য। পুং নিয়ে লাফিয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গীর মাধ্যমে, পায়ের ছন্দ সমস্ত কিছুই দর্শক মহলে প্রশংসা অর্জন করে। দলগত ভাবে পুংচোলোম করার সময় সকল শিল্পী একটি নির্দিষ্ট সময় তাঁদের মাথার কয়েৎ বা পাগড়ি মঞ্চে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলেন। এই অংশটি নৃত্যেকে আরও আকর্শনিয় করে তোলে। এই সকল নৃত্য দলগত ভাবে আত্ম প্রকাশ করলেও বর্তমানে এই সকল নৃত্য একক ও দ্বৈত নৃত্য হিসাবেও বর্তমানে মঞ্চে দেখা যায়। দ্বৈত কিংবা একক কোন ক্ষেত্রেই এই সকল নৃত্যের মাণ কোন অংশেই কম হয়নি। তা সমরুপে আজও বিরাজমান। মন্দিলা নৃত্য সমবেত ভাবে মহিলা শিল্পীরা করলেও বিবর্তনের সাথে সাথে শিল্পীরা মন্দিলা নৃত্য একক ভাবে মঞ্চে পরিবেশন করেছেন এবং করছেন।
রাসলীলা
মনিপুরে আমরা পাঁচ ধরণের রাসনৃত্য দেখে থাকি।
 মহারাস
 কুঞ্জ রাস
 বসন্ত রাস
 নিত্য রাস
 দিবারাস
এই পাঁচ ধরণের রাস নৃত্য রাধা, কৃষ্ণ ও গোপীদের বিভিন্ন লীলা জনিত কাহিনী অবলম্বনে গঠিত নৃত্য। এছাড়াও আরও দুই ধরণের রাস নৃত্য আছে, যা কৃষ্ণের বাল্য লীলার কাহিনীর ওপর রচিত। যথা- গোষ্ঠ লীলা ও ঊলূখোল রাস।
বিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়জন হয়েছে মণিপুরী নৃত্যের প্রচার ও প্রসারের, গুরুরা নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন নৃত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তবে অবশ্যই গুরুরা মণিপুরী নৃত্যের মাণ ও ঐতিহ্য বজায় রেখেই তা নবরূপে পরিমার্জিত করেছেন। মণিপুরী নৃত্যকে একক নৃত্য হিসাবে প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুরা বিভিন্ন পদ থেকে গান নিয়ে ও বোল দিয়ে তাল ও লয়ের সংযোজনের মাধ্যমে নবরূপে একক নৃত্য নির্মাণ করেছেন।এই সকল নৃত্য ছাড়াও খুবাক ঈশৈ, গৌরাঙ্গ ভাবের উপর গৌরাঙ্গ নর্তন, রথ যাত্রার দিনে দশাবতার গানটি থেকে ‘দশাবতার নৃত্য’ রূপ দেওয়া হয়। এছাড়াও অন্যান্য সকল পদ থেকে গান নিয়ে সেগুলি একক নৃত্য হিসাবে মঞ্চে আত্ম প্রকাশ ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
গুরু মাইস্নাম অমুবী সিং তাঁর শিষ্যদের ও অন্যান্য গুরুদের মধ্যে এই বাসনা তৈরী করে ছিলেন। আলমোড়াতে থাকা কালীন দাদা উদয়শঙ্করের সঙ্গ তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়ে ছিল। নৃত্যে ব্যবহিত নতুন পন্থা, নতুন চিন্তা তার মন মধ্যে চিরকাল ঘুরত। তিনি যখন ‘নীল কমল দল শ্যাম’ নৃত্যটি নির্মাণ করে ছিলেন তখন তার ভাবনা একক নৃত্য প্রচার ছিলনা। পরবর্তী কালে যখন ‘নীলকমল দল শ্যাম’ নৃত্যটি দর্শকদের কাছে প্রশংসিত হল তখন তার সুপ্ত বাসনা জাগ্রত হল। তিনি দেখলেন মণিপুরী নৃত্যের এটিও একটি রূপ হতে পারে। তিনি মণিপুরে ফিরে একক নৃত্য প্রচার ও প্রসার কার্যে মননিবেশ করলেন। তিনি বুঝেছিলেন মণিপুরী নৃত্যে একক নৃত্যের প্রয়োজনীয়তা। তিনি এরপর থেকে ‘গীত গোবিন্দ’, ‘শ্রীমদভগবত পুরাণ’, মৈথিলী ভাষায় রচিত গ্রন্থ ‘লাইথেক লাইকা জগোই’, ‘শ্রী কৃষ্ণরস সঙ্গীত’, ‘সঙ্গীত দামোদর’ প্রভৃতি গ্রন্থ অনুসরণ করে বহু একক নৃত্য নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে সেটি প্রচার করেছিলেন। পরবর্তী কালে কৃষ্ণ অভিসার, কৃষ্ণ নর্তন, রাধা অভিসার, রাধা নর্তন একক নৃত্য হিসাবে মঞ্চস্থ হতে শুরু করল। মণিপুরের প্রত্যেক গুরু চেয়ে ছিলেন একক নৃত্যকে বিশ্বসম্মুখে জনপ্রিয় করে তুলতে। সে বিষয়ে বিভিণ্ণ গুরুরা নৃত্যে বিভিণ্ণ পন্থা ব্যবহার করেতেন। মণিপুরী নৃত্যে আমরা বিভিণ্ণ তালের সমাবেশ দেখে থাকি এই সকল তালের ছন্দকে নৃত্যে ব্যবহার করেছিলেন, লক্ষ্য ছিল একটাই একক নৃত্যের এক নতুন পথ খুঁজে বের করা। তারা সকলে একটা কথাই চিন্তা করেছেন কি ভাবে নৃত্যটি মঞ্চে উপস্থাপিত করলে তা দর্শক মহলে প্রশংসিত হবে। তাঁদের এই প্রচেষ্টা স্বরূপ ‘মণিপুরের স্টেট কলা অ্যাকাডেমী’ একক নৃত্য উৎসবের আয়োজন করছেন। মণিপুরী একক নৃত্য উৎসব, ভাগ্যচন্দ্র নৃত্য উৎসব এই সমস্ত উৎসব একক নৃত্য প্রচারের উদ্দেশ্যেই আয়োজন করা হয়। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মণিপুরে বহু একক নৃত্য আমরা দেখতে পাই। বহু মণিপুরী গুরুরা একক নৃত্য নির্মাণ করেছেন, শিষ্যদের শিখিয়েছেন এবং আধুনিক কালে তাঁরা সেটি প্রচার করছেন দেশে ও বিদেশের বহু প্রান্তে।
ভারতের ধ্রুপদী নৃত্য শৈলীর মধ্যে ভারত নাট্যম, কত্থক এবং ওড়িশি নৃত্যে গুলি একক রূপ হিসাবে উদ্ভূত এবং তাই মঞ্চে একক নৃত্য হিসাবেও আত্মপ্রকাশ করেছে। যেখানে ধ্রুপদী মণিপুরী নৃত্য রাস মণ্ডলে জন্মগ্রহন করেছে। রাসলীলার মূল নির্মাণ হল মহাজাগতিক মণ্ডল যেখানে গোপীরা রাধা কৃষ্ণকে মাঝখানে রেখে- নৃত্য প্রদর্শন করেন। সেখানে মণিপুরী নৃত্য একক নৃত্য-হিসাবে পরিচিতি লাভ করা যথেষ্টে কষ্ট সাপেক্ষ ছিল। যদিও গুরুরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে একের পর এক নৃত্য নির্মাণ করেছেন। প্রত্যেক গুরু দের রচিত নৃত্যই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সে সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রত্যেক গুরুই তাদের জীবনের অনেকাংশ অতিবাহিত করেছেন একক মণিপুরী নৃত্যের প্রচারে। শুধু মণিপুরী গুরুরাই নন তাদের তত্ত্বাবধানে নৃত্য চর্চা করেছেন তাঁদের অ-মণিপুরী শিষ্যরাও যথেষ্ট প্রয়াস করছেন একক মণিপুরী নৃত্যের প্রচার কার্যে।উদ্দেশ্য একটাই একক মণিপুরী নৃত্যের এক নতুন রূপ সৃষ্টি করা। সকল গুরুরাও জানেন এটি যথেষ্ট কষ্ট সাপেক্ষ ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তবুও তারা একনিষ্ঠ ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন মণিপুরী একক নৃত্যের প্রচার ও প্রসার কার্যে।
মাইস্নাম গুরু অমুবী সিং থেকে শুরু করে পরবর্তী গুরুরা মণিপুরী নৃত্যকে এক নতুন মাত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একক মণিপুরী নৃত্য মঞ্চস্থ করা থেকে শুরু করে নতুন নতুন নৃত্য নির্মাণ করা, নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা, একক মণিপুরী নৃত্য রঙ্গমঞ্চেও প্রতিষ্ঠিত করা, শুধু তাই নয় যাতে নৃত্যের মাধ্যমে দর্শকদের মোহিত করে রাখা যায় সেই দিকেও তাঁরা নজর দিয়েছেন। একই মঞ্চে অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের সাথে মণিপুরী একক নৃত্য সম মর্যদায় প্রদর্শিত হতে পারে সে দিকেও নজর দিয়েছেন।মাইস্নাম গুরু অমুবী সিং যে সকল নৃত্য নির্মাণ করেছিলেন সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তাঁর শিষ্যরা গুরু তরুণ কুমার, গুরু বাবু সিং, গুরু সূর্যমুখি দেবী কিংবা অন্যান্য গুরুরা লয়ের তারতম্য ঘটিয়ে অর্থাৎ কোথাও লয় বাড়িয়ে বা নতুন পুং এর বোল সংযোজন করে নৃত্যটিকে নতুন করে নির্মাণ করে ছিলেন। সময়ের সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গী ও চাহিদার পার্থক্য ঘটে। গুরু মাইস্নাম অমুবী সিং এর সময় দর্শকদের যে রূপ চাহিদা ছিল তার পরবর্তী কালে সেই চাহিদার পরিবর্তন হতে দেখা যায়। পরবর্তী গুরুরা দেখলেন মণিপুরী নৃত্যের ধীমা লয়ের কারনে দর্শকদের সে ভাবে মনযোগ আকৃষ্ট করতে পারছে না, তাই তাঁরা নৃত্য নির্মাণেতে নতুন নতুন দ্রুতলয়ের বোল ও তাল ব্যবহার করে নতুন রূপে নৃত্য রঙ্গমঞ্চের জন্য নির্মাণ করলেন । সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুর পরিবর্তন হতে লাগলো। নৃত্যে ব্যবহৃত মিউজিক যা আগে বেশীরভাগ live এ সম্প্রচারিত করা হতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন সুবিদার্থে সেটি রেকর্ডার করা হয়েছে। এর কারন হেতু বলা যায় অনেক সময় বাদক পাওয়া, গায়িকা পাওয়া সম্ভব হতো না, এছাড়াও নির্দিষ্ট দিনে নৃত্যের অভ্যাসের সময় সকল শিল্পীর সকল ক্ষেত্রে সময় দেওয়াও সম্ভবপর হয়ে উঠত না, সেক্ষেত্রে সকল সুবিধা বজায় রাখার হেতু রেকর্ডার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে মনে করা যেতেই পারে।এক্ষেত্রে নৃত্যশিল্পীর সুবিধাও বাড়ল বললে হয়তো ভুল হবেনা। বাইরে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সকল শিল্পীকে একত্রীত করে নৃত্যের অভ্যাসের বা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সকল শিল্পীর পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন হল না। সময় পরিবর্তনের ছাপ কিছুটা মণিপুরী পোশাকের ওপর পরিলক্ষিত হয়। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের সময় প্রচলিত রাস নৃত্য। সেই রাস নৃত্যের পোশাক কাপড়ের ওপর চুমকির কাজকরা ছিল কুমিন। সুন্দর দেখার প্রয়জনে কাপড়ের নীচের অংশটিতে মোটা কাপড়ের লেয়ার ও লোহার সরু তাড় ব্যবহার করে কুমিনটিকে শক্ত করা হল। পূর্ব দিনে আমরা কেবল নৃত্যে কুমিনের প্রচলন দেখেছি, পরবর্তি কালে নৃত্যের সুবিদার্থে ফানেক পরার প্রচলন শুরু হল, অনেক গুরুরাই মনে করেন এই পরিবর্তনের ফলে অঙ্গ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে অনেকাংশ সুবিধা বোধ হয় এবং নৃত্যে পায়ের চালনা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়। পরিবর্তন এসেছে ফানেকের ওপরের ইনেফি পরার ক্ষেত্রেও, বর্তমানে নেটের কাপড়ের ওপর ‘লমথাং খুল্লক’ পাড় লাগিয়ে ওড়না হিসাবে ব্যবহার দেখা যায়। এক্ষেত্রেও গুরুরা মনে করেন যে ইনেফির দাম প্রচুর, সেগুলি নষ্টও হয়ে যায়, দলগত নৃত্যের ক্ষেত্রে সকল শিল্পীকে একি রকমের পোশাক পরিধান করতে হয়, পোশাকের ক্ষেত্রে ব্যায় তাই বহুল পরিমানে হয়ে দাঁড়ায়, এক্ষেত্রে ইনেফির পরিবর্তে নেটের ওড়না ব্যবহার করাতে দলগত নৃত্যে পোশাকের উপস্থাপনায় বাঁধার সৃষ্টি হয় না, এবং এক্ষেত্রে পোশাকের সৌন্দর্য কোন অংশেই ক্ষুন্ন হয় না। যে সকল শিল্পীরা পোশাক বানান তাঁরা মণিপুরী নৃত্যের ঐতিহ্যের বিষয়টি চিন্তা ভাবনা করেই পোশাকের পরিবর্তন করেছেন। এ সকল কিছু পরিবর্তন কেবল রঙ্গমঞ্চের ক্ষেত্রেই মণিপুরী নৃত্যে পোশাকের বৈচিত্র্য সকলকেই মুগ্ধ করে। সকল শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে মণিপুরী নৃত্য এমন এক শাস্ত্রীয় নৃত্য যেখানে পোশাকের এরুপ বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। রাধার পোশাক, কৃষ্ণের পোশাক, গোপীদের পোশাক সম্পূর্ন ভিন্ন। কিংবা ‘মাইবী’, ‘লৈমা’, ‘সংকীর্তন’, ‘নাগা’ সকল নৃত্যের ক্ষেত্রে ভিন্ন পোশাক পরিলক্ষিত হয়। এটি একমাত্র আমরা মণিপুরী নৃত্যের ক্ষেত্রেই দেখে থাকি।
উপসংহার
মণিপুরী নৃত্যে এত বৈচিত্র্য এত সৌন্দর্য থাকাকালিনও আজ একক মণিপুরী নৃত্য কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। গুরুদের চেষ্টা আজ কোথাও যেন বিফলের দিকে মনে হচ্ছে। একক মণিপুরী নৃত্য শিল্পী অর্থাৎ যে একা একটি অনুষ্ঠান চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট কিংবা এক ঘন্টা করতে সক্ষম হবে। শিল্পী একাই একটি সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকা বাঞ্ছনীয়। গুরুদের মতামতের উপর ভিত্তি করে বলা যায় একক নৃত্যের একটি ক্রম থাকা অর্থাৎ-ভগবানের আরাধনা দিয়ে নৃত্য শুরু করতে হবে ও প্রার্থনার মাধ্যমে শেষ করতে হবে, কিংবা রাসের যে ক্রম বা সংকীর্তনের যে ক্রম আমরা দেখি সেই ক্রম অনুযায়ী নৃত্য সাজাতে হবে। একটা সম্পূর্ন অনুষ্ঠান একক শিল্পীর নৃত্যের দ্বারা প্রদর্শন করার জন্য দরকার শিল্পীর প্রচুর মনোবোল ও নৃত্যের অভ্যাস, অন্যথায় শিল্পীর ক্ষেত্রে একক নৃত্য পরিবেশন করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। এছাড়া মণিপুরী নৃত্যে পোশাকের বৈচিত্র্য যেখানে রাধা বা গোপি করতে হলে ফানেক কিংবা পলোই পরতে হবে আবার তান্ডব করতে হলে ধুতি পরতে হবে, কিন্তু এক ঘন্টার অনুষ্ঠানে শুধু তান্ডব কিংবা শুধু লাস্য করলে দর্শকদের মোহিত করে রাখা সম্ভবপর হবে না। কারন মানুষ বৈচিত্র্য খোঁজে। তথাপি শিল্পী তার নৃত্য পরিকল্পনায় তান্ডব ও লাস্য উভয় নৃত্যই রাখতে একপ্রকারের বাধ্য বলা যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে ওঠে পোশাক পরিবর্তনের। যে সকল শিল্পীরা আজ একক নৃত্য পরিবেশন করছেন তাঁদের সকলের মতামতের ওপর ভিত্তি করে এটা পরিষ্কার যে একক নৃত্য পরিবেশনা কালিন পোশাক পরিবর্তন এক কঠিন বিষয়। কারন অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যে তাঁরা একটি নির্দিষ্ট পোশাকের মাধ্যমেই সম্পূর্ণ নৃত্যানুষ্ঠান করতে সক্ষম, কারন হিসাবে বলা যেতেই পারে যে তাঁদের পোশাক মণিপুরী নৃত্যের পোশাকের ন্যায় সেইরূপ বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়, অর্থাৎ তাঁরা একইরকম পোশাক পরিধান করে তাণ্ডব কিংবা লাস্য করতে সক্ষম। মণিপুরী নৃত্যের ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব নয় কারন মণিপুরী নৃত্যে তাণ্ডব এবং লাস্যে ভিন্ন পোশাক। একটি নৃত্য সমাপ্ত করার পর আর একটি নৃত্যে উত্তীর্ন হওয়া কালীন নৃত্য সম্বন্ধে ধারাভাষ্যের যে ব্যাবধাণ থাকে তা খুববেশি হলে এক মিনিট সেই স্বল্প সময়ে শিল্পীকে তার সম্পূর্ন পোশাক পরিবর্তন করে মঞ্চে উপস্থিত হতে হচ্ছে। ফলে শিল্পী নৃত্য ব্যবধাণের সময়ে কোন ভাবেই বিশ্রামের সময় পাচ্ছে না। সেই সময় শিল্পী ব্যস্ত থাকছে পোশাক পরিবর্তনে ফলস্বরূপ শিল্পীর সম্পূর্ণ মনোযোগ তাঁর পোশাক পরিবর্তনের উপর চলে যায়। সমসাময়িক কালে পোশাক পরিবর্তনটা কঠিন এক সমস্যার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলে একক নৃত্য উপস্থাপন কালীন সকল মণিপুরী নৃত্য শিল্পী একটু ভীতি বোধ করছে। সমসাময়িক কালে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক গুরুই তাঁর নিজ নিজ ঘরানায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শিষ্যদের মণিপুরী নৃত্য শিক্ষাদান করে তাঁদেরকে সুযোগ্য নৃত্য শিল্পী তৈরী করতে। সেক্ষেত্রেও একটু সমস্যা দেখা দিচ্ছে বললে হয়তো ভুল বলা হবে না।
মণিপুরের বাসী অর্থাৎ মৈতৈ জনগোষ্ঠীদের রক্তে নৃত্য বিরাজ মান। কারন হিসাবে বলা যায় তাঁরা ছোট থেকেই নৃত্যের মধ্যেই বড় হয়ে ওঠে। মণিপুরে নৃত্য মানুষের জীবনের সাথে যুক্ত। কাল থেকে অনাদায়ী নৃত্য মানুষের প্রতিদিনের জীবনে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা অধিকার করে আছে। লাই হরাও-বা মণিপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্য। মাইবী ও মাইবারা দেব আহবান থেকে শুরু করে সমস্ত কর্ম সম্পূর্ণ করে এবং গ্রামের সাধারণ মানুষ তাতে অংশ গ্রহন করে। এটি একটি সম্প্রদায় উৎসব যা ২১ শতক ধরে প্রচলিত। ঐতিহ্যবাহী সংকীর্তন ও রাসলীলা চিরকাল জনগণকে মুগ্ধ করে চলেছে। ঐতিহ্যবাহী রাস ও লাই হরাওবা উভয় নৃত্যই ভক্তি মূলক ও ধর্মীয়। প্রাচীণ কাল থেকেই এই দুই নৃত্যই রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। রাজ পরিবার থেকে জ্ঞানী দক্ষশীল যুবক যুবতিদের উৎসাহ করা হত নৃত্য-চর্চা করার জন্য। প্রাচীণ কাল থেকেই গুরু পরম্পরা অনুযায়ী নৃত্য চর্চা করা হত। তরুণ ছেলে মেয়েরা চারুকলার চেয়ে বেশী লাভজনক পেশার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে চলেছে। ফলস্বরুপ ঐতিহ্যবাহী শিল্পীদের ছেলেমেয়েরা নাচের চেয়ে কম্পিউটার শিক্ষা গ্রহন করতে পছন্দ করে। সুতরাং সমস্যাটি কর্মসংস্থানের চারপাশকে কেন্দ্র করেই তৈরী হয়। শৈল্পিক মনোভাব যুক্ত ব্যক্তিরা এমন পেশাগুলিতে আকৃষ্ট হন যেগুলির সনাতন এবং শিল্পের সাথে কোনও সংযোগ নেই। ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা পুরানো দিনগুলির একটি কারন ছিল যখন লোকেরা তাদের নিজস্ব জমি এবং সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল। আধুনিক যুগে লোকেরা বাইরে বিস্তৃত বিশ্বের সংস্পর্শে এসেছে যার ফলে ঐতিহ্যবাহীটিকে আর অলঙ্ঘনীয় বলে বিবেচনা করা হয় না।
বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে কারা নৃত্যের অনুসরণ করছে? স্বাভাবিক ভাবে যারা সত্যিকারের আগ্রহী। এখনকার সময়ে একটি ভালো স্থান পেতে গেলে কমপক্ষে অ্যাকাডেমীক শিক্ষার স্নাতকোত্তর প্রাপ্তি হওয়া জরুরী, যদিও এটিও পর্যাপ্ত পরিমাণের নয়, ভাল অবস্থান পাওয়ার জন্য পি এইচ ডি হওয়া অত্যবশ্যকীয়। যারা গুরুত্ব সহকারে নৃত্য গ্রহণে ঝুঁকছেন তাঁদের অ্যাকাডেমীক শিক্ষার সর্বাধিক সময় ব্যয় করতে হবে। পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রে কীভাবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা যায়? এটি একটি বড় প্রশ্ন এবং এটি এমন একটি সমস্যা যা বর্তমান প্রসঙ্গে গুরুতর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। নট-পালা শিল্পীরা গ্রামে অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধ, বিবাহ এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে থাকে। যার ফলে তরুণ প্রজন্ম শহরগুলিতে এবং গ্রামগুলিতে নট-পালা শিখতে আগ্রহ রাখে। সেই তুলনায় পৃষ্ঠপোষকতা নৃত্যশিল্পীরা পায়না। প্রাচীণকালে সাগল কংজৈই বা এর আগে পোলোকে আচারের সাথে সাথে সম্মানের ক্রীড়া হিসাবে বিবেচনা করা হত। রাজা এবং রাজ পরিবার এই ক্রীড়ায় অংশ নিতেন। এটি শৈল্পিকতর সাথে একটি অত্যাধুনিক ক্রীড়া। সংকীর্তন এবং জগোই এ যেই গুরুরা নৃত্য করতেন তাদের বেশীরভাগই ছিলেন খ্যাতিমান পোলো খেলোয়াড়। ১৯৫৪ সালের পর থেকে গুরু শিষ্য পরম্পরার এক পরিবর্তন ঘটেছিল যখন মণিপুর নৃত্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হল, তখন শিক্ষার্থীরা নৃত্য শিখতে শুরু করে এবং তাদের কাছে প্রশংসাপত্রটি সংগ্রহ করাই উল্লেখযোগ্য স্থান গ্রহন করে। যে শিক্ষার্থীরা ডান্স কলেজ থেকে কিংবা অ্যাকাডেমীক থেকে পাশ করেছেন তারা স্কুল শিক্ষকতার দায়িত্ব পেয়ে থাকেন কিংবা তারা নিজস্ব দল গঠন করে। ইম্ফলে এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যা সরকার দ্বারা অনুমোদিত।
মণিপুরী নৃত্য তার জন্মস্থান মণিপুর থেকে বাইরের জগতে পা রেখেছিল কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে। ১৯১৯ সালে নোবেল জয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে।মণিপুরী নৃত্যের সুলালিত্য পূর্ণ ভঙ্গী, সরল সৌন্দর্য কবিকে বিশেষ ভাবে আকর্ষিত করেছিল। কবি বুঝে ছিলেন মণিপুরী নৃত্যের মাধ্যমেই তাঁর কল্পনার প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। এই ভাবে মণিপুরী নৃত্য বাংলায় এক সর্বস্থান খুঁজে পেয়েছিল। যার পরবর্তী কালে ভারত ও বিদেশের বিভিণ্ণ স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার নৃত্যের ক্ষেত্রে বিশেষত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় মণিপুরী নৃত্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে একমাত্র নৃত্য শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় থেকে অর্থাৎ পাঠভবন থেকে শেখানো হয় এবং সঙ্গীত ভবনে পি. এইচ. ডি পর্যন্ত আছে ।
১৯৭০ সালে যখন সংস্থার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কেবল একটি স্টাইলের নৃত্যকে পাঠদানের ব্যবস্থা শুরু করলেন তখন থেকেই শুরু হল বিশেষীকরণ। মণিপুরী নৃত্যে ও ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহ প্রকাশ করল। সময়ের বদল ঘটল। কিন্তু পড়াশোনার অত্যধিক চাপের ফলে ছেলেমেয়েরা অন্যকিছু বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার সময় বেরকরে উঠতে পারছিল না। এটা সকল নৃত্যের ক্ষেত্রেই সমান সমস্যা তৈরী হয়েছিল কিন্তু তাও কত্থক, ভারতনাট্যম ও ওড়িশি বেশি জনপ্রিয় নৃত্যে রূপ নিলো। কিন্তু মণিপুরী নৃত্য শিল্পীরা তাও হার মানে নি তাঁরা যুদ্ধ করে গিয়েছেন মণিপুরী নৃত্যকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বিশ্বে প্রচার করার জন্য এবং আজ তারা সক্ষম। আজ অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের ন্যায় মণিপুরী নৃত্য জনপ্রিয়। কিন্তু গুরুরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন একক নৃত্যের, একক নৃত্য শিল্পী গড়ে তোলার সেটি কতটা সম্ভবপর হয়েছে। তা আজও প্রশ্ন? গুরু বিপিন সিং একজন জ্ঞানী, বুদ্ধিমান পণ্ডিত ছিলেন। নৃত্যে নতুন নতুন তাল, বোল, গান ব্যবহার করে মণিপুরী নৃত্যে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছেন। তিনি প্রথম যিনি মহিলাদেরও পুং চর্চা করিয়ে ছিলেন। তার ঘরানা আজ যথেষ্ট জনপ্রিয়। বাংলাদেশে এমন বহু শিল্পী আছেন যারা তার ঘরানায় সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী। এছাড়া কলকাতায় তার প্রতিষ্ঠানে বহু নৃত্য শিল্পী তৈরী হচ্ছে যারা মণিপুরী নৃত্য চর্চা করছে। গুরু কলাবতী দেবী ও বিম্বাবতি দেবী দুজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত নৃত্য শিল্পী। সমসাময়িক কালে বিম্বাবতি দেবী একজন খ্যাতি নামা একক মণিপুরী নৃত্য শিল্পী।
গুরু বিপিন সিং ঘরানাকে সযত্নে বহন করছেন কলকাতায় বিম্বাবতি দেবী। বোম্বে পদ্মশ্রী গুরু দর্শনা ঝাভেরী গুরুজীর ঘরানাকে বহন করছেন। তিনি এবং তাঁর বোনেরা সকলে মিলে গুরুজীর সাথে প্রচুর কাজ করেছেন। বহু পুঁথি ও তথ্য তাঁরা গুরুজীর সহযোগিতায় সংগ্রহ করেছেন। এবং পরবর্তী কালে শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রীতি প্যাটেল যারা এই ঘরানাকে সযত্নে বহন করছেন। একক মণিপুরী নৃত্য শিল্পী হিসাবে এনারা সকলেই বহু কাজ করেছেন কিন্তু তাও একক মণিপুরী নৃত্য কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। কলকাতা কিংবা শান্তিনিকেতন যেখানেই মণিপুরী নৃত্যশিল্পীরা আছে তাদের সকলের একমত।

গ্রন্থপঞ্জী:
১। বসু ড. সুমিত, পৃষ্ঠা- ৯৪
২। তদেব।
৩ চৌধুরী আবুল আহসান, অন্তরঙ্গ দেবযানী, শোভা প্রকাশ ঢাকা, ২০১৬ মে ১০ই, পৃষ্ঠা: ১৭
৪ । তদেব।
৫। তদেব ।
৬। তদেব।
৭।চৌধুরী আবুল আহসান, অন্তরঙ্গ দেবযানী, শোভা প্রকাশ ঢাকা, ২০১৬ মে ১০ই, পৃষ্ঠা: ৮৯
৮। তদেব। পৃষ্ঠা: ৯০
৯। তদেব। পৃষ্ঠা: ১৯
১০- তদেব
১১। তদেব। পৃষ্ঠা: ১১৮
১২। তদেব। পৃষ্ঠা: ১৫৭
১৩। তদেব। পৃষ্ঠা: ১৫৫
১৪। darshanajhaveri.com
১৫। https://bit.ly/30T1J0i
১৬। darshanajhaveri.com
১৭। https://rb.gy/uirewm
১৮। তদেব।
১৯। তদেব।
২০। তদেব।
২১। https://rb.gy/5oi2ol
২২। তদেব।
২৩। তদেব।
২৪। https://rb.gy/hqfytn
২৫। Bandopadhay Dr. Sruti, Manipuri Dance, an Assesment on History and Presentation, Shubhi Publication, New Delhi – 16, 2010. PP-423
২৬। https://rb.gy/kxpdcr
২৭। তদেব।
২৮। https://rb.gy/ofqmjd
২৯। গুরু রঞ্জিৎ অধিকারীময়ূম শর্ম্মার সাক্ষাৎকার।
৩০। তদেব ।
৩১। https://bit.ly/2GPyvZx
৩২। https://bit.ly/2FkmwT3
৩৩। https://rb.gy/fmoti0
৩৪। তদেব ।
৩৫। তদেব ।
৩৬। https://bit.ly/3jKEdKm
৩৭। https://bit.ly/30V1PVr
৩৮। https://bit.ly/3lAmYvY
৩৯। https://rb.gy/stddg0