সারাংশ (Abstract):
পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ (১৯০৯–১৯৯৭) ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে এক বিশিষ্ট তবলাবাদক, শিক্ষক, সুরকার, গবেষক ও সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর সৃজনশীল প্রচেষ্টা এবং গুরুশিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে কলকাতায় তবলার এক নবজাগরণের সূচনা হয়। তিনি ফরুকাবাদ, লখনউ এবং পাঞ্জাব ঘরানার শৈলীসমূহকে একত্রিত করে এক নতুন বাদনরীতি গঠন করেন, যা তবলার একক পরিবেশনায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবলাকে তিনি সঙ্গত যন্ত্রের গণ্ডি থেকে তুলে এনে একক বাদ্যযন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠা করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং দূরদর্শনে সংগীত পরিচালক হিসেবে তাঁর অবদান তবলাকে প্রধান স্রোতের সঙ্গীতে এক অনন্য স্থান দিয়েছে। তাঁর শিষ্যগণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তবলার ঐতিহ্যকে বহন করেছেন। “তাহজিব-এ-মৌসিকি” নামক গ্রন্থে তিনি তবলা ও ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কর্মজীবন কলকাতাকে তবলার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে।
মূল শব্দ (Key Words):
পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, তবলা, কলকাতা, একক তবলা পরিবেশনা, গুরুশিষ্য পরম্পরা, তবলা ঘরানা, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সুরকার, সঙ্গীত গবেষক, অল ইন্ডিয়া রেডিও, সাংস্কৃতিক দূত, তাহজিব-এ-মৌসিকি।
জ্ঞানবাবু একজন বিখ্যাত তবলাগুরু, সঙ্গীতগুরু, সঙ্গীত গবেষক, সুরকার, শিক্ষক এবং সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন যার হাত ধরে কলকাতায় তবলার ক্রম-বিকাশ হয়| কলকাতাকে তবলা সঙ্গীতের মূল কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ফারুখাবাদ, লখনউ এবং পাঞ্জাব ঘরানার শৈলীগুলিকে নির্বিঘ্নে মিশ্রিত করেছিলেন, যার মধ্য় দিয়ে উদ্ভাবনী তবলা শৈলী তৈরি করেছিলেন যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সঙ্গীতজ্ঞদের উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। পণ্ডিত ঘোষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল একক তবলা পরিবেশনা (Tabla Solo )। তিনি সু-স্পষ্টতা, ছন্দময় নির্ভুলতা এবং লয়ের উপর নানান লয়কারী ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়| যা তবলার একক উপস্থাপনের পদ্ধতিতে বিপ্লব এনেছিল এবং ছন্দময় নির্ভুলতার দৃষ্টিভঙ্গি তবলার ধারণাকে বদলে দিয়েছিল, পরিবেশনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাক পালন করেছিল।একজন সঙ্গীতগুরু হিসাবে, পণ্ডিত জ্ঞানবাবুর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তাঁর শিষ্যদের মধ্য় পন্ডিত কানাই দত্ত, পন্ডিত নিখিল ঘোষ, পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ এবং পণ্ডিত অনিন্দ্য চ্যাটার্জী তবলা শিল্পকলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং উত্তরাধিকার অব্যাহত রেখেছেন| শিষ্যরা তার তবলার ঐতিহ্যের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জ্ঞানবাবু অল ইন্ডিয়া রেডিও (এআইআর) কলকাতা এবং দূরদর্শনে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যার মধ্য় দিয়ে তবলা এবং সঙ্গীতের বিভিন্ন সঙ্গীত ধারার সাথে একীভূত করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, বাংলা আধুনিক গান এবং চলচ্চিত্র সঙ্গীত। জ্ঞানবাবুর গবেষণা-ভিত্তিক বই “তাহজিব-এ-মৌসিকি” তবলার ইতিহাস এবং সঙ্গীত সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন।তাঁর অগ্রণী কাজের মাধ্যমে তবলাকে কেবল একটি শাস্ত্রীয় যন্ত্র হিসেবেই উন্নত করেননি বরং এটিকে একক বাদ্যযন্ত্র হিসাবে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিলেন|
ভূমিকা:- সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন পদ্মভূষণ পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ| ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে বিশিষ্ট গুণীজনদের মধ্যে অন্যতম পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, যিনি শুধু একজন তবলাবাদকই নন, বরং একজন সংগীত-গবেষক, শিক্ষক, সুরকার, এবং সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে তবলার বিস্তারে এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন। “কলকাতা সঙ্গীতের প্রাণকেন্দ্র” হিসাবে পরিচিত, এই শহরে তবলার বিস্তার, প্রসার এবং জনপ্রিয়তার করবার ক্ষেত্রে জ্ঞানবাবুর অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায়, সাধনা, শিক্ষাদানের কৌশলের ফলে সম্ভব হয়েছে । তবলা সঙ্গীতে পণ্ডিত ঘোষের অবদান কলকাতাকে তবলা শিক্ষা এবং পরিবেশনার একটি মূল কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর প্রভাবে শহরটি কেবল তবলা শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, বরং এমন একটি জায়গা যেখানে তবলা সঙ্গীতের বিকাশ ঘটে এবং তার প্রাপ্য স্বীকৃতি লাভ করে। তাঁর প্রচেষ্টা কলকাতাকে ভারতের সঙ্গীত ভূদৃশ্যের শীর্ষে স্থান দিতে সাহায্য করেছে, এটি তবলা বাদক এবং সঙ্গীত প্রেমীদের জন্য একটি গুরুতপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছিল।
পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ কেবল তবলার একজন তবলা গুরু ছিলেন না বরং একজন সঙ্গীত গুরু ছিলেন| যিনি কলকাতার তবলা ঐতিহ্য গঠন এবং এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তখনকার সময় তিনি বিনা পরিশ্রমে তবলা শিক্ষা ও সঙ্গীত শিক্ষা দান করতেন| পণ্ডিত জ্ঞানবাবুর অবদান, পরিবেশনা, শিক্ষা এবং গবেষণা, ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের জগতে একটি বিশেষ চিহ্ন রেখে গেছে, যার কারণে ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্থান করে নিয়েছেন। জ্ঞানবাবুর নতুন-নতুন উদ্ভাবন, নিষ্ঠা এবং শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, কলকাতার তবলাকে উন্নীত করেছেন, এটিকে একটি ধ্রুপদী যন্ত্র থেকে সাংস্কৃতিক মর্যাদা এবং উৎকর্ষতার প্রতীকে রূপান্তরিত করেছেন যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সঙ্গীতজ্ঞ এবং সঙ্গীতপ্রেমীদের অনুপেরণা যোগাবে|
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গতের ক্ষেত্রে তবলার ব্যবহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্রগুলির মধ্যে একটি, যা উত্তর ভারতীয় এবং আঞ্চলিক উভয় ক্ষেত্রেই তবলার ব্যবহার হয়ে থাকে| শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, সঙ্গত/সহযোগী যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে| এই রূপান্তরে ক্ষেত্রে পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের এক অনন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি তবলাকে সঙ্গত থেকে একক তবলা বাদনের রীতি চালু করেন| এই যাত্রায় তাঁর অবদান বহুমুখী ছিল – তিনি কেবল একজন ব্যতিক্রমী তবলা বাদকই ছিলেন না বরং একজন গুরু, সুরকার, গবেষক এবং ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রবর্তকও ছিলেন।
প্রাথমিক জীবন এবং সঙ্গীত প্রশিক্ষণ
পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ ০৮ মে ১৯০৯ সালে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায় এক সাঙ্গীতিক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতামহ দ্বারকানাথ ঘোষ ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ “দ্বারকিন” কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা যিনি হারমোনিয়াম বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভাবক ছিলেন| তাঁহার পিতার নাম ছিল কিরণচন্দ্র ঘোষ তিনি ছিলেন একজন সংগীতানুরাগী এবং মাতার নাম ছিল নলিনীবালা ঘোষ। সাঙ্গীতিক পরিবারে জন্ম হওয়ায় সঙ্গীতের প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী ছিল এবং ছোটবেলা থেকেই তানপুরা ও কণ্ঠসঙ্গীতের সাথে পরিচিত হন, তবে পরবর্তীতে তালবাদ্য—বিশেষত তবলার প্রতি আকৃষ্ট হন।তিনি অল্প বয়স থেকেই বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীতের প্রভাবের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এই পরিবেশ তার সঙ্গীত শৈল্পিক যাত্রা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
জ্ঞানবাবুর মাত্র ৭ বছর বয়সে তবলা-শিক্ষায় হতেখড়ি হয় টনিবাবুর নিকট|পরবর্তী সময়ে উস্তাদ মসীত খাঁ,আজিম খাঁ এবং ফিরোজ খাঁ এর নিকট তবলা-শিক্ষা গ্রহণ করেন| তিনি নবদ্বীপ ব্রজবাসীর কাছে শ্রীখোল এবং চন্দননগরের বিপিন ঘোষের কাছে পাখোয়াজ শিক্ষা লাভ করেন|কণ্ঠসঙ্গীতে শিক্ষা শুরু করেন- উস্তাদ সগীরুদ্দিন খাঁ, পন্ডিত গিরিজা শঙ্কর চক্রবর্তী, উস্তাদ দবীর খাঁ এবং শব্বন খাঁর নিকট| এছাড়া উস্তাদ খুশি মহম্মদের কাছে হারমোনিয়াম বাদনের তালিম গ্রহণ করেন|
তবলায় মৌলিক শিক্ষা ও ঘরানার সম্মিলন
জ্ঞানবাবুর সংগীতচর্চার একটি বিশেষ দিক ছিল বিভিন্ন তবলার ঘরানার শৈলী একত্রিত করা। পণ্ডিত ঘোষ নিজেকে একটি নির্দিষ্ট ঘরানার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং ফরুকাবাদ, দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, বেনারস, এবং আজরার ঘরানার বাজগুলি একত্রিত করে নতুন-নতুন বোল-বাণী তৈরি করতেন। জ্ঞানবাবুর বাদন-শৈলী বিভিন্ন উস্তাদের কাছে তালিম নেবার জন্য এবং নিজের প্রতিভার মধ্য় গুণে প্রায় প্রত্যেকটি ঘরাণার বাজ আয়ত করে নিয়েছিলেন। যার ফলে বিভিন্ন ঘরাণার বাজ একত্রে তাঁর বাদনে বিশেষ রূপদান করে বিভিন্ন লয়কারী এবং বোলের মিষ্টটা মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল| তাই তার বাদনে নূতনত্বের সঙ্গে-সঙ্গে মিষ্টত্বের সংমিশ্রণ এক সুন্দর অনন্যতা এনে দিয়েছে। গাব, কানি এবং বাঁয়ার কাজের সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগকলায় তিনি ছিলেন খুবই সিদ্ধহস্ত, যার ফলে তবলার সুমধুর ধ্বনি উত্পন্ন করে সঙ্গীত প্রেমী মানুষকে আনন্দ দান করতেন।
কলকাতায় তবলার বিকাশে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ভূমিকা
শিক্ষা ও গুরুশিষ্য পরম্পরার নবজাগরণ: পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ একজন শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। পণ্ডিত ঘোষ তাঁর শিক্ষাদানে গভীর মনস্তত্ত্ব এবং রচনাশৈলীকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি শিষ্যদের তবলার তত্ত্ব, কাঠামো, স্বরবিন্যাস, রচনার মূলনীতি, সঙ্গত এবং রাগতত্ত্ব শেখাতেন। শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গি কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতার উপরই নয়, সঙ্গীতের দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা, সৃজনশীলতা এবং প্রকাশভঙ্গির উপরও জোর দেয়। তিনি তার ছাত্রদের ঐতিহ্যবাহী ঘরাণার রচনাগুলির গভীর উপলব্ধি বজায় রেখে তাদের নিজস্ব শৈলী বিকাশ করতে উৎসাহিত করেছিলেন।তিনি বহু শিষ্যকে তবলার উচ্চমানের শিক্ষা দেন, যাঁদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো:-
পন্ডিত কানাই দত্ত
পন্ডিত নিখিল ঘোষ
পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ
পণ্ডিত শ্যামল বসু
পন্ডিত সঞ্জয় মুখার্জী
পণ্ডিত অনিন্দ্য চ্যাটার্জী
পণ্ডিত পরিমল চক্রবর্তী,
পন্ডিত অভিজিৎ ব্যানার্জী
পুত্র মল্লার ঘোষ
পন্ডিত নিখিল ঘোষ, পন্ডিত কানাই দত্ত, পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ, পণ্ডিত অনিন্দ্য চ্যাটার্জী এবং পণ্ডিত পরিমল চক্রবর্তীর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সহ তাঁর অনেক ছাত্র বিশ্বজুড়ে তবলা সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে এই অবদানগুলি নিশ্চিত করেছে যে তবলা ঐতিহ্যের উপর তাঁর প্রভাব জীবিত রয়েছে, সেই সাথে নতুন প্রজন্মের তবলা প্রেমীদের তাঁর শিক্ষার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম করেছে।এই ছাত্ররা শুধু ভারতের নয়, সারাবিশ্বে ভারতীয় তবলার মানচিত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে।
পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের একটি রচনা ঝাঁপতালের ওপর-
ঝাঁপতাল – কামালী পরণ (জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ)
| ধা তেটেকতাগদিঘেনে | ধাতে – টে ক- |
| তাগ –দি | ঘে— নেধা তেটেকতা |
| গদিঘেনে ধাতে | –টেক তাগ -দিঘে |
| নেধা তেটেকতাগদিঘেনে | ধাতেটেকতা গদিঘেনেধা তেটেকতাগদিঘেনে |
| ধাধা তেটেকতাগদিঘেনে | ধাতেটেকতা গদিঘেনেধা তেটেকতাগদিঘেনে |
| ধাধা তেটেকতাগদিঘেনে | ধাতেটেকতা গদিঘেনেধা তেটেকতাগদিঘেনে | ধা+
সংগীত জীবনে তিনি অজস্র শিষ্য-প্রশিষ্য তৈরী করেছেন এবং তাদের সাফল্যের উচ্চশিখরে লৌছে দিয়েছেন।তাঁদের মধ্যে কণ্ঠসংগীতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো:
সহধর্মিণী ললিতা ঘোষ
অজয় চক্রবতী
অরুণ ভাদুড়ী
প্রসুন ব্যানার্জী
তনিমা ঠাকুর
বাণী কোনার
রেবা ঘোষ
শীলা মুখোপাধ্যায়
পূর্ণিমা ঠাকুর
উমা দে
তবলার একক রূপ এবং সংগীত-সহচর থেকে মূল শিল্পে উত্তরণ: তবলা দীর্ঘদিন ধরে শুধু সহচর বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। তিনি বুঝেছিলেন তবলা শুধু সঙ্গতের জন্য নয়, বরং এর নিজস্ব সৃজনশীল জগৎ রয়েছে। জ্ঞানবাবু তবলাকে একটি একক বাদ্যযন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় কলকাতায় একক তবলা অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
রাগাশ্রয়ী তবলা রচনার সূচনা: এক সৃজনশীল বিপ্লব
পণ্ডিত ঘোষ ভারতীয় রাগসঙ্গীতের কাঠামোর মধ্যেই তবলার নতুন-নতুন রচনা তৈরি শুরু করেন। তিনি দেখান যে রাগের সংবেদনশীলতা এবং লয়বোধ তবলার মধ্যেও ব্যক্ত করা যায়। তাই তিনি একটি রাগ রচনা করেছিলেন “ভৈরবী টুকড়া” নামে এবং এখানেই তিনি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান রাখেন যা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি বিশেষ রচনা| তিনি তার সাঙ্গীতিক নৈপুণে যেখানে তিনি রাগের আবহে তবলার বোল ও রচনা সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করে মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন| যার ফলে শ্রোতার মনে সঙ্গীতের ‘সুর-তাল-রাগ’ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন|
তবলা এবং অন্যান্য সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ
পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের সঙ্গীত শিক্ষা ছিল বিস্তৃত এবং সুদূরপ্রসারী, তবলায় তার দক্ষতা তার কর্মজীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও, ঘোষের প্রশিক্ষণে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিস্তৃত রূপ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার ফলে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ও সমান দক্ষতার পরিচয় দেখতে পাওয়া যায়| তিনি ধ্রুপদ, ধামার এবং খেয়ালে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন, যা সুর কণ্ঠসঙ্গীত এবং ছন্দবদ্ধ কাঠামো সম্পর্কে তার জ্ঞানকে আরও গভীর করে তুলেছিল। এই বিস্তৃত সঙ্গীত অভিজ্ঞতা তাকে তালের সাথে সুরের মিশ্রণ ঘটাতে সাহায্য করেছিল, যা উদ্ভাবনী এবং অত্যন্ত অভিব্যক্তিপূর্ণ ছিল। এই বৈচিত্র্যময় রূপগুলি সম্পর্কে তার বোধগম্যতা তাকে একটি অনন্য দৃষ্টিকোণ থেকে তবলা বাজানোর পদ্ধতি গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল, কারণ তিনি জটিল ছন্দময় তবলার বোল-বাণী গুলিকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম ছিলেন এবং সঙ্গীতের সূক্ষ্মরূপ ও নিখুঁত বাজনার মধ্য় দিয়ে সঙ্গীতের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। ছন্দ এবং সুরকে নির্বিঘ্নে একত্রিত করার তার ক্ষমতা তবলার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছিল, যা তাকে সবচেয়ে উদ্ভাবনী এবং সম্মানিত শিল্পীদের একজন হিসেবে পরিচিত করেছিল। এই বিস্তৃত সঙ্গীত ভিত্তি তার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি ছিল এবং আজও তবলা বাদকদের প্রভাবিত করে চলেছে।
তবলা বাদনের আধুনিকতায় পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ অবদান
সঙ্গত থেকে একক পরিবেশনা:- ঐতিহাসিকভাবে তবলা মূলত কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনার জন্য একটি সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে, জ্ঞানবাবু একক যন্ত্র হিসেবে তবলার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন। তার প্রচেষ্টার ফলে সুগঠিত তবলা একক বাজনার বিকাশ ঘটে, তবলায় থাকা নানা রকম শব্দ আর জটিল ছন্দের দিকগুলোকে সুন্দরভাবে তুলে তবলার একক বাজনার বিকাশ ঘটান।তবলা এককের উপস্থাপনাকে সুন্দর ভাবে তিনি একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন যেখানে রচনাগুলি একটি কাঠামোগত পদ্ধতিতে পরিবেশিত হতো| যেখানে পেশকার, কায়দা, রেলা, গৎ, টুকরা এবং চক্রধরের মতো বিভিন্ন উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার প্রচেষ্টায় তবলা একক ঐতিহ্যগতভাবে কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত সুরের সাথে অভ্যস্ত শ্রোতাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।
নতুন রচনা সৃষ্টিতে ভূমিকা: জ্ঞানবাবু নতুন-নতুন তবলার রচনা সৃষ্টিতে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে সঙ্গীত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন| তিনি অনেক তবলা রচনা করেছিলেন যা বাদ্যযন্ত্রের ভাণ্ডারকে প্রসারিত করেছিল| তার রচনাগুলির মধ্যে ছিল উদ্ভাবনী কায়দা এবং রেলা যা ঐতিহ্যবাহী বাজের সাথে আধুনিক ছন্দময় বাক্য দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। গৎ এবং চক্রদার নতুন রূপে জটিল গাণিতিক কাঠামোকে অভিব্যক্তিপূর্ণ বাক্যাংশের সাথে মিশ্রিত করে তৈরি করেছিলেন। তিনি লোকসঙ্গীত, ধ্রুপদ, আধুনিক ধারার সুর ও ছন্দ একত্র করে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর রচনাগুলি এখনও ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করা হয় এবং পরিবেশিত হয়| তাঁর সৃষ্টি ছিল এক নতুন ধারার সূচনা, যেখানে প্রাচীন তালের নান্দনিকতা মিলিয়ে এসব রচনার সৃষ্টি করেন| যার মধ্য় দিয়ে ধ্রুপদ ও তবলার জটিল ছন্দের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল। সঙ্গীতচর্চায় তিনি এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন, নতুন পথের দিশা দেখান, সঙ্গীতকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন। পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের একটি রচনা ঝাঁপতালের ওপর-
ঝাঁপতাল – টুকড়া (জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ)
| তাকিটেতাকিটে তাকিটেতাকিটে | ধেনেঘেড়েনাগ তাক্রাণ্ ধা-|
| তাকতাকতাক তাকতাকতাক | ঘেঘেঘে ঘেঘেঘে ঘেনতড়ান্|
| ধাথুনা কৎ- – | ধা– থুনাকৎ -তে |
| টেক তাগ | দিঘে -নেধা তেটেকতাগদিঘেনে|
| ধাতেটেকতা গদিঘেনেধা | ক্রেধেৎতা কেটেতাকধেরেধেরে কেটেতাকধাতেরে|
| কেটেতাকতাকিটে ধা– | ধাতেটেকতা গদিঘেনেধা ক্রেধেৎতা|
| কেটেতাকধেরেধেরে কেটেতাকধাতেরে| কেটেতাকতাকিটে ধা– ধাতেটেকতা |
| গদিঘেনেধা ক্রেধেৎতা |কেটেতাকধেরেধেরে কেটেতাকধাতেরে কেটেতাকতাকিটে|ধা+
বাদ্যযন্ত্র সহযোগিতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা: পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ ছিলেন একজন দূরদর্শী যিনি ঐতিহ্যবাহী ধ্রুপদী সঙ্গীতের বাইরে তবলার ভূমিকা প্রসারিত করেছিলেন। তিনি যুগান্তকারী সহযোগিতার পথিকৃৎ ছিলেন, পাখোয়াজ এবং মৃদঙ্গমের মতো বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাথে তবলাকে সংযুক্ত করেছিলেন, বিভিন্ন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র ঐতিহ্যের মধ্যে গতিশীল ছন্দবদ্ধ বোল-বাণী তৈরি করেছিলেন। তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, জ্ঞানবাবু সেতার এবং সরোদের মতো তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্রের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন, যেখানে তবলা কেবল সঙ্গত বাদ্য ছিল না বরং একটি অভিব্যক্তিপূর্ণ অংশীদার ছিল, সঙ্গীতকে আর সুন্দর ও প্রাণবন্ত করে তুলতো । Western Musical Instruments, Jazz Music And Fusion Music সঙ্গীতের সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবলাকে বিশ্বায়ন করতে এবং আন্তর্জাতিক শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
সঙ্গীতে অন্যান্য অবদান
বাংলা ধ্রুপদ ও ধামার পুনরুজ্জীবন:- জ্ঞানবাবুর গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির মধ্যে একটি ছিল বাংলা ধ্রুপদ ও ধামার পুনরুজ্জীবিত করে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। একসময় বাংলার ধ্রুপদী সঙ্গীত ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এই ধারাগুলি ম্লান হতে শুরু করেছিল| এগুলিকে মূলধারার পরিবেশনায় ফিরিয়ে আনার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি এই ধারাগুলির ছন্দময় সৌন্দর্যকে তুলে ধরে অনেকগুলি গানও রচনা ও করেছিলেন, যার ফলে বাংলা ধ্রুপদ ও ধামার গানের উন্নতি শুরু হয়েছিল।
লোক ও ধ্রুপদী সঙ্গীতের সেতুবন্ধন:- জ্ঞানবাবু লোকসঙ্গীতের প্রতি গভীর উপলব্ধি পোষণ করতেন এবং এর ছন্দময় সঙ্গীতকে উন্নতির কথা মাথায় রেখে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক লোকসঙ্গীতের উপাদানগুলিকে তাঁর রচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যা এগুলিকে আরও প্রাণবন্ত এবং আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। লোকসঙ্গীত এবং ধ্রুপদী ঐতিহ্যের মধ্যে ব্যবধান দূর করতে সাহায্য করেছিল, যার মধ্য় দিয়ে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সাথে বৃহত্তর শ্রোতাদের সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছিল।
অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং দূরদর্শনে অবদান
পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত সম্প্রচারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন একথা বলা যায়| অল ইন্ডিয়া রেডিও (এআইআর) এবং দূরদর্শনের মাধ্যমে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং তবলাবাদনের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার অবদানের মধ্যে রয়েছে: ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনুষ্ঠান পরিচালনা করা এবং শ্রোতাদের কাছে নতুন শিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তবলাবাদনের উপর শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান তৈরি করা। তার প্রচেষ্টা নিশ্চিত করেছিল যে তবলা সঙ্গীত সারা ভারতের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন যা অনেক তরুণ তবলা বাদককে অনুপ্রাণিত করেছিল।
একজন শিক্ষক হিসেবে, পণ্ডিত ঘোষ ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তাঁর জ্ঞান এবং দক্ষতা প্রেরণের জন্য গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি অগণিত ছাত্রদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, কেবল তবলা বাজানোর প্রযুক্তিগত দিকগুলিই নয় বরং তাল এবং শব্দের সাথে গভীর মানসিক সংযোগও প্রদান করেছিলেন যা তাঁর নিজস্ব বাজনা শৈলীকে সংজ্ঞায়িত করেছিল। শিক্ষাদানের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা তবলা বাজানোর সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং প্রচারে সহায়তা করেছিল| জ্ঞানবাবু সঙ্গীত কৃতিত্বের পাশাপাশি, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে বাদ্যযন্ত্রের শিল্পকে প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবলা এবং সঙ্গীত শিল্পীদের উন্নতি করবার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা সত্যি অনেক প্রশংসনীয়| পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের উত্তরাধিকার সঙ্গীতজ্ঞদের অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত করে চলেছে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে তার মর্যাদাকে সুদৃঢ় করেছে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর প্রভাব
পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তবলা বাদকদের উত্সাহিত করেছে। তাঁর শিক্ষা প্রাপ্তির মধ্য় দিয়ে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ ও সম্মানিত তবলা শিল্পীদের গড়ে তুলেছে। জ্ঞানবাবুর রচনাগুলি ধ্রুপদী তবলা ভাণ্ডারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং মর্যাদাপূর্ণ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উৎসবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। তবলার জটিল ছন্দ এবং উদ্ভাবনী কাঠামোর জন্য পরিচিত তাঁর রচনাগুলি সঙ্গীতজ্ঞদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে এবং একজন সুরকার হিসেবে তাঁর প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়।তিনি একাধিক বংলা সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেন| তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হল :
বসন্তবাহার
যদুভট্ট
আশা
রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত
আঁধারে আলো
জ্ঞানবাবু তবলার একক পরিবেশনার ক্ষেত্রে বোলের মিষ্টটা, লয়কারী, বিভিন্ন বাজকে নতুন রূপে প্রকাশ করতেন| জ্ঞানবাবুর অবদান ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতে তবলাকে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় উন্নীত করেছে, যা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতে ছড়িয়ে পড়ে।ভারতীয় তবলা বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রে পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের অবদান অপরিসীম| ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সংরক্ষণের সাথে সাথে উদ্ভাবনের জন্য প্রচেষ্টা করার জন্য সঙ্গীতজ্ঞদের অনুপ্রাণিত করছেন। তবলার উপর তাঁর প্রভাব এই যন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং এর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন|
জ্ঞানবাবুর দৃষ্টিভঙ্গিতে কলকাতায় আধুনিক তবলা বাজনার ভিত্তি স্থাপন করেছিল, নিশ্চিত করেছিল যে যন্ত্রটি কেবল একটি ছন্দময় সঙ্গত যন্ত্র নয় বরং আত্ম-প্রকাশের একটি শক্তিশালী রূপ।যার মধ্য় দিয়ে অগণিত শিষ্য সঙ্গীতজ্ঞদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কলকাতায় তবলার বিবর্তন এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জ্ঞানবাবুর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে আগামী প্রজন্মের কাছে|
জ্ঞানবাবু তবলার গভীর জ্ঞান, বিভিন্ন ঘরানার মিশ্রণের দক্ষতার সাথে মিলিত করে একটি স্বতন্ত্র এবং অনন্য বাজ তৈরি করেছিলেন, যা আজও তবলা বাদকদের প্রভাবিত করে। ফারুখাবাদ, লখনউ এবং পাঞ্জাব ঘরানার বাজগুলিকে একত্রিত করেন, তিনি বিভিন্ন ঐতিহ্যকে একটি সুসংগত তবলার বাজে পরিণত করেন| বিভিন্ন বাজের এই উদ্ভাবন, ছন্দবদ্ধ ধরণের নির্ভুলতা এবং স্পষ্টতার প্রতি তার সূক্ষ্ম মনোযোগের সাথে, তবলা পরিবেশনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। জ্ঞানবাবুর কাজ কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতার অনুশীলন ছিল না বরং তিনি তবলা এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রতিভার প্রতিফলন করতেন।
পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের প্রভাব কেবল তার পরিবেশনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। একজন শিক্ষক, গুরু হিসাবে তিনি তার শিষ্যদের প্রশিক্ষণ এবং লালন-পালনেরমাধ্যমে বিখ্যাত তবলা বাদককে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন|জ্ঞানবাবু নিশ্চিত করেছিলেন যে তার উত্তরাধিকার তার শিষ্যদের দ্বারা এগিয়ে যাবে। তার শিক্ষার মাধ্যমে, তিনি কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতাই নয়, ছন্দ এবং সঙ্গীতের গভীর উপলব্ধিও স্থাপন করেছিলেন।
বিভিন্ন সংগীত প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক মিশনের নেতৃত্ব
পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সংগঠিত করেন এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় তবলা এবং ধ্রুপদ সঙ্গীতকে প্রতিনিধিত্ব করেন। জ্ঞানবাবু নিজও উদ্যোগে তবলার মান রক্ষা করতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রশিক্ষণ ও গবেষণার পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন।
Doordarshan এবং All India Radio-তে দীর্ঘদিন ধরে সংগীত পরিচালক নিযুক্ত ছিলেন এবং সঙ্গীতের বিকাশ করেন।
১৯৫৪ সালে ভারতের সাংস্কৃতিক দলের প্রধান হয়ে তিনি রাশিয়া, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভানিয়া ইত্যাদি দেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন|
১৯৬৮ সালে সৌরভ একাডেমী অফ মিউজিক নামে একটি সঙ্গীত স্কুল স্থাপন করেন|
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
পণ্ডিত ঘোষ তাঁর কর্মজীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ সম্মান প্রাপ্তি লাভ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:-
১৯৭৫ সালে সংগীত নাটক একাদেমী তাঁকে “রত্নসদস্য” এবং ফেলোশিপ সম্মানে ভূষিত করেন।
১৯৮০ সালে “ভট্টওয়ালকা” সম্মানে ভূষিত করেন|
১৯৮৪ সালে “পদ্মভূষণ” ও বম্বের সুর-সংসদ কর্তৃক ফেলোশিফ সম্মানে ভূষিত করেন|
১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক “আলাউদ্দিন পুরস্কার” সম্মানে ভূষিত করেন|
১৯৮৮ সালে বিশ্বভারতী কর্তৃক “দেশিকোত্তম” সম্মানে ভূষিত করেন|
রবীন্দ্রভারতী ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় হতে ষান্মানিক “D.Litt” সম্মানে ভূষিত করেন|
১৯৭৮ সালে রামচরিত মানসের সাংগীতিক রূপায়নের জন্য তিনি এশিয়ান রামায়ণ কনফারেন্স কানপুরে তাঁকে সর্বোচ্চ উপাধিতে অলংকৃত করেন।
১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত গ্রন্থ “তহজীব-এ-মৌসিকী”।
উপসংহার
কলকাতা দূরদর্শনে মতো প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত ছিলেন, একজন বহুমুখী সঙ্গীতজ্ঞ এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর খ্যাতি আরও দৃঢ় করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর কার্যকাল তবলাকে বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন| যার ফলে ধ্রুপদী সঙ্গীতের বাইরেও এর প্রসারিত হয়েছিল। রবীন্দ্র সঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান, এমনকি চলচ্চিত্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও পণ্ডিত ঘোষ দক্ষতার সাথে তবলাকে একীভূত করেছিলেন, এর বহুমুখীতা প্রদর্শন করেছিলেন এবং বৃহত্তর শ্রোতাদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিলেন। আকাশবাণী এবং দূরদর্শনে তাঁর কাজ কেবল তবলা পরিবেশনার পরিধিই প্রসারিত করেনি বরং মূলধারার গণমাধ্যমে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সামগ্রিক উন্নতিতেও গুরুতপূর্ণ অবদান রেখেছে।
পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ছিলেন এমন একজন সংগীতশিল্পী, যিনি একাধারে তবলা বাদক গবেষক, শিক্ষা-প্রদানকারী গুরু, সৃষ্টিশীল সুরকার, এবং সাংস্কৃতিক রূপকার। তিনি শুধু কলকাতার তবলা জগতে নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় সংগীতচর্চার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কলকাতায় তবলার উত্থান, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং জনপ্রিয়তার পিছনে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন যা ষততী প্রশংসনীয় ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে জ্ঞানবাবুর যার সারণাক্ষর লিখা থাকবে। বর্তমান প্রজন্ম তার পথ অনুসরণ করে তবলাকে বিশ্বসংগীতের মঞ্চে এক বিশেষ উচ্চতায় স্থাপন করেছে|
পণ্ডিত ঘোষের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তাঁর লিখিত রচনা, বিশেষ করে তাঁর “তাহজিব-এ-মৌসিকি” বইটি, যা তবলার ইতিহাস এবং বিবর্তনের একটি বিস্তৃত অধ্যয়ন প্রদান করে। এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর বিশাল জ্ঞান এবং গবেষণা তুলে ধরেছেন| শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তবলার ভূমিকা সম্পর্কে একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন। এই কাজটি অমূল্য, যা বাদ্যযন্ত্রের প্রযুক্তিগত, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এই বইটি সঙ্গীতপ্রেমী উৎসাহীদের জন্য একটি বিশেষ গুরুতপূর্ণ ভূমিকা হিসাবে পালন করবে, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তবলা বাজানোর সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করবে।
পরিশেষে, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের তবলার প্রতি তাঁর শৈল্পিকতা, উদ্ভাবন এবং নিষ্ঠা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনেক বেশি উন্নত করেছিল| একজন শিল্পী, শিক্ষাবিদ এবং গবেষক হিসেবে, তিনি কেবল কলকাতার তবলা ঐতিহ্যকেই রূপ দেননি বরং ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিতেও অবদান রেখেছেন। জ্ঞানবাবুর কাজ অগণিত সঙ্গীতজ্ঞদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং তাঁর প্রভাব আগামী প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পীদেরকে অনেক বেশি প্রভাবিত করবে, সেই সাথে নিশ্চিত করবে যে তবলা বিশ্বের সঙ্গীত ঐতিহ্যের একটি বিশেষ সাঙ্গীতিক বাদ্যযন্ত্র।
References
1. Ghosh , Pandit Sankar. Anaddha Part- 01. Kolkata: Birujatio Sahitya Sammiloni, 2023. 2014.
2. Ghosh , Sumbhunath. Tablar Itibritta. Kolkata: Adi Nath Brothers, 2014. Bangla.
3. Ghosh, Gyan Prakash. Tahzib-E-Mousiki. Kolkata: Baulmon Prakason, 2016. 16.
4. Ghosh, Gyan Prakash . Tahzib-E-Mousiki. Kolkata: Baulmon Prakasoni, 2016. 03.
5. Ghosh, Gyan Prakash . “Tahzib-E-Mousiki.” Kolkata: Baulmon Prakason, 2006. 17-18.
6. Ghosh, Jnan Prakash . “Tahzib-E-Mousiki.” kolkata: Baulmon Prakason, 1995. 04-05.
7. Ghosh, Pandit Sankar. Anaddha Part- 01. Kolkata: Birujatio Sahitya Sammiloni, 2023. Bangla.
8. Ghosh, Shambhunath . Tablar Itibritta. Kolkata : Adi Nath Brothers, 1997. 108.
9. Ghosh, Shambunath. Tablar Itibritta. Kolkata: Adi NAth Brothers, 2014. Bangla.
10. Ghosh, Shanbhunath. Tablar Itibritta. Kolkata: Adi Nath Brothers, 1997. 109.
11. Ghosh, Shumbhunath. Tablar Itibritta. Kolkata: Adi Nath Brothers, 1997. 107.
12. Roy , Indubhusan . “TAbla Bigyan Part 1.” Kolkata: Adi Nath Brothers, 2012. 146-147.
13. wikipedia. https://en.wikipedia.org/wiki/All_India_Radio. 10 01 2025. English, Bangla. 10 01 2025.
14. —. https://en.wikipedia.org/wiki/Doordarshan. 16 04 2025. English, Bangla. 10 04 2025.
15. —. https://en.wikipedia.org/wiki/Jnan_Prakash_Ghosh. 10 10 2018. English, Bangla. 10 01 2025.
16. —. https://en.wikipedia.org/wiki/Jnan_Prakash_Ghosh . 16 10 2016. Bangla,English. 10 01 2025.
Name: Apurba Biswas
Designation: Ph.D Scholar ( Department of Tabla )
University: Indira Kala Sangit Vishwavidyalaya, Khairagarh
Chhattisgarh, pin- 491881.
Name: Assistant Professor Dr. Hariom Hari
Designation: Supervisor
University: Indira Kala Sangit Vishwavidyalaya, Khairagarh
Chhattisgarh, pin-491881.
Date: 22.04.2025
Place: Khairagarh, Chhattisgarh.