সারসংক্ষেপ (Abstract in Bengali):
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্যসমূহ যেমন চণ্ডালিকা, শ্যামা, ও তালবাদল—এই সব কৃতিতে প্রাচীন ভারতীয় নাট্যতত্ত্বের সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র, বিশেষত ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র, আবহমান কাল ধরে শিল্পকলার নানা ধারাকে প্রভাবিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ এই তাত্ত্বিক ভিত্তিকে আধুনিক রূপ দিয়েছেন তাঁর নৃত্যনাট্যে। রস, ভাব, অঙ্গিক, সাত্ত্বিক ও বাচিক অভিনয়প্রকরণ, সংগীত ও নৃত্যের সম্মিলনে নির্মিত তাঁর কাব্যনাট্যগুলি প্রাচীন নাট্যতত্ত্বের রূপরেখাকে ধারণ করে সমকালীন ও মানবিক আবেগকে প্রকাশ করেছে। এই প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে, কীভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৃত্যনাট্যে প্রাচীন নাট্যতত্ত্বের মৌলিক উপাদানসমূহ গ্রহণ করে, সেগুলিকে সময়োপযোগী করে রূপান্তরিত করেছেন এবং এক নতুন নাট্যভাষার সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে তাঁর কাব্যনাট্যগুলি হয়ে উঠেছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক সার্থক সংমিশ্রণ।
সূচক শব্দ (Key Words in Bengali):
রবীন্দ্রনাথ, নৃত্যনাট্য, ভারতীয় নাট্যতত্ত্ব, নাট্যশাস্ত্র, রসতত্ত্ব, ভাব, অভিনয়, ভরত, চণ্ডালিকা, শ্যামা, নৃত্যনাট্যচর্চা।
ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে “নাট্য” একটি অন্যতম মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পরূপ। ভরতমুনিররচিত নাট্যশাস্ত্র হলো এই ধারার প্রাচীনতম ও প্রামাণ্য গ্রন্থ, যা নাট্য সংগীত ও নৃত্যের একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব প্রদান করে। নাট্যশাস্ত্রে ভরত নৃত্যকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করেছেন—নৃত্ত, নৃত্য, এবং নাট্য। আচার্য ধনঞ্জয় তাঁর “দশরূপক” গ্রন্থে এর লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন-
“নৃত্তং তাললয়াশ্রয়ম্।”
“অন্যদ্ভাবাশ্রয়ং নৃত্যম্।”
“অবস্থানুকৃতির্নাট্যম্।”
অর্থাৎ, “নৃত্ত” হলো নিছক ছন্দানুসারে গঠিত শুদ্ধ নৃত্য, যেখানে কোনো ভাব নেই, কেবল মাত্র শারীরিক নৈপুণ্য ও লয়-তাল অনুসরণ। “নৃত্য” হলো ভাবপ্রকাশের সহিত আবেগপ্রবণ নৃত্য, যা ‘রস’ সৃষ্টি করে। “নাট্য” হলো নাটকীয় উপস্থাপন, যেখানে সংলাপ, অভিনয়, আবেগ সবকিছুর সংমিশ্রণ ঘটে। নাট্যশাস্ত্রে আলোচিত আছে ‘আঙ্গিক’, ‘বাচিক’, ‘আহার্য’ও ‘সাত্ত্বিক’ অভিনয়, যা নৃত্য ও নাট্যের পরিবেশনে অপরিহার্য-
“আঙ্গিকো বাচিকশ্চৈব আহার্যঃ সাত্ত্বিকস্তথা।
চত্বারোভিনয়া হ্যেতে বিজ্ঞেয়া নাট্যসংশ্রয়াঃ।।’’
এছাড়া, ভরত নৃত্যের দুটি প্রাথমিক রূপ উল্লেখ করেছেন:
তাণ্ডব: প্রবল, শক্তিশালী, শিবের নৃত্যধর্মী রূপ।
লাস্য: কোমল, রমণীয়, পার্বতীর অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট রূপ।
অপরদিকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলা সাহিত্যে ও সংগীত-নাট্যের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর সৃষ্ট “রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য” একটি স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দেয় যেখানে কাব্য, সংগীত, অভিনয় ও নৃত্য একত্রিত হয়ে একটি সামগ্রিক শিল্পরূপে আত্মপ্রকাশ পায়। তিনি নৃত্যের মধ্যে মুক্তির রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, নৃত্যরূপের সীমায় অরূপ সৌন্দর্য সন্ধান করেছিলেন-
“নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ নৃত্যে তোমার মায়া-
বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।।”
রবীন্দ্রসাহিত্যের নির্ভরতায় দেহের ভাষায় প্রকাশিত হল যে নতুন মিশ্রশিল্পরূপ, তা-ই ক্রমশ শান্তিনিকেতনের নৃত্য, রবীন্দ্র-প্রবর্তিত নৃত্য থেকে হয়ে উঠল ‘রবীন্দ্রনৃত্য’। এই প্রবন্ধে আমরা রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের নৃত্যশৈলীগুলিকে ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত নৃত্যধারার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করব এবং তুলনামূলকভাবে উভয়ের মধ্যেকার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য অন্বেষণ করব।
নাট্যশাস্ত্র ও তার নৃত্যতত্ত্ব
নাট্য বা নৃত্যে রসতত্ত্বও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভরত রসসিদ্ধান্ত প্রচার করেছেন। মম্মটের উল্লেখে-
“বিভাবানুভাব্যভিচারিসংযোগাদ্রসনিষ্পত্তিঃ”।
নাট্য বা নৃত্যের মূল লক্ষ্য হলো রস সঞ্চার। রসের উৎপত্তি হয় ‘ভাব’-এর দ্বারা।
ভরতের মতে, রস জন্মায় ‘বিভাব’, ‘অনুভাব’, ও ‘ব্যভিচারী ভাব’-এর সম্মিলনে। আটটি প্রধান রস—শৃঙ্গার, করুণা, বীর, রৌদ্র, হাস্য, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত—নাট্য পরিবেশনায় অন্তর্নিহিত থাকতে হবে-
“শৃঙ্গারহাস্যকরুণরৌদ্রবীরভয়ানকাঃ।
বীভৎসাদ্ভুতসংজ্ঞৌ চেত্যষ্টৌ নাট্যে রসা স্মৃতাঃ।। ”
নৃত্যের মাধ্যমে এই রসগুলি প্রকাশ পায় মুখমণ্ডলের ভঙ্গি, দেহবচালনা ও হস্তমুদ্রার সাহায্যে।
রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যের সৃষ্টি ও শৈলী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্যচর্চা তাঁর সাহিত্যিক ও দার্শনিক চিন্তাধারার একটি অংশ। তিনি শিল্পের মধ্যে দিয়ে মানবিক ভাবনা, সামাজিক প্রশ্ন, ও আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর নৃত্যনাট্য মূলত : “চিত্রাঙ্গদা” (১৯৩৬), “শ্যামা” (১৯৩৯), “চণ্ডালিকা” (১৯৩৮), ও “তাসের দেশ” (১৯৩৩) প্রভৃতি। এই নৃত্যনাট্যগুলি কেবল নাটক নয়, সংগীত ও নৃত্যের অপূর্ব সংমিশ্রণে এক স্বতন্ত্র রূপ লাভ করেছে।
রবীন্দ্রনাথ নৃত্যের ক্ষেত্রে ক্লাসিক্যাল ভারতীয় ধারার সঙ্গে লোকনৃত্য ও পাশ্চাত্য ধ্যানধারণাকেও সংযুক্ত করেছেন। তাঁর নৃত্যনাট্যে কথক, ভরতনাট্যম, মণিপুরী প্রভৃতি ধারা যেমন পাওয়া যায়, তেমনই শান্তিনিকেতনের নিজস্ব কোরিওগ্রাফিক ভাষাও তৈরি হয়েছে। ভাব, রস, গতিময়তা ও সহজতাই এখানে মুখ্য।
নাট্যশাস্ত্র ও রবীন্দ্রনৃত্যনাট্য: সাদৃশ্য
১. রসতত্ত্বের প্রয়োগ: নাট্যশাস্ত্রে রসতত্ত্ব একটি কেন্দ্রবিন্দু। রবীন্দ্রনাথও তাঁর নৃত্যনাট্যে প্রতিটি নাট্যকে একেকটি রসের আধার হিসেবে নির্মাণ করেছেন। “শ্যামা” নৃত্যনাট্যে করুণা রস, “চিত্রাঙ্গদা”য় বীর ও শৃঙ্গার রস, “চণ্ডালিকা”য় বীতরাগ ও বিবেচনার দ্বন্দ্বে সৃষ্টি শান্ত রস বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
২. অভিনয়ের চার উপাদান: রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাট্য পরিবেশনে আঙ্গিক (দেহভঙ্গি), বাচিক (সংলাপ/গান), আহার্য (পোশাক-আবরণ), ও সাত্ত্বিক (আভ্যন্তরীণ অনুভূতি)-এই চতুর্ভাগীয় উপাদান ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, “চণ্ডালিকা”য় প্রকৃতি ও মায়ার চাহনি, দেহভঙ্গিমা ও কণ্ঠস্বরের ওঠানামায় এই চার উপাদানের প্রকাশ স্পষ্ট।
৩. নাট্যরূপে সামগ্রিকতা: নাট্যশাস্ত্র অনুযায়ী একটি নাট্যে সংগীত, নৃত্য, ও নাট্য একত্রে থাকে। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলো একইভাবে একটি ‘সামগ্রিক শিল্প’ (Total Art Form)।
নাট্যশাস্ত্র ও রবীন্দ্রনৃত্যনাট্য: বৈসাদৃশ্য
১. দর্শন ও উদ্দেশ্য: নাট্যশাস্ত্র মূলত দেবতাদের বিনোদনের জন্য নির্মিত এবং রাজসভাকেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথের নাট্যচর্চা মানবিক মুক্তি, আত্মবিশ্বাস, ও সাম্যবাদের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে।
২. নায়ক-নায়িকার চরিত্র: নাট্যশাস্ত্রে নায়িকা ও নায়কের নির্দিষ্ট শ্রেণিবিভাগ ও আচরণ আছে। রবীন্দ্রনাথ সেই কাঠামো ভেঙে নারীচরিত্রকে আত্মনির্ভর, চিন্তাশীল ও প্রগতিশীল রূপে গড়ে তোলেন।
৩. নৃত্যকলা ও নৃত্যকৌশল : নাট্যশাস্ত্রের কড়া ছন্দ, মুদ্রা ও নির্দিষ্ট কাঠামোর পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যকৌশল অনেক বেশি মুক্ত, আবেগনির্ভর ও অভিনব। তিনি নৃত্যকে ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন, কৌশলের উৎসর্গ নয়।
নৃত্যনাট্য পর্যালোচনা
১. চিত্রাঙ্গদা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নাট্যসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে আধুনিক যুগের অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁর সৃষ্টি ‘চিত্রাঙ্গদা’ কেবলমাত্র একটি নাটক নয়, বরং তা ভারতীয় নাট্যচর্চার এক সংবেদনশীল, চিন্তামূলক ও নান্দনিক পুনর্নির্মাণ। ‘চিত্রাঙ্গদা’র মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে আঙ্গিকে ও দর্শনে নাট্যরূপায়ণ করেছেন, তা প্রাচীন ভারতীয় নাট্যতত্ত্ব, বিশেষত ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’-এর সঙ্গে একটি সমান্তরাল সংলাপ রচনা করে।
‘চিত্রাঙ্গদা’ভরতের নাট্যশাস্ত্রের নন্দনতত্ত্ব, রসতত্ত্ব ও অভিনয় সংক্রান্ত উপাদানের সঙ্গে সংলগ্ন এবংতাঁর নিজস্ব কাব্যিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে নাট্যশাস্ত্রের আধুনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
চিত্রাঙ্গদা’ রবীন্দ্রনাথের ১৯৩৬ সালে রচিত নৃত্যনাট্য, যা ‘রবীন্দ্রনৃত্যনাট্য’ ধারার অংশ। এর উৎস মহাভারতের ‘চিত্রাঙ্গদা’ চরিত্র, যিনি মণিপুরের রাজকন্যা। নাটকে চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের প্রেমে পড়ে; অর্জুন নারীসুলভ চেহারায় অভ্যস্ত এবং বীরচরিত্রের নারীতে আকৃষ্ট নন। চিত্রাঙ্গদা তাই দেবতার বর পেয়ে রূপবতী রমণীতে রূপান্তরিত হন, কিন্তু আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে ভোগেন। নাটকের অন্তিমে তিনি নিজের প্রকৃত রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেন। ভরত যেখানে নারীচরিত্রকে কোমল, প্রেমিক এবং শিষ্ট চরিত্রের রূপে দেখেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে নারীকে শক্তিশালী, স্বাধীন এবং আত্মসম্মানসম্পন্ন হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর নৃত্যবিভঙ্গতে কখনও কোমলতা, কখনও দৃঢ়তা প্রকাশ পায়।
চিত্রাঙ্গদায় রসতত্ত্বের প্রয়োগ
নাট্যশাস্ত্রের ‘রস’ ধারণা রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকে বহুরসের সমাবেশ রয়েছে।
বীর রস: চিত্রাঙ্গদা একজন বীরাঙ্গনা। রাজকুমারী হিসেবে রাজ্য রক্ষা এবং যুদ্ধকলায় পারদর্শী আবার প্রজানুরঞ্জনে তাঁর স্নেহের পরিচয় পাওয়া যায় জনপদবাসীদের গানে ও অর্জুনের আকুতিতে-
“স্নেহবলে তিনি মাতা, বাহুবলে তিনি রাজা।’’
অথবা
“কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা-
দারুণ সে, সুন্দর সে
উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে
নহে সে ভোগীর লোচনলোভা
ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণ শোভা।।”
শৃঙ্গার রস: অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার সম্পর্কের মধ্যে প্রণয় ও শরীরী আকর্ষণের সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি রয়েছে।
“যে ফুলমালা দুলায়েছ আজি রোমাঞ্চিত বক্ষতলে,
মধুরজনীতে রেখো সরসিয়া মোহের মদির জলে।”
করুণ রস: চিত্রাঙ্গদার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব – নিজের রূপ নিয়ে সংশয় এবং আত্মত্যাগের ইচ্ছা।
“হায়, হায়, নারীরে করেছি ব্যর্থ দীর্ঘকাল জীবনে আমার।
ধিক্ ধনুঃশর! ধিক্ বাহুবল!
মুহূর্তের অশ্রুবন্যাবেগে ভাসায়ে দিল যে মোর পৌরুষসাধনা।।”
শান্ত রস: আত্মসত্যের উপলব্ধি এবং নিজের অস্তিত্বের গ্রহণ –
“আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী নহি সামান্যা নারী।”
চরিত্র নির্মাণ ও নায়িকা ভেদ-
নাট্যশাস্ত্রে নায়িকার নানা ভেদ রয়েছে – স্বাধীনপতিকা, প্রগলভা, মধ্যা, বাসকসজ্জা ইত্যাদি। চিত্রাঙ্গদা এই সকল ভেদের সংমিশ্রণে নির্মিত। তিনি একাধারে বীরাঙ্গনা, প্রেমিকা এবং আত্মসন্ধানী নারী। রবীন্দ্রনাথ এখানে নারী চরিত্রকে দেহ ও প্রেমের সীমা ছাড়িয়ে অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়ের অন্বেষায় রূপান্তরিত করেছেন-
‘রমণীর মন-ভোলাবার ছলাকলা
দূর ক’রে দিয়ে উঠিয়া দাঁড়াক নারী।
সরল উন্নত বীর্যবন্ত অন্তরের বলে
পর্বতের তেজস্বী তরুণ তরু সম-
যেন সে সন্মান পায় পুরুষের।।’’
অভিনয়ের চতুর্বিধ উপাদান প্রয়োগ-
আঙ্গিক অভিনয়: মণিপুরি নৃত্যভঙ্গিমা ও মার্শাল মুভমেন্টের মাধ্যমে চিত্রাঙ্গদার বীরত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
বাচিক অভিনয়: রবীন্দ্রসংগীত ও কবিতায় ভরপুর সংলাপে বাচিক অভিব্যক্তি সমৃদ্ধ করেছে কথানককে।
সাত্ত্বিক অভিনয়: চিত্রাঙ্গদার দ্বন্দ্ব, বেদনা ও গৌরব – এই তিনটি স্তরের অনুভূতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
আহার্য অভিনয়: পোশাক, আলোকসজ্জা, ও নৃত্যভঙ্গিমায় রবীন্দ্রনাথের নান্দনিক চিন্তাধারা এবং বৈশ্বিক সন্মেলনের প্রতিফলন ঘটেছে।
নৃত্য ও সংগীতের ভূমিকা
নাট্যশাস্ত্রে সংগীত ও নৃত্যকে নাট্যরূপের অন্যতম মৌলিক মাধ্যম বলা হয়েছে। ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যে নৃত্য ও সংগীত একে অপরের পরিপূরক। প্রতিটি আবেগের দৃশ্য নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মণিপুরি নৃত্যরীতির অন্তর্নিহিত লাস্য ও তাণ্ডব একত্রিত হয়ে এক অভিনব নৃত্যরূপ গঠিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের স্বতন্ত্রতা: নাট্যশাস্ত্রের আধুনিক রূপায়ণ
যেখানে ভরতের নাট্যশাস্ত্র মূলত রাজসভামুখী এবং পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্গত, রবীন্দ্রনাথ সেখানে এক মানবিক ও আত্মবিশ্বাসী নারীর কাহিনি বুনেছেন। তিনি নাট্যশাস্ত্রকে কেবল অনুসরণ করেননি, বরং তা পুনঃনির্মাণ করেছেন তাঁর কাব্যিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। নারীকে রমণী বা প্রণয়পাত্র হিসেবে নয়, বরং মানবিক আত্ম-অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন-
“রজনীর নর্মসহচরী যেন হয় পুরুষের কর্মসহচরী,
যেন বামহস্তসম দক্ষিণহস্তের থাকে সহকারী।
তাহে যেন পুরুষের তৃপ্তি হয় বীরোত্তম।।’’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যশাস্ত্রের রসতত্ত্ব, অভিনয়রীতি ও নাট্যশিল্পের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে নতুন ভাষায় এবং নতুন দৃষ্টিতে তুলে ধরেছে। তিনি প্রাচীন নাট্যচিন্তাকে তাঁর সময়ের বাস্তবতা ও ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত করে আধুনিক নাট্যশিল্পের এক নতুন পথ দেখিয়েছেন। ‘চিত্রাঙ্গদা’ কেবল এক নৃত্যনাট্য নয় – এটি প্রাচীন ভারতীয় নাট্য-ঐতিহ্যের আধুনিক পুনর্পাঠ, যেখানে নারীস্বাধীনতা, আত্মপ্রকাশ ও মানবিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে এক পরিপূর্ণ রসোপলব্ধির পথ খোলা হয়েছে।
২. শ্যামা
শ্যামা একটি কবিত্বময় প্রেমকাহিনী। প্রেমের জন্য আত্মত্যাগ এবং স্বার্থসিদ্ধির একাধারে দেখা যায় এই নৃত্যনাট্যে। এই নাটকে করুণা রস ও শৃঙ্গার রসের সমন্বয় ঘটেছে। নাট্যশাস্ত্রের করুণা রসের নায়িকা কেবল ভুক্তভোগী নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণকারীকেও অন্তর্ভুক্ত করে। শ্যামার চরিত্রে এই সক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই নাট্যে সংগীত, কাব্য ও নৃত্যকে এমনভাবে মিশিয়েছেন যা নাট্যশাস্ত্রের ‘সামগ্রিক অভিজ্ঞতা’র ধারণাকে স্মরণ করায়।
রসতত্ত্বের প্রয়োগ
‘শ্যামা’তে দেখা যায়:
শৃঙ্গার রস: শ্যামা ও বজ্রসেনের গোপন পলায়নের পর কোন একান্তে তাদের আনন্দঘন মুহূর্ততে-
“প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে –
বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও, দাও।।”
করুণ রস: বজ্রসেনের অপরাধ নিজ স্কন্ধে নিয়ে উত্তীয়ের মৃত্যুদণ্ড ও শ্যামার অনুশোচনায়-
“রাজ-আভরণ দেহে করেছি ধারণ আজি,
সেই পরিতাপে আমি কাঁদি।’’
বীর রস: উত্তীয়ের দৃপ্ত আত্মত্যাগে বীর রসের প্রকাশ-
“প্রিয় যে তোমার বাঁচাবে যারে, নেবে মোর প্রাণঋণ-
তাহারি সংগে তোমারি বক্ষে বাঁধা রব চিরদিন,
মরণডোরে
কেমনে ছাড়িবে মোরে, ওগো সুন্দরী।”
এই রসগুলির সহাবস্থান নাট্যশাস্ত্রীয় ‘রস সমন্বয়’-এর দৃষ্টান্ত। শ্যামা চরিত্রটি ‘নায়িকা’ তত্ত্ব অনুযায়ী ‘স্বতন্ত্রা’ নায়িকার আদর্শ উদাহরণ। উত্তীয় চরিত্রটি ‘ধীরপ্রশান্ত’ নায়কের প্রতিচ্ছবি।
* অভিনয় ও প্রকাশরীতি-
‘শ্যামা’-তে এই চতুর্মুখী অভিনয়ের সফল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
আঙ্গিক অভিনয়ে নৃত্যের ভূমিকা অসামান্য। রবীন্দ্রনাথ কণ্ঠনৃত্য ও সঙ্গীতের মাধ্যমে বাক অভিনয়কে এক অভিনব উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সাত্ত্বিক অভিব্যক্তি দেখা যায় শ্যামার চোখে-চোখে দ্বিধা, যন্ত্রণার নৃত্যে।
দৃশ্যবিন্যাস ও মঞ্চায়ন-
ভরত মুনির নাট্যগৃহ বর্ণনার সঙ্গে মিল রেখে রবীন্দ্রনাথ প্রতীকী মঞ্চব্যবহার করেছেন।
আলোকসজ্জা, আবহসংগীত, চলন ও রঙের মধ্য দিয়ে সময় ও মানসিক দৃশ্যপট নির্মাণ করেছেন।
যেমন: উত্তীয়ের মৃত্যুদণ্ডের সময় মঞ্চে অন্ধকার ও আলো ও সংগীতের নাটকীয়তা। শেষে মৃদু করুণ সুর কিংবা, শ্যামার আত্মদ্বন্দ্বের সময় একক নৃত্য পরিবেশন।
রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নাট্যশাস্ত্রের তত্ত্বের সরাসরি অনুবর্তী না হলেও তার মূল চেতনাকে আধুনিক, মানবিক ও কাব্যিক প্রেক্ষাপটে প্রকাশ করেছে। রস, ভাব, নায়ক-নায়িকা নির্মাণ, দৃশ্যায়ন ও অভিনয় তত্ত্বে ‘শ্যামা’নাট্যশাস্ত্রীয় ধারার এক নবচিন্তিত রূপ। একে ভারতীয় নাট্য-ঐতিহ্যের একটি আধুনিক উত্তরাধিকার বলাই যায়।
৩. চণ্ডালিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য ‘চন্ডালিকা’ (১৯৩৮) একটি সমাজসচেতন, মানবতাবাদী এবং আধ্যাত্মিক বোধে উজ্জীবিত কাব্যনাট্য। এই নাটকে তিনি ব্যক্তির আত্মমর্যাদা, জাতিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রশ্নকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘চণ্ডালিকা’ কেবল একটি নৃত্যনাট্য নয়; এটি একটি সামাজিক ঘোষণা, জাতপাতভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক দৃঢ় অবস্থান।
চণ্ডালিকা’ নাটকটি এক চণ্ডাল কন্যা প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, যার মধ্যে আত্মপরিচয়ের সংকট, সামাজিক বঞ্চনার বেদনা এবং আত্মমর্যাদার জাগরণ পরিলক্ষিত হয়। একদিন অনাগরিক নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষু তৃষ্ণার্ত হয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে জল চান। এতে প্রকৃতির মধ্যে এক অভাবিত চেতনার উদয় ঘটে – সে প্রথমবার অনুভব করে, সে কেবল চণ্ডাল নয়, একজন মানুষও।
তবে তার এই জাগরণ এক ধরনের অহং-জড়িত আকাঙ্ক্ষায় রূপ নেয়, এবং সে অনাগরিককে পাওয়ার জন্য তার মায়ের সহায়তায় মায়াবিদ্যার আশ্রয় নেয়। শেষপর্যন্ত, অনাগরিকের মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দেখে প্রকৃতি অনুতপ্ত হয় এবং আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে সে মুক্তি লাভ করে।
রস ও ভাবের প্রয়োগ-
ভরতের মতে, রস হচ্ছে নাটকের প্রাণ। ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যে করুণ, বীর, রৌদ্র, শান্ত ও বীভৎস রসের সংমিশ্রণ দেখা যায়।
করুণ রস: প্রকৃতির আত্ম-অবিশ্বাস, বঞ্চনা ও অনুতাপের দৃশ্যে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে-
“যে আমারে পাঠালো এই অপমানের অন্ধকারে
পূজিব না, পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে
পূজিব না।”
বীর রস: আত্মমর্যাদার দাবিতে প্রকৃতির দৃঢ়তা ও বিদ্রোহী সত্তা এই রসের প্রতিফলন।
“আমি চণ্ডালী – সে যে মিথ্যা, সে যে মিথ্যা,
সে যে দারুণ মিথ্যা।
তিনি বলে গেলেন আমায়-
নিজেরে নিন্দা কোরো না,
মানবের বংশ তোমার,
মানবের রক্ত তোমার নাড়ীতে।”
রৌদ্র রস: প্রকৃতির মা মায়ার উক্তি ও কর্মে জাতিপ্রথার প্রতি রৌদ্র রসের রূপ পায়-
“কী যে ভাবিস তুই অন্যমনে- নিষ্কারণে-
বেলা বহে যায়, বেলা বহে যায় যে।
থাক্ তবে থাক্ তুই পড়ে,
মিথ্যা কান্না কাঁদ তুই মিথ্যা দুঃখ গড়ে।।”
শান্ত রস: অনাগরিকের চরিত্র শান্ত রসের নিদর্শন – এক নির্বিঘ্ন ও ত্যাগময় আত্মিক অবস্থান-
“কল্যাণ হোক তব কল্যাণী।”
বিভৎস রস: অনাগরিকের ওপর মায়াবিদ্যার প্রয়োগে যে মানসিক-শারীরিক বিকার সৃষ্টি হয়, তা বীভৎস রসের আওতাভুক্ত।
এই রসগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত স্থায়ী ভাব, উদ্বীপন, ব্যভিচারী ভাব ইত্যাদি ভরতের মতানুসারে ‘চন্ডালিকা’য় সুস্পষ্টভাবে রূপায়িত হয়েছে।
আঙ্গিক অভিনয় ও নৃত্যচর্চা
‘চন্ডালিকা’তে অঙ্গিক অভিনয়ের বিস্তৃত ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়:
আঙ্গিক ভঙ্গি: প্রকৃতির আত্মজাগরণ, মায়ার প্রতিক্রিয়া, অনাগরিকের তপস্যা ইত্যাদি দৃশ্যাবলীতে শরীরী ভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হস্তমুদ্রা ও নৃত্য: নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত হস্তমুদ্রাগুলি যেমন পত্রক, মৃগশীর্ষ, করতল প্রভৃতি রূপে অনুরণিত হয়।
নৃত্য ও নৃত্যনাট্য: রবীন্দ্রনাথ নৃত্যকে ব্যবহার করেছেন রূপক অর্থে, যেমন – প্রকৃতির মানসিক দ্বন্দ্ব নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
বাচিক ও সাত্ত্বিক অভিনয়
বাচিক অভিনয়: ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য হওয়ায় গানের মাধ্যমে চরিত্রের মনস্তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। সংলাপের মধ্যে ছন্দ ও অলংকার নাট্যশাস্ত্রের আদর্শকে অনুসরণ করে।
সাত্ত্বিক অভিনয়: অনাগরিকের তপস্যা, প্রকৃতির অনুশোচনা, মায়ার ক্রোধে যে অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থা উদ্ভাসিত হয় তা সাত্ত্বিক অভিনয়ের অন্তর্ভুক্ত। ভরতের মতে, কান্না, কম্পন, স্তম্ভ, স্বেদ ইত্যাদি অনুভূতি ‘সাত্ত্বিক ভাব’ হিসাবে পরিচিত-
“স্তম্ভঃ স্বেদোঽথ রোমাঞ্চঃ স্বরসাদোঽথ বেপথুঃ।
বৈবর্ণ্যমশ্রুপ্রলয় ইত্যষ্টৌ সাত্ত্বিকাঃ স্মৃতাঃ।।”
আহার্য ও দৃশ্যরূপ
রবীন্দ্রনাথ দৃশ্যরূপ নির্মাণে সরলতা ও প্রতীকী ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। চরিত্রের কস্টিউম, মঞ্চসজ্জা, আলোকসম্পাত – সবকিছু নাট্যশাস্ত্রের আহার্য উপাদানের আধুনিক রূপান্তর।
নাট্যধর্ম ও লক্ষ্যে
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাটকের উদ্দেশ্য – ‘লোকরঞ্জন’ ও ‘লোকশিক্ষা’। ‘চণ্ডালিকা’য় রবীন্দ্রনাথ নাট্যধর্মকে আরও উচ্চতর মাত্রায় উন্নীত করেছেন, যেখানে জাতিভেদ, আত্মমর্যাদা ও মানবতার প্রশ্ন নাটকের মূল বোধ হয়ে ওঠে।
‘চণ্ডালিকা’ নাট্যশাস্ত্রের ধারাকে অনুসরণ করলেও তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ এক অভিনব মানবিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি সংযুক্ত করেছেন। রস, অভিনয়, মঞ্চরূপ ইত্যাদির মাধ্যমে ‘চন্ডালিকা’ নাট্যশাস্ত্রের মূল তত্ত্বগুলিকে নতুন ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণে উপস্থাপন করেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই নৃত্যনাট্যে নাট্যশাস্ত্রকে কেবল অনুসরণ করেননি, বরং তাকে সমকালীন সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ‘চন্ডালিকা’ তাই শুধু এক নৃত্যনাট্য নয়, এক সাংস্কৃতিক পুনর্নির্মাণের দলিল।
৪. তাসের দেশ
১৯৩৩ সালে রচিত ও প্রকাশিত ‘তাসের দেশ’ একটি রূপক নাটক যা নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মনোভঙ্গির প্রতিফলন। নাট্যটির কেন্দ্রবিন্দু হলো রাজপুত্রের দেশত্যাগ এবং এক অলীক ‘তাসের দেশ’-এ গমন। এই দেশ নিয়ম, শৃঙ্খলা এবং বদ্ধতার প্রতীক, যেখানে মানবিকতা ও স্বাধীন চিন্তার কোনো স্থান নেই। রাজপুত্রের আগমন এবং তার মাধ্যমে দেশটির রূপান্তর আসলে এক বিপ্লবের ইঙ্গিত। এই রূপক নাট্যে শাসনব্যবস্থা, আনুগত্য, নারী স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
নাট্য শাস্ত্রের ‘রস’ ও ‘ভাব’ তত্ত্ব-
‘তাসের দেশ’-এ ‘রস’ তত্ত্বের বিশেষ প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। নাট্যশাস্ত্র অনুযায়ী ৯টি প্রধান রস রয়েছে। এখানে প্রধানত:
শৃঙ্গার রস: রাজপুত্র ও পত্রলেখার মধ্যে বার্তাবৃত্তান্ত-
“গোপন কথাটি রবে নে গোপনে,
উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।।”
বীর রস: রাজপুত্রের প্রতিবাদ ও বিপ্লব-
“আমরা নূতন যৌবনেরই দূত,
আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।”
করুণ রস: তাসের সৈন্যদের যান্ত্রিক জীবনের প্রতি করুণার ভাব-
অদ্ভুত রস: তাসের দেশের অতিপ্রাকৃত ও অলীক নিয়মাবলী-
“তোলন নামন পিছন সামন,
বাঁয়ে ডাইনে চাই নে চাই নে,
বোসন ওঠন ছড়ান গুটন,
উলটো –পালটা ঘূর্ণি চালটা
বাস্, বাস্ বাস্। ”
এই রসগুলির অভিব্যক্তি নাট্যটির দৃশ্য বিন্যাস, সংলাপ ও নৃত্যভঙ্গিমার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে-
“বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও,
বাঁধ ভেঙে দাও।
বন্দী প্রাণমন হোক উধাও।
শুকনো গাঙে আসুক
জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক;
ভাঙনের জয়গান গাও।’’
অভিনয় ও আঙ্গিক প্রকাশ-
নাট্য শাস্ত্রে ‘আঙ্গিক’ (শরীরভঙ্গী), ‘সাত্ত্বিক’ (আভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তি) ও ‘বাচিক’ (বাক্প্রকাশ)-এর সমন্বয়ে যে অভিনয় তত্ত্ব গড়ে ওঠে, তার নিপুণ ব্যবহার ‘তাসের দেশ’-এ দেখা যায়। বিশেষ করে, তাসের সৈন্যদের যান্ত্রিক গতিবিধি, মুখাবয়বের অভিব্যক্তি স্থিরতা, এবং রাজপুত্রের আবেগপূর্ণ সংলাপে এই অভিনয় তত্ত্বের সফল প্রয়োগ ঘটেছে।
নৃত্য ও সঙ্গীত
‘তাসের দেশ’-এ ব্যবহৃত নৃত্য ও সঙ্গীত নাট্যশাস্ত্রের নৃত্যবিভাগের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এখানে ‘লাস্য’ (কোমল ও সৌন্দর্যপ্রধান নৃত্য) এবং ‘তাণ্ডব’ (উত্তেজনাপূর্ণ ও উদ্দীপক নৃত্য) উভয়েরই মিশ্রণ দেখা যায়। প্রাথমিক দৃশ্যে, যেখানে তাসের সৈন্যরা যান্ত্রিক ভঙ্গিমায় নৃত্য করে, সেখানে ‘লাস্য’ নেই। রাজপুত্রের আগমনের পরে ধীরে ধীরে ‘তাণ্ডব’-এর প্রবেশ ঘটে—স্বাধীনতার ছন্দে।
• সংগীতের ভূমিকা-
সংগীত নাটকের আবেগ ও রস সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ‘তাসের দেশ’-এ ব্যবহৃত গানগুলি রূপকধর্মী নাটকের মূলভাব প্রকাশে সহায়ক। যেমন:
“ইচ্ছে।
সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে,
সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।’’
গানটি একদিকে যেমন আবেগঘন, তেমনি তাসের দেশের নিয়মতান্ত্রিক জীবনের এক অন্তিম ঘোষণা।
• মঞ্চনির্মাণ ও নন্দনতত্ত্ব-
রবীন্দ্রনাথের মঞ্চনির্মাণ কৌশল নাট্য শাস্ত্রের পটভূমি ও প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের তত্ত্ব অনুসরণ করলেও তাতে আধুনিকতা যুক্ত হয়েছে। আলোকসজ্জা, নৃত্যদল, পট পরিবর্তন, রঙের ব্যবহার, প্রতীকধর্মী পোশাক—সবই নাটকটির ভাব প্রকাশে সহায়তা করে।
• নারী চরিত্র ও নাট্যশাস্ত্র-
নাট্য শাস্ত্রে ‘নটী’-র গুরুত্ব বিশেষভাবে আলোচিত। ‘তাসের দেশ’-এ আমরা দেখি ‘রানী’ ও অন্যান্য নারী চরিত্র যারা প্রথাবদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়। এটি নাট্য শাস্ত্রের ‘নটী’ ধারণার একটি আধুনিক রূপান্তর।
‘তাসের দেশ’ একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি যেখানে রবীন্দ্রনাথ ভরতের নাট্য শাস্ত্রকে আধুনিক চিন্তাধারার আলোকে পুনঃব্যাখ্যা করেছেন। তিনি প্রাচীন নাট্যতত্ত্বের কাঠামোকে গ্রহণ করে, তাতে আধুনিকতা, রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যুক্ত করে এক নতুন নাট্যরীতি নির্মাণ করেছেন। এই প্রবন্ধ থেকে প্রতীয়মান হয় যে ‘তাসের দেশ’ শুধুমাত্র একটি নাট্য সৃষ্টি নয়, এটি একটি দার্শনিক ভাষ্য যেখানে শিল্প, রাজনীতি ও মানবিকতা একাকার হয়ে গেছে।
মূল্যায়ন
১৯৩২ থেকে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের কাল শুরু। গীতিকার, সুরকার, কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাটককার ও নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অভিজ্ঞতায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য পৃথিবীর দুই প্রান্তের শিল্পকলার প্রতি সম-অনুভব, অনুভূতি, জ্ঞান থাকলেও প্রাচ্যের পূজারি ছিলেন তিনি। ভারতীয় বেদ, উপনিষদ ও নাট্যশাস্ত্রের প্রতি তাঁর প্রাজ্ঞতার অন্ত ছিল না। আর এই ভারতীয় দর্শনকেই অবলম্বন করে তিনি তাঁর সৃজনশীল শক্তির পরিচয় রেখেছেন। তাঁর সৃষ্টিগুলি শুধুমাত্র জনপ্রিয়তার নিরিখে নয়, সাময়িক উত্তেজনার জন্য নয়, চিত্তের প্রশান্তি ও মনের মুক্তির জন্যই যেন বিরাজ করে। আর এই কাজে তিনি কোনো কিছুকেই অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয় মনে করেননি। আমাদের সামাজিক জীবন আছে। সেখানে প্রাত্যহিক ঘটনা আছে। তেমনই প্রকৃতির জগৎও আছে। আর এই দুই জীবন ও জগতের পারস্পরিক সম্পর্ক অতি নিবিড়, অতি দৃঢ়। সমাজজীবনে চিত্তের প্রশান্তি আর মনের মুক্তির ক্ষেত্রে তাঁর আশ্রয় “অন্তরে বাহিরে মহাকালের এই বিরাট নৃত্যছন্দে যোগ দিতে পারিলে জগতে ও জীবনে অখণ্ড লীলারস উপলব্ধির আনন্দে মন বন্ধন মুক্ত হয়।” এই ভাবনার সঙ্গে ভারতীয় প্রাচীন নাটাশাস্ত্রের অমোঘ ব্যাকরণকে সাঙ্গীকরণ করেই প্রকৃত আধুনিক নাট্যকলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর নৃত্যনাট্যগুলির রচনা ও প্রযোজনা এই সাক্ষ্যই বহন করে।
রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র শাস্ত্র অনুসরণ করেননি, বরং তিনি এক নতুন শাস্ত্র নির্মাণ করেছেন। নাট্যশাস্ত্রের কাঠামোকে বুঝে তার প্রাসঙ্গিক অংশ গ্রহণ করে সমকালীন চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন নাট্যরূপ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর নৃত্যনাট্যে ভাব, বোধ, চেতনা, ও সৌন্দর্য এমনভাবে মিলিত হয় যে তা নাট্যশাস্ত্রের চেয়েও একধাপ এগিয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নৃত্যনাট্যে ভারতীয় নাট্য ও নৃত্যতত্ত্বের একটি সৃজনশীল পুনর্পাঠ করেছেন। ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র তাঁকে ভিত্তি ও অনুপ্রেরণা দিলেও তিনি তা অনুসরণ করে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন—যেখানে আঙ্গিকের চেয়ে ভাব, শাস্ত্রের চেয়ে মানবতা ও রসের গভীরতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য তাই ভারতীয় শাস্ত্রীয় ধারা ও আধুনিক কাব্যিক নাট্যরূপের মধ্যে এক সেতুবন্ধন রচনা করে। তাঁর সৃষ্ট এই নতুন নৃত্যভাষা একটি সাংস্কৃতিক সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করে, যেখানে প্রাচীন ও আধুনিক, শাস্ত্র ও সৃজনশীলতা পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথনে যুক্ত হয়।
সহায়ক-গ্রন্থসূচী
1. বন্দ্যোপাধ্যায় সুরেশচন্দ্র ও চক্রবর্তী ছন্দা; ভরত নাট্যশাস্ত্র, নবপত্র প্রকাশন, কলিকাতা, ২০২১
2. ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; গীতবিতান তৃতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, কলিকাতা শ্রাবণ ১৩৬৭
3. ভট্টাচার্য উপেন্দ্রনাথ; রবীন্দ্র নাট্যপরিক্রমা; ওরিয়েন্ট বুক ডিস্ট্রিবিউটারস, কলিকাতা ১২, মাঘ ১৩৬৬
4. মুখোপাধ্যায় অমর্ত্য; রবীন্দ্র নৃত্য; প্রস্তুতি প্রয়োগ প্রগতি, স্পার্ক বুক কোম্পানী, কোলকাতা, ২০১৯
5. বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রুতি; রবীন্দ্র মননে নৃত্য, কারিগর প্রকাশনী, কলকাতা, মার্চ ২০২৫
6. Vatsyayan Kapila; Classical Indian Dance in Literature and the Arts, Sangeet Natak Academy, New Delhi, 1977.
7. Rangacharya Adya, The Nāṭyaśāstra: English Translation with Critical Notes, Munsiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi
8. ঘোষ শান্তিদেব; গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, আনন্দ পাব্লিশার্স, কলকাতা
9. আচার্য সীতানাথ ও দাস দেবকুমার; দশরূপক ধনঞ্জয় বিরচিত, সদেশ, কলকাতা, ২০১৬
10. মৈত্র অনির্বাণ ও মণ্ডল অমিত সম্পাদিত; স্বর ও বর্ণ, দ্বিতীয় সংখ্যাঃ ক্রোড়পত্র প্রতিমা দেবী, কলিকাতা, চৈত্র ১৪৩০
গবেষক
সংস্কৃত বিভাগ, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়
ফোন- ৯৮৫১৬০২৪৪৫