March 1, 2024

Continuity of Bhakti movement

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. Srabani Sen, Associate Professor, Tarakeswar Degree College

Bhakti is a Sanskrit word that means ‘devotion’. The Bhakti movement was a medieval Indian religious and social reform movement that emphasized devotion and spiritual connection with the divine. It aimed to reform society by removing the boundaries of caste, creed and gender between the devotee and God. The Bhakti movement was started with the idea that the best way to reach God is not via rituals or religious rites but through love and worship. The movement was based on religious equality and broad-based social participation.

ভক্তি আন্দোলনের ধারা, ড.শ্রাবণীসেন, আ্যসোসিয়েট প্রফেসর,সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী

ভারতীয় জীবনধারার সাথে ধর্মের সংযোগ অবিচ্ছেদ্য। ভারতের সুলতানি যুগে হিন্দু ধর্মের যাগযজ্ঞ, ধর্মীয় আরম্বর, সমাজের অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে যে উদার ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা ‘ভক্তিবাদী আন্দোলন’ নামে পরিচিত। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমাজব্যবস্থায় যে রূপান্তর ঘটেছে, তার মূলে আছে ধর্মভাবনার পরিবর্তন। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ জন্ম নিয়েছে বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম বা আজিবিক মতবাদ। আবার ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনিবার্য প্রভাবের ফলে পরিবর্তন ঘটেছে প্রায় সব প্রতিবাদী ধর্মের মধ্যে । এরপর ভারতে আসে ইসলাম মতাদর্শ। ইসলামের আগমনের ফলে ভারতের ধর্মজীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্নিহিত ও স্ব-আরোপিত দুর্বলতা, বৌদ্ধ ধর্মের পতন এবং অতি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে জৈন ধর্ম আবদ্ধ হওয়ার ফলে ইসলামের নতুন আদর্শ ও তত্ত্ব দক্ষিণ ভারত ছাড়া প্রায় সব দেশে দ্রুতপ্রসার লাভ করতে থাকে। সমাজ ও রাজনীতিতে বৌদ্ধ ও জৈনদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, রাজতন্ত্রের ওপর বৌদ্ধ জৈনদের প্রভাব, মূলত বৌদ্ধ জৈনদের ধর্মীয় আচরণের প্রতিবাদে মধ্যে দিয়ে ভক্তিবাদের প্রসার ঘটে।

বৈদিক হিন্দুধর্মের মধ্যেই ভক্তিবাদের তত্ত্ব নিহিত ছিল। বেদে ব্রহ্মাকেই ‘সৃষ্টির সূত্র’ এবং ‘আনন্দের উৎস’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ঈশ্বরের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবত গীতায়। হিন্দুধর্মশাস্ত্রে মুক্তির পথ হিসেবে জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সূত্রে ভগবানের উপর ভক্তি তত্ত্ব বিকশিত হয়। সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠ। সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতে ভক্তি আন্দোলন শুরু হয়, তামিলনাড়ু থেকে কর্ণাটক হয়ে উত্তর দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পঞ্চদশ শতকে বাংলা, উত্তর ভারতে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। আন্দোলনটি ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু ধর্মের প্রভাবশালী সামাজিক সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। জাতি প্রথা, বর্ণ প্রথা এবং ব্রাহ্মণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মে সংস্কারের লক্ষ্যে ভক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ষোড়শ শতক পর্যন্ত ভক্তিবাদের রেশ ভারতে ধর্মাচরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুলতানি আমল ছিল ভক্তিবাদী ধারার জনপ্রিয়তার কাল। ভক্তিবাদী তত্ত্বধর্মাচারণের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মাচরণ প্রক্রিয়ার যে বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছিল, তাকে ‘নীরব বিপ্লব’ বলা যায়। সহজ, সরল এবং একান্তভাবে মানবিক ভক্তিবাদী তত্ত্ব সমাজের বৃহত্তর অংশে যে আন্তরিকতার সাথে গৃহীত হয়েছিল, সেকালের সমাজ চিন্তা, সাহিত্য সংস্কৃতির ওপর যে প্রভাব ফেলেছিল, তার ফলস্বরূপ একে যথার্থই ‘আন্দোলন’ বলা চলে। 

সনাতন হিন্দুধর্ম বা ব্রাহ্মণ্যবাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম এবং রাজশক্তি প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন সমর্থনপুষ্ট ইসলাম মতাদর্শের স্বাভাবিক প্রসার সুলতানি আমলের প্রথম দিকে ধর্ম ভাবনার মূল সুর হিসেবে গণ্য হয়। এই পটভূমিতে ভারতের ধর্মীয় বিবর্তনের ইতিহাসে এক উদার ও সমন্বয়বাদী ধর্মতাত্ত্বিকের অভ্যুত্থান ঘটে। সাধারণভাবে এঁরা ‘সন্ত’ বা ‘অতীন্দ্রিয়বাদী সাধক’ নামে পরিচিত হন। নবম থেকে ষোড়শ শতকে অতীন্দ্রিয়বাদী বহু সাধক ভারতের ধর্ম জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ভক্তি আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তারা সকলেই ধর্মীয় বিভেদ ভুলে সমন্বয়ের কথা প্রচার করেন। তাঁরা সকলেই ভক্তিকেই ধর্মীয় উপাসনার পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

ভক্তিবাদী আন্দোলনের দুটি লক্ষ্য ছিল। একটি হল, হিন্দুধর্মের সংস্কার করে তাকে একটি সহজ- সরল রূপ দেওয়া – যাতে ইসলামধর্মের সাম্যবাদী আদর্শের আহ্বান থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সরিয়ে আনা যায়। অন্যটি হল হিন্দু ও ইসলামধর্মের বিরোধ কমিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসা। বর্ণভেদ-প্রথার বিরোধিতা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তে সাধন পথে ঈশ্বরলাভের তত্ত্ব প্রচার করে ভক্তিবাদীরা নিম্ন বর্ণের মানুষের কাছে হিন্দুধর্মকে জনপ্রিয় করতে পেরেছিলেন। কবীর, নানক, শ্রীচৈতন্য প্রমূখ ভক্তিবাদী আন্দোলনকে অস্পৃশ্য, অন্ত্যজ অসংখ্য মানুষের মনে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আশা সঞ্চার করে তাদের নব প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ভক্তিবাদের এই সামাজিক সচলতাকে সুলতানি আমলের অনন্য অবদান বলা যায়।

ধর্মসংস্কারের মধ্য দিয়ে সমাজ সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছিলেন ভক্তিবাদীরা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সামাজিক অসাম্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই একদল মানুষ ভক্তিমার্গের অনুগামী হয়েছিলেন। ভক্তিবাদী প্রচারকরা ছিলেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর অন্তর্গত। তাদের কেউ ছিলেন পেশায় কারিগর, আবার কেউ চৈতন্যদেবের মত ব্রাহ্মণ, ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও আন্দোলনে ডাকে সাড়া দেন সমাজে তথাকথিত নিম্নবর্গের জনগণ। এই ভক্তি আন্দোলনে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের সীমিত পরিসরে আবদ্ধ ছিল না। এই আন্দোলন সমাজে সামাজিক প্রতিষ্ঠার পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক ছিল। ভক্তিবাদী দার্শনিকেরা সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে স্থানীয় কথ্য ভাষায় তাদের মতাদর্শ প্রচার করেছেন। হলে তাঁদের বক্তব্য খুব সহজেই সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়। সহজ-সরল ভাবে কখনো রূপকের সাহায্যে, কখনো আকর্ষক প্রবচন প্রয়োগ করে এঁদের কথা প্ররোচিত হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে খুব সহজেই এঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভক্তিবাদে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বর্ণপ্রথাকে আক্রমণ করার ফলে নিম্ন বর্ণের বহু মানুষ ভক্তিবাদের অনুগামী হয়ে ওঠে।

মধ্যযুগে ভারতে বহু ভক্তিবাদী সাধকের আবির্ভাব ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে স্মরণীয় হলেন রামানুজ, নির্ম্বাক, বল্লভাচার্য, নামদেব, কবীর, নানক, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ। এঁদের রচিত কবিতা ও গান সেকালের সমাজ চিন্তা, সাহিত্য সংস্কৃতির ওপর যেমন প্রভাব ফেলেছিল, তেমনই খুব সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল।

ভক্তিবাদী সাধক হিন্দুধর্মের প্রখ্যাত সংস্কারক শঙ্করাচার্য অদ্বৈত মতবাদ প্রচার করেন। শঙ্করাচার্য বলেছেন, মুক্তির একমাত্র পথ হলো ‘জ্ঞান’। ভক্তিবাদের আদি প্রবক্তা রামানুজ এই মতে বিরোধিতা করেছিলেন। রামানুজের সমসাময়িক নিম্বার্ক। ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা করে তিনি ‘বেদান্ত-পারিজাত-সৌরভ’ রচনা করেন। নিম্বার্ক অদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করেন।

খ্রীঃ চতুর্দশ শতকের প্রথম দিকে মারাঠি সন্ত নামদেব মহারাষ্ট্রে ভক্তিবাদের প্রচার করেন। তিনি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী এবং মূর্তিপূজা ও ধর্মের বাহ্যিক অনুষ্ঠানের ঘোর বিরোধী ছিলেন। নামদেবের ধর্ম মতের মূল কথা অন্তরের শুচিতা, ঈশ্বরের ঐকান্তিক ব্যক্তি ও ‘হরি’র গুণকীর্তন। তাঁর গান সমাজ সংস্কারের কাজে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।

সুলতানি আমলে উত্তর ভারতের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বক্তা ছিলেন রামানন্দ। মধ্যযুগে অতীন্দ্রিয়বাদের প্রধান ও প্রথম বক্তা রামানন্দ ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভক্তিবাদ প্রচার করেছিলেন। “শ্রীরামচন্দ্রই  ঈশ্বর – তাঁর প্রতি অবিচল ভক্তিই মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবে’’- এই ছিল রামানন্দের বাণী। তিনি জাতিভেদ মানতেন না। হিন্দু সমাজের ধর্মীয়  আড়ম্বর ও নিরর্থক আচার-অনুষ্ঠানের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর ভারতে ভক্তিবাদের বাণী বহন করে আনেন রামানন্দ। বলা যায় তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে ভক্তি আন্দোলনের সেতু রচনা করেছিলেন। তিনি রামানুজের ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ প্রচার করেন। সমস্ত জাতের মানুষই তাঁর শিষ্য ছিলেন। তিনি হিন্দি ভাষায় কবিতা রচনা করে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তির বাণী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। রামানন্দের বড় কৃতিত্ব হল তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে গড়ে তোলা অসংখ্য শিষ্যের মাধ্যমে ভক্তিবাদকে দ্রুত দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই বলা হয় ‘মধ্যযুগের ভক্তিবাদী আন্দোলন রামানন্দের সাথে সূচিত হয়েছিল’। 

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মধ্যযুগের ভক্তি-আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি দান কবীর ও নানকের। রামানন্দ শিষ্য কবীর ছিলেন মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম সাধক। রামানন্দ স্বামীর উদার মতবাদ তার ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনিই প্রথম হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে মিলনের আহ্বান জানিয়ে গেয়েছেন মিলনের গান। কবীর বলতেন “ ঈশ্বর এক, কেবল নামে ভিন্ন। তার মতে, আল্লাহ ও রাম একই ঈশ্বরের আলাদা নাম।” কবীর বিভিন্ন ধরনের স্বাতন্ত্র ও বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে বলতেন -“ঈশ্বর মসজিদে নেই; মন্দিরেও নেই; কাবাতেও নেই, কৈলাসেও নেই আচারেও নেই. অনুষ্ঠানেও নেই; যোগেও নেই, ত্যাগেও নেই।” তাঁর মতে, ঈশ্বরের অধিষ্টান মানুষের হৃদয়ের মধ্যে। ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের জন্য গার্হস্থ্যধর্ম পরিত্যাগেরও তিনি বিরোধী ছিলেন। ইসলামীয় চিন্তাধারার সংস্পর্শে থাকার ফলে তার চিন্তাভাবনায় কিছুটা নতুনত্ব ছিল। তিনি ধর্মীয় উদারতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবি করেন। সর্বধর্ম-বর্ণ-সমন্বয়ী প্রেমের ধর্ম প্রচার করাই ছিল কবীরের লক্ষ্য। দু- লাইনের এক-একটি শ্লোকের (দোহা) মধ্যে দিয়ে কবীর অত্যন্ত সহজ-সরল বক্তব্য প্রচার সহজেই সাধারণ মানুষের বোধগম্য হত। আন্তরিক ভাবে জীবন-সত্যের উপলব্ধিকে তিনি নির্ভীকভাবে প্রচার করে গেছেন। শুধু বৈরাগ্যের সাজ নয়, অন্তরে বৈরাগ্য, প্রেম ও ভক্তি-এই সম্বল করে কঠোর কৃচ্ছসাধনের মধ্যেদিয়ে মানুষকে ভগবানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে- এই ছিল কবীরের শিক্ষা এবং এই শিক্ষাই তিনি দিয়ে গেছেন তাঁর দোহাবলীতে। তিনি হিন্দু ও মুসলমান সমাজের কদাচার ও ভন্ডামির উপরে আঘাত এনেছেন। কবীর বলেছেন-

    যো যাকে স্মরণ লয়ে ভাই

সোঁ রাখে তাকে লাজ

উলট জলে মীন চলে

                                     বহি যায় গজরাজ।…..১

আবার  কপট বৈরাগ্য, প্রেম ভক্তিহীন পাণ্ডিত্য, ভোগী মোহান্তদের বিরুদ্ধে বিদ্রুপের সুরে কবীর বলেছেন-

মুণ্ড মুড়ায়ে হরি মিলে

সব কোই লিয়ে মুড়ায়।

  বার বার কে মুড়াতে ভেড়

                                   না বৈকুন্ঠ জ্যায়ে।।… ২

কবীরের সাধনার মূল কথা হচ্ছে- নাম জপা, ভজন করা এবং সেবা ধর্ম গ্রহণ। তিনি ভজনের মধ্যে সাধনা করেছেন। ভজনের প্রত্যেকটি বাণীর মধ্যে দিয়ে তিনি ধর্মের মূল কথাকে ব্যক্ত করেছেন – 

মালা ফেরত জনম গয়া,গয়া ন মানকা ফের

করকা মালা ছোড়কে মনকা মালা ফের।…৩

  রাম নামে রসনাই কবীরকে উত্তরকালে এক সিদ্ধ সাধকে পরিণত করে। কবীর বলেছিলেন, “পাথরের মূর্তির মধ্যেই যদি ঈশ্বরের অধিষ্ঠান, তাহলে আমি সুবিশাল পর্বতকেই দেবতা হিসেবে পূজা করার পক্ষপাতী।” তার যুক্তিবাদী দর্শন খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে ভক্তিবাদের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল।

কবীরের মত নানকও একেশ্বরবাদ-তত্ত্ব প্রচার করেন। জাতিধর্মনির্বিশেষে যে কেউ প্রেম ও ভক্তিসহযোগে বারবার ঈশ্বরের নাম জপলে মোক্ষলাভ করবে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভের জন্য তিনি চরিত্র আচরণের পবিত্রতা ও গুরুর সান্নিধ্য লাভের উপর জোর দেন। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের ভাবধারা গ্রহণ করে দুই ধর্মের পার্থক্য দূর করার বা কোন নতুন সমন্বয়বাদী ধর্মমত প্রচারের জন্য কৃষকশ্রেণীর মধ্যে কবীর ও নানক  দুই প্রচারক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার প্রধান কারণ এঁদের মতবাদ ছিল বাস্তবজীবনের সঙ্গে সংযুক্ত। এঁরা উভয়ের সামাজিক সমস্যার কথা অনুভব করেছিলেন এবং তা দূরীকরণে সচেষ্ট ছিলেন। জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার করে সামাজিক সাম্যের ভিত্তিতে এঁরা সমাজকে পুনর্গঠিত করার আহ্বান জানান। কবীর ও নানক কোন নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা না করলেও শেষ পর্যন্ত অনুগামীরা যথাক্রমে ‘কবীর-পন্থী’ ও ‘শিখ-সম্প্রদায়’ নামে স্বতন্ত্রগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হন। অধ্যাত্মভাবে অনুপ্রাণিত নানকের কন্ঠের মধুর বাণী পরবর্তীকালে ‘নানকের ভজন’ নামে জনপ্রিয়তা পায়। নানক বলেছেন-

           যো একে নীর হ্যায় গঙ্গাজি

   এক নাম হ্যায় রাম

         এক চাঁদ হ্যায় এক সুরজ

           নির্বল কে বল রাম ।…..৪

 অর্থাৎ রাম নামই হল সারবস্তু- এই নামের মধ্যে দিয়েই সবকিছু উপলব্ধি করা যায়। নানকের ভজন গান ছিল ভক্তদের এক প্রধান আকর্ষণ। ঐশী প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে নানক যেসব ভজন রচনা করতেন তা ‘জপজী’ নামক গ্রন্থে সংবদ্ধ করা আছে ।

ভগবত কৃপালাপ করার একমাত্র উপায় অলখপুরুষের নাম জপ। নানকের দোহায় এই ভাবটি প্রকাশিত –

কূপ নীর বিনা ধেনু ছির বিনা

মন্দির দীপ বিনা

জ্যায়সে তরুবর ফল বিনা হীনা

ত্যায়সে প্রাণী হরিনাম বিনা।…..৫

নানক এইভাবে তার ধর্মের উপলব্ধি সমূহকে গ্রথিত করে যেসব ভজন রচনা করেছেন তা আমাদের সংগীত-ভান্ডারের অক্ষয় সম্পদ হয়ে রয়ে গেছে। 

উত্তর-পূর্ব ভারতের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা কেন্দ্র করে ভক্তিবাদের তথা বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে চৈতন্যদেব ছিলেন অন্যতম। শ্রীচৈতন্য বিশ্বাস করতেন নাম গানের মধ্যে দিয়েই ঈশ্বর লাভ করা যায়। চৈতন্য ধর্মমতের মূল কথা ছিল- বৈরাগ্য, জীবে দয়া ও শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক প্রেম। তিনি জাতিভেদ বর্ণভেদ প্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি অহিংসা পরম ধর্ম বলে মনে করতেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের সমানাধিকারের বাণী তিনি প্রচার করেন। চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনকে বাঙালি জাতির প্রথম জাগরণ বলে অভিহিত করা যায়। ষোড়শ শতকে বাংলাদেশে ভক্তিবাদের জোয়ার নিয়ে আসেন শ্রীচৈতন্যদেব। সমকালীন বাংলায় সামাজিক অচলতা, মানসিক জড়তা এবং ব্যবহারিক জীবনযাপনে উদ্দেশ্যহীনতার প্রতিবাদে শ্রীচৈতন্য এক হৃদয় ধর্মী, মানবতাবাদী প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। চৈতন্যদেবের আন্দোলনের পশ্চাদপটে সমকালীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। শ্রীচৈতন্য গৃহাঙ্গনের রুদ্ধ দ্বারের গোষ্ঠী-কীর্তনকে রাজপথের জন-সংকীর্তনের রূপান্তরিত করেন। সামাজিক বিভেদ (বর্ণগত) ও বৈষম্যের সামগ্রিক কাঠামোকে তিনি ভাঙতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রচারের কেন্দ্র ছিল হীনবর্ণের সমাজ।

কৃষ্ণ ভক্ত সুরদাস ছিলেন মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের স্মরণীয় সাধক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভক্তিগীতি বা ভজনের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর লাভ করা যায় । তার রচিত ভজন গুলো হলো হিন্দি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

ভক্তিআন্দোলনের এক স্মরণীয় নাম মীরাবাঈ। তিনি ছিলেন সাধিকা এবং কৃষ্ণভক্ত। সংগীত বা ভজনের মধ্যে দিয়েই কৃষ্ণ তথা ঈশ্বর লাভ করা যায়, এই ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।

মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের আর এক খ্যাতনামা সাধক হলেন দাদু। হিন্দু মুসলমানদের অনেকই দাদুর শিষ্য ছিলেন। তিনি প্রায় সারা ভারত পরিক্রমা করে সব ধর্মের অন্তর্নিহিত নিগুঢ় ঐক্যটি আবিষ্কার করেন। তিনি প্রচার করেন,“আমি হিন্দু নই, মুসলমানও নই, আমি পরম করুণাময় ঈশ্বরকেই ভালবাসি। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রত্যেকের মধ্যে ঈশ্বর আছেন – অন্তর শুদ্ধিই আসল কথা।”সর্বধর্ম সমন্বয় ছিল তাঁর আদর্শ। তাঁর কথা-

              ন তহাঁ হিন্দু দেহরা, ন তহাঁ তুরুক মুসীতি।

                                 দাদু আপৈ পাপ হৈ নহী তহাঁ রহ রীতি।।…৬

তুলসীদাসের অধ্যাত্ম চেতনা ভক্তি রসে সঞ্চিত ভাবাবেগ তার মুখ নিঃসৃত বাণী তাই তাঁর ভজন। তুলসী দাস তাঁর একটি ভজনে লিখেছেন-

         রাম জপু, রাম জপু রাম জপু বাবরে।

                ঘোর ভব নীরড় নিধি নাম নিজ নাবরে।।….৭

অর্থাৎ রাম নাম জপ করাই হল প্রধান কথা- এই জপের দ্বারাই ভগবৎকৃপা লাভ করা সম্ভব।

মধ্যযুগের রাষ্ট্র, ধর্মগত জীবনের অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ভাতৃত্বের বন্ধন দিয়ে সব মত পথের সমন্বয়ে গড়ে তোলাই ছিল সন্ত-কবিদের মূল উদ্দেশ্য । সুফি মত এবং বৈষ্ণব মতে এই দুই মতবাদের মধ্যবর্তী সন্ত-মতকে সমন্বয় সৃষ্টির প্রয়াস বলা চলে। অবতারবাদ তারা মানতেন না। ভগবান নির্গুণ-এই ছিল তাদের মতবাদ। এছাড়াও মুসলমান কবি রজ্জক, মুবারক, জামাল, আহমদ, রমলীন, দীন দরবেশ হিন্দুধর্মাত্মক গীতি কাব্য রচনা করেছেন। বলা যায় গানের মধ্যে দিয়ে মধ্যযুগে সাধকেরা হিন্দু-মুসলমান মিলনের ঐক্যের সুর বেঁধেছিলেন। 

আপাত দৃষ্টিতে ভক্তিবাদী আন্দোলন মধ্যযুগের ভারতে সামাজিক ধর্মীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করলেও বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। ভক্তিবাদী আন্দোলন ভারতীয় ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে ছিল এক ফলপ্রদ ঘটনা। কারণ এই আন্দোলন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির পরিবেশ রচনা করেছিল। ইসলামের উদারতাবাদী সম্প্রদায় সুফিসন্তের সাথে ভক্তিবাদী সাধকদের অনেক ক্ষেত্রেই মিল ছিল। এই দুটি অতীন্দ্রিয়বাদী আন্দোলন হিন্দু ও মুসলমান-সংস্কৃতির সেতুবন্ধন স্বরূপ কাজ করেছিল। বলা যায় ইউরোপের সংস্কার-আন্দোলনের মতো মধ্যযুগের হিন্দু ধর্মে সংস্কার-আন্দোলনও সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের বার্তা বয়ে আনে এবং ভক্তিবাদের উপর ভিত্তি করে হিন্দু-দর্শনকে নতুন সমাজ গঠন ও আধ্যাত্মিকতা বিকাশের উপযোগী করে তোলে।

তথ্যসূত্র

১। ভারতীয় সংগীতের কথা -পৃঃ-১২৪

২। ভারতীয় সংগীতের কথা – পৃঃ-১২৫

৩। বাংলা গানের ইতিবৃত্ত -পৃঃ-৯০

৪। বাংলা গানের ইতিবৃত্ত -পৃঃ -৮৭

৫। বাংলা গানের ইতিবৃত্ত -পৃঃ -৮৭

৬। ভারতীয় সংগীতের কথা – পৃঃ-১৩১

৭। বাংলা গানের ইতিবৃত্ত – পৃঃ -৯২

সহায়ক গ্রন্থ

১। সাবিত্রী ঘোষ -বাংলা গানের ইতিবৃত্ত।

২। প্রভাত কুমার গোস্বামী – ভারতীয় সংগীতের কথা।

৩। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য – ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস।

৪। অধ্যাপক জি.কে.পাহাড়ী – ভারতের ইতিবৃত্ত।

৫। হিতেশরঞ্জন সান্যাল – বাংলার ভক্তি আন্দোলনে পরিবর্তনের ধারা।