ভাদু গান, ভাদু নাচ : আদিবাসী পরব থেকে সাধারণের লোক উৎসব
দেবাশিস মণ্ডল
বাংলার রাঢ় অঞ্চলে যেসব লোক উৎসব ব্রত ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান সাধারণভাবে বেশিরভাগ মানুষ পালন করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হলো ভাদু উৎসব। প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়, বর্ধমান জেলার পশ্চিম অংশে এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের কিছু অঞ্চলে ভাদু উৎসব হয়ে থাকে।
ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকেই এই উৎসবের সূচনা হয়। বাড়ির কুলুঙ্গি পরিষ্কার করে গোবর জল দিয়ে নিকিয়ে সেখানে একটি পাত্রে কিছু ফুল, বিভিন্ন গাছের লতা পাতে দিয়ে ভাদুর বিমূর্ত রূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফুল, ও ফলমূল দিয়ে নিবেদন করা হয়। ভক্তি ভরে প্রণাম করা হয় ভাদু কে। সারা মাস ধরে ভাদু পুজো র বিশেষ রীতি পালন করে মাসের সংক্রান্তিতে ভাদুর বিমূর্ত কাঠামো, উপকরণ বা মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়।
ভাদ্র মাসের প্রথম দিনটিতে ভাদুর আগমনী গান গাওয়া হয়। ভাদুর বিমুর্ত রূপ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা ভাদুর আগমনী গান গায়-
আমার ঘরকে ভাদু এলেন
কুত্থাকে বসাবো,
পিয়াল গাছের তলায় আসন পাতাবো
না না না,
আমার সোনার ভাদুক কোলে তুলে লিব।।
……………………………………………
ভাদু খাবেক কড়কড়া
মোতির দাঁতে আওয়াজ দিবে
কুটুর মুটুর মড়মড়া ।…।…।…।…।…।।
ভাদু ‘মা’। আবার ভাদু কন্যাও। সোনার বরণ তার রূপ। তাকে কোলে তুলে আদর করা যায়। আবার পিয়াল গাছের তলায় আসন পেতে যত্ন করে ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে পুজোও করা যায়। গার্হস্থ জীবনের চলমান দুঃখ, সুখ, দৈন্য-দুর্দশার অংশীদার করে তোলা হয় ভাদুকে। আবার তার কাছে আবদার করে বলা হয়, দুঃখ যন্ত্রনার অবসান ঘটাতে। ভাদু কীভাবে কীভাবে, তার মোতির দাঁত। কলাই খাবার সময় কীরকম শব্দ হবে তারও নিখুঁত বর্ণনা আছে। ভাদুকে পেয়ে আত্মহারা কুমারী, কিশোরী
আর একটি আগমনী ভাদু গান –
ভাদু রানী আইলো আজি মোদের প্রাঙ্গণে
খুশির জোয়ার বইছে মোদের পরানে
মোদের ভাদুর আগমনে পুজো করবো সারা রাত্রি
জ্বালিয়ে সবাই মাটির বাতি
ফল দিয়ে করব পুজো ভাদুর চরণে।
মাটির বাতি জ্বালানোর রেওয়াজ এখনো আছে। দেবালয়ে, তুলসী তলায় নিত্য মাটির বাতি জ্বালার প্রথা এখনো গ্রামা রয়েছে। তবে কোথাও কোথাও পিতলের বাতিও জ্বালানো হয়। আর, সারারত ধরে পুজো করার কথা বলা হলেও সারা রাত ধরে ভাদু পুজোর রীতি নেই। শুধু ভাদু দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য আর নিজেদের আবেগ ও উচ্ছ্বাস থেকে এই কথা বলা হয়েছে।
ভাদু চলেছেন ল্যাচে ল্যাচে
ঝুমঝুম ঝুমঝুম নেপুর বাজে
ভাদুর উপের (রূপের) বাহার দেইখ্যা
উইঠলো জুয়ার (জোয়ার) মনের মাঝে।।
ভাদু পুজোর প্রচলিত ধারা সাধারণ ভূমিজ ও অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়। খুব সম্ভবতঃ এদের মধ্যেই এক সময় ভাদু পুজোর প্রচলন ছিল। পরে তা অন্যান্য সাধারণ ও অভিজাত গ্রামীন মানুষদের মধ্যেও প্রচলিত হয়। উপরের এই গানগুলির উচ্চারন বৈশিষ্ট্য থেকে সেরকমই কিছু ধারণা পাওয়া যায়। কুত্থাকে, আসন্ন্য সাঁজাহাবো, ল্যাচে ল্যাচে, উপের, জুয়ার, উইঠলো ইত্যাদি সাধারণ আদিবাসী মানুষদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত শব্দ।যাইহোক, বিষয়টি ভাষা তাত্বিকদের বিচার্য ও আলোচ্য।
ভাদুর বিসর্জনের আগের দিন থেকেই বিদায়ের সুর বেজে ওঠে। ভাদুকে ফুলে চন্দনে, মালায়, নানা রঙ্গের কাগজ দিয়ে সাজিয়ে ছোট মন্দিরের মতো করা হয়। সেটি কলা গাছের বা সোলার ভেলার উপরে বসিয়ে সংক্রান্তির দিনে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে, খালে বা বড়ো পুকুরে। আর তখনই চোখের জলে বিদায় জানানো হয় কন্যা রূপী ভাদু ‘মা’ কে।
বিদায় দিব কেমনে
বলো না ভাদু।
মোদের মন কইরেছ চুরি
দিয়ে তোমার জাদু।
যাচ্ছ তুমি যাও মাগো
আবার আইসো ফিরে।
ভুইল্যো না ভুইল্যো না
ভুইল্যো না মোরে।।৩
নীলাম্বরী পরবি পর,
ভাদু সোহাগিনী।
গরিব সই দের না দেখিলে
মাইরবো ঝাঁটা কপালে আনি।
মা ভাদু, কন্যা ভাদু, আবার এই ভাদুই কখনো সই অর্থাৎ বন্ধু। বাংলার লোক দেব দেবীদের অবস্থান ঘরের কুলুংঙ্গীতে, শবার ঘরে কিংবা গোয়ালে। উঠোনে, গাছের তলায়। সেখানে বরর্ষার জল পড়ে। ভাদু দেবী ভিজে সারা হয়ে যায়। তাতে এই গরিব প্রান্তিক মানুষদের মনে কোন রেখা পাত করেনা। কারন ভাদু দেবী। সেই রক্ষা কর্ত্রী। ভাদুর উপর ভরসা আছে, দাবি আছে, অধিকার আছে। তাই ভাদুর সেবা, খুব কাছের মানুষের মতো করে। সেখানে নিয়ম আছে, ঐতিহ্য আছে আর আছে বিশ্বাস। প্রিয়জনের মতো করে পাওয়ার অধিকার বোধ।
ভাদুর প্রতিষ্ঠার দিন থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভাদুর পুজো হয়। সাধারণভাবে প্রত্যেকবারই মহিলারাই এই পুজো নৈবেদ্য সাজান। তারাই গান গেয়ে ভাদুর প্রশংসাসূচক নানা আখ্যান পাঁচালীর মতো করে সহজ সরল ভাষায় ও সুরেগেয়ে ভাদু কে পুজো করেন। এর কোন সুনির্দিষ্ট রীতি নীতি প্রায় নেই বললেই চলে। নেই কোন মন্ত্র, যাগ যজ্ঞের মতো বিধি। বাড়িতে আর বাড়ির আশে পাশে যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই ভাদুর সেবা চলে। এই রীতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। ভাদুর অবস্থান হয় বাড়ির কুলুঙ্গিতে। অথবা কোন একটি মাটির পাত্রে কিছু ফুল, আতপ চাল ইত্যাদি দিয়ে ভাদুর কল্পিত রূপকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর প্রতিদিন সন্ধ্যায় গান গাইতে গাইতে কিছু ফুল ছিটিয়ে ভাদুর পুজো করা হয়। সঙ্গে কিছু ফল বা নাড়ু, কলাই ভাজা, নারকোল বা এই জাতীয় কিছু উপকরণ ভাদুকে দেওয়া হয়। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত এই পুজো চলে। সংক্রান্তির দিনে সকালবেলায় বাড়ির সকলে এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা সবাই মিলে একসঙ্গে নদীতে বা পুকুরে গিয়ে ভাদুর বিসর্জন দিয়ে আসে। অনেকে ভাদুর বিসর্জন এর আগের রাতে ভাদুকে নানা ভাবে সাজিয়ে ভেলা তৈরি করে তার উপরে বসিয়ে বিসর্জন দেয়। ইদানিংকালে বেশ কয়েক বছর ধরে ভাদুর মূর্তির প্রচলন হয়েছে। এই মূর্তির গায়ের রং হলুদ বর্ণের। সোনার বরণ। অনেকে বিমুর্ত ভাদুর পাশে মূর্তিকে বসিয়েও পুজো করে থাকেন। ভাদু মা লক্ষ্মীর প্রতীক। ভাদ্র মাসে যখন কৃষিকাজের কোন চাপ থাকে না, সে সময় ছোট ছোট মেয়েরা এবং বাড়ির বড়রা সবাই মিলে একসঙ্গে মিলে গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখের কথা, পাড়া-প্রতিবেশীর বিভিন্ন ঘটনা ভাদু গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
সাধারণভাবে আদিবাসী সমাজের মধ্যে ভাদু পুজোর রীতি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে সাধারণ ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে এই পুজোর প্রচলন হয়। ভাদু পুজোর উপকরণের মধ্যে ফুল এবং স্থানীয়ভাবে যা কিছু পাওয়া যায় সেগুলি নৈবেদ্য আকারে ভাদুকে দেওয়া হয়। কোন কোন গানে রয়েছে ভাদু খাবে কড় কড়া, মোতির দাঁতে আওয়াজ দেবে/ কুটুর মটুর মড় মড়া। এই ভাদু মুড়ির মোয়া খায় কিংবা ভাদু খায় গুড় মুড়ি, চিড়া, ভাজা ছোলা ইত্যাদিও। বর্ধমানে প্রচলিত একটি গানে রয়েছে ‘বর্ধমানের মহারাজা গো/ সে করে ভাদুর পুজা গো/ সন্ধ্যা বেলায় ভোগ দেয়/ কড়কড়া আর কলাই ভাজা।‘
ভাদু পূজো বা ভাদু উৎসব নিয়ে কিছু লোক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তারমধ্যে একটি কাহিনীতে জানা যায়, পঞ্চকোট রাজবাড়ীর নীলমণি সিংহের কন্যা ভদ্রাবতী। ভদ্রাবতীর বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে তার ভাবি স্বামীর অকাল মৃত্যু হয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কুমারী ভদ্রাবতী আত্মহত্যা করেন। অনেকে বলেন ভদ্রাবতী কে বিয়ে করতে আসার সময় তার হবু বর ডাকাত দলের হাতে মারা যায়। ভদ্রাবতী এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে তার ভাবী স্বামীর চিতার আগুনে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয়। এই কাহিনী মালভূমি অঞ্চলে সর্বত্র প্রচারিত হয়। ভদ্রাবতীর বাবা নীলমণি সিং দেও ভদ্রাবতীর স্মরণে অনেক গান লিখে সেগুলি প্রচার করতে থাকেন। এভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই গানগুলি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষ অনেকেই এই ভদ্রাবতী বা ভাদুর নামে গান রচনা করে মুখে মুখে প্রচার করেন। এভাবেই ভাদু পুজো ও ভাদু উৎসবের সূচনা ও বিকাশ ঘটে বলে অনেকে মনে করেন। বীরভূম জেলাতে প্রচলিত কাহিনী হল, ভদ্রাবতীর বাড়ি হেতমপুর বলে কল্পনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে হেতমপুরের রাজকন্যা ভদ্রাবতী কে বিয়ে করতে আসছিলেন বর্ধমানের রাজপুত্র। পথে ইলামবাজারের কাছে শালবনে ডাকাতদের আক্রমণে এই রাজপুত্রের মৃত্যু হয়। ভদ্রাবতী এই মৃতদেহের সঙ্গে সহমরণে যান। এই ঘটনা লোকমুখে প্রচারিত হয় এবং ভদ্রাবতী ক্রমে ভাদু নামে পরিচিত হোন। এর থেকেই ভাদু পুজো এবং ভাদু উৎসবের সূচনা বলে কেউ কেউ মনে করে থাকেন।
আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি নিবন্ধে লেখা হয়েছে, ‘ভাদু গান-কেন্দ্রিক লোক-উ়ৎসব। সে উৎসবের উৎস খুঁজতে গিয়ে পেয়েছি, নানা কিংবদন্তি। বিভিন্ন গবেষক, লেখক, ভাদু শিল্পীদের দেওয়া তথ্যানুসারে কিংবদন্তির বিভিন্ন রূপ কেমন? ভাদুই বা কে? এ নিয়ে নানা কিংবদন্তী রয়েছে। যেমন, অনেকে মনে করেন ‘ভাদ্র’ মাস থেকে ভাদু শব্দটি এসেছে। আবার কেউ বলেন, ভাদু মানে লক্ষ্মী। যে হেতু লক্ষ্মী বিভিন্ন সময়ে পূজিত হন, তাই ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীকে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করার জন্য ভাদু পুজোর প্রচলন হয়। অন্য মতও রয়েছে। সেই মতে ভাদুর সঙ্গে বাস্তবের কাহিনি জড়িয়ে আছে।
এই মতে ভদ্রাবতীর সংক্ষিপ্ত নাম ভাদু। তিনি পুরুলিয়ার এক রাজা নীলমণি সিংহদেওয়ের কন্যা। তিনি অন্ত্যজ শ্রেণির এক জনকে ভালবাসতেন। পিতা মেনে নিতে পারেননি। তাই ভাদু আত্মহত্যা করেন। রাজা মেয়ের স্মৃতিতে শুরু করেন ভাদু পুজো। কেউ কেউ বলেন প্রেম নয়, ভাদু ব্যাধির কারণে মৃত্যুবরণ করেন। রাজা মেয়েকে হারিয়ে তাঁর নামে চালু করেন স্মৃতি-তর্পণ।
আবার এক মতে, ভাদু কাশীপুরের রাজার মেয়ে। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বর্ধমানের রাজকুমারের সঙ্গে। বিয়ের দিন বর বেশে যাত্রা পথে রাজকুমারের ম়ৃত্যু ঘটে লেঠেলদের হাতে। ভাদু আত্মহত্যা করেন। অনেকে আবার ভাদুর সঙ্গে মীরাবাই-এর মিল পান। সে খানে রাজকন্যা ভাদু, জন্ম থেকে তিনি মীরার মতো কৃষ্ণভক্তি পরায়ণা। রাজা তাঁর বিবাহ ঠিক করলে ভাদু মন্দিরে নিজের প্রাণ ধ্যানস্থ অবস্থায় ত্যাগ করেন। কেউ কেউ ভাদুকে বাঁকুড়ার মল্ল রাজাদের কন্যা ভদ্রাবতী বলে মনে করেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে ভাদু পুজোর প্রচলন।
অনেকের মতে সাঁজপুজুনি, পুণ্যিপুকুরের মতো না হলেও এয়োস্ত্রী মহিলাদের শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে সংসার জীবনে সুস্থ থাকার জন্য এ এক ধর্মীয় ব্রত। কেউ কেউ বলেন ভাদু বীরভূমের সন্তান। তাই বীরভূমে ভাদু পুজোর এত প্রসার। আবার বর্ধমানের সঙ্গে ভাদুর যোগ খুঁজে পান কেউ কেউ। অবিভক্ত বর্ধমানের খনি অঞ্চলে ‘ভাদা গান’ বলে একটি লোক-সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। এখনও কিছু কিছু জায়গায় তার প্রচলন রয়েছে। তার নামে ভাদু পুজো’।১
ভাদু ছিলেন একজন অনাথ মেয়ে। কাশীপুর রাজ্যের লাদা গ্রামের প্রধান তাঁকে খুঁজে পেয়েছিলেন। কাশীপুরের রাজা নীলমনি সিং দেও এর রাজ্যের মধ্যেই লাদা গ্রাম। সেখানে এক ধরণের নতুন ধান চাষ হত, যার নাম ভাদুয়ি। সভমত সেই ধান ভাদ্রমাসে ফলত। সেই ক্ষেতের পাশ দিয়ে ভ্রমণের রাজ নীলমণি শুনতে পান যে লাদা গ্রামের প্রধানের একটি কন্যা আছে, যিনি দেবী লক্ষ্মীর জীবন্ত মূর্তি। তিনি তাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একটি সংস্কৃত পণ্ডিত (পণ্ডিত) এর ছদ্মবেশ ধারণ করেন। ভাদুকে দেখেন। তার সৌন্দর্য এবং অনুগ্রহে বিস্মিত হন। তিনি তাকে তার কন্যা হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। যাইহোক, তার বাবা, গ্রামের প্রধান, তার পালিতা কন্যাকে দূরে যেতে দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। রাজা ভাদুকে রাজকুমারির মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ধ্রুবচাঁদ তার শিক্ষার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেন। রাজকুমারী হিসেবে ভাদুর নতুন পরিচয় গোপন রাখা হয়। ভাদু গ্রামের মানুষের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কারণ তিনি রাজ্যের সব মানুষদের উন্নতির জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন। এক সময় পাশের গ্রামের কবিরাজ এর ছেলে অঞ্জনের সাথে ভাদুর দেখা হয়ে যায়। তারা প্রেমে পড়ে। এরই মধ্যে ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার জন্য রাজাকে কারারুদ্ধ করে। পরে অবশ্য তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। যখন তিনি অঞ্জনের সঙ্গে ভাদু‘র সম্পর্কের কথা শুনেন, তখন তিনি তাকে গ্রেপ্তার করে গোপন কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
ভাদু তার দুই সঙ্গীর সাথে রাজ্য জুড়ে ভ্রমণ করে অঞ্জনের অনুসন্ধান করতে থাকেন। বিভিন্ন দুর্গের ফটকে গান গেয়ে অঞ্জনের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। ভাধুর ধারণা ছিল অঞ্জনকে বন্দী করা হতে পারে। সে বুঝেছিল অঞ্জন তার কণ্ঠস্বর চিনবে এবং সাড়া দেবে। ভাদুর আকুলতায় সাড়া দিয়ে রাজ অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন। কিন্তু তত দিনে ভাদু অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার সহচররা জানায় যে একদিন সকালে সে আকাশের সাথে মিশে যায়। ভাদু তার প্রেমিকের জন্য নিরর্থক অনুসন্ধানে প্রথম যে গানগুলি গেয়েছিল তা গ্রামের মহিলারা গাইতে থাকে।
ভাদু গান, ভাদু উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গান গ্রামীণ সমাজের রঙকে প্রতিফলিত করে। এটি বর্ধমান, বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরে খুব জনপ্রিয় ছিল, এখনো অনেক জায়গায় ভাদু গানের ও উৎসবের জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভাদু গানগুলি স্থানীয় পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ গ্রাম্য মানুষেরা রচনা করে থাকেন। উত্সবের প্রতিটি রাতে ভাদু গান গাওয়া হয়। গানে ভাদু দেবীকে তরুণী হিসেবে দেখানো হয়। তারা ভাদুর রূপ ও গুণের বর্ণনা করে এবং কীভাবে ভাদু আনন্দ পাবে তা গভীর স্নেহের সাথে বিস্তারিতভাবে গেয়ে যায়। যেহেতু ভাদু অবিবাহিত, তার গানগুলি বেশিরভাগই অবিবাহিত মেয়েরা গায়।
দীর্ঘকাল ধরে ভাদু উৎসব উদযাপন করা হলেও ভাদু দেবীর কোন স্থায়ী মূর্তি ছিল না। সাধারণত একটি মাটির পাত্রে নানা রকম ফুল ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে ভাদুর বিমুর্ত রূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকত। এই পাত্রে ফুল ফল ও অন্যান্য নানা ধরনের উপকরণ প্রতিদিন দেয়া হত বা এখনো হয়ে থাকে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষরা ভাদু পুজো বা ভাদু উৎসব উদযাপন করলেও রাঢ় অঞ্চলের এবং বিহার ও ঝাড়খন্ড এই দুটি রাজ্যের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে একই সময়ে করম গান ও করম উৎসবের রীতি প্রচলিত রয়েছে। আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন আদিবাসীদের গরম উৎসবেরই হিন্দু সংস্করণ হলেও ভাদু পুজো বা ভাদু উৎসব। এ সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘ভাদু উৎসব ভাদ্র মাসের উৎসব। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসবে পালন করার রীতি রয়েছে বর্ষাকালে। তা-ও বিশেষ ভাবে ভাদ্র মাসে। বর্ষা উৎসবের এই করম গানের হিন্দু সংস্করণ হিসেবে ভাদু গানকে ধরেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি ভাদু গানকে আর্যেতর সমাজ উদ্ভূত ধরে, হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার প্রভাবজাত বলেছেন।’ ২
সাধারণভাবে ভাদু গানে পৌরাণিক নানা বিষয়, সমাজ ও গার্হস্থের বিভিন্ন নিয়ম নীতি ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। সেসব গানে বিভিন্ন পাঁচালির সুর শোনা যায়। সাধারণ ও গ্রাম্য মহিলাদের কণ্ঠে নিজেদের সুখ দুঃখের কথাও ঢুকে পড়ে। চাষ আবাদের সমস্যা, দৈনিক জীবনের জটিলতা, ইর্শা, পারষ্পরিক সমবেদনা ইত্যাদি সরল জীবনের নানা কথা ধরা পড়ে এইসব গানে। এছাড়া অল্প কয়েক লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানও রয়েছে। যেখানে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা সরসভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই সব লোকগান গুলিতে সমাজ জীবনের আনন্দদায়ক নানা ছবি ধরা পড়ে। ভাদুর গান আসলে সমাজের সাধারণ গ্রাম্য মেয়েদের মনের কথা। গানের কথায় বোঝা যায় তাদের গার্হস্থ্য জীবন ও সমাজ চেতনা।
১
‘ভাদু করি যে মানা
তুমি রামপুরাটের সিনেমা যেও না’,
‘ভাদু চাই ম্যাক্সি জামা
আমরা করি গো মানা
কলিকালের এই ঘটনা
বাপ মা করে না মানা’। ইত্যাদি।
২
ভাদু লে লে
ভাদু লে লে পয়সা দু‘আনা
কিনে খাবি,
কিনে খাবি মিছরির দানা,
কিনে খাবি মিছরির দানা।
৩
উপর পাড়া যাইয়ো ভাদু
নম পাড়া যাইয়ো না,
মাঝ পাড়াতে সতীন আছে,
মাঝ পাড়াতে সতীন আছে
পান দিলে পান খেয়ো না।
ভাদু লে লে পয়সা দু‘আনা
কিনে খাবি মিছরির দানা,
কিনে খাবি মিছরির দানা।
৪
সকাল বেলা উঠে পড়ে
ভাদু পয়সা পয়সা করো না,
বাবুরা পয়সা দিছে,
ওই বাবুরা পয়সা দিছে
গুনে লওগা দু‘আনা।
ভাদু লে লে,
ভাদু লে লে পয়সা দুআনা
কিনে খাবি মিছরির দানা,
কিনে খাবি মিছরির দানা।
৫
ও দোকানী দোকান খোলো
লিব পাওডার হিমানী,
আমার ভাদু মাথা বাঁধবে,
আমার ভাদু মাথা বাঁধবে,
পয়সা লিও না গো দোকানী।
ভাদু লে লে পয়সা দু আনা
কিনে খাবি মিছরির দানা,
কিনে খাবি মিছরির দানা..
৬
“ভাদু আমার গরবিনী
ওগো আমার ভাদুমনি
মাথায় দিব সোনার মুকুট
শাড়ি দিব জামদানি……”…..
৭
‘ভাদু যেয়ো না জলে
কোলের ভাদু যায়ো না মোদের ছেড়ে
গটা ভাদর থাকলে ভাদু গো
মা বলে ত ডাকলে না
যাবার সময় রগড় লিলে
মা বিনে ত যাব না’।
বর্ধমান ও পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভাদু গানের দল বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে,। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভাদু গান আর নাচের আসর বসায়। চাল, ডাল, টাকা সংগ্রহ করে। এর ফলে ভাদু গানের চর্চা বেড়েছে। আর নতুন নতুন রং বে রং এর গানও ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। এই নাচ ও গানের দলে একটি ছোট ছেলে বা মেয়ে ভাদু সেজে কোমরে ভাদুর পুতুল নিয়ে নাচে। ভাদ্র মাসের প্রথম সন্ধ্যায় ভাদুর পুতুল পুজোর মধ্যে দিয়ে সূচনা হয় এই ভাদু নাচের। সঙ্গে থাকে ঢোল, পাখোয়াজ, খঞ্জনী, হারমোনিয়াম। গানগুলি কখনো একক কখনো সমবেতভাবে গাওয়া হয়।
তথ্যসূত্র
৩। http://www.vivekanandacollegealipurduar.in/UploadedFiles/287498Acombinepdf-compressed%20(1).pdf