সত্যেন মৈত্র ও সাক্ষরতা আন্দোলন
স্বাধীনতা-উত্তরকালে এদেশে সাক্ষরতা তথা আ-বাঁধা শিক্ষাকে সত্যেন মৈত্র এক সুসংহত তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে গেছেন। দেশজুড়ে তার রূপায়ণে রেখে গেছেন অনন্য অবদান। আবিষ্কার করেছেন প্রাপ্ত বয়স্ক নিরক্ষদের শেখানোর জন্য ‘সারগ্রাহী’ পদ্ধতি। তৈরি করেছেন তাদের শেখানোর জন্য অতুলনীয় প্রাইমার ও বহুবিধ শিক্ষা উপকরণ। নিপীড়িতদের কাছে শিক্ষাগত ফ্রন্টে লড়াইয়ের জন্য রেখে গেছেন ধারালো হাতিয়ার। তিনি তাঁর জীবিতকালে দেশজুড়ে পেয়েছেন সাধারণ মানুষের অগাধ ভালোবাসা। একমাত্র তাঁর নামেই ১৯৯৭সাল থেকে ভারত সরকার প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর প্রদান করে আসছে ‘সত্যেন মৈত্র লিটারেসি অ্যাওয়ার্ড’।
পারিবারিক পরিচয় ও কর্মকাণ্ড:
সত্যেনদা জন্মেছিলেন নবজাগরণের প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত এক ঐতিহ্যমণ্ডিত ব্রাহ্ম পরিবারে। তাঁর জন্ম ১৫ আগস্ট ১৯১৫ সালে এবং মৃত্যু ৫ জুন ১৯৯৬ সালে। তাঁর ঠাকুরদা লোকনাথ মৈত্র ছিলেন বিদ্যাসাগরের একজন সুহৃদ। তিনি বিদ্যাসাগরের ডাকে সাড়া দিয়ে বিধবা জগত্তারিণী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন।সত্যেনদার বাবা ডা.দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র ছিলেন মেয়ো হাসপাতালের প্রখ্যাত সার্জেন, রবীন্দ্রনাথের বন্ধু এবং সমাজসেবী। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিয়মিত সাক্ষাৎ ও পত্রালাপ হত (চিঠিপত্র:সপ্তদশ খণ্ড; বিশ্বভারতী)। তিনি শিবনাথ শাস্ত্রী,ডা.নীলরতন সরকার, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার রায় প্রমুখের সহায়তায় ১৯১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি স্থাপন করেন, সম্ভবত ভারতের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সমাজসেবী সংস্থা, বঙ্গীয় হিতসাধন মণ্ডলী’ (বেঙ্গল সোস্যাল সার্ভিস লিগ)।এর উদ্দেশ্য ছিল জনশিক্ষা ও জনচেতনা প্রসারের মাধ্যমে নিপীড়িত জনগণের আত্মশক্তির বিকাশ।ড.মৈত্র সে সময় নানা স্লাইড, পুতুল ও ম্যাজিক লন্ঠনের সাহায্যে গ্রামে গঞ্জে ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্য চেতনা বিকাশের কাজ করে গেছেন।
সত্যেন মৈত্রর বাবা দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসাবে সত্যেনদা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ে উত্তীর্ণ হন। এখানে পড়াশোনার সময় তিনি স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একটি গুপ্ত সমিতির সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারপর তিনি বিলেতে গিয়ে একই সঙ্গে ভর্তি হন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে এবং ব্যা্রিস্টারির শিক্ষাক্রমে।আলোচ্য সময়ে ওখানে পড়াশোনার জন্য গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ও। ওখানে তিনি রজনীপাম দত্ত-র সংস্পর্শে আসেন এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হন। কিন্তু বাবার গুরতর অসুস্থতার কারণে পড়াশোনা অসামাপ্ত রেখেই তাঁকে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়।
এখানে প্রথম দিকে তিনি ‘আগন্তুক’,’চুন্টাপ্রকাশ’ নামে পরপর দুটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু রাজরোষে এগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৫৩ সাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ৪৩ বছর ধরে ‘বেঙ্গল সোস্যাল সার্ভিস লিগ’-এর সম্পাদক হিসাবে বিনা বেতনে তিনি জনশিক্ষার কাজে ব্রতী থেকেছেন। প্রথম দিকে অনেক বছর বেশ আর্থিক অনটনের মধ্যে তিনি রাজাবাজারে লিগের বাড়িতে সামান্য ক’জন কর্মী নিয়ে,একটি আবাসিক অফিস করে এলাকার লোকদের মধ্যে স্বাস্থ্যের ও সাক্ষরতার কাজ করতে থাকেন। তখন তাঁর সম্পর্কিত মাসীমা কুমুদিনী দত্ত সবার জন্য রান্না করে দিতেন। এরপর তিনি হাত দেন কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে সমীক্ষা করে নিরক্ষরদের খুঁজে বের করা, তাদের উপযোগী প্রাথমিক পাঠের বই (প্রাইমার) ও বহুবিধ উপকরণ তৈরি করার উপর।প্রখ্যাত বিদেশি বয়স্কশিক্ষাবিদ্ লব্যাক সন্ধান করে সত্যেনদার সাথে যোগাযোগ করেন। দুজনে মিলে এদেশে সাক্ষরতার কিছু পরীক্ষামূলক কাজ করেন। এই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে লিগকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সমাজ -শিক্ষার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য।
১৯৭০ সালে সত্যেনদাকে ‘জাতীয় শিক্ষা পর্ষদ’-এর সদস্য করা হয়। এই সময় থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘নিপীড়িতদের শিক্ষা বিজ্ঞান’-এর প্রণেতা পাওলো ফ্রেইরি-র সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সূচনা হয়।১৯৭৭ সালে সহকর্মী বিজন চৌধুরী ও (আন্দামান নির্বাসন ফেরত বিপ্লবী)প্রীতিশ দে-র সহায়তায় তিনি তৈরি করেন ফটো-ন্যুভেল “আমরা কেন লেখাপড়া শিখবে ?” এটি দেশে বিদেশে বিপুল সাড়া ফেলে এবং ৪০ টি ভাষায় অনূদিত হয়।লিগ থেকে প্রকাশ করা হতে থাকে স্বল্প সাক্ষরদের পাক্ষিক পত্রিকা ‘চলতি জগৎ’।এর শিরোনামটি এঁকে দেন সত্যজিৎ রায়।
পরবর্তী কালে ১৯৭৮ সালে বিরাট আকারে দেশব্যাপী ‘জাতীয় বয়স্কশিক্ষা কর্মসূচি’ গ্রহণ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী ড.প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র সত্যেনদাকে সারা দেশে বয়স্কশিক্ষার উপকরণ নির্মাণ ও প্রশিক্ষণ টিমের সদস্য করেন। লিগকে এরাজ্যের ‘রাজ্য উপকরণ কেন্দ্র’ হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়।সারগ্রাহী (ECLECTIC) পদ্ধতিতে সত্যেনদার তৈরি প্রাইমারকে সারা দেশের আদর্শ পাঠ্য বই হিসাবে গণ্য করা হয়। সত্যেনদা পরিচালিত ‘বারাসাত- ব্যারাকপুর গ্রামীণ শিক্ষা প্রকল্প’-ও পরপর তিন বছর সারা ভারতে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লাভ করে।এরপর ১৯৮৮ সালে ‘জাতীয় সাক্ষরতা মিশন’ শুরু হলে সত্যেনদা সেখানে নানা কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা কর্মসূচির পরিকল্পনা ও রূপায়ণের ক্ষেত্রেও তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। তিনি ইউনেস্কোর উদ্যোগে আয়োজিত মন্ট্রিল ও টোকিও-র আন্তর্জাতিক বয়স্কশিক্ষা সভাতে চেয়ারম্যানের গুরু দায়িত্ব পালন করেন।
এরাজ্যে ‘সার্বিক সাক্ষরতা অভিমান’ (TLC) শুরু হয় ১৯৯০সালে, মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলাতে। তারপর এটি একটির পর একটি জেলাতে ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অতি দ্রুত উপকরণ সরবরাহ, বিভিন্ন স্তরের প্রশিক্ষণ, তদারকি ও মূল্যায়নের যে বিশাল কর্মকাণ্ড সত্যেনদা পরিচালনা করেছেন, তার সত্যিই বিস্ময়কর। তবে এই অভিযান ও তার অনুসারি কার্যক্রগুলির ক্ষেত্রে যে সত্যনিষ্ঠতা ও জনমুখীনতার পরামর্শ তিনি দিয়েছিলেন,তা বহুক্ষেত্রেই মানা হয়নি। এজন্য তিনি খুবই ব্যথিত হয়েছেন।
চিন্তার বৈশিষ্ট্য:
সত্যেনদার সঙ্গে সাক্ষরতার কাজের সূত্রে আমার যোগাযোগ প্রায় সতেরো বছর।আর সরাসরি সত্যেনদার প্রত্যক্ষ পরিচালনায় ‘বয়স্কশিক্ষার রাজ্য উপকরণ কেন্দ্র’-এ কর্মসূচি সমন্বয়কারী হিসাবে আমার দশ বছর কাজ করার সুযোগ হয়। সত্যেনদার চিন্তার যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আমার বিশেষ করে চোখে পড়েছে,তা হল-
-উনি সাক্ষরতা বলতে কখনও অ আ ক খ শেখা মনে করতেন না। মনে করতেন ব্যবহারযোগ্য পড়া, লেখা, হিসাবের দক্ষতা,যুক্তিশীল মন এবং সক্ষমতার বিকাশ। তিনি বলতেন ফ্রেইরির কথা,’Learn to read the word and the world’.
-সত্যেনদা কখনও মনে করতেন না যে নিরক্ষর মানেই মুর্খ। তিনি ওদের সম্মান করতেন, ভালোবাসতেন।দয়ার মনোভাব নয়।উনি ওদের একটি যুক্তিশীল শিক্ষাশ্রয়ী সমাজের সদস্য হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।চেতনা বিকাশের নানা পন্থা পদ্ধতি নিয়ে তিনি সারা জীবন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেছেন।
-তাঁর কাছে মূল সমস্যা ছিল যুগ যুগের নিপীড়িতদের ‘নীরবতার সংস্কৃতি’ কাটিয়ে তাদের সরব ও সক্রিয় করে তোলা। কেননা, তিনি মনে করতেন দেশের কোটি কোটি মানুষ নিরক্ষর ও অজ্ঞ হয়ে থাকলে কখনই স্বৈরাচার ও ধর্মান্ধতাকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এজন্য গুরুগিরি নয়, তিনি জোর দিয়েছিলেন বন্ধুত্বপূর্ণ অংশভাগী শিক্ষণ প্রক্রিয়ার উপর।
-তিনি সব সময়েই মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির চর্চার উপর গুরুত্ব দিয়ে গেছেন।তিনি চাইতেন, প্রতিটি জনশিক্ষা কেন্দ্র হোক সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র। সাক্ষরতা তথা জনশিক্ষা আন্দোলন পরিণত হোক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে।
-সত্যেনদা চাইতেন সাক্ষরতা হোক সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার।বিজনদা,তান্তুদা (প্রীতিশ দে) ও আমাকে তিনি অনেকবার বলেছেন যে রাশিয়ায় লেনিন, চিনে মাও,ভিয়েৎনামে হো চি মিন,কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো সাক্ষরতা আন্দোলকে বিপ্লবী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এদেশে তিনি সেই দূরদর্শিতা একেবারেই দেখতে পাচ্ছেন না।
আজকের দিনেও বিকল্প সমাজের কথা যারা ভাবেন, তাদের কাছে সত্যনদাকে ফিরে দেখার আহ্বান জানাই।।
http://www.accu.or.jp/litdbase/material/_data/material/Use_of_Gas_from_Daily_Wastes/Use_of_Gas_from_Daily_Wastes_BEN_2_India.pdf