শিশুশিক্ষার উপকরণে ছন্দ : বিদ্যাসাগর ও আধুনিক প্রজন্ম
দেবাশিস মণ্ডল
লেখাপড়া শেখার শুরুতে ছড়া গান, কবিতাকে প্রাধান্য দেওয়ার রীতি সারা পৃথিবীতে সব ভাষাতেই প্রচলিত পদ্ধতি। ছন্দে পাঠ স্মৃতিতে সহজেই স্থান করে নেয় বলেই প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ রচয়িতারা অনেক জটিল নীতিকথাও ছন্দের মাধ্যমে শিশু কিশোরদের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দেবার জন্য সচেষ্ট হন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও তাই করেছেন। তার বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ এ স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণগুলি এমনভাবে সাজানো যাতে ছন্দের সৌন্দর্য অনুভূত হয়। প্রতিটি বর্গের মধ্যে কী অদ্ভূত ছন্দ লুকিয়ে আছে। যা শিক্ষার্থীদের ক্লান্তি বোধ করতে দেয় না। এর পরের অংশে যেখানে ব্যঞ্জনবর্ণগুলি এলোমেলো করে লেখা হয়েছে, সেখানেও ছন্দ বর্জিত হয়নি। পরের পৃষ্ঠায় বর্ণযোজনায় অজ-আম, ঈট-ঈশ, উট-ঋণ, এক-ওল ছন্দের বন্যা বইয়ে দেওয়া নাহলেও ছন্দের ছাঁদেই পর পর লেখা হয়েছে বইটি। পরে অচল-অধম, আলয়-আসন। কিংবা যাই-ভাই, চাই-পাই, ঝাউ-লাউ, খাও-দাও। আ-কারান্ত শব্দ শেখানোর জন্য তিনি লিখেছেন, ছাগল-পায়স, বালক-সাহস ইত্যাদি। ঊনস্বার (ং) শেখানোর সময় লিখেছেন, অংশ-বংশ, হংস-মাংস,সিঙ্ঘ-হিংসা, এবং-বরং। প্রথম বাক্য নির্মান শেখানোর জন্য লিখেছেন, বড় গাছ। ভাল জল। লাল ফুল। ছোট পাতা। পথ ছাড়। জল খাও। হাত ধর। বাড়ি যাও। কথা কয়। জল পড়ে। মেঘ ডাকে। হাত নাড়ে। খেলা করে। পাশাপাশি বা ওপর নীচ শব্দ সারিতেও ছন্দের ভাবনা মিশে আছে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় বইয়ে। এরকম উদাহরণ রয়েছে প্রতিটি ছত্রে ছত্রে।
সারা পৃথিবীতেই একই নিয়মে শিশুদের সংগে কথা বলা হয়, পড়ানো হয়, গল্প করা হয়। আমাদের বাংলার রূপকথাতেও ছন্দই প্রাধান্য পায়। আর তাই আবহমান কালধরে সেই সব গল্প শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত সবার মনের মনিকোঠায় স্থান পেয়েছে। কেউ বোধহয় তার সুর ভুলে যায়নি। আমরা যখন পড়ি, গলদা চিংড়ি, তিংড়ি মিংড়ি , লম্বা দাঁড়ার করতাল। পাকড়াশীদের কাঁকড়া ডোবায়, মাকড়শাদের হরতাল। তখন এর অরথ বোঝার দুসাধ্য প্রচেষ্টা থাকেনা। শুধু ছন্দ আর কব্য সৌন্দর্য সারা মনে আর অন্তঃকরণে সুরের ঝঙ্কার ধরে রাখে, শেষ হতে চায় না। রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে লিখেছেন, অবচেতন মনের কাব্যরচনা অভ্যাস করছি। সচেতন বুদ্ধির পক্ষে বচনের অসংলগ্নতা দুঃসাধ্য। ভাবী যুগের সাহিত্যের প্রতি লক্ষ্য ক’রে হাত পাকাতে প্রবৃত্ত হলেম। তারি এই নমুনা। কেউ কিছুই বুঝতে যদি না পারেন, তা হ’লেই আশাজনক হবে। [ অবচেতনার অবদান ] গলদা চিংড়ি, তিংড়ি মিংড়ি………… মাকড়শাদের হরতাল। পয়লা ভাদর, পাগলা বাঁদর ল্যাজখানা যায় ছিড়ে, পালছে মাদার, সেরেস্তাদার,কুটছে নতুন চিঁড়ে।। কলেজ পাড়ায় শেয়াল তাড়ায়, অন্ধ কলুর গিন্নি। ফটকে ছোঁড়া চটকিয়ে খায়, সত্যিপিরের সিন্নি।। মুল্লুক জুড়ে উল্লুক ডাকে, ঢোলে কুল্লুক ভট্ট। ইলিশের ডিম ভাজে বঙ্কিম, কাঁদে তিনকড়ি চট্ট।।
পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষার সুফল আমরা অনেক পেয়েছি। সভ্যতা দ্রুত গতিতে মানুষকে উন্নতির শিখরের দিকে নিয়ে চলেছে। কন্তু এখনো তবু দুঃখ করে বলেন ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’। তার কারন স্বার্থপরতা, হিংসা। পৃথিবীতে যত মানুষ অপুষ্টিতে অনাহারে মারাগেছে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ হিংসার বলি হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও মানবিকতা বিচ্ছিন্ন শিক্ষাকেই হয়তো দায়ী করতে হয়। শিক্ষায় মানবিকতা ও মূল্যবোধ বাড়ানো দরকার। চারুকলা বিশেষ করে সংগীত শ্রবণ ও শিক্ষায় যে মানবিকতার স্ফূরণ ঘটে তাকে চর্চার মধ্যে আনতে পারলে হয়তো হিংসা কমানো যাবে। মনোরোগের প্রকোপ কমবে।
16
সুরের নিজস্ব ভাষা আছে, ছন্দেরও ভাষা আছে। আনন্দের ছন্দ, দুঃখের ছন্দ, অবসাদের ছন্দ, নীরবতার ছন্দ, কোলাহলের ছন্দ। ছন্দের সঙ্গে শব্দের মেলবন্ধনে হয় সংগীত। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত হৃদয় থেকে রক্ত শ্রোত তরঙ্গ তুলে আন্দোলন সৃষ্টি করে চলেছে। দোলায়মান ছন্দে আমরা প্রতিনিয়ত ছন্দময় হয়ে আছি। Douglas নামে একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, ছন্দ সঙ্গীতের অত্যন্ত প্রভাবশালী দিক। ‘Everything from the cycle of our brain waves to the pumping of our heart . . . all work in rhythms. We’re a mass of cycles piled one on top of another, so we’re clearly organized both to generate and respond to rhythmic phenomena’। (Douglas 1987)
বাংলায় ছন্দে নামতা মুখস্ত করার মধ্যেও ছন্দের প্রাধান্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেখাযায় ছন্দে মুখস্ত কোন কিছুকে স্মরণ করতেও কোন বেগ পেতে বা বেশি মাথা ঘামাতে হয়না। যেমন কবিতার প্রথম লাইন মনে পড়ে গেলে পরের লাইনগুলো আপনা-আপনিই মনে এসে যায়। তারও বড় কারন হল ছন্দ ও সুর। লক্ষ্য করা যায় অ্যালজাইমার রোগীদের দ্রুত স্মৃতি ভ্রষ্ট হতে থাকে। যাকে সারিয়ে তোলার চিকিৎসা এখনো সম্ভব হয়নি। এই রোগীদের শেখা গান তারা ভুলে যায়না। ফলে তাদের সুরের মাধ্যমে অনেক কিছুই শেখানো যেতে পারে যা তারা সহজেই মনে রাখতে পারবে। হয়তো সুর ও ছন্দের মধ্যদিয়েই তাদের স্মৃতি শক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। নানা ধরণের তথ্য মনে রাখার জন্য ছন্দ ও সুরকে ব্যবহার করা একটি প্রাচীন পদ্ধতি। ভারতে বহুকাল এই পদ্ধিতি চালু রয়েছে। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, ভারতীয় লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বহু উপকরণ ছন্দে রচিত। এখনও লোকসংস্কৃতিতে ছন্দের প্রাধান্যই চলে আসছে। ছড়া, গান থেকে লোককথা, লোকনাট্য এমনকি বর্ণনামূলক কাহিনিও ছন্দে রচিত হয়। আধুনিক সাহিত্যেও ছন্দের নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে। অনেক ছড়া আছে যেগুলিতে ছন্দ বাদ দিলে তার অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়না।
ছন্দ আমাদের স্মৃতি শক্তি বাড়িয়ে দেয়। শিশুরা প্রথম কথা বলতে শেখে ছন্দ মেলানো শব্দ দিয়ে। আম্মা, আব্বা, মাম্মা, বাব্বা, কাক্কা, দাদ্দা ইত্যাদি শব্দ দিয়ে। একটু বড় হতে তারা ছড়া শেখে, ছন্দে ভরা কথা আর গানে তার মন প্রাণ ভরিয়ে দেয় তার গুরুজনেরা।
প্রথম ভাষা উচ্চারিত হবার সময় থেকে সুর ও ছন্দই ভাষা শেখার প্রথম অবলম্বন হয় বলেই ভাষা শেখাতে শিশুদেরও পটুত্ব দেখা যায়। সুর ও ছন্দহীন ভাষা চর্চা শুরু হলে হয়তো শৈশবটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠতো। বহুকাল ধরে মানুষ এসব দেখে শুনে বুঝেছে। হয়তো নিজের অজান্তেই প্রাথমিক শিক্ষায় ছন্দের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে মানুষ। তাই তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে বহমান রয়েছে যুগ যুগ ধরে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এইসব ব্যবস্থার বিশ্লেষণও শুরু হয়েছে বেশ কিছুকাল। প্রতিদিন নতুন নতুন গবেষণায় যে সত্য জানা গেছে তা’হল ছন্দ মানুষের স্মৃতি শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। ছন্দে শেখা গান কবিতা মানুষ ভুলে যায়না। ভুলে যায়না ছন্দে শেখা মন্ত্র তন্ত্রও।
যুগ যুগ ধরে মানুষ এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের মধ্যে তাদের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা মুখে মুখে প্রবাহিত হয়েছে। তারমধ্যে কত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা হারিয়ে গেছে তা আমরা জানিনা। কিন্তু মানুষই নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সম্মৃদ্ধ জ্ঞানকে ছন্দোবদ্ধ করে রেখে গেছে পরের প্রজন্মের মধ্যে। তা আর হারিয়ে যায়নি।
Rhythm in Kids’ Primer : Vidyasagar & New Generation