অধ্যাপিকা শিশিরকণা বুঝিয়ে গেলেন, বাঙালির সংস্কৃতি বলে আর কিছু নেই
পণ্ডিত অনিন্দ ব্যানার্জির হোয়াটস আপ থেকে
শিশিরকণা বুঝিয়ে গেলেন, বাঙালির সংস্কৃতি বলে আর কিছু নেই
বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে ইদানীং খুব লেখালেখি, কথা চালাচালি হচ্ছে চারদিকে। বাঙালির সংস্কৃতির বিপন্ন, বাঙালি ক্রমেই বাংগালি হয়ে যাচ্ছে—অনেক লোককে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে বলতে শুনছি।
কেন রে সংস্কৃতিকে বিপন্ন করিস তোরা? কত দুশ্চিন্তার লোক এক কথায় এসে হাজির।
ভালো, ভালো, বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে চারদিকে মাথাব্যথা।
কিন্তু দিন দুই আগে একটা ঘটনা দেখে ভাবতে ইচ্ছে করে, বাঙালির সংস্কৃতি বলে আদৌ আছে কিছু? আমি নিশ্চিত, আর নেই। যা ছিল, নির্বাচনের হট্টমেলায় ফুলে-ফুলে কাস্তে, হাতে সব সাফ হয়ে গিয়েছে। যা পড়ে রয়েছে, তা অতীতের কিছু জাবরকাটার ঘটনা। আমরা কেউই আর বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে গলা ফাটানোর জায়গায় নেই। আমরা মনেই রাখি না আমাদের গর্ব। গলা পর্যন্ত রাজনীতির নোংরা জলে ডুবিয়ে সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
শুধু রাজনীতিকদের, বাইরের লোকদের দোষ দিয়ে লাভ কী?
গত কাল ৯ মার্চ, ২০২১ তারিখে সকালে নয়াদিল্লিতে মেয়ের বাড়িতে প্রয়াত হয়েছেন কিংবদন্তি বেহালা শিল্পী শিশিরকণা ধর চৌধুরী। ভোটের গন্ধে গন্ধে হঠাৎই চারদিকে প্রচুর টিভির আবির্ভাব। এ একটা পার্টিকে তুলে ধরবে, ও আর একটার হয়ে পিছন থেকে খেলবে। সে করুক গে। কিন্তু সারাদিন কোথাও শিশিরকণার মতো কিংবদন্তির চলে যাওয়ার খবর একলাইনও দেখা গেল না। ওয়েবেও না, টিভিতেও না। নিজের গালে নিজেই একটা থাপ্পড় লাগে। তারপর ভাবি, বাংলা চ্যানেল তো এখন গোটা রাজ্য আর দেশের খবর পাওয়া যায় না। ঘুরেফিরে সারা দিন দুটো তিনটে খবর। সন্ধেয় কলতলার তর্ক। তারা না হয় শিশিরকণাকে এখন ভাববে ঘাসফুল বা পদ্মফুলের শিশিরকণা।
কেউ জানেন না, এই নারী ছিলেন তরবারি। নতুন দিগন্ত এনে দেন বাঙালিকে।
পরদিন কাগজ খুলে আরও বড় থাপ্পড় খাই। ছটা কাগজ উল্টে দেখি, চারটে বাংলা কাগজে খবরটা নেই। একটা লাইনও না। একটা ইংরেজি কাগজেও নেই খবরটা। তারা শিশিরকণাকে যোগ্য মনে করেননি। কলকাতার একটা বাংলা কাগজ ও একটা ইংরেজি কাগজ, শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ সংবাদে খবরটা বেরিয়েছে। অন্য বাংলা কাগজে বা ওয়েবে সে দিন লাভলি মৈত্র, কৌশানী মুখোপাধ্যায়, তনুশ্রী চক্রবর্তীদের নিয়ে লেখা ছিল অনেক।
শিশিরকণা কি একটা লাইনও দাবি করেন না? তাঁর ভক্তকূল কি বাংলা থেকে লোপাট হয়ে গেলেন রাতারাতি? পরের দিন ফেসবুকে অনেকের হাহাকার দেখো তো মনে হল না।
আমরা দোষ দেব অবাঙালিদের, আমরা গালাগাল দেব গুটখা সংস্কৃতিকে, আ মরি বাংলা ভাষা লেখা পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরে ঘুরব, নারী দিবসে নারীদের অবমাননা নিয়ে লিখব, ভাষণ দেব। আর ভুলে যাব বেহালার ছড়ে প্রথম সুর তোলা ভারতীয় তরুণী শিশিরকণাকে। এর চেয়ে দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে?
কে আপনি শিশিরকণা? সময়ের তুলনায় অনেক আগে চলে এসেছিলেন বাংলায়? শিলংয়ে জন্ম, সেখানে থাকলেই পারতেন তো! ভূপেন হাজারিকার মতো উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির মুখ হয়ে উঠতেন। জুটে যেতে পারত ভারতরত্ন। এ রাজ্যকে ভালোবেসে আজীবন সল্টলেকেই কাটিয়ে দিয়েছেন ওডিশার গর্ব, সেখানকার সর্বকালের সেরা গায়িকা সুনন্দা পট্টনায়েক। ওডিশার লোকেরা বারবার তাঁকে চেয়েও পাননি। কী পেয়েছেন সুনন্দা? বছর খানেক আগে অমৃতলোকে গিয়েছেন শিশিরকণার মতো নিঃশব্দে, নীরবে।
এখন কাগজে বা ওয়েবে বিশিষ্টদের প্রয়াণের খবর লেখার একটা নতুন ধারা দেখি। তাঁর মৃত্যুর খবর তিন লাইন লিখেই লেখা হয়—প্রধানমন্ত্রী টুইটারে গভীর শোক প্রকাশ করে লিখেছেন… মুখ্যমন্ত্রী গভীর শোকপ্রকাশ করে লিখেছেন…। কিংবদন্তির কৃতিত্ব আসে পরে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা টুইট করলেই যেন প্রয়াতর গুরুত্ব বাড়ে। শিশিরকণার জন্য ওঁরা দুজনের কেউ টুইট করেননি। সম্ভবত তাই অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমও জানতে পারেননি। এমন টুইট সম্ভবত সুনন্দারও জোটেনি। নবীন পটনায়েক করেছিলেন শুধু।
নারীবাদ নিয়ে বাংলায় ইদানীং চুটিয়ে দারুণ লেখালেখি করেন যাঁরা, দায় কিন্তু আপনাদেরও। শিশিরকণা যা করে দেখিয়ে গিয়েছেন, ভারতের কোনও নারী তখনও ভাবেননি। নারীদিবসের দুদিন পরে যে তিনি চলে গেলেন বাঙালির অবহেলার ভেলায় ভেসে, তাঁকে নিয়ে কী লিখলেন কেউ? লজ্জা বা অসম্মানটা শিশিরকণার নয়। পুরো বাঙালির। আমাদের এখনকার স্বনামধন্য বাঙালি মেয়েদের। তাঁরাও তো কেউ কিছু বললেন না। তাঁরা কি শিশিরকণার অবদান জানতেন না?
তখন তো অধিকাংশ মেয়ে শুধু গাইতেন। তার হাতে যন্ত্র ধরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস অভিভাবকদের ছিল না। কোনও মেয়েরও ছিল কি? ভারতের এমন কোনও কনফারেন্স নেই, যেখানে ডাক পাননি আলি আকবর, রবিশঙ্কর, অন্নপূর্ণা দেবী, ভিজি যোগের ছাত্রী। সর্ব অর্থে তিনি সর্বভারতীয় চরিত্র। আমেরিকায় শেখাতে গিয়েছেন আলি আকবর খানের স্কুলে। যাঁর স্টাইলে স্বপন চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট তবলিয়া খুঁজে পেতেন স্বয়ং অন্নপূর্ণা দেবীকে। আজকের কিংবদন্তি বেহালা বাজিয়ে এন রাজম কিন্তু শিশিরকণার পরে প্রচারের আলোয় এসেছেন।
শিশিরকণার পরে যন্ত্রসঙ্গীতে সাড়া ফেলেছিলেন রবিশঙ্করের ছাত্রী জয়া বিশ্বাস। তাঁকেই কি মনে রেখেছি আমরা? এখানে অনেক ক্লাসিকাল শিল্পী প্রচার নিতে ওস্তাদ। একটু কিছু করলেই নিজের প্রচারের জন্য ফোন করেন মিডিয়ায়। তাঁরাও কি জানাতে পারলেন না সবাইকে, যে শিশিরকণা নেই।
শিশিরকণা জীবন দিয়ে জানিয়ে গেলেন, আমরা বাঙালিরা সংস্কৃতির পানপেয়ালায় ডুবে আছি। কিন্তু আসল সংস্কৃতিকে পাঠিয়ে দিয়েছি বাংলার বাইরে। সপাটে। সংস্কৃতি শুধু টিভি চ্যানেলের কলতলার যুদ্ধে। এখানে এখন এ সব বিস্মরণ অনিবার্য। অতীত ভুলে থাকা মানেই ধমক খাবেন, আপনি না বড্ড পুরোনো হয়ে গিয়েছেন। নস্টালজিয়া ধুয়ে খেতে চান আম বাঙালির মতো।
শিশিরকণা সেই বিরল চরিত্র, নিজের জন্য কিছু বলেননি। করেই গিয়েছেন অসংখ্য সৃষ্টি। আজ রাজ্যে অনেকের বাড়িতে সরকারের দেওয়া শাল উপচে পড়ে। এতবার পেয়েছেন সরকারি পুরস্কার। শিশিরকণার জন্য সরকার বা বিরোধীরা ভেবেছেন কিছু? কবার তাঁকে ডাকা হয়েছে পার্টিগুলোর সংবর্ধনা সভায়? যেখানে ভোটের জন্য অসংখ্য লোকদের পাল্লা করে ডাকা হয়েছে। এক পার্টি গাইছে টুম্পা। এক পার্টি ডাকছে গোখরো, এক পার্টি সিরিয়াল শুরু করা তরুণীকে ভোটে নিয়ে চলে যাচ্ছে। পাল্লা করে ফ্লপ অভিনেতা অভিনেত্রীদের ডাকা চলছে দুই ফুলের তরফে। শিশিরকণা এঁদের কারও মা, মাসি, পিসি হলে প্রেসকে বলে কিছু পাবলিসিটি পাইয়ে দেওয়া যেত। এখন চুপ করে বসে থাকো।
নিন্দুকে যা বলছে বলুক, তাতে তোমার কী আর আমার কী?
এই বাজারে ফুল নিয়ে ভাবছে সবাই। এখানে শিশিরকণাকে নিয়ে ভাববে কে? ফুলের গন্ধ পেলে টাকা পাবেন। শিশিরের গন্ধে টাকাফাকা নেই। আপনিও যেমন দাদা, লিখতে বসেছেন। কাজ নেই কোনও।
চাঁদের কণা শিশিরকণাকেই যখন এত সহজে ভুলে যাওয়া হল, তা হলে বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে এত বড় বড় কথার কী আছে?
তবু শিশিরকণাকে হয়তো মনে রেখে দেবেন অজস্র মধ্যবয়সীরা। আকাশবাণীতে অনেকবার বাজনা শুনেছেন যাঁরা। ছোটবেলায় এত চমৎকার নামের অন্য কোনও ক্লাসিকাল শিল্পীকে কেউ জানত না।
শিশিরকণাকে ভুলবে না কলকাতার অজস্র গানের ঘর, হল। তাঁর বাজানো অজস্র রাগ মাথায় ঘুরঘুর করবে সে সব জায়গায়।
পলাশ কাফি রাগটা খুব ভালো বাজাতেন শিশিরকণা। এখন পলাশ শেষের সময়। সেই হারিয়ে যেতে বসা পলাশের দলও হয়তো মনে মনে বলবে, শিশিরকণা আরও একটু স্বীকৃতি পেতে পারতেন এই বাংলায়। যে অপমান, উপেক্ষা বাঙালি তাঁর জন্য রাখল, তা একদিন উপচে পড়বে বাঙালির জন্যই।
সূত্র
https://web.whatsapp.com/