নারী ক্ষমতায়ন প্রেক্ষিতে বঙ্গ-রঙ্গমঞ্চের শতাব্দীব্যাপী ‘অভিনেত্রী’ সূত্রতা
মৌ চক্রবর্তী , নাট্য গবেষক , নাটক ও নাট্যকলা বিভাগ, সংগীত ভবন, বিশ্বভারতী
mou.chakraborty@visva-bharati.ac.in
১.১ ভূমিকা
বঙ্গরঙ্গমঞ্চ ও ক্ষমতায়ন–এর পারস্পরিক কি কোন যোগ হতে পারে। যেখানে ক্ষমতা বিষয়টি নিয়ে এখনও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা পুরুষতান্ত্রিক ভরকেন্দ্রিক। সার্বিক প্রেক্ষাপট এবং জ্ঞাপক – সর্বজনীন মাধ্যমের তথ্য, উপাদানসহ এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আধুনিক পর্যায়ে। তবে বঙ্গরঙ্গমঞ্চ –এর ব্যাপ্তিতে পুরুষ-সমাজের উত্তম পুরুষকার তো সর্বজনবিদিত। এর সঙ্গে ক্ষমতায়ন জুড়তে গেলে তা হতে হবে, নারীকেন্দ্রিক আলোচনা। এবং, তা কেবলমাত্র নটী, অভিনেত্রীদের দিক থেকেই হতে পারে। জাতীয় পর্যায়ের যে পরিসংখ্যান তাতে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে আলোচনা এক নতুনতর অভিযোজন। এর মুখ্য উদ্দেশ্য নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আর্থিক অবস্থান বোঝা। এবং উক্ত প্রসঙ্গ সমাজ নামক এককে বিশেষ করে উপস্থাপিত হতে থাকছে ততক্ষণ, যতক্ষণ না আলোচনায় মতামতে সার্বিকভাবে নারীর সহাবস্থান ঘটে। উক্ত সহ – অবস্থানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এক ইউটোপিয় ধারণা, যার বাস্তবায়ন না ঘটলেও ধারণাটি নিয়ে সম্যক চর্চা হতে পারে। আলোচ্য প্রবন্ধের বিষয় নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গটি আন্তর্জাতিক এক মতবাদ। যা সম্পূরক হয়ে উঠছে বিগত শতকের নটী- সম্প্রদায়ের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায়। বিশেষত, একুশ শতকের নারীবাদ তত্ত্ব থেকে নিঃসৃত উদার ধারা, যা সামগ্রিকভাবে নারীজাতি লিঙ্গবৈষম্য, অধিকার, শিক্ষা, ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়কে উল্লেখ করে আলোচিত। এবং, তা নিয়ে আলোচনায় পৃথিবীব্যাপী এক নব পরিচিতি লাভ করবে বঙ্গনটী- সম্প্রদায়। ক্ষমতায়ন প্রেক্ষিত নারী সমাজের জন্যে। সেখানে নটী – সম্প্রদায়ের বিষয় হয়ে ওঠা কি সম্ভব? প্রশ্ন এও যে, বঙ্গনটীদের তো কাল গিয়েছে, তবে এখন ফের তাঁদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করার সার্থকতা কি? এবং, বঙ্গনটীদের জন্যে আলোচনার প্রেক্ষাপট আর সাধারণ নারী সমাজের আলোচনার প্রেক্ষাপট কি এক হতে পারে?
২.১ প্রেক্ষাপট ও বিস্তার
আলোচ্য যে, ক্ষমতায়ন শব্দটি বঙ্গীয়করণ করা হয় ইংরেজি এম্পাওয়ারমেনট শব্দের। এটি ইংরেজি এম্পাওয়ারমেনট শব্দের বাংলা অনুবাদকৃত। সেই হিসেবেই বাংলা প্রবন্ধের আলোচনায় উল্লিখিত। ইংরেজি অভিধানে এম্পাওয়ারমেনট শব্দটি থাকলেও, সমাজতাত্ত্বিক অভিধানে তা নারীর ভূমিকায় আলোচিত হয়নি বিশ শতকের আগে। এবং, সেই প্রেক্ষাপট থেকে এর আলোচনা হতে থাকে, সাধারণ সমাজের নারী তথা মেয়েরা কি কি সুবিধে পেতে পারেন, তা নিয়ে। ‘উইমেন এম্পাওয়ারমেনট’ – এর তাত্ত্বিক আলোচনা অর্থে বোঝানো যায় যে, এটি কোন এক নির্দিষ্ট বিষয় দ্বারা সংজ্ঞায় আবদ্ধ বিজ্ঞানলব্ধ প্রক্রিয়া নয়। এটি এক সমাজভিত্তিক প্রক্রিয়া। যা নিত্যদিনের মধ্যে দিয়ে ঘটবে এবং নারীকে জারিত করবে ক্ষমতা জোগাবে। নারীর সামাজিক অবস্থান, অধিকার, নারীর শিক্ষা, নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রভৃতির বিকাশ হল ক্ষমতায়ন।
কিন্তু এই আলোচনা তো সাধারণ সমাজের নারীদের জন্যে। তাঁদের সামগ্রিক উন্নতির জন্যে। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে। সমাজের গঠন, পরিবেশ থেকে সমাজে মেয়েদের যে সংস্কার বা উন্নতির প্রকাশ, তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সাধারণ সমাজের নারীরাই। কারণ, এক, সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে থাকা নারীজাতির বিশেষ পদক্ষেপ মানে, সমাজেরই উন্নতি। সেই সামগ্রিক উন্নতির ভাগ সমাজবিচ্ছিন্ন জাতিকারাও পেয়ে থাকবেন। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে সমাজের সঙ্গে যোগ নেই। অথচ, সমাজের দ্বারা লাঞ্ছিত সমাজের ভোগ্যা – নির্যাতিত জাতিকাদের তবে কোন সমাজ? নিজেদের জন্যে পৃথক সমাজ? যে সমাজের নামকরণ করা যায় – বণিতাপল্লী, পতিতাপল্লী বা তদ্রূপ কিছু। নাটকের সমাজের যোগ দিতে আসা মেয়েদের নাটকে আসার আগে থেকেই এক পৃথক সমাজ ছিল। বিশ্লেষক আলোচক রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সমাজের নাম উল্লেখ করেছেন তাঁর বইয়ে। বইয়ের নামকরণও বিশেষ শব্দ দ্বারা সূচিত করে, যে ‘অবিদ্যাপাড়ার অভিনেত্রীরা’।
তাহলেই বোঝা যায়, সাধারণ সমাজের ক্ষমতায় কতটা এগিয়ে যেতে পারে উক্ত বিশেষ পাড়ার অভিনেত্রীরা। প্রশ্ন এ নিয়ে নয় যে কতটা এগোতে পারছে। প্রশ্ন হল পরিচয় যেখানে অভিনেত্রী, সেখানে কোন পাড়ার – একথা কিজন্যে নির্ধারিত করে দেখানো হচ্ছে। এক, গোত্র পৃথক করে দেওয়া। দুই, সমাজগত দৃষ্টি, তিন, কোন স্থান থেকে উঠে কতটা ক্ষমতা অর্জন করেছে , তা সূচিত করা। আলোচ্য তিন প্রশ্ন তথা জিজ্ঞাসায় প্রবন্ধের ধাঁচাটি তৈরি হতে পারে। উক্ত তিন নম্বর প্রশ্নতথ্যের মধ্যে, অভিনেত্রীদের পক্ষ থেকে ক্ষমতায়ন শব্দের প্রেক্ষাপট আলোচনা প্রয়োজন।
ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে একটি উক্তি উদ্ধৃত করা হল যুক্তিসাপেক্ষে, উক্তিটি পাকিস্তানের বাসিন্দা সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী নারীশিক্ষার অগ্রদূত মালানা ইউসাফজাই-এর। তাঁর কথায়, ” I raise up my voice – not so I can shout, but so that those without a voice can be heard … we cannot succeed when half of us are held back.” [i] অর্থাৎ, ক্ষমতায়ন -এর বিস্তার ক্ষমতার প্রভাব সৃষ্টি করা নয়, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
প্রাসঙ্গিক ক্ষমতায়নের মধ্যে দিয়ে সমাজের সমানুপাত রক্ষা। নারীর ক্ষমতা, যা প্রধানত তিন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এক, অর্থ অর্থাৎ, রোজগার করে স্বাবলম্বী হওয়া। রোজগার করার জন্যে প্রয়োজন শিক্ষা। অর্থাৎ দুই, শিক্ষা অর্জন। শিক্ষা দ্বারা চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা তৈরি হয়। ফলে, তিন, মতামত দেওয়ার স্বাধীনতা, নারীর প্রাপ্য। উক্ত তিন সূত্রের অভ্যন্তরে নারী ও সমাজ, নারী ও লিঙ্গভেদ, নারী ও স্বাধীনতা প্রভৃতি সমাজতাত্ত্বিক পারিভাষিক আলোচনা চলমান। নারী ক্ষমতায়ন এর কারণ, শুধুমাত্র নারীর উন্নীত হওয়ায় নয়। এর সদর্থক ভূমিকায় সমাজের উন্নতি ঘটে। কারণ, নারী সমাজের অংশ। নারী দ্বারা শিশু পালিত হয়। নারী দ্বারা সংসারের অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম চলে। ফলে, নারী দ্বারা সমাজের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তগুলি নারী ক্ষমতায়ন দিয়ে সমাজকেই সক্ষম করে। এবং, এর স্বাভাবিক রূপ হিসেবে নারী নিজের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে , শিক্ষার দ্বারা পেশাভিত্তিক আয় তথা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। নিজস্ব মূল্যবোধ তৈরি হতে পারে নারী দর্শন উন্নত হতে পারে। অপরদিকে, নারী ক্ষমতায়ন স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঠিক দিকটি তাঁর শিক্ষা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলে, সমাজের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উন্নতি ঘটে।
এ প্রসঙ্গের উদাহরণ হিসেবে, সাধারণ সমাজের কন্যা। তাঁরা ব্যতীত যে উনিশ শতকের নটী – সম্প্রদায় বা অনুরূপ জাতিকারা – তাঁদের বিষয়েও একই তত্ত্ব প্রয়োগ এবং উল্লেখ করা যায়। কারণ এই প্রবন্ধের মেরুদণ্ড তাঁরাই। মেরুকরণের সিকিভাগে পরিগণিত না হওয়া জাতিকাদের কয়েকজন যে কৃতিত্ব রেখেছিলেন নাট্যশালার ইতিহাস থেকে, তাই আলোচনার। এক, সুকুমারী দত্ত ওরফে গোলাপসুন্দরীর লেখা নাটক ‘অপূর্ব সতী’, যা বাংলা সাহিত্যের নাহোক বাংলা নাটকের আলোচনায় অবধারিত আলোচ্যের।
দুই, বিনোদিনীর লেখা , তাঁর কলমে, তাঁর জবানিতে অভিনয় জীবন নিয়েই শুধু নয়। সমাজের কিছু পরিচয় মেলে। আলোচ্যের ‘আমার অভিনয় জীবন’ লেখা ৬২ বছর বয়সে। তিন, সরযূবালা-র প্রবন্ধ লেখা। চার, সুশীলাবালার গিরিশচন্দ্র ঘোষের প্রয়াণ সভায় বক্তৃতা দেওয়ার অধিকার নেওয়া, নটী-দের আপনবর্গীয় সচেতনতা। একুশ শতকের ভাষায়, নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা।
পাঁচ, সুকুমারী দত্ত নাম নিয়ে গোলাপসুন্দরীর বিবাহের সিদ্ধান্ত, সংসার, নাটক লেখা এবং পরবর্তীতে নাটক শেখানোর স্কুল খোলা। ছয়, প্রভা দেবীর সন্তান ও সংসার পালন, সিনেমায় অভিনয় প্রভৃতি। সাত, বিশ শতকে কেতকী দত্তের অভিনয়ের সূত্রে লিভিং লেজেনড ‘নটী বিনোদিনী ‘, নাটকের অভিনয়।[ii] প্রতিটি উদাহরণের ক্ষেত্রে নটী –দের অভিনেত্রী হয়ে ওঠাই মূল্যায়নের ভিত্তি। এবং, অভিনয় দ্বারাই তাঁরা এমন এক আলোচনার স্থানে , যেখানে তাঁদের নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে গবেষণামূলক কাজে। এবং, উনিশ শতকের অভ্যন্তরে ব্যবসায়িক প্রাচীরের মধ্যে নতুন মুখের ভিড় জমা হতে থাকাদের চিত্রাবলী, মানে ছবি মেলে না। হাতেগোনা কয়েকজন নটী –দের স্ক্যান করা সাদা কালো সংরক্ষণহীন ছবি পাওয়া গেলেও, খুব পার্থক্য করা যায় না। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, ভুল তথ্যের অবকাশ থাকে।
এঁদের সম্বন্ধে আকর তথ্যাদি জানা যায়, নটীদের আত্মজীবনীমূলক লেখা থেকে, তাঁদেরকে নিয়ে তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে। উপাদান হিসেবে অমিত মৈত্র –এর ‘রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’, উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের ‘তিনকড়ি , বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী’, দেবনারায়ণ গুপ্ত –এর ‘বাংলার নট-নটী’ দু – খণ্ডে এবং রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বই , ‘অবিদ্যাপাড়ার অভিনেত্রী’ প্রভৃতিই প্রত্যক্ষ সহায়ক। এবং, অভিনেত্রীদের ছবির কপিও সেখান থেকেই নেওয়া হয়। নটী বিনোদিনী-র নিজের লিখে যাওয়া কথা, যা বই আকারে বের হয়। এবং, পরবর্তীতে সেই বই ঘিরে আরও বই। জিজ্ঞাসু করে পাঠক ও গবেষকদের, একই বই ঘিরে এতগুলো সম্পাদিত – গ্রন্থের মানে মূল্যায়ন করা। একুশ শতকের বিদ্যা-চেতনার নতুন দিশায় নটীদের সম্মান জ্ঞাপন।
এক্ষেত্রে একটি প্রত্যক্ষ উপাদান গ্রহণ করা হয় আলোচনার সুবিধার্থে। যেমন, ‘আমার অভিনয় জীবন’ শীর্ষক রচনায় নটী বিনোদিনী লিখেছেন যে, দরিদ্র ছিলেন। তাঁর মা তাই থিয়েটারে পাঠান। টাকা রোজগারের জন্যে তিনি কাজ করলেও, বেশ স্নেহ পেয়েছিলেন। টাকা তখন বেশি পাওয়া যেত না। কিন্তু নতুন একটা কাজে যুক্ত হতে অনেকেই এসেছিলেন। বিনোদিনীকে বেশি স্নেহ করতেন এক বড় নটী, তাঁর নাম রাজা। তিনি তাঁর থিয়েটারে পার্ট বলার প্রথমদিনের ঘটনার সঙ্গে তিনি প্রাপ্ত বয়সের ঘটনার উল্লেখ করেছেন তথা তুলনা করেছেন। সেখানে তিনি জানান যে, এখন অনেক বদলে গেছে।[iii] এই যে ‘লেখিকা বিনোদিনীর এখন’ অর্থে ৬২ বছর বয়সের রঙ্গালয়। এখানে, উল্লেখ করার যে, তিনি ২৩-২৪ বছর বয়সে রঙ্গালয়ে অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপরের সময় হল ৩৮ বছর। যখন তিনি দ্বিতীয়বার নিজের কথা, লিখছেন এবং লেখার শুরুতেই লিখেছেন যে, ‘আবছা হয়ে আছে’। এরপর ছোট থেকে থিয়েটারের সঙ্গে বেড়ে ওঠার ঘটনা। এবং, সঙ্গে থিয়েটারের বদলে তুলনা করা। যাকে সাহিত্যের ভাষায় তুলনা বলা হয়। আর, তাঁর ক্ষেত্রে, নাটক শুধুমাত্র রুজিরুটির উপাদান নয়। নাটক থেকেই শিক্ষা। দেখা ও শেখা নাটকের পরিবেশ থেকে অভিজ্ঞতা, যা পরবর্তীতে অভিনেত্রী থেকে লেখিকা, লেখিকা থেকে আকাশবাণীর গায়িকা করে তোলে। কিন্তু এই ধরণের শিক্ষা তো অপ্রাতিষ্ঠানিক। আর, ক্ষমতায়নের যে শিক্ষা তা আক্ষরিক অর্থে সমাজের বিদ্যায়তনি শিক্ষা। তবুও, বিনোদিনী নাটকের অভিনয়কালীন শিক্ষাকেই কাজে লাগিয়েছেন বিকল্পের ভাবনায়। এবং, আত্ম-সম্ভ্রম রক্ষায় নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘটনা, যা নাটকের অভিনেত্রীদের মধ্যে একমাত্র উদাহরণ। উক্ত ঘটনা ক্ষমতায়নের লক্ষণ হিসেবেই আলোচিত হওয়ার প্রাসঙ্গিক দাবি রাখে একুশ শতকের সময়কালে।
এও উল্লেখ্য যে, নটী বিনোদিনীর যে লেখা থেকে উদ্ধৃত অংশ তুলে ধরা হল, তা এক বিশেষ সংকলনের অংশ। ‘ দুই শতাব্দীর বাঙালির নাট্যচিন্তা’ নামের বাংলা নাটকের আলোচনামূলক বইয়ের অংশ। উক্ত বইয়ের ৬৭১ পাতার বিন্যাসে , বিনোদিনী দাসীর ভাগে লেখিকা হিসেবে ২৫ পাতা। প্রবন্ধ ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’ নতুন কিছুই নয়। বরং, যা তাঁর আত্মজীবনীতে লেখা, তারই খানিকটা, বলা যায় অংশবিশেষ। উক্ত সম্পাদিত নাটকের বইয়ে উনিশ, বিশ, একুশ শতকের নাট্যবিদ, নাট্য বিশ্লেষক, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিকদের দুর্লভ প্রবন্ধ ঠাসা। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মেধায় ভরপুর প্রবন্ধাবলীর মধ্যে একটি বিনোদিনী দাসী, একটি তিনকড়ি দাসী এবং একটি সরযূ দেবীর লেখা। সেখানে উনিশ শতকের বিনোদিনী দাসী ওরফে নটী বিনোদিনী লেখিকা হিসেবে উল্লিখিত।[iv] অর্থাৎ, উনিশ শতকের এক বিশিষ্ট অভিনেত্রীর সংগ্রামের সঙ্গে বাঙালির নাট্যচিন্তার সূত্ররূপ প্রতিষ্ঠা হয়। শুধু কি তা নাটকের জন্যে, নাটকের ইতিহাসের জন্যে। এই জিজ্ঞাসু দৃষ্টির একটি উত্তর, ক্ষমতায়নের ব্যাখ্যায় একথাই বিবৃত করা হয়েছে যে, ক্ষমতায়ন আত্মসম্মান থেকে প্রকাশ লাভ করে। ক্ষমতায়ন সমাজের থেকেই অর্জন করতে হয়। যেমন, বিনোদিনীদের তথা নটী –দের অর্জন করতে হয়েছিল। সমাজের বঞ্চিত, লাঞ্ছিত শ্রেণি হওয়াও তাঁদের ক্ষমতায়ন শতাব্দীর নাট্যচর্চার উপাদান হয়ে ওঠে।
নানান ব্যাখ্যার একটি স্বরূপ এও যে, নাটকের মঞ্চে অভিনয়কালে তাঁদের স্থান ঐ সাধারণ সমাজের শিক্ষিত বাবুদের মতনই হয়। সমাজ থেকে নিচু বা উঁচু নয়, একই অবস্থানে। তবুও ছবি মেলে না তাঁদের সঙ্গে অভিনয়ের। এক্ষেত্রে সমাজের প্রস্তরখণ্ডের ছবি তুলে ধরা যেতে পারে, প্রামাণ্য তথ্যরূপে।
ছবি ৭ থেকে এ ধারণা করা যায় যে, এটি এমন এক সামাজিক ফলক, যা কোনও আলোচিত নাট্যদৃশ্য হয়ে উঠতে পারে। আলোচ্য ছবিটির মালিকানা নেই। আন্তর্জালিক মাধ্যমে বিনোদিনী নাম লেখার সঙ্গে সঙ্গে মেলে। এমন কিছু ছবি নটী হিসেবে তিনকড়ি দাসী, সুশীলাবালা, তারকবালা, এলোকেশীদের থাকাটাও অবাক করত না। কারণ, তাঁরাও বিনোদিনীর মতনই , একই পথে এসেছিলেন মুক্তির সন্ধানে। যেমন, তিনকড়ি দাসী, নটী হিসেবে বিখ্যাত হলেও, তাঁকে নিয়ে আলোচনার জন্যে ঐ জন্মগত সূত্রটিকেই বৃহৎ করে দেখার সমাজ। কিন্তু, সেযুগের হুজুগে নাট্যপ্রেমী , খোলাম কুচির মতন টাকা ওড়ানো শখের আর্ট প্রেমীরা নকল করলেও, সংরক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবতেই পারেনি। আরেকটি কারণ এঁদের ছবি মেলে না, তা হল এঁদের জন্মগত বংশগত সূত্র। যা কোনও মানুষেরই জন্ম – পরিচয় তাঁর নিজের ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের ক্ষমতার বিকাশ ঘটা, কিন্তু ক্ষমতায়ন নয়।
ক্ষমতায়ন বিস্তারের পূর্বেই বঙ্গরঙ্গমঞ্চের নটী-রা নিজেদের স্থাপন করার প্রক্রিয়ার মধ্যে চলছিলেন। ঠিক যেমন ক্ষমতায়ন চলে। উনিশ শতকের ১৮৭৩ সালের পর থেকে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অভিনেত্রীদের যে চলমান ধারা, তাতেই ক্ষমতায়নের বাস্তববাদী উদাহরণ মেলে।
সমাজ তখনও নটী, অভিনেত্রীদের নিয়ে ততটা অগ্রসর হয়নি, যে তাঁদের সাধারণ শিল্পীর সম্মান দিতে পারে। সমাজ অর্থে সেই বৃহত্তর সমাজ পরিসর যার মধ্যে উনিশ শতকের সমাজসূচিত মন্দ মেয়েরাও অবস্থিত। সমাজের ব্যবহৃত মেয়ে, নারী, শিল্পী, কন্যা প্রতিটি শব্দের বিভিন্ন অর্থ অভিধান অনুযায়ী। সমাজ এক বৃহৎ সংগঠন যেখানে মেয়ে, নারীদের সঙ্গে সংঘাত অর্থে সমাজের ভেতরের সেই কুসংস্কারসমূহ। যার কিছু বা সময়ের সঙ্গে চলে গেছে, কিছু জাঁকিয়ে মজ্জাগত হয়ে রয়েছে। বিশ শতকের আগে সাধারণ সমাজের মেয়েদের সুবিধে ছিল এই যে, তাঁদের লড়াই ছিল সমাজের সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি লাভের জন্যে। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে নেই, এমন জাতিকাদের সংগ্রামের ক্ষেত্র আরও ব্যাপক। যা সে বা তিনি ব্যতীত বিশ্বের সবটুকুতেই লড়াই। প্রথমত লড়াই বা অধিকার ,তা হল সামাজিক সম্মানের। মায়ের পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকা জাতিকাদের এক্ষেত্রে মাতৃজাতিকা বলে অভিহিত করা হল। [v]
সামাজিক সম্মানহীন আচরণ সত্ত্বেও ততদিনে তাঁকে বা তাঁদের নিয়ে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ যতটা না এগিয়েছে, তার চেয়ে যে বেশি এগিয়েছেন নটী – অভিনেত্রীরা, সে বিষয়টি আলোচনার। কারণ, ক্ষমতায়নের উপাদ্য বিষয় থেকেই জ্ঞাত হওয়া যে, নারীকেন্দ্রিক ক্ষমতায়নের যে বিষয়টি মুখ্য, সেই বিষয়টি একটি ধারণার প্রকাশ ও সঠিক প্রয়োগ। যা, নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এমন নীতি তথা কর্মসূচি , যার দ্বারা শুধুমাত্র নারীরাই নয় – সমাজের তথা দেশেরও সামগ্রিক অগ্রগতি ঘটে।[vi]
উক্ত সূত্র ধরলে নটী – ক্ষমতায়নের মধ্যে দিয়ে বাংলা নাটকের যে উন্নতি ঘটেছে, তা প্রতিস্থাপিত হয়। ফলে, এই সূত্রের সফল প্রয়োগ ঘটে। কিন্তু, নটী হতে আসিয়েরা নিজেদের জন্যে বিকল্প একটি উপায় খুঁজতেই বঙ্গরঙ্গমঞ্চে এসে যুক্ত হতে থাকেন। এবং বঙ্গরঙ্গমঞ্চে নটীদের তালিকা দীর্ঘ হয়। এবং, তারকা হয়ে ওঠার পর দুই শতাব্দীর মধ্যেকার সূত্র হয়ে থাকে। সপ্তাহের ছবিমালায় পাল্টে যায় না নগরের থামের ছবির পোস্টারের মতন। যায় না বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শিল্প-জাতিকাদের নাম ডাকনাম, উপনাম আলোচিত হতে দেখা যায়। বঙ্গরঙ্গমঞ্চের নাট্যসম্রাজ্ঞী, মর্জিনা, প্রাইমা ডোনা নাইটিংগেল, রেয়ার ফ্লাওয়ার, ইয়াং জিনিয়াস, কিংবদন্তী, এবং স্টার।
স্টার এক বিশেষণ, যার মধ্যে বঙ্গরঙ্গালয়ের নটী, অভিনেত্রীদের অস্তিত্ব এককথায় প্রকাশিত। ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়ায় নব্য দর্শনগত প্রকাশ, নটী –দের দিক থেকে আলোচিত হলে, তা বাংলা নাটককে আন্তর্জাতিক মান দেয়। কারণ, যে নটী- দের জন্মকথা, মানহীন সমাজের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তা ক্ষমতায়ন সূত্রের প্রয়োগে বিশ্বায়নের মাত্রায় ঠেকে। এবং সমাজের নির্ধারিত সেই ঘূর্ণি থেকে বের হয়ে আসার ঘটনাবলী কি তাঁদের পুনর্জন্ম কথা হিসেবে আলোচিত হবে? নাকি ক্ষমতায়ন?
আরেকটি একুশ শতকের ছবি তুলে আলোচনার প্রসঙ্গের মতটি প্রতিষ্ঠা করা যায়। এটি আন্তর্জালিক মাধ্যমে ভাসমান সূত্রে প্রাপ্ত। যেখানে বিনোদিনীর উপস্থাপনার চিত্রটি বিশেষ দৃষ্টিতে ধরতে চাওয়া হয়েছে।
ছবি ১০ – এর সূত্র হল, একটি চলচ্চিত্রের পোস্টার। যার মূল উপজীব্য নটী বিনোদিনী। ছবির বর্ণনায় লেখা , ‘ Above: Teaser poster for the upcoming Binodini movie by Ram Kamal Mukherjee. Photo courtesy Ram Kamal Mukherjee‘। [vii]
কিন্তু এই ছবির সঙ্গে তো নটী – বিনোদিনীর চেনা-জানা ছবির মিল নেই। ছবির মূল উপপাদ্যে রয়েছেন নটী ও নটীদের জীবনের প্রাপ্তি । এবং অপ্রাপ্তির শতাংশ। যেখানে নটীদের পুনর্জন্ম কথা ও ক্ষমতায়ন বিষয় প্রেক্ষিত হয়ে ওঠে। এবং, ধরে নিতে হবে নটীদের একক বিনোদিনী। তাঁকে কেন্দ্রে রেখেই নটী থেকে অভিনেত্রীদের বিশেষত্বের উপস্থাপন।
২.২ নটীদের পুনর্জন্ম কথা ও ক্ষমতায়ন
নটীদের পূর্বজন্ম ছিল। সেই জন্মকথা কোনও পৌরাণিক আধ্যাত্মিক পাঠ নয়। তা ছিল সমাজের নিপীড়িত, শোষিত জাতিকাদের কথা। যার কেন্দ্রভাগে ছিল সেই কুসংস্কার ও সমাজ, যেখানে সামগ্রিকভাবে সাধারণ সমাজের মেয়েদেরও লাঞ্ছনার সূত্রপাত। এবং, কোনও কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরিণত বয়সের বিধবা, শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া ভদ্রঘরের মেয়েদেরই সমাজ নির্ধারিত আচার – আচরণের যে পাশবিক যন্ত্রণা, তাতে বাঁচতে চাওয়া কোনও কোনও মেয়েরা চৌকাঠ পেরিয়ে যেত। এবং, পুরুষের ফুঁসলে আনা নিগৃহীতা, জাতিকাদের অনুরূপ কোনও ভদ্রস্থান সমাজ দেয়নি। কিভাবে জন্ম হয় সমাজচ্যুত জাতিকাদের এমন বৃত্তান্তের গবেষণাপত্র এক সজাগ উদাহরণ। বহু গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত এ তথ্য। উদাহরণস্বরূপ, দেবযানী কর –এর ‘ নগরনটী কথা ‘ গবেষণাপত্রটির উল্লেখ করা যায়। কলকাতার যে মন্দ মেয়েদের উল্লেখ, যে নিষিদ্ধ পল্লীর ক্ষেত্র – তা কিভাবে চলে পুরুষ ছাড়া, এ প্রশ্ন গবেষক রেখেছেন পাঠকের কাছে, সমাজের জন্যে।
সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের সমাজচরিত্রের সঙ্গে মেলে ‘বামুনের মেয়ে’, ‘রাজলক্ষ্মী’, কিরণময়ী-দের চরিত্র নির্মাণে। উক্ত চরিত্ররা সাধারণ সমাজের। থেকে উত্থিত এবং পরে জীবনের বিচিত্র গতিতে নির্মম সমাজের হয়ে গেছে। বিনোদিনীদের মতন নটী –দের বিষয় ঠিক মেলে না সোজাসুজি দেখলে। কিন্তু, একটি সমাজ, পরিবারবিচ্ছিন্ন মেয়ের পুঁটুলি নিয়ে রাতের অন্ধকারে গৃহত্যাগ – যেন গ্রিক ট্র্যাজেডির নিয়তি- নির্ধারিত পথ। ‘নগরনটী কথা’ এ যাবতকাল দীর্ঘ গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠা জাতিকাদের যে নিন্দিত সমাজের অত্যাচারের জন্যেই একঘরে জীবন নিয়ে বাস করতে হয়, সেবিষয়টি প্রমাণিত সমাজসত্য। যেহেতু জাতিকা একঘরে, ফলে স্ব-উপার্জনের পথটিই একমাত্র রয়ে যায়। যেখানে শিক্ষা বলতে মৌখিক , খুব বেশি হলে নামটুকু লেখায়, প্রাথমিক পড়ায় সীমাবদ্ধ। তাতে আর কোনও পেশা গ্রহণের সুযোগ থাকে না। একা বিধবার জন্যে পরিচারিকা, রান্নার মেয়ে – এসব ভূমিকা সাহিত্যে, সমাজে মেলে। এবং, একা বিধবা, অরক্ষণীয়াদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ , তা প্রাজ্ঞ লেখকরাও দেখাতে পারেননি। কেননা, তা হত অতি – কাল্পনিক। যা ঐ সময়ের রচনায় থাকলে, পাঠকের ভ্রু-কুঞ্চন আর নারীদের এক অন্য সমাজের দেখা মিলতেও পারত। সাহিত্যের ইত্যাকার শ্রেষ্ঠ রচনাকারদের চরিত্র উনিশ এবং বিশ শতকের থিয়েটারের প্রাণ। সাহিত্যের যে মেয়ে সমাজের দ্বারা অত্যাচারে পালিয়ে যায়, তারজন্যে সমাজের গৃহ-পালিত কাজগুলোর সুযোগ থাকে না। ফলে, একটি ব্যবসাই অবলম্বন থাকে। সেই নির্যাতিত জাতিকা একসময় গোত্রের রোল বা চরিত্রে অভিনয় করে। নাটক সমাজের অংশ। এবং সমাজ থেকে নাটকের রসদ মেলে। এর মধ্যে দুই সমাজ ভাগ হয়ে যায়, জাতিকাদের জন্যে। অন্তপুরবাসিনীদের সমাজ। আর মন্দ মেয়েদের সমাজ। সমাজের ডাকনামে নির্ধারিত জাতিকাদের সমাজের বাইরের হয়েও, পুরুষের গণ্ডীর মধ্যে থেকে যেতে হয়। এই আবর্তে থাকলেও, সব জাতিকাদেরই কূল-পেশা দেহকেন্দ্রিক নয়। এরমধ্যে ভারতীয় লোকধারার শিল্পীদের এক বিশেষ যোগদান থাকে।
বাংলা নাটকের নটী-দের জন্মকথা যাইহোক, কর্মবৃত্ত দেখা যায় পেশাদার শিল্পী হিসেবেই। যাত্রাপালার দল, কীর্তনের দল, হাফ আখরাই শিল্পীকন্যাদের থেকে যে তাঁদের বাছাই করা হয়েছিল , এমন উদাহরণের জন্যে আর কোনও সূত্র দিতে হয় না। সব তাত্ত্বিক, আলোচক একই মতের প্রামাণ্য তথ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, বাংলার কয়েকটি আকর শিল্প – কর্মের মধ্যে কীর্তন, হাফ আখরাই, তামাশা, তরজা, খেমটা, খেউর প্রভৃতিতে জাতিকা তথা শিল্প – জাতিকাদের অস্তিত্ব ছিল প্রবলভাবেই। এবং, তাঁরা পেশাগতভাবে সফল হয়েই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, উচ্চশ্রেণির অভিনয় ভাবাতুর নাট্যকার, অভিনেতাদের। এবং তাঁদের সমৃদ্ধগুণের বহিঃপ্রকাশ হয় মঞ্চনাটকের সাফল্য। সাফল্য অর্থের বিশ্লেষণ হল, এক, মঞ্চ নাটকের দিকে দেশীয় দর্শকদের আগ্রহ। দুই, হাততালি। তিন, এনকোর, এনকোর ধবনি। চার, একই পাড়ায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে আরও মঞ্চ তৈরি হওয়া। পাঁচ, বেনিয়া , মুৎসুদ্দিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাটকের বাজার। এবং, অনুচ্চারিত যে সাফল্য, তাহল মন্দ মেয়েদের ক্ষেত্রে, এক ধাপ এগিয়ে সমাজের ভদ্রজনদের সঙ্গে নাটকের মহলা দিতে দিনের আলোয় বেরোনোর সাহস। এবং, সাহসের ফলে, তাঁদের এক বিশেষ গোষ্ঠী তৈরি হয়, একজনের পথ দেখে আরেকজন আসেন। ইত্যাদি আলোচনার এক পরিভাষা যদি সাফল্য হয়, তবে অন্য সমাজভিত্তিক পরিভাষা হতে পারে, নটীদের অবস্থান সমাজভিত্তিক নাহলেও ক্ষমতায়ন-এর সোপানে পা রাখা। যা একুশ শতকের সাংস্কৃতিক বহুমুখী সৃজনশীল নারীসত্তার দিক থেকে ছিল – বৈষম্যমূলক টিকে থাকার লড়াই।
নটীদের ক্ষমতায়নের কিছু পত্রিকার ছাপা দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ, প্রবন্ধের যুক্তি, সমাজের তৎকালীন দর্শন, নাটকের সামগ্রিক অবস্থান এবং পত্রিকার সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা কতটা ছিল, সাম্প্রতিক একুশ শতকে তা তুলনাত্মক প্রতিবেদনের সাক্ষ্য।
এক, সাধারণী, ১৯ শে জ্যেষ্ঠ , ১২৮৬ বঙ্গাব্দ প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় যে, এক, কুক্ষণে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বঙ্গের রঙ্গভূমিতে বারাঙ্গনা প্রবিষ্ট করিয়া গিয়াছেন …।[viii] এবং, দুই, মন্দ স্ত্রীলোক দিয়া অভিনয় … শ্রাদ্ধ অনেক দূর অবধি গড়াইবে…।[ix] এবং তিন, সেই স্ত্রীলকেরা কত মন্দ ,তার নির্ধারণের জন্যে ‘ভারত সংস্কারক’ পত্রিকার ২২ আগস্ট, ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত অংশের উল্লেখ করেছেন অমিত মৈত্র। তাঁর ‘রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’ বইয়ের আলোচনায়। সূচনা লিখতে গিয়ে তিনি ‘ গোড়ার কথা ‘ বলে বইয়ের ভূমিকায় তুলে ধরেছেন নটী –দের মঞ্চে অভিনয় প্রসঙ্গ। উক্ত প্রতিবেদনের ভাষারূপ থেকেই সমাজের সার্বিক রূপ নির্দেশিত হয়। ” এ পর্যন্ত আমরা যাত্রা , নাচ, কীর্তন, ঝুমুরেই কেবল বেশ্যাদিগকে দেখিতে পাইতাম,কিন্তু বিশিষ্ট বংশীয় ভদ্রলোকদিগের সহিত প্রকাশ্যভাবে বেশ্যাদিগের অভিনয় এই প্রথম দেখিলাম। ভদ্রসন্তানেরা আপনাদিগের মর্যাদা আপনারা রক্ষা করেন ইহাই বাঞ্ছনীয়।”[x] চার, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট ‘ ১৮৭৩, ১৮ আগস্ট, পত্রিকায় প্রতিবেদনের অংশ – ” … the two actresses, who were professional women, we are informed, were msot successful. we wish this dramtic crops had done without the actresses. It is true that professional women join the jatras and natches, but we had hoped that the managers of the Bengali Theatres would not bring themselves down to the level of the Jattrawallas.”[xi]
পাঁচ, অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বাংলা ভাষায় লেখা হয় ‘সমাজপরিত্যক্ত ধর্ম – ভ্রষ্টা’ এবং ‘ নাটকাভিনয়ে উন্নতি করিতে গিয়া যদি সমাজের একজন লোককেও আমাদের পরিহার করিতে হয়, তাহা হইলে সে ক্ষতির আর পূরণ করা হইবে না।[xii] অর্থাৎ, নাটক বনাম সমাজের লড়াই নয়। কেবলমাত্র ভ্রষ্টা – স্ত্রীলোকই লক্ষ্য প্রভৃতি আলোচনার।
অপরদিকে, নাট্যকার অমৃতলাল বসু , যিনি প্রথিতযশা অভিনেতাও। নাট্যপ্রাণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল ঐজাতীয় স্ত্রীলোক নেওয়ায়। তিনি তো লিখেইছিলেন যে, ‘ যে শ্রেণীর স্ত্রীলোকের মধ্য হইতে অভিনেত্রী নির্বাচন করা হয়’, এবং উচ্চাঙ্গের স্ত্রী-চরিত্র সকল অভিনয় করিতে সক্ষম হইবে না। এবং তাহারা উশৃঙ্খল হবে।’ আরও উল্লেখ্য যে, পরে তিনি এই ধারণা যে ভুল ছিল তাও লিখেছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি ছিল যে, ‘… শ্লীল আচরণের সঙ্গে নিয়মানুবর্তী।’ [xiii] অর্থাৎ, সমাজের পুরুষেরা নষ্ট হতে পারে, এমনতর অবগুণ নটী হতে আসা জাতিকাদের ছিল না। উক্ত উদাহরণগুলো, বহু প্রবন্ধের সহায়ক। কারণ, এই উপমা ধরেই নটী –দের নিয়ে লেখা একাধিক প্রবন্ধের এক জোরদার তথ্য, যা নটীদের স্বপক্ষের। যে নটীদের আগামির জন্যে অভিনয় করার শিল্পী সত্তা থেকে জন্ম নেবে, অভিনেত্রী, স্টার প্রভৃতি।
একদিকে যেমন অভিনেত্রীদের নিয়ে পত্রিকামণ্ডলীর ভাবপ্রকাশ তথা প্রতিবাদ। অন্যদিকে, নাট্য – গবেষকরা দাঁড়িয়েছেন এই নিন্দিত তবুও স্পর্ধায় মঞ্চায়ন করিয়ে ‘কলাবতী’দের পাশে।তৎকালীন থিয়েটারে দর্শকের অবস্থান ছিল লক্ষ্মী উপমায়। দর্শক আচরণ নাটকের শো –এর সঙ্গে যে মানানসই ছিল না, সেই প্রসঙ্গে দুটো উদাহরণ দেওয়া যায়। এক, নাট্য- গবেষক তথা বিশ্লেষক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বাংলা নাটকের পরিবেশ-বর্ণনার একাংশ যা তিনি ‘রঙ্গালয়ের বঙ্গনটী’ বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ রেখেছেন। উল্লেখ্য অংশ – “হাতিবাগান থেকে বিডন স্ট্রিট পর্যন্ত অঞ্চল নটীর নূপুর নিক্কনে মুখরিত হয়ে উঠত, মদ্যপ শ্রোতারা বারবার এনকোর এবং করতালির সমবেত শব্দে থিয়েটারের করিনথিইয়াম থামগুলিতে কাঁপন লাগাত। দেওয়ালে পানে পিকের শ্রাবস্তীর কারুকার্য …।” [xiv]
দুই, নাট্যকার উৎপল দত্ত –এর নাটক ‘টিনের তলোয়ার’। নাটকের এক অংশে যেখানে মঞ্চে প্রথম অভিনয় করতে এসে শঙ্করী ভয় পাচ্ছে। সে সংলাপে বলছে, মাতালের দলের সামনে ভয় করছে ইত্যাদি। কিন্তু তাঁকে শেখানো হচ্ছে কিভাবে ওদের তুচ্ছ জ্ঞান করে অভিনয় করতে হবে। অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর এমন একটি রূপক , উপমার উদাহরণ যেন সমাজের বাবুদের চিনিয়ে দেয়। এমন চরিত্র কলকাতার স্পর্ধিত নটী – দের সামনে এসেছে সমাজের দিক হয়ে। নটীদের জন্মকথার মধ্যে থিয়েটারের গুণমান বেড়ে ওঠে বলেই ধরা যায়। যদিও, এই সময়কাল ছিল, মহামারির অন্তর্বর্তী। তাতে থিয়েটার করতে আসা জাতিকাদের প্রাসঙ্গিক ধাপে ধাপে উন্নতি থেমে থাকে না। এবং, ক্ষমতায়ন নিয়ে নারী – প্রসঙ্গের ব্যাখ্যায় এই বিষয়টিও আলোচিত হয় যে, নারী ক্ষমতায়ন অর্থে সমাজের উন্নতি। অর্থে , ‘ক্ষমতায়ন হিউম্যান রাইটস্ অ্যান্ড ডেভলপমেন্টকে সম্বোধন করার সময় অন্যতম প্রধান পদ্ধতিগত উদ্বেগ।’[xv]
২.৩ অভিনেত্রী , গণমাধ্যম ও ক্ষমতায়ন
অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতেই পর্যবসিত হয় ভারতীয় তথা বৃহত্তর সমাজ অভিনেত্রী শব্দটিকে কীভাবে দেখে এবং বোঝে এবং বিশ্লেষণ করে থাকে। গণপ্রচার মাধ্যমের নিরিখে শিশু বয়স ব্যতীত কিশোর – কিশোরী, যুবক – যুবতী , প্রাপ্তবয়স্কদের দৃষ্টিভঙ্গিতে অভিনেত্রী নামক শব্দ হল মূলত চলমান মাধ্যমের জন্যে বৈশিষ্ট্য রাখা একটি বিশেষণ। যার দ্বারা সহজেই এক ব্যক্তির কাজ বোঝানোর ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। তবে, উল্লেখ্য যে, ঐ একজনকে ব্যক্তি বলে ধরা হবে কিনা। সমাজের ভাষায়, যা প্রচলিত শব্দবিশেষ, তাতে যে মেয়েরা অভিনয় কাজ করেন, তাঁরাই অভিনেত্রী। বাংলা ভাষায়, অভিনেত্রী শব্দের জন্যে যে পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তা হল – অভিনয় কর্মেরত নারী, মেয়ে, মহিলা, স্ত্রী। উল্লেখ্য প্রতিটা শব্দের নির্ণায়ক ভাষা ছিল – লিঙ্গভেদের সাপেক্ষে। ফলে, স্ত্রীলিঙ্গের অভিনয়জাত কর্মকেই অভিনেত্রী বলে আখ্যায়িত করা হয়। আলোচ্য অংশের বিবিধতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে সঙ্গত পরিচয় ঘটায় নাট্যকলা তথা নাটকের মধ্যে দিয়ে। অতি প্রাচীনকালের অনুষঙ্গ টেনে আনলে, নাটকের লিখিত শাস্ত্র, নাট্যশাস্ত্র , ভরতমুনির রচিত , সেই অনুষঙ্গে নাটকের ক্ষেত্রে অভিনেত্রী শব্দের ব্যবহার মেলে। অন্যদিকে, সময়ান্তরে বিদেশি শাসকের আগমন অনুষঙ্গে নাটকের সঙ্গে পুনঃ পুনঃ সংঘটন ঘটে। এবং, নাটকের শব্দায়ন ঘটে সংস্কৃত অনুষঙ্গের অনুবাদিত ধারায়, ব্রিটিশের প্রাণিত অনুকরণে। সঙ্গে অভিনেত্রী শব্দের যথাযথ প্রয়োগের জন্যে অপেক্ষা চলে, সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সময়কাল পর্যন্ত। প্রাক – উনিশ শতকের নাট্যকাল কলকাতা তথা ভারতীয় অনুষঙ্গে ছিল বিদেশিদের নাটক-কর্মে।
১৮৭৩ থেকে ১৯৭৩ একশো বছরে পা রেখেছে নটী তথা অভিনেত্রীদের বঙ্গরঙ্গমঞ্চে যোগদান। তারপরও কেটে গেছে ২০২১ পর্যন্ত সময়, অর্থাৎ ৪৮ বছর। অঙ্কের হিসেবে অনেক হলেও, অগ্রগতি কতটা তার পরিসংখ্যান কিভাবে সম্ভব। নাটক, রঙ্গমঞ্চ এমন এক ফর্ম বা মাধ্যম , যার সঙ্গে সংখ্যাতত্ত্বের চেয়েও বেশি আলোচনা হয় গুণমানতত্ত্বের ভিত্তিতে। উদাহরণ, এক, বিনোদিনী নাটকের প্রযোজনায় দেখা যায় প্রাজ্ঞ নাট্যবর্গদের। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা, সীমা বিশ্বাস নটী বিনোদিনীর চরিত্রটি অভিনয় করেন।
এবং, ঐ নাটক নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় জাতীয় আন্তর্জালিক পত্রিকা ‘The Tribune’ , -এর নভেম্বর ২০২০ তারিখে। যেখানে লেখা হয় বিনোদিনীর সম্পর্কে উল্লেখ করা যায় সেই শব্দমালা – ” How courtesan Nati Binodini saved theatre” এবং সঙ্গে আরও লেখা হয় – ‘At 12, Nati Binodini took to theatre. At 23, she left, inspiring generations of artistes. Hundred years later, … is all set to play her in a film’।
প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ে যাত্রাশিল্পে বীণা দাশগুপ্ত –এর বিনোদিনী চরিত্রে অভিনয়। এবং বাংলা সিনেমায় বিনোদিনীর চরিত্রে অভিনয় করেন দেবশ্রী রায়। এরসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক নাটকের পাঠে বিনোদিনী – দের জীবন, রঙ্গকর্ম পড়া বাধ্যতামূলক। শুধু নাটকের বিষয়েই নয়, বিনোদিনী-রা একুশ শতকের আন্তর্জাতিক ভাষায় ‘সাব – অলটারন’ হিসেবেও আলোচিত হতে পারেন। যেখানে, মুষ্টিমেয় জাতিকাদের কি নামে সম্বোধন করা সম্মানের হবে, তাই এখনও ঠিক করা যায় না। সমাজের নিন্দিতপল্লীর বাসিন্দারা যে, অভিনয় শিল্পের হীরকদ্যুতিতে, তাঁদের নাম অভিনেত্রী হিসেবেই গৃহীত হবে আন্তর্জাতিক সমাজে। দুটি ছবি দেওয়া হল। যা সম্পদ হয়ে ওঠে আলোচ্য প্রবন্ধের।
[i] https://www.tribuneindia.com/news/features
নাটকের নাম নটী বিনোদিনী। অভিনীত হচ্ছে চণ্ডীগড় টেগোর থিয়েটার-এ। প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ট্রিবুন ই – পত্রিকার সৌজন্যে প্রাপ্ত।
প্রাসঙ্গিক, একুশ শতকের শব্দচয়নের বাজারিয় নীতি, নাটকের ব্যক্তির চেয়ে বেশি লক্ষ্য করে বিক্রিতেই। যেমন, এপ্রসঙ্গে , এক বাংলা আন্তর্জালিক দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদকের ভাষায়, বিনোদিনীর আমার কথা বইয়ের জনপ্রিয়তা এখনও বিষয়টি উল্লেখিত হয়। বিনোদিনীর লেখা বই বিক্রি হচ্ছে আন্তর্জাতিক আন্তর্জালিক ১০ টি মাধ্যমে। তাঁর বইয়ের সম্পাদনা করা প্রচ্ছদ অভিনেত্রী – ক্ষমতায়নের সূত্রে দেওয়া হল।
বিনোদিনী দাসী –র বইয়ের ইংরেজিতে তর্জমা তথা অনুবাদ করার তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধে হয় না। অনুবাদক গবেষক হিসেবে সেই কাজটি করেছেন বিনোদিনীকে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রতিভূ করে তুলতে। অন্যান্য সম্পাদিত বই, প্রচ্ছদ –ছবি উল্লেখ করার কারণ তথ্যাদির একত্রীকরণ। এবং জ্ঞাত করার যে, বিনোদিনী এক বা দুই শতকের মধ্যে হারিয়ে যাবার নন। বিনোদিনীকে নিয়ে বই, কাগজের লেখালিখির অর্থ, একুশ শতকের সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক সহ – নাগরিক তিনি। এবং, তাঁর সঙ্গে নটী – কূলের অন্যান্য অভিনেত্রীরা। এবং ক্ষমতায়ন আলোচনায় সাধারণ সমাজের নারীদের প্রতি যে আলোচনা, তা নটী-দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্যের। প্রবন্ধের সূত্রপাত থেকেই যে সূচক প্রশ্ন – নটী এবং ক্ষমতায়ন এই দুই বিষয় আন্তর্জাতিকভাবে যুক্ত, তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বরং, সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে নটী –দের আলোচনা অভিনেত্রী হিসেবে জাতির পরম্পরায় যুক্ত হলে, সংস্কৃতির কৌলীন্য বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ দেওয়ার যে লড়াই, সেদিক থেকে যুক্ত। প্রথম ঘটে একটি আন্তর্জাতিক উনিশ শতকের উত্তীর্ণ নাট্যকাল ও বঙ্গরঙ্গমঞ্চ নিয়ে একুশ শতকের ফিরে দেখার উদ্দেশ্য রয়েছে। এক, ‘নটী’দের কাজ আলোচনা করার মধ্যে দিয়ে নাটকের ইতিহাস পাঠ। দুই, ‘নটী’দের সমাজ ও একুশের সমাজের তুলনাত্মক আলোচনা। তিন, একুশ শতকের বিশ্বায়নে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। এবং তার নিরিখে বিগত শতকের ‘নটী’ ক্ষমতার বিশ্লেষণ। চার, শিক্ষা ও সংস্কৃতির নিরিখে নারীর এক লভ্য , গোচর, সংস্কৃতির উন্নতি হয়ে অভিনেত্রী- আলোক উজ্জ্বল তারকা। যেখানে অতীতের নটী – দের কাজ সাম্প্রতিক সংস্কৃতির সব মাধ্যমেই চর্চার। যেখানে নারী একটি দিবসের জ্ঞাপিত মাধ্যমে, আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবসের প্রকাশ্য উৎসব পেয়েছে। সেখানে সমাজ বিশ্ব নাট্য দিবসে যে বাণী পাঠ করে, তাঁর জ্ঞাপক এক বিশিষ্ট অভিনেত্রী। এক্ষেত্রে থিয়েটার বা নাটকের দেশ কাল সমাজ ভূগোলে নির্ধারিত থাকে না। কারণ, নাটকের জন্যে বিশেষ বার্তা ছিল আগেই, সারা পৃথিবীই একটা মঞ্চ। সেই মঞ্চের নারী শক্তির এক বিশেষ হয়ে ওঠা। আর সেই নিরিখেই তাঁর নামের চরিত্রে অভিনয় করতে উদ্দীপক পোস্টার সাজাতে হয় সমুহ মুনাফাকামী উৎসবমুখর ছবির মাত্রাজ্ঞানহীন স্বপ্নিল চিত্র –তারকাদের। জনমাধ্যমের নিজেদের ছবির সঙ্গে বিজ্ঞাপনের মতন জুড়ে নেন এবং জুড়ে দেন নটী বিনোদিনীর ছবি। সেই ছবি, যা আন্তর্জাতিক মাধ্যমের একমাত্র সাদাকালো চিত্র। যা এই রঙিন জাদুময় বর্ণাঢ্য সাজপোশাকে পুতুলের মতন মুখের সঙ্গে নিতান্তই বেমানান ও হাস্যকর। সেই বেনিয়া, যারা দেয়নি তাঁকে তাঁর অধিকারের ফল , বি- থিয়েটার নাম নাহয় স্টার থিয়েটারের মালিকানা তো পেতে পারতেন যুবতী স্টার অভিনেত্রী। সেই আরেকদল শতক পেরোনো সাজানো বেনিয়া, বেওয়াসারদের হাতে পড়েছেন বিনোদিনী। এখানে তিনি ভাবমূর্তির মতন। যার শুরু এবং শেষ কোনও এক অভিনেত্রীর অভিনয় সংজ্ঞায় বাঁধা পড়ে না।
গ্রুপ থিয়েটার পর্বে বিনোদিনীর নাটক নিয়ে কাজ হচ্ছে। এবং তা সদর্থকও বটে। মঞ্চের বিনোদিনী ভাব সঞ্জাত এক বিভোর সত্তা। যার প্রতিবাদে ধারা, একার হলেও, গ্রুপ থিয়েটারের মূল ধর্ম।
কিন্তু, দহরম করে ছবিতে তাঁর বেশভূষায় সফল মূল্যায়ন হতেই পারে না। কারণ, বড় সহজ। বিনোদিনীর জীবনের গতানুগতিক ধারা, তাঁর জীবন কাহিনির লেখ্যরূপ রূপান্তর ঘটাতে গেলে, বিনোদিনী বিশদে গবেষণার। আর , সেই গবেষণা সিনেমার পাতায় তুলে ধরাটা কোন এক অভিনেত্রীর নাম চোখে ভাসে না। কারণ, বিনোদিনী অভিনয়ের ব্যাকরণ। ব্যাকরণ না জেনে অভিনয় করতে আসিয়েদের এটা সুবিধে ছিল যে, তাঁদের সামনে কোনও বিনোদিনী ছিল না।
২.৪ উপসংহার
অভিনেত্রী, গণমাধ্যম একে অপরের পিঠে চলেছে। একুশ শতকের স্ফুরণ ওয়েবসাইটের নাটুকেপনার ইঙ্গিত কি নির্দেশ করে, সেও এক প্রশ্ন। যে ধরণ, মুন্সিয়ানা, কাজের নজির গত শতাব্দীর জো – হুজুর না করা নটী, অভিনেত্রীরা রেখে গেছে্ তা কতটা গ্রহণ করা গেল। এবং, কতটা চর্চায় রাখা যাচ্ছে। উল্লেখের যে, একুশ শতকীয় অভিজাত সংস্কৃতিতে প্রতিবিম্বিত পুরস্কার ও লাল কার্পেট। বস্তুগত উল্লেখ্যের হাঁটাচলার সমাজ কি ক্ষমতায়নের খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার?
একুশ শতকের আন্তর্জাতিক ধারায় অভিনেত্রী অর্থে রুপোলি মাধ্যমের কলাকারদের চিনহিত করে। বিশেষ করে, সমাজ নির্ধারিত নারী তখন ঝটিকায় বার্তা দেয় – নারী উপভোগ্য। নারী মানে যে উপাদান নয়, সেই লড়াইয়ে বিশ্বের নারী নির্যাতনের তালিকাটি নিয়েও আলোচনার। থিয়েটার সমাজের প্রতিচ্ছবি। থিয়েটার সমাজের সংস্কারের কাজে পার করেছে কয়েক দশক। নিন্দিত –কন্যেদের নিয়ে যে সামাজিক নাটকের অভিনয় হত, সে সমাজের জন্যেই। সমাজ থেকে বিষয় হয়ে ওঠা নারী খমতায়ন এখন চলমান প্রক্রিয়া। যেমন থিয়েটারও। আর, সেই প্রক্রিয়ায় কাজ করতে গেলে বরিষ্ঠ অভিনেত্রী তথা থিয়েটার – কর্মী শোভা সেন – এর উপদেশ শুনতেই হবে। তিনি তাঁর ‘ওঁরা , আমরা, এরা’ – বইয়ের মুখবন্ধে আলোচনায় জানিয়েছেন যে, থিয়েটার করতে গেলে গত দশকের অভিনেত্রীদের কথা জানতেই হবে। সেই মর্মে, নটী, অভিনেত্রী সুকুমারী দত্ত থেকে কেতকী দত্তের পাঠ ও আলোচনা অপরিহার্য। ঠিক যেমন নারী প্রতিবিম্বিত হয় অসাড় এক বোধের বৃত্তে। যেখানে স্টার – গরিমাও গত শতকের অভিনেত্রীদের ধারা থেকেই পাওয়া। যেখানে নির্বাক যুগের সিনেমা থেকে সবাক যুগের ধারাটিও তাঁদেরই কলাপ্রসূত।
তাঁদের এক লক্ষ্য ছিল। সমাজের জন্যে কিছু করা। যেমন, আলোচনায় তুলে ধরেছেন বিশ শতকের খ্যাতনামা পণ্ডিত উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ। অ-প্রাতিষ্ঠানিক ঐ গবেষণার কেন্দ্র নটী তথা বঙ্গ নটীদের জীবন, কাজ, অভিনয় ও প্রতিষ্ঠা এবং বঞ্চনা। সেদিক থেকে থিয়েটার তো বিশ শতকের নাট্যশিল্পী কেতকী দত্তকেও সম্মান দিতে পারেনি। তাঁর কথা বিশেষ করে উল্লেখের। কারণ, নাটকের অভিনীত চরিত্রটি কখন যে সমাজ তাঁর জীবনের সঙ্গে সেঁটে দিয়েছে, তা বোঝার মধ্যেই নাটকের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। সেই বাজার সংস্কৃতির নিগড়ে এক প্রখ্যাত অভিনেত্রী ‘বারবধূ’ রূপেই পরিচিতি পেলেন। সময়কাল বিশ শতকের কলকাতার হাতিবাগানের পাড়া এবং সেই মঞ্চের দর্শক পাল্টে গেছে। কিন্তু সমাজ তাহলে ততটা পালটায়নি। এখনও সামগ্রিক জিজ্ঞাসায় রয়ে যাচ্ছে তাহলে সংস্কৃতির উত্তরণ। অভিনেত্রীদের ক্ষমতায়নের বার্তা নিয়ে আগামি দশকের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। নবিশ অভিনেত্রীদের পুরাতন কালের নটীদের স্বীকৃতি না হোক, অস্বীকৃতির জন্যেই আলোচিত হয়ে চলুক। এবং, সমাজের উত্তরাধিকার মেনে বাংলা থিয়েটার আগামির অভিনেত্রীদের শেখাবে ক্ষমতায়নের দর্শন।
তথ্যসূত্র
[i] https://www.worldvision.com.au/womens-empowerment
[ii] সমাদ্দার ছন্দা; সাবিত্রী, গীতা, কেতকী, রায় সঞ্জীব ( সম্পাদক); কথাকৃতি স্মারক নাট্যপত্র ২০১৯; কলকাতা; কথাকৃতি; পৃষ্ঠা ১৬১ – ১৬৭
[iii] দাসী বিনোদিনী; আমার অভিনেত্রী জীবন ;সমাদ্দার শেখর ( সম্পাদিত); দুই শতাব্দীর বাঙালির নাট্যচিন্তা ; কলকাতা; এবং মুশায়েরা; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০২০ ; পৃষ্ঠা ৪১ – ৬৫
[iv] ঐ
[v] মাতৃজাতিকা , অর্থ মায়ের সন্তান। যাঁদের সামাজিকভাবে পিতৃ পরিচয়ের উল্লেখ নেই। উনিশ শতকের যে নটী –দের দেখা যায়, বাংলা সমাজের থিয়েটারে, তাঁদের পরিচিতির জন্যে এই শব্দটি ব্যবহার করা হল।
[vi] https://bn.wikipedia.org/wiki/নারীরক্ষমতায়ন
[vii] https://www.firstpost.com/long-reads
[viii] মিস্ত্রী জয়ন্ত (সম্পাদিত) ; সাময়িক পত্র ঃ উনিশ – বিশ শতক ; একুশ শতক কলকাতা ; প্রথম প্রকাশ ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ; আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৮৩৫২১-৬০-৯ ; পৃষ্ঠা ১২৬ – ১২৮
[ix] ঐ
[x] মৈত্র অমিত, রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী ; প্রথম সংস্করণ তৃতীয় মুদ্রণ ; জানুয়ারি ২০০৪ অক্টোবর ২০১৫ ; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড কলকাতা ; আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৭৫৬-৩৭৬-৪ ; পৃষ্ঠা ৭ – ৯
[xi] ঐ
[xii] ঐ
[xiii] ঐ
[xiv] ঐ , পৃষ্ঠা – ভূমিকা
[xv] https://bn.wikipedia.org/wiki/নারীরক্ষমতায়ন
[xvi] https://www.tribuneindia.com/news/features
[xvii] https://www.goodreads.com/book
ছবির তালিকা
১. ছবি ১ বিনোদিনী দাসী , আন্তর্জালিক মাধ্যম https://www.anandabazar.com
২ ছবি ২ বইয়ের প্রচ্ছদ, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় , অবিদ্যাপাড়ার অভিনেত্রীরা
৩ ছবি ৩ বইয়ের প্রচ্ছদ, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় , অবিদ্যাপাড়ার অভিনেত্রীরা
৪ ছবি ৪ সুকুমারী দত্ত , বাংলার নট নটী , দেবনারায়ণ গুপ্ত
৫ ছবি ৫ সুশীলাবালা , বাংলার নট নটী, দেবনারায়ণ গুপ্ত
৬ ছবি ৬ বইয়ের প্রচ্ছদ, বিনোদিনী দাসী, আমার কথা
৭ ছবি ৭ আন্তর্জালিক মাধ্যম , বিনোদিনী দাসী -র নামাঙ্কিত ফলক
৮ ছবি ৮ আন্তর্জালিক মাধ্যম , বিনোদিনী দাসী -র নামাঙ্কিত ফলক
৯ ছবি ৯ সূত্র আন্তর্জালিক মাধ্যম, বিনোদিনী দাসী -র নামাঙ্কিত ফলক
১০ ছবি ১০ চলচ্চিত্রের পোস্টার,
১১ ছবি ১১ আন্তর্জালিক ই- পত্রিকা ‘The Tribune ‘
১২ ছবি ১২ নাটক নটী বিনোদিনী , টেগোর থিয়েটার, চণ্ডীগড় আন্তর্জালিক ই- পত্রিকা ‘The Tribune ‘
১৩ ছবি ১৩ যাত্রাপালা নটী বিনোদিনী পোস্টার
১৪ ছবি ১৪ গ্রুপ থিয়েটারে বিনোদিনী পোস্টার
১৫ ছবি ১৫ সিনেমাশিল্প পোস্টার দেবশ্রী রায়, নটী বিনোদিনী চরিত্রে
১৬ ছবি ১৬ যাত্রাশিল্পে বিখ্যাত শিল্পী বীণা দাশগুপ্ত, নটী তারাসুন্দরী চরিত্রে
১৭ ছবি ১৭ নটী বিনোদিনী যাত্রাপালা পোস্টার
১৮ ছবি ১৮ ডানদিকে নটী বিনোদিনীর ছবিসহ পোস্টার, কলকাতার জি ডি বিড়লা সভাঘর
১৯ ছবি ১৯ প্রচ্ছদ বিনোদিনী-র লেখা আমার কথা, রথীন চক্রবর্তী সম্পাদিত
২০ ছবি ২০ প্রচ্ছদ সম্পাদনা দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
২১ ছবি ২১ বিনোদিনী রচনা সমগ্র
২২ ছবি ২২ ইংরেজিতে অনুবাদ করা বিনোদিনী দাসী –র আমার কথা , অনুবাদক রিমলি ভট্টাচার্য