রবিশঙ্করের সেতারের বাজ
পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়; সরোদবাদক পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার তথা ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে পরিচিত নাম। লেখালেখি করেন, খুব ভালো আলোচনা করেন। তাঁর লেখা কয়েকটি বই হল ‘আপনাদের সেবায়’, ‘প্রসঙ্গ ঠুমরি’, ‘সুরের গুরু’ ইত্যাদি। বাংলা ছবিতে তিনি নিয়মিত অভিনয় করেন। আর তাঁকে আমরা পাই বিভিন্ন শিক্ষামূলক কাজে।
অনেকের ধারণা আছে যে রবিশঙ্কর সেতারে যে বাজ বাজাতেন তা আসল সেতারের বাজ ছিল না। সরােদ ও বীণের বাজের সংমিশ্রণে একটা নতুন বাজ সৃষ্টি করেছিলেন। আসল বা পুরােনাে সেতারের যে বাজ ছিল তা বীণ ও ধ্রুপদী অঙ্গের উপর নির্ভরশীল ছিল। এই বাজে ডান হাতে মিজরাবের নানা রকম বােল, কৃন্তন, জমজমা ও খটকার ব্যবহার হত। জয়পুর সেনীয়া ঘরানায় বা হাতের মীড়, লপেট, ঘসিট, গমক ও কৃন্তন আর ডান হাতে মিজরাবের বিভিন্ন বােলবাণী বাজানাে হত আলাপে জোড় অংশ থেকে কারার শেষ অংশ অবধি।
রবিশঙ্করের গােড়ার দিকের বাজনায় এই পুরােনাে জয়পুর ঘরানার সেতার বাজের বৈশিষ্ট ছিল। তাঁর বলকারই, জমজমা, গমক, লপেট, খটকা ইত্যাদির কাজ খুব বলিষ্ট ছিল। যার নিদর্শন আমরা ওঁর পুরনো রেকর্ড বা রেকর্ডিংসে পেয়ে থাকি। এ বাজ উনি শিখেছিলেন ওঁর গুরু বাবা আলউদ্দিন খান সাহেবের কাছে, যিনি এই রাগ খুব ভালোভাবে জানতেন। যেহেতু জয়পুর ঘরানার সেতারীয়া নিজেদের পরিবার বা ঘরানার বাইরে কাউকে শেখাতেন না, তাই এই বাজ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। কিছু শ্রতিধর শিল্পী তাঁদের মধ্যে বিলায়েত খান সাহেবের ঠাকুরদা ইমদাদ খান বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁরা ওই জয়পুরী সেতার বাজের এক-একটি আশ আবিষ্কার হবার পর সেতারীয়া যেমন সুরবাহার বাজাতে শুরু করলেন তেমনি সেতারে সুরবাহারের বীণ অঙ্গের আলাপ ও লম্বা মীড়ের প্রয়োগ শুরু করলেন। ফলে কোনাে না কোনাে বাজে ডান হাতের বােল বাণীর প্রাধান্য পেল। আবার কোন না কোন বাজে বাঁ হাতের কাজ অর্থাৎ মীড় গমক, কৃন্তন, খট্কা, মুড়কির প্রযে বেশি হতে লাগল।
যদিও রবিশঙ্কর তার বাজানো আলাপ সুরবাহার এর মতো করেই বাজাতেন কিন্তু তাতে লম্বা করে মীড় সেইভাবে বাজাননি। খাদের খরজ ও পঞ্চম তার যুক্ত সেতারে বিণ অঙ্গের কাজ করতেন নিজের বাদন শৈলী ও চিন্তা ধারায়। আলাউদ্দিন খানের কাছে শিখে তিনি বিলম্বিত গতিতে বিভিন্ন প্রকারের লয়কারি ও তেহাই বাজিয়ে একটা নতুন রূপ দেন। পরবর্তীকালে কর্ণাটকী সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছন্দ ও লয়কারীতে কর্ণাটকী সঙ্গীতের হিসাব প্রবর্তন করে বিলম্বিত গৎকারীকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলেন।
রবিশঙ্কর যে সময় বাজাতে শুরু করেন সে সময় জনসম্মুখে দুটি সেতারের বাজের প্রচলন ছিল। এক ইমদাদখানি ও দ্বিতীয়টি জয়পুর বাজেরএকটি সীমিত সংস্করণ। যদিও এই ইমদাদখানি বাজও বিলায়েত খানের হাতে পড়ে বা হাতের মিড প্রধান খেয়াল গায়কি’ অঙ্গের বাজে পরিণত হয়েছে যাতে কেবলই তিন তালে বাজানাে সীমিত ছন্দ বা লয়কারীর কজ করা হত।
এইসব শুনে একদিকে দ্বাদশ অঙ্গের আলাপ আর অন্যদিকে বিভিন্ন ছন্দ, লয়কারী, তেহাই যুক্ত গৎ বিভিন্ন তালে বাজাতে শুক করেন এবং শােতৃমণ্ডলে এক আলােড়ন সৃষ্টি করেন। যা শুনে সংগীতবেত্তারা বলতে শুরু করেন যে এ বাজ সরােদের বাজের সংমিশ্রণে সৃষ্ট। আলাউদ্দিন খান সাহেবের শেখানাে এই বাজ কিন্তু তখনকার প্রচলিত সেতারের বাজের থেকে অনেকটা পরিপূর্ণ ছিল। ইমদাদ খানি শৈলীতে সুরবাহারে আলাপ বাজিয়ে সেতারে গৎ তোড়া বাজানাে হত যা মহত্ত্বপূর্ণ হলেও পরিধি ও গভীরতা কিছুটা সীমিত ছিল। বিশেষ করে আলাপ অংশে। আর সেতারে বাজানাে হত হাল ধরনের রাগ আর সেই অনুযায়ী গৎ।
লখনউয়ের কারিগর এবং সেতাবী ইউসুফ আলি খানকে দিয়ে আলাউদ্দিন খান এমন এক সেতার বানালেন যে তাতে খরজ ও লরজ যুক্ত তার থাকার ফলে বীণ অঙ্গের সম্পূর্ণ আলাপ ও গৎকারী করা যেমন সম্ভব হল, তেমনি ভারি বা গম্ভীর চালের কাজ থেকে চলে সব রকম কায়দার বাজনা বাজানাে সম্ভব হল। এর ফলে রবিশঙ্কর চমৎকার ভাবে ধ্রুপদ থেকে ঠুমরী বা ধুন পরিবেশন করতে লাগলেন তার এই নতুন ধারাব সেতারে। ফলে রবিশঙ্করের হাত ধরে পুরােনাে সেতার বা জয়পুরী বাজের পুনর্জন্ম হল পরিপূর্ণতার সঙ্গে।