উদয়শংকরের ‘কল্পনা’য় নৃত্যের সাংগঠনিক ভূমিকা
তপোব্রত চ্যাটার্জ্জী
গবেষক, সংগীত ভবন, বিশ্বভারতী
উদয়শংকরের কল্পনায় যে ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল সেখানে আসার আগে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস সম্পর্কে জানা একটু প্রয়োজন। চলচ্চিত্র কথাটা শোনা মাত্রই সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা অদ্ভূত আগ্রহ ও ভালোবাসা লক্ষ্য করা যায় যেটা অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রে ততটা দেখা যায় না এর কারণ হয়ত এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শিল্পীরা খুব তাড়াতাড়ি মানুষের মনের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারে। এছাড়াও এই শিল্পের মাধ্যমে যেকোনো শিল্পী অল্প সময়েই অন্যান্য শিল্পের তুলনায় বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষে এই চলচ্চিত্রের আগমন বলা যেতে পারে প্রায় ঔপনিবেশিক ইতিহাসের মধ্যগগনে। পরাধীন ভারতে অর্থাৎ ১৮৯৬ সালের ৭ই জুলাই মুম্বাইতে প্রথম চলচ্চিত্র দেখানো হয়।
ফ্রান্সের লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের এজেন্টরা বিভিন্ন স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র মিউজিয়ামের এলাকায়, এসপ্ল্যানেড ম্যানসনে, ওয়াটসন হোটেলে দেখাতে শুরু করেন। এই সময় যে সমস্ত চলচ্চিত্র গুলি দেখানো হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল ‘এন্ট্রি অব সিনেমাটোগ্রাফ’, ‘লেডিস অ্যান্ড সোলজারস অন হুইলস’, ‘অ্যারাইভেল অব এ ট্রেন’, ‘ ডেমোলিশন অব এ ওয়াল’ ইত্যাদি। চলচ্চিত্র গুলি দেখে সেই সময়ের মানুষেরা বেশ অবাক হয়ে যায় কারণ এর আগে তারা এই ধরনের চলমান ছবি কোনদিন দেখেনি, শুধু যে অবাক হয়েছিল তাই না তাদের মনে চলচ্চিত্র নিয়ে একটা আগ্রহও তৈরী হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন তাঁবুতে, খেলার মাঠে নানা জায়গায় চলচ্চিত্র দেখানো হতে থাকে, কিন্তু খোলা জায়গায় ছবি দেখানো বর্ষাকালে বন্ধ থাকতো। ধীরে ধীরে এই শিল্পটি টাকা কামানোর একটা রাস্তাও তৈরী করলো। এই সময় ক্লিফস্টন, মেৎজারের মত ছোট ছোট কোম্পানীরা ক্যামেরা প্রোজেক্টর এমনকি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের ব্যবসাও শুরু করেন, এছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে স্বল্প সমন্বিত স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র আসতে শুরু করে। ১৯০১-১৯০৭ এর মধ্যে Georges Melies এর ‘ট্রিপ টু দ্য মুন’, এডুইন পোর্টারের ‘গ্রেট ট্রেন রবারি’, ‘ আঙ্কেল টমস কেবিন’ এছাড়া ‘লাইফ অব ক্রাইমস’ এর মত চলচ্চিত্র ভারতে আসতে শুরু করে। এই সব দেখে একটা সখের ক্লাব তাঁদের কলা কুশলীদের নিয়ে কাহিনী চিত্র তোলার চেষ্টা করেন এবং এই জন্য তাঁরা ব্রিটিশ কোম্পানী বোন অ্যান্ড শেপার্ডের স্থানীয় শাখা থেকে ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যান দুই অনান। এঁদেরই ছবিটির নাম ‘ পুণ্ডলিক ‘। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯১২ সালের ১৮ই মে মুম্বাই এর করপোরেশন সিনেমায়। এরপর ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ রাজা হরিশচন্দ্র ‘ মুক্তি পায়। ‘ রাজা হরিশচন্দ্র ‘ চলচ্চিত্রটির আগে অর্থাৎ ১৯১৩ সালের আগে ‘ পুণ্ডলিক ‘ এক মাত্র কাহিনী চিত্র যা ভারতবর্ষের মাটিতে নির্মিত হয়। এখান থেকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা উঠে আসে যে তাহলে ১৮৯৬ সালের ৭ই জুলাই সময়টিকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সূত্রপাতের সময় বলাটা কতখানি যুক্তিযুক্ত, কারণ সেই সময় লুমিয়ের ভ্রাতাদের প্রতিনিধিরা যে সমস্ত স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র দেখাতো তার সবই বিদেশী চলচ্চিত্র ছিল অর্থাৎ এই কথা বলা যেতেই পারে যে পুণ্ডলিকের সময় থেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়, কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষা যে মানুষটি প্রথম সন্ধান করেন তিনি হলেন দাদাসাহেব ফালকে। ভারতবর্ষে ঊনিশ শতকে বিভিন্ন ভাষার উপন্যাসের উদ্ভবও ভারতীয় চলচ্চিত্রকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তৎকালীন চলচ্চিত্র প্রস্তুতকারকদের কাছে উপন্যাসের কাহিনী গুলি যেন চলচ্চিত্র তৈরী করার একটা নতুন পথ খুলে দিয়েছিল। চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে তার বিভিন্ন তারতম্যের ভিত্তিতে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে একটি হল নির্বাক যুগ ও অন্যটি সবাক যুগ।
১৯১৩ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সবাক ছবির সূচনা পর্যন্ত ভারতবর্ষের নির্বাক ছবি নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে কেন্দ্র করেই চলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ তে শুরু হওয়ার পর ইতালী, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। এই সুযোগে আমেরিকানরা তাদের বানানো চলচ্চিত্র ভারতে দেখানো শুরু করে এবং দেখতে দেখতে তারা আমেরিকান চলচ্চিত্রের একটা বড় বাজার ভারতে তৈরী করে ফেলে। ১৯২৬-১৯২৭ এর মধ্যে যত গুলি নির্বাক চলচ্চিত্র দেখানো হয় তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল আমেরিকান ছবি। এই ব্যাপারটি ব্রিটিশরা মেনে নিতে না পেরে ১৯২৭ সালে সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট চালু করে এবং এরকম রটানো হয় যে আমেরিকান ছবি দেখলে ভারতীয়দের নৈতিক অবক্ষয় হতে পারে এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ও হতে পারে, ব্রিটিশদের এই ধরনের কথাবার্তা কতখানি সঠিক বা আদৌ এই বক্তব্যের কোনো বাস্তবতা আছে কিনা জানতে তৎকালীন ভারত সরকার একটি অনুসন্ধান কমিটি তৈরী করে এই কমিটিতে তিনজন ভারতীয়কেও নেওয়া হয়েছিল যে কমিটি বলে যে ব্রিটিশদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো সত্যতা নেই আর যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে ব্রিটিশ চলচ্চিত্রও দেখানো বন্ধ করে দেওয়া উচিত কারণ ভারতীয়দের পক্ষে আমেরিকান ও ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব নয়। এই কমিটি কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ড তৈরির পরামর্শও দেয় এছাড়াও ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্যও অনেক কথা বলা হয় যেমন ভারতীয় বানিজ্য দফতরের অধীনে একটি চলচ্চিত্র দপ্তর খোলার কথা, সরকারি চলচ্চিত্র গ্রন্থাগার স্থাপন করার কথা, অর্থভান্ডার তৈরী করে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রযোজকদের ঋণ দেওয়ার কথা ইত্যাদি। ব্রিটিশরা এই কমিটির কোনো কথাতেই কর্ণপাত করেনি পরে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের পর এই নিয়ে আবার বিবেচনা করা হয়েছিল। এই সময় দাদাসাহেব ফালকে ছাড়াও একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন হীরালাল সেন। তিনি তাঁর বায়োস্কোপের ব্যবসা শুরু করেন স্থির চিত্র দেখিয়ে তারপর তিনি নাটকের অংশ তুলে সেটাকে দেখাতে শুরু করেন এরপরে তার মনে হয় যে নিজে কাজ করতে হবে সেখান থেকেই তিনি ধীরে ধীরে কাহিনী চিত্রে প্রবেশ করেন কিন্তু সেই চিত্রগুলি এখন আর পাওয়া যায় না তার কারণ একটি দুর্ঘটনায় তার চিত্র গুলি সবই আগুনে পুরে যায় তাদের মধ্যে ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ অন্যতম একটি চলচ্চিত্র, তার কোম্পানীর নাম ছিল ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানী’। এছাড়াও আরো অনেক ঘটনা এই নির্বাক যুগকে ঘিরে আছে। ১৯৩১ সালে শুরু হল চলচ্চিত্র জগতের আর একটি নতুন অধ্যায় যেখানে চলমান ছবিতে মানুষ গুলির শুধু আঙ্গিক অভিনয় দেখা যাবে তাই নয় বাচিক অভিনয়ও শোনা যাবে অর্থাৎ যুগ এলো সবাক চলচ্চিত্রের। এই সময়ের অর্থাৎ ১৯৩১ সালের একটি চর্চিত সবাক চলচ্চিত্র হল ‘ আলম আরা ‘ এই চলচ্চিত্রটি নাচ, গান, সংলাপ দিয়ে তৈরী হয়েছিল। এই ভাবে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র তার পরিপূর্ণ রূপ ধরতে শুরু করলো এবং পরে এই চলচ্চিত্র প্রযুক্তিগত দিক থেকেও অনেক পরিবর্তন হতে শুরু করলো যা আজও তার নিজস্ব গতিতে চলছে। চলচ্চিত্র যেন ধীরে ধীরে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়িয়েই চলেছে এবং যাবতীয় নতুন যে সব প্রযুক্তি তাকে শ্রেষ্ঠ শিল্পের জায়গায় তুলতে পারে তার সব টুকুই যেনো এক আদর্শ শিক্ষার্থীর মত গ্রহণ করে চলেছে। এই হল মোটামুটি ভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি ছোট্ট বিবরন।
চলচ্চিত্র এমন একটি শিল্প যার নিজস্ব উপাদান বলতে বিশেষ কিছু নেই সে অনেক শিল্পের সমন্বয়ে গঠিত একটি শিল্প কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বিভিন্ন শিল্প থেকে ধার নিয়ে যখন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় তখন এটি একটি নিজস্বতা লাভ করে অর্থাৎ এটি একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন শিল্পে পরিণত হয়। যেমন আলো, ক্যামেরা, অভিনয়, নাচ, গান ইত্যাদি আরো অনেকের সমন্বয়ে তৈরি একটি শিল্প। এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বা উপাদান হল নৃত্য এই বিষয়টিকে চলচ্চিত্রে আমরা বেশির ভাগই মনোরঞ্জনের বিষয় হিসেবেই দেখি কিন্তু এই নৃত্য যে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের বিশেষ অংশ হয়ে উঠতে পারে এই নিয়ে খুব একটা ভাবা হয় না। চলচ্চিত্রে নৃত্যের প্রয়োগ তার সাংগঠনিক ভূমিকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। কিন্তু তা বলে সব ধরনের চলচ্চিত্রের নৃত্যই যে চলচ্চিত্রের সাংগঠনিক উপাদান হতে পেরেছে সেটা নয়। চলচ্চিত্রে নৃত্যের সাংগঠনিক উপাদান বলতে যা বোঝায় সেটা হল চলচ্চিত্রের যে কাহিনী বা চলচ্চিত্রের যে বক্তব্য সেই অনুযায়ী নৃত্যটি কতখানি প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে, যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ‘গুপী গাইন ও বাঘ বাইন’ চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে যে ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্যকে তুলে ধরা হয়েছে ঠিক সেই ভাবে ভূতের নাচের দৃশ্যটি আপাত ভাবে একটি মনোরঞ্জনের বিষয় মনে হলেও ওখানে কিন্তু ভীষণ সুন্দর ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক যে পরিকাঠামো সেই বিষয়টিকে মনোরঞ্জনের মোড়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেমন রাজা, চাষী, সাহেব, ব্রাহ্মণ, পাদ্রী চরিত্র গুলিকে ভূতের মত সাজিয়ে নৃত্যের মাধ্যমে সমাজের ছবিটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, এই নৃত্যটি শুধুমাত্র কিছু তাল, লয়, অঙ্গভঙ্গি দিয়ে উপস্থাপিত হয়নি। অতএব ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রটিতে নৃত্যটি চলচ্চিত্রের সাংগঠনিক উপাদান হয়ে উঠতে পেরেছে। নৃত্য মানে শুধু অঙ্গভঙ্গি নয় , নান্দনিক ভাবে বিচার করতে গেলে নৃত্যের মধ্যে গতি, তাল, লয়, ছন্দ এই সবগুলিই প্রয়োজন এবং আরও একটি উপাদান থাকা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন সেটি হল যে সংগীত বা যে কাহিনীর মধ্যে দিয়ে নৃত্যটি ঘটিত হচ্ছে সেই সংগীত বা কাহিনীটিকে নৃত্যের মাধ্যমে কতখানি ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে বা নৃত্যটি কতখানি সেই বিশেষ মুহূর্তটিকে বা সামগ্রিক বক্তব্যটি তুলে ধরতে পারছে সেই জায়গাটির উপর বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন, মানে কাহিনীর মধ্যে বা সংগীতের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত অর্থ আছে সেটাকে প্রাধান্য না দিয়ে কিছু তাল, ছন্দ,লয়, গতি এবং অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে একটি নৃত্য পরিবেশন করলে সেই নৃত্যটির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। চলচ্চিত্রের মধ্যে যে নৃত্য হয় তার মধ্যেও এই ব্যাপার গুলি থাকা খুবই প্রয়োজন কারণ চলচ্চিত্রও নির্দিষ্ট একটি কাহিনীকে ব্যক্ত করে। এই প্রসঙ্গে একটি চলচ্চিত্র ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক সেটি হল উদয়শংকরের ‘কল্পনা’।
উদয়শংকর এই নামটি বাংলা তথা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি জগতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি একাধারে যেমন ছিলেন চিত্রকার ঠিক অন্যদিকে ছিলেন একজন নৃত্যশিল্পী, নৃত্য পরিচালক এবং চলচ্চিত্র পরিচালকও। অ্যানা পাভলোভার হাত ধরেই চিত্রকার থেকে নৃত্যের জগতে তাঁর আসা। কারণ তিনি ছোটবেলা থেকে নাচ কোনো দিন শেখেননি ব্যালেরিনার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে তিনি ভারতে ফিরে এলেন এবং আলমোরাতে নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেন ও সেখানে বিখ্যাত নৃত্য ও সংগীত গুরুদের আমন্ত্রণ জানালেন এই সময় সেখানে প্রশিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন ভরতনাট্যমের জন্য কান্ডাপ্পা পিল্লাই, কথাকলির জন্য এসেছিলেন শংকরন নাম্বুদ্রি, মণিপুরী নৃত্যের প্রশিক্ষণের জন্য এসেছিলেন মাইসনাম আমুবী সিং, সংগীতের জন্য এসেছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব এছাড়াও আরো অনেক বিখ্যাত মানুষদের আনাগোনা ছিল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এই কথাগুলি মোটামুটি অনেকেই জানে এবার আসা যাক আসল বক্তব্যে অর্থাৎ উদয়শংকরের কল্পনার কথায়।
একজন শিল্পীর কল্পনার জগৎ তার কাছে সব থেকে শ্রেষ্ঠ জগৎ হয় কারণ বাস্তব জীবনে মানুষ তথা প্রাণীকূলকে এই বিশাল মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কখনও ইচ্ছায় আবার কখনও অনিচ্ছা থাকার সত্বেও সময়ের সঙ্গে মানুষকে চলতেই হয়, কিন্তু একজন শিল্পীর দ্বারাই সম্ভব হয় এই বিশাল জগতের কর্মকাণ্ডের বাইরেও নিজস্ব একটা কল্পনার জগৎ বানানো যে জগতের স্রষ্ঠা শিল্পী নিজেই হয় তারই ভাবনায় সেই জগতের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত সবই হয়। উদয়শংকরের ‘ কল্পনা ‘ চলচ্চিত্রটি হল সেই রকমই একটি কল্পনা যা আমরা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেখতে পাই।এই চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ধরনের নৃত্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে যেমন, পুতুল নাচ, কথাকলি নৃত্য, গুজরাটী নৃত্য, মণিপুরী নৃত্য, কত্থক নৃত্য, তরবারি বা অশি নৃত্য এই ধরনের আরো অনেক নৃত্যকে একই কাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন ভাবে দেখানো হয়েছে। এই চলচ্চিত্রে নাচ গুলির মধ্যে দিয়ে যে ভাবে চলচ্চিত্রের গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানেই হল এই চলচ্চিত্রের সার্থকতা অর্থাৎ যেটা আগে বলা হয়েছিল যে চলচ্চিত্রের মধ্যে নৃত্যের সাংগঠনিক ভূমিকা কী রকম হওয়া উচিত এই নিয়েই এই আলোচনাটি। প্রথমে এই চলচ্চিত্রের কাহিনীর মধ্যে আসা যাক।
এই চলচ্চিত্রে একজন লেখক তার কাহিনী দিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য একজন প্রযোজকের কাছে যান প্রযোজক প্রথমে সেই কাহিনী শুনতে রাজি হননি কিন্তু সেই লেখকের অনুরোধের জন্য প্রযোজক কাহিনী শুনতে রাজি হয়। কাহিনীটি হলো, একজন ছোট ছেলে যে প্রায় গন্ডগোল, ঝামেলা, মারপিট ছাড়া থাকতই না তার জীবনে একদিন একজন মানুষ এলেন যিনি ছেলেটির মধ্যে থাকা প্রতিভাকে চিনতে পেরে ছিলেন তারপর সেই ছেলেটি ঐ মানুষটিকে নিজের গুরুর মতন শ্রদ্ধা করতে লাগলো এবং তার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা শুরু করলো এই ভাবে দিন যেতে থাকলো এক সময় ছেলেটি যুবকে পরিনত হল এবং গুরুর আদেশ অনুযায়ী সে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বেড়িয়ে পরলো এবং তার যাত্রা শুরু করলো বারাণসী থেকে। ছেলেটির একটি ইচ্ছা ছিল যে যদি সে একটা এমন প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে পারে যেখানে বিভিন্ন ধরনের শিল্প চর্চা হবে এবং যেখানে প্রকৃত জ্ঞানের আদান প্রদান হবে, এই লক্ষের পথে চলতে চলতে সে একটা নিজস্ব সাংস্কৃতিক দল গঠন করলো এবং সেই দল নিয়ে সে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতে শুরু করলো এবং ধীরে ধীরে তার পরিচিতি যখন বাড়তে শুরু করলো তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুষ্ঠান ও অনুদানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সে একটা শিল্প চর্চার কেন্দ্র তৈরী করলো এবং অনেক শিল্পীদের ওখানে থেকে শেখার এবং বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করার সুযোগও করে দিল। এই হল মোটামুটি ভাবে কল্পনা চলচ্চিত্রের যে কাহিনী তার বাহ্যিক একটি রূপরেখা। এই চলচ্চিত্রের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক উদয়শংকর কিন্তু একটি অভ্যন্তরীণ মানেকেও প্রকাশ করতে চেয়েছেন, সেটি হল আমাদের দেশের কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি এই সবই যেনো দিন দিন নিজের অস্তিত্ব হারাচ্ছে সবাই যেনো বিশ্বায়নের ইঁদুর দৌড়ে নাম লিখিয়েছে, পুঁজিপতিরা গরীব, সাধারণ মানুষকে যন্ত্রের মতন ব্যবহার করছে, এই চিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য উদয়শংকর তার বিখ্যাত প্রযোজনা ‘Labour and Machinery’ কে চলচ্চিত্রের পর্দায় তুলে ধরেছেন।
মানুষেরা যেন কাঠের পুতুলের মত অন্যের ইশারাতে নেচেই চলেছে নিজের সত্তাকে ভুলে গিয়ে, এই পরিস্থিতি টিকেও পুতুল নাচের মাধ্যমে খুব সুন্দর ভাবে শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছেন। শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গুলি ছেলে মেয়েদের শুধু তথ্যের জালে জড়িয়ে রেখে হাতে একটি করে জ্ঞানের পরিধি মাপার কাগজ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে যাকে ডিগ্রী বলা হয়, ছেলে মেয়েরা জানতেই পারছে না আসল জ্ঞানের অর্থটিকে। তাই তারা এই তথ্যের স্তূপ হয়ে দরজায় দরজায় একটা চাকরির আশায় ঘুরতে ঘুরতে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত কোনো আশার আলো না দেখতে পেয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকারের দিকে নিমজ্জিত হচ্ছে। এই বিষয়টিকেও খুবই সুন্দর ভাবে নাচের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
উদয়শংকর এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এটাও দেখাতে চেয়েছেন যে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি যদি প্রকৃত জ্ঞানের কেন্দ্র হয়ে ওঠে অর্থাৎ এমন শিক্ষা যা আমাদের দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতির ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তাহলে আমাদের অন্যকে অনুকরণ করার বা অনুসরণ করার খুব একটা প্রয়োজন পরবেনা। আমাদের দেশ কৃষি, শিক্ষা,সংস্কৃতি, ব্যবসা বানিজ্য সব দিক থেকেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে এবং কাউকে যন্ত্রের মতন ব্যবহৃত হতে হবে না জীবিকার জন্য এদিক সেদিক ছুটতে হবে না, না খেতে পেয়ে মরতে হবে না এই প্রত্যেকটি অংশই তিনি কল্পনা করেছেন একজন লেখক হিসেবে একজন চলচ্চিত্রের পরিচালক হিসেবে একজন নৃত্যের পরিচালক হিসেবে এবং একজন সুদৃঢ় পরিকল্পক হিসেবে।
শুধু মাত্র তাল, লয়, ছন্দ, আঙ্গিক অভিনয়, বিভিন্ন নৃত্য শৈলী দিয়েই যে ‘ কল্পনা ‘ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে তা নয় প্রত্যেকটি নৃত্য এই চলচ্চিত্রের মূল বক্তব্যের সঙ্গে ভীষন ভাবে প্রাসঙ্গিক। তাই এই কথা বলাই যায় যে উদয়শংকরের ‘ কল্পনা ‘ চলচ্চিত্রে নৃত্যের সাংগঠনিক ভূমিকা যথাযথ ভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।
তথ্য সূত্র:
১) বন্দোপাধ্যায়, পার্থ প্রতিম। ভারতীয় চলচ্চিত্রের রূপরেখা।কলকাতা: বানীশিল্প, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭।
২) দাশগুপ্ত, ধীমান। পরিভাষা কোষ। কলকাতা: সুজন প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১৩।
৩) দাশগুপ্ত, ধীমান। চলচ্চিত্রের অভিধান।কলকাতা: বাণী শিল্প, আগস্ট ২০১৪।
৪) মজুমদার, : ডঃ মালা । ভারতীয় নৃত্যের পুনর্নবীকরণ পর্ব। কলকাতা: এম.এম পাবলিকেশন, জুলাই ২০০২।
৫) মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস। দেমুর নানারকম। হাওড়া: সৃষ্টিসুখ প্রকাশন, জানুয়ারি ২০২০।
৬) ঘোষ,প্রসাদ, গৌরাঙ্গ। সোনার দাগ। কলকাতা: যোগমায়া পাবলিসার্স, জানুয়ারি ২০১০।