July 1, 2020

ভূত ও অদ্ভূত কাহিনী

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রত্যেক দেখার একটা গোড়ার কথা থাকে। আমার এই লেখায় গুড়ার কতটা আমার নিজের ভাষায় না লিখে উদ্ধৃত করে দিচ্ছে। তার কারণ এই উদ্ধৃতির মধ্যে আমার ভূত সম্বন্ধে ধ্যানধারণা অভিজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতা সবই লুকিয়ে আছে। পণ্ডিত প্রবর সুকুমার সেন মহাশয়ের লেখা একটা বই আছে যার নাম ‘কলিকাতার কাহিনী’। সেই বইয়ের ৫৪ পাতায় একটি প্রবন্ধ আছে “ভূত ও ভীতি” নামে। এই প্রবন্ধের গোড়ায় সুকুমার বাবু লিখেছেন, ড. শ্রীসুভদ্রকুমার সেন কিছু দিন আগে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন কলকাতার ভূত” নামে সেটি এখানে উদ্ধৃত করছি। “নানান চরিত্রের মানুষের নানান ধরনের মৃত্যুর নীরব সাক্ষী। এই শহর। অনাগত ভবিষ্যৎ একদিন বর্তমান হয়েছে এবং তারপর প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সেই বর্তমান আবার এক সময়ে ‘ভূত হয়েছে। আর ‘ভূত’ কাল যখন নিজেকে বর্তমানে প্রক্ষেপ করে তখনই ভৌতিক সত্তা আত্মপ্রকাশ করে এবং ভীতির সঞ্চার করে। তবে অনেক কিছুর মত ভূত ও বিশ্বাসের ব্যাপার। বিশ্বাস করতে আছে; না করলে নেই। গল্পের বাইরে ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা মুশকিল। ব্যক্তির অভিজ্ঞতা কতটা গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হবে? এ বিষয়ে দ্বিমত থাকবেই। চাক্ষুষ তথ্য দাখিল করে ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা দুরূহ। হয়তো বা অসম্ভব।” 

এই লেখার উদ্দেশ্য হল কয়েকটি নিজের অভিজ্ঞতা ও সেনাবাহিনীর পরিচয় দেওয়া। 

আমার বাস দেশপ্রিয় পার্ক-এর ধারে প্রিয়া সিনেমা হলের পেছনে। আমি যখন ৮/৯ ক্লাসে পড়ি তখন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে নিজেদের সংগ্রহের বই দিয়ে একটা লাইব্রেরি করি। লাইব্রেরি করা হয় আমাদের এক বন্ধু দেবাশিস রায়ের বাড়ির তিনতলায়। এই বাড়িটি ছিল রাসবিহারী এভেনিউ-এর ওপর ও প্রিয়া সিনেমার উল্টোদিকে। বর্তমানে সেই বাড়ি ভেঙে বহুতল বাড়ি হয়েছে। সে বাড়ির তলায় আছে টাইমেক্স ঘড়ির দোকান। দেবাশিসদের এই নি তলাটায় তখন কেউ থাকত না। অনেকটা পাবড়া বাড়ির মতন পড়েছে। যাই হোকআমরা তিন তলার ঘরদোর সব পরিষ্কার করে আমাদের নিজস্ব সংগ্রহের বই রেখে লাইব্রেরি শুরু করলাম। লাইব্রেরি বেশ কিছুদিন নির্বিঘ্নে চলার পর কতগুলো ঘটনা এমনি ঘটতে শুরু করল যে আমরা কিছুটা ভয় আর কিছুটা বিরক্ত হয়ে লাইব্রেরি তুলে দিলাম। যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল সেগুলো হল, এক, আলো পাখার সুইচ দেওয়া ও না দেওয়া সত্বেও যখন তখন আলো পাখা জ্বলে উঠত আবার যখন তখন নিভে যেত। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি দিয়ে পরীক্ষা করেও কোনো ফল হয়নি। দ্বিতীয় ঘটনা হল যে জানালা ও দরজা ওই একইভাবে অর্থাৎ ছিটকিনি দেওয়া এবং না দেওয়া সত্বেও খুলে যেত এবং বন্ধ হয়ে যেত আপনা আপনি। এই সময়ে মনে পড়ছে না যে অন্যান্য বন্ধুদের মনের অবস্থা কী হয়েছিল, তবে আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম এই কারণে যে আমি তখন সেন্ট লরেন্স স্কুলে পড়তাম এবং ছোটবেলা থেকেই ‘our Father The Son of Holy Ghost’ কথাটার প্রভাব আমার ওপর পড়েছিল। 

Ballet Dancer

এরপর এবং এখনও অবধি যে ঘটনা আমার ঘটেছিল তাই আমার শেষ অভিজ্ঞতা ভূত বা অদ্ভুত সম্বন্ধে। আমি পেশায় সাংবাদিক। ১৯৮৫ সালে আমার বিশিষ্ট বন্ধু বিনোদ কৈলাসের আমন্ত্রণে হায়দ্রাবাদ শহরে যাই অনুষ্ঠান করতে। বিনোদের বাড়িতে পুরানো হাভেলি ধরনের। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল জ্ঞি তলার একটি বড়ো ঘরে এবং কেবল মাত্র একটি ঠাকুরের সিংহাসন এবং তাতে কয়েকটি ঠাকুরের ছবি ছাড়া ঘরে আসবাবপত্র প্রায় ছিলই না। আমি ওই শহরে চারদিন ছিলাম। অনুষ্ঠান ছিল তৃতীয় দিন সন্ধ্যাবেলা। পরদিন ভোরে ছিল কলকাতা ফেরার ট্রেন। অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরে গল্পগুজব করে শুতে শুতে বেশ রাত হয়েছে। যাই হোক ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খুব গভীরভাবে। খুব সম্ভবত ভো ররাত্রির ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল আমার চারপাশে নূপুরের আওয়াজ। প্রথমদিকে ঘুম থেকে উঠে কী হচ্ছে ব্যাপারটা জানার কৌতুহল হলেও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু নূপুরের আওয়াজ ক্রমশই বাড়তে থাকায় শেষমেষ উঠতে হল। অাওয়া তে খেলে নুপুরের আওয়াজ আর আলো জ্বালালে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি ভয় না পেলেও কিছুটা লা ও অর্থনীতিতে পড়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ভো র হয়ে আসায় এবং কেন ধরার তাগিদে বাকি সময়টা আলো ফেলেই শুয়েছিলাম। যাই হোক পরদিন সকালে বন্ধুবর বিনোদ ও বাড়ির অন্যান্য জনকে যখন এই ঘটনার কথা জানালাম তখন তারা প্রথমদিকে এটাকে দিবাসপ্ন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বার বার চাপ দিয়ে যে, আসল ঘটনা জানতে পারলাম তা হল বিনোদেরই কোনো পূর্বপুরুষ অত্যন্ত শিশু বসে মারা যান ওই গেছে আর নুপুরের আওয়াজ নাকি ওই শিশু পূর্বপুরুষটির, যিনি ভো র রাত্রে ওই ঘরে খেলে বা ঘুরে বেড়ান। 

উপরিউক্ত ঘটনা দুটি আমার জীবনের দুটি অভিজ্ঞতা। এরপর যে কয়েকটি ঘটনার কথা লিখব। তা শােনা এবং পড়া। আমাদের সাগীত জশাতে ব শিল্পী ছিলেন এবং এখন আছেন যারা ভুত, পীর/জীন এসবে খুবই বিশ্বাস করেন। প্রবাদপ্রতিম সংগীত সাধক বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেব তার আত্মজীবিনী  “আমার কথা”-য় লিখেছেন, …একদিন চা খেয়ে দেয়ে ভৈরবী বাজাচ্ছি,- ভৈরবী বড় ভালোবাসি আমি। দেখি এক কাবলি এসে হাজির- এই পর্যন্ত দাড়ি। “আমি আসতে পারি।” আমি বাজিয়ে চললাম।এক ঘন্টা দেড় ঘন্টা বাজানোর পর চোখ খুললাম। ‘’অনেকদিন থেকেই  ঘুরি এখানে। তােমার বাজনা শুনি। চা খাওয়াতে পারবে? চা তৈরি করলাম । তিনি তো ঝোলার থেকে একটা কালো কটোরা বের করলেন।  আগুনে দিয়ে কী টিপ দিলেন। সেটা সোনা হয়ে গেল। তুমি এটা ভাঙ্গিয়ে আনো রোজ চা খোয়াবে।’’

‘’তা সোনার কী দরকার? চা আপনি এমনি রোজ খেয়ে যাবেন।’’ আঃ যাওতো আমার দরকার আছে। রামপুরের সুন্দরলাল আমার কাছে তবলা শিখত।তার কাছেই প্রথমে গেলাম।  কী জনি,পুলিশে যদি ধরে। পুসি গণ মজ। সুন্দরলাল দেখেতো থ! আরে এতো আধুলি সোনা। – কোথা মিলল?’’ এক মহাত্মা দিলেন। তিন তোলার টাকা দিলাম তাকে। রোজ তিনি চাএর সরঞ্জাম আনতেন। সাত দিন চা খেতেন আট দিনের দিন একটা রুটি। এক মাস ছিলেন। এক মাস ছিলেন। যাবার আগে তমসা নদীতে সাত দিন গলা জলে নেমে রইলেন। তারপর একটা মাদুলি তৈরি করে  দিলেন আমাকে।আপনারা কী বিশ্বাস করবেন সেই কথা? বললেন ‘এইটা তোমার কাছে রেখে দেবে।  খুব উপকার হবে। আমি চলে গেলে  শনিবার দিন বাম হাতে বাঁধবে’’।  তাই করলাম। ঘুমের থেকে উঠে দেখলাম দুটো দৈত্যের মত আমার পাশে শুয়ে।  সর্বনাশ এটা কি স্বপ্ন দেখছি নাকি? মাদুলি টা খুলে ফেললাম। দেখি আর নেই। কি ব্যাপার আলাউদ্দিনের চেরাগ পাবো নাকি?  দ্বিতীয় দিনও তাই হোলো। চক্ষু মেলে দেখি আর ভয় নাই। এই বড় বড় লোম নিজের চোখে দেখেছি।  তৃতীয় দিন ফেলে দিলাম তমসার  জলে। গুরুদেব  (উস্তাদ ওয়াজির খান) কে বললাম। তিনি বললেন আরে আরে করলে কি? তোমাকে দুজন জামিন দিয়ে গেছল। যা বলতে তাই করত ওরা। তুমি মহা বেয়াকুব।  আমাকে দিয়ে দিতে’’! 

আর একটা ঘটনা আমার গুরু আচার্য আলী আকবর খান সাহেবের স্ত্রী যুবেদা খান এর কাছে শুনেছি.।  সন্ধ্যাবেলা বাবা আলাউদ্দীন যখন নিজের ঘরে বসে সাধনা করতেন তখন নাকি প্রায় ছয় লাল পাড় শাড়ি পরিহিতা এক রমণীকে ঘরে ঢুকতে দেখা যেত। প্রথমদিকে সন্দেহ হয় যে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ বয়সে বাবার ভীমরতি হয়েছে,  তাই  ঘরে অন্য স্ত্রীলোকনিয়ে আসতেন। কিন্তু গুরুমা বেশ কয়েকবার ওই স্ত্রীলোককে অনুসরণ করতে গিয়ে দেখেছেন  স্ত্রীলোকটি যেন হওয়ায় উবে গেছেন।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। ১৯৯৪ সালে আমি তখন আমার গুরু আচার্য আলী আকবর খান সাহেবের কাছে শিক্ষা নিচ্ছি আমেরিকায়। আমি থাকাকালীন কোন একটা সময়, খান সাহেবের পরিবার বেড়াতে গেলেন লস এঞ্জেল শহরে।  খান সাহেব বাড়িতে একা ছিলেন এবং আমার কাজ ছিল তাঁর দেখভাল করা। সারাদিন বাড়িতে কাটাবার পর উনি আমাকে রাত্রে উনার কলেজে যেখানে আমি থাকতাম সেখানে গিয়ে শুতে অনুরোধ  করলেন। আমি উনাকে অনেক বার অনুরোধ করি যাতে ওই কয়েকটা দিন আমি রাতে বাড়িতে শুতে পারি। কারণ উনি একা। কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হলেন না। কারণ হিসাবে বললেন যে রাত্রে উনার কাছে থাকলে আমি ভয় পাব, কারণ রাত্রে নাকি ওনার বাবা অর্থাৎ আচার্য আলাউদ্দিন খান সাহেব রাত্রে এসে ওনাকে তালিম দেন এবং বকাবকি করেন। সেই সঙ্গে নাকি সারা বাড়ি পীর/জীন এরা ঘুরে বেড়ান। এবং এদের দেখলে আমি ভয় পাব। তাই তিনি চান না যে আমি রাত্রে ওনার বাড়িতে থাকি।

আমার লেখা শেষ করব প্রখ্যাত সরোদবাদক শ্রীবুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাছে শোনা গল্প দিয়ে। যশোর জেলার গদখালি গ্রামের গল্প। বহু বছর আগে এই গদখালি গ্রামের বহু পুরুষ মানুষ চাকুরি করতে কলকাতা শহরে এবং কেউ সপ্তাহের শেষে, কেউ মাসের শেষে গ্রামে ফিরতেন পরিবারের কাছে। একবার গদখালিতে প্রচণ্ডভাবে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং মড়কের আকার ধারণ করে। ফলে বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। এই সময়ে তিন ব্যক্তি গ্রামে ফেরেন পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। প্রথম জন দেখেন যে তার স্ত্রী একহাত ঘোমটা টেনে তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছেন।

এই ঘটনায় বিস্মিত হয়ে তিনি স্ত্রীর ঘোমটা সরাতে গিয়ে দেখেন মানুষের পরিবর্তে একটি কঙ্কাল। দ্বিতীয় ভদ্রলোক খাওয়ার পাতে লেবু চাওয়ায় স্ত্রী নাকি বিশাল লম্বা হাত রানাঘরের জানলা দিয়ে বার করে বাগানের লেবু গাছ থেকে লেবু পেড়ে আনেন। আর তৃতীয় ভদ্রলোক বাড়ি এসে স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে, খোজাখুজির পর স্ত্রীকে আবিষ্কার করেন রান্নার ঘরে। যেখানে উনুনে ভাত সিদ্ধ হচ্ছে এবং কাঠের বদলে স্ত্রী তার দুটো হাত উনুনের আগুনে গুঁজে রেখেছেন। এই কাহিনি নাকি যশোরের ঘরে ঘরে  লোকের মুখে ফিরত এবং সত্যি বলে বিশ্বাস করত।