Vidyasagar’s Vision and the Expansion of Women’s Education in Bengal through the Establishment of Girls’ Schools
Dr. Jayanti Mandal
Abstract: This study explores the transformative efforts of Ishwar Chandra Vidyasagar in advancing women’s education in Bengal during the 19th century. Focusing on Vidyasagar’s pioneering initiative to establish girls’ schools, the research delves into the socio-cultural context of the time and examines the impact of these educational institutions on the empowerment of women. By analyzing Vidyasagar’s educational philosophy, pedagogical methods, and the challenges faced, this study sheds light on the pivotal role played by the establishment of girls’ schools in fostering a paradigm shift towards gender inclusivity and enlightenment in Bengal’s educational landscape. The findings contribute to a nuanced understanding of the historical progression of women’s education in the region and highlight Vidyasagar’s enduring legacy as a champion of educational equality.
বাংলায় স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার : বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিদ্যাসাগর
ডঃ জয়ন্তী মণ্ডল
অতিথি অধ্যাপিকা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
যুগে যুগে দেখা যায় কোনো কোনো মানুষ সমাজের যুগসঞ্চিত সমস্যাগুলি চিহ্নিত করেই নিশ্চিন্ত বোধ করেন না। সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধ থাকেন। তাই তাঁরা দায়কে অন্যের কাধে না চাপিয়ে বা অহেতুক সমালোচনায়, বিতর্কে না গিয়ে নিজেরাই এগিয়ে আসেন। তারা তাদের গভীর চিন্তা, অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি এবং তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে সমস্যার কারণগুলি খুঁজে বের করে সেগুলিকে সমূলে উৎপাটিত করেন। এরকম কয়েকজন মহানব্রতী মানুষ ভারতবর্ষে তথা বাংলাদেশে নারী জাতির শিক্ষার এবং সংস্কারের উন্নতির জন্য ব্রত নিয়ে ছিলেন। এরকম কয়েকজন মহানব্রতী হলেন—রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বেথুন, গৌরমোহন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
১৮৫৬ সালে বাংলায় ছোটো লাট সিসিলি বিডনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায়। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য বিদ্যাসাগর ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। ছোটোলাট বিডনের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের বিখ্যাত পত্রে ও অন্যত্র বিলাতের কর্তৃপক্ষ স্ত্রীশিক্ষা সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করার মত প্রকাশ করেন। ভারতে স্ত্রীশিক্ষা সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় প্রচুর পরিমাণে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে হলিডে বিদ্যাসাগরকে ডেকে আলোচনা করলেন। বিদ্যাসাগরের মনে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যে স্ত্রী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কঠিন হলেও আগ্রহভরে কাজ করলে জনগণের সহানুভূতি পাওয়া যাবে। বিদ্যাসাগর অল্প দিনের মধ্যে হ্যালিডেকে জানালেন বর্ধমান জেলার জৌগ্রামে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় খুলেছেন। সালটি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে মে। স্কুল অপ ডিরেক্টর বিদ্যালয়টির জন্য সরকারের কাছে ৩২ টাকা মাসিক সাহায্যের অনুমোদন চেয়ে পাঠান। সরকার তার আবেদন মঞ্জুর করেন। ইতিমধ্যে দক্ষিণবঙ্গের স্কুলগুলির ইনস্পেক্টর প্র্যাট সাহেবের কাছে তিনটি আবেদন আসে। হুগলি জেলার হরিপাল থানার অন্তর্গত দোহারহাটা, বৈদ্যবাটী থানার গোপালনগর গ্রামে এবং বর্ধমানের নারো গ্রামে তিনটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রস্তাব আসে। ছোটোলাট সব আবেদনই মঞ্জুর করেন। তবে সবজায়গায় গ্রামবাসীরা বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণ করে দেবার ভার নেন। এমনকি আবেদনগুলি মঞ্জুর করার সময় ছোটোলাট বিভাগীয় ইনস্পেক্টরদের কাছ থেকে জানতে চান ডিরেক্টর আর কোন আবেদন পেয়েছেন কি না। তাহলে সেই প্রার্থনাও তিনি মঞ্জুর করে দেবেন।
এ হেন আচরণ দেখে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে বাংলা সরকারের মনোভাব বেশ ভালোই ভাবলেন বিদ্যাসাগর মশায়। তিনি অতি দ্রুত কাজে নেমে পড়লেন। এর আগে বালকদের আদর্শ বালক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রণালী অবলম্বন করেছিলেন বালিকাদের ক্ষেত্রেও তাই করলেন। তিনি ভাবলেন সরকার তার ইচ্ছা মঞ্জুর করেছেন। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি নিজের এলাকাভুক্ত জেলাগুলিতে অনেকগুলি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। এসব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেই সংবাদ ডিরেক্টর অফ স্কুল ইনস্ট্রাকশানের কাছে পাঠিয়ে মাসিক সাহায্য প্রার্থনা করে পাঠালেন। ডিরেক্টর ছোটোলাটের আগের আদেশ মতো আবেদনটি ছোটোলাটের কাছে পাঠিয়ে দেন। ১৮৫৭ নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ মে পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মহাশয় পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয় গুলির জন্য মাসে ৮৪৫ টাকা খরচ লাগত। বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রীসংখ্যা ছিল তেরোশো।
বিদ্যাসাগরের বিদ্যালয়গুলির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় ছোটোলাট ভারত সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠান। তিনি উল্লেখ করেন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা অক্টোবরের পত্রে বিলাতের কর্তৃপক্ষ আশা দিয়ে বলেছেন নবপ্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির ছাত্রীদের কাছ থেকে মাইনে নেওয়া হবে না। ছোটোলাট ভাবলেন মেয়েদের শিক্ষার জন্য আরও কিছু করা দরকার। তাই তিনি প্রস্তাব করলেন এই বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে নিখরচায় গৃহ এবং কুড়িটি ছাত্রী ভর্তি হলেই সরকারের স্কুল পরিচালনার সমস্ত খরচ বহন করা উচিত।
কিন্তু ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে র পত্রে ভারত সরকার বালিকা বিদ্যালয় সম্পর্কে সরকারি সাহায্যের নিয়মের ব্যতিক্রম করতে অস্বীকার করেন। সরকার জানালেন উপযুক্ত পরিমাণে স্বেচ্ছাপ্রদত্ত সাহায্য না পেলে এরকম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ভালো। সরকারের এরকম আদেশে বিদ্যাসাগর সমস্যায় পড়লেন। তিনি ভেবেছিলেন বিদ্যালয়গুলির জন্য অনুমোদন পাওয়া যাবে। তিনি ভাবলেন স্কুলগুলি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে শিক্ষকেরা বেতন পাননি।
নব প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলি যখন তুলে দিতে হবে বলে বিদ্যাসাগর ভাবলেন, তখন তিনি ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনকে লিখলেন ২৪ শে জুন ১৮৫৮ সাল—হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া এবং মেদিনীপুর জেলায় অনেকগুলি গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলাম। বিশ্বাস ছিল, সরকার হইতে মঞ্জুরী পাওয়া যাইবে। স্থানীয় অধিবাসীরা স্কুল গৃহ তৈয়ারি করাইয়া দিলে সরকার খরচ-পত্র চালাইবেন। ভারত সরকার কিন্তু ওই শর্তে সাহায্য করিতে নারাজ, কাজেই স্কুলগুলি তুলিয়া দিতে হইবে। কিন্তু শিক্ষকবর্গ গোড়া হইতে মাহিনা পান নাই, তাঁহাদের প্রাপ্য মিটাইয়া দেওয়া দরকার। আশা করি, সরকার এই ব্যয় মঞ্জুর করিবেন।[১] স্কুল অফ ডিরেক্টর বাংলার সরকারের কাছে বিদ্যাসাগরের কথা জানিয়ে লিখলেন—“পণ্ডিতের পত্রের সহিত সংযুক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণীর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি; কেন না, স্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কে এই কর্মচারীর স্বেচ্ছাকৃত এবং অনাড়ম্বর পরিশ্রমের কথা সরকারের না জানাই সম্ভব। দূরবর্তী স্থানের অন্যবিধ কর্তব্যের গুরুভার যাহার উপর ন্যস্ত; কর্তৃত্বের বিশেষ উচ্চপদেও যিনি অবস্থিত নন, এমন এক ব্যক্তি কর্তৃপক্ষের বিশেষ সাহায্য ও সহানুভূতি ব্যতীতও
গ্রামসমুহে যদি এতটা করিয়া থাকিতে পারেন, সরকারের অনুমোদন ও সাহায্য পাইলে সেই দিকে কতটাই না তিনি করিতে পারিতেন? আর যদি আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্বেও ইহাতে সেই কর্মচারীর অপমান ও আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইলে স্ত্রীশিক্ষার প্রচারে কি নিরুৎসাহের ভাবই না আসিয়া পড়িবে?”[২] ছোটোলার্ট ডিরেক্টরের অনুরোধ পত্রটিকে পুনরায় ভারত সরকারকে বিবেচনার জন্য পাঠান। ১৮৫৮ সালের ২২ শে জুলাই। ভারত সরকার ২২ শে ডিসেম্বর এই উপলক্ষ্যে পত্র পাঠান। পত্রটি এ ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পত্রটির কিছু অংশ ‘দেখা যাইতেছে, পণ্ডিত আন্তরিক বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়াই এ কাজ করিয়াছেন, এবং এ কাজ করিতে উচ্চতম কর্মচারীদের উৎসাহ এবং সম্মতিও তিনি পাইয়াছেন। এই সকল কথা বিবেচনা করিয়া, এই বিদ্যালয়গুলিতে যে ৩৪৩৯৫ প্রকৃত পক্ষে ব্যয় হইয়াছে সেই টাকার দায় হইতে সপারিষদ বড়োলার্ট তাহাকে মুক্ত করিতেছেন। সরকার এ টাকা দিবেন, ইহাই তাঁহার আদেশ।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির, অথবা সেগুলির পরিবর্তে প্রস্তাবিত সরকারি বিদ্যালয়গুলির ব্যয়নিৰ্বাহাৰ্থ কোন স্থায়ী অর্থসাহায্য করিতে কাউন্সিলের সভাপতি সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক। সমস্ত চিঠিপত্র বিবেচনার্থ সেক্রেটারী অফ স্টেটের নিকট প্রেরিত হইবে। হুগলি, বর্ধমান ও ২৪ পরগনায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য অনধিক এক হাজার টাকার সাহায্যের জন্যও ইহাতে অনুরোধ থাকিবে। সেই টাকার কিয়দংশ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলির সাহায্যার্থ এবং কিয়দংশ সরকার সমর্থিত কতকগুলি মডেল স্কুলের জন্য ব্যয় করা হইবে। [৩]
ইতিমধ্যে ইংরেজ সরকার সিপাহী বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েন। ফলে আর্থিক অনটন বশত বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে কোন স্থায়ী সাহায্য করতে অস্বীকার করেন এবং আশা দেন ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে তারা ভাববেন।
ইতিমধ্যে ১৮৫৮ সালের নভেম্বর মাসে বিদ্যাসাগর সরকারি চাকুরী থেকে স্বেচ্ছাবসর নেন। বালিকা বিদ্যালয়গুলির প্রতিষ্ঠা নিয়েই স্কুল অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সঙ্গে বিরোধ বাধায় তিনি চাকুরী থেকে পদত্যাগ করেন বলে মনে করা হয়। ফলে মাসে ৫০০ টাকা তার আয় কমে গেল। অন্যদিকে তার প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে সরকার অর্থ সাহায্যে অসম্মত হল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগর হতাশ হলেন না। তিনি তাঁর বজ্র কঠিন মনের মতো বালিকা বিদ্যালয়গুলি পরিচালনার জন্য এক নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাণ্ডার খুললেন। তাঁর এই নারীশিক্ষা ভাণ্ডারে পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ এবং বহু সম্রান্ত দেশীয় ভদ্রলোক এবং উচ্চপদের সরকারি কর্মচারীরা নিয়মিত চাঁদা দিতেন। ছোটোলাট বীভনও ঈশ্বরচন্দ্রকে ৫৫ টাকা সাহায্য করে তাকে উৎসাহ দিলেন। দেশীয় এই আনুকূল্য বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষার প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রাখল।
তথ্যসূত্র
১। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ২য় খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, শ্রাবণ ১৩৬২, পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭০।
২। তদেব, পৃষ্ঠা ৭১।
৩। তদেব, পৃষ্ঠা ৭২।