বিসর্জন নাটকের সংগীত
ডঃ ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়
‘বিসর্জন’ নাটক যখন রচিত হয়, কবির বয়স তখন ২৯ বছর। বাংলা সাল ১২৯৭, ইংরাজী সাল ১৮৯০।
নাটকের গানগুলি :
১। ঝর ঝর রক্ত ঝরে কাটা মুণ্ডু বেয়ে’।
২। আমি একলা চলেছি এ ভবে’ – দেশ/কাওয়ালী, অপর্ণার গান।।
৩। উলঙ্গিনী নাচে রণরঙ্গে’ – পঞ্চম দৃশ্যে হারুর গান।
৪। ওগো পুরবাসী – অপর্ণার গান।।
৫। “আমারে কে নিবি ভাই, সঁপিতে চাই আপনারে’’ – দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে জয়সিংহের গান।
৬। থাকতে আরতো পারলি নে মা – ভৈরবী, একতাল, কোরাস।।
বিসর্জনের রচনাকাল ফাল্গুন, ১২৯৬। কিন্তু গ্রন্থাকারে তা প্রকাশ পেয়েছে, ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৭/ইংরাজী ১৮৯০ খৃষ্টাব্দ। স্নেহের ভ্রাতুস্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তার রবিকাকা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিসর্জন’ নাটকটি উৎসর্গ করেছেন। সকলেরই জানা ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের প্রথম কিছুটা অংশ নাট্যাকারে কবি যেটি রচনা করেছেন, সেটিই ‘বিসর্জন’ নাটক।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন – রবিকাকা ঘনবর্ষাকালে রয়েছেন ঠাকুরবাড়ির উত্তরবঙ্গস্থিত কয়েকটি মহাল পরিদর্শনের কাজে। অবনীন্দ্রনাথসহ আরো কয়েকজন ঠাকুরবাড়ির সদস্য সঙ্গে রয়েছেন। সবারই বাই উঠল সেখানে নাটক করতে হবে। হয় ‘রাজা ও রাণী’, না হয় বৌঠাকুরাণীর হাট ইত্যাদি। রবিকাকা বললেন এগুলি চলবে না। আট দশ দিন অন্য মহালের কাজ সেরেই ফিরে এসে বললেন ‘বিসর্জন’ নাটক লিখে ফেলেছি। রচনাস্থল শাজাদপুর বা শিলাইদহ হতে পারে।
সুরেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবী দুজনেই তাদের রবিকাকাকে বছর বছর তার জন্মদিনে কোনো না কোনো বই অথবা লিখবার জন্য বাঁধানো খাতা দিতেন। সমগ্র ‘বিসর্জন’ নাটকটি সুরেন্দ্রনাথ প্রদত্ত একটি বাঁধাখাতায় মাত্র আট-দশদিনের মধ্যে লিখে ফেলেছেন। উৎসর্গের বয়ানটি একটি দীর্ঘ কবিতা। তারই চারটি পংক্তি আপনারা লক্ষ্য করুন :
তােরি হাতে বাঁধা খাতা তারি শ-খানেক পাতা|
অক্ষরেতে ফেলিয়াছি ঢেকে,
মস্তিষ্ক কোটরবাসী চিন্তাকীট রাশি রাশি
পদচিহ্ন গেছে যেন রেখে।
পাঠকেরা সমগ্র কবিতাটি মূলগ্রন্থ থেকে পড়ে নেবেন। আমার ছোটো রচনায় উল্লেখ মাত্র করলাম। সমগ্রটি দেবার অবকাশ নেই।
বিসর্জন’ নাটকের প্রথম গান – ‘ঝর ঝর রক্ত ঝরে কাটামুণ্ডু বেয়ে : রাগ বিভাস, তাল কাওয়ালী গানটি ‘বিসর্জন’ নাটকের প্রথম সংস্করণে মুদ্রিত হয়েছিল, পরবর্তী সংস্করণে গানটি কেন বর্জিত হয় সেকথা কবিও লেখেন নি, প্রকাশকরাও লেখেন নি; ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে কোলকাতায় নাটকটি অভিনীত হয়েছিল। জনতার গান বলে সমস্বরে গানটি নাটকের মধ্যে গীত হয়েছিল। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় একটু সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এই গানটি আদৌ রবীন্দ্রনাথের রচনা কি-না সে বিষয়ে।
অপর্ণার কণ্ঠে গীত, দেশ রাগে কাওয়ালী তালে ‘আমি একলা চলেছি, এ ভবে’। গানটি অপর্ণার ব্যক্তিত্বকেও যেমন প্রকাশ করছে, তেমনি প্রকাশ করছে নাটকের মূলসুরকে। তার সপ্তকের যড়জের উপর উদাত্ত কণ্ঠে গাওয়া এই গানটি কোলকাতার সমস্ত দর্শক তথা শ্রোতাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল (১৩৩০, ভাদ্র)। এরপর আপনারা লক্ষ্য করুন গানটি কি ভাবে শেষ হচ্ছে।
বালিকা অপর্ণার অভয়বাণী।
‘ভয় নেই, ভয় নেই –
যাও আপন মনেই’।
কি অপরূপ প্রাকৃতিক উৎপ্রেক্ষাসহ সংগীত-সমাপ্তি ঘটাচ্ছে।
“যেমন একলা মধুপ ধেয়ে যায়
কেবল ফুলের সৌরভে।।
মঞ্চে অপর্ণার গান শেষ হলেও সংগীত সৌরভ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, সংবেদনশীল দর্শকের কানে, মনে। স্বরলিপিকার রবীন্দ্র নির্দেশিত কাওয়ালী তালকে না রেখে কেন দাদরা তালে স্বরলিপি বাঁধলেন তা আমরা জানি না। কাওয়ালী চতুর্মাত্রিক তাল, দাদরা ত্রিমাতৃক। এবার আসা যাক ‘উলঙ্গিনী নাচে রণরঙ্গে গানটির প্রসঙ্গে। হারু আর সকল পুরবাসীদের আহ্বান করছে “আয় রে, মায়ের সামনে বাহু তুলে নৃত্য করি”। গানটি ভৈরব রাগে, একতালা তালে, দ্রুতলয়ে বাঁধা। দশদিক অন্ধকার করে দিক্-বসনা মেতে উঠেছে তার রাঙা-রসনা তথা লোল জিহ্বা যেন বহ্নি শিখার মতো জ্বলজ্বল করছে। কৃষ্ণমেঘের মতো তার কালো কেশ যেন সমগ্র আকাশকে ঢেকে রেখেছে। কালীর কালো কেশে ঢেকে গেছে রবি, সোম সহ গ্রহনক্ষত্ররা। তার ভ্রুভঙ্গে ত্রিভুবন কেঁপে উঠছে। তার কালো অঙ্গে রাঙা রক্তধারা ঝরে পড়েছে। কথায়, সুরে, তালে এ যেন সত্যিই রণরঙ্গ। হারুর নেতৃত্বে পুরবাসীগণের এই নৃত্যগীত ‘বিসর্জন’ নাটকের যেন Climax. অপর্ণার পরবর্তী গান :
‘ওগো পুরবাসী,
আমি দ্বারে দাড়ায়ে আছি উপবাসী”।
কবির পাণ্ডুলিপি অনুসারে গানটির রাগ মিশ্র সিন্ধু, তাল কাওয়ালী। কিন্তু স্বরলিপি অনুসারে (স্বরবিতান-২৮) রাগ মিশ্রখম্বাজ, তাল-কাহারবা। সন্দেহ হয় স্বরলিপিকর্তা কবি-প্রদত্ত সুর-তাল ভুলে নিজের সুর-তাল বসিয়ে দেন নি তো? গানটির সঞ্চারীর দ্বিতীয় পংক্তিতে একটি শিক্ষামূলক পরমসত্য তথা আপ্তবাক্য আমার মতো বেশ কয়েকজন রবীন্দ্র-অনুরাগীকে বিমোহিত করে রেখেছে।
আপ্তবাক্যটি হলো :
‘যেথা হতে আসিয়াছি সেথা যাবো ভাসি’।
এবার আসি জয়সিংহ-গীত : ‘আমারে কে নিবি ভাই, সঁপিতে চাই আপনারে’।
এই গানটি সুরের দিক থেকে কীৰ্ত্তনাঙ্গ এবং বাউলাঙ্গ, তাল লোফা বা দাদরা। গানটি জয়সিংহের কণ্ঠে কেন এলালো তা বুঝতে গেলে গানটির পূর্বাংশের সংলাপ বিশেষ ভাবে দ্রষ্টব্য। নিশিপুরের মেলায় কুকি-রমণীদের নৃত্যগীত হবে। নিশ্চিন্ত আনন্দে সমস্ত পথিক গান গাইতে গাইতে হাস্য-পরিহাস করতে করতে এই ধরণীর শোভাকে উজ্জল মূর্তিতে সাজিয়ে চলেছে। জয়সিংহ বলছে –‘আমিও চলিনু’। পথিকদের ডেকে বলছে ‘সঙ্গে তাদের নিয়ে যা রে’। রূপের হাট’, ‘ভবের বাট’ একাধারেই বাউলদের যাকে বলে Catch words। রবীন্দ্রনাথ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই Catch words দুটি নিজের গানে প্রয়োগ করেছেন :
‘তোরা কোন রূপের হাটে, চলেছিস ভবের বাটে’। গানটি রবীন্দ্রনাথ স্বকণ্ঠে রেকর্ড করেছেন। তার গান শুনে বোঝা যায় বাংলা গানের রূপ ও গায়কি সে আমলে কেমন ছিল।
‘বিসর্জন’ নাটকের ছয়সংখ্যক তথা শেষ গান :
‘থাকতে আর তো পারলি নে মা ।
পারলি কই ?”
আপনারা সকলেই জানেন রঘুপতি নিজের হাতে কালীমূর্তির মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল; গ্রামবাসীদের রাজার বিরূদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলানোই তার মুখ্য উস্কেশ্য ছিল। অপর্ণা রঘুপতির ছল চাতুরিকে প্রজাবৃন্দের তথা গ্রামবাসীদের সামনে প্রকাশ করে দিল। মন্দিরে উঠে কালীমূর্তির মুখ সামনে এনে দিয়ে বললো :
আয় তো মা, দেখি
আয় তো সম্মুখে একবার!
এই দেখো মুখ ফিরায়েছে মাতা।
সকলে মিলে বলে উঠল :
ফিরেছে জননী ! জয় হোক! জয় হোক! মাতঃ, জয় হোক!
সকলে মিলে গাইতে থাকলো :
“থাকতে আর তো পারলি নে মা, পারলি কই ?
কোলের সন্তানেরে ছাড়লি কই ।
দোষী আছি অনেক দোষে, ছিলি বসে ক্ষণিক রোষে,
মুখ তো ফিরালি শেষে, অভয় চরণ কাড়লি কই ?”
সাধারণতঃ গান দিয়ে নাটক শেষ হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে তা নয়। কেন না মুখ্য ঘটনাবলী এখনো মঞ্চেও দেখানো হয়নি, সংলাপেও বিস্তৃত হয়নি। রঘুপতি যখন শেষ রাত্রে ধ্রুবকে বলি দিতে খাঁড়া উত্তোলন করেছে, সেই মুহূর্তে রাজা গোবিন্দমাণিক্য ও প্রহরীগণ রঘুপতি ও নক্ষত্ররায়কে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করলো। বিচার সভাতেও রঘুপতি রাজার প্রতি সমানভাবে রুষ্ট ও ক্রুদ্ধ। বলে চলেছে :
শরতের প্রথম প্রত্যুষে – চলে যাবো।
তোমার এ অভিশপ্ত দগ্ধ রাজ্য ছেড়ে,
আর ফিরাবো না মুখ।।
নিজ বক্ষে, নিজ হস্তে, ছুরি বিন্ধনের ঠিক প্রাক্কালে জয়সিংহ আবেগভরে ঘোষণা করে উঠলো:
‘আমি রাজপুত, পূর্ব পিতামহ ছিল রাজা,
এখনো রাজত্ব করে মোর
মাতামহ বংশ – রাজরক্ত আছে দেহে।
এই রক্ত দিব। এই যেন শেষ রক্ত হয় মাতা,
এই রক্তে শেষ মিটে যেন
অনন্ত পিপাসা তোর, রক্ততৃষাতুরা।”
সর্বশেষে রঘুপতির উপলব্ধি হলো :
‘জয়সিংহ নিবায়েছে নিজ রক্ত দিয়ে|
হিংসারক্তশিখা।‘
গোবিন্দমাণিক্য গুণবতীকে লক্ষ্য করে বলছে :
“দেবী আজ এসেছে ফিরিয়া, আমার দেবীর মাঝে।”
রঘুপতিও অপর্ণাকে সম্বোধন করে বলছে :
জননী আমার,
এবারে দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা!
জননী অমৃতময়ী!
পরিশিষ্ট
‘বিসর্জন’ নাটকের পরম মহিমা প্রকাশ করতে আমাদের পরিবারের, বিশেষভাবে আমার স্বর্গত পিতৃদেব বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়ের কথা আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পিতৃদেব ছিলেন অসাধারণ নাট্যমােদী, দক্ষ অভিনেতা, দক্ষ আবৃত্তিকার।
আমার পিতামহ স্বৰ্গত ভূদেব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ীর ছাত্র। শিশির ভাদুড়ী মহাশয় যখন কোলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরাজীর অধ্যাপনা করতেন, তখন আমার পিতামহ ঐ কলেজের স্নাতকের ছাত্র। ঐ সময়ে বিদ্যাসাগর কলেজে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে পিতামহের ‘চাণক্য’র ভূমিকায় অভিনয় দেখে শিশির ভাদুড়ী মন্তব্য করেছিলেন : “এ তো গলার আওয়াজ নয়, একে বলে কণ্ঠ।” তখনকার দিনে মাইক্রোফোন ছিল না, মায়েরা বাচ্চাদের মুখ টিপে ধরতো, যখন পিতামহ অভিনয় করতেন। পিতামহের কাছেই পিতৃদেবের নাটক শেখা। পঞ্চাশের দশকে বোলপুর তথা বীরভূমের একমাত্র নাট্যচর্চার কেন্দ্র ‘শ্রীনাট্যম’। এই ‘শ্রীনাট্যম’ সংস্থার প্রযােজনায়, বোলপুর বিচিত্রা সিনেমা হল ভাড়া নিয়ে ‘বিসর্জন নাটক মঞ্চস্থ হয়। পরিচালক ছিলেন কোলকাতার অনুশীলন সম্প্রদায়ের পরিচালক মমতাজ আমেদ ও কোলকাতার বিশ্বরূপা থিয়েটারের ঠাকুরদাস মিত্র। গোটা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের সেট কোলকাতা থেকে লরি ভাড়া করে আমার পিতৃদেব নিয়ে এসেছিলেন। এই নাটকে মঞ্চে আলোক-সম্পাতে ছিলেন, মঞ্চে আলোর জাদুকর তাপস সেন মহাশয়। আমার পিতৃদেব বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয়, মঙ্গল চৌধুরী মহাশয়ের জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় আজও বোলপুরের মানুষের মনে কিংবদন্তী হিসাবে গণ্য হয়। দর্শকাসনে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা ছিলেন। শোনা যায় তখনকার দিনে পাঁচ টাকার টিকিট পনেরো টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তাপস সেন মহাশয় অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন যে, “মফস্বলে এইরকম নাট্যচর্চা হয় জেনে আমি অভিভূত এবং ১ টাকা মাত্র পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। ‘বিসর্জন’ নাটকের শেষ দৃশ্যে যখন শ্রাবণের শেষ রাত্রি, জয়সিংহ এসে আত্মবলিদান দেবে, সেই দৃশ্যে ঝড়বৃষ্টির আবহ এবং আলো এবং রঘুপতির অট্টহাসির সঙ্গে ‘এতো দিনে বুঝি জাগিয়াছ দেবী সংলাপ বোলপুরের মানুষদের মুখে এখনও শোনা যায়। আমার সেজদিদি গীতশ্রী পিতৃদেবের সঙ্গে ধ্রুবর চরিত্রে রূপদান করেছিলেন।
আমার মাতৃদেবী স্বর্গতা নির্মলা চট্টোপাধ্যায় তখন সদ্যবিবাহিতা, পিতামহের পরবর্তীকালে আবারও চাণক্য’র অভিনয়ের জন্য, পিতৃদেবের রঘুপতির অভিনয়ের জন্য লণ্ঠনের আলাের সংসারের সব কাজ সেরে কাপড়ের পাড় ছিড়ে সুতো বের করে পৈতা তৈরী করে দিতেন। তখনকার দিনে এত মেকাপ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। নাটকের সাজপোষাক নিজেদেরকেই করতে হোতো। ‘বিসর্জনে’ রঘুপতি রাগে পৈতা ছিঁড়িতে উদ্যত ছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে চাণক্যও পৈতা ছিড়িয়া অভিশাপ দিয়েছিলেন মৌর্যবংশ ধ্বংস হবে। পরবর্তীকালে ৮০ এর দশকে পিতৃদেবের উপস্থিতিতে শান্তিনিকেতনে, সংগীত ভবনের ছাত্র থাকাকালীন আমি শারদোৎসবে বিদ্যাভবন ছাত্রসম্মিলনীকে দিয়ে শান্তিনিকেতনের নাট্যঘরে ‘বিসর্জন’ নাটক মঞ্চস্থ করিয়েছিলেন।
আমি পরিচালকের ভূমিকায় ছিলাম। তখন রঘুপতির অভিনয় করেছিলেন তৎকালীন বিশ্বভারতীর ছাত্র সম্পাদক শ্রীমান কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাকে আবহসঙ্গীতে সহযোগিতা করেছিলেন বর্তমানে সংগীতভবন, বিশ্বভারতীর এসরাজের অধ্যাপক বুদ্ধদেব দাস এবং শিক্ষাসত্র, বিশ্বভারতীর ইতিহাসের অধ্যাপক সৌমেন সেনগুপ্ত মহাশয়।
আর একটি ঘটনা মনে দাগ কেটে আছে। আমার পরিবারের নাট্যচর্চার উদাহরণ হিসাবে আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। শ্রীনাট্যম সংস্থায় তখন কেরানীর জীবন’ নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য মহড়া চলছে। একদিন গভীর রাতে পিতৃদেব মহড়া শেষে বাড়ী ফিরলেন। মাতৃদেবী লণ্ঠনের আলোয় পিতৃদেবের রাত্রের আহার নিয়ে অপেক্ষারতা। পিতৃদেব আহার করতে বসে একটু ভাত খেয়ে নিয়ে হঠাৎ ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। মাতৃদেবী ভয় পেয়ে গেলেন। সন্ত্রস্ত হয়ে ভাবতে লাগলেন, রান্না ভালো হয়নি বোধ হয়! পিতৃদেব মাতৃদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে পিতৃদেব হাসতে লাগলেন এবং মাতৃদেবীকে হাসতে হাসতে বলছেন, “কেমন হয়েছে অভিনয়টা? মাতৃদেবী অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন। আসলে কেরাণীর জীবন নাটকে যখন কেরাণী ধারদেনায় একেবারে বিপর্যস্ত, পাওনাদাররা একে একে এসে কেরাণীকে অপমান করে যাচ্ছে, শেষে বাড়ীওয়ালা বাড়ী ছেড়ে দিতে বলছে, তখন রাগে, অপমানে কেরাণী ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। সেই দৃশ্যটার মহড়া বাড়িতে মাতৃদেবীকে করে দেখালেন ঠিক হল কি না! কেরাণীর জীবনে পরিচালক ছিলেন কলিকাতার বিশ্বরূপার ঠাকুরদাস মিত্র এবং কেরাণীর স্ত্রী এবং কন্যার চরিত্রে আমার পিতৃদেবের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন স্বনামধন্যা গীতা দে, মাধবী চক্রবর্তী। আমার পরিবারে পিতৃদেব যে সংস্কৃতিচর্চার সূচনা করে গেছেন তা আজও প্রবহমান।
—————–ঃ—————-
ডঃ ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার উচ্চ শিক্ষা বিভাগ স্বীকৃত পদ্মজা নাইডু কলেজ অফ মিউজিক-এ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং দীর্ঘ ২০ বছর খেয়াল গানের অধ্যাপক। এছাড়াও নাট্যাভিনেতা ও আবৃত্তিকার।