তাহাদের কথা
অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
তখনকার দিনে লোকজনদের ধারণা ছিল বাঁশি বাজালে ‘থাইসিস’ হয়। ফলে এআত্মীয় সজন পাড়া-পড়শীরা ভয় দেখাতে শুরু করলেন সাত বছরের বালক গৌরকে। কিন্তু সোভাগ্য এই যে ওর মা-বাবা ওদের কথায় ভনা পেয়ে বরং আরও বেশি উৎসাহ দিতে লাখালেন বাঁশি বাজাতে। সঙ্গীত তখনকার জনমানসে ছিল অপরাধের কাজ। ঠিক সেই সময়ে সঙ্গীতকেই জীবনের সঙ্গী করে ছিলেন সুপরিচিত বংশীবাদক গৌর গোস্বামী। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের লীলাসঙ্গী শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বংশধর গৌর গোস্বামীর দাদু বলাইচাদ গোস্বামী শুধুমাত্র পণ্ডিতই ছিলেন না খেয়াল, ধ্রুপদ গানের চর্চাও করতেন। একই পথের পথিক ছিলেন বাবা বীরেশ্বর গোস্বামীও | বাড়িতে প্রায় গানের আসর বসত আর ছোটবেলা থেকেই গেীর ছিল সেইসব আসরের শ্রোতা। ছােটবেলা থেকেই বাঁশির সুর গেীরকে পাগল করতে। সাত বছর বাসে চড়কের মেলা। থেকে কিনে আনা একটা ছোট বাঁশিতে হয়েছিল সরগমের সঙ্গে তঁর প্রথম পরিচয়। বড়দাদা ব্রজেশ্বর বাজাতেন বীণা, সুরবাহার ও সেতার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। ফলে এই দাদা হয়েছিলেন গৌরের প্রথম গুরু। দিদি গান শিখতেন সতীশ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। সেই সুবাদে গৌরের গানের তালিমও হতে লাগলো সতীশবাবুর কাছে।
একে বাড়িতে এত গান বাজনার চর্চা তারপর ছেলে বাশি বাজাচ্ছে, দেখে আড়ীয়স্বজনরা গৌরবের মা-বাবাকে বলতে আরম্ভ করলেন ‘তোমাদের ছেলে আর বাজারের বাঈজীতে কী তফাৎ। কেন এভাবে এত বড়ো একটা বংশের নাম ডোবাচ্ছ।’
মা-বাবা কিন্তু এতে এতটুকু বিচলিত না হয়ে বরং আত্বীয়-স্বজনদের ত্যাগ করেছিলেন। গান-বাজনা শিক্ষার সঙ্গে লেখাপড়াও চলছিল পুরোদমে। সফলতার সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হলেন বিদ্যাসাগর কলেজে। কলেজের ছাত্রজীবনেই হারালেন প্রিয়তম দাদাকে চিরতরের জন্য। দাদাকে হারিয়ে দাদার বন্ধু পান্নালাল ঘোষের কাছে গেলেন।
শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জানা। কিন্তু বেশিদিন শিক্ষা লাভ হল না, কারণ । পান্নাবার কলকাতা ছেড়ে বোম্বাই পাড়ি দিলেন জীবিকার আশায়। অগতা উপায় না দেখে শরণাপন্ন হলেন সে যুগের বিখ্যাত কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী বার, মিশ্রের কাছে। ওনার কাছেই শিখলেন গায়কী অঙ্গ পরিবেশন। দীর্ঘ দশ বছর ক তালিমের পর গেীর গোস্বামী গেলেন লঘুসঙ্গীতের জনপ্রিয় শিল্পী। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে যখন পান্নাবাবু আসতেন কলকাতায় তখন তার কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ ছাড়তেন না।
১১২ সালে আকাশবাণীতে শিল্পীপদ লাভ হওয়ার সুবাদে আলাপ হল অনুষ্ঠান পরিচালক বিখ্যাত গায়ক সুনীল বসুর সঙ্গে। এই সুনীলবাবুর সহায়তায় আকাশবাণীতে পেলেন চাকরি। ১৯৪৩ সালে। প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী দক্ষিণামোন ঠাকুর যখন আকাশবাণীর চাকরি ছাড়লেন ১৯৪৫ সালে, তখন গৌরবাবুর ওপর পড়ল বিভিন্ন নাটক, সঙ্গীত ও ঐকতান শাখার সুর রচনার দায়িত্ব। ১৯৪৯ সালে এই পদ থেকে উন্নীত হলেন মিউজিক সুপারভাইজারের পদে।।
শিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় রানাঘাটে নগেন দত্ত সঙ্গীত সম্মেলনে বাজাতে গিয়ে নজর কাড়লেন তানসেন সঙ্গীত সম্মেলনের সম্পাদক শৈলেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং পরের বছরই তানসেন সঙ্গীত সম্মেলনে শিল্পী হিসাবে আমন্ত্রিত হলেন। আর এই তানসেনের পর থেকেই গৌর গোস্বামী শুধু কলকাতাই নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেও।
শিল্পী হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। ফিল্মী গানের সঙ্গে গৌর গোস্বামী জড়িত ছিলেন।অসমিয়া, ওড়িয়া হিন্দি ও বাংলায় বিভিন্ন ছবিতে আবহসঙ্গীত ও সঙ্গীত পরিচালনা ছাড়াও ফরাসী চিত্র পরিচালক জাঁ রেনায়ার ‘দি রিভার’ ছবিতে তিনি আবহ সঙ্গীতের কাজ করার জন্য আমন্ত্রিত হন।
হিমাংশু বিশ্বাস ঐকতান বা বৃন্দবাদনের সঙ্গে যেমন প্রখ্যাত শিল্পী তিমিরবরণের নাম ওতপ্রােত যুক্ত।
ছিল তেমনই তার পরবর্তী যে নাম আমরা পাই তা হল হিমাংশু বিশ্বাস মহাশয়ের ঐকতান বা লঘুসঙ্গীতের শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেরও ছিলেন এক অনন্য সাধারণ শিল্পী।
ছােটবেলা থেকেই তার সুরের প্রতি অনুরাগ। প্রতিবেশী বরুণ রায়চৌধুরী ছিলেন। শখের বংশীবাদক। তার সুর হিমাংশুকে করত উতলা। যদিও সেই সময় তিনি পুরোদস্তুরভাবে নিয়োজিত ছিলেন কণ্ঠসাধনে ও ম্যান্ডোলিন বাদনে। বরুণবাবুর বাঁশির সুর তাকে বাধ্য করল বাঁশি শিখতে, শুরু হল বাঁশির তালিম। এরপর বিভিন্ন সময়ে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করলেন অমর রায়চৌধুরী, শৈলেন বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় লাহিড়ী ও দবীর খান সাহেবের কাছে। তাঁর মতন সুবিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, গুণীদের কাছে আরও শিক্ষা পেলেন । শেষোক্ত দু’জনের কাছে পেলেন মার্গ সঙ্গীতের তালিম।
১৯৪৯ সালে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সের শ্রোতারা শিল্পী হিসাবে হিমাংশু বিশ্বাসের নাম প্রথম শুনলেন। প্রথম অনুষ্ঠানে রসিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের দুর্লভ সীভাগ্যও মিলল সেদিন মালকোষ বাজিয়ে। আকাশবাণীর শিল্পী হন ১৯৪৮ সালে আর ১৯৫৬ সালে চাকরি পেলেন ঐ আকাশবাণীতেই। কিন্তু মন পড়েছিল ক্রিয়াশীল কাছের প্রতি তাই ১৯৬২ সালে আকাশবাণীর কাজে ইস্তফা দিয়ে গড়ে তুললেন নিজস্ব ঐকতান সম্প্রদায়। আর খুব অল্পদিনের মধ্যেই এই ঐকতান সম্প্রদায় পেল বিপন জনপ্রিয়তা। এর সঙ্গে সঙ্গে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগতের আসরেও সুপরিচিত হয়ে উঠলেন হিমাংশু বিশ্বাস।
হিমাংশুবাবুর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে ১৯৪৮ সালে। এর পর তিনি এককভাবে লং প্লেয়িং রেকর্ড এবং তিনটি দ্বৈত লং প্লেয়িং রেকর্ডে রবীন ঘোষের বেহালা, দুলাল রায়ের জলতরঙ্গ ও জয়া বিশ্বাসের সেতারের সঙ্গে বাজিয়েছেন। একটি ইপি রেকর্ডে বিভিন্ন যন্ত্রের সমন্বয়ে সুর ও ছন্দের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটির ভাবরূপের সার্থক রূপায়ণ তার এক উল্লেখযােগ্য সৃষ্টি। বাঁশি ছাড়া গীটার ম্যাণ্ডোলিন প্রভৃতি যন্ত্রেও তিনি ছিলেন পারদর্শী এবং তার নিদর্শন রেখে গেছেন বিভিন্ন রেকর্ডে লঘু ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাজিয়ে। এইচ.এম.ভি. ছাড়াও ভারতী, হিন্দুস্তান, সেনোলা প্রভৃতি রেকর্ড কোম্পানিতে ট্রেনার হিসাবে অনেক শিল্পীর গানের সুরও রচনা করেছিলেন হিমাংশু বিশ্বাস।