বাংলা গানে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
অজন্তা জানা, গবেষক, সঙ্গীত ভবন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতে বাংলা গানের চর্চা প্রসঙ্গে প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসৃষ্ট বাংলা গানের কথা আলোচনায় এসে পড়ে। রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা গানের চর্চার ধারায় আমরা দেখতে পাই নিধুবাবুর গান, শ্রীধর কথকের গান, লালচাঁদ বড়ালের গান – যা রাজ–দরবারের মজলিশ, নাটক – থিয়েটারে পরিবেশিত হত ও আসর মাতিয়ে রাখত। এই গানের পথ অনুসরণ করে ঐতিহ্য বহনের দায়িত্ব নিয়েছেন বিশ্ববন্দিত অগণিত একাধারে গীতিকার ও সুরকার, যথা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, কাজী নজরুল। এঁদের গানের উপস্থাপনা করা হয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের বন্দিশ, ঘরানা, গায়কীকে বজায় রেখে নিজস্ব স্বতন্ত্রতায় কথা ও ভাবপ্রধান বৈশিষ্ট্যকে বজায় রেখে। এই পাঁচ বাংলা গানের এই পাঁচজন সৃষ্টিকর্তার প্রত্যেক গানের স্বাদ ও প্রকাশভঙ্গিমা ভিন্ন ভিন্ন – সেটা কথা কিংবা সুর, দুই–এর ক্ষেত্রেই। এবার চলচ্চিত্রের সময় থেকে ভিন্ন গীতিকার ও ভিন্ন সুরকারের কথা ও সুর সমন্বিত নতুন আঙ্গিকের বাংলা গানের উদ্ভব হয়েছে। এতে কবি ও গীতিকারের আলাদা আলাদা সত্তা পরিস্ফুট হয়েছে। কবিতা ও গীতিকবিতার নিজস্ব বৈচিত্র্য আছে। কবিতার চলন এবং তার চরিত্রের সঙ্গে গীতিকবিতার চলন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিছুটা পৃথক হয়ে থাকে। সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভাষার চর্চা ও উপলদ্ধি করতে পারার ক্ষমতার মধ্যে দিয়ে শিক্ষিত সমাজ কবিতা ও গীতিকবিতার তফাৎ অনুভব করতে পারে তাদের শিক্ষিত ও নান্দনিক মননের দ্বারা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম বহু ক্ষেত্রে অবশ্য কবিতায় সুরপ্রদান করেছে গানের মধ্যে বৈচিত্র্য আনার জন্য। রবীন্দ্র পরবর্তীকালের কিছু কবি–সাহিত্যিকদের গীতিকারের ভূমিকায় পাওয়া যায়। নিম্নে তাঁদের কিছু নাম ও গানের কথা সহযোগে একটা দৃষ্টান্তেমূলক তালিকা প্রদান করা হল –
কথা সুর গান
কথা | সুর | গান |
১। হেমেন্দ্রকুমার রায় | কৃষ্ণচন্দ্র দে | অন্ধকারের অন্তরেতে |
২। সজনীকান্ত দাস | সুকৃতি সেন জনতা’ | ‘জাগে নবভারতের |
৩। প্রেমেন্দ্র মিত্র | সুধীন দাশগুপ্ত | সাগর থেকে ফেরা |
৪। অন্নদাশঙ্কর রায় | সলিল চৌধুরী | তেলের শিশি ভাঙলো বলে |
৫। শৈলেন রায় | অনুপম ঘটক জাগে’ | কত কথা প্রাণে |
৬। জীবনানন্দ দাশ | অনুপ ঘোষাল | হায় চিল |
৭। সুভাষ মুখোপাধ্যায় | সুধীন দাশগুপ্ত | ছোটদের রামায়ণ |
৮। সুকান্ত ভট্টাচার্য | সলিল চৌধুরী | রাণার, অবাক পৃথিবী |
৯। কুমুদরঞ্জন মল্লিক | ইন্দুবালা দেবী | ওরে মাঝি, তরী হেথা বাঁধবো নাকো |
১০। বিমল ঘোষ | সলিল চৌধুরী | উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা |
১১। সুকুমার রায় | অরুণ বসু | বাবুরাম সাপুড়ে |
কথা | সুর | গান |
১২। যতীন্দ্রমোহন বাগচি | সুধীন দাশগুপ্ত | বাঁশবাগানে মাথার উপর |
১৩। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় | সুধীন দাশগুপ্ত | মধুর মধুর বংশী বাজে’ |
১৪। মাইকেল মধুসূদন দত্ত | সলিল চৌধুরী | রেখো মা দাসেরে মনে |
১৫। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত | সলিল চৌধুরী ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় | পাল্কির গান |
এবং ‘ছিপখান তিন দাঁড়’ |
গীতিকবিতার রূপ ও সৃষ্টিকৌশল হল – গীতিকবিতার বিষয়বস্তুকে নানাভাবে অলঙ্কৃত করে বিভিন্ন ব্যঞ্জনার দ্বারা কথা তৈরি করে তাতে পরিসীমিত সুরপ্রদান যার কারণে মূলবর্ণিত বিষয় অব্যাহত রেখে কথা ও সুরে মালা গেঁথে যথার্থ মনোরম ও হৃদয়স্পর্শী সুচারু সঙ্গীতের সৃষ্টি করে পরিমার্জিত ও পরিশীলিত কণ্ঠের সাহায্যে তার যথার্থ পরিবেশনা। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে নানা পর্যায়ের, নানা দেশী–বিদেশী সুরের, নানা ভক্তিভাবাত্মক, দেশাত্মবোধ প্রভৃতি নানা আঙ্গিকের রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপাসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এবং কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাত ধরে বাংলা গানের পরবর্তী পর্বে বহু গীতিকার ও সুরকার এবং বাংলা গানের নানা শিল্পীকে ভারতীয়–সঙ্গীতজগত পেয়েছে নানা উপলক্ষে। নানা আঙ্গিকের গান রচিত হয়েছে এই তৎকালীন নতুন সুরকার–গীতিকারের সৃষ্টিশীলতায়। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, কে.এল.সাইগল, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, লালচাঁদ বড়াল, পাহাড়ী সান্যাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, মৃণালকান্তি ঘোষ, সন্তোষ সেনগুপ্ত, অসিতবরণ, রবীন মজুমদার, কানন দেবী, জৈন দেবী, আঙ্গুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবী, কমল ঝরিয়া, যুথিকা রায় – এই গুণী শিল্পীগণের সময়ে বাংলাগানের আর একটি নতুন ধারার গানের সংযোজন হয়েছিল, যার নাম দেওয়া হল ‘রাগপ্রধান গান’ বা ‘রাগাশ্রয়ী বাংলা গান’। এই সময়ে সুরকার হিসেবে রাইচাঁদ বড়াল, তিমিরবরণ, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, সুরসাগর, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, শচীন দেববর্মণ, তুলসীদাস লাহিড়ী, দিলিপ কুমার রায়, হীরেন বসু প্রমুখদের এবং গীতিকার হিসেবে অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ, শৈলেন রায়, প্রণব রায়, অনিল ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী প্রমুখদের উল্লেখ্য ভূমিকা ছিল বাংলা গান সৃষ্টিতে। চল্লিশের দশকের মধ্যে আমাদের দেশে নানা রাজনৈতিক উত্থানপতন, দেশজুড়ে অর্থনৈতিক কারণে নানা ধরনের সংগ্রাম, স্বাধীনতা আন্দোলন, মহামারী এবং অবশেষে স্বাধীনতা প্রাপ্তি আবার পাশাপাশি হিন্দু–মুসলিম দাঙ্গা প্রভৃতির প্রতিফলনে বাংলা আধুনিক গানের জগতে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিনয় রায়, সলিল চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট গীতিকার–সুরকারেরা আবির্ভূত হন তাঁদের সঙ্গীতের ডালি নিয়ে। কিছু উদাহরণ নিম্নে দেওয়া হল –
কথা ও সুর | গান | কণ্ঠ |
১। সলিল চৌধুরী | গাঁয়ের বধূ’ | |
২। সলিল চৌধুরী | সেই মেয়ে | সুচিত্রা মিত্র |
আবার নতুন ধরনের কাব্যধর্মী কাহিনী–সঙ্গীতের সৃষ্টি হয় এইসময়, যা জনপ্রিয়তা লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি গানের একটি তালিকা নিম্নে দেওয়া হল –
কথা | সুর | কণ্ঠ | গান |
১। জলধর চট্টোপাধ্যায় | কৃষ্ণচন্দ্র দে | ||
২। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার | শচীন দেববর্মণ | কৃষ্ণচন্দ্র দে | স্বপন যদি মধুর এমন |
৩। মোহিনী চৌধুরী | কৃষ্ণচন্দ্র দে | শচীন দেববর্মণ | শ্রীমতী যে কাঁদে |
৪। মোহিনী চৌধুরী | কমল দাশগুপ্ত | কৃষ্ণচন্দ্র দে | মুক্তি মন্দির সোপানতলে |
৫। শ্যামল গুপ্ত | সত্য চৌধুরী | পৃথিবী আমারে চায় | |
জগন্ময় মিত্র | অন্তবিহীন নহে তো অন্তকার |
চল্লিশের শেষে এবং পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়ে আরও নতুন গীতিকার সুরাকারের আবির্ভাব হয়। যেমন – নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরেশ ধর, দিলীপ সরকার, ভুপেন হাজারিকা প্রমুখ। শুধু সুরকারের ভূমিকায় সতীনাথ মুখার্জী, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখার্জী, মান্না দে, শৈলেন মুখার্জী, মৃণাল চক্রবর্তী, সুবীর সেন প্রমুখ এবং গীতিকারের ভূমিকায় শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাস্কর বসু, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ মুখোপাধ্যায়, সুনীলবরণ, সুবির হাজরা, মিল্টু ঘোষ, মুকুল দত্ত, অমিয় দাশগুপ্ত, রঞ্জিত দে, প্রবোধ ঘোষ প্রমুখদের বাংলা গানের বিভিন্ন দিকের অর্থাৎ যথাক্রমে সুর ও কথার রচনা ভারতবর্ষে বাংলা গানের এক ইতিহাস তৈরি করেছে। এই সুরকার–গীতিকারের গানের সার্থক রূপায়ণ করেছেন কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাণী ঘোষাল, ইলা বসু, নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ, পান্নালাল ভট্টাচার্য, অরুণ দত্ত প্রমুখ। এইসব কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকারের একত্র সফল সাংগীতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলা গানের পঞ্চাশ দশকের সূচনা হয়। এই পঞ্চাশের দশকে মানুষের মনের সহজ–সরল অনুভূতি অর্থাৎ প্রেম, বিরহ, মিলন, অভিমান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে, আবার কখনো রাষ্ট্র ও সামাজিক বিষয়কে কেন্দ্র করে কিংবা মানুষের জীবনের নানা জীবিকাকে কেন্দ্র করে বাংলা গানের কথা রচিত হয়েছে নানা অঙ্গে নানা সুরে। এর পাশাপাশি আবার ছড়ার গানেরও এক জোয়ারের আবির্ভাব হয়েছে এই দশকে। নীচে প্রত্যেক বিষয়ের কয়েকটি গানের সুরকার–গীতিকারের তালিকা উদাহরণস্বরূপ দেওয়া হল –
কথা | সুর | কণ্ঠ | গান |
১। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার | নচিকেতা ঘোষ | হেমন্ত মুখোপাধ্যায় | আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে |
২। প্রণব রায় | সুধীরলাল চক্রবর্তী | সুধীরলাল চক্রবর্তী | মধুর আমার মায়ের হাসি |
৩। শ্যামল গুপ্ত | সতীনাথ মুখার্জী | সুপ্রীতি ঘোষ | যেথায় গেলে হারায় সবাই |
৪। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার | রবীন চট্টোপাধ্যায় | তালাৎ মামুদ | আলোতে ছায়াতে দিন গুনি |
৬। সলিল চৌধুরী | সলিল চৌধুরী | দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় | শ্যামল বরণী ওগো কন্যা |
৭। পবিত্র মিত্র | সুধীরলাল | শ্যামল মিত্র | স্মৃতি তুমি বেদনার |
৮। প্রবীর মজুমদার | প্রবীর মজুমদার | ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য | মাটিতে জন্ম নিলাম |
৯। কবি সত্যেন দত্ত | অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় | শ্যামল মিত্র | ছিপ্খান তিন দাঁড় |
‘ধানকাটার গান’ , ‘নাও বাওয়ার গান’ , ‘নও জোয়ানের গান’ , ‘বীজ বোনার গান’ (সলিল চৌধুরী), ‘ঘুমভাঙার গান’ (জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র) ইত্যাদি গান হল মানুষের বাস্তব জীবন ও জীবিকা নির্ভর বাংলা গান।
এই দশকে বাংলা গান আরও নব ধারার সুর মিশ্রিত হয়ে নব নব বাংলা গানের সৃষ্টি হয়। উচ্চাঙ্গ, প্রাদেশিক লোকসুর, পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণে এবং বিখ্যাত কিছু কবিতায় সুর সংযোজিত হয়ে আরও অনেক ধরনের বাংলা গানের সৃষ্টি হয়েছে গীতিকার–সুরকারের সৃষ্টিশীলতায়। এমনই কিছু গানের নমুনা দেওয়া হল –
কথা | সুর | কণ্ঠ | গান |
১। মাইকেল মধুসূদন দত্ত | সলিল চৌধুরী | দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় | রেখো মা দাসেরে মনে |
২। অমিয় দাশগুপ্ত | অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় | শ্যামল মিত্র | হংস পাখা দিয়ে |
৩। প্রবোধ ঘোষ | অনল চট্টোপাধ্যায় | প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় | ছলকে পড়ে কল্কে ফুলে |
৪। সলিল চৌধুরী | সলিল চৌধুরী | উৎপলা সেন | প্রান্তরের গান আমার |
৫। শ্যামল গুপ্ত | সতীনাথ মুখোপাধ্যায় | পাষানের বুকে লিখো না আমার নাম | |
৬। বিমল ঘোষ | সলিল চৌধুরী | সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় | উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা |
৭। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার | নচিকেতা ঘোষ | হেমন্ত মুখোপাধ্যায় | মেঘ কালো আঁধার কালো |
৮। শ্যামল গুপ্ত | মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় | আমি এতো যে তোমায় ভালবেসেছি | |
৯। শ্যামল গুপ্ত | মান্না দে | মান্না দে | মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে |
এরপর ষাটের দশকে শ্রী সলিল চৌধুরীর একাধিক গান প্রণম্য শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে যেমন – ‘না যেওনা’ , ‘যারে উড়ে যারে পাখি’ , ওগো আর কিছু তো নাই’ ; শ্রী অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে শ্রীমতী গীতা দত্তের কণ্ঠে ‘কৃষ্ণনগর থেকে আমি’ , শ্রীতরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘মধুমতী যায় বয়ে যায়’ ; শ্রীমতী আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘জানি এ ভুল’, ‘ওগো মনের দুয়ারে’ ; শ্রী শ্যামল গুপ্তের কথা ও শ্রী অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুর এবং কণ্ঠের উপস্থাপনায় শ্রী পিন্টু ভট্টাচার্যের ‘জানি পৃথিবী আমায় যাবে ভুলে’ ; শ্রী সুনীলবরণ বাবুর কথা ও শ্রী অনল চট্টোপাধ্যায় সুরে এবং কণ্ঠে শ্রী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের পরিবেশনায় ‘কাল সারারাত চোখে ঘুম ছিল’ – এই গানগুলি ছিল বাংলা গানের যুগের এক এক যুগান্তকারী সৃষ্টি। এঁনারা ছাড়াও এই যুগের বাংলা গানের আরও অপূর্ব সব দিক্পাল কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পীরা হলেন বাংলার শ্রীমতী মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, শ্রীমতী সবিতা চৌধুরী, শ্রীমতী বনশ্রী সেনগুপ্ত, শ্রীমতী মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী শিপ্রা বসু, বোম্বের আশা ভোঁসলেজী, মুকেশজী, কিশোর কুমারজী, রাহুল দেববর্মণজী, অমিত কুমারজী, বাপী লাহিড়ীজী প্রমুখ। এর পরের দশকগুলিতে এই বাংলা জগতের দুনিয়ায় নানা নতুনের আগমন ঘটেছে – সে কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পী কিংবা গীতিকার কিংবা সুরকারই হোক। যেমন – অনুপ ঘোষাল, শক্তি ঠাকুর, অরুন্ধতী হোমচৌধুরী, হৈমন্তী শুক্লার মতো কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পী ; অজয় দাস, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অশোক রায়, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় মতো গীতিকার–সুরকার ; সুধীন দাসগুপ্ত, অনল চট্টোপাধ্যায়ের মতো উল্লিখিত সুরকারদের সৃষ্টি বাংলা গানের গীতিকারদের রচনার সম্ভার বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। তার সঙ্গে নবাগতদের দ্বারা বাংলা গানের চর্চা চলছে এভাবেই আজ পর্যন্ত।
এই বাংলা গানের পটভূমিকায় চল্লিশ দশকে এক উল্লেখযোগ্য সুরকার–গীতিকারের আবির্ভাব হয় বাংলা রাগাশ্রয়ী গানের জগতে নক্ষত্রসম। তাঁর নাম হল আমাদের বহু পরিচিত যুগজয়ী প্রণম্য শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। তাঁর কালজয়ী বাংলা রাগাশ্রয়ী বা রাগপ্রধান গানের সম্ভার সমগ্র বাংলা গানের ক্ষেত্রকে এক নতুন দিক দেখায়। তাঁর সৃষ্ট রাগশ্রয়ী গানগুলি ছিল কখনও ঠুংরি–আঙ্গিক, কখনও খেয়াল–আঙ্গিক। তিনি উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় কিংবা উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধারে উচ্চাকাব্যগুণসম্পন্ন কথা–সুর–ভাবের এক সুসংগত বোধপুরিপুষ্ট ধ্রুপদীভাব–পরিপূর্ণ সুমিষ্ট বাংলা গান সৃষ্টি করেছেন বহুল পরিমাণে। বাংলা গানের জগতে ছিল জ্ঞানপ্রকাশের এক স্বাতন্ত্রতাপূর্ণ নবসৃষ্টি, যা শ্রোতাদের ‘উচ্চ মানের গানের বনেদিয়ানা’ শেখায়। খুব লঘু চালের সুরে লঘু কথার বাংলা গান জ্ঞানপ্রকাশের সৃষ্টিতে লক্ষ্য করা যায়না। এক কথায় বলা যায় যে, তাঁর বাংলা রাগাশ্রয়ী গানের সৃষ্টি ছিল এক উচ্চমার্গের অথচ চিত্তহরণকারী এক সঙ্গীতের নিদর্শন। রাগপ্রধান বাংলাগানে আরও অন্যান্য শিল্পী যেমন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, শচীনদেব বর্মণ, তারাপদ চক্রবর্তী, চিন্ময় লাহিড়ী এবং পরবর্তীকালে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপালি নাগ, অজয় চক্রবর্তী, মানস চক্রবর্তী, অরুণ ভাদুড়ী, তনিমা ঠাকুর, শ্রিপ্রা বসু প্রমুখ শিল্পীদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। তৎকালীন আকাশবাণীর সঙ্গীত উপদেষ্টা শ্রী সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীকৃত নামকরণ ‘রাগপ্রধান গান’ বা ‘রাগাশ্রয়ী বাংলা গান’ – এই বিভাগে জ্ঞানবাবুর নিজ কথা ও সুরে সৃষ্ট বাংলা গান, অন্য গীতিকারের কথায় সুরপ্রদান – এই বিষয়গুলি এই অধ্যায়ে পর্যালোচিত হবে। জ্ঞানবাবু তাঁর এই রাগাশ্রয়ী গানে মানবিক নানা অনুভূতি, ঈশ্বর স্মরণ, ঈশ্বরের ভজন–সাধন, ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ, রাধাকৃষ্ণের প্রেম, হোলী অঙ্গ, খেয়াল, ঠুংরি–দাদরা অঙ্গ, প্রেমিকের প্রতি দিশেহারা মনের কাতরতা – দুঃখের প্রকাশ, প্রকৃতির রূপ–শোভা, কখনও প্রেমে মিলনের মাধুর্যতা, কখনও জীবনের যাত্রায় পুরাতন–নতুনের সম্পর্কের দর্শন, প্রকৃতির নানা জীবন্ত সুন্দর উপাদানের সঙ্গে মানব সম্পর্কের প্রেমের দ্ব্যর্থক কথা, প্রেমের নানাদিক যেমন – ছলনা, অভিমান, প্রেমে কাতরতা, মাধুরতা, পূর্বরাগ, আকুলতা, আত্মসমর্পণ, রাধার প্রেমের নানা অনুভূতি, শিবশঙ্কর বর্ণনা, ‘মা’ – অর্থাৎ বিশ্ববন্দিত ‘মা’ এর প্রতি প্রেম, ভালবাসা, নির্ভরতা, সখীপ্রেম, প্রেমিক–বন্ধুর সুদূর থেকে আগমনের প্রতীক্ষা, প্রিয়র কাছে প্রেমভিক্ষা, প্রকৃতির নানা ঋতুসংক্রান্ত বর্ণনা এবং সর্বোপরি সবরকম দুঃখ–সুখ–এর অনুভূতি গানের দ্বারা মুক্তির পথ – এইসমস্ত বিষয় সংক্রান্ত গীতিকবিতা রচনা করেছেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ এবং এই গীতিকবিতাগুলি উচ্চ মার্গের সুর সংযোজন করে জ্ঞানবাবু সৃষ্টি করেছেন তাঁর নবনির্মিত নবধারার রাগাশ্রয়ী বাংলা গান।
এই রাগপ্রধান বাংলাগান শাস্ত্রীয় / উপশাস্ত্রীয় ঢঙে গেয়েছেন প্রতিথযশা শিল্পীগণেরা। কিছুক্ষেত্রে আবার কোনো কারুকার্য না করেও সুর ও ভাবের সংমিশ্রণে গেয়েছেন নানান গুণী শিল্পীরা। জ্ঞানবাবুর সৃষ্ট এই বাংলা গানের কণ্ঠে সার্থক রূপায়ণ করেছেন যে শিল্পীরা তাঁরা হলেন – শ্রীমতী বাণী কোনার, শ্রীমতী সাবিত্রী ঘোষ, শ্রীমতী ললিতা ঘোষ, শ্রী দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, পণ্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী বেগম আখতার, পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী, শ্রীমতী শিপ্রা বসু, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, শ্রীমতী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্রীমতী অনুসূয়া মুখোপাধ্যায়, শ্রীমতী ইন্দ্রাণী সেন প্রমুখ।
পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ রচিত কথা ও সুরে সৃষ্ট বাংলা গান
বাংলা রাগপ্রধান
(পণ্ডিত মল্লার ঘোষের সাক্ষাৎকার কর্তৃক সংগৃহীত)
(১) তোমায় আমি পেয়েছি যতবার
ততবার তুমি হারায়ে গিয়াছো,
খুঁজিয়াছি চারিধার।।
যখনি ভেবেছি তুমি আছো কাছে
ভুবনে আমার সকলি তো আছে
তখনই সে মোর ভুল ভাঙিয়াছে
জীবনে নেমেছে ঘন আঁধার।।
তোমায় আমি চেয়েছি যতবার
চরণের ধ্বনি শুনিয়া শুনিয়া খুলেছি হৃদয় দ্বার
তখনি চকিতে কি মায়ার ছলে
লুকায়েছো তুমি কোন্ সে বিরলে
বল কত আর ভাসি আঁখিজলে
একাকী বহি এ জীবনভার।।
(পণ্ডিত মল্লার ঘোষের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত)
(২) রাগ – আভোগী তাল – ঝাঁপতাল
চরণে শরণ মাগি, মাগো অভয় দাও
তনয়ের মুখ চাও
তাপিত দুর্গতের থাকো না শিয়রে জাগি।
যে দিকে আঁখি ফিরাই
কোথা মোর কেহ নাই
তুমি না দিলে মা ঠাঁই
কি হবে পরাণ রাখি।।
পণ্ডিত মল্লার ঘোষের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত
রাগ – খাম্বাজ তাল – তিনতাল
(৩) কেন রাঙালে মোরে রঙে শ্যাম বল না
ছিনু আনমনা আমি একা ব্রজললনা
এবার আমার পালা রঙে লাল হবে কালা।
মানিব না কোনো বাধা, কোনো ছলনা।।
(মল্লার বাবুর মতে এই গানটিকে বাংলা ঠুংরি বলা হয়)
(৪) (পণ্ডিত মল্লার ঘোষের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত)
অলস বেলায় একা নিরালায়
কতো যে ছবি ভাসে আর মিলায়
মনের কোণে সঙ্গোপনে
অশ্রু হাসির মিলন মেলায়।
কত না পাখি উঠেছে ডাকি
শাখায় শাখায় প্রাণেরই আঙিনায়
তাদের কলতান মমতা ভরা গান
আজও কানে বাজে আকুল বেদনায়।
নিকুঞ্জ দুয়ার খুলেছি কতোবার
নতুন অতিথির আসার আশায়।
দূরের কতজন হল যে আপন
যে ছিল কাছে পাসরিলো হায়
যে দিন চলে যায় তার ছোঁওয়া রেখে যায়
শত স্মৃতির ভিড়ে কিছুই না হারায়।
বাংলা রাগাশ্রয়ী গান
কথা ও সুর
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
(১) (আমি) নূতনের অভিলাষী
যা কিছু নবীন নবোল রঙিন
তারই আমি পিয়াসী।
পুরাতন তাও জানি, ফিরে ফিরে আসে
নূতনের সাথে মিশে করে কানাকানি
নূতনের বেশে পুরাতন এসে
দিলে মোরে হাতছানি
তাহারেই আমি মানি।।
১৯৭২ – বাণী রায় (কোনার)
(২) এ কেমন রঙ্গ তোমার
কাছে এসে দূরে থাকা
বিরাগে মুখ ফিরায়ে অনুরাগে পিছু ডাকা।
আমি ফুল মাটির পরে
তুমি চাঁদ নীলাম্বরে, কখনো ঝরাও আলো
কখনও মেঘে ঢাকা।
কুঁড়ি এক ছিনু একেলা
এল হায় ফোটার বেলা
প্রজাপতি জাগিয়ে স্বপন, মেলিনু রঙিন পাখা
মিলনের মধুমাসে ভুলিনু কি যে আসে
জানি আজ খুশি তোমার
কথা রাখা, না রাখা।।
(৩) শ্রবণ মেঘমায়া ছাইল গগনে
পিয়া পরবাসে নিশি যাপি কেমনে।
জলদ নিকষে বিজুলী হেমলেখা
মুছিয়া গিয়াছে আঁধারে পথরেখা
কাটিবে কি রজনী, সজনী মোর একা
বরষা নামিবে মোর এ দুটি নয়নে।।
(৪) ভালো না বাসিবে যদি, ভালোবাসিতে দিও
ওগো দূরে থাকো যদি তবু কাছে আসিতে দিও।
সেদিনের সুখছবি আজ স্মরণে
যদি গো অশ্রু আনে মোর নয়নে
ওগো গোপনে সে আঁখিজল নিরবে মুছিয়া
মোরে হাসিতে দিও।।
(৫) কেন যে লুকাতে চাই
মোর যত মলিনতা আর যত বিফলতা
তোমার অজনা কিছু নাই।
সব কাজে আপনার ভাবি, আছে অধিকার
নিজেরেই মান দিতে চাই
আঘাতের অঙ্গারে নিয়তই বারে বারে
অভিমান পুড়ে হয় ছাই।।
(৬) আমি নিজেরে শুধাই বারে বারে
সাথী হারা লগনের সুর নিয়ে কত আর
ভোলাব বল আপনারে।
বসন্ত এ জীবনে আসেনি
শরতের চাঁদ সেথা হাসেনি
শুধু নয়নের বরষায়, দিন মোর ভেসে যায়
রাত কাটে দীপহীন আঁধারে।।
(৭) এলে কি গো মোর যাবার বেলায় পিছনে ডেকে
এলে কি, সাড়া দিলে কি শেষে,
কুহেলিকার ওপার থেকে।
যবে জীবনতটে প্রেমের হাটে বসিল মেলা
আমি পসরা লয়ে রইনু বসে, করিলে হেলা
ভেবে ফিরিছ খুঁজি লইয়া পুঁজি, শিখিলে ঠেকে।
যবে ফাগুন এল নিকুঞ্জে পিক্ উঠিল গাহি
তুমি মরিচিক পিছে, ছুটিলে মিছে ফিরিলে না, হে
আমি বিজন তীরে নিরবে ধীরে, নামিল নিশা
মোর ঘরের পানে যাবার টানে বাড়িল তৃষা
বল, এই তিমিরে আসিলে ফিরে
কি আলো দেখে।।
(৮) ছলনা জানি তবু, পারিনা ফিরে যেতে
জানি এ মালা দেবে শুধু জ্বালা
তবু বুকে ধরে রাখি।
কত যে রাতি কেটেছে তারা গুণে গুণে
ভাসায়ে দিয়েছি মন স্বপন–তরণীতে।।
(৯) কোয়েলিয়া গান থামা এবার
তোর ঐ কুহুতান ভালো লাগে না আর।
আন বঁধু যার মন টানে,
ফিরে যে না চায় ঘরপানে।
তোর ঐ কুহু কুহু তানে
তারে মনে পড়ে বারে বার।
প্রিয় বুঝি তোর ওরে পাখী,
মোর মত তোরে দিল ফাঁকি ?
তাই কি রে তুই ডাকি ডাকি
প্রাণ কাঁদাস দুখিনী রাধার ?
(১০) পিয়া ভোলো অভিমান
মধুরাতি বয়ে যায়।
কেন আঁখি ছলছল, ওগো কথা ছিল বলো
দূরে থাকা কি গো সাজে
মায়া ভরা জোছনায়।।
(১১) কণ্ঠ – (অজয় চক্রবর্তী, অরুণাঞ্জলী), (বাণী কোনার)
রাগ – ভাটিয়ার
আজি দুখনিশি ভোর, মোছ আঁখিলোর
হাসে আঁধার মলিনতা সরায়ে, নব আশা অরুণ আলোর।
লাগে নবহিল্লোল আজি পবনে, জাগে কলকল্লোল সাড়া গগনে
আজি দূরে বিদূরিত যুগে যুগে সঞ্চিত তমশারাশি ঘনঘোর।
আজি নন্দন ঝংকৃত গানে, শুভ মঙ্গল মাল্যবিতানে
এসো হাসো সুভাষিত সুগন্ধে পুলকিত
বিবস আনন্দ বিভোর।।
(১২) (আমি) সুরে সুরে ওগো তোমায় ছুঁয়ে যাই
নাই বা পেলাম দরশ তোমার
গানে গানে যদি তোমায় পাই।
তোমায় চেয়ে সারাবেলা
কাটল নিয়ে সুরের খেলা
এবার আমার গানের ভেলা
তোমার চরণকুলে ভিড়াই।
যুগে যুগে প্লাবন আনে যে সুর চরাচরে
জানি সে যে তোমারি প্রেম
উপর হতে ঝরে
যে মন্ত্রে আজ তোমায় পুঁজি
ছন্দে গানে তোমার খুঁজি
তোমার দেওয়া সে দান বুঝি
সেই ভরসায় তোমায় চাই।।
(১৩) ফিরে কেন এলেনা
মধু এ লগন বয়ে যে গেল
মধুর পরশ দিয়ে গেলে না।
মৃদু মলয়ে হিল্লোল প্রাণে শিহরণ জাগায়
চোখে রঙ্গিন আশা, মায়া কাজল লাগায়ে
যা স্বপন দেখি, তা দেখা মেলে না।
(১৪) কূল ছেড়ে এসে মাঝ দরিয়ায়
পিছনের পানে চাই।
ফেলে আসা তীরে কী মায়া যে টানে
মন বলে ফিরে যাই।
কত হাসি আর কত না রোদন
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা কত উপবন
কত সাধনার কামনার ধন
পড়ে রয় সেই ঠাঁই।
এ পারের ছবি ম্লান হয়ে এলো
ওপার কুহেলী ছাওয়া
আশা নিরাশা ঢেউ দিয়ে যায়
তারি মাঝে তারি বাওয়া
অজানা বাঁশির ভেসে আসে সুর
মন কেড়ে নেয় এতো সুমধুর
যেন ডেকে বলে আর নহে দূর
হে যাত্রী ভয় নাই।।
(১৫) হায়, মিছে লেখা এই গান,
মিছে মনের জানালা খোলা
যে পথিক গেছে চলে, জানি হবে না সে পথ ভোলা।
তবু এ গানের পাখি, মেলি স্বপ্নরঙিন পাখা
হলো উধাও অচীনপথে,
নিয়ে গানখানি সুধামাখা,
কোন্ সে যুগের পারে,
কবে কোন্ সুদূরের দেশে
পাখি মোর গাবে গান, শুনে চিনিবে কি মৃদু হেসে
স্মরণের দোলা লেগে যদি পিছনে পড়ে টান,
যদি হয় অতীতের জয়,
তবে সার্থক অভিযান।।
(১৬) তুমি ব্যাথা দিলে ব্যাথা নাহি পাই
দুখ পেলে আমি দুখ পাই গো
যদি মন নাহি চায়, দাও গো বিদায়
আনমনে চলে যাই গো।
যদি বলো মোর ভালবাসা ছল
প্রেম নয়, শুধু মোহ সে চপল
ভুল বুঝে মিছে ফেলো আঁখিজল
(আমি) কেমনে বলো বুঝাই গো।
কত সে যুগের বেদনার ভারে
আমি তো ছিলাম লুটায়ে
তুমি আসিলে মধুর হাসিলে
(মোরে) করুণায় নিলে উঠায়ে।
কতটুকু তার পেলে প্রতিদান
তাই সুরী মিছে কর অভিমান
আমার দেওয়ার নাই অবসান
(আমি) চিরঋণ দিতে চাই গো।।
(১৭) শঙ্কর করে ডমরু বাজে
দ্রিমি দ্রিমি দ্রিমি দ্রিমি ডমরু বাজে।
গলে বিরাজে গন্ধপুস্পরাজি
জটাজুট তার শিরে বিরাজে।
নাম নিলে যার দুঃখ থাকে না আর
ভষ্ম মুখে সেই পিনাকী সাজে।।
(১৮) যে আকাশে ঝরে বাদল
সে আকাশে চাঁদ উঠবে কি
যে ঘন তিমির ছাইল গগন,
তারি মাঝে তারা ফুটবে কি,
যে কুসুম চুমিল ভূতল, তারি পাশে অলি জুটবে কী।
যে তটিনীর শুকালো জল, তাই কুল ভরে উঠবে কি
যেথা পিপাসায় মরে ধূ ধূ মরু, তারি বুকে এসে লুটবে কি
যে নিরাশা রচিল আগল,
সে আগল কভু টুটবে কি।।
(১৯) চরণে বাজে মঞ্জির রিনিঝিনি
যমুনায় চলে নাগরী, লয়ে গাগরী
বিনোদিনী সুহাসিনী।
চমকী থমকি চলে চঞ্চল চাহনি
অঙ্গে বিভঙ্গে তরঙ্গীত লাবণী
কার সনে মিলনে চলে অভিসারিণী।।
(২০) মধুলগন বয়ে যায়, অকারণে অবহেলায়
কেন সে আড়ালে রয়, তৃষিত হিয়া যারে চায়।
স্বপন সমাধি ’পরে কুসুম কোরক ঝরে
তারি স্মৃতি বুকে ধরে, যায় দিন নিশি ফুরায়।
একেলা কাননে কাঁদি সমুখে বিরহ নদী
বয়ে যায় নিরবধি, পিয়া মিলন তিয়াসায়।।
(২১) মিছে এ ধরণীর, মিছে এ আশ
রোদন ভরা হেথা যত মধুমাস।
জীবনে যা কিছু ভাঙা ও গড়া
নিমেষে ফোটা আর নিমেষে ঝরা
সে শুধু ক্ষণিকের স্বপনে ভরা
মেটেনা মেটেনা কোন পিয়াস।
ভালবেসে সুখ চাওয়া মিছে,
সুখ চেয়ে দুখ পাওয়া মিছে
মনে রাখা, ভুলে যাওয়া মিছে
বালুতে মিছে বাঁধার প্রয়াস।।
(২২) হিন্দী হোলী ঠুংরি : (বাংলা ভার্সন) বাংলা ঠুংরি – ‘সারি সারি ডার গয়ে’
কেন ভিজালে রঙে মোরে শ্যাম বলোনা
আমি আনমনে ছিনু চেয়ে গোপ–ললনা।
এবার আমার পালা,
রঙে লাল হবে কালা
ওগো দাঁড়াও, কোথা লুকাও করি ছলনা।।
(২৩) অন্তরদ্বার খোলো গো খোলো
সারানিশি জাগি আছ যার লাগি
তারই আসার সময় যে হলো।
প্রিয় যে এনেছে আজি প্রেম উপহার
হাসি মুখে নিয়ে, দাও প্রতিদান তার।
অতীত দিনের স্মৃতি ভোলো গো ভোলো।।
(২৪) আসি বলে কেন এল না
সখী তোরা বল
শ্যামের পিরীতি তবে শুধু কি গো ছলনা
তোরা নিঠুর বলিস তারে
নিঠুর সে নয় গো
ফিরে সে আসবে তারি হৃদিমাময় গো
আমার শ্যামের ভবে
নাই কোন তুলনা।।
(২৫) যা যারে ভ্রমরা
এ কুলের মধু তোর নয়
যে পিয়ার লাগি এ আমিও লুকায়ে রাখি
তারি তরে মোর সঞ্চয়
খুঁজে দেখ আর কোন ফুল যদি সাড়া দেয়
যদি দিতে চায় পরিচয়।।
(২৬) আজ খেলিছে হোরী ব্রজনরনারী
হোলী শুধু তো নয় সাথে পিচকারী।
ফাগুয়ায় রাঙা হল
রঙে রসে আবেশে দেয় সব তাড়ি
আঙিনায় চারিধার রঙে হল একাকার
গোপিনী রমণী যত হেসে দেয়
আবিরে গুলালে পবন গগন ছায়ে
শ্রী রাধার সনে হরি খেলে গিরিধারী।।
(২৭) মা গো তোমার ডাকে দেব সাড়া
তাই তো আমি জাগি
মা গো জানি তুমি তন্দ্রাহারা
জাগো আমার লাগি।
চেতনা মোর ঝিমিয়ে আসে ঘুমে
তুমি অভয় দেবে এসে নয়ন চুমে
মা গো ক্লান্ত আমি তোমার কোলে
শান্ত শয়ন মাগে।
চোখ মেলিলাম তোমার বক্ষনীড়ে
আমার জগত জেগে উঠল তোমায় ঘিরে
আমি হেসে কেঁদে কাটিয়ে দিলাম বেলা
আমার সাঙ্গ হয়ে গেল ধূলাখেলা
এখন মায়ের মুখের ঘুমপাড়ানীর
আমিও অনুরাগী।।
(২৮) রাগ – দেশী টোড়ী, কণ্ঠ – অজয় চক্রবর্তী (অ্যালবাম অরুণাঞ্জলী)
স্বপনে ভাঙ্গিল ঘুমঘোর
রজনী শেষে হেরিণু কি আবেশে
সখী যেন হেসেহেসে দাঁড়াল শিয়রে এসে
সে মনচোর।
হারানো সে দিনগুলি
কেমনে বল ভুলি
যতনে রেখেছি তুলি হিয়ামাঝে মোর।।
(২৯) ভুলেছে যে আমায়
কেমনে ভুলি তারে
সবাই লেখা মনের পাতায়।
কত ফাল্গুন সন্ধ্যায়, ছলছল কত বরষায়
কানে কানে বলা শপথের কথা
মনে পড়ে বেদনায়।
সে কবির সেই বাণী
সে সুর সে গানখানি
হৃদয়ের বীনে বাঁধা, সে কি কভু ভোলা যায়
বাতাসের কানাকানিতে মন যেন চায় জানিতে
দূরের বন্ধু আসিবে কি ফিরে মোর এই আঙিনায়।।
‘যদি কণ্ঠ দাও, আমি তোমার গাহি গান’ – গানটি ইংরেজী ভাষায় রচনা করছেন বিশিষ্ট গীতিকার সুরকার পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। পণ্ডিত মল্লার ঘোষের সাক্ষাৎকার থেকে তা সংগৃহীত করা হয়েছে।
(৩০) (পণ্ডিত মল্লার ঘোষের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত)
যদি কণ্ঠ দাও, আমি তোমার গাহি গান
যদি দৃষ্টি দাও, আমি নয়ন ভরি করি অমৃতরূপ সুধাপান।
যদি কর্ণ দাও, আমি অনাহত নাদ শুনু
আর তারি সুরে সুরে প্রেমেরই জালখানি বুনি
যেন তোমারি করুণায়, আমারি রসনায়
উঠলে নাম সুরধুনি
যেন তাহারি ধারাজলে তপ্ত ধরাতলে
তাপিতজনে করে স্নান।।
(৩১) ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে
কুঞ্জে এখনো কুহু কূজনে মাতে।
নাই যদি দাও হাসি, তবু যেন বাজে বাঁশি।
সুরেরই আঘাত দিও এ মধুরাতে।
অবহেলা নয় প্রিয়, চাহ যদি ব্যাথ্যা দিও
অশ্রু মাধুরী আন এ আঁখিপাতে।।
(৩২) কারে বা শোনাই বল
কেই বা শোনে মোরে হায়
আমার মনের কথা কেউ জানে না।
সুখে কি দুখে আছি, দূরে না কাছাকাছি
মনের খবর মোর কেউ রাখে না হায়।
আমারে সবাই চায়, সেও যেন মোর দায়
আমার চাওয়ার দাবী কেউ মানে না
তাই গানের ভেলা ভাসিয়ে চলি একেলা
কোনো কূল যেন তারে কাছে টানে না হায়।।
(৩৩) এলোরে ভোরের পাখী ডাকি ডাকি
কূজনে কূজনে মোদের দুজনের
সুরে সুরে মেলুক আঁখি।
যে গান শোনালে পাখী
জীবনের দিনগুলি রাঙাবে নাকি
জাগরণে জেগে থাক
ঘুমের পালা থাক্ না বাকি।।
(৩৪) নিশীথ যামিনী ঘন অন্ধকারে
কানে কানে পুছিল তুমি চাও কাহারে।
ভাবিয়া কহিনু আমি কারেও না চাই
যদি শুধু তারে পাই যে
চাওয়া পাওয়া ভুলে তরী বাঁধে মোর কূলে
চিনে নেয় আমারে।।
(৩৫) (পণ্ডিত মল্লার ঘোষের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত)
সমুদ্র আর পাহাড়ের মতো উদার গম্ভীর
আমি চাই আমার গানের কঠোর তরল তীর।
প্রেম প্রীতি মাধুর্য বিশ্বাস
আনন্দের স্নিগ্ধ নিঃশ্বাস
ছেয়ে যাক জীবনের শেষ অবধি
শান্ত সৌন্দর্য নির্দ্বিধা ধীর।।
(৩৬) ঝর ঝর ধারে বারি ঝরে
শ্রাবণরই নিশি কাজল মায়া ঘন যামিনী
একা কামিনী জাগে।
চমকি চমকি বিজলী ধায় আকাশে
বুঝি কার চরণের ধ্বনি শুনি বাতাসে।।
(৩৭) দাদরা অঙ্গ (সাল ১৯৮৩, HMV থেকে প্রকাশিত)
হোলি খেলিছে শ্যাম কুঞ্জ কাননে
পথ নাহি জানে রাই, যাবে সেথা কেমনে।
আবীরের রাঙা রাগে ছবি জাগে স্মরণে
বধূ সলে হোলী খেলা এই মধু লগনে।।
গায়ক জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কণ্ঠে তাঁর সৃষ্ট একটি বাংলা গানের লাইন হল – ‘বিফল যামিনী বয়ে যায়, ফিরলো না হায়’। এই গানের মধ্য দিয়ে গায়ক জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে অনুভব করা যায় এবং তাঁর শিল্পীপ্রতিভার খোঁজ মেলে।
সুগম সঙ্গীত রচনায় গানের কথা অন্যান্য কবি ও গীতিকার দিয়ে গান রচনা করিয়ে জ্ঞানবাবু নিজে সুর দিয়েছেন। আবার কখনো অন্য গীতিকার ও সুরকারের গান ও সম্প্রচারিত হয়েছে রেডিও মারফৎ। জ্ঞানবাবুকৃত সুরের বাঁধনে সৃষ্ট সুগমসঙ্গীত জ্ঞানবাবু সমসাময়িক বহু গুণী শিল্পী রেডিওতে গেয়েছেন। এছাড়া আধুনিক বাংলা গানের কিছু গান, যার কয়েকটি জ্ঞানবাবুকৃত সুর ও কথা আবার কোনোটা শুধু সুরপ্রদান – সেইসব গানও বহু নামী শিল্পীরা গেয়েছেন এবং যা রেডিও মারফৎ সম্প্রচারও হয়েছে। শ্রীমতী বাণী কোনার, যিনি জ্ঞানবাবুর সম্পর্কে ভাগ্নি ছিলেন, তিনি জ্ঞানবাবুর কথা ও সুরে বহু গান রেকর্ড করেছেন। আবার পরে শ্রীমতী বেগম আখতার মহাশয়াও জ্ঞানকৃত কথা ও সুরে নিবদ্ধ বহু বাংলা আধুনিক রাগাশ্রিত গান গেয়েছেন এবং সেতারে রেকর্ডও করেছিলেন। শ্রীমতী ললিতা ঘোষ, যিনি জ্ঞানবাবুর সুযোগ্যা শিষ্যা ও সহধর্মিণী। তাঁর গানও রেকর্ড করা হয়েছে বেতারে। জ্ঞানবাবু উল্লেখ করেছেন যে, ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার’ – গানটি বেগম আখতার সাহেবা বেতারে রেকর্ড করেন, যার কথা ও সুর করেছিলেন শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয়। জ্ঞানবাবু তাঁর স্মৃতিচারণায় জানান যে, ‘কণিকা দেবীকে দিয়েও হিন্দী গান করিয়েছিলাম’।
২০১৫ সালের ৪ঠা এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয় বিদগ্ধ গুণী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ার রবীন্দ্রসঙ্গীত গানের গায়কী, রাবীন্দ্রিক শিল্পসত্ত্বা এবং জ্ঞানবাবুর কাছে সাংগীতিক আখর গ্রহণের সূত্রে ঘনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে জ্ঞানবাবু লেখেন যে, “যখন আমার কাছে আসতেন, তখন আমারও যাতায়াত ছিল শান্তিনিকেতনে। তাঁর মধ্যে সঙ্গীতের সমস্ত গুণ দেখেছি। শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। পাঁচের দশকের শেষ দিকে কণিকা ভজন, গীত ও বিভিন্ন গানের নেশায় মাঝে মাঝে আমার কাছে পরামর্শ নেবার জন্য আসতেন। দুই এক বছর তাঁকে আমি অন্য তালিমও দিয়েছি। গানের গায়কী অন্য সব রাবীন্দ্রিক শিল্পীদের চেয়ে আলাদা। রবীন্দ্রনাথের গানকে দেশ ও বিদেশের মাটিতে জনপ্রিয় করার মূলে যে কজন শিল্পীর কথা মনে পড়ে তাঁদের মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য নাম”।
বাংলাগানের সঙ্গে শৈশবকাল থেকেই জ্ঞানবাবুর পরিচিতি। রবীন্দ্রসঙ্গীত যেখানে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে ভাব, ভাষা, শব্দচয়ন – যা একজন সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টির জন্মগত প্রতিভার গোড়াপত্তন তৈরি করতে। পরবর্তীকালে এরই প্রতিফলন ঘটেছে জ্ঞানবাবুর নিজস্ব ধারার সৃষ্টিশীল বাংলা গান রচনার ক্ষেত্রে। নজরুল গীতির সঙ্গেও জ্ঞানবাবুর ঘনিষ্ঠ আত্মিক সম্পর্ক ছিল জীবনকালের বিভিন্ন পর্যায়ের সাংগীতিক চর্চায় ও মানসিকভাবে। এম.এ পঠনপাঠনরত সময়ে জ্ঞানবাবু গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলগীতি রেকর্ড করার সুযোগ আসার গল্প করেছেন জ্ঞানবাবু নিজেই তাঁর স্মৃতিচারণায়। কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে সেই রেকর্ড আর করা হয়নি। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের গানের সঙ্গে নানা রাগের বাঁধুনির, স্বরের বিন্যাসের একটা চর্চা হয়েছে জ্ঞানবাবুর এবং এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে, অগ্রগণ্য একত্রে দুই সুরকার ও গীতিকার – একাধারে যাঁরা, পরবর্তী প্রজন্ম সেই সৃষ্টির শোনা, শেখা, চর্চা এবং সর্বোপরি নিজস্ব সৃষ্টিশীল প্রতিভার দ্বারা কথা, শব্দচয়ন অথবা রাগভিত্তিক গানে স্বরের বিন্যাস, সুরের মাধ্যমে কথার ভাব বজায় রেখে গানের রাগভিত্তিক মাধুর্যতাকে সঙ্গে নিয়ে শিল্পসত্ত্বাকে ফুটিয়ে তোলার বিষয়গুলিতে পূর্ববর্তী সৃষ্টিশীলতার প্রভাব সাহায্য করেছে জ্ঞানবাবুর ক্ষেত্রে, যার উদাহরণ হিসেবে অনুমান করা যায় জ্ঞানবাবুর বর্ণিত স্মৃতিচারণায়। জীবনের নানা কালে নানা গানের চর্চার গল্পের মধ্যে দিয়ে। গানে সুর প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দে মহাশয়কে সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে স্মরণ করেছেন। আবার তুলসী লাহিড়ী মহাশয়ের রাগপ্রধান অঙ্গের বাংলা গান সৃষ্টি, অর্থাৎ কথা ও সুর দুই–এর সৃষ্টির চর্চাও জ্ঞানবাবু তাঁর পূর্ববর্তী সুরকার ও গীতিকার হিসেবে।
পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয়ের বাংলা গানের নানা চর্চার মধ্যে শ্রবণের চর্চার ক্ষেত্রে তিনি কয়েকজন গুণী শিল্পীর স্মৃতিচারণ করেছেন, যাঁদের বাংলা গানের গায়কীর বিশ্লেষণও করেছেন জ্ঞানবাবু। মহারাষ্ট্রের গুণীশিল্পী পণ্ডিত বিশ্বনাথ রাও মহাশয়ের গ্রামোফোন রেকর্ডে শ্যামাসঙ্গীত গায়নের কথা স্মরণ করেছেন শ্রী ঘোষ মহাশয়।
মহারাষ্ট্রের আর এক বিদগ্ধ মহিলা কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী, যাঁর বাংলা গানের গায়কীর প্রভূত প্রশংসাসূচক বিশ্লেষণ করেন জ্ঞানবাবু। তাঁর নাম শ্রীমতী শান্তা আপ্তে। আদি রেকর্ডিং ১৯৪১ সালে শ্রী কমল দাশগুপ্ত মশাহয়ের পরিচালনায় গ্রামোফোন কোম্পানিকৃত রেকর্ডে শিল্পীর নজরুল সঙ্গীতের অন্তর্গত একটি গানের স্মৃতিচারণ করেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয়। গানটি হল – “মোর না মিটিতে আশা ভাঙ্গিল খেলা” , এই গানের গায়কীর বিশ্লেষণে জ্ঞানবাবু বলেন যে, “আমার আজও মনে হয় কণ্ঠের গুণে, ভঙ্গিমার চালে এবং সুরের পরিশীলিত রাগাশ্রয়ী ভঙ্গিমার বিন্যাসে এমন উন্নত আঙ্গিকে বাংলা গান আমি বোধহয় তখন প্রথম শুনলাম শিল্পী শান্তা আপ্তে। পরে সঙ্গীত সম্মেলন ইত্যাদিতে হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীত রূপায়নে খুবই যশ ও সম্মান পেয়েছিলেন। হয়তো কিছু অংশে তার কারণ ছিল চিত্রপটে অভিনয় এবং সঙ্গীতে তাঁর জনপ্রিয়তা”।
হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্তর্গত গীতশৈলী, ধ্রুপদগানের কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত চুটে গোপাল মহাশয়ের বাংলা গানের উপস্থাপনার সুখ্যাতি করেছেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয় তাঁর লেখা গ্রন্থে।
আবার বিখ্যাত বাঙালী শিল্পী–গায়ক শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দে মহাশয়, যিনি অন্ধ গায়ক নামেই পরিচিত ছিলেন এবং যিনি শ্রী মান্না দে মহাশয়ের সম্পর্কে কাকা হন। এই গুণী শিল্পীর বাংলা গানের উপস্থাপনা স্মরণ করেছেন জ্ঞানবাবু। শ্রী শিশির কুমার ভাদুড়ী মহাশয়ের মঞ্চাভিনয়ে পণ্ডিত কৃষ্ণচন্দ্র দে মহাশয়ের গাওয়া ‘জয় সীতাপতি’ এবং ‘অন্ধকারের অন্তরেতে’ ; গান দুটির সুখশ্রাব্য স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন জ্ঞানবাবু। শ্রী হেমেন্দ্র কুমার রায় মহাশয়ের সৃষ্ট কথায় সুরপ্রদান করেন শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দে মহাশয়। দুই সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টির একত্র প্রয়াসে সৃষ্টি হয়েছিল ‘জয় সীতাপতি’ গানটি। গানটির কথাটি ছিল
জয় সীতাপতি সুন্দর তনু প্রজারঞ্জনকারী।
রাঘব রামচন্দ্র জয়তু সত্যব্রতধারী।
ধরণীপুত চরণপরশে
প্রবাসীগণ মগন হরষে
আকাশ হইতে নিত্য বরষে, দেবতার কৃপাবারী।।
আবার শিশির ভাদুড়ী মহাশয়ের মঞ্চস্থ নাটকে সীতা উদ্দেশ্যে হাহাকারের অভিব্যাক্তি বর্ণনা করা হয়েছে ‘অন্ধকারের অন্তরেতে’ গানের দ্বারা। এই গানের রেকর্ডিং প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৬ সালে। রেকর্ড নং ছিল – পি ৭৪০৪। গানটি ছিল –
অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবাদল ঝরে
লক্ষ্মীহীন এ শূন্যপুরী, মন যে কেমন করে।
কোথায় আলো কোথায় আলো
আকাশ ভরা কালোয় কালো
ফিরবো না আর ফিরব না আর
মা হারানো প্রাণ কাঁদানো ঘরে
হায় সরযূ সজল সুরে শোকের গীতা গো
ডাকছে যেন করুণ তানে, কোথায় সীতা গো
কোথায় গীতা কোথায় গীতা, জ্বলছে বুকে স্মৃতির চিতা
কাজলারাতের বেদন বাঁশি বাজছে নীরব স্বরে।।
এই পুরাতনী বাংলা গানের শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দে মহাশয়ের উপস্থাপনার ব্যাখ্যা এবং এই গায়ক তথা সুরকারকে জ্ঞানবাবু অনুকরণ করতেন বলে তাঁর নিজস্ব স্বীকারোক্তিতে জানান যে – “হিন্দুস্থানী খেয়াল গানের প্রসঙ্গে আমার তিরিশ বছর আগে যতটুকু ধারণা হওয়া সম্ভব হয়েছিল, সেই কথা উল্লেখ করে এখন আমি অন্তত কয়েকজনের নাম স্মরণ করতে চাই প্রথম কারণ, তাঁদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণ, বাংলাদেশে হিন্দুস্থানী খেয়াল সঙ্গীতের ধারার প্রচলনের ব্যাপারে তাঁদের প্রত্যেকেরই কিছু বিশেষ অবদান ছিল। প্রথম আমি স্মরণ করব অন্ধ গায়ক শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দে–কে, যাঁর গান শুনতে এবং অনুকরণ করতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম স্কুল জীবনে, পরে বহু গ্রামোফোন রেকর্ডে এবং আরও পরে বেতারে নিয়মিত প্রচারের মাধ্যমে। আমার স্কুল জীবনের পর কোনও এক সময় আমাদের পাড়ার (ক্রীক–রো) কোনও বাড়ির কোনও ঘরে, একটা ক্লাবের মতো, মাত্র কয়েক জনকে নিয়ে ছোটখাটো কিছু আসর হত। আমার বয়স তখন দশ – এগারো হতে পারে। একদিন ময়দানে খেলাধূলা করে বাড়ি ফেরবার পথে উল্লিখিত সেই ঘরের সামনে একটি পুরুষ কণ্ঠের গানের আওয়াজ কানে আসায় আমি অন্তত কিছুক্ষণ স্তব্ধ, মুগ্ধ হয়ে সেই গান শুনি এবং পরে কিছু বন্ধুবান্ধবদের মুখে শুনি ‘ওরে বাবা, ওখানে তো গান করতে আসেন কানাকেষ্ট’। তখন থেকেই সঙ্গীতের কোনও স্বর কানে এলেই আমার মন আকৃষ্ট হত তবে তখনই হত যখন সেই স্বরে কিছু মাধুর্য বা কিছু সুখশ্রাব্যতার লক্ষণ থাকত। সেই সময়ের তিন চার বছর পরে ইডেন গার্ডেনে স্বনামধন্য শিশির কুমার ভাদুড়ীর মঞ্চাভিনয়ে কৃষ্ণচন্দ্র দে–র ‘জয় সীতাপতি’ এবং ‘অন্ধকারের অন্তরেতে’ গানগুলি শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, বীণা মাইক্রোফোনে উদাত্ত কণ্ঠের গান আমাকে বহুদিনের জন্য মুগ্ধ না করে পারেনি”। তার কিছুকাল পরেই ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে Indian Broadcasting Service–এর বেতার অনুষ্ঠানের কল্যাণে কৃষ্ণচন্দ্র দের নানারকম গানের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে। নানারকম বলছি এজন্য যে, তাঁরই গ্রামোফোন রেকর্ডের বা সেই ধরণের বাংলা গান এবং পরে কীর্তন, হিন্দুস্থানী, দাদরা, ঠুংরি থেকে আরম্ভ করে ধ্রুপদ, ধামার ও খেয়াল। ইতিমধ্যেই বা এর কিছু পরেই সবাক চিত্র আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। সেখানেও কৃষ্ণচন্দ্র দে–র হিন্দীভজন এবং অন্যান্য গান শোনবার সুবিধা হলে নিজের কণ্ঠে শোনা গানের অংশবিশেষ সশব্দে উৎসারিত করবার প্রবৃত্তি জন্মাতে আরম্ভ করেছে”।
বাংলার বিদগ্ধ কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামী মহাশয়ের গাওয়া বাংলা গানের মধ্যে দুটি গানের স্মৃতিচারণ করেছেন জ্ঞানবাবু। একটি গান হল – ‘উজল কাজল দুটি নয়ন তারা’। গানটির রেকর্ডিং ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয়। কথা ও সুর – দুইয়ের স্রষ্ঠা ছিলেন শ্রী তুলসী লাহিড়ী মহাশয়। গানটি মালগুঞ্জ রাগে নিবদ্ধ। গানটির কথাটি ছিল –
উজল কাজল দুটি নয়নতারা,
আকুল চঞ্চল কারে খুঁজি সারা।
আসিলে পাশে লাজে মুদিয়া হাসে
পিয়াসী সদা ফেরে কারি দরশ আসে
দখিনা বাতাসে কুসুম সুবাসে
কারে মনে পড়ে বহে নয়নধারা।।
আর একটি গান হল ‘আজি নিজুম রাতে’। এই গানটির কথা ও সুরের স্রষ্টা হলেন শ্রী তুলসী লাহিড়ী মহাশয়ের। দরবারী রাগ এবং ত্রিতালে নিবদ্ধ এই গানটির রেকর্ড ১৯৩৩ সালে হয়েছিল। গানটির কথাটি ছিল –
আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায়
সুরে বেদন বাজে গোপন হিয়ায়।
সুখস্মৃতি সাথে ওই সুর মায়ায়
কত দুঃখ মেশে যেন আলোতে ছায়ায়।
আজি নিশীথ রাতে জাগি তারার সাথে
তারি স্মৃতিটি নিয়ে নীরব ব্যাথায়।।
পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী মহাশয়ের বাংলা রাগাশ্রয়ী গানের উপস্থাপনার বিশ্লেষণে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয় বলেন যে, “খেয়াল গানের কিছু রেকর্ড জ্ঞানবাবু করেছিলেন এবং আসরেও গাইতেন। এই খেয়াল গানের গায়কীর অনেক গান তিনি যখন কাজী সাহেব অথবা তুলসী লাহিড়ীর রাগপ্রধান অঙ্গের গায়কী অবলম্বন করে গাইতেন সে গান যেন ওজস্বিতা–মাধুর্যে বেশি আকর্ষণীয় হত। পুরো রাগপ্রধান গানে যতটা নিখুঁত বাঙালীয়ানা থাকা আমার কাছে বাঞ্ছনীয় মনে হত সেটা না থেকে যেন একটা হিন্দুস্থানী আঙ্গিক ঘেঁষা গান তিনি গাইতে পছন্দ করতেন মনে হয়েছিল। বোধহয় হিন্দুস্থানী ঢঙের গান, যার মধ্যে একটু মর্যাদা ভাব থাকত, সেই গানই জ্ঞানবাবুর ভাল লাগত যার জন্য তিনি বেশ কিছুদিন পরে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের শার্গিদ হয়েছিলেন”। পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী মহাশয়ের বাংলা রাগাশ্রয়ী গানের বিশ্লেষনে জ্ঞানবাবু আরও একটু ব্যাখ্যা করেন যে, “জ্ঞান গোস্বামীর গানের মধ্যে যে আনন্দ রসের উদ্ভব হত তা প্রথম দিন থেকেই আমার মনে এসেছিল যদিও নিশ্চয় এ জ্ঞান এবং অনুভূতি পরে এসেছিল যে, তাঁর কণ্ঠস্বর এবং কণ্ঠ পরিচালনায় যতখানি সমৃদ্ধি ছিল তার বেশিরভাগটাই তাঁর নিজস্ব স্বভাবসিদ্ধ সৌন্দর্য যা প্রকৃত সৎশিক্ষাপ্রসূত নয়”।
পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, যিনি বাঙালীর কাছে আর একজন বাঙালী শিল্পী হিসেবে সারা দেশে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয়কণ্ঠসঙ্গীত, বাংলাগান, চলচ্চিত্রের গানে সুরপ্রদান এবং সর্বোপরি কণ্ঠে গানের সার্থক রূপায়ণে ছিলেন ঐতিহ্যবাহী। জ্ঞানবাবু তাঁর চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপ প্রসঙ্গে প্রশংসাসূচক ব্যাখ্যা করেছেন নানা ভাষায় নানা ভঙ্গীমায়। পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাংলা গানের গায়নের বিশ্লেষিত ব্যাখ্যা করেছেন নিজস্ব ভাষায়। যা হল – “ভীষ্মদেবের লয়, গীতক্রিয়ার পরিকল্পনা, মনোহারিত্ব এবং কঠিন কারুক্রিয়া ওঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিশেষ বিশেষজ্ঞদের চমৎকৃত করেছে কিন্তু রীতিপদ্ধতিসম্পন্ন প্রথাগত সঙ্গীতের সুষ্ঠু পরিবেশনে সর্বমান্য মানানুসারে হয়তো সমর্থ অবস্থায় এবং পরে অসুস্থ অবস্থায় কোনোদিনই পাইনি। এগুলি কিন্তু ওঁর শাস্ত্রীয় অথবা লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন সম্পর্কে প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলা গান পরিবেশনের সময় ভীষ্মদেবের সঙ্গীতময় সত্তার যে পরিচয় আমরা দীর্ঘদিন ধরে পেয়েছি তা এককথায় অপূর্ব ও অতুলনীয়। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় শুধু একজন সুদক্ষ গায়কই ছিলেন তা তো নয়, তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল নানা দিকে। হিন্দুস্থানী খেয়াল, ঠুংরি মধ্যেও তিনি অনেক স্থানে নিজের রুচি অনুসারে পরিবর্তন করে থাকবেন যার মধ্যে অনেক সময় পুরাতন সংস্কৃতির কিছু বিচ্যুতি হয়েছে। কিন্তু তিনি বাংলা গানের ক্ষেত্রে যে সৃষ্টির শক্তি এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির সামর্থ তিনি দেশকে উপহার দিয়েছেন তা বাঙালীর সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ ভীষ্মবাবুর বাংলা গানের নিবেদনের মধ্যে সেটা তাঁর কণ্ঠ ও মস্তিষ্ক মিশ্রিত বস্তু। Typically বাঙালীয়ানা হলেও উচ্চারণে কিন্তু খানিকটা অবাঙালী ভাব”। গানের মধ্যে বাঙালীয়ানা প্রসঙ্গে আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয় যে ব্যাখ্যার উল্লেখ করলেন পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের গানে, সমযুগের আর এক খ্যাতনামা কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী মহাশয়ের বাংলা গানের গায়নের বাংলা উচ্চারণের প্রসঙ্গক্রমে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয়। তিনি বলেছেন – “একই যুগের রাগাশ্রয়ী বাংলা গানের শিল্পী জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী সঙ্গীত শিল্পচাতুর্যে যথেষ্ট সুদক্ষ। সঙ্গীত সৃষ্টির মূলে যে আবেদন থাকলে শ্রোতার মনকে আকর্ষণ করা যায় যে আবেদনও থাকত যদি বলা যায়, তাহলেও তার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বাঙালীয়ানা থাকত না”।
সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত নানান সূত্রে বাংলার আর এক প্রখ্যাত শিল্পী পণ্ডিত ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের সঙ্গে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এক্ষেত্রে জ্ঞানবাবু ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের হারমোনিয়াম বাদন প্রসঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি তাঁর শিল্পী পরিচিতি প্রসঙ্গে জানান যে–“ধীরেন্দ্রচন্দ্র সারা কলকাতা তাঁকে জানল এবং চিনল একজন বিদগ্ধ হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের এবং সঙ্গে সঙ্গে কীর্তন ও কাজী সাহেবের বাংলা গানের শিল্পী হিসাবে”। জ্ঞানবাবু এই শিল্পী প্রসঙ্গে আরও বলেছেন যে – “সঙ্গীতের যা কিছু তিনি শিখে আয়ত্ত্ব করেছিলেন, একটি সুকোমল স্বরসম্পদ নিয়ে, সুশিক্ষিত রূপায়ণে তিনি একান্ত সাধকের মতো চর্চা করেছেন বরাবর। অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছেন নজরুল সঙ্গীতের কয়েকটি বিশেষ প্রকারের তালাশ্রিত গানে। সব জড়িয়ে বাংলাদেশের শিক্ষিত সঙ্গীত সমাজে তাঁর একটা স্থান রয়ে গেছে, যা স্মরণীয় থাকা উচিৎ।
বাংলা রাগাশ্রয়ী গানে চর্চার প্রসঙ্গে শ্রীমতী দিপালী নাগ মহাশয়ার বাংলা রাগাশ্রয়ী সাংগীতিক কার্যক্রমের ব্যাখ্যায় পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয়ের বিশেষণাত্মক উক্তি হল – “দিপালী নাগ যদিও তাঁর সঙ্গীত জীবনের প্রথম থেকেই ঘরানাদার তালিম এবং আগ্রাম বেনারস, দিল্লীর মতো জায়গায় জীবনের অনেকখানি সময় ব্যয় করেছেন কিন্তু বহুদিন থেকে বাঙালী অবাঙালী সামাজিক সংস্কৃতির মধ্যে মানুষ হওয়ার জন্য এবং পারিবারিক জীবনে উচ্চ সংস্কৃতির সঙ্গে দীর্ঘদিন কাটানোর ফলে হিন্দুস্থানী সনাতন সঙ্গীত, তাছাড়া রাগাশ্রয়ী বাংলা গানের শিক্ষা, সাধনা ও প্রচার করে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একরকম আদর্শের সৃষ্টি করেছেন – যার মধ্যে শুধু সঙ্গীতমাত্র তাঁর জীবনের আরাধ্য ছিলনা”।
বহু সঙ্গীতশিল্পী বহুবিধ সঙ্গীত উপস্থাপনার বিশ্লেষণে জ্ঞানবাবু যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা ভারতবর্ষের সভ্যতা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারণ ও বহণে এক অনন্য সম্পদসম। এছাড়াও জ্ঞানবাবুর আর একটি কীর্ত্তি হল রাগাশ্রয়ী বাংলা গান রচনা ও সুরারোপ, যার ব্যাপ্তি ভারতীয় সাংগীতিক পরিমণ্ডলে একটা স্বাতন্ত্রতাপূর্ণ জায়গা করে নিতে পেরেছিল। জ্ঞানবাবুর রচিত বাংলা গান বেগম আখতারজী, শ্রীমতী বাণী কোনার, শ্রীমতী ললিতা বসু, শ্রীমতী শিপ্রা বসু, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী প্রমুখ গুণী শিল্পীরা গেয়েছেন। এই শিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ জ্ঞানবাবুর সমসাময়িককালের প্রথিতযশা শিল্পী, আবার কেউ কেউ তাঁর ছাত্রছাত্রী ছিলেন। শ্রীমতী বেগম আখতারের বাংলাগান উপস্থাপনা প্রসঙ্গে জ্ঞানবাবুর স্মৃতিচারণায় বলেন যে – “কয়েকবার কলকাতার বেতারে অনুষ্ঠান শুনেছি, তখন আমি বেতারের লাইট মিউজিক ইউনিটের সঞ্চালক। তখন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে এবং আমি তাঁর কিছু বাংলা গান, ঠুংরি, দাদরা অঙ্গে প্রস্তুত করেছি বেতার–প্রচারের উদ্দেশ্যে। তিনি সানন্দে তা করেছিলেন এবং তাঁর সেই গানের সমতুল্য গান তিনি রেকর্ডও করতে পারেননি অন্তত একটা কারণে যে, গাইবার স্বাধীনতা তিনি পেয়েছিলেন সময়ের দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে। এর অনেক পরে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁকে দিয়ে আমারই রচিত এবং সুরারোপিত চারখানি বাংলা গান গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডে ধরে রাখবার”। নীচে কিছু রম্যগীতির উদাহরণ দেওয়া হল।
অন্য গীতিকবির কথায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুর করা গান :
(১) রম্যগীতি :
আকাশবাণী রম্য গীতি
কথা ও সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
কণ্ঠ – ললিতা ঘোষ
রাতের স্বপন বলো কে গো মনে রাখে
নিশীথের তারাগুলি প্রভাতে কি থাকে।
বাসর ঘরের বাতি জ্বলে যতটুকু রাতি
নিভে যাওয়া প্রদীপেরে আঁচলেতে ঢাকে।।
(২) রম্যগীতি
কণ্ঠ – শ্যামল মিত্র।
কথা – গোপাল দাসগুপ্ত
সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
কাঙাল আঁখি কাজলহারা, এ তোমার ফুরিয়ে যাবার খেলা
জানি আমার কাছে চাইবে কিছু এইবেলা।
আজকে তুমি আমার আবার হলে
আমার মালা দুলবে তোমার গলে
কাছে টানার মায়ায় বুঝি আড়ালেরই জাল ফেলা।।
আজ আমি তো রিক্ত নহি আর
হাত পেতেছ আমার কাছে,
এ মোর অহংকার।
আসবে তুমি বাজল আবার বাঁশি
ভাঙনভরা গোপন তারার হাসি
তোমার তরে আমার ঘরে লক্ষ শিখা দীপমেলা।
(৩) বাংলা খেয়াল (বাংলা রাগপ্রধান গান)
সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
কথা – গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
কণ্ঠ – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, আকাশাবাণী রেকর্ডিং
ঝরঝর ঝরে বাদল
বিজলী চমকে গগনে, গরজে ঘন সঘনে
নাচে ময়ূর বন ভবনে, সাথে বাজে মেঘ মাদল।।
(৪) রম্য গীতি – কলকাতা আকাশবাণী
কথা – গোপাল দাসগুপ্ত
সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
কণ্ঠ – মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
বন্ধু হে পরবাসী, দেখেছ কি হায়
বাদলধারায় দিগন্ত আজি যায় ভাসি।
দেখয়েছ কি নভঃনীলিমার নিভৃতে
ঘনাল যে ছায়া স্বপ্নমধুর মেঘ শ্যামলীম মাধুরীতে
শুনেছ কি হায়, বাদলের বায়
উদাসী বধূর দুর্বাসে।
জাগুক তোমার মৌনবীণার তারে তারে
বিরাহী ধারার বেদনার গাঁথা অশ্রুগাঁথা মল্লারে
শুনেছ কি হায় ! অন্তরে তব, যে কাতর ওঠে উচ্ছ্বাসে।।
(৫) কণ্ঠ – সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (বাংলা গান)
কথা – শ্যামল গুপ্ত
সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
ফিল্ম – আঁধারে আলো
আমার জীবনে আজ, এ কী অজানার ছোঁয়া লাগে
একটি নিমেষ কেন চিরবসন্ত হয়ে জাগে।
মনে মনে শুনি বহু দূরে মিলনের বেণু বাজে সুরে
মায়ার বাঁধন জড়াল যে, এ কী অনুরাগে।।
(৬) কণ্ঠ – সাবিত্রী ঘোষ (১৯৪১) বাংলা গান
কথা – অজয় ভট্টাচার্য
সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
বিরহী চিরবিরহী
তোমার আঁধারে আঁধার করেছ ধরা
বাদল এলে গভীর।।
(৭) কণ্ঠ – ললিতা ঘোষ, পিয়া পিয়া বোলে (১৯৬৫)
কথা – শ্যামল গুপ্ত
সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
পিয়া পিয়া বোলে পাপিয়া
*********
(৮) আকাশবাণী হিন্দী রম্যগীতি
কথা – দোশী
সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
কণ্ঠ – সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
থাকে পাওঁ লেকিন বহুত দূর জানা
খড়ী হর কদম পর নঈ মুশকিলে হ্যায়
অভী মঞ্জীলোঁ পর কঈ মঞ্জীলে হ্যায়।
অভী তো হামে দিল উন্হে হ্যায় সুনানা।
বনেগা না জানে কাঁহা আশিয়ানা।
না পুছোঁ সিতারোঁ সে দিল কি কাহানী
লুটি কিস্ গলি মেঁ গলি কি জবানী
কহে গা উসে খুদ কিসি দিন জমানা
বনেগা না জানে কাঁহা আশিয়ানা।।
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দশকের বাংলা গানের জগতে আর এক ভিন্ন ধারার গানের সৃষ্টি ঘটে, তা হল ‘ছড়ার গান’। বাংলা গানের এই পরিধিতে সলিল চৌধুরী, ভাস্কর বসু, নচিকেতা ঘোষের মতো সুরকার – গীতিকারের ভূমিকা ছিল উল্লেখনীয়। ছড়ার গানের পরিসরে বাংলার প্রণম্য কিছু গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও গানের একটি তালিকা উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হল –
কথা | সুর | কণ্ঠ | গান |
১। ভাস্কর বসু | নচিকেতা ঘোষ | আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় | যমুনাবতী সরস্বতী |
২। সলিল চৌধুরী | সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় | সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় | আয় বৃষ্টি ঝেঁপে |
৩। অন্নদাশঙ্কর রায় | সলিল চৌধুরী | বাণী ঘোষাল | তেলের শিশি ভাঙলো বলে |
৪। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় | অনল চট্টোপাধ্যায় | সনৎ সিংহ | রথের মেলা নাগের দোলা দেয়ালীর গান |
৫। মিন্টু ঘোষ | সুধীন দাশগুপ্ত | গীতা দত্ত | কাজল কাজল কুমকুম |
৬। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় | অনল চট্টোপাধ্যায় | সনৎ সিংহ | সরস্বতী বিদ্যোবতী এবং দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর |
৭। সুকুমার রায় | অরুণ বসু | সনৎ সিংহ | আবোল তাবোল’–এর বাবুরাম সাপুড়ে |
এছাড়াও প্রবীর মজুমদারের গান নির্মলা মিশ্রের কণ্ঠে ‘ও তোতাপাখি রে’ , লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে সলিল চৌধুরীর ‘সাত ভাই চম্পা’ এবং এর আরও পরে অন্তরা চৌধুরীর একাধিক গান বাংলায় ছড়ার গানকে পরিপূর্ণ করেছে।
পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের প্রধানত রাগাশ্রয়ী গানে অপরিসীম উচ্চমার্গের সৃষ্টিশীলতা ছাড়াও সঙ্গীতের সমস্ত ধারার গানেই তাঁর সাংগীতিক কর্ম লক্ষ্য করা যায়। জ্ঞানবাবুর এক ভিডিও থেকে জানা যায় যে, তিনি নিজেই তাঁর ছাত্রছাত্রী পরিসরে প্রধানত পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, শ্রীমতী ললিতা ঘোষ এঁদের উপস্থিতিতে বলছেন যে, রেডিওতে কর্মাধীনকালীন রেডিওর এক কর্মকর্তার অনুরোধে একটি ছড়ার গান তৈরি করেছেন তিনি। গানটির পুরো কথা তাঁর স্মরণে নেই জানিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে দুই লাইন গেয়েছেন শিষ্য অজয় চক্রবর্তীর অনুরোধে। গানটির দুই লাইন হল –
“আমি ফেরিওয়ালা
কত রঙ বেরঙের সস্তা দামের খেলনা বেচে খাই
কচি কচি ছোট ছোট কত না চাঁদমুখে হাসি ফোটাই”।
ছড়ার গান
কথা ও সুর – পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ
ওরে ও বেলী চামেলী ও জুঁই বকুলের দল
এমন মনমাতানো গন্ধ তোরা কোথায় পেলি বল।
নরম পাতার কোলে তোদের সবুজ ঘর
হেসে রোজ রকালে সূয্যিমামা করে যে আদর
মলয়াদোল দিয়ে যায়, পরাণে পুলক জাগায়
ছড়ায়ে দিস কি রে তাই হাসির পরিমল।
যখন আকাশপারের নীল সায়রে আলোর জোয়ার আসে
চাঁদের দেশে যাবে বলে মেঘের তরী ভাসে।
কাটিয়ে মাটির মায়া লভিস কি রে নতুন কায়া
আগনন উঠিস ফুটে নীল সায়রে আলোর শতদল।
তথ্যপঞ্জি
গন্থপঞ্জি
১। মজুমদার, দীপ্তি প্রকাশ, হাজার বছরের বাংলা গান, প্রকাশক – অমর ভারতী, ৮ সি, ট্যামার লেন, কলকাতা, প্রকাশকাল – ২০১৩
২। গোস্বামী করুণাময়, বাংলা গানের কথা, শিশু সাহিত্য বিতান, চট্টগ্রাম
৩। নস্কর, ডঃ স্বপন, ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিকথা, দ্বিতীয় খণ্ড, শিল্পী প্রকাশিকা, কলকাতা
৪। চক্রবর্তী, মৃদুলকান্তি, বাংলা গানের ধারা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, প্রকাশকাল – ১৯৯৩
৫। মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যপ্রসাদ, সঙ্গীত ও স্বরলিপি (৫১ টি পুরোনো দিনের গান) প্রকাশক মঞ্জু মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামপুর, হুগলী, বইমেলা’ ৯৯
৬। ঘোষ, জ্ঞানপ্রকাশ, তহজীব–এ–মৌসিকী, বাউলমন প্রকাশন, ২৮, বালিগঞ্জ গার্ডেন্স, কল্কাআ ৭০০০১৯, প্রথম প্রকাশ অগ্রহায়ণ ১৪০১
৭। সঙ্গীত মূল্যায়ন বক্তৃতামালা, প্রথমখণ্ড, সম্পাদনা ডঃ উৎপলা গোস্বামী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ৩৬ আনোয়ার শাহ্ রোড, কলিকাতা ৭০০০৩৩, প্রথম প্রকাশ অক্টোবর, ১৯৮৯
৮। গোস্বামী, ডঃ উৎপলা, কলকাতায় সঙ্গীতচর্চা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত একাডেমী, কলকাতা, প্রকাশ জানুয়ারী ১৯৯১
৯। Avantika, Editor – Shouvik Kumar Dasgupta, Published by Santi Ranjan Sarkar, Published from 37/A, Southern Avenue, 1st Floor, PS Tollygunge, Kol 700029
সাক্ষাৎকার
১। পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
২। পণ্ডিত অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩। পণ্ডিত মল্লার ঘোষ
৪। পণ্ডিত গোবিন্দ বসু
৫। পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
৬। পণ্ডিত সঞ্জয় মুখার্জী
—-০—
অজন্তা জানা
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিভাগ (কণ্ঠসঙ্গীত)
সঙ্গীতভবন
তারিখ – ২৮.১১.২০১৯