বৃন্দ গানে মানুষ ও সমাজ
দেবাশিস মন্ডল *
সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিকাশিত হয়েছে সঙ্গীত ধারা। যুগ যুগ ধরে সমাজের শোষণ-মুক্তির সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে সমবেত সঙ্গীত। কুসংস্কার, ধর্মন্ধতা, অন্যায়-অবিচার এসবের বিরুদ্ধেও সমবেত সঙ্গীত আন্দোলনের সহায়কশক্তি হিসাবে কাজ করেছে। শুধু একসঙ্গে অনেকে মিলে গাইলেই তা সমবেত সঙ্গীত হয় না। এ-জাতীয় সঙ্গীতের বিশেষ কিছু আদর্শ রয়েছে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে ‘কোরাল সঙ’ এবং ‘কোরাস’ এই দুটি পর্যায়ের সঙ্গীত সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন গ্রন্থে আলোচনা দেখেছি। কোরাস ল্যাটিন শব্দ। গানের ক্ষেত্রে কোরাস বা কোরাল বলতে কোন বিশেষ রচনাকে সমবেতভাবে গাওয়া বোঝায়; যদিও তা সাধারণভাবে অপেরা, অরাটোরিও কন্টাটা এবং চার্চের গান গাওয়ার রীতিকেই বোঝায়। ইদানিং অবশ্য পাশ্চাত্য সঙ্গীতেও সমবেতভাবে গাওয়া প্রায় সব ধরনের গানকেই কোরাল সং বলা হয়। কিন্তু সমবেত সঙ্গীত সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার বিষয়গত দিকটি। যদি গানের বিষয় সমবেত আদর্শের পরিপন্থী হয় তবে তা সমবেত পর্যায়ের সঙ্গীত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে সমষ্টির স্বার্থ-বিযুক্ত কোন চিন্তা সমবেত সঙ্গীতের পর্যায়ে পড়ে না। আদিম যুগ থেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমবেতভাবে গাওয়া গানে একটা ঐক্যের আদর্শ দেখতে পাব। তা বলে একক সঙ্গীতের মধ্যে সমবেত্ত আদর্শ মূর্ত হবে না এরকম চিন্তা সম্পূর্ণ অমূলক। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে তা বিশেষ চিন্তার কোন বিশেষ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। আবার কখনো কখনো সমবেত আদর্শের পরিপন্থী হতে পারে। এক্ষেত্রে এই গান যুগোত্তীর্ণ বা কালোত্তীর্ণ হতে পারে না।
একক গানের মধ্যে সমাজের বা একটি অঞ্চলের মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা ও মানসিকতা ফুটে উঠতে পারলে তা যুগোত্তীর্ণ হতে পারে। যেমন লোকসঙ্গীতে ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিগে চাইয়ারে…. কি কব দুঃস্কের জ্বালা গাঁথিয়াছি বন মালা রে’ গানটিতে উত্তরবঙ্গের গ্রাম্য মহিলার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে।
উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবিকার সঙ্গে সেখানকার প্রায় প্রতিটি মানুষের মানসিকতার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই একটি চিন্তার সুর অন্যের মনের সঙ্গে মিলে যায়। তবুও তা একক মানুষের কথাই বলে। দেশ-কাল-সমাজকে ভাবায়না। কোন পরিবর্তনের কথা বলেনা। শুধু একজন মানুষের জন্য ভাবায় অন্য একজনকে। তাই এই গান একটি অঞ্চলের হাজারো মানুষের সুর ধ্বনিত করলেও তা সমবেত সঙ্গীত হিসাবে গাওয়ার কোন রীতি নেই।
অন্যদিকে সমবেত সঙ্গীতের ভাবাদর্শ একটা পুরো গোষ্ঠী, সমাজ, দেশ বা পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের সম্পর্কে মানুষকে ভাবায়। একটা উত্তর খোঁজে। যেমন –
ভাঙো বাধা নিরাশার অন্ধকার
শোষণের বন্ধন কারাগার
এসো এই জীবনের মিছিলে
কোটি প্রাণ ঐকতান যায় মিলে।
এখানে কোন দোদুল্যমানতা নেই। একটা পাকা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলার আহ্বান। শুধু সমস্যা নয়, দুঃখ নয়। সমাধানের লক্ষ্যে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন উপলব্ধি থেকেই লেখা এই গান। কোন একজন মানুষের কাজ নয় সমাজ-পরিবর্তন। তাই এখানে সমাজ বা দেশেকে ভাবাতে ঐক্যের আহ্বান সমবেতভাবেই যথার্থ-ভঙ্গীতে প্রকাশিত হতে পারে। কেন, এবং বিভাবে সমবেত সঙ্গীত আত্মপ্রকাশ করেছিল তার কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু নৃতান্ত্রিক উপাদান এবং সমাজতাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণ থেকে আদিম সমাজের গঠন এবং তাদের মানসিকতার একটা ধারণা পাওয়া যায়। তা থেকে যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই সঙ্গীতসৃষ্টির সূত্র এবং সমবেত সঙ্গীতের বিকাশ সম্বন্ধে একটা ধারণা পেতে পারি। মর্গানের আবিষ্কার আদিম যুগের ঢেকে যাওয়া তথ্যকেও অনেকটা স্বচ্ছ করে তুলতে পারে।
মানুষের জীবনে সঙ্গীত নানা রূপে নানা ভাবে হাজির হচ্ছে। বর্তমান যুগের সঙ্গীতের সামাজিক দিকগুলি নিয়ে প্রশ্ন করলে নানা মতের উত্তর বেরিয়ে আসবে। যার মধ্যে একটা উৎকট ও ভায়াবহ প্রভাবের কথা থাকবেই। কিন্তু যদি সমবেত সঙ্গীতের (কণ্ঠ) ব্যাপারে আলোচনা হয় তবে জানা যাবে যুগ যুগ ধরে সমবেত-সঙ্গীত সমাজের ঐক্য ও হিত সাধনের ভূমিকা পালন করে এসেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেই আদিম যুগ থেকে বর্তমান কালেও সমবেত সঙ্গীতের মধ্যে অশুভ বা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর বক্তব্য স্থান পায়নি। সৃষ্টির সময় থেকেই সঙ্গীত ঐক্যভাবনাকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে। একক বা বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনার যুগ এসেছে অনেক পরে। বেঁচে থাকাটাই যখন অনিশ্চিত তখন এককভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নও মানুষ দেখতে পারে না। তাই কল্পনাতেও এককের কোন অস্তিত্ব ছিল না সে-যুগে। একটু সংক্ষেপে সঙ্গীত বিকাশের প্রথম যুগ সম্বন্ধে আলোচনা করলেই এ ব্যাপারে একটা পরিস্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সমবেতভাবে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে মানুষ। ঝড়ঝঞ্ঝা আর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে মানুষ টিকে থেকেছে। যৌথভাবে জীবন সংগ্রামের ফলেই, পরস্পরকে ভালবাসার নিবিড়
মানসিকতা গড়ে উঠেছে। আর এই কোমল উদার মানসিকতা থেকেই প্রশস্ত চিন্তার পথ ধরে সৃষ্টিশীলতা বেড়েছে মানুষের।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে আদিমযুগে মানুষ বাস করত গোষ্ঠীবদ্ধভাবে। তখনও সেভাবে সমাজবদ্ধ ছিল না মানুষ। কিন্তু সমবেতভাবে থাকার প্রয়োজনীয়তা মানুষ অনুভব করেছিল। যাইহোক, জীবন জীবিকার সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্ক গড়ে
ওঠায় মানুষের মন আরো বিকশিত ও উদার হয়েছে। শিল্পকলা রূপ পেয়েছে মানবিকতাবোধ থেকে। এই ভাবেই সমবেত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েইে সৃষ্টি হয়েছে আদিম পর্যায়ের সঙ্গীত। প্রায় সমস্ত সমাজবিজ্ঞানীর সিদ্ধান্ত, অপ্রতুল সংখ্যক শব্দের পাশাপাশি অঙ্গ চালনার মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে সুর যুক্ত করা হয়েছে।
ছন্দবোধ একটা জৈব ও প্রাকৃতিক ব্যাপার। যূথবদ্ধভাবে কাজ করতে করতেই মানুষ ছন্দবোধকে আয়ত্ব করেছে। শব্দ, সুর ও ছন্দের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সঙ্গীত। কাজেই সঙ্গীতের সৃষ্টির প্রথম পর্বটিও সমবেত। তখন মানুষের আনন্দ বা বিনোদন
কোন একক বিষয় ছিল না। বিপর্যয়, দুঃখ বা যন্ত্রণা যখন আসত, তার আঘাত পড়ত পুরো গোষ্ঠী বা সমাজের উপর। আবার আনন্দ বা উচ্ছ্বাসের কারনও ছিল সমবেত গোষ্ঠী-কে কেন্দ্র করেই। সে আনন্দের সময় সবাই মিলে নাচতে নাচতে গান গাইত।
গান গাইতে গাইতেই খাওয়া দাওয়া, হৈ-হুল্লোড়। মানুষ যত ক্রিয়াশীল হয়েছে ততই বৃষ্টিশীলতা বেড়েছে। আবার সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হয়েছে জীবনযাত্রা, শিল্প সৌন্দর্য চেতনা। সঙ্গীতও বিকশিত হয়েছে ধীরগতিতে যুগের পর যুগ ধরে, একটু
একটু করে অভিজ্ঞতায় উদ্ভাসিত হতে হতে।
সাঙ্গীতিক ছন্দ মানুষের স্মৃতি সহায়ক। বোধহয় মনুষ্যেতর অন্যান্য প্রাণীদেরও। সঙ্গীত অভিজ্ঞতার নির্যাসকেও ধরে রেখেছে। গান করেছে মানুষ। ছন্দের ঝোঁকগুলিকে ব্যবহারের জন্য সমবেতভাবে সঙ্গীতকে ব্যবহার করেছে। এভাবেই সঙ্গীত বিনোদনের পাশাপাশি কর্মজীবনে মানুষের সহায়ক শক্তি হিসাবে হাজির আমরা আদিম জাতিগুলির সঙ্গীত শিল্পকলা এবং জীবনযাত্রা সম্বন্ধে একটু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো তাদের সমবেত প্রচেষ্টা এবং প্রক্রিয়া। যদিও সমাজের সভ্যতার বিকাশের কিছু প্রভাব তাদের সংস্কৃতির উপরও পড়েছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের উৎসবের মধ্যে ঐতিহ্যের ধারাকে সঠিকভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁদের যে কোন উৎসবেই সময়েতভাবে গানের সঙ্গে নাচের দৃশ্য দেখা যায়। তাঁদের গানের ও গোষ্ঠীর মঙ্গল কামনার কথা সুস্পষ্ট। যেমন সাঁওতাল উপজাতিদের উৎসবে প্রকৃতি ও সূর্যের কাছে সবার মঙ্গল কামনারা গাওয়া হয়- সিং পারম এনা। ধারণে যাপুর পারম এনা। রাবাং তেরা মেন শেষমা না চুর উন। অর্থাৎ দিন চলে যায়। হাতে চলে যায় তবু তুমি আছ। হে প্রকৃতি হে সূর্য যেন তোমার করুণা থেকে বঞ্চিত না হই।
তেমনি বাভা, রাজবংশী, কোচ ইত্যাদি নানা উপজাতির উৎসব ও আচার অনুষ্ঠান থেকে প্রাচীন ঐতিহ্যের অবশিষ্টটুকু খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া গ্রাম্য জীবনে সাধারণ মানুষের উৎসব অনুষ্ঠানে প্রচলিত লোকসঙ্গীতে এখনো আদিম সঙ্গীতের ধারাগুলির কিছু কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে।
আদিমযুগে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করত। যা কিছু কল্পনা তার বেশিরভাগ ছিল গোষ্ঠীকে ঘিরেই। সাঁওতালদের মধ্যে এখনো গোষ্ঠীর মানসিকতা এবং শিল্প সংস্কৃতি অবশিষ্ট রয়েছে। সাঁওতালদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও বৃত্তি সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে তাদের প্রচলিত লোকসঙ্গীতে।
চায়-চম্পা দিসম রেয়াক রিবি/ হাঁটিঞ লেদাকো সানাম রিকিত,/ সরেন সিপাহী মুর্মু ঠাকুর / টুডু মান্দাড়িয়া হেমব্রম কুঁয়ার/ মান্ডি কিপিসঁড় কিস্কু রাপান/ সুলুক নিরাই রেয়াক রাজপাট,/ সেন্দারা কারকারেন শিকারিয়া।
অর্থাৎ
চায়-চম্পা দেশের বৃত্তি ভাগাভাগি করে ছিল সবাই মিলে, সরেন সিপাহী মুমু ঠাকুর, টুডু বাজনদার হেমব্রম দেওয়ান। মানডি মহাজন কিস্কুউ রাজা, সুখ শান্তির রাজপাট, শিকার ভাঙ্গলে শিকারীরা বাঁশির সুর ধরে। সেই অঞ্চলের বাঁশির সুর তাদের গানে।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই আদিম জীবনে ছিল। কিন্তু সবাই সবাইকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছে। তাঁদের লোকসঙ্গীতে সেই ঐক্যের ও হুঁশিয়ারির সুর শোনা যায়।
বেরো বেরো মেসে গাতেঞ্চ হো
চিরগাল চিরগাল চিরগান মেসে গাতিঞ্চ হো।
কঁয়জকো শপার কানা গাড়ে হো
বাদোলী কোঞ্চোপা গপচ্ কান।
উ-ঠ উঠ উঠ বন্ধু হে।।
অর্থাৎ-
হুঁশিয়ার বন্রাধু
কঁয়ড়ারা কাটাকাটি করছে
হানাহানি করে মরছে বাদোলিরা।।
অর্থাৎ চায় দেশ বাগড়া বিবাদে পূর্ণ হল। চম্পাদেশ অনুর্বর হল। এস আমরা অন্য
বাসভূমি খুঁজি। (ধীরেন্দ্রনাথ বাসকে- বঙ্গ সংস্কৃতিতে প্রাক বৈদিক প্রভাব)
ঝগড়া বিবাদের পরিণতিতে ক্ষয়ক্ষতি হত প্রচুর। বিভিন্ন গোষ্ঠী নানা কারণে
বিবাদপূর্ণ এলাকা ছেড়ে চলে যেত দল বল নিয়ে।
যেমন-
চায় দিশম দ চাঁয়া এনা হো
টম্পা দিসম দ মার্চা এনা
দেবন দেলাবন সি সা জর আহো।
দেব দেলাবন দিলেন হং আ
রাভা উপজাতির উৎসবেও সমবেত নাচ গানের অনুষ্ঠান হয়। শরৎকালে রাভাদের গ্রিমবুদা উৎসব হয়। মাঠভরে ওঠে নতুন ফসলে। কৃষিজীবী রাভাদের মনে আনন্দ সারা বছরের হাড়ভাঙা খাটুনি এবার সার্থকতার পথে। কত সোনালি স্বপ্ন।
ফসল যেন নষ্ট না হয় তাই প্রার্থনা সবুজ ধানের খেত রক্ষার জন্য; সমবেত প্রার্থনা আর্তি। দেবতার নিকট ধরনা। বলিদান তো আছেই। আর আছে চকোেত।
রাতাদের বিশ্বাস- গ্রিমবুদা দুঃখতাপনাশক ও শস্যবৃদ্ধিকারক। দেবতা তুষ্ট হলে অবিবাহিতা স্বামীলাভ করেন, নির্ধনের ধন লাভ হয়। রোগীর রোগ নাশ হয়।
গ্রিমবুদা উৎসবে যখন খেত থেকে ধান ঘরে নিয়ে আসা হয় তখন রাজারা গান ফেই হচ্ছিতা ফোই কুরিচ্ছা ফোই গায়
হি হি ও ওই ফোই আবু ফোই ছানি ফোই ছি ছি কই।
ফোই হাম্পা ফোই মাই ফোই
হি হি কই…..।
রাজবংশী সম্প্রদায়ের মেয়েদের অনুষ্ঠান ‘কুম দেও।’ বৃষ্টি না-হলে বৃষ্টির কামনায় সমবেতভাবে সমাজের কল্যাণের জন্য এই নুষ্ঠান হয়। রাজবংশী মেয়েরা ধারালো ছুরি ও দা নিয়ে রাতের অন্ধকারে দূরে কোন ক্ষেতে গিয়ে হাজির হন। কলাগাছের পাতা দিয়ে হুকুম দেও-এর মূর্তি তৈরি করেন। মূর্তিটিকে মাটিতে পুঁতে মেয়েরা নিজেদের জামাকাপড় সব খুলে ফেলেন। মাথার কেশও খুলে দেন। একেবারে উলঙ্গ অবস্থা। তাঁরা নাচতে নাচতে সমবেত ভাবে গান গাইতে থাকেন বৃষ্টির প্রার্থনায় (মাঝে মধ্যে উৎকটভাবে গালি-গালাজও করা হয়।)ঃ জাগরে জাগরে হুকুম আজিকার রচিত। গৃহস্থিরা করে পূজা দিয়া ধুপ চাইলন রাতি। আকাশেতে কর পূজা আকশ কাওয়ালি। পাতালেতে কর পূজা একক লাগালি। কালা মেঘে ধলা মেঘে ডাকি আনি বাড়ি। অন্ধকার করিয়া দেওয়ার আইসাক দবাড়ি…কারো খেতে পানি নাই, আছে পানি গাঙ্গেতে। ঢালিম দিব জমিতে। ইত্যাদি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বৃষ্টির জন্য সমবেত সঙ্গীতের মাধ্যমে নানা অনুষ্ঠানের রীতি জনসমাজে প্রচলিত রয়েছে। থে সেলী ও মেসিডোনিয়ার গ্রিকরা শিশুদের নিয়ে সদলবলে নাচতে নাচতে গান গেয়ে এগিয়ে চলেন।
Per peria, all fresh bedewed Freshen all the neighbourhood,
By the woods, on the highway,
As thou goest, to God now
Oh Pray! My God, upon the plain.
…Send thou us a still, small rain
That the fields may fruitful be
And vines in blossom we may see,
That the grain be full and sound,
And wealthy grow the folks around.
আদিম যুগ থেকে ক্রমশ সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের স্বাচ্ছন্দা যত বেড়ছে ততই শ্রেণী-বিভাজনও বেড়েছে। পুঁজির উদ্ভব থেকেই বিচ্ছিন্নতাবোধ গড়ে উঠেছে। কিন্তু ঐক্যের প্রয়োজন কোন যুগেই শেষ হয়ে যায় নি।অনেক ক্ষতিকর জিনিস দূর হয়েছে সমবেত প্রচেষ্টায়। কাজেই প্রত্যেক যুগের গানেই নেই রে প্রয়োজনীয়তাই অনুভূত হয়েছে। সমবেতভাবে সমাজ গঠনের গান, মিথ্যার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সচেতনতা বাড়াতে সমবেত সঙ্গীতকেই আশ্রয় করা হয়েছে।
ভারতীয় সঙ্গীতে খ্রীঃ পূর্ব ৩০০০ অব্দে রচিত বেদের সূত্রগুলি থেকে আমরা সে যুগের সঙ্গীতধারা লক্ষ্য করতে পারি। বৈদিকযুগে সামগরা গান গাইতে সমবেতভাবে। গানে গানেই আহ্বান করা হয় প্রকৃতি, সূর্য ও নানা শক্তিকে। সন্তান-সন্ততি, ফসল গৃহপালিত জন্তুর কামনা করা হত। কিন্তু তখনো সমবেত প্রক্রিয়া বিছিন্ন হয়নি। সামগরা একই সঙ্গে গান গেয়ে পুরো সমাজের কল্যাণকামনা করত।
সামবেদের ১১৫ নম্বর সূক্তে বলা হয়েছে, ‘তদবো গায় সুতে সভা পুরু হুতায় সত্বনে। শং যদগবে ন শাকিলে’। অর্থাৎ হে স্তোতাগণ, গবাদি পশুর কাছে উদ্ভিদ যেমন সুখকর হয় সে-রূপ সোমাভিষেকে বহু লোকের বন্দনীয় সর্বশক্তিমান ইন্দ্রের সুখদায়ক স্তোত্র তোমরা একত্র মিলিত হয়ে গান কর। ১১৯ নম্বর সূক্তে বৃত্রকে রহস্যময় গানের দ্বারা স্তব করার কথা বলা হয়েছে। অন্য একটি সূক্তে ইন্দ্রের প্রশংসা করে তাঁর উদ্দেশে সোমরস নিবেদন করে গান করতে বলা হয়েছে। ৩/১২/১ মন্ত্রে নৃত্যসহ গানের কথা বলা হয়েছে- ‘গায়ন্তি তা গায়ত্রি- নোহচন্ত কর্মকির্নঃত ব্ৰহ্মানসত্ত্বা শতদ্রুত উদ্বংশমির থোনিবে।
এছাড়া ১/১২/১০ সূক্তে অগ্নির উদ্দেশে সামগদের স্তব করে ধন, বীরত্ব ও অন্ন প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। এভাবে সূক্তগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা সমাজ ও গোষ্ঠীর মঙ্গল কামনার জন্যই আহ্বান লক্ষ্য করতে পারি। কিন্তু চাহিদার ভিন্নতাও রয়েছে। কোথাও সম্পদ ও সুখের জন্য পশু, বীরত্ব, অন্ন, আবার কোথাও সন্তান কামনা করা হয়েছে। সর্বত্রই দেবতাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য তাদের উদ্দেশে সুখদায়ক স্তোত্রও পাঠ করার রীতি লক্ষ্য করা যায়।
সমন্ত যুগের উত্থান ও বিকাশের পর্যায়ে শিল্পকলা ও সঙ্গীতচর্চা বহুলভাবে বেড়েছে। সমবতে সঙ্গীত ধারার পাশাপাশি একক চিন্তা চেতনাও প্রাধান্য পেয়েছে। সমাজ থেকেই একাংশের মানুষ বাড়তি সুযোগ সুবিধা নিয়ে একক সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা ভেবেছে। আর অকইভাবে সঙ্গীত চেতনার মধ্যেও বিছিন্ন ও একক চিন্তা বেড়েছে। তা সত্বেও যৌথভাবে বেঁচে থাকার এবং লড়াই করার প্রয়োজনীয়তা কোন যুগেই শেষ হয়ে যায়নি। সমবেত উদ্যোগ ও উদ্দীপনা সৃষ্টির কাজে সমবেত সঙ্গীত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।
পৌরাণিক যুগ, নাট শাস্ত্রের যুগ পার হয়ে বাংলার আদি সাহিত্য চর্যাপদগুলি থেকেও ঐকা ও সমন্বরের প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়। লক্ষনীয়, প্রতিটি যুগেই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর বিষয়গুলির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে সমবেত সঙ্গীতে। আবার সমাজের কল্যাণের জন্য সমবেত আহ্বানও শোনা গেছে যুগ যুগ ধরে।
লোকচেতনা, প্রাকৃতিক উত্থান-পতন, ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে শক্তি বা প্রকৃতির আরাধনা, উপাসনা ও কল্পিত ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস গড়ে উঠেছে। প্রকৃতির কাছে সমাজের কল্যাণ কামনা করেছে। বৃষ্টি, ফসল, সন্তান, পণ্ড ইত্যাদির জন্য একসঙ্গে গান গেয়েছে মানুষ। এর পাশাপাশিই কিন্তু চলে এসেছে লোকসঙ্গীতের ধারা। লোকসঙ্গীতে কর্ম সঙ্গীতই মূলত সমবেত পর্যায়ের গান। এছাড়া ব্যবহারিক সঙ্গীত, নৌকা বাইচ, ঝুমুর, তুমু, ভাদু ইত্যাদি উৎসব অনুষ্ঠানের লোকসঙ্গীতগুলি একসঙ্গে গাওয়া হয়।
ছাদ পেটা, ধানকাটা, ডাল তোলা ইত্যাদির সময় সমবেত কর্মসঙ্গীত গাওয়ার রীতি এখনো প্রচলিত রয়েছে অনেক জায়গায়। যদিও ছাদ পেটানো হয় না এখন। জল সেচ দেওয়া হয় যন্ত্রের সাহায্যে। তবু গানগুলি এখনো সমাজের সবজায়গা থেকে মুছে যায়নি। যেমন ধানকাটার গান-
হেঁই, চলরে মাঠে চল, ও ভাই ধানকাটিরে চল
মনের মুখে তুইল্যারে খানি অঘ্রানে ফসল।
চর্যার যুগ পার হয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে মুঘল যুগের শেষ দিকে সমবেত ধর্মীয় সঙ্গীত লক্ষ্য করি বৈষ্ণবীয় কীর্তনে ও নাম সংকীর্তনে। তখন সমাজে সংহতি বিপন্ন প্রায়। এক ধর্মের সঙ্গে অন্যের লড়াই, এক জাতির সঙ্গে অন্যের শত্রুতায় মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক এমনই একটি ক্ষণে শ্রী গৌরাঙ্গের আবির্ভাব। কিন্তু নিছক কোন তত্বকথা মানুষকে সুপথে পরিচালনা করতে পারেনা। সেই তত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মানবিক কর্মকাণ্ড আর হৃদয়াবেগ জাগ্রত করা প্রয়োজন। তাই শ্রী গৌরাঙ্গ সঙ্গীতের মাধ্যমেই মানুষের কাছে ভালবাসার মূল সুরটি ধ্বনিত করেছেন। আর সেই সুর একের সুর নয়, সকলের। সমবেত ভাবাবেগ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি জয় করেছেন ভালবাসাকে। ধর্মের নামে পরস্পরকে দূরে সরিয়ে রাখার বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার মিথ্যা অহংকারকে চূর্ণ করেছেন ভালবাসার আবেশ তৈরি করে। এইসব পথদ্রষ্টারাও ভাবোন্মাদনা সৃষ্টির জন্য সঙ্গীতকে ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন এই জায়গায় ধর্মীয় উন্মাদনার গান কোন প্রগতিশীল ভূমিকা পাল করেছে কি না? তার উত্তরে বলা যায়, সেদিন আচণ্ডাল সব মানুষকে কীর্তনের অধিকার দিয়ে চৈতন্যদের সেই জরাজীর্ণ ধর্মীয় অহংকারকে চূর্ণ করার জন্য স্থবির ও জড়তায় পূর্ণ সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তৎকালীন সামাজিক পরিবেশে সমবেত কীর্তন ছিল প্রগতিশীল কালচার।
প্রথম স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতা সংগ্র প্রেরণা ও উদ্দীপনা জাগিয়েছে প্রবীন ও নবীন প্রখ্যাত ও অখ্যাত বহু কবির রচিত অসংখ্য কবিতা ও গান। সেই দুর্লভ কবি কীর্তিগুলি আমাদের অভিশপ্ত নিপীড়িত জাতীয় জীবনের অন্তর্গট দুঃখ বেদনা ও আশা আকাঙ্ক্ষার গতিময় ইতিহাস। দেশের সাহিত্য ভাণ্ডারেও এগুলি অমূল্য সম্পদ। বাংলার স্বদেশীচেতনায় এইসব গানগুলি রচিত হয়েছিল স্বতস্ফূর্তভাবে। দেশাত্মবোধের গভীরে উপলব্ধি এই গান রচনায় প্রেরণা যুগিয়েছে। জাতীয়তার নবমন্ত্র’ গ্রন্থে যোগেশচন্দ্র বাগল এই পর্যায়ের গানতে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বলে উল্লেখ করেছেন।
পূর্বে সমাজ, মানুষ, জনপদ ইত্যাদির কল্যাণে বহুকাব্য রচিত হলেও দেশাত্মবোধকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে দেশমাতৃকার বন্দনা সংক্রান্ত কবিতা প্রথম রচনা করেছিলেন ডিরোজিও এবং কাশীপ্রসাদ ঘোষ। এরপর গুপ্তকবি, রঙ্গলাল ও মধুসুদন ছন্দে জন্মভূমী ও জননী বঙ্গভাষার প্রশস্তি করেন। কিন্তু ছন্দ ও সুরে দেশমাতৃকার প্রশস্তি শুরু হয় জাতীয় মেলা থেকে। জাতীয় মেলা প্রথম আরম্ভ হয় আশুতোষ দেবের বেলগাছিয়া উদ্যানে। এই উপলক্ষ্যে প্রথম দেশাত্ববোধক গান ‘মিলে সবে ভারত সন্তান, একতান-মনপ্রান গাও ভারতের যশোগান’ গাওয়া হয়। গানটির রচনা করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর দ্বিজেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য অনেকেই জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই দেশজুড়ে কাব্যসহিত্যে দেশাত্মবোধ ক্রমশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকে। নিধুবাবুর টপ্পা গানে স্বদেশী ভাষা সম্পর্কে লেখা হয় ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশীভাষা মেটে কি আশা?’ তাছাড়া এই সময় আর একজন কবি লিখেছিলেন ‘স্বদেশের গৌরব রবি গেল অস্তাচলে।
১৮০০-১৮৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলা কাব্যকে জাতীয় আন্দোলনের কাব্য হিসাবেও কোন কোন সাহিত্যিক আলাচনা করেছেন। ১৮৯৬ সালের পর থেকে বেশ কতকগুলি বছর গীতিকাররা স্বদেশী গানের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এপ্রসঙ্গে লিখেছেন ‘এযুগে এত গান লেখার স্বাভাবিক কারণও রয়েছে। নিজহাদয়ের আবেগ প্রেরণা অপরের হৃদয়ে পৌঁছে দেবার সরল পথটি হল সঙ্গীত। তাই সে যুগে অখ্যাত অসংখ্য গীতিকার গান রচনার কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। উল্লেখ্য, সমবেত সঙ্গীতের যেমন একটা আদর্শ আছে, তেমনি আছে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। আসলে অতিমাত্রায় ভাবায়ক এবং বাস্তব বহির্ভূত কোন কল্পনা থেকে এই পর্যায়ের গানের সৃষ্টি হয়নি। স্বদেশী সঙ্গীতের আদর্শ সমবেত সঙ্গীতের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই এই সব গান গাওয়া হত ঐক্যবদ্ধভাবে। যদিও অনেক গান একক কণ্ঠে গাওয়া হত। বিশেষ করে কবিগান বা অন্যান্য বাঙ্গাত্মক খান। সাধারণ মানুষের কাছে দেশাত্মবোধক মূল কথাগুলি পৌঁছে দিতে এবং উদ্বুদ্ধ করতে সহজ সরল প্রচলিত সুরকেই ব্যবহার করা হত। সে যুগে রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে ‘ছেড়েদে রেশমি চুড়ি’ (মুকুন্দ দাস) ‘আজি বাংলা দেশের হৃদয় হতে
কখন আপনি, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ (ডি এল রায়) ইত্যাদি গান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯০০ সালে লর্ড কার্জন শাসন ব্যবস্থা সুব্যবস্থিত করার নামে বঙ্গভঙ্গের জন্য প্রস্তাব হাফির করেন। ১৯০৫ সালের ২০ শে জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়। এই সময় উত্তাল আন্দোলন শুরু হয় সারা বাংলা জুড়ে। একদিকে বলিষ্ঠ আন্দোলন প্রতিবাদ অসহযোগিতা অন্যদিকে শিল্প ও সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে আন্দোলন ব্যাপক রূপ লাভ করে। এই প্রসঙ্গে সাহানাদেবী লিখেছেন এসময় জাতীয় আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী আপামর জনসাধারণ কন্ঠে তুলে নিল স্বদেশী গান্য দিকে দিকে শোনা
যাচ্ছে দেশমাতৃকার বন্দনা-সঙ্গীত নানা সম্মিলিত কণ্ঠে সুরে। তাদের আকুল করা গানে আমাদের পাগল করে দিচ্ছে। এই সময় রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘তোমারি করে সঁপিনু মা’ ‘একবার তোরা মা বলে ডাকা ইত্যাদি বহু গান। ১৯০৫ সালের ১৬ ই
অক্টোবর প্রচলন করেন রাখী বন্ধন উৎসব। বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি দল বেঁধে গাইতে গাইতে রাখি পরান রাস্তায়, গঙ্গার ঘাটে, চতুর্দিকে হাজার হাজার মানুষকে। এভাবেই স্বদেশী আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে স্বদেশী গান। পরবর্তী কালে অন্যান্য স্বদেশী গীতিকারদের মধ্যে রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে প্রচলিত বাংলা ভাষায় কোরাস বা সমবেত বাংলা গানের আধুনিক রীতির প্রবর্তন করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন গানের উদ্দীপনার ভাব অভিসহজেই মানুষের মনের মধ্যে সঞ্চারিত করা সম্ভব সমবেত সঙ্গীতের মাধ্যমে।
দিলীপ রায় তাঁর কোরাস গান সম্পর্কে বলেছেন- ‘কোরাস গানে তাঁর তুল্য শক্তিসত্তা আদ্যাবধি কেউ প্রকাশ করতে পারেনি। কারণ তাঁর সুর রচনার ভঙ্গি, প্রাণের উৎসাহ, আনন্দের পৌরুষ ছিল আশ্চর্য অদ্বিতীয়।’ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে সারা বাংলা
জুড়ে যখন তুমুল আন্দোলন শুরু হয়, শিল্প সাহিত্যেও দেশাত্মবোধ জাতীয় আন্দোলনকে আরো উদ্দীপনা যোগাতে থাকে। সেসময় স্বদেশীগান মুখে মুখে ফিরতে থাকে বাংলার যুবকদের। রাখী বন্ধন উৎসব যখন কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ঐক্যের আহ্বানকে সুদৃঢ় করে তুলেছে তখন পূর্ব বঙ্গেও স্বদেশীগান রচনা করে অনেক ছোটবড় নামি অ-নামি শিল্পী ও যুবকের দল গান বেঁধেছেন। বহুদিন ধরে এই জাতীয়তাবোধ কাজ করছে। শতশত গান ধ্বনিত হয়েছে লক্ষ নিযুত কণ্ঠে।
স্বদেশী আন্দোলনের যুগেই দেশাত্মবোধের পাশাপাশি সামাজিক শোষন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাগ্রত হয়েছে মানুষের চেতনা। নতুন একটা বাস্তবতা বোধ জেগে উঠেছে। দেশান্ববোধের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে আন্তর্জাতিকতাবোধ। এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে শিল্পীর রঙে তুলিতে কণ্ঠে লেখনিতে। ১৯২০ সালে শ্রেণী চেতনা ও আন্তর্জাতিকতা বোধ থেকে কমিউনিষ্ট পার্টির জন্মলাভ হয় এবং এই সময় থেকেই স্বদেশী আন্দোলনে নতুন চিন্তা চেতনা প্রবেশ করে। ফলে স্বদেশী সঙ্গীতের পাশাপাশি শ্রেণী চেতনা, আন্তর্জাতিকতা বোধ এবং বাস্তববাদী চিন্তাভাবনায় আর এক ধরণের গান রচিত হয়। যেগুলো হল গণ-সঙ্গীত। এই গানে সামাজিক বৈষম্য এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে।
নানা বাধা বিপত্তির মধ্যেই কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রেণী সচেতন মানুষের পরিধি বেড়ে চলে। ১৯৪৩ সালে এই ধরণের বাস্তববাদী ও প্রগতিশীল শিল্পীদের নিয়ে গঠিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। সারা ভারতের বিভিন্ন স্বদেশী বা দেশাত্মবোধক গানে স্বদেশ চেতনা ও পরাধীনতার বেদনা ফুটে উঠেছিল। অনেক গান আবার ধর্মীয় সংকীর্ণতায় ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তাই বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকলেও এ-সব গান শোষিত শ্রেণীর কাছে সংগ্রামের আহ্বান জানাল না।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথায় এ গানে দেশের মুক্তির সঙ্গে শোষন মুক্তির চিন্তার মিলন ঘটেনি।…….. স্বদেশ চেতনা যেখানে গণচেতনায় মিলিত হয়ে শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতার ভাবাদর্শের সাগরে মিশলো সেই মোহনাতেই গণ-সঙ্গীতের জন্ম।
এই সময় লোকসঙ্গীতের চিরাচরিত স্নিগ্ধ ধারায় গণসংগ্রামের অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে লাগল। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত বিপ্লব সংগঠিত হয়। তারফলে শ্রেণীচেতনা বেডে চলছিল। গণনাট্য সংঘ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই লোকসঙ্গীতের দূরে ও সহজ
ভাষায় মুক্তির গান রচিত হতে থাকে। ১৯৩৯-৪০ সালে শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী গুরুদাস পাল লিখলেন
‘জাগো নিপীড়িত জাগো সর্বহারা।
সময় থাকিতে হও সবে ভাই হুঁশিয়ার…..
রক্ত পতাকা লয়ে যতেক মানুষদ
বিশ্বভূবন ব্যাপী জ্বেলেছে প্রলয়ানন
ধনিক বনিকদল যাক চলে রসাতল
আমি এই ধরাতন হয়ে যাবে একাকার।
ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের শোষণের বিরুদ্ধে শ্রেণী চেতনার গান রচনা করলেন কবি রমেশ শীল।
আমার খুনে মোটর গাড়ি
তেতালা চৌতাল বাড়ি
আমার খুনে রেডিও আর বিজলিবাতি জ্বলে।
আমি কৃষক তুমি মজুর দিনে রাতে খাটি
দুই শক্তি এক হইলে তারা পিছু যাবে হটি
একসঙ্গে নিশ্বাস ছাড়ি
পর্বতে উড়াতে পারি
দুশমন চক্রে চাওনা ফিরি কী আছে তার মূলে?
এ সময় তাঁর লেখা আর একটি গানে তিনি লিখেছেন-
বাংলার কৃষক ভাইগণ হওরে চেতন…
শোষনকারী জমিদার, জমিদার না যমদুয়ার
লাঙল যার জমি তার, কৃষকের এই পণ।
গুরুদাসপাল তারপর লৌকিক পদ্ধতিটিকেই ভাবপ্রকাশের যোগ্য মাধ্যম বলে মনে করেছিলেন তাঁর এরকমই একটি তরজা গানে-
‘হায়রে হায় মান বাঁচানোর কি করি উপায়।
ঘুরে ফিরে পড়ছি এক জোচ্চরের পাল্লায়।
পুষলে পরে কাকের ছানা
কা ছাড়া কেউ কেষ্ট বলেনা
যতই বুলি শিখাও না ভাই তায়
ছুঁচোর গায়ের গন্ধ কি আর গোলাপ জলে যায়?
এছাড়ও মালিকের পক্ষ যারা নেয় তাদের বিরুদ্ধে কড়া কথা—
যেমন জলের স্বভাব নিম্নগতি
আগুনের স্বভাব পোড়া
বিড়ালের স্বভাব হাঁড়ি খাওয়া
পাখির স্বভাব ওড়া,
বেশ্যার স্বভাব যেমন ধারা চার আনাতে স্বামী
এদের স্বভাব তেমনিধারা ধনিকের গোলামি।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠার পর একটু একটু করে গণ-সঙ্গীতের প্রবর্তন হচ্ছিল। লোককবিরাও শ্রেণী চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানসিকতায় রচনা করেছিলেন গণসঙ্গীত। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হুঙ্কার ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীময়। এসময় ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতেই গণ-সঙ্গীতের জোয়ার এল ভারতে। ‘শিল্পীরা তখন সমসাময়িক নতুন রচনা ছাড়াও খুঁজতে লাগলেন পুরানো দিনের সমধর্মী কবিতা গান। যেসব রচনার মধ্যে আছে কোন না কেন গণচেতনার ভাব, তাঁরা সুর দিতে শুরু করলেন পুরোনো সেইসব লেখায়। (গণসঙ্গীত সংগ্রহ- সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত)।
সাম্রাজ্যবাদী শোষনের বিরুদ্ধে, যেমন ইংরেজদের ভারত-ছাড়ার জন্য দাবি উঠেছে, তেমনি যখন ভারতের পূর্ব প্রান্তে জাপানী আক্রমন আসন্ন হয়ে ওঠে তখন ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে লোক কবিদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় গণসঙ্গীত। এসময় কৃষক কবি নিবারন পণ্ডিত লেখেন,
শুনেন ভাই বলে যাই শুনেন দিয়া মন।
জাপানী দস্যুদের কথা করিব বর্ণন।দস্যু এলে দেশে
দস্যু এলে দেশে মারবে পিষে লুটে নিবে ধন
থাকবে না আর মান ইজ্জত ভাই হারাব জীবন।।
লোকসঙ্গীতের প্রবহমান ধারার সঙ্গে গণসঙ্গীত নিজেকে যুক্ত করেছে অনেকটাই। আসলে শ্রমজীবী মানুষের ভাব প্রকাশের প্রধান মধ্যমণিই হল লোকসঙ্গীত। স্বভাবতই লোকসঙ্গীতের এই ধারার সঙ্গে গণচেতনা যুক্ত হয়ে আদর্শ জীবনেবোধের উজ্জীবন
ঘটিয়েছে। লোকসঙ্গীতের প্রবহমান ধারা ছাড়াও গণসঙ্গীত প্রতিবাদী সুর সংগ্রহ করেছে দেশী বিদেশী বিভিন্ন সঙ্গীত থেকে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় তথা বাংলাগানে রবীন্দ্রনাথ সহ অনেক শিল্পীই দেশী ও বিদেশী সুরের সংমিশ্রনে বাংলা স্বদেশীগান রচনা
করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ, কাজী নজরুল প্রমুখ। তাঁদের দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের অনুসরণেও নিত্য নূতন সুরে গণসঙ্গীত রচিত হয়েছে। যেমন সলিল চৌধুরীর—
১।মানবোনা এ বন্ধনে মানবো না এ শৃঙ্খলে।
২। হেই সামালো।
৩। ও আলোর পথ যাত্রী।
৪। নওজোয়ান নওজোয়ান।
৫। ঢেউ উঠেছে কারা টুটছে।
দিলীপ সেনগুপ্ত-র লেখা-
১। এ লড়াই বাঁচার লড়াই।
২। এদেশ আমার এদেশ তোমার.
৩। ভাঙরে ভাঙরে ভাঙ
৪। পথে আজ নামতে হবে।
বাসুদেব দাশগুপ্ত-র
১। হুঁশিয়ার ও সাথী কিষাণ মজদুর ভাই সব হুঁশিয়ার।
অলোক সান্যাল-এর
১। সে আমার রক্তে ধোয়া দিন।
সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত
- শতফুল বিকশিত হোক।
করুন ভট্টাচার্য রচিত
- ও দুঃখী নহিয়া।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়-এর লাল রঙ দেখে কিছু লোক হয়; ইত্যাদি।
এসব গান দেশী বিদেশী সংমিশ্রনে গাওয়া হলেও মূলত সহজ ও অপেক্ষাকৃত পরিচিত সুরে পরিবেশিত হত। ফলে এই গানগুলিও অত্যধিক গ্রহণযোগ্য হয়েছিল বাংলার মানুষের।
শুধু গান কখনো গণ-আন্দোলনেকে বিকাশিত করতে পারেনি। কিন্তু গণআন্দোলনকে উদ্দীপিত করেছে এবং তাকে বিকশিত হতে সহযোগিতা করেছে। ১৯৪৫ সালে ভারত ভাগ করে স্বাধীনতা মনেপ্রাণে মেনে নেননি বাংলার মানুষ। গভীর যন্ত্রনা বুকে নিয়েই বহু মানুষ ছিন্নমূল হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে এসেছেন। আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে সারা জীবনের মতো। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিভেদকামীরা দাঙ্গা বাধিয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে সদর্থক বক্তব্য হাজির করেছে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। গণনাট্য সংঘের উৎসাহে বহু মানুষ গান নাটক রচনা করেছেন। এখানেও শ্রমজীবী মানুষেদের ঐক্যের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে মৌলবাদী প্রচেষ্টা তার বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত গাওয়া হয়েছে। একটা যুক্তিবাদী মানসিকতা ও শ্রেণীচেতনা গড়ে তোলার চেষ্টা চলেছে অবিরাম।
গণসঙ্গীত কখনো একক মানুষকে নিয়ে রচিত হয়নি। এখানে সমবেত আদর্শবোধ সবচেয়ে বেশি ব্যাপ্তি লাভ করেছে। আদিমযুগ থেকে শুরু করে সমবেত সঙ্গীতের পরিধি এবং আদর্শবোধ ক্রমশ ব্যাপকতর হয়েছে। আদিমযুগে গোষ্ঠী থেকে সমাজ, সমাজ থেকে ছোট ছোট এলাকা, এলাকা থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে দেশ দেশ থেকে বিশ্ব, এইভাবেই মানুষের সম্পর্কের ও কাজের পরিধি ক্রমশ বেড়েছে।
পাশাপাশি সঙ্গীতের মধ্যেও চিন্তা চেতনায় স্থান লাভ করেছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বোধ। এই কথার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা উঠে আসে একক সঙ্গীত সম্পর্কে। এক্ষেত্রে অনেকটা উল্টো ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। কেননা আদিম যুগ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত
সামাজিক পরিবর্তনের ধারাকে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তবে দেখা যাবে উৎপাদন।
ব্যবস্থা গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন জীবিকার পথ যেমন বিচিত্র ও প্রসারিত হয়েছে, তেমনি একটা শ্রেণী গড়ে উঠেছে যাদের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে ক্রমশ বেশি বেশি সম্পদ। এই শ্রেণীর হাতে অঢেল সম্পদ আর অফুরন্ত সময় ব্যক্তিগত চাহিদা।
ও ভোগ সুখের দিকে এই সমাজ ও মানুষকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করছে। এই সমাজ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রেরও জন্ম দিয়েছে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিমণ্ডলে তৈরি হয়েছে একক সঙ্গীত। অন্যদিকে অত্যাচার অবিচার-শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের সমবেত সংগ্রামের শেষ নেই। সংগ্রামী সমবেত গণসঙ্গীতের প্রেক্ষাপট রয়েছে এখানেই। এই সঙ্গীত সংগ্রামের ফসল, আবার তার
প্রেরণাও বটে।