A Drama Exploring the Delicate Balance Between Desires and Necessities

A Drama Exploring the Delicate Balance Between Desires and Necessities
Dr. Krisnapada Das

Abstract

Drama has always mirrored societal changes and served as a powerful tool for both entertainment and social reform. From the early influences of Charyapad and Sri Krishnakirtan, which drew from public life, drama evolved to reflect the socio-political currents of its time. Beginning with the British era, when theatre construction gained momentum, playwrights like Ramnarayan and Michael Madhusudan Dutt laid the foundation for modern drama by integrating epic themes and addressing illusions of traditional forms. Over time, drama transcended entertainment to become a medium for protest, reform, and societal commentary.

The socio-political upheavals of the 20th century, including the Partition of Bengal, world wars, and the emergence of movements such as the Communist Party of India, profoundly influenced dramatic narratives. Notable playwrights and directors like Rabindranath Tagore, Tulsi Lahiri, and Bijan Bhattacharya incorporated themes of survival, human struggle, and social justice into their works, reflecting the turbulent history of Bengal.

Despite the challenges posed by modern entertainment mediums such as television and digital platforms, drama continues to thrive through the dedication of individuals and groups committed to preserving its essence. The group theater movement, in particular, emerged as a courageous voice for life and truth, breaking away from traditional constraints and addressing the concerns of the common people. While urban theaters have flourished, the potential of rural and suburban drama remains largely untapped, necessitating further exploration and support to bridge this divide.

Key Words

Drama evolution, Charyapad, Sri Krishnakirtan, social reform, British period theater, group theater movement, socio-political impact, Rabindranath Tagore, rural and urban theater, modern entertainment challenges.

চাওয়া-পাওয়ার সীমানায় নাটক
ড. কৃষ্ণপদ দাস
নাট্যচর্চার সূচনা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। কেননা পদকর্তাদের লেখনীতে মুখ্য রয়েছে জন-জীবন। আবার এই জনজীবনই নাটকের প্রধান উপকরণ। সময়ের পরিবর্তনের ঢেউ নাটকের বিষয়েও পরিবর্তন এনে দিল। ব্রিটিশ আমল থেকেই এদেশে নাট্যশালা তৈরীর প্রবণতা দেখা যায়। ধনী জমিদার নাট্যশালা তৈরী করে নিজেকে মহান ভাবেনা সে সময়ের সকল নাট্যকার হিসেবে রামনারায়ণের নাম করতেই হবে। তারপর হার ধরলেন মধুসূদন। অলীক কুনাট্য থেকে নাটককে মুক্তি দিতে লিখলেন মহাকাব্যের ঘটনা অবলম্বনে নাটক। তার পরের ইতিহাস সকলের জানা। আমাদের দেশীয় রঙ্গালয়ে রামনারায়ণ প্রথম মৌলিক নাটক রচনা করেন – ‘কুলীন-কুল-সর্বস্ব’। বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত হয়। তখনও কিন্তু নাটকের মধ্যে শৌখিনতা, বিনোদন, সমাজ সংস্কারের বিষয় প্রাধান্য পেত। তারপর মৌলিক নাটকের বিকাশ শুরু হলে নাটক অন্য রূপ নিলো। আনন্দের উপকরণ ছাড়াও সমাজ সংস্কারের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠল নাটক। অস্ত্রের সেই ঝনঝনি দেখার জন্য তৈরী হল ১৮৭২ সালে জাতীয় নাট্যশালা বা National Theatre.
এর পরের ইতিহাস কারও অজানা নয়। ১৯০৫ যে বঙ্গভঙ্গ, ১৯১৪ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু, ১৯২১ যে মস্কোতে গঠিত ভারতের প্রবাসী কম্যুউনিস্ট পার্টি, ১৯২৩ যে AITUC-র প্রতিষ্ঠা, ১৯২৯ যে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা – এসবের মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবা সমাজের বুকে আকার নিল। সামাজিক এই চিত্র নাটকেরও স্থান করে নিল। অন্যদিকে অজানাকে জানার ইচ্ছা মানুষের সহজাত। কতরকম যন্ত্র আবিষ্কার হল। সুচতুর মানুষ যন্ত্র আর প্রযুক্তির কৌশলে মানবতার কণ্ঠ রোধ করতে চাইল – এ চিত্র দেখলাম রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকে। সমাজে ভাঙন প্রকট, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা তুঙ্গে এই সময়ের সমাজিক দায়বদ্ধতা তুলে নিলেন প্রগতি-লেখক-সংঘ-সময়কাল ১৯৩৬। উল্লেখযোগ্য অনেকেই স্বল্প সময়ে দু-একটি নাম বলতেই হয়। তুলসী লাহিড়ী, বিজন ভট্টাচার্য, বাদল সরকার, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মনোজ মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
১৯৩৯। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাংলার পরিস্থিতি উত্তাল। ১৯৪০ – ৫০ -এই দশ বছরে সামাজিক ও রাজনৈতিক সব পট ভূমি বদলে গেল। প্রাকৃতিক ঝড়-বন্যা, সৃষ্টি করা দুর্ভিক্ষ যাকে বলি ৫০ এর মন্বন্তর, লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেল, ছায়াসুনিবিড় শান্তিময় গ্রামীণ জীবন, অর্থনীতি সব ভেঙে চুরে তৈরী হল চলমান মুখর সংগ্রাম; অশান্ত জীবন-যাবন প্রণালী। এই পরিস্থিতিতে বাঁচার লড়াই চলে এলো নাটকের উপজীব্য হয়ে। সামাজিক দায়বদ্ধতায় জড়িত নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজন, বিভিন্ন নাট্যব্যক্তিত্ব সকলেই নাটককে দেশীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে দেশান্তরে ছড়িয়ে দিলেন। নাটক যেহেতু মানুষের কথা বলছে তাই এটা একটা প্ল্যাটফর্ম বা মিডিয়ার রূপ নিল। কিন্তু বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব জয়যাত্রায় সহজ বিনোদনের জন্য এসে গেল নানা টি.ভি. সিরিয়াল, দামী মোবাইল, ল্যাপটপ, দেশী-বিদেশী মনোরঞ্জনী চ্যানেল। বর্তমান প্রজন্মের একটা অংশ নাটকের দিক থএকে বা পথ-পরিশ্রম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ঠিকই; তবু আশার দিকও রয়েছে। নাট্যশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বেশ কিছু ঝকঝকে কৃতী ব্যক্তিত্ব সর্বদা চেষ্টা করেন যাচ্ছেন পড়াশুনা ও গবেষণার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য অনেকেই – কয়েকটি নাম বলি, সৌমিত্র বসু, দেবশঙ্কর হালদার, বিভাস চক্রবর্তী, নন্দন সেন, সম্প্রতি চলে গেলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, ঊষা গাঙ্গুলী প্রমুখ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে ভারতের জনজীবনে যে আমূল পরিবর্তন এসেছি, তার হাত ধরে তৈরী হল গ্রুপ থিয়েটার। গ্রুপ থিয়েটার জীবনের কথা বলতে সাহস দেখালো। সাহস দেখালো – শাসকও যদি অন্যায় বলে তার প্রতিবাদ করতে। গ্রুপ থিয়েটার আরও শেখালো অন্যায়ের প্রতিবাদ মানেই কিন্তু জঙ্গিপনা নয়। তৎকালীন সরকার নাট্যদলের টিকে থাকার জন্য বেশ কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলে কিন্তু তা সীমাবদ্ধ ছিল কেবল শহরের বুকে। শহুরে নাট্যদল প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হলেও জেলা বা শহরতলির নাট্যদলের অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তারা পিলসুজের মতো অন্ধকারেই রয়ে গেল। কেয়কটি নাটক আলোচনায় আমার বক্তব্য স্পষ্ট রূপ পাবে।
• দেবেশ রায়ের লেখা ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’। নাট্যবিষয়ক প্রান্তিক জনজীবনের সমস্যা। প্রান্তিক মানুষেরা চিরকাল অবহেলিত, নিবীড়িত। তাদের মাথা তুলে কথা ব বার যেন কোন অধিকার নেই। চিরদিন তো এভাবে যায় না। ঘা খেতে খেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় যখন, তখনই বাঘারু, কেলু, ফ্যাতারুরা অনুভব করে সামাজিক উন্নয়ন হয়, এম.এল.এ সাহেবকে নিয়ে হৈচৈ হয়, উন্নয়নের রথ উড়ে জলে কিন্তু কেউ জানতে চায় না উন্নয়নের পিছনে কাদের শ্রম ছিল ? কারা মাটি কাটল ? তবে না উন্নয়নের ধ্বজা উড়ল ! আসলে চিরকাল শাসকসমাজ এই সত্য এড়িয়ে যায় বলেও এই ধরণের বিষয় অবলম্বনে নাটক তৈরী হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
• ব্রাত্য বসুর লেখা ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকে ১৯৬০ – ৭০ দশকের রাজনৈতিক বন্দী সব্যসাচী সেন ১৮৭৬ সালে পুলিশি হেফাজত থএকে পালান – দীর্ঘ ২৬ বছর বাদে ফিরে আসেন এক কট্টর মার্কসবাদী নেতার ভূমিকায়। তিনিও অনুভব করেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তন করতে হয় ; নয়ত জীবন্মৃত হয়েই বেঁচে থাকতে হয়।
• অর্পিতা ঘোষের নির্দেশনায় পঞ্চমবৈদিক উপস্থাপন করে পশুখামার নাটকটি। মালিকের অত্যাচারে পশুখামারের পশুরাও যে বিপ্লবী হয়ে ওঠে, তারাও নিজেদের মতো বিধি তৈরী করে, ক্ষমতার লড়াইয়ে যে জেতে একচ্ছত্র অধিকার তার। সেই নিজের ইচ্ছামতো আইন তৈরী করে, পছন্দ না হলে সংশোধন করে, নিজেকে বাঁচিয়ে আইনের অপপ্রয়োগ করে অন্যদের ওপর। একটু ধৈর্য্য সহকারে দেখলেই বোধগম্য হবে এ নাটকের Call show যে বাতিল হবে এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।
• মনোজ মিত্রের নির্দেশনায় ‘অপারেশন ভোমরাগড়’ প্রযোজনা করে সুন্দরম্ নাট্যগোষ্ঠী। রূপকথার আদলে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে সরকারের পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে স্বজনপোষণের রূপটি তুলে ধরেছেন।
• কল্যাণীর ঋত্বিক সদনে অভিনীত হয় ‘হারিয়ে যায় মানুষ’ নাটকটি। সন্ত্রাসবাদের আদর্শে দীক্ষিত অনীক, সুহাস, রাহুল প্রমুখ। প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারেও বন্টনে সরকারী দুর্নীতি ধরা পড়তেই ওরা মাওবাদীর তকমা পায়। অথচ ওরা তো আমাদেরই কারোর ছেলে, কারো বন্ধু, তাই বা স্বামী। মাওবাদীর তকমায় হারিয়ে যায় মানুষ।
• সংগীত শিল্পী গওহরজানের জীবন নিয়ে লেখা ‘গওহরজান’ নাটক। ছোট বেলা থেকেই অসামান্য প্রতিভার অধিকারী গওহরজান। তাঁর শিল্পী সত্ত্বা যত সুন্দরই হোক, তাঁর নারীসত্তা সামাজিক ভাবে বঞ্চিত, নিপীড়িত, অবহেলিত। সাঙ্গীতিক আবহে বহরমপুরের প্রান্তিক দল গওহরজানের ট্রাজিক জীবন সংগ্রাম অভিনয় করে দেখালে দর্শকের চোখের কোন্ চিক্ চিক্ করে ওঠে।
• ঊষ্ণা গাঙ্গুলীর নির্দেশনায় ‘হাম মোখতারা’ নাটকে পাকিস্তানের এক নির্যাতিতা নারীর প্রতিবাদী সত্তা দেখানো হয়েছে। মৌলবীদের অহেতুক রোজ-নামচা থেকে বেরিয়ে এক নারী ‘মানুষ’ হিসেবে নারীর বিচার চেয়েছে পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের কাছে। খুব সহজ সরল কাহিনীও যে প্রতিবাদী চরিত্রের জন্ম দিতে পারে – তা দেখালেন বঙ্গকর্মীর কুশীলবেরা।
এতক্ষণ যে নাট্য কাহিনীগুলো অতি সংক্ষেপে উপস্থাপন করলাম এ থেকে এটা স্পষ্ট হল যে বাংলায় থিয়েটার কর্মীদের সম্ভাবনা ছিল অসীম, কিন্তু ছিল তাদের পেশাগত সমস্যা। এটা কেন হল? আমার মতে –
১. থিয়েটারের জন্য গভীর মনোযোগ ও অনুশীলন দরকার – যা চাকরী করে করা  সম্বব নয়।
২. চাকরী না করলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় – যা নিজের, পরিবারের তথা সমাজের পক্ষেও ক্ষতিকর।
৩. সরকারী অনুদান থাকলেও দর্শকের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করতেই হয়।
৪. প্রেক্ষাগৃহের ভাড়া, বিজ্ঞাপনের খরচ যোগানো অসম্ভব হলেও আপ্রাণ চেষ্টা করে দল আর্থিক ক্ষতি মেটাতে, কিন্তু সম্ভব হয় না।
৫. থিয়েটারকে সকল নাট্যপ্রেমীদের কাছে জীবিকা করে তুলতে সীমাবদ্ধতা হ্রাস পাবে বলেই মনে হয়।
নাটক জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আমাদের প্রতিটি নাট্যশিল্পীসত্তার দাবি থিয়েটারকে বাঁচাতেই হবে। সরকারকেই সেই গুরুদায়িত্ব নিতে হবে। মনে রাখতে হবে – নাট্যচর্চা কেবল শৌখিনতা নয়, বাণিজ্যীকরণ নয়, নাটক মানুষের জন্য মানুষের শিল্পীসত্তা জাগরণের জন্য, তার হাসি-কান্নার সহমর্মী হবার জন্য।
নাট্য সৃষ্টির ঊষাকালে নাটক ছিল মূলতঃ পৌরাণিক কাহিনী বা দেব-দেবীর নির্ভর। তারপর সময়ের পরিবর্তনে নাটক জীবনের কথা বলতে শুরু করল। সকলেই জানি, বাংলা সাহিত্য ধারার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম নাটক এবং একই সঙ্গে পাঠ ও অভিনয়ের মেলবন্ধন। বর্তমানে নাটকের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞাপন, থিয়েটার কোম্পানী, নাটকের কুশীলবেলা এবং দর্শক। নাটকের বিষয় তৈরী হয়েছে নাট্যকারদের ভিন্ন ভিন্ন সচেতনতা থেকে। নাটক যেহেতু দেশ-কাল-পাত্রের পরিপ্রেক্ষিত তাই দেশভাগ, স্বাধীনতা অর্জন, সন্ত্রাস, আন্দোলন, অধিকারবোধ সব উঠে এসেছে নাটকে। তাই একুশ শতকে বাংলা নাটকে প্রত্যাশা কি – এ প্রশ্নের সম্মুখীন হলে এককথায় উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন।
যে কোন সাহিত্যকর্ম সমাজ বাদ দিয়ে সম্ভবই নয়। নাটক ও সাহিত্য কর্ম – তাই সব দেশে সবকালে তৎকালীন প্রেক্ষিতকে নাটকের বিষয়বস্তু করে সমাজের দর্পণ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন নাট্যকারেরা। সাহেবদের হাত ধরে এদেশে নাটকর্চার সূত্রপাত। তখন অবশ্য নাটক ছিল কেবল শৌখিনতার তকমাধারী। ধীরে ধীরে নাটক জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ব্রিটিশদের সহযোগিতায় এদেশে বাবুসমাজ নাট্যশালা বা রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিলেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় লেবেডেফ সাহেব।
প্রসঙ্গত বলা ভালো, একুশ শতকে নাট্যচর্চা প্রসঙ্গে মূল্যবোধ বিশেষভাবে জায়গা করে নেয়। প্রকৃতপক্ষে মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে জীবনবোধ, জীবনচর্চা ও সমকালীন সভ্যতা-সাহিত্য। তাই মূল্যবোধ শব্দটি বড়ো আপেক্ষিক। আদিম যুগ থেকেই সমাজে পরিবর্তনের ঢেউ চলেছে সেই হিসেবে মূল্যবোধও পরিবর্তনশীল। আবার সমাজ বাদ দিয়ে সাহিত্য নাটক কিছুই হওয়া সম্ভব নয়, তাই সমাজের প্রতিটি ঘটনার খুঁটিনাটি মূল্যবোধ নাটকে স্থান পায় বলেই নাটক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যেমন – দেবেশ রায়ের ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’, কুন্তর মুখোপাধ্যায়ের ‘কালচক্র’ ইত্যাদি। যেমন – জ্যোৎস্নাময় ঘোষের লেখা ‘জিয়নপালা’ আসলে নাটক তো জীবনেরই অঙ্গ, তাই জীবনের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, রাজনীতি-সমাজনীতি সব এসেছে নাট্যকারের মূল্যবোধের পথ ধরে। নাট্যকার নন্দন, সেনের ‘বিয়ে গাউনি কাঁদন চাপা’ – এটি প্রান্তিক নারীর জীবন – যন্ত্রণার ছবি ; সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ব্রাত্যজন অভিনীত ‘রুদ্ধ সংগীত’ নাটক। সমাজের খুন, আত্মরক্ষা, অবৈধ-প্রেম, সন্তানের দায়িত্ব পালন না করার ছবি, যৌথ পরিবারের ভাঙন – কি আসেনি নাটকে ! যে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ আমাদের সংকটে ফেলেছে, – তার জন্য সভ্যতাগর্বী ক্ষমতালোভী মানুষেরাই দায়ী। এর ফলে কত কত বন্যপ্রাণী অবলুপ্তির পথে – এই বিষয় নিয়ে নাটক লিখলেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় ‘ধৃতবানসী’ – বহুরূপীর প্রযোজনা এটি। অর্থ আর ক্ষমতার লোভ মানুষকে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে বাধ্য করেছে। এই সব অসাম্য থেকে ব্যক্তি মানুষ ও সমাজকে কলুষমুক্ত করে তোলা নাট্যকারের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তবে নাটক ছাড়াও তো বিনোদনের অনেক সহজ এবং চটুল মাধ্যম এসে গেছে – তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নাটককে অবিরাম পরিশ্রম করতেই হবে। তবু বলব, নাটকের কেবল আনন্দদান মুখ্য উদ্দেশ্য নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাণিজ্যিক সফলতা, পেশাদারিত্ব, লাভ-ক্ষতির হিসেব এবং সমাজ-সংস্কার। নাট্যচর্চা আজ অনেকেরই পেশা। মন প্রাণ দিয়ে নাট্য শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে নেমেছন যাঁরা – তাঁদের চর্যাতেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে  নাটক  জীবনধর্মী  শিল্প হিসেবে মর্যাদা পাবে।  এটাই প্রত্যাশা, এটাই প্রাপ্তি।
তথ্যসূত্র
১) অদ্বিতীয় নাট্য সাপ্তাহিক, প্রতি বৃহস্পতি নাট্য মুখপত্র, বর্ষ – ২১, সংখ্যা ১০৪০, তারিখ – ০৯.০৬.২০১৬, ইব্রাহিম আলেকাজির মন্তব্য
২) নাট্য সংবাদ সাপ্তাহিক, প্রতি বৃহস্পতিবার নাট্য মুখপত্র, বর্ষ – ২১, সংখ্যা – ১০২৫, তারিখ – ২৫.০২.২০১৬, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস মন্তব্য করেছন
৪) বাংলা নাটক নাট্যতত্ত্ব ও রক্ষামঞ্চ প্রশাখা, ড. প্রদ্যোত সেুগুপ্ত, বর্ণালী, ৭৩, মহাত্মা গান্ধী রোড, কলকাতা – ৭০০০০৯
৫) নাট্যচিন্তা – বেঙ্গল লোলিত প্রিন্টার্স, প্রাঃলিঃ, ১০-বি, ক্রিক লেন, কলকাতা – ৭০০০১৪
৬) রঙ্গকর্মীর ‘হাম মোখতারা’, নাট্য মুখপত্র, বর্ষ ১৮, সংখ্যা ৮৭২, ৩১/০১/২০১৩
৭) নৃপেন্দ্র সাহা, ‘থিয়েটারের বাজার বা থিয়েটার বিপণনঃ একটি উৎকেন্দ্রিক প্রস্তাব, নাট্য আকাদেমি পত্রিকা সংখ্যা ১০, ২০০৪, পৃঃ ৭৮
৮) মনীশ মিত্র, ‘প্রসঙ্গঃ আজকের থিয়েটার, পঃ বঃ নাট্য আকাদেমি পত্রিকা সংখ্যা ১০, ২০০৪, পৃঃ ৯৪
৯) আশিস চট্টোপাধ্যায়, ‘তুই পেশাদার না মুই পেশাদার, নাট্য আকাদেমি পত্রিকা সংখ্যা ১০, ২০০৪, পৃঃ ৯৬
১০) রবিবাসরীয় জনতা – ২৩শে নভেম্বর, ১৯৮০-তে প্রকাশিত চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনা থেকে প্রাপ্ত।
১১) ‘The Times of India’, Thursday, 16 November 2017, তে ব্রাত্য বসুর মন্তব্য।
১২) নাট্টান্বেষী – সম্পাদক – জয়ন্ত মালাকার, ৪০-এ/১, উপেন্দ্রচন্দ্র ব্যানার্জি রোড, কলকাতা – ৭০০০৫৪
ড. কৃষ্ণপদ দাস
৪৩৯, কালিকাপুর রোড, পোঃ মুকুন্দপুর,
২ নং ইস্টএন্ড পার্ক, ফ্ল্যাট নম্বর (জি-১),
কলকাতা – ৭০০০৯৯
ফোন নম্বর – 7003787726 / 9836680333
E-mail : krishnapadadas57@gmail.com

Poush Mela

Nandita Basu Sarjajari
Assistant Professor, Department of Rabindra Sangeet, Dance and Drama,
Sangeet Bhavan, Visva-Bharati, Santiniketan

Abstract : The Poush Mela of Santiniketan, inaugurated by Maharshi Debendranath Tagore in 1894, is a significant cultural and spiritual festival of Bengal. It marks the anniversary of Debendranath’s initiation into Brahmanism, influenced by Raja Rammohan Roy’s monotheistic reform movement during the Bengal Renaissance. The event celebrates religious harmony and promotes rural arts and crafts through interfaith dialogues and vibrant marketplaces. The Santiniketan Ashram, envisioned under the serene Chatim trees, reflects Debendranath’s spiritual revelations and ideals. Over the years, Poush Mela has grown into a unique cultural confluence, showcasing performances like Baul songs, Kirtans, Jatra, and traditional crafts, symbolizing Bengal’s diverse heritage.

Key Words

Poush Mela, Maharshi Debendranath Tagore, Brahmanism, Santiniketan Ashram, Bengal Renaissance, Religious Harmony, Rural Arts, Baul Songs, Rabindranath Tagore, Cultural Heritage

পৌষমেলা
নন্দিতা বসু সর্বাধিকারী
সহকারী অধ্যাপক, রবীন্দ্রসংগীত, নৃত্য ও নাটক বিভাগ,
সংগীত ভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা বাংলার একটি অতি জনপ্রিয় উৎসব। ৭ পৌষ হল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার দিন।
বঙ্গীয় রেনেসাঁর সময় রামমোহন রায়ের একেশ্বরবাদী ধর্মসংস্কারক আন্দোলনের দ্বারা প্রভূত আকৃষ্ট হয়ে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন ১৮৪২ সালে, অক্ষয়কুমার দত্ত ছাড়াও আরও কুড়িজন সহ। ১৮৪৩ খৃঃ থেকে প্রথম দীক্ষাপদ্ধতি ব্রাহ্মসমাজে প্রবর্তিত হয়। ১৮৪৪ খৃ দেবেন্দ্রনাথ অক্ষয় দত্ত ও অন্যান্যরা রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মধর্ম তখনও পর্যন্ত হিন্দু ধর্মেরই অন্তর্গত ছিল। দেবেন্দ্রনাথের ধ্যানের আসন পেতেছিলেন আদিগন্ত বিস্তৃত নির্জনতার মাঝে দুটি ছাতিমগাছের তলায়। সেখানেই একদা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন –
‘তিনি আমার প্রাণের আরাম
মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।’
দীর্ঘকাল এই ছাতিমতলায় নির্মিত বেদীর উপর বসে তিনি ধ্যান করেছেন ও সূর্যাস্তের রঙের খেলা নিরীক্ষণ করেছেন। ধীরে ধীরে এই সুপবিত্র স্থানকে কেন্দ্র ক’রে গড়ে তুলতে শুরু করেন শান্তিনিকেতন আশ্রম। মহর্ষি ১৯০৫-এ দেহ রাখলেও শান্তিনিকেতনে তাঁর শেষ আসা ১৮৮৩ খৃঃ-র শেষ দিকে। এরপর ১৮৮৮ খৃঃ-এ ৮ মার্চ ট্রাস্ট ডীড গঠন ক’রে শান্তিনিকেতন বাড়ি ও তার সংলগ্ন ২০ বিঘা জমি সর্বসাধারণের হাতে তুলে দেন। ঐ ট্রাস্ট ডীড অনুযায়ীবলা হয় যে একজন বা অনেকে একত্র হয়ে নিরাকার পরব্রহ্মের উপাসনা করতে পারবেন শান্তিনিকেতন গৃহের অভ্যন্তরে। এ ছাড়া অন্য কোনও সম্প্রদায়ের অভীষ্ট দেবতা বা কোনও বিগ্রহ বা চিত্র বা চিহ্নের পূজা অর্থাৎ পৌত্তলিক আরাধনা এই শান্তিনিকেতনে হবে না। আমিষ ভোজনও নিষিদ্ধ ছিল এই অঞ্চলে। কোনও ধর্মের উপাস্য দেবতার কোনও প্রকার নিন্দা বা অবমাননা করা যাবে না বলেও বলা হয়। কোনওপ্রকার অপবিত্র আমোদ-প্রমোদ হবে না – এও স্পষ্ট বলা হয়েছে। বলা হয় – জনসাধারণের মধ্যে ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য ট্রাস্টী থেকে প্রতি বছর একটি মেলার আয়োজন করা হবে যেখানে সবধর্মের সাধুপুরুষরা এসে একত্রে ধর্মালাপ করতে পারবেন।
১৯ অক্টোবর, ১৮৮৮ আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হবার দুবছর পরে শান্তিনিকেতন গৃহের নিকটেই নিত্য উপাসনার জন্য একটি ব্রাহ্মমন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৯০ সালে তার ভিত্তি স্থাপনের একবছরের মধ্যে অপূর্ব একটি উপাসনা গৃহ লৌহস্তম্ভর কাঠামোয় বিচিত্র বর্ণের কাচ দিয়ে নির্মিত হয়, অভ্যন্তরের মেঝে শ্বেতপাথরের ও বহিরাঙ্গন ও সিঁড়িগুলি বেলেপাথরের। চারদিকে চারটি গেটসহ লোহার রেলিং দ্বারা সমগ্র মন্দিরটি বেষ্টিত। দক্ষিণ গেটে লাগানো ঘন্টার ধ্বনি দিয়েই উপাসনা শুরু হয়।
মন্দির নির্মাণ শেষ হলে মহা সমারোহে তা প্রতিষ্ঠা হয়, তার দিনও ৭ পৌষ ১৮৯১। এই উপলক্ষে কলকাতা থেকে বহু শত মানুষের সমাগম ঘটে। দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠাপত্র পাঠ করে সর্বসাধারণের জন্য মন্দিরের দ্বার উদ্‌ঘাটন করে দেন। রবীন্দ্রনাথ সংগীত পরিবেশন করে সকলকে পরম তৃপ্তিদান করেন। কলকাতা থেকে আনা ব্যাটারীর আলোয় মন্দির প্রাঙ্গন আলোকিত করা হয়েছিল।
এই পবিত্র দিনকে উপলক্ষ ক’রে মহর্ষি ১৮৯৪ সালে এক মেলার প্রবর্তন করেছিলেন যার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমতঃ এক ধর্ম-সম্মেলন করা যেখানে দেশের বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষজন একত্রে মিলিত হবেন ও ধর্মালোচনা করবেন। এইভাবে এক সমন্বয়ের পরিবেশ স্থাপিত হবে। দ্বিতীয়তঃ, গ্রামের মানুষজন তাঁদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এই মেলায় বেচা-কেনার সুযোগ পাবেন। তার সঙ্গে হস্তশিল্প কুটীরের বিচিত্র শিল্পদ্রব্যগুলি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবে। নগরের মানুষজনও গ্রামের শিল্প সম্বন্ধে অবহিত হবে। মেলার সঙ্গে গ্রামীণ কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিবিড়ভাবে সংযুক্ত।
প্রথম যুগে পৌষমেলা বসত উপাসনা-মন্দিরের পার্শ্বস্থ মাঠে, উত্তরায়ণের পুব দিকে।
রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় এই মেলাতে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে জনসমাজে তুলে ধরার প্রয়াস শুরু হয়। কীর্তন, বাউল, কবিগান, পাঁচালি, যাত্রা প্রভৃতির আসর বসতে লাগল এই মেলায়। রবীন্দ্রনাথ নিজে নীলকণ্ঠের যাত্রা দেখতে উপস্থিত থেকেছেন। উত্তরায়ণের গা ঘেঁষে বসত সার্কাসের তাঁবু। মিষ্টির দোকান অবশ্য থাকত। মন্দিরের গেটের বাঁপাশে বটতলায় বাউলের আখড়া বসত যেখানে প্রধান আকর্ষণ ছিলেন নবনী দাস বাউল। বাউল গানের উদাস করা মরমীয়া সুরে মনের মানুষের সন্ধান খোঁজা হত। বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিয়ালরাও এই মেলায় অংশগ্রহণ করতেন। ক্রমে এই মেলার আয়তন বৃদ্ধি পেতে থাকে। গোয়ালপাড়া গ্রামের দিকে যাবার পথের দিকে রাস্তার ধারে হাঁড়ি, কলসী, কাঠের দোকান বসত। বিশ্বভারতীর স্টলে বই আর শিল্পসদনের দোকানে শ্রীনিকেতনে তৈরী শিল্পসামগ্রী বস্ত্রবিপনি বিক্রি হত।
দিন যাবার সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে পৌষমেলার স্থান পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে পুরনো মেলার মাঠ থেকে স্থানান্তরিত হল পূর্বপল্লীর মেলার মাঠে। ৭ পৌষ সকালে প্রারম্ভিক প্রার্থনা-উপাসনারও স্থানান্তর ঘটে – মন্দির থেকে ছাতিমতলা।
বর্তমানে এই মেলার আকার বহুগুণ বর্ধিত হয়েছে। দোকানের সংখ্যা কয়েক শোতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পৌষমেলা যে পৌষ-উৎসবকে কেন্দ্র ক’রে গড়ে উঠেছিল, তার আকর্ষণও কিছুমাত্র কম নয়।
পৌষমেলা মাঠের বিনোদন মঞ্চে লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি সমান্তরালভাবে আয়োজন হতে থাকে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব কিছু অনুষ্ঠান। বিশ্বভারতী কর্মীমণ্ডলী দ্বারা পরিচালিত এই অনুষ্ঠানগুলি পৌষ উৎসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
৬ পৌষ সন্ধ্যা-রাত থেকে শান্তিনিকেতন-গৃহ থেকে বাজানো সানাইয়ের সুরের মূর্ছনায় সারা আশ্রম মুখরিত হয়ে ওঠে। অংশগ্রহণকারী এবং দর্শক, শ্রোতৃমণ্ডলী সকলেই শ্বেতবস্ত্র পরিহিত হয়ে ছাতিমতলায় আসেন।
এই সানাই পৌষ-উৎসবের প্রত্যেক দিনই মাঝে-মধ্যেই বাজানো হয়ে থাকে। ৬ পৌষ রাত ৯টায় আশ্রমিকরা আশ্রমের পথে পথে বৈতালিক করেন রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে –
‘আজি যত তারা তব আকাশে
সবে মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে।’
আবার ৭ পৌষ ভোর ৫টায় উৎসবের সূচনা হয় বৈতালিকের মাধ্যমে। এদিন আশ্রম প্রদক্ষিণ করা হয় ‘মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে’ গানটি গাইতে গাইতে। এই দিনই সকাল ৭.৩০ মিনিটে শান্তিনিকেতনের প্রাণকেন্দ্র ছাতিমতলায় উপাসনার আয়োজন হয়। সেখানে ব্রহ্মসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, মন্ত্রোচ্চারণ, আচার্যের (উপাচার্য মহাশয়ের) ভাষণসহ এই উপাসনা সংঘটিত হয়ে থাকে। বহু লোকসমাগম ঘটে এই মনোরম প্রার্থনা-সভার অভিজ্ঞতা লাভ করার উদ্দেশ্যে। বিশ্বভারতীর সংগীতভবনের ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপক-অধ্যাপিকা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। গাম্ভীর্যপূর্ণ ও নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ উপাসনা অনুষ্ঠানটি আজও তার ঐতিহ্য বহন ক’রে চলেছে। অনুষ্ঠান শেষে সমবেত সকলে ছাতিমতলার মঞ্চ প্রদক্ষিণ করেন ‘কর তাঁর নাম গান যতদিন রহে দেহে প্রাণ’ – দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটি গাইতে গাইতে। এরপর এখান থেকেই সবাই ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি গাইতে গাইতে উত্তরায়ণ প্রাঙ্গনে (যেখানে রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি গৃহ বর্তমান) যান প্রণাম নিবেদন করতে।
সন্ধ্যায় ছাতিমতলা ও আশ্রম প্রাঙ্গনে মোমবাতির আলো দিয়ে আলোকসজ্জা হয়, সেও এক অপূর্ব শোভা সৃজন করে। ৮ পৌষ হল বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা দিবস। সেদিন সকাল ৮টায় আম্রকুঞ্জে আয়োজিত হয় পাঠভবন ও শিক্ষাসত্র অর্থাৎ বিশ্বভারতীর দুটি বিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব। এই অনুষ্ঠানটিও অতি মনোরম ভাবে তার নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসরণ ক’রে পালিত হয়। পূর্বে এই দিনেই বিশ্বভারতীর বার্ষিক সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠিত হত, যেখানে বিশ্বভারতীর আচার্য (প্রথামতন ভারতের প্রধানমন্ত্রী)উপস্থিত থেকে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের সমাবৃত করতেন। কিন্তু মেলার প্রচণ্ড ভীড় এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তার কারণে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন এই মেলার সময় না হয়ে বছরের অন্য কোনও সময়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৮ পৌষ দ্বিপ্রহরে ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয় মেলামাঠ সংলগ্ন দর্শনবিভাগে যেখানে বিশিষ্ট কোনও পণ্ডিত ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ব্রাহ্মধর্ম সংক্রান্ত বক্তৃতাদানের জন্য। ৮ পৌষ-ই সন্ধ্যায় মেলাপ্রাঙ্গনে আয়োজিত হত বাজি প্রদর্শন। এর আকর্ষণে গ্রামগঞ্জ থেকে অগণিত মানুষের সমাগম ঘটত। প্রতি বৎসর নতুন নতুন প্রকারের কিছু বাজি দর্শকরা উপভোগ করতেন। সেই বাজিতে থাকত দেবেন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ, যা বহুক্ষণ নীল আলোয় জ্বল্‌জ্বল্ করতে থাকত। বাজি শেষে জাহাজ ও দুর্গের মধ্যে যুদ্ধ হত, গোলাগুলি ছোঁড়াছুড়ি চলত বহুক্ষণ, কে জয়লাভ করে জাহাজ না দুর্গ তা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা কাজ করত। কিন্তু কয়েক বছর পূর্বে শব্দ-দূষণের জন্য বাজিপ্রদর্শন নিষিদ্ধ ক’রে দেওয়া হয়। ৯ পৌষ দিনটি শান্তিনিকেতনে এক বিশেষ ভাবনায় গাঁথা। উৎসবের দিনেও আমরা আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে যাওয়া আশ্রমিকদের ভুলিনি – সেই কথা স্মরণে রেখে পরলোকগত আশ্রমবন্ধুদের উদ্দেশ্যে ৯ পৌষ দিনটি উৎসর্গ করা হয়। আম্রকুঞ্জে অতি আড়ম্বরহীন একটি অনুষ্ঠানে বিগত বছরে পরলোকগতদের নাম উল্লেখ ক’রে স্মৃতিতর্পণ করা হয়; সংগীতও পরিবেশিত হয় – আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ এবং ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই।’ এই উপলক্ষ্যেই অপরাহ্নে পাঠভবন কিচেনে বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী ও বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের জন্য সকলে একত্রে হবিষ্যান্ন খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। মধ্যাহ্ন বেলায় মেলা প্রাঙ্গননেসাঁওতালদের খেলাধুলার আয়োজন থাকে। তাঁরা সেজেগুজে তীরধনুক, ধামসা, মাদল ইত্যাদি নিয়ে দলে দলে যোগদান করতে আসেন মহা উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে।
সন্ধ্যায় খৃষ্টোৎসব উপলক্ষ্যে উপাসনাগৃহে মোমবাতি দিয়ে সাজিয়ে রবীন্দ্রসংগীত, ক্যারল, ভাষণ, মন্ত্রপাঠ, বাইবেল থেকে অংশবিশেষ পাঠ প্রভৃতির মাধ্যমে এই মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়। মন্দিরের শ্বেতপাথরের মেঝেতে অপূর্ব আলপনা আঁকা হয়। রঙিন কাচের মন্দিরটি মোমবাতির আলোয়, চার্চসঙ্গীতে, গানে, মন্ত্রপাঠে যেন এক অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অগণিত মানুষজন একত্রিত হয়ে এখানে যীশুখ্রীষ্টকে তাঁদের অন্তরের প্রণাম নিবেদন করেন। উপাসনা শেষে সকলে মোমবাতি হাতে নিয়ে ‘মোর হৃদয়ে গোপন বিজন ঘরে’ সঙ্গীতটি গাইতে গাইতে ছাতিমতলায় যান।
এই কদিন মেলাপ্রাঙ্গনে সকাল থেকে রাত্রি অবধি বিনোদন-মঞ্চে চলতে থাকে বিবিধ অনুষ্ঠান – যেমন বাউল, কীর্তন, পাঁচালি, কবিগান, রায়বেঁশে নাচ, ছৌ-নাচ, ফকিরি গান, আলকাপ ইত্যাদি। সকাল থেকে রাত অবধি স্বর্গীয় শান্তিদেব ঘোষ মহাশয় এই বিনোদন মঞ্চে বসে থাকতেন ও পরিচালনাকার্যে সাহায্য করতেন।
অধিক রাত্রে থাকে যাত্রাপালা যা দেখতে প্রভূত উৎসাহ দেখা যায় জনগণের মধ্যে। কয়েক বছর আগে অবধি চলচ্চিত্র দেখানোরও প্রচলন ছিল। মেলাপ্রাঙ্গনে ঢুকতেই স্বেচ্ছাসেবক দফতর বসে, যেখান থেকে মাইক্রোফোনে নানান ঘোষণা চলতে থাকতে সারাদিন ধরে। জেলা পুলিশ বিভিন্নভাবে মেলা সুশৃঙ্খলভাবে যাতে পরিচালিত হয়, সে ব্যাপারে সচেতন ও তৎপর থাকেন। জেলা স্বাস্থ শিবির-এর স্টলে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। এছাড়া ব্যাঙ্ক ও কৃষি উন্নয়নকল্পে স্টল দেওয়া হয়। মেলার পূর্বপ্রান্তে থাকে বিশ্বভারতীর প্রদর্শণী ,সেখানে বিশ্বভারতীর নানা বিভাগের কর্মধারা প্রদর্শিত হয়ে থাকে – যেমন কলাভবন, রবীন্দ্রভবন, গ্রাম সম্প্রসারণ কেন্দ্র, সাংবাদিকতা ও সমাজ মাধ্যম বিভাগ, N.C.C. প্রভৃতি।
শ্রীনিকেতনের শিল্পসদনের বস্ত্রাদি, শিল্পসামগ্রী ও পুস্তক বিপণনের ব্যবস্থাও থাকে। উদ্যানবিভাগ প্রদর্শনীটিকে ফুলের সমাহারে সাজিয়ে তোলেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৌষমেলার আয়তন যেমন বেড়েছে, বহু পরিবর্তনও ঘটেছে।
মেলার বিশেষ আকর্ষণ কাঠের নাগরদোলা মেলা ঢোকার মুখেই ডানদিকে সার দিয়ে বসত। তার ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ সকলকে আকর্ষণ করত। কিন্তু তার রোমাঞ্চ আজ হারিয়ে গেছে বিভিন্ন আধুনিক rides-এর কাছে। মেলার পিছনদিকে বাঁদিকে বসে বিশালাকার giant wheels, কলম্বাস ইত্যাদি। গরুর গাড়ির জায়গা নিয়েছে চারচাকা গাড়ি, লরি।
এই মেলাতে কত যে বিচিত্র ধরনের সামগ্রীর কেনাবেচা চলে, তা লক্ষ্য করলে বিস্ময় জাগে। কারুশিল্প, জামাকাপড়, কাশ্মীর থেকে গরম শাল ও গরম পোষাক, গয়নাগাঁটি, কাঁথাস্টিচের শাড়ি ও অন্যান্য জিনিসপত্র, বিভিন্ন প্রকার খেলনা, ঘর-সাজানো সামগ্রী বিচিত্র রকমারি পণ্যের সমাহার। বিভিন্ন প্রদেশ থেকেও বস্ত্র ভাণ্ডার ও শিল্পসামগ্রী নিয়ে হাজির হন বিক্রেতারা। একদিকে যেমন টেলিভিশন, মোটরগাড়িও বিক্রি হচ্ছে, অপরদিকে সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যাদি যেমন হাতা-খুন্তী, কলসি-হাঁড়ি, লোহালক্কড়ের জিনিস থেকে কাঠের খাট, টেবিল-চেয়ার, দরজা-জানলা বাঁশের ঝুড়ি সস্তায় হরেক মালের দোকান সবই হাজির। মহিলাদের বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় রূপদস্তার গয়না বা কাচের চুড়ি ও পুঁতির গয়নার দোকানে। ডোকরার বিচিত্র কাজ নিয়ে ছোট ছোট বিক্রেতারা স্টল না ক’রে মেলার মাঠেই বসেন তাঁদের সামগ্রী নিয়ে। কয়েক বছর ধরে পটের তৈরী নানা জিনিসও বিক্রি হচ্ছে।
মেলার দক্ষিণপ্রান্তে বসে সার্কাস, নানান কৌশল দেখানোর খেলা, মরণকুপ, জন্তু-জানোয়ারের চিড়িয়াখানা ইত্যাদি হরেক আকর্ষণ। জিলিপি, পাঁপড়ভাজা, খাজা-গজা, বাদাম-ভাজা, ভেলপুরি, ফুচকা প্রভৃতি বিচিত্র খাওয়ার দোকান। মেলার পশ্চিম সারি ধ’রে বসে যাবতীয় রেস্টুরেন্ট বা খাবার দোকান। বেলুন আর চোখ-ধাঁধানো আলোয় মেলাপ্রাঙ্গন ঝল্‌মল্ করে, বিভিন্ন দোকান থেকে ভেসে আসা মাইকে বিচিত্র গান আর জনগণের কোলাহল হৈ-হট্টগোলে মেলা গম্‌গম্ করতে থাকে। দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মেলায় কদিন আনন্দ করতে আসেন, এ যেন এক মহামিলন যজ্ঞ।
১৯৯৪তে এই মেলার শতবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার এই পৌষমেলাকে জাতীয় মেলা হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। ঐ বছর এবং তারপর কয়েক বছর পুরনো মেলার মাঠেও  দীর্ঘদিন ধ’রে এই মেলা তিনদিনের হয়ে আসছে যদিও ১০ পৌষ জল ও বিদ্যুৎ-সরবরাহ আরও একদিনের জন্য বাড়ানো হয়ে থাকে। তার পরেও ভাঙা মেলা হিসেবে এই মেলা আরও সপ্তাহখানেক চলে। নতুন মাস শুরু হলে মাইনেপত্তর পেলে সাধারণ মানুষজনের কেনাকাটা করা সুবিধা হয়। দলে দলে আশপাশ থেকে গ্রামের মানুষজন আসতে থাকেন ভাঙা মেলায় দরদাম করে সারা বছরের প্রয়োজনীয় বাজার করতে।
ক্রমে মেলার রোশনাই কমে আসে, দোকান-পাট উঠতে শুরু করে, দোকানীরা আবার অন্য কোনও মেলার উদ্দেশ্যে দোকানপাট গুটিয়ে বিদায় নেন। পরিত্যক্ত মেলার মাঠে তখন শুধুই আবর্জনার পাহাড়। শীঘ্রই তা পরিষ্কার করার বন্দোবস্ত হয়।এই বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও বিশ্বভারতী র যৌথ উদ্যোগে পৌষমেলা ছদিনের জন্য আয়োজন করা হয় ও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ভাবে সম্পন্ন হয়।
আবার একবছরের অপেক্ষা পৌষমেলার জন্য। সব দিক বিবেচনা করলে পৌষ-উৎসব তথা পৌষমেলা বাংলার একটি অন্যন্য উৎসব যার তুলনা আমরা অন্যত্র কোথাও পাব না।
তথ্যসূত্র : শান্তিনিকেতন (সংকলন ও সম্পাদনা : গৌতম ভট্টাচার্য); পৌষমেলা, ১৪১৫

Rabindranath Tagore and Vaishnava  Literature

Dr. Srabani Sen
                               Associate Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College
e-mail-srabanisn1@gmail.com  Mobile no- 6290855102
Vaishnava Literature mainly deals with Vaishnava religion and philosophy. Rabindranath Tagore was influenced by Vaishnava literature and philosophy.Tagore was deeply impressed by the works of Govinda Das and wrote many Vaishnava and Baul pieces. In Bhanusingher Padavali literary concepts having an influence of Vaishnava lyrics. Bhanusingher Padavali was composed in Brajabuli language. Tagore emphasizes similarities between Vaishnava Soul Force and Tagore’s Maanvika Bhuma points out the philosophical significance in human- nature relationship.
পদাবলী সাহিত্য  ও রবীন্দ্রনাথ
বাংলা সাহিত্যে ষোড়শ ও সপ্তদশ – এই দুই শতক জুড়ে মহাজন কবিদের হাতে বৈষ্ণব পদাবলী শ্রেষ্ঠ নমুনাগুলো রচিত হয়েছিল। বৈষ্ণব পদাবলী সুর-সংযোগে গীত হত- এই গানই ‘পদাবলী কীর্তন’। বৈষ্ণব-পদাবলীর পরমরসাস্বাদক শ্রীচৈতন্যদেবের উদার ধর্মভাব ও মানবপ্রেমের প্রতিও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বৈষ্ণব-পদাবলীর বিকাশ ছিল শ্রীচৈতন্যদেবের বহু পূর্ব থেকে এবং বিদগ্ধ পদাবলী- রচয়িতা কবি জয়দেব, চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি  ছিলেন শ্রীচৈতন্যের পরম অনুসারী।
বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি কবির নিবিড় আকর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ভানুসিংহ-ঠাকুরের পদাবলী’। ‘ভানুসিংহ-ঠাকুরের পদাবলী’ বৈষ্ণব কাব্যের অনুকরণপ্রিয়তার নিদর্শন নয়, বরং বৈষ্ণবকাব্যরসলোভী মনের এক স্বাভাবিক প্রেরণারই পরিচায়ক – যা ছন্দ ও ভাষার উপর তার  অধিকারকেই ব্যক্ত করেছে। কবির স্বতঃস্ফূর্ত ভাবোচ্ছলতা, দার্শনিক মনোবৃত্তি ও গভীর রসোপলব্ধি তাঁর রচনাকে নিছক অনুকরণতাপ্রসূত ভাবক্লিষ্টতা ও ব্যঞ্জনার দৈন্য হতে সচ্ছন্দভাবে মুক্ত করে দিয়েছে ।
বৈষ্ণব-পদাবলী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রথম কৌতূহল উদ্দীপিত হয়েছিল ‘প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ’ পড়ে। গীতিকবিতাগুলো সম্বন্ধে কিশোরবয়স থেকে রবীন্দ্রনাথের কৌতূহল ছিল অসীম। ‘প্রাচীন কাব্য-সংগ্রহ’ গ্রন্থে সংকলিত বৈষ্ণব পদগুলোর মধ্যে চন্ডীদাস, বিদ্যাবতী ও গোবিন্দ দাসের রচনাগুলি কিশোর রবীন্দ্রনাথকে সর্বাধিক আকৃষ্ট করেছিল এবং বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্যবহৃত ব্রজবুলি ভাষার অর্থ বিশ্লেষণ করে রসাস্বাদ করেন এবং চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের পদগুলো পড়ে  মুগ্ধ হন। এই কবিত্রয়ের মধ্যে কবি বিদ্যাপতির উপর রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিদ্যাপতির কবিতার শব্দঝংকার,  ছন্দগ্রন্থনা  ও চন্ডীদাসের তুলনায় অগভীর কাব্যভাবনার প্রভাব ভানুসিংহের বিভিন্ন পদে লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন আলোচনায়, চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতি অপেক্ষা চন্ডীদাসকে অনেক উচ্চতর আসন দান করেছেন। চন্ডীদাসের কাব্যের  Romantic melancholy ও গীতিময়তা রবীন্দ্রনাথকে বেশি স্পর্শ করেছে।
এরপরই রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীর অনুসরণে পদ রচনা শুরু করেন। কিশোর কবি প্রাচীন কবিদের ভাষাও আঙ্গিকে লেখেন বিশুদ্ধ পদ। ইংরেজ বালক-কবি চ্যাটার্টনের দুঃসাহসিক সাহিত্য-প্রচেষ্টার কাহিনী বালক রবীন্দ্রনাথের মনে অনুপ্রেরণার আগুন জ্বালিয়েছিল। চ্যাটার্টন প্রাচীন ইংরেজ কবিদের নকল করে বহুসংখ্যক কবিতা রচনা করে ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন। সে রকমই প্রাচীন কবিদের অনুসরণে বালক রবীন্দ্রনাথ প্রতি পদের ভণিতায় ‘ভানুসিংহ’ ছদ্মনামটি জুড়ে দেন, এবং অর্থ বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দেন ‘ ভানুসিংহ’ ও ‘রবীন্দ্রনাথ’ সমার্থক।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ষোল বছর, ‘ভারতী’ পত্রিকায় ভানুসিংহের প্রথম সাতটি পদ প্রকাশিত হয়। বাকি তেরোটি পদ প্রকাশিত হয় তার পঁচিশ বছর বয়স কালের মধ্যে। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘ ভানুসিংহেরপদাবলী ছোট বয়স থেকে অপেক্ষাকৃত বড় বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকালের সূত্রে গাঁথা।’
যে বৈষ্ণবীও তত্ত্বাদর্শে নিষ্ঠাবান থেকে মহাজন পদকর্তাগণ পদ রচনা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তা থেকে অনেক দূরে। মহাজন- কবিদের মতে বৈষ্ণব পদাবলী সাধারণ নরনারী লৌকিক প্রেমের কাব্য নয়; রাধাও কৃষ্ণের প্রেমলীলা একটি রূপ মাত্র —এর মধ্যে দিয়ে বলা হয়েছে ভক্ত ও ভগবানের আধ্যাত্মিক সম্পর্কের কথা।
ভানুসিংহের পদাবলী কুড়িটি মাত্র খন্ডপদের সমষ্টি। ভানুসিংহের কুড়িটি খন্ডপদের মধ্যে  মধ্যে দিয়ে শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ দেখাবার কোন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় না। পূর্ব রাগ, অভিসার, মান, প্রেমবৈচিত্র্য, নিবেদন, মাথুর, মিলন, প্রার্থনা প্রভৃতি প্রথাবদ্ধ ধারনুক্রমে পদগুলো বিন্যস্ত নয়। ঊনিশ ও কুড়ি সংখ্যক পদ দুটো ছাড়াও এমন কিছু পদ কবি লিখেছেন  যেগুলো বাহিরাঙ্গিকে কিংবা আন্তর ভাব-গভীরতায় যে কোন প্রথম শ্রেণীর বৈষ্ণব কবির রচনার পাশে স্থান পাওয়ার যোগ্য।
 ‘ভানুসিংহের পদাবলী’র মাধুর্যরসনির্যাসের নিষ্কাশনে রবীন্দ্রনাথ  বলেছেন: “বিদ্যাপতি সুখের কবি ও চন্ডীদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে  সার বলিয়া জানিয়েছেন, চন্ডীদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়েছেন”। রবীন্দ্রনাথের কাছে চন্ডীদাস ছিলেন বিদ্যাপতি অপেক্ষাও সকরুণ, সচল ও কোমল, কিন্তু পদ- রচনার মাধুর্যে ও রস- সম্ভোগের ক্ষেত্রে উভয়েরই তুলনা নেই ।
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দের’ কাব্যরসের  আভাস ভানুসিংহের পদাবলীর অনেক স্থানে পাওয়া যায়। কবি জয়দেবের-
নামসমেতং কৃতসঙ্কেতং বাদয়তে মৃদু বেণুম্।
  বহু মনুতে নণু তনসঙ্গতপবনচলিতমপি রেণুম্।।
 পততি পতত্রে বিচলিতপত্রে শঙ্কিতভবদুপযানম্।
              রচয়তি শয়নং সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্।। ৫।১০-১১
ছায়া রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখা যায়-
    সতিমির রজনী, সচকিত সজনী, শূণ্য, নিকুঞ্জ অরণ্য,
    কলয়িত  মলয়ে, সুবিজন-নিলয়, বালা- বিরহ- বিষণ্ণ।
তৃষিত নয়নে, বনপথপানে নিরখে ব্যাকুল বালা।
   দেখন পাওয়ে , আাঁখি ফিরাওয়ে,গাঁথে বনফুলমালা।
সহসা রাধা চাহল  সচকিত, দূরে খেপল মালা —
        কহল সজনি, শুন বাঁশরী বাজে,  কুঞ্জে  আওল কালা। ১
জয়দেবের ছন্দ, কাব্য ও সুর কবির লেখনীর মাধ্যমে পেয়েছে নবজীবন এবং বৈষ্ণব-পদের সমতুল্যতা।
যদিও ভাবের গভীরতা দিক থেকে বিদ্যাপতি আরও ছাপিয়ে গেছেন। যেমন-
নিজ পহুঁ পরিহরি সঁতরি বিখম নরি
অঁগরি মহাকূল গারী
তু অ অনুরাগ মধুর মদে মাতলি
          কিছু ন গুণল বরনারী-ই।২
ভাবের গভীরতায়, প্রকাশের মাধুর্যতায় ও ব্যঞ্জনার সৌন্দর্যে এমনি অনেক বৈষ্ণব-কবিতাই নিঃসংশয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বীরূপে প্রতিয়মান হতে পারে, কিন্তু ভাষার সংযমতার পরিবেশ সৃষ্টির কুশলতায় ও প্রাকৃত বর্ণনার প্রাঞ্জলতায় কবির  পদটি উৎকর্ষতার পরিচয় দেয়। ভাব-বিচিত্রতার নব নব অবিভক্তি – যা ব্যক্ত হয়েছে দান, গোষ্ঠ, নৌকাবিলাস, রাস, মুরলীশিক্ষা প্রভৃতি লীলা বৈচিত্র্যের মাধ্যমে, রস-সাহিত্যকে করে তুলেছে সুসমৃদ্ধ,  তাদের অনুরূপ  সন্ধান কবির সৃষ্টির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাথের স্বভাব-সুন্দর কবি-মন বৈষ্ণবসাধকদের মতো প্রেমের জটিলতাকে উপলব্ধ করতে না পারায় ‘মান’ লীলাকে যথোপযুক্ত মূল্য দিতে সমর্থ্য হননি। তবু দার্শনিক ভাব ও মধুর রসের প্রতিচ্ছায়ার প্রতিফলন ঘটেছে কবির মনে। যার ফলে রচিত হয়েছে ‘কো তুহুঁ বোলবি মোয়’ -অনুরূপ পদ, সার্বজনীন প্রভাবের দিক থেকে যার সাথে বিদ্যাপতির- ‘‘সখি কি পুছসি অনুভব মোয়’’ পদটির সাদৃশ্য মেলে। যদিও এখানে বিদ্যাপতির ভাবগম্ভীর্য অতুলনীয় এবং তার বাচনিক অভিব্যক্তির সঙ্গে কবির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না ।
সখি কি  পুছসি  অনুভব মোয়
সেহো পিরিত                  অনুরাগ বখানইত
তিলে তিলে নূতন হোয়।
জনম অবধি হাম                রূপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল।৩
এবং
কো তুহুঁ বোলবি মোয়,
                হৃদয়- মাহ মঝুকু জাগসি অনুখন          আঁখ উপর তুহুঁ রচলহি  আসন
                                           অরুণ নয়ন তব মরণ সঙে মম,
          নিমিখন অন্তর হোয়                   কো তুহুঁ বোলবি মোয়। ৪
পাশাপাশি পড়লেই ভাব ও ছন্দের ঐক্য সহজেই ধরা পড়ে। বৈষ্ণব-মহাজন ও রবীন্দ্রনাথের রচনা পদ্ধতি ও ভাষার মধ্যে সাদৃশ্যও অনুভূত হয়।
ভানুসিংহের শ্রীরাধার প্রশ্নকাতরতা কবি বিদ্যাপতির প্রশ্নকাতরতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও উভয়ের রস ঠিক এক নয়। ভানুসিংহের রাধার মনে যে প্রশ্ন তা অজানার, আর বিদ্যাপতি রাধার প্রশ্ন অশেষের অতৃপ্তির। ভানুসিংহে রাধা বিস্মিতা, বিদ্যাপতির রাধা চির-আকাঙ্ক্ষিনী। তবু মানব-মনের চির-আকুলতা উভয়ের মধ্যেই প্রকট ।
 চন্ডীদাসের ‘কানুর পিরীতি মরণ অধিক’ -গান রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘ জীবনবল্লভ মরণ অধিক সো’-তে পর্যবসিত হওয়ার পূর্বে কবির চরণগুলি এক মাধুর্যপূর্ণভাবের সৃষ্টি করেছে, পদটিতে কোথাও অনুকরণে ছায়া লক্ষ্য করা যায় না। এভাবেই অনুকরণ করতে গিয়ে কবি বহুস্থানে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে বৈষ্ণব ভাবপ্রবাহের মধ্যে থেকে তাকে খুঁজে বের করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। যেমন উদ্ধবদাসের কবিতায়-
‘আষাঢ় গত পুণ মাহ শাঙন সুখদ যমুনা তীর।
ঘোর ঘটা ঘন দামিনী দমকত, বিন্দু বরিখত নীর।। ৫
এবং
‘শাঙন মাসে সগন ঘন গরজন পুলকিত দামিনী মাল।
বরিখত বারি পবন মৃদু মন্দ হি গঙ্গা-রঙ্গ বিশাল।।
শিবরাম দাসের ‘মাহ শাঙন বরিখে ঘন ঘন দুহুঁ ঝুলে কুঞ্জক মাঝ’ পদে। আবার  ‘গগন গরজনি দমকে দামিনী’,  ‘দুহুঁ গাওহে বহুবিধ তান’ প্রভৃতি এবং গোবিন্দ দাসের পদে-
‘ মন্দিরও বাহির কঠিন কবাট।
চলইতে  শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তঁহি অতি বাদর  দরদর রোল।
বারি কি বারই নীল নিচোল।।
সুন্দরি কইছে করবি অভিসার
হরি বহু মানুষ সুরধুনী পার।।
ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত।
শুনইতে শ্রবণ মরম জরি যাত।।
ইথে  যব সুন্দরি তেজবি গেহ ।
প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।। ৬
সমন্বিতভাবে রবীন্দ্রনাথের হাতে পায় নতুন রূপ-
 শাঙন -গগনে ঘোর ঘন ঘটা নিশীথ যামিনীরে।
কুঞ্জপথে অব কৈ-সে যাওব অবলা কামিনীরে।
 উন্মদ পবনে, যমুনা তর্জিত ঘন ঘন গর্জিত মেহ
       দমকত বিদ্যুত পথতরু লুন্ঠিত থর থর কম্পিত দেহ।
      ঘনঘন রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ বরখত নীরদ -পুঁঞ্জ।
     শাল- পিয়ালে তাল -তমালে নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ।
   কহলো  সজনী এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান
 দারুণ বাঁশি কাহে বাজায়ত সকরুণ রাধানাম। ৭
‘নীলশাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলা’ চন্ডীদাস নামাঙ্কিত পদে পাওয়া যায়-
 চলে নীল শাড়ি              নিঙগাড়ি নিঙগাড়ি
                   পরাণ  সহিত  মোর।
সেই হইতে মোর               হিয়া নহে থির
                    মনমথ-জ্বরে ভোর।। ৮
তাছাড়া ‘ গহন রয়ণ সে ন যাও বালা, নওল কিশোরক পাশ’ – কবিতাটি ভাবের অভিব্যক্তি ও বর্ণনাতে তা বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে সমতুল্যতার দাবি রাখে।
নায়িকার মনোবেদনা উৎকণ্ঠিতারপদে গোবিন্দ দাসের লেখনীতে মুহূর্ত হয়েছে-
‘ হামরহু সঙ্কেত আনত বহু কান
একলি  নিকুঞ্জে কুসুমো-সর হান
এ  সখি  হৃদয়ও জলত মঝু আগি
   কঠিন পরাণ রহত কথি লাগি। ৯
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে নূতনত্ব ধরা পড়ে- ‘ হৃদয়কে সাধ মিশাওল হৃদয়ে’পদটির মাধ্যমে। যথা-
      বিরহ বিষে দোহি বহিগল  রয়নি, নহি নহি আওল কালা।
   তৃষিত প্রাণ মম দিবস যামিনী শ্যামক দরশন আসে।
    আকুল জীবন থেহ ন মানে, অহরহ জ্বলত হুতাশে। ১০
রসসৃষ্টি ও ব্যঞ্জনার দিক থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় গোবিন্দ দাসের। কবির ভাষা ও ভাব-সম্প্রসারণেও অনুভূত হয় গোবিন্দ দাসের প্রভাব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শ্রীরাধার মধ্যে মানবীয় প্রেমের রূপ অধিক প্রকট এবং রাধার মধ্যে যে প্রেম ব্যক্ত হয়েছে তাতে ঐশী প্রেমের ছায়া ক্ষুণ্ণ হয়ে মানবীয় প্রেমকেই প্রকাশ করেছে। তাই  ভানুসিংহের শ্রীরাধার মধ্যে  অভিমানের তীব্রতা অপেক্ষাকৃত মৃদু। ভানুসিংহ পদাবলীর শ্রীরাধার মধ্যে আশা ও নিরাশার দোলা অনেকটা সাধারণ মানুষের মানসিক গতির দোলার মতো, এজন্য সাধারণের পক্ষে তাতে সরস প্রাণের ছোঁয়া সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
রসের বিচারে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’কে বৈষ্ণব- কাব্যধারার সমান মূল্য দেওয়া চলে, — ভাবের  দিক থেকে তা যদিও হালকা। তবে স্বাতন্ত্র্যের বিচারে কবি রবীন্দ্রনাথের কাব্য সৃষ্টি পদাবলী সাহিত্যের  পাশে স্থান পায়। যে রসের স্রোতে অবগাহন করে বৈষ্ণব- কবিরা আজও অমর হয়ে আছেন সেই স্রোতেই ডুব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাসিয়েছেন তার কাব্যের অর্ঘ্য যার এক প্রান্তে গাঁথা- চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও গোবিন্দ দাসের অমৃত-রত্নাবলীরূপ অম্লান কুসুমরাজি।
 অধ্যাত্ম-সাধনপথেররহস্যের  ইঙ্গিত রবীন্দ্রনাথ এ বৈষ্ণব সাধনা থেকে পৃথক হলেও মহাজন- পদাবলীর রস-মন্দাকিনীতে যে তিনি অবগাহন করেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথের কাব্যরসপূর্ণ সাহিত্যভাষা বৈষ্ণব- পদাবলীর ভাষা ব্রজবুলির শব্দ- ঝংকার ও ছন্দলালিত্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল বা সামঞ্জস্য  প্রকাশ না পেলেও তা কোন কোন অংশে প্রায় সমশ্রেণীভক্ত । পদকর্তা গোবিন্দদাস যেখানে রসায়িত পদলালিত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন –
শরদ চন্দ        পবন মন্দ
বিপিনে ভরল কুসুম-গন্ধ
ফুল্ল মল্লিকা মালতি যুথি
  মত্ত মধুকর- ভোরনি। ১১
‘ভানুসিংহের পদাবলী’র ভাষা বৈষ্ণব- পদাবলীর ভাষা কিছুটা কৃত্রিম হলেও গোবিন্দদাসের প্রায় অনুরূপভাবেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন –
“ গহন কুসুম- কুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর  বংশি বাজে
বিসরি ত্রাস লোক- লাজে
সজনি, আও আও লো।
অঙ্গ চারু নীল বাস,
হৃদয়ে প্রণয়- কুসুমরাশ,
হরিণ- নেত্রে  বিমল হাস
 কুঞ্জ- বনামে আও লো। ১২
বৈষ্ণব পদাবলী প্রত্যক্ষ প্রভাবে রচিত হয়েছিল ভানুসিংহের পদাবলী। পদাবলী সাহিত্যের পরোক্ষ প্রভাব সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যে  সুদূর প্রসারী।  বৈষ্ণব-পদাবলী-সাহিত্যের দ্বারা রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রকাব্য- প্রবাহ প্রভাবিত হলেও তারা স্বকীয়তার আসনে অধিষ্ঠিত ও মহিমান্বিত।
 ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব- কবিদের প্রত্যক্ষভাবে অনুকরণ না করলেও পরোক্ষভাবে অনুসরণ করেছেন বলা যায়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : “পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণব চিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই।” এখানে কবির স্বীকারোক্তিতে বৈষ্ণব-পদাবলীর সঙ্গে  স্বীয় জীবনের  অনৈক্য ভাব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে, কারন রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্ম-সাধনার, ধারা বৈষ্ণব-সাধনরীতি থেকে চিরদিন  পৃথকই ছিল।
তথ্যসূত্র
১। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ–১৭৭
২। ড.সনাতন গোস্বামী ,পৃঃ—৬২
৩। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৭৬
৪। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৭৬
৫। ড.সনাতন গোস্বামী,পৃঃ—৮২
৬। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, ,পৃঃ-১৭৩
৭। ড.সনাতন গোস্বামী, পৃঃ—৮০
৯। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৭৭
১০। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৭৮
১২। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃঃ—১৮৭
গ্রন্থপঞ্জি
১। অমল মুখোপাধ্যায় – রবীন্দ্রসংগীত পরিক্রমা
২। প্রজ্ঞানানন্দ- সঙ্গীতে রবীন্দ্রপ্রতিভার দান
৩। ড.সনাতন গোস্বামী- বৈষ্ণব পদাবলী
৪। শান্তিদেব ঘোষ-রবীন্দ্রসঙ্গীত
৫। প্রভাত কুমার গোস্বামী –ভারতীয় সংগীতের কথা
           :