Begum Akhtarji’s Timeless Bengali Raga Pradhan Songs: An Analytical Survey

Pratyusha Roy

Abstract:

This analytical survey delves into the enduring legacy of Begum Akhtarji, the legendary Indian classical vocalist, focusing specifically on her timeless renditions of Bengali Raga Pradhan songs. Begum Akhtar’s profound mastery of classical music, combined with her emotive and soul-stirring renditions, has left an indelible mark on the cultural tapestry of India. The research employs a multidimensional analytical approach, exploring the intricate nuances of Begum Akhtarji’s interpretations of Bengali Raga Pradhan compositions. The study incorporates historical, musical, and cultural perspectives to provide a comprehensive understanding of the evolution and significance of these timeless renditions. Through an exploration of the distinctive features of Bengali Raga Pradhan and an in-depth analysis of Begum Akhtarji’s interpretative style, the research seeks to unravel the intricate interplay of melody, emotion, and cultural context. Special attention is given to the unique elements that distinguish Begum Akhtarji’s renditions, showcasing her ability to seamlessly blend classical traditions with a deep understanding of the emotive nuances embedded in the lyrics. The study also delves into the socio-cultural impact of Begum Akhtarji’s renditions, examining their role in preserving and promoting the rich heritage of Bengali music. By examining archival recordings, scholarly writings, and expert commentaries, this research sheds light on the transformative influence of Begum Akhtarji’s contributions to the genre. In conclusion, this analytical survey serves as a tribute to Begum Akhtarji’s unparalleled artistry and aims to contribute to a deeper appreciation of her timeless renditions of Bengali Raga Pradhan songs. By unravelling the intricacies of her musical expressions, this research invites scholars, musicians, and enthusiasts to explore the profound cultural resonance of Begum Akhtarji’s contributions to the world of classical music.

বেগম আখতারজির কালজয়ী বাংলা রাগপ্রধান গান: একটি বিশ্লেষণাত্মক সমীক্ষা

প্রত্যুষা রায়, হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সঙ্গীত ভবন, বিশ্বভারতী

সারসংক্ষেপ

সুরের নক্ষত্রদের চমকে প্রজ্ব্যলিত হয়েছে বাংলা রাগপ্রধান গানের জগত। বিবর্তনের ধারা বয়ে এনেছে প্রতিনিয়ত নতুনকে। বিংশ শতাব্দীর সুনামধন্য শিল্পী বিদূষি বেগম আখতারজির কিছু বাংলা রাগপ্রধান গান এই ধারায় জুটিয়েছে স্বর্ণমুকুট। আখতারজির এই গানগুলি বাংলা রাগপ্রধান  গানে যেন এক অন্য ঘরাণার সৃষ্টি করেছে, যার মোহনীয়তা আজও বর্তমান। উক্ত সমীক্ষায় এই বাংলা রাগপ্রধান গানগুলির জনপ্রিয়তার সূদুরপ্রসারী প্রভাবের সাথে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ রাগ,তাল,ভাব রস ও কথার গুরুত্ত্বসহ কিছুক্ষেত্রে গানের বিশেষ বিশেষ সৌন্দর্য্যের জায়গাগুলির স্বরলিপি প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হল।

সাংকেতিক শব্দগুচ্ছ– বাংলা রাগপ্রধান গান, বেগম আখতার , কালজয়ী, জোছনা।

ভূমিকা

রাগপ্রধান গানের জগতে একটি নক্ষত্র আজও বর্তমান রয়েছে। তিনি হলেন বিদূষী বেগম আখতার। বিংশ শতাব্দির এই চিরন্তন শিল্পীর কিছু কিছু বাংলা রাগপ্রধান গানের জনপ্রিয়তা গগনচুম্বি। এর মোহনীয়তা যেন ফুরায়েও ফুরোতেই চায়না।  কিন্তু কেন এই জনপ্রিয়তা? বিবর্তনের ধারায় হয়তো এমন বহু কালজয়ী সৃষ্টিরা ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু এমন কিছু রাগপ্রধান গানের ছোঁয়া আজও মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাবে জন্ম হলেও বাংলা রাগপ্রধান গানগুলি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্মগত অভ্যাসগুলি বর্জন করে স্বকীয় রূপেই চীরকাল পরিবেশিত হয়েছ। এমনই কিছু কালজয়ী সৃষ্টিদের মধ্যে কয়েকটি হল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরারোপিত ও পুলক ব্যানার্জীর কথার মালায় গাঁথা ” ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে “ গানটি। রবি গুহ মজুমদারের সুরারোপিত ও কথায় , আখতারজীর সুর মূর্ছনায় সমৃদ্ধ আরও একটি গান “ চুপি চুপি চলে না গিয়ে।” অপূর্ব মায়া জুড়োনো এই সৃষ্টিগুলির শেষ না হওয়া সু্র যেন বেজে যায় কানে বারবার। আখতারজীর কন্ঠের কিছু বাংলা রাগপ্রধান গানের মধ্যে সব কয়টিই বিশেষ, তবুও সাধ্যানুযায়ী কয়েকটি গানের বিশ্লেষণ করা হলো এই সমীক্ষাটিতে।

বেগম আখতারজীর গীত কয়েকটি রাগপ্রধান গানের বিশ্লেষণ

সুর – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ

কথা – পুলক ব্যানার্জী

শিল্পী – বেগম আখতার

ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে

কুঞ্জে এখনো কুহু কূজনে মাতে।

                           নাই যদি দাও হাসি, তবু যেন বাজে বাঁশি

 সুরেরই আঘাত দিও এ মধুরাতে    

অবহেলা নয় প্রিয় ,চাহ যদি ব্যথা দিও      

অশ্রু-মাধুরী আনো, এ আঁখিপাতে।।

রাগ নায়কি কানাড়া অঙ্গের উপর এই রাগপ্রধান গানটির চমকই প্রসিদ্ধ করেছে কথাশিল্পী,

সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পীকে।

যে ভাবনা নিয়েই গানটি রচনা হোক না কেন আখতারজীর কন্ঠে গায়নের পর তা পুরোপুরি ঠুমরী

আঙ্গিক মনে হচ্ছে ।

রাগ [1]নায়কি কানাড়ার বিবরণ

 ঠাট – কাফি

বাদি – মধ্যম

সম্বাদী – ষড়জ

জাতি – ষাড়ব-ষাড়ব বা অন্য মতে ষাড়ব – বক্র।

পরিবেশনের সময় – মধ্যরাত্রি

আরোহনঃ  সা, রে জ্ঞ, ম প, ণি প, র্সা

অবোরহণঃ র্সা, প ণি প, ম প, জ্ঞ ম, রে সা।

গানের সুরের ওপর রাগের প্রভাব

সুরের জাদু, বাণীর মোহনীয়তা ও রাগের ছোঁয়ায়  কালজয়ী এই গানের কথার প্রারম্ভেই যে সুর মূর্ছনা -ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে…………………

ঝাঁপতালে নিবদ্ধ এই রাগপ্রধান গানের প্রথম লাইনের মধ্যে দিয়েই কানাড়া অঙ্গের প্রভাব মিলেছে । এরপর যে আলাপের মূর্ছনা ,তা যেন কোন হারিয়ে যাওয়া অমূল্য জিনিসকে প্রাণপণে আটকে রাখার প্রচেষ্টা। কথার যাদু, সুরের মায়া এবং গায়কীর ঐশ্বর্য্যে এমনটাই প্রতিফলিত হচ্ছে।  গানের দ্বিতীয় লাইন ,”কুঞ্জে এখনো” …………

গানের প্রত্যেকটি কথা এবং তার গায়কী যেন এক একটি মণিমাণিক্য। ভাবে রসে মিলে একাকার স্থায়ীর পরে অন্তরার পঙক্তিগুলি, যা ব্যাখ্যা করার দুঃসাহস বোধহয় চরম ভালোলাগা থেকেই ।  অন্তরার দ্বিতীয় লাইনের মধ্যে যে সৌন্দর্য্য তা বোধহয় ভাষায় ব্যক্ত করা খুব কঠিন। “ সুরেরই আঘাত “ কথাটির মধ্যে যে ভাব ব্যক্ত হয়েছে,  তা যেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে থেকে যাবে।

স্থায়ী ও অন্তরার পরের অংশ অর্থাৎ সঞ্চারীর মনমুগ্ধকর এই গান কানাড়া অঙ্গের প্রায় নিংড়ে নেওয়া কম্পোজিশন বললেও ভুল হবেনা।

গানের ভাব ও রসঃ-

যে কোনো সংগীতের ভাব ও রস গায়নের দাড়াই ব্যক্ত হয়। রচয়িতা হয়তো যে ভাব নিয়ে রচনা করেন ,সঙ্গীতশিল্পী তার গায়নের মাধ্যমে তাতে অন্য রসসঞ্চার করেন। বেগম আখতারজির কন্ঠে গীত এই রাগপ্রধান গানের কথা ও সুর অনুযায়ী একাধিক রসের সঞ্চার দেখা যায়। যদিও এই বিষয় সম্বন্ধে প্রত্যেকের ভিন্ন অনুভূতি হতেই পারে। “ ফিরায়ে দিও না মোরে শুন্য হাতে, কুঞ্জে এখনো কুহু কুজনে মাতে।” এখানে গানের কথা এবং বেগম আখতারজির অনবদ্য গায়কির মাধ্যমে করুণভাবে মিনতির দ্বারা বিরহ ভাব ফুটে উঠেছে ।

“ নাও যদি দাও হাসি, তবু যেন বাজে বাঁশি”..………………….

 এই লাইনে শিল্পী তাঁর গায়কীর মাধ্যমে শৃঙ্গার রসের সঞ্চার ঘটিয়েছেন। সবশেষে শ্রোতাদের অনুভূতি অনুযায়ী বিশেষ কয়েকটি রস ও ভাবের সঞ্চার ঘটাতেই পারে এই গান। সব মিলিয়ে এই শিল্পীর গায়নের মাধ্যমে যে অনুভূতির সঞ্চার হয় তা সেভাবে ব্যক্ত করা কঠিন হলেও কিছুক্ষেত্রে করুন আবার বিরহ আবার কখনো শৃঙ্গার রসের ধারা শ্রোতার মনকে ভাবিয়ে তোলে। রাগপ্রধান গানের জগতে আরও একটি কালজয়ী সৃষ্টির দিকে যদি হাত বাড়াই তবে আরও একটি গানকে তুলে না ধরলে বোধহয় এই সমীক্ষা অপূর্ণই থেকে যাবে ।

গান – জোছনা করেছে আড়ি

শিল্পী – বেগম আখতার

সঙ্গীত পরিচালক – রবি গুহ মজুমদার

গীতিকার –  রবি গুহ মজুমদার

জোছনা করেছে আড়ি

আসেনা আমার বাড়ি।

গলি দিয়ে চলে যায়

লুটিয়ে রূপোলি শাড়ি।

চেয়ে চেয়ে পথ তারি, হিয়া মোর হয় ভারি

রূপের মধুর মোহ

বলোনা কি করে ছাড়ি[2]।।

রবি গুহ মজুমদারের পরিচালনায় ও সুরে , বিদূষি বেগম আখতারজির কন্ঠে গীত “ জোছনা করেছে আড়ি ” গানটি বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে আন্দোলন তুলেছে তার ঢেউ বহুদূরগামী। সূত্রে জানা যায় ১৯৭২ সালে রবি গুহ মজুমদারের হাতে লেখা ও সুরের মালায় গাঁথা হয় এই গানটি। কতটা অধ্যাবসায় ও গভীরতা সহ গাইলে এমন প্রসিদ্ধি পাওয়া যায় তা বোধহয় অকল্পনীয়। তবে প্রসিদ্ধ হবার এই শ্রেয় কার? রচয়িতার নাকি শিল্পীর গায়কীর ? নাকি সবকিছু অতিক্রম করে এই প্রসিদ্ধির শ্রেয় শ্রোতার উপরেই ? এই বিতর্কমূলক প্রশ্নের বেড়াজাল অতিক্রম করা বোধহয় খুব জটিল । তুলনাহীন এই গায়কীর গভীরতা ব্যক্ত করার অর্থ হল কোনো সমুদ্রের মধ্যে থেকে এক কণা বালু তুলে নেওয়া। তবুও সমীক্ষাটি সমাপ্ত করার জন্য এবং আগামী প্রজন্মকে এইসব সৃষ্টিগুলির গুরুত্ব বোঝাবার জন্য এই গানের রাগ, ভাব ও রস এছাড়াও কথার গুরুত্ব সম্মন্ধে বিশ্লেষণ করা হল। রাগ পিলুর উপর সুরারোপিত “ জোছনা করেছে আড়ি “ গানটির সমগ্র জুড়েই রয়েছে এক শুধুই তৃপ্তি।

গানের সুরের উপর রাগের প্রভাব

এই গান কাফী ঠাটের রাগ পিলুর উপর আধারিত। পিলু রাগ সাধারণত ঠুমরী ও দাদরা কম্পোজিশন গুলির উপরেই বেশি শুনতে পাওয়া যায়। পিলু রাগের মুখ্য অঙ্গগুলি হলঃ  ম প জ্ঞ ম, ধ প, ণ ধ প, নি ধ, র্সা অর্থাৎ আরোহনে শুদ্ধ নিষাদ এবং অবোরহণে কোমল নিষাদের প্রয়োগ। গানের শুরুতেই যে ছোট্ট আলাপ আখতারজির কন্ঠে আমরা শুনতে পাই……………

আহা, গানের শুরুতেই এমন ভাব; যেন এক মহাসমুদ্র। যাকে পাড়ি দেওয়ার সাধ্যি কারোর নেই। গানের প্রথম লাইনটি –  “ জোছনা করেছে আড়ি ,আসেনা আমার বাড়ি।”

এ শুধুই কন্ঠের খেলা। সুরের যাদু ও বাণীর মোহনীয়তাতো আছেই, তার উপর রাগের প্রাধান্য, সবটা মিলেমিশে যেন এক অন্য রূপ ধারন করেছে। প্রথম দুই লাইন গাইবার পর আখতারজির কন্ঠে যে ছোট্ট আলাপ , শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভাষায় যাকে বলে বোল আলাপ। এর একটু স্বরলিপি করার চেষ্টা করছি। যদিও গায়কীর কোনো স্বরলিপি হয়তো হয় না , তবুও এই সকল অমূল্য সম্পদগুলি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লেখনির মাধ্যমে রেখে যাওয়ার সামান্য প্রচেষ্টামাত্র।

কি অপূর্ব ; এ যেন এক নতুন স্বাদ, যা আগে কখনোও শোনা যায়নি। ঠুমরী অঙ্গের এই গানের বিশেষ কাজগুলি মাদকতায় ভরা। “ লুটিয়ে রূপোলি শাড়ি “- কি ভাবনা,কি লেখনি। এই গান কোনো যাদুর থেকে কম কিছুই নয়। অন্তরার দিকে কয়েকটি লাইনের দিকে যদি বিশেষ নজর দিই – “ রূপের মধুর মোহ, বলোনা কি করে ছাড়ি “ – যেহেতু ঠুমরী অঙ্গের গান তাই সঠিকভাবে রাগের শুদ্ধতা বজায় রাখা যায় না স্বাভাবিক ভাবেই। এমনিতেই পিলু রাগে অন্যান্য রাগের ছায়াপাত ঘটে, তাই একে সংকীর্ণ জাতির রাগ বলে। অন্তরার দ্বিতীয় লাইন “ রূপের মধূর মোহ “ – “ রূপের “ শুরুতেই শুদ্ধ গান্ধার ব্যবহৃত হয়েছে। সবশেষে বলতে পারি এই গান নেশা ধরায়, এই গানের প্রতিটি লাইন যেন হৃদয়কে এক নৈষর্গিক সুষমা উপলব্ধ করায়।

গানের ভাব ও রস

গানের কথানুযায়ী “জোছনা করেছে আড়ি , আসেনা আমার বাড়ি “,গানের প্রথম পংক্তিতেই একটু হলেও অভিমানে ভরা আবদার, যার রূপকল্প বোঝায় – জোছনা আড়ি করেছে,জোছনা অর্থাৎ চাঁদের আলো। সে আমার বাড়ি আসে না, রূপোলি শাড়ি লুটিয়ে চলে যায় গলি দিয়ে। এইখানে কবির মনের ভাব ও সঙ্গীত শিল্পীর গায়কীর ভাব মিশিয়ে যদি বলি তাহলে এই মনের ভাব বড্ড করুণ। “ আসেনা আমার বাড়ি , গলি দিয়ে চলে যায় “– অর্থাৎ গানের কথানুযায়ী স্বর ও সুর শ্রষ্ঠা শ্রী রবি গুহ মজুমদারের এই আক্ষেপ প্রকাশের কারন হল, তাঁর বাড়িতে জোছনার না আসা ।

আবার স্থায়ীর পর অন্তরার দিকে যদি নজর দিই , ‘ চেয়ে চেয়ে পথ তারি ‘ – ঠুমরীর আঙ্গিকে গীত এই গানের প্রতিটি লাইনই যেন মায়া ধরায়। কারোর পথ চেয়ে বসে থাকার যে জ্বালা, তা বিরহ ভাবের জন্ম দিয়েছে। “ হিয়া মোর হয় ভারি “- ,আহা; কি চমৎকার ভাবে ভাবের পরিবেশন, কি সৌন্দর্য্য এই রসের। বিরহের জ্বালা তো ক্ষণিকের। কিছু পরেই বিরহ ভাব শৃঙ্গার রসের জন্ম দিয়েছে পরবর্তী লাইনে- “ রূপের মধুর মোহ, বলোনা কি করে ছাড়ি “………………………………।  অর্থাৎ চেয়ে চেয়ে পথ চাওয়াতেই যে আনন্দ। এ মোহ ছাড়া যাবেনা।

গানের কথার বৈশিষ্ঠ্য

বেগম আখতারজির কন্ঠে গীত বাংলা রাগপ্রধান গুলির প্রায় সবকয়টিই আধুনিক ভাবধারায় রচিত এবং এই সব গানগুলিই আসলে রাগপ্রধান গানের প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রসঙ্গে শ্রী অমলেন্দু বিকাশ করচৌধুরী তাঁর একটি লেখনিতে বলেছেন-[3] “ আরও যদি আধুনিক সময়ে এগিয়ে আসি তবে চিন্ময় লাহিড়ীর ‘ রাধা বলে শুনি বাঁশরী বাজে ‘( খাম্বাজ) কিংবা জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের রচনায় – তাঁর লেখা ও সুরে গাওয়া বিভিন্ন বাংলা রাগ –  ভিত্তিক গানে রাগপ্রধান গানের সার্থক উত্তরণের ছোঁয়া মিলবে। এঁরা বাংলা গানে প্রগতিপন্থীর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।”

আধুনিকী প্রভাব অর্থাৎ পূর্বে যে ধরনের রাগপ্রধান গান রচনা হত, কৃষ্ণ চেতনাই ছিল তার প্রধান বিষয়বস্তু। রাধা – কৃষ্ণের প্রেম ও বিরহ লীলাকে ঘিরে রচিত হত রাগপ্রধান গানগুলি। সেক্ষেত্রে বিচার করলে, বর্তমান রাগপ্রধান গানগুলির লিরিক্স এক্কেবারেই বিপরীত। তার জলন্ত উদাহরণ হিসেবে বেগম আখতারজির গানগুলিকেই ধরা যায়। বর্তমানে কবির মনের খেয়াল বা ভাবানুযায়ীই কথা বসানো হয় বাংলা রাগপ্রধান গানগুলিতে। এই প্রসঙ্গে শ্রী অমলেন্দু বিকাশ কর চৌধুরীর একটি উক্তি উল্লেখ করছি।

তিনি লিখছেন –[4]” রাগপ্রধান নামে গীত না হলেও আগেকার দিনে রাগভিত্তিক যে সমস্ত বাংলা বৈঠকী গান গাওয়া হত তার কথাগুলিতে শ্যাম, বেণু, রাধা, যমুনা, গিরিধারী, নূপুর, কদম্ব, ধেনু, অভিসার, বিরহ, রুনুঝুনু, রাই কিশোর, ললিতা, বিশাখা, কুঞ্জ, নীপশাখে, ভ্রমরা ইত্যাদি সব শব্দ এত বেশি প্রচলিত ও ব্যবহৃত হোত যে তার বাইরে রাগ-সঙ্গীত রচনা করার চিন্তা কেউই করতেন না। আধুনিক চিন্তাধারা এবং গীত-রচনা রাগসঙ্গীতে গীত-রচনার ঐ ধরনের নাগপাশ থেকে আজকের রাগপ্রধান গানকে মুক্তি দিয়েছে। “ প্রথম গানটির কথা নিয়ে একটু দৃষ্টিপাত করি।

ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে

কুঞ্জে এখনো কুহু কুজনে মাতে

                           নাই যদি দাও হাসি, তবু যেন বাজে বাঁশি

 সুরেরই আঘাত দিও ,এ মধু রাতে    

অবহেলা নয় প্রিয় ,চাহ যদি ব্যথা দিও      

অশ্রু মাধুরী এনো, এ আঁখি পাতে।। [5]

কথানুযায়ী এই গান রোমাঞ্চ জাগায়। দুজন অভিমানী বিরহীদের একে অপরের প্রতি কাতর প্রার্থনার ছবি ফুটে উঠেছে, যার ব্যাখ্যা ও রূপকল্প এইরূপ হতে পারে। শূন্য হাতে আমায় ফিরিয়ে দিও না, কুঞ্জে পাখিদের কূজন এখনোও মেতে আছে। হাসি যদি নাই দাও তবু বাঁশি বাজিও। এই রাতে আঘাত যদি দাও তা যেন হয় সুরের আঘাত। ব্যাথা দিও কিন্তু অবহেলা কর না………। অপূর্ব এই লিরিকাল কম্পোজিশন । হৃদয়ের ভাবগুলো এত সহজভাবে এখানে বর্ণিত, তাই হয়তো শ্রোতার কানে পুরোনো হয়নি আজও এই গান। রাধা – কৃষ্ণের প্রেম ও বিরহলীলা , রাইকিশোর, ললিতা, যমুনার ঘাট, শ্যামরাই প্রভৃতির বাইরেও বাংলা রাগপ্রধান গানের কথায় এক অন্য চমক এনেছে এই আধুনিকী ধারা। আরও একটি কালজয়ী গানের কথা নিয়ে আলোচনা করছি ঃ-

জোছনা করেছে আড়ি

আসেনা আমার বাড়ি

গলি দিয়ে চলে যায়

লুটিয়ে রূপোলি শাড়ি

চেয়ে চেয়ে পথ তারি, হিয়া মোর হয় ভারি

রূপের মধুর মোহ

বলোনা কি করে ছাড়ি।।

এই গানের যে কথা তা পুরোপুরি প্রেম সুলভ। বিরহ , ভালোবাসা এবং দুষ্টু মিষ্টি অভিমান নিয়ে রচিত এই সব বাংলা রাগপ্রধান গানে রয়েছে এক ম্যাজিক। “ জোছনা “এই  গানের মুখ্য চরিত্র। এই ‘ জোছনা ‘ শব্দের মধ্যে দিয়ে কবি তার মনের কোনো প্রিয় মানুষের দিকেও ইঙ্গিত করতে পারেন যা তিনি চাঁদের আলোর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ‘জোছনা, বাড়ি ,রূপোলি শাড়ি ‘ প্রভৃতি শব্দের মধ্যে দিয়ে হয়তো কবি তার মনের আন্দোলনকে বুঝিয়েছেন। জোছনা আড়ি করেছে ,সে বিরহীর বাড়ি আসেনা। অন্য গলি দিয়ে চলে যায়, তার আভাস রেখে। তার পথ চেয়ে চেয়ে বিরহীর মন হয়ে ওঠে ভারি। তবুও সেই প্রিয়র রূপের মোহ ছাড়তে পারেনা বিরহী। এভাবেই অপেক্ষা চলে অবিরত।

বেগম আখতারজির রাগপ্রধান গানগুলিতে ঠুমরী ও দাদরার প্রভাব-

যেটা না বললেই নয় তা হল রাগপ্রধান বাংলা গানগুলি বেশি প্রভাবিত হয়েছে ঠুমরী ও দাদরা অঙ্গের গানগুলি থেকেই। বহু লেখনীর দ্বারা এমন বহু বাংলা রাগপ্রধান গানের ঠুমরীর সাথে হুবহু অনুকরণের প্রমান মিলেছে। এই উদ্দেশেই বলা যায় যে শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরারোপিত ও লিখিত “ কোয়েলিয়া গান থামা এবার “ গানটি পুরোপুরিই দাদরা অঙ্গের। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ রচিত প্রায় সব গানগুলিই বেগম আখতারজির কন্ঠে কোনোটা ঠুমরী ও কোনোটা দাদরা অঙ্গের বলে মনে হচ্ছে। “ চুপি চুপি চলে না গিয়ে “ , “ এই মরসুমে পরদেশে “ প্রভৃতি রবি গুহ মজুমদার রচিত গানগুলিতে ঠুমরী ও দাদরার প্রভাব রয়েছে।

এই প্রসঙ্গেই শ্রী অমলেন্দু বিকাশ  করচৌধুরীর একটি লেখনিতে তিনি বলেছেন,[6] “ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের লেখা ও সুর দেওয়া এবং বেগম আখতারের গাওয়া ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার’ গানখানিও দাদরা অঙ্গের রাগপ্রধান হিসেবে এক অনুপম সৃষ্টি বলা চলে !“

ঠুমরী সাধারণত রোমান্সধর্মী একপ্রকার উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত। নাটকীয় ভঙ্গিতে গায়ন এবং একের অধিক রাগ – রাগিনীর উল্লেখ ঠুমরীর প্রধান বৈশিষ্ঠ্য। কথার বৈশিষ্ঠ্য হিসেবে কানহা, কানু, মূরলী, শ্যাম প্রভৃতি ছাড়া প্রায় অধুরা ঠুমরী গানগুলি। যদিও বর্তমানে এগুলি ছাড়াও নানা ধরনের বোল বাকথা দিয়েও রচিত হচ্ছে ঠুমরী ও দাদরা গান।

বাংলা রাগপ্রধান গানের জগতে আখতারজীর জনপ্রিয়তা

বেগম আখতারজীর কন্ঠে গীত বাংলা রাগপ্রধান গানগুলি যেমন, জোছনা করেছে আড়ি, ফিরায়ে দিও না মোরে, কোয়েলিয়া গান থামা এবার, চুপি চুপি চলে না গিয়ে, পিয়া ভোলো অভিমান, এই মৌসুমে পরদেশে, ফিরে কেন এলোনা , ফিরে যা ফিরে যা বনে প্রভৃতি গানগুলি বিংশ শতকের বাংলা রাগপ্রধান গানের জগতে এক একটি অমূল্য সম্পদ। উক্ত সমীক্ষা বেগম আখতারজীর কন্ঠ ও গায়কীর মোহনীয়তা এবং প্রসিদ্ধতা ছাড়াও রচয়িতার ভূমিকাকেও কূর্ণিশ জানায়। কথা ও সুরের মালা গেঁথে যারা রাগপ্রধান গানের স্নিগ্ধ ভুবনে আজও ভ্রমণ করিয়ে চলেছেন শ্রোতাদের, তাঁদের অর্থাৎ শ্রী রবি গুহ মজুমদার,  শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, শ্রী পুলক ব্যনার্জি প্রমুখ ব্যক্তিত্ত্বদের কাছে চীরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে আগামি প্রজন্মেরা। শ্রী রবি গুহ মজুমদারের সুরে ও কথায় যে কয়টি গান যথাঃ-  চুপি চুপি চলে না গিয়ে, জোছনা করেছে আড়ি, এই মরসুমে পরদেশে, ফিরে যা ফিরে যা বনে প্রভৃতি গানগুলি প্রত্যেকটিই মাদকতার ভেলা । আবার শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ রচিত ও সুরারোপিত কোয়েলিয়া গান থামা এবার, ফিরায়ে দিও না মোরে , পিয়া ভোলো অভিমান প্রভৃতি গান গুলিও সুর ও কথার যাদুতে হৃদয়ের গহীনে তৈরী করে এক অসীম শূন্যতার। বাঙালি জাতি তো চীরকালই গীতিপ্রিয়।  পুরোনো কোনো নেশার গন্ধ  আঁকড়ে , ভাবের ভেলায় ভেসে অতলে গা ভাসানো বাঙালি জাতির কাছে এক উপহার স্বরূপ শ্রী রবি গুহ মজুমদার, শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, শ্রী পুলক ব্যনার্জির কম্পোজিশনগুলি। বিদূষি বেগম আখতার একজন সুদক্ষ ও সনামধন্য ঠুমরী ও দাদরা শিল্পী হবার জন্য তাঁর কন্ঠে গীত বাংলা রাগপ্রধান গানগুলিতেও সেই রেষ থেকে গেছে। অকৃত্রিম কন্ঠের অধিকারী আখতারজী তাঁর গায়কীর মাধ্যমে যে সুধা ঢেলেছেন তা সত্যিই অকল্পনীয়। তাঁর অমিত শক্তিশালী কন্ঠ যেন সুরের ছলে হৃদয়কে সম্মহিত করে নিয়ে যায় কোনো এক অপরিচিত ভুবনে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধূনকে তিনি যে বাংলা রাগপ্রধান গানের মধ্যে কি সাফল্যের সাথে ঢেলে দিয়ে গেছেন, তা বলাই বাহুল্য।

উপসংহার

উক্ত সমীক্ষার শেষে এটুকুই বলতে পারি; জনসমুদ্রে প্রসিদ্ধ হবার এই শ্রেয় হয়তো শুধু গায়ক -গায়িকাদের নয়। গীতের সমগ্র এই সৌন্দর্য্যের দায়ভার সুরোকারদেরও। এবং তারও পরে যারা এই সৌন্দর্য্যকে গ্রহণ করেছেন এবং স্থান দিয়েছেন হৃদয়ে, সেই শ্রোতার ভূমিকাও কম নয়। বাংলা গান যে রূপেই আসুক না কেন সমগ্র বাঙালি জাতিই তাকে গ্রহণ করেছে। শাস্ত্রীয় গানপাগল বাঙালি আখতারজীর গায়কী এবং দরদী কন্ঠে মুগ্ধ চীরকালই। আজ একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও এই গানগুলির আমেজ একটুও পুরোনো হয়নি। বাংলা রাগপ্রধান গানের জগতে আখতারজীর কালজয়ী গানগুলির যে সুর, আবেগ, গায়কী, যাদু, স্তব্ধতা ও জনপ্রিয়তা তা গগনচুম্বী। শুরুর রেষ ধরেই বলতে পারি , বিংশ শতকে শ্রী রবি গুহ মজুমদার, শ্রী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ,শ্রী পুলক ব্যানার্জি প্রমুখ বিদ্বানেরা তাঁদের হৃদয় মোড়ানো কথা ও মদিরাবিষ্ট সুরের যা ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে বেগম আখতারজী “ জোছনার “ মতোই মায়াবী স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে তাকে পরিপুর্ণ করে তুলেছিলেন। এবং আজ একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও সেই স্নিগ্ধ আলোর ছটা শ্রোতার হাত ধরে খুঁজে চলেছে সেইসব শোক ও গ্লানির আঘাতে জরাজীর্ণ মনকে, এবং ছড়িয়ে দিচ্ছে এক টুকরো “ জোছনা “।। 

সাক্ষাৎকার

শ্রী শ্যামল লাহিড়ী (প্রখ্যাত রাগপ্রধান শিল্পী আচার্য্য চিন্ময় লাহিড়ীর পুত্র)

ডঃ প্রদীপ কুমার ঘোষ ( প্রখ্যাত মিউজিকোলজিস্ট )।

তথ্যসূত্র

[1] দত্ত, দেবব্রত, সঙ্গীত তত্ত্ব, দ্বিতীয় খন্ড, ব্রতী প্রকাশনী, ১৯৯৭

[2] Kotharsur.com

[3] করচৌধুরী, শ্রী অমলেন্দুবিকাশ, রাগপ্রধান গানের উৎস সন্ধানে, পৃষ্ঠা – ১০

[4] করচৌধুরী, শ্রী অমলেন্দুবিকাশ, রাগপ্রধান গানের উৎস সন্ধানে, পৃষ্ঠা – ৭১

[5]  জানা, অজন্তা, বাংলা গানে পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, Lokogandhar, ২৮.১১.২০১৯

[6] করচৌধুরী, শ্রী অমলেন্দুবিকাশ, রাগপ্রধান গানের উৎস সন্ধানে, পৃষ্ঠা – ১২

সহায়ক গ্রন্থ

১. করচৌধুরী, বিকাশ অমলেন্দু , রাগপ্রধান গানের উৎস সন্ধানে, ফার্মা কে এল এম, প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা ১৯২ চৌধুরী।

২. চৌধুরী, নারায়ণ ,বাংলা গানের জগৎ, ফার্মা  কে এল এম প্রাইভেট লিমিটেড,২৫৭ , বি, বিলিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীট, কলিকাতা।

৩. চক্রবর্তী, মৃদুলকান্তি, বাংলা গানের ধারা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, সেগুন বাগিচা, রমনা, ঢাকা।

. চক্রবর্তী, সুধীর,  বাংলা গানের চার দিগন্ত, কুন্ডু লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯।

৫. রায়, শ্রীবুদ্ধদেব, বাংলা গানের স্বরূপ, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড,  কলিকাতা-১৯৯০।

৬. করচৌধুরী, বিকাশ, অমলেন্দু, ফার্মা কেএলএম (প্রাইভেট) লিমিটেড, কলিকাতা- ৭০০০১২, ১৯৮৬ , কলিকাতা- ৭০০ ০১২, ১৯৮৬ ।

৭. ডঃ ছায়ারাণী মন্ডল, অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর, সঙ্গীত ভবন, বিশ্বভারতী।

.  Khan Hamza, After 38 yrs, Begum Akhtar’s grave gets due attention, Lucknow, Wed Nov 07 2012, 05:42 hrs

প্রত্যুষা রায়, ইমেলঃ pratyusha03131@gmail.com

The Role of Mass Media in Establishing National Unity Through Music

Dr. Nandita Basu Sarbadhikari

Abstract:

This abstract explores the pivotal role that mass media plays in fostering national unity through the powerful medium of music. In an era marked by cultural diversity and globalization, the ability of mass media to transcend geographical and cultural boundaries is unparalleled. This paper delves into how music, disseminated through various mass media channels, contributes to the creation and reinforcement of a shared national identity. The study investigates the impact of music as a unifying force, examining its ability to evoke collective emotions, memories, and a sense of belonging among diverse populations. Mass media platforms, including radio, television, streaming services, and social media, serve as conduits for the widespread dissemination of musical content, enabling citizens to engage with a common cultural narrative.

Drawing on case studies and examples from different nations, the research analyzes how mass media strategically utilizes music to amplify messages of unity, diversity, and patriotism. Additionally, the study explores the role of music in reflecting the cultural mosaic of a nation, celebrating its diversity while reinforcing a cohesive national narrative. Furthermore, the paper investigates the challenges and opportunities associated with leveraging music as a tool for national unity through mass media. It examines the potential of music to bridge social divides, promote inclusivity, and contribute to the development of a collective consciousness that transcends regional, ethnic, and linguistic differences. The findings of this research contribute to a deeper understanding of the intricate relationship between mass media, music, and national unity. As societies continue to grapple with issues of identity and diversity, this study sheds light on the potential of music, disseminated through mass media, to serve as a unifying force that fosters a stronger sense of shared national identity.

সংগীতের মাধ্যমে জাতীয় সংহতি স্থাপনে গণমাধ্যমের ভূমিকা

ডঃ নন্দিতা বসু সর্বাধিকারী, সহকারী অধ্যাপক, রবীন্দ্রসংগীত, নৃত্য ও নাটক বিভাগ, সংগীতভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন

সংগীত, নৃত্য ও অভিনয় চিরকাল সমাজে সংঘাত ও অনৈক্য হ্রাস করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছে। ভারতবর্ষে যুগে যুগে গ্রাম এবং শহরাঞ্চলে চিরাচরিত মাধ্যমগুলি যেমন ভ্রাম্যমান শিল্পীদের সংগীত, বিভিন্ন জনসমাজের পরম্পরাগত সংগীত, লোকনৃত্য ও লোকাভিনয় যথা যাত্রা, পালাগান, পুতুলনাচ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

 অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের মত আমাদের দেশেও প্রচলিত ও আধুনিক গণমাধ্যমের একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।

মুদ্রণ-শিল্প

      প্রাচীনতম প্রচারমাধ্যম মুদ্রণ-শিল্পর সাহায্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন ভাষায় সংগীতের অজস্র পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে, এবং স্বরলিপিও মুদ্রিত হয়েছে। এর সাহায্য ছাড়া আমাদের সমৃদ্ধ সংগীত-ভাণ্ডারের বাণী ও সুর অবলুপ্তির পথে হারিয়ে যেত। আধুনিক সভ্যতায় বিবিধ প্রযুক্তি আবিষ্কার যোগাযোগ ব্যবস্থায় নবদিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছে। বৈদ্যুতিন মাধ্যম আজ বিশ্বায়নের দ্বার উদ্‌ঘাটিত করে দিয়েছে। আঞ্চলিক সমাজকে অতিক্রম করে, সাংস্কৃতিক গণ্ডী উত্তীর্ণ হয়ে আমরা পৌঁছে যাচ্ছি বিশ্বে।

বেতার মাধ্যম

      ভারতবর্ষে সর্বশক্তিমান গণমাধ্যম বেতারজগৎ দেশ-বিদেশের সংগীত, সাহিত্য, অভিনয় ইত্যাদি প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে একসূত্রে গ্রথিত করে সহজেই। ভারতের স্বাধীনতার প্রথম দিকে ৩২টি বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীত। প্রত্যহ উষাকালে রেডিওর কার্যক্রমের শুভসূচনা হয় ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতের মাধ্যমে।

      ১৯৫০ সালে প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার সম্ভব হয় এবং ১৯৫৬ সালে ভারতের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এবং প্রায় অর্দ্ধেক সংখ্যক দেশবাসীর কাছে পৌঁছে যায় বেতার সম্প্রচার। তথ্য সম্প্রচার দপ্তরের অধীনে সংগীত ও নাটক বিভাগে প্রায় ৪৩টি বিভাগীয় গোষ্ঠী এবং ৫০০টি বেসরকারী সংস্থা প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ অনুষ্ঠান ক’রে থাকে। বিবিধ শ্রেণীর শ্রোতারা এর মাধ্যমে সম্মিলিত হয়। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি জনগণের আগ্রহ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বেতারে National Programme আয়োজিত হয়।

      পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং হিন্দুস্থানী ও দক্ষিণী শাস্ত্রীয় সংগীত-শিল্পীদের সম্মিলিত প্রয়াসে নির্মিত হয় ‘বাদ্যবৃন্দ’। ১৯৫৪ সাল নাগাদ অনুষ্ঠানের ৩১ শতাংশ ছিল মার্গসংগীত-নির্ভর। বর্তমানে, বেতার-অনুষ্ঠানের ৪২ শতাংশ হল সংগীতানুষ্ঠান। F.M. প্রচার-তরঙ্গের মাধ্যমে বেতারজগৎ তার ক্ষেত্রপ্রসারে নিয়তই প্রয়াসী। প্রায় ৮৪টি প্রচারকেন্দ্র প্রায় ৯০ শতাংশ দেশবাসীর কাছে তার সম্প্রচার পৌঁছে দেয়। প্রতিদিন ৩৫টি ভাষা এবং ১৩৭টি আঞ্চলিক ভাষায় দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্ভারতে বেতার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। আমরা দেখি গ্রামেগঞ্জে, মফস্বল শহরের রাস্তাঘাটে, দোকানে শ্রমিক বা কৃষকদের কর্মক্ষেত্রে সারাদিনের সাথী হল ট্রান্‌জিস্টার।

চলচ্চিত্র

      ভারতে চলচ্চিত্র-শিল্পের সাফল্য অনেকাংশই সংগীতের উপর নির্ভরশীল। প্রথমদিকে লোকসংগীত, ভক্তিগীতি, উচ্চাঙ্গসংগীত, গজল ও কাওয়ালি বেশি ব্যবহার হত।

      বৃটিশ সরকারের সেন্সর বোর্ড মূলত চলচ্চিত্রের সংলাপের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতেন, কিন্তু ছবিতে ব্যবহৃত দেশাত্মবোধক গানগুলি মুক্তি পেতে বাধা পেত না। ফলে এগুলি গভীর জাতীয় সংহতিভাব জাগ্রত করত এবং জাতীয় আন্দোলনে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ১৯৩৬ সালে ‘জন্মভূমি’ ছবিতে অশোক কুমারের ‘জয় জয় প্যারী জন্মভূমি মাতা’, ১৯৪০-এ ‘বন্ধন’ ছবিতে লীলা চিৎনিস্-এর ‘চল্ রে নওজয়ান’, ১৯৪৩-এ অনিল বিশ্বাসের পরিচালনায় ‘কিসমেত’ ছবিতে ‘আজ হিমালয় কি চোটি সে’, ১৯৪৪-এ জি.এম্. দুরানি ও মঞ্জুর ‘ওয়াতন সে চলা হ্যায়’ প্রভৃতি গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়।

      স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতীয় আন্দোলন ও জাতীয় নেতাদের জীবন অবলম্বন করে নির্মিত বহু চলচ্চিত্রে স্বদেশী গান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি নরসিং মেহ্‌তা রচিত ‘বৈষ্ণব জন তো তেনে কহিয়ে’ গান্ধীজির অত্যন্ত প্রিয় গান ছিল। শ্যাম বেনেগালের ‘গান্ধী’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে গীত হ’লে সাড়া ফেলে দেয়। ১৯৬৬-তে ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে ক্ষুদিরামের স্মরণে পীতাম্বর দাসের রচিত ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে এবং INA-র অন্যান্য উদ্দীপক গানগুলিও প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিভাবান শিল্পী সবিতাব্রত দত্ত চারণকবি মুকুন্দদাসের ভূমিকায় অসাধারণ সব স্বদেশী-গান পরিবেশন করেন।

https://www.youtube.com/watch?v=5wjGc1zGWBc
https://www.youtube.com/watch?v=5wjGc1zGWBc

      ১৯৫৫-তে রাজকাপুরের ‘শ্রী-৪২০’ ছবিতে মুকেশের গাওয়া, শৈলেন্দ্রর লেখা ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানী’ গানে ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দোস্তানী’ উল্লেখ করা যায়। ‘উপকার’ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রের ‘জয় জওয়ান জয় কিসান’, ‘পুরব ঔর পশ্চিম’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রের গান ‘ভারত কা রহনেওয়ালা হুঁ’ প্রভৃতি উল্লেখ্য। ১৯৫২ সালে বেতারে ফিল্মিগান প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এর ফলে শ্রোতার সংখ্যা বিশেষভাবে হ্রাস পেতে থাকলে পাঁচবছর পর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। শুধু ভারতে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য-প্রাচ্য এবং আফ্রিকাতেও এর চাহিদা বিপুল বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি ভগৎ সিং-এর উপর ফিল্মেও আলোড়ন ফেলা দেশাত্মবোধক গান পাই। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত শুধু স্বদেশী গান নয়, প্রেমের গানও সংহতির ভূমিকা পালন ক’রে থাকে।

রেকর্ডিং

      ভারতবর্ষে প্রথম মোম-রেকর্ডিং প্রবর্তিত হয় ১৯০১ সালে। বম্বেতে ১৯০২ সালে প্রথম ভারতীয় সংগীতের রেকর্ডিং হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯০৬ সালের মার্চ মাসে H. Bose Records রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে ১৪টি দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মোম সিলিণ্ডারে রেকর্ড করা গানগুলি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। পরে হেমেন্দ্রনাথ বসু ফরাসী কোম্পানী Pathey-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কবিকণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম্’ এবং ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’ গান দুটি মোম সিলিণ্ডারের পরিবর্তে ডিস্কে রেকর্ড করেন। অবশ্য প্রকাশের সময় রেকর্ডে ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’-র জায়গায় ‘সোনার তরী’ কবিতা আবৃত্তি প্রকাশিত হয়।

Two-minute wax cylinders. http://www.tinfoil.com/cylinder.htm
Close-up of Edison ‘Home’ phonograph playing an old wax record.Tinfoil.com – Early Recorded Sounds & Wax Cylinders

      প্রথম যুগে কুসংস্কারবশত ভদ্র পরিবারের শিল্পীরা রেকর্ড করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। পেশাদারী মহিলা শিল্পী বিশেষত বাঈজীরাই রেকর্ড করতে এগিয়ে এসেছিলেন এবং অনেকেই উচ্চমানের শিল্পী ছিলেন। ক্রমে এই মাধ্যম খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

      প্রথমদিকে গ্রামোফোন কোম্পানী শুধু উচ্চাঙ্গসংগীত রেকর্ড করলেও পরে ভারতীয় লোকসংগীত ও দেশাত্মবোধক গানও রেকর্ড হতে থাকে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ‘বন্দেমাতরম’ গানেরই ১২৫টি পৃথক রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৩০-এর দশকে সবাক চলচ্চিত্র আসার সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড শিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ ঘটে।

      প্রসঙ্গক্রমে আমরা বিখ্যাত সংগীত রচয়িতা শচীনদেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী বা ভূপেন হাজারিকার অবদান স্মরণ করব যাঁরা তাঁদের নিজস্ব সুরের সঙ্গে লোকসংগীতের সুরের সম্মিলন ঘটাতেন অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে। জনপ্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা ও হিন্দী রেকর্ড জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম। রাহুল দেব বর্মণ আমাদের সংগীতে পাশ্চাত্য সুরের সংমিশ্রণ ক’রে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন।

দূরদর্শন

      একবিংশ শতকে সাংস্কৃতিক সংহতি আনয়নে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হল দূরদর্শন।

      ১৯৫৯ সালে দিল্লীতে পরীক্ষামূলকভাবে দূরদর্শনকেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং ১৯৬৮ সালে তার জয়যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে, দৈনিক ১২টি ভাষায় ১৮ থেকে ২২ ঘন্টা সম্প্রচার কার্য চলে। কিন্তু গ্রামের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ টেলিভিশন ক্রয় করতে সমর্থ। দূরদর্শনে সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে বিবিধ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। দূরদর্শন-প্রচারিত ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ ১০/১২টি ভাষায় গীত গানটি যেন সারা ভারতকে একসূত্রে বাঁধে। কুসংস্কার দূরীকরণ, বিজ্ঞান ও শিল্পসংস্কৃতির বিবিধ অনুষ্ঠানের অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে সংগীত।

      নব নব টেলিকমুনিকেশন আঞ্চলিক সমাজ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন করে। তাদের সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধ’রে তাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগায়। এর ফলে একদিকে যেমন মুছে যাচ্ছে ভৌগোলিক সীমানা, শিল্প-সংস্কৃতি হয়ে উঠছে সার্বজনীন, অপরদিকে আধুনিক বাজারের চাহিদানুযায়ী একীকরণের প্রবণতার ফলে আঞ্চলিক শিল্প-সত্তা এক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় স্বতন্ত্রতা, নিজস্ব মৌলিকতা।

তথ্যসূত্র

১. D.S. Mehta – Handbook of PR. Allied Pub Ltd.

২. Ashok Ranade – Hindusthani Music

৩. Jogendra Singh – Cultural Change in India.

৪. A Team of Experts, Modern UGC NET / SLET 2004.

৫. John Story – Cult Studies and Studies of Pays Cult.

৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – সংগীতচিন্তা।

Exploring Nature in the Arena of Rabindra Sangeet: A Melodic Journey Through Ecological Reverie

Subhraparna Biswas

Abstract:

Rabindra Sangeet, the musical legacy created by the polymath Rabindranath Tagore, stands as a profound expression of the poet’s deep connection with nature. This abstract delves into the intricate relationship between Rabindra Sangeet and the natural world, unravelling how the songs capture the essence of nature and its myriad facets. Rabindranath Tagore, a Nobel laureate poet and the composer of numerous songs, was known for his keen observation of the environment around him. The abstract explores how Rabindra Sangeet serves as a poetic canvas upon which Tagore painted vivid images of nature, seamlessly integrating the rhythms and melodies of the songs with the ever-changing moods of the natural world. The paper investigates specific themes within Rabindra Sangeet that highlight nature’s influence, such as the changing seasons, the beauty of landscapes, and the profound symbolism attached to elements like rivers, trees, and flowers. By analyzing select compositions, we aim to unveil the poetic techniques employed by Tagore to personify nature, creating a harmonious blend between the lyrical and the organic. Furthermore, the abstract examines the impact of Rabindra Sangeet on listeners, exploring how the melodic renditions of nature contribute to ecological consciousness and a sense of environmental stewardship. By drawing parallels between the verses and the ecological challenges of our time, we aim to demonstrate the enduring relevance of Rabindra Sangeet in fostering a deeper appreciation for the natural world. In conclusion, this abstract seeks to illuminate the enchanting interplay between Rabindra Sangeet and nature, shedding light on how Tagore’s musical compositions serve as a timeless ode to the beauty, diversity, and interconnectedness of the environment. Through this exploration, we hope to inspire a renewed appreciation for the ecological dimensions embedded within the soul-stirring melodies of Rabindra Sangeet.

রবীন্দ্র গানের অঙ্গনে প্রকৃতির অবয়ব

শুভ্রপর্ণা বিশ্বাস

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে সঙ্গীত রচয়িতা ও সুকণ্ঠ গায়ক । তাঁর বিপুল সৃষ্টি ভাণ্ডারের মধ্যে অন্যতম সৃষ্টি কাজ হল সঙ্গীত, যা রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে বাঙালী তথা বিশ্ববাসীর কাছে সমাদৃত। তাঁর এই বিপুল সঙ্গীত সম্ভারকে বিভিন্ন পর্যায় বিভক্ত করলে পাই ৬টি পর্যায়, যথা- পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র ও আনুষ্ঠানিক। এই ৬ টি পর্যায়ের মধ্যে তাঁর প্রকৃতি পর্যায়ের গানগুলি অন্যতম। আলোচ্য বিষয়ে মুল কর্মক্ষেত্রটি হল  রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি  পর্যায়ের গান। কবির জীবনের শেষ দুই দশকে রচিত বিভিন্ন প্রকৃতি পর্যায়ের গানের মধ্যে যে নৈস্বর্গীক ভাবনা ও বিশ্বপ্রকৃতির নানা রূপের যে সাদৃশ্য ও সাযুর্জ ঘটেছে তার বিন্যাস-সাধন এবং বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে তিনি কিভাবে  অবলীলাক্রমে মানবপ্রকৃতির নানা রূপের মধ্যে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন তার বিশ্লেষণ । বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান বলতে যে সব কথা মনে আসে তা হল- আলো, বাতাস, মেঘ, বৃষ্টি, ফুল, তরুমূল, ঋতুচক্র ইত্যাদি ।এই বিষয়গুলি কিভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রকৃতির গানের বিভিন্ন উপমা ও উপমানের মধ্যে দিয়ে চিত্রিত করেছেন, তার বাস্তবরূপ খুঁজে দেখবার প্রয়াস নিম্নোক্ত অংশে করা হল।

মূখ্য শব্দ সমূহ

ঋতুচক্র, প্রকৃতি, আলো, বাতাস, মেঘ, বৃষ্টি, ফুল,তরুমূল, বিশ্বপ্রকৃতি, ঋতুলীলা, বন্দনা, মহাকাশ, মানবপ্রকৃতি, ঋতু, পর্যায়, নৈস্বর্গীক, সাধনা, আনন্দ, শান্তিনিকেতন, পদ্মা, নটরাজ, ঋতুরাজ।

গুরুদেব মনে করতেন আনন্দের সাধনার পথে প্রকৃতিই মানুষের একটি বড় অবলম্বন। প্রকৃতি আমাদের চারিদিকে ঋতুতে ঋতুতে যে সৌন্দর্য ও আনন্দ বিতরণ করে তা আমাদের ভোগের জন্য। তাকে গ্রহণ না করলে  মনের একটি অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় । অল্প বয়স থেকেই কবির কাছে বিশ্বপ্রকৃতির লীলা বিশেষ উপভোগের বস্তু ছিল। তিনি তাঁর “ছেলেবেলা” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “আমার জীবনে বাইরের খোলা ছাদ ছিল প্রধান ছুটির দেশ। ছোটো থেকে বড়ো বয়স পর়্ন্ত আমার নানা রকমের দিন ওই ছাদে নানাভাবে বয়ে চলেছে। আমার পিতা যখন বাড়ি থাকতেন তার থেকে কত দিন দেখেছি, তখনো সূর্য ওঠে নি, তিনি সাদা পাথরের মূর্তির মতো ছাদে চুপ করে বসে আছেন, কোলে দুটি হাত জোড়-করা। মাঝে মাঝে তিনি অনেকদিনের জন্য চলে যেতেন পাহাড়ে পর্বতে, তখন ওই ছাদে যাওয়া ছিল আমার সাত সমুদ্‌দুর-পারে যাওয়ার আনন্দ। চিরদিনের নীচে তলায় বারান্দায় বসে বসে রেলিঙের ফাক দিয়ে দেখে এসেছি রাস্তার লোক-চলাচল; কিস্ত এ ছাদের উপর যাওয়া লোকবসতির পিল্পেগাড়ি পেরিয়ে যাওয়া।”[1] রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ও মননের সাথে বিশ্বপ্রকৃতির যে আত্মিক যোগ তা ছিল তাঁর ছেলেবেলা থেকেই এবং তার পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ ঘটে কবিগুরুর জীবনের শেষ দুই দশকের রচিত গানে।

 তিনি মুগ্ধ চিত্তে তখন থেকেই ঋতুকে ও তার বৈচিত্র্যকে মনে প্রাণে উপভোগ করবার চেষ্টা করেছেন। কখনো তা নিজের চোখ দিয়ে, কখনো বা অন্তর দিয়ে, কখনো বা জ্ঞানচক্ষু দিয়ে। তাঁর জীবনের শেষ দুই দশকে রচিত সৃষ্টি কাজের মধ্যে প্রকৃতির গান ছিল অন্যতম। সেই সময় থেকে প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর অন্তরের গভীর যোগের উন্মোচন ঘটে ।

গীতবিতান এর তৃতীয় পর্যায়ে তাঁর প্রকৃতি পর্যায়ের গান গুলি (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত) সংগৃহীত আছে। এই পর্যায়ে প্রকৃতির মোট গানের সংখ্যা ২৮৩ টি। যেখানে প্রথমে ৯ টি সাধারণ পর্যায়ের গান, গ্রীষ্মের ১৬ টি গান, বর্ষার ১১৫ টি গান, শরৎ এর ৩০ টি গান, হেমন্তের ৫ টি গান, শীতের ১২ টি এবং বসন্তের ৯৬ টি গান সংকলিত রয়েছে। প্রথম জীবনে তাঁর প্রকৃতি পর্যায়ের গানের সংখ্যা ছিল ১২ টি, যেখানে বর্ষার গান ৭ টি, বসন্তের গান ৩ টি, শরৎ এর গান ১ টি এবং আরও ১ টি গান যেখানে পূর্বের তিনটি ঋতুর সমাবেশ রয়েছে। বর্ষার গান গুলো মূলত মল্লার রাগিণী, বসন্তের গান গুলো মূলত বাহার ও বসন্ত রাগিণী  ও শরৎ এর গানটি যোগীয়া-বিভাস রাগিণীর ওপর আধারিত ছিল।[2]

তাঁর শেষ জীবনে রচিত প্রকৃতির গানে তিনি কেবল মেঘমল্লার, বসন্ত, বাহার, যোগিয়া, বিভাস ছাড়াও ইমন, বেহাগ, ভূপালী, ভৈরবী, সিন্ধুকাফি ইত্যাদি রাগের ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান গাছপালা, ফুল, ফল, আলো, বাতাসের মতো তাঁর জীবনটিও ঋতুলীলার বিকাশে সাহায্যে করেছে। প্রত্যেক ঋতুই যেন গুরুদেবের গান ছাড়া অসম্পূর্ণ। তিনি ঋতুতে ঋতুতে তাঁর গানের ফুল ফুটিয়েছেন আর তারই সাহায্যে ঋতুর আনন্দ অনুভব করা আমাদের পক্ষে আরো সহজ হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের গান বলতে মুলত ৬টি ঋতুর গান (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত) ছাড়াও কখনো কখনো কোনো নৃত্যনাট্য বা গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির গান ব্যবহার করেছেন,  যেমন—“চক্ষে আমার তৃষ্ণা” (চন্ডালিকা), “গুরু গুরু, গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে” (চিত্রাঙ্গদা), ময়ূর ও ময়ূরী নাচিছে হরষে/ রিমঝিম ঘন ঘন রে বরষে”(বাল্মিকী প্রতিভা)

 গ্রীষ্মের দুপুরের দাবদাহ “ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায়” ও  গুরুমেঘগর্জনের মধ্যে কালবৈশাখীর আভাস এবং রিমঝিম ঘন বরষায় ময়ুর-ময়ুরীর অপরূপ নৃত্যশোভা ইত্যাদি।রবীন্দ্রনাথ এখানে মানবজীবনের সাথে বিশ্বপ্রকৃতির উপাদান জলবায়ু ঋতুচক্রকে এক্সুত্রে গেঁথেছেন ।

এছাড়া প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ পূজা-পর্যায়ের গানেও প্রকৃতিকে দেখেছেন, যেমন –”আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ / খেলে যায়  রৌদ্র ছায়া বর্ষা আসে বসন্ত”-এখানে এই ছয় ঋতুর  সমাগমে বর্ষা ও বসন্তের আগমন সেখানেও কবি বারবার  উপমার প্রয়োগ করেছেন।

প্রকৃতির ঋতুচক্রের সাথে গ্রামীণ বাংলার আর্থসামাজিক জীবনও যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পর্যায়ক্রমে তার উদাহরনস্বরূপ বলা যায়-

  • “আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই… লুকোচুরি খেলা ” (শরৎ),
  • “নমো, নমো, নমো,/ নমো, নমো, নমো,/ তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য/ অম্ত-অন্ন- ভোগ ধন্য করো অন্তর মম”(হেমন্ত),
  • “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে , আয় রে চলে আয়, আয়, আয়/ ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে মরি হায় হায় হায় ” (শীত)

গান তিনটি ভিন্ন পর্যায়ভুক্ত হলেও বাংলার শস্য শ্যামলা অন্নপূর্ণার তিন মাতৃ রূপের প্রতি আলোকপাত করেছে।

প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুচক্রের ওপর গড়ে ওঠে সাধারন মানুষের মিলন উৎসব-“ হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিকবধূরা ধানের ক্ষেতে ” অথবা

“আমরা চাষ করি আনন্দে/ মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে” অথবা “মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হলো/ ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো খোলো দুয়ার খোলো ওগো খোলো দুয়ার খোলো” নতুন ফসল কেটে ঘরে তোলার যে আনন্দ উৎসব এ যেন তারই উদযাপন। এছাড়া, “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল/ স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল” একটি অতি জনপ্রিয় ও লোকপ্রিয় সঙ্গীত যার মধ্য দিয়ে কবি ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের বন্দনা করেছেন।

‘নটরাজ ঋতুনাট্যশালা’ নাটকে কবি দেবাদিদেব মহাকালের বিভিন্ন রূপের সাথে ঋতুচক্রের বর্ণনা করেছেন।বৈশাখে তিনি আসেন তপস্বী বেশে, তখন তার তপের তাপে জগৎ হয়ে ওঠে তপ্ত। “তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে/ হৃদয় আমার, শ্যামল-বঁধুর করুণ স্পর্শ নে”। আবার বর্ষায় তিনি রূপ নেন আষাঢ় সন্ন্যাসীর , ঘরছাড়া এই সন্ন্যাসীর জন্য কোনো এক উমা কোথায় যেন বিরহের তপঃশয্যায় দীর্ঘপ্রহর নিশি-দিবস যাপন করে চলেছেন।

“কেন    পান্থ, এ চঞ্চলতা।

কোন্‌   শূন্য হতে এল কার বারতা ॥

নয়ন কিসের প্রতীক্ষা-রত   বিদায়বিষাদে উদাসমত–

ঘনকুন্তলভার ললাটে নত,   ক্লান্ত তড়িতবধু তন্দ্রাগতা ॥

কেশরকীর্ণ কদম্ববনে   মর্মরমুখরিত মৃদুপবনে

বর্ষণহর্ষ-ভরা ধরণীর   বিরহবিশঙ্কিত করুণ কথা।

ধৈর্য মানো ওগো, ধৈর্য মানো!   বরমাল্য গলে তব হয় নি ম্লান’

আজও হয় নি ম্লান’—

ফুলগন্ধনিবেদনবেদনসুন্দর   মালতী তব চরণে প্রণতা॥[3]

শরতে শারদার পুত্র শরৎ – রূপে তিনি কুয়াশা ও সাদা মেঘের বেশে, কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে ও ভোরবেলার শিউলি ফুলের পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন।

“… শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে।

ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে।

তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে   কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে,

বনের প্রাণে মর্‌মরানির ঢেউ উঠালে”॥[4]

হেমন্তে তিনি হেমকান্ত স্নিগ্ধ শান্তির পূর্ণতায় পাকা শস্যের মধ্যে দিয়ে তিনি পৃথিবীতে বিচরণ করেন।

“হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা–

হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা ॥

সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে   মলিন হেরি কুয়াশাতে,

কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা ॥

ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।

দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।

আপন দানের আড়ালেতে   রইলে কেন আসন পেতে,

আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন ক’রে রাখা ॥“[5]

শীতে তিনি যেন রুদ্র সন্ন্যাসী, কিন্তু তা বিনাশের রূপ নয়, নবতর জীবনের ভূমিকামাত্র।

“হে সন্ন্যাসী,

হিমগিরি ফেলে   নীচে নেমে এলে   কিসের জন্য।

কুন্দমালতী   করিছে মিনতি,   হও প্রসন্ন॥

যাহা-কিছু ম্লান বিরস জীর্ণ   দিকে দিকে দিলে করি বিকীর্ণ।

বিচ্ছেদভারে   বনচ্ছায়ারে   করে বিষণ্ন– হও প্রসন্ন॥

সাজাবে কি ডালা, গাঁথিবে কি মালা   মরণসত্রে!

তাই উত্তরী   নিলে ভরি ভরি   শুকানো পত্রে?

ধরণী যে তব তাণ্ডবে সাথি   প্রলয়বেদনা নিল বুকে পাতি।

রুদ্র, এবারে বরবেশে তারে   করো গো ধন্য– হও প্রসন্ন॥“[6]

বসন্তে তার তপস্যা যৌবন রসের বার্তা বয়ে আনে। শীতের ধরণী যেন উমারূপী তপস্বিনী। শীতের সন্ন্যাসীই বসন্তের বরবেশে নবযৌবনকান্তি নিয়ে তপোবনপ্রান্তে এসে উপস্থিত হন স্বয়ং মহাদেব।

“রাঙিয়ে দিয়ে যাও   যাও   যাও গো এবার যাবার আগে–

তোমার   আপন রাগে,   তোমার   গোপন রাগে,

তোমার   তরুণ হাসির অরুণ রাগে

অশ্রুজলের করুণ রাগে॥“[7]

রবীন্দ্রনাথের ‘ শেষ বর্ষণ ‘ নাটকে বাদললক্ষ্মী তার ঘোমটা সরানোর পর তিনিই যেন শরৎশ্রী রূপে প্রকটিত হন সবার সামনে। এই রূপকের সাহায্যে তিনি বর্ষার বিদায়ের সাথে শরতের আগমন কে ফুটিয়ে তুলেছেন।

“তোমার   নাম জানি নে, সুর জানি।

তুমি   শরৎ-প্রাতের আলোর বাণী॥

সারা বেলা শিউলিবনে   আছি মগন আপন মনে,

কিসের ভুল রেখে গেলে   আমার   বুকে ব্যথার বাঁশিখানি॥“[8]

‘বসন্ত’ নাটকে তিনি ঋতুরাজ কে রাজা ও সন্ন্যাসী, এক সত্ত্বায় দুই রূপে বর্ণনা করেছেন। ঋতুরাজ বসন্ত ঐশ্বর্যে পূর্ণ, সেই পূর্ণতার আনন্দে তিনি তাঁর সর্বস্ব দান করে শূন্য হতে ফিরে যান। তিনি আসেন স্বর্ণরথে, কিন্তু সানন্দে ভিক্ষুকের মত দান যাত্রা করে ফিরে যান।

“সব দিবি কে সব দিবি পায়,    আয় আয় আয়।

ডাক পড়েছে ওই শোনা যায়,    আয় আয় আয়॥

আসবে যে সে স্বর্ণরথে–  জাগবি কারা রিক্ত পথে

পৌষ-রজনী তাহার আশায়, আয় আয় আয়॥

ক্ষণেক কেবল তাহার খেলা,    হায় হায় হায়।

তার পরে তার যাবার বেলা,    হায় হায় হায়।

চলে গেলে জাগবি যবে    ধনরতন বোঝা হবে,

বহন করা হবে-যে দায়,    আয় আয় আয়॥“

এছাড়া “রৌদ্র দাহ হলে সারা নামবে  কি ওর বর্ষাধারা”-[9]

এখানে রৌদের তীব্র দাবদাহকে নিবারণের জন্য যে বর্ষাকে প্রয়োজন বাংলার ঋতুতেও রবীন্দ্রনাথ তা বার বার মিলিয়েছেন। গ্রীষ্মের দাবদাহের পর যে বর্ষার আগমন হয় , সেই বর্ষার সাথে রবীন্দ্রনাথ মানব জীবনধারাকে মিলিয়েছেন এক সূত্রে। দুঃখের পরে সুখ, রাতের পরে দিন ও বিরহ-বিচ্ছেদের  মধ্যে যে মিলন  রবীন্দ্রনাথ তা বার বার দেখিয়েছেন। সেইদর্শন নিয়ে পর্যালোচনাই এই বিশ্লেষণের মূল উদ্দেশ্য।

উপসংহার

রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের সাথে বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান- জলবায়ু, আলো, বাতাস, ফুল, তরুমুল, বৃষ্টি, ঋতুচক্র, মহাকাশ ইত্যাদিকে এক সূত্রে গেঁথেছেন বারবার। শান্তিনিকেতন ও উত্তরবঙ্গের পদ্মা অঞ্চলের অপরূপ প্রকৃতি তাঁকে প্রকৃতির প্রেমে পড়তে ও গান লিখতে অনুপ্রাণিত করে এসেছে চিরকাল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রকৃতির গানের যে সম্ভার আমাদের দান করে গেছেন তার মধ্যে এত রূপ, এত রস, এত উপলব্ধি, এত বৈচিত্র্য, নিত্যদিনের অতি ছোট ছোট সাধারণ ঘটনা অথচ তাকে এত তিনি পুঙ্খানপুঙ্খভাবে ব্যখ্যা করে অতি সাধারণ রূপে বর্ণনা করেছেন। প্রাকৃতিক জগতের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি মহাবিশ্বের বিশালতা, তার সাথে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারা, ও তাদের রহস্য কবির অন্তরকে আন্দোলিত হয়েছে বারবার এবং সেই আত্মপলব্ধির জোয়ারে ভেসে গিয়ে কবির মন গেয়ে ওঠে-

“আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥

অসীম কালের যে হিল্লোলে   জোয়ার-ভাঁটার ভুবন দোলে

নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥

ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে,

ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে,

ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।

কান পেতেছি, চোখ মেলেছি,   ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,

জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥“[10]

তথ্যসূত্র


[1] https://archive.org/stream/chelebela-rabindranathtagore/chelebela-%20Rabindranath%20Tagore_djvu.txt

[2] http://www.gitabitan.net/

[3] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/keno-pantha-e-chanchalata-5185

[4] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/alor-amal-kamall-khani-5259

[5] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/hay-hemanta-lakkhi-5264

[6] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/he-sanyasi-himgiri-5279

[7] https://www.tagoreweb.in/Songs/bichitra-237/rangiye-diye-jao-5808

[8] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/tomar-nam-jani-ne-5255

[9] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/sab-dibi-ke-sab-dibi-pay-5305

[10] https://www.tagoreweb.in/Songs/prakriti-236/akash-bhara-surja-tara-5100

সহায়ক গ্রন্থ

গ্রন্থপঞ্জি

  • গীতবিতান – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  •  রবীন্দ্ররচনাবলী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  •  রবীন্দ্রসঙ্গীত – শান্তিদেব ঘোষ
  •  রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা – শান্তিদেব ঘোষ
  •  রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ  – প্রমথনাথ বিশী

Impact of Rabindra Sangeet Melodies and Instrumental Music on Hindi Film Song


Dr. Durba Singha Roy Choudhury

Abstract:

This research explores the profound influence of Rabindra Sangeet’s melodies and instrumental music on the evolution and development of Hindi film music. The abstract highlights Rabindranath Tagore’s unique approach to music composition, wherein he integrated tunes from diverse sources worldwide into his own distinctive creations. The musical environment at Thakurbari encompassed both Indian and Western songs, with Tagore’s exposure to more Western music following his 1878 trip abroad. This influence is evident in his initial ballads, ‘Valmiki Pratibha’ and ‘Kaalmrigaya,’ fashioned in an operatic style, blending foreign tunes, Bengali melodies, and classical raga-ragini. The impact of various provincial and Western tunes extends beyond ballads to many of Tagore’s songs. Notably, post-Rabindra era music directors such as Salil Chowdhury, Sachin Dev Burman, and Pankaj Kumar Mallick incorporated Tagore’s melodies into their compositions. This trend continued with later directors like Bapi Lahiri, Rajesh Roshan, and Shantanu Maitra, who also drew inspiration from Rabindranath’s tunes for their musical creations.

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুরধারার সম্মিলন – Roar বাংলা

হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে রবীন্দ্র সুরের প্রভাব এবং যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যবহার

ডঃ দূর্বা সিংহ রায়চৌধুরী, সহকারী অধ্যাপিকা, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগ, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গীতসৃষ্টির ক্ষেত্রে সারা বিশ্ব থেকে সুর সংগ্রহ করেছেন সেই সুরে তাঁর নিজস্বতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাঁর একান্ত নিজস্ব মৌলিক সৃষ্টি। ঠাকুরবাড়ির সাংগীতিক আবহাওয়ায় ভারতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি বিলাতি গানের চর্চা ছিল। তবে ১৮৭৮ সালে প্রথম বিলাত যাত্রার পর কবি আরও বেশি বিলাতি গান শোনবার সুযোগ পান। তার প্রভাবেই অপেরার আদলে সৃষ্টি হয় কবির রচিত প্রথম দুটি গীতিনাট্য – ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ এবং ‘কালমৃগয়া’। দুটি গীতিনাট্যের গানেই দেখা যায় যেমন বিদেশি সুরের প্রভাব, তেমনই বাংলাগান এবং শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিনীর ব্যবহার।

শুধুমাত্র গীতিনাট্যই নয় অনেক গানের মধ্যে বিভিন্ন প্রাদেশিক ও পাশ্চাত্য সুরের প্রভাব উল্লেখ্য। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের বিখ্যাত সংগীত পরিচালকরাও রবীন্দ্রনাথের গানের সুর গ্রহণ করেছেন তাদের নিজস্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে। যেমন – সলিল চৌধুরী, শচীন দেব বর্মন, পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রভৃতি। পরবর্তী সংগীত পরিচালকদের মধ্যে বাপি লাহিড়ী, রাজেশ রোশন, শান্তনু মৈত্র তাদের সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের সুর ব্যবহার করেছেন।

 হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে রবীন্দ্রনাথের সুর প্রয়োগ দুই প্রকারে হয়েছে

  • সমগ্র হিন্দি গানে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রায় এক সুর এবং কথারও প্রায় একই অনুবাদ 
  • রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের প্রভাব কিন্তু গানের বেশিরভাগ অংশেই সংগীত পরিচালকের সুরের নিজস্বতা
  • সমগ্র হিন্দি গানে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রায় এক সুর এবং কথারও প্রায় একই অনুবাদ  ১। ১৯৫০ সালে ‘আফসার’ Afsar ছায়াছবিতে নরেন্দ্র শর্মার কথায় এবং শচীন দেব বর্মণের সুরে একটি গান ব্যবহৃত হয় – ‘নৈন দিওয়ানে এক নেহি মানে’ – গানটি গেয়েছিলেন সুরাইয়া – Suraiya Jamal Sheikh। সম্পূর্ণ গানটির সুর রবীন্দ্রনাথের ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানটির মত।  

২। ১৯৫২ সালের ‘জলজলা’ Zalzala ছায়াছবিতে সত্যকুমারের কথায় এবং পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুরে একটি গান ব্যবহৃত হয় – ‘পবন চলে জোর, লহর মচায়ে শোর’ – গানটি গেয়েছিলেনও স্বয়ং পঙ্কজ কুমার মল্লিক। গানটির শুরুতে ‘হৈ য় – হৈ য়’ শব্দবন্ধের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শুরুর সুরটির স্বরলিপি নিম্নরূপ –

II সা ঋ ঋ গা । ঋ –া সা না্। সা ঋ ঋ গা । ঋ –া সা না্।

I প ব  ন  চ   লে o  জো র    ল  হ  র  ম    চা য়ে শো র ।

I না্–া  না্  না্। সা –া ঋ গা । ঋ –া সা –া ।(সা ঋ  না্-া )।  -া –া –া –া II

  নৈ   o  য়া   কো   জো র  সে চ   লা  ই  য় o      o o  o   o        o  o   o   o

‘পকড়কে জোর হাথ উঠাকে বাঁধো পাল’ এই অংশ পর্যন্ত কিছুটা সুর আলাদা হলেও সম্পূর্ণ  গানটির কথা ও সুরের মিল লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘খরবায়ু বয় বেগে’ গানটির সঙ্গে। গানটি হিন্দি ভাষায় থাকার কারণে সম্পূর্ণ গানটির কথা ইংরাজি অক্ষরে দেওয়া হল –

Hai o hai o hai o
Pawan chaley zor
Lehar machaaye shor
Naiya ko zor se chalaiyo
Naiya ko zor se chalaiyo

Pakad ke zor haath
Utha ke baandho paal

Hai maaro maaro zor

Hai o hai o hai o

Bedi se baar baar
Jhananana jhankaar
Ye to nahin naiya
Ki krandan chitkaar

Zulm-o-sitam se
Kabhi na darnaa
Himmat se badh jaiyo
Hai maaro maaro zor

     Hai o hai o hai o

৩। ১৯৫৩ সালে মহম্মদ হানিফ এর পরিচালনায় হামদরদ Humdard ছায়াছবিতে Prem Dhawan র কথায় অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘মেরে মন কি ধড়কন মে কোই নাচে’ গানটি গেয়েছিলেন মান্না দে। সম্পূর্ণ গানের কথা ও সুরে দেখা যায় ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে’ গানের প্রভাব।

 ৪। ১৯৫৪ সালে নীতিন বসুর পরিচালনায় ‘ওয়ারিশ’ waris ছায়াছবিতে Qamar Jalalabadi র কথায় এবং অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘রাহি মতওয়ালে’ গানটি গেয়েছিলেন Talat Mahmood ও Suraiya Jamal Sheikh। তাঁরা শুধুমাত্র যে গান গেয়েছিলেন তা-ই নয়, তাঁরা অভিনয়ও করেছিলেন। গানটি দুই ভাবে গাওয়া হয়েছে, একটি দ্রুত লয় এবং অপরটি ধীর লয়। প্রায় সম্পূর্ণ গানটির সুরেই পরিলক্ষিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘ওরে গৃহবাসী’ গানটির প্রভাব। যদিও সঞ্চারী অংশে কিছুটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।

যন্ত্রানুসঙ্গ – দ্রুত লয়ের গানের সঙ্গে ধীর লয়ের গানের পাঠভেদ লক্ষণীয়। আর ধীর লয়ের গানটির মধ্যে শুরুতে সেতার এবং সম্পূর্ণ গানে শ্রীখোলের ব্যবহার উল্লেখ্য।  

৫। ১৯৬২ সালের ‘মা-বেটা’ Maa-Beta ছায়াছবিতে প্রেম ধাওয়ানের  কথায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে একটি গান ব্যবহৃত হয় – ‘মন মেরা উড়তা যায়ে’ – গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সম্পূর্ণ গানটির কথা ও সুরেই পরিলক্ষিত হয় কবিগুরুর ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটির প্রভাব। গানটির কথা নিম্নরূপ –

Man mera udta jaye
Badal ke sang dur gagan me
Aaj nashe me gaata git milan ke re
Rimjhim rimjhim rimjhim

Aas ke pankh lagakar panchi mastana
Pi ki nagariya aaj chala dil divana
Ghan ghan badal garje to kya
Cham cham bijli chamke to kya
Chanchal man to rukna kahi na jane re

Uthti hai jaise sagar me
Kal kal chal chal karti tarange
Man me vaise hi jaag rahi
Pal pal vyakul mast umange
Aaj na roko pyar ke is divane ko
Aatho se dil jata hai to jane do
Tod chala ye bandhan sare
Jaha sajan ka pyar pukare
 

৬। ১৯৯৮ সালে ‘যুগপুরুষ’ Yugpurush ছায়াছবিতে Majrooh Sultanpuri র  কথায় এবং রাজেশ রোশনের সুরে একটি গান ব্যবহৃত হয় – ‘কোই জ্যায়সে মেরে দিলকা দার খটকায়ে’ – গানটি গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে। সম্পূর্ণ গানটির সুরেই পরিলক্ষিত হয় কবিগুরুর ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ গানটির প্রভাব।

যন্ত্রানুসঙ্গ – যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীতটির সঞ্চারী অংশের সুর গানে ব্যবহৃত হয়নি। দুটি অন্তরার মাঝখানে সারেঙ্গী ও বাঁশীর ব্যবহার উল্লেখ্য। আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যা এই গানের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় তা হল গানের শেষে পুরুষ কণ্ঠে [কার কণ্ঠ উল্লিখিত নেই] গানটির স্বরলিপি পরিবেশিত হয়, কিন্তু টনিক পরিবর্তন করে – ‘তুমি কেমন করে গান কর হে’ গানটির স্বরলিপি –   

TUMI_KEMON_KORE_GAAN.gif 

কিন্তু গানে স্বরলিপিটি গাওয়া হয়েছে – গা গা II গা মা ধা পা । পা মা মা গা। রা গা গা রা।

সা না্ ধা না্ । না্-া  সা -া । 

৭। ১৯৯৮ সালে ‘যুগপুরুষ’ Yugpurush ছায়াছবিতে Majrooh Sultanpuri র  কথায় এবং রাজেশ রোশনের সুরে আরও একটি গান ব্যবহৃত হয় – ‘বন্ধন খুলা পঞ্ছি উড়া’ – গানটি গেয়েছিলেন Ravindra Sathe। প্রায় সম্পূর্ণ গানটির সুরেই [অন্তরার একটি পংক্তি ছাড়া] পরিলক্ষিত হয় কবিগুরুর ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানটির প্রভাব। এই গানটির শেষেও পুরুষ কণ্ঠে গানটির স্বরলিপি গীত হয়েছে।

৮। ২০০৫ সালে ‘পরিণীতা’ Parineeta ছায়াছবিতে Swanand Kirkire র  কথায় এবং Shantanu Moitra র সুরে একটি গান ব্যবহৃত হয় – ‘সুনা মন কা আঙ্গন’ – গানটি গেয়েছিলেন সনু নিগম এবং শ্রেয়া ঘোষাল। গানটিতে শান্তনু মৈত্র তাঁর শৈলী দ্বারা  নিজস্ব সুর সৃষ্টি করলেও, গানের মাঝে মাঝেই বারবারই ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানটির সুর ব্যবহৃত হয়েছে। ছায়াছবিটি দেখলে এটি পরিষ্কার বোঝা যায়, সইফ আলি খানের স্মৃতিরোমন্থন বারবার তাঁকে তাঁর  শৈশবে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কবিগুরুর এই গান তার বারবার মনে পড়ছে। সংগীত পরিচালক গানটির ব্যবহার খুব সুন্দর ভাবে করেছেন।

গানটি ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নলিখিত কথায় –

‘…phul phul bhanwara dole, man mai gunji teri yaad
bag mai papiha bole, pihu pihu pihu kaha…’

৯। ২০১২ সালে সুজয় ঘোষ এর পরিচালনায় কাহানি Kahaani ছায়াছবিতে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে ব্যবহৃত হয় ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটি।   

  • রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের প্রভাব কিন্তু গানের বেশিরভাগ অংশেই সংগীত পরিচালকের সুরের নিজস্বতা

 ১। ১৯৪২ সালে Ravi Pradeep র কথায় অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘অব তেরে সিওয়া কৌন মেরা কৃষ্ণা কনহাইয়া’ গানটি গেয়েছিলেন এবং অভিনয় করেছিলেন Amirbai Karnataki। গানটির মধ্যে ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ গানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

যন্ত্রানুসঙ্গ – গানে শ্রীখোলের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।

২। ১৯৪৭ সালে ‘দো ভাই’ ছায়াছবিতে একটি গান ব্যবহৃত হয় গীতা দত্তের কণ্ঠে – ‘মেরা সুন্দর সপনা বীত গয়া’। গীতিকার – Raja Mehendi Ali Khan, সুরকার – S.D. Barman। সম্পূর্ণ গানেই দেখা যায় ‘রোদন ভরা এ বসন্ত’ গানের আভাস।  

৩। নীতিন বোস পরিচালিত ‘দিদার’ Deedar ছায়াছবিতে [১৯৫১] লতা মঙ্গেশকর এবং শামশাদ  বেগমের কন্ঠে গাওয়া ‘বচপন কে দিন ভুলা না দেনা’ গানটির সঙ্গীত পরিচালক Naushad এবং কথা Shakeel Badayuni। এই গানটির প্রথম লাইনে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের ‘মনে রবে কি না রবে আমারে’ গানের সুরের আভাস।

৪। ১৯৫৪ সালে চেতন আনন্দের পরিচালনায় ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছায়াছবিতে একটি গান ব্যবহৃত হয় – ‘যায়ে তো যায়ে কাঁহা’। গানটির সংগীত পরিচালক ছিলেন শচীন দেব বর্মন এবং গানটির কথা Sahir Ludhianviর। গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর এবং তালাত মাহমুদ। গানটির প্রথম লাইনটির রবীন্দ্রনাথের ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গানটির সাদৃশ্য বর্তমান।

৫। শরৎচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে ১৯৫৪ সালে বিমল রায়ের পরিচালনায় একটি ছায়াছবি মুক্তি পায় – ‘বিরাজ বহু’। সলিল চৌধুরীর সংগীত পরিচালনায়, প্রেম ধাওয়ানের কথায় সেই ছায়াছবিতে একটি গান প্রকাশিত হয় ‘মেরে মন ভুলা ভুলা’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে গানটি গীত হয়। গানটির প্রথম পঙক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘হৃদয়ের একুল ওকুল দুকুল ভেসে যায়’ গানটির সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও পরবর্তী অংশে ‘আমি কান পেতে রই’ গানটির অন্তরার সুরের সঙ্গেও অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়।

যন্ত্রানুসঙ্গ – গানটি কবিগুরুর গানের সুরের আঙ্গিকে শুধুমাত্র যে ব্যবহার করা হয়েছে তা-ই নয় বাঁশি এবং শ্রীখোলের ব্যবহার এই গানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

৬। ১৯৫৯ সালে বিমল রায় পরিচালিত ‘সুজাতা’ ছায়াছবিতে ‘একদা তুমি প্রিয়ে’ গানের আভাসে Majrooh Sultanpuri র কথায় এবং শচীন দেব বর্মণের সুরে একটি গান ব্যবহৃত হয় – ‘জলতে হ্যাঁয় জিসকে লিয়ে’। যদিও হিন্দি গানটি দাদরা তালে গাওয়া হয়েছে।

৭ । ১৯৭১ সালে ‘দূর কা রাহি’ ছায়াছবিতে কিশোর কুমারের কণ্ঠে গীত ‘পন্থি হু ম্যায় উস পথ কা’ গানটির ভাবে এবং সুরে পাওয়া যায় ‘পথের শেষ কোথায়’ গানের আভাস। গানের গীতিকার A Irshad, সুরকার – কিশোর কুমার।

৮। ১৯৭৩ সালে ‘অভিমান’ ছায়াছবিতে কবিগুরুর ‘যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে’ গানটির অবলম্বনে ব্যবহৃত হয় ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে রয়না’ গানটি । কিশোর কুমার এবং লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া এই বিখ্যাত গানটির গীতিকার ছিলেন – Majrooh Sultanpuri সুরকার ছিলেন শচীন দেব বর্মণ। যদিও সংগীত পরিচালক শুধু প্রথম লাইনটিতেই এই সুরটি গ্রহণ করেছেন।

যন্ত্রানুসঙ্গ – গানের মধ্যে সেতার ও বাঁশির ব্যবহার গানটিকে একটি অন্য মাত্রা দিয়েছে।

৯। ১৯৭৭ সালে ‘আপকি খাতির’ ছায়াছবিতে লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে গীত হয় ‘রাজা মেরে তেরে লিয়ে’ গানটি।  যার গীতিকার ছিলেন শৈলী শৈলেন এবং সুরকার বাপি লাহিড়ী।  গানটির শুধু ‘রাজা মেরে তেরে লিয়ে’ – এইটুকু অংশে দেখা যায় সুরটি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’র মত কিন্তু বাকি অংশে গানের সম্পূর্ণ সুরে সুরকারের নিজস্বতা লক্ষণীয়।

১০। ১৯৭৮ সালে ‘টুটে খিলোনে’ ছায়াছবির অন্তর্গত ‘ননহাসা পঞ্ছি রে তু বহত বড়া পিঞ্জরা তেরা’ গানটির কথা কৈফি আজমি এবং সুর বাপি লাহিড়ীর। এই গানটির প্রথম লাইনের সুরটির সঙ্গে  শুধু ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ বা ‘আমারে কে নিবি ভাই’ গানটির সুরের চলনের সঙ্গে মিল আছে। গানটি কিশোর কুমারের কন্ঠে গীত হয়েছে।

১১ । ১৯৮১ সালে ‘ইয়ারানা’ ছায়াছবিতে রাজেশ রোশনের সংগীত পরিচালনায়, কিশোর কুমারের কন্ঠে গীত হয় ‘ছুঁ কর মেরে মনকো’ গানটি। প্রথম লাইনটির সঙ্গে ‘তোমার হল শুরু’ গানটির মিল পরিলক্ষিত হয়। এই গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

এই গানটিরও মাঝে মাঝে বাঁশির ব্যবহার উল্লেখ্য। 

১২ । ‘ঝুটি’ নামক ছায়াছবিতে [১৯৮৫] বাপ্পি লাহিড়ীর সংগীত পরিচালনায় মায়া গোবিন্দের কথায় কিশোর কুমার ও লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে একটি গান গীত হয় – ‘চন্দা দেখে চন্দা তো চন্দা শরমায়ে’ – গানটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’ গানটির প্রথম লাইনের সুরের মিল পরিলক্ষিত হয়।

যদিও হিন্দি গানটি তেওড়া তালে নিবদ্ধ এবং গানের বাকি অংশে পরিচালক তার নিজস্বতায় ভরিয়ে তুলেছেন, কিন্তু সমগ্র সুরেই কবিগুরুর এক গায়কীর আভাস অনুভূত হয় যেন।

যন্ত্রানুসঙ্গ – এই গানে ও তবলা এবং বাঁশির ব্যবহার গানটিকে অন্য মাত্রা প্রদান করেছে।

১৩।  ১৯৯৮ সালে ‘যুগপুরুষ’ ছায়াছবিতে একটি গান ব্যবহৃত হয়েছে ‘এ জীবন পথ মেরা’ – যার প্রথম পঙক্তির সঙ্গে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটির মিল লক্ষণীয়।

উপরোক্ত দ্বিতীয় বিভাজনের সকল গানেই রবীন্দ্রনাথের সুরের আভাস পাওয়া যায় মাত্র। বাকি সম্পূর্ণ গানটিতেই পরিচালকের নিজস্বতায় পরিপূর্ণ।

চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কথায়, ‘The popularity of the songs has been consistent from the time these were written and will remain the same because Tagore has woven every emotion in them through his works and music. The result can be seen not only in Bengali, but also in Hindi.’

সর্বোপরি একটি কথাই বলা যায় যে সুর হল সমগ্র বিশ্বের। সঙ্গীতের না থাকে কোন দেশ বিভাজন, না থাকে কাল বিভাজন। সুরের যে নান্দনিক বোধ, তার উপলব্ধি সমগ্র বিশ্বের কাছেই সমান।

সহায়ক লিঙ্ক  

  1. https://youtu.be/2kTvpo_tZu8
  2. https://indianexpress.com/article/lifestyle/art-and-culture/rabindranath-tagore-in-bollywood-hindi-film-songs-based-on-rabindrasangeet-4647441/
  3. https://www.republicworld.com/entertainment-news/bollywood-news/rabindranath-tagores-songs-influenced-many-hindi-film-songs.html
  4. http://unmeshpatil.blogspot.com/2019/08/ravindra-sangeet-in-hindi-film-songs.html
  5. https://www.researchgate.net/publication/361580472_Rabindranath_Tagore’s_Views_on_Camera_Cinema_and_Film_Adaptation
  6. https://www.academia.edu/10315517/Tagore_Cinema_and_the_Poetry_of_Movement
  7. https://www.jstor.org/stable/23508496
  8. https://www.cinestaan.com/articles/2018/aug/7/14885/tagore-s-eternal-music-and-its-influence-on-cinema-death-anniversary-special

দুরাভাস – 9804145248 / 9836620426, মেইল – durba697@gmail.com

Music in the Manasa Cult of Bengal: Significance of the Traditional Folk-drama Performances

Aindrila Dutta Chowdhury, Ph.D. Research Scholar, Department of Music, University of Delhi

Abstract

The worshipping of the snake goddess Manasa has been quite popular in Bengal, mostly in the rural parts. Throughout the year, especially in the rainy season, one can find several ritualistic as well as non-ritualistic performances related to the folk deity are going on. Focusing on non-ritualistic performances, music plays a significant role in almost all forms of the Manasa-oriented performance tradition. Based on the previous works and critical observations, this paper primarily deals with the systematic and scientific study of the musical analysis of Bhashan Jatra and Bishahara, the two main folk drama performance traditions of Manasa where the performers portray the stories of the chosen deity by amalgamating the three various mediums of art- acting, storytelling and music. In addition, the introductory part explores the historical evolution of the practice of worshipping Manasa in Bengal, and the conclusion part talks about the contemporary trends of these particular art forms. 

Keywords: Bhashan Jatra, Bishahara, Folk Drama, Manasa, Bengal.

Introduction

Telling stories of various deities to preach their glory to the world has been largely well-known from the very beginning and the storytellers prefer using music to portray these stories in a more beautiful manner. Manana, the snake goddess has been a source of various performance traditions in the eastern parts of India, especially in the Indian subcontinent of West Bengal. It is interesting to notice that in these performance traditions, the theme remains the same but their name and performative style differ because of their regional influences. Starting flourishing in the medieval period, these performances still are seen to be practiced throughout the year, especially in rural Bengal. From the women of the houses performing Manasa Brata[1] and singing the ritualistic Brata-Gaan[2] to the fully commercial non-ritualistic theatrical performances of Manasa, e.g., Bhashan Jatra (also known as Manasa Jatra) and Bishahara, music plays a very significant role in all of these performance traditions.

Manasa cult and Manasa narratives

In India, we have the Nag-puja tradition. In North India Nagraj Vasuki is worshipped in zoomorphic form, in South India live snakes are worshipped, and in Bengal, a folk goddess named Manasa is worshipped in the anthropomorphic form. Scholars are of various opinions regarding the origin of Manasa. Research says that the goddess was popular among the people in Bengal in different eras by different names. Till the era of the Buddhist Pala dynasty, the goddess was known as Janguli and at the time of the reawakening of Hinduism the name Janguli[3] was relinquished, and instead of that the goddess was newly named Bishahari because of its alexipharmic quality. The name Manasa is comparatively a modern name for the goddess Janguli and also the folk deity Manasa is quite identical to the south Indian goddess Manchamma or Mane Manchamme[4].

But the mention of the name Manasa is not found in any Sanskrit Purana or Ramayana or Mahabharata or even in Panini’s Ashtadhyayi. It was only around the 12th century onwards, that the name of the goddess Manasa has been started mentioned in Padma Purana, Devi Bhagvata Purana, and Brahmavaivarta Purana.

A type of religious narrative poem was popular in Bengal from the thirteenth century CE to the eighteenth-century CE. This narrative poem is called Mangal Kavya. It has dealt with the different cultures, faiths, and lifestyles of several religious and regional sects. In Bengal, the myth of the goddess, Manasa has been expanded and explored in detail and by large in the Manasamangal kavya, the sacred book that relates to the great name of the goddess, which has been written from the twelfth century CE to the nineteenth century CE in Bengal. The widely popular Manasamangal Kavya or Manasamangal Pala[5] is regarded as the oldest among the Bengali Mangal Kavya literature and has been written under various names, like Manasamangal, Padmapuran, and Manasavijay, through the ages. A total of fifty-eight poets of the Manasamangal are listed in the book, History of Bengali Literature and Language (Sen, 1954). From the narrative technique perspective, Manasamangal literature is generally divided into three regional aspects, e.g., West Bengal, East Bengal or Bangladesh, and North Bengal or Assam. (Sen, 1940). So, it can be said that the poets of Manasamanal literature can be separated as – West Bengal – Bipradas Piplai, Ketakadas Khemananda, etc, North Bengal & Assam – Tantrabibhuti, Jagajjiban Ghoshal, Jibankrishna Maitra, Durgabar, Mankar, etc, East Bengal or Bangladesh – Vijaygupta, Narayandev, Dwija Bangshiya, etc.

Manasa Mangal Kavya emerges at a time when Saivism in Bengal is getting replaced by the Sakta cult. The worship of the serpent goddess reveals its strong association with non-Aryan cultural influences. In fact, the worship of Manasa is prevalent all over Bengal especially the rural Bengal and the neighboring regions among the people of the lower stratum of the society like the Dom, Bauri, Keot, Mal, Bagdi, etc., mostly Hinduised aboriginals (Jash, 1986). 

The eastern provinces of India and the peninsula of the Deccan are the places where the Aryan influence could not spread so effectively. Hence it is this part of India that possesses some of the pre-Aryan cultural characteristics (Bhattacharya, 1977, p. 131)

The deity is worshipped regularly in a permanent shrine[6] or in a Manasa sij,[7], particularly during the rainy season. On the last day of the Bengali month of Ashadha (June-July), Shravana (July-August), and of Bhadra (August-September), Manasa is worshipped all over Bengal.

Manasa Performance tradition: Bhashan Jatra & Bishahara

In Bengal, numerous performances related to the goddess Manasa can be seen performing throughout the year, especially in the rainy season by using various mediums – songs, drama, pictures, storytelling, etc.

 As far as performance is concerned, these Manasa narratives can be performed in various ways. These are the four principal forms in which the narrative has been adopted for folk amusement: viz, Bhasan Yatra, a popular drama; Rayani, a kind of musical entertainment; Jagaran, a musical recitation of the narratives; and Putul Nach, a puppet dance. In addition to these principal forms, there are a few others of minor importance (Bhattacharyya, 1965, p. 10)

The following chart describes the present scenario of the Manasa performance tradition of West Bengal:

If we consider the following definition of storytelling, we can see that throughout the ages, the Bhashan Jatra of South Bengal & the Bishahara of North Bengal has been a platform where several methods of communication mingled- including folklore, oral tradition, acting, and music- all of which helped to amalgamate, involve, and portray the stories of Manasa and its ideations.

“Storytelling is the art or craft of narration of stories in verse and/or led by one person before a live audience; the stories narrated may be spoken, chanted or sung, with or without musical, pictorial, and/or other accompaniment, and maybe learned from oral, printed, or mechanically recorded sources, one of its purposes must be that of entertainment”. (Anne Pellowski, The World of Storytelling, 1977, 3-5)

It is believed that because of the regional influences, the performers of Bhashan Jatra of South Bengal and Bishahara of North Bengal generally follow the text of the Manasa Mangal poets Ketakadas Khemananda and Jagajjiban Ghoshal respectively.

Performative style

Focusing on Bhashan Jatra and Bishahara, both of the performance traditions have ritualistic as well as non-ritualistic elements. Among the people of North Bengal especially among the Rajbangshi[8] community listening to the songs of Bishahara is regarded auspicious and as the story of Behula and Lakhindar, the two main protagonists of Manasa Mangal is a story of the reawakening of life, at the wedding, Bishahara pala is arranged by the groom’s side for the goodwill of the newlyweds. If these two folk drama performances are performed for ritualistic purposes only, then the performative style remains simple, and these can be played for six to seven nights generally. But now, because of increasing commercialization, these performance traditions become more professional, and various professional groups are found that perform these palas throughout the year regularly. Long prose dialogues, loud makeup, light, etc make these performative styles even more theatrical[9] where the performers are seen to perform only a small section of the Manasa Mangal Pala, preferably the part of Behula and Lakhindar which can be played within three to four hours. This type of compact and concise theatrical representation of Bhashan Jatra and Bishahara performance tradition is seen usually in recent times.

Both the ritualistic and non-ritualistic performances start with a concert[10], generally, is played to attract the attention of the audience at the beginning of a performance, and then the Vandana music is performed where the performers seek blessings for the gods and goddesses and their gurus[11].

The theatrical representation of both of these performances needs a total of ten to twelve performers where there should be one Geedal or the director (also known as sutradhar) of the play who sings the entire pala, one Doyari or the Buffon who basically assists the director to carry out the play and sometimes gives the audience comic relief. Other than these two performers there should be some accompanying singers[12], dancers,[13], and musicians[14].      

Music in the Manasa folk drama performances – a scientific study

Written in the Bengali language, the entire performances of Bhashan Jatra and Bishahara are the perfect blend of oral literature that has been passed down over generations by word of mouth and numerous instant musical dialogues which the performers create during their performance rapidly.

Revealing the stories of Manasa, both of the folk drama performances preferably concentrate on the life of Behula (the women protagonist of the Manasa Mangal literature) and her chastity. Starting with the pre-composed traditional Vandana music, the entire conversation of the Pala is in the musical form which is delivered in various styles, e.g., kathakata, question-answer, etc.

If we concentrate on the musicality of the songs used in these two performance traditions, we can notice that like any other genre of music, these songs also comprise tonal and rhythmic structures. Now examining the tonal structure, the range of these songs is between the middle and the higher octave as the main target of this performance is to tell the stories to the listeners and make them understand that is why the performers preferably do not choose the lower octave. Generally, the performers of these performance traditions use the musical scale equivalent to Hindustani classical music ragas[15], e.g., Bilawal[16], Kafi[17], Khamaj[18], Bhairavi[19], etc. Especially, the use of Komal Ga and Komal Ni can be found in all genres of pala gaan tradition. If we analyze the rhythmic structure usually, 3/3,4/4, and 5/5 beats are found in the songs.  From this perspective, it is considered that the songs are sung in the Hindustani classical music tala[20] named Dadra[21], Keherwa[22], Ektali[23], Jhaptal[24], Ar-theka[25], Jhumur[26], etc.

Like other Pala Gaan performances of Bengal, dance is one of the major elements in Bhashan Jatra and Bishahara as well. As these two folk forms have been performing for ages, previously women were not allowed to perform in front of audiences, which is why young boys are seen dressing up as women and dancing like them. The peculiarity of the Bhashan and Bishahara dance can be easily noticed because the dancers move and dance like snakes as the performance reveals the stories of Manasa, the snake-goddess.

The musical instruments used in the Bhashan Jatra and Bishahara performances are Khol, Kartal, Mandira, etc. Some regional influence can be seen in the use of musical instruments in both performances, especially, in Bishahara we can find the use of the regional musical instruments, Mukhabanshi[27] and Dotara.  

Mukhabanshi

Conclusion

Though centuries ago, Bhahashan Jatra and Bishahara started flourishing as a ritual among the people of Bengal where the main purpose of this tradition was to make people know about the greatness of the goddess Manasa, now it has also become the source of entertainment for the society.

Nowadays, like in any other traditional art form, in the case of Bhashan Jatra and Bishahara too, it is a matter of debate when comes to the word ‘originality’. Once we comprehend the dynamics of oral composition, we have to leave the idea of the ‘original’ of any traditional song. In fact, each performance is an original; it is futile to retrace the work of generations of singers at the moment of composition. One song keeps changing as many times as it is sung by different singers. So, the process of change continues from generation to generation. We must be content with the texts that we have; we must not endeavor to ‘correct’ or ‘perfect’ them in accordance with a purely arbitrary guess at what the original might have been. The use of heavy costumes, make-up, lights, long prose dialogue, characterizations, and use of electronic musical instruments, are some of the shreds of evidence of the evolution that highly influenced every Pala Gaan tradition of Bengal. But it is painful that in recent times, the dominance of the contemporary tune of film songs in a Bhashan Jatra or a Bishahara performance has increased so much that the original tune has been corrupted or lost in many ways. Sometimes, even the performers or the artists have no idea about what the original tune was and what has been evaluated. The possible reasons for this evaluation can be one, the popularity of the film songs, two, the financial and social crisis of the performers of Rayani Gaan as the number of performances has now become so less that they cannot survive only on the basis of earnings from their performances, three, the lack of awareness of the tradition among the people of the society and so on.

Apart from the formation and presentation style of Bhashan Jatra and Bishahara, needless to say, the thematic element remains unchanged even today and that uniqueness is the key element of these two performance traditions to keep its standing as a performance tradition through centuries.

Frame from the Bhashan Jatra performance performed by the Jayanti Jatra Unit, at Ramrajatala on 16th March 2023

Reference

Ahmed, W. (1965). Banglar Lok Sanskriti. Dhaka: Bangla Akademi.

Bhattacharyya, A. (1954). Banglar Lok Sahitya. Calcutta: Calcutta Book House.

Bhattacharyya, A. (1979). Bangla Mangal Kavyer Itihas. Calcutta: Calcutta Book    House.

Bhattacharyya, A. (1965). The Serpent as a Folk-Deity in Bengal. Asian Folklore Studies, 24(1), 1–10. https://doi.org/10.2307/1177595

Bhattacharya, J.M. (1949). Manasa Mangal by Ketakadas Khemananda. Calcutta: Calcutta University.

Biswas, A. (2017). Manasa Mangal by Vijay Gupta. ed. Kolkata: New Boipotro.

Clark, T. W. (1955). Evolution of Hinduism in Medieval Bengali Literature: Śiva, Caṇḍī, Manasā. Bulletin of the School of Oriental and African Studies, University of London, 17(3), 503–518. http://www.jstor.org/stable/609593

Dasputa, S.C. (2009). A Journey to Joramath and its Manasamangalpala. Calcutta: Centre of Advanced Study, Department of Comparative Literature, Jadavpur University.

Dimock, E. C. (1962). The Goddess of Snakes in Medieval Bengali Literature. History of Religions, 1(2), 307–321. http://www.jstor.org/stable/1062059

Finnegan, R. (1977). Oral Poetry: Its nature, significance, and social context. London: Cambridge University Press.

Jash, P. (1986). THE CULT OF MANASA IN BENGAL. Proceedings of the Indian History Congress, 47, 169–177. http://www.jstor.org/stable/44141538

Jazeel, T. (2005). The World Is Sound? Geography, Musicology, and British-Asian Soundscapes. Area, 37(3), 233–241. http://www.jstor.org/stable/20004456

Mitra, H. (1414 Poush). Banglar Lokoutsab O Lokosilpo. Calcutta: Bangiya Sahitya Parishad

Mitra, S.K. (1382 Ashad)). Pashchimbanglar Lokosanskriti Bichitra. Calcutta: Biswas Publishing House.

Sen, S. (1960). History of Bengali Literature. New Delhi: Sahitya Akademi.

Sengupta, P. (1984). Puja Parboner Utsabkatha. Calcutta: Pustak Bipani.

Sur, S. (1982). Banglar Prachinatama Lokopuran: Manasamangal. In P. Sengupta (Ed.), Banglar Prachinatama Liko Puran (pp. 96-111). Calcutta: Pustak Bipani.

Rahman, H. (1982). Bangladesher Lokosangeet O Bhougalik Paribesh. Dacca: Bangla Akademi

Sen, A. & Islam, S.M. (2012). Sarpa-Sanskriti O Mansa. Kolkata: Bangiya Sahitya Samsad.


[1] Some religious rituals are related to a particular deity and are performed by the women of the houses traditionally.

[2] Songs of Brata

[3] ‘The Hindu Goddess Manasa or Visahari has a marked resemblance to the appearance of Janguli, and some of the Dhyanas in the Hindu Tantric works for the goddess distinctly give her the epithet of Janguli’ (Bhattacharya, 1958, p. 80)

[4]‘The Senas came from Southern India and settled in Bengal in the middle of the eleventh century CE. They very likely favored the worship of the snake goddess Manch and their rise probably gave an impetus to her popularity’ (Bhattasali, 1929, p. 224)

[5]The Bengali word Pala means a branch. Pala gaan means a branch or a small section of a musical drama

[6]Temples made with mud walls and covered with straws, commonly known as ‘Manasa-badi’ (House of Manasa)

[7]Kind of tree (scientific name – Euphobia Lingularia)

[8]Ethnic Koch people are found in North Bengal, lower Assam, Bangladesh, Bihar, Nepal, and Bhutan.

[9]Jatra, a performance tradition of Bengal

[10]A loud musical piece played by all of the musicians of the performance

[11]Teachers or the ancestors of the performers

[12]Dohar

[13]Chokra or chukri

[14]Vadak

[15] Literary means ‘coloring’, a raga is a specific grouping of musical notes.

[16]Ragas with all Buddha swaras, musical notes

[17]Raga with Komal Ga and Komal Ni and the rest of the notes are Suddha. Komal Swara is a half note below the Suddha Swara

[18]Raga is with Komal Ni and the rest of the notes are with Suddha.

[19]Raga where Re, Ga, Dha, and Ni are Komal. The rest of the notes are Suddha.

[20]musical meter

[21]tala comprises six beats

[22]tala with eight beats

[23]tala comprises twelve beats

[24]Ten beats tala

[25]tala with twelve beats

[26]Eight beats tala

[27]kind of flute, popular in the North Bengal region, especially in the Jalpaiguri district.

New Experiments in the Application of Rabindra Sangeet in Film Modernity (Post Copyright Episode)

Dr. Pratiti Pramanik De
Gobardanga Hindu College
Music Dept.

Abstract :
Film is a young and modern industry.  This opened up a huge field of interesting possibilities for new composers.  The use of music started from the first stage of film exhibition (1885). It acts as a huge weapon in the film apart from connecting the music as well.  Through music we try to express the image’s message in a parallel way on another huge level. Our main focus in the film is vocal music.  And Rabindra Sangeet is the best example in this regard. The relevance of Rabindranath’s songs is therefore eternal.  But the change that can be noticed today is the attempt to make Rabindra Sangeet more contemporary with the passage of time.  As a result, its acceptance has increased and it has become easier to reach people, especially the younger generation. Rabindrasangeet will continue to fill Bengali films in many different ways with songs, sounds and creations in the future.

Key notes : Film, Rabindrasangeet, New generation, contemporary. 

চলচ্চিত্রের আধুনিকতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা (উত্তর কপিরাইট পর্ব)

ডঃ প্রতীতি প্রামণিক দে, গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ,সঙ্গীত বিভাগ

         সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ মানবীয় বৈশিষ্টের উৎকর্ষসাধন। কোনস্থানের মানুষের আচার ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, শিক্ষাদীক্ষা, ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হ্য, তাই সংস্কৃতি। শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে তা সাহিত্য বা সংগীত যাই হোক না কেন তার প্রধান স্বরূপটি হল নন্দনতত্ত্ব। এবং এই নন্দনতত্ত্বর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল প্রকাশ।শিল্পী যে উপলব্ধি নিয়ে তাঁর শিল্পসৃষ্টি করেছেন সেই প্রকাশিত রূপ হুবহু একই উপলব্ধিতে দর্শক বা শ্রোতার কাছে সবসময় গ্রহণীয় হয় না। দর্শক বা শ্রোতা তাঁর নিজস্ব উপলব্ধিরও কিছুটা মিশ্রণ ঘটান। রবীন্দ্রনাথ নামটি ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালির মনে প্রানে প্রতিটি রক্তবিন্দুতে প্রতিটিক্ষণে প্রবহমান। নামটির সাথেই কোথাও গভীর উপলব্ধি জড়িয়ে থাকে । ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও তিনি সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। তবে এক্ষেত্রে বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গী, চেতনা ও উপলব্ধির বিশেষ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এর একটি বিশেষ কারণও আছে – ২০০১ সালে কপিরাইট উঠে যাওয়া। বিশ শতকে সংস্কৃতি বা চলচ্চিত্র জগতে রবীন্দ্রসৃষ্টিকে যখন সম্পূর্ণ প্রকৃত ভাবে কাজে লাগানো হত সেখানে কিছুটা রবীন্দ্রভাবনার সরাসরি প্রভাব পড়ত। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দিকটি বিচার করলে দেখা যায় স্বরলিপি নির্দেশ অনুসারে পালন করে সঙ্গীতগুলি পরিবেশিত হত। তার ফলে গায়নশৈলী, বাচনভঙ্গি এমনকি সর্বাঙ্গীণভাবে গানটির ভাবও ফুটে উঠত সহজে। তারসঙ্গে যন্ত্রানুসঙ্গের প্রয়োগ হত খুব পরিমার্জিতভাবে। একই বিষয় পরিলক্ষিত হয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রসাহিত্য অবলম্বনে যে চলচ্চিত্র ২০০১ সালের আগে পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল সেইগুলি নিরীক্ষণের মাধ্যমেই দর্শকের সাহিত্য পড়া হয়ে যেত। খুব বেশি পরিবর্তন করা হত না। যদিও সাহিত্য ও চলচ্চিত্র উভয়ের ভাষা সম্পূর্ণ পৃথক। প্রকাশের ক্ষেত্রে মূল গল্পের পরিবর্তন না করলেও দৃশ্যমান্যতার অনেক পরিবর্তন করতে হয় দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য।

        চলচ্চিত্র হল একটি তরুণ ও আধুনিক শিল্প। এটি নতুন সুরকারদের জন্য আকর্ষণীয় সম্ভাবনার বিরাট বিরাট ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দিল। যদিও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর প্রথম পর্ব থেকেই (১৮৮৫) সঙ্গীতের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল তথাপি চলচ্চিত্র শিল্পের অঙ্গ হিসাবে নিজের জায়গা করে নিতে এর অনেকটা সময় লেগেছিল। জনপ্রিয় প্রমোদ মাধ্যমগুলির সঙ্গে পরিচিতি থাকার সুবাদে প্রথম দিককার চলচ্চিত্রকারেরা সহজাতগুনে বুঝতে পে্রেছিলেন সঙ্গীতের সংযোজনে চলচ্চিত্র উপকৃত হবে। ক্রমান্বয়ে এটাও বোঝা গেল ছবির সঙ্গে সঙ্গীতকে পাশাপাশি সংযুক্ত করা ছাড়াও ছবিতে এটি একটি বিপুল অস্ত্র হিসাবে কাজ করে। সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আমরা অপর একটি বিশাল স্তরে সমান্তরালভাবে ছবির বক্তব্যকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি। যেমন সমস্ত সঙ্গীতের বিশাল ছকটিকে মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে তবে সুরটিকে প্রথমে বসানো হয়। গোড়াতেই পরিচয়লিপিতে সমস্ত ছবির একটা ওভারটিউন তৈরি করার চেষ্টা, তারপর বিভিন্ন চরিত্র, বিভিন্ন মন্তব্যের জন্য বিশেষ বিশেষ সুর বা কম্পোজিশন আসে। পরিণতিতে সেই বিশেষ সুরটিই বক্তব্যের দ্যোতকরূপে কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেটা ভেবেও সুর তৈরি করা হয়। সঙ্গীত অত্যন্ত সংকেতবহ। সেই সংকেত স্বাভাবিকভাবেই চিত্রস্রষ্টার। কাজেই তা ব্যবহৃত হয় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তার পিছনে একটা সচেতন নকশা থাকে।

            আমাদের ছবির নিজস্ব রূপটাই ভারতীয় ছবির প্রাণ। অর্থাৎ যে ধরণের ছবিই হোক না কেন আমরা সবার আগে জানতে চাই ভাল গান আছে কি না। ভাল গান বলতে ভাল কথা ও ভাল সুর সমৃদ্ধ, তার সাথে থাকবে কথা ও সুরের সাযুজ্য। এব্যাপারে রবীন্দ্রনাথকে আদর্শ মানা যায়। সঙ্গীত পরিচালকের কাজ শুধু একটা কি দুটো গানে ভাল সুর দিতে পারা নয়, সঠিক জায়গায় সঠিক আবহসঙ্গীত তৈরি করে তোলাও তাঁর দায়িত্ব। যে সুরব্যাঞ্জনা গোটা কাহিনীকে ধরে রাখবে পিছন থেকে; কাহিনীর কাঠামোর কাজ করবে আবহসঙ্গীত। সঙ্গীত পরিচালক সবসময় একটা স্বাধীনতা চান যা চিত্রপরিচালকের পক্ষে সবসময় দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সঙ্গীতের আবেদন ছবিকে ছাপিয়ে নয়, ছবির প্রয়োজনে, সহযোগিতায়। অতিরিক্ত সঙ্গীতের প্রয়োগে সূক্ষ্মভাবে ছবির নান্দনিক দিকটি ব্যাহত হয়। তবে ছবিতে ভালো সুরারোপ করতে গেলে সঙ্গীত পরিচালকদেরও অবশ্যই সঙ্গীত বুঝতে হবে। সব সঙ্গীত সবার জন্য হতে পারে না, এক এক রকমের গান বা যন্ত্রসঙ্গীত এক একরকমের শ্রেণীকে এক একভাবে নাড়া দেয়। তাই সঙ্গীতের চলচ্চিত্রে প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বভাবতই কাহিনীর আবেদনের কথা মনে রেখে সুররচনা করতে হবে। অন্যথায় সেটি গুরুচন্ডালি দোষে দুষ্ট হবে। বেশীরভাগ সঙ্গীত পরিচালকেরাই এই কারণে কোন একটি রাস্তা বেছে নেন। হয় তাঁরা চলচ্চিত্রের গতিশীলতার প্রতি নজর রেখে মানানসই একটা সুর করেন, অথবা সংলাপে যা বলা সম্ভব নয় তা গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। দুইক্ষেত্রেই গান সাধারণভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।  ফিল্মমিউজিক আসলে অ্যাপ্লায়েড মিউজিক, আলাদাভাবে তার চিত্তাকর্ষক হবার দায় নেই। সংলাপ, গতি ও শব্দময়তার অনুষঙ্গে যখন সঙ্গীত আসে তখন এই ধারণা অনেকাংশে ফলপ্রসূ হয়, কিন্ত ঘটনা পরম্পরার ওপর গুরুত্ব আরোপ, আবেগের মাত্রাবৃদ্ধি বা সংলাপের পরিবর্ত হিসাবে যখন সঙ্গীত আসে তখন দৃশ্যের বাইরেও তা রসানুভূতি জাগাতে পারে। ছবিতে আমাদের প্রধান অবলম্বন কণ্ঠসঙ্গীত। সেখানে বাজনা থাকে গানের পিছনে, গানকে আঘাত করে না। আর রবীন্দ্রসঙ্গীত এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আমরা জীবনে প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করি, আর তাঁর রচিত গানের সম্ভারে সমৃদ্ধ হই। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ক-গায়িকাদের একযোগে দুটি মূল্যবান দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রথমতঃ দীর্ঘ সাধনায় এবং গভীর অনুশীলনে তাকে রবীন্দ্র-মনস্ক হতেই হয়, তা না হলে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবরূপে নিমগ্ন হওয়া তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়তঃ গানের মধ্যে সঞ্চারিত কবিহৃদয়ের বিশেষ ভাবটিকে নিজের হৃদয়ভাবের সঙ্গে সঞ্জীবিত করে শ্রোতার মর্মমূলে প্রেরণ করা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পীরাও এখন দ্বিধাবিভক্ত। খুব সাধারণ দুটি শব্দ বর্তমানকালে অতিপ্রচলিত –

১) বিশুদ্ধ  রবীন্দ্রসঙ্গীত

২) বাণিজ্যিক রবীন্দ্রসঙ্গীত

এই নামকরণের ইঙ্গিত অস্পষ্ট নয়। বর্তমানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই রূপান্তরকরণের আবশ্যিকতা ব্যাখ্যা করে বলা যায় যুগধর্মের প্রবণতা অনুসারে শ্রোতাসমাজের দাবি মেটানো শিল্পীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেহেতু আধুনিক মানুষের রুচিবদল ঘটেছে অনেকটা প্রাকৃতিক নিয়মে, সেহেতু শিল্পসংস্কৃতির জগতে বিবর্তন আসবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

‘Theory of Film’ গ্রন্থে S. Kracaure বলেছেন –

   ‘Film images affect primarily the spectator’s senses, engaging him physiologically  

   before he is in the position to respond intellectually’.[1]

সিনেমা সঙ্গীতের প্রতীকী প্রয়োগ। রাগরাগিণী বা বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনিময়তার সংকেত। সমান্তরাল সঙ্গীতের প্রয়োগ, মাল্টিলেয়ারড মিউজিক, গানের কলির আভাস দিয়ে ব্যাঞ্জনা আনবার প্রয়াস, সঙ্গীতের গাঠনিক ট্রিটমেন্ট বা শর্তসাপেক্ষ রিফ্লেক্সের প্ররোচনা অর্থাৎ মেধা এবং পরিশীলিত সাংস্কৃতিকবোধের কাছে যার আবেদন, সাধারণ দর্শকের কাছে তা কতখানি গ্রহণযোগ্য অনুমানের বিষয়। বরং বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়িয়ে বলা যায়, সিনেমা-সঙ্গীতের যথার্থ রসগ্রহণের জন্য দর্শকের যথেষ্ট শিক্ষাবোধ জরুরী। রবীন্দ্রনাথ নামে বাঙালির মনে প্রথমেই যেটা মনে আসে তা হল তাঁর বিপুল গানের সম্ভার। মোট ২,২৩২টি গান লিখেছেন তিনি। প্রেম, আনন্দ, দুঃখ, রাগ, অভিমান, হতাশা, জন্ম, মৃত্যু মানুষের প্রতিটি আবেগ, অনুভূতি তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে ধরা দেয়। আবার জীবনে চলার পথে প্রেরণাও দেয়। তাঁর এক একটি পর্যায়ের গান আমাদের মনের এক একটি জানালা খুলে দেয়। প্রেম পর্যায়ের গান আমাদের ভালবাসতে শেখায়, প্রকৃতি পর্যায়ের গানে প্রকৃতির রূপ আমাদের মুগ্ধ করে আর পূজা পর্যায়ের গান আমাদের ঈশ্বরকে আপন করতে শেখায়। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রাসঙ্গিকতা তাই চিরন্তন। কিন্তু বর্তমানে যে জিনিসটায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তা হল সময়ের সাথে সাথে গান পরিবেশনের ধরণে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আরও বেশী যুগোপযোগী করে তোলার চেষ্টা। ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে এবং তারও সহজে মানুষের কাছে পৌঁছোতে পেরেছে, বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কাছে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে পরিচালকরা কবির গানকে ছবির মর্মকথা রূপায়ণে বিশেষ তাৎপর্যবাহী করে তোলেন, কারণ আজও তাঁর রচিত গান বড়ই আধুনিক। আগামী যুগেও বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি এইভাবেই তাঁর গান, শব্দ ও সৃষ্টি দিয়ে নানাভাবে নানা আঙ্গিকে ভরিয়ে রাখবেন। সাধারণত চলচ্চিত্রে দুভাবে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার হয় –

১) ট্রাঞ্জীশান হিসাবে – কাহিনীর গতিকে ব্যাহত না করে তার ছন্দে গানকে ব্যবহার করে কাহিনীর অন্য সূত্রের উত্তরণ ঘটানো । এর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’ ছবিতে “বাজে করুণ সুরে’-র ব্যবহার। এছাড়া এ গানে মূল চরিত্রের বিষাদের সুরটিও ধরা পড়ে।

২) সিনেমার অলংকার হিসাবে – এমন ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট   প্রয়োগ দেখিয়েছেন তরুণ মজুমদার ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ও ‘আলো’ ছবিতে। এও উল্লেখযোগ্য ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে ‘দূরে কোথাও দূরে দূরে’ গানটির ব্যবহারে তার অনবদ্য চিত্রপরিকল্পনা।      

চলচ্চিত্র শিল্পে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই আধুনিকতাই ফুটে ওঠে প্রকট হয়ে। একবিংশ শতকে কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর এক বিশেষ হাওয়াবদল হয় রবীন্দ্র – নির্মিত সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে। আধুনিক কিছু পরিচালক সমাজের ভালোমন্দ উভয়দিক সহজে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। আবার কিছু সময় তা একেবারেই রাবীন্দ্রিক স্টাইল ভেঙে অতীব আধুনিক হয়ে উঠল – যা রবীন্দ্রানুরাগীদের সহজেই বিব্রত করে তুলল। যেমন একটি উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ২০১৩ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কপিরাইট উঠে যাওয়ার সময় থেকে শুরু হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগে পুরানো সাবেকি স্টাইল ভেঙে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার। কিছু সময় যেমন তা হল অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য – আরও বেশি মনের কোণে স্থান করে নিল, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘হাওয়া বদল’ চলচ্চিত্রে ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতাল’ রবীন্দ্রসংগীতটি সপ্তর্ষি মূখাজ্জী ও সাহানা বাজপেয়ীর কণ্ঠে প্রয়োগ করেছেন সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। এই প্রয়োগ যথেষ্ট সুন্দর ও স্বচ্ছভাবেই হয়েছে।

‘প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা সৃজনপ্রত্যয়ী মন থাকে। সেই মনের জমিনে অনেককিছু খেলা করে অনেক সময় জনসম্মুখে প্রকাশিত হয় অনেক সময় হয় না। প্রকাশিত সৃজনকর্মগুলো কখনো ব্যক্তির কাছেই গুরুত্ব পায় না জাতীয়ভাবে গুরুত্ব অর্জন করে। সেই সম্পর্কের সুরক্ষা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। লালন, হাছনের গান, রবীন্দ্র-নজরুলের সৃষ্টিসহ সব সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে উত্তরাধিকাররা আয় অর্জন করবে এমনটা নয় কপিরাইট আইন অনুযায়ী সৃষ্টের মৃত্যুর ৬০ বছর পেরিয়ে গেলে আর্থিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলেও নৈতিক অধিকার থাকবে যুগ-যুগান্তরে। এ জন্যই আর একটি রবীন্দ্রসংগীত সৃষ্টি করা সম্ভব নয়- বিষয়টি প্রগাঢ় ও গভীর ভাবনার। দেশের উন্নয়ন, শুধু আর্থিক উন্নয়ন নয়, মানবিক সূচকগুলোর পরিব্যাপ্তি প্রয়োজন- এ ক্ষেত্রে সৃজনকর্মের রক্ষাকবচ আইন ও জনসচেতনতার মাধ্যমে নিশ্চিত প্রয়োজন’।[2]  

 ইদানীংকালে কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার, অন্য সুরের সাথে  কবির গান মিশিয়ে নতুন গান সৃষ্টিকে ঘিরে শিল্পীর গানের গায়কী নিয়ে নানা বিতর্ক চলমান। কবির জন্মসার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে, তাঁর গল্প, উপন্যাস, ছাড়াও জীবননির্ভর কল্পকাহিনী (কাদম্বরী) নিয়েও ছবি হয়েছে, কিন্তু সেসব ছবি কতখানি দর্শকের মন ছুঁয়ে গেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। নতুন শতাব্দীর সূচনায় কিছু কিছু দিকপাল শিল্পী নতুনভাবে চলচ্চিত্রকে তুলে ধরলেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে। অপর্ণা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, প্রভাত রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখেরা সমাজের ভালোমন্দ উভয় দিকটিই অত্যন্ত সহজে দর্শকের সামনে তুলে ধরলেন। অনেক না বলা কথা জানা অথচ না জানা বিষয়বস্তু ক্রমশই প্রকাশ হতে লাগল চলচ্চিত্রের ভাষায়। শুধুই গল্প নয় রবিন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও রদবদল হতে থাকল। যখন কপিরাইট উঠে গেল তখন থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলির প্রয়োগ নিয়ে যন্ত্রানুসঙ্গ বা কন্ঠসঙ্গীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগে পুরনো সাবেকি স্টাইল ভেঙে নতুনভাবে প্রয়োগের পরীক্ষানিরীকগের। কিছুসময় তা যেমন হল অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য – আরও বেশী করে মনের মধ্যে স্থান করে নিল, আবার কিছুসময় তা একেবারেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাবেকি স্টাইল ভেঙে অতীব আধুনিক হয়ে উঠল – রবীন্দ্রানুরাগীদের বিব্রতই করে তুলল। যেমন – ‘দ্য বং কানেকশন’ ছবিতে নচিকেতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে পরিচালক অঞ্জন দত্ত  ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানটির সাথে ঊলালা ঊলালা জুড়ে দিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন। 

            রবীন্দ্রসঙ্গীতের আর একধরণের আধুনিকীকরণ চলছে ব্যান্ড মিউজিক ও চলচ্চিত্রে বিপুল পরিমাণ অনাবশ্যক রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে। অদ্ভুত একটা আধুনিকতা গ্রাস করছে বর্তমান সমাজকে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিশ্রী ও বিকৃত করে অনেক গানই আজ পরিবেশন করা হয়। তবে এটা একটা স্রোতের মত। সেই স্রোতটা চলে যাবে। আমাদের চারপাশে যারা রবীন্দ্রসনগীতের সাধনা করছেন তারা ঠিকই তা ধরে রাখবেন। সঙ্গীতের প্রায় সব শাখাতেই  মূল একটা বিশুদ্ধ রূপ থাকে। যুগের পরিবর্তনে শ্রোতার পরিবর্তনে সেটার পরিবর্তন হয় সত্যি কিন্তু তার মানে এই নয় পরিবর্তন মানেই সবসময় ভাল। ফিউশন বা মিশ্রণ সবসময়ই একটি পরীক্ষণীয় বিষয় কিন্তু তার ফলাফল যে পজিটিভ বা গ্রহণযোগ্য হতেই হবে এমনটা নয়। রাগসঙ্গীত চর্চায় যেমন বিশুদ্ধ ধারাটিই শুনতে ভাল লাগে রবিন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও কিছুটা তাই। কিন্তু তা বলে এই নয় যে আমি পরিবর্তনের বিরুদ্ধে, যারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের আধুনিকীকরণ করতে চান তারা এর মূল বিষয়টির সাথে ঠিক কতটা পরিচিত আর সম্পৃক্ত সেটা জানার অধিকার অবশ্যই শ্রোতার আছে। শ্রোতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যে তাকে সবসময় আধুনিক হতে হবে এমনটা নয়, পরীক্ষানিরীক্ষা হোক কিন্তু পরীক্ষকের যোগ্যতাও এক্ষেত্রে একটি ফ্যাক্ট।

              একের পর এক শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন, কিন্তু সেসব গানে রাবীন্দ্রিক ভাব কতটা থাকছে সে বিষয়ে বিস্ময় থেকেই যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় নতুন ধাঁচের যন্ত্রানুসঙ্গ। কোথাও আবার গানের বাণী বদলে যায়। অর্থাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষঙ্গটুকুই থাকে, হারিয়ে যায় তার নিজস্বতা। যা কিছু ধ্রুপদী তার রিমেক হয়না। সেই সূত্র ধরে রবীন্দ্রসংগীতেও রিমেকের প্রয়োজন নেই, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির যে বৈশিষ্ট্য তাঁর বাণীর যে গভীরতা তার রিমেক করার দুঃসাহস হয়ত কারোর নেই। তবে কিছুক্ষেত্রে এমন উদাহরণ পাওয়া যায়, যাতে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের গানের অনুষঙ্গ ব্যবহার করে নতুন কিছু সৃজন হচ্ছে। এ ধরণের উদ্যোগের তবু একটা অর্থ থাকে, যা রবীন্দ্রসংগীতের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে তাকে আধুনিক সময়ের সাথে জুড়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ –

মেঘের পালক চাঁদের নোলক

কাগজের খেয়া ভাসছে,

মেঘের পালক চাঁদের নোলক

কাগজের খেয়া ভাসছে,

বুক ধুক-পুক চাঁদপানা মুখ

চিলেকোঠা থেকে হাসছে,

মেঘের বাড়িতে ভেজা ভেজা পায়ে

তা-থই তা-থই বরষা,

কাক ভেজা মন জল থইথই

রাত্তির হোল ফরসা,

আমি তুমি আজ একাকার হয়ে

মিশেছি আলোর বৃত্তে,

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে ..

মেঘের পালক চাঁদের নোলক

কাগজের খেয়া ভাসছে।।[3]

অমিত সেন পরিচালিত ‘নটবর নট আউট’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত প্রিচাল্ক দেবজ্যেতি মিশ্র সুন্দরভাবে দুটি গানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।

             একজন গীতিকার যখন গান লেখেন তখন তিনি আশা করেন যে তাঁর গানের কথা বা উচ্চারণের বিকৃতি ঘ্টবে না। ঠিক একইভাবে একজন সুরকার যখন সুর সৃষ্টি করেন তিনিও আশা করেন যে তাঁর সৃষ্ট গান সুর, তাল, লয়, ব্যাকরণ ও গায়কি মেনেই গীত হবে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর নিজস্ব গানের ব্যাকরণ অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে জোর দিয়ে গেছেন। তার মানে এই নয় যে তিনি যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যাপারেও বিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখতে বলেছেন। গানের ব্যাকরণ বৈজ্ঞানিক সূত্রের মতোই অপরিবর্তনীয়। সেটা ঠিক রেখে যদি আধুনিক যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করা হয় তবে কোন সমস্যা নেই।

              শিল্পের নান্দনিকতার সঙ্গে শিল্পের সার্বিকতার দিকটিও আমাদের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। সেক্ষেত্রে শিল্পের সার্থকতা বজায় রাখতে গিয়ে আধুনিকতম চিন্তার ফসল ফলালে বোধহয় গুরুচন্ডালি দোষ হয় না। শিল্পের নান্দনিকতাকে বাদ দিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করাও শিল্পের একটি সার্থক রূপ। বিনোদন বা মনোরঞ্জনকে কখনোও উপেক্ষা করা যায় না। রবিন্দ্রনাথ প্রাদেশিকতার থেকেও অনেক বেশী সার্বজনীন। তিনি নিজেও তাই চেয়েছিলেন। সেই কারণেই তিনি তাঁর জীবিত অবস্থায় বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পী বা চিত্রপরিচালকদের প্রয়োজন অনুসারে তাঁর লেখার পরিবর্তন করতে মত দিয়েছিলেন। তিনি কখনই বলেননি ‘চল নিয়মমতে’, পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন ‘ভাঙো বাঁধ ভেঙে দাও’। সেই কারণেই কপিরাইট উঠে যাওয়ার পরে তাঁর গান অনেক বেশী সমাদৃত ভারতে এবং ভারতের বাইরে। তাঁর গাঙ্কে বর্তমানে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত করা হচ্ছে। এই আধুনিকতাকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করে বর্তমান প্রজন্ম সংস্কৃতির পরিশ্রুতকরণের মাধ্যমে এক সতেজ নিষ্ঠাবান পৃথিবী তৈরি করবে এই আশা রাখা যায় ।

তথ্যসূত্র :

[1] Oxford University Press, New York, 1974, page – 158

[2] https://www.jugantor.com/todays-paper/literature-magazine/414629/কপিরাইট-নতুন-আইন

[3] https://www.gdn8.com/2015/03/megher-palok-lyrics-shreya-ghosal.html

Unveiling Challenges in Music Direction and Arrangement of Rabindra Sangeet

Kushni Soren

Abstract:

Rabindra Sangeet, the musical oeuvre of the renowned poet Rabindranath Tagore, holds a unique and cherished place in the cultural heritage of Bengal and beyond. This paper explores the intricate challenges encountered in the music direction and arrangement of Rabindra Sangeet, shedding light on the complexities faced by contemporary musicians in interpreting and presenting this rich musical tradition. The study begins by delving into the historical and cultural context of Rabindra Sangeet, emphasizing its origins and evolution. It examines how the fusion of diverse musical elements, including classical, folk, and international influences, poses a multifaceted challenge for music directors and arrangers. The delicate balance between preserving the authenticity of Tagore’s compositions and infusing innovative elements to engage modern audiences is a central concern. Furthermore, the paper addresses the linguistic nuances embedded in Rabindra Sangeet’s lyrics, which demand a deep understanding of Bengali poetry and a nuanced approach to expression. The intricate use of melody, rhythm, and unconventional scales in Tagore’s compositions adds an extra layer of complexity for musicians aiming to convey the intended emotions accurately. The technological advancements in music production also present both opportunities and challenges. While modern tools enable innovative arrangements, the risk of diluting the traditional essence looms large. Balancing traditional instruments with contemporary sounds requires a judicious approach to maintain the authenticity of Rabindra Sangeet. Additionally, the paper explores the challenges posed by the diverse regional variations of Rabindra Sangeet, as interpretations can differ significantly across different geographical locations. This necessitates a comprehensive understanding of regional sensibilities and preferences, further complicating the task for music directors and arrangers. In conclusion, this study unveils the multifaceted challenges faced by musicians engaged in the direction and arrangement of Rabindra Sangeet. It calls for a delicate balance between tradition and innovation, linguistic proficiency, and a nuanced grasp of cultural variations to ensure the continued relevance and resonance of this musical tradition in contemporary times.

রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রানুসঙ্গের সমস্যা

কুশনি সরেন

বাঙালির মননে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রসংগীত, আর রবীন্দ্রসংগীত প্রাসঙ্গিক হয়ে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে। তাই এই গানের এত ব্যাপ্তি। রবীন্দ্রসংগীত এই যে যুগের পর যুগ ধরে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের শিরোপা জয় করে চলেছে, তাতে যোগ্য সহযোগিতা করার দায়িত্ব পালন করে যন্ত্রানুসঙ্গ, যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রসংগীত শিল্পী এবং যন্ত্র আয়োজকরা গানটিকে সুন্দর করে পরিবেশন করতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে basic album, বিজ্ঞাপণ, টিভি সিরিয়ালে রবীন্দ্রসংগীতের বহুল ব্যবহার সবার জানা।  

রবীন্দ্রসংগীত নিঃসন্দেহে উচ্চমার্গের সংগীত, কিন্তু এই গান পরিবেশনের ক্ষেত্রেও যন্ত্রানুসঙ্গ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যুগে যুগে রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রানুসঙ্গের যেমন পরিবর্তন ঘটেছে, যন্ত্রানুসঙ্গের ধরণ পাল্টে গেছে, সমস্যাও তৈরি হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, অনেক রকম বাধা বিপত্তিও এসেছে।

ঠাকুরবাড়িতে পাশ্চাত্য সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের চর্চা, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কনসার্ট ও গুণী ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসা, গানে পাশ্চাত্যের হার্মনির ব্যবহার রবীন্দ্রনাথকে যেমন ছোটবেলা থেকে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন যন্ত্রানুসঙ্গের সঙ্গে পরিচিত করেছিল, বাড়িতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চা তাঁকে সে বিষয়েও সমান ভাবে শিক্ষিত করে তুলেছিল। প্রাথমিক সংগীত চর্চার সময় তাঁর জ্যোতিদাদা পিয়ানো বাজাতেন গানের অনুষঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় লিখছেন: ‘ছাদের ঘরে এল পিয়ানো। … এইবার ছুটল আমার গানের ফোয়ারা। জ্যোতিদাদা পিয়ানোর উপর হাত চালিয়ে নতুন নতুন ভঙ্গিতে ঝমাঝম সুর তৈরি করে যেতেন, আমাকে রাখতেন পাশে। তখনি তখনি সেই ছুটে-চলা সুরে কথা বসিয়ে বেঁধে রাখবার কাজ ছিল আমার।’….. ‘গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা; বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান।’[1] দ্বিতীয়বার বিলাত যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ মাদ্রাজ থেকে ফিরে এসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে থাকাকালীন সেখানে কিছুদিন হারমোনিয়াম যন্ত্রযোগে গান গেয়েছেন। জীবনস্মৃতিতে বলছেন, ‘কখনো বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা লইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম— জ্যোতিদাদা বেহালা বাজাইতেন, আমি গান গাইতাম’।[2] এমনও অনেক নজির আছে যেখানে গায়ক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হারমোনিয়ামে সঙ্গত করছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ২৫ বছর সেইসময়ের কথা লিখছেন : ‘একবার মাঘোৎসবে সকালে ও বিকালে আমি অনেকগুলি গান তৈরি করিয়াছিলাম। তাহার মধ্যে একটা গান ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’ – পিতা তখন চুঁচুড়ায় ছিলেন। সেখানে আমার এবং জ্যোতিদাদার ডাক পড়িল। হার্মোনিয়ামে জ্যোতিদাদাকে বসাইয়া আমাকে তিনি নুতন গান সব কটি একে একে গাহিতে বলিলেন। কোনো কোনো গান দুবারও গাহিতে হইল।’[3] আরও কিছু পরে দেখি রবীন্দ্রনাথ গান করছেন সঙ্গে যন্ত্র বাজছে অর্গান। ১৯০৩ সালে মহর্ষির জন্মদিনে অর্গান বাজিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অর্গান, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। শান্তিনিকেতনে শারদোৎসব’-এর গান রচনার সময়ের দিনেন্দ্রনাথ বসতেন এস্রাজে আর অজিতকুমার বাজাতেন হারমোনিয়াম। 

দ্বিতীয় বার বিলাত যাত্রার পথ থেকে ফিরে এসে যখন জ্যোতিদাদার চন্দননগরের বাড়িতে ছিলেন, তখনকার কথা ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন: “আমার গঙ্গাতীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার জলে উৎসর্গ-করা পূর্ণ-বিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি করিয়া ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কখনো-বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়াম যন্ত্র যোগে বিদ্যাপতির ‘ভরাবাদর মাহভাদর’ পদটিতে মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিনী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম”। [4]

অথচ হারমোনিয়াম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বারবার মত পাল্টেছিলেন। ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন, “তখন হারমোনিয়াম আসেনি এদেশের জাত মারতে। কাঁধের ওপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যেস করেছি। কলটেপা সুরের গোলামি করিনি।”

রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপে সূক্ষ্ম মীড়ের কাজ মনের মধ্যে যে ভাব ও আবেশের সৃষ্টি করে তা হারমোনিয়াম যন্ত্রটির reed থেকে তোলা বেশ কষ্টের। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে হারমোনিয়াম যন্ত্রটির প্রয়োগ বিশেষভাবে দেখা যায় না। শেষ জীবনে পৌঁছে কবি হারমোনিয়াম ব্যবহারের ব্যাপারে এতটাই ঘোর বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন যে ১৯ জানুয়ারি ১৯৪০ এ আকাশবাণী কলকাতার সেই সময়কার স্টেশন ডিরেক্টর অশোক কুমার সেন-কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন “I have always been very much against the prevalent use of Harmonium for purpose of accompaniment in our music and it is banished completely from our ashram. You will be doing a great service to the cause of Indian Music if you get it abandoned in the studio of All India Radio”.[5]

এই চিঠিকে মান্যতা দিয়ে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ হারমোনিয়াম ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন, যা স্বাধীনতার পরেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বহাল রেখেছিলেন। এর প্রতিবাদে আকাশবাণীতে দিলীপকুমার রায়, শচীন দেববর্মণ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা গান গাওয়া বন্ধ করে দেন। 

একথা মানতেই হবে, হারমোনিয়াম ব্যবহারের অনেকগুলি সুবিধা আছেই। এটি অনেক বেশি সহজলভ্য, সহজে বহনযোগ্য, আর সহজে শিখে নেওয়া যায়। এটি সহজে যেকোন স্কেলে বাজানো যায়, এবং অন্যান্য অনেক যন্ত্রের মত প্রত্যেকবার বাজানোর আগে টিউন করতে হয় না, অনুষ্ঠানের মাঝে টিউনিং নষ্টও হয়ে যায় না। তাই এর কার্যকারিতা, সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা কখনোই অস্বীকার করা যাবে না। বরং যুগে যুগে যন্ত্রানুসঙ্গে হারমোনিয়ামের জনপ্রিয়তা ক্রমশঃ বেড়েছে। আকাশবাণীতে হারমোনিয়াম ব্যবহার নিষিদ্ধ করে যন্ত্রানুসঙ্গের যথেষ্ট সমস্যা তৈরি হয়েছিল। অবশেষে সেই নিষেধাজ্ঞা ১৯৮০ সালে পুরোপুরি উঠে গিয়ে সমস্যা দূর হয়। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে হারমোনিয়াম নিষিদ্ধ করেছিলেন। শান্তিদেব ঘোষ এই বিষয়ে লিখেছেন, ‘১৯২২ সাল থেকে অর্থাৎ বিশ্বভারতীর যুগ থেকে হারমোনিয়াম যন্ত্রটির ব্যবহার গুরুদেব শান্তিনিকেতনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’।[6] শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মৃতিচারণে দেখি, ‘শান্তিনিকেতনে এসে দেখলাম হারমোনিয়ামের প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ। এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ওই যন্ত্র আর ছুঁয়েও দেখিনি।’[7] শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত সংগীতশিল্পীদের তাই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে দেখা যেত না।

আমি নিজে যখন ছাত্রী ছিলাম, তখনও দেখেছি শান্তিনিকেতনে হারমোনিয়ামের ব্যবহার খুবই গৌণ ছিল। তাই হারমোনিয়াম বাজানোর ব্যাপারে কাউকে কোনদিন উৎসাহ দেওয়া হত না। এস্রাজকেই অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হত। এস্রাজ ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান হতই না। বরং বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে একাধিক এস্রাজ ব্যবহার হত অনুষ্ঠানে। আজকের দিনেও এই প্রথাই চালু আছে শান্তিনিকেতনে। 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের গানে যন্ত্রানুসঙ্গের ক্ষেত্রে এস্রাজ বাদ্যযন্ত্রটিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর গানে সঙ্গত নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ তিনি দিয়ে যাননি। তাতে শিল্পী থেকে শ্রোতা, সবার লাভই হয়েছে, যন্ত্রানুসঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ হয়েছে। 

তাঁর জীবদ্দশাতে রবীন্দ্রসংগীত যতটা জনপ্রিয় ছিল, মৃত্যুর পর তা অনেক বেড়েছে। প্রচারের আলোকে যত এসেছে, যন্ত্রানুসঙ্গ নিয়ে ‘experiment’ করার প্রবণতাও তত বেড়েছে। আগে ভারতীয় সংগীতে ‘Composer শব্দটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পাশ্চাত্য সংগীতে Symphony Orchestra Music- এর বিখ্যাত বিখ্যাত সমস্ত Composer – Mozart, Beethoven, Chopin, Bach, সমস্ত বাদ্যযন্ত্রের নির্দেশসহ লয়, স্কেল সহ notation লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কিন্তু এই পদ্ধতি তো রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপিতে নেই। তাই লয় নির্বাচন, গায়কি, স্কেল-এর ক্ষেত্রে শিল্পীর পরিবেশনের স্বাধীনতার সঙ্গে যন্ত্রানুসঙ্গের স্বাধীনতাও যথেষ্ট রয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভীমরাও শাস্ত্রী ও দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের গান এবং এস্রাজ শেখাতেন। ১৯১৯ সালে নকুলেশ্বর গোস্বামী বিষ্ণুপুর থেকে এসে সেই কাজে যোগ দেন। পিঠাপুরম থেকে এলেন বীণাবাদক সঙ্গমেশ্বর শাস্ত্রী। তাঁর কাছে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী বীণা শিক্ষা শুরু করেন। সঙ্গমেশ্বর শাস্ত্রীর সাহায্যে পিঠাপুরম থেকে আশ্রমের জন্য বেশ কয়েকটি বীণাও তৈরি করে আনা হয়েছিল। মিসেস্ ভ্যান ইগেন একমাসের ওপর হল্যান্ড থেকে শান্তিনিকেতনে ইউরোপীয় সংগীত শিক্ষা দিতে এসেছিলেন। ১৯২২ সালে আরেকজন ওস্তাদ বীণকর এসেছিলেন ত্রিবায়ুর থেকে। ইনি বেহালা বাদনেও দক্ষ এবং যুরোপীয় সংগীতশাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞানী ছিলেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমে ইনি ছাত্রছাত্রীদের বেহালা ও বীণা বাদনের শিক্ষা দিতেন। সে বছর আশ্রমে ‘বসন্তোৎসব’ হয়েছিল। ‘ফাল্গুনী’-র গানের সঙ্গে পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী মৃদঙ্গম বাজিয়েছিলেন। ১৯২৩ এ রণজিৎ সিংহ সেতার ও এস্রাজের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবলা ও পাখোয়াজ শিক্ষা দিতেন পূর্ণচন্দ্র ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শৈলজারঞ্জন মজুমদার, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী এস্রাজ বাজিয়ে গান শেখাতেন। রবীন্দ্রসংগীতে শ্রুতির এবং মীড়ের ব্যবহার অনেক বেশি, তাই তারযন্ত্রে এই গানের সঙ্গত অনেক শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে। এই কারণেই শান্তিনিকেতনে এস্রাজ এত মূল্য পেয়ে এসেছে। আর এই কারণেই হয়ত রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তাঁর গানের সঙ্গে সারেঙ্গী বাজুক। সেসময় বেহালা যন্ত্রটিও ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দক্ষ বেহালাবাদক ছাড়া সংগতের অনুমতি দিতেন না। সেতার বাদক হিসাবে নিযুক্ত হন সুশীল ভঞ্জ। অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এস্রাজ, হারমোনিয়াম, সেতার, তবলা, প্রায় সব ধরণের যন্ত্র বাদনেই পটু ছিলেন। তালবাদ্য হিসাবে কবির জীবদ্দশায় পাখোয়াজ, মৃদঙ্গম্ ও শ্রীখোলই ব্যবহৃত হতো। তবলার ব্যবহার প্রথম দিকে ছিল না। পরে তা ব্যবহৃত হলেও খুব সীমিত ছিল। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরে তবলা যন্ত্রটির ব্যবহার নিয়মিত হয়। তবলা যন্ত্রটি নিয়মিত ব্যবহারের শুরুর দিকে শ্রী অনাদি দত্ত ছিলেন একজন সুদক্ষ তবলা ও শ্রীখোল বাদক। 

যে সময় রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি আজকের মত সহজলভ্য ছিল না, শিল্পীদের স্মৃতিনির্ভর হয়েই গাইতে হত,স্বাভাবিক ভাবেই সুরের বিচ্যুতি ঘটত। ১৯১৬ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত করা রেকর্ডে এমনটা দেখা যায়। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ চুক্তিবদ্ধ হন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির সাথে। এর পর থেকে সরাসরি রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে অধিকাংশ শিল্পীর রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড হতো। যে সমস্ত রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড ১৯২৬ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে, তা বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অনুমোদন করেছেন। সেই সময়কার জনপ্রিয় শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কণক দাস (বিশ্বাস) যিনি তিরিশটি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছিলেন। কবির অন্যতম প্রিয় গায়িকা ছিলেন সাহানা দেবী, যাঁর ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ এবং ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’ গান দুটিতে যন্ত্রানুসঙ্গে শুধু Organ বাজিয়েছিলেন ভানু ব্যানার্জী। রবীন্দ্রনাথ গান দুটিতে তবলা, শ্রীখোল অথবা পাখোয়াজ ব্যবহার করতে দেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্যের রেকর্ডিং- এ তালবাদ্য হিসাবে তবলা, শ্রী খোল, পাখোয়াজ ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ডিংয়ের শুরুর দিকে বিভিন্ন যন্ত্রে পারদর্শী শিল্পী ও যোগ্য সঙ্গতের অভাবে তাঁর গানে সেগুলির ব্যবহারের অনুমোদন দেননি, জীবনের শেষের দিকে দক্ষ ও পারদর্শী যন্ত্রশিল্পীদের তিনি স্বয়ং অনুমোদন দিয়েছেন।

নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহৃত হতো, সেগুলির যন্ত্রানুসঙ্গে বেহালায় ছিলেন অবনী মুখোপাধ্যায় ও পরিতোষ শীল, বাঁশিতে প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবীশ, এস্রাজে দক্ষিণা মোহন ঠাকুর, music arrangementএ রাইচাঁদ বড়াল। তখনকার বেশ কিছু বেসিক রেকর্ডে এস্রাজ বাজিয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। ‘Columbia Record’ থেকে যে সমস্ত রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে তার অধিকাংশ রেকর্ডেই গীটার বাজিয়েছেন তারকনাথ দে । এর পরবর্তী সময়ে যন্ত্রানুসঙ্গে বেহালা ও পিয়ানো যন্ত্রের দ্বৈত প্রয়োগে ‘tune follow করা এবং Prelude কিংবা Interlude বাজানোর প্রচলন শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের খুব ইচ্ছে ছিল, তাঁর গানে সারেঙ্গীর অনুষঙ্গ থাকুক, তিনি শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে মিরাট থেকে একটি সারেঙ্গী আনিয়ে দিয়েছিলেন। শৈলজারঞ্জন উৎসাহের সঙ্গে শিখতে শুরুও করেছিলেন, কিন্তু এর মধ্যে কবির মৃত্যু হয়। শৈলজারঞ্জনের সারেঙ্গী শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি, তাই তা কোন গানে বাজানো হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথ অন্য কোন সারেঙ্গী বাদক পাননি তাঁর জীবদ্দশায়। তিনি বৈচিত্রময় যন্ত্র যেমন পাননি, বেশ কিছু যন্ত্রের সহযোগও পাননি দক্ষ যন্ত্রশিল্পীর অভাবে। 

        রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ২০ বছর পরে ১৯৬১ সালে তাঁর জন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের যথার্থ মান বজায় রাখার জন্য ‘বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি’ তৈরি হয়, ২০০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড প্রকাশের ক্ষেত্রে যার অনুমতি বাধ্যতামূলক ছিল। এতে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এবং রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরাই সদস্য হতেন। সমিতির উদ্দেশ্য ছিল রেকর্ড, ক্যাসেটের স্বরলিপিসম্মত গানের এবং যন্ত্রানুসঙ্গের ‘যথোপযুক্ত’ সাংগীতিক গুণমান পর্যালোচনা করে তাকে প্রকাশের অনুমতি দেওয়া। রেকর্ড প্রকাশের অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির নির্দিষ্ট কোনো নিয়মাবলী ছিল না। যে গানের সঙ্গে যে যন্ত্রের সঙ্গত যথাযথ বলে মনে করতেন, সেই ধরনের গানে প্রচলিত বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের অনুমতি সমিতির সদস্যরা দিতেন। কোনো যন্ত্রের ব্যবহার সেই বিশেষ গানটির সাথে ‘শ্রুতিমধুর’ লাগছে বা লাগছে না, মূলতঃ তার উপরে নির্ভর করেই ‘বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি’ যন্ত্রানুসঙ্গের বিষয়টিতে রেকর্ডের অনুমোদন দিতেন। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির অনুমোদন পাওয়া যেত না ‘যন্ত্রানুসঙ্গ যথাযথ না হওয়ার কারণে’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই ‘যথাযথ’ যন্ত্রানুসঙ্গের কোন সংজ্ঞা কোনদিন কোথাও ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কারণে গান রেকর্ডের অনুমোদন না পাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল, যা যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়পত্র পেত, যা হয়ত অন্যদের ক্ষেত্রে অনুমোদন পেত না। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথের গানের উপর থেকে কপিরাইট উঠে যাওয়ার সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগরীতির একটি বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কপিরাইট থাকাকালীন বিশেষ কিছু বাদ্যযন্ত্র কিছু কিছু শিল্পীর গানের যন্ত্রানুসঙ্গে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। দেবব্রত বিশ্বাসের লেখা ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’এ এমন পক্ষপাতের উদাহরণ দেখতে পাই। তাঁর গানের অনুমোদন না দিয়ে সমিতি লিখেছিল, “Inspite of repeated requests to control and restrict uncalled for composed musical interludes, the same have been applied freely making the production awfully jarring and distorted.[8] 

  • পুষ্প দিয়ে মারো যারে – Excessive music accompaniment hampers the sentiment of the song.
  • তোমার শেষের গানের – Music accompaniment is too much.”

বলা বাহুল্য, এই ‘excessive’ বা  ‘too much music accompaniment’ এর মাপকাঠি বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কাছে ছিল না। দেবব্রত বিশ্বাস বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডকে ‘dictator’ আখ্যা দিয়েছিলেন, হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা যেন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডকে বিশেষ অনুরোধ করেন, grace marks দিয়ে সেবারের মতো গান গুলো পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য, কারণ তাঁর যথেষ্ট বয়স হয়েছিল আর নতুন করে গানগুলো রেকর্ড করতে অনেক টাকা খরচ হতো। আমরা জানি গান দুটি অনুমোদন পায় নি। শিল্পী ১৯৬৯ সালে রেকর্ড করা বন্ধ করে দেন, কারণ রেকর্ড করার সময় অনেক বাদ্যযন্ত্রীর পারিশ্রমিক বাবদ প্রচুর অর্থ খরচ হতো, গান অনুমোদিত না হলে সমস্ত টাকা লোকসান হতো। পরের বছর কোম্পানীর কর্ণধারের বিশেষ অনুরোধে তিনি নতুন অনেকগুলি গান রেকর্ড করেন, যার মধ্যে কয়েকটি গান আবার অনুমোদিত না হওয়ায় শিল্পী আর কোনদিন রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেন নি। এর ফলে prelude, interlude এ নতুন যন্ত্রানুসঙ্গের যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শিল্পী করতে চেয়েছিলেন, সেটি বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্বাভাবিক কারণেই অন্যান্য শিল্পীরাও যন্ত্রানুসঙ্গ নিয়ে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে তেমন সাহস করেননি। চিরাচরিত বাদ্যযন্ত্রগুলিই ব্যবহার করা হতো। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত। নতুন নতুন যন্ত্র ব্যবহারে, নতুন ধরনের আবহের music arrangement এর পরীক্ষা নিরীক্ষায় শ্রোতারা যে আনন্দ পেতে পারতেন, ১৯৬১ থেকে ২০০১ সালের ৪০ বছরের দীর্ঘ সময়ে তা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। সমস্যা এটাও, যে তখনকার রেকর্ড করা কালজয়ী শিল্পীদের গানে বৈচিত্রময় যন্ত্রানুসঙ্গ থেকে আমাদের চিরকাল বঞ্চিত থাকতে হবে। পরে ক্রমশঃ বাণিজ্যিক রবীন্দ্রসংগীতে Prelude, Interlude, Chords, Harmony প্রভৃতি ব্যবহার করার চেষ্টা শুরু হয়। এতে নতুন নতুন যন্ত্রের ব্যবহার যন্ত্রানুসঙ্গকে ধীরে ধীরে নতুন রূপ দিতে শুরু করে, কিন্তু ২০০১ সালে Copyright উঠে যাওয়ার পরও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত সংগীত শিক্ষাব্যবস্থা ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের ধরণ অপরিবর্তিতই থেকেছে।  

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে তাঁর গানের সাথে কখনো ‘Prelude’ বা ‘Interlude’ ইত্যাদি বাজানো হত না। ক্রমশঃ রেকর্ডে রবীন্দ্রসংগীতের যন্ত্রানুসঙ্গের ক্ষেত্রে মোটামুটি একটি পরিবর্তিত রূপ এসেছে। এই আদর্শে চারতুকের রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে যন্ত্রানুসঙ্গের রূপটি হল-

 ১) গানের শুরুতে Prelude Music

 ২) স্থায়ী ও অন্তরার মধ্যবর্তী পর্যায়ে 1st Interlude Music

 ৩) সঞ্চারীর আগে 2nd Interlude Music

কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সমস্যাটি হল Prelude, 1st Interlude এবং 2nd Interlude Music দিতেই হবে, নাহলে একটি গান বাণিজ্যিক ভাবে সফল হবে না, এই বাধ্যবাধকতা বজায় রাখতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে গানের সুর ব্যাহত হয়। যেমন, ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুল গুলি ঝরে’ গানটিতে যদি সঞ্চারীর আগে interlude music দেওয়া হয়, তাহলে স্থায়ী থেকে ‘সা রা’ হয়ে গড়িয়ে সঞ্চারীতে গান্ধারে পৌঁছে ‘বউকথাকও’ বলার সৌন্দর্যের সুযোগটি হারিয়ে যায়, কারণ  interlude music এর পরে সরাসরি সঞ্চারী ধরা হয়।

গ্রামোফোন পরবর্তী কালে EP আর LP রেকর্ডের যুগে যখন লম্বা দৈর্ঘের রেকর্ডিং প্রকাশের সুযোগ এলো, তখন গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্য গুলির audio রেকর্ড এবং অ্যালবাম প্রকাশের ক্ষেত্রে স্থানাভাবের জন্য গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্যের অনেক গান রাখা সম্ভব হতো না, বা স্বরলিপি নির্দেশিত পুনরাবৃত্তি রক্ষা করা সম্ভব হতো না। যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র তেমন রাখা যেত না। পরে সিডির ব্যবহার শুরু হওয়ার পরে এই সমস্যা দূর হয়। 

বর্তমানে গানের ছন্দবিন্যাস, চরিত্র, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে তালবাদ্য যন্ত্র হিসাবে তবলা, শ্রীখোল বা পাখোয়াজের জায়গায় পিয়ানো বা গিটারের ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়াও বাউল, ভাটিয়ালী প্রভৃতি লোকসংগীত ভাঙা রবীন্দ্রসংগীতে দোতারা বা একতারাকে তালবাদ্য যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ঢোল ব্যবহার হচ্ছে। অন্যান্য বাংলা গানে তালবাদ্য যন্ত্রে যতটা লয়কারী এবং আনুষঙ্গিক বৈচিত্র এনে বাজানো হয়, রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই শুধু ঠেকা বা সামান্য বৈচিত্র সহকারে গানের ছন্দের পটভূমি রচনা করার কাজই করা হয়। বাউলাঙ্গ, কীর্তনাঙ্গ বা ধ্রুপদাঙ্গের রবীন্দ্রসংগীতে কেমন ঠেকা দিয়ে কী তালবাদ্য বাজবে, অলিখিত নিয়মে তা নির্ধারিত হয়ে গেছে, বিশেষ বিচ্যুতি হয় না সাধারণত।

যে কোন শ্রুতি মাধ্যমের রেকর্ড, যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। প্রথম যুগে ছিল গ্রামোফোন রেকর্ড, যা দম দেওয়া গ্রামফোনে বাজতো। একটা রেকর্ডের দু পিঠে দুটো কিংবা বড়জোর চারটে গান থাকতো। রেকর্ড কোম্পানি রেকর্ড বিক্রির মূল্য থেকে রয়্যাল্টী দিত শিল্পীদের। সেই রয়্যাল্টীই শিল্পীদের উপার্জনের পথ ছিল। এর পরে আবিষ্কার হলো বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রে EP এবং LP রেকর্ড। এতে লম্বা সময়ের অনুষ্ঠান ধারণ করার সুযোগ তৈরি হয়। এই সময় থেকেই গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্যের সংক্ষিপ্ত রূপ রেকর্ড হিসাবে প্রকাশ পেতে শুরু করে। এরপর ক্যাসেট এবং টেপ রেকর্ডার আবিষ্কৃত হওয়ার পর তার বহনযোগ্যতা এবং কম দামের ফলে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল। তারপর আসে ডিজিটাল যুগ। কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডি, digital versatile disc বা ডিভিডি, মিনি ডিস্ক হয়ে mp3 ডিস্ক, পেন ড্রাইভ এবং মাইক্রো এসডি কার্ডে গানের মুক্তি হয়েছে ক্রমশঃ। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে এই সময়টার বেশির ভাগ অংশে ছিল বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ। যখন এই নিয়ন্ত্রণ আর থাকলো না, কাকতালীয় ভাবে বাজার থেকে সিডি বাজানোর যন্ত্রও ক্রমশঃ হারিয়ে গেল। কম্পিউটারেও এখন আর কোন মিডিয়া ড্রাইভ থাকে না যাতে সিডি বা ডিভিডি বাজিয়ে গান শোনা যায়। এই আমূল পরিবর্তনের পেছনে একটাই কারণ, অল্প খরচায় জোরালো ইন্টারনেট এবং সবার হাতে স্মার্টফোন, যাতে ইচ্ছে-মতো যে কোন গান যখন খুশি, যেখানে খুশি শুনে নেওয়া যায়। তাই কেউ আর সিডি কিনে গান শোনার প্রয়োজনই বোধ করেন না। অথচ আজকের দিনেও কোন অ্যালবামের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো সিডি প্রকাশ করা। সিডি ডেটাবেস (CDDB) বা ডিস্ক আইডি না থাকলে কোন গান আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় প্রচার মাধ্যম যেমন আমাজন মিউজিক, আপেল মিউজিক, স্পটিফাই, উইঙ্ক মিউজিক, জিও সাওন ইত্যাদিতে স্থান পায় না। আকাশবাণীর কোন কেন্দ্রে রেকর্ডেড গান প্রচারের ক্ষেত্রেও এই ডিস্ক আইডি জরুরী। তাই শ্রোতার কাছে সিডি বাজানোর কোন উপায় না থাকলেও গানের অ্যালবামের মুক্তি হওয়া চাই সিডির মাধ্যমে। মিউজিক স্টোরের সংখ্যা স্বাভাবিক কারণেই কমে কমে উধাও হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক কারণে যন্ত্রশিল্পীদের পারিশ্রমিক আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বিক্রি করে উপার্জনের কোনো উপায় আর নেই। ফলে খরচ কমানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। রেকর্ডিংয়ের নির্দিষ্ট কিছু খরচ থাকে যেগুলো এড়ানো সম্ভব নয়। শ্রোতাকে গান শোনানোর একটা বিকল্প উপায় এখন হয়েছে – ইউটিউবে গানপ্রকাশ করা, যেখানে কোন কোম্পানিকে অর্থ দিতে হয় না। এটা এমন সহজলভ্য একটা মাধ্যম, যা শুধু ইন্টারনেট থাকলেই চলে। কিন্তু সেখানে প্রকাশনার জন্য গানটির সঙ্গে একটি নান্দনিক ভিডিওরও প্রয়োজন হয়। সেটাও যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, কারণ সেক্ষেত্রে ভিডিও রেকর্ডিং, এডিটিং এবং পোস্ট প্রোডাক্শনে অর্থ লাগে। সুতরাং, এত খরচ এড়াতে কোপ পড়ছে যন্ত্রানুসঙ্গের ওপর, বিশেষ করে তালবাদ্য, বাঁশি এবং কিছু ব্যতিক্রমী যন্ত্রের ওপর যেমন সন্তুর, oboe, স্যাক্সোফোন, সানাই, সারেঙ্গী, বেস গিটার, সরোদ, twelve string guitar, বীণা, harp, mandolin ইত্যাদি। ন্যূনতম অনুষঙ্গ সহ গানের আবহ রক্ষা করে পিয়ানো বা গিটারে vamping, strumming বা arpeggio দিয়ে তাল রক্ষা করলেই গান গাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এই কারণেই এমন কিছু গান শিল্পীরা মুক্তছন্দে গাইছেন, যেগুলি তালবাদ্যের সঙ্গে গাইলেই বেশি ভালো লাগে শুনতে। রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ডিংয়ের প্রথম যুগে যন্ত্রানুসঙ্গের যোগানের অভাবে যে minimalistic ব্যাপার ছিল, আজকের দিনে যন্ত্রানুসঙ্গে অনেকটা তেমনই minimalistic ব্যাপার ফিরে এসেছে অর্থনৈতিক কারণে। আমরা, রবীন্দ্রসংগীতের শ্রোতারা মানিয়ে নিচ্ছি ক্রমশঃ কমে যাওয়া যন্ত্রানুসঙ্গের সঙ্গে। 

–—

তথ্যসূত্র


[1] https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/7199

[2] https://nobojug.blog/রবীন্দ্রনাথের-গান-২য়-পর/   

[3] https://www.tagoreweb.in/Songs/pooja-o-prarthana-508/noyon-tomare-pay-na-dekhite-9067

[4] https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/shaarechuattor/30337006

[5] https://www.songsofyore.com/baaja-that-was-harmonium-that-was-music/

[6] https://gaanpaar.com/rabindranath-and-harmonium/

[7] https://gaanpaar.com/rabindranath-and-harmonium/  

[8] https://www.facebook.com/kabiguru1861/photos/a.548802931851101/2373986015999441/?paipv=0&eav=AfZ-Ga6rlhvj-RLdXCb_Tfik2JZOunawMKjCsaXgz8nMAO72Zp9jhB-QLG2Dmk8zqjA&_rdr

সহায়ক গ্রন্থ

১. জীবনস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর( বিশ্বভারতী)

২. ছেলেবেলা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(বিশ্বভারতী)

৩. যাত্রাপথের আনন্দগান – শৈলজারঞ্জন মজুমদার( আনন্দ পাবলিশার্স)

৪. রবীন্দ্রনাথের গান ও অন্যান্য – সুভাষ চৌধুরী( প্রতিভাস)

৫. রবীন্দ্রস্মৃতি – ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ( প্রতীক)

৬. রবীন্দ্রসংগীত চিন্তা – শৈলজারঞ্জন মজুমদার (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি)

৭. ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত – দেবব্রত বিশ্বাস (করুণা প্রকাশনী)

Harmonizing Inclusivity: Navigating the Landscape of Music Accessibility in the Digital Age

Dr. Asima Jana Maity

Abstract:

As the digital era transforms the music industry, the issue of music accessibility emerges as a critical concern. This paper delves into the multifaceted dimensions of accessibility, exploring how various barriers, such as economic constraints, technological disparities, and disabilities, hinder individuals’ ability to engage with and enjoy music. We examine the impact of streaming platforms, adaptive technologies, and inclusive design on widening or narrowing the musical landscape for diverse populations. By addressing the challenges and opportunities inherent in music accessibility, this research aims to contribute to a more harmonious and inclusive musical ecosystem for all.

সঙ্গীতের সহজলভ্যতার সমস্যা

ড. অসীমা জানা মাইতি

সহকারি অধ্যাপিকা, (SACT-II), বিদ্যাসাগর শিক্ষক শিখণ মহাবিদ্যালয়, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ, Mobile no. 7063057716, email id : ajanamaiti@gmail.com

সারসংক্ষেপ :

মনুষ্যজাতির জন্ম থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি আবেগ, অনুভূতির সাথে সঙ্গীত জড়িয়ে রয়েছে আমরা আমাদের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, উচ্ছাস সব কিছুকেই অনুভব করার জন্য সঙ্গীতকেই মাধ্যম করি কিন্তু বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে যে কোনো ধরনের সঙ্গীতকে পাওয়া মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে বর্তমান সময়ে সোসাল মিডিয়া অর্থাৎ ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদির জন্য মানুষ খুব সহজেই গান শুনতে পাচ্ছে, শিখতে পাচ্ছে এবং ইচ্ছা খুশি ব্যবহার করতে পারছে কিন্তু সঙ্গীত যেমন খুব সহজেই মানুষের কাছে বিনা খরচে এবং বিনা পরিশ্রমে পৌঁছে যাচ্ছে, তেমনি এর বিরাট বড় সমস্যাও রয়েছে সঙ্গীত জগত তাই বিরাট বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে

ভূমিকা : 

    বর্তমানে আমরা ২১ শতকে Technology এবং Internet এর জন্য আমরা সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোতে ব্যবহার করতে পারছি। নিজের ইচ্ছে মতো বিশ্বের যেকোনো খবর যেকোনো সময় জানতে পারছি, শিখতে পারছি।

     ঠিক সেরকমই একটি বিষয় হল সঙ্গীত। গান শোনে না – এরকম মানুষ পৃথিবীতে নেই বল্লেই চলে, মানুষের জীবনের প্রতিটি আবেগ, অনুভূতি, প্রকাশভঙ্গি, ঈশ্বর সাধনা, সর্বোপরি যেকোনো অনুষ্ঠানে সুখ-দুঃখ, ক্লান্তি, রিফ্রেসমেন্ট, সর্বোপরি যেকোনো ধরণের অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সঙ্গীতকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিই।

উদ্দেশ্য :

এই নিবন্ধে আলোচনার উদ্দেশ্যগুলি হল –

১. সঙ্গীতের সহজলভ্যতার সমস্যার কারণ।

২. সঙ্গীতের সহজলভ্যতার জন্য শিল্পীবৃন্দের সমস্যা।

৩. সঙ্গীতের সহজলভ্যতার সমস্যা সমাধানের উপায়

কীওয়ার্ড – সঙ্গীত, সমস্যা, সহজলভ্যতা, সোশাল মিডিয়া, মানুষ জাতি।

বিবরণ

  • সঙ্গীতের সহজভ্যতার ফলে সমস্যা ও তার কারণ :

     বর্তমান সময়ে Internet এর জন্য আমরা সবকিছুকেই সহজেই হাতের মুঠোর আনতে পারি। সঙ্গীত আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বর্তমান সময়ে Social Media অর্থাৎ Face book, You tube, Twitter, Instagram ইত্যাদির দ্বারা যেকোনো গান মানুষ বিনামূল্যে ইচ্ছে খুশি ব্যবহার করতে পারে।

আগে ৭০ এর দশক বা ৮০ এর দশকের সময়ে নাম করা Company থেকে বাছাই করা শিল্পীদের গান বছরে একবার বা দুইবার Release হত। সেইসব গানগুলি Caset এ Release হত এবং গানগুলি শোনার জন্য বা সংরক্ষণ করার জন্য শ্রোতাদেরকে গানের ক্যাসেট দোকান থেকে কিনতে হত। ফলে শ্রোতাদের মধ্যে সচেতনতার সহিত গানগুলি শোনার এবং সংরক্ষণ করার একটা আগ্রহ থাকতো।

কিন্তু বর্তমান সময়ে খুব সহজেই এবং বিনামূল্যে প্রচুর গান শ্রোতারা পেয়ে যাচ্ছেন। এবং দেখা যাচ্ছে যে প্রতিদিন YouTube এ কয়েক হাজার গান রিলিজ হচ্ছে। কম সময়ে অধিক সংখ্যক গান বিনা খরচে শ্রোতারা হাতে পেয়ে যান। তাই তাদের মধ্যে ভালো গান সংরক্ষণ করার দিকে অনীহা দেখা যায়। বর্তমান সময়ে ভালো স্রোতার সমস্যাও কিন্তু একটা বড় সমস্যার কারন।

  • সঙ্গীতের সহজলভ্যতার জন্য শিল্পীবৃন্দের সমস্যা :

সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন মাধ্যমগুলিতে প্রতিনিয়ত গান Release হচ্ছে। সেক্ষেত্রে নতুন গান ও রিলিজ হচ্ছে এবং পুরোনো গানও নতুন ডিজাইনে রিলিজ হচ্ছে। শিল্পীদের মধ্যে এই প্লাটফর্মে নতুন শিল্পী এবং পুরানো শিল্পী উভয়েই রয়েছে। তবে সোশাল মিডিয়ার দৌলতে নতুন শিল্পীদের বেশী খোঁজ পাওয়া যায়।

      তাহলে এতো গান, এতো শিল্পী ভিডিওগ্রাফী সবকিছুর জন্য প্রয়োজন অর্থ। আগে শিল্পী ভালো গান গাইলে তাদেরকে দিয়ে ক্যাসেট কোম্পানীগুলো গান গাইয়ে দোকানে বিক্রি করে রোজগার হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে ক্যাসেট কোম্পাণীটাই উঠে গেছে। দোকানে ক্যাসেট বিক্রিও উঠে গেছে। গানবাজনার একমাত্র প্লাটফর্ম হল YouTube, Face book, Instagram ইত্যাদি। যেখানে শিল্পীদেরকে আগে নিজেদের টাকা খরচ করে গানের রেকর্ডিং এবং ভিডিওগ্রাফি করতে হয়। সেক্ষেত্রে শিল্পীদের টাকা রোজগারের কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। যেমন YouTube একটি গান ৯০ দিনের মধ্যে ১০০০ সাবস্ক্রাইবার এবং ১০ মিলিয়ন পাবলিক ভিউ না হলে YouTube পেমেন্ট দেয় না। শিল্পীরা বেশী পরিমানে সাবস্ক্রাইবারের আশায় YouTube এ  ভিডিওসহ গান Release করতে থাকে। কিন্তু মানুষ এত এত বেশি গান বিনা খরচে পেয়ে যাচ্ছে, তাই সাধারণ মানুষের সেক্ষেত্রে কোনো YouTube Channel টি Subscribe করতে হবে তার কোনো বাধ্যতা নেই।

     অন্যদিকে শিল্পীরাও ভালোগান বা পারফর্মেন্স করা সত্ত্বেও তারা তাদের সঠিক সাম্মানিক পাচ্ছে না। শিল্পীদের একটা অনিশ্চিত জীবনের সম্মুখিন হতে হচ্ছে বারবার। তাই বহু বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে মেয়েদেরকে ছোটোবেলা থেকে গানবাজনা শিখিয়েও গানবাজনাটাকে প্রফেশন হিসেবে নিতে দিতে চায় না।

      তাই অনেকেই আছেন গানবাজনার পাশাপাশি অন্যকোনো প্রফেশনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। এই সমস্ত শিল্পীরা পারফর্ম করার জন্য অনেক সময় দেখা যায় খুব বেশী টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে দাবি করে না।

      কিন্তু, অপরদিকে যারা শুধুমাত্র গানবাজনাকেই তাদের জীবন-জীবিকা হিসেবে নিয়েছে তারা অতিরিক্ত কম পারিশ্রমিকে কাজ করলে তাদের জীবন চালানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা বাধ্য হয় কম পারিশ্রমিক নিজে কার করতে। Covid-19 –এর সময়ে বহু শিল্পীরা বাধ্য হয়েছে অন্য কাজ বেছে নিতে। সেইসময় কোনো Program হত না, যারা সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন তাদেরও উপার্জন কমে গেছিল। ফলে শিল্পী জীবন বহু সমস্যার সম্মুখীন।

  • সঙ্গীতের সহজলভ্যতার সমস্যা সমাধানের উপায় :

     সঙ্গীত এতো সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে সেই কারণে সঙ্গীতের সঠিক গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে, ভালো কাজের মূল্যায়ণ হচ্ছে না সঠিকভাবে। তবে সঙ্গীতের সহজলভ্যতার সমস্যা সমাধানের উপায় আমাদেরকেই খুঁজে বার করতে হবে। YouTube Launch করেছিল 2005 এর 14th February, Face book এ ভিডিও update দেওয়া শুরু হয়েছিল ২০১৪ সাল থেকে।

১. Face book এ Video করা যদি বন্ধ করা যায়।

২. YouTube এ গান শোনার জন্য Payment করার পদ্ধতি থাকা দরকার।

৩. যেকোনো গান শোনার জন্য Payment করে গান শোনার পদ্ধতি থাকা দরকার।

৪. Performance মূলক কোনো Program হলে artist দের ঘন্টা পিছু টাকা ধার্য করা থাকবে।

৫. শিল্পীদের বিনা পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা বন্ধ করা দরকার।

৬. Promoting Company এবং YouTube এর মতো platform গুলিকে শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

    এছাড়াও short video করার জন্য গান বা আবহ সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়। যেমন –  দেখা যায় যে কোন ব্যক্তি ছবি পোস্ট করছে, কিন্তু সেই ছবির জন্য একটা background music ব্যবহার করছে। এইরকম নানান ক্ষেত্রে দেখা যায় সঙ্গীতকে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু তার জন্য সেই শিল্পীরা কোনো পারিশ্রমিক পায় না। এবং সাধারণ মানুষও বিনা খরচে এই সুবিধাগুলো নিতে চায়।

কিন্তু আমাদের নিজেদেরও উচিত প্রতিটি শিল্পীর শিল্প যখন ব্যবহার করবো, তাকে উপযুক্ত সাম্মানিক দান করা।

Conclusion:  

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। এই সঙ্গীত শিল্পীদের বিনাপারিশ্রমিকে ব্যবহার না করে তাদেরকে যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত। খুব সহজে কোন জিনিস হাতে পেয়ে গেলে তার কোনো মর্যাদা থাকে না। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছে। সঙ্গীত ইন্টারনেট এর মাধ্যমে বানিজ্যিক হচ্ছে, এবং কিছু সংস্থাও এক্ষেত্রে সুবিধাভোগী হচ্ছে। এতে শিল্পীগোষ্ঠী পরিচিতি পাচ্ছে কিন্তু যথার্থ অর্থ পাচ্ছে না। তাদের ভবিষ্যৎ বিপদমুখী হচ্ছে। তারা বাধ্য হচ্ছে কম পারিশ্রমিক নিয়ে কাজ করতে । তাই আমাদের সাধারণ মানুষদের নিজের থেকে শিল্পীদের দিকে সততার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত, তাদের কাজের সঠিক মর্যাদা দেওয়া উচিত।

Reference:  

  1. E. Jochen.(05 February 2013) , Published online by Cambridge University Press https://www.cambridge.org/core/books/abs/accessibility-of-music/what-is-musical-accessibility/17DD920F3B9F29302F51D5F81671492
  2. Furniture@work, December 23,2021 https://www.furniture-work.co.uk/blog/music-in-the-office-advantages-and-disadvantages
  3. 3. P. Dmitry, (14 March 2022) Trends & Expert Predictions for 2023  https://soundcharts.com/blog/music-industry-trends                                     
  4. P. T. John, F. Lukas, A.C. Bruce, Article, Musial Performance.  https://www.britannica.com/art/musical-performance
  5. S. Jimmy (2020). The State of the Music Industry in  https://www.toptal.com/finance/market-research-analysts/state-of-music-industry
  6. V. H. Mark , La Verne, CA, United States. https://www.jukeboxliveband.com/blog/how-social-media-affects-music-industry#:~:text=Social%20media%20connects%20fans%20to,artists%20through%20social%20media%20platforms.

Harmony of Expression: Exploring the Application of Music and Modernity in Rabindranath Tagore’s Plays, Stories, and Poems

Dr. Moushumi Pal, Assistant Professor, Purnidevi Chowdhury Girls College, Bolpur, Birbhum

Abstract: The abstract highlights the extensive discussions and revisions regarding the intertwined nature of literature and music in the works of Rabindranath Tagore. The focus is on the significance of music in Tagore’s plays, stories, and poems, with an emphasis on the close relationship between literature and music, particularly in the context of theatre. The abstract suggests that understanding the songs in Tagore’s dramas reveals more than just a collection of musical pieces; it unveils songs depicting seasons, work, and thematic elements. Additionally, the abstract acknowledges the undeniable role of music in some of Tagore’s stories, indicating that certain songs may offer clues or hints about the underlying narrative. This study delves into the profound intersection of music and modernity in the literary works of Rabindranath Tagore, the revered polymath of Bengal. Tagore, a Nobel laureate poet, playwright, and philosopher, seamlessly integrated music into his creative expressions, transcending traditional boundaries and infusing his works with a distinctive rhythmic and melodic essence. This research examines how Tagore’s innovative use of music catalyzes the portrayal of modern themes in his plays, stories, and poems. By analyzing the intricate relationship between music and modernity in Tagore’s oeuvre, this study aims to unravel the nuanced layers of cultural, social, and existential significance embedded in his artistic creations. Through a comprehensive exploration of selected works, this research sheds light on Tagore’s unique approach to blending traditional musical elements with progressive ideas, thereby contributing to a deeper understanding of the symbiotic relationship between artistic expression, music, and the evolving landscape of modernity in Tagore’s literary legacy.

রবীন্দ্রনাথের নাটক, গল্প ও কবিতায় সঙ্গীতের প্রয়োগ ও আধুনিকতা

ড. মৌসুমী পাল, সহকারি অধ্যাপিকা, পূর্ণিদেবী চৌধুরী গার্লস কলেজ, বোলপুর, বীরভূম, E-mail – palkundu.mausumi9@gmail.com, Mobile No. : 9830353952

Abstract :

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক, গল্প এবং কবিতায় সঙ্গীতের সম্পর্ক নিয়ে আমরা অনেক আলোচনা, পুনরালোচনার সম্মুখীন হয়েছি, যার মধ্যে বেশীরভাগই প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্যমুখী এবং পরোক্ষভাবে সংগীত সংক্রান্ত। কয়েকটি ক্ষেত্রে নাট্যসংগীতের আলোচনায় অবশ্য সাহিত্য ও সংগীতের পরিমান ঘটেছে প্রায় সমান সমান। রবীন্দ্রনাথের এই নাটকের গানগুলি খুব ভালোভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায় যে সেগুলি শুধু গানের তালিকামাত্র নয়, তাতে স্থান পেয়েছে ঋতুবিষয়ক গান, কর্মসংগীত বিষয়ক গান, আবার কোথাও উদ্দেশ্যমূলক গান বা থিম সঙ্। তাছাড়া তাঁর কিছু কিছু গল্পে গানের ভূমিকার প্রাধান্য অস্বীকার করা যায়না। আবার কিছু কিছু গানের নেপথ্যে কোনো সম্ভাব্য গল্পের আভাসও মেলে।

বীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের মধ্যবর্তী সীমারেখাটি চিহ্নিত করা খুবই সমস্যামূলক। কারন রবীন্দ্রনাথের বেশীরভাগ গানই কবিতা। এর মধ্যে বেশকিছু কবিতাকেও রবীন্দ্রনাথ পরে সম্পূর্ণরূপে অথবা আংশিকভাবে গানে রূপান্তরিত করেন। সাধারণভাবে এই সকল কবিতা – গানের সঙ্গে তাঁর গান-কবিতার কিছু পার্থক্য অনুভব করা যায়। কবিতা ও গানের পারস্পরিক সম্বন্ধ বিষয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা রবীন্দ্রনাথ নিজেই করেছিলেন। তাঁর প্রথম জীবনের ‘সহযোগিতা‌‌’ গ্রন্থে ‘সংগীত ও ভাব’, ‘সংগীত ও কবিতা‌’ প্রবন্ধগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। এগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে সারাজীবন কবিতা ও গান একত্রে অনুশীলন করতে করতে রবীন্দ্রনাথ এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বিভেদ রাখেননি।

রবীন্দ্রনাথের রচিত প্রথম গান – জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‌‘সরোজিনী‌’ নাটকে সংযোজিত চিতা প্রবেশের গানে (‌‘জ্বল্‌ জ্বল্‌ চিতা, দ্বিগুন দ্বিগুন‌’) আসন্ন আত্মদানের পটভূমিতে যে তীব্র অভিশাপের রুদ্রবাণী ধ্বনিত হয়েছিল, তারই পরিণত রসঋদ্ধ রূপায়ন এই ‌‘দহন-সংগীত‌’।

রবীন্দ্রনাথের নাটকে গানের প্রয়োগ নিয়ে রবীন্দ্রনাট্য সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থগুলিতে কিছু কিছু আলোচনা আছে যেগুলিতে অধিকাংশই সাহিত্যের দিক থেকে আলোচনা হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন – রমেন্দ্র নারায়ণ নাগের ‌‘রবীন্দ্রনাটকে গানের ভূমিকা‌’ এইরূপ একটি গ্রন্থ। তাছাড়া অরুণকুমার বসুর ‌‘বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত‌’ গ্রন্থে ‌‘নাটকের গান ও গানের নাটক‌’ নামক অধ্যায়ে এই সম্পর্কে যেমন গভীর তেমনি তথ্যপূর্ণ আলোচনা পাওয়া যায়। অধ্যাপক বসুর ‌‘রবীন্দ্র বিচিন্তা‌’ গ্রন্থের অন্তর্গত রবীন্দ্রনাথের ‌‘রাজানাটক ও রাজাতত্ত্ব‌‌’ প্রবন্ধেও এই জাতীয় সাংগীতিক, সাহিত্যিক বিচার দৃষ্টিগোচর হয়। শঙ্খ ঘোষের ‌‘নাটকে গান রবীন্দ্রনাথের নাটক‌’ এই বিষয়ে আর একটি গুরুত্বপূর্ন প্রবন্ধ। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও কতকগুলি বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায়।

‌‘চোখের জলের লাগল জোয়ার‌’ অজয় রায় রচিত ‌‘শেষ বসন্তে রবীন্দ্রনাথ‌’ (প্রিন্টো বুকস্‌, ১৯৯৬) গ্রন্থের একটি অধ্যায়েও রক্তকরবী নাটকে সংগীত প্রয়োগ সম্পর্কে একটি মননশীল আলোচনা স্থান পেয়েছে।

সুচিত্রা মিত্রের ‌‘রবীন্দ্রনাটকের গান‌’ শুধু রবীন্দ্রনাথের নাটকে গানের তালিকা নয়, গানের শ্রেনীবিভাগও, তিনি নাটকে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসংগীতগুলিকে ঋতুবিষয়ক গান, কর্মসংগীত,উদ্দেশ্যমূলক গান, থীম সঙ্‌ এইভাবে ভাগ করেছেন। জয়দেব রায়ের ‌‘রবীন্দ্রনাথের গানের পালা‌‌’য় নাট্যগীতি ছাড়াও ঋতুনাট্য বা নটরাজ পালাগানের প্রসঙ্গও এসে গেছে। সেখানে গ্রীক নাটকের কোরাসের অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় সকল নাটকে একটি করে গানের দল রেখেছেন। সেই দলের অধিপতি স্বয়ং কবি, কখনও তাঁর নাম দাদাঠাকুর, কখনও বা ঠাকুরদা, কখনও বা ধনঞ্জয় বৈরাগী। ‌‘বাল্মীকি প্রতিভা‌‌’ ও ‌‘কালমৃগয়া‌’ গীতিনাট্যে এই গানের দলে ছিল বনদেবীগণ, ‌‘মায়ার খেলা‌’য় মায়াকুমারীগণ, ঋতুনাট্যগুলিতে কোথাও কবিশেখর, কোথাও বা স্বয়ং নটরাজের দল।

কথাসাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষ তাঁর ‌‘রবীন্দ্রনাট্যঃ গান দিয়ে দ্বার খোলানো‌’ প্রবন্ধে সাহিত্যবুদ্ধিও নাট্যরসজ্ঞতার দুর্লভ এক দৃষ্টান্ত রক্ষা করেছেন। তাঁর মননে বোধে রসচেতনায় রবীন্দ্রনাথ যেন অন্তরঙ্গতম হয়ে উঠেছেন। বর্তমান প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের নাট্যসিদ্ধি সংগীত সম্পর্কিত অভীপ্সার গভীর সূত্রগুলি সন্ধান করে সন্তোষকুমার ঘোষ লিখেছেন- ‌‘‌‘কোনো উৎসর্গপত্রই বলি, আর ব্রহ্মসংগীতই বলি, একটি গানে যাঁকেই তিনি জীবনের ধ্রুবতারা বলে থাকুন না কেন, রবীন্দ্রনাথের স্থির ধ্রুবতারা কিন্তু ছিল সংগীতই। সেই সংগীত, নাটকের সহকারবৃক্ষকে লতার মতো জড়িয়ে উঠেছে। তাকে দুরন্ত তুরঙ্গম করে তুলতে পারে উধাও সুর, উদাত্ত ধ্বনি।’‌’

আবার এও লক্ষ্য করা যায়, যে ফাল্গুনী নাটকের মর্মবস্তু বিজন মন্দিরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে তখনই যখন একটি আর্ত অন্ধ বাউলের কন্ঠে ওই আকুল সংগীতটি গীত হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ গান দিয়ে নাট্যবস্তুর অন্তরলোকের দ্বার খুলিয়েছেন। নিস্তব্ধ গিরিরাজকেও যিনি অনুদাত্ত, উদাত্ত, স্বরিত রেখায় বিস্তারিত অভ্রভেদী সংগীতরূপে কল্পনা করেন, গান তাঁর সৃষ্টিলোকের চাবি হবে বইকি।

আর একজন কথা সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাটকে সংগীত ব্যবহারের মর্মকথাকে উদ্‌ঘাটিত করেছেন। যেমন শুধু রক্তকরবীর ক্ষেত্রে তিনি লিখেছেন –‌‘‌‘আরো ভালো উদাহরণ ‌‘রক্তকরবী‌’র মর্মগীতিটি। অর্থাৎ ‌পৌষের গান। ফসল পেকেছে, কাটতে হবে, তারই ডাক। রক্তকরবীর সিদ্ধান্ত বাক্যটি কি? পুঁজিবাদী শোষণের বেড়াজাল তৈরী করে যে বিপুল শক্তিধর কর্মী মানুষটি তিলে তিলে আত্মনাশের মধ্য দিয়ে মরা ধনের শবসাধনা করছে, প্রেম আর সৌন্দর্যের তৃষ্ণায়, জীবনের আকুতিতে নিজের ধ্বজাদন্ডটি ভেঙে দিয়ে সে বেরিয়ে আসবে? সর্বসাধারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সে আবার নতুনভাবে আরম্ভ করবে জীবনসাধনা, দীক্ষা নিতে ছুটবে Socialism এর মন্ত্রে? আর এই সমাজতন্ত্রবাদের পালা গান শুরু হবে কারখানায়, নাগরিকতায় নয়, পল্লীপ্রকৃতির কোলে, কলতন্ত্র থেকে বেরিয়ে হল তন্ত্রে?‌’‌’ সাধারণভাবে এই কথাটির মনে হয় বটে, কিন্তু পৌষের গানটি লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে ‌‘রক্তকরবী‌’র পরম বক্তব্যটি এর চাইতে আরো কিছু বেশি। আসলে রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে ধনতান্ত্রিক শোষণবাদের বিরুদ্ধে কন্ঠস্বর তুলে ধরলেও কোনো একটা বিশেষ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছেন না; যে কর্ষণজীবি সভ্যতার কথা তিনি বলছেন তাকে ‌‘এগ্রিকালচারল্‌ সিভিলাইজেশন‌’ মনে করলে ভুল করা হবে; বরং তা ‌‘ক্রিশ্চান মিলেনিয়ামে‌’র মতো যেদিন তরোয়াল ভেঙে লাঙল তৈরী হবে, খ্রীস্টের পুনরাবির্ভাবে ঐশ্বরিক ভক্তির ছত্রছায়ায় সমস্ত মানুষ একটি প্রীতির সূত্রে আবদ্ধ হবে। অর্থাৎ রক্তকরবীর শেষ কথায় কোনো বাস্তবসিদ্ধ রেখাবৃত্ত নেই, তার ভাবময়তায় বিকীর্ণ। ‌‌‘পৌষের গান‌’ কী বলছে?/ মাঠের বাঁশি শুনে আকাশ খুশি হ‌’ল-/ঘরেতে আজ কে রবে গো।/ খোলো দুয়ার খোলো’ ‌‘মাঠ‌’ এবং ‌‘আকাশ‌’ দুটো কথা আছে এর ভিতরে। এখানে মাঠ হল সামগ্রিক কর্ষণার প্রাণের অন্ন, আকাশ হল উর্ধ্বলোক, যেখান থেকে দেবতার প্রসন্ন দৃষ্টিকিরণ মানুষের উপর বর্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ দেবলোকের করুণার চন্দ্রাতপতলে অহিংস নির্দ্বন্দ্ব মানুষ যে প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে, বিশেষ সামাজিক অবস্থা পার হয়ে সমস্ত প্যাটার্নকে অতিক্রম করে সেই ভাবক্ষেত্রেই ‌‘রক্তকরবী‌’র বিস্তার‌। ‌‘‌‌‘আর এই বক্তব্যটি হৃদয়ঙ্গম না হলে‌ ‌‘রক্তকরবী‌’তে মাত্র সোশ্যালিষ্ট, রিভোলিউশনই পাওয়া যাবে। তাতে খুশি হওয়ার মতো নগদ বিদায় নিশ্চয় মিলবে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উপরে কোনোমতেই সুবিচার করা হবে না।‌’‌’ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে যে কথা ভিতর থেকে উঠে আসা মৌলিক চিন্তায় উদ্ভাসিত, সেইরূপ মৌলিক চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায় আলপনা রায়ের প্রবন্ধ দুটিতে১০, সুধীর চক্রবর্তী১১ ও অশ্রুকুমার সিকদারের প্রবন্ধে১২

রবীন্দ্রনাথের ‌‘দুঃখের গান‌’ গ্রন্থে ‌‘নাটকের গান‌’ অধ্যায়ে১৩ নাটকের গানগুলিকে শ্রীমতী জয়ন্তী ভট্টাচার্য শান্তিদেব ঘোষের বক্তব্য অনুযায়ী এবং সাংগীতিক গুরুত্বের বিচারে দুই ভাগে বিভক্ত করলেও মূলত প্রথম ভাগ অর্থাৎ শান্তিদেব ঘোষ যেগুলিকে ‘গীতিনাট্য‌’ আখ্যা দিয়েছেন তারই আলোচনা করেছেন। শান্তিদেব ঘোষের সঙ্গে একমত হয়ে লেখিকা দ্বিতীয়ভাগের অন্তর্ভুক্ত ‘বসন্ত’ ‘শ্রাবণগাথা‌’, ‘ঋতুরঙ্গ‌’ এইগুলিকে তাঁর ‘গীতিনাট্য’ বলে মনে না হওয়ার জন্য তিনি এগুলিকে তাঁর আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেন নি।

১৮০৩ শকাব্দে রচিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাট্যগীতি ‌‌‘ভগ্নহৃদয়ে‌’র ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে‌’ গানটিতে লেখিকার মতে “বিচ্ছেদ আছে, কিন্তু বিষণ্ণতা নেই । প্রকৃতির এই নিরাসক্ত লীলা কবিকে শিক্ষা দেয় মানবজীবনের চাওয়া-পাওয়ার খেলায় অবিচলিত থাকতে—বৃহত্তর জীবনবোধের পটভূমিতে স্থাপিত করে আবিষ্কার করতে খণ্ড খণ্ড সুখ দুঃখের সামগ্রিক তাৎপর্যকে।” (পৃ. ১০৪ )

এরপর ‘মায়ার খেলা’নৃত্যনাট্যের ‘আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই‌’ গানে কবির মনে জেগেছে প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কা। ‘রাজা ও রাণী‌’ নাটকে মিলনের প্রত্যাশার মধ্যে ঘটেছে বেদনার ছায়া পাত যা কিনা পরবর্তী ‘ঐ বুঝি বাঁশি বাজে‌’ গানে সুখের মাধুর্যের বদলে পরিণতি লাভ করেছে তীব্র উৎকণ্ঠার হাহাকারে এবং পঞ্চম অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে চিরবিদায়ের সুর ধ্বনিত হয়েছে ‌‘আমি নিশিদিন তোমায় ভালবাসি‌’ গানে। ১৩৩৬ সালে লাহোর জেলে যতীন দাসের অনশনের ফলে মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ যে গানটি লিখেছিলেন সেটি পরে ‘তপতী‌’ নাটকের অন্তর্ভুক্ত হয়। গানটি হল ‌‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ’। ‌‘তপতী‌’ নাটকের আরও গানগুলি হল ‌‘আমি সকল নিয়ে বসে আছি‌’, ‘আমি তোমার প্রেমে’, ‘এ অন্ধকার ডুবাও’, ‘দিনের পরে দিন যে গেল‌’। এই রকম আরও কিছু কিছু নাটকের গানের উল্লেখ করা যায়। যেমন—‌‘বিসর্জন‌’ নাটকের ‘আমারে কে নিবি ভাই’, ‘প্রায়শ্চিত্ত‌’ নাটকের ‌‘আজ তোমারে দেখতে এলেম‌’, ‘চিরকুমার সভা‌’র না বলে যায় পাছে সে‌’, ‌‘তোমায় চেয়ে আছি বসে‌’ বা ‌‘জ্বলে নি আলো অন্ধকারে’,‘শোধবোধ’নাটকের ‘বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা’, ‘উজাড় করে লও হে আমার সকল সম্বল’, ‘শেষরক্ষা‌’ নাটকের ‘হায় রে ওরে যায় না কি জানা‌’, ‘যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে’, ‘কাছে যবে ছিল’, ‘মুখপানে চেয়ে দেখি, ‘গৃহপ্রবেশ’নাটকের ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’, ‘রক্তকরবী’র ‘তোর প্রাণের রস তো শুকিয়ে গেল ওরে’,‘তোমায় গান শোনাব’, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’, ‘অচলায়তনে’র পঞ্চক বা ‘ফাল্গুনী‌’ নাটকের কবি শেখরের মুখের গান ‌‘পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে‌’।

এছাড়া কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের ‌‘রবীন্দ্র গল্পে গান‌’ নামে একটি প্রবন্ধে১৪ কিছু কিছু গল্পে গানের সামান্য উল্লেখ করেছেন। অন্যদিক থেকে সৌমেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‌‘ভ্রষ্টলগ্নের গান‌’১৫ নামক একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের নেপথ্যে কোনো সম্ভাব্য গল্পের আভাস দিয়েছেন।

আবার রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের মাঝখানের সীমান্তরেখাটি যে চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য যে ব্যাপারে অধ্যাপক সুকুমার সেন তাঁর ‌‘রবীন্দ্রনাথের গান‌’১৬ গ্রন্থে কিছু আলোকপাত করেছেন। যেমন – ‌‘‌‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব গান সুরের ফ্রেমে ভেবে নিয়ে লিখেছিলেন কিনা। না লিখে থাকলে কোন্‌ কোন্‌ গান তিনি সুরের ‌ধারায় মিলিয়ে ছন্দ ও ভাষা দিয়েছিলেন?‌’‌’

এ ব্যাপারে অবশ্য কোনো প্রামান্য তথ্য মিলবে না রবীন্দ্রনাথের উক্তি ছাড়া। এক্ষেত্রে গান-কবিতা রচনার সময় কবিমনে সুরের সহযোগিতা কিছু মেনে নিতে হবে। আর গ্রন্থনামে (গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি) এবং তাঁর আগে এরূপ রচনার শীর্ষে (‌‘কল্পনায়‌’ ও ‌‘খেয়ায়‌’) আর ইঙ্গিত পাওয়া যায়, আবার কোথাও কোথাও রাগ-তাল নির্দেশ থাকলে তো কথাই নেই। এটাও মেনে নেওয়া প্রাসঙ্গিক যে সব গান-কবিতায় সুরের সহযোগিতা সমান পরিমানে নয়, যেখানে রচনাটি একটু দীর্ঘ সেখানে সুরের সহযোগিতা কম বলে মনে হয়। গান-কবিতার একটি বিশিষ্ট লক্ষণ হল এক-মিল, অন্ততপক্ষে প্রথম ও শেষ পদে। ব্যতিক্রমও আছে।

কবিতা ও গানের পারস্পরিক সম্বন্ধ বিষয়ে প্রথম আলোচনা রবীন্দ্রনাথই করেছিলেন। তাঁর প্রথম জীবনে ‌‘সহযোগিতা‌’ নামক গ্রন্থে ‌‘সংগীত ও কবিতা‌’, ‌‘সংগীত ও ভাব‌’ প্রবন্ধগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘটেছে। সারাজীবন কবিতা ও গান অনুশীলন করতে করতে রবীন্দ্রনাথ এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বেড়া রাখেননি। কবিতা ও সংগীতের এই পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষন ও রসগ্রাহী আলোচনা করেছেন অধ্যাপক অরুণ কুমার বসু তাঁর ‌‘বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত গ্রন্থে১৭। তাঁর গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ অধ্যায়ে ‌‘যুগলমিলন‌ স্রোতে‌’ শিরোনামে কবির বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত গান ও সুরারোপিত কবিতাগুলির যে আলোচনা আছে অনুরূপ বিষয়ে তাঁর পূর্বে আর কোনো আলোচনা আমাদের চোখে পড়েনি। তবে পরবর্তীকালে এই বিষয়ে কেউ কেউ আরো আলোচনা করেছেন। শান্তিদেব ঘোষ তাঁর ‌‘রবীন্দ্রসংগীত‌’ গ্রন্থের ‌‘কাব্যগীতি‌’ নামক অধ্যায়ে১৮ এই বিষয়ে একটা প্রাথমিক খসড়া করেছিলেন। তাছাড়া সুধীর চক্রবর্তী  ‌‘কবিতা আর গানের আকাশঃরবীন্দ্রনাথ‌’ নামে তাঁর ‌‘গানের লীলার সেই কিনারে‌’ গ্রন্থে (১৩৯২)১৯, শঙ্খ ঘোষের ‌‘এ আমির আবরন‌’ (১৯৮০) গ্রন্থের ‌‘ধরেছি ছন্দবন্ধনে‌’ প্রবন্ধটিতেও২০ এই বিষয়ে কিছু আলোচনা আছে। এই বিষয়ে অবশ্য বিচ্ছিন্ন কিছু প্রবন্ধও আমাদের চোখে পড়েছে। সেগুলির মধ্যে ‌‘বাণী ও বীণা‌’ প্রবোধচন্দ্র সেনের এই দিক নির্ণায়ক প্রবন্ধটি২১ মূলত রবীন্দ্রনাথের গানের ছন্দে কাব্যছন্দের বিশিষ্টতা ও পদ্ধতি নিরূপণ করা।

‌‘কড়ি ও কোমল‌:শতবর্ষের গান‌’ হর্ষ দত্তের এই প্রবন্ধটিতে২২ ‌‘কড়ি ও কোমল‌’ কাব্যের আলোচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে কড়ি ও কোমলের ‌‘হেলাফেলা সারাবেলা‌’, ‌‘আজি শরততপনে‌ প্রভাত স্বপনে‌’ গান দুটির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন – ‌‘‌‘এ যে গোপন তন্ত্রীতে বেজে ওঠা দুঃখী প্রাণের গভীর দীর্ঘশ্বাস। স্বতঃই মনে হয়, এদুটি গানেরও রচনা উপলক্ষ্য কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু। এদের বাণী সামান্যত স্পর্শ করে আছে শরৎ ঋতুর সোনালি দিনের বসনাঞ্চল। কিন্তু সমগ্র অবয়বে এ গান ধরে রেখেছে ব্যথার পূজার অর্ঘ্য‌।‌’ (পৃঃ ৪০) যদিও এ প্রবন্ধ প্রকাশের বহু পূর্বে অধ্যাপক অরুণ কুমার বসুর ‌‘বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত‌’ গ্রন্থে আমরা এই মন্তব্য পেয়েছিলাম।

ঋষিণ মিত্র আধুনিক কবিতায় সুরারোপ করে খ্যাতিলাভ করেছেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর অনেক কবিতার ওপর সুরারোপ করে গানে পরিণত করেছেন। শ্রীমিত্র তাঁর ‌‘আধুনিক কবিতার গীতিরূপ ও রবীন্দ্রসংগীতের কয়েকটি দিক‌’ প্রবন্ধে২৩ রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাকে গানে রূপান্তরিকরণের আদর্শকে মানদন্ড করে তাঁর আধুনিক কবিতার ওপরে সুর দেওয়ার যোগ্যতা ও পদ্ধতিকে বুঝে নিতে চেয়েছেন।

রবীন্দ্রসংগীতের দুটি দিক তার সুর ও বাণীর ক্ষেত্র- রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক আলোচনায় প্রায় সমান গুরুত্ব পেয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডের দ্বিতীয় সংস্করণে (১৩৪৬) রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর গানগুলিকে পূজা, স্বদেশ, আনুষ্ঠানিক, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র প্রভৃতি পর্যায়ে নির্দেশ করে বলেছিলেন, এই ভাবের অনুষঙ্গে সুরের সহযোগিতা না পেলেও পাঠক গীতিকাব্যরূপে গানগুলির আস্বাদন করতে পারবেন।

উল্লেখপঞ্জী

১) রবীন্দ্রনাটকে গানের ভূমিকা – রমেন্দ্রনারায়ণ নাগ, ডি.এম.লাইব্রেরি, ফাল্গুন, ১৩৮৮

২) বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত- অরুণ কুমার বসু, দে‌’জ, আগষ্ট, ১৯৯৪ (২য় সং)

৩) রবীন্দ্রবিচিন্তা – অরুণকুমার বসু, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, মহালয়া, ১৩৫৭

৪) রবীন্দ্রনাথ মনন ও শিল্প – সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, নাটকে গান রবীন্দ্রনাথের নাটক – শঙ্খ ঘোষ, প্রকাশক?

৫) শেষ বসন্তে রবীন্দ্রনাথ – অজয় রায়, প্রিন্টো বুক্‌স, ১৯৯৬।

৬) রবীন্দ্রনাটকের গান – সুচিত্রা মিত্র, রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি সাহিত্যপত্র, বর্ষ-২, সংখ্যা ১, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৮৮

৭) রবীন্দ্রনাথের গানের পালা – জয়দেব রায়, রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি, বর্ষ-২, সংখ্যা-১, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৮৮।

৮) রবীন্দ্রনাট্যঃ গান দিয়ে দ্বার খোলানো- সন্তোষ কুমার ঘোষ, চতুরঙ্গ, বর্ষ ৪৫, সংখ্যা – ২, জুন ১৯৮৪

৯) রবীন্দ্রনাট্যে গানের ভূমিকা – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, গীতবিতান জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ (১ম) ১৯৬১

১০) রবীন্দ্রনাটকে গানের সুর – রক্তকরবীর গান- আলাপ থেকে বিস্তার – আলপনা রায়, প্যাপিরাস, মে ১৯৯২।

১১) গানের লীলার সেই কিনারে – সুধীর চক্রবর্তী, বাংলা নাটকের গান, রবীন্দ্রনাটকের গান, অরুণা, নববর্ষ, ১৩৯২

১২) রবীন্দ্রনাটকের গান- অশ্রুকুমার সিকদার,

১৩) রবীন্দ্রনাথের দুঃখের গান- জয়ন্তী ভট্টাচার্য, করুণা প্রকাশনী, ১৩৯২

১৪) রবীন্দ্রগল্পে গান- কণিকা বন্দোপাধ্যায়, গল্পগুচ্ছ (বিশেষ রবীন্দ্র সংকলন), বর্ষ-৬, সংখ্যা – ২, গ্রীষ্ম ১৩৯০।

১৫) ভ্রষ্টলগ্নের গান – সোমেন্দ্রনাথ বসু, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৯০ সালে (জোড়াসাঁকোতে অনুষ্ঠিত বৈতানিকের একটি অনুষ্ঠান থেকে গৃহীত)।

১৬) রবীন্দ্রনাথের গান- সুকুমার সেন, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ৮মে, ১৯৯৮

১৭) বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত- অরুণকুমার বসু, দে‌’জ, আগষ্ট, ১৯৯৪ (২য় সং)

১৮) রবীন্দ্রসংগীত – শান্তিদেব ঘোষ, বিশ্বভারতী, ৭ই পৌষ, ১৩৪৯

১৯) গানের লীলার সেই কিনারে- সুধীর চক্রবর্তী, কবিতা আর গানের আকাশঃ রবীন্দ্রনাথ, অরুণা, নববর্ষ, ১৩৯২

২০) এ আমির আবরণ – শঙ্খ ঘোষ, ধরেছি ছন্দবন্ধনে, প্যাপিরাস, ১৯৮০

২১) বাণী ও বীণা – প্রবোধচন্দ্র সেন, গীতবিতান, রবীন্দ্র জন্ম জয়ন্তী সংকলন, অক্টোবর, ১৯৬১

২২) কড়ি ও কোমল – শতবর্ষের গান – হর্ষ দত্ত, দেশ সাহিত্যসংখ্যা, ১৩৯৩

২৩) আধুনিক কবিতার গীতিরূপ ও রবীন্দ্রসংগীতের কয়েকটি দিক- ঋষিণ মিত্র, অতিথি, বর্ষ-১২, ১৩৮৭।   

Navigating the Interplay of Composition and Instrumentation in Music, Bridging Tradition and Modernity

Dr. Sudipendranath Chatterjee, Guest Lecturer, Department of Instrumental Music, Rabindra Bharati University

Abstract:

This study delves into the intricate relationship between composition and instrumentation in music, exploring the dynamic interplay of tradition and modernity. Through a comprehensive examination of historical precedents and contemporary innovations, we unravel the evolving landscape of musical creation and the diverse roles played by instruments in shaping sonic expressions. The investigation traces the roots of traditional compositional techniques while scrutinizing the transformative impact of modern technologies and unconventional instrumentation. By analyzing key works and trends, we seek to understand how composers navigate the delicate balance between honouring classical conventions and embracing avant-garde possibilities. Ultimately, this research illuminates the evolving dialogue between composition and instrumentation, shedding light on the continuum that links the rich tapestry of musical heritage to the cutting-edge frontiers of contemporary sonic exploration.

সংগীতে সৃজন পদ্ধতি ও যন্ত্রানুসঙ্গ প্রয়োগ : ঐতিহ্য ও আধুনিকতা

ড. সুদীপেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি, অতিথি শিক্ষক, যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

Indian girl Sucheta Satish wins Global Child Prodigy Award 2020

পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে,

যেন   সিন্ধুপারের পাখি তারা,   যা য়   যা য়   যায় চলে॥

   আলোছায়ার সুরে   অনেক কালের সে কোন্‌ দূরে

    ডাকে   আ য়   আ য়   আয় ব’লে॥১

সংগীতে যন্ত্রানুসঙ্গ বা ” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো ভাবনা। এই ভাবনার সঙ্গে যখন নানান সুরে ছন্দে বাদ্যযন্ত্রগুলি সেই কাহিনীর মূল সুরটিকে বিভিন্ন ব্যঞ্জনার মাধ্যমে প্রকাশ করতে থাকে। সেই আবহে প্রকাশিত হয় এক ভিন্ন স্বতন্ত্র  ‘ মুড’ বা  তার নিজস্ব অভিব্যাক্তি। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে  যে ‘ থিম সংগীতে’ মূল সুরটি নির্ভর করে কাহিনী বা স্ক্রিপ্টের উপর এরই সঙ্গে  কাহিনীর স্থান কাল পাত্র হিসাবে সুরের কাঠামোটির গঠন ও নির্মাণ হয়। যেমন পাহাড় অঞ্চলের কাহিনীর ক্ষেত্রে ধামসা, মাদল, ঢোল, টুমদা,তামাক,দোতারা, সারিন্দা, বাঁশি, বানাম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় সেই স্থান মাহাত্যটিকে ফুটিয়ে তুলতে। আবার শহুরে জীবনের পথচলা ও তার সুরটিকে বাঁধা হয়, Violin ,Viola,Cello, Base, Piano accordian,Piano,Guitar, Tabla,Congo, Bongo, to Drums এমন বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্রতে শহুরে চাকচিক্যকে মেলে ধরে। কাহিনীর প্রেক্ষাপট ও যন্ত্রগুলির নির্বাচন এখানে গুরত্বপূর্ণ। থিম সংগীতের একটি স্বতন্ত্র দিক হলো কাহিনীর চরিত্র। এখানে চরিত্রটিকে একটি বিশেষ সুরের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়ে থাকে।মূল চরিত্রটি একটি সুরের মধ্যে যেন বাঁধা হয়ে যান।

আমাদের দেশের স্বনামধন্য চিত্র-পরিচালক এবং সংগীত পরিচালকেরা তাঁদের মুন্সীআনায় এর অসামান্য নিদর্শন রেখে গেছেন। যেমন মহানায়ক উত্তম কুমারের রুপালি পর্দায় প্রবেশ মাত্রই হারানো সুরের সেই স্মৃতি মধুর তুমি যে আমার সুরটি বেজে ওঠে। সংগীত পরিচালক ভি বালসারার আঙ্গুল স্পর্শে একটি সময়কে যেনো বেঁধে দিয়ে গেছেন।

চিত্র পরিচালক, সংগীত পরিচালক শ্রী সত্যজিৎ রায় অভিনেতা উৎপল দত্তের জন্য একটা জটিল সুর বেঁধে দিয়েছিলেন। শ্রীউৎপল এর জটিল চরিত্রর ফ্রেসিংটা সুরের মাধ্যমেই মনে করিয়ে দেয়। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ এর টাইটেল মিউজিকে যে ভারতবর্ষের নানা জাতিবর্ণ কে একটা সার্কাস্টিক কমেডির  মধ্যে তুলে ধরেছেন পরিচালক। আসলে সংগীত পরিচালক টাইটেল মিউজিক এর মধ্য দিয়েই সমগ্র কাহিনীর বক্তব্য টিকে তুলে ধরেন আর থিম সংগীতটি তার মূল নির্যাস। কাহিনীর স্ক্রিপ্ট মধ্যে যেমন নায়ক, নায়িকা অনুষঙ্গ শিল্পী অভিনেতাদের ভূমিকা পালন হয়ে থাকে তেমনি যন্ত্রানুসঙ্গ প্রয়োগের মাধ্যমে মূলসুর বা মেলডির সঙ্গে আসে ‘কাউন্টার মেলোডি’ বা ‘অব্লিগেট লাইনস’ ইত্যাদি, ‘ফার্স্ট ভায়োলিন’, ‘সেকেন্ড ভায়োলিন’, ‘চেলো ‘, বেস  এই ভাবেই আরো তালবাদ্যের বিভিন্ন লাইনগুলি তৈরি হয় মুডকে ফুটিয়ে তোলার তাগিদে। প্রসঙ্গত  কাহিনীর পরিস্থিতিতে একটি গ্রাম্য নারী যখন শহরের রাস্তায় উপস্থিত হয়  সেইমত সংগীত পরিচালক তখন গ্রাম্য সুরের ধারাটি বদলে শহুরে জমজমাটে ভরপুর করেন। তাই মেঠো সুরের ভঙ্গিমাটিও বদল করে শহুরে করতে হয় ।

যন্ত্রের কথা নেই তবে যেটি আছে সেটি হল ভাব! আর এই ভাবনাকেই আশ্রয় করে যে কথা মুখে বলা যায় না তা প্রকাশিত হয় যন্ত্রে একজন যন্ত্র ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে। বাস্তবিক জীবনে একজন স্বাভাবিক মানুষ যেমন বাজার করে আনে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংসারে তাগিদে তেমনি একটি ‘মুখ ‘ বা বোবা-লোক  তার নানা অভিব্যক্তি দিয়ে তার বাজার কার্যটি সম্পন্ন করে। চলচ্চিত্রে সংগীতের তাগিদে বাদ্যযন্ত্র গুলিও তার অভিব্যক্তি ও ভাবনাগুলিকে সুরের মাধ্যমে কাহিনী ও চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলে। থিম সংগীতের মধ্যে একটি কাল্পনিক চরিত্র রূপ থেকে অরূপে রূপান্তরিত হয়। নানান শব্দের সুরের ব্যঞ্জনায় ভরিয়ে তোলে তার আবেগ। চরিত্রের মধ্যে সুরটি এমনভাবে তার ডানা বিস্তার করে যে দর্শক শ্রোতা দর্শনে ও শ্রবণে চোখে আসে জল এবং এই নাটকীয়তার মধ্যে দিয়েই এক আবেগের জন্ম হয়।

আধুনিককালে সময় ব্যস্ততা পরিবেশের অভাবে ভাবনাগুলিও এককে রূপান্তরিত হয়েছে! ডিজিটালাইজেশনের যুগে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, কম্পিউটার বিভিন্ন মাধ্যম যেমন বাণিজ্যিক সফলতা এনে দিয়েছে, ফলে আজ অনেক সুবিধা এবং অনেক কিছু আমাদের হাতের নাগালে ।একটি মুঠোফোন বা চলমান যন্ত্রেই আমরা বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন পেয়ে থাকি কিন্তু সেকালের শিল্প সৃষ্টিতে সুরের ব্যাঞ্জণায় এমন কিছু নির্মাণ কৌশল ছিল যা চলচ্চিত্র তথা চলচ্চিত্র সংগীত জগতে আজও অধরা ।

এইভাবেই চলচ্চিত্র জগতের সুরের কাঠামোটি যে যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে বহমান  সেই স্রোতের উৎস তার নির্মাণ কৌশল। কোন সুরটির বিপরীত কি সুর যাবে যা কখনোই বেসুর হবে না বরং সৃষ্টি করবে তার ঐকতান।

 সত্যজিৎ তার ছবিতে রবীন্দ্রনাথের পুরো গান ব্যবহার করেছেন খুব সীমিত জায়গায় কিন্তু সেখানেই গোটা গানকে ব্যবহার করেছেন যা হয়ে উঠেছে সিকোয়েন্স ও চারিত্রিক ভাব বিন্যাসের অমোঘ উপকরণ বহু ছবিতেই যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত খন্ডাংশ ব্যবহার করেছেন তেমনি বহু ছবির মুডকে ধরিয়ে দেবার জন্য নেপথ্যে যন্ত্রণানুসঙ্গে রবীন্দ্র সংগীতের সুর ব্যবহার করেছেন। অপুর সংসার ছবিতে আমরা অপুকে বাঁশি বাজাতে দেখেছি। এ নেপথে বাঁশিতে শোনা গেছে।

” আমার সোনার বাংলা” সুরটি। চারুলতার মতো ‘ঘরে বাইরে’ ছবির থিম মিউজিক হিসেবে সত্যজিৎ ‘পুজা ‘ পর্বের অনবদ্য রচনা “একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে” গানের সুরকে ব্যবহার করেছেন। ঋত্বিকের ছবি আমাদের এক ভিন্ন শিল্পরসের সন্ধান দেয়। ঋত্বিকের ছবির চড়া সুর আর আবেগ সমৃদ্ধ দৃশ্য বিন্যাসে রবীন্দ্রনাথের গান আরো এক ব্যাপ্তি তে স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছায়াছবিতে হৃদয়বিদারকভাবে প্রয়োগ করেছেন “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে” রবীন্দ্রনাথ যে অনুসঙ্গে গানটি লিখেছিলেন ঋত্বিক সেই জায়গা থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যঞ্জনাতে এটিকে ব্যবহার করেছেন। বাজে করুন সুরে গানের শেষ কটি চরণ “এ মম পান্থ চিত চঞ্চল/ জানিনা কি উদ্দেশ্যে/… ইত্যাদি প্রয়োগ সম্পর্কে স্বয়ং বিদেশী সমালোচককে বলেছিলেন- It is very ornate very lonely song that also lately suited the mood. It is not that the words actually reflects her situation – they are not important here – it is the tune”২

চলচ্চিত্র সংগীতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিং’ গুলি হয় স্বতন্ত্র, ঠিক নিয়মানুগতিক পদ্ধতি মেনে শিল্প শৈলী গুলি তৈরি হয় না। এ প্রসঙ্গে শ্রী সত্যজিৎ নির্মিত ‘জয় বাবা ফেলুনাথ ‘চলচ্চিত্রে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে ছিলেন তবলিয়া শ্রী রাধাকান্ত নন্দী, সময় ওভাবে ওর  বাজনাটি তখন রেকর্ড করা যায়নি। যদিও রাধাকান্ত প্রতিদিনই আসেন,  বিষয়টি সত্যজিৎ এর গোচরে আসতে রাধাকান্তকে বিশেষ বাজাতে না বলে ফ্লোরে জনৈক মিউজিসিয়ানের ডুবকি দিয়ে কেবল পাঁচ মিনিট বাজাতে বলেন, একজন প্রথিতযশা তবলিয়া কে এমন একটি বাজনা বাজাতে দেখে সেদিন ফ্লোরে অন্যান্য কলা কুশলীরাও অবাক হয়ে যান। আসলে সেদিন হয়েছিল এক অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি ! সিনেমায় অভিনেতা কামু মুখার্জির জাগলিং  দৃশ্যায়নে সত্যজিৎ ডুবকি টি ব্যবহার করেছিলেন ঠিক এমন ভাবেই বোধহয় ইতিহাস রচনা হয়।৩

বর্তমান সময়ের যে সব সংগীত-পরিচালক কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রী দেবজ্যোতি মিশ্র, উপল চক্রবর্তী, শ্রী অনুপম  প্রমুখ। পুরাতন এবং নুতন সংগীতায়োজন পদ্ধতির মধ্যে যেমন ব্যবধান আছে তেমনি কখনো অ্যাকাউস্টিক বাদ্যযন্ত্র নিয়েও  কাজ হচ্ছে । অর্কেস্ট্রাশন করতে ভায়োলিন, ভিওলা,চেলো ডবল বেস্ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আজও রেকর্ডিং হয়। 

আবার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে  VST Library, Sound Lab প্রযুক্তিতে, Midi- keyboard এর মাধ্যমে নানান শব্দ বা টোন সংগ্রহ করা হয়। এমত ব্যবস্থায় বিদেশে বসে কোন সংগীত ব্যবস্থাপক সরোদ, সেতারের নানান শব্দ নিয়ে কাজ করে থাকেন। যদিও বেহালা বা বাঁশির feel বা আবেগ এর জন্য প্রয়োজন সমবাদ্য এবং সমযন্ত্রীর। আবার সিম্ফোনিক অ্যারেঞ্জমেন্ট বা ট্রাক রেকর্ডিং ক্ষেত্রে কোন ভায়োলিনের মাধ্যমে বিভিন্ন Layer বা  সুরের রেখাকে বিন্যস্ত করা হয়। যেমন মূল সুরটির সঙ্গে হারমোনি লাইন তৈরি করা হয়। আবার সফটওয়্যার মাধ্যমে ভায়োলিনের পঞ্চাশটির মত টোন তৈরি করা যেতে পারে। আগে যেমন বাদ্যযন্ত্রীদের  আঙ্গুলের টিপ বা পিচের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু আধুনিক কালের ‘পিচ কারেকশন সফটওয়্যার’ মাধ্যমে বাজনা চলাকালীন বাদকের শুটটি সংশোধিত হয়ে যাচ্ছে সফটওয়্যার প্রযুক্তি মাধ্যমে।

Dr. Sudipendra Nath Chatterjee

আবার ‘প্রসেসর রেকর্ড সিষ্টেম ‘ মাধ্যমে বাচিক মাধ্যমে ছন্দের নকশা তৈরি বা ‘কর্ড প্যাটার্ন ‘ বানিয়ে তার সঙ্গে বাদক সুর-বিহার করে থাকে। আর এমনি ভাবেই সময়ের সিঁড়ি বেয়ে অতীত থেকে বর্তমান সময়ের সাথে প্রযুক্তির হাতে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন দৃশ্য ও শ্রাব্য মাধ্যমে (You tube, Media Sights..etc.) একালের সংগীত পরিচালক, শিল্পীরা নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন। রবি ঠাকুর মনে করতেন যে শিল্প সৃষ্টির মধ্যে সত্যই কোনো রসদ আছে সেটি মানুষের মধ্যে রয়ে যাবে, আর বাকি টা মহাকালের গর্ভে লীন হবে। সুতরাং সংগীতসৃষ্টির মধ্যে যে নান্দনিক অনুভূতি, বিষাদ-বিপর্যয় – হাহাকার যখন শিল্পীর গভীর দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে- ভাষায় সুরে ছন্দে তার প্রকাশও হয় অভিনব। আজকের সংগীত ও তার সৃজন পদ্ধতি ও বিভিন্ন ধারার যন্ত্রানুসঙ্গ প্রয়োগের যে নিত্য নতুন পরিকল্পনা যেমন আধুনিক সেই সঙ্গে কতদূর ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে যাবে সেটি আগামী দিনের  সংগীত সমালোচক শ্রোতাই তার মূল্যায়ন করবে। এমনি ভাবেই সময়ের ধারাপথকে অনুসরণ করে শিল্প স্রষ্টার চিন্তনে-মননে তাঁর কল্পনার তারগুলি নব-নব ছন্দে বেজে উঠে। কবির ভাষায়..

মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি  কোন নব চঞ্চল ছন্দে।

 মম  অন্তর কম্পিত আজি নিখিলের হৃদয়স্পন্দে।। 

তথ্য সুত্র  

১.পূর্ণ চাঁদের মায়ায় : প্রকৃতি পর্যায়, কবিতা রবীন্দ্রনাথ

২.The Inner Eye; Andrew Robinson, Page 132

৩. সাক্ষাৎকার ২০০৯; দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়,বেহালাবাদক, সংগীত ব্যবস্থাপক

৪. মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি – প্রকৃতি পর্যায়, কবিতা,প্রথম সংস্করণ ১৯১৯ )