Month: July 2021
Humanistic Philosophy of Lalon and Tagore Song
Dr. Srabani Sen, Associate Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College, Tarakeswar, Hooghly, e-mail-srabanisn1@gmail.com Mobile no- 6290242709
Dr. Srabani Sen
Assistant Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College, Tarakeswar, Hooghly
e-mail-srabanisn1@gmail.com Mobile no- 6290242709
Baul is a secular sect ( Lokayata Darsana). Baul the popular cultural way of life, is mainly dependent upon songs which are written by Lalon also known as Lalongiti. Lalon Fakir is the main pioneer and the greatest
spokesperson of the Baul tradition. Baul songs reflect the Baul philosophy of Dehototto. Lalon’s philosophy of humanity rejects all distinctions of caste, class and creed and takes a stand against religious conflicts and racism. They have no social and religious hierarchy in their tradition. They always keep themselves engaged in searching for manera manusa. Rabindranath Tagore’s intimate involvement with Bauls, their philosophy and their songs. Their relationship with Bauls began when Tagore was introduced to their songs during his middle youth at Shelaidaho. Rabindranath used the Baul tunes to create a variety of songs. His association with Baul’s songs and Baul’s way of life became deeper and deeper with time, the Baul- world gradually emerged as a powerful metaphor which served him as a model for, more perfect form of human community.
রবীন্দ্রনাথের বাউল দর্শন ও সঙ্গীত
ড.শ্রাবণী সেন
বাউল বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ। ঐতিহাসিকভাবে এবং তত্ত্বগতভাবে বাংলার বাউল সাধনা উপনিষদ, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব এবং ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারার সাথে যুক্ত। বাউলের বাণী ও সুর একান্তই বাংলার নিজস্ব সম্পদ। ‘বাউল’ শব্দটি প্রথম উচ্চারিত হয় শ্রীচৈতন্যদেবের মুখে।’বাতুল’ শব্দ থেকে বাউল শব্দটির উদ্ভব। আবার অনেকের মতে বাউল এসেছে ব্যাকুল শব্দ থেকে। কেউ কেউ বলেন বা অর্থে আত্ম এবং উল অর্থে সন্ধানী অর্থাৎ এই বাউল সাধকেরা হলেন আত্মানুসন্ধানী উণ্মত্ত সাধক।
বস্তুত বাংলায় বাউলের কাল ঊনিশ শতক। প্রখ্যাত বাউল শিরোমণি লালন শাহ, পূর্ববাংলা আর পশ্চিমবাংলার রাঢ় অঞ্চলের কিছু বাউলের দ্বারা হৃদ্য এই বাউলিয়া সাহিত্য জগৎ। বস্তুত বাঙালি মানসের প্রকাশ ক্ষেত্রের দুটি জগৎ – বৈষ্ণব পদাবলী আর বাউল পদাবলী। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত কবিতায় যার উল্লেখ পাওয়া যায় –
কীর্তনে আর বাউলের গানে
আমরা দিয়েছি খুলি
মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে
দ্বার ছিল যতগুলি।
বাউল লোকজীবন থেকে উৎসারিত। এর বাণী ও সুর এই জীবনেরই ফসল। গভীর বাণীকে সরল ভাষায় বলা হয়- আর গ্রামীণ সুরে ফুটে উঠে তার গীতরূপ। রবীন্দ্রনাথই বস্তুত পরিশীলিত সাহিত্য – জগতে বাউলকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি দেন গান সংগ্রহ করে, নিজের সংগীত সষ্টিতে তার ঋণ গ্রহণ করে এবং সর্বোপরি বিশ্বের দরবারে বাউলকে পরিচিত করে। কবি সাধক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বসিয়েছেন বাউলের পাশে –
কবি আমি ওদের দলে
আমি বাত্য আমি মন্ত্রহীন।
রবীন্দ্রনাথ শুধু বাউলকে বিশ্বের দরবারে উপস্হিত করে কিংবা নিজেকে বাউলের দলভু্ক্তই করেন নি, আপন সৃষ্টির ক্ষেত্রে সারস্বত ঋণ গ্রহণ করেছেন বাউলের কাছে। গান সংগ্রহ, প্রকাশ এবং অনুবাদ কর্মের বাইরে নিজের সৃষ্টির জগতে বাউলকে বসিয়েছেন বিশেষ আসনে।
বাউল প্রেমের সাধক। তাঁদের প্রেম মানব আশ্রয়ী। মানুষের মধ্যেই তারা মনের মানুষ,অধরা মানুষ,সহজ মানুষ,রসের মানুষ,সোনার মানুষ, ভাবের মানুষ, কিংবা এদেরই প্রতীক অচিন পাখীকে খোঁজেন। বাউলের এই খোঁজা চলে মানবদেহের মধ্যেই এবং তার প্রাপ্তিতেই বাউলের সিদ্ধি।
রবীন্দ্রনাথ বাউল সম্প্রদায়ের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্র বাউল চিন্তা ও মরমী ভাবনা তাঁর জীবনীচেতনার অন্তর্গত বিষয় হিসেবে বিবেচিত। রবীন্দ্রভাবনা, চিন্তা ও আলোচনায় বাউল প্রসঙ্গ নানা ভাবে এসেছে। মূলত শিলাইদহের বাউল সম্প্রদায়ের প্রেরণা ও প্রভাবেই তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন ‘রবীন্দ্রবাউলে’। তাঁর শিল্পকর্ম পোষাক পরিচ্ছদ, ধর্মদর্শন চিন্তায় বাউল ভাবের পরিচয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় । অঞ্চল বিশেষে বাউল সম্প্রদায়ের ভাবধারা, তাদের আধার, তাদের গানকে তিনি তার প্রবন্ধে, নাটকে, নৃত্যে ও সর্বোপরি দার্শনিকতায় বার বার বিভিন্নভাবে ধরার চেষ্টা করেছেন।
বাউলের দর্শন ও ধর্মচিন্তার সঙ্গে গুরুদেবের অন্তরাত্মার যোগ ঘটেছিল এবং গুরুদেব তাঁর জীবনদর্শন ও সৃষ্টির সঙ্গে বাউলদের ধর্মসাধনা ও গানকে যুক্ত করেছিলেন। বাউলের মত রবীন্দ্রনাথও বাহ্যিক সাম্প্রদায়িক ধর্মকে অগ্রাহ্য করে অন্তরের ধর্মকেই আপন বলে মনে করতেন। বাউলের ধর্ম নিজেকে জানার ধর্ম,সহজ মানুষেরর ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – আমার ধর্ম কী, তা যে আজও আমি সম্পূ্র্ণ এবং স্পষ্ট করে জানি এমন কথা বলতে পারিনে – অনুশাসন আকারে তত্ত্ব আকারে কোন পুঁথিতে লেখা ধর্ম সে তো নয়। অন্যভাবে এই কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় লালনের গানে –
সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন
লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান
শিলাইদহে বসবাসকালে গুরুদেব উপলব্ধি করেন এই বাউলরা এমন একজন মানুষের কথা চিন্তা করেন, যিনি গোপনে প্রতি মানুষের অন্তরে বিরাজমান এবং উপলব্ধি করেন উপনিষদের মানুষ, যিনি নিরাকার এবং সর্বমানবের অন্তরে বিরাজিত সেইরূপ এক মানুষের সন্ধানে এরাঁ মগ্ন, যাকে প্রেমের দ্বারা, ভালবাসার ঐকান্তিক আকাঙ্খার দ্বারা অনুভব করে গভীর এক ঐশ্বরিক আনন্দে মগ্ন হওয়া যায়। এই কারণে গুরুদেবের পক্ষে তাঁর অন্তরের অন্তর্যামী বা জীবনদেবতাকে, নিরাসক্ত প্রেমের আবেগে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে কোন বাধা থাকে না। বাউলদের ধর্মচিন্তা দেশবাসীকে তাঁর গানে, গদ্যে ও পদ্যের মাধ্যমে তিনি রূপ দিতে উৎসাহিত হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের বাউল দর্শন ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে দেখা যায় আপন জনের মত তার অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছেন, আত্মীয়তা স্হাপন করে একাত্ম হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রাণধর্মের প্রেরণা আর বাউলের প্রেরণার উৎস অভিন্ন হলেও বাউলের মনের মানুষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতার ঐক্য সহজেই লক্ষ্য করা যায়। বাউলদের যা ‘মনের মানুষ’ গুরুদেবের ‘জীবন দেবতা’ বা অন্তর্যামী তাই। গুরুদেব বলেছেন “অন্তরতর হৃদয়াত্মা”,উপনিষদের এইবাণী এদের মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলুম আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল। ‘মনের মানুষ’ বাউলদের অন্তরে বাস করে যেভাবে লুকোচুরি খেলা খেলে চলেছেন, গুরুদেবের ‘জীবন দেবতা’ বা অন্তর্যামীও তাঁর সঙ্গে সেই ভাবেই লুকোচুরি খেলেছেন। গুরুদেবের পূজা, প্রেম ও প্রকৃতি পর্যায়ের গানেও তাই কোন একজনকে না-জানার, না-পাবার বেদনার প্রকাশিত হয়েছে।
বাউলের কাছে দেহই দেবালয়, কায়া সাধনাই সারকথা। সাধারণ সহজ অথচ প্রতীকী ভাবনায় সেই তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। লালন শাহের বিখ্যাত গান- খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়। অচিন পাখী – দেহ ও আত্মার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা অন্তর্যামী, অরূপ রতনকেও সেভাবে খোঁজা চলছে সারাজীবন –
তোমার খোঁজা শেষ হবে না মোর
তোমার অন্ত নাই গো। …..
লালনের পর গগন হরকরারার দ্বারা রবীন্দ্রনাথ সবথেকে বেশী অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখীর’ মতই রবীন্দ্র বাউলকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সহিত আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ ও আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি; এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন একসময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।’ শিলাইদহের বাউল গানের উদাহরণ –
“কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।”
রবীন্দ্রনাথ ক্রমে বাউল তত্ত্বের ভিতরে প্রবেশ করেছেন। বাউলদের গোপন সাধনক্রিয়া বা আচার অনুষ্ঠানে তাঁর আগ্রহ ছিল না। বাউলের গান তাদের সাধনার বড় অঙ্গ। এই গানের ভিতর দিয়ে তাদের গভীর অধ্যাত্মজিজ্ঞাসার প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ বাউল-ধর্মকে ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখেছেন, সেই সঙ্গে বাউলতত্ত্বকে তাঁর জীবনদর্শনের সমর্থনরূপেও গ্রহণ করেছেন।এই রবীন্দ্র বাউলতত্ত্বের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচিতি সার্বিকভাবে তাঁর সঙ্গীত সত্ত্বার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিছু ‘বাউল’ গান রচনা করেছেন। সেগুলো বাউলের অনুকরণ নয় বরং বলা যায় তা ’রবীন্দ্রবাউলের’ রচনা -ভাবে ও রসে তা স্বতন্ত্র। স্বদেশী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ অনেক গান রচনা করেছিলেন যার সুর বাউলের থেকে নেওয়া। এই গানগুলো স্বদেশ প্রেমের উদ্দীপনামূলক গান।
শিলাইদহের বাউলদের গানের বাণী ও ভাবধারা রবীন্দ্রনাথের বহু গানে প্রতিফলিত হয়েছে-
মূল বাউল গান –
১)আমি কোথায় পাব তারে।
২)কথা কয় দেখা দেয় না
৩) খাঁচার ভিতর অচিন পাখী
৪)মনের মধ্যে মনের মানুষ করো অন্বেষণ
রবীন্দ্রনাথের গান –
১) আমি তারেই খুঁজে বেড়াই
২) আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
৩)আমার মন যখন জাগলি নারে
৪)তোর গোপন প্রাণে একলা মানুষ যে
বাউল সাধনার মূল দর্শন গুরুদেব নিজের জীবনদর্শন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বলা যায় রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতই একজন ঋষি ও বাউল সাধক।
তথ্যসূত্র
১। অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়-বাংলা সাহিত্যের ।ইতিবৃত্ত
২। শান্তিদেব ঘোষ- রবীন্দ্রসঙ্গীত।
৩। সুকুমার সেন -বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস(৩য় খণ্ড)।
৪। শ্রী অমল মুখোপাধ্যায়- রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিক্রমা।
৫। সুভাষ চধুরী- বীন্দ্রনাথের গান ও অন্যান্যর
৬। লীনা চাকী- রবীন্দ্রনাথ ও বাউল।
Contents
Volume III. No. IV. : July-August 2021
Angashuddhi : Bharatnatyam Dance -NrityaChuramani Rahul Dev Mondal Page 1-4
রাঢ় বাংলার লোকসংগীতে আধুনিকতা-দেবাশিস মণ্ডল Page 9-14
শিশুশিক্ষার উপকরণে ছন্দ : বিদ্যাসাগর ও আধুনিক প্রজন্ম Page 15-16
চিত্তপটে নাট্যভাবনা-কৃষ্ণপদ দাস Page 17-29
ঠাকুরবাড়ির দুই সংগীত বিদুষী : প্রতিভা ও ইন্দিরা– ড. জয়ন্তী মণ্ডল Page 30-35
ইউরোপের ঐতিহ্য, শিক্ষা ও আমাদের ৫১ দিন-শক্তি মণ্ডল ও মায়া মণ্ডল Page 36-45
রবীন্দ্রনাথের বাউল দর্শন ও সঙ্গীত-ড. শ্রাবণী সেন
Angashuddhi : Bharatnatyam Dance
Author : NrityaChuramani Prof. Rahul Dev Mondal ( Assistant Professor , Rabindra Bharati University, Department of Dance )
Bharatanatyam dancer is said to possess Angashudhi. Anga meaning body parts, and shudhi means perfection or purity. The Natyashastra has shlokas describing how to perform all the above movement.
Anagalakshana means the way of moving the body parts. There are 5 different types of Angalakshana.
Before we get into this let’s understand how the entire body is defined and categorized.
The entire body is divided into three like Anga, Pratyanga and Upanga. The pratyanga and upanagas should move along with the Angas. :
1.Anga : : “This includes Shiras (Head), Hastas(two palms), Vakshas (chest), Parshwa (the two sides), Kati (two sides of the waist) and the Padas (legs)”
The Sloka
Anganyatra shirohastou
Vaksha parshwa kateetatou
Paadaviti shaduktaani
Greevamapyaparae jaguhu
2
2.Pratyanga : : “This includes Skanda (Shoulders), Bahu (Arms), Prshtam (back), Udaram (stomach),Uru ( thighs) and Janks (shanks)”
The Sloka
Pratyangaani twathaskandou
Baho prushtam tadhodaram
Ooroo janghae shadityahuraparae
Manibhandakou Janoonikooraparamiti
Trayamapyathikam jaguhu
3. Upanga : “This includes the Drishti (Eyes), Bhru (Eye brows), Puta (Eye lids), Tara (Eye balls), Kapola (Cheeks), Nasi (Nose), Hanu (Jaws), Adhara (Lower lip), Dasana (Teeth), Jithva (Tongue), Chubukam (Chin) and Vadanam (Face)”
The Sloka
Dhrishti bhrooputatarascha
Kapolou nasikakanuhu
Adharodashanaa jihwa
Chubukam vadanam tatha
Upangaani dwadashita
Anyanyan gani santicha
Paarshnee gulbauta thangulya
Karayoha paadayostale
3
Now let us see the various types of Angalakshanas
Shirobheda
Drishtibheda
Greevabheda
Paadabheda
Gatibheda
Each of these are again sub divided and well defined. Here we go into the details
Shirobheda : Shiro means head and thus it self defines the term as “ bhedas or movements of the head”.
Samam : Head held straight
Udhvahitam : Head lifted up
Adhomukam : Head held down
Alolitam : Rotate
Dhutam : Shaking side to side as if to say NO
Kampitam : Nodding up and down as if to say YES
Paravrittam : Looking away to the side as if to ingnore
Utkshiptam : Turn to the side and lift up as if to command or request
Parivahitam : Shaking the head swiftly left to right
Besides these nine types of shirobheda which are very commonly known, there are a few other shirobhedas which are known to be included in the Natyashastra. They are Akampitam (moving head slowly up and down), Vidhutam (nodding fastly), Parilolitam (head moving to all sides showing the power of intoxication, possession by an evil spirit, drowsiness etc) ……
4
2. Dhrishtibheda : ‘Drishti’ means eyes and thus the term explains itself as ‘bhedas or movements of eyes’ as described in Abhinaya Darpana.
• Samam – look straight
• Alokitam – circular movement
• Sachi – look to either sides without turning the head
• Pralokitam – look to both sides turning the head
• Nimeelithe – look down
• Ullokitam – look up
• Anuvrittam – look up and down
• Avalokitam – look deep down
As per Natyashastra there are three categories of Drishtibheda 1) for expressing the eight rasa 2) for expressing sthayi bhavas and 3) for expressing sanchaari bhavas. First and second categories have 8 varieties each and the third one has 20 varieties thus making altogether 36 drishtibhedas. It also describes their applications (viniyogas).
5
3. Greevabheda : ‘Greeva’ means neck and hence the term means ‘bhedas or movements of neck’. The Natyashastra describes seven variations like Sama, Nata, Unnata, Tryasra, Rechita, Kunchita, Vahita and Vivarta Whereas, the below mentioned are the four variations of Greeva bhedas as described in Abhinaya Darpana:
• Sundareescha – moving the neck to either sides (Also known as ‘atami’)
• Thirascheeva – moving the neck to form 8
• Parivarthitha – move the neck in a semi circle
• Prakampita – move the neck forward and backward like a rooster
4. Paadabheda : As the word says it is the ‘bhedas or movements of the paada or legs’. They are basically four types and each of which has again various styles which are detailed below:
• Mandala – Standing position (10 types)
• Utplavana – Jumping (5 types)
• Bhramari – Circular movement (7 types)
• Paadachari – Walking (8 types)
Various ‘Mandala’ styles are the following:
• Sthanaka – Samam with ‘ardhachandra’ hasta on your waist
• Aayata – Araimandi position
• Aalitha – In Ayatam keep right foot 3 feet facing the side & shikara hasta on your left hand and katakhamukha on right
6
• Prenkhana – Left leg in Ayatam and right stretched to side on heels with khoorma hasta
• Preritha – Both legs a little far apart in ayatham with shikhara hasta on the left held at the chest and pataka on the right stretched up
• Pratyalitha – Opposite of Aalitha
• Swasthika – keep right leg (on the toes) across the left (flat)
• Motitha – Sit in muzhumandi, jump and place one knee down (hands in natyarambha posture)
• Samasuchi – Sit with toes and knees
• Paarswasuchi – Sit on toes and touch the ground with one knees to the side
Various ‘Utplavana’ styles are the following:
• Alaga – Hold shikhara hasta on the waist and jump
• Kartari – Hop on the toes with kartareemukha on the left behind the left leg and shikhara hasta on the right held upside down at the waist
• Ashvotplavana – Hop forward on one leg and bring the other leg together holding tripataka hasta on both hands
• Motita – Hop on toes with tripataka on both hands
7
• Krupalaga – Jump in such a way that the heels touch your back
Various ‘Bhramari’ styles are the following:
• Utplutabhramari – Jump and turn around from and back to Sthanaka Mandala
• Chakrabhramari – While dragging the legs on the floor turn around with tripataka on both hands
• Garudabhramari – From Paarswasuchi stretch one leg and turn around
• Ekapaadbhramari – Turn around while standing on one leg
• Kunchitabhramari – Jump and turn around while holding the legs up
• Aakaashabhramari – Jump , turn the legs apart and turn around
• Angabhramari – keep the feet 12 inch apart and turn around
Various ‘Paadaachari’ styles are the following:
• Chalanaachaari – Casual walking
• Chankramanachaari – Walking with the legs swaying to the sides
• Saranachaari – Walk with one feet dragged and bringing the other together without lifting the heels
• Veginichaari – Walk fast with alapadma and tripataka hasta alternately
8
• Kuttanachaari – Walk while tapping the feet hard on the floor
• Lunthithachaari – Stand in swastika mandala and perform kuttanachaari in the right leg
• Lolithachaari – Do kuttanachaari in one leg and walk slowly with the other one
• Vishwamachaari – Walk while the legs are twisted together
রাঢ় বাংলার লোকসংগীতে আধুনিকতা
দেবাশিস মন্ডল
বহুকাল আগেই বাংলায় নগরায়ণ শুরু হয়েছিল। সেসময় এই নগরায়ণে স্থানীয় মানুষদের ও দেশজ উপকরণের প্রাধান্য ছিল বেশি। ফলে লোক সংস্কৃতির উপকরণের বৈপরিত্য ঘটেনি। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের সাথে সাথে যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ ঘটে। শিল্পায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন সাধনের ফলে সারা বিশ্বে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে বাংলায় ইংরেজদের বানিজ্য ও ভারত শাসনের সুবাদে এদেশেও শিল্পের আগমন হয়। প্রযুক্তির ও শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে লোকশিল্পের নানা উপকরণ তৈরিতেও আধুনিক প্রযুক্তির ছাপ লক্ষ্য করা যায়। মোটর চালিত ইঞ্জিন, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, ছাপাখানা, নানা ধরণের কল কারখানার সাথে সাথে বানিজ্যিক প্রয়োজনে এবং যাতায়াতের সুবিধার কারনে কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলায় নগরায়নের বিকাশ হতে থাকে। প্রথমাবস্থায় এই নগরায়ণের গতি ছিল কম, ক্রমে তা একটু একটু করে বাড়তে থাকে।
তখনও বাংলার পথে প্রান্তরে ভূস্বামীদের দাপট অব্যাহত ছিল। কলকাতার সন্নিহিত কিছু জায়গায় শহুরে হওয়া নবজাগরণের ঢেউ এখানে ওখানে তরঙ্গ তুলেছিল। কিন্তু তার গতি ছিল মন্থর। তাই বাংলার পথে প্রান্তরে প্রতিদিন শোনাযেত বাউল,ভাটিয়ালি। বিভিন্ন আসরে কবিগান,তরজা, খেউড়,আখড়াই, রামযাত্রা, রামায়ণ গানের আসর বসত। গানের সুরে বাংলার মাটির ঘ্রাণ পাগল করে তুলত সে যুগের মানুষদের। শত সহস্র মানুষ প্রাণ ভরে তার আনন্দ উপভোগ করত। বাংলায় হত বারো মাসে তেষট্টি পরব। উত্তর দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সর্বত্রই পৌষ সংক্রান্তির পিঠে পরবে আর নবান্নর গানে ঘর বার আকুল আনন্দে মেতে উঠত। লক্ষী এসে ভরে দিত গোলা সবার ঘরে ঘরে। মানুষের বিশ্বাসে জন্ম নিয়েছিল বিশ্বজননী দূর্গা, মা লক্ষী, সরস্বতী, কালী, জগদ্ধাত্রী, বাসন্তী, শীতলা। সর্বত্রই মায়েরা জগতকে আগলে রাখত। আর কাজ কর্মের মাঝে বার ব্রত,মেলা, নানা উত্সব আচার অনুষ্ঠানে ভরে উঠত সারা বাংলা। হাজার অভাব অভিযোগের মাঝেই দেব-দেবীর কাছে আবদার করা হত। শিব দূর্গা, রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষী-নারায়ণ, মাটির ঘরে, উঠোনে কুলুঙ্গিতে আসন পেতে বসত। নিজের মত করে, নিজের পরিজনের মত করে মায়ের কাছে দাবি করা হত ‘এসো মা’।
ধন সম্পদ সবার সমান ছিলনা, তবু একান্নবর্তী পরিবার ছিল। পরিবারের যেকোন ধর্মীয় কাজই ছোট-বড় উৎসবের আকার নিত। আর এইসব লোকাচারের সঙ্গে যোগ ছিল ছড়া, গান, ধর্ম-কর্ম, পরিচ্ছদ, নানা ধরনের খাবার, নিকানো উঠান, ঘরদোর। প্রতিদিন প্রতি রাতে সকালে সন্ধ্যায় নিয়ম করে ধূপ, ধুনো,দেওয়া প্রদীপ জ্বালানো, মনে মনে পূর্বপুরুষদের আর দেব দেবীদের স্মরণ করা।শাঁখ বাজিয়ে মঙ্গল কামনা। এরকম প্রতিদিনকার লোকাচারের সঙ্গে বার-ব্রত,পুজো অর্চনায় শত শত অনুষ্ঠানে দেবতাদের স্মরণ করা হত।
10
ভারতের নগরায়ণ তিন ধরনের। এক-শিল্পায়নের আগের নগরায়ণ। দুই-অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শিল্পায়নের যুগে নগরায়ণ। তিন-পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তভাবে অবাধ নগরায়ণ। প্রথম শ্রেণির নগরায়ণে গ্রাম বাংলায় নাগরিক জীবনে গ্রামীণ জীবনযাত্রার ও সাংস্কৃতিক ভাবনার বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি বহুদিন। দ্বিতীয় ধরনের নগরায়ণের সময় দূর দূরান্তের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফলে লোকসংগীতের ভালো ও মন্দ দুইই লক্ষ্য করা যায়। নতুন উপকরণ ও নতুন ভাবনার সঙ্গে লোকসংগীতের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। সমৃদ্ধ হয় সংগীত। এই যুগে ইংরেজ ও বিভিন্ন দেশের মিশনারিদের থেকে বাংলার মানুষ নানা ক্ষেত্রে বহুতর শিক্ষা ও নবচেতনায় উন্নীত হয়। লোকসাধারণের মধ্যেও তার প্রভাব পড়ে। নতুন যুগে বিজ্ঞান চেতনা, নবতর শিক্ষা সংস্কৃতির অসাধারণ পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। দূর হয়ে ওঠে নিকট। পর হয় আপন। ক্রমে অশিক্ষার অন্ধকার কমে যায়। দিক দিগন্তের আলো এসে পড়ে কলকাতা ও বাংলার অন্যান্য শহরে নগরে। শিল্প সংস্কৃতির মর্যাদা বাড়ে। বাংলা লোকসংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক সভ্যতার পরিচিতি ও সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বেতার তরঙ্গ, কলের গান, দূর দূরান্তের মানুষের সঙ্গে সুস্থ্য রুচিশীল সংগীতের মেল বন্ধন গড়ে তোলে। এর ফলে উন্নততর সংগীতের সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাংলা গানের সুবর্ণ যুগের সূচনা হয়, আর লোক সংগীতের জগতেও এই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। নতুন সুরের পরশে বিভিন্ন অঞ্চলে লোকসংগীতও প্রাণ পায়। বড়ো গানের জায়গায় ছোটগান আসর মাতিয়ে তোলে। বেতার তরঙ্গ প্রত্যন্ত অঞ্চলের আঞ্চলিক গীতি (ঝুমুর, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া,চটকা), পূজা পার্বণের গান (ভাদু, টুসু, গাজন, গম্ভীরা) ধর্মীয় সংগীত (জারি, আউল, বাউল, ফকিরি, ঘাটু, মুর্শিদা, আগমনী, বিজয়া), ব্যবহারিক সংগীত (বিয়ের গান, ধামাইল), কর্মসংগীত (ছাদ পেটা, ধান কাটা) ইত্যাদিকে পৌঁছে দেয় ঘরে ঘরে। একদা ‘ছোটোলোকের’ গান অভিজাতদের ঘরেও অমৃতের সন্ধান দেয়। তাই আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি ‘যেদিন বাংলার উপেক্ষিত লোকসাহিত্য বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে সেইদিন হইতে তাহারা এক অনাবিস্কৃত সৌন্দর্যময় লোকের সন্ধান পাইয়াছে’।[i] (দেব ১৯৯৩ )লোকসংগীতে নগরায়ণের সুফলের পাশাপাশি লোকসংগীতের অনুকরণে গান রচনা করে তাকেও লোকসংগীত বলে রেডিওতে গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রচার করা প্রকৃত লোকসংগীতের ক্ষতি করার সামিল হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথ সংগীত চিন্তা গ্রন্থে ‘বাউল-গান’ সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘অধিকাংশ আধুনিক বাউলের গানের অমূল্যতা চলে গেছে, তা চলতি হাতের সস্তা দামের জিনিস হয়ে পথে পথে বিকোচ্ছে. ……… এইজন্যে সাধারণত যে-সব বাউলের গান যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়, কী সাধনার কী সাহিত্যের দিক থেকে তার দাম বেশি নয়।’[ii]
নবজাগরণের ঊষা লগ্নে বাংলা গানে যে নতুনের সূচনা হয়েছিল তা ক্রমে আরো উন্নত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নগরায়ণের ব্যপকতা গ্রাম ও গ্রামের সংস্কৃতিকে একটু একটু করে পরিবর্তন করতে থাকে। একসময় আধুনিকতা ও স্বাদেশিকতা লোকসংস্কৃতিকে মর্যাদার আসনে স্থান দিয়েছে। আবার আধুনিকতার আর এক পর্যায়ে লোকসংস্কৃতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্তও তবে বাংলার সর্বত্র তার ক্ষতিকর প্রভাব একইভাবে দেখা যায়নি। চিত্তরঞ্জন দেব লিখেছেন ‘নগরীর আলোক রশ্মির গণ্ডী ছাড়িয়ে নদী, নালা, খাল, বিল, ঝোপ-ঝাড়ে ঘেরা পূর্ববাংলার পল্লী অঞ্চল বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বুকের উপর ঘটে গেল কতনা বিচিত্র ব্যাপার, কিন্তু এই পরিবর্তনে কোন ছোঁয়াটি লাগলনা সেইসব জায়গায় এবং সেইসব জায়গার অধিবাসীদের মনে।
11
এককথায় নিতান্ত পল্লীবাসী তারা। শহরের আবহাওয়ায় তাদের নিজস্ব পল্লীগত প্রাণ এখনো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়নি। তাই তারা এখনও সারা বছর ধরে গান বাঁধে এবং সেগুলি গায় নিজেদের গড়া আসরের মাঝে’।[iii] (দেব, পৃষ্ঠা ১) স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও আধুনিক সভ্যতার বিকাশ ঘটলেও সনাতন লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সেভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি।
বিশ্বায়নের সঙ্গে ভারত অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বিংশশতকে ১৯৯১ সালে। আটের দশক থেকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলো উঠে পড়ে লেগেছিল। তারই ফলশ্রুতিতে অনেকটা চাপে পড়ে ভারতকে বিশ্বয়ানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। মূলতঃ ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির জন্য তৃতীয় বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর বাজারকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বিশ্বায়নের মধ্যদিয়ে। বিশ্বায়নের চুক্তির সময় ছোট ও মাঝারি শিল্পের মালিকরা ভয় পেয়েছিল নিজেদের অস্তিত্বের কথা ভেবে। এতদ সত্বেও কেউ কেউ বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার মধ্যে সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলেন।কেউ কেউ মনে করেন, ‘………….বিশ্বায়নকে ঘিরে গত পৃথিবীর কম উন্নত দেশগুলোর সামনে যতনা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিপদ তারথেকে বেশি বড় বিপদ মানুষের চিন্তা-চেতনাগত দীনতায়। মানুষের যে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, যে প্রতিবাদী মনন সমাজ বিকাশের ধারা সুনিশ্চিত করেছে, তা যদি ভোঁতা হয়ে যায় তাহলে মানব জাতির সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ সূচিত করে।’[iv] (কর ২০০৩)
বিভিন্ন দেশের মানুষ ভারতে আসছে খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকেই। বিভিন্ন দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয়দের পরিচয়ও গড়ে ওঠে এবং সংস্কৃতির আদান প্রদান হয়। এভাবেই বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার বিনিময় হয়েছে। ইংরেজদের সময়ে বিশ্বায়নের গতি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়েছে, যদিও এই বাণিজ্য ব্যবস্থাকে বিশ্বায়ন বলা হয়নি। পল সুইজি মান্থলি রিভিউ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘বিশ্বায়ন কোন শর্ত নয়।ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন ঘটনা নয়, এ হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া। বহুদিন ধরে চলছে এই প্রক্রিয়া। সেটা প্রায় চার পাঁচশো বছর ধরে।’[v] (কর ২০০৩)ভারতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে প্রত্যক্ষভাবে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে চতুর্দশ শতক থেকে বা তার আগে থেকে। পঞ্চদশ ষোড়শশতাব্দীতে তা আরো সম্প্রসারিত হয়।
গত আড়াই দশক ধরে বিশ্বায়নের পরবর্তীকালে দ্রুত গতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের আর্থিক ও বানিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশ-বিদেশ থেকে নানা ধরনের পণ্য সুলভে ভারতের বাজারে ঢুকে পড়ে। সেইসব পণ্যের চাহিদাও বাড়ে। বিপনন ব্যবস্থা দ্রুত বদলে যেতে থাকে। প্রায় প্রত্যেক গ্রামের সংলগ্ন নানা জায়গায় দোকান, বাজার বসে। বাণিজ্যিক কাজ কর্মের সুবাদে বাইরের বিভিন্ন দেশের মানুষের যাতায়াত বেড়ে যায়। একসঙ্গে কৃষির কাজের পরিবর্তে কলে কারখানায় অফিসে চাকরি, ব্যবসা বানিজ্যের ফলে এককভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ বাড়ে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে টুকরো হয়। যৌথ পরিবারের সকলে মিলে যে বার-ব্রত হত তা আর হয়না।জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের ফলে পরিবারের জনসংখ্যাও খুবই কমে যায়। ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য আদব কায়দার প্রাধান্য বাড়ে। জীবিকার সন্ধানে দূর-দূরান্তে নিজের গ্রাম ছেড়ে চলে যায় অন্যত্র। পরিবহন ব্যবস্থা আরো সম্প্রসারিত হয়। গ্রাম্য সারল্য ক্রমে জটিল হয়ে ওঠে। বার-ব্রত, পূজা-পার্বণের মধ্যেও নাগরিক জীবনের প্রভাব পড়ে। গ্রামের আঞ্চলিক ভাষার জায়গায় শহুরে ভাষার ব্যবহার বাড়ে। লোকখেলার পরিবর্তে বিদেশী নানা ধরনের খেলনার প্রাধান্য বাড়ে। ইলেকট্রনিক্স খেলনা, মোবাইল গেম, কম্পিউটারে টিভিতে রিমোট চালিয়ে গেম চলতে থাকে। আগের মতো আর নীলের বিয়ে হয়না। শিবের পোষাকে আধুনিক উপকরণ যুক্ত হয়। বার ব্রতর সঙ্গে সম্পর্কিত লোকগানের ব্যবহার কমে। কোথাও কোথাও পুরো পাড়া ও গ্রাম থেকেই উধাও হয়ে যায় সেইসব ব্রত, পূজা পার্বণ আর তার সঙ্গে যুক্ত বা সম্পর্কিত গান গাথা। ক্ষেত্র সমীক্ষা করে এ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য হাজির করা সম্ভব হবে।
12
অনিবার্যভাবে লোকশিল্প সৃষ্টির পরিবেশ গ্রাম। বিশ্বায়নের পর নগরজীবন ও নাগরিক সংস্কৃতির বিস্তৃতি ঘটেছে। গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক লোকশিল্পের উপর প্রভাব পড়েছে নগরজীবনে। এভাবেই সর্বত্র লোকশিল্পের মূলধারা বিচ্যুত হতে চলেছে। এ সম্পর্কে সুমন কুমার দাস লিখেছেন, ‘ধীরে ধীরে বাউলগানের পরিসর ও ক্ষেত্রগুলো ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাউলগান ছাড়া অপরাপর গানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ঘাটুগান হারিয়েছে সেই কবে, এমন কী উরিগান (হোরি), গাজীর গান, বটকিরাগান, টপ্পা আর মালজোড়াগানও তেমন চোখে পড়ে না। …….সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যাচ্ছে ঔৎসুক্য শ্রোতা-দর্শকেরাও। বড় বেশি আফসোস হয় ধীরে ধীরে যেন হারিয়ে যাচ্ছে গানের সমৃদ্ধ ধারাগুলো। অতীতের সেই সুর কিংবা গান অতি দ্রুতই যেন সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে।’[vi](দাস ২০১৪)
সুর আমাদের সংস্কৃতির আত্মা। এর সঙ্গে ভাব যুক্ত হলে বাণী আসে, বাণী গতি পায়, জোর পায় কাহিনির বুননে। এভাবে গানে-নাট্যে জমে উঠে যা দাঁড়ায়, সেটাই লোকজীবনের সংস্কৃতি, শিল্প। পদাবলী কীর্তন, পালাগান, বারমাস্যা, গম্ভীরা—সবকিছুতেই একই রকম। পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গাড়োয়ানের গান, বাওয়ালীদের গান, পালকির গান, ওঝার গান, গাছ কাটার গান, জেলেদের গান, কবিরাজের গান, ঘোল তৈরীর গান, চুন তৈরীর গান, কুমারের গান, হাবু গান, ধান কাটার গান, ধুয়া গান ইত্যাদি। এছাড়া আছে তালের পাখা, শোলার খেলনা, বাঁশ ও বেতের পাত্র, মাটির পাত্র, পুতুল ও খেলনা, মাদুর, কাঠের খেলনা ইত্যাদি তৈরি কাজে নিয়োজিত পেশার মানুষের দ্বারা গড়ে ওঠা লোকজ সংস্কৃতি। পালকির গান এখন আর শোনা যায় না। পালকির পেশা আর নেই। তেমনি গাড়োয়ানের গান, বাওয়ালীদের গান, গাছ কাটার গান, জেলেদের গান, কবিরাজের গান, ঘোল তৈরীর গান, চুন তৈরির গান, কুমারের গান, হাবু গান, ধান কাটার গান, ধুয়া গানও আর নেই। এইসব পেশার জায়গায় এখন যন্ত্রের আগমন ঘটেছে। পাল্কির জায়গায় এসেছে মোটর গাড়ি, কুড়ুল, করাতে সুর তুলে গাছ কাটার জায়গায় এসেছে মোটর চালিত করাত, পেটানো ছাদ নির্মান বহুকাল ধরেই আর নেই তাই তার গানও এখন খাতায় কলমে আর শহুরে শিল্পীদের কন্ঠে স্থান পেয়েছে। এভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই জটিল অবস্থার মধ্যেও বহুগান নিজের জায়গাগুলিকে ধরে রেখেছে। এই আলোচনায় এগুলি অনুসন্ধান করা হবে।
ইদানিং ক্রমশঃ ভয়ানকভাবে আমাদের সময় কেড়ে নিচ্ছে তা’হল মোবাইল ফোন। লোককথা, লোকসংগীত এর পরিবর্তে টিভি সিরিয়াল। ২৪ ঘন্টা ধরে চলা বিনোদন ব্যবস্থার অজস্র উপকরণ। সাংসারিক, দৈবিক,ভৌতিক অজস্র কাহিনীর টানে অবসর সময়ে, সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে সবার মুখ টিভির দিকে। ফলতঃ আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনা নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল। প্রতিদিনের চণ্ডীমণ্ডপ কিংবা গাজনতলায় আর আসর বসেনা। সতঃস্ফূর্তভাবে আর কবি গানের লড়াইয়ের প্রচেষ্টা চোখে পড়েনা। অনেকে লোকসুরে চটকদারি কথায় গান বাঁধেন। কিন্তু তা সাধারণের কাছে সেই আবেদন সৃষ্টি করেনা। আমার আলোচনার ক্ষেত্রে শুধু এর কারণ নির্ণয়ই নয় লোকসংগীতের প্রাণ শক্তিটি ঠিক কোথায় এবং কী করে তা সাধারণের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে টিকে আছে আর তা কীভাবে একটু একটু করে পরিবর্তীত হয়ে নিজেকে উন্নীত করে চলেছে তাও নির্ণয় করা হবে।
আধুনিকতা, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও বিশ্বায়নের ফল
কিছু ক্ষেত্রে লোকসংগীত শিল্পীদের কদর বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে যোগ সূত্র তৈরি হচ্ছে লোকশিল্পীদের। তার সুফল যেমন আছে তেমনি কুফলও আছে।
সুফল :
নতুন উপকরণ, নব চেতনা লোক গানকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
আঞ্চলিক সব সঙ্গীতের সঙ্গে দেশের ও বিদেশের মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠায় এর চাহিদা বেড়েছে।
লোকশিল্পীরা অনেকে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হচ্ছেন। বিশ্বের বাজারে তাদের স্থান হচ্ছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে লোকসংগীতের সম্প্রচার হচ্ছে. লোকশিল্পীদের প্রাধান্য বাড়ছে।
13
লোকশিল্পীদের সন্মান ও মর্যাদা বাড়ছে।
লোকসংগীতের সুর নানাভাবে চলচ্চিত্রে, নাটকে, টিভি সিরিয়ালে গুরুত্ব পাচ্ছে।
লোকবাদ্যযন্ত্রগুলিও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি করে।
লোকসংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে মাইক ও নানা ধরনের উন্নত যন্ত্রের ব্যবহার গানের শিল্পীর পরিবেশনকে সহজ করে দিয়েছে।
ক্ষতিকর দিক :
লোকসংগীতকে বাজারের দরদামের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ফলে তা স্বাভাবিকতা ও সারল্য হারাচ্ছে।
বাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে তাদের সংগীত রচনা করছেন। যা লোক সুরে আধুনিক গানের ঢঙে পরিবেশিত হচ্ছে।
লোকসংগীতে আধুনিক ইলেকট্রনিক্স বাদ্যযন্ত্রের বহুল ব্যবহার বাড়ছে। এর ফলে গানের সামগ্রিক পরিবর্তন হচ্ছে।
ইদানিং বাংলা ব্যান্ডের গানে লোকসংগীতকে ভেঙ্গে চুরে গাওয়া হচ্ছে এবং তা মর্যাদাও পাচ্ছে। যেখানে লোকশিল্পীদের কোন স্পর্শ নেই। পাশ্চাত্য সুরের সঙ্গে মিলিয়ে লোক সংগীতের গানের কথা ও সুরকে ব্যবহার করে গাওয়া হচ্ছে।
একক ভাবে গাইবার উপযোগী গানগুলিকেও বহুল পরিমান বাদ্যযন্ত্র (ভারতীয় ও পাশ্চাত্য) সহযোগে সমবেতভাবে গাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। প্রতিদিন সি ডি আকারে প্রকাশিত হচ্ছে পরিবর্তিত লোকসুরেরঅজস্র গান। ভালো-মন্দ খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে শ্রোতাদের। গ্রামীন অর্থনীতিতে ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটছে লোকসংগীতেও তার প্রভাব পড়ছে।
এই রকম বহু পরিবর্তন প্রতিদিন হয়ে চলেছে। বহু লোকসংগীত হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যেতে বসেছে।
স্বাধীনতার সময়ে মানুষের মনে যে আশা আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছিল ও তার মধ্যদিয়ে নানা আবেগ উদ্দীপনা কাজ করেছিল তা লোকসংগীতে প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশ গঠনের কাজে দেশীয় নেতৃত্ব দায়িত্ব নেয়। তার পাশাপাশিজ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে নবজাগরণ ঘটতে থাকে গ্রামে গঞ্জে, শহরে নগরে। সংগীত ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বইতে থকে ঝড়ো হওয়া। আঞ্চলিক ও অন্যান্য লোকগীতিতেও নানা নতুন উপকরণ যুক্ত হয়। স্বাধীনতার প্রভাব হয় সুদূর প্রসারী। গ্রামীন জীবন ক্রমে নাগরিক সুবিধা ও সাচ্ছন্দের স্বাদ পেতে থাকে। লোকসংগীতে তার প্রভাব পড়তে থাকে। এ সম্পর্কে আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
লোকসংগীত যত বেশি জনপ্রিয় হয়েছে ততই তার মূল শেকড় একটু একটু করে ছিন্ন হয়েছে। আঞ্চলিক ও পল্লী অঞ্চলের কোন গানগুলি কেন, কখন ও কিভাবে হারিয়ে গিয়েছে বা লুপ্ত হয়েছে বা লুপ্ত হতে চলেছে তা জানা দরকার। পরিবর্তন ঘটে চলেছে বিশ্বায়নের পরেও এবার তা আরো দ্রুত এবং এর ফল একেবারে অন্যরকম। বিষয়টি আলোচনা জরুরী মূলতঃ আগামী দিনে লোকসংগীতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানা বোঝা ও করনীয় স্থির করার জন্য।
14
[i]দেব চিত্ত রঞ্জন,পল্লীগীতি ও পূর্ববঙ্গ। কলকাতা, ফার্মা কে এল এম, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ভূমিকা ১।
[ii]ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, সংগীতচিন্তা।কলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯২ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ৩১২।
[iii]দেব চিত্ত রঞ্জন,পল্লীগীতি ও পূর্ববঙ্গ। কলকাতা, ফার্মা কে এল এম, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১।
[iv]কর শমিত, বিশ্বায়নের হাল হকিকত.ডিরেকটেড ইনিসিয়েটিভ, ২০০৫, কলকাতা. পৃষ্ঠা ভূমিকা ২।
[v]বসু সুধীন (সম্পাদনা), বিশ্বায়ন সংস্কৃতি ও সমাজ– বিশ্বায়ন প্রবন্ধ-পল সুইজী. বলাকা সাহিত্য প্রকাশনা, ২০০৫, কলকাতা. পৃষ্ঠা২৭।
[vi]দাশ সুমনকুমার,ভাটি অঞ্চলের গান সেকাল একাল। http://banglalibrary.org/page/3/?s=%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%95+%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%97%E0%A7%80%E0%A6%A4
শিশুশিক্ষার উপকরণে ছন্দ : বিদ্যাসাগর ও আধুনিক প্রজন্ম
দেবাশিস মণ্ডল
লেখাপড়া শেখার শুরুতে ছড়া গান, কবিতাকে প্রাধান্য দেওয়ার রীতি সারা পৃথিবীতে সব ভাষাতেই প্রচলিত পদ্ধতি। ছন্দে পাঠ স্মৃতিতে সহজেই স্থান করে নেয় বলেই প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ রচয়িতারা অনেক জটিল নীতিকথাও ছন্দের মাধ্যমে শিশু কিশোরদের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দেবার জন্য সচেষ্ট হন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও তাই করেছেন। তার বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ এ স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণগুলি এমনভাবে সাজানো যাতে ছন্দের সৌন্দর্য অনুভূত হয়। প্রতিটি বর্গের মধ্যে কী অদ্ভূত ছন্দ লুকিয়ে আছে। যা শিক্ষার্থীদের ক্লান্তি বোধ করতে দেয় না। এর পরের অংশে যেখানে ব্যঞ্জনবর্ণগুলি এলোমেলো করে লেখা হয়েছে, সেখানেও ছন্দ বর্জিত হয়নি। পরের পৃষ্ঠায় বর্ণযোজনায় অজ-আম, ঈট-ঈশ, উট-ঋণ, এক-ওল ছন্দের বন্যা বইয়ে দেওয়া নাহলেও ছন্দের ছাঁদেই পর পর লেখা হয়েছে বইটি। পরে অচল-অধম, আলয়-আসন। কিংবা যাই-ভাই, চাই-পাই, ঝাউ-লাউ, খাও-দাও। আ-কারান্ত শব্দ শেখানোর জন্য তিনি লিখেছেন, ছাগল-পায়স, বালক-সাহস ইত্যাদি। ঊনস্বার (ং) শেখানোর সময় লিখেছেন, অংশ-বংশ, হংস-মাংস,সিঙ্ঘ-হিংসা, এবং-বরং। প্রথম বাক্য নির্মান শেখানোর জন্য লিখেছেন, বড় গাছ। ভাল জল। লাল ফুল। ছোট পাতা। পথ ছাড়। জল খাও। হাত ধর। বাড়ি যাও। কথা কয়। জল পড়ে। মেঘ ডাকে। হাত নাড়ে। খেলা করে। পাশাপাশি বা ওপর নীচ শব্দ সারিতেও ছন্দের ভাবনা মিশে আছে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় বইয়ে। এরকম উদাহরণ রয়েছে প্রতিটি ছত্রে ছত্রে।
সারা পৃথিবীতেই একই নিয়মে শিশুদের সংগে কথা বলা হয়, পড়ানো হয়, গল্প করা হয়। আমাদের বাংলার রূপকথাতেও ছন্দই প্রাধান্য পায়। আর তাই আবহমান কালধরে সেই সব গল্প শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত সবার মনের মনিকোঠায় স্থান পেয়েছে। কেউ বোধহয় তার সুর ভুলে যায়নি। আমরা যখন পড়ি, গলদা চিংড়ি, তিংড়ি মিংড়ি , লম্বা দাঁড়ার করতাল। পাকড়াশীদের কাঁকড়া ডোবায়, মাকড়শাদের হরতাল। তখন এর অরথ বোঝার দুসাধ্য প্রচেষ্টা থাকেনা। শুধু ছন্দ আর কব্য সৌন্দর্য সারা মনে আর অন্তঃকরণে সুরের ঝঙ্কার ধরে রাখে, শেষ হতে চায় না। রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে লিখেছেন, অবচেতন মনের কাব্যরচনা অভ্যাস করছি। সচেতন বুদ্ধির পক্ষে বচনের অসংলগ্নতা দুঃসাধ্য। ভাবী যুগের সাহিত্যের প্রতি লক্ষ্য ক’রে হাত পাকাতে প্রবৃত্ত হলেম। তারি এই নমুনা। কেউ কিছুই বুঝতে যদি না পারেন, তা হ’লেই আশাজনক হবে। [ অবচেতনার অবদান ] গলদা চিংড়ি, তিংড়ি মিংড়ি………… মাকড়শাদের হরতাল। পয়লা ভাদর, পাগলা বাঁদর ল্যাজখানা যায় ছিড়ে, পালছে মাদার, সেরেস্তাদার,কুটছে নতুন চিঁড়ে।। কলেজ পাড়ায় শেয়াল তাড়ায়, অন্ধ কলুর গিন্নি। ফটকে ছোঁড়া চটকিয়ে খায়, সত্যিপিরের সিন্নি।। মুল্লুক জুড়ে উল্লুক ডাকে, ঢোলে কুল্লুক ভট্ট। ইলিশের ডিম ভাজে বঙ্কিম, কাঁদে তিনকড়ি চট্ট।।
পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষার সুফল আমরা অনেক পেয়েছি। সভ্যতা দ্রুত গতিতে মানুষকে উন্নতির শিখরের দিকে নিয়ে চলেছে। কন্তু এখনো তবু দুঃখ করে বলেন ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’। তার কারন স্বার্থপরতা, হিংসা। পৃথিবীতে যত মানুষ অপুষ্টিতে অনাহারে মারাগেছে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ হিংসার বলি হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও মানবিকতা বিচ্ছিন্ন শিক্ষাকেই হয়তো দায়ী করতে হয়। শিক্ষায় মানবিকতা ও মূল্যবোধ বাড়ানো দরকার। চারুকলা বিশেষ করে সংগীত শ্রবণ ও শিক্ষায় যে মানবিকতার স্ফূরণ ঘটে তাকে চর্চার মধ্যে আনতে পারলে হয়তো হিংসা কমানো যাবে। মনোরোগের প্রকোপ কমবে।
16
সুরের নিজস্ব ভাষা আছে, ছন্দেরও ভাষা আছে। আনন্দের ছন্দ, দুঃখের ছন্দ, অবসাদের ছন্দ, নীরবতার ছন্দ, কোলাহলের ছন্দ। ছন্দের সঙ্গে শব্দের মেলবন্ধনে হয় সংগীত। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত হৃদয় থেকে রক্ত শ্রোত তরঙ্গ তুলে আন্দোলন সৃষ্টি করে চলেছে। দোলায়মান ছন্দে আমরা প্রতিনিয়ত ছন্দময় হয়ে আছি। Douglas নামে একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, ছন্দ সঙ্গীতের অত্যন্ত প্রভাবশালী দিক। ‘Everything from the cycle of our brain waves to the pumping of our heart . . . all work in rhythms. We’re a mass of cycles piled one on top of another, so we’re clearly organized both to generate and respond to rhythmic phenomena’। (Douglas 1987)
বাংলায় ছন্দে নামতা মুখস্ত করার মধ্যেও ছন্দের প্রাধান্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেখাযায় ছন্দে মুখস্ত কোন কিছুকে স্মরণ করতেও কোন বেগ পেতে বা বেশি মাথা ঘামাতে হয়না। যেমন কবিতার প্রথম লাইন মনে পড়ে গেলে পরের লাইনগুলো আপনা-আপনিই মনে এসে যায়। তারও বড় কারন হল ছন্দ ও সুর। লক্ষ্য করা যায় অ্যালজাইমার রোগীদের দ্রুত স্মৃতি ভ্রষ্ট হতে থাকে। যাকে সারিয়ে তোলার চিকিৎসা এখনো সম্ভব হয়নি। এই রোগীদের শেখা গান তারা ভুলে যায়না। ফলে তাদের সুরের মাধ্যমে অনেক কিছুই শেখানো যেতে পারে যা তারা সহজেই মনে রাখতে পারবে। হয়তো সুর ও ছন্দের মধ্যদিয়েই তাদের স্মৃতি শক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। নানা ধরণের তথ্য মনে রাখার জন্য ছন্দ ও সুরকে ব্যবহার করা একটি প্রাচীন পদ্ধতি। ভারতে বহুকাল এই পদ্ধিতি চালু রয়েছে। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, ভারতীয় লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বহু উপকরণ ছন্দে রচিত। এখনও লোকসংস্কৃতিতে ছন্দের প্রাধান্যই চলে আসছে। ছড়া, গান থেকে লোককথা, লোকনাট্য এমনকি বর্ণনামূলক কাহিনিও ছন্দে রচিত হয়। আধুনিক সাহিত্যেও ছন্দের নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে। অনেক ছড়া আছে যেগুলিতে ছন্দ বাদ দিলে তার অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়না।
ছন্দ আমাদের স্মৃতি শক্তি বাড়িয়ে দেয়। শিশুরা প্রথম কথা বলতে শেখে ছন্দ মেলানো শব্দ দিয়ে। আম্মা, আব্বা, মাম্মা, বাব্বা, কাক্কা, দাদ্দা ইত্যাদি শব্দ দিয়ে। একটু বড় হতে তারা ছড়া শেখে, ছন্দে ভরা কথা আর গানে তার মন প্রাণ ভরিয়ে দেয় তার গুরুজনেরা।
প্রথম ভাষা উচ্চারিত হবার সময় থেকে সুর ও ছন্দই ভাষা শেখার প্রথম অবলম্বন হয় বলেই ভাষা শেখাতে শিশুদেরও পটুত্ব দেখা যায়। সুর ও ছন্দহীন ভাষা চর্চা শুরু হলে হয়তো শৈশবটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠতো। বহুকাল ধরে মানুষ এসব দেখে শুনে বুঝেছে। হয়তো নিজের অজান্তেই প্রাথমিক শিক্ষায় ছন্দের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে মানুষ। তাই তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে বহমান রয়েছে যুগ যুগ ধরে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এইসব ব্যবস্থার বিশ্লেষণও শুরু হয়েছে বেশ কিছুকাল। প্রতিদিন নতুন নতুন গবেষণায় যে সত্য জানা গেছে তা’হল ছন্দ মানুষের স্মৃতি শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। ছন্দে শেখা গান কবিতা মানুষ ভুলে যায়না। ভুলে যায়না ছন্দে শেখা মন্ত্র তন্ত্রও।
যুগ যুগ ধরে মানুষ এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের মধ্যে তাদের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা মুখে মুখে প্রবাহিত হয়েছে। তারমধ্যে কত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা হারিয়ে গেছে তা আমরা জানিনা। কিন্তু মানুষই নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সম্মৃদ্ধ জ্ঞানকে ছন্দোবদ্ধ করে রেখে গেছে পরের প্রজন্মের মধ্যে। তা আর হারিয়ে যায়নি।
Rhythm in Kids’ Primer : Vidyasagar & New Generation
ঠাকুরবাড়ির দুই সংগীত বিদুষী : প্রতিভা ও ইন্দিরা
৩০
ডঃ জয়ন্তী মন্ডল
রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে। জোড়াসাঁকো বাড়িতে বইছে গীতিনাট্যের হাওয়া। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘মানময়ী’ গীতিনা্ট্যের জোড়াসাঁকোর বাড়ির আনাচে কানাচে। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘মানময়ী’র অভিনয় হলো কয়েকবার। এমন সময় রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে এসে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেললেন অপেরা স্টাইলে গীতিনাট্য ‘বাল্মিকীপ্রতিভা’। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল গীতিনাট্যের মহড়া। এবারের দর্শকাসনে কেবল ঘরের লোকজন নয় ‘বিদ্বজ্জন সভা’র বাইরের সদস্যরাও থাকবেন। মহর্ষি ভবনের বাইরের তিন তলার ছাদে স্টেজ বাঁধা হল। রবীন্দ্রনাথ সাজলেন বাল্মিকী। রবীন্দ্রনাথের দাদা হেমেন্দ্র কন্যা প্রতিভাদেবী হলেন সরস্বতী। লক্ষী সাজলেন বিবি অর্থাৎ কবির আর এক দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরাদেবী। মঞ্চে বীণা হতে প্রতিভা দেবীকে দেখে দর্শক একেবারে স্তব্ধ এবং উচ্ছ্বসিত।
তবে মঞ্চে প্রতিভা দেবীর আগমন এটা প্রথম নয়। এর আগে ‘বিদ্যোৎসাহিনীসভা’য় প্রতিভাদেবীর গান ও সেতার শুনে খুশি হয়ে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর তাকে দিয়েছিলেন স্বরলিপির বই। রঘুনন্দন ঠাকুর দিয়েছিলেন বিশাল তানপুরা। মঞ্চে গান গাওয়া অভিনয় ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কাছে নতুন নয়। কিন্তু প্রতিভাদেবীর মা, জেঠিমা, কাকি্মা, পিসিমারা জোড়াসাঁকো বাড়ির সদস্যদের সামনেই সেসব গান বা অভিনয় করেছেন বা হাজির হয়েছেন। একেবারে ঘরোয়া আসরে। সেখানে ঠাকুরবাড়ির সভ্যরাই গায়ক-অভিনেতা- অভিনেত্রী। আবার ঠাকুরবাড়ির সভ্যরাই দর্শক। প্রতিভাদেবীই প্রথম সাধারণ মানুষের সামনে গান গেয়ে, সেতার বাজিয়ে এবং অভিনয় করে বাঙালি মেয়েদের পথ দেখালেন। জোড়াসাঁকো বাড়ির মাঘোৎসব এ প্রতিভা দেবী প্রথম তার ভাইদের সঙ্গে ব্রহ্ম সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
রবীন্দ্রনাথের দাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কন্যাটির সংগীতে হাতেখড়ি ছোটবেলাতেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেশি-বিদেশি সঙ্গীতের তালিম নেন বাড়ির ওস্তাদ বিষ্ণু চক্রবর্তীর কাছে। গান শেখার পাশাপাশি বিদেশি গান ও পিয়ানো শিখতেন। এছাড়াও
৩১
তিনি নানা রকম বাদ্যযন্ত্রও শিখেছিলেন। দেশী-বিদেশী গান শেখার ব্যাপারে প্রতিভা দেবীর পিতা হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রধান। বিলিতি গান শেখার ব্যাপারে তিনি প্রতিভা দেবীকে চিঠিতে লেখেন –
“কেবল নাচের বাজনা ও সামান্য গান না শিখিয়া যদি Beethoven প্রভৃতি বড় বড় German পন্ডিত দের গান বাজনা শিক্ষা করিতে পার এবং সেইসঙ্গে ইউনিয়ন থিওরি শেখো তবে আসল কর্ম হয়।“১
প্রতিভা দেবী সারা জীবন সংগীতের সাধনা যেমন করেছেন তেওমনি সঙ্গীত নিয়ে গবেষণাও করেছেন। স্বামী প্রখ্যাত সাহিত্যিক আশুতোষ চৌধুরীর সান্নিধ্যে এসে তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগৎ আরো শানিত হয়েছে। সংগীতের পরিসরে প্রতিভা দেবীর কৃতিত্ব সহজ স্বরলিপি রচনা। প্রতিভা দেবি প্রথম মহিলা যিনি সঙ্গীতের স্বরলিপি নির্মাণ করেন। তিনি প্রথমেই দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রণয়ন করা স্বরলিপি পদ্ধতি এবং স্বরসন্ধি প্রয়োগ পদ্ধতিতে নতুনত্ব এনে সঙ্গীতকে সকলের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলেন। প্রতিভা দেবীর জেঠিমা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকায় প্রতিভা দেবী স্বরলিপি পদ্ধতি প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ ও ‘কালমৃগয়া’র গানগুলির প্রথম স্বরলিপি রচয়িতা প্রতিভা দেবীই। শুধু দ্বিজেন্দ্রনাথ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথের গান নয় পিতার আদেশে তিনি বহু ব্রহ্মসংগীত এবং হিন্দুস্তানী সংগীতের স্বরলিপি রচনা করেন। প্রতিভা দেবীর ভাইয়ের মত অনুযায়ী ‘সে প্রায় তিন চারশ হবে’।
স্বরলিপি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি গান শেখানো শুরু করলেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী প্রকাশিত বালক পত্রিকায়। নাম দিলেন ‘সহজ গান শিক্ষা’। পরে গানের চর্চার প্রয়োজনে নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আনন্দ সভা’ আরো পরে ‘সঙ্গীতসংঘ’। সঙ্গীতসঙ্ঘে তিনি শেখাতেন ওস্তাদি হিন্দুস্থানী সংগীত। এই প্রথম বাঙালি মেয়েরা এভাবে ভালো করে গান শেখার সুযোগ পেলেন। প্রতিভা দেবীর এই স্কুলে এসে যোগ দিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী কন্যা ইন্দিরা দেবী। অবশ্য সেটা
৩২
পরে তিনি চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে এখানে যোগ দিয়েছিলেন। প্রতিভা দেবীর স্বামী আশুতোষ চৌধুরীর সহোদর ভাই ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে ইন্দিরা দেবী বিবাহ হয়। সেই সুবাদে প্রতিভাদেবী এবং ইন্দিরা দেবী দুই বোন একই পরিবারের বধূ হয়ে একসঙ্গে ‘সংগীতসংঘ’ পরিচালনার ভার নিলেন। ‘আনন্দসভা’র নামে নিজে প্রকাশ করলেন ‘আনন্দ পত্রিকা’। পত্রিকাটি প্রতিভা দেবী এবং ইন্দিরা দেবীর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় আট বছর। পত্রিকাটিতে থাকতো সংগীত বিষয়ক আলোচনা। সেখানেই স্বরলিপি প্রকাশের পাশাপাশি লুপ্ত সংগীত শিল্পী ও যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের কথা তুলে ধরলেন তিনি। তানসেন, সদারঙ, বৈজু বাওয়া, নায়্ক, শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রভৃতি সংগীত শিল্পীদের এবং সঙ্গীত গুণীদের জীবন ও তাঁদের সাংগীতিক চিন্তার ধারা তুলে ধরলেন পত্রিকাটিতে। তাঁর সঙ্গীত চিন্তার পরিচয় বহন করে তাঁর মৃত্যুর পর ‘সঙ্গীতসংঘ’ এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কাকা রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “সঙ্গীত শুধু যে তাঁর কন্ঠে আশ্রয় নিয়েছিল তা নয়, তাঁর প্রাণকে পরিপূর্ণ করেছিল। এরই মাধুর্য প্রবাহ তাঁর জীবনের সমস্ত কর্ম কে প্লাবিত করেছে।“২
রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রতিভা দেবীর কৃতিত্ব স্বরসন্ধি সহ রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি নির্মাণ। রবীন্দ্রনাথের ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ’ গানটি এর উজ্জ্বল উদাহরণ। সংস্কৃত স্তোত্রে সুর দিয়ে গান গাওয়া রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে। এই ইচ্ছেকেও তিনি রূপ দেন। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুরে বেদ গানের স্বরলিপি তৈরি করেন প্রতিভা দেবী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে মাঘোৎসব এর সূচনা হত একটি বেদ গানের ভাবগম্ভীর পরিবেশে দিয়ে। প্রত্যেকবার সে সব বেদ গান বা কখনো গীতার স্তোত্র এ প্রতিভা দেবী নিচে স্বরলিপি তৈরি করে সকলকে গান শেখাতেন। এমনই সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন প্রতিভা দেবী। তাঁর নিজের লেখা গানের সংখ্যাও কম ছিল না। ‘সাঁঝের প্রদীপ দিনু জ্বালায়ে’, ‘দীন দয়াল প্রভু ভুলো না অনাথে’ গানগুলি সে সময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। জোড়াসাঁকো পরিবারেরে ব্রাহ্ম ধর্মের হাওয়া, পিতার ধর্মানুরাগ গভীর ভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল প্রতিভা দেবীর মননে। তাঁর লেখা প্রবন্ধের কিছু অংশ পড়লেই ফুটে ওঠে তার ধর্মানুরাগ এবং জ্ঞানের স্পৃহা –-
৩৩
‘ভালো চিন্তা হৃদয়কে অধিকার না করিলে ভালো হইবার দিকে অগ্রসর হওয়া যায়না । চিন্তার ভালো-মন্দ গতি আমাদের আচার-ব্যবহার এর গতি নিয়ন্ত্রিত করে। চিন্তা সংযত না হইলে আমাদের স্বভাব যথেচ্ছাচারী ও ও শিথিল হইয়া পড়ে। কিন্তু কাহার চালনায় এই চিন্তাকে আমরা সংযত করতে পারি? কুপথ হইতে ফিরাইয়া লইতে পারি? সে সারথি কে? সে আর কেহ নয় – জ্ঞান।‘৩
ইন্দিরা দেবী ঠাকুরবাড়ির নবজাগরণের আর এক নাম। ঠাকুরবাড়ি মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম বি এ পাস করেন। ইন্দিরা দেবী হলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা। রবিকাকার আদরের ‘বিবি’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই ভাইঝিটিকে খুব পছন্দ করতেন। কোনো লেখা ‘বিবি’ কে না দেখিয়ে সন্তুট হতেন না। ছোট বেলা থেকেই ইন্দিরা দেবী পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন। কবিগুরুর অসংখ্য গানের স্বরলিপি লিখেছেন ইন্দিরা দেবী। এছাড়াও কয়েকটি ব্রাহ্ম সঙ্গীতও রচনা করেন। প্রতিভা দেবী যেমন গানের জগতে বাঙালি মেয়েদের মুক্তি দিয়েছিলেন। ইন্দিরা দেবী উদ্ধার করেছিলেন প্রায় লুপ্তপ্রায় প্রথমদিকের রবীন্দ্র সংগীতকে। ইন্দিরা দেবী বিদেশি সংগীত শিক্ষক সেন্ট পলস এর অর্গানিস্ট স্লেটার সাহেবের কাছে পিয়ানো এবং সিনর ম্যাঞ্জাটর কাছে বেহালার তালিম নেন। এরপর ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিকের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করে বদ্রি দাস মুকুলের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন।৪
ইন্দিরা দেবী বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন দক্ষ অনুবাদক অন্যদিকে সঙ্গীত জ্ঞানী। তাঁর অনুবাদের হাতে খড়ি সেই ছোট বেলাতেই। মা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যখন ঠাকুরবাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ করেন সেই সময় তিনি রাস্কিন এর রচনার বাংলা অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ফরাসী অনুবাদ থেকে অনুবাদ করেন ইন্দিরা দেবী। অনুবাদ প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায়। রবিন্দ্রনাথের বহু কবিতা ও রচনার দক্ষ অনুবাদক ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ প্রথম ইন্দিরা দেবী করেন। ইন্দিরা দেবীর অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত হতেন।৫
৩৪
আবার সঙ্গীতের কথায় ফিরে আসা যাক। ইন্দিরা দেবী অসংখ্য রবীন্দ্র সংগীতের স্বরলিপি করেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুধু সুর এবং স্বরলিপি নয় রবীন্দ্র সংগীতকে তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। সঙ্গীত বিষয়ে তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। স্বামী প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে লিখিত ‘হিন্দু সঙ্গীত’ গ্রন্থের ‘সঙ্গীত পরিচয়’ নামক প্রাথমিক অংশ উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখা ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ত্রিবেণী সঙ্গম’ বইটির পুরো বই জুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার ফসল। ইন্দিরা দেবী দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ অন্যের সুরে নিজের কথা দিয়ে কত নতুন নতুন গান সৃষ্টি করেছেন। আবার এও দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের অন্যের কথায় সুর দেওয়া গানগুলি। রবীন্দ্রসঙ্গীতে হিন্দুস্থানী গানের অবদানের কথাও তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত ভাঙ্গা গানের তালিকা তৈরি করে দেখিয়েছেন যে কবি সামান্য অদল বদল করে কি অসাধ্য সাধন করেছেন। সঙ্গীত শাস্ত্রে বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত শাস্ত্রে এই বইটি এক অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে এত বিপুল আলোচনা এখন পর্যন্ত তেমন দৃষ্টিগোচর হয় নি বলাই বাহুল্য। ইন্দিরা দেবীর হিসেব অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের ভাঙ্গা গানের সংখ্যা দুশো সাতাশটি।
ইন্দিরা দেবীর লেখা রবীন্দ্র সংগীত বিষয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গুলি হল ‘সংগীতে রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্র সংগীতের শিক্ষা’, ‘রবীন্দ্র সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য’, ‘রবীন্দ্রনাথের সংগীত প্রভাত’, ‘স্বরলিপি পদ্ধতি’, ‘শান্তিনিকেতনে শিশুদের সংগীত শিক্ষা’, ‘হারমনি বা স্বর সংযোগ’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে তানের স্থান’, ‘রবীন্দ্রনাথের গান’, ‘বিশুদ্ধ রবীন্দ্র সংগীত’, ‘হিন্দু সংগীত’, ‘আমাদের গান’, ‘স্বরলিপি’, ‘দি মিউজিক অফ রবীন্দ্রনাথ টেগর’। ইন্দিরা দেবী রচিত সংগীতের এই বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধ সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর গভীর সঙ্গীত চিন্তা ও চেতনার পরিচয় বহন করে।
ইন্দিরা দেবীর স্বামী জনপ্রিয় প্রাবন্ধিক এবং সবুজপত্রের সম্পাদক স্বামী প্রমথ চৌধুরীর সান্নিধ্যে এসে তাঁর সাহিত্য এবং সঙ্গীত চর্চা কে আরো বহুগুণান্বিত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি সৌদামিনী দেবীর স্বামী, ঠাকুর বাড়ির জামাই সারাদা প্রসাদ মারা গেলে মহর্ষি রবীন্দ্রনাথকে
৩৫
শিলাইদহে পাঠান জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য। শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একান্ত অনুরাগী ভাইঝিটিকে অসংখ্য চিঠি লিখেন। এসব চিঠির কথা ইন্দিরা দেবী তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। এছাড়াও তিনি নানারকম সামাজিক উন্নয়নের কাজে যুক্ত ছিলেন। মহিলা শিক্ষা লীগ, সর্ব ভারতীয় মহিলা সম্মেলন সহ নানা সামাজিক কর্ম কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্দিরা দেবীকে ‘ভুবনমোহিনী’ স্বর্ণপদক এবং বিশ্বভারতী থেকে ‘দেশিকোত্তমা’ উপাধি দেওয়া হয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর ইন্দিরা দেবী শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন থেকেই তিনি রবীন্দ্রভবনে রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষা দেন। কিছুদিনের জন্য বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পদও সামলান। শান্তিনিকেতনে আশ্রম কুটিরের সর্বত্র তাঁর ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বে যেমন ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিক্ষিত নারীর আদর্শ রূপটি। তেমনি ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সাহিত্য সংস্কৃতির নিজস্ব ঢং টি।
তথ্যসূত্র
১। চিত্রা দেব – ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৯৯
২। চিত্রা দেব — ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ১০৮
৩। চিত্রা দেব – ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, আনন্দ পাবলিসার্স, পৃষ্ঠা ১০৯
৪। banglaamarpran.in/unto
৫। তদেব
৬। bangla.newsnextbd.com
ইউরোপের ঐতিহ্য, শিক্ষা ও আমাদের ৫১ দিন
শক্তি মণ্ডল ও মায়া মণ্ডল
আমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি। তাই আমি পৃথিবীর বাপ খুঁজিতে যাই না আর।” তিনি বিভোর ছিলেন বাংলার রূপ-মাধুর্যে। তবে কবি রবীন্দ্রনাথ যখন আহ্বান জানান, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে পাড়া”, তখন আর বাইরের ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় থাকে না।
আমাদের মেয়ে রিনি (সংকলিতা), গত দশ বছর ধরে রয়েছে জার্মানিতে গবেষণার কাজে। এখন পি-এইচ. ডি করে সেখানেই অধ্যাপনা করেছে। তারই একান্ত আগ্রহে, পরিকল্পনায় ও ব্যবস্থাপনার ইউরোপের কয়েকটি দেশে ঘুরেছি। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত। মাঝখানে আমাদের ছেলে সুমু (সায়ন্তন) এবং পুত্রবধূ সঞ্চারী কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ইউরোপের মোট ৬টি দেশের অংশবিশেষ ঘুরে দেখেছি। জার্মানি, ইতালি, ভ্যাটিকান সিটি, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্স। পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের মধ্যে ইউরোপের পুরোটাই রয়েছে উত্তর গোলার্ধে। তাই এখানে সারা বছরই শীত। তবে হয়তো বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে এবার এখানে শীতের প্রকোপ ছিল কিছুটা কম। আমরা জানি, ইউরোপের ভূখণ্ড ভারতের ৩.১ গুণ। কিন্তু জনসংখ্যা ভারতের প্রায় অর্ধেক (৫৭%)। প্রসঙ্গত স্মরণ করি যে পৃথিবীতে মোট স্বাধীন দেশের সংখ্যা প্রায় ২০০টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য দেশ ১৯৫টি। যদি আমরা ইউরোপ মহাদেশের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, এখানে মোট দেশের সংখ্যা ৪৪টি। ব্রিটেন বেরিয়ে যাবার পর এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশের সংখ্যা ২৭টি। এই সব দেশগুলিতে সাধারণ মুদ্রা হিসাবে ইউরো চলে। এছাড়া সুবিধা হল, এক ভিসাতে সব সদস্য দেশে যাওয়া যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সবথেকে জনসংখ্যা বহুল এবং শক্তিশালী দেশ হল জার্মানি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তার বাইরে থাকা ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি মানুষ কথা বলেন নিম্নোক্ত ভাষায়-
রুশ-১৪.৫০ কোটি, জার্মান- ৮.৩১ কোটি, ফরাসি ৬.৭৪ কোটি, ইংরেজি- ৬.৬৫ কোটি, ইতালিয়-
৬.৫০ কোটি, স্পেনীয় – ৪.৬৮ কোটি
এখানকার জনসংখ্যা দীর্ঘদিন ধরে মূলত একই রকম আছে। তবে জার্মানি, রাশিয়া, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশে জনসংখ্যা একটু একটু করে কমছে। এখানে আমাদের ভ্রমণের বিস্তৃত বিবরণ দেবার সুযোগ নেই। কেবল এর কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
রামমোহন ১৮৩০ সালে বিদেশ গিয়েছিলেন জাহাজে করে। রবীন্দ্রনাথও ইউরোপ গিয়েছিলেন জাহাজে চড়ে। তবে আজকাল আমরা সকলেই দূর-দূরান্তে যাই হাওয়াই জাহাজে। আমাদের টিকিট রাশিয়ার অ্যারোফ্লট বিমানে। সোভিয়েতের পতন হয়েছে। কিন্তু বিমানে রয়ে গেছে কাস্তে হাতুড়ি।’ নয়াদিল্লি থেকে মস্কো হয়ে বার্লিনে যেতে সময় লেগেছে প্রায় ১৩ ঘণ্টা। বিমানের পর্দায় দেখলাম বিমান চলেছে ঘন্টায় ১১০০ কিলোমিটার বেগে। ৩৭,০০০ ফুট উপর দিয়ে বাইরের তাপমাত্রা শূনোর ৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে আমরা বার্লিনে পৌঁছেছিলাম (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯-৩০টায়। ভারতীয় সময় বেলা ১-০০টায়। বেশ ঠান্ডা। ৱিনি আমাদের নিতে এসেছিল বিমান বন্দরে। এই সেই বার্লিন, যার প্রতিটি পথে ছড়ানো আছে অনেক রোমাঞ্চকর ইতিহাস। গোথে, কেপলার, মার্কস, এঙ্গেলস আইনস্টাইন, ব্রেট, রোজা লুক্সেমবুর্গের স্মৃতি বিজড়িত এই মহানগর। আবার হিটলারের স্বৈরাচারে বিঁধ্বস্ত বার্লিন।
রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে এসেছিলেন তিনবার। ১৯২১,১৯২৬ এবং ১৯৩০ সালে। আর সুভাষচন্দ্র ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি তার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে গভীর রাতে গোপনে বের হয়ে পাঠানের ছদ্মবেশে গুমা-পেশোয়ার-কাবুল-মস্কো হয়ে আসেন বার্লিনে। এখানে তিনি ছিলেন ১৯৪১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই বার্লিনে বসেই তিনি আজাদ হিন্দ রেডিও (Free India Centre) থেকে রাতে ভারতীয়দের উদ্দেশে ভাষণ দিতেন। পরে ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জার্মানি থেকে সাবমেরিনে করে বিপদসঙ্কুল পথে মাদাগাস্কার পৌঁছান। সেখান থেকে রওনা হন আপানের পথে।
ইউরোপে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, শিরিষ বকুল, কৃষ্ণচূড়ার গাছ নেই। তবে সেপ্টেম্বরের বার্লিন ওক, ম্যাপল, উইলো, ফার, চিনারের নানা রঙ্গিন পাতায় ফুলে অপরূপ। আমরা থেকেছি বার্লিনের গায়ে লাগানো শহর পটসডামে, যেখানে সংকলিতা থাকত। এখান থেকে আমরা অন্য দেশগুলিতে গিয়েছি। আবার এখানে ফিরে দু’তিনদিন করে থেকে গিয়েছি অন্য দেশে। এইসব দেশগুলিতে যা যা না দেখেছি, তার মধ্যে কিছু বিষয়ের উল্লেখ এখানে করছি।
বার্লিন পটাসডাম
এখানে আমরা যা যা দেখেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
(১) ব্রান্ডেনবুর্গ গেট বা ভিক্টোরিয়া বিজয়স্তম্ভ (কোয়াড্রিজা), যাকে বলা হয় জার্মানির প্রতীক।
(২) রাইঘস্টাঘ বা পার্লামেন্ট। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এর চূড়াতে উঠে আমরা মহানগরটিকে সুন্দরভাবে দেখেছি। অনেকে জানেন ১৯৩২ সালের ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাত্র ৩৩% ভোট পেয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল হিটলারের নাজি পার্টি। ক্ষমতায় এসেই ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে তারা রাইখস্ট্যাগ পুড়িয়ে দেয়। মারিনাস ভ্যান দার লুবে নামে হল্যান্ডের একজন যুবকের প্রাণদণ্ড দেয়। বলা হয়, সে একজন কমিউনিস্ট চক্রান্তকারী। কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই বছরের ১০ মে পোড়ানো হয় ২৫,০০০ বিরোধী মতবাদের বই। স্বৈরাচারী হিটলারের শাসনকাল ছিল ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।
(৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমায় বিধ্বস্ত একটি চার্চ
(8) নিহত লক্ষ লক্ষ ইহুদিদের স্মরণে হলোকাস্ট মেমোরিয়াল।
(৫) ইউরোপের সবথেকে উঁচু বিশাল টি. ভি. টাওয়ার।
(৬) আলেকজান্ডার প্লাজ (কেন্দ্রীয় পার্ক)।
(৭) আধুনিক প্রযুক্তির নিদর্শন পাঁচতলা বার্লিন রেলওয়ে স্টেশন।
(৮) স্প্রি নদীর ধারে বার্লিন প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ (ইস্ট সাইড গ্যালারি): যে প্রাচীর গড়া হয়েছিল। ১৯৬১ সালে এবং ধ্বংস হয় ১৯৮৯ সালে। দুই অংশ এক হয়ে শক্তিশালী হয় পুঁজিবাদী জার্মানি। এই দেওয়ালে শিল্পীরা নিয়মিত ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন।
(৯) পটাসডামে অষ্টম শতকের জার্মান সম্রাট ফ্রেডরিক-২-এর বিশাল এলাকাজুড়ে সানসোসি (যত্নহীন) প্রাসাদ। অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা সনসোসি প্রাসাদ ঘিরে থাকে সুসজ্জিত আঙুর বাগিচা।
(১০) সংকলিতার বাঙালি বন্ধুদের আসর। এখানে হয়েছে সংকলিতার গান, নৃত্যশিল্পী শুভম মুখোপাধ্যায়ের নাচ ইত্যাদি। এখানে আমরা দুজনেই কবিতা পাঠ করেছি। করেছি ‘জবাব চাই’ কবিতাটি। দেখেছি ভারতীয় দূতাবাসে অনুষ্ঠিত প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলিত সুর-তরঙ্গ।
ইউরোপের প্রতিটি বড়ো শহরেই বাঙালিরা দুর্গাপুজো উপলক্ষে আনন্দে মেতে ওঠে। যোগ দেয় অবাঙালি এবং বিদেশিরাও। বার্লিনের দুর্গাপুজো এবার ৪৪তম বছরে পড়ল। এখানে আমি পুজো উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে দু’চার কথা বলেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছি। এখানে পুজোর পর প্রতিমাকে প্যাক করে বাক্সবন্দি করে রাখা হয়। পুজোর শেষ দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংকলিতা ও তার তৈরি ব্যান্ডের গান হল। সংকলিতাদের ‘ইউরোপিয়ান কয়্যার’ টিমের গানের মহড়া ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে গানেও অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটল। ইউরোপের সর্বত্র দেখেছি সাদা-কালো কাক। ইউরোপের বহু দেশেই সাইকেলের জন্য রয়েছে আলাদা লেন। বৃদ্ধ বৃদ্ধারা যুবক যুবতীদের মতোই নিশ্চিন্তে সাইকেলে ভ্রমণ করে মজা পান।
পৃথিবীতে যে কটি ভাষা রাষ্ট্রসংঘে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তার অন্যতম হল ইংরেজি। কিন্তু উৎসের দিক থেকে ধরলে ইংরেজি আসলে পশ্চিম জার্মানির একটি আঞ্চলিক ভাষা। প্রায় ৫০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এখানকার ‘এঞ্জেলস’ নামে আদিবাসী গোষ্ঠী ব্রিটেনে যায়। সেখানে বেশ কিছু অংশ দখল করে তারা স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। তাদের ভাষাই ক্রমে স্যাক্সন, জুট্টিস ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব বিস্তার করে। পরে এই ‘এঞ্জেলস’ গোষ্ঠীর নাম থেকেই ব্রিটেনের নাম হয় ইংল্যান্ড এবং তাদের ভাষার নাম হয় ইংলিশ।
ইংরেজি ভাষার মধ্যে মিশে আছে প্রচুর পরিমাণে জার্মান ও অন্যান্য ইউরোপীয় শব্দ। সাম্প্রতিক একটি বিশ্লেষণ থেকে (সূত্র- উইকিপিডিয়া) দেখা গেছে পুরোনো ইংরেজি থেকে আধুনিক ইংরেজি বিপুল পরিমাণে বদলে গেছে। আধুনিক ইংরেজিতে অন্যান্য ভাষা থেকে আত্মস্থ করা শব্দের পরিমাণ নিম্নরূপ-
-ল্যাটিন থেকে ২৯%
–ফরাসি থেকে ২৯%
-জার্মান থেকে ২৬%
-গ্রিক থেকে ৬%
এখনও নিয়মিতভাবে এই ভাষা বিশ্বের অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ-সম্ভাব আত্মস্থ করে থাকে। ভারতীয় ভাষা আত্মস্থ করা এরকম কয়েকটি শব্দ হল-জাঙ্গাল, কারি পাইজামা, বাংলো, বারান্দা, থাকি, শ্যাম্পু ইত্যাদি। আরবি থেকে কফি, অ্যালজেব্রা, লেমন, জেসমিন, অ্যালকোহল, অরেঞ্জ, সুগার, কাবাব ইত্যাদি।
আমরা ইতালিতে পৌঁছেছি বিদ্যাসাগরের জন্মদিন ২৬ সেপ্টেম্বর। দেখেছি (১) রোম, (২) ফ্লোরেন্স এবং (৩) পিসা। এরই সঙ্গে আমরা দেখেছি ভ্যাটিকান সিটি।
আমরা দেখেছি অ্যাম্পিথিয়েটার বা কলোসিয়াম, যা প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য। দু হাজার বছর আগে ইউরোপের সবথেকে ক্ষমতাশালী রোমান সম্রাটদের দম্বের প্রতীক। এটি দেখতে প্রতি বছর আসেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো রোম সভ্যতার সূচনা হয়েছিল কৃষির মধ্য দিয়ে। তখন এখানে এক ধরনের গ্রামীণ গণতন্ত্র ছিল। কৃষির উদ্বৃত্ত ও বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে নগরের পতন হল। গড়ে উঠল অভিজাততন্ত্র (রোমান ফোরাম)। প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক লুঠ ধনসম্পত্তি ও দাস আসতে লাগল। রোেম পরিণত হল দাস-সাম্রাজো। গড়ে উঠল অসীম ক্ষমতাশালী সম্রাট ও তার বিলাস-ব্যাসন। জনগণের কুৎসিত বিনোদনের জন্য তৈরি করা হল এই দৈত্যাকার ব্যবস্থা। এখানে একই দিনে অনেকগুলি করে মারণখেলা হত। যোদ্ধার সঙ্গে যোদ্ধার, মানুষের সঙ্গে বাঘ, সিংহ, ভালুক ইত্যাদির। এক পক্ষের মৃত্যু হওয়ার আগে যুদ্ধ থামত না। এটি তৈরি করতে লেগেছিল অনেক বছর। এটি প্রায় ৫০ মিটার উঁচু। তখন একসঙ্গে ৫০,০০০ মানুষ বসে খেলা দেখত। সম্রাট টিটাস এর উদ্বোধন করেন ৮০ সালে। তিন মাস ধরে চলত উৎসব। খেলাতে প্রাণ যেত 20,000 মানুষ ও ৯,০০০ পশুর।
রোমেরই একজন খেলোয়াড় (গ্ল্যাডিয়েটর) ছিলেন স্পার্টাকাস। তাঁর নেতৃত্বে ৭৩-৭১ খ্রিস্ট খৃষ্টপূর্বাব্দে হয়েছিল ঐতিহাসিক দাস বিদ্রোহ। ভিত কেঁপেছিল রোম সাম্রাজ্যের। আমরা দেখেছি প্রাচীন রোমের শাসন কেন্দ্র রোমান ফোরাম। এটি দীর্ঘকাল মাটির নীচে চাপা পড়েছিল। সম্প্রতি একে খুঁড়ে বের করা হয়েছে। এখানে ঘটেছে কত উত্থান-পতন। এখানেই হত নির্বাচন, বক্তৃতা সভা, বিজয় উৎসব, সেনেট সভা। এখানেই খুন হয়েছিলেন এখানকার সম্রাট জুলিয়াস সিজার। আমরা যে এখন ইংরেজি মাসের নামগুলি ব্যবহার করি, তার উৎপত্তি হয়েছিল রোম থেকে। যেমন জলের দেবতা মার্স থেকে এসেছে মার্চ, জুলাই এসেছে জুলিয়াস সিজার থেকে আগস্ট এসেছে জুলিয়াস অগস্টাসের নাম থেকে। দেখেছি পানথেয়ন। এটি খ্রিস্টধর্ম পত্তনের আগের একটি অন্য ধরনের ধর্মস্থান। এর মাথাটিতে কোনও চূড়া নেই। এখানকার প্রতিটি প্লাজাই নানা ভাস্কর্যে, ছবির পসরা এবং অদম্য সাংগীতিক উপকরণে পরিপূর্ণ। কী প্রাণবন্ত নরনারী। এখানে সান্ধ্য আড্ডা খুবই জমজমাট।
ভ্যাটিকান সিটি
পৃথিবীতে সবথেকে ছোট্যে রষ্ট্রটি হল ভ্যাটিকান সিটি, ক্যাথলিক ধর্মের প্রধান কেন্দ্র, পোপের রাজত্ব। অথচ এককালে পোপের সাম্রাজ্য ও প্রভাব ছিল বিশ্বজোড়া। আর আজ এই রাষ্ট্রের মোট নাগরিক ১,০০০ জন। চৌহদ্দি রোমের একটি প্রান্তের দেওয়াল ঘেরা অংশটুকু। এখানে দেখেছি জগৎ বিখ্যাত সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকা, সিস্টাইন চ্যাপেল ও সেন্ট পিটার স্কোয়ার।এককালে এটি ছিল জলাভূমি। বলা হয় যে এখানে যিশুর ১২ জন প্রধান শিষ্যদের একজন সেন্ট পিটার একটি কুটির তৈরি করে ক্রিতদাস ও দেউলিয়া নাগরিকদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতেন। পরে তার সঙ্গে যোগ দেন সেন্ট পল। সেই অপরাধে সম্রাট নীরো দুজনকেই ৬৫ থেকে ৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ক্রুশকাঠে বিদ্ধ করে হত্যা করেন। সেই কবরের উপর গড়ে ওঠে পুরোনো গির্জা। পরে সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্টধর্মকে রাজধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনিই এখানে বড়ো করে একটি গির্জা তৈরি করে দেন। তবে এখানকার আকর্ষণীয় রাজকীয় স্থাপতা ও চিত্রকলাগুলি তৈরি হয়েছিল রেনেসাঁর যুগে। সিস্টিন চ্যাপেলটি তৈরি হয় ১৪৭৩ থেকে ৯ বছর ধরে। ব্যাসিলিকাটি ১৫০৬ সাল থেকে ১৬২৬ সাল পর্যন্ত ১২০ বছর ধরে।
ধর্মকেন্দ্র ছাড়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এখানকার বৃহৎ গির্জা বা ব্যাসিলিকার দেওয়ালে এবং ছাদে (সিলিং-এ) রাফায়েল, মাইকেল অ্যান্ড্রোলোর-র মতো প্রখ্যাত শিল্পীদের আঁকা নানা ধরনের অসাধারণ সব চিত্র, ফ্রেসকো এবং ভাস্কর্য। বাইবেলের কাহিনি এর ভিত্তি হলেও রেনেসাঁর যুগে এগুলি সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখকেই মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছে।
ফ্লোরেন্স
ফ্লোরেন্স এক স্বপ্নের রাজ্য। বিশ্বের পর্যটকদের প্রিয় গম্ভব্য। আমরা এখানকার সৌন্দর্যে অভিভূত হয়েছি। এটি ইতালির তাসকানি প্রদেশের রাজধানী। ছোটো ছোটো ঢেউ খেলানো পাহাড়ের কোলে অনো নদীর দুপাশে এটি গড়ে উঠেছে। এখানে একটিও বহুতল বাড়ি নেই। সব বাড়িই ৩-৪ তলা।প্রতিটি বাড়িই সোনালি টালি দিয়ে ঢাকা। আমরা এখানে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি শাস্তা মারিয়ার ব্যাসিলিকা,অনো নদীর দুই তাঁর, পিয়েলে মাইকেল অ্যাঞ্জোলো-তে বহিবেলের চরিত্র ডেভিডের মানবীয় মধ্যযুগে এটি ছিল ইউরোপের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। এরা চালু করেছিল ‘ফ্লোরিন’ নামে অতি সুন্দর সোনার মুদ্রা, যা ইউরোপে বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। এরা তৈরি করে শক্তিশালী ব্যাঙ্ক, যেখান থেকে এমনকি ব্রিটেনের রাজারাও (শতবর্ষের যুদ্ধের সময়) ঋণ নেয়। ফ্লোরেন্সকে ১৩শ
থেকে ১৫ শতকে নবজাগরণের জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। মহাকবি দান্তে, পেত্রার্ক, বোকাচ্চিও; মেকিয়াভেলি, মাইকেল অ্যান্ড্রোলো প্রমুখ মহা শক্তিশালী কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিত্রকরের অবদা জন্য ফ্লোরেন্স বিশ্বে অগ্রণী স্থান দখল করে। এখানকার ভাষাই সারা ইতালির মান্য চলিতের মর্যাদা লাভ করে।
আমরা দেখতে গিয়েছি পিসার হেলানো টাওয়ারটিকে। একে মধ্যযুগের বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি বলে মনে করা হয়। কিন্তু অনেকে মনে করেন এটি আসলে স্থাপত্যগত অতিকায় ত্রুটির একটি উদাহরণ। পিসার শাসকরা সিসিলি দ্বীপের ‘সিটি অফ পালার্মো’ জয়ের পর লুঠ করে আনে বিপুল সম্পদ। নিজেদের কৃতিত্বকে জাহির করার জন্য ১১৭৩ সালে তারা বিজয় ময়দানে গড়ে তোলেন মার্বেল পাথরের বিরাট গির্জা (ব্যাসিলিকা), ডোম এবং আটতলা উঁচু এই ঘণ্টা ঘর (বেল টাওয়ার)। তিনটি তলা তৈরির পর নরম মাটির জন্য এটি হেলে পড়ছে তা বোঝা যায়। তারপর নানা সাবধানতা অবলম্বন করে এটি তৈরির কাজ চলতে থাকে। মাঝখানে যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য একশো বছর কাজ বন্ধ থাকে। পরে আটটি তলা শেষ করা হয়। তবে এখনও টাওয়ারটি বছরে ১.২ মিমি (০৫ ইঞ্চি) করে হেলে চলেছে।
পিসা শহরেই ১৫৬৪ সালে সেকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এর বলা হয়, তিনি এই টাওয়ারে পৃথিবীর অভিকর্ষ সম্পর্কে একটি পরীক্ষা করেছিলেন। সেটি হয়তো গল্পকথা। তবে তিনি ‘পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে এই তত্ত্ব সরল ভাষায় বই লিখে প্রচার করায় তাঁর বন্ধু পোপ বারবিরিনিন তাকে সারা জীবনের জন্য গৃহবন্দী করে রাখেন। সেখানেই (১৬৩৮ সালে) তিনি অন্ধ হয়ে যান এবং মারা যান (১৬৪২ সালে)। এর আগে একই ‘অপরাধে’ ১৬০০ সালে পোপের বিচারে জিওর্দানো ব্রুনো-কে নগ্ন করে উল্টো দিকে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। সমরখন্দে তৈমুরী সাম্রাজ্যের সম্রাট উলুম কোকে হত্যা করা হয় ১৪৪৯ সালে, জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে। পিসার একটি বাঙালি রেঁস্তোরা-তে আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছি। গিয়েছি অদূরে ভূমধ্যসাগরের তীরে। সাগরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় প্রশান্তি অনুভব করেছি।
ভেনিস
ফ্লোরেন্স থেকে দ্রুতগামী ট্রেনে আমরা পৌঁছেছি ভেনিসের দ্বারপ্রাস্তে। সংকলিতার দুই বন্ধু ফ্রানচেস্কা ও আলেকজান্দ্রো এখানে আমাদের স্বাগত জানাল। হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া ঘুরে সুমু ও সঞ্চারী (বৌমা) এখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। আমরা এসে পড়েছি অতীতের এক স্বপ্নময় জগতে ।
আমরা অনেকেই শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ পড়েছি। আড্রিয়াটিক সাগরে পো এবং পিয়েতে নদী দুটির বয়ে আনা পলিমাটিতে তৈরি ১১৮ টি ছোটো চরের উপর এই বন্দর শহরটি যেন অদ্ভুতভাবে সরাসরি সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে। সারা বিশ্বে এই অপরূপ নগরীর কোনও তুলনা নেই। রেলওয়ে স্টেশনের পর স্থলযান চলাচলের কোনও পথ নেই। সুন্দর গন্ডোলা, জল-ট্যাক্সি, বোঁট, লঞ্চের ছড়াছড়ি। এখানে চারশো-র বেশি প্রাকৃতিক খাল। প্রথমে ১৫৫৮ সালে তৈরি করা হয়েছিল একটি বড়ো সেতু, রিয়েলটো। এখন সেতুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে চারশো। এজন্য এই কন্দর নগরীটিকে বলা হয় ‘‘ক্যানেলের শহর’ বা ‘সেতুর শহর’। সেতুর পাশে অজস্র জলযান। আর ভেনিসের অলিগলি, জনশিক্ষা ভাবনা, একাদশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা ও দ্বাদশ বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা, 2020 মানে রকমারি আঁকাবাকা বাধানো খাল।
১৩শ শতকে ভেনিস ছিল ইউরোপের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। সে সময় এখানে থাকত ৩৩০০ জাহাজ এবং ৩৬০০০ নাবিক। তখন দেশ-বিদেশের ধনী লোকেরা এখানে নানা কারুকার্যময় প্রাসাদ তৈরি করাতেন। সেখানে আভিজাতের অন্যতম চিহ্ন ছিল চিত্রকলা ও ভাস্কর্য। নবজাগরণে বিশেষ অবদান রাখে ভেনিস। বিশ্বের বৃহত্তম তেল-রঙে আঁকা চিত্র টিনটোরেটোর ‘প্যারাডাইস’ আঁকা হয়েছিল এখানেই।
তবে কলম্বাসের নতুন মহাদেশ আবিষ্কার ও পরবর্তীকালে নতুন বাণিজ্য পথ আবিষ্কারের ফলে ভেনিসের গৌরব কমতে থাকে। আইন অনুসারে এখানে কোনও বাড়ির কাঠামোতে বদল করা চলে না। তাই এটি সবথেকে সংরক্ষিত মধ্যযুগের শহর। তবে এখন প্রতি বছর শহরটি ৯ ইঞ্চি করে মাটিতে বসে যাচ্ছে। বছরে ১০০ বার করে এখানে বন্যা হচ্ছে।
আমরা মুগ্ধ চোখে দেখেছি ভেনিসের অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ বুরানো। এখানের প্রথম বাসিন্দা ছিল মাত্র কয়েক ঘর জেলে। তারা ঠিক করেছিল, আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন রঙে বাড়ির দেওয়াল রঙ করবে। এখনও সেই ধারা বজায় রয়েছে। এটি তাই আশ্চর্য এক রঙিন দ্বীপ। আমরা ফিরলাম বার্লিন। বিমান থেকে দেখলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত আল্পস পর্বতমালা। এই আল্পস ছড়িয়ে আছে ১২০০ কিলোমিটার জুড়ে ইউরোপের অনেকগুলি দেশে। প্রস্থ প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। তবে লম্বায়, চওড়ায় এবং উচ্চতায় হিমালয় অনেক বড়ো। হিমালয়ের দৈর্ঘ্য ২৩০০ কিলোমিটার। প্রস্থ ১৫০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার। পৃথিবীর উঁচু চূড়াগুলি রয়েছে হিমালয় ও কারাকোরাম পর্বতমালায়। সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্টের উচ্চতা ২৯:০২৯ ফুট। অন্যদিকে আল্পসের সর্বোচ্চ চূড়া মন্ট ব্লাঙ্কের উচ্চতা ১৫,৭৭৭ ফুট।
সুইজারল্যান্ড
বার্লিন থেকে বিমানে করে আমরা এসে পড়েছিলাম চির বসন্তের দেশ সুইজারল্যান্ডে। চারদিকে যা দেখেছি, তাতে অবাক হয়েছি। এত সুন্দরও কোনও দেশ হতে পারে। আমরা উঠেছিলাম এই দেশের সবথেকে বড়ো এবং আন্তর্জাতিক শহর জুরিখে। জুরিখ হ্রদের স্বচ্ছ নীল জল আমাদের মন ভরিয়ে দিল। লঞ্চে করে আমরা এক ঘণ্টা ধরে হ্রদের চারদিক ঘুরে দেখলাম। এরপর আমরা এলাম আর একটি শৈল শহর লুসার্নে। এখানে বইছে বসন্তের রোমাঞ্চকর আবহাওয়া। দেখলাম আল্পসের পিলেতাস ও রিগি পাহাড়ের পাদদেশে রিউস নদী এবং তার উপর তৈরি নয়নভোলানো চ্যাপেল সেতু। অনেক বিয়ের অনুষ্ঠান এখানে হয়।
পরদিন সুইজারল্যান্ডের একেবারে মধ্য ভাগ দিয়ে সীমান্তে অবস্থিত জেনেভা হ্রদ পর্যন্ত দীর্ঘ সোনালী ভ্রমণ (Golden Panoromic Trip)-এর জন্য বিশেষভাবে সজ্জিত আরামদায়ক ট্রেনে চেপে বসলাম। যেদিকেই দেখি সবুজ ঘাসের গালিচা, রঙিন গাছপালা, ছোটো ছোটো হ্রদ, বিচিত্র সব পাহাড়ের সারি, ছবির মতো ছোটো ছোটো সাজানো বাড়ি। দূর থেকে আমরা দেখলাম জাংফ্লোজোেক পর্বতশৃঙ্গ। এখানেই রয়েছে ইউরোপের সবথেকে উঁচু ইয়াংফাউ রেলওয়ে স্টেশন (১১,৩৩২ ফুট)।ইউরোপের সর্বত্র আমরা দেখেছি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য নিরন্তর কতো আয়োজন। আর আমাদের দেশে কত কিছু থাকতেও কী নিদারুণ অবহেলা। ভূস্বর্গ কাশ্মীরকেও আমাদের শাসকশ্রেণি রাজনৈতিক স্বার্থে নরককুন্ডে পরিণত করেছে।
শুরুতে লুসার্ন থেকে ইন্টারলকেন পর্যন্ত ট্রেনে সব ঘোষণা হচ্ছিল সুইস জার্মানে। তারপর মন্ট্রো জংশন পর্যন্ত ঘোষণা হতে থাকল সুইস ফরাসিতে। এই বৈচিত্রোর কারণ হল চারশো বছরেরও আগে এই এলাকার চারটি ভাষাভাষীর মানুষ অস্ট্রিয়া ও বুরগুন্ডির বিরুদ্ধে একসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য গঠন করেছিল একটি কনফেডারেশন। তারপর তথাকথিত ‘পবিত্র’ রোমান সাম্রাজ্য থেকে মুক্তিলাভ করে তারা ১৬৪৮ সালে তৈরি করেছিল স্বাধীন দেশ সুইজারল্যান্ড। তখন থেকে এরা একসঙ্গেই আছে। সুইজারল্যান্ড এর সরকারি ভাষা চারটি। মোট ৭৫.৮১ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে এই চার ভাষাভাষীর সংখ্যা হল নিম্নরূপ
১. সুইস জার্মান ৬৩%
২. সুইস ফরাসি ২২.৭%
৩. সুইস ইতালিয় ৮.৪%
৪. রোমানিশ (স্থানীয় ইতালিয়) ০.৪%
এত কম জনসংখ্যার দেশে চারটি সরকারি ভাষা থাকার ফলে কোনও অসুবিধা তো হচ্ছেই না, বরং সংহতি আরও দৃঢ় হয়েছে। যে যার মাতৃভাষায় শিক্ষা ও সমস্ত সরকারি-বেসরকারি কাজ করতে পারায় তাদের বিকাশ হচ্ছে স্বচ্ছন্দভাবে। জানতে পারলাম, এখন প্রযুক্তির বিপুল প্রসারের ফলে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষাগুলিতে রূপান্তর ওদের কাছে অনেক সহজ হয়ে গেছে।
ওদের এই ভাষা-গণতন্ত্র দেখে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার দুর্দশা মনে যন্ত্রণার জন্ম দিল। সারা
বিশ্বে কোন্ মাতৃভাষায় কতজন কথা বলেন, তার প্রথম পাঁচটি ভাষাভাষীর চিত্রটি নিম্নরূপ—
মান্দারিন (চিনা)
১. স্পেনিয় – ১১.৮ কোটি
২. ইংরেজি – ৪৬.০ কোটি
৩. ইংরেজি-৩৭.৯ কোটি
৪. হিন্দি – ৩৪.১ কোটি
৫. বাংলা – ২২.৮ কোটি
সাম্প্রতিক আর একটি তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে এখন সারা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। অথচ আমাদের দেশে ইংরেজির চাপ এবং হিন্দিওয়ালাদের আগ্রাসনে বাংলাভাষা ও বাঙালিরা ক্রমে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। দুঃখজনক যে এই বিষয়ে শাসক বা বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দলই সোচ্চার নয়।
সুইজারল্যান্ডে এখন মোট স্বশাসিত ক্যান্টনের সংখ্যা ২৬টি। লোকসংখ্যা ৭৬ লক্ষ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে ১৯৫ জন।
প্রকৃতি যেন সব সৌন্দর্য উজাড় করে সাজিয়ে তুলেছে এই দেশের সব কিছুকে। সৌন্দর্যের অসীমতায় ভাসতে ভাসতে আমরা এসে পৌঁছালাম মন্ট্রিয়াক্স পাহাড়ের পাদদেশে অতুলনীয় জেনেভা হ্রদে। দেশ বিদেশের পর্যটকদের কোলাহলে সদ্য মুখরিত জেনেভা। আমরা এখানে হ্রদের ধাত্রে প্রাণভরে আনন্দের সুবাস নিলাম। লঞ্চের ছাদে চড়ে কলি (কাপুচিনো) খেতে খেতে যতটা পারি সুখের স্বাদ নিলাম।।
আমরা এসে পড়েছি ইতিহাসের বহু উত্থান-পতনের গীলাভূমি স্পেনে। এর অবস্থান ইউরোপের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে। এর গায়ে লাগানো ছোট্ট দেশ পর্তুগাল আর ঠিক দক্ষিণে বিশাল আফ্রিকা মহাদেশ।
আমরা অনেকেই আলতামিরার গুহাচিত্রের কথা ইতিহাসে পড়েছি। এখন থেকে প্রায় ৩৮১০০ বছর আগে থেকে ৪,০০০ বছর ধরে প্রস্তর যুগের মানুষেরা এখানকার আঠারোটি গুহাতে বাস করেছে। গুহার দেওয়াল ও ছাদে শিকারের ছবি এঁকেছে ১০০টিরও বেশি। আমরা আলতামিরায় যেতে পারিনি। কিন্তু স্পেনে এসে এসম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি।
নৃতত্ত্ববিদরা বলেন হোমো ইরেকটাস, নিয়েনতারথেল, ক্রো-ম্যাগননের স্তর পেরিয়ে আধুনিক চেহারার মানুষের বিকাশ হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকাতে। তখন তারা ছিল ফলমূল সংগ্রহকারী। তারপর তাদের রূপান্তর ঘটতে থাকল শিকারি হিসাবে। তারপর পশু পালনকারী হিসাবে। বহুকাল ধরে এরা ছিল অরণ্যচারী এবং ভ্রাম্যমান। এই মানুষদেরই একটি দল হয়তো ফলমূল, শিকার বা চারণভূমির সন্ধানে জিব্রালটার প্রণালী পেরিয়ে এই স্পেনে এসে গুহাবাসী হয়েছিল। আবার অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে আদিম মানুষেরা পূর্ব আফ্রিকা থেকে আনাতোলিয়া (তুরস্ক) হয়ে বসপোরস প্রণালী পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রিস, ইতালি, স্পেন ও রাশিয়ায়। আমরা স্পেনে এসে আদিম মানুষদের এই জীবন সংগ্রামের কাহিনির সঙ্গে আরও বেশি করে পরিচিত হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি। স্পেনে আমরা বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছি বার্সেলোনায়।
আমরা প্রাণভরে দেখেছি বার্সেলোনা বন্দর ও বিস্তৃত সমুদ্র সৈকতের রূপমাধুর্য। ফুটবল পাগল শহরে আমরা দেখলাম অলিম্পিক বন্দর। দেখলাম পাহাড়ের ঢালে ক্যাটালোনিয়া রাজপ্রাসাদ, রোমানদের তৈরি প্রাচীন শহরের অলিগলি, প্রখ্যাত স্থপতি গাউদির সারা জীবন ধরে এবং তারপরেও মোট ১৩৫ বছর ধরে নির্মিয়মাণ ‘গাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া’ নামে একটি গির্জা (ব্যাসিলিকা) হলেও কার্যত এ এক ভিন্ন ধরনের অসাধারণ স্থাপত্য। পুরোনো শহরের সুরক্ষা প্রাচীর ভেঙ্গে আড্ডা ক্ষেত্র (বুলেভার্ড) লারালা, যা সবাই পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে আটলান্টিক সাগর পেরিয়ে প্রাচ্যের জলপথের সন্ধানে ১৪৯২ সালে এই স্পেন থেকেই তিনটি ছোটো জাহাজে ১২০ জন নাবিককে নিয়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাস দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়েছিলেন। নাবিকদের বিজ্ঞাহে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে বসেছিল। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকার ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, বাহামা, কিউবা প্রভৃতি। আটমাস পরে তিনি ফিরেছিলেন এই বার্সেলোনা বদরে। এখানে রাজা ফার্ডিনান্ত ও রানি ইসাবেলা তাকে বীরের অভ্যর্থনা জানান। এখানকার আর একটি উত্তেযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা হল. জেনারেল ফ্রাস্কোর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-যুদ্ধ ভারতে হিটলারের বাহিনী ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল পার্শ্ববর্তী যান্ত অঞ্চলের ওয়ের্নিকাতে ভয়ংকর বোমা বর্ষণ করে। বীভৎস সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পাবলো পিকাসো ‘ওয়ার্নিকা’ নামে ছবিটি আঁকেন।
আমরা এখানকার এবং ইউরোপের সর্বত্র মানুষদের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার বহু পরিচয় পেয়েছি। ওদের মতে, মাতৃভাষাই নিজেদের বৈশিষ্ট্যের মূল পরিচয়। আমাদের দেশের তুলনায় ওখানে অনেক কম লোক ইংরেজি জানেন। কিন্তু সকলেই ব্যবহার করেন নিজের নিজের মাতৃভাষা।
বার্সেলোনাতে রয়েছে ভূমধ্যসাগরের জলজ জীবদের শ্রেষ্ঠ মিউজিয়াম। আমরা সেখানে ঢুকছি। সেখানে কত রকমের মাছ, কোরাল, জলজ প্রাণী, সবুজ চিংড়ি, পেঙ্গুইনদের সংসার। সমুদ্রের একাংশকে ঘিরে রয়েছে অ্যাকোরিয়ামের সবথেকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী। সমুদ্রের নীচে ফাইবার টানেলের মধ্য দিয়ে এসকালেটরে করে যেতে যেতে হাঙর, তরোয়াল মাছ, ক্যাটল ফিস, তারা মাছদের দেখার কী দারুন অনুভূতি! বিচিত্র ধরনের মাছের বাজার দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। তবে শুধু মুগ্ধ হওয়া নয়, আমরা চেখে দেখেছি বহু রকম মাছ ও সামুদ্রিক জীবের স্বাদ; যেমন অক্টোপাস, সালমন, ক্যাটল, সার্জিন, ঝিনুক, কুমির, সামুদ্রিক শ্যাওলা; নানা মাছের টুকরো দিয়ে তৈরি পিথেরা, তাপাস, পায়া ইত্যাদি।
অবশেষে আমরা ঢুকেছি ফ্রান্সে। গৌরবময় গণ-বিপ্লব ও সৌন্দর্যের পীঠস্থান ফ্রান্সের রাজধানীতে এসে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, তার জানালা দিয়ে দেখা যেত আইফেল টাওয়ারকে। এটি মানুষের তৈরি একমাত্র লোহার কাঠামো, যার দিকে মুগ্ধ চোখে ঘন্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা যায়। এখানে একঘণ্টা ছাড়া ছাড়া ৫ মিনিট ধরে মাঝামায় রঙিন আলোর অপূর্ব নৃত্য। এই টাওয়ারটি এখন হয়ে উঠেছে ফ্রান্সের প্রধান পরিচয় চিহ্ন। প্রতি বছর ধরে প্রবাহিনী সাইন নদীর পাশে দাঁড়ানো এই অভ্রভেদী টাওয়ারে টিকিট কেটে ওঠেন ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। অথচ ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে বিশ্ব উৎসবে যোগ দিতে আসা অতিথিদের স্বাগত তোরণ হিসাবে এরকম একটি টাওয়ার গড়ে তোলার জন্য মরিস কোয়েচলিন এবং এমিল নওগুয়েক যখন আইফেল কোম্পানির কাছে এর নক্সা পেশ করেন তখন প্যারিস জুড়ে বিদ্রুপের বান ডেকেছিল। এই স্বাগত তোরণের পাশেই ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে শুরু হয়েছিল সমাজতান্ত্রিকদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’। সেখান থেকেই আমেরিকাতে ১৮৮৬ সালে আঁটি ঘণ্টা কাজের সময়সীমা বেঁধে দেবার আন্দোলনের সমর্থনে প্রতি বছর ১ মে ‘মে দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আমরা একটি পুরো দিন ধরে দেখলাম বিশ্বের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালা মিউজিয়াম। প্রথমে এটি ছিল দুর্গ। তারপর হল বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদ। রাজারা প্রায় এক বছর ধরে ছিলেন চিত্রের সমঝদার। তারা চিত্রকর ও শিল্পীদের ভরণপোষণ করতেন। তবে এগুলি দেখার অধিকার ছিল কেবল রাজপরিবারের সদস্য ও উচ্চ অভিজাতদের। সাম্য, মৈত্রী স্বাধীনতার ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপ্লবী পরিষদ ১৭৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘোষণা করে। ফৈব্বরাচারী ষোড়শ লুই ও রানি মেরি আঁতিয়োনেত হাজার হাজার প্রতিবাদী নরনারীকে বাস্তিল দুখে বছরের পর বছর আটকে রেখেছিলেন, শত শত জনকে খুশিমতো গিলোটিনে হত্যা করেছিলেন, তাদেরও গিলোটিনে হত্যা করা হয়। কিন্তু একটিও শিল্পদ্রব্য নষ্ট না করে বিপ্লবীরা ১৯৭৩ সালে। মিউজিয়াম হিসাবে এটিকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। কেবল ২০১৭ সালে এই মিউজিয়ামটি দেখেছেন ৮১ লক্ষ মানুষ। আমরা এখানে দেখেছি লিওনার্দো-দ্যা-ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা। দেখলাম মিশরের প্রায় চারশো হাজার বছর আগেকার হায়ারোগ্লিফিক লিপি, যা তৈরি হয়েছিল প্রায় সব লিখিত ি ভাষার উৎস ফোনেশিয় লিপি থেকে।
লুতে মিউজিয়ামে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক গ্যালারিটিও বিশাল। এখানে আদিম মানুষদের ব্যবহৃত কত হাতিয়ার, শিল্পকলা, বাদ্যযন্ত্র, হস্তশিল্পের সমারোহ। মধ্যযুগের নৃপতিদের আস্ত তোরণ, নানা কারুকার্যের নিদর্শন এখানে শোভা পাচ্ছে।
আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম একটির পর একটি প্রশস্ত হল ঘরে আনাতোলিয়া (তুরস্ক), গ্রিস, মেসোপটেমিয়া ও মিশরের প্রাচীন সভ্যতা বিকাশের কত শত নিদর্শন এখানে যত্নের সঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে। আজকের দিনের অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন, আধুনিক মানুষের উদ্ভব যেমন হয়েছিল পূর্ব আফ্রিকাতে, তেমনই তাদের একটি অংশ বন্য, যাযাবর জীবনকে অতিক্রম করে প্রায় ৯,০০০ বছর আগে আদিম চাষ এবং তার অনুসঙ্গ হিসাবে স্থায়ী বাসের পত্তন করেছিল আনাতোলিয়াতে। আগে বন্য মানুষেরা ইঙ্গিত এবং নানা আওয়াজের মধ্য দিয়ে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করত। কিন্তু চাষবাসের জন্য দরকার হল আরও বেশি ভাব বিনিময়ের। এর ফলে ভাষার দ্রুত বিকাশ হল। তারপর মানুষ নানা কারণে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। কিন্তু তাদের ভাষাতে রয়ে গেছে তার চিহ্ন। তাই কিছু মূল শব্দ অধিকাংশ ভাষাতে একই রকম, যেমন বাংলাতে মা, জার্মানিতে মাট্রার, রুশ ভাষায় মটি, পার্শিতে মাডার, ইংরেজিতে মাদার, ল্যাতিনে মাটের, আরবিতে আম্মা, পোলিশে মাটকা। বর্ণমালাকে ইংরেজিতে বলা হয় আলফাবেট। কিন্তু আলফা মানে তো ষাঁড়, আর বিটা মানে ঘর। সুমেরিয়া বণিকেরা এবং ক্রিট দ্বীপ-সহ গ্রিসের নাবিকেরা কীভাবে চিত্রলিপি থেকে আজকের দিনে বহু ব্যবহৃত ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালা গড়ে তুলল, তারপর মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম, মিশরের হায়রোগ্লিফিক লিপির বিপুল বিস্তার ঘটল তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এখানে দেখেছি পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র গ্রিসের অতুলনীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। হোমার, আর্কিমিডিস, সক্রেটিস এবং অলিম্পিক খ্যাত গ্রিসকে এখানে অনন্য নিপুণতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এতে আমরা এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছি যে আমাদের পরবর্তী ইউরোপ ভ্রমণের অবশ্য গন্তব্য হবে গ্রিস এবং আনাতোলিয়া (যার বড়ো অংশটাই রয়েছে এশিয়া-ভূখণ্ডে)।
আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম মিশর ও মেসোপটেমিয়ার বিপুল প্রত্নসম্ভার, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের আঁকা অসাধারণ চিত্রকলা, দেওয়াল জোড়া ফ্রেসকো, বহু যুগ সঞ্চিত শিল্প ও ভাস্কর্য সম্ভার। কিন্তু আমরা একদিনে কতটুকু দেখেছি। কেননা এখানে যত দ্রষ্টবা আছে তার প্রতিটিকে যদি কেবল এক মিনিট করে দেখা হয়, তবে দেখতে সময় লাগবে ৬৪ দিন।
আমরা দেখলাম ৩০,০০০ শিল্পীর ৫০ বছর ধরে তৈরি (প্যারিস থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে জনবসতি উচ্ছেদ করে) রাজাদের নতুন বিলাস-ব্যাসনের লীলাভূমি ভার্সাইল রাজপ্রাসাদ। এত আড়ম্বর, এত বিলাসিতা এর আগে আর কোথাও দেখিনি। রাজার ‘হল অফ মিরর এবং অন্যান্য বিলাসবহুল প্রশস্ত কক্ষের পর কক্ষে দেওয়াল ও ছাদ জুড়ে বিখ্যাত শিল্পীদের সৃষ্টি অতি কারুকার্যময় অসংখ্য ঘর, যুদ্ধ চিত্র দেখে আমরা নির্বাক হয়ে গেছি।
এখানে বাছাই করা দার্শনিক ও বিপ্লবীদের সঙ্গে বসানো হয়েছে জোয়ান অফ আর্কের মর্মর মূর্তি, যিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করে সেনা সহায়তা নিয়ে অর্লিয়েন্সকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করেন। কিন্তু ফরাসি অভিজ্ঞাতরা তাকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়। পোপের আদেশে তাকে ডাইন বলে চিহ্নিত করে প্রকাশ্য বাজারে পিলারের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়।
চারদিকের দিগন্তবিস্তৃত বাগান-সহ রাজপ্রাসাদটি গড়ে উঠেছিল ৮.২ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে । এখানেই রাজার টেনিস কোর্টে বসেছিল জনসাধারণের প্রতিবাদী সভা। পরে ১৭৮৯ সালের ৫ অক্টোবর 6 এখান থেকেই রাজা-রানিকে প্যারিসে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদের বহু সাধের প্রাসাদটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল জনসাধারণের জন্য।
আমরা অনেকেই ভিক্টর হুগোর ‘হ্যাঞ্চব্যাক অফ নোেতরদাম’ পড়েছি। আমরা দেখেছি সেই নোতারদাম গির্জা, যার গঠনপ্রণালী একেবারেই ভিন্ন ধরনের। এখানেই পোপকে সামনে রেখে রাজমুকুট পরেছিলেন নেপোলিয়ন।
আমার দেখেছি প্যারিসের ব্যস্ত ১২ টি রাস্তার কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত বিজয় স্তম্ভ (ভিক্টি অফ ট্রিয়াম্ফ)। এটি তৈরি করেছিলেন নেপোলিয়ান। পরবর্তীকালে নেপোলিয়ানের দেহ সেন্ট হেলেনা দ্বীপ থেকে এখানে এনে সমাহিত করা হয়। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের যোদ্ধারা অন্যতম প্রধান প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন এখানেই। অবশ্য তখন এই স্তম্ভ ছিল না। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ব্যঙ্গচিত্র শার্লে এবদোর দপ্তরে হামলা চালিয়ে আল কায়দা সম্পাদকীয় দফতরের ১১ জনকে খুন করে। পরের সপ্তাহে নিয়মিত ৬০,০০০ কপির জায়গায় ৬টি ভাষায় ৭৯৫ লক্ষ কপি পত্রিকা ছাপা * হয়। আর ১১ জানুয়ারি এই বিজয় স্তম্ভ সহ প্যারিসের নানা জায়গায় ২০ লাখ নরনারী জমায়েত হয়ে ধ্বনি তোলেন ‘আমরাও শার্লে এবদো’। আমরা পরজন্মে স্বর্গ চাই না। এই জন্মেই পৃথিবীকে সুখ ও শাস্তির আবাস হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। বর্তমানে এটিই প্যারিসের ইয়োলো ভেস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি।
আমরা চড়েছি প্যারিসের চালকহীন ট্রেনে। দেখেছি বিখ্যাত মমার্ত, যেখানে শিল্পী, সাহিত্যিক ও চিত্রকরদের সাদ্ধা মজলিস বসে। মমার্ত থেকে প্যারিস মহানগরীর দৃশ্য অতুলনীয়। ইউরোপের যে বিষয়গুলি আমাদের বিশেষ নজর কেড়েছে তা হল এখানে নেই কোনও জাত-পাতের অস্তিত্ব। নেই তপশিলি জাতি, উপজাতি, ও.বি.সি. ইত্যাদি। • নেই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা খাদ্য নিয়ে কোনও বাছবিচার। ইদানিং ওখানে ঈশ্বর উদাসীন ও নিরিশ্বরবাদীর সংখ্যা বাড়ছে।
এখানে সাক্ষরতার ও ন্যূনতম শিক্ষার হার প্রায় ১০০ শতাংশ। এরা মাতৃভাষাকেই আত্মপরিচয়ের প্রধান চিহ্ন বলে মনে করে। নাগরিকরা এখানে অনেক বেশি গণতন্ত্র সচেতন ও উদার মনোভাবাপন্ন। মেয়েরাও এখানে পুরুষদের সমানতালে যোগ্য মর্যাদা নিয়ে কাজ • ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব সমানভাবে মা ও বাবারা করে চলেছে। শুরু থেকেই শিশুদের দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
এখন এইসব উন্নত দেশের বেশ কিছু মেয়ে মা হতে চাইছে না । এখানকার এক একটি দেশ ছোট্ট হলেও গুণমানে অনেক বড়ো দেশের থেকেও এগিয়ে আছে। এখানে উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার। উন্নত রুচিসম্মত অট্টালিকা, প্রশস্ত রাস্তা, দিনরাত যান-বাহন। মানুষের বেশি আয় ও বেশি ব্যয়। এরা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পর্কে খুবই সচেতন, সংযমী ও শৃঙ্খলাপরায়ণ। এখানকার কোনও দেশেই একটিও ট্রাফিক পুলিশ বা বাস-ট্রামের কন্ডাক্টর দেখলাম না। বয়স্ক নর-নারীরাও বেশ ফুর্তির সঙ্গে গান, আড্ডা, সাইকেল চড়া, মাছধরা নিয়ে মেতে থাকে। গান ও শিল্পকলা ও খেলা পাগল স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স। এই দেশের নেতারা তৃতীয় বিশ্বে বেসরকারীকরণ, উদারনীতির কথা বললেও নিজের দেশের মানুষের জন্য উন্নত সামাজিক সুরক্ষা বজায় রেখেছে। এখন কোথাও কোথাও পুঁজিবাদী সংকটের কবলে পড়ে এই সুরক্ষাকে সংকুচিত করার বা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ তৈরির প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে অসন্তোষ, গণবিক্ষোভ ও স্বচ্ছন্দে বাঁচার জন্য নতুন পথের সন্ধান।
প্রতিবেদক শক্তি মণ্ডল ‘সত্যেন মৈত্র জনশিক্ষা সমিতির সভাপতি এবং মায়া মণ্ডল একজন লেখিকা ও ভ্রমণ পিপাসু।
চিত্তপটে নাট্যভাবনা
কৃষ্ণপদ দাস
ভূমিকা ––
রুশ নাট্যকার লেবেডফের হাত ধরেই বাংলা নাটকের সূচনা – এ কথা কোনদিনই অত্যুক্তি হবে না । কেননা রুশদেশীয় নাট্যকার লেবেডফ এদেশে এসে এদেশের সংস্কৃতিতে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে এদেশের ভাষা শিক্ষা জরুরী বলে মনে করলেন । স্থির হল শ্রদ্ধেয় গোলকনাথ দাসের তত্ত্বাবধানে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করবেন । টানা সাত বছর ভাষা চর্চা করে শেষ পর্যন্ত তৈরি করলেন বাংলা নাটক । যদিও অনুবাদ নাটক – তবু বিদেশীর সৃষ্টি বাংলা নাটক তো বটে । নাটক দুটি ‘Disguise’ এবং ‘Love is the Best Doctor’. বাঙালী নাট্যকার হিসেবে প্রথমেই আসেন রামনারায়ণ তর্করত্ন বা নাটুকে রামনারায়ণ । তবে নাটকে আধুনিকতা এলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে । তারপর উঠল পালাবদলের ঢেউ । পরাধীনতা–বঙ্গভঙ্গ–বিশ্বযুদ্ধ–সাম্রাজ্যবাদ–যড়যন্ত্র মামলা–নিয়ন্ত্রণ আইন–ভাষা–সভ্যতা–সংস্কৃতি–কোম্পানির থিয়েটার–পেশাদারি থিটেয়ার–গণনাট্য–নবনাট্য–গ্রুপ থিয়েটার সর্বত্র । এই পালাবদলের সূরে আগুন জ্বালিয়েছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি । নাট্যকারের হাতে যখন এসব বিষয় ‘নাটক’ হয়ে উঠতে লাগল তখনই বিধিনিষেধের বন্যা ধেয়ে আসতে লাগল । তবু নাটক একাধারে আনন্দনায়ক এবং বার্তাবাহক – তাই নাট্যশিল্পকে বাঁচাতে লড়াইকে সঙ্গী করেই পথ চলেছেন নাট্যকারেরা । জীবনধর্মী শিল্পই যে আত্মার মুকুর । মানুষ যখন হাতুড়ি, ছেনি, বাটালি কিছুই ধরতে জানতে না – তখনও তার চোখে ছিল স্বপ্ন বা রূপকল্প । তখন তার ‘প্রযোজন’ আর ‘ইচ্ছা’র মাঝে দাঁড়িয়ে সে নিজের ভাবনা অনুযায়ী ‘ইচ্ছা’কে কাজ লাগিয়ে ‘প্রয়োজন’ মিটিয়েছে । সে হয়ে উঠেছে শিল্পী । আর শিল্প থেকে যে জীবনবোধ উঠে এসেছে সেই জীবনবোধেই ‘শিল্পী’ হয়ে উঠেছেন ‘নাট্যকার’ । এই পালাবদলের পথ মোটেই সুখকর ছিল না । তবি নাটক সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল । কেবল সেই কারণেই নাটক আর চারদেয়ালের মধ্যে বন্দী রইল না । মাঝে–মঞ্চে–পথে–ঘাটে জনপ্রিয় হয়ে উঠল নাটক । শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত এঁদের অবদান এই শিল্পের ভিতকে মজবুত করে গেছেন । গোটা ভারত জুড়ে যত বেশি রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলেছে ততই এসব অবলম্বন করে নাট্যশিল্প মানবমনের চৈতন্যের জাগরণ ঘটিয়েছে । আর সেই জাগরণের জোয়ারে ২১ শতকের নাট্যভাবনা চিত্তপটে স্থান করে নিয়েছে । )
একেবারে যদি একুশ শতকেই চলে আসি – তখনই দেখব নাটকের ক্ষেত্রে কত পরিবর্তন আসছে বিষয়-মঞ্চ-সংলাপ-উপস্থাপনা-পোশাক-নাট্যকারের ভাবনা সব ব্যাপারে । ৮০ দশকের নাট্যকার যাঁরা ছিলেন অর্থাৎ বাদল সরকার, মনোজ মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের মত বিদগ্ধজনেরা একুশ শতকে নাট্য-মহীরুহ হয়ে বিরাজ করলেন । নাট্য এবং নাটক গোটা বিষয়টাতেই অর্থাৎ উপস্থাপনার ভঙ্গিমাতেও বদল এল, বিষয়ের মধ্যেও বদল এল । নাট্যকারও নতুন এলেন । সব নাট্যকারেরাই যে নতুন এলেন হঠাৎ করে তা বলা যায় না । অনেক পুরানো নাট্যকার যাঁরা ছিলেন বিশেষ করে আশির দশকে – নব্বই-এর দশকে যাঁদের উত্থান এবং সত্তরের দশক থেকেও যাঁদের উত্থান এবং আশির-নব্বই-এর দশকে যাঁরা রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং তাঁদের বহু নাটক প্রবাদ-প্রতিম হয়ে রয়েছে, সেই সমস্ত নাট্যকার যাঁরা প্রধান হয়ে পড়েছেন একুশ শতকে এসে, সেই নাট্যকারদের কথা আমাদের উল্লেখ করতে হবে । তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন নাট্যকারদের পাব । এই দুইয়ের মিশেলে বাংলা নাটক কিন্তু অনেক সমৃদ্ধ হলো । এবার প্রবীণ নাট্যকারদের মধ্যে যাঁদের কথা না উল্লেখ করলেই নয় – তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসবে – বাদল সরকার, তারপর আসবে মোহিত চট্টোপাধ্যায় । এঁরা যদিও একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত দুজনেই জীবিত ছিলেন । একজন মারা গেলেন ২০১১-তে, অপরজন মারা গেলেন ২০১২ সালে । কাজেই প্রথম একটা দশক কিন্তু তাঁরা সক্রিয় ছিলেন । ২১ শতকের প্রথম দশকে মোহিত চট্টোপাধ্যায় ও বাদল সরকার রীতিমত প্রৌঢ় । শেষ অবস্থায় তাঁরা যে খুব দাগ কেটেছেন এমন বলাও যায় না । কিন্তু তাঁদের উপস্থিতিটাই আসলে আমাদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় এবং উজ্জ্বল বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে । আরেকজনের নাম করতে হয় এই সময় । তিনি হলেন – মনোজ মিত্র । তিনিও প্রৌঢ় হয়ে পড়েছেন এবং জীবিত আছেন এখনও । তবে একুশ শতকের প্রথম দশকে তাঁর বেশ কিছু নাটক আমরা পেয়েছি । তাঁর নিজের দল সুন্দরম্ ।
18
সেই দলে তিনিও অভিনয় করেছেন চুটিয়ে প্রথম দশকে । দ্বিতীয় দশক থেকে তিনি ক্রমে ক্রমে আরো প্রৌঢ় ও বার্ধক্যজনিত কারণে কমিয়ে দিয়েছেন তাঁর এই সমস্ত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ । এছাড়া, যে সমস্ত নাট্যকাররা এলেন – তাঁদের মধ্যে প্রথমেই চন্দন সেনের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় । চন্দন সেন তাঁদের মধ্যে খুবই উল্লেখযোগ্য নাম । তারপরে একঝাঁক নতুন নাট্যকার এলেন এই একুশের দশকের প্রথম দশকে এবং প্রতিষ্ঠা পেলেন । তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন – ব্রাত্য বসু, তীর্থঙ্কর চন্দ, উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় এবং একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আরো দু-একজন নাট্যকার প্রতিষ্ঠা পেলেন – তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন – কৌশিক চট্টোপাধ্যায় আর অন্যান্যরা হলেন অধিকারি কৌশিক, কৌশিক কর, সুভাষিক খামারু – এই তো গেল – নাট্যকারদের সম্পর্কে কথা । এরপর যাদের কথা বলতে হয় তাদের কথা না বললেই নয় । তাঁরা হলেন একঝাঁক অভিনেতা – অভিনেত্রী । যাঁরা এই সময়ে বাংলা নাটককে নাড়িয়ে দিলেন, কাঁপিয়ে দিলেন । তাঁদের অবদান যে খুব বেশী সেকথা বলতেই হয় । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিনেতা ছিলেন – দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, ব্রাত্য বসু নিজে । এই রকম একঝাঁক নতুন অভিনেতা – অভিনেত্রী, যাঁরা বাংলা নাটককে দিশা দেখালেন । বিজয়লক্ষ্মী বর্মন, আরেকজন উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী । কৌশিক সেন এঁরা আসতে লাগলেন বাংলা নাটকের জগতে । কাজেই এদের কথা বলতে হবে আমাদের । বিশ শতকের প্রথম দশকে এঁরা এলেন । বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে নতুন নতুন নাট্যদলও এলো, যাঁরা তাঁদের প্রথম প্রযোজনতাই চমকে দিয়েছেন – সেই রকম নাট্যদলের কথা উল্লেখ না করলেই নয় । ‘বেলঘরিয়া অভিমুখ’ – তাঁদের অন্যতম একটি নাটক এবং তাঁদের প্রথম প্রযোজনা – ‘কোজাগরি’ । দু হাজার ষোল – সতেরো সাল নাগাদ নির্মিত । সেই ‘কোজাগরি’ দিয়ে তারা বাংলা নাটকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়েছেন – চমকে দিয়েছেন এবং সেই কোজাগরির মাধ্যমেই নাট্যকার কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের উত্থান বলা যেতে পারে । এই হল একুশ শতকের বাংলা নাটকের নাট্যভিনয়ের যে গতিপ্রকৃতি তার প্রাথমিক একটা চিত্র আমরা এখানে এঁকে নিলাম । এইবার আমরা পরপর আলোচনা করবো সেই সমস্ত নাট্যকার – অভিনেতার অবদান কী কী ? তার আগে, যাঁদের নাম আমরা এই প্রসঙ্গে আলোচনা করলাম – তাঁদের নাটকগুলো বিস্তারিত বলতে থাকবো ।
নাট্যচর্চা একটা প্রক্রিয়া – একটা পদ্ধতি । কাজেই একুশ শতক নিয়ে বলতে গেলে বিশ শতকের নাট্যচর্চার যে ধারাবাহিকতা ছিল, সেটাই একুশ শতকে এসে পৌঁছেছে । একুশ শতকে যাঁরা নাট্যকার – নাটক রচনার দিক থেকে বলা যায় প্রধান ভূমিকায় এলেন – পুরোনো এবং নতুন মিলে, তাঁদের মধ্যে দেখা গেল – যে বিশ শতকের উপান্ত থেকে যাঁরা থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন – তাঁরা একুশ শতকে এসেও বিশ্রাম নেননি । তাঁরা তখনও তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন । একই সঙ্গে একুশ শতকে আরও অনেক নতুন নতুন শক্তিশালী নাট্যকার, শক্তিশালী নির্দেশক, শক্তিশালী অভিনেতা – বাংলা থিয়েটারকে সমৃদ্ধশালী করে চলেছেন । অর্থাৎ পুরোনোর ধারাবাহিকতা এবং নতুনের আগমন এই দুইয়ে মিলে বাংলা থিয়েটার একটা নতুন ধরনের সমৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে । এই ব্যাপারে প্রাচীন পন্থীদের হা-হুতাশ করার কোন অর্থ হয় না । কেননা দেখা যায় যে, উনিশ শতকে যাঁরা নাট্য চর্চা করতেন, তাঁরা বিশ শতকের যাঁরা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদেরকে প্রাথমিকভাবে আদর করতে পারেননি, সমর্থন করতে পারেননি বা তাঁদের সমর্থন করতে দ্বিধা ছিল । তাঁরা চাইতেন না সেই সময় বাইরের কোন লোক এগিয়ে আসুক । বাংলা নাট্যচর্চাকে একটা কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা সেই প্রধানদের ছিল ।
19
প্রধান নাট্য নির্দেশকরাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করেও তাঁরা নাটককে তাঁদের মতো করে বদলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন, তাঁদের সংখ্যাও কম নয় । যাঁরা পারলেন না তাঁরা হারিয়ে গেলেন । বিশ শতকের পর একুশ শতকে তাঁদের মধ্যে নতুন নাম আর পাওয়া গেল না । আর যাঁরা পারলেন, তাদের দেখা গেলে যে – নতুন সময়ের অভিঘাতে তাঁরা নিজেদের বদলে নিতে সক্ষম হলেন । যে পরিবর্তন করা দরকার, সেই পরিবর্তন করলেন তাঁরা । আবার একই সঙ্গে নতুন নাটক লিখছেন যাঁরা, তাঁরাও কিন্তু সেই পুরোনো নাট্যকারদের দেখে উদ্দীপিত হলেন । তাঁরা প্রবীণদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের মতো করে নতুন ধরণের নাটক লিখছেন । কাজেই বিশ শতকের প্রাচীনপন্থী যাঁরা, তাঁরা কিন্তু নতুনদের একটা পথপ্রদর্শক হয়ে উঠলেন । এটা একটা সুস্থতার লক্ষণ । এটা বোঝা গেল যে, একুশ শতকের বাংলা থিয়েটারের নাটক কোন অবস্থাতেই হীনবল হয়ে পড়েনি । বাংলা থিয়েটারের প্রচার কম – তা সত্ত্বেও বাংলা থিয়েটার ভারতবর্ষীয় প্রেক্ষাপটে তার বহুমাত্রিকতা পরিচয় রেখেছে । যার ফলে, একুশ শতকে বাংলা নাট্যচর্চার দিক থেকে তিনটে প্রধান ব্যাপার উল্লেখযোগ্য বলা যেতে পারে । (১) ঊনিশ শতক থেকে বিশ শতকের শেষ দিকে নাটকের ধারাবাহিকতা দেখা গেল দীর্ঘ সংলাপ পরিবর্তিত হয়ে আঁটোসাঁটো হল । অর্থাৎ দীর্ঘ সংলাপ কমে যাচ্ছে । প্রয়োজনীয় সংলাপ উঠে আসছে । আঁটোসাঁটো হচ্ছে সংলাপ । (২) মঞ্চপ্রীতি । মঞ্চ উপকরণের ক্ষেত্রে অনেকটা পরিবর্তন হলো । অর্থাৎ ঊনিশ শতক – এমন কি বিশ শতকের অনেকখানি জায়গা জুড়ে মঞ্চ ব্যবহার অনেকটা প্রাচীন ছিল সেটাকে পরিবর্তন করে নতুন ধারা আনা হলো । একুশ শতকে এসে সেটা আরো নবীন হলো । মঞ্চের ব্যবহার আরো অগ্রসর হলো বলা যায় । খুব অল্প বলে, অনেক বেশি বোঝানোর একটা প্রবণতা একুশ শতকে আমরা দেখতে পাচ্ছি । আর তাছাড়া, থিয়েটার এমন একটা শিল্প – সেখানে কম কথা বলে, কম জায়গা দেখিয়ে – কম দৃশ্যপট দেখিয়েও দর্শকদের কল্পনার জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং সেই দর্শকরা সব বুঝে নিতে সক্ষম হবে – ফলে দৃশ্যপটের একটা পরিবর্তন এল । সেটা নাট্যাকাররা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলেন । তার ফলে, একটা স্পেসকে কখনো বাজার বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে, রাজসভা বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে – পুকুর বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যা ইচ্ছে তাই বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে । ফলে, একুশ শতকে সেট ডিজাইন এবং মঞ্চে তার প্রয়োগের একটা অভিনবত্ব বলা যেতে পারে । আর এই কারণেই, একুশ শতকের নাট্যকাররা আলাদা করে আর ভাবতে দিলেন না একই সঙ্গে এতগুলো জটিলতা মঞ্চে আনা সম্ভব কিনা । সম্ভব যে, সেটা দেখালেন তাঁরা ।
21
এই প্রসঙ্গে চন্দন সেনের ‘কর্ণাবতী’ – নাটকের উল্লেখ করা যেতে পারে । নদী, পাহাড়, মরুভূমি একই সঙ্গে দেখবার চেষ্টা করছেন – নাট্যকার । সেই একটা জটিলতা তৈরি করেছিল । মেঘনাদ ভট্টাচার্য – তাঁর দল সায়কে এটা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন । সেটা সেই সময় খালেদ চৌধুরীর মতো প্রাতঃস্মরণীয় মঞ্চকার – তিনি এই কাজটা করে দেখিয়েছিলেন । এক সাক্ষাৎকালে চন্দন সেন জানিয়েছেন, খালেদ চৌধুরী চন্দন সেনকে বলেছিলেন, একই মঞ্চে এতগুলো জিনিস পাহাড়, নদী, মেলা কী করে করা সম্ভব ? সেটা মজা করে তিনি চন্দন সেনের কাছে বলে ছিলেন । কিন্তু খালেদ চৌধুরী কাজটা করতে পেরেছিলেন । এতে তাপস সেন আলো করেছিলেন । সেও এক আশ্চর্য আলো । খালেদ চৌধুরীও তাপস সেন দুজনে মিলে বাংলা নাটকের একটা যুগলবন্দী তৈরি করলেন সেই সময় । এই ‘কর্ণাবতী’ – নাটকে সেটা একটা ম্যাজিক তৈরি হয়েছিল । তবে নাট্যকার যদি এই একুশ শতকে নাটকটি লিখতেন, তবে নিঃসন্দেহে আরো নতুন কোন পরিচালক যদি পরিচালনা করতেন – তাহলে যে ডিজাইন কর্ণাবতী করতে গিয়ে খালেদ চৌধুরী ও তাপস সেনের যে যুগলবন্দী হয়েছিল তাঁদের তা হয়তো অন্যরকম হতে পারতো । অন্যভাবে হতে পারতো । নাট্যকারও এই কথা বিশ্বাস করেন । কারণ একথা আমরা বলতেই পারি, কেন না এই সময়ে দিল্লীতেও একটি দল কর্ণাবতীর অনুবাদ হিন্দীতে করিয়ে অভিনয় করেছিল । এবং তারা কিন্তু এই সময় দাঁড়িয়েও আশ্চর্যভাবে এই নাটকটি উপস্থাপিত করেছিল । খালেদ চৌধুরী ও তাপস সেনের চিন্তা ধারা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে তাঁরা কিন্তু তাঁদের মতো করে এই নাটকটি প্রয়োগ করেছিলেন । কাজেই বিশ শতকেও আমরা এই নাটক দেখেছি, একুশ শতকেও তা অভিনীত হচ্ছে – তখন কিন্তু একই Text, অথচ একই সঙ্গে ভাবনা-চিন্তার বদল হচ্ছে – নির্দেশকের ভাবনা-চিন্তা । সেই জন্য নব-নির্মিত হচ্ছে বলা যেতে পারে একুশ শতকের নাটক । এই নাটকটি মেঘনাদ ভট্টাচার্যের অন্যান্য নাটকের সঙ্গে কোন মিল ছিল না, কিন্তু এই কর্ণাবতী নাটকটি একেবারে আধুনিক হয়ে উঠেছিল । তার ফলে, এই সময় দাঁড়িয়ে সব কিছুই নির্মেদ হতে শুরু করল বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে । যত কম সময়ের মধ্যে অনেক কম কারুকৃতি দেখিয়ে অনেক বেশি দর্শককে মনোরঞ্জন করানো যায় – সেটা কিন্তু এই একুশ শতকের নাটক করে দেখালো ।
তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার এই আলোচনা প্রসঙ্গে, তা হল একুশ শতকের প্রথম দশক বামফ্রন্ট সরকারের চলে যাওয়ার সময় । এই সময় আর মনে করা চলছিলো না যে আমরা সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে গেছি । বরং কোন কোন নাট্যকারের নাটককেও ‘সেন্সর’ করবারও চেষ্টা দেখা যাচ্ছিলো ।
22
আগে রাজনৈতিক নাটক অনেক বেশি করে লেখা ও অভিনীত হচ্ছিলো, কিন্তু এই সময়ে শাসক কি ভয় পেল নিজেদের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে ? তবে কোন কালেই কি শাসকের চোখ রাঙানিকে ভয় পেয়েছে নাটক ও নাট্যকার ? তাই কোন কোন নাট্যকার চেষ্টা করলেন আবার মঞ্চে রাজনৈতিক নাটককে ফিরিয়ে আনবার । এক্ষেত্রে চন্দন সেন, অশোক মুখোপাধ্যায় বা তীর্থঙ্কর চন্দ-র কথা বলা যায় । চন্দন সেনের ‘দুই হুজুরের গপ্পো’ কিম্বা অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘বেলা অবেলার গল্প’ এগুলোতে পলিটিক্যাল আণ্ডারটোন আছে । সব ভয়কে উপেক্ষা করেই তাঁরা এই সময়ের রাজনীতির কথা তুলে আনছেন নাটকে । বর্তমান গবেষকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নাট্যকার চন্দন সেন এই বিষয়ের চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন।তিনি জানিয়েছেন—“আমি ‘দুই হুজুরের গপ্পো’ লিখছি । কিন্তু তার আগে বিভাসদার’ মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ বা আমার ‘দায়বদ্ধ’ অসম্ভব জনপ্রিয় নাটক । এই নাটকগুলো কিম্বা অশোকদার ‘বেলা অবেলার গল্প’ এর মধ্যে পলিটিক্যাল আণ্ডারটোন আছে । পরে যখন নাটক লেখা হচ্ছে তখন তার মধ্যে ফ্যামিলি ম্যাটার, রূপক, রূপকথা, কল্পনা এগুলো আসতে লাগলো।তার ফলে রাজনৈতিক নাটকের অত্যন্ত আকাল দেখা দিলো একটা সময় । একটা সময় আমি, তীর্থঙ্কর চন্দ সীমিত ভাবে আবার রাজনৈতিক নাটক লেখার চেষ্টা করলাম।তার ফলে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি হল । অর্থাৎ দেখা গেল আমার একটি নাটক যা এই সময়ের রাজনীতিকে, রাজনৈতিক সুবিধেবাদকে আক্রমণ করে লেখা হচ্ছে,তখন আমি একজন বামপন্থী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার নাটককেও সেন্সর করার চেষ্টা করা হচ্ছে । এ ঘটনাগুলো ঘটেছে।বামফ্রন্টের আমলেই ঘটেছে ।” ১
এর পর পরই বাংলা নাট্যমঞ্চে ব্রাত্য বসু একটি নতুন সুর নিয়ে এলেন ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকের মধ্যে দিয়ে । এই নাটকটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে গেল । মানুষ শুনতে চান শাসক নির্বিশেষে শোষণের বিরুদ্ধে, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা । এ দিক থেকে একটা নতুনত্ব নিয়ে এলেন ব্রাত্য বসু তাঁর নাটকে এবং অবশ্যই বাংলা থিয়েটারে । এই নতুনত্ব অবশ্যই স্বাস্থ্যকর। এর পর একে একে তিনি লিখে গেছেন রাজনৈতিক নাটক ।
এর পর বাংলার রাজনীতিতে ও ভারতবর্ষের রাজনীতিতে যখন পালাবদল ঘটে গেল তখন আবার আমাদের রাজনৈতিক নাটকের ভাটা দেখা দিল । আর কোন দিক থেকেই রাজনৈতিক নাটক করার অনুকুল পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে না।তার নানাবিধ কারণ । আসলে শাসকের কাছে থিয়েটার সব সময় বিপজ্জনক । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে থিয়েটার কোন দিনই রাজ- প্রসাদ বা রাজানুগ্রহ পায় নি । রাজারা সব সময়ই মনে করেন যে থিয়েটার মানেই তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির জায়গা। ফলে বাম সরকারের শেষ দিকে যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে নাট্যকারদের যেতে হয়েছিলো, পালাবদলের পরও চিত্র কিছু বদলালো না থিয়েটারের ক্ষেত্রে । বরং থিয়েটারে একটা বিভাজন দেখা দিল । যারা বর্তমান তৃণমূল সরকারকে সমর্থন করেছিলেন সেই নাট্যকারেরা এক ধরণের নাটক করতে শুরু করলেন আর যারা সমর্থন করেন নি তাঁরা নাটক করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হলেন । সে বাধা অলিখিত । বোঝা যায় কিন্তু সহ্য করা যায় না।দেখা গেল সরকার নিয়ন্ত্রিত নাট্য একাডেমি আর নিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করতে পারলো না । যার শুরু হয়েছিলো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শাসনের শেষ সময় থেকে । যদিও বুদ্ধদেব কখনো চান নি থিয়েটার রাজনীতির দ্বারা চালিত হোক।তাঁর স্বপ্নকে ভেঙে দিচ্ছিল নাট্য একাডেমি বা মিনার্ভা নাট্যচর্চাকেন্দ্রের কিছু কিছু ভূমিকা । আর পালাবদলের পর সেটা আরো নগ্ন হয়ে গেল । ফলে নাট্য একাডেমিতে কোন প্রবীণ মানুষ রইলেন না, যাঁরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেন।যাঁরাও বা রইলেন তাঁদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ । কাজেই সমগ্র ভাবে একুশ শতকের বাংলা নাটক ও নাট্যচর্চা দলদাসের চর্চায় পরিণত হয়েছে।
23
পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও থিয়েটার তার জন্য কিন্তু থেমে থাকে নি।নিজের খাতে বয়ে চলেছে থিয়েটার । দলবৃত্তির আধিপত্যের মধ্যে যাঁরা অন্য রকম ভাবনার নাটক করতে সচেষ্ট হলেন তাঁদের এ ক্ষেত্রে কিন্তু বাধা দেওয়া হয় নি।কারণ বাধা দেওয়া হলে অন্য ধরণের লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিলো । সেই লড়াইয়ের ব্যাপকতা অনেক বেশি হতো।কারণ মহানগরের বাইরেই তো সিংহভাগ থিয়েটারের দল । তাঁরা বেশির ভাগই শাসকের সুরে সুর মেলান নি । তাঁরা ভাবেন অন্য ভাবে।শাসক তা জানতেন নিশ্চয়ই । তাই বাধা দেওয়ার কথা ভাবেন নি । একবার ‘নাট্যসুজন’ তৈরী করে সে শক্তি পরখ করে নিতে চেয়েছিলেন শাসক শিবির । কিন্তু ফল হয়েছিলো উল্টো । কিছুদিনের মধ্যে নিজেদের মধ্যে মতান্তর হয়ে তারা নিজেরাই ভেঙে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লো । মূল চালিকাশক্তি স্বতন্ত্র স্বর নিয়ে বেঁচে রইলো আজ অবধি ।
একুশ শতকের বাংলা নাটক ও নাট্যাভিনয়ের আরো কিছু গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করা যায় । একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মূলত বাংলা নাটকে নতুনভাবে আবার লেখা ছিল ‘কোম্পানি থিয়েটার’ শব্দটি । বাংলা থিয়েটারের প্রথম পর্যায়ে এই কোম্পানি থিয়েটার জাঁকিয়ে বসেছিল । অর্থাৎ একজন ব্যক্তিমালিক এই থিয়েটারকে নিয়ন্ত্রণ করবেন । তিনি তাঁর পছন্দ মতো অভিনেতা, পরিচালক, কর্মী নিয়োগ করবেন এবং নাট্য প্রযোজনা করাবেন তাঁদের দিয়ে । তার বিনিময়ে তারা মাস-মাইনে পাবেন । আর ঐ প্রযোজনার সম্পূর্ণ লভ্যাংশ থাকবে ঐ ব্যক্তিমালিকের । আমরা এ প্রসঙ্গে মনে করতে পারি প্রতাপচাঁদ জহুরির কথা । তাঁর থিয়েটারের নামও ছিল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ অধ্যাপক দর্শন চৌধুরী এই থিয়েটার সম্পর্কে বলেছন –
“প্রতাপচাঁদের ন্যাশনাল থিয়েটার পুরোপুরি পেশাদারি থিয়েটার এবং বাণিজ্যিক থিয়েটার ।” ২
অধ্যাপক চৌধুরী এই ব্যক্তিমালিকানাধীন থিয়েটারের ধরণ সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে বলেছেন –
“গ্রেট ন্যাশনাল …… বাংলা থিয়েটারকে রক্ষা করেছিল ।” ৩
গ্রেট ন্যাশনাল নীলামে উঠলে প্রতাপচাদ ২৫ হাজার টাকায় কিনে নিলেন । ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে । অবাঙালি ব্যবসাদার প্রতাপচাঁদ জহুরি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের বাড়িতে চালু করলেন ন্যাশনাল থিয়েটার । এই প্রথম একজন পাকাপোক্ত ব্যবসায়ী বাংলা রঙ্গালয়ের মালিক হলেন । তার আগে বেঙ্গল থিয়েটারের শরৎচন্দ্র ঘোষ কিংবা গ্রেট ন্যাশনালের ভুবনমোহন নিয়োগী-পুরোপুরি ব্যবসাদার ছিলেন না । বা বলা যেতে পারে, একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে রঙ্গমঞ্চের মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব নেননি । প্রথমে ছিল নাটক অভিনয় করা এবং অভিনয়ের উন্মাদনা ভোগ করা । তারপরে শখ শৌখিনতা এবং সবশেষে আর্থিক লেনদেনের ব্যবসা । যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শেষেরটি গৌণ হয়ে পড়েছিল।
24
কিন্তু প্রতাপচাঁদ ঝানু ব্যবসায়ী । তার অন্যত্র জহরতের দোকান এবং অন্য নানাধরনের ব্যবসা ছিল । সে দেখেছিল, অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো বাংলা থিয়েটারেও ভালো ব্যবসা করা যায় । টাকা লগ্নী করা এবং ঠিকমতো পরিচালনার মাধ্যমে সেই লগ্নীকৃত টাকা ফেরত আনা-মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে বেশি করে মুনাফা লোটা–ব্যবসায়ের এই সাধারণ সূত্র তিনি থিয়েটারে প্রয়োগ করলেন । তিনি দেখেছিলেন, লোকে থিয়েটার দেখে পয়সা দিয়ে । তাদের উৎসাহিত করে থিয়েটারে বেশি বেশি আনতে পারলে টিকিট বিক্রি বেশি হবে । ফলে লগ্নীকৃত মূলধন সহজেই বহুগুণ হয়ে ফিরে আসবে ।
কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থাটিকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, আগের অনেক মালিকের মতোই তাকেও লোকসান দিয়ে ব্যবসা চালাতে হবে । তাই একটি নিয়মবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মতো তিনি থিয়েটারের প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখলেন । কর্মচারীদের নির্দিষ্ট বেতন, হাজিরা খাতা, আয়-ব্যয়ের হিসাব-সবই পেশাদারিভাবে চালু করলেন । এই নিয়মের আওতা থেকে কারও রেহাই ছিল না, সে অভিনেতা-অভিনেত্রী, ম্যানেজার, নাট্যকার কিংবা দারোয়ান, যেই হোক না কেন ।
এই থেকেই বাংলা থিয়েটারে পাকাপাকিভাবে পেশাদারি থিয়েটার বা ব্যবসায়িক থিয়েটার তার প্রথাসিদ্ধ পথ খুঁজে পেলো । মালিকানাধীন এবং মুনাফাভিত্তিক পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাংলা রঙ্গালয়ের নতুন যুগ শুরু হয়ে গেল । পূর্ববর্তী সাধারণ রঙ্গালয়গুলির মধ্যে এই পেশাদারিত্ব কিংবা বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি এত প্রখরভাবে ছিল না । প্রতাপচাঁদ বাংলা থিয়েটারে সেটিই যথাযথভাবে চালু করলেন ।
ব্যবসা পরিচালনার নিয়মনীতি এবং শৃঙ্খলা থিয়েটারে প্রয়োগ করা হলো । রঙ্গালয়ের ভিতর ও বাইরে এই প্রথম নিয়মশৃঙ্খলা প্রবর্তিত হল । ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো থিয়েটারও একটি প্রতিষ্ঠান—এর ভালোমন্দ, লাভ লোকসান সবই নির্ভর করে তার সুষ্ঠু ও যথাযথ পেশাদারি প্রথা, মনোভাব ও প্রয়োগের উপর ।
25
এইরকম একটি থিয়েটার-প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য একজন যোগ্য ম্যানেজারের দরকার । তিনি জানলেন, সেই সময়ে থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র সেই যোগ্যতম ব্যক্তি । গিরিশ তখন পার্কার কোম্পানিতে ১৫০ টাকার চাকুরি করেন । তাকে ১০০ টাকা বেতন দিয়ে ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার করে আনা হল । সঙ্গে বাড়তি বোনাস । গিরিশ চাকুরি ছেড়ে এই প্রথম থিয়েটারকে তার জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করলেন । বাংলা থিয়েটারে ‘এমেচারিস’ গিরিশ এই প্রথম পুরোপুরি ‘প্রোফেশনাল’ হলেন ।
প্রতাপচাঁদ ও গিরিশচন্দ্রের যোগাযোগের ফলে পেশাদার বাংলা থিয়েটারের ভিত্তিটি মজবুত হল । এই দুজনে মিলে পেশাদার থিয়েটার পরিচালনার যে সব নিয়মনীতি চালু করলেন, পরবর্তী বহুদিন সেই ধারাই বাংলা থিয়েটারে চলে এসেছে । বাধাবন্ধহীন উচ্ছলতায় বাংলা থিয়েটার যখন ভেসে যেতে বসেছিল, যাকে অভিনেত্রী বিনোদিনী বলেছে ‘অশুভ গ্রহ’, সেই সময়ে এই দুজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দৃঢ়বদ্ধ নিয়মনীতি প্রায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মতো করে বাংলা থিয়েটারকে রক্ষা করেছিল ।
আসলে একজন পাকা ব্যবসায়ী এবং একজন শক্তিশালী অর্থাৎ প্রতিভাশালী নাট্যশিল্পীর সমন্বয়ে তৈরী হলো এই পেশাদারী থিয়েটার । এই তো কোম্পানি থিয়েটার । তবে সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে এক সময় কোম্পানির থিয়েটার লুপ্ত হয়ে যায় সেখানে আসে গণনাট্য সংঘ । তারপর গ্রুপ থিয়েটার । এখন বর্তমানে গ্রুপ থিয়েটারের সাথে সাথে আবার কোম্পানি থিয়েটারের এই ধরণের বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে । এক্ষেত্রে মূলত ব্রাত্য বসুর নাম অগ্রগণ্য । যেমন ভাবে প্রতাপচাঁদ জহুরি ও গিরিশ ঘোষের যুগলবন্দী দেখা গেছিলো । সেই ধাঁচেই বর্তমানে কোম্পানির থিটেয়ার নির্মিত হচ্ছে । তবে একথা মূলগত পার্থক্য বর্তমানে লক্ষ্য করা যায় । তা হল, আগে সরাসরি কোন ব্যবসায়ী হাত ধরতেন নাট্যশিল্পীর । আর এখন প্রযোজক একজন থাকেন বটে তবে তিনিই মূলত নাট্যশিল্পী । তবে সেই প্রযোজক অবশ্য অন্য কোন ব্যবসায়ীর সাহায্য নিতেই পারেন । এ বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় ব্রাত্য বসুর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল । সেখানে তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে তাঁর থিয়েটার সম্পূর্ণ কোম্পানি থিয়েটার । আমরা সে সাক্ষাৎকারে সমগ্র অংশই এখানে তুলে ধরলাম । যাতে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করি আমরা ।
“ঢেউ উঠেছে, বেড়া ভাঙছে
. . . . . . . . উল্লাসটা অস্বীকার করি কী করে ?” ৪
26
তবে মোদ্দা কথা হ’ল থিয়েটার । সে যে ভাবেই হোক । ‘গণনাট্য’- তাঁদের একটা দর্শন ছিলো । গ্রুপ থিয়েটারও তাই । আর কোম্পানির থিয়েটারে এসে জুড়লো অর্থ । অর্থাৎ বাণিজ্য ও নাটক হাত ধরাধরি করে চলুক – এটাই তাঁদের চাওয়া । তাতে শিল্পীদের যেমন ভালো হলো, তেমনি নাট্য-মানের উত্তুঙ্গতা দেখা দিল । তবে এ ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হ’ল বাজার । থিয়েটারের বাজার খুবই ছোট । অল্প দর্শক তার । কাজেই কতদিন এই পেশাদারিত্ব রাখা সম্ভব হবে তা এক মাত্র সময়ই বলবে । তবে এই প্রবণতা স্বাস্থ্যকর বাংলা থিয়েটারের জন্য ।
বাংলা থিয়েটার শুরু থেকেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে । আজ একুশ শতকে এসে তা আরো প্রবল হয়েছে । এই সময়ের অনেক প্রবণতার কথা আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি । তবে আরো এক ধরণের নাট্যচর্চার কথা না বললেই নয় । তা হ’ল নাট্যগ্রাম নির্মাণ করে নাট্যচর্চা অন্যান্য প্রদেশের সাথে সাথে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও ‘থিয়েটার ভিলেজ’ বা ‘থিয়ে-ভিলেজ’ বা নাট্যগ্রামের নাট্যচর্চার একটা বহমানতা রয়েছে । এই দশকে তা অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে কী এই থিয়েটার ভিলেজ ? নাটকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত কিছু মানুষ যাতে আরো ভালোভাবে নাটকটাই করতে পারেন তার জন্য তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে কোন একটি গ্রামের কিছু জমিতে চাষ বাস করে, পুকুরে মাছ চাষ করে কিম্বা ক্ষেত্রে সব্জী ফলিয়ে তার লভ্যাংশের কিছু অংশ পরিবারে দিয়ে এবং কিছু অংশ নাটকের কাজে ব্যয় করে জীবিকা ও শিল্প – দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়ে শিল্পচর্চাকে অগ্রাধিকার দেন, তাই হল থিয়েটার ভিলেজের ধারণা । আর্থাৎ থিয়েটার করতে গিয়ে কোথাও যেন পরিবার প্রতিপালন করতে অসুবিধে না হয় তাই তাঁরা বিকল্প জীবিকার সন্ধান করেন এবং এতে তাঁরা সফলও হন । আসলে থিয়েটারের লক্ষ্যে জীবিকা অর্জনে ব্যাপারটি প্রবেশ করল । কারণ আমাদের দেশে এখনো থিয়েটারকে পুরোপুরি পেশা করবার মতো পরিস্থিতি নেই । তাই থিয়েটার করে সংসার চালানো সম্ভব নয় । সেই কারণে মন দিয়ে থিয়েটার করতে গেলে বা সর্বক্ষণ থিয়েটার চর্চা গেলে একটা সুনির্দিষ্ট রোজগার দরকার । এই রোজগারেরও বন্দোবস্ত তাঁরা নিজেরাই করে নেন থিয়েটারের স্বার্থে । এখান থেকেই আসে ‘থিয়েটার ভিলেজ’ বা নাট্যগ্রামের ধারণা । আসাম, মণিপুর, কেরালা, ওড়িষ্যা, তামিলনাড়ু – প্রভৃতি রাজ্য এই ধরণের থিয়েটারের চর্চা আছে । আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি এই রকম নাট্যগ্রাম আছে বর্তমানে । এখানে নিরন্তর জাতীয়মানের নাট্য নির্মাণ লক্ষ্য করা যায় । সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের পরিচিতি ঘটেছে তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে ।
প্রথমেই যে নাট্যগ্রামটির কথা উল্লেখ করতে হয় তার নাম ‘তেপান্তর’ নাট্যগ্রাম । তাঁদের কর্ণধার কল্লোল ভট্টাচার্য । এটি বীরভূমের অজয় নদের পাশে অবস্থিত । গ্রামের নামটি ভারি চমৎকার । সাতকাহনিয়া । বর্তমান পশ্চিম বর্ধমানের বনকাঠি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই সাতকাহনিয়া গ্রাম । এখানেই প্রায় দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলেছে নিবিড় নাট্যচর্চা । ইতিহাস বলছে ১৯৯৬ সালে গ্রামের জনা ২০ ছেলেকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘এবং আমরা’ নাট্যদল । এরা সকলেই প্রায় কৃষক পরিবারের সন্তান । কিন্তু খালি পেটে তো আর নাটক হয় না । তাই স্থির হলো গ্রামের পতিত জমিতে সব্জি চাষ করা হবে, হাঁস-মুরগি পালন করা হবে – এই ভাবে উপার্জিত অর্থের কিছুটা নাটকের কাজে লাগানো হবে এবং বাকিটা তুলে দেওয়া হবে পরিবারের হাতে । এই শুরু হলো নাট্যপরিক্রমা ।
27
পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে জমির মালিকের অনুমতি নিয়ে ১২ বিঘে বন্য জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে একটু একটু করে স্থায়ী ও অস্থায়ী চালা ঘর, ইটের গাথনি দেওয়া অথচ চাপ শনপাতার নির্মিত ঘর তৈরী হ’ল । পুকুর কাটা হ’ল মাছ চাষের জন্য । তারপর ২০০৪ সালে ঐ সমগ্র জমি নিজেরা কিনে নিয়ে নাম দিলেন ‘তেপান্তর’ । এই তেপান্তরের বিভিন্ন জায়গায় নাট্যমঞ্চ তৈরী হল । কোথাও ব্ল্যাকবক্স তৈরী হ’ল । এভাবে এখানে চলতে থাকলো নাট্য নির্মাণ প্রকৃতির সান্নিধ্যে । প্রবীর গুহ, বাদল সরকারের মতো মানুষের ভালোবাসা ও প্রেরণা পেয়েছে এই তেপান্তর নাট্যগ্রামটি । পরে তো বিশ্ববিখ্যাত হয়ে পড়ে এঁদের কাজকর্ম । ২০০৫ সালে ফ্লাইং ফিশ থিয়েটার কোম্পানি এখানে এসেছিল বার্লিন থেকে । ২০০৮ সালে আসে রাশিয়ান অ্যাকাডেমি ফর থিয়েটার আর্টস । আর দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন এঁদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে । এই গ্রামের মানুষজন বেশিরভাগই ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত । কঠোর জীবন সংগ্রাম করে তাঁরা দিনপাত করেন । কিন্তু এই তেপান্তরের নাটক এঁদের বোধের জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে । বর্ষাকাল বাদে বছরের বাকি সময়ে প্রায় প্রতিদিনই তাঁরা এখানে এসে নাটক দেখেন । নানা গল্প, পরিবেশ, সংস্কৃতির হদিস মেলে এখান থেকে । তাই তাঁরা অনেকেই নিরক্ষর হলেও অশিক্ষিত নয় । নাটক ঐ গ্রামের সকল মানুষের চেতনায় আঘাত হেনেছে । সংস্কৃত ও মার্জিত হয়েছে তাঁদের জীবনাচরণ । সবই এই তেপান্তরের হাত ধরে । তবে এই থিয়েটার ভিলেজের কর্ণধার কল্লোপ ভট্টাচার্যের আক্ষেপ যে কলকাতার দলগুলো তাঁদের কথা বলেন না । কলকাতা তাঁদের দেখেন জেলার দল হিসেবে । নাটকের এই বৈষম্য তাঁকে বেদনাহত করে বারে বারে । ৫ যাই হোক, তেপান্তরই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম থিয়েটার ভিলেজ – যাঁরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিও অর্জন করেছেন।
এছাড়া এই বীরভূম জেলাতেই আরো দু’একটি নাট্যগ্রামের সন্ধান মেলে । সে রকম একটি নাট্যগ্রাম হল ‘নিভৃত পূর্ণিমা নাট্যগ্রাম’ । এটি বোলপুর শহরের মধ্যেই নির্মিত । এর কর্ণধার হলেন জুলফিকার জিন্না । অন্যদিকে বহরমপুরে ছ’বিঘে জমির ওপর তৈরি হয়েছে একটি নাট্যগ্রাম । ‘বহরমপুর গাঙচিল’ নাট্যদল এটি নির্মাণ করেছে ।
এই থিয়েটার ভিলেজ একুশ শতকের প্রথম দুই দশকে বেশ সাড়া জাগিয়েছে । খুবই সাধারণ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা, আদিবাসী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা নিষ্ঠার সাথে এখানে কাজ করেন । তাঁরা এখন বাংলা নাটকের সর্বক্ষণের কর্মী । সম্পদ । শিল্পী । কলকাতা তাঁদের থেকে মুখ ফেরালেও তারা কিন্তু থেমে নেই । তাঁদের কাজ তাঁরা করে চলেছেন নিরন্তর । নিরলস । বাংলা নাটককে এক নতুন দিশা দেখাচ্ছেন তাঁরা । আস্তে আস্তে হয়ে উঠছেন বাংলা নাটকের এক দৃঢ় স্বর । তবে এই প্রচেষ্টা তো আর একদিনে করা যায় নি । প্রায় আড়াই দশকের লাগাতার শ্রম রয়েছে এর পেছনে । নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে । সব কিছুকে সামলে সামনে এগিয়ে চলা এবং উন্নতমানের প্রযোজনা উপহার দেওয়া যেমন সহজ কথা নয়, তেমনই বাংলা নাট্যজগতের জন্য তা শ্লাঘার বিষয়ও বটে ।
একশ শতকের দ্বিতীয় দশকের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সমগ্র বিশ্ববাসী এক বিরাট মহামারির সম্মুখীন । কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কোটি কোটি মানুষ মারা যাচ্ছেন সারা পৃথিবী জুড়ে । আর যেহেতু এই ভাইরাস হাঁচি-কাশির মধ্যে দিয়ে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় তাই এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল মানুষ থেকে মানুষের দূরে থাকা । দূরত্ব বজায় রাখলে তো আর থিয়েটার হবে না । তাই নাটক এই বৈশ্বিক মহামারির কারণে সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ । ফলে অনেকেই এর বিকল্প পথ খুঁজছেন । প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে মানুষ গৃহবন্দী । স্কুল-কলেজ-বাস-ট্রেন-সিনেমা হল – সব বন্ধ । মানুষ মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পাচ্ছে না । তাই বাংলা থিয়েটারের মানুষজনও নতুন পথ খুঁজছেন । বড় বড় প্রসেনিয়াম মঞ্চে আর অভিনয় করা অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব নয় । তাই অনেকেই ছোট জায়গায় সামান্য ব্যয়ে নাটক করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন । ইতিমধ্যেই অনেক নাট্যদল তৈরী করে ফেলেছেন নিজস্ব ছোট মঞ্চ । যাকে বলা হচ্ছে ‘ইন্টিমেট থিয়েটার স্পেস’ বা ‘অন্তরঙ্গ মঞ্চ’ । অল্পকালের মধ্যেই সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে এরকম অন্তত আটটি ৬ হলের উদ্বোধন হয়েছে । দর্শকদের সঙ্গে এই মুহূর্তে দেখা হবার কোন সুযোগ নেই । গত বছর অক্টোবর মাসে থিয়েটার হলগুলো খুললেও তাতে দর্শকের দেখা মেলে নি । ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাটকওয়ালারা । তাই নাট্যদলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে এই ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন । এখন তাঁদের ভরসা বলতে ‘ব্ল্যাক বক্স’, ‘স্টুডিও থিটেয়ার’, কিংবা ছোট হলগুলো ।
28
‘ইফটা’ নাটকের দল দমদমের একটি বাড়ির ছাদে বানিয়েছে ‘থিয়ে অ্যাপেক্স’ নামের ছোট্ট একটি প্রসেনিয়াম মঞ্চ । এখানে ৫০ জন দর্শকের বসারও ব্যবস্থা আছে । এখানে মঞ্চ ছোট হলেও আলো এবং শব্দ প্রক্ষেপণের ব্যবস্থা কিন্তু আধুনিক । লকডাউনের ফলেই তাঁরা এমন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন । আবার ‘অমল আলোয়’ নাম দিয়ে অন্তরঙ্গ মঞ্চ নির্মাণ করেছেন ‘অশোকনগর নাট্যমুখ’ অশোকনগরে । এতে আসলে প্রযোজনার ব্যয় অনেক কম হচ্ছে । ফলে কাজ করতে সুবিধে হচ্ছে দলগুলোর । এই পথেই চাকদায় নির্মিত হয়েছে এই ধরণের মঞ্চ । ‘চাকদা নাট্যজন’ তৈরী করেছে ‘আঙিনা’ নামের একটি ব্ল্যাক বক্স । এরই সঙ্গে রয়েছে একটি ‘ক্যাফে থিয়েটার’ । এখানে নাটক দেখতে দেখতে কিছু খেয়েও নেওয়া যাবে । ‘মহিষাদল শিল্পকৃতি’ মহিষাদলে তৈরী করেছে ‘মহিষাদল নাট্যমঞ্চ’ । ‘কল্যাণী নাট্যচর্চাকেন্দ্র’ অবশ্য অনেক আগেই তৈরী করেছে একটি সুসজ্জিত অন্তরঙ্গ থিয়েটার মঞ্চ, যার নাম ‘তাপস সেন – কুমার রায়’ মঞ্চ । ‘চেতনা’ নাট্যদল কলকাতার আনোয়ার শাহ রোডে নির্মাণ করেছেন অত্যাধুনিক ‘ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়’ মঞ্চ । শুবাশিস মুখোপাধ্যায় ও ইশিতা মুখোপাধ্যায় বিক্রমগড়ে একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তুলেছেন তাঁদের নিজস্ব ‘স্টুডিও থিয়েটার’ ।
এই অতিমারিকবলিত সময়ে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই ধরণের অন্তরঙ্গ মঞ্চগুলি । নাট্যদলগুলো তাঁদের প্রযোজনাগুলো সফল ভাবে মঞ্চস্থ করতে পারছে এই মঞ্চগুলি নির্মাণ করে । অল্প দর্শক আসন হওয়ায় তা পূরণ হতেও অসুবিধে হচ্ছে না । ফলে একুশ শতকের বাংলা নাটক এখন এক নতুন পথে চলেছে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে । সময়ের দাবী মেনেই এ বদল এসেছে বাংলা থিয়েটারে ।
কাজেই দেখা যাচ্ছে একুশ দশকে বাংলা নাটক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলেছে । তার সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে হচ্ছে তাকে । তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা নাটকের মান আরো ভালো হয়েছে । যারা পেশাদার দল নয় তারাও চেষ্টা করে চলেছেন ভালো মানের নাটক করবার । বিজ্ঞাপন বা প্রচারের জন্য দলগুলো এখন অতি সহজেই নানান সামাজিক মাধ্যমকে (ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি) ব্যবহার করে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারছে । শুধু স্থির চিত্র নয়, চলচ্চিত্র করেও বিজ্ঞাপন দিতে পারছেন এ সময়ের দলগুলো । আবার অন-লাইন টিকিট বিক্রির ফলে দর্শকদেরও অনেক সুবিধে হয়েছে টিকিট পেতে । ঘরে বলেই নিজের পছন্দমতো আসন কিনতে পারছেন । কাজেই অনেক ইতিবাচক দিক এসে পড়েছে প্রযুক্তির হাত ধরে বাংলা নাটকে একটা সীমিত সংখ্যক মানুষের শিল্প বা ‘মাইনরিটি আর্ট’ হলেও নাটক বরাবর তার নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে ক্রমাগত উন্নত হয়েছে বাংলা নাটক । তার ধারা আজও অব্যহত ।
29
সূত্র নির্দেশ |
১) বর্তমান গবেষক কর্তৃক নাট্যকার চন্দন সেনের সাক্ষাৎকার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০
২) বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস, দর্শন চৌধুরী, পঞ্চম পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ,
২০১১, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃঃ ১৭৫
৩) তদেব পৃঃ ১৭৫-১৭৬ ।
৪) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪২০, রবিবার ৮ ডিসেম্বর, Link :
“ http://archives.anandabazar.com/archive/1131208/8edit2.html ”
৫) You Tube link : http://youtu.be/6FbHj-07f4A
৬) বর্তমান পত্রিকা, কলকাতা, মঙ্গলবার, ৬ জুলাই, ২০২১
Link : http://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=26886
——————————————————————————————————————
লেখক পরিচিতি : কৃষ্ণপদ দাস, গবেষক, (বাংলা বিভাগ) বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফোন নম্বর – 7003787726/ 9836680333, E-mail : krishnapadadas57@gmail.com