Shakti Mandal: Empowering Mass Education and the Adult Education Movement in West Bengal

Sandeep Dey

Abstract: This study delves into the dynamic interplay between mass education initiatives and the Adult Education Movement in the state of West Bengal, with a particular focus on the transformative role played by Shakti Mandal. As an influential force in the region, Shakti Mandal has emerged as a key player in advancing educational opportunities for both the masses and adults seeking to enhance their skills and knowledge. The paper explores the historical context, key strategies, and impact of Shakti Mandal’s interventions in fostering widespread education. Through a comprehensive analysis, this research aims to contribute to a deeper understanding of the intricate relationship between mass education, adult education movements, and the pivotal role of organizations like Shakti Mandal in shaping the educational landscape of West Bengal.

-সন্দীপ দে

আলোর পথিক : শক্তি মণ্ডল

মৃত্যু তুমি সহিষ্ণুতা শেখো,আমাদের প্রস্তুত হতে দাও”… (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)কবির এই আকুল আর্তি কি শোনে মৃত্যুর বিভীষিকা! তা নাহলে কি এভাবে অকালে সমাপ্ত হয় শক্তিদার মতো আলোর পথিকের জীবন পরিক্রমা! এ যে আমাদের কাছে দুঃসহ! এই ভয়ঙ্কর দুর্দিনে এক একটি বেসামাল মুহূর্তের অভিঘাতে হতাশাদীর্ণ-বেপথু মনের গভীরে আলো জ্বালবার অমূল্য জীবনের দীপগুলি যে একে একে নিভে যাচ্ছে! জানিনা এই নিদারুণ দুঃসংবাদ শক্তিদারই দীর্ঘদিনের অগ্রজ সঙ্গী নবতিপরপ্রায় পাহাড়ি দা কীভাবে সহ্য করছেন! এ রাজ্য তথা দেশের সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা ও সংগঠক ছিলেন শ্রদ্ধেয় শক্তি মণ্ডল। কিন্তু আমাদের মতো অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন অনিবার উৎসাহ ও প্রেরণা সঞ্চারক একজন পরম সুহৃদ, আত্মজন। শান্ত-স্থিতধী,হাসিমুখ নিয়ে সর্বদা ছুটে চলা শক্তিদার উজ্জ্বল ছবি আজও আমার স্মৃতিপটে সজীব। আমার কলকাতার জীবনে যে ক’জন মানুষ আমাকে চলার পথে উষ্ণতার বন্ধনে জড়িয়ে দিশা দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রিয় মানুষ ছিলেন শক্তিদা। বাহ্যিক আড়ম্বর ও আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত,আত্মপ্রচার বিমুখ এই মানুষটির ছিল মানুষের প্রতি দুর্নিবার ভালোবাসা। তাই তাঁর অনিবার্য সংলগ্নতা ছিল কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্রোতধারায়,সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা আন্দোলনের আলোক অভিযানে। ছাত্র আন্দোলন ও হোস্টেল জীবনের অন্যতম সহযাত্রী দেবাশিসদার সূত্রে তাঁরই ছোড়দা শক্তিদার সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। তাঁর অফুরান প্রাণসম্পদ ও আকর্ষণী ক্ষমতায় যে পরিচয় ধীরেধীরে আত্মজনের বন্ধনে নিবিড় হয়েছে। ছুটির দিনে বা বিশেষ কোনো উপলক্ষ্যে বেলগাছিয়ার ফ্রেজার হোস্টেলে আগমন ঘটতো শক্তিদার। সঙ্গে অবধারিতভাবেই শ্বেত-শুভ্র ধুতি পাঞ্জাবিশোভিত পাহাড়িদা।

শক্তিদার উপস্থিতি মানেই একরাশ উৎসাহ নিয়ে নতুন কোনো ভাবনা বা কর্মসূচি উপস্থাপন ও সেসব বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা। শক্তিদা-পাহাড়িদা আসা মানে সেসময় হোস্টেলের ক্লান্তিকর দীনজীবনে একগুচ্ছ ভালোলাগা উপহার হিসেবে সঞ্চয় করা। সাক্ষরতা ও জনশিক্ষার নানা কর্মসূচিতে রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অথবা ভিন্ রাজ্যে ছিল তাঁর প্রায় নিত্য যাওয়া আসা। এমনকি এই উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ,শ্রীলঙ্কা সহ বিভিন্ন রাষ্টেও তিনি সফর করেছেন। সেইসব অভিজ্ঞতার কথাই শোনা যেত তাঁর কাছে। মুড়ি -বাদাম কখনো কখনো সিঙারা-তেলেভাজা, চা সহযোগে দীর্ঘ সময় ধরে চলতো আড্ডা;তার সাথে দেবাশিসদার আবেগমথিত কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও বাংলাদেশের বন্ধু মারুফ(পরবর্তীতে প্রয়াত)-এর প্রাণ উজাড় করা গান — আমরা যেন পোঁছে যেতাম অন্য এক জগতে!

শক্তিদার প্রণোদনাতেই আমরা অংশ নিয়েছি সাক্ষরতা প্রসারের নানা কর্মসূচিতে,সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।এক সময়ে তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও উৎসাহে আমরা গড়ে তুলেছিলাম কাছের বন্ধু-প্রিয়জনদের মিলিত সংগঠন ‘সুহৃদ সম্মিলনী’। তাঁরই ভাবনায় প্রকাশিত হয়েছিল এই সংগঠনের স্মারক গ্রন্থ ‘সংবীক্ষণ’। আবার আমরা যখন রবীন্দ্র ভারতীর প্রাক্তন বন্ধু-সতীর্থদের সংগঠন ‘মরমি’ গড়েছি, তখন শক্তিদাকে পেয়েছি অগ্রজ অভিভাবক হিসেবেই। মনে পড়ে রাজাবাজারে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য ‘বেঙ্গল সোশাল সার্ভিস লিগ’ দপ্তরে যাওয়া এবং এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ, দেশের জনশিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ শ্রদ্ধেয় সত্যন মৈত্রের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল শক্তিদার আগ্রহেই। সেই সুবাদেই সেখানে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী বিজন চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে সাক্ষরতা সংক্রান্ত কর্মশালায় উপস্থিত থাকার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল শক্তিদার সৌজন্যেই। এছাড়াও দেশ ও রাজ্যের বরেণ্য শিক্ষাবিদ,সাহিত্যিক, শিল্পীদের নিয়ে সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা সংক্রান্ত সম্মেলনে থাকারও সুযোগ হয়েছে কয়েকবার,যেগুলি জীবনের অন্যতম অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়ে আছে।

শক্তিদাই এক সময়ে শিখিয়েছিলেন কীকরে নব্য সাক্ষর,স্বল্প সাক্ষর ও সীমিত শিক্ষিতদের জন্য সংবাদ প্রতিবেদন রচনা করতে হয়। মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামের কমিউনিস্ট পরিবারে জন্ম নেওয়া অফুরান প্রাণপ্রাচুর্য আর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এই মানুষটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের নানা আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করেছেন,কারান্তরালে থেকেছেন এবং পরবর্তীকালে সাক্ষরতা ও জনশিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মহতী কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন — যা ভাবলে বিস্ময় জাগে! নিরন্তর চর্চা,অধ্যবসায় ও আন্তরিক ইচ্ছার মিলনে যে একজনের মধ্যে মেধা ও সৃজনের অপরূপ উন্মেষ ঘটে এবং এই সন্মিলন যে একজনকে অনিন্দ্যসুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে তারই অনুপম দৃষ্টান্ত যেন শক্তিদা। আশ্চর্যের বিষয়,বহু সময়ে তাঁর সঙ্গে কাটানোর অবকাশ হয়েছে,কিন্তু কখনো একমুহূর্তের জন্য তাকেঁ এতটুকু রুষ্ট হতে অথবা কারও প্রতি বিন্দুমাত্র অসূয়া প্রকাশ করতে দেখিনি। এটা নিঃসন্দেহে মানব চরিত্রের এক বিরল প্রকাশ বলেই মনে হয় !

শক্তিদা প্রতিনিয়ত সাংগঠনিক কাজে মগ্ন থেকেছেন।তারই ফাঁকে নিয়মিত লিখেছেন প্রবন্ধ,প্রতিবেদন,কবিতা,ছড়া, অনুগল্প ইত্যাদি। তবে সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা সংক্রান্ত রচনাগুলি ছিল সর্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। যেগুলোর মধ্যে নিবিড় পাঠ,শিক্ষা,অভিজ্ঞতা ও গবেষণার চমকপ্রদ প্রতিফলন লক্ষণীয়। ইদানীং শক্তিদার সঙ্গে খুব একটা সাক্ষাৎ না হলেও দূরভাষের মাধ্যমে সংযোগ ছিল অটুট। তিনি সময়করে কুশল জানতে চাইতেন। বিশেষকরে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের আবহে ফোন করে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। দেশহিতৈষীর সঙ্গে ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এখানে তিনি যেমন নিজে থেকে লেখা পাঠাতেন, তেমনি আমরাও মাঝেমাঝে লেখার জন্য অনুরোধ করতাম। তিনি সানন্দে সেই অনুরোধ রক্ষা করতেন। এছাড়াও আমার সম্পাদনায় বিভিন্ন স্মারক গ্রন্থেও তিনি তাঁর মূল্যবান রচনা পাঠিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। শক্তিদার উদ্যোগেই গড়ে ওঠে ‘সত্যেন মৈত্র জনশিক্ষা সমিতি’। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের সভাপতি। সেখানে যুক্ত ছিলেন তাঁরই দীর্ঘদিনের সহযাত্রী কল্যাণ শতপথি(প্রয়াত)। আরও অনেকের সাথে পাহাড়িদার মতো প্রবীণ মানুষকেও তিনি এই সংগঠনের বৃত্তে নিয়ে এসেছিলেন।

‘জনশিক্ষা ভাবনা’ এই সংগঠনের মুখপত্র–যা শক্তিদার ভাবনার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে। শক্তিদা বেশকিছু বই ও পুস্তিকা রচনা করেছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি আমাকে বই ও নানা পত্রপত্রিকা পাঠাতেন। সম্প্রতি তিনি ফোনে বললেন,বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষ্যে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন,সঙ্গে আরও একটি বই। যেদু’টি আমাকে পাঠাবেন। শুনে আমিও অধীর আগ্রহেই বই দু’টির প্রত্যাশায় ছিলাম। এছাড়া কথা হয়েছিল বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিশ্বে জনশিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ব্রাজিলের পাওলো ফ্রেইরির জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দেশহিতৈষীর শারদ সংখ্যায় তিনি লিখবেন। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে! আজ মনে পড়ছে শক্তিদা দেশে সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘ড. সুশীলা নায়ার লিটারেসি অ্যাওয়ার্ড ২০০৭-০৮’ অর্জন করেছিলেন। এই কৃতিত্বের জন্য তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের পক্ষ থেকে ধর্মতলায় রাজ্য দপ্তরে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। সেদিন অনেক বিদগ্ধ মানুষের উপস্থিতিতে শক্তিদার বক্তৃতা অনেকের স্মৃতিতে আজও অমলিন। গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ ও এই সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অনেকের সঙ্গেই শক্তিদার ছিল হার্দিক সম্পর্ক। বিভিন্ন সময়ে তিনি এই সংগঠনের কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকেছেন,আবার ইন্দ্রদাকেও তাঁদের নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছেন।

শক্তিদা সাক্ষরতা ও জনশিক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি নানা সামাজিক ও গণ আন্দোলনে যুক্ত থেকেছেন। কেন্দ্রের সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতি বিশেষকরে মানুষকে বিভাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে এন আর সি, সিএএ, এনপিআর বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি পথে নেমেছেন এবং মানুষকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ‘নাগরিকপঞ্জি বিরোধী মঞ্চে’ শামিল হয়েছেন। আগেই উল্লেখিত হয়েছে,শক্তিদা সব সময়ই সৃষ্টির কাজে ব্যাপৃত থেকেছেন। মনে পড়ছে গতবছর লকডাউনের সময়ে গৃহবন্দিদশায় কেন্দ্রের শাসকদল ও সরকারের অবৈজ্ঞানিক ভাবনা ও অবিমৃশ্যকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও শ্লেষ ব্যক্ত করে সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন অনবদ্য কবিতা—- ‘নতুন কত কী’, ‘দেবতার ত্রাস’; যেগুলির মধ্যে অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার কথাই পরিস্ফুটিত হয়েছিল। সেই কবিতাগুলো পড়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম তাঁকে। খুবই খুশি হয়ে তিনি সে সময়ে রচনা করা কয়েকটি অনুগল্প পড়ার অনুরোধ করেছিলেন। সেগুলোও তাঁর বিচিত্র সৃজনশীলতাকেই মূর্ত করছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন ভরতি ছিলেন হাসপাতালে। ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। সব সময় সৃষ্টির নেশায় মগ্ন মানুষটি ভেবেছিলেন হাসপাতালের বেডে শুধু শুধু শুয়ে না থেকে কিছু লেখালেখি করবেন। তাই খবর পাঠিয়েছিলেন পরদিন যেন বাড়ি থেকে কলম-কাগজ পৌঁছে দেওয়া হয় তাঁকে। সেইমতো পুত্র ও বৌমা (৬ মে) রওনা হয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু কী মর্মান্তিক সমাপতন! পথেই আসে দুঃসংবাদ! সেই কলম-কাগজ অধরাই রয়ে গেল! বাবাকে আর পৌঁছে দেওয়া গেলনা! নতুন কোনো সৃষ্টিও আর ডানা মেললো না! শক্তিদার শিক্ষা ও আদর্শেরই উজ্জ্বল উত্তরাধিকার বহন করছে তাঁর পুত্র ও কন্যা। ছেলেবেলার সেই দুরন্ত সুমু (সায়ন্তন) এখন জম্মুতে আই আই টি’র অধ্যাপক এবং কন্যা রিনি(সংকলিতা)জার্মানিতে অধ্যাপনায় রত।

প্রিয় শক্তিদার মতো একজন প্রাণবন্ত মানুষের আকস্মিক চিরবিদায়ের জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। আরও অনেকের মতোই আমার কাছে এ যেন এক ব্যক্তিগত ক্ষতি। তাঁর প্রয়াণে আজ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি মাও সে তুঙের সেই বিখ্যাত পঙ্ ক্তি —-“কোনো কোনো মৃত্যু ‘তাই’ পাহাড়ের চেয়েও ভারি”….. আমরা জানি সবাইকেই কালের নিয়মে জীবনের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে একদিন বিদায় নিতে হবে। কিন্তু শক্তিদার মতো এমন একজন বিরল প্রাণের শূন্যতা কি সহজে পূর্ণ হবে? আমি শক্তিদার অবিনাশী উজ্জ্বল স্মৃতির প্রতি জানাই অনন্ত শ্রদ্ধা এবং আত্মীয় পরিজনদের প্রতি জানাই আমার গভীর সমবেদনা।।

Contents

Volume-3. No-3 May- June 2021

কোচবিহারের বৈরাতী নৃত্যে আধুনিকতা – অম্বিকা ভান্ডারী পৃষ্ঠা ১-৫

মন নাকি মনোরঞ্জন : সিনেমা , অভিনেত্রী এবং সত্যজিৎ রায় পৃষ্ঠা ৬-২৭

ছ’য়ের দশকে বহুরূপীর রবীন্দ্র নাটক ও শম্ভু মিত্রের নাটক – প্রযোজনা – কৃষ্ণপদ দাস পৃষ্ঠা ২৮-৪৪

বাংলা লোকসংগীতে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারে আধুনিকতা ও নান্দনিক দিক – প্রশেন রায় পৃষ্ঠা ৪৫-৫৫

বাক্‌যন্ত্র : গঠণ ও সাঙ্গীতিক ব্যবহার-নূর নবী মীরণ পৃষ্ঠা ৫৬-৫৮

Embodied Modernity: A Cultural Exploration of Bairati Dance in Cooch Behar

Ambika Bhandari

Abstract:

This research delves into the dynamic intersection of tradition and modernity within the context of Bairati dance in Cooch Behar. Bairati dance, a traditional folk art form, has evolved over time, embodying cultural shifts and adapting to contemporary influences. This study examines the ways in which Bairati dance reflects and negotiates modernity, considering both the preservation of its rich historical roots and its responsiveness to changing social, cultural, and technological landscapes. By analyzing the choreographic elements, costumes, and performances, this research aims to uncover the nuanced expressions of modernity within the Bairati dance tradition, shedding light on the intricate balance between heritage and innovation in the cultural tapestry of Cooch Behar.


কোচবিহারের বৈরাতী নৃত্যে আধুনিকতা

অম্বিকা ভান্ডারী

উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার লোকসংস্কৃতির উপাদান গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লোকনৃত্য। সেই লোকনৃত্য গুলির মধ্যে ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য হল বৈরাতী নৃত্য। এই বৈরাতী নৃত্য সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত। আগে কোচবিহারের গ্রামগুলিতে বিয়ের দিন ঠিক হবার দিন থেকে শুরু করে বর কনে বিদায়ের দিন অবধি এই নৃত্য উপস্থাপন করা হতো। বিয়ে বাড়িতে বর ও কনের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে এমন একজন মহিলাকে বৈরাতী নির্বাচন করা হতো। বাড়ির কোন বৌদি স্থানীয় মহিলা কে অথবা বাড়িতে বৌদি তৎ সম্বন্ধীয় কোন মহিলা না থাকলে গ্রামের কোন মহিলাকে নিয়ে আসা হতো বৈরাতী হিসেবে। এই বৈরাতির উপর বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের নানান দায়িত্ব থাকতো। বিশেষ করে বর-কনের দায়িত্ব। কনের বাড়িতে কনে কে বরণ করতে করতে কনেকে ঘিরে এবং বর আসলে বরকে বরণ করতে করতে ঘুরে ঘুরে এই নাচ করা হয়ে থাকে। বৈরাতির সাথে বাড়ির অন্যান্য মহিলারাও এই নাচে অংশগ্রহণ করতেন। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রতিটি পর্বের ভিন্ন ভিন্ন গান আছে এবং তার সাথে নাচ। বৈরাতী নাচের ক্ষেত্রে দেখা যেত ঘরে পড়া ভালো শাড়ি পরে নাচ পরিবেশন করতেন শিল্পীরা, সাজসজ্জাও অতি সাধারণ করা হতো। তবে এ বৈরাতী নাচের সময় বৈরাতির হাতে থাকে চাইলন। চাইলন অর্থাৎ বরণডালা। এটি দেখতে কানা উঁচু থালার মতো। কান্না গুলো পাঁচ ইঞ্চির মতো উঁচু থাকে। তার মধ্যে থাকে আটিয়া কলা, বাতি এবং বরণের সামগ্রী।


বর্তমানে আস্তে আস্তে এই বৈরাতী নৃত্যের প্রথা প্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে গ্রামগুলিতে খুঁজলে হয়তো পাওয়া যেতেও পারে সেই সমস্ত বৈরাতী এবং বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে এই বৈরাতী নৃত্য। এখন এই আধুনিকতার যুগে দাঁড়িয়ে আমরা হারাতে বসেছি আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য গুলিকে। বর্তমানে কোচবিহার জেলার এই বৈরাতী নৃত্য আর প্রথাগতভাবে পরিবেশিত হয় না। এই বৈরাতী নৃত্য এখন আধুনিকতার যুগে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছে। তৈরি হয়েছে বৈরাতী নাচের নানা নৃত্য গোষ্ঠী।

2

তারা বৈরাতী নৃত্য শুধু বরণের অংশটুকু পরিবেশন করছে অশোক মন্ডলীর সামনে। তবে এই মঞ্চে উপস্থাপিত বৈরাতী নৃত্য ও আস্তে আস্তে দর্শকের কাছে অতিরঞ্জিত করে তোলার তাগিদে বৈরাতী নৃত্যের আঙ্গিকে এসেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। অর্থাৎ বর্তমান যুগের দর্শকদের চাহিদা পূরণের জন্য এবং বৈরাতী নৃত্য কে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আধুনিক আঙ্গিক, পোশাক, গহনা, মেকাপ ও বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রণ ঘটেছে। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে আগে বরনের থালা অর্থাৎ চাইলন বাতি ধরে মজার ছলে এই নৃত্য পরিবেশন করতো গ্রামের বৈরাতী ও মহিলাগণ বর ও কনে কে ঘিরে। কিন্তু বর্তমানে গানের কথা অনুযায়ী নাচের অঙ্গ সঞ্চালন ও ভাব প্রকাশ করা হয়। মঞ্চে উপস্থাপনের জন্য নানান ধরনের নৃত্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে যাতে দেখা যাচ্ছে মহিলারা কখনো সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াচ্ছে, কখনো পাশাপাশি দুটি লাইনে দাঁড়াচ্ছে আবার কখনো গোল করে ঘুরছেন।

পোশাকের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে আগে পরার ভালো শাড়ি পরে বৃত্ত পরিবেশন করতেন শিল্পীরা কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে লাল পাড় সাদা শাড়ি অথবা লাল পাড় হলুদ শাড়ি, লাল ব্লাউজ কখনো আবার পাঠানি ও রাজবংশী চাদর পরা হচ্ছে। কখনো আবার দেখা যাচ্ছে রঙিন এক রঙের শাড়ি ও পরছেন। গহনার ক্ষেত্রে এখন দেখা যাচ্ছে পুঁতির মালা, সোনালী অথবা পাথর বসানো নকল

3

গহনা করছেন শিল্পীরা। মুখের মধ্যে আগে কোন মেকাপ করা হতো না, শুধু আলতা সিঁদুর টিপ পরা হতো তবে এখন আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মেকাপ করে থাকেন শিল্পীরা,যা ভালোই লাগে। তবে বাদ্যযন্ত্রের যেমন আগে বাংলার ঢাক, দোতারা বাজানো হতো,এখন এই বৈরাতী নৃত্যে যেটি দেখা যায় তা হল ঢাক ও দোতারার সাথে বাঁশির যোগ হয়েছে আবার কিছু নৃত্য গোষ্ঠী ক্যাসিওর ব্যবহারও করছেন। এছাড়া এখনকার বৈরাতী নৃত্যে দেখা যায় অবিবাহিত মহিলারাও এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করছেন। আগে শুধুমাত্র বিবাহিত মহিলারা এই নৃত্যে অংশ গ্রহণ করতেন।

বৈরাতি নৃত্য || BOIRATI DANCE || CHAILON BATI || BARON DANCE || Bhawaiya  Goalparia - YouTube
https://www.youtube.com/watch?v=_44rd7l2jOs&ab_channel=EktaraEntertainment


এই বৈরাতী নৃত্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন এসেছে সেটি হল বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়াও কোচবিহার জেলায় কোন সম্মানীয় অতিথি আসলে তাকে বরন নৃত্যের দ্বারা স্বাগত জানানো হচ্ছে। শিল্পীরা অতীতের দিকে মুখ করে হাতে চাইলন নিয়ে নাচতে নাচতে অতিথি কে অতি সম্মানের সাথে মঞ্চের কাছে নিয়ে আসেন। এই বরন নৃত্যের ক্ষেত্রে শুধু বাজনার সাথে সাথে নাচ করা হয়,কোন গান ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু যখন মঞ্চে বৈরাতী নৃত্য উপস্থাপন করা হয় তখন গানের সাথে নাচ করা হয়। মঞ্চে বৈরাতী নৃত্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু নৃত্যগোষ্ঠী নৃত্যনাট্যের মতো করে বিয়ের প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান দেখিয়ে বৈরাতী নৃত্য উপস্থাপন করেন।
কোচবিহারের এই লোকনৃত্য লুপ্ত হয়ে গেলেও আধুনিক যুগের মঞ্চের জন্য বৈরাতী নৃত্যের অল্প কিছু অংশ আজও বেঁচে রয়েছে। তার মধ্যে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া তুলনায় আধুনিকতার প্রভাব বেশি থাকলেও কোচবিহারের ঐতিহ্যবাহী বৈরাতী নৃত্য বেঁচে রয়েছে।

4

তথ্যসূত্র:-
১)দে,ডঃ দিলীপ কুমার।কোচবিহারের লোকসংস্কৃতি,অনিমা প্রকাশনী,আগস্ট 2015।
২)বর্মন,ধনেশ্বর।উত্তরবঙ্গের জনজীবন ও লোকাচার,প্রগতিশীল প্রকাশক,এপ্রিল 2011।
সাক্ষাৎকার:-
১)নির্মল দাস,নিউ কোচবিহার,তারিখ:-20/12/2020,দুপুর 12:40।
২)শ্রীপর্ণা সরকার,রানীবাগান,কোচবিহার,তারিখ:-20/12/2020,সন্ধ্যা 8 টা।
৩)জয়জিৎ বর্মা,তুফানগঞ্জ,কোচবিহার,তারিখ:-26/12/2020,সকাল 11টা।
৪)সুখেশ্বর দেউরী,শালবাড়ী,কোচবিহার,তারিখ:-26/12/2020,দুপুর 2 টা
৫)সুশীলা রায়,হাজরা পাড়া,কোচবিহার,তারিখ:-22/9/2019,19/12/2020,সকাল-৯ টা

মন নাকি মনোরঞ্জন : সিনেমা , অভিনেত্রী এবং সত্যজিৎ রায়

মৌ চক্রবর্তী

ছবি ১

১.১ মন নাকি মনোরঞ্জন

বাংলা সিনেমার পাহাড়। সিনেমাগুলো শুরুতেই যে পথ ধরে ফেলেছে, তা আদতে মনোরঞ্জনের আয়োজনে তৈরি। তাতেই ব্যবসা। নির্বাক ছবির হাতেখড়ির পরই, বাংলা ছবির অর্থনীতির পারদ চড়া সংস্কৃতির মেজাজে। সিনেমার শর্ত তো বিনোদন। নাট্যচর্চার শিল্পীদের মতন তার শিল্পের মধ্যে আন্দোলনের জোয়ার আনার দরকার হয় না। এমনিতেই বাজার পায়। বেশি দেরি হয় না, সাদাকালোতে নায়িকার ভাব, নায়িকার গান-নাচের দৃশ্যকে একটু রঞ্জিত করতে। সেখানে সত্যজিৎ রায় এলেন এক অতি-বাস্তব নিয়ে। সেখানে মাত্র ৩৭ টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। আর নির্মাণকাল মোটে ৩৬ বছর। উক্ত সিনেমায় চালচুলোহীন সমাজ, বিপন্ন পরিবারের প্রতিনিধিত্বে কি মন টান হতে পারে?  এসব সিনেমার শুরুটায় বুঝিয়ে দেয় মন না পেলেও, মনোরঞ্জন কখনই নয়। এইখানেই দ্বন্দ্ব, ছন্দ এবং সিনেমার পাঁচালী, এক অন্য পথ ধরে চলল। এমনকি স্রষ্টার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী-  যাঁদের প্রথম ও শেষ চেনার সনদ হয়ে রইল – সত্যজিৎ রায় – এর সিনেমা। এক কথায়, বলা যায় না। বাংলা সিনেমায় কাজ করে, কোনও অভিনেত্রী বিশ্ব সিনেমায় গৃহীত হয়েছেন, নাম খুঁজতে থাকার।

6

ছবি ২

১.২ নায়িকা নাকি অভিনেত্রী?

নায়িকাও একপ্রকারের অভিনেত্রী। কিন্তু সব অভিনেত্রীই নায়িকা নন। পেশাদারিত্বে টিকে থাকতে গেলে শুধু চরিত্রাভিনেত্রী হয়ে থাকলেও চলে না। অভিনয়ের খিদে থেকেই বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়েও, লক্ষ্যে থাকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়। নায়িকা। নায়িকা মানে বেশি আর্থিক লাভ। ফলে রোজগার এবং সিনেমায় আরও কাজ। তখনও বিজ্ঞাপনে ছেয়ে থাকার যুগ আসেনি। নায়িকা মানে সর্বত্রগামী নন। নায়িকা মানে সর্বজনসমক্ষে বিজ্ঞাপিত হতে থাকা নয়। অবশ্যই নিয়মমাফিক চলা এক অভিনয়ের চাকরি। তবে এর বৃত্তের পরিধি বাংলা সিনেমার, ভাষা বাংলার চত্বরের। আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার পথ, জানা নেই তার।

সিনেমার সঙ্গে তো এক উপনিবেশকেন্দ্রিক জীবন। যাদের সঙ্গে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা সবই জুড়ে যায়। এবং জীবনের চাহিদায় ঘরের চৌহদ্দিতে থাকা কোনও কোনও মেয়েদের সিনেমায় কাজ খুঁজতে হয়। যেমন, কানন দেবী, যেমন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। ওঁদের জীবনের সঙ্গে সিনেমার যোগসূত্র তাত্ত্বিক নয়, ভাবুক হওয়ার নয়। কেবলই প্রয়োজনের খাতিরে পরিবারের অনুমতি পেয়ে কাজ করার। সিনেমার একটা মাধ্যম হয়ে এলেও, বাঙালির সংস্কৃতির ধ্বজা ওড়াবে, এমন কোনও শর্ত টুকরো উদ্বাস্তু জীবনের বাংলার ছিল না।

ফলে, আঞ্চলিক সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভাত-কাপড়ের জোগাড় করতে আসা অভিনেত্রীদের লক্ষ্য হয় রোজগার। সেটা যুক্তিও বটে, জীবন তো শুধু শিল্পের গুণে চলে না। ফলে, সিনেমার পর্দায় ভাল অভিনেত্রীদের থাকাটা বাঙালির অন্তঃপুরে থাকা মেয়েদের মতনই। সেখানেই হাসি-কান্নার জীবন। চোখে গ্লিসারিন, চকচকে মুখ। মুখর সংলাপ। হাততালি। টিকিট বিক্রি। হাউস ফুল শো। এই পর্যন্ত ব্যবসা এবং সিনেমার অন্তর্বর্তীকালে সর্বজয়া-দের শুরু। পড়াশোনা জানা, সার্বিকভাবে নিজস্ব বোধের জন্যে গণনাট্যের সঙ্গে জুড়ে থাকা এক সত্তার পক্ষে সেকালের বাংলা ছবির আবহাওয়া অচেনা ছিল না। এর বাইরের কিছু হতে পারে, তখনও ভাবতে পারেনি রুচিশীল বাঙালি। জনৈক এক সাংবাদিক সদ্য ৯ মে চলে যাওয়ার সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে লিখেছেন যে, তিনি ফিল্মের মহাকবি। এই দিয়ে পরিচালকের জন্যে ভূমিকাটি সারা হলেও, বাকি থেকে যান, নায়িকা , অভিনেত্রী হতে আসা শিল্পীদের আলোচনা।

7

ছবি ৩ ও ৪

নায়িকার কাজ মনোগ্রাহী হতে হবে। বাণিজ্য দিতে হবে। সেই কর্মধারার উলটোদিকে সত্যজিৎ কি করতে চলেছেন , তা বোঝার জন্যে ১৯৫৫ সাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এবং, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সেই পরিচালকের দেখা হতে হবে, যাঁর কাছে সিনেমার আগ্রহ জন্ম নেয়। এবং বাংলাছবির দুনিয়া বিশ্বভ্রমণে সামিল হয়। সেখানে তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনার চেয়েও বেশি মন টানে। তাঁর সিনেমায় অভিনেত্রীদের কর্মব্যাপ্তি ঘটে শিল্পের মাধুর্যে।

 কিন্তু ঝোঁক এবং দর্শক ঝাঁকের কই হয়ে দেখতে থাকেন সিনেমা রঙ- চঙ – ঢঙ করা নায়িকার বাধ্যতামূলক সূচি। গতানুগতিক নায়িকা- নায়কের মিল-অমিলে চলা চলচ্ছবির সঙ্গে বাংলাভাষাতেই রিলিজ হবে আরেক ধরণের চলচ্চিত্র। নায়িকা একা কেন, বাণিজ্যের জন্যে ব্যস্ত সিনেমা জগতের সমস্ত কলা-কুশলীদের লক্ষ্য কেবলই আর্থিক মন্দা সরিয়ে চলা। সেক্ষেত্রে, ইচ্ছেমূলক নায়িকার পাশ কাটিয়ে যে ছলাকলা এবং নটী – দের অভিনয়, সেখানে বাংলার ক্ষেত্রে তারকাদের উদয় ও অস্ত অনেকটাই ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত। প্রোডিউসারের ইচ্ছেয় কর্ম-নির্ভর করার। গত শতকের হাল- হকিকতের সূত্র ধরে একুশ শতকের দিকটা দেখে নেওয়া যায়।

একটা সজীব , প্রাণবন্ত ফিল্ম কারখানা খুলে দিয়েছে রোজগারের পথ। তাকালেই চোখ ঝলসানো সিনেমা। ব্যাপ্তির সঙ্গত পরিবেশনে অকারণে শট থেকে শটে, নদী নালা খাল বিল ছেড়ে পাহাড় সবজে উপত্যকা। দ্রুত পাল্টে যায়। মনমোহিনী মনেহতে থাকে নায়িকাকে।  একটা ডিজিটাল ভ্রমণের ক্লিপিংস উড়ে চলে যায়। সেখানে অভিনয়কে তুড়ি মেরে নায়িকার সাজসজ্জাসমূহের প্রকাশ, সিনেমার ব্যাকরণের সঙ্গে যেন ব্যঙ্গ করে। নায়িকা কেবলই নায়িকা সেজেই পার পেয়ে যান, অনেকটা পুতুলের মতন। এক না-অভিনেত্রীর সঙ্গে সিনেমা শেষের আগেই পালিয়ে যেতে থাকা দর্শকের প্রবণতা থেকেই বিচারের। আন্তর্জালিক মাধ্যমের কল্যাণের সিনেমার প্রাদুর্ভাবের আগেই সত্যজিৎ- এর সিনেমার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। যা রয়ে গেছে, তা হল শিক্ষার।

ছবি ৫

ছবি ৬

8

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার কাজ নিয়ে বিচার করার প্রশ্নই ওঠে না।  স্বভাবতই, প্রশ্ন ওঠে তবে উক্ত প্রবন্ধের লক্ষ্য কি, শব্দের প্রাচুর্যয়ের মধ্যে এমন করে ভেসে থাকা। লক্ষ্য বা উদেশ্য হল, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে দেখা অভিনেত্রীদের নিয়ে বিশ্লেষণ করে যাওয়া। যার ফলে, বর্তমানের সঙ্গে গত শতকের এক দফা তুল্যমূল্য বিচার হয়ে যাবে। অর্থাৎ, রঙিন নায়িকাদের সঙ্গে সাদাকালো শিল্পীদের আলোচনা। যেমন ধরা যাক, এক প্রতিযোগিতায় এই দুই ধরণের সিনেমার শিল্পীদের কাজের ক্লিপ্নিং দেখানো হচ্ছে। একুশের উপগ্রহ-নির্ভর একাধিক শিল্পরসিক  জনমাধ্যমের সঙ্গে ওদের অস্পষ্ট কথা, যান্ত্রিক ত্রুটির সঙ্গে সিনেমা-গ্রহে কতখানি থাকবেন , কতক্ষণ থাকবেন।

ছবি ৭

উত্তরের এক, অভিনয় দিয়ে শুরু হয়ে নায়িকা না হয়ে ওঠা, কয়েকজন অভিনেত্রীর কথা। তদুপরি ২০২১ সালের নিরিখে তাঁদের শিল্পীর শিরোনামে রেখে দেওয়ার ডজন গল্প।

দুই, যাঁদের সঙ্গে সিম্বলিক সিনেমার যোগমাত্র এই যে, তাঁরা সত্যজিৎ – এর সিনেমার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। উক্ত পরিক্রমায় চূড়ান্ত বিন্দু হয়ে থাকে সত্যজিৎ রায় –এর ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা।

তিন, ছবির সংখ্যা নগণ্য। একটি, দুটি বা চারটি। মুখ্য হয়ে সেখানে একব্যক্তিকেন্দ্রিক গল্প গড়াচ্ছে না। সেটা না জেনেই, উমা দাশগুপ্ত, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় না-বলেছিলেন।

চার, কারণ, বাংলা সমাজের মেয়েদের চিন্তা, ভাবনা, দর্শন এবং উল্লিখিত বাংলা ছবির বাজার, দিখানেপনার ছবির বর্ণাঢ্য বিজ্ঞাপন।

9

পাঁচ, বাছাই করা শিল্পীদের সঙ্গে মনোরঞ্জন, মনকেই প্রাধান্য দিয়ে ছবি করেন তিনি। কিন্তু, ছবি তো চুপ থাকে, সিনেমা কথা বলে। হ্যাঁ, তাঁর সিনেমায় সংলাপ, কথা সীমিত। অল্প। অপ্রয়োজনে নয়। চুপ থাকার মধ্যেই শিল্পের ভাবনা, শিল্পীর ভাবনা ও প্রতিষ্ঠা।

ছয়, নজরকাড়া, মনকাড়া পোশাক নেই। কানন দেবীর অভিযোগ ছিল যে, সাজগোজ করানোর জন্যে জোর করে খোলামেলা পোশাক পরানোর জন্যে চাপ দেওয়া হত। ওরা জানতেন, মানে মালিকপক্ষ যে নায়িকারা থাকতেন একটি বিশেষ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ। ফলে, টাকা নিলে যা বলা, তাই করতেই হবে। আত্মজীবনীতে সিনেমাওলাদের ব্যবসায়িক অমার্জিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখেছেন কানন দেবী। অন্যদিকে, সত্যজিৎ রায় –এর সিনেমায় না – মেকআপের বাড়াবাড়ি, না আড়ম্বর, না সাজানো সেট, না আতিশয্যের ছোঁয়া। শুধু কি ফিল্ম দেখে সিনেমা করার ইচ্ছে। নাকি আরও কিছু নিয়ে এসেছিলেন বাস্তববাদী সিনেমা ‘বাইসাইকেল থিবস’- এর নির্মাণ থেকে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের অপর নির্দেশক জা রনোয়ারের বন্ধুত্বের বিষয়টিও উল্লেখ করতে হবে। কলকাতায় পরিচয় ১৯৪৯ সালে। এরপরই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়ে ভাবতে থাকেন। ইতিমধ্যে তাঁর ঝুলিতে লন্ডনের ৯৯টি সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাও যোগ হয়। বিদেশি সিনেমার প্রভাব তাঁর কাজে এসেছিল।  

ছবি ৮

.১ বিশ শতকের সিনেমার সেই আগন্তুক

বিশ শতকের সিনেমার ‘আগন্তুক’ পরিচালক সত্যজিৎ রায়। তিনি সিনেমা করতে এসেছিলেন সিনেমার বইপত্রপত্রিকা পড়ে, অবশ্যই বিদেশি। এবং সিনেমা সরাসরি দেখে শিখেছেন , সিনেমা করার পদ্ধতি। তিনি উক্ত বক্তব্য রাখেন, একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে। পারিবারিক পরিচিতিতে সাহিত্যের সঙ্গেই তাঁর বেড়ে ওঠা। একটি বিদেশি ছবি দেখে, তিনি সিদ্ধান্ত করে ফেলেন, ছবি করবেন। মানে চলচ্চিত্র। মানে সিনেমা। বাংলাভাষার সিনেমা। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিক্ষার মিশেল থেকে চলচ্চিত্রের নির্মাণের যে নতুন দিক তিনি বুঝেছিলেন, তাই দেখতে পাওয়া যায় পর্দায়। তাঁকে অনেকবার কাজ করতে অনিচ্ছুক তা জানিয়ে ছিলেন সর্বজয়া।

10

ছবি ৯  

 মানে গণনাট্যের সক্রিয় কর্মী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্বন্তর দেখা করুণার আদর্শের সঙ্গে চলা, কমিউন জীবনের পাঁচালী , সিনেমার থেকে অনেকটাই আলাদা বলেই অমত ছিল অনুমান। শিল্পীর গড়ে ওঠার পটভূমি অর্থাৎ সমাজ ছিল যুদ্ধ দাঙ্গা স্বাধীনতা আন্দোলন এবং নাট্যকর্মের মধ্যে দিয়ে আন্দোলন করার দিকে। সেখানে সিনেমা, শতকরা বাঙালির যা ধারণা, তাঁর ব্যতিক্রম হবেন কেন সর্বজয়া। তবে, পারিবারিক বন্ধুত্ব এবং চেনাজানা এক সদ্য হতে চাওয়া পরিচালকের প্রথম নায়িকা তিনি। ভাগ্যিস তিনি রাজি হয়েছিলেন, নইলে বিশ্ব সিনেমা তার সর্বজয়াটিকে পেত না। আর পেত না ইন্দির ঠাকুরনকে। আর দুর্গা-র পেলবতা সত্যজিৎ সিনেমা না করলে দেখা হত না। আন্তর্জাতিক মানব সভ্যতার সংস্কৃতিতে বাংলার যে পোশাক-আশাকহীন মেকআপের জৌলুসহীন মুখটি এত নির্মল , তা  অপরিচিত থেকেই যেত।

ছবি ১০

৩৪ বছর বয়সের মধ্যে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র, ‘পথের পাঁচালী’। সাল ১৯৫৩। ছবির বিষয় গ্রামবাংলার জীবন, হতদরিদ্র পরিবার, মৃত্যু এবং জীবনের চলতে থাকা। এবং  এবং উক্ত চলচ্চিত্রের জন্যে মোট ১১ টি পুরস্কার অরজিত হয় তাঁর ঝুলিতে। প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’ –এ , “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” ইংরেজিতে বেস্ট হিউম্যান ডকুমেনট্রি। সাল ১৯৫৬। এর উপলক্ষ্যে অসীম রেজ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়ে ছিলেন যে, যখন প্রথম কাজ থেকেই কিছুটা সাফল্য পাওয়া গেল। তখন আর থামার প্রশ্ন ওঠে না।

11

ছবি ১১

স্থানিক ভূগোলে চলচ্চিত্র আলোচনায় তাঁর কাজের মান বিচার হয় যে, ‘ গতিহীন’ ‘ দীর্ঘ দৃশ্যায়ন’, ‘সংলাপহীন’।

12

ছবি ১২

ততদিনে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ছজন বিদেশি অভিনেত্রীদের মধ্যে উঠে এসেছেন সিনেমার অভিনেত্রী হিসেবে। পুরস্কার প্রাপ্তি। দ্বাদশ ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড , ‘ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্ট’ –এর ছয় অভিনেত্রীর তালিকায় ছিলেন তিনিও। সাল ১৯৫৯। তাঁর সঙ্গে আর যাঁদের নাম ছিল,তাঁরা হলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান, তাতিয়ানা সামজলোভা, জোয়ানে উডওয়ার্ড, গুইলেত্তা মাসিনা, আনা ম্যাগনানি।[i]   

ছবি ১৩

13

২.২ কিছু চরিত্রেরা তাঁর ফ্রেম ধরেই চিরকালীন

ছবি ১৪

ছবি ১৫

14

ছবি ১৬

এসব তত্ত্বের বিচার করতে করতেই ঠিক এরপরই ১৯৫৯ সালে ‘ অপুর সংসার’ মুক্তি পায়। কারণ, মুক্তি পেল কিশোরী অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর,  অভিনয় ক্ষেত্রটিও।  তাঁকে নিয়ে লেখার আর কি নতুনতর দিক থাকতে পারে। একটি বিষয় তবুও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তা হল সত্যজিৎ রায় –এর অভিনেত্রী ভাবনার স্বকীয় বোধ। তিনি যাঁদের নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা একুশ শতকের সিনেমার ইতিহাসে সুপরিচিত এবং সফল অভিনয় জগতের মুখ। কিন্তু তাঁর কাজের শুরুর সময়ে এরকম ছিলেন না। তিনিও যেমন সিনেমা পরিচালনায় নবদূত, তেমনই তাঁর সঙ্গে কাজ করতে আসা অভিনেত্রীরাও। নতুন অভিনেত্রীদের থেকে ববিতা, মাধবীদের নাম বাদ থাকবে।  তিনি অর্থাৎ পরিচালক সত্যজিৎ রায় সমাজের উপর তাঁর দর্শনের ড্রোন ক্যামেরা উড়িয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন, কি কি গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে সিনেমার সমাজ বয়ে চলছে। এবং তা থেকে বেরোনোর জন্যে সিনেমার ভূমিকা ঠিক হতে পারে।

15

তাঁর ছবির বিষয় নিয়ে তর্ক না করেই, বাঙালি সিনেমা প্রেমী ফিরিয়ে দিয়েছেন অবোধ্য শব্দ। এর বিষয়ে অসীম রেজ – এর নেওয়া আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র-র তরফে সাক্ষাৎকার সাক্ষ্য। তাঁকে বাঙালি সমাজের তীক্ষ্ণ সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।

ছবি ১৭

একথা উল্লেখের কারণ হল, সত্যজিৎ রায় – এর ছবি নিয়ে লিখতে গেলে সিনেমার পড়াশোনার প্রাথমিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এদেশে সিনেমার পরিকাঠামো তৈরি হওয়ার আগেই ব্রিটিশদের সঙ্গ-সংস্কৃতি হিসেবে নাটকের চর্চা শুরু এদেশে। কলকাতায় প্রথমদিকের রাজধানী শহর বলে, সেখানেই শুরু হয়েছিল নাটক, থিয়েটার। সিনেমার সময় আসার আগে পর্যন্ত সময়ে, সাংস্কৃতিক ভাবধারার অর্থ ছিল, সাহিত্য এবং নাটক। ততদিনে গণনাট্যের পরবর্তী সময় ধরে ‘ভাল নাটক করার লক্ষ্যে’ এগিয়ে চলেছে গ্রুপ থিয়েটার। মানে কলকাতার নাটকের দলগুলো। পাশাপাশি, সিনেমার বাজার বেশ চড়া। মধ্যবর্তী বিশ শতকের কলকাতার সিনেমা বলতে ছিল মূলত, ছায়াছবির নায়ক-নায়িকা প্রধান ছবি। বাজারিয় হিট-এর দুই অর্থে ভাবা যায়। এক, অর্থ টাকা। অন্য অর্থ নামভূমিকায় অভিনেত্রীদের বাজারদর ওঠে। এবং হিট সিনেমার ফায়দার ফসলে নায়ক – নায়িকার পাশাপাশি সহযোগী, সহকারী, কারু – চারুশিল্পীদের বাজার – সংসার চলে। তথা খাওয়া- পরার সংস্থানের ভূমিকায় বিশ শতকের সিনেমা সংস্কৃতির এক মূল্যবান দিক থেকে আলোচিত হতে পারে।

16

ছবি ১৮

অন্যদিকে, আলোচ্য প্রবন্ধের আলোচনা সত্যজিৎ রায় – নির্মিত ছবির অভিনেত্রীদের নিয়েই। অর্থাৎ, কিনা বাছাই করা কিছুজন। সত্যজিৎ রায় মুনাফামুখী চলচ্চিত্রের ধারার বিপরীতে কাজ শুরু করেন। তাঁর বাছাই করা অভিনেত্রীদের বিশিষ্টতা হল – এক, মধ্যবিত্ত সমাজের স্কুল – পড়ুয়া, দুই, গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেত্রী, তিন, গণনাট্যের অভিযোজিত মেধা, শিল্পত্বের ধারণাজ্ঞান সম্পন্নতা। যা সমাজের নির্ণীত স্টার – কেন্দ্রিক নির্মাণের ধারণার নয়।

অভিনেত্রীদের বর্ণনা দেওয়া যায় নাম ও চরিত্রায়ন হিসেবে। মঞ্চে কাজ করা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। গণনাট্য সংঘের করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশিষ্ট চুনিবালা ওরফে নিভাননী থিয়েটার পাড়ার কাজ না পাওয়া এক শিল্পী। স্কুল – পড়ুয়া উমা দাশগুপ্ত। এঁদের পরিচিতির কতটুকু তিনি নিয়েছিলেন অভিনেত্রী হিসেবে? এবং, তাঁরা কতটুকু পেয়েছেন তাঁর ছবিতে একটিবার একটিমাত্র চরিত্র থেকে। এর মূল্যায়ন তো বাণিজ্যিক মাননির্ভর হয় না। বিশেষত যেখানে গবেষণার বৈজ্ঞানিক যুক্তিসম্পন্ন দিকটি গুণগতমান ও সংখ্যাগতমান নির্ভর হয়ে বিচার্য। এক্ষেত্রে গুণগতমান নির্ভর হতে হবে আলোচনার বিশ্লেষণ।

17

. একুশ শতকের নারী ম্যাসকট  

কেন সত্যজিৎ রায় সমালোচিত। উত্তরে বিশ্লেষক হিসেবে এটাই দর্শান যায়। এক, একুশ শতকের বাণিজ্যিক ধারণার প্রগতির সূচনা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। দুই, ঘরের বাইরে বেরোতেই নারী ও শাড়ি অদম্য এক শক্তি। সে গৃহের সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করে ঘর। ঘর ভাড়া? সংসার? বিয়ের পরের সংসার? এসব এক মেয়ের সঙ্গ ছেড়ে দেয়। মর্যাদার মধ্যে থেকে সমাজ – শর্ত করে যে, ঘোমটা দিয়ে পাড়া, ঘর সংসার। আর পাড়ার পর বাইরের দুনিয়ায় মানানসই, আধুনিকা হয়ে ওঠার সূচনা। আধুনিকতা কি সেই প্রসঙ্গের ধার ঘেঁষে নারীর আধুনিক বিষয়টা যুক্তি ও তর্কের। নারীর ঘর, সংসার এবং বাইরের সমাজ দেখাতে থাকার গল্প ক্যামেরার সুবাদে হয়ে যায় আন্তর্জাতিক উপাদান। সমাজের এক নির্দিষ্ট ভূগোলে মেয়েদের কিছু হয়ে ওঠার কারণ হল আর্থিক দুরবস্থা, অসামঞ্জস্যের দিনলিপি। অর্থাৎ, নারীর স্বাধীনতা দেখানেপনা, অনেকটা মিথ্যের সঙ্গে অনেকটা সত্যির যোগসূত্রে ছক। সমাজের ছকে মেয়েরা যেন ব্যাঙের জিভে আটকে পড়া পতঙ্গ। বিশ শতকের এই নারীর বাইরের দুনিয়ার গড়ন একুশ শতকের নারীর প্রগতির পরিকাঠামোর প্রেক্ষাপট। সত্যজিতের সিনেমা ছাড়াও একইভাবে নারীকে ব্যবহার করার ঘটনা ঘটে সমকালীন পরিচালকদের সিনেমায়। তাহলে, রোজনামচার নিম্নবিত্ত বাঙালি সমাজ গায়ে আঁচল, মাথায় ঘোমটা দেওয়া নারীকে মহানগরের ভিড়ে ছেড়ে দেয় গ্রাসাচ্ছদনের শর্তে।

একুশ শতকের নারী ম্যাসকট সেই মেয়ে তথা রোজগেরে নারীদের প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে সাহিত্য ও কলার উপাদান। এবং, সিনেমার উপাদানও হয়। কারণ, বিশ শতকের বাজার-নীতির পরিকাঠামোয় সিনেমার স্থান ছিল।সুরক্ষাবিহীন দৃষ্টিতে শুরু হওয়া সমাজের এই পরিবর্তনকে একাধিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রধানতম ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে সমাজের প্রয়োজন । সমাজের আগের কাঠামো অনুসারে চলে আসা দৃষ্টিতে মেয়েদের সুশীল কন্যা, ভাল মেয়ে – তকমার পাশে তৈরি হয় আধুনিকা সত্তা। এই আধুনিক সত্তাকে স্তরভেদে সমাজ নির্ণীত মেয়েদের ভাল হয়ে থাকা আর চলে না। কারণ, আধুনিক সত্তা মানে ঠিক হবে, তা সমাজ নির্ণয় করতে সক্ষম হয় না। কারণ, আধুনিকা সত্তাকে ঘরে ও বাইরে লড়াই করতে হয়। লড়াই অর্থে মেনে না নেওয়া। আর সমাজ প্রতিফলনে একথা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, মেনে না নেওয়া মেয়েরা পুরুষের কাজ, সিদ্ধান্তই মেনে নেয় না। ফলে, আধুনিকা সত্তাকে নিয়ে বিতর্ক ঘটে।

ছবি ১৯

18

ছবি ২০

19

ছবি ২১

এবং তাঁদের নিয়ে ঝাপসা এক উগ্র ভাবমূর্তি দেখান হয়। সেখানে, প্রচ্ছন্নভাবে পুরুষের দিক থেকে আসা সিদ্ধান্ত, না মেনে নেওয়াই কারণ। ফলে, বিশ শতকের স্বাধীন দেশীয় সমাজে মেয়েদের আধুনিক রূপটি অনেক সিনেমাতেই ব্যঙ্গ পুতুল হিসেবে চিহ্নিত। যেহেতু বিশ শতকের সিনেমায় বাস্তব সমাজ – উপাদান নিয়েই সত্যজিৎ – এর কাজ। তাই সিনেমার মধ্যে দিয়ে সমাজের দেখানো সত্যিকারের প্রতিফলন সমাজের বাণিজ্য লক্ষ্যে পৌছয় না। এবং, আরও নির্দিষ্ট হয়ে যায় আন্তর্জাতিক সমাজে বাংলার সমাজ-চিত্র। সত্যজিৎ যেন আধুনিকা সত্তাকে বিশেষ করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন আগামির জন্যে। একুশ শতকের দিকেও এই আধুনিকা সত্তার মেয়েদের সমস্যা ধেয়ে আসে। এর নির্ণয় করা যায়, তবে সমাজ সমাধান দেখায় না। আর সমাধানের প্রশ্ন তুলে তাই মহানগরের লাজুক গৃহবধূ-টি আন্তর্জাতিক এক কর্মী-নারী হয়ে যায়। বলা যায়, শ্রমিক।  কারণ, পরিবার নামক ক্ষুদ্র পরিসরের থেকে সে বা তারা চলতে শুরু করে চাকরি – সংগঠন – অফিস – কাছারির এক বৃহৎ পরিসরে। সেখানেই এক থেকে একক হয়ে সেই চরিত্র প্রতিনিধিত্ব করে। আন্দোলন করে। সত্যজিৎ এই কর্মীনারীদের লড়াইয়ের সলতে জ্বালিয়ে দেন চিত্রায়নের মাধ্যমে।  সে প্রতিনিধি,  শুধু ভূগোলের এপাশের নয়, এর ক্ষেত্র হয় বিশ্ব সমাজ, মূলত মেয়েদের সমাজ। নারীসত্তার বিকাশ এবং আত্ম নির্ভরতা যেখানে। সেখানেও দর কষে দেওয়া সমাজের চৌকাঠে মেয়েরা ঘর ও বাইরের টানাপোড়েনে ভুগছে। একুশ শতকের নারী ম্যাসকট বলে মনে করা যায় ‘মহানগর’ – এর আরতিকে।

20

 সম্পর্কের দাবিতে নারীর প্রাচীন মূল্যবোধের উদাহরণ তুলে এনে দায়ী করে পারিবারিক কর্তব্যের শিথিলতায়। সমাজ বাইরের কর্মযোগী মেয়েকে আধুনিকা হয়ে ওঠার সূচিতে ফেলছে ঠিকই, কিন্তু আধুনিক হয়ে উঠছে না সমাজ। এবং, মেয়েদের আধুনিকা বাইরের পোশাকটি পরিবর্তন করে ঘরের পোশাক পরতে বাধ্য করে তুলছে।  এক, কাজের সুবিধের জন্যে। দুই, ভেতরে সংসারের দিকে টান। তিন, ননদের বিয়ে। চার, শ্বশুরের ওষুধ কিন্তু পুরুষ-প্রচণ্ড মহিমাকে সম্মান। পাঁচ, বউ , ছেলের মধ্যে বাণিজ্যের লক্ষ্মী মানে মেয়ে, লজিক সিম্বল সব মেনে গৃহস্থের কল্যাণের জনেই চাকরি। দুই ভাগে বিভক্ত জীবন। আরও ভাগ হতেও পারত। সেটা সবটা মধ্যবিত্ত সমাজ মানবে না জানতেন সত্যজিৎ রায়।

মহানগর। কেন্দ্রীয় চরিত্র , একটি এমন চরিত্র যার সঙ্গে অনেকগুলো সম্পর্কের শাখা প্রশাখা। মাধবী মুখারজি। এরপর ছবি চারুলতা। কেন্দ্রীয় চরিত্র, রবীন্দ্রনাথের লেখা এক চরিত্র। এই ছবিকে অনেক ফিল্ম – তাত্ত্বিক তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবির বাছাই তালিকায় ফেলেন।  … সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে টেক্সট হিসেবে বিশ শতকের সাহিত্য, এবং তার কেন্দ্রের ঘটনা – চরিত্র ধরে চলচ্চিত্র – রূপায়ন। ফলে, একথা বুঝতে অসুবিধে হয় না, সাধারণ সমাজের একটি মেয়েকে এক্ষেত্রে সিনেমার চরিত্রে দেখা যায়।  একজন চরিত্র কেন্দ্র চরিত্র হবে না, অনেকে মিলেই ছবির একটা চরিত্র তৈরি করে।

 

ছবি ২২

21

বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী। সিনেমার অফারে এমনই এক লক্ষ্মী – চরিত্রের জন্যে কাস্ট করতে চেয়েছিল স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ওরফে বিমলাকে। বিমলা “ঘরে- বাইরে”র তীব্র ভাল ছবির সঙ্গেই বেছে থাকতে চেয়েছিলেন। ফলত, তাঁর আর ছবিতে কাজ দেখা যায় না। তবে, বাংলা ছবির অ

ছবি ২৩
ছবি ২৪

হিসেবে অনেক নাম তালিকায় এলেও, যে নামগুলো তুল্যমূল্য বিচারে সাধারণ তালিকার অনেক উপরের দিকে, তাঁরা চরিত্রের জন্যেই বাছাই করা, পরিচালকের সনদ এবং চরিত্রের একক হিসেবে আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লিখিত হবে।

বাংলা ছবির অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন যে যে শিল্পীরা, তাঁদের তখনও অভিনেত্রী বলা যায় না। অবশ্যই স্বাতীলেখা এর বাইরের। তাঁর ছবিতে অভিনীত অভিনেত্রীদের দু – গোত্রে ভাগ করা যেতে পারে। এক, অনভিজ্ঞ। দুই, অভিজ্ঞ। সিনেমায় না হলেও, অভিনয় বিষয়ে জ্ঞান, চর্চা ছিল থিয়েটার করার মধ্যে দিয়ে। অভিনেত্রী-শিল্পীদের আরেকদিক থেকেও ভাগ করা যায়। এক, নায়িকাকেন্দ্রিক চরিত্র বা প্রধান ভূমিকা। দুই, চরিত্রাভিনেত্রী বা পার্শ্ব চরিত্র। আবার, আরেকদিক থেকেও ভাগ করা যায়। এক, থিয়েটারের । দুই, সিনেমার।  তিনি থিয়েটারের অভিনেত্রী। সিনেমার  পর্দায় তাঁকে দেখার পর তাঁকে চিনলেন কজন বাঙালি।  জানেন। আবার, ঘরে বাইরে-র স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-কে ক্লাসিক অভিনেত্রী হিসেবে বারবার দেখা যায়। কিন্তু মঞ্চে ওঁর অভিনয় কজন দেখেছেন, সেটা ফিল্ম এবং থিয়েটারের পারিভাষিক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-ই বলে দেয়।

ছবি ২৫

22

ছবি ২৬

ছবি ২৭,২৮

23

সত্যজিৎ রায়-কে নিয়ে লেখার জন্যে বেশি ভাবতে হয় না। আবার, খুব ভাবতেও হয়। এক, তো উনি একুশ শতকের কাছাকাছি সময়ের আইকন , বিশেষত সিনেমার। সিনেমার তত্ত্ব না বোঝা বাঙালির জীবনের সবকটি সামাজিক – অর্থনৈতিক স্তর তিনি ধরেছিলেন ফ্রেমে।  যদিও, বাঙালির কাছে ফিল্ম মানেটা সত্যজিৎ রায় নন।  সত্যজিৎ রায় এমন একজন পরিচালক যিনি মুখ খুঁজে এনে নক্ষত্রে বসিয়েছেন।  

ছবি ২৯

ছবি ৩০

24

কখনও পরিবেশ পাল্টে গেলে ছবির দৃশ্য পাল্টে যায় , সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছবির চরিত্রদের নাম, পদবি, এমনকি কাস্টিংও বদলে যেতে পারে, সেটা সত্যজিৎ-এর ছবিতে অনেকবার হয়েছে। যেমন, কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাগানবাড়ি থেকে দৃশ্য সরে পাহাড় , তাই ছবির নাম যেমন পাল্টে গেল। তেমনই পাল্টে গেল – চরিত্রদের পদবি পর্যন্ত।[ii] এই পরিবর্তনের কারণ, মনস্তাত্ত্বিক একপ্রকার সূক্ষ্মতা। যেখানে সমাজ থেকে তুলে আনা চরিত্রদের নিপুণ পদ্ধতিতে নির্মাণ করেন পরিচালক। ঐ যেমন তাঁর খেরোর খাতায় আঁকা মেলে। ঐ যেমন তাঁর স্ক্রিপ্টের পাশে বর্ণিত পোশাক – চরিত্র মেলে হাতে আঁকা। যেমন, জানিয়েছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত , বিমলা – চরিত্রের কাস্টিং হতে আসার সময়ের বর্ণনায়। মনে করা যায়, শিল্পের ব্যাকরণ বোধের নির্মিতি পাঠ তাঁকে সহজিয়া করেছিল। তাঁর চরিত্রায়ন আন্তর্জাতিক মানের একক। যার বিকল্পের সন্ধানে কোন অন্য মুখ মেলে না। কঠিন করে দেখলেও, চরিত্র মানে খোঁজার শেষ বলা যায়। বিশ্লেষণের অতিমাত্রায় তিনি।

সত্যজিৎ রায় –এর ক্যামেরার টেক , শট থেকে অভিনেত্রী হয়ে ওঠাদের তালিকা সাল অনুযায়ী করা যায়। সিনেমার অভিনেত্রী অনঙ্গ বউ ওরফে ববিতা। আন্তর্জাতিক শিল্পী বলতে এককথায় তাই। যাঁকে মিডিয়া চেনে,। এরকমভাবে  পদ্মা দেবীর নাম করলে? কতজন জানেন। তিনি “জলসাঘর” ১৯৫৮-এর চরিত্র। শর্মিলা ঠাকুর, “দেবী” ( ১৯৬০); “তিনকন্যা”-র  ১৯৬১, মণিহারা – তে কনিকা মজুমদার, চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অপর্ণা দাশগুপ্ত। অনুভা গুপ্ত, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, অলকানন্দা রায় “কাঞ্চনজঙ্ঘা” (১৯৬২) তে। রুমা গুহ ঠাকুরতা “অভিযান” (১৯৬২)।মাধবী মুখোপাধ্যায়, জয়া ভাদুড়ি , শেফালিকা দেবী, “মহানগর”( ১৯৬৩)। মাধবী , গীতালি রায় “চারুলতা” ( ১৯৬৪)। মাধবী মুখোপাধ্যায় “কাপুরুষ ও মহাপুরুষ”(১৯৬৫)। শর্মিলা ঠাকুর, সুমিতা সান্যাল “নায়ক” ( ১৯৬৬)। কণিকা মজুমদার , গীতালি রায় “চিড়িয়াখানা” ( ১৯৬৭)। শর্মিলা ঠাকুর, সিমি, কাবেরি চট্টোপাধ্যায়  “অরণ্যের দিনরাত্রি”(১৯৭০) । জয়শ্রী  রায়, কৃষ্ণা বসু “প্রতিদ্বন্দ্বী” (১৯৭০)।শর্মিলা ঠাকুর, “সীমাবদ্ধ” ( ১৯৭১)। ববিতা, সন্ধ্যা রায়, “অশনি সংকেত” ( ১৯৭৩)। লিলি চক্রবর্তী, আরতি ভট্টাচার্য “জন অরণ্য”( ১৯৭৫)। সাবানা আজমি, ফরিদা জালাল “শতরঞ্জ কি খিলাড়ী”(১৯৭৭)। অপর্ণা,  “পিকু”(১৯৮২)। স্মিতা পাতিল, রিচা মিশ্র” সদ্গতি”( ১৯৮২)। “গণশত্রু ” মমতা শঙ্কর ,  ( ১৯৮৯)  । “শাখা – প্রশাখা, ( ১৯৯০),  মমতা শঙ্কর ,  ( ১৯৯০)  ” আগন্তুক”  মমতা শঙ্কর ,  ( ১৯৯১)।

25

 ২.৪ অতপর, সিন্ধান্তে

, অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের সৃজনশীলতা, শৈল্পিক কারুশিল্পের সম্পূর্ণতা এবং যাঁরা কাস্টিং বোঝেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে মেকআপ ধরা চারুলতা, বিমলার চরিত্রায়নের বিভাময়তা স্বীকার করবেন। যদিও, সিনেমা দেখার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের মধ্যে সেই ক্ষমতা এমনিই জন্ম নেয়, যাকে বলা যায়, জন্মগত ক্ষমতা। সমালোচনা করার জন্যে তাঁদের কাছে ফিল্ম স্টাডিজের পাথেয় প্রয়োজন হয় না। হ্যাঁ, তিনি সিনেমার অস্কার “পথের পাঁচালী”র দীর্ঘসূত্র রেখে গেছেন। তাঁর কাজ থেকে কয়েক দশকের পরও গবেষণাধর্মী অভিনেত্রী সত্তার বিশ্লেষণ লিখে ফেলা যায়। সত্যজিৎ রায় একশো বছরের সেই ঋদ্ধ পরিচালক। তিনি সিনেমা শিল্পের অস্তিত্ব। সিনেমার এটাই সুবিধে যে, যত্রতত্র ফিল্মের উপস্থাপনা নিজস্ব স্থান কাল সময়ে করা যায়। কিন্তু, মঞ্চের ক্ষেত্রে এরকম হয় না। মঞ্চের কাছে আসতে হয়।

ছবি ৩১

তাই, লেখা যায় তাঁর অভিনেত্রীরা আন্তর্জাতিক। কারণ, তিনি তাঁদের বঙ্গসমাজের থেকে বের করে দিয়েছেন মুক্তি।

 এবং একুশ শতকের সবচেয়ে ধারালো, দৃঢ়, অনিঃশেষ সম্পদ সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর কাজের সার্বিক প্রতিফলনে ঋদ্ধ। যেখানে অভিনেত্রী তথা নারী মানে নতুন ঝলমলে পোশাকের বিভা, যেখানে সিনেমায় দেখানো অর্থেই নয়। আসলে নায়িকা তিনিই যিনি কালোত্তীর্ণ। অভিনেত্রীদের বিপণন, সেই হালফিলের মধ্যে একটি করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর বা ইন্দির ঠাকুরনের সঙ্গে একটি অলকানন্দা যদি মেলে,… মানে অর্থের অপচয় হলেও, হে সিনেমাওয়ালা তাঁদের অভিনেত্রী পদে সাজিও। যেখানে আলোচকদের আশঙ্কা এও রয়ে যায় যে, নয়া জেনারেশন ইঙ্গ – বঙ্গ মিশেলের এই সংস্কৃতি থেকে মউন মুখর সত্যজিৎ ঘরানার চলচ্চিত্রের মন আদৌ বুঝবেন তো। নাকি সিরিজ – মনোরঞ্জনে ভেসে যাবেন। এবং আরেকটি প্রজন্মের অপেক্ষার পর বেছে নিতে পারা যাবে সত্যজিৎ রায় নামক উপাদান।    

26


তথ্যসূত্র

[i] https://www.anandabazar.com/patrika/article-on-famous-actress-karuna-banerjee-1.1023365

[ii] সেনগুপ্ত সুনীত ; সত্যজিতের ছবি ও খেরোর খাতা; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০০ কলকাতা; গাঙচিল ; পৃষ্ঠা ১৮ – ২০ 

ওয়েবসূত্র

ছবি ১ থেকে ৩১, সূত্র আন্তর্জালিক মাধ্যম  

মৌ চক্রবর্তী । গবেষক, লেখক

mou.chakraborty@visva-bharati.ac.in

ছ’য়ের দশকে বহুরূপীর রবীন্দ্র নাটক ও শম্ভু মিত্রের নাটক – প্রযোজনা

কৃষ্ণপদ দাস

ভূমিকা আধুনিক বাংলা-নাট্যের আলোচনায় অন্যতম ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র। অভিনেতা, নাট্যকার, পরিচালক এবং সংগঠকের ভূমিকায় থেকে প্রথম গ্রুপ থিয়েটারের সূত্রপাতের জনক তিনিই। প্রথম গ্রুপ থিয়েটার ‘বহুরূপী’ — যা তৈরীর কৃতিত্ব শম্ভু মিত্রের। গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে এসে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে নিয়ে ‘বহুরূপী’ খুব স্বল্প সময়েই বিশেষ উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছে রবীন্দ্র-নাট্যের প্রযোজনা দিয়ে — যা পাঁচের দশক থেকে শুরু হয়েছিল। পাঁচের দশকে ‘রক্তকরবী’, ছয়ের দশকে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ‘বিসর্জন’ ‘রাজা’ নিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠে বহুরূপী। বহুরূপীর পাশাপাশি এল নান্দীকার, শৌভনিকের মত নাট্যদল। তবে আমার এই মুহূর্তের উপস্থাপনা শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাট্যভাবনা এবং বহুরূপীর নিজস্ব প্রযোজনায় রবীন্দ্র-নাটক।)

স্বাধীনতা উত্তর বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাদের প্রায় সকলেই গণসংস্কৃতির প্রশস্ত রাস্তায় পা মিলিয়েছিলেন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অভূতপূর্ব অগ্রগতি লক্ষ করে ভারতের শ্রমজীবী মানুষের । মনেও সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরিত হয়। স্বাধীনতা দেশপ্রেম ও মানবমুক্তির । সংজ্ঞায় শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব যুক্ত হল । এরই পটভূমিতে প্রতিষ্ঠিত গণনাট্য সংঘের কর্মসূচিতে যে সকল প্রগতিশীল শিল্পী-নাট্যকর্মী এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন যুবক শম্ভু মিত্রও । গণনাট্য সংঘের ‘ল্যাবরেটরি’, ‘জবানবন্দী’, ‘নবান্ন’ নাটকের প্রযোজনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তার । অভিনয়ে ও পরিচালনায় তার দক্ষতা স্বীকৃত হয় । কয়েক বছর বাদে গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে এসে শম্ভু মিত্র ও মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য সম্মিলিত প্রয়াসে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বহুরূপী’ নাট্য সংস্থা (১৯৫০, ১ মে) । বাংলা নাটকের ইতিহাসে সূচিত হল এক স্মরণীয় পর্ব ।

বহুরূপীর নাট্যাদর্শ  ও প্রযোজনারীতি গণনাট্য সংঘের পথে অগ্রসর হয়নি বলে শম্ভু । মিত্র সমালোচিত হলেও তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি । বিশেষ করে রবীন্দ্রনাটকের । উপস্থাপনা ও প্রযোজনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল স্রষ্টার । রবীন্দ্ৰনাটকের ব্যাপক পরিচিতির মূলেও তাঁর অবদান বিস্মৃত হবার নয় । সে কারণেই বিশিষ্ট অভিনেতা ও নাট্যকার কুমার রায় বলেছেন –

“ভারতীয় থিয়েটারের রূপরেখা শম্ভু মিত্র প্রযোজিত, নির্দেশিত রবীন্দ্রনাটক অবলম্বন করেই আঁকা যায় । যে ইতিহাস তিনি এ ক্ষেত্রে তৈরি করে গেছেন তাকে । আজকের বিশ্লেষণী চোখে, আজকের দূরত্বে কেউ হয়তো বিচার করতে পারেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাটক প্রযোজনায় তার সাফল্য অস্বীকার করা যায় না ।”

28

পাঁচের দশকেই বহুরূপী রবীন্দ্রনাটককে এক বিশেষ উচ্চতায় তুলে ধরেছিল । ছয়ের দশকেও বহুরূপীর পাশাপাশি অন্যান্য কিছু দলও রবীন্দ্রনাটকের একাধিক প্রযোজনা করেছে । ১৯৬১ সাল ছিল রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ । সেই জন্যে রবীন্দ্রনাটক অভিনয়ের একটা নতুনতর প্রচেষ্টা দেখা দিচ্ছিল । বহুরূপীর ‘বিসর্জন’ ও ‘রাজা’ ছাড়াও নান্দীকার অভিনয় করেছে ‘চার অধ্যায়, সুন্দরম ‘ডাকঘর’ এবং শৌভনিক মঞ্চস্থ করেছে একাধিক রবীন্দ্ৰনাটক ‘রাজা ও রাণী’, ‘তাসের দেশ’, ‘বাঁশরী’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘শেষ রক্ষা । থিয়েটার ইউনিট প্রযোজনা করেছে ‘নৌকাডুবি’ ও ‘শোধবোধ’। আসলে রবীন্দ্র নাট্যভাবনা, নাট্যাঙ্গিক সমস্ত শ্রেণির মানুষের কাছে বোধগম্য না হওয়ায় রবীন্দ্রনাটককে । বহুকাল মঞ্চনীরব থাকতে হয়েছে । শম্ভু মিত্র আদ্যন্ত একটি ভারতীয় নাট্যকলার সন্ধানে নিয়োজিত ছিলেন,  সেই সূত্রে আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের কথাও ভাবতেন । ঐতিহ্য কী, আধুনিকতা কী এসব ভাবতে ভাবতেই ‘আধুনিক কালকে বুঝতে বুঝতে, ব্যক্তি ও সমাজের বন্ধনকে ও দ্বন্দ্বকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে করতে, পথ । চলে এল প্রাক্তন যুগের এক রবীন্দ্রনাথের প্রাঙ্গণে ।

শম্ভু মিত্রই প্রথম রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও নাট্যভাষা আয়ত্তে এনেছিলেন বুদ্ধি দিয়ে, হৃদয় দিয়ে এবং আন্তরিক ভালোবাসা দিয়ে, বিজ্ঞানীর মতো অনুসন্ধিৎসু মন দিয়ে । তাই একথা আজকে কেউ অস্বীকার করবেন না যে, তিনি একটা যুগ তৈরি করে গেছেন— ঐতিহ্যকে অস্বীকার না করেই; তিনি রবীন্দ্রনাটককে মঞ্চে পুনরাবিষ্কার করে গেছেন ।

(ক) বিসর্জন

রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন’ নাটকটি বহুরূপীর প্রযোজনায় ও শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় দিল্লির । আইফ্যাক্স হলে মঞ্চস্থ হয় ১৯৫১ সালের ২৭ অক্টোবর। এই নাটককে সময়োপযোগী । করে মঞ্চস্থ করেছিল বহুরূপী । এই নাটকের বার্তা দেশকালজয়ী । কেননা যুগে যুগে সব । দেশে আদর্শের নামে, ধর্মের নামে নরমেধ যজ্ঞ অতীতেও ঘটেছে, আজও ঘটছে । ১৯১৬-তে ‘বিসর্জন’-এর ইংরেজি রূপান্তর ‘স্যাক্রিফাইস’ রবীন্দ্রনাথ যখন লিখছেন জাপানের পথে জাহাজের ডেকে বসে, এক বিশ্বব্যাপী মহাযুদ্ধ তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে দেশ-বিদেশের নগর প্রান্তরকে করেছে প্লাবিত । উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন— “I dedicate this play to those heros who bravely stood for peace when human sacrifice was claimed for the God of war”. ‘রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এই নাটকে প্রেম আর প্রতাপের মধ্যে ভাবের বিরোধ বেঁধেছে ।

29

একদিকে অহিংস প্রেম, অপর দিকে সংস্কারাশ্রয়ী হিংসার উন্মত্ত উল্লাস । একদিকে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের অটল আদর্শনিষ্ঠা ও আত্মপ্রত্যয়, অন্যদিকে শক্তির উপাসক রঘুপতির মোহান্ধতা ও  দাম্ভিক ব্রহ্মতেজ— এই দুয়ের সংঘাতে দিশাহারা জয়সিংহের দুঃসহ চিত্তদাহ, যার চরম নিবৃত্তি আত্মবিসর্জনে । রাজর্ষি গোবিন্দমাণিক্যের অঞ্চল স্থিতপ্রতিষ্ঠ আদর্শ বিশ্বাসে রানি গুণবতীর দেশাচারমূলক অন্ধ আবেগ স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাহৃত রঘুপতি আত্মপ্রেমের কাছে নিষ্কলুষ জয়সিংহের আত্মবলি করুণ রসকে আরো ঘনীভূত করে । তুলেছে, অন্যদিকে অপর্ণা তার রিক্ততা হাহাকার ও বিদীর্ণ হৃদয় নিয়ে দর্শকদের সামনে নিজেকে তুলে ধরেছে । প্রেয় ও শ্রেয়র দ্বন্দ্বে জয়সিংহ ক্ষতবিক্ষত, সত্য ও মিথ্যার মায়ায় দোদুল্যমান; রঘুপতি অন্ধ বিশ্বাস ও হিংস্র সংস্কারের নাগপাশ থেকে মানবিক প্রেম ও প্রীতিতে উত্তীর্ণ । সমগ্র নাটকের সার্থক রূপায়ণে দর্শকবৃন্দ সংঘাতের শিখরে বিচরণ করতে করতে স্তম্ভিত বিস্ময়ে উপনীত হন এক মঙ্গলময় পরিণতিতে, যেখানে বজ্ৰদগ্ধ । পুরোহিত রঘুপতি অশ্রুধৌত পরিশোধিত চিত্তে সাড়া দেয় অর্পণার আহ্বানে ।

সেকালের অনেক সমালোচক বলেছেন যে মঞ্চের চরিত্রদের যে কোনও রকম একমুখী ভাবকে পরিচালক বর্জন করেছিলেন বলে তারা হয়ে উঠেছিল রক্ত-মাংসের স্ত্রী-পুরুষ, সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে যাদের সহজেই আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ৩ ধীরস্থির দয়াবান গোবিন্দমাণিক্য (কুমার রায়) যে কত নিঃসঙ্গ, তার স্ত্রী বা তাই । তার অতরের অংশভাগ নয়, তা যেমন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে, তেমনি প্রথানিষ্ঠ, প্রাণ । হত্যায় দ্বিধাহীন, ধর্মের নামে মিথ্যাচারের অসংকোচ, আপাত দৃষ্টিতে নিষ্ঠুর রঘুপতি । (অমর গাঙ্গুলী) যখন জয়সিংহের আত্মবলিতে হাহাকারে ভেঙে পড়েন, তখন গর্বোদ্ধত অহংকারের অন্তরালে সুগভীর স্নেহের প্রবাহ আর গোপন থাকে না, আর জয়সিংহের (শম্ভু মিত্র) দুই পরস্পরবিরোধী প্রত্যয়ের মাঝখানে পড়ে যে দোদুল্যমানতা, তা শুধু দুটি ভাবের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার ব্যাপার নয়রঘুপতি ও গোবিন্দমাণিক্য দুজনের সঙ্গেই তার হৃদয়ের, জীবনের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য । শিশুকাল থেকে রঘুপতি তাকে মানুষ করেছে; কালী মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতির । সঙ্গে মিশে আছে রঘুপতির প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা, সেখানে ভিন্নমুখী টান দিয়েছে । শুধু গোবিন্দমাণিক্যের স্বভাবসঙ্গত প্রত্যয় নয়, তাকে জোরদার করেছে রাজার নির্মম, নির্ভয় ব্যক্তিত্ব । আর তাতে প্রেমের স্পর্শ এনেছে সরল, একাকিনী বালিকা অপর্ণা । কিন্তু দর্শককে গভীরভাবে আলোড়িত করে জয়সিংহের আত্মবলি । অবশ্য তাকেও । ছাপিয়ে যায় রঘুপতির মমদ শোকসন্তাপ । কালী প্রতিমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার আগে তার সেই আর্ত হাহকার—

“দে ফিরায়ে জয়সিংহ মোরে ! দে ফিরায়ে ! দে ফিরায়ে রাক্ষসী পিশাচী ! শুনিতে কি পাস আছে কর্ণ ? জানিস কী করেছিস ? কার রক্ত করেছিস পান ?”

‘বিজর্সন’-এর স্মারক পত্র থেকে জানা যায়—

30

“পৃথিবীর অজস্র রাজনৈতিক বেদীর সামনে আদর্শের নামে, ভবিষ্যতের নামে, ঐতিহ্যের নামে ব্যক্তিগত মানুষের সুখ, দুঃখ আশা আর ভালোবাসা সমস্ত কিছুকে । অবজ্ঞায় ভূলুণ্ঠিত করে এক বিরাট নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন ইচ্ছা । সমাসন্ন সেই ভয়ঙ্কর বিসর্জনের সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো ‘বিসর্জন’ নাটকে বাঁচবার পথের একটা দিশা পাব ।”

‘বিসর্জন’ নাটকের সঙ্গে সরাসরি হয়তো মধ্যবিত্ত জীবনে সম্পর্ক নেই । তাই, রঘুপতির দম্ভ, গোবিন্দমাণিক্যের আজ্ঞা দেশকালোত্তীর্ণ মানবের সঙ্কট । রবীন্দ্রনাট্যে শ্রেণি-উত্তীর্ণ যে কোনও মানবের আর্তনাদ শোনা যায় । তবুও নাটক অবশ্যই মধ্যবিত্ত জীবনপ্রান্ত স্পর্শ করে থাকে। বিশেষত বহুরূপীর বিশিষ্ট প্রযোজনারীতি ও সমকালীনতার জন্য ।

আসলে জয়সিংহের এই দাহ দেখা দিয়েছে হৃদয়ের দুটি পরস্পর গতি থেকে । একদিকে পশুবলির প্রতি বিতৃষ্ণা, অন্যদিকে গুরুর প্রতি আনুগত্যের অভ্যাস জয়াসহ চিরকাল থেকে গেছে এই দুয়ের মাঝখানে । কিন্তু বর্তমান অভিনয়ে এই অন্তর্দাহের মূল । কারণগুলি যেমন একদিকে স্পষ্টতর শব্দে ধ্বনিত হয়েছে— এত স্পষ্ট এবং মর্মভেদী আর কখনো শুনিনি, তেমনি অন্যদিকে একালের এযুগের কতকগুলো ভাবানুষঙ্গ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । এরা অস্পষ্ট ব্যঞ্জনার মতো, তবু তারা অর্থবহ । জয়সিংহ শুধু রঘুপতি নামক পণ্ডিত, দাম্ভিক পুরোহিতের দ্বারা আবদ্ধ নয়, সে প্রথার দাসত্বে আবদ্ধ । কিন্তু অভিনয়ের ব্যঞ্জনা এইখানে যে সে একালের ভাবানুষঙ্গ এনে দাঁড় করাচ্ছে, মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই প্রথা শুধু ধর্মের, মন্দিরের, দেশাচারের প্রথাও নয় । বারবার মনে হয়েছে এ জগতে, এ যুগে তাছাড়াও আরও প্রথা আছে যে নিষ্ঠুর স্পর্ধিত, যে প্রথার কাছে আমার জয়সিংহ প্রতিদিন আত্মরক্তদানে নিহত। এ-কথাগুলো রবীন্দ্রনাথের, যা নাটকের চিরন্তন বাণী । নাটকের এই চিরন্তন বাণীর ব্যঞ্জনা মানব-সঙ্কটকেই নতুন রূপে আমাদের চেনায় । ছয়ের দশকের ভারতের রাজনৈতিক সঙ্কট, দেশনেতাদের দোলাচলতা, অসংখ্য প্রাণের নিত্য বলিদানের কথা এ প্রসঙ্গে মনে জাগে । ক্ষমতার সেই উল্লাস এর বিষয়বস্তুকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলে ।

“But Sambhu Mitra has given it through passion, movement and action a certain dimension. His interpretation goes beyond the surface story of king Gobindamanikya’s edict blood sacrifice and emphasizes of humanism and Love.”

এই নাটকটিতে জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র স্বয়ং । ১৯৬১-র নভেম্বর ‘ক্যাপিটাল’ পত্রিকায় শম্ভু মিত্র পরিচালিত এ অভিনীত ‘বিসর্জন না ? সম্পর্কে লেখা হয়—

“But it is not in individual performance that ‘Visarjan’ serves the highest praise. Its claim to wider recogniu that Sambhu Mitra is doing the same kind of work o Bengali Stage as Satyajit Roy is doing on the Bengali Screen; and this is not praising Sambhu Mitra too much. The importance of dialogue in productions to non-Bengali audiances; but I am happy to learn that that the group’s recent performances in New Bohurupee’s, may help integrate the country, whatever the theme.”

31

যুগান্তর পত্রিকা ‘বিসর্জন’-এর অভিনয় সম্পর্কে লেখে—

“…বহুরূপীর কৃতিত্ব এবং মৌলিকতা এইখানে যে, তারা বিসর্জনের কোনও আক্ষরিক অর্থকে বিনষ্ট হতে না দিয়েও একটি প্রবল আবেগময়, নিষ্ঠুর যন্ত্রণাদায়ক উপলব্ধিকে সার্থকভাবে অনুবাদ করেছেন ।… নাটকের প্রশ্নগুলির সঙ্গে তারা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সমসাময়িক চিন্তার উত্তাপ এনে যুক্ত করেছেন । এই উত্তাপ বর্তমানকে চিরন্তনের সঙ্গে যুক্ত করেছে । এই উত্তাপ আমাদের অন্তরের সংঘাতকে রবীন্দ্রনাটকের অন্তর্নিহিত সংঘাতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ।”

‘বিসর্জন’-এর পর রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকটি বহুরূপী  মঞ্চস্থ করল  ১৯৬৪ সালে । নাটকটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্র বাংলা থিয়েটারকে উপহার দিয়েছিলেন এক অন্য অভিজ্ঞতা । ‘রাজা’ একটি আত্ম-জাগরণের নাটক । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—

“…the human soul has its inner drama, which is just same as any thing else that concers man.”

একক মানুষ বাইরে এবং ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে চাইছে । সেখানে প্রত্যেকের নিজের মতো করে রাজা আছেন যার কাছে আত্মনিবেদন করতে  হয় । রানি সুদর্শনার আত্মপলব্ধির সেই তীর্থযাত্রাই এই নাটকের কাহিনি । নাটকের রাজা কোনও কুমুটধারী রাজা নয় । তিনি বিশেষ গুণবান একজন উত্তম মানুষ । নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রানি সুদর্শনা, দেশের নাগরিকবৃন্দ, বিদেশের রাজা ও পথিকদল সবাই যে রাজার অন্বেষণে ছুটে বেড়া, সে রাজা নিচক আধ্যাত্মিক চেতনা প্রসূত রাজা নন । এই অদৃশ্য রাজা সঙ্কটমুহূর্তে যেমন আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রানিকে এবং জনগণকে রক্ষা করেন । রাজা যে দেশকে ভালোবাসে তা তার এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে । দিয়েই প্রমাণিত । এই অদেখা রাজাকে চোখের সামনে দেখতে চেয়ে রানি সুদশনা । নিজেকে সাধারণ নাগরিকদের দলে নামিয়ে এনেছে । তার অবস্থা অনেকটা বিদেশ পথিক দলের মতো—

“সত্যি বলছি ভাই, রাজা আমাদের এমনি অভ্যেস হয়ে গেছে যে, এখানে কোথাও রাজা  না দেখে  মনে হচ্ছে   দাঁড়িয়ে আছি,   কিন্তু পায়ের তলায় যেন মাটি নেই ।” ১০

সুদর্শনা রাজাকে শক্তি, ক্ষমতা ও রূপের মধ্যে দিয়ে পেতে চায় কিন্তু এ সবই তো বিমূর্ত । সুদর্শনা নিজের আমিত্ব ও অহংবোধকে বজায় রেখে ভালোবাসা পেতে চায় । তার ইচ্ছে সে যেভাবে রাজাকে ভালোবাসে রাজাও যেন তাই-ই করেন । এ যেন আধুনিক বস্তুবাদী সমাজের শিক্ষিত নরনারীর সমস্যা । কিন্তু ভালোবাসা তো পুঁজি নয়, একে দিয়ে আর যাই হোক বিনিময় চলে না ।

32

(খ) রাজা

“রাজা নাটককে বলা হয়েছিল ‘অন্ধকারের নাটক । স্বভাবতই আমাদের প্রশ্ন জাগে শম্ভু মিত্রের অনুসন্ধানে অন্ধকারই কি আরদ্ধ ? মহৎ শিল্পীর তপস্যা তো আলোর তপস্যা, তবে কেন এই অন্ধকারের আহ্বান ? অন্ধকার তো মহৎ শিল্পীর নাট্যভাবনাকে কলঙ্কিত করে । আসলে এই ‘অন্ধকার’ শব্দটি শম্ভু মিত্রের অনুভবে দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে ধরা দিয়েছিল । এই অন্ধকার সূর্যের অবর্তমানে যে তমসা, তা নয় । আলোর বিপরীতার্থক শব্দও নয় । এই অন্ধকার মুদিতনেত্র যোগীর ধ্যানের জগতের অন্ধকার । বাইরের জগতের কোলাহল ও তুচ্ছতা থেকে সরে এসে আমরা যখ ডুব দিয়ে কোনও সত্যকে উপলব্ধির চেষ্টা করি, তখন মনের ভেতরের অন্ধকার কিন্তু শূন্যতার রূপ নয়, সত্যকে আবিষ্কার করার একটি উপযোগী পরিমণ্ডল । শম্ভু মিত্র এই সত্যের উপলব্ধির অন্ধকারের দ্যোতনা পেয়েছিলেন ‘রাজা’ নাটকের মধ্যে । এই অন্ধকার আসলে আলোতে ফিরে আসার পথ । তাই ‘এ আঁধার আলোর অধিক । ‘রাজা’ নাটকের মধ্যে এই ভাবনাই প্রতিফলিত ।—

বহুরূপী প্রযোজিত ‘রাজা’ নাটকটি অসম্ভব মঞ্চ সাফল্য পেয়েছিল সেই সময় । তার একটি কারণ রবীন্দ্রনাথকে শম্ভু মিত্র অনুভব করেছেন এক অন্য মন নিয়ে । এ প্রসঙ্গে রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য—

“রাজা’ নাটকের প্রয়োগেও তিল তিল করে শম্ভু মিত্র সৃজন করেছেন রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক প্রত্যয়ের মনোভূমি । আলো, মঞ্চ, সঙ্গীত, পোশাক, কারুকৃতি, চরিত্র বিন্যাস আর অভিনয় সব মিলিয়ে সে এক অনন্তের সন্ধান অনিঃশেষের দৃশ্যকাব্য । রবীন্দ্রনাটকের অন্তরের সুখ দুঃখের-ভালোবাসার কাব্য হয়ে আলো ছড়িয়েছিল এখানে, যে আলোয় হারিয়ে যাওয়া পথ পাওয়া যায়, যে পথ মানুষকে পূর্ণ করে তোলে, যে পথে সব ক্ষুদ্রতা-তুচ্ছতার বাঁধন টুটে যায় ।” ১১

যাই হোক, ‘রাজা’র অভিনয়ে বহুরূপীর শিল্পীরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি । বিশেষত শম্ভু মিত্রের অভিনয় দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছিল । সন্তোষকুমার ঘোষ দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ১৭ জুন মন্তব্য করেন—

“…. এই নাটকে ‘রাজা’ও একটি নিয়ত উপস্থিতি— শ্রী শম্ভু মিত্রের সুষ্ঠু ও নিষ্ঠাবান উচ্চারণে বারবার তার অমোঘ; অভ্রান্ত আবির্ভাব…।” ১২

শম্ভু মিত্র তথা এই বহুরূপী নাট্যদলই রবীন্দ্রনাটককে পেশাদারি মঞ্চে সাফল্য এনে দিয়েছিল । একটা সময় ছিল রবীন্দ্রনাথের এই সব রূপক নাটকগুলি বাংলা রঙ্গমঞ্চে প্রায় ব্রাত্য ছিল । তার গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য বহুল পরিমাণে এবং উপন্যাসের নাট্যরূপও শিশিরকুমার পূর্ব বাংলা মঞ্চে অভিনীত হলেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সমালোচনা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাটকের জনপ্রিয়তার অভাব সম্পর্কে তারা সচেতন ছিলেন । যেমন ‘নাচঘর’ পত্রিকা বলেছে—

“রবীন্দ্রনাথের নাটকের মর্মগ্রহণ করবার মতো শিক্ষার উৎকর্ষ ও রসবোধ এদেশের দর্শক সাধারণের নেই…” ১৩

33

গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন রূপে গড়ে ওঠার পর, প্রথমে বহুরূপী, তারপর একে একে বহু দলের রবীন্দ্রনাটকের এই নিরীক্ষা বাঙালির রুচিবোধ, সংস্কৃতি সচেতনতা ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসাকেই প্রমাণ করে । তবে বহুরূপীর প্রচেষ্টাগুলো যে সমকালীন অন্যান্য দলেরও অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করেছে সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় । এ প্রসঙ্গে কুমার রায় বলেছেন—

“রবীন্দ্রনাথের নাটককে আমরা মঞ্চে পুনরাবিষ্কারের জন্য গৌরব করতে পারি । পারি, কিন্তু একটি একটি মাত্র সংস্থার সুবাদে । সে সংস্থা বহুরূপী, এবং তার রূপকার-নির্দেশক-অভিনেতা শম্ভু মিত্র ।” ১৪

শম্ভু মিত্র কর্তৃক রূপান্তরিত ও পরিচালিত নাটকের পরিচয়

শম্ভু মিত্রের বহুরূপীর শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাটকের প্রযোজনা তথা রবীন্দ্রনাটকের কথা এতক্ষণ আলোচিত হল । শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাটকসহ তাঁর নাট্যভাবনার কথা না বললে বোধহয় আলোচনাটি খণ্ডিত থেকে যায় । তাই সেকথা এখানে বর্তমানে বলবার চেষ্টা করছি । তবে শম্ভু মিত্রের সারাজীবনের সৃষ্টি নিয়ে এখানে আলোচনা করার অবকাশ নেই, শুধুমাত্র ছয়ের দশকে শম্ভু মিত্রের নাটক ও নাট্যাভিনয় নিয়ে আলোচনা করা হবে ।

বহুমুখী প্রতিভার দ্যুতিতে শম্ভু মিত্রের সৃষ্টিশীল জীবন আলোকিত হয়ে উঠেছিল । তিনি যে কেবল নাট্য-নিদের্শনার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা তথা ভারতীয় আধুনিক থিয়েটারের জনক ও তার শ্রেষ্ঠতম রূপনির্মাণ করেছিলেন তাই-ই নয়- চলচ্চিত্র, আবৃত্তি ও সাহিত্যকর্মেও তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব । নাট্য-নির্দেশনার পাশাপাশি নাটক রচনাতেও অসামান্য পরিচয় রেখেছেন । নাট্যরূপ, অনুবাদ, রূপান্তর এবং মৌলিক নাটক নির্মাণের এই বিচিত্র প্রবাহে তিনি অবগাহন করেছেন । তার এই বিপুল কর্মের সামান্যতম অংশের পরিচয় এখানে তুলে ধরা হবে ।

বিশ শতকের ছয়ের দশকের প্রারম্ভে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় বহুরূপী রবীন্দ্ৰনাটক প্রযোজনা করে । পরবর্তীতে তার সংখ্যা আরো বেড়ে যায় । সেকথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি । যাই হোক রবীন্দ্ৰনাটক বাদ দিলে ছয়ের দশকের প্রারম্ভে শম্ভু মিত্র পরিচালিত ও অভিনীত নাটকগুলির একটি ‘দশচক্র’ । ১৫ এই সময় অর্থাৎ ১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর নিউ অ্যাম্পায়ারে নব পর্যায়ে ‘দশচক্র’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় । নতুনভাবে বিন্যস্ত সঙ্গীতের পথ ধরে সমগ্র অভিনয়কে এই নাটকে বেঁধেছিলেন পরিচালক । ডাক্তার পূর্ণেন্দু গুহ-র ভূমিকায় শম্ভু মিত্র যখন উপযুপরি ‘Strike the tent’ এবং ‘one must bear one’s own cross to the calvary’ বাক্য দুটি যোজনা করেন, সমগ্র প্রযোজনাটি যেন—

“আবেগ ও বুদ্ধি, হৃদয় ও বোধিকে আশ্রয় করে এক আত্মপ্রতিষ্ঠ মানুষের দুর্মর আশার, নিরন্তর সংগ্রামের নাটক হয়ে ওঠে ।” ১৬

এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন ছয়ের দশকে রবীন্দ্রনাটক বাদে শম্ভু মিত্র নর্দেশিত প্রথম নাটক ‘কাঞ্চনরঙ্গ’ । নাটকটি শম্ভু মিত্র এবং অমিত মৈত্রের যৌথ চরনা । ১৯৬১ সালের ২৪ জানুয়ারি বিশ্বরূপা মঞ্চে নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় । নাটকটি সম্পর্কে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন—

“…..সামগ্রিক বিচারে কাঞ্চনরঙ্গ’বহুরূপী-র একটি মনোহারী সৃষ্টি । বিশেষত পরিচালনা বাবস্থাপনা ও অভিনয়ের দিক হইতে নাটকটিকে নিখুত বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না…। ‘কাঞ্চনরঙ্গ’ কাঞ্চনের চেয়ে জীবনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াছে ।” ১৭

34

এরপরে ১৯৩০ সালের ১২ জুন নিউ এম্পায়ারে মঞ্চস্থ হয় ‘রাজা অয়দিপাউস’ । সোফোক্লিসের এই নাটকটি অনুবাদও করেন স্বয়ং শম্ভু মিত্র । প্রধান ভূমিকায় অভিনয়ও করেন তিনি নিজে এবং দর্শকদের কাছ থেকে বিপুল অভিনন্দন লাভ করেন । সেই সময় দেশ পত্রিকায় ‘রাজা অয়দিপাউস’সম্পর্কে ছাপা হয়—

“ঈদিপাসের ভূমিকায় শম্ভু মিত্র অসাধারণ অভিনয় করেছেন । ভাগ্যবিড়ম্বিত একটি চরিত্রের স্বগত হাহাকার তার অভিনয়ে অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছে । এই চরিত্রের মর্মজ্বালা ও অসহায়তা তিনি অবলীলায় তার অভিব্যক্তি ও বাচনভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন । মঞ্চে এই অভিনয় তুলনারহিত ।” ১৮

‘রাজা অয়দিপাউস’-কে নিয়ে সে সময় কিছু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, নাটকটিকে কেউ কেউ অশ্লীল ও প্রগতিবিরোধী বলে মন্তব্য করেছিলেন । তবে এ কথাও ঠিক যে ক্ল্যাসিকের বিচার এমন ভাবে হয় না । নাটকটির সপক্ষে রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন—

“রাজা অয়দিপাউস মায়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলেন কী করলেন না এটা কোনও বিষয়ই নয় । যুদ্ধজয়ী রাজা রানির অধিকার পাবে, এটাই ছিল তৎকালীন গ্রিস দেশের নিয়ম । মায়ের সঙ্গে যৌন মিলন বা মায়ের গর্ভে নিজের সন্তানের জন্মদান, এ সবই ঘটেছে অয়দিপাউসের অজান্তে । তাই কোনও পাপ বা অন্যায় স্পর্শ করতে পারেনি অয়দিপাউসকে।” ১৯

আসলে অয়দিপাউসের সত্যের তৃষ্ণা, তার দেশপ্রেম এই নাটকের প্রধান বিষয় । অত্যাচারী স্ফিংক্সকে পরাজিত করে থেবাই-এর রাজা হয়েছিল অয়দিপাউস । থেবাই নগরীর জনসাধারণ গভীর কৃতজ্ঞতায় সিংহাসনে বসিয়েছিল সেই আগন্তুক, বীরশ্রেষ্ঠ অয়দিপাউসকে । রাজা হয়ে সিংহাসনে বসাই তার কাল হল । ঘনিয়ে এল মহা বিপর্যয় ।  দেশবাসীকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল রাজা । দৈবজ্ঞ পণ্ডিত তেইরেসিয়াসের কণ্ঠে চরম সর্বনাশের সতর্ক বাণীও তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি সত্য-সন্ধান থেকে । আর এখানেই ‘রাজা অয়দিপাউস’ এক মহা ক্ল্যাসিকে উত্তীর্ণ হয়েছে । এখানে বড় হয়ে উঠেছে সত্যের সন্ধান । রাজা অয়দিপাউস সব সীমা আর ক্ষুদ্রতাকে তুচ্ছ করে সত্যের তৃষ্ণায় মহীয়ান হয়ে ওঠেন । সত্যকে জেনেই রাজা অয়দিপাউসের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয় । রাজা জানতে পারল, সে পিতৃহন্তা । আপন জন্মদাত্রীর গর্ভে তিনি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন । সমাজে কোনও পাপ একা, বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে না । সত্য উদঘাটন করতে গিয়ে রাজা খুঁজে পেল, এই পাপের উৎসে রয়েছে সে নিজে । অনুশোচনায়, আত্মধিক্কারে সে নিজেই নিজের চোখ উপড়ে নিল । নাটকের শেষে অন্ধ অয়দিপাউস যখন বলেন যে, নিয়তি আর কী সঞ্চিত রেখেছে তার জন্য, তখন নাটকটি হয়ে ওঠে আরও মর্মস্পর্শী । যুগ যুগ ধরে রাজা অয়দিপাউসের সত্যের সন্ধান আলোকিত করে এসেছে সারা পৃথিবীর দশর্কদের । শম্ভু মিত্র ‘রাজা অয়দিপাউস’ অভিনয় করে সেই অসামান্য অভিজ্ঞতায় নিয়ে এসেছিলেন বাঙালি দর্শকদের । বাঙালি দর্শক সেদিন ক্ল্যাসিকের বিশালতায় অবগাহন করেছিলেন ।

আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে ছয়ের দশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে দেখা দিয়েছিল নতুট সঙ্কট । সাম্যবাদী শিবিরে ফাটল, ভারত-চিন সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করল । জাতীয় জীবনের সে এক তমসাচ্ছন্ন ছবি । উৎপল দত্ত ‘কল্লোল’ প্রযোজনা করে এই অন্ধকারে নবতর প্রত্যয়ের আলো জ্বেলেছিলেন । শম্ভু মিত্রও ‘রাজা অয়দিপাউস’ এবং ‘রাজা অভিনয় করে সেই প্রত্যয়ের এবং সম্ভাবনার আলোই জ্বেলেছিলেন । উৎপল দত্ত এবং শম্ভু মিত্র দুজনেই সত্যকে খুঁজেছেন । দুজনের প্রকাশ আলাদা কিন্তু লক্ষ্য একই । কল্লোল’ নতুন যুগের ক্ল্যাসিক হয়েও শার্দুল সিং-এর শৌর্য, সাহস, ত্যাগ, ভালোবাসায় কোথায় যেন চিরকালীন ব্যাপ্তি পেয়ে যায় । আর ‘রাজা’, ‘রাজা অয়দিপাউস’ চিরকালের চির প্রাসঙ্গিক । বিশ্ব নাট্য-সাহিত্যে যা অতুলনীয় ।

35

‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটকটির মাধ্যমে শম্ভু মিত্র বাংলা থিয়েটারকে উপহার দিয়েছিলেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা । অভিনয়, আলো, আবহ, মঞ্চ, পোশাক— সব মিলিয়ে এক সাঙ্গীতিক ঐকতান । রাজা অয়দিপাউস ও রানি ইয়োকাস্তের ভূমিকায় শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় সেদিন বাংলা থিয়েটারকে বিস্মিত করেছিল । আজও বিস্ময়ের সেই দুই ধ্রুপদী চরিত্রের অভিনয় । পৃথিবীর যে কোনও শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের সমকক্ষতার দাবি করে সেই অভিনয় ।

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সাঙ্গীতিক ঐকতান গড়ে তোলা হয়েছিল । আলো, আবহ, মঞ্চ, পোশাক, অভিনয়, কারুকৃতি অভিনেতাদের বিন্যাস সব মিলিয়ে এক ভিন্ন রকমের ছন্দ গড়ে উঠেছিল সেই প্রযোজনায়। শম্ভু মিত্রের নির্মাণ ও সৃজনে সমগ্র । নাটকটি অসামান্য হয়ে উঠত । অভিনয়, মঞ্চ এবং সাজপোশাকের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সেতুবন্ধন তৈরি করা হয়েছিল । ‘রাজা অয়দিপাউস’ প্রযোজনাটি সম্পর্কে কুমার রায়ের একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ্য—

“মধ্য মঞ্চ থেকে শুরু করে মঞ্চ গভীর পর্যন্ত মঞ্চজোড়া পাটাতন ধূসর কাপড়ে ঢাকা । রঙ্গ শীর্ষে মধ্যিখানে লালচে মেরুন রঙের দুটি বৃহৎ থাম, স্বল্প-অলঙ্কৃত । কয়েক ধাপ সিঁড়ি থামের মধ্য স্থানে পাটাতনের ওপর থেকে উঠে গেছে ।… অভিনেতার ডানদিকে অন্দরে যাওয়ার আলোকিত পথ । থামের বাইরে দিয়ে দু’দিকে প্রসারিত কালো পর্দা । মঞ্চব্যাপী পাটাতনের সামনের অংশে রঙ্গস্থলে দু’দিকে খানিকটা ছেড়ে দুটি কিংবা তিনটি ধাপের টানা সিঁড়ি । অভিনেতার ডানদিকে সেই সিঁড়ির ধাপের শেষে একটা ঢালু সরু চাতাল নেমে এসেছে মঞ্চতল ছুঁয়ে । মঞ্চবামে মূল পাটাতনের ওপর একটা প্রার্থনা জানানোর বেদী । সেটার রঙও ধূসর এবং গ্রিক মোটিফের অলঙ্করণ তার গায়ে । দুই থামের ওপরদিকে মধ্যবর্তী স্থানে একটা ছোট মেরুন রঙের ফ্ল্যাট লাগানো থাকত— তার মাঝে দেব আপোল্লোনের প্রতীক সোনালি-হলুদ রঙের সূর্য। ওই সূর্য চিহ্ন যুক্ত ফ্ল্যাটটা লাগানোর ফলে থামের মাঝে একটা প্রবেশ পথের অনুরূপ তৈরি হত । অন্ধকার প্রেক্ষায় যবনিকা উঠতে শুরু করলেই যারা নতজানু হয়ে মূল মঞ্চে, সিড়ির ধাপে, হাতে পল্লব ও পশম নিয়ে বসে থাকত (প্রায় তিরিশ জন) তাদের মুখে। রাজা নাম নিয়ে আর্তনাদ শোনা যেত ।” ২০

এই নাটকের আলো নিয়েও ছিল বিস্তীর্ণ ভাবনা । শম্ভু মিত্র এর জন্য আলোক-লেখ (Light Script) তৈরি করেছিলেন । ‘রাজা অয়দিপাউস’-এর ধ্রুপদী বাস্তবতার ক্যানভাসকে ফুটিয়ে তুলতে গভীর, সংযমী আলোর তুলি ব্যবহার করেছিলেন শম্ভু মিত্র । সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই। কোনও আবহসঙ্গীত ব্যবহার করতেন না শম্ভু মিত্র । তাঁর নিজের কণ্ঠস্বরে, আবৃত্তির স্পর্শে তুলে ধরতেন অন্তরের সুর আর ছন্দ ।

১৯৬৪-তে ‘রাজা’ ও ‘রাজা অয়দিপাউস’ দটি ক্যাসিক নাটক প্রযোজনা করার পর ১৯৬৫-তে শম্ভু মিত্র নতুন কোনও নাটকের কথা ভাবেননি । ‘ছেঁড়াতার’ থেকে শুরু করে পুরনো নাটকগুলি এই সময় পুনর্বার মঞ্চস্থ করা হয় । ১৯৬৬-তেও ‘বহুরূপী নতুন কোনও নাটক মঞ্চস্থ করতে পারেনি । আগের বারের মতোই পুরনো নাটকের অভিনয় হতে থাকে ‘৬৬-তে । ১৯৬৭ সালে শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় । ৭ মে নিউ এমপায়ারে প্রথম অভিনয় হয় । এই নাটকটিতে শম্ভু মিত্র অভিনয় করেননি ।

36

নাটকটির বিষয়বস্তু খুব উঁচু মানের একথা সেদিন সবাই মানেননি, কিন্তু শম্ভু মিত্রের পরিচালনার প্রশংসা করেছিলেন সকলেই । তারই অসাধারণ পরিচালনায় ও সম্মিলিত অভিনয়ে বাদল সরকার যে নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন সেদিন, তা কিন্তু ভুলে যাবার নয় । বাকি ইতিহাস প্রসঙ্গে ‘দেশ’ পত্রিকায় সে দিন লেখা হয়—

“বহুরূপীর নতুন নাটক ‘বাকি ইতিহাস’ ও যথাবিহিত দর্শকদের আনন্দ দেবে, মুগ্ধ করবে । তবে তা সুপ্রযোজনা, সুপরিচালনা ও সম্মিলিত অভিনয়ের জন্য নাট্যামোদীদের প্রশংসা যতটা পাবে, নাটকের জন্য ততটা নয় ।… শম্ভু মিত্র বুদ্ধিদীপ্ত নাট্য পরিচালনার ছাপ নাটকের প্রতি দৃশ্যেই মেলে । ডিটেল-এর প্রতি তার নজর এবং শ্রী মিত্রের বাস্তববোধ লক্ষ করার মতো।” ২১

১৯৬৮ সালে আবারও পুরনো নাটকের অভিনয় করে বহুরূপী । ১৯৬৯-এ নীতীশ সেন নামে আর এক নতুন নাট্যকারের লেখা ‘বর্বর বাঁশি’ নাটকের পরিচালনা করেন শম্ভু মিত্র । নতুন নাট্যকারের নাটক মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্র পূর্বেও ঝুঁকি নিয়েছেন (বাদল সরকারের ক্ষেত্রে), এবারও নিলেন । ১৯৬৯-এর ৭ মে কলামন্দিরে ‘বর্বর বাঁশি’ মঞ্চস্থ হল । শম্ভু মিত্র আবার প্রমাণ করলেন তাঁর নির্দেশনার গভীরতা । ফলে একেবারে নতুন নাট্যকারও সকলের কাছে পরিচিত হয়ে গেলেন ।

শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাটক

এতক্ষণ ছয়ের দশকের শম্ভু মিত্র পরিচালিত নাটকগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল । এবার অলোচনা করবো ছয়ের দশকে শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাটকগুলি ।

এই সময় শম্ভু মিত্র রচিত মৌলিক নাটকগুলি হল— ‘গর্ভবতী বর্তমান’ (১৯৬৩), ‘চাঁদ বণিকের পালা’ (১৯৬৫) ও ‘অতুলনীয় সম্বাদ’ (১৯৬৫) । শম্ভু মিত্র ‘গর্ভবতী বর্তমান’ ও ‘অতুলনীয় সম্বাদ’ একাঙ্কিকা দুটি লেখেন সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ছদ্মনামে । গ্রন্থভুক্তি কালে (বৈশাখ, ১৪০০) এদের তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘কৃষ্ণকৌতুকীয় নাটিকা’ বলে । যাকে নাটকীয় পরিভাষায় বলে ‘ব্ল্যাক কমেডি’ । ব্ল্যাক কমেডির মধ্যে কমেডির বৈশিষ্ট্য আপাতভাবে বজায় রেখে ভেতরে ভেতরে সমাজ ও জীবনের গুঢ় গম্ভীর, বিকট এক কৃষ্ণচ্ছায়ার আভাস সঞ্চারিত রাখা । ফলে কমেডির কৌতুকময় সুখকর রূপের মধ্যে জটিলতাপূর্ণ এক অশুভ-সংকেত উঁকি দেয় । গর্ভবতী বর্তমান এবং ‘অতুলনীয় সম্বাদ’ নাটিকা দুটির মধ্যে ব্ল্যাক কমেডি বার কৃষ্ণকৌতুকীয় নাটকের এই বৈশিষ্ট্য বর্তমান । গর্ভবতী বর্তমান’-এ মধ্যবিত্ত মানুষের সুখ-সন্ধানের বিপন্ন অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ডামাডোলের পটভূমিতে । ‘অতুলনীয় সম্বাদ’-এ প্রেম-বিবাহ- সংসার-সন্তান-সন্ততি প্রবাহিত জীবনে দুর্নীতি ও অনাচারকে চেপে রেখে বহিরঙ্গে নীতির মহিমা কীর্তনের এক হাস্যকর প্রয়াস ।

আর ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটি বাংলা নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাসে এক আশ্চর্য সুন্দর সৃষ্টি । নাটকটি ‘বটুক’ ছদ্মনামে ছাপা শুরু হয়েছিল । ১৯৬৫ সালে নাটকটির । প্রথম পর্ব ‘বহুরূপী’ নাট্য পত্রিকার ২৩তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় । দ্বিতীয় পর্বাংশ বহুরূপী’র ২৪তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে ।

37

মনসামঙ্গল কাব্যের চঁদ সদাগরের কাহিনিকে আশ্রয় করে এই নাটকের মধ্যে দিয়ে নাট্যকার প্রকাশ করেছেন আধুনিককালের কিংবা সর্বকালের এক মহাকাব্য । মূল কাহিনির অনেক রদবদল করে  দেশকাল সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দর্শন, উপলব্ধি  ও অনুভবের  এক গভীরতম কাহিনি শম্ভু মিত্র আমাদের শুনিয়েছেন ‘চাঁদ বণিকের গালা’তে । জীবনের, সমাজের অনিবার্য, অমোঘ কত প্রশ্ন, কতরকম উপলব্ধি, কত রহস্যের সংবাদই না রয়েছে এই নাটকে । নীতিহীনতার বিরুদ্ধে, অজ্ঞানের বিরুদ্ধে, আন্ধকারের বিরুদ্ধে ‘চাঁদ বণিকের পালা’ এক সুগভীর প্রতিবাদ । নাটকের শুরু চাঁদ বণিকের অভিযানের প্রস্তুতি দিয়ে, তারপর সাগর-যাত্রা, সাগরে দুরন্ত ঝড়ের মধ্যে, প্রচণ্ডতম বিরুদ্ধতার মধ্যে এ পাড়ি দেওয়ার বিফলতাও যেন বিফলতা নয়, পরাজয়ও পরাজয় নয় । কারণ চরম দুর্যোগ ও বিরুদ্ধতার মধ্যে মানুষের অভিযাত্রী অন্তর তো থেমে থাকতে পারে না তাহলে তো থেমে যাবে জীবনের প্রবহমানতার শাক্ত, তাহলে তো স্তব্ধ হয়ে যাবে জীবনের মহত্তর রূপের আবিষ্কারের ইতিহাস । তাই এই নাটকের একেবারে শেষে চাঁদ সব হারিয়েও বলতে পেরেছে—

“চাঁদ  ।।      আমরা ক’জনা প্রেতের মতন চিরকাল পাড়ি দিয়্যা যাব । আমাদের

                কেউ নাই, কিছু নাই । নাোঙর তো কেট্যে দেছে শিব।—প্রস্তুত

সবাই? হৈ-ঈ-ঈ-য়াঃ । কতো বাঁও জল দেখ । তল নাই ?– পাড়ি দেও । এ আন্ধারে চম্পকনগরী তবু পাড়ি দেয় শিবের সন্ধানে । পাড়ি দেও— পাড়ি দেও—” ২২

‘চাঁদ বণিকের পালা’-র চাদের মতো প্রত্যেক মানুষের জীবনই বোধহয় এমন এক পাড়ি দেবার কাহিনি— অন্ধকার থেকে আলোতে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানে । পথ চলতে চলতে, পথের বাধায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে গড়ে ওঠে একজন মানুষের নিজস্ব জীবনবোধ বা দর্শন—

“চাঁদ  ।।      কিন্তু এটাও যেন ভাই বেভুল না হয়, যে, আমাদের পথে হোল

                দুরুস্তর বাধা । সমাজে, সংসারে,— দেখো, সবায়ে তো আমাদেরে

                খালি অপবাদ দিবে । আপন ঘরের লোকে, আত্মীয় স্বজনে,

                আমাদেরে খালি গালমন্দ দিবে । কেননা, তুমি যে শিবের ভজনা

                করো । যেটা সত্য মনে করো সেটারে যে তুমি মন খুল্যে সত্য

বলো । এইট্যাই অপরাধ ।… আমাদের পথ সত্য, চিন্তা সত্য, কর্ম

সত্য । আমাদের জয় কেউ ঠেকাতি পারে না ।” ২৩

38

নাটকের শুরুতেই চাঁদের এই বক্তব্য থেকে আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, একেবারে সম্পূর্ণভাবে বৈপরীত্যহীন একরৈখিক মহাসর্বনাশকে, সেই মহাসর্বনাশের গহ্বরে লুকিয়ে থাকা অতল অন্ধকারকে নাট্যকার দেখতে পাচ্ছেন, অন্ধকারকে দেখাতে চাইছেন ‘চাঁদ বণিকের পালা’য় ।

সত্যতাকে সম্বল করে বুকভরা প্রত্যয় নিয়ে সমুদ্রের বুকে পাড়ি দেবার সংকল্পে দলবলসহ এগিয়ে এসেছিল চাঁদ, স্বপ্ন ছিল চাদের ভাবনা বাস্তবায়িত হবে । কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে ঘটে উল্টো । চাঁদের এই ব্যর্থতা, তার সর্বহারা হয়ে যাবার ইতিবৃত্ত যেন আমাদের ব্যর্থ জীবনের ইতিবৃত্তের সঙ্গে মিলে যায় । সত্য পরাজিত হবে, এ কথা কখনো মেনে নিতে পারে না, তাই সে বলে—

“চাঁদ   ।।      মিথ্যা যতোই কেন প্রবলপ্রতাপী হোক, তবু সে ভঙ্গুর, অবশেষে

                সত্য জয়ী হয় ? জীবনে সত্যের জয় অবশ্য, নিশ্চিত ?” ২৪

এর উত্তরে বল্লভাচার্য বলে—

“বল্লভ  ।।     …ইতিহাস খুল্যে দেখো, অবশেষে চিরকাল মিথ্যা জয়ী হয়্যা এল ।

                রামচন্দ্র জানকীরে উদ্ধারের লেগ্যে পুণযুদ্ধ করে, কিন্তুক, সে জয়

                তো সাময়িক । প্রজাদের মিথ্যা কুৎসা শুন্যা গর্ভবতী পত্নীট্যারে

                পুনরায় বনবাসে দিতে হয়। সেই হোল অবশেষ । কার জয় হয় ?

                সেই অবশেষে ?– কুরুক্ষেত্রে ধর্মযুদ্ধ হোল, কতো বীর অকাতরে

                প্রাণ দিল,— ধর্মরাজ্য স্থাপনের লেগ্যে । কিন্তুক, কোথায় ? সেই

                ধর্মরাজ্য ? এ ভারতে এখনো কি এল ? ভুল, ভুল, পৃথিবী যেখানে

                ছিল সেখানেই আছে । কুচরিত্রা মন্থরার পরামর্শে কৈকেয়ীরা একদিন

                রামচন্দ্রে বনবাসে দেয়,— আর তারেপর আরদিন কুৎসাকারী

                প্রজাদের কথা শুন্যে রামচন্দ্র জানকীরে বনেতে পাঠায় । এই হয়

                অবশেষে । কার জয় হয় ?” ২৫

39

অবশ্য চাঁদ পথ চলতে চলতে লক্ষ করে কীভাবে ‘আমাদের আধুনিকতা নষ্ট হয়্যা যায়’ । চাদের জীবনের টানাপোড়েনের সঙ্গে আমাদের জীবনের সমস্যা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । সমাজে কোনও, ‘জ্ঞানের সম্মান নাই, বিদ্যার মর্যাদা নাই, সুভদ্র আচার নাই, সুভাষণ নাই, মাংস সুখ ছাড়া অন্য কোনো সুখচিন্তা নাই’– এই উপলব্ধি যেমন চাঁদের তেমনি তা আমাদেরও। চাদের এক সময়ের গুরু বল্লভাচার্যও এক সময় বলে—‘আদর্শের পাছে ছুট্যে কোনো লাভ নাই’ । তবুও চাঁদ তার নিজের সংকল্পে দৃঢ় থাকে । এমনকী তার ছয় পুত্রের মৃত্যুও তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি । সে বলেছে—

“চাঁদ    ।।     হয়তো-বা আরো পুত্র যাবে । হয়তো-বা আমরাই কতো জনা যাব ।

                তবু যদি আমরা সকলে আজ পাড়ি দিতে পারি— তাইলে যে, তারি

                মধ্যে আরো কতো পুত্র বেচ্যে যাবে ! সেই সব বীজগুলা একদিন

                গাছ হবে, মহীরুহ হবে, ফল দিবে, ছায়া দিবে, আমার দেশের মুখ

                হাসিতে ভরাবে । ভাইরে, আমি জানি, আমার এ দেশের অন্তর মরে

                নাই । সে তো আমাদেরে ডাকে । চলো, চলো, চলো—” ২৬

কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিবদাস ছাড়া অন্য সঙ্গীরা চাঁদকে ছেড়ে চলে যায় । চাঁদ অনুভব করে সে একা হয়ে যাচ্ছে—

“চাঁদ   ।।      শিবদাস, আরো কতোবার এইমতো হবে বলো দেখি ? এই যে,

                সকলের বিশ্বাস হারাবে,— বারে— বারে সকলেই নাও ছেড়্যে চলে

                যেতে চাবে, আর আমি বারে— বারে বাক্যজাল বুন্যে, যুক্তি দিয়্যা,

                কথকতা দিয়্যা, তাদের পড়ন্ত মন উৎসাহিত করে-কর্যে যাব ?

                আমারও যে ক্লান্ত লাগে । আর তো পারিনে শিবদাস ।” ২৭

40

এই একাকিত্বের জগতে চাঁদ সম্পূর্ণ নগ্ন, একেবারেই নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ । এতটাই একা যে জ্বলন্ত ক্ষতের পরে এতটুকু শুশ্রুষা কামনা করে সে স্ত্রী সনকার কাছে এসে দাঁড়ায়—মনসাভক্ত সনকার কাছে যে ন্যূনতম আশ্রয়টুকু পায় না । চাদের গুরু বল্লভাচার্য পর্যন্ত বাস্তব অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়, ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হয়ে সে চাঁদকে বোঝানোর চেষ্টা করে । তার ছেলে লখিন্দর পর্যন্ত তাকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না । এত কিছুর পরেও চাঁদ বিশ্বাস হারাতে নারাজ । জীবনের কেন্দ্রে কোনো এক মহৎ সত্যের ওপর বিশ্বাস ছিল চাঁদের, তাই অর্থহীন, যুক্তিহীন অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি সে । কিন্তু এক সময় সনকা যখন চাঁদকে বলে—

“আগুকার কথা হোল তুমি অহঙ্কারী। আপনার অহঙ্কার তোষণের তরে তুমি লড়াই করেছ ।” ২৮

আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত চাঁদ তখন শিহরিত হয় সনকার কথায় । কেননা সে যা চেয়েছিল তা তো কেউ বোঝেনি, চাঁদ তো শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জয় চায়নি । আসলে বড় কোনও লক্ষ্য নিয়ে জীবনকে কেউ যখন এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, সে চাওয়া কি শুধু ব্যক্তিগত থাকে ? তার আন্তরিক আপ্রাণ প্রচেষ্টা কি শুধু ব্যক্তিগত তাগিদ ? অথবা তার ব্যর্থতা কি শুধুমাত্র ব্যক্তির ব্যর্থতা ? চাঁদ কখনোই তা ভাবে না, বরং চাদের মহত্বই প্রকাশিত হয় তার কথায়—

“…যা কিছু আমার আছে সমস্ত উৎসর্গ করা দেউল্যা হয়্যা যাব,— যাতে ভবিষ্যৎ একদিন রঙেতে রঙীন হয়, যাতে চম্পকনগরী সুস্থ, মুক্ত, অনর্গল হয়্যা । যেতে পারে ।— সেদিন আমারে যদি ভুলে যায় লোকে,— যাক, ভুল্যে যাক ।… আমি কিছু চাইনেক । শুধু হোক । শুধু সেই ভবিষ্যৎ সত্য হোক ।” ২৯

শেষ পর্যন্ত পরাজয় হয় চাঁদের । যুক্তিহীনতার কাছে, মিথ্যার কাছে মাথা নত করতে হয় তাকে । তাকে নিচু হতে হয়েছে অমঙ্গলের কাছে, অন্ধকারের কাছে । অবশেষে চাঁদ ক্ষতবিক্ষত চিত্তে মনসার পুজো দেয় । এই সময়ে চাঁদের অভিব্যক্তি আর্তনাদের মতো শোনায়—

“চাঁদ    ।।     (দু-হাতে তার মাথাটা ধরে প্রায় ফিস্ ফিস্ করে শুরু করে) আমি

                পূজা দিব । পূজা দিব । জানিনে তো সে মানুষ আছি কিনা । তবু পূজা

                দিব । (বেহুলাকে ছেড়ে) জীবনের থিক্যা অঙ্ক কষ্যা-কষ্যা শিবাইয়ে

                পৌঁছাতে চাই, সেথা শিবাই মেলে না । আর শিবায়ের থিক্যা অঙ্ক

                কষ্যা-কষ্যা জীবনে পৌছাতে চাই, দেখি জীবন মেলে না ।” ৩০

41

কিন্তু চাঁদের মনসাকে পূজা দেওয়াও শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচালো না, বিষ খেয়ে মারা গেল বেহুলা— লখিন্দর । এবারে আক্ষরিক অর্থেই চাঁদ একা হল—

“চাঁদ   ।।      এট্যাও বিফলে গেল !— পূজা দেওয়া হোল । তবু যেন পূজা দেওয়া হয় নাই । পাড়ি দিয়েছিনু, তবু যেন পাড়ি দেওয়া হয় নাই । ঘর বেন্ধেছিনু তবু যেন ঘর বান্ধা হয় নাই । তুমি তো উলঙ্গ শিব তাই মোরে বুঝি উলঙ্গ করাতে চাও ? চাঁদ বণিকের সব পরিচয়— যেন জলের আল্পনা ? সব মুছে দিতি চাও ? দেও ।” ৩১

তবে, এমন শোচনীয় পরিণামের পরে, এমন মর্মন্তুদ হাহাকারের পরেও একবারের

জন্যও মনে হয় না এই ঘৃণ্য পৃথিবী বাসযোগ্য নয় । গভীর অন্ধকার বুকে নিয়েও ‘চাঁদ বণিকের পালা’ শেষপর্যন্ত এক জীবনবোধ, অন্যতর এক জীবনস্পর্ধা জাগিয়ে তোলে আমাদের অনুভবে, এ নাটকের অন্তর্নিহিত এক সূক্ষ্ম ভালোবাসার উচ্চারণে ব্যক্তি সম্পর্ক থেকে জেগে ওঠা এক পরম মমতাময় নগ্নতায় আমাদের মনেপ্রাণে এক জীবনস্পর্ধাই উচ্চকিত হয়ে ওঠে । ‘চাঁদ বণিকের পালায় মৃত্যর বীভৎস প্রেক্ষাপটে বেহুলা-লখিন্দর যেন পরস্পর বলে ওঠে, ‘এত ভালো কেউ কারে কোনোদিন বাসেনি কখনো অথবা, আমরা দুজনা যেন ভালোবেস্যা বেস্যা মরে যেতে পারি’– তখন আমরা বুঝতে পারি মনসার চরম আধিপত্য সত্ত্বেও ‘সুন্দর জীবন’ আছে । আবার সনকা চাঁদকে যখন বলে, ‘আজ চলো— সব কিছু ছেড়া দিয়্যা দুইজনা চল্যে যাই’— তখন মনে হয় এই প্রশান্তিময় কথা শোনার জন্যই পৃথিবীতে বারে বারে জন্মাননা উচিত । তখন পৃথিবীর সমস্ত আবিলতা, মলিনতা দূরে সরিয়ে রেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শাশ্বত ভালোবাসা ।

এই নাটকে শেষ পর্যন্ত কোথাও উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া বা জয়ী হওয়াটা বড় হয়ে ওঠে না, বড় হয়ে ওঠে পথ চলা, শুধু জীবনসমুদ্রে পাড়ি দেওয়া, নতুন সম্পদের সন্ধান করা । সব মিলিয়ে নাটকটি শম্ভু মিত্রের এক স্মরণীয় কীর্তি এবং আমাদের বাংলা নাট্য-সংসারের এক বিশাল সম্পদ । তবে কোনও কোনও নাট্য-সমালােচক এ নাটকের কিছু ত্রুটি লক্ষ করেছেন—

“প্রথমত, নাটকটির আত্যন্তিক দীর্ঘতা । দ্বিতীয়ত, বড় বড় শিথিলগতি অনাটকীয় সংলাপের প্রাচুর্য । তৃতীয়ত, নাটকের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় লোকের অবান্তর কথাবার্তার বাহুল্য । চতুর্থত, মূল একটি অবিচ্ছিন্ন কাহিনি দুই বিরুদ্ধ শক্তির ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়া অনিবার্য পরিণতি লাভ করে নাই । পঞ্চমত, খোলা ও স্থির মঞ্চে বহুবিস্তৃত জনস্থলের ঘটনা দৃশ্য পরিবেশ না আনিয়া এবং বিরতি না দিয়া মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্য রূপে উপস্থাপন করা প্রয়োগের দিক দিয়া খুবই সমস্যাপূর্ণ ব্যাপার ।” ৩২

‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটির ক্ষেত্রে ড. অজিতকুমার ঘোষের এই মন্তব্য সঠিক হলেও ““চাঁদ বণিকের পালা’ আমাদের সমকালের ‘ওডেসি’। বিষয়ে, গঠনে এ এক মহাবিস্ময় ।” ৩৩ শুধু তাই-ই নয় রবীন্দ্রনাথের পর এমন স্মরণীয় বাংলা নাটকের অন্য দৃষ্টান্ত মেলে না বললেই চলে ।

42

উপসংহার

অণু-গবেষণার শেষে এসে যে দু-একটি কথা আমরা আমাদের মতো করে বলতে চাই তা হল, বাংলা নাটকের গজতে শম্ভু মিত্র যথা অর্থে সফল নাট্য ব্যক্তিত্ব । তাঁর নাট্যজীবন নিয়ে কোনও কোনও সময়ে বিতর্ক হয়েছে বটে তবে তা তাঁর লক্ষ্য থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি । তিনি একদিনে সংগঠন তৈরি করছেন, তাঁকে সফল করতে নিজেই বিদেশি নাটকের রূপান্তর করে মঞ্চায়ন করছেন ; কখনও বা স্রোতের বিপরীতে হেঁটে রবীন্দ্রনাটককে পেশাদারি নাটক হিসেবে দর্শকের দরবারে এনে ফেলেছেন । আবার কখনও নিজেই লিখে ফেলেছেন  ‘চাঁদ বণিকের পালা’র মতো কালজয়ী নাটক । তবে যে বিষয়টি আমরা আরও গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি, তা হল তিনি যে যে নাটক বেছে নিয়েছেন বহুরূপীর জন্য বা লিখেছেন সেগুলোকে পাশাপাশি  রাখলে বোঝা যায়, তিনি যুদ্ধে নেমেছেন নাটক নিয়ে । এ-যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আসাম্যের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় শোষণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে । এক্ষেত্রে তার অস্ত্র শুধু নাটক । রক্তকরবী, রাজা, দশচক্র, কাঞ্চনবেদ, রাজা অয়দিপাউস, গর্ভবতী বর্তমান, চাঁদ বণিকের পালা— এই নাটকগুলোর বিষয় থেকেই স্পষ্ট হয়— তিনি একটা সমাজ সংস্কারের তাগিদ অনুভব করেছেন, সামাজিক শোধনেরও তাগিদ অনুভব করেছেন । সে কারণেই এমন সব নাটক নির্বাচন করেছেন তিনি । আর একটা ব্যাপারও আমাদের মনে হয়েছে, তা হল, তার অতি উচ্চ সৃজনশীলতার দিক । যে সমস্ত নাটকগুলির উল্লেখ করা গেল আগেই, তার প্রতিটি নাটকের প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন । প্রসঙ্গত বলা যায়, ‘নবান্ন’ নাটকের ক্ষেত্রে ঘূর্ণায়মান মঞ্চের ব্যবহার সেসময় ছিল অভিনব । এছাড়া নিখুঁত পরিপাট্য তার নাটকের এক বিরাট গুণ । সবশেষে যেটা বলা যায়, তা হল, শম্ভু মিত্র বাংলা-নাট্যের ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠান ! মহীরূহ । তাঁর মতো নাট্যব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যত বেশি আলোচনা ও গবেষণা হবে ততই নতুন নতুন দিক পাঠকের সামনে উঠে আসবে । তা বাংলা নাটকের পক্ষে সত্যিই এক সদর্থক দিক । আমরা আমাদের অণু-গবেষণায় বহুরূপী ও শম্ভু মিত্র সম্পর্কে এই কথাগুলিই বলবার চেষ্টা করলাম ।

43

গ্রন্থপঞ্জী :

১)     ভিন্ন এক নাট্যের স্বপ্ন ও সৃজনশীল শম্ভু মিত্র, রায় কুমার, পশ্চিমবঙ্গ, শম্ভু মিত্র

        স্মরণ সংখ্যা, ১৪০৭, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ: ৫

২)     ভূমিকা, সম্মার্গ সপর্যা, মিত্র শম্ভু এম সি সরকার এন্ড সনস প্রাঃ লিঃ, কলকাতা

        ১৩৯৬,  পৃ: ১০

৩)     বিসর্জন, ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতীর, পৌষ ১৪০৫, পৃ: ১১৫

৪)     বিসর্জন, স্মারক পত্র, বহুরূপী, ১৯৬১

৫)     বিসর্জনের অসাধারণ অভিনয়, মঞ্চ যুগান্তর, ১৯৬১

৬)     Theatre, Thought, November 25, 1961

৭)     ক্যাপিটাল পত্রিকা, ১৮ নভেম্বর, ১৯৬১

৮)     যুগান্তর, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৬১

৯)     গ্রন্থ পরিচয়, রাজা, ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, মাঘ ১৩৯২

১০)   রাজা, ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, মাঘ ১৩৯২, পৃ: ২৮

১১)    শম্ভু মিত্র ও অন্ধকারের নাটক, রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ, শম্ভু মিত্র স্মরণ

        সংখ্যা, ১৪০৭, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ: ৯১

১২)   আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জুন, ১৯৬৪

১৩)   নাচঘর, ২৩ ফাধন ১১৩৬, ১৯২৯

১৪)    শৌভনিকের রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনা, প্রতিবেদন, দাস নিবেদিতা, নবম নাট্যোৎসব

        উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক পুস্তিকা

১৫)   ১৯৫২ সালের ১ জুন শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় বহুরূপী প্রথম অনুবাদ নাটক মঞ্চস্থ

        করেন শ্রীরঙ্গমে । ইবসেনের ‘An Enemy of the People’-এর বাংলা রূপান্তর

        করেন শান্তি বসু, নাম দেওয়া হয় ‘দশচক্র ।

১৬)   দশকের ব্যবধানে দশচক্র : মজুমদার স্বপন, ‘বহুরূপী’, ৩৮, মে ১৯৭২, পৃ: ৮৬

১৭)    যুগান্তর, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১

১৮)   দেশ, ২৫ জুন ১৯৬৪

১৯)   শম্ভু মিত্র ও অন্ধকারের নাটক, গঙ্গোপাধ্যায় রঞ্জন, পশ্চিমবঙ্গ, শম্ভু মিত্র স্মরণ

        সংখ্যা, ১৪০৭, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ: ৯০

44

২০)   শম্ভু মিত্রের প্রযোজনা : নির্মাণ ও সৃজন : রায় কুমার, বাংলা আকাদেমি পত্রিকা ৪,

        পৃ: ৩২৭

২১)   দেশ, জুন সংখ্যা ১৯৬৭

২২)   চাঁদ বণিকের পালা, মিত্র শম্ভু, দশম সংস্করণ, বৈশাখ ১৮২৬, এম. সি, সরকার

        অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ: ১৩১

২৩)   তদেব, পৃ: ১৪

২৪)   তদেব, পৃ: ২৪

২৫)   তদেব, পৃ: ২৪

২৬)   তদেব, পৃ: ৩৫

২৭)   তদেব, পৃ: ৪০

২৮)   তদেব, পৃ: ৬৯

২৯)   তদেব, পৃ: ৮৪

৩০)   তদেব, পৃ: ১২৮

৩১)   তদেব, পৃ: ১৩১

৩২)   বাংলা নাটকের ইতিহাস, ঘোষ ড. অজিতকুমার, প্রথম দে’জ সংস্করণ : কলকাতা

        পুস্তক মেলা, জানুয়ারি ২০০৫, পৃ: ৪৫০

৩৩)  নির্বাচিত প্রবন্ধ সংগ্রহ, চট্টোপাধ্যায় মোহিত, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন। কলকাতা,

        জানুয়ারি ২০০৬, পৃ: ৮১

                                                    লেখক পরিচিতি

কৃষ্ণপদ দাস, রিসার্চ স্কলার (বাংলা বিভাগ), বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৩৯, কালিকাপুর রোড, পোঃ মুকুন্দপুর, ২ নং ইস্টএন্ড পার্ক, ফ্ল্যাট নম্বর (জি-১), কলকাতা – ৭০০০৯৯, ফোন নম্বর – 7003787726/ 9836680333,                                                                           E-mail : krishnapadadas57@gmail.com

বাংলা লোকসংগীতে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারে আধুনিকতা ও নান্দনিক দিক – প্রশেন রায়

লোকসঙ্গীতে বিভিন্ন প্রকার লোক বাদ্যের ব্যবহার

লোক সঙ্গীতের ভাব এক এক প্রকার। এগুলো নির্ভর করে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের উপর। ভৌগলিক অবস্থান থেকে শুরু করে মানুষের সামাজিক অবস্থা, জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলী, অর্থনৈতিক অবস্থা, বিভিন্ন ধরনের কাজের ব্যবহৃত শ্রম ইত্যাদির উপরে লোকসঙ্গীতের ধরণ নির্ভর করে। বাংলাতেও বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এক এক প্রকার লোকসঙ্গীতের প্রকাশ ঘটেছে। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন লোকগানের মধ্যে কোথাও রয়েছে প্রাকৃতিক রুক্ষতা বা কমলতার প্রভাব, কোথাও আছে নিরন্তর অপেক্ষা অথবা অশ্রুসজল কারন, কোথাও আছে ঋতুকালীন উৎসব, আবার কোথাও আছে সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার ব্যাঙ্গত্মক প্রকাশ। এইরূপ বহুমুখী লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন প্রকার ভাব ধারাকে পরিস্ফূট করার জন্য সঠিক লোকবাদ্যাদির ব্যবহারও বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। বাদ্যযন্ত্রের সঠিক প্রয়োগেই একটি লোকসঙ্গীত ভাবানুযায়ী প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারে। এই প্রসঙ্গে বাংলায় বিভিন্ন প্রকার লোকসঙ্গীতে বিভিন্ন প্রকার লোক বাদ্যাদির কিরূপ ব্যবহার হয় তা আলোচনা করা হচ্ছে।

বাউল গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

বাউল গানের মধ্যে গুরুবাদী তত্ত্ব বা দেহতত্ত্বের ভাব ব্যাঞ্জনায় যে একাগ্রতা প্রকাশ পায় অথবা অসীম জগতের বিশালতার মাঝে যা উদাত্য সুর ধ্বনিত হয় সেই সুরকে এবং ভাবকে যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে একতারা বাদ্যটির একতন্ত্রীর স্পন্দন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাউল গানের বিভিন্ন প্রকার শৈলী আছে। যেমন – গুরুবাদী, দেহতত্ত্ব, মুশি©দী ইত্যাদি গানের শৈলী। প্রত্যেকটি শৈলীরই নিজস্ব নিজস্ব ভাব প্রকাশের বিভিন্ন ব্যাঞ্জন আছে এবং ভাবের মুহুর্ত গুলিকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে আরো কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়। যেমন – গুপগুপি বা আনন্দলহরী, গোপীযন্ত্র (এটিও একতার বিশিষ্ট),ঠুনঠুনে ইত্যাদি তত বাদ্য বংশী ইত্যাদী শুষির বাদ্য এবং আনদ্ধ বাদ্য হিসেবে বিশেষ করে শ্রীখোল বাদ্য বহুল পরিমানে ব্যবহৃত হয়।

৪৬

ভাটিয়ালী গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

ভাটি শব্দ থেকেই ভাটিয়ালীর উৎপত্তি। আবার অনেকে বলেন, ভাটা শব্দ থেকে মাঝিদের টানটান সুরে এই গান গাইতে শোনা যায়। নদীমাতৃক দেশ (বাংলাদেশ) এ ভাটিয়ালী গান এর প্রচলন বেশী। দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, লৌকিক কৃষ্ণ প্রেম আঙ্গিক এর ভাটিয়ালী গান দোতারার সুর ও ছন্দে কারন্য রূপ ফুটে উঠে।

ছন্দ রক্ষার্থে এবং ভাটিয়ালী গানের ভাবানুযায়ী সুর সহযোগী বাদ্য হিসেবে দোতারাই শেষভাবে ব্যবহৃত হয়। দোতারার তারে ঘাত দ্বারা ছন্দের কাজ চলে। কখনো বাঁশীর সুর ও ভাটিয়ালীর ঔদার্য কে বিশেষভাবে প্রতিভাত করে। ভাওয়াইয়া গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

ভাওয়াইয়া শব্দটির উৎপত্তি ভাব: কথাটি থেকে, ভাবের গান বলেই তা এই রূপ নামকরন করা হয়েছে। গলার স্বর ভেঙ্গে এক বিশেষ ঢঙ্গে টান টান সুরে এই গান গাওয়া হয়। নারী ঘটিত বিরহ ও প্রেমের কথাই এ গানের বিষয়। সাধারনতঃ পুরুষেরাই এ গান গেয়ে থাকেন। গায়ন ভঙ্গিমার জন্য দোতারাই হলো এ গানের এক মাত্র সঙ্গী, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঢোল জাতীয় বাদ্য ছন্দ রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়।

চটকা গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

সাধারনতঃ প্রেম বিষয়ক হালকা চটুল কথাবার্তা নিয়েই চটকা গান রচিত হয়। সুর ও ছন্দের দিক থেকে চটকা গানের সুর চটুল বা নাচুনে এবং তার গতিও দ্রুত হয়। ভাওয়াইয়া গানের সঙ্গে ব্যবহৃত দোতারা এ গানের প্রধান আনুষাঙ্গিক যন্ত্র।

জারিগান এ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

এটা বিশেষ ধরনের ধমী©য় সঙ্গীত। বাংলার মুসলমানদের প্রিয় গান। এই গানের সুর অতি করুন। কারবালার ইমাম হাসান ও হুসেনের মৃত্যুর ঘটনাকে অবলম্বন করেই এই গান গড়ে উঠেছে। সারিগানের মত এটিও সমবেত সঙ্গীত। এই গানের সঙ্গে তাল দেওয়ার জন্য ঢোল বাজাবার রীতি প্রচলিত আছে ।

৪৭

তরজাগান এ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

তরজা গানের ইতিহাস খুব বেশী দিনের নয়। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে হাওরার শালকিয়া অঞ্চলের মধুঠাকুর ও তারকপাল নামক দুজন রসিক মানুষই বাংলায় প্রথম| তরজা গানের প্রচলন করেন। তরজা গানের বিষয় বস্তু হল বেদ পুরান ও উপনিষদের কাহিনী। তরজা গানের বিশেষ কিছু অংশে ঢোলের ব্যবহার গানকে প্রাণবন্ত করে তোলে। 

শিবের গান এ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

গম্ভীরা গান, গাজন গান ও নীলের গান এই তিনটি গানই শিবের গান এর অন্তভু©ক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে গম্ভীর শব্দ থেকেই গম্ভীরার উৎপত্তি। গম্ভীর হলেন শিব । মালদহ জেলার প্রধান লোক উৎসব হল গম্ভীরা। বৌদ্ধ শাসনের ভিতর থেকেই গম্ভীরার সূচনা এবং হিন্দুধর্মের পুনরভ্যুত্থানের সময় এই উৎসব শৈব উৎসবে রূপান্তরিত হয়। এই ধরনের গানে সমাজ ব্যবস্থার দোষ গুন, লাঞ্ছনা, উন্নতি-অবনতি প্রভৃতি নানা বিষয় নিয়ে কোন ব্যক্তিকে শিব সাজিয়ে তার সামনে উপস্থাপন করা হয়। এই ধরনের গান মনের মধ্যে যেমন ধর্ম ভাব জাগায় তেমনি সমাজ সংস্কারেও সাহায্য করে । পশ্চিমবঙ্গে ‘গাজন পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশ) নীল ও জলপাইগুড়িতে 1 গম্ভীরা মূলত সবকয়টিই শৈব উৎসবের নামান্তর। শৈব উৎসবের সবকয়টি গানে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি ‘ঢোল ও বাঁশির ব্যবহার দেখা যায়। এছাড়াও বাঁশি, শিঙ্গা, দোতারা ইত্যাদি বাদ্যেরও প্রয়োগ হয়।

কবিগান এ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

তিনশ বছর পূর্বে বৃটিশ শাসনের গোরাতেই কবি গানের প্রচলন হয়েছিল, কবিগান বাংলার একান্ত নিজস্ব সম্পদ। কবি গানের প্রতি বাঙ্গালীর একটা স্বাভাবিক মমতা আছে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আসরে দাড়িয়ে কবিওয়ালাদের মুখে মুখে গান বাঁধতে হয়। প্রাচীন পুরান রামায়ন, মহাভারত ইত্যাদির কাহিনী ছাড়াও বহু লৌকিক ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের উপরেও দুপক্ষের চাপা উত্তর হয়। কবি গানের অনুসাঙ্গিক যন্ত্রের মধ্যে ঢোল ও বাঁশী অন্যতম, এছাড়া শিঙ্গা জাতীয় শুষির বাদ্যের প্রয়োগও হয়। বর্তমানে এই ধরনের গানের প্রচলন অনেক কমে এসেছে এবং যা রয়েছে তার মধ্যে ও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে তাই অনেক ক্ষেত্রে হারমোনিয়াম ও সুর সহযোগী বাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৪৮

বিয়ের গান এ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

বিবাহের স্ত্রী আচারের অঙ্গ হিসেবে যে গানগুলি সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাই হল বিবাহ সঙ্গীত । পুর্ব বাংলায় মেয়েদের কণ্ঠে বিবাহ সঙ্গীত অন্যতম প্রধান। লোকসঙ্গীত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শ্রীহট্ট (বাংলাদেশ) জেলার মেয়েদের বিয়ের গান, বিয়ের গানে সানাই, ঢোল অন্যতম বাদ্যযন্ত্র।

ত্রিনাথের গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

সৃষ্ঠি, স্থিতি আর প্রলয়ের দেবতা হলেন ত্রিনাথ। পূর্ব বাংলায় হিন্দু সমাজে ত্রিনাথের গানের প্রচলন আছে। বর্তমানে এ গানের প্রসার ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গেও। ঢোলক এর বাদন শৈলী ত্রিনাথের গানকে সৌন্দর্য ময় করে তালে। এছাড়া শ্রীখোল ও বাঁশী, করতাল এবং বর্তমানকালে হারমোনিয়াম এর ব্যবহারও হয়।  প্রভাতী গান এ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র বাংলায় প্রভাতী গান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কেউ কেউ এ জাতির গানকে টহলদারী গান বলে থাকেন। বাউল সম্প্রদায়ের লোকেরাও এ ধরনের প্রভাতী গান করেন।

প্রভাতী গানে তাল যন্ত্র হিসেবে শ্রীখোল এবং অন্যান্য বাদ্য যন্ত্র হিসেবে বাঁশী, একতারা, আনন্দলহরী,  করতাল এর ব্যবহার দেখা যায়। হোলির গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র ফাল্গুন চৈত্রমাসে দোলযাত্রা উপলক্ষে সারা ভারতবর্ষে হোলির উৎসব ও হোলির গানের প্রচলন রয়েছে। বাংলার হোলির গান ততটা বণা©ঢ্য নয়। হোলির গানে অন্যান্য যন্ত্রের সাথে ঢালে, শ্রীখোল, করতাল এর ব্যবহার দেখা যায়।

ঝুমুর গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

ঝুমুর গান সাধারনতঃ পুরুলিয়া, বাকুঁড়া, পশ্চিম বধ©মান, ঝাড়গ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে বহুল প্রচলিত। বাংলা ঝুমুর গান রাধাকৃষ্ণের বিরহের কথা নিয়ে রচিত । ঝুমুর গান সাঁওতাল এবং কোলভীলদের এক ধরনের গোষ্ঠী সঙ্গীত। সাওঁতালী ছেলে মেয়েরা বনফুলে সেজে মাদলের সাথে দল বেঁধে নাচের তালে তালে এই গান গেয়ে থাকেন। মাদল ছাড়াও ছোট বাঁশীর প্রয়োগ হয়।

৪৯

রাখালিয়া গান এ ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

এই গান সাধারনতঃ রাখাল বালকেরা গরু চরাইবার সময় মাঠে গেয়ে থাকেন। অনেক সময় বাঁশী ও এই গানে বাজানো হয়। রাখালিয়া গানের বিষয়বস্তু কৃষক ও গোপবালকদের গোচরনকে উপলক্ষ্য করে লিখা হয়ে থাকে।

কোন শিল্প বস্তুর প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিল্পের সৌন্দর্য। অসুন্দর কোন বস্তুই শিল্প বস্তুতে পরিনত হতে পারে না। এই সুন্দর মনের মধ্যে বিশেষভাবের উদ্ভেক করে, ভাব বিভিন্ন প্রকার বিভাব ও অনুভবের সম্মেলনে ঘনিভূত ভাবে পরিনত হয়। সেই ঘনিভূত ভাব থেকেই রসের উদ্ভেক হয় এবং রসাস্বাদনের মধ্য দিয়েই আনন্দ লাভ হয় আর এখানেই শিল্পের নান্দনিকতা প্রকাশ পায়। নন্দনতত্ত্ব বলতে আমরা সৌন্দর্যতত্ত্ব বা আনন্দতত্ত্বকে বুঝে থাকি। রসাস্বাদনের মাধ্যমে আনন্দলাভ ঘটলে ও রস শাস্ত্রের সঙ্গে সৌন্দর্য শাস্ত্রের প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ নেই। আবার অন্যদিক থেকে কোনো একটা জায়গায় এই দুইয়ের সম্মেলনেই আনন্দের উদ্ভব হয়। রস অভিনয়ের বস্তু। নাট্যের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিনয়ের সুযোগ থাকে। কিন্তু গীত বাদ্য বা নৃত্যের সমন্বয়ে গঠিত সংগীত শিল্পের ক্ষেত্রে একমাত্র নৃত্য ছাড়া বাকীগুলোতে প্রত্যক্ষ অভিনয়ের সুযোগ নেই। তাই এক্ষেত্রে বিশিষ্ট গীতি বা ভঙ্গির দ্বারা অভিনয় প্রকাশ করা হয়। অবশ্য চিত্র বা ভাস্ককর্যের ক্ষেত্রে একটা স্থায়ী বক্তব্য প্রকাশ করা যায় বলে এক্ষেত্রেও সরাসরি ভাব তথা রসের উদ্ভেক হতে পারে।

সংগীত এমনি এক শিল্প যা বিমূর্ত। অর্থাৎ সংগীতের যে নাদময় রূপ তা শুধু শ্ৰবনগ্রাহ্য কিন্তু চাক্ষুষ নয়। যেহেতু সংগীত এক প্রকার শিল্প, অতএব সেই শিল্পের মধ্যে যেমন সৌন্দর্য থাকবে তেমনি থাকবে তার নান্দনিকতা। আলোচনা পর্বে আমরা দেখেছি, নন্দন বা আনন্দ লাভই শিল্পের প্রধান উদ্দেশ্য এবং যা রসাস্বাদনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ সংগীতের ক্ষেত্রে ও তার বিশেষভাব এবং ভাব থেকে রসে পৌঁছতে হবে। যেহেতু রস অভিনয়ের বস্তু অতএব সংগীতের ক্ষেত্রেও অভিনয়কে প্রকাশ করতে হবে। বিমূর্ত সংগীতে একমাত্র বৈশিষ্ট্য স্বরভঙ্গি প্রয়োগের মাধ্যমেই অভিনয়কে প্রকাশ করা হয়। এই অভিনয় অবশ্যই নাদময় এবং এই নাদময় রূপ থেকেই বিভিন্ন বিভাব ও অনুভবের সাহায্যে স্থায়ীভাব তথা রস তথা আনন্দের সঞ্চার হয়। সংগীতের বিভিন্ন চরিত্র অনুযায়ী বিশিষ্ট স্বরভঙ্গি প্রয়োগ করা হয়। যেমন- রাগ সংগীত, দেশী সংগীত বা আঞ্চলিক সংগীত, লোকসংগীত ইত্যাদিতে বিশেষ বিশেষ ভাবকে প্রকাশ করবার জন্য বিশেষ বিশেষ আঞ্চলিক ভঙ্গির প্রয়োগ করা হয়। তবে শাস্ত্রীয় সংগীতের ক্ষেত্রে শুধু মাত্র আঞ্চলিক ভঙ্গি নয় তার সঙ্গে বিজ্ঞান সম্মতভাবে বিভিন্ন শ্রুতি প্রয়োগের মাধ্যমে স্বরভঙ্গি প্রকাশ করা হয়। লোকসংগীত এমনি এক সংগীত যা গ্রামীন সামাজিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই সংগীত সাধারন মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-মিলন, বেদনা-যন্ত্রনার ভাষাকেই তুলে ধরে। বাংলার লোকসংগীতও এমনি এক সমৃদ্ধশালী সংগীত যার মধ্য দিয়ে সাধারন মানুষের আবেগের ধ্বনি সঞ্চারিত হয়।

৫০

লোক সংগীত এমনি এক ধরনের সংগীত যেখানে ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বরক্ষেপনের আঞ্চলিক গীত ভঙ্গির প্রভাব অধিক মাত্রায় পড়ে, যা ভৌগলিক পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। বাংলার লোক সংগীতের ক্ষেত্রেও ভৌগলিক পরিবেশ অনুযায়ী প্রধানতঃ দুটি ধারা আছে-

১) উত্তরবঙ্গীয়

২) পূর্ব ও দক্ষিন বঙ্গীয়

এখানে বাংলা বলতে আমরা অবিভক্ত বাংলাকেই বুঝাচ্ছি। উত্তর বঙ্গীয় ভৌগলিক অঞ্চল সমতল নয় এবং সেখানে গভীর বনভুমিও দেখা যায়। গ্রামের লোকালয়গুলির মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। কৃষিকাযে©র ক্ষেত্রে বহু পরিশ্রম করতে হয়। আবার অন্যান্য জীবিকা হিসাবে হাতি, মেষ ইত্যাদি প্রাণীর রক্ষনাবেক্ষনও এসে পড়ে তাই এই কঠিন জীবন যাত্রায় মানুষের শারীরিক গঠন, উচ্চগ্রামের কণ্ঠস্বর, সামাজিক ও অথ©নৈতিক প্রভাব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে আমরা বিশেষ লক্ষন দেখতে পাই। উচ্চগ্রামে এই গান গাওয়া হয় এবং গানের সুর ও ছন্দ অনেক ক্ষেত্রে মাহুত চালিত হাতি অথবা মহিষ পালক চালিত মহিষের চলার ভঙ্গির উপর গঠিত হয়। গানের সুরে কিঞ্চিত স্বরভঙ্গ ভাওয়াইয়া গানের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। দোতারার সুর এই গানের ভাবকে ফুটিয়ে তুলতে বিশেষ সাহায্য করে, অপরপক্ষে দোতরার তারে এমন এক ছন্দ সৃষ্টি করা হয় যা মাহুত বন্ধু বা মইষাল বন্ধুকে কেন্দ্র করে তার গাওয়া গানের মধ্যে এক বিশেষ ভাবকে প্রকাশ করা হয়।

এরপর যদি আসা যায় ভাটিয়ালী গানের প্রসঙ্গে তবে আমরা দেখবো এই গান বাংলার প্রধান নদী, খাল-বিলের নৌকা চালক মাঝিমাল্লাদের গান। আবার ফাঁকা মাঠের গাছ তলায় বসে পথ চলার মাঝেও ভাটিয়ালী গান গাওয়া হয়, তাই একে মেঠো গানও বলা হয়।

আমরা যদি বাংলার বাউল গানের দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে দেখবো এই গান এক অথে© বৈরাগ্যের গান। ঘরছাড়া বৈরাগী বাউন্ডেলারাই এই গান গেয়ে থাকেন। গানের বিষয় বস্তু মূলত লৌকিক ধর্মকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠে। আবার সহজ সরল ভাষার অন্তরালে হিয়াঁলীর আকারে দেহতত্বের বহু জটিল বিষয়টিকেও অতি চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়। বাউল যখন একমনা তখন তার হাতে একতারার একটি সুরই তার চরম বৈরাগ্যের ভাবকে ফুটিয়ে তুলে। আবার বাউল যখন কোন আখরা বা মেলায় বা সভায় গান গাইবেন তখন সেই গানের আঙ্গিককে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আনন্দলহরী, খমক এবং তালবাদ্য হিসাবে শ্রীখোল, খঞ্জনী ইত্যাদি সঠিক আনুষঙ্গিক বাদ্য। নৃত্যরত বাউলের পায়ে বাধাঁ ঘুঙ্গুরের ঝংকারে এক অপূর্ব ভাবময় তার প্রকাশ ঘটে।

৫১

বাংলার লোকসংগীতের যে উদ্ভব ঘটেছে তাকে আমরা আবার বিশেষ দুটি ধারায় বিভক্ত করতে পারি যেমন-

১) বিভিন্ন লৌকিক উৎসব ও পালা পার্বন কেন্দ্রিক

২) বিভিন্ন সামাজিক বিষয় কেন্দ্রীক

বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বন। বিভিন্ন ধমী©য় উৎসব ছাড়াও বিভিন্ন ব্রত, ছড়া পাঁচালি ইত্যাদিতে আঞ্চলিক সংস্কৃতি অনুযায়ী লোকগান ও লোক নৃত্যের বহুল প্রসার আছে। মানভূম, সিংভূম, ধলভূম ও বাংলার অন্যান্য দেশে বিশেষ করে বাংলার পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভাদু পূজা ও টুসু পূজাকে কেন্দ্র করে কুমারী মেয়েদের যে ব্রত পালিত হয় তাতে ভাদুর গান, টুসুর গান গাওয়া হয়। এই গানগুলির সঙ্গে মাদলের তাল বাঁশীর সুর এক অপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি করে। এছাড়া চৈত্রমাসের নীল পূজাকে কেন্দ্র করে নীলের গান চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজাকে কেন্দ্র করে চড়কের গান, আলকাফ গান, মা শীতলার গান, গো-মঙ্গল গান, মুশকিল আসান অর্থাৎ সত্যপীরের গান ফসল তোলার গান ইত্যাদি বাংলার বিভিন্ন বারব্রত পালা পার্বন উৎসবকে ঘিরে গীত হয়। দোতারা বা বাঁশীর সুরে ঢোল বা মাদলের ছন্দে বাংলার মানুষ বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ আনন্দ ও খুশিতে মেতে উঠে। বিবাহকে কেন্দ্র করেও বিভিন্ন পর্ব অনুযায়ী বাংলার লোক সংগীতের ধারা গ্রামীন সমাজে এখনো অনেকাংশে প্রচলিত আছে। এই উৎসবের অন্তর্গত হলুদ কোটা, জলসওয়া, দধিমঙ্গল ইত্যাদি পর্যায়গুলিতে বাড়ীর মেয়েরাই বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে থাকে। সাধারনতঃ এই সকল গান বাদ্য যন্ত্র ছাড়াই গীত হয়। তবে ঢোলের বোলে এর ছান্দিক নান্দনিকতা বিশেষভাবে ফুটে উঠে। বিভিন্ন উৎসকেই কেন্দ্র করে আবার তরজা গান, কবি গান ইত্যাদি পরিবেষ্টিত হয়। মূলত এই প্রকার গানে দুটি দলের মধ্যে এক প্রকার সাংগেতিক প্রতিদ্বন্দিতা চলে। পৌরানিক বা সামাজিক কোনো তত্ত্ব বিষয়ে এই ধরনের কাব্যিক লড়াই হয়। কাব্য ছন্দ্যে নাচের তালে তালে ঢোল, কাঁশি, বাঁশী ইত্যাদি বাদ্য এমনভাবে বেজে উঠে যে এই গানের মাধ্যমে প্রায় সকল শ্রোতা দর্শকই উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে এবং বিনোদনে মেতে উঠে।

লোক গানের সামাজিক ধারার মধ্যে সারিগান, চটকা, গম্ভীরা, ঘেঁটুর গান, ঘাটু গান, ঝুমুর গান ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে যেমন সমবেত কণ্ঠে সারিগান গাওয়া হয় তেমনি আবার চটকা ঝুমুর ইত্যাদি গানের মধ্যে সামাজিক বা সাংসারিক বিষয়কে তুলে ধরা হয়। আবার কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে ও বিভিন্ন গানের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যাকে তুলে ধরা হয়। উদাহরনস্বরূহ গম্ভীরাগান, ঘেটুর গান ইত্যাদি। সারি গানে তালের প্রাধান্য অধিক কারন তালের ছন্দেই সারিবদ্ধভাবে নৌকার দাঁড় টানা হয়। ঢোল জাতীয় বাদ্যই এই সমবেত ছন্দকে ধরে রাখে আবার ঝুমুর গানের সঙ্গে মাদল, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এক অপূর্ব বিনোদনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে। মাদলাজেলার গম্ভীরা গান উত্তরবাংলার বর্ষ শেষের গান। এটি একপ্রকার উৎসব কেন্দ্রিক গান হলেও এখানে শিবকে কেন্দ্র করে তাঁর স্তোতী ও বন্দনার মধ্য দিয়েই জাতীর সমাজ ব্যবস্থার দোষ গুণ, জাতীর দুঃখ লাঞ্ছনার উন্নতি অবনতির প্রভৃতির নানা বিষয়কে তুলে ধরা হয়। এই ধরনের গান মনে যেমন ধর্মভাব জাগায় তেমনি সমাজ সংস্কারে ও সাহায্য করে। গম্ভীরা গানের শোভাযাত্রায় নানা রকমের সঙ্গ বের করা হয়। আগেকার দিনে কলকাতাতে ও জেলে পাড়ার সঙ্গ বা গঙ্গা পূঁজার সঙ্গ বের করা হতো।  বিভিন্ন সাজে সজ্জিত সঙ্গদের মুখ দিয়ে সমাজের নানা রকম ত্রুটি বিচ্যুতি ও প্রচলিত ব্যবস্থার কথা বলা হতো। গম্ভীরা ও সঙ্‌ জাতীয় গানের মধ্যে নাচের প্রভাব বেশী থাকায় ঢোল, কাঁশি, বাঁশী ও শিঙ্গা জাতীয় বাদ্যের ব্যবহার অধিক হয়। ঢোলের তালে তালে ও বাঁশির সুরে গ্রামাঞ্চলের লোক সংস্কৃতির ধারা বিশেষভাবে ফুটে উঠে। ঘেঁটুর গান ও এইরূপ ঘন্টার্কন বা ঘেঁটুকে কেন্দ্র করে যে ধর্মীয় সংগীত গাওয়া হয় তার মধ্যেও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি বিষয়বস্তু প্রতিফলিত হয়।

৫২

পরিশেষে আমরা এ কথাই বলতে পারি বাংলার লোক সংগীতের বিভিন্ন আঙ্গিক অনুযায়ি বিভিন্ন প্রকার লোকবাদ্যের যে সুচারু ব্যবহার দেখা যায় তা গ্রাম বাংলার লোক সংস্কৃতিকে অতি নান্দনিকভাবে মানব মনে প্রবাহিত করে।

লোকসংগীতের বিস্তৃতি এতটাই ব্যাপক যে একটি দুটি লাইনে এর সঠিক সংজ্ঞা নিরূপন করা সম্ভব নয়। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশের লোকসংগীত নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে এবং গবেষনালব্ধ ফল থেকে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে যে লোক সঙ্গীত মূলত গ্রামাঞ্চলের সঙ্গীত এবং মানুষের জীবন যাত্রার বিভিন্ন ধারাকে কেন্দ্র করে এই সংগীত গড়ে উঠেছে। গীত বাদ্য এবং নৃত্যের সমন্বয়ে যেমন সংগীত গড়ে উঠে তেমনি লোকসংগীতের মধ্যে ত্রিধারা প্রবাহমান। সামাজিক অথ©নৈতিক,সংস্কৃতির বিষয়ের সঙ্গে জড়িত গ্রামীন মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না , বিরহ-মিলনের কথাই এই সংগীত বলে। আবার লোকগানের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরে আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। লোক সঙ্গীত মূলত গ্রামাঞ্চলের গান হলেও পরবর্তী কালে দেখা গেছে শহরাঞ্চলের অনেক বিষয় বস্তুকে কেন্দ্র করে বহু লোকগান রচিত হয়েছে ।

আমি যে বিষয়ে আলোচনা করেছি তা বাংলার লোকসংগীতকে (অখন্ড বাংলা) কেন্দ্র করে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মতো বাংলার লোকসংগীত ও সংগীত ভান্ডারের এক অমূল্য সম্পদ। বাংলার বিভিন্ন জেলা বা গ্রামীণ অঞ্চলে যে সকল লোকসঙ্গীতের ধারা আছে তা বিশেষ বৈচিত্রপূর্ণ এবং হৃদয়গ্রাহী। ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালীর ছন্দ ও সুরের বৈচিত্র ঔদার্য বাউল গানের বৈরাগ্য, ঝুমুর গানে খুলির নেশা অথবা কবি গানে কবিত্ব প্রতিভা মানুষের মনে এক গভীর সংবেদন সৃষ্টি করে।

লোকগান ও লোকনৃত্যকে সুরে, ছন্দে তালে প্রানবন্ত করে তোলে নানা লোকবাদ্য। বাউলের একতারার তারে যেমন একনিষ্ঠ্য হবার সুর বাজে তেমনি ভাটিয়ালী বা ভাওয়াইয়ার সুরকে বয়ে নিয়ে যায় দুতারার দুটি তার । ঝুমুরের মাদল অথবা গম্ভীরার ঢোল কাঁশি জাগিয়ে তোলে এক অপূর্ব ছন্দ, যা হৃদয়ের প্রত্যেকটি স্পন্দন এর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই সকল লোকবাদ্য যন্ত্রাদির সুচারু ব্যবহারে লোক সংগীতের মধ্যে যে সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় তাই মানবমনকে এক নিবিড় ভাবে নিমগ্ন করায় এবং যার পরিনতি রসাস্বাদনের মাধ্যমে আনন্দলোকে প্রবেশ।

“বাংলার লোকসংগীতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার” এই প্রসঙ্গে যে আলোচনা করা হলো তাকে পাচঁটি অধ্যায়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। লোকবাদ্যে আলোচনার পূর্বে বাংলার বিভিন্ন প্রকার লোক সংগীতের শৈলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর এই সংগীতে ব্যবহৃত নানা প্রকার লোক বাদ্যাদির নাম ও তাদের গঠন সম্পর্কে একটা ধারনা দেবার চেষ্টা করেছি। এমন অনেক লোকসংগীত আছে যা হয়তো আমাদের সকলের কাছে পরিচিত নয় এবং সেই সকল লোকসংগীতের গায়ন শৈলীর সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার লোকবাদ্যের ব্যবহার ও তাদের বাদন শৈলীর সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারনা আমরা পেতে পারি। সবশেষে বিভিন্ন প্রকার লোকসংগীতে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার লোকবাদ্য যন্ত্রাদির ব্যবহারের যে একটা যৌক্তিকতা আছে এবং একটা নান্দনিক দিক আছে সে সম্পর্কে যথাসম্ভব আলোচনা করেছি। আশা করি আমার এই গবেষনামূলক আলোচনা পত্রটি সঠিকভাবে বিবেচিত হবে।

৫৩

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী

১) গীত বাদ্যম (১ম খন্ড),লেখক- লক্ষীনারায়ন ঘোষ। প্রকাশক : প্রতাপ নারায়ন ঘোষ, বি, কম, শিশির ভাদুরী সরনী মানিকতলা স্ট্রীট, কলকাতা

২) সংগীত মূল্যায়ন বক্তৃতামালা (৩য় খন্ড), সম্পাদনা – ডঃ উৎপল গোস্বামী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি। তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার

৩) লোক সংগীত বিভাকর (১ম খন্ড),লেখক – সুবোধ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রকাশক : ফামা© কে-এল-এম প্রাইভেট লিমিটেড। বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীট, কলকাতা

৪) আরও স্বরলিপি লোকগীতি, লেখক – বুদ্ধদেব রায়, সঙ্গীত প্ৰকাশনের পক্ষে -মীরা নাথ, আর কে চ্যাটার্জী রোড, কলকাতা

৫) গানের বাহিরানা, লেখক – হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সম্পাদনা – মৈনাক বিশ্বাস, গনেন্দ্র মিত্র লেন, কলকাতা

৬) উত্তরবঙ্গের লোকসঙ্গীত লেখক – ডঃ মুহম্মদ আবদুল জলিল, প্রকাশক – তোফাজ্জল হোসেন, বিশ্বসাহিত্য ভবন, বাংলা বাজার, ঢাকা

৭) প্রসঙ্গঃ লোকসংস্কৃতি, – সৌগত চট্টপাধ্যায়, পুস্তক বিপনি, বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা

৮) ভাওয়াইয়া লোকসঙ্গীত চয়নিকা, – নীহার মজুমদার, প্রকাশক – অমল সাহা,ভি, আই, পি, পার্ক, কলকাতা

৯) সঙ্গীত তত্ত্ব, দেবব্রত দত্ত, প্রকাশক – দেবী দত্ত, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, কলকাতা

১০) বাদ্যযন্ত্র প্রসঙ্গ ,- মোবারক হোসেন খান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

১১) তবলা বিজ্ঞান (দ্বিতীয় খন্ড), – ইন্দুভূষন রায়, ভারতী প্রকাশনী, চৌধুরী পাড়া রোড, বারাসাত উঃ ২৪ পরগনা

১২) লোক-সাংগেতিকী, লেখক – বুদ্ধদেব রায়, প্রকাশনা -ফার্মা কে, এল, এম প্রাইভেট

৫৪

১৩) বঙ্গীয় লোকসংগীতে রত্নাকর (প্রথম খন্ড)। – আশুতোষ ভট্টাচার্য

১৪) নিবারন পন্ডিতের গান। তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশিমবঙ্গ সরকার

১৫) জন্ম শতবর্ষে কবিয়াল লম্বোদর চক্রবর্তী, – হীরেন ভট্টাচার্য, – ভারতীয় গননাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি

১৬) নীলের গান, লেখক – শামসুর রহমান, প্রকাশনা – জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, বাংলাদেশ

বাক্‌যন্ত্র : গঠণ ও সাঙ্গীতিক ব্যবহার

নূর নবী মীরণ

বাকযন্ত্র আদতে কি!

এটি (বাকযন্ত্র বা ভোকাল) সত্যিই একটি অনন্য বাদ্যযন্ত্র। যে যন্ত্রের আওয়াজ এর গুণগত মান এবং যন্ত্রের নাম প্রকাশের জন্য একটিই শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যন্ত্রটির আওয়াজের নামেই এটিকে চেনা যায়। একে চেনার জন্য এই যন্ত্রের সাহায্যে সৃষ্ট আওয়াজের বিশেষ ব্যাখ্যার দরকার হয় না। এই যন্ত্রটিকে ব্যবহারের সময় বা ব্যবহারের প্রয়োজনে ব্যবহারকারীকেই ব্যবহার উপযোগী করতে হয়। বাইরে থেকে বা ব্যবহারকারী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে এটিকে তৈরি করে দেয়া সম্ভব নয়। কেননা এর কাঠামো পুরোটাই মানুষের শরীরের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে। বাইরে থেকে যন্ত্রটির কিছু খন্ডিত অংশ দেখা গেলেও পুরো যন্ত্রটি দেখা কোনভাবেই সম্ভব হয় না। সাধারণ বাদ্যযন্ত্রের মত এটি সাধারণ ছকে আবদ্ধ থাকে না। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে এটিকে তৈরি করতে হয়। মূলত এটি পেশি, কোমলাস্থি এবং হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে। বাকযন্ত্র বা কন্ঠ নামে এই যন্ত্রটিকে নামকরণ করা হলেও এর যন্ত্রাংশগুলি আওয়াজ তৈরি ছাড়াও অন্য কাজ করে থাকে। যা আর কোন বাদ্যযন্ত্র করে না। করা সম্ভব নয়। এটি সাধারণ একটি আওয়াজকে বিভিন্ন রকম শব্দে রূপান্তর করতে পারে। এই যন্ত্রের বিচিত্র কার্যধারার বিশেষ দিক হল যন্ত্রটিকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভালো বা খারাপ অভ্যাস তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ এটিকে সঠিক বা ভুল প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এই যন্ত্রটি সরাসরি মানুষের মস্তিষ্কের সাথে সম্পৃক্ত। প্রত্যেকবার ব্যবহারের সময় যন্ত্রটিকে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারিক ছকে রূপান্তর করতে হয়। আর ব্যবহার করার পর পর যন্ত্রাংশগুলি তার পূর্ববর্তী অবস্থানে ফেরত যায় এবং অন্য কাজে নিয়োজিত হয়।

মানুষের কন্ঠ নামক যন্ত্রটি এমন একটি যন্ত্র যা ব্যবহারকারীকে তৈরি করতে হয়। ব্যবহারকারী ছাড়া এই যন্ত্রটিকে আর কেউ ছকে এনে ব্যবহার করতে পারে না। যার কন্ঠ তাকে ব্যবহার করতে হয়। যেটি পৃথিবীর আর কোন বাদ্যযন্ত্রের বেলায় ঘটে না। মানবকণ্ঠ নামক বাদ্যযন্ত্র ছাড়া অন্যসব বাদ্যযন্ত্রের বেলায় দেখা যায় যন্ত্র প্রস্তুতকারী এবং ব্যবহারকারী আলাদা ব্যক্তি হয়ে থাকে। সেইসাথে কোন নির্দিষ্ট বাদ্যযন্ত্র একবার তৈরী হয়ে গেলে তার পুরো কাঠামো বাইরে থেকে দৃশ্যমান হয়। দৃশ্যমান অবয়ব দেখে আমরা কোন নির্দিষ্ট বাদ্যযন্ত্রকে চিনতে পারি। কিন্তু মানুষের কন্ঠ নামক যন্ত্রটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। সে কারণে যন্ত্রটির কোন আকার আকৃতি বা অবয়ব আমরা দেখতে পাই না। আর দেখতে না পারার কারণে একে ব্যবহার করার বিধি বিধান আমাদের কাছে অপরিচ্ছন্ন রয়ে গেছে। তাই যন্ত্রটি ব্যবহারের বেলায় প্রতিনিয়ত আমাদেরকে ভুল—ঠিক এর গোলকধাঁধায় পড়তে হয়।

৫৬

বিষয়টিকে আরও বিস্তারিত ভাবে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন একজন কন্ঠশিল্পী গান করছেন। তিনি আদতে কি করছেন? তিনি একাধারে কণ্ঠযন্ত্রটিকে ব্যবহার করার উপযোগী করছেন অর্থাৎ যন্ত্রটি নির্মাণ করছেন এবং একই সাথে ব্যবহার করছেন। ব্যবহারের ফল হিসেবে আমরা গান শুনতে পাই। কিন্তু এই কন্ঠযন্ত্রটি যা মানবদেহের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বর্তমান আছে, তা দিয়ে সবসময় সুরেলা আওয়াজ তৈরি হবে বা সে কণ্ঠ সর্বদা সুন্দর গান গাইবে এমনটা আমরা আশা করতে পারি না। বাস্তবে এরকম আমরা দেখতে পাই না। বাকযন্ত্রের প্রতিটি অংশ প্রত্যেক মানুষের শরীরে একই প্রক্রিয়ায় থাকা সত্ত্বেও তা থেকে সৃষ্ট আওয়াজের এত রকমের হয়ে থাকে। যদি বাকযন্ত্রটি অন্য কোন বাদ্যযন্ত্রের মত (বেহালা, গিটার, পিয়ানো) পরিপূর্ণ কাঠামোতে তৈরি থাকতো তাহলে প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষ সুন্দরভাবে গান গাইতে পারতো। কিন্তু এ অভিজ্ঞতা আমাদের একেবারেই নেই। যদিও বাকযন্ত্রের প্রতিটি অংশ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একই আকৃতিতে বিদ্যমান, তবুও তা থেকে সৃষ্ট ধ্বনির এত ভিন্নতা। বাকযন্ত্রের অংশগুলিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারার জন্য মানুষ সাধারণভাবে সুন্দর আওয়াজ করতে পারে না। তাই প্রত্যেক বাচিকশিল্পী বা যিনি কণ্ঠস্বরকে সুন্দর করতে চান তাদের প্রত্যেককেই কণ্ঠ নামক যন্ত্রটির কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া প্রথমে শিখতে হবে। যন্ত্রের কাঠামো সঠিকভাবে নির্মাণ না করে তাকে ব্যবহার করতে গেলে বিপর্যয় আসতে বাধ্য। এই বিবেচনায় বলা যেতে পারে একজন কণ্ঠশিল্পী বা একজন বাচিকশিল্পী প্রথমে একজন নির্মাতা তারপর ব্যবহারকারী। কেননা একজন কণ্ঠশিল্পীকে সর্বপ্রথম অংশগুলির সঠিক সমন্বয় করে যন্ত্রের কাঠামো নির্মাণ করতে হবে তারপর তাকে বাজাবার চেষ্টা করতে হবে।

আমরা যে যন্ত্রটির বিষয়ে কথা বলছি— কন্ঠযন্ত্র— এটি আওয়াজ তৈরি করা বা না করার বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কিছু কাজ করে থাকে। যা মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। বাগযন্ত্রের অন্তর্গত মানুষের শারীরিক অঙ্গগুলির মূল কাজ হলো মানুষের বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াকে সচল রাখা। শব্দ তৈরির প্রক্রিয়া সেই অঙ্গগুলির বাড়তি কাজ। যেহেতু অঙ্গগুলি শুধুমাত্র শব্দ তৈরীর জন্য মানবদেহে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তাই শব্দ তৈরীর ক্ষেত্রে তাদের ব্যবহার প্রক্রিয়াও সহজ সরল অংকের মত নয়। সেই কারণে শব্দ তৈরীর বেলাতে অঙ্গগুলির সঠিক ব্যবহার পদ্ধতি জানা অত্যন্ত জরুরী। তাই শব্দ তৈরি করার ক্ষেত্রে বাকযন্ত্রের সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলির সঠিক ব্যবহার এর গুরুত্ব সর্বাধিক। কারণ সেই অঙ্গ গুলির সঠিক সমন্বিত ব্যবহারের ফলই হল সুন্দর শব্দ, ধ্বনি, বা আওয়াজ।

বাকযন্ত্র আদতে কি— ২

মানুষের কণ্ঠস্বর এমন একটি যন্ত্র যার পুরোটাই শরীরে প্রচ্ছন্ন থাকে।
মানুষের জীবন প্রবাহকে সঠিক রাখার কাজে নিয়োজিত কিছু অংশের সমন্বয় করে এই বাকযন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। এর নামকরণ মানুষের দেয়া। মানুষ নিজের প্রয়োজনে এই ভয়েস বা বাকযন্ত্রের অবতারণা করেছে। এই বাকযন্ত্রের যন্ত্রগুলির মূল কাজ কিন্তু ধ্বনি বা আওয়াজ তৈরি করা নয়। এদের মূল কাজ হলো জীবন বাঁচিয়ে রাখার উপকরণ কে সরবরাহ করা। জীবনধারণের জন্য যে সব উপকরণ অপরিহার্য সেসবকে শরীরে চালান করার কিছু মাধ্যম। যেমন মুখ, দাঁত হলো খাবার গ্রহণ করার মাধ্যম। জিভ হলো খাবারকে খাদ্যনালীতে পার করার উপকরণ। ফুসফুস হলো বাতাস থেকে অক্সিজেনকে শরীরে সরবরাহ করার মাধ্যম। ভোকাল কর্ড ফুসফুসে বাতাস ঢোকা এবং বের হবার গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে। আর ডায়াফ্রাম ফুসফুসে বাতাস ঢুকানো ও বের করার পাম্প হিসাবে কাজ করে। এইসব কাজ মানুষের জীবন রক্ষার জন্য কতটা প্রয়োজনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

৫৭

বাকযন্ত্র ছাড়া অন্য সকল বাদ্যযন্ত্র পুরোটাই বাইরে থেকে দেখা যায়। প্রত্যেক বাদ্যযন্ত্রের অবয়ব, আকার-আকৃতি, গঠনশৈলী ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে যন্ত্রের নাম করন করা হয়। যা দেখে আমরা খুব সহজেই চিনতে পারি কোনটি বেহালা, কোনটি গিটার বা কোনটি হারমোনিয়াম। এবং এইসব বাদ্যযন্ত্রের কাঠামো নির্দিষ্ট থাকে। যেহেতু এই সব বাদ্যযন্ত্র একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে বাঁধা থাকে তাই এগুলোকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন বাদকই যথেষ্ট। একজন বাদক নির্দিষ্ট বাদ্যযন্ত্রের বাদন প্রক্রিয়া যত ভালোভাবে রপ্ত করতে পারবেন তিনি ততো ভালো বাদক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। এক্ষেত্রে বাদন কৌশল হলো মুখ্য বিষয়।

কিন্তু বাকযন্ত্রের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে অতটা সহজ সরলীকরণ করা যাবে না। আওয়াজ তৈরীর কাজ ছাড়া যন্ত্রগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের স্বতন্ত্র অন্য কিছু কাজের সাথে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিনিয়ত সম্পৃক্ত থাকে। আবার সেই যন্ত্রাংশগুলোর সমন্বয়ে আওয়াজ তৈরীর বেলাতেও বাড়তি কিছু বিষয় এর সাথে সংযুক্ত হয়। যে বিষয়গুলি বাকযন্ত্র ছাড়া অন্য কোন বাদ্যযন্ত্রের বেলায় তেমন ভূমিকা রাখে না। বাকযন্ত্রকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রাথমিকভাবে এসব পরিবেশের প্রভাবকে উপেক্ষা করা যায় না। এছাড়া আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে এর সাথে জড়িত তা হলো যন্ত্র ব্যবহারকারীর তাৎক্ষণিক মানসিক অবস্থা। যদিও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি নিবিড় ভাবে জড়িত, তবে পার্থক্য হলো অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রে বাদক ঠিকভাবে বাজাতে না পারলেও যন্ত্রটি কিন্তু তার নিয়ম মত ঠিক বাজে। বাদকের অসুবিধার জন্য যন্ত্রের নিজস্ব প্রক্রিয়ার কোন পরিবর্তন হয়না। বাদকের অপরিপক্কতা প্রকাশ পায়। অথচ বাকযন্ত্রের বেলাতে বাদকের সার্বিক অবস্থার উপর যন্ত্রের অবস্থা পুরোপুরি নির্ভর করে। বাদকের ভুল প্রক্রিয়ার জন্য যন্ত্রের কাঠামো ভুলভাবে তৈরি হয় এবং ভুলভাবে বাজে। অর্থাৎ বাদকের বাদনশৈলীর উপর সরাসরি নির্ভর করছে যন্ত্রের কাঠামো। বাকযন্ত্রের ক্ষেত্রে বাদক একাধারে যন্ত্র তৈরি করে এবং বাজায়। একসাথে যন্ত্র নির্মাতা ও ব্যবহারকারী। এই পর্ব নিরন্তর চলতে থাকে। সুতরাং বাদকের সামান্যতম ভুলের জন্য যন্ত্রের কাঠামো পাল্টে যেতে পারে। কোন একটি বাদ্যযন্ত্রের কাঠামো যদি পাল্টে যায় তাহলে সেই যন্ত্র যে ঠিকভাবে কাজ করবে না সে বিষয়ে আমরা সবাই কম বেশি বুঝতে পারি।

বাকযন্ত্রের মাধ্যমে শব্দ তৈরীর ক্ষেত্রে তিনটি প্রক্রিয়া একই সাথে কাজ করে।
মানুষের বাকযন্ত্র এমন একটি যন্ত্র যার মাধ্যে তিনটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া একই সাথে কাজ করে। তিনটি প্রক্রিয়ার সমন্বিত ফলাফল আমরা শুনতে পাই।
১) ধ্বনি উৎপাদন প্রক্রিয়া ২) ধ্বনি সহযোগী প্রক্রিয়া এবং ৩) শব্দ তৈরি করন প্রক্রিয়া। বাকযন্ত্রের এই তিনটি পৃথক এবং স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া যখন সঠিকভাবে নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করে, অত্যন্ত সুষম এবং একইসাথে সচল হয় তখনই একটি সুন্দর শব্দ তৈরি হতে পারে। এই তিনটি প্রক্রিয়ার কোনোটিতে গন্ডগোল হলে পুরো প্রক্রিয়াটি নষ্ট হয়ে যায়। সুন্দর শব্দ তৈরি হয় না। আর সুন্দর শব্দ ছাড়া সুন্দর সংগীত সম্ভব নয়।

৫৮


ধ্বনি উৎপাদন প্রক্রিয়া

ধ্বনি উৎপাদন উপকরণে দুই ধরনের শারীরিক অংশ প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করে। কিছু স্থির অংশ আর কিছু অস্থির বা পরিবর্তনশীল অংশ। পরিবর্তনশীল অংশগুলির মধ্যে রয়েছে— ল্যারিংস, ভোকাল কর্ড, গলার কিছু পেশী, জীভের গোড়ার অংশ এবং নরম তালু। আর স্থির অংশগুলির মধ্যে রয়েছে— নাকের ফাঁপা অংশ, তিনটি ফ্যারিংস এলাকা এবং সাইনাস এলাকা। এই অংশগুলি প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয় ভূমিকার ফলে ধ্বনি বা আওয়াজ শোনার উপযোগী হয়ে থাকে।
ধ্বনি সহযোগী প্রক্রিয়া থেকে বাতাস প্রবাহ ভোকাল কর্ডের ভিতর দিয়ে পার হবার সময় ভোকাল কর্ডে কম্পনের সৃষ্টি করে। সেই কম্পনের ফলে সৃষ্ট আওয়াজ হলো মূল ধ্বনি। এই পর্যায়ে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভোকাল কর্ডের ভিতর দিয়ে বাতাস প্রবাহ প্রবাহিত করার পরও কিন্তু ধ্বনি তৈরি হবে এমনটি নিশ্চিত নয়। তার কারণ ধ্বনি তৈরীর জন্য ভোকাল কর্ডে একটি টানটান ভাব তৈরি করতে হয়। সেই টানটান ভাব ধ্বনি বা আওয়াজ তৈরিতে সাহায্য করে। সুতরাং বলা যেতে পারে যখন আওয়াজ তৈরি করার ইচ্ছা বা চেষ্টা করা হবে তখনই আওয়াজ সৃষ্টি হবে। অন্যথায় হবে না। এর মূল কারণ হলো আওয়াজ তৈরি করা ছাড়া শরীরের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিনিয়ত ফুসফুসে বাতাস ঢুকে এবং বের হয়। যেহেতু ফুসফুসে বাতাস ঢোকা ও বের হবার একমাত্র পথ হল ভোকাল কর্ড। কিন্তু আমরা যখন কোন শব্দ না করে চুপচাপ বসে থাকি তখনও ফুসফুস বাতাস নেয়া এবং বের করে দেয়ার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। তখন ভোকাল কর্ড দিয়ে বাতাস বের হবার সময় কোন আওয়াজ হয় না।

ভোকাল কর্ড থেকে সৃষ্ট ধ্বনি ভোকাল কর্ডের উপরের অংশ যেমন— তিনটি ফ্যারিংস এলাকা, নাকের ফাঁপা অংশ, সাইনাস এবং মুখের নরম তালু ইত্যাদি অংশে এসে আন্দোলিত হয়ে শ্রবণযোগ্য হয়ে ওঠে। এইভাবেই একটি ধ্বনি বা শব্দ তৈরি হয় এবং আমরা শুনতে পাই। ভোকাল কর্ডের নিচের এবং উপরের অংশকে সঠিক কাঠামোতে এনে ধ্বনি তৈরি করতে পারলে একটি সুন্দর প্রাণবন্ত আওয়াজ তৈরি করা সম্ভব।

মাতৃভাষা বাংলা ও এরাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি

-শক্তি মণ্ডল

শক্তি মণ্ডল

খবরে প্রকাশ,বাংলার গর্ব, শিবপুরের আই আই ই এস টি-তে ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, সোসাইটি অব মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার -এর উদ্যেগে সেনাদের উদ্দেশে হিন্দিতে একটি শ্লোগান লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা শ্রী পার্থসারথি চক্রবর্তী হিন্দিতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লিখেছিলেন এই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে হিন্দির প্রসার ঘটানো উচিত। তিনি হিন্দিতে সইও করেছিলেন। বর্তমান ও প্রাক্তন অনেক শিক্ষার্থী এর প্রতিবাদ করেন। সব ভাষায় এটি করার দাবি তোলেন। অধিকর্তা বলেন, “…কেন্দ্রীয় এই প্রতিষ্ঠানে হিন্দি প্রসারের কথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিধিতেই আছে।এরা(প্রতিবাদী পড়ুয়ারা) বাংলার বাইরে যায়নি।তাই এসব নিয়ে ছেলেমানুষি করে যাচ্ছে।”(আ.বা.প./১৪.০৯.২০) সাবাস! তাহলে সব ভাষার সম-অধিকরের দাবি ছেলেমানুষি ?আশ্চর্য এই যে,এখনও পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে একটিও রাজনৈতিক দল বা গণ-সংগঠনের বিবৃতি চোখে পড়েনি।স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েই বাংলার উন্নত চেতনায়, মননশীলতায় ও মুক্তচিন্তায়, শুধু বৃটিশ শাসকরা নয়, জমিদার-পুঁজিপতি শ্রেণিও দারুণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।তাই তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গভঙ্গে সামিল হয়েছিল।বাংলাতে যখন থেকে কংগ্রেস দলে সুভাষ- বিরোধী গোষ্ঠীর প্রাধান্য বেড়েছে, তখন থেকে এখানে অবাধে চলেছে দিল্লির আগ্রাসন। তবু জনগণের আবেগকে মর্যাদা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজ্যের সমস্ত সরকারি কাজে বাংলাভাষাকে ইংরেজির স্থলাভিষিক্ত করার ঘোষণা করা হয়েছিল।১৯৬১ সালে বিধানসভায় এই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে তা কার্যকর করা হয়নি।

মনে রাখতে হবে, এরাজ্যের উদীয়মান শক্তি বিজেপি কেবল একটি মামুলি রাজনৈতিক দল নয়।এই দলের এবং আর এস এস-পরিচালিত সংঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের অ্যাজেন্ডা হল, বাঙালি জাতিসত্তা, বাংলাভাষা ও বাংলার প্রগতিশীল সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা।যদি তা করা যায়, তবে ভবিষ্যতে আর কেউ রবীন্দ্র-নজরুল-শরৎ- সত্যজিৎ চর্চা করবে না।তখন সহজ হবে এখানে গো বলয়ের সংস্কৃতি কায়েম করতে।এরই একটি ধাপ হল,সর্বনাশা নাগরিক পঞ্জিকরণ।বিশ্বে বহু ভাষাভাষীদের সম-মর্যাদা দিয়ে সমন্বিত করার উজ্জ্বলতম উদাহরণ হল লেনিন-স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন।তারই প্রভাবে এদেশের সবকটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে দাবি করা হয়েছে,চাষি মজুরদের মাতৃভাষাকেই সরকারের, আদালতের ও শিক্ষার ভাষা করতে হবে।১৯৫৮ সালের ১৯ মার্চ বিধানসভায় কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ী বলেন,” যেভাবে অন্যান্য রাজ্যে সেই রাজ্যের ভাষাকে সরকারী স্তরে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, আমরা পশ্চিমবঙ্গে তা যদি না দেই, তাহলে ক্রমশ অন্যান্য ভাষা এসে আমাদের গ্রাস করতে পারে।।এই সংকটের মোকাবিলার জন্য যা যা করা দরকার আমাদের এখনি তার করতে হবে।” কিন্তু দূরদর্শিতা-পূর্ণ একথাকে তখন কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।আমাদের দেশে চাষিদের ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষদের সংগঠিত করার মহান ঐতিহ্য বামপন্থীদের আছে।বস্তুত প্রকৃত বামপন্থাই আর এস এস-এর শ্রেষ্ঠ বিকল্প। কিন্তু তার জন্য তো নিরন্তর এই পন্থার অনুশীলন করতে হবে!

এরাজ্যে বামপন্থী সরকারের আমলে রাজ্যের ৮৬% মানুষের ভাষা বাংলার ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যথার্থভাবেই বলা হয়েছিল,”শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ”। কিন্তু এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল।তার মূল কারণ-১.এই আন্দোলন ছিল সংকীর্ণ বুদ্ধিজীবী-কেন্দ্রিক।একে চাষি,মজুর, জনসাধারণের আন্দোলন হিসাবে গড়ে তোলা হয়নি।২.এটি ছিল দ্বিচারিতায় পূর্ণ।৩.মুনাফালোভী শিক্ষা ব্যবসায়ীরা এবং স্বার্থবাদী বিরোধী দলগুলির ক্রমাগত এর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালিয়েছিল।পরবর্তীকালে বিভ্রান্ত বামেদের ভাষানীতি যে কী,তা কেউ বলতে পারেন না।এখন অনেক বামপন্থী ‘বাঙালি জাতি’, বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ কথাগুলি শুনলে চমকে ওঠেন। যেন এসব আঞ্চলিকতাবাদীরা বলছেন! অথচ, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, গুরুসদয়, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান কতবার এবিষয়ে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।অনেক বামপন্থী মনে করেন,তারা ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী’। এসব তুচ্ছ বিষয়ে মাথা ঘামানো তাদের কাজ নয়! কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাকে একটু বদলে বলা যায়- ওরা বিশ্বমায়ের দুঃখে কাতর, নিজের দুঃখিনী মায়ের কান্না ওরা শুনতে পায় না। ওরা গর্জনবিলাসী। যখন থেকে নির্বাচন-সর্বস্বতা বামেদের গ্রাস করেছে, তখন থেকে সুদূরপ্রসারী আন্দোলনের জন্য আত্মত্যাগ থেকে ওরা ক্রমেই দূরে সরছে। নয়া শিক্ষানীতি সম্পর্কে বাম গণ-সংগঠনগুলির বিবৃতিতে ইংরেজির জন্য ব্যাকুলতা আছে। কিন্তু কোথাও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার দাবিতে একটি বাক্যও নেই।

তবে দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বামপন্থীদের মধ্যে ভাষার প্রশ্নে স্পষ্ট পার্থক্য আছে। ই ভি রামস্বামী পেরিয়ারের নেতৃত্বে ‘আত্মমর্যাদা’-র আন্দোলনের পর তামিলনাড়ুর বাম,ডান, সরকারি, বেসরকারি সব দল মাতৃভাষার পক্ষে এবং হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এককাট্টা। কেরলে স্কুল- স্তরে মালায়লাম বাধ্যতামূলক।মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন স্পষ্ট বলেছেন,”ত্রিভাষা-সূত্র আসলে হিন্দি চাপানোর ষড়যন্ত্র।তা কখন‌ই মানব না।” আর এরাজ্যে বামপন্থীরা সরকারি কাজে এবং বিদ্যালয়ে বাংলাকে এবং একই সঙ্গে যেখানে যেখানে প্রচলিত সেখানে সাঁওতালি,নেপালি প্রভৃতি ভাষাকে আবশ্যিক করার কথা উচ্চারণই করতে পারেন না। আমাদের রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল একটি জনমোহিনী দল। কোনও মৌলিক সমস্যার সমাধান এই দলের সাধ্যের বাইরে।এদের জন্যই ‌ রাজ্যে বি জি পি পায়ের তলার মাটি খুঁজে পাচ্ছে।২০১৭ সালের ১২ মে এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন,রাজ্যের সব সরকারি, বেসরকারি বিদ্যালয়ে একটি বিষয় হিসাবে বাংলা শেখানো আবশ্যিক করা হল। কিন্তু তারপরে এবিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়নি। বিধানসভাতেও এবিষয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়নি।

এই অবস্থায় কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পেয়েও মাতৃভাষা-প্রেমিক যেসব ব্যক্তি ও সামাজিক মঞ্চ দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাভাষার ও অন্যান্য মাতৃভাষার দাবি সোচ্চারে তুলে ধরছেন, তাদের অভিনন্দন জানাই।এই আন্দোলনের ‌অন্যতম দাবি,’বাংলাভাষাকে ধ্রুপদি ভাষার মর্যাদা’ দেবার দাবি এখন সাংসদ শ্রী অধীর চৌধুরীর মুখে, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখে শোনা যাচ্ছে।এদেরও অভিনন্দন।সব অগ্রণী চিন্তা ‌যে রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাথায় সবার আগে আসবে, এমন কোনও কথা নেই।যেমন নাগরিকপঞ্জি-বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন কিছু সমাজ সচেতন ব্যক্তি ও সংস্থা। তারপর যখন আন্দোলনের জমি তৈরি হল, তখন একে একে সব রাজনৈতিক দল পথে নামল। একইভাবে বাঙালি ও বাংলাভাষার দাবি ক্রমবর্ধমান হলে,জল মেপে দেখে,হয়তো একদিন এই রাজনৈতিক দলগুলি এগুলি নিয়ে পথে নামবে।গড়ে তুলবে বাংলাভাষার জন্য সেল, গণ-সংগঠন।।